শনিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২০

সোভিয়েতের পতন ~ কৌস্তভ কুন্ডু

১৯৯১, ২৫ শে ডিসেম্বর, ঠিক সন্ধ্যা ৭:৩২ মিনিটে ভেঙে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হয় কাস্তে হাতুড়ি পতাকা। ভেঙে পড়ে দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্নের সোভিয়েত ইউনিয়ন। 

কিন্তু কি কারণ থাকতে পারে, পৃথিবীর দ্বিতীয় সুপার পাওয়ার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ার! বহু জায়গায় বহু ব্যখ্যা পড়েছি কিন্তু যুক্তিসঙ্গত লাগেনি, তাই খোঁজার চেষ্টা করলাম নিজের মতো করে।

তবে কি মানুষ চায়নি? কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত নিয়ে যে রেফারেন্ডাম আনা হয় তাতে ৭৭.৮৫ % ভোট পড়ে সোভিয়েতের পক্ষে। তবে? 
অনেকে বলে অর্থনৈতিক ফেলিওর, যে দেশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৩ কোটি প্রাণ দেবার পর ১০ বছরে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হতে পারে, অন্য কোনও দেশ দখল না করে, উপনিবেশ ছাড়াই, তারা অর্থনৈতিক ফেলিওর বিশ্বাস করিনা আমি। ১৯৯০ - ৯১ তেও উৎপাদন স্ট্যাটিসটিক্স দেখুন, বা আমেরিকার মানুষের থেকে বেশী প্রোটিন ইনটেক দেখুন, তথ্য কিন্তু সে কথা বলে না।

তবে কি কারণ থাকতে পারে?
আসুন আগে দেখি কি ঘটেছিল সেসময়। মদ বিরোধী আন্দোলন করে কমিউনিস্ট পার্টির ভিতর বিখ্যাত হন এবং ১৯৮৫ সালে কম্যুনিস্ট পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন মিখাইল গর্বাচেভ। উনি এসে ইমপ্লিমেন্ট করেন পেরেস্ত্রইকা এবং গ্লাসনস্ত। অর্থাৎ খোলামেলা রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং খোলা বাজার। ১৯৯১ এ খোদ কমিউনিস্ট পার্টির জেনেরাল সেক্রেটারি মিখাইল গর্বাচেভ কম্যুনিস্ট পার্টির অফিসে তালা মারেন। সোভিয়েত ভেঙে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। আগস্ট মাসে যদিও কমিউনিস্ট পার্টির একাংশ চেষ্টা করে গর্বাচেভ কে উচ্ছেদ করার সশস্ত্র অভ্যুত্থান এর মধ্যে দিয়ে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসেন বরিস ইয়়েলিৎসিন, যে কিনা একসময় ৪ বিলিয়ন ডলার চেয়েছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছে, নির্বাচন জিততে। গর্বাচেভ জানায় রেফারেন্ডাম এ মানুষ নাকি ভয়ে ভোট দিয়েছিল, তাই জনাদেশের বিপক্ষে ভেঙে ফেলা হয়। এরপর ইয়়েলিৎসিন এর নেতৃত্বে এবং আমেরিকার অর্থদপ্তরের সহযোগিতায় ইমপ্লিমেন্ট হয় 'শক থেরাপি', একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে সমস্ত সামাজিক মালিকানা তুলে দেওয়া হল পুঁজিবাদের হাতে। শুধু সোভিয়েতের ক্ষেত মজুররা প্রতিরোধ করেছিল, তাই আজও রাশিয়ার ৭০% কৃষিজমি যৌথ খামার।

পেরেস্ত্রইকা, গ্লাসনস্ত, শক থেরাপি পরপর অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গুলোকে সাজান মাথায় রাখুন।
এবার আপনি যদি ব্যাক ক্যালকুলেশন করে কোনোদিন অঙ্ক মিলিয়ে থাকেন, একটা ব্যাক ক্যালকুলেশন করি চলুন।
প্রথম যে কথাটা মাথায় আসল, সেটা হল শক থেরাপির মধ্য দিয়ে যে হঠাৎ করে যে পুঁজিবাদে পরিণত হল সমাজতান্ত্রিক দেশ। কিকরে সম্ভব!! পুঁজিবাদের জন্য যেটা সবচেয়ে প্রয়োজন, যেটা ছাড়া চলে না, সেটা হল পুঁজিপতি। কিন্তু প্রশ্নটা আসে যে সমাজতান্ত্রিক দেশে যেখানে পুঁজিপতি শ্রেণীটাই অ্যবোলিশড সেখানে পুঁজিপতি এলো কোথা থেকে, পুঁজিই বা এলো কোত্থেকে? এখানেই খটকা লাগে আমার।

এবার শুরু করি ব্যাক ক্যালকুলেশন।
গুগলে যান সার্চ করুন রাশিয়ার বিলিওনিয়ার লিস্ট। এবার পরপর যা নাম আসবে তাদের বায়োগ্রাফি চেক করুন। একটা অদ্ভুত জিনিস দেখবেন, বিলিওনিয়ার লিস্টের ৭০% সোভিয়েত আমলের আমলা অথবা কমিউনিস্ট পার্টির উঁচু লিডার। লজ্জার ব্যাপার।
যেমন ধরুন - রাশিয়ার ৫ম ধনী ব্যক্তি ভাগিট আলেকপেরভ, উনি সোভিয়েত আমলে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন, এরপরে উনি সোভিয়েতের গ্যাস এবং পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের মন্ত্রী নিযুক্ত হন।
বা, গেনাডি টিমোশেঙ্কো, উনি সোভিয়েতে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানির ডেপুটি ডিরেক্টর ছিলেন। অর্ডার অব ফাদারল্যান্ড পেয়েছিলেন। 
বা, সুলেমান কেরিমোভ ডেপুটি ডিরেক্টর ছিলেন আলতাব সংস্থার।
মোট ৪৬ জন বিলিওনিয়ার এর লিস্ট খুঁজে দেখুন ৭০% সোভিয়েত আমলের আমলা অথবা কমিউনিস্ট পার্টির উঁচু লিডার।
এদের হাতেই তুলে দেয় বরিস ইয়েলিৎসিন পুঁজিবাদের ভার, পুঁজি হিসেবে আসে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের অর্থ সাহায্য।

সমস্যাটা শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ পেরেস্ত্রইকা, গ্লাসনস্ত আমল থেকে। মিখাইল গর্বাচেভ খোলামেলা ব্যবস্থার নামে কিছু কিছু সংস্থাকে পুঁজি এবং আমলাদের পুঁজিপতি হওয়ার সুযোগ দেন। তখনই রক্তের স্বাদ পেয়ে যায় তারা। তারা বোঝে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পুঁজিবাদ এলে তারা কোটিপতিতে পরিণত হতে চলেছে। তাই তাদের সমর্থন ছিল মিখাইল গর্বাচেভ এবং বরিস ইয়েলিৎসিন দের ওপর। এরাই কমিউনিস্ট পার্টির বড় বড় কমিটিতে মেজরিটি ছিল। ফলে ষড়যন্ত্র হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ফেলার, আমেরিকার ফান্ড সাহায্য নিয়ে। মিখাইল গর্বাচেভ এবং বরিস ইয়েলিৎসিন এর নাটক, তারা একদিকে দেখাত শত্রু এদিকে অ্যালাই। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙা হয় রেফারেন্ডামে মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। আভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা, আমলারাই ভাঙে সোভিয়েত, তাদের চোখে বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন। সোভিয়েত মানুষ ভাঙেনি, ৭৭.৮৫% মানুষের হৃদয়ে ছিল তাদের শ্রমিকরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন। এখনও রাশিয়ার ৭০% কৃষিজমি যৌথ খামার, তাদের হৃদয়ে সোভিয়েত বেঁচে আছে।

কিন্তু প্রশ্নটা আসে এই যে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কতন্ত্রের যে সোভিয়েত মডেলকে আমরা মডেল হিসেবে দেখি, এখানে আদর্শবিচ্যুত দূর্নীতিগ্রস্ত লোকেরা মেজরিটি পেলে কি হতে পারে? ধরুন যেমন উত্তর কোরিয়া, ৬০ এর দশকেই অফিসিয়ালি ঘোষিত ভাবে তারা কম্যুনিস্ট আদর্শ ত্যাগ করে, যুচে নামক একটি জগা খিচুড়ি প্রতিষ্ঠা করে, তার ফলস্বরূপ উত্তর কোরিয়া আজ পুঁজিবাদহীন কিন্তু একটি পরিবারতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে পরিণত হয়েছে।  শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কতন্ত্রকে আরও স্বতঃস্ফূর্ত, স্টেবল, এবং মাস পার্টিসিপেশন ওয়ালা ব্যবস্থায় পরিণত করতে হবে। মাস পার্টিসিপেশন বলতে লাতিন আমেরিকা খুব ভালো কাজ করছে, তারা পপুলার কমিউনিস্ট পার্টি তৈরী করছে। অন্যদিকে চীন, সেখানে পুঁজিপতি আছে, পুঁজিবাদ আছে, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির কন্ট্রোল রয়েছে সেসবের ওপর, দেখতে হবে চীনের ভবিষ্যৎ।

মোট কথা মার্ক্সবাদীরা ভুল কে এড়িয়ে যায় না, সেটা স্বীকার করে এবং সমাধান করার চেষ্টা করে, ব্লেমগেম খেলে না। আরও ভাবতে হবে আমাদের। তাই ভাববাদী না তথ্যনির্ভর কারণ খোঁজার চেষ্টা করলাম, বিরোধিতা থাকলে জানান। 
আর আমরা যারা বামপন্থী, যারা একটা বয়সের পর উঠতে বসতে একটাই স্বপ্ন দেখেছি, তাদের একটা সেভিয়েত পতনে স্বপ্নভঙ্গ হবে না। গর্বাচেভ, বরিস ইয়েলিৎসিনরা কমিউনিস্ট আদর্শকে ভেঙে ফেলতে পারবে না। ক্রেমলিনে আবার কাস্তে হাতুড়িই উড়বে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন