সোমবার, ৩০ মার্চ, ২০২০

কারোনা ভাইরাস প্রতিরোধ ~ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য

কারোনা ভাইরাস প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সং স্থার প্রধান নির্দেশ হল, টেস্ট টেস্ট টেস্ট, মানে অসুস্থ বা আপাত সুস্থ মানুষ এই ভাইরাস আক্রান্ত কিনা তা টেস্ট মানে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া আর সাথে সাথে তাকে কোয়ারেন্টাইন কর আর চিকিৎসা কর। এই পরীক্ষা কিভাবে করতে হবে সে সম্পর্কেও তারা জানিয়ে দিয়েছেন। এবার টেস্ট করতে কিছু সরঞ্জাম লাগবে যাকে আমরা কিট বলছি, তবে এ কিট প্রেগ্নেন্সি কিটের মত সহজ সরল নয়, মানে এক ড্রপ ইউরিন ফেলে রঙ পাল্টে গেলেই পজিটিভ। এ কিট ব্যাবহার করতে একটা যন্ত্রও লাগে আর সম্পূর্ণ টেস্ট করতে কিছু দক্ষতা লাগে যা শিখতে হয়।

প্রধানমন্ত্রীর একটি সাইন্টিফিক এডভাইসরি বোর্ড আছে সে এখন আমরা জেনে গেছি( যার প্রধান বিজয় রাঘবন) যারা করোনা প্রতিরোধে কি কি করা উচিৎ সে টেস্ট বল, চিকিৎসা বল বা লকডাউন বল সাজেস্ট করেন আর সেই অনুসারে তা কার্যকর করা হয়। এই যে টেস্ট ব্যাপারটা কত বেশি কত দ্রুত করা যায় তার একটা ব্লু প্রিন্ট তারা বানিয়েছেন। দেশের প্রায় ১০০ টি গবেষণা কেন্দ্রকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এই পরীক্ষা পদ্ধতি বিভিন্ন হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক কেন্দ্রকে হাতে কলমে শেখাতে যাতে তারা কিছুদিনের মধ্যে স্বয়ংসম্পুর্ন হয়ে ওঠে।

এবার দেখা যাক এ পরীক্ষা পদ্ধতি কেমন, স্যাম্পল বা নমুনা হিসেবে নেওয়া হয় সন্দেহভাজন ব্যক্তির লালারস।সেই লালারসে থাকে ভাইরাস, মানুষের অন্য কোষ (cell) এর সাথে।এই কোরোনা ভাইরাস  RNA গোত্রের( জিনোম), মানে সেই নাইন টেনে পড়া ডিএনএ আরএনএ, বেশ মেয়েদের চুলের বিনুনির মত দেখতে। এই লালারসকে প্রথমে নিষ্ক্রিয় করা হয় কিছু রাসায়নিক দিয়ে, যাতে ভাইরাস গুলো মরে যায়, তারপর এই নিষ্ক্রিয় নমুনা থেকে আরএনএ আলাদা করা হয়। মুশকিল হল আরএনএ তো আরএনএ ই, মানে এই যে আলাদা করা হল এতে মানুষের আর ভাইরাস দু রকমের আরএনএ-ই থাকে।এবার এই আলাদা করা আরএনএ কে প্রথমে complementary DNA (cDNA) তে পরিনত করে নেওয়া হয়, আর এ কাজে যে এনজাইম লাগে তার নাম রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ এনজাইম( reverse transcriptase enzyme) সাথে লাগে প্রাইমার আর সেই নাইনে পড়া এডিনিন, গুয়ানিন, থাইমিন আর সাইটসিন deoxyribonucleotide triphosphates(dNTP)। 
বোঝা গেল এতদূর, জলের মত। হ্যাঁ একটা কথা ভাইরাসের যে আরএনএ তারা উচ্চঘর, কংসরাজের বংশধর, তাতে সেই A T G C, দিয়ে যেন ছন্দ কবিতা লেখা থাকে। এবার ওই যে প্রাইমার যোগ করা হয়েছিল, সে আরএনএ এর ওপর বেশ আয়েস করে বসতে পারে, সেই আইসক্রিমের ওপর চেরি যেমন, তবে সে ভাইরাস আরএনএ এর ওপর বসবে না মানুষের আরএনএ এর ওপর বসবে তা নির্ভর করে তার ক্রমের(sequence) ওপর( মানে ধরা যাক সেই ছন্দ), মানে তা ভাইরাসের আরএনএ ছন্দর সাথে ভাল যাবে না মানুষের আরএনএ এর ছন্দের সাথে। আর যদি ভাইরাস আরএনএ এর ওপর বসে যায়( মানে সেই খাপে খাপ মন্টুর বাপ), সেই যে রিভার্স ট্রান্সকিপ্টেজ এনজাইম বলেছিলাম না, তা dNTP       
গুলোকে জুড়ে জুড়ে ভাইরাস আরএনএ এর ক্রমানুসারে( মানে as per sequence) cDNA বানাতে থাকবে, (মানে করোনা ভাইরাস আরএনএ না থাকলে এই cDNA ও তৈরি হতে থাকবে না)। এক বার cDNA তৈরি হয়ে গেলে , আর একটা শক্তপোক্ত robust ( আগের এনজাইমের তুলনায় শক্তিশালী ) TAQ পলিমারেজ নামে এনজাইম টাকে  আরও বেশ কয়েক বার কপি করে দেয়। এই এমপ্লিফায়েড কপিগুলো ডাই এর সাথে জুড়ে বিশেষ রঙ মানে কালার ইন্ডিকেশন দেয় যাতে বোঝা যায় সেই লালারসে কারোনা ভাইরাস ছিল কিনা! এই কপি বানানো যাকে বলছি এমপ্লিফিকেশন, যে মেশিনে করা হয় তা হল, RT-PCR (Real Time Polymerase Chain Reaction) machine. মোদ্দা কথা অনেকটা সেই ছেলেবেলার জলছবির মত, কাগজের ওপর জলছবি রেখে পয়সা দিয়ে জলছবি ঘষলে আস্তে আস্তে সেই ছবির অবয়ব কাগজের ওপর স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে থাকে। এখানেই অনেকটা তাই, যদি লালারসে সেই ভাইরাস থাকে সেটা ওই দুই এনজাইমের উপস্তিতিতে জানান দেয় সে আছে, মানে পজিটিভ।
এই সমস্ত উপাদান , প্রাইমার আর উপযুক্ত বিক্রিয়া মাধ্যম- এই সব মিলিয়ে বলা হয় কিট। 

এই যন্ত্র আগে তো তেমন দরকার ছিল না মূলত কিছু গবেষণাগারে আর বড় মেডিক্যাল কলেজে থাকত, প্রধানত বিদেশী, এখন দেশেও তৈরি হচ্ছে। ছোট আর বড় দু ধরনের যন্ত্রে যথাক্রমে ৯৬ আর ৩৮৪ খানা নমুনা এক এক বারে পরীক্ষা করা যায়। এই পরীক্ষা এক একটা সাইকেল চার ঘণ্টা লাগে, মানে দিনে কমবেশি চারবার চালাতে পারলে ১৫০০ নমুনা পরীক্ষা করা যায়। আর কিট এখন অনেক সংস্থা বানাচ্ছে এ দেশেই।

মানে ১০০ টা যন্ত্রে দিনে প্রায় দেড় লক্ষ নমুনা পরীক্ষা করতে পারবে। সেই অনুসারে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে (ICMR এ অনুমতি দিচ্ছে), তারা তৈরি হচ্ছে অনেকে শুরুও করে দিয়েছে।ন্যাশনাল ইন্সটিটুট অফ ভাইরলজি ( NIV pune) আর  NCDC Delhi প্রথমে নতুন তৈরি করা কিট গুলো পরীক্ষা করে দেখে, পাস করলে ছাড়পত্র দেয় আর সেই সংস্থা কিটের বানিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে।  

আমি গরিব আদমি আছি, এসব বিজ্ঞান টিজ্ঞান বড় ভয়, বুঝিও না, আমি ওপর ওপর( ভেতরে ঢুকলে কিছুই বুঝব না সেজন্য)  কিছু বুঝি উচ্চশিক্কিত বন্ধুদের জ্ঞানের বিচ্ছুরণ থেকে! আমাদের অনুজ সৌভিক আর দেবজ্যোতি, দিল্লীর এমন একটা গবেষণাগারের দলবলের সদস্য। সেই দল এই ট্রেনিং তত্বাবধান করছে গত ১৫ দিন ধরে, সে অনেক দৌড়াদৌড়ি, মাঠে নেমে কাজ, ভলেন্টিয়ার  তৈরি করা, হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ রাখা, ল্যাবরেটরির তত্ত্বাবধান করা, ওদিকে ওপর মহলের  অফিসে আপডেট দেওয়া, মাল মসলার ( মানে ইনগ্র্যাডিয়েন্ট, কিটের) অর্ডার দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।

এনিওয়ে জাস্ট জানিয়ে রাখলাম আর কি, চলুন আমরা ফেসবুক, টুইটার কি হোয়াতে জুজু জুজু খেলি, সংখ্যা নিয়ে খেলি( বাজারে এত আই এস আই ফেরত বি স্টাট, এম স্টাট ঘুরঘুর করছে, ফটাস করে লাল নীল উঁচু নিচু সব গ্রাফ এক তুড়িতে এক্স আর ওয়াই অক্ষ বরাবর প্লট করে বলে দিচ্ছে আগামী পরশু কেরলে কজনের টেস্ট পজিটিভ হবে!!!  ),তর্ক করি ( মানে ফেসবুক ফ্রম হোম)।

সবাই সাবধানে থাকুক,যারা মাঠে নেমে কাজ করছেন স্যালুট তাদের আর যথাসম্ভব সাবধানে কাজ করুন। উই শ্যাল ওভারকাম।

শনিবার, ২৮ মার্চ, ২০২০

দ্য ওয়ার্ল্ড আফটার করোনা ভাইরাস ~ ইউভ্যাল নোহা হারারি

বিশ্বব্যাপী সঙ্কটের মুখোমুখি মানবসমাজ। সম্ভবত আমাদের প্রজন্মের সবচেয়ে বড় সঙ্কট। সামনের কয়েকটা সপ্তাহে সাধারণ মানুষ আর সরকারগুলো যা যা সিদ্ধান্ত নেবে, তা সম্ভবত আগামী বেশ কয়েকটা বছর ধরে সারা পৃথিবীকে প্রভাবিত করবে। শুধু স্বাস্থ্য-পরিসেবা নয়, গভীর ভাবে প্রভাবিত হবে আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতি, এমনকি সংস্কৃতিও। যা করার, তা দ্রুত করতে হবে। ডিসিসিভলি করতে হবে। আজকে আমরা যা করবো, আগামীদিনে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব থেকে যাবে। শুধু অল্টারনেটিভ বেছে নেওয়া নয়, নিজেকে প্রশ্ন করুন, এই ঝড়-ঝাপটা কেটে গেলে ঠিক কি রকম পৃথিবীকে আপনি দেখতে চান। হ্যাঁ, যে ঝড়টা এসেছে সেটা কেটে যাবে, মানবসমাজ উঠে দাঁড়াবে, এমনকি আমি-আপনি সহ আমাদের মধ্যে বেশীরভাগ মানুষ বেঁচে-বর্তেও থাকবে ... তবে সেটা এক নতুন পৃথিবীতে!  
   
আজকে যেগুলো আপনি 'শর্ট-টার্ম এমারজেন্সি পদক্ষেপ' হিসাবে দেখছেন, তার অনেকগুলোই কিন্তু ভবিষ্যতে থেকে যাবে। 'এমারজেন্সি'-র মজাই তাই। এই পদক্ষেপগুলো ইতিহাসের চাকাকে ঝপ্‌ করে অনেকটা এগিয়ে দেয়। নর্মাল সময়ে যে ডিসিশন-গুলো নিতে বছরের পর বছর লেগে যায়, সমাজ জুড়ে তর্ক-বিতর্ক চলে, এমারজেন্সি-সিচুয়েশনে সেই ডিসিশন-গুলো নিয়ে ফেলাটা জাস্ট কয়েক ঘন্টার মামলা। ইম্‌ম্যাচিওর, এমনকি ভয়ঙ্কর কিছু টেকনোলজিকেও এই সময় আমরা ছাড়পত্র দিয়ে ফেলি, কারন হাত-পা গুটিয়ে কিছু না করে বসে থাকার বিপদ তার চেয়েও বেশী। তখনকার মতো আস্ত একটা দেশ হয়ে ওঠে লার্জ স্কেল সোশ্যাল এক্সপেরিমেন্টের গিনিপিগ মাত্র। কেমন হবে, সমস্ত ক্ষেত্রে যদি 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' চালু হয়? কিংবা ধরুন দূর থেকে কম্যুনিকেট করাটাই যদি নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়? কেমন হবে, যদি সমস্ত স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিগুলোকে অনলাইন করে দেওয়া হয়? নর্মাল সময়ে সরকার, এডুকেশনাল বোর্ড অথবা ব্যবসায়ীরা এ'সব কথা ভুলেও ভাববে না। কিন্তু এটা নর্মাল সময় নয়। এই সঙ্কট-মুহূর্তে দুটো ক্ষেত্রে আমাদের অপশন বেছে না নিয়ে উপায় নেই। প্রথমটা হলো 'সর্বগ্রাসী নজরদারি' এবং 'নাগরিক ক্ষমতায়নের' মধ্যে। দ্বিতীয়টা হলো 'জাতীয়তাবাদী বিচ্ছিন্নতা' ও 'বিশ্বব্যাপী সংহতির' মধ্যে। 
    
*চামড়ার নীচে নজরদারি*  
আজকের মহামারী রুখতে গেলে, সবাইকেই নির্দিষ্ট একটা গাইডলাইন বাধ্যতামূলক ভাবে মেনে চলতে হবে। দু'ভাবে এটা করা যায়। তার মধ্যে একটা হলো, সরকার সর্বত্র নজরদারি করুক এবং নিয়ম ভাঙলেই কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করুক। মানব-ইতিহাসে এই প্রথম টেকনোলজিকে কাজে লাগিয়ে সেটা সম্ভবও বটে। মাত্র ৫০ বছর আগেও কে.জি.বি-র পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের ২৪০ মিলিয়ন নাগরিকের ওপর ২৪ ঘন্টা ধরে নজরদারি চালানো সম্ভব ছিলো না। সমস্ত নাগরিকদের সম্পর্কে গাদা গাদা ইনফর্মেশন জোগাড় করে সেই বিপুল তথ্যকে প্রসেস করাটা তো ছিলো কল্পনারও অতীত। এই কাজগুলো করার জন্য কে.জি.বি-কে তখন কিছু চর তথা অ্যানালিস্টের ওপরেই ডিপেন্ড করতে হয়েছিল। আর এটাও ঠিক, যে দেশের সবগুলো মানুষের পেছনে একটা করে চর লাগানোটা জাস্ট অসম্ভব ছিলো। কিন্তু আজকের দিনের সরকারগুলো ঠিক এই কাজটাই নিঃশব্দে করে ফেলতে পারে সর্বব্যাপী সেন্সর আর শক্তিশালী অ্যালগোরিদমকে কাজে লাগিয়ে। নাঃ, একটাও রক্ত-মাংসের মানুষ লাগবে না!  

করোনা-ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু দেশের সরকার এই রাস্তায় হাঁটছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো চীন। সাধারণ মানুষের স্মার্টফোনে নিবিড় নজরদারি চালিয়ে, কোটি কোটি ফেস-রেকগনাইজিং ক্যামেরাকে কাজে লাগিয়ে, এবং মানুষকে তাদের শরীরের তাপমাত্রা থেকে শুরু করে অন্যান্য মেডিকেল-রিপোর্ট দিতে বাধ্য করে সরকার অত্যন্ত দ্রুত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত লোকজনকে চিহ্নিত করতে পেরেছে। তাদের গতিবিধিকে ট্র্যাক করতে পেরেছে। কারা কারা তাদের সংস্পর্শে আসছে, সেটাও ঝপ্‌ করে আইডেন্টিফাই করে ফেলতে পেরেছে। মোবাইল অ্যাপেই নাগরিকদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে একজন করোনা-ইনফেক্টেড মানুষের থেকে তিনি কতোটা দূরত্বে আছেন।

এই ধরনের টেকনোলজির ব্যবহার আজ কেবল পুর্ব-এশিয়াতেই সীমাবদ্ধ নেই। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি করোনা-আক্রান্তদের চিহ্নিত করতে সে'দেশের সিকিউরিটি এজেন্সিকে এমন একটি নজরদারি-প্রযুক্তি ব্যবহার করার অনুমোদন দিয়েছেন, যা সাধারনত টেররিস্টদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। কিছু পার্লামেন্ট সদস্য এই নিয়ে আপত্তি জানালে তিনি পত্রপাঠ 'এমারজেন্সি-ডিক্রি' জারি করে ব্যাপারটি চালু করে দেন। 

আপনি বলতেই পারেন, এ আর এমন নতুন কথা কি? আজকালকার দিনে সরকার এবং কর্পোরেট সংস্থাগুলি এর চেয়েও শক্তিশালী প্রযুক্তি ব্যাবহার করছে মানুষকে ট্র্যাক করার জন্যে, নজরে রাখার জন্যে, ম্যানিপুলেট করার জন্যে। কিন্তু তবুও বলবো, আমরা যদি সতর্ক না হই, তাহলে অচিরেই এই মহামারীটি 'মানুষের ওপর নজরদারি চালানোর' ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড় হয়ে উঠবে। কারন, দু'দিন আগেও যাঁরা রাষ্ট্রের এই নজরদারি-ব্যবস্থাটির সোচ্চার বিরোধিতা করতেন, অ্যাবনর্মাল সিচুয়েশনে পড়ে তাঁরাও আজ নিজের থেকেই ব্যাপারটি নিপাট ভালো মানুষের মতো মেনে নিয়েছেন। তার চেয়েও বড় কথা হলো, সমগ্র নজরদারি-ব্যবস্থাটি 'চামড়ার ওপর' থেকে তার দৃষ্টিকে গেঁথে দিচ্ছে আরও গভীরে, 'চামড়ার ভেতরে'! এর আগে পর্যন্ত, আপনার আঙুলটি একটি মোবাইল ফোনের স্ক্রিন টাচ্‌ করলে অথবা কোনও লিঙ্কে ক্লিক করলে সরকার বড়জোর জানতে পারতো যে আপনি কোন্‌ লিঙ্কে ক্লিক করেছেন। এখন সরকার আপনার আঙুলের তাপমাত্রা এবং চামড়ার নীচের ব্লাড-প্রেশারও জানতে পারবে। ড্রামাটিক চেঞ্জই বটে!  

*এমারজেন্সি পুডিং*
মুশকিল হলো, আজকের নজরদারি-ব্যবস্থায় আমরা কেউই জানি না যে ঠিক কিভাবে আমাদের জরীপ করা হচ্ছে, অথবা আগামী দিনেই বা ঠিক কি কি ঘটতে চলেছে। নজরদারি-প্রযুক্তি সাংঘাতিক দ্রুতবেগে ডেভালপ করছে। ১০ বছর আগেও যেগুলো কল্পবিজ্ঞানের গপ্প মনে হতো, আজ সেগুলো নিছকই প্রস্তর-যুগের প্রযুক্তি বলে মনে হয়। কল্পনার খাতিরে, মনে করুন সরকার বললো যে প্রত্যেক নাগরিককে একটা করে 'বায়োমেট্রিক-ব্রেসলেট' পরতে হবে, যা ২৪ ঘন্টা ধরে আপনার ব্লাড-প্রেসার এবং শরীরের তাপমাত্রা মাপবে। সেই তথ্যগুলো তারপর অ্যালগোরিদমে ফেলে সরকার খতিয়ে দেখবে। আপনি অসুস্থ কিনা, সেটা আপনি নিজে টের পাওয়ার আগেই অ্যালগোরিদমগুলি ব্যাপারটা বুঝে ফেলবে। আপনি কোথায় কোথায় ছিলেন, কার কার সাথে দ্যাখা করেছেন, সেটাও সরকার পরিষ্কার বুঝতে পারবে। ইনফেকশনের চেন-কে এই পদ্ধতিতে ছোট করে আনা, এমনকি একেবারে কেটে ফেলাও সম্ভব। এই ধরনের একটা সিস্টেম মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই করোনার মতো মহামারী রুখে দিতে পারে। ফাটাফাটি ব্যাপার, তাই না? 

কিন্তু সমস্যাটা হলো, এটাই আবার একটা ভয়াবহ নজরদারি-ব্যবস্থাকেও সমাজে বৈধতা দেবে। এদ্দিন পর্যন্ত আমি মোবাইলে 'ফক্স নিউজের' একটি ভিডিও লিঙ্কে ক্লিক করেছি, নাকি 'সি.এন.এন'-এর, তা থেকে আপনি বড়জোর আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বুঝতে পারতেন, কিংবা খুব বেশী হলে আমার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে। কিন্তু এবার আপনি তার সাথে সাথে আমার হার্ট-রেট, ব্লাড-প্রেসার অথবা বডি-টেম্পারেচার দেখে এটাও বুঝতে পারবেন যে ওই ভিডিওটি দেখে আমি হাসলাম, কাঁদলাম, নাকি প্রচন্ড রেগে গেলাম!    

মাথায় রাখতে ভুলবেন না, রাগ – আনন্দ – একঘেঁয়েমি – ভালোবাসা হলো জ্বর অথবা কাশির মতোই জৈবিক ক্রিয়াকলাপ। কাশি-শনাক্তকারী একই প্রযুক্তি হাসিকেও চিহ্নিত করতে পারে। কর্পোরেট সংস্থা অথবা সরকারগুলি যদি পাইকারি রেটে আমাদের এই বায়োমেট্রিক-ডেটা অ্যানালাইসিস করে, তাহলে আমাদের নিজেদের চেয়েও ভালোভাবে ওরা আমাদের বুঝতে পারবে। ওরা কেবল আমাদের অনুভুতিগুলির পূর্বাভাসই পাবে না, চাই কি সেগুলোকে ম্যানিপুলেটও করতে পারবে। এবং সর্বোপরি সেই পদ্ধতিতে ওরা আমাদের কাছে যা ইচ্ছে তাই বেচে দিতে পারে, সেটা একটা পণ্যই হোক, অথবা একটা বিশেষ রাজনীতি। বায়োমেট্রিক নজরদারির কাছে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার ডেটা-হ্যাকিং কৌশলও জাস্ট শিশু। ২০৩০ সালের উত্তর কোরিয়ার একটি সিচুয়েশন কল্পনা করুন। আপনার কব্জিতে বায়োমেট্রিক-ব্রেসলেট লাগানো রয়েছে। আপনি রাষ্ট্র-নায়কের ভাষণ শুনতে শুনতে ভীষণ রেগে উঠছেন। ওমনি বায়োমেট্রিক-ব্রেসলেট সেটা ধরে ফেললো। আপ্‌ তো গ্যায়া!  

এমারজেন্সি পরিস্থিতিতে একটি 'অস্থায়ী ব্যবস্থা' হিসাবে বায়োমেট্রিক-নজরদারিকে আপনি অবশ্যই অ্যালাউ করতে পারেন। কিন্তু এই 'অস্থায়ী ব্যবস্থা'গুলির একটা খারাপ স্বভাব হলো এমারজেন্সি কেটে গেলেও এরা বহাল তবিয়তে থেকে যেতে চায়। কারন, দেশে নিত্য-নতুন এমারজেন্সি পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার তো আর বিরাম নেই! আমার স্বদেশ ইজরায়েলে ১৯৪৮ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই রকম জরুরী অবস্থা জারি হয়েছিলো। তাতে প্রেস-সেন্সরশিপ থেকে শুরু করে জমি বাজেয়াপ্তকরন হয়ে পুডিং তৈরির পদ্ধতির ওপরেও (আমি একদম ইয়ার্কি মারছি না) কিছু 'অস্থায়ী বিধি-নিষেধ' আরোপিত হয়েছিলো। বহুদিন হয়ে গেলো স্বাধীনতা যুদ্ধে ইজরায়েল জিতেছে। তারপর থেকে আর কখনও জরুরী অবস্থা জারিও করেনি। কিন্তু ১৯৪৮ সালে জারি হওয়া সেই 'অস্থায়ী বিধি-নিষেধ'গুলোর মধ্যে বেশ কিছু পরবর্তীতে দিব্যি স্থায়ী ভাবেই রয়ে যায় (মাত্র এই সেদিন, ২০১১ সালে, সেদিনের সেই জরুরী 'পুডিং-ডিক্রি'টি সরকার দয়া করে বাতিল করলো)!   

করোনা ভাইরাসের প্রকোপ থেমে গেলেও বেশ কিছু দেশের তথ্য-লোভী সরকার বায়োমেট্রিক নজরদারি চালিয়েই যেতে চাইবে। তখন তাদের অজুহাত হবে, করোনা-সংক্রমণের সেকেন্ড ওয়েভ আসতে চলেছে ... অথবা মধ্য আফ্রিকায় একটি নতুন ইবোলা ভাইরাস ধরা পড়েছে ... অথবা অন্য কিছু। ব্যাপারটা নিজেই বুঝে নিন। আমাদের প্রাইভেসি বজায় রাখতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটা বড় লড়াই চারদিকে শুরু হয়েছে। করোনা-সঙ্কট সেই লড়াইয়ে একটা টিপিং-পয়েন্ট হয়ে উঠতে পারে। 'প্রাইভেসি' আর 'হেলথ'-এর মধ্যে মানুষকে কোনও একটা বেছে নিতে বললে স্বাভাবিক ভাবে সে 'হেলথ'-কেই বেছে নেবে। 

*সাবান পুলিশ* 
কিন্তু মানুষকে 'প্রাইভেসি' আর 'হেলথ'-এর মধ্যে কোনও একটাকে বেছে নিতে বলাটাই বিরাট গোলমেলে ব্যাপার। এটা কি 'বেছে নেওয়ার' মতো কোনও বিষয় নাকি? 'প্রাইভেসি' আর 'হেলথ', এই দুটোই তো আমার চয়েস। এই দুটো জিনিসের ওপরেই তো আমার অধিকার থাকা উচিৎ। আমাদের স্বাস্থ্যকে সুরক্ষিত রাখতে এবং করোনা-সংক্রমণকে আটকাতে আমরা 'সর্বব্যাপী নজরদারি ব্যবস্থা'র বদলে 'নাগরিক ক্ষমতায়ন'কেও বেছে নিতে পারি। দক্ষিন কোরিয়া, সিঙ্গাপুর এবং তাইওয়ান এই পদ্ধতিতে করোনা-সংক্রমণ রুখতে দুর্দান্ত সাফল্য পেয়েছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে কিছু কিছু 'নজরদারি ব্যবস্থা' ওরাও নিয়েছিলো। কিন্তু মূলত ওরা নির্ভর করেছিলো ব্যাপক টেস্টিং-এর ওপর, ওয়েল-ইনফর্মড নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত রিপোর্টিং এবং সহযোগিতার ওপর। 

কেন্দ্রীয় নজরদারি এবং কঠোর শাস্তির সাহায্যেই কেবল মানুষকে দিয়ে কার্যকারী-গাইডলাইন মানিয়ে চলানো যায়, এটা ভুল ধারনা। সরকার যদি নিষ্ঠার সাথে মানুষের কাছে বৈজ্ঞানিক ভাবে বিষয়গুলো তুলে ধরে, মানুষের কাছে সরকারের যদি বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়, তাহলে ঘাড়ের ওপর সর্বক্ষণ কোনও 'বিগ ব্রাদার' নিঃশ্বাস না ফেললেও মানুষ গাইড-লাইন মেনে চলে। নিজের থেকেই। সাধারণ ভাবে বলতে গেলে একটি স্বতঃপ্রানিত এবং সচেতন জনগোষ্ঠী, পুলিশের ডান্ডার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা অজ্ঞ একটি জনগোষ্ঠীর তুলনায় অনেক বেশী কার্যকরী।   

'সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার' বিষয়টাকেই দেখুন। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে এটা একটা যুগান্তকারী ব্যাপার ছিলো। ছোট্ট এই পদক্ষেপটা আজও লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে চলেছে। অথচ সেভাবে দেখলে মাত্র এই সেদিন, ১৯শতকে বিজ্ঞানীরা বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। তার আগে এমনকি ডাক্তার-নার্সরাও হাত-টাত না ধুয়েই একটার পর একটা অপরেশন করতেন। আজকে যে কোটি-কোটি মানুষ নিজের থেকেই রোজ সাবান দিয়ে হাত ধোয়, তার পিছনে কি কোনও 'সাবান-পুলিশের' চোখরাঙানি আছে? একদম নয়। বরং তারা সহজ-সরল একটা বৈজ্ঞানিক সত্যকে বুঝতে পেরেছে। আমি সাবান দিয়ে হাত ধুই, কারন আমি জানি যে ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাসের মতো ক্ষতিকর জীবানুগুলো সাবান দিয়ে হাত ধুলে নষ্ট হয়ে যায়। সিম্পল। 

তবে গণ-সম্মতি এবং সহযোগিতার এ'রকম একটি স্তরে পৌঁছতে গেলে একটা বিষয় লাগবেই, সেটা হলো 'বিশ্বাস'। মানুষকে বিজ্ঞানের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে, সরকারি কর্তৃপক্ষের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে, মিডিয়ার ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। বিগত কয়েকটা বছর ধরে দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতিবিদরা ইচ্ছাকৃতভাবে বিজ্ঞানের বিশ্বাসযোগ্যতাকে, সরকারি কর্তৃপক্ষের বিশ্বাসযোগ্যতাকে এবং মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাকে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন। এখন সেই দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকগুলোই আরও কর্তৃত্ববাদের রাস্তায় দেশকে নিয়ে যেতে পারে এই যুক্তিতে, যে, 'সঠিক রাস্তায় চলতে গেলে আম-পাবলিকের কথা শুনলে চলে না'!  

সাধারণভাবে, বছরের পর বছর ধরে একটু একটু করে নষ্ট হয়ে যাওয়া বিশ্বাস রাতারাতি ফিরে আসে না। তবে এটাও ঠিক যে এখন নর্মাল সময় নয়। সঙ্কটকালীন মুহূর্তে মনেরও দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। আপনি বছরের পর বছর ধরে আপনার ভাই-বোনদের সাথে তিক্ত তর্ক-বিতর্ক চালিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু পরিবারে একটা সঙ্কট আসুক। ওমনি দেখবেন পারস্পরিক আস্থা আর ভালোবাসার বন্ধন আপনাদেরকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সর্বব্যাপী নজরদারি-ব্যবস্থার বদলে বিজ্ঞান, সরকারী কর্তৃপক্ষ এবং মিডিয়ার ওপর মানুষের বিশ্বাস পুনর্নির্মাণ করতেও আবার খুব বেশি দেরি হয় না। আমাদের অবশ্যই নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত, তবে এই প্রযুক্তিগুলো যেন নাগরিকদের ক্ষমতায়নকে নিশ্চিত করে। আমি অবশ্যই আমার শরীরের তাপমাত্রা এবং রক্তচাপ মনিটারিং-এর পক্ষে, তবে সেই ডেটা যেন কোনভাবেই একটা 'সর্বশক্তিমান সরকার' গঠনের জন্য ব্যবহার করা না হয়। বরং সেই ডেটা যাতে আমাকে আরও ওয়েল-ইনফর্মড একজন নাগরিক হিসাবে আমার চয়েস বেছে নিতে সাহায্য করে, এবং সরকারকেও তার পদক্ষেপের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য করে। 

আমি যদি ২৪ঘন্টা আমার মেডিকেল-কন্ডিশন ট্র্যাক করতে পারি, তাহলে অন্যের জন্য আমি বিপদের কারন হয়ে উঠছি কিনা সেটা যেমন বুঝতে পারবো, তেমনি নিজের ভালোটাও একই সাথে খেয়াল করতে পারবো। আমি যদি করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য তথ্য অ্যাক্‌কেস করতে পারি, অ্যানালাইসিস করতে পারি, তাহলে সরকার এই সংক্রমণ রুখতে ঠিক কি কি করছে, সেটাও আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। মনে রাখবেন, যে প্রযুক্তি দিয়ে সরকার আমাদের ওপর নজরদারি করে, সেই একই প্রযুক্তি দিয়ে চাইলে আমরাও সরকারের ওপর নজরদারি চালাতে পারি।

করোনা-মহামারী, সেই হিসাবে নাগরিকত্ব-কেও একটা বড় পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে আসুন আমরা নির্ভর করি কেবলমাত্র বিজ্ঞান-সম্মত তথ্য এবং স্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞদের ওপর, কোনও মতেই ভিত্তিহীন 'কন্সপিরেসি-থিওরি' অথবা স্বার্থপর রাজনৈতিক নেতাদের ওপর নয়। সঠিক চয়েসটা বেছে নিতে না পারলে হয়তো আমরা আমাদের পরম প্রিয় ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়ে ফেলবো স্রেফ এটা ভেবে, যে নিজের শরীর-স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখতে এ'ছাড়া আমার আর অন্য কিছুই করার ছিলো না। 

*আমাদের একটা গ্লোবাল-প্ল্যান দরকার*
এবার আসা যাক দ্বিতীয় চয়েসটি প্রসঙ্গে। 'জাতীয়তাবাদী বিচ্ছিন্নতা' ও 'বিশ্বব্যাপী সংহতির' মধ্যে কোনটিকে আমরা বেছে নেবো? করোনা-সংক্রমণ এবং তজ্জনিত অর্থনৈতিক সঙ্কট, দুটোই হলো গ্লোবাল-ক্রাইসিস। দুনিয়া জোড়া সঙ্কট। কাজেই বিশ্বব্যাপী সহযোগিতার মাধ্যমেই একমাত্র এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। 

করোনা-সংক্রমণকে আটকাতে সবার আগে দরকার দুনিয়া জুড়ে তথ্যের অবাধ আদান-প্রদান। এই জায়গাটায় আমরা, মানুষরা, করোনা ভাইরাসের তুলনায় এগিয়ে। মানুষকে আক্রমণ করার ব্যাপারে চীনের একটি করোনা ভাইরাস, আমেরিকার একটি করোনা ভাইরাসকে কার্যকরী টিপ্‌স দিতে অক্ষম। কিন্তু চীনের মানুষ আমেরিকার মানুষকে করোনা-সংক্রমণ রোখার ব্যাপারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ টিপ্‌স দিতে পারে। একজন ইতালিয়ান ডাক্তার সকালবেলায় মিলান শহরে বসে যা আবিষ্কার করলেন, তা সন্ধ্যের মধ্যেই তেহ্‌রানে অসংখ্য মানুষের প্রাণ বাঁচাতে পারে। যখন ইংল্যান্ডের সরকার অনেকগুলি আর্জেন্ট স্টেপের মধ্যে কোন্‌টি আগে নেওয়া উচিৎ তাই নিয়ে কনফিউশনে পড়ে, তখন কোরিয়া তাকে দারুণ ভাবে সাহায্য করতে পারে, যারা হয়তো মাসখানেক আগেই ওই একই সমস্যায় পড়েছিলো। এ'সব কিছুই অসম্ভব নয়, তবে তার জন্য সবার আগে আমাদের মধ্যে বিশ্ব-ব্যাপী সহযোগিতা ও বিশ্বাসের মনোভাব গড়ে তোলা দরকার। 

দেশগুলোকে নিজেদের মধ্যে ইনফর্মেশন শেয়ার করার ব্যাপারে মুক্ত মনে এগিয়ে আসতে হবে। নম্র ভাবে অন্য দেশের কাছে পরামর্শ চাইতে হবে। অন্য দেশের দেওয়া তথ্য এবং বিশ্লেষণগুলোকে খোলা মনে গ্রহণ করতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে। টেস্টিং কিট এবং রেস্পিরেটরি মেশিনের মতো অত্যাবশ্যক মেডিকেল-ইক্যুইপমেন্টগুলি তৈরি করা এবং ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যও আমাদের একটা গ্লোবাল উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিটি দেশ আলাদা আলাদা করে এই কাজটি নিজের চৌহদ্দিতে করার বদলে যদি একটি গ্লোবাল উদ্যোগকে ঠিক ভাবে কোঅর্ডিনেট করা যায়, তাহলে জীবনদায়ী যন্ত্রগুলির আরও ব্যাপক উৎপাদন ও প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলির বিতরন সম্ভব। একটি যুদ্ধের সময় দেশগুলি যেমন মূল শিল্পগুলিকে 'জাতীয়করণ' করে, তেমনি করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানব-যুদ্ধের সময় আমাদের গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন-লাইনকে 'মানবিক' করার প্রয়োজন হতে পারে। 'ন্যাশনালাইজ' করার বদলে দরকার হতে পারে 'হিউম্যানাইজ' করা। অল্প কিছু করোনা-আক্রান্ত রোগী আছে, এমন কোনও ধনী দেশকে স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসে বহুমূল্য সরঞ্জাম পাঠিয়ে দিতে হবে সেই সব গরীব দেশে, যেখানে করোনা-আক্রান্তের সংখ্যা অনেক। সেই ধনী দেশকে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে প্রয়োজনে সে-ও একই রকমের সাহায্য পাবে অন্য দেশগুলোর কাছ থেকে। 

চিকিৎসকদের একজোট করার জন্যও আমরা এ'রকম একটা গ্লোবাল-উদ্যোগ নিতে পারি। কম আক্রান্ত দেশগুলো তাদের চিকিৎসকদের পাঠাতে পারে বেশী আক্রান্ত দেশগুলোতে। তাতে, প্রয়োজনীয় সাহায্য করাও হবে, আবার সেই চিকিৎসকরা অমূল্য অভিজ্ঞতা অর্জন করে নিজের দেশে ফেরার পর সেটা কাজেও লাগাতে পারবেন। মহামারীর ভরকেন্দ্র উল্টে গেলে, সাহায্যের গতিমুখকেও উল্টে দিতে হবে।     

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এই একই রকমের গ্লোবাল-সহযোগিতা প্রয়োজন। গ্লোবাল-ইকোনমির যুগে প্রতিটি দেশের সরকার যদি অন্যের স্বার্থকে উপেক্ষা করে খালি নিজের স্বার্থ দেখে, তাহলে সামগ্রিক ভাবে ক্যাওস বাড়বে বৈ কমবে না; দুনিয়া জোড়া অর্থনৈতিক সঙ্কট আরও গভীরই হতে থাকবে। আমাদের একটা গ্লোবাল-প্ল্যান-অফ্‌-অ্যাকশন চাই। এবং সেটা এক্ষুনি।

আরও একটা জিনিস দরকার। সেটা হলো পৃথিবীর এ'প্রান্ত থেকে ও'প্রান্তে যাতায়াত করার জন্য একটি গ্লোবাল-বোঝাপড়া। মাসের পর মাস ধরে আন্তর্জাতিক যাতায়াত বন্ধ করে রাখলে তা পরিস্থিতিকে আরও বিগড়ে দেবে। করোনা-সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই তাতে আখেরে দূর্বলই হবে। গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের একটি লিস্ট বানিয়ে তাঁদের এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করার ব্যাপারে সবাই সবাইকে সহযোগিতা করুক, এটাই কাঙ্খিত। একটা কমন বোঝাপড়ার ভিত্তিতে প্রথমে প্রতিটা দেশ তার নিজের দেশের এই ধরনের মানুষদের স্বাস্থ্য-পরীক্ষা করুক, যাঁরা অন্য দেশে যাবেন। আপনি যখন নিশ্চিত হবেন যে ভালো ভাবে পরীক্ষা করা একদল নীরোগ, সুস্থ-সবল কাজের মানুষই কেবল প্লেনে করে আপনার দেশে আসছে, দেখবেন আপনার টেনশনও কমবে। আপনিও তাতে উৎসাহীই হবেন। 

দুঃখের বিষয়, বর্তমানে খুব কম দেশই এ'সব নিয়ে ভাবছে। আন্তর্জাতিক ভাবেই আমরা প্যারালাইসড হয়ে পড়ছি। মনে হচ্ছে একটা বদ্ধ ঘরে কিছু বাচ্চা আটকে পড়েছে, যেখানে বড়রা কেউ নেই। গত সপ্তাহে সারা পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট্রনায়কদের একটা এমারজেন্সি মিটিং হবে বলে মনে হয়েছিলো, যাতে করে অন্তত একটা কমন প্ল্যান বানানো যায়। এই সপ্তাহে জি-সেভেনের নেতারা কোনোক্রমে একটা ভিডিও-কনফারেন্স করেছেন বটে, কিন্তু কাজের কাজ কিস্যুই হয়নি। 

অতীতে এই ধরনের সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে, যেমন ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কটই হোক অথবা ২০১৪ সালের ইবোলা-মহামারী, আমেরিকা একটা বিশ্ব-নেতৃত্বসুলভ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলো। এবারে নেতার ভূমিকা থেকে সে পরিষ্কার ইস্তফা দিয়ে দিয়েছে। মার্কিন-মহত্ত্বকে আঁকড়ে ধরাই এখন তার কাছে প্রায়োরিটি, বিশ্ব-মানবতার ভবিষ্যতের চেয়েও। 

এই মার্কিন প্রশাসন এমনকি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও ত্যাগ করেছে। ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন থেকে আমেরিকায় ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার আগে এরা একবার বিষয়টা আগাম জানানোর পর্যন্ত প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। জার্মানির একটি ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাকে ১বিলয়ন ডলার দিয়ে করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিনের একচেটিয়া অধিকার কিনতে চেয়ে এরা জার্মানিকেও কলঙ্কিত করেছে। এমনকি এই মার্কিন প্রশাসন আজ যদি হঠাৎ ভোল পালটে কোনও গ্লোবাল-প্ল্যান নেয়ও বা, তাহলেও খুব কম দেশই তাকে নেতা বলে মানবে, যে নেতা আবার কখনোই কোনও দায়িত্ব নেয় না, যে নেতা কখনোই নিজের ভুল স্বীকার করে না এবং যে নেতা সবসময়েই অন্যের ঘাড়ে সমস্ত দোষ চাপিয়ে ক্রেডিটের পুরোটা নিজে মেরে দেয়। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ফেলে যাওয়া শূন্যস্থানকে যদি দ্রুত অন্য দেশগুলি পূরণ করতে না পারে, তাহলে বর্তমান মহামারীটিকে সামলানো তো কঠিন হবেই, তার সাথে সাথে আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলোও আগামী দিনে আরও বিষিয়ে উঠবে। প্রতিটি সঙ্কট তবু একটি সুযোগকেও সামনে আনে। আমরা আশা করবো করোনা-মহামারী, পৃথিবীর দেশে-দেশে বর্তমান বিভেদের সাংঘাতিক বিপদটা সম্পর্কে মানবজাতিকে সতর্ক করবে।

বিশ্ব-মানবতার সামনে আজ দুটো রাস্তা খোলা। যে কোনও একটা বেছে নিতে হবে। আমরা কি বিভেদ-বৈষম্যের সঙ্কীর্ণ পথেই পা বাড়াবো? নাকি বিশ্ব-সংহতির পথে? যদি আমরা অনৈক্যের পথ বেছে নিই, তাহলে তা শুধু এখনকার সঙ্কটকেই দীর্ঘায়িত করবে না, ভবিষ্যতে এর চেয়েও আরও খারাপ সঙ্কটকে ডেকে আনবে। আর আমরা যদি বিশ্ব-ব্যাপী সংহতি তথা সৌভ্রাতৃত্বের পথকে বেছে নিই, তাহলে তা শুধু করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধেই নয়, ভবিষ্যতের সমস্ত মহামারী তথা সঙ্কটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের জয়কে নিশ্চিত করবে। একবিংশ শতাব্দীতে গভীর ভাবে প্রভাবিত হবে গোটা মানব জাতি।

**********************************************

ইউভাল নোহা হারারি একজন ইজরায়েলি ঐতিহাসিক। "সাপিয়েন্স" গ্রন্থটির জন্য মূলত বিশ্ব ওনাকে চিনেছে। সম্প্রতি উনি The world after corona virus শীর্ষক একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেন। আর্টিকেলটির বঙ্গানুবাদ করেছেন বিশ্বজিৎ হাজরা। বঙ্গানুবাদ এবং আর্টিকেল লিঙ্ক দুটোই দিলাম আগ্রহীরা পড়তে পারেন।

~ অনির্বান মাইতি

শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০২০

ভাইরাস ও মানবজাতি ~ মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায়

সেদিন ছিল ঘোর অমাবস্যা। চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের পরামর্শে সেদিন ১৩৪ কোটি মানুষের সম্পূর্ণ সঙ্গরোধে থাকবার নির্দেশ এসেছে। সম্ভবত আমরা তৈরী করতে চলেছি পৃথিবীতে সর্ববৃহৎ সঙ্গরোধের ইতিহাস।

কালকে জানালা দিয়ে দ্বিতীয়ার একফালি চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, ধীরে ধীরে একদিন আসবে পূর্ণিমা। সেদিন কি চাঁদের সাথে পৃথিবীও একটু হাসবে? নাকি আরেক অমাবস্যার প্রতীক্ষায় তাকে ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে হবে?

যে দিন মানুষ আবার হাসবে সেদিন কি সে মনে রাখবে এই দিনগুলোর কথা? সেদিন কি খবরের কাগজে প্রথম পাতায় জায়গা হবে আজকের বিজ্ঞানী, ডাক্তারদের? জায়গা হবে অসংখ্য সাধারণ মানুষের যারা এই অবস্থায় ঢাল তলোয়ারহীন হয়ে লড়ে যাচ্ছেন তাদের? নাকি আমরা হয়ে যাব 'পুনর্মূষিক ভব'!

যে বিজ্ঞানীরা লেবোরেটরিতে থেকে জনগণেশের তোয়াক্কা না করে ৭৮০ কোটি মানুষকে বাঁচাতে নিরন্তর সাধনা করে চলেছেন সেদিনের চাঁদের আলোয় কি বিজ্ঞানে উৎসর্গীকৃত এই মৌন সাধকদের কথা আমরা জানতে পারব? 
একবার তাদের জন্য সারা পৃথিবী উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট করব?

নাকি ফিরে যাব স্টারডম, ভোটের কারসাজি, ধর্মীয় জিগির দেওয়া বিভেদসৃষ্টিকারী গুরুদের ফাঁপা কথায় !

যে সাধকরা আমাদের আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুন করে তাদের কথা কাগজে পাবেন না। বিজ্ঞান থাকে না খবরের কাগজে। ওগুলো ঠিক সমসাময়িক নয়, ওই খবরগুলো ভীষণ ক্লান্তিকর, আমাদের জিভে লালা ঝরান উত্তেজনা আনে না। 

আমরা ৯৯.৯৯% সময়ে ব্যস্ত থাকি নায়ক ও নায়িকাদের জীবনের গুপ্ত কথা জানতে, নেতা ও নেত্রীদের দলবাজিতে গা ভাসাতে, অবৈজ্ঞানিক ধর্মীয় গুরুদের জিগির শুনতে।

তাই শেষ পর্যন্ত কিছু 'জনপ্রিয়' মানুষ পাঁচ পুরুষের জন্য সংস্থান করে যায়, আর বিজ্ঞানের কথা মনে আসে এই ক্রান্তিকালে।

আমরা হয়ত শিক্ষা নেব। 

ভাবতে ভাল লাগে একমাস বাদে পরের অমাবস্যায় পৃথিবী থেকে হয়ত কালো অন্ধকার কিছুটা ঘুচে যাবে। প্রতিপদের চাঁদের আলোয় নতুন পৃথিবী উদ্ভাসিত হবে। হয়ত সেই সময়ে অতি ক্ষুদ্র মানুষ বুঝবে আমাদের প্রয়োজন বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য, শিক্ষায় অধিক অর্থ বরাদ্দ করা।

হয়ত সেই সময়ে রচিত হবে The Plague-এর মত আরেকটা মহাকাব্যিক রচনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ৭০ বছর আগে উত্তর আফ্রিকার একটি শহরে মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পরে আলবেয়ার ক্যামু লিখেছিলেন এক রূপকধর্মী উপন্যাস।

মৃত্যুর প্রতীক্ষায় মানুষের প্রতিক্রিয়া। 

কারণ এই শেষ নয়, আমরা যদি নিজেদের না পাল্টাতে পারি আবার আসবে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস; তারা বুঝবে না রাজপুত্র ও ভিখারির তফাৎ, জানবে না ষ্টার গায়িকা ও রেলের সাধারণ যাত্রীর পার্থক্য - ভাইরাস ছড়িয়ে যাবে। 

এইবার অনেক দুঃখ, অনেক মৃত্যুর বিনিময়ে আমরা মুক্তি পাব। 

তবে পূর্ণ মুক্তি আসবে তখনই, যখন মানবজাতির রক্ষাকার্যে সকলে মিলে নিয়োজিত হব। সম্মান দেব আমাদের প্রকৃত রক্ষাকর্তাদের। অগ্রাধিকার দেব মানুষের একত্রিত যাত্রায়, বেঁচে থাকার  জন্য প্রকৃত প্রয়োজনে।

ভাইরাসকে আটকাতে সমাজের ভাইরাসদের সমূলে উৎপাটিত করতে হবে।

Madhusree Bandyopadhyay
27/03/2020

বুধবার, ১৮ মার্চ, ২০২০

করোনা ভাইরাস ও চীন ~ সুশোভন পাত্র

ভাবুন আপনি আছেন চিনের Wuhan শহরে। করোনা ভাইরাস প্যান্ডেমিকের আঁতুড়ঘরে! 
না, আমি জানি আপনি টুনি বাল্ব থেকে মোবাইল, সস্তার টর্চ থেকে মেয়ের খেলনা –যে কোন জিনিসের শীঘ্রপতনেই 'চায়না মাল' বলে খিল্লি করেন, কালীপূজায় হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির কৃতী ছাত্র হিসেবে 'চাইনিজ বাজি' বর্জন করে বেজিং-র অর্থনীতি কে হেব্বি ধাক্কা দিয়ে দু-পেগ রাম সেবন করেন; তাহলে কোন দুঃখে আপনি চিনের Wuhan শহরে থাকতে যাবেন? সুপারপাওয়ার না ছাই! 
তবুও একটু কষ্ট করেই না হয় ভাবুন, আপনি আছেন চিনের Wuhan শহরে! আপনি আছেন করোনা ভাইরাস প্যান্ডেমিকের এক্কেরে আঁতুড়ঘরে! 
প্যান্ডেমিকের সতর্কতায় Wuhan-এ 'কমপ্লিট লকডাউন'। এমনিতে 'কমপ্লিট লকডাউন' শব্দটায় থ্রিলিং একটা ব্যাপার আছে! কিন্তু মুশকিল হল, 'কমপ্লিট লকডাউন' বিষয়টা এক্সিকিউট করার ক্ষেত্রে তার থেকে অনেক বেশি চাপ আছে। কারণ 'কমপ্লিট লকডাউনে' মানুষ ঘরে বসে থাকে, কর্পূরের মত উবে তো আর যায় না! তাঁরা স্নান করে, গান শোনে, প্রেম করে, খাবার খায়, এমনকি তাঁদের আমাশাও হয়। তাই 'কমপ্লিট লক ডাউনে'ও Wuhan-এ নাগরিক জীবন স্বাভাবিক রাখতে চিন সরকার ঘোষণা করেছে, মাসিক বিল বকেয়া থাকলেও নাগরিকদের ইলেকট্রিক, জল, ইন্টারনেট, টেলিফোন সহ কোন জরুরী পরিষেবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। কিন্তু তা হলেই বা! এসবে কি মানুষের পেট ভরে? এমনিতে যে সুইগি-জোমেটোর যুগে ঘরে বসেই যে চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য খাওয়াই যায় সেটা আমার ৩ বছরের মেয়েও জানে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল অনলাইন ফুড ডেলিভারির বিশালতা। 'কমপ্লিট লকডাউন'-র সময় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১কোটি ৫০লক্ষ মানুষ Wuhan-এ অনলাইন খাবার অর্ডার করেছেন এবং ডেলিভারি পেয়েছেন¹।   
সে না হয় হল! কিন্তু খেয়ে আবার আমাশা হলে কি হবে? কারও প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজন হলে কি করবে? দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না বুঝেই প্রাথমিক চিকিৎসার ৫০%-ই অনলাইন করেছে চিন। ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট থেকে প্রেসক্রিপশন, এমনকি ওষুধ ডেলিভারি –সবটাই অনলাইনে। প্যান্ডেমিকের আতঙ্কে বিশ্বের তাবড় শহরে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের হাহাকার। লন্ডনের শপিং মলে মামুলি টয়লেট পেপার নিয়ে হাতাহাতি হচ্ছে। ইতালির সুপার মার্কেটে গ্রোসারি জাস্ট ছবি হয়ে যাচ্ছে। খোদ কলকাতায় স্যানেটাইজার খুঁজতে আপনার প্যান্টালুন হলুদ হয়ে যাচ্ছে। আর চিন সমস্ত রাষ্ট্রীয় সংস্থার সমস্ত কাজ থামিয়ে, জরুরী ভিত্তিতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনে নিয়োগ করেছে। আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট চিনে পাওয়া যাচ্ছে সবই, সুলভে²! 
এসবই তো গেলো সতর্কতা। ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় কি ম্যাজিক দেখাচ্ছে চিন? ম্যাজিকই বটে! ২০০২-র সার্স ফ্লু-র সময় গোটা দেশে যে অসংখ্য 'ফিভার ক্লিনিক' বানিয়েছিল চিন, সেই ফিভার ক্লিনিকই এখন চিকিৎসার প্রাথমিক স্তর। ফিভার ক্লিনিকের পরীক্ষায় যদি COVID19-র কোন লক্ষণ দেখা যায় তাহলে হচ্ছে বাকায়দা সিটি স্ক্যান! কারণ চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে এক্স-রে নয়, COVID19 আক্রান্ত ব্যক্তির ফুসফুসের 'গ্রাউন্ড-গ্লাস-অপাসিটিস' কার্যকরী ভাবে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে সিটি স্ক্যানেই। দিনে ২০০টা সিটি স্ক্যান করছে চিনের প্রতিটি মেশিন। আপনার ধারেপাশে খোঁজ নিয়ে দেখুন, সংখ্যাটা ৫০ পেরুবে না। সিটি স্ক্যানেও যদি COVID19-র লক্ষণ থাকে তখন পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে আক্রান্ত কে ক্যাটাগোরাইজেশন করা হচ্ছে -মাইল্ড, সিভিয়ার, কিম্বা ক্রিটিক্যাল। মাইল্ড আক্রান্তদের জন্য অপেক্ষা করছে চিনের স্টেডিয়াম, জিমনাসিয়াম, স্কুল, কমিউনিটি হল দখল করে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা অসংখ্য আইসোলেশন সেন্টার। আর সিভিয়ার বা ক্রিটিক্যালদের জন্য হাসপাতাল। 
করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষান করেছে চিন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৪০,০০০ মেডিক্যাল কর্মী পৌঁছে গেছে Wuhan-এ³। কালকে যিনি ছিলেন হোটেলের রিসেপসনিস্ট আজ তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে জ্বর মাপছেন। পরশু যিনি নির্মাণ কর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন আজ তিনি সিচুয়ানের প্রত্যন্ত গ্রামে স্বাস্থ্য শিবির করছেন। প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১৬লক্ষ টেস্ট করার মেডিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার বানিয়েছে চিন। ১০দিনে ৬৪৫,০০০ স্কয়ার ফুটের হাসপাতালে দাঁড় করিয়েছে চিন⁴। আক্রান্তদের মোবাইল ডেটা-স্যাম্পল থেকে 'কন্টাক্ট পয়েন্ট' ট্রেস করে রুগীর সংস্পর্শে আসা সকলকে আইসোললেট করার চেষ্টা করেছে চিন⁵। আর তাই, ডিসেম্বরও আক্রান্ত কাউকে চিহ্নিত করে চিকিৎসা শুরু করতে যেখানে ১৫ দিন সময় লাগছিল চিনের, এখন সেটা কমে গড়ে ২দিন। ডিসেম্বরও যেখানে প্রতিদিন ৪৬,০০০ সন্দেহভাজন কেস আসছিল চিনে এখন সেটা কমে ৫-১০। 
কি ভাবছেন 'চিনের দালাল'? 'চিনের প্রেসিডেন্ট আমার প্রেসিডেন্ট'? রেড আর্মির পুরনো পাপী? আরে চাপ নেবেন না! কারণ উপরের এই তথ্য গুলো মাও সে তুং বলেননি কিম্বা লি শাও চি লিখে যাননি। বলছে খোদ WHO-র যে টিম ফেব্রুয়ারি তে চিনে গিয়েছিল সেই টিমের লিডার; পোলিও, এবোলার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের লড়াই'র ক্রুসেডর ডঃ ব্রুস আইলওয়ার্ড। নিউইয়র্ক টাইমসের সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন "চিন সরকার COVID19 আক্রান্তদের টেস্ট এবং চিকিৎসার সমস্ত খরচা বহন করছে। আর এখানেই চিন দৃষ্টান্তমূলক। চিনের অভাবনীয় লড়াইর জন্যই গোটা বিশ্ব নিজেদের প্রস্তুত করতে কমপক্ষে ২সপ্তাহ সময় হাতে পেয়েছে।" 
আর অন্যদিকে প্যান্ডেমিকে ক্যাপিটালিজমের পিতামহ ভীষ্ম, আমেরিকার অবস্থা লেজে গোবরে⁶। ২০১৮তে ট্রাম্প সরকারী স্বাস্থ্য সুরক্ষা সংস্থায় ৮০% বরাদ্দ ছাঁটাই করে, শূন্য পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে আমেরিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কে ঠেলে দিয়েছিলেন আরও বেসরকারিকরণের পথে⁷। প্যান্ডেমিকের প্রাদুর্ভাবে তারই মাশুল গুনছেন সাধারণ নাগরিকরা। সাধারণ ডাক্তার ভিজিটের খরচা ১৪৯-১১৫১ ডলারে ঘোরাফেরা করছে⁸। বেসরকারি ক্ষেত্রে করোনা ভাইরাসের টেস্ট করাতে  ৩,২৭০ ডলার খরচা হচ্ছে⁹। কিছু প্রভিন্সে নামমাত্র সরকারি ভর্তুকির ঘোষণা করলেও গোটা আমেরিকায় করোনা ভাইরাসের টেস্ট এবং চিকিৎসা মূলত বেসরকারি এবং ব্যাপক খরচা সাপেক্ষ। গোদের উপর বিষফোঁড়া ৩কোটি আমেরিকানদের কোন মেডিক্যাল ইনস্যুরেন্সই নেই, আরও ৪কোটির ইনস্যুরেন্স থাকলেও ব্যাপক খরচা কভার করতে অপর্যাপ্ত¹⁰। তাই চিনে যেখানে প্রতি ১০লক্ষ মানুষের মধ্যে করোনা ভাইরাসের টেস্ট হচ্ছে গড়ে ২,৮২০জনের, আমেরিকায় সেটা মাত্র ২৩জনের¹¹। আমেরিকায় তীব্রতর হচ্ছে প্যানিক। মুডি অ্যানালেটিক্সের অনুমান প্যান্ডেমিকে ক্যাসকেডিং এফেক্টে কর্মহীন হতে পারেন ৮ কোটি মানুষ¹²।   
বিশেষজ্ঞদের মতে সামনের কয়েক সপ্তাহে অগ্নিপরীক্ষা ভারতের। জানি, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা রাতারাতি বদলাবে না। কিন্তু সরকারের পলিসি মেকিং-র প্রায়োরিটি তো বদলাতে পারে। হাতে গরম উদাহরণ তো রইলোই। একদিকে ক্যাপিটালিস্ট আমেরিকা। যারা স্বাস্থ্য পরিষেবা কে প্রফিটের জন্য বাজারের উপর ছেড়ে, সেনসেক্স আর নিফটি সূচকে বড়লোক শিল্পপতিদের পকেট ভরাতে, শ্রমিকদের পেড সিক লিভের আবেদন বাতিল করে¹³, ভাইরাসের 'কমিউনিটি স্প্রেড' আটকাতে 'কমপ্লিট লকডাউন' না করে সাধারণ মানুষ কে ঠেলে দিচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। আরেকদিকে রইলো সমাজতান্ত্রিক চিন, যারা সেনসেক্স-নিফটি-প্রফিট কে গুলি মেরে, 'কমিউনিটি স্প্রেড' আটকাতে তৎক্ষণাৎ 'কমপ্লিট লকডাউন' করে, নাগরিক জীবন সচল রাখতে বকেয়া বিল মকুব করে, শ্রমিকদের পেড সিক লিভ মঞ্জুর করে, পুরো রাষ্ট্রশক্তি কে সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচানোর কাজে লাগিয়ে দিতে পারে, চিকিৎসার সম্পূর্ণ খরচা বহন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। হাতে গরম উদাহরণ তো রইলোই। একদিকে ক্যাপিটালিজম, যেখানে প্রফিট আগে, পরে মানুষ। একদিকে সমাজতন্ত্র, যেখানে মানুষ আগে, অন্য সবকিছু পরে। চয়েস ইস ইয়োর্স!













সোমবার, ১৬ মার্চ, ২০২০

করোনা ভাইরাস ~ স্বপন ভট্টাচার্য

নভেল করোনাভাইরাস নিয়ে একজন মাইক্রোবায়োলজির মাস্টার হয়ে ফেবুতে কিছু না বললে ইজ্জত থাকে না। সুতরাং দু চার কথা আমি যা জানি আর যেভাবে বলতে ভালবাসি সেভাবে বলি। উৎসাহ না থাকলে এখানেই পাঠক ছেড়ে যেতে পারেন এই লেখা, কেন না কোনোদিক থেকেই বিশেষজ্ঞ হবার দাবি আমি করছি না।

নভেল করোনাভাইরাস নভেল কেন? কেন না করোনাভাইরাসের চলতি প্রকরণগুলির থেকে এটা কিছুটা আলাদা বা ব্যতিক্রমী তাই নভেল।
সাধারন করোনাভাইরাস তো তেমন মারাত্মক নয়, এটা এমন হল কি করে? এটা একটা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার গল্প। এমনিতে আমাদের শরীর অন্ততপক্ষে ১০০০০০০০০০০০০ রকমের সংক্রমনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম , কিন্তু তার একটা পুর্বশর্ত আছে। শরীরকে তার সাথে পরিচিত হওয়া দরকার। টীকাদান এরকম একটা পরিচিতি ঘটানোর উদাহরণ। মারক সংক্রমণের হাত থেকে তাতে বাঁচা যায় কেন না মানবশরীরের নিজস্ব একটা 'স্মৃতি' আছে। একবার পরিচিতি ঘটে গেলে সে দাঙ্গাকারী যতদিন পরেই আবার আসুক না কেন,শরীর তাকে স্মৃতি থেকে চিনে নিয়ে আটকে দেয়। ফলে ব্যারিকেডের ওধারে থাকা হামলাকারী সংক্রমণকে ঢুকতে হয় ট্রয়ের ঘোড়ার মত আপাতনির্বিষ হয়ে। নভেল করোনা হল ওই বহুদিন বেকার বসে থাকা গ্রীক সেনার মত প্রায় বেকার ভাইরাস যারা নিজেদের গঠণ একটু আধটু আড়াল করে ঢুকে পড়ছে শরীরে। এই প্রথম তার বদলানো রূপের সঙ্গে 'পরিচিত' হচ্ছে শরীর। এর কিছু প্রতিক্রিয়া আছে। যেমন বি সি জি নিলে বাচ্চার হয়,যেমন পোলিও প্রথমবার নিলে হয় ,তেমন এই চেনা পরিচিতির ফলস্বরূপ জ্বর, শ্বাসজনিত সমস্যা এসব হয়। মুশকিল আরো বাড়ে যখন এই অপরিচিত শত্রুর মোকাবিলায় ব্যস্ত শরীরকে আক্রমণ করে বসে অন্যান্য জীবাণু। সুতরাং নভেল করোনায় আক্রান্ত মানুষ ততদিন ভুগতে থাকবে যতদিন না শরীর এই চেনা পরিচিতিটা সম্পন্ন করে যথোচিত ব্যবস্থা নিয়ে তাকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলবে। এই সময়টা দিতে হবে আক্রান্ত শরীরকে।
নভেল করোনা বয়স্কদের ক্ষেত্রেই মারাত্মক হয়ে উঠছে অথচ বাচ্চাদের মধ্যে তো মৃত্যুহার অতটা নয়। এটা কেন? আমার মনে হয় গত দশ পনের বছরে যে সব ইম্যুনাইজেশন প্রোটোকল WHO দ্বারা আবশ্যিক করা হয়েছে তা কিছুটা হলেও প্রোটেকশন দিতে পারছে বাচ্চাদের হয়তো অপ্রত্যক্ষভাবে, কিন্তু দিচ্ছে,সেটা MMR বা যার জন্যই হোক না কেন । নয়তো, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ফলাফল মারাত্মক হবার কথা। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মানুষেরা, যাদের এইসব আধুনিক ইম্যুনাইজেশন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় নি তাদের শরীরকে এই পরিচিতি ঘটানোর ধকলটা নিতে হচ্ছে অনেক বেশি করে। যারা সেটা পারছে না তারা সহজেই অন্যান্য জীবাণুরও শিকার হয়ে পড়ছে এবং মারা যাচ্ছে।

এর শেষ কোথায়? শরীর শত্রুকে ভালোভাবে চিনতে প্রথমবার যদি সময় নেয় ১৫ দিন তো দ্বিতীয়বার তা হয়ত হবে ১৫ ঘন্টায়।অর্থাৎ, নভেল ততদিনই নভেল যতদিন শরীরের চেনা না সম্পূর্ণ হচ্ছে। এই সময়টা সংক্রামিত শরীরকে দিতে হবে। যেহেতু চীন থেকে সংক্রমণ শুরু হয়েছে সেহেতু চীনের মানুষ সেরে উঠবে সবচেয়ে আগে,তারপর ইরান, ইটালী এই ক্রমে যদি না নতুন নতুন মানুষ আক্রান্ত হয়। সুতরাং দেশে দেশে প্রতিক্রিয়া বাড়াবাড়ি রকমের মনে হলেও যে কোন প্যানডেমিকের জন্য প্রতিক্রিয়ার বাড়াবাড়ি আদতে সবার জন্যই ভালো।
কারা বেশি সতর্ক থাকবেন? যারা ইমুনোসাপ্রেসিভ ওষুধ খান, কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে, অটো ইম্যুউন ডিজিজে ভোগেন তারা বাড়তি সতর্ক থাকবেন। ভাইরাস শরীরে ঢুকলে কিছু খেল দেখাবেই কেন না ওষুধ দিয়ে তাকে মারা যায় না। সে তখন আপনার শরীরের মালিক এবং যতদিন না শরীর সক্রিয়তা দেখাতে পারছে ততদিন জানবেন, আপনার সংক্রামিত কোষকলা তার দাসমাত্র, তার অর্ডারেই তারা চলবে,আপনি অসহায়। তবে আশার কথা, কোটিতে গুটিক ছাড়া বাকীরা সময় নিলেও ঠিক শত্রুকে সীমান্ত পার করে তাড়িয়ে ছাড়বে। অযথা আতঙ্কিত হলে তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন না, বরং শত্রু বুদ্ধিমান হলে তাকে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।বুঝুন, একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা যেটাকে পুরোপুরি জীবিত পদার্থই বলা যায় না তাকে মানুষ হয়ে 'বুদ্ধিমান' বলছি! এখন 'বুদ্ধি' জিনিষটাকে যদি মস্তিষ্ক নামক একদলা বাটার জাতীয় পদার্থ ছাড়া অন্যভাবে ভাবা যায় তাহলে খুব ভুল বললাম কী?

  

মঙ্গলবার, ৩ মার্চ, ২০২০

ধর্ম ও মানুষ ~ মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায়

তিন লক্ষ বছরের মানুষের ইতিহাসে অধিকাংশ সময় অধিকাংশ মানুষ থাকত ক্ষুধার্ত হয়ে। রাতে শিশুরা ঘুমাতে যেত খিদে নিয়ে।

১৮০০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল মোটমাট ১০০ কোটি। 
দু'শ বছর আগেও পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ খাদ্যের জন্য হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও দুই বেলা পেট ভরাতে পারেনি। 
দুর্ভিক্ষ ও ক্ষুধা ছিল অধিকাংশ মানুষের জীবনের অংশ। 

তাই, বিগত দুই শতক ধরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, সমাজতাত্ত্বিক ও বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করেছেন অধিকাংশ মানুষকে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে বার করে আনতে। খাদ্য উৎপাদন ও বন্টনে জন্য বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিক নতুন তত্ত্ব দিয়েছেন। সেই সব তত্ত্বকে বাস্তবে প্রয়োগের প্রচেষ্টা নিয়েছে রাষ্ট্র।

একইসাথে বিজ্ঞানের দ্রুত অগ্রগতি হয়েছে, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির প্রচেষ্টা নিয়েছেন বিভিন্ন বিজ্ঞানী। এমনকি সেই প্রচেষ্টা স্বীকৃতি পেয়েছে নোবেল পুরস্কার প্রদানে। খাদ্যের উৎপাদনের দ্রুত বৃদ্ধির সাথে বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছিল বন্টন ব্যবস্থায় বিপ্লব।
শেষ দুইশ বছরে ভ্যাক্সিনেসন, আ্যন্টিবায়োটিক ও স্বাস্থ্যবিধির জন্য পৃথিবীর জনসংখ্যা লাফ দিয়ে ১০০ কোটি থেকে হয়েছে প্রায় ৭৮০ কোটি।

১৯৭০ সালে পৃথিবীর ৩০% মানুষ থাকত ক্ষুধার্ত হয়ে। ভয়ানক জনসংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও ২০১৮ সালে প্রায় ১০% মানুষ খিদে নিয়ে ঘুমাতে যায়। এই সংখ্যা ফেলে দেবার মত নয়। বোঝা যায় খাদ্য উৎপাদন ও বন্টনের যে প্রক্রিয়া বিগত শতাব্দীতে বিভিন্ন দেশে নেওয়া হয়েছিল, তার অনেকটা সাফল্য বিভিন্ন দেশে এসেছে। 
সত্যি কথা বলতে দূর্ভিক্ষের যে ছবি পৃথিবীতে ১০০ বছর আগেও দেখা যেত এখন তা কমে গেছে। 

নিশ্চিত আগামী একশ বছরের মধ্যে পৃথিবী থেকে ক্ষুধা কমে যাবে। তবে বৈষম্য সম্ভবত কমবে না।

মানুষ অধিকাংশ সময়ে শুধু খাদ্য অন্বেষণ করেছে, খাদ্যের জন্য অন্যকে সংহার করেছে, খাদ্য প্রাপ্তিকে নিশ্চিত করবার জন্য ধর্মের জন্ম দিয়েছে। 

পরবর্তীকালে সেই ধর্ম মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করল। শেষ আড়াই হাজর বছর ধরে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ও তার বিভেদ রাষ্ট্রের হাতিয়ার হয়ে গেল। 

লক্ষ্য করে দেখবেন, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ৯০% মানুষ একটাই ধর্ম পালন করেন। এই একরূপতা এসেছে অনেক রক্তের বিনিময়ে। আর একরূপ সমাজে ধর্মের প্রভাবে জীবন যাপন, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক হয়ে গেছে বৈচিত্র্যহীন।

প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে সাথে নিয়ে রাষ্ট্রের পক্ষে সহজ হয়েছে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা।
আমেরিকা, ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা ও এশিয়ার অধিকাংশ দেশ এর বাইরে নয়। 

ধর্মই জীবন, ধর্মই মরণ। তাই ধর্ম এত শক্তিশালী।

তবে বিগত অন্তত ২০০ বছরে পৃথিবীতে ধর্মের বাইরে গিয়ে বহু মানুষ চিন্তা করছেন। তারা সামগ্রিকভাবে মানুষকে নিয়ে ভাবছেন। বিংশ শতকে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বাদ দেবার প্রচেষ্টা শুরু হয়। 
রাষ্ট্র ধর্মের থেকে বিচ্ছিন্ন হলে সুবিধা হল বিভিন্ন দেশের সংখ্যালঘু ও নিরীশ্বরবাদীরা নিরাপদে থাকতে পারেন। ধর্মের অধিকারের বদলে মানুষের অধিকার সুরক্ষিত হয়। তাই রোমান ক্যাথলিক পোপকেও বিভিন্ন দেশের সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান মানুষকে রক্ষা করতে সেকুলারিজমের কথা বলতে হয়। 

সেকুলারিজমের কথা সকলকে সৎভাবে ভাবতে হবে, বলতে হবে। 
আমি ভারতবর্ষ হিন্দুদের দেশ চাইব, বাংলাদেশ মুসলমানের জন্য চাইব আর ইউরোপে দেশান্তরী হয়ে সেকুলার হব - এই ভাবে চলে না, চলতে পারে না।

নিশ্চিত একদিন এই খাঁচাগুলি ভাঙবে। 

মানুষ নিজের স্বার্থেই ধর্মের উপরে স্থান দেবে মানবধর্মকে। সে এই কাজ করতে বাধ্য হবে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। কারণ যতদিন যাচ্ছে, দলবদ্ধভাবে নয়, এককভাবে মানুষ দেশান্তরে যাচ্ছে। শুধু ধনী নয়; কর্ম, শিক্ষা, বিবাহ উপলক্ষে বহু মানুষ অন্য দেশে যাচ্ছে। অন্যদের সাথে মিশছে। নিজের স্বার্থে সে বাধ্য হবে শান্তি ও সেকুলারিজমের কথা বলতে।

আমরা এক ক্রান্তি-কালে আছি। ট্রান্সিশন পিরিয়ড। পরিবর্তন আসবে।

Madhusree Bandyopadhyay
03/03/2020

রবিবার, ১ মার্চ, ২০২০

ভয়ের গল্প ~ আর্যতীর্থ

বাসটা লেট করে সর্বনাশ করে দিলো সৌরভের। মাঝরাত্তির ছুঁই ছুঁই সময়ে মনসাপোতা বাসস্টপে  নামালো, তখন পথঘাট শুনশান। সব দোকানে ঝাঁপ পড়ে গেছে। অবশ্য দোকান বলতে তো দুটো চা দোকান, একখানা মনিহারি কাম মুদি,
একটা পাইসহোটেল আর একটা নাপিতের দোকান।দিনের বেলায় রাস্তার ধারে আনাজপাতি বসে। এটাকেই এখানকার লোক মার্কেট বলে। 
মনসাপোতার নাম জানি কেউ শোনোনি। বর্ধমান থেকে বাঁকুড়ার দিকে যেতে গেলে এক মিনিটের জন্য বাস থামে এখানে। কোনোকালে নাকি কেউ মাটি খুঁড়ে মা মনসার মূর্তি পেয়েছিলো, সেই জন্য এই নাম। সে মায়ের মন্দির এখন পোড়ো, মা মনসার চেলাচামুন্ডাদের বাস, ওই যে গো, রাত্তিরে যাদের লতা বলতে হয়।
 এই পান্ডববর্জিত জায়গায় সখ করে যে আসেনি , বলাই বাহুল্য।গ্রামটির নামও মনসাপোতা, এখানে নেমে লোকে ওই একটা জায়গাতেই যায় সাধারনত, যদিও আশেপাশে ছোটোখাটো আরো কয়েকটা গাঁ আছে। সৌরভের প্রিয়তম পুরুষ ও নারীটি এই গাঁয়েই বাস করেন, মানে তার দাদা আর নাম্মা। দাদা পঁচাশি পেরিয়ে আজও সটান, নাম্মা আটাত্তরে একটু সুগারে কাবু হলেও,দিব্যি সচল আছেন।গ্রামের বাড়ি ছেড়ে থাকেননা, তবে দেখাশোনার দু তিনজন আছে। দিন কয়েক আগে নাতিকে অনেকদিন দেখেন নি বলে মোবাইলে করা অভিমানহেতু চমক দিতে আজকে সৌরভের মনসাপোতা অভিযান। কিন্তু আটটায় পৌঁছনোর বাস যে ঝুলিয়ে এরকম সাড়ে দশটা করবে, বোঝেনি ও। অন্যসময় হলে তবু ভ্যানগাড়ি থাকে একটা দুটো।কিন্তু এখন....
  এখনকার কথা মনে করেই শিরদাঁড়া বেয়ে হিম নামলো সৌরভের। গত ছয়মাসে পাঁচজন খুন হয়েছে এই অঞ্চলে,
সকলেই গভীর রাতে। খুব সম্ভব লোকাল কোনো ডাকাতের গ্যাং। সৌরভ শুনেছে রাত্রে সবাই দল বেঁধে চলা ফেরা করে। খুব বোকার মতো কাজ হয়েছে এই সময়ে একলা এসে পড়ে।
 কি করবে এখন? হেঁটে গেলে পাক্কা পয়তাল্লিশ মিনিট, তার বেশির ভাগটাই আলো নেই। একশো দিনের কাজের দৌলতে  খানাখন্দ নেই ঠিকই, কিন্তু  দুধারে ঝোপ, ওখানে ওত পেতে কেউ বসে থাকলে বোঝার উপায় নেই।
ক্রিং ক্রিং! রিকশার বেলের শব্দটা যেন জমাট অন্ধকার চিরে আছড়ে পড়লো সৌরভের কানে। অন্ধকার ফুঁড়ে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ধরা দিলো একটু বাদেই। সৌরভকে দেখে একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলো চালক, ' যাবেন?'। এ লাইনের রিকশা সব ওই মনসাপোতার আশেপাশেই যায়, সুতরাং কোথায় জানার খুব একটা দরকার নেই।
চালকটি সৌরভেরই বয়েসী হবে। হাঁফ ছেড়ে রিকশায় উঠে পড়তে বললো, ' বাঁচালেন! একা একা ফিরতে হবে ভেবে খুব চিন্তায় ছিলাম' 
' আমিও তাই রে ভাই। দুজন হলে একটু ভরসা পাওয়া যায়। নাম কি তোমার?'
 ' আজ্ঞে, রানা। আপনি মনসাপোতাতেই নামবেন তো? আমারও ঘর ওদিকপানেই।'।
 ' হ্যাঁ, সেনবাড়ি চেনো? ওখানেই যাবো। না চিনলে কাছাকাছি এলে চিনিয়ে দিতে পারি'
   ' আজ্ঞে খুব চিনি। কদিন আগেই সেনদাদুকে নিয়ে হাটে গেছিলাম তো । আপনি ওবাড়ির ছেলে ?'
   ' একদম। সম্বিত সেন আমার দাদু। '
বলতে বলতে ওরা আলোর বৃত্ত পেরিয়ে অন্ধকারের আয়ত্ত্বে চলে এসেছে। চাঁদের আলোয় দেখতে খুব অসুবিধে নেই, তবে গা ছমছম ভাবটা এড়ানো মুশকিল। সুবিধা এটাই, রানার রিকশাতে আলো রয়েছে, গ্রামদেশে প্রায়শই টর্চ দিয়ে এ কান্ডটা করা হয়। গোরুর গাড়ির হেডলাইট মোটেই হাসির বস্তু না, রীতিমতো বাস্তব।
 ভটভট .. ভটভট.. হঠাৎই দূর থেকে আরেকটা আলো রিকশার ওপরে। একটা মোটরসাইকেল। অনেকটা পেছন থেকে এলেও, পাশ দিয়ে হুট করে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। 
কিন্তু এখানে কিছু গণ্ডগোল দেখা যাচ্ছে। কেউ যেন অসম্ভব ধীরে রিকশাটার পেছন পেছন আসছে। রাস্তার বাঁক এলে আলো সরে যাচ্ছে, কিন্তু তারপরই আবার। রিকশার সাথে মোটামুটি সত্তর আশি ফুট দূরত্ত্বে চলেছে বাইকটা। দু চারবার ঘুরে দেখার চেষ্টা করেছে সৌরভ আরোহীকে। আবছা হেলমেট পরা অবয়ব, তার বেশি কিছু দৃশ্যমন নয়।এসব দিকে দিনের বেলাতেই হেলমেটের বালাই থাকে না! তবে কি..?
   রানা চাপাস্বরে বলে, 'বাবু ভালো বুঝছি না। নির্ঘাত কোনো মতলবে আছে ওই বাইকটা।'
    'কি করা যায় বলো তো?  থেমে দেখবো কাছে আসে কিনা?'
 'না বাবু, আমরা যা ভাবছি তা ঠিক হলে ওর কাছে হাতিয়ার থাকবে। সামনেই বটতলার মাঠ। ওখান থেকে একটা শর্ট কাট  করা যাবে। ও রাস্তাটা সবাই জানেনা।'
  'কিন্তু, এটা যদি সেই খুনীটাই হবে, ও এখনো এগিয়ে আসছে না কেন? '
   'বোধহয় দুজন আছি বলে। কিংবা সামনে কোনো স্যাঙাৎ আছে ওর। ধরে বসুন বাবু।'
    বটতলার মাঠের সামনে গোত্তা খেয়ে রানা রিকশাটাকে আচমকা পাশের পাতলা জঙ্গলে ঢুকিয়ে দিলো। বাঁক থাকায় বাইকটা তখনও এসে পৌঁছায় নি। এখানে পথ এবড়োখেবড়ো, মাঝে মাঝেই গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে গাছের ছুটকো ডাল। রানা প্রাণপণ চালাচ্ছে, অঘটনের আশঙ্কা মানুষের জোর বাড়িয়ে দেয়।একটু নিশ্চিন্তের শ্বাস ফেলছিলো সৌরভ,
বাইকটাকে ছাড়িয়ে, হঠাৎই তার মনে তিরের মতো এক সন্দেহ বিঁধে গেলো।
     ব্যাপারটা প্ল্যান নয়তো?  রানা আর ওই বাইক, একই গ্যাংয়ের অংশ নয় তো? হঠাৎ রিকশার উদয়, ভাড়া নিয়ে দর না কষেই রাজী হওয়া, আর তার পরেই বাইক, যেটা আবার ঠিক পেছন পেছন, সবই কি কাকতালীয়? মূল রাস্তা থেকে এখন সে সরে এসেছে, এখানে কেটে ফেললেও টের পেতে লোকের এক দুদিন লাগবে। 
      বলতে বলতে একটা ঝাঁকুনি খেয়ে রিকশাটা দাঁড়ালো। হিসহিসে গলায় রানা বললো, 'চেন পড়ে গেছে। অন্ধকারে একটু সময় লাগবে বাবু।' হেডলাইট বনা টর্চ নিয়ে সে উবু হয়ে বসে পড়লো। টর্চের আধাআলো পড়ে রানার মুখটা কেমন ভয়ানক দেখাচ্ছিলো, গালের কাটা দাগ, চোয়াড়ে মুখে না কাটা দাড়ি, পুরু নিচেক ঠোঁট  সৌরভের মনে  একটা চেনা চেনা ছবির কথা তুলে আনছিলো। কোথায় দেখেছে, কোথায় দেখেছে..
    বিদ্যুৎচমকের মতো মনে পড়লো, ক'মাস আগেই এই মুখ সে দেখেছে আনন্দবাজারের প্রথম পৃষ্ঠায়। রঞ্জিত! সাতটা খুন, গোটা পনেরো ডাকাতি। তিনটে পুলিশকে জখম করে আদালতের থেকে ফেরার, সেটাও ওই ছয়মাস আগেই। দাড়ি বাদ দিলে অবিকল সেই মুখ। হিম বয়ে যায় সৌরভের বুকে ।এই ভয়ঙ্কর অপরাধীর সামনে তো ও নস্যি। এমন সময় আবার .. ভট ভট ভট ভট.. দূরে সেই বাইক। ওদের ওপর আলো পড়তেই দাঁডিয়ে পড়লো দূরত্ব রেখে। 
   তক্ষুণি রানা অথবা রঞ্জিত চেন ঠিক করে উঠে প্যাডেলে উদ্দাম চাপ দিলো। শুরুর আগে একবার সৌরভের দিকে তাকালো, সেই তাকানোয় আর যাই থাক, আন্তরিকতা ছিলো না। রিকশা চলছে, পেছনে বাইক, আর একটু বাদেই নির্ঘাত ঝাঁপিয়ে পড়বে দুজনে সৌরভের ওপর। অদূরে একচিলতে আলো, কিছু লোকের নড়াচড়া, সৌরভকে ওরা নিয়ে আসছে ডাকাতদের বধ্যভূমিতে.. মা বাবা দাদু নাম্মা....
   দুম করে রিকশাটা মনসাপোতার প্রথম বাড়িটা পেরোলো। রানা রিকশাটা থামিয়ে বললো ' দাঁড়ান দেখি, বাইকটার সাথে বোঝাপড়া করে নিই।' কটা বাড়ি পেরোলেই সেনবাড়ি, চেনা জায়গায় ফিরে এসেছে সৌরভ। দেখতে দেখতে পাশে এসে দাঁড়ালো বাইকটা। হেলমেট খুলে ফেললো মাঝবয়েসী লোকটা। একগাল হেসে বললো, 'কি ভয়ই পেয়েছিলাম! এত রাত্রে রিকশা, ভাবলাম আপনারা নির্ঘাত ওই খুনীর দল, পেরোতে গেলেই কোনোভাবে ঝাঁপাবেন।'রানা খিকখিক করে হেসে বললো, ' আমি তো ভাবছিলাম এই বাবু আর আপনি ষড় করে আমাকে মারবেন, আজ নিঘঘাত গেছি।'
 সৌরভ হাসলো শুধু। সে কি ভাবছিলো সেটা আর খোলসা করলো না। এখন তার দাদু নাম্মার সাথে দেখা করার তাড়া।

পুঃ:  গল্পের রিকশাওয়ালাটিকে দলিত, সৌরভকে হিন্দু এবং বাইকচালককে মুসলিম ভাবলে আমাদের দেশের গল্পটা পেয়ে যাবেন হয়তো। খুনী কিন্তু এখনো অধরা...