শুক্রবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২

ধর্মানুভূতি সুরক্ষার তরিকা ~ লিটন চন্দ্র ভৌমিক

বাংলাস্থানে মুক্তি পেয়েছে সাড়াজাগানো বিতর্কিত মুভি 'মানুষই সর্বশক্তিমান'।

নাম শুনেই দেশব্যাপী বিক্ষোভ, দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত প্রকম্পিত।

মুভিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ: 'স্রষ্টাকে অবমাননা করা হয়েছে, মানুষকে স্রষ্টা বানানো হয়েছে'।

চারদিক উত্তাল-বিক্ষুব্ধ। মুভিটির সাথে জড়িত সবাইকে কতল করা হয়েছে।

উড়িয়ে দেয়া হয়েছে সিনেমা হল; সিডি-ডিভিডির দোকান; সকল শ্রেষ্ঠাংশে অভিনয়কারীর বাড়িঘর।

বাংলাস্থানের প্রধানমন্ত্রীসহ সকল মন্ত্রীর শ্বাসরুদ্ধকর বৈঠক।

আলোচ্য বিষয় 'জনগনের ধর্মানুভূতিতে আঘাতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা'।

প্রথমে শিল্পমন্ত্রী বললেন, সকল সিডি, ডিভিডি, মুভির সকল প্রিন্ট সরিয়ে ফেলতে। সাথে সাথে সবকিছু সরানো হল।

কিন্তু অভিযোগ উঠল ইন্টারনেটে মুভিটি ছড়িয়ে পড়ছে দাবানলের মত।

আবার বৈঠক।

এবার অর্থমন্ত্রী বললেন: গুগল দিয়া সার্চ করে; ইউটিউব দিয়া ভিডিও নামায়; ফেসবুক দিয়া মন্তব্য করে; ব্লগ দিয়া আলোচনা করে... সবগুলা বন্ধ কইরা দেন।

সব বন্ধ করা হলো।

কিন্তু বাদবাকি ইন্টারনেট উন্মুক্ত। গুগলের বিকল্প ইয়াহু বিং; ফেসবুকের বিকল্প টুইটার, গুগল প্লাসে; ইউটিউবের বিকল্প মেটাক্যাফে, জিপকাস্ট, হুলু, ডেইলী মোশানে সবাই সক্রিয়।

আবার বৈঠক। সিদ্ধান্ত হলো: গোটা ইন্টারনেট ব্যবস্থা বাংলাস্থানে বন্ধ থাকবে। বাংলাস্থান হবে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন।

আবার সমস্যা। অভিযোগ উঠল: মানুষের কম্পিউটারে ছবিটি আছে।

সিদ্ধান্ত নেয়া হলো সকল কম্পিউটার, টিভি সিজ করা হবে।

আবার অভিযোগ: সবাই মোবাইলে ছবিটি দেখছে। মানুষের বাসায় বাসায় হানা দিয়ে গুটিকয়েক মোবাইল সিজ করা হলো; বাদবাকি মোবাইল খুঁজে পাওয়া গেল না।

আবার বৈঠক। সমস্ত মোবাইল কিভাবে সিজ করা যায়? অত্যন্ত স্লিম এই যন্ত্রটির সংখ্যাগত পরিসংখ্যান নেই। এটি লুকিয়া রাখা সহজ।

ওদিকে অভিযোগ: মোবাইলের মাধ্যমে মুভিটি জনগণের অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। দাঙ্গা-হাঙ্গামা দেশজুড়ে শুরু হয়েছে। যার হাতে মোবাইল দেখছে, তাকেই খুন করছে ধর্মানুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত লোকজন।

এবার বিদ্যুৎ মন্ত্রী বললেন: দেশব্যাপী বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেন। মোবাইল থাকলেও চার্জ দিতে পারবে না। চার্জের অভাবে তারা মোবাইলে মুভিটি দেখবে না।

বন্ধ করে দেয়া হলো বিদ্যুৎ। বাংলাস্থান অন্ধকারে। তীব্র গরম, লাগাতার লোডশেডিং; চিকিৎসা, উৎপাদন-শিল্প কারখানা সব বন্ধ। সবাই মেনে নিচ্ছে, কারণ ধর্মানুভূতি তো রক্ষা পাচ্ছে।

কয়েকদিন পর আবার সমস্যা: বাংলাস্থানে ঘরে ঘরে সৌরবিদ্যুৎ। সবাই সূর্যের আলো দিয়ে মোবাইল চার্জ দেয়। চোরাই পথে ভারত বার্মা হতে ব্যাপক মোবাইল চার্জার আসতে লাগলো। অনেকে মোবাইল ব্যাটারি চার্জ দেয়ার আরো বিকল্প পদ্ধতি বের করতে লাগলো। অভিযোগ উঠেছে, আবার সবাই মুভিটি দেখছে। আবার জ্বলে উঠেছে ধর্মানুভূতি।

আবার বৈঠক। কোনো বিকল্প পথ খুঁজে পাচ্ছে না সরকার; মন্ত্রী মহোদয়রা এমনকি ধর্মমন্ত্রণালয়। বৈঠকের পর বৈঠক; আলোচনা চলছে তো চলছে; সকাল গড়িয়ে দুপুর-রাত্রি আবার সকাল আবার পরদিন সকাল। যে কোনো মুল্যে ধর্মানুভূতি রক্ষা করতে হবে। নইলে নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত।

হঠাৎ করে লাফ দিয়ে উঠলেন ধর্মমন্ত্রী, পেয়েছি পেয়েছি.....।

সবাই আনন্দে ফেটে পড়ল।

ধর্মমন্ত্রী বললো, যে চোখ দিয়ে সবাই মুভিটি দেখবে, তা খুঁচিয়ে উঠিয়ে ফেললেই তো হয়। চোখই যত সমস্যার মূল। আগামীতে আরো মুভি, চিত্র বেরোবে। মানুষের চোখ ধ্বংস করে দিলে এসব যেমন দেখতে পাবে না; তৈরিও করতে পারবে না।

সবাই স্বীকৃতি দিল; আইন পাশ হলো: ধর্মানুভূতি সুরক্ষায় চোখ নষ্ট করা হবে।

চোখ তুলতে মহাসমারোহে মাঠে নামলো সরকারের পুলিশ-আর্মি-সেনাবাহিনী আর ধর্মানুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা।

এক বছর পর বাংলাস্থানের সকল জনগণ চোখহীন। তাদের দর্শনানুভূতি সম্পূর্ণ লুপ্ত।

কোনোকিছু দেখতে হয় না বলে তাদের আর কোনো অনুভূতিতে আঘাত লাগে না।

ফলে তারা সুখ আর স্বস্তিতে থাকতে লাগল ।

শুক্রবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১২

আমার চিতার আগুনে চোখ মোছ ~ সুনীল পাল

সন্ধ্যে হয়ে এল
এবার আমায় চিতায় তোল
তারপর, চিতার আগুন তার রক্তশিখায় জ্বলতে থাকুক
এক মহান প্রতিজ্ঞা নিয়ে। 

কমরেড !
ঠিক এই সময়,
আমি ফুলের মালা, স্মৃতিসৌধ, শোকজ্ঞাপন, এসব কিছুই চাইনা
আমি চাই, 
আমার স্বপ্ন, প্রথম প্রেমের মত
জেগে থাকুক তোমাদের হৃদয়ে

আহা !!!!
মেঘমুক্ত নিরুদ্বেগ নীলাকাশ
স্বর্ণশস্য আন্দোলিত মাটির পৃথিবী
নদী ও সমূদ্রের উচ্চরোল আনন্দ সঙ্গীত
তার মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে
শত শতাব্দীর, প্রাচীন শোষণমুক্ত মানুষের
মহিমান্বিত, দীর্ঘ পদযাত্রা ।


সাতের দশকে খড়দহের কমরেড সুনীল পালের লেখা। মূল কবিতাটার নাম "আমার চিতার আগুনে চোখ মোছ"। 
কবিতাটিতে দেখানো হয়েছে কবিকে কংশাল রা শ্রেণীশত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে খতম করে। আপাদমস্তক বামপন্থী এই কবি জানতে চান "আমি ?? শ্রেণীশত্রু ?? আমার বাবা মারা গেছেন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সাথে লড়াই করতে করতে, সেই আমি শ্রেণীশত্রু ??
কিন্তু কিছুই বেরোয় না মুখ থেকে, যখন দেখেন তাঁরই বাল্যবন্ধুর হাতে ছোরা, অতিবাম রাজনীতির ছদ্মবেশে কেন্দ্রে বসে থাকা কংগ্রেসী শ্বাপদের ভাড়াটে খুনীর দল। কবি মারা যান। উপরের লাইন গুলো মারা যাবার পরের অনুভূতি।

এখানেই বিস্ময়ের শেষ নয়। এই কবিতা লেখার ঠিক দেড় বছর পর, কমরেড পাল, এই ভাবেই খুন হন। সাল ১৯৭৪, স্থান খড়দহ

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ সৌমিক দাশগুপ্ত 

বুধবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২

আজ মহোৎসব ~ অরুণাচল দত্তচৌধুরী

এই যে আমাদের আপাদ মস্তক,
ঢাকছে ঘন সাদা কুয়াশা মস্ত।

চলছি বিনোদনে জ্বলছি তর্কে ...
বলছি প্রেমকথা শূন্য ঘরকে।

খেলা তো শেষ তবু শেষের কয় দান,
স্বাস্থ্যশিকারীরা খেলছিi ময়দান!

মঞ্চে বাসুকীরা চাটছে চেরা জিভ।
মেঘের আঁচলেও তুমুল নেগেটিভ!

এই যে আমাদের আপাদ মস্তক
ভেজায় সান্ত্বনা, মিথ্যে যত স্তোক।

সহানুভুতি ভরা কথার আড়ালে ...
ঝরছে অবহেলা, সামনে দাঁড়ালে!

এই যে আমাদের, সামনে পেছনে ...
চলছে ফিসফাস, সে কথা কে শোনে?

তবুও কেউ যদি বলে তোমার কথা,
মুছেছে ... মুছে যায় ... ধূসর মলিনতা।

তোমার হিমবাহ ... তোমার তালসারি ...
তোমার নীল ঢেউয়ে ... সকাল ... লাল শাড়ি ...

আমার জাফরিতে অচেনা রোদ সব
হঠাত্ এসে বলে ... আজ মহোৎসব!

আপনাকে এই জানার আমার ~ অমিতাভ প্রামাণিক

'ও মিটু, চাড্ডি চালভাজা খাবি? আয়,' বাড়িওয়ালি ঠাকমা ডাক দিলেন ওঁদের রান্নাঘর থেকে। মা রোজ সকালে গুড় দিয়ে বাসি রুটি, নয় লেবু-চিনি দিয়ে চিঁড়ে দেয় খেতে, সে সব খেতে খেতে মুখ পচে গেছে। তার চেয়ে চালভাজা অনেক স্বাদু আর কুড়মুড়ে। বাজিতপুর থেকে ওদের ঘরে ধান আর চালের বস্তা আসে, আমি দেখেছি। ঠাকমা বালিখোলায় খই ভাজে, মুড়ি বানায়, চালভাজা বানায়। আমার মুড়ি খেতে খুব ভালো লাগে, চালভাজায় আরো বেশি স্বাদ। আমি দৌড়ে
হাঁপাতে হাঁপাতে ওদের রান্নাঘরের দালানে বসে চালভাজার বাটি হাতে নিয়ে বললাম, 'ও ঠাকমা, জানো, ইন্নান বোডে কত লোক এসেছে। কাল সন্ধ্যেবেলা তো ছিলোনা। এই লম্বা লম্বা দাড়ি ওদের। কারা গো ওরা? এখানে কেন এসেছে?'
ঠাকমা চুপ করে রইলেন, মুখটা বিরক্তি মাখা।
'ও ঠাকমা, বলোনা, ওরা কারা? তুমি দেখেছো?'
'দেখেছি, দেখেছি। ওরা মুসলমান'।
'মুসলমান কী গো ঠাকমা?'
'পাকিস্তানের লোক'।
'ও। পাকিস্তান কোথায় ঠাকমা? ওখানকার লোক এখানে এসেছে কেন? বলোনা'।
'জানিনা। তোর বাবা মাস্টার, বাবাকে জিগ্যেস করিস। এখন খা, খেয়ে পড়তে বোস'।

বাবা টিউশানির ছাত্রছাত্রী পড়াচ্ছে, তাকে এখন এসব নিয়ে বিরক্ত করা যাবে না। মা উনুন ধরাচ্ছে ফুঁ দিয়ে দিয়ে, সাদা সাদা ধোঁয়া উঠছে, ধরে গেলে ধোঁয়া চলে যাবে, তারপরে রান্না হবে, বাবা ভাত খেয়ে ইস্কুলে যাবে, মা-র হাতে এখন একদম সময় নেই। আমি বই নিয়ে পড়তে বসলাম ঠিকই, কিন্তু পড়ায় মন নেই। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাইরে ইউনিয়ন বোর্ডের মাঠে লোকগুলো ত্রিপল খাটাচ্ছে। সার্কাস পার্টি নাকি? সার্কাসের জন্যে তো অনেক বড়ো মাঠ লাগে, ইস্কুলের মাঠের মত। এই মাঠে তো বেশি লোক ধরবে না। ঠাকমা যে বললো এরা মুসলমান। সেটা কী?

সারাদিন প্রশ্নটা মনের মধ্যে ঘুরঘুর করতে লাগলো। সন্ধ্যেবেলা শ্যামলকাকু্র সাথে বারান্দায় দ্যাখা হতেই পাকড়াও করলাম। সামনেই রাস্তার ওপারে ইউনিয়ন বোর্ডে তখন অনেকগুলো ছাউনি পড়ে গেছে। সেদিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, 'শ্যামলকাকু, ওখানে যে লোকগুলো এসেছে তারা কে গো? ঠাকমা বললো ওরা নাকি মুসলমান, পাকিস্তানের লোক'।
'হুঁ', শ্যামলকাকু মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললেন, 'ঠাকমা অনেকটা ঠিকই বলেছেন মিঠুবাবু। তবে এখন আর ওটা পাকিস্তান না, বাংলাদেশ'।
'বাংলাদেশ কোথায় কাকু? আমাদের এই দেশটা বাংলাদেশ না? আমাদের ইস্কুলে যে প্রেয়ারে গান হয়, বাংলার মাটি, বাংলার জল?'
'হুম। গানটা জানো কে লিখেছেন? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যখন লিখেছিলেন, তখন একটাই বাংলা ছিল। এখন দুটো ভাগ হয়ে গেছে। একটা বাংলাদেশ, আর একটা, মানে আমাদেরটা পশ্চিমবঙ্গ, ওয়েষ্ট বেঙ্গল'।
'কেন ভাগ হয়ে গেছে কাকু? কে ভাগ করলো? ওরা কেন মুসলমান? দাড়ি আছে বলে? আমরা কেন মুসলমান না? আমার বাবা যে দাড়ি কাটে রেজার দিয়ে, না কাটলে কি বাবাও মুসলমান হয়ে যাবে? তুমি যে বললে এখন আর পাকিস্তান নেই, বাংলাদেশ, কখন পাকিস্তান ছিল?'
আমার প্রশ্নের শেষ নেই। একটা প্রশ্ন করে থেমে যাওয়ার পাত্র আমি নই। এক সময়ে যতগুলো প্রশ্ন আমার মাথায় আসবে সবগুলো হড়হড় করে বমি না করে দিলে আমার শান্তি হয় না। মা, ঠাকমা, যমুনা কাকিমা, ফুটিপিসি কেউ আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে চায় না, সবাই বলে, থাম তো বাপু, মেলা বকাস নে।

আমার ভরসা হল বাবা, বাবার অগাধ ধৈর্য। আর শ্যামলকাকু। কাকু তো শুধু প্রশ্নের উত্তর দেন সব হাসিমুখে, তাই নয়, তার সঙ্গে গিয়েগার গল্পও শোনান। কিছুদিন আগে আমাকে লাল রঙের একটা তিনচাকার সাইকেল কিনে দিয়েছেন, সামনে প্যাডেল, সেটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমি বাড়িময় ঘুরে বেড়াই। অঞ্জলিকাকিমার শরীর খারাপ। মা বলছিল ওদের ঘরে নাকি আমার একটা ভাই আসবে।
আমি আবার বলে উঠলাম, 'বলো না কাকু, পাকিস্তান কী করে বাংলাদেশ হয়ে গেল?'
কাকু বললেন, 'ভুলে গেলে মিঠুবাবু, সেই একদিন আমরা রাত্রিবেলা এখানে বসে গল্প করছিলাম। আর মোটরসাইকেলে করে একটা লোক মাইকে ঘোষণা করতে করতে চলে গেল' ...

বিদ্যুৎ চমকের মত আমার মনে পড়ে গেল সেই ঘটনা। তখনো আমার ইস্কুলে যাওয়া শুরু হয়নি। রাত্রে বারান্দায় বসে শ্যামলকাকুর গিয়েগার গল্প শুনছিলাম। অনেকেই তখন শুয়ে পড়েছে, পাড়াঘরে লোকজন বেশি রাত অবধি তো জেগে থাকে না। চারিদিক শুনশান। রাস্তায় বাতি জ্বলছে টিমটিম করে। এদিক ওদিক দু একটা নেড়িকুত্তার কুঁই কুঁই বা ঘেউ ঘেউ ছাড়া কোন শব্দ নেই। লাস্ট বাস চলে গেছে। হঠাৎ রাস্তার আলো ঝুপ করে নিভে গেল। আর একটু পরে দূর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এল। আওয়াজটা ক্রমেই বাড়তে থাকল, আর বুঝতে পারলাম মাইক নিয়ে কে একটা ঘোষণা করতে করতে এগিয়ে আসছে। খুব দ্রুত আওয়াজটা জোর হয়ে কাছে এসে গেল, আবার আস্তে হয়ে দূরেও চলে গেল। মোটরবাইকে মনে হল দুটো লোক, একজনের হাতে লাউডস্পীকারের মত একটা চোঙা, সে শুধু বলে চলেছে, লাইট নিভিয়ে দিন, লাইট নিভিয়ে দিন, লাইট নিভিয়ে দিন।

আমাদের গল্প বন্ধ হয়ে গেল। শ্যামলকাকু বললেন, 'চলো মিঠুবাবু, আমরা ঘরে গিয়ে আজ শুয়ে পড়ি। গল্পের বাকিটুকু কালকে হবে'।
আমার তো উঠে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। গল্প ছেড়ে উঠে যাওয়া যায় নাকি? কিন্তু শ্যামলকাকু উঠে চলে গেলেন আমাকে আমাদের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে। পরদিন সন্ধ্যে থেকে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে দেখি ঘটাং ঘটাং শব্দ করে বিচিত্র সব যানবাহন যাচ্ছে। গোল গোল চাকাগুলো রবারের না, সেগুলোকে ঘিরে সাইকেলের চেনের মত দেখতে কিন্তু অনেক চওড়া বেল্ট। ঐ বেল্টগুলোই রাস্তার ওপরে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে আর গাড়িগুলো এগিয়ে যাচ্ছে, চাকাগুলো মাটি স্পর্শও করছে না।
সেদিন সন্ধ্যে থেকেই সব ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। আমি শ্যামলকাকুর ঘরে এসে গেছি গল্পের বাকিটুকু শোনার জন্যে। জিগ্যেস করলাম, কাকু, কী হয়েছে বলোতো আজ?
কাকু বললেন, 'যুদ্ধ লেগে গ্যাছে। দেখলে না, রাস্তা দিয়ে ট্যাঙ্ক যাচ্ছে'।
'ট্যাঙ্ক কোথায় যাচ্ছে কাকু? কোথায় যুদ্ধ? ওর মধ্যে কারা আছে?'
'ওর মধ্যে আছে সৈন্য। ওরাই তো যাচ্ছে যুদ্ধ করতে। শত্রুরা যাতে জানতে না পারে যে ওরা এই পথ দিয়ে যাচ্ছে, তাই কাল বলে গেল, লাইট নেভাও। লাইটে তো ওরা দেখে ফেলতে পারে, তাই না?'
আমার কাছে তখন যুদ্ধ মানেই রামায়ণ-মহাভারত। আমি শ্যামলকাকুকে জিজ্ঞেস করলাম, 'কার সাথে কার যুদ্ধ কাকু? ওদের কত অক্ষৌহিণী সৈন্য আছে? বাঁদরও আছে নাকি? কদিন আগে মা বড়ি শুকাতে দিয়েছিল রোদে, জানো কতগুলো বাঁদর এসে খেয়ে গেছে, ওরা কেন যুদ্ধে যাচ্ছে না?'
কাকু বললেন, 'না, এটা তো পুরাণের গল্পের মত যুদ্ধ না। তোমাকে নেতাজী সুভাষের গল্প বললাম যে সেদিন। সেই যে নেতাজী ছদ্মবেশ ধরে দেশ থেকে বিদেশ চলে গেলেন, তারপর বিদেশ থেকে সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসে ব্রিটিশের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন, এটাও সেই রকম স্বাধীনতার যুদ্ধ। আমাদের পাশের যে দেশ, ওখানকার মানুষেরা চায় স্বাধীনতা। তাই তারা যুদ্ধ করছে'।

... সেই ঘটনা, সেই পুরনো সংলাপ, মাত্র এক দেড় বছরের পুরনো, আমার সব মনে পড়ে গেল। আমি বললাম, 'ও, সেই ট্রাঙ্ক দিয়ে যুদ্ধ করলো ওরা, আর তারপর জিতে গিয়ে স্বাধীন হয়ে ওরা বাংলাদেশ হয়ে গেল?'
'হুম, ঠিক। তবে ট্রাঙ্ক না, ওগুলোকে বলে ট্যাঙ্ক'।
'ওহো, তাই তো। ট্রাঙ্ক মানে তো হাতির শুঁড়, না কাকু? তো ঐ বাংলাদেশের মানুষ এখানে কেন এসেছে?'
'কেন এসেছে, তা তো জানি না মিঠুবাবু। যুদ্ধে তো শুধু সৈন্যরাই মারা যায় না, অনেক নিরীহ মানুষও মারা যায়। ওদেরও হয়তো কেউ কেউ মারা গেছে। হয়তো তারাই চাষবাস বা চাকরি বাকরি করত। তাছাড়া রেডিওতে শুনেছ নিশ্চয় যে, আমাদের এখানে যখন ঝড় তুফান হয়, অনেক সময় ওখানে সেগুলো আরো বড়ো আকারে হয়। অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয় মানুষের। তখন জীবনধারণের জন্যে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় উঠে যেতেই হয়। এই যে আমরা, তোমার বাবা, আমি আমরাও তো বড়ো হয়েছি অন্য জায়গায়, এখন চাকরির জন্যে এখানে চলে এসেছি। আমাদের বাবা মা-রা তো কেউ এখানে থাকেন নি'।

কেন জানি না, আমাদের সঙ্গে ওদের আমি ঠিক মেলাতে পারলাম না। সারাদিন রোদের মধ্যে ওরা ত্রিপল টাঙাচ্ছিল। মেয়েরাও ছিল ওদের মধ্যে, অজন্তা কুঠির গায়ে হেলান দিয়ে বসে। সঙ্গে অনেকগুলো বাচ্চাও। শ্যামলকাকু ওরকম করে রোদের মধ্যে ত্রিপল টাঙাতে পারবেন? অঞ্জলিকাকিমা ঐভাবে মাঠের মধ্যে পা ছড়িয়ে বসে, যাঃ, হতেই পারে না। আমার মা যেখানে সেখানে বসে পড়তে পারে, একগাদা গোবর হাত দিয়ে চটকায়, কিন্তু অঞ্জলিকাকিমা অনেক অন্যরকম। ওদের ঘরে বিছানাটা কী পরিপাটি। অঞ্জলিকাকিমা স্নো মাখেন, তা থেকে কী সুন্দর গন্ধ বেরোয়।

মাঠ জবরদখল হয়ে যাওয়ায় পাড়ার বাচ্চাকাচ্চাদের মাথায় হাত। ডাঙ্গুলি খেলার জায়গা নেই। মাঠের মধ্যে সাত আটটা ছাউনি, তার মধ্যে গাদা গুচ্ছের লোক। কে যেন মাকে বলছিল, 'আর বলবেন না বৌদি, হেগে মুতে ছিরকুট করে রেখেছে'।

আমাদের প্রাইমারী স্কুলে ক্লাশ ওয়ান আর টু সকালে ক্লাশ হয়, ওদের ছুটি হয়ে গেলে থ্রী-ফোর। আমি স্কুলে যাই বাবা চলে যাওয়ার অনেক পরে। সপ্তাখানেক পর একদিন সকালে বাবা বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে, রাস্তায় চার-পাঁচটা পুলিশ। ওদের সঙ্গে কথা বলছে একটা সবুজ লুঙি পরা লোক, তার লম্বা দাড়ি। নিশ্চয় ইউনিয়ন বোর্ডে যারা আস্তানা গেড়েছে, তাদের কেউ। লোকটা পুলিশকে কিছু বললো, আর পুলিশটা একটা ডান্ডা দিয়ে ফটাস করে ওর মাথায় মারলো। লোকটা মাথা চেপে বসে পড়লো মাটিতে, আর পুলিশটা ওর পেটে মারলো এক লাথি। আমি দূর থেকে ওর করুণ আর্তনাদ শুনতে পেলাম।
একা একা আমার বাইরে যাওয়া বারণ, আমি দৌড়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে মাকে খুঁজতে লাগলাম। কোথাও খুঁজে না পেয়ে গেলাম পাশের ঘরে। শ্যামলকাকু কলেজে চলে গেছেন, অঞ্জলিকাকিমা শুয়ে। ওকে ডিস্টার্ব করা ঠিক হবে না ভেবে ভেতর বাড়িতে গিয়ে দেখতে পেলাম বাড়িওয়ালা দাদুকে। 'ও দাদু, শীগগির দেখবে চলো, পুলিশে একটা মুসলমান লোককে কী মার মারছে। ঐ যে মাঠে যারা এসেছে, ওদের লোক। ওকে কেন মারছে দাদু, ও কী করেছে? তুমি যাও না, পুলিশটাকে বলো না ওকে না মারতে। ও দাদু...'
'আমি জানি না দাদুভাই ও কী করেছে। আমার কথা কি পুলিশ শুনবে? শুনবে না'।

দাদু আমার কথা শুনেও উঠলো না। আমি আবার ফিরে এলাম আমার ঘরের জানলার কাছে। এর মধ্যেই পুলিশগুলো চলে গেছে গাড়ি নিয়ে। মাটিতে পড়ে কাতরানো সেই লুঙিপরা লোকটাকেও আর দেখতে পেলাম না।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ইউনিয়ন বোর্ডের মাঠ ফাঁকা। একটা মানুষও নেই, নেই একটা ত্রিপলও। যে রকম ভোজবাজির মত ওরা এসে হাজির হয়েছিল, সে রকমই যেন উবে গেছে দৃশ্যপট থেকে।

এই যে একটু আগে আমাদের গ্রাম মাজদিয়াকে অজ পাড়াগাঁ বললাম, এটা নিতান্তই বাড়িয়ে বলা। পারিপার্শ্বিক আর গ্রামগুলোর তুলনায় মাজদিয়া বেশ বর্ধিষ্ণু জনপদ। ট্রেনে চেপে সোজা কলকাতা চলে যাওয়া যায়। যদিও আমাদের এখানে কয়লার ইঞ্জিনের ট্রেন, ঢিকুস ঢিকুস করতে করতে চলে আর কথায় কথায় দাঁড়িয়ে পড়ে, তবু কোনোমতে রাণাঘাট পেরোলেই ইলেক্ট্রিক, আর হুশ করে আর দু'ঘন্টায় শিয়ালদা। আমি অবশ্য ট্রেনে তখনো বেশিদূর যাইনি, বাবা মা-র
সঙ্গে রাণাঘাট হয়ে একবারই গেছি তাহেরপুর, সেখানে জ্যাঠামশাই আর ছোটকাকা থাকে। কিন্তু জিতেনকাকু কলকাতার কাছেই কোথায় চাকরি করেন, উনি তো রোজ সকালে উঠে ট্রেনে করে যান, রাত্রে বাড়ি ফেরেন। বাবা বলছিল, ইংরেজরা প্রথম ভারতবর্ষে যে রেললাইন পাতে, সেটা ছিল বোম্বে থেকে পুনা, আর দ্বিতীয়টাই আমাদের এইটা। ফরাক্কায় গঙ্গার ওপর ব্রিজ বানানোর আগে উত্তরবঙ্গমুখী সব ট্রেন এই লাইন দিয়েই যেত। আমার জন্মের কাছাকাছি কোন সময়ে দার্জিলিং মেল আর ঢাকা মেল একই লাইনে এসে প্রবল অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল মাজদিয়াতেই, বহু লোক মারা গেছিল, সে কাহিনী অনেকেই জানে। পরে জেনেছি এই ট্রেনপথে রবীন্দ্রনাথও গেছেন, তাঁর 'নৌকাডুবি' উপন্যাসে বগুলা ষ্টেশনের কথা লেখা আছে। মাজদিয়ার পরের প্ল্যাটফর্মওয়ালা ষ্টেশনই তো বগুলা। 'আসামী হাজির', 'সাহেব বিবি গোলাম' খ্যাত ঔপন্যাসিক বিমল মিত্রের পৈতৃক ভিটেবাড়ি কাছেই ভাজনঘাট গ্রামে, উনি এই ট্রেনে যাতায়াত করতেন, আর বাড়ি ফেরার পথে ষ্টেশনের কাছে ভীমের দোকানের সন্দেশ খেতেন, লেখা আছে তার লেখা গল্পেই। ভীমের দোকান থেকে তো বাবাও মিষ্টি কেনে।

আর এই বাস চলার জন্যে যশোর রোড। আমাদের বাড়ির সামনে থেকে বাস ধরলে চলে যাওয়া যায় কৃষ্ণনগর, সেখানে আমার মামার বাড়ি। পুজো আর গরমের ছুটিতে সেখানেই যাওয়া। তারপর প্রাইমারী স্কুল আছে, যেখানে আমি পড়ি। হাই স্কুল আছে তার পাশেই, ইংরেজ আমলে বানানো, সেখানে বাবা পড়ায়। একটা কলেজ আছে, শ্যামলকাকু-মানসকাকু সেখানে অধ্যাপক। রেল ষ্টেশনের কাছে একটা সিনেমাহল, তার নাম চিত্রবাণী, সেখানে সিনেমা দেখা যায়, দিনে তিনটে শো। নতুন সিনেমা এলেই রিকশা করে একটা লোক মাইক হাতে বলতে বলতে যায়, আজ থেকে চিত্রবাণী সিনেমার রূপালি পর্দায় সগৌরবে চলিতেছে নাচে-গানে ভরপুর অশ্রুসজল সামাজিক ছবি চাওয়া পাওয়া। শ্রেষ্ঠাংশে অভিনয় করেছেন মহানায়ক উত্তমকুমার ও সুন্দরী অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন। অন্যান্য মুখ্য ভূমিকায় রয়েছেন বিকাশ রায়, জহর রায়, কালী ব্যানার্জী, পাহাড়ী সান্যাল ও আরো অনেকে। নৃত্যে বোম্বের অতিথি শিল্পী মিস জোজো। এই 'মিস জোজো'টা দুবার বলতো। আর বাকি সব চলিত ভাষায় বললেও 'চলিতেছে'টা সাধুভাষা। রাস্তা দিয়ে চলে যেত সেই রিকশা, বারোটা-তিনটে, তিনটে-ছ'টা, ছ'টা-ন'টায় শো বলতে বলতে। তার পেছনে ছুটে ছুটে যেত একগাদা কাচ্চাবাচ্চার দল।

তাহেরপুরে সেই যে জ্যাঠামশাই আর কাকার বাড়ি গেছিলাম, সে তুলনায় আমাদের মাজদিয়া তো স্বর্গ। সেখানে কিছুই নেই এসব, পাকা রাস্তাও নেই। আমাদের অনেকটা রাস্তা গরুর গাড়িতে যেতে হয়েছিল। আমাদের এখানে রিকশা চলে। শুধু ডাক্তার-বদ্যির যা অভাব। ইস্কুলের কাছে একটা হোমিওপ্যাথি ডাক্তারখানা, সেখানে মা আমাকে নিয়ে যায় শরীর খারাপ হলে। ঐ ডাক্তারটা মাকে 'মা' বলে ডাকেন, আর আমার হাতের নাড়ি টিপে ধরে চোখ বন্ধ করে অনেকক্ষণ ধরে দ্যাখেন। তারপর একটা সুটকেসের মত বাক্স খুলে ওষুধ বের করে কয়েকটা গুলির পুরিয়া বানিয়ে মার হাতে দ্যান। রেলষ্টেশন পেরিয়ে আর একটু গেলে ননী লাহিড়ীর ডাক্তারখানা, উনিই একমাত্র অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার এ অঞ্চলে। খুব রাশভারি লোক, কথায় কথায় রোগীদের গালমন্দ করেন। আমি দু'একবার গেছি, বোতল নিয়ে যেতে হয় ওখানে। উনি মিকচার বানিয়ে বোতলে ঢেলে দেন, আর গঁদের আঠা দিয়ে বোতলের গায়ে একটা খাঁজকাটা কাগজ সেঁটে দেন। ওই কাগজের খাঁজ অনুযায়ী এক একবারে এক এক দাগ খেতে হবে। কেমন বোঁটকা গন্ধ ওর ওষুধে, আর ভীষণ তেতো। আমার একটুও ভাল লাগেনা অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খেতে। এর চেয়ে হোমিওপ্যাথির গুলি অনেক ভালো।

সকালে ছাত্র পড়িয়ে বাবা যখন খেতে বসে, আমিও বাবার পাশেই বসে পড়ি। বাবা চটপট খেয়ে স্কুলে চলে যায়, আমার ততক্ষণে দু তিন গ্রাস মাত্র ভাত মুখে উঠেছে। বাবা স্কুল চলে গেলে বাবার পাতেই মা খেতে বসে যায়। মা'র খাওয়া শেষ হয়ে গেলেও আমার তখনো প্রায় সবই পাতে পড়ে। আমাকে খাওয়ানো নিয়ে মা নাজেহাল হয়ে যায়। কিন্তু যত সময়ই লাগুক, খাবার নষ্ট করা চলবে না, সব শেষ করে আমাকে তবে উঠতে হবে।

বাড়ির বাইরে অবশ্য আমার চেহারা একটু অন্যরকম। যশোর রোডে বাস চললেও খুব ঘনঘন নয়। একটা বাস চলে গেলে পরেরটা অন্তত আধঘন্টা পরে। সাইকেল আর রিকশাই বেশি, তবে বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার জন্যে কখনোই বিপজ্জনক নয়। আমি প্রথম প্রথম অন্য কারো সঙ্গে একসাথে যেতাম। ছোটি পরীক্ষায় ফেল করে এখনো নীচু ক্লাশে পড়ে, ওদের স্কুল সকালে। আমারটা পরে শুরু হয়, আমি একা একাই চলে যেতে পারি। পায়ে যে চটি পরে স্কুলে যাই, সেটার একপাটি পা দিয়ে ছুঁড়ে দিই আগে। হেঁটে সেটার কাছে পৌঁছে গেলে সেটা পরে নিয়ে অন্য পাটিটা একই রকমভাবে ছুঁড়ে দিই। ফলে একপাটি চটি সবসময় আমার আগে আগে চলে। এই রকম যেতে যেতে কখনো সেটা পড়ে যায় রাস্তার কোন জল জমা গর্তে, বা কাদায়। রাস্তায় ঘষা লেগে ছিঁড়েও যায়। চারমাসে তিনবার চটি পালটানো হয়ে গেল। মা আর কত চটি কিনে দেবে? আমি এর পর থেকে খালি পায়েই স্কুলে যেতে লাগলাম।

এক এক দিন স্কুলে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে আমার মনে পড়ে যেত, কোন একটা হোমটাস্ক করা হয়নি। তখন আর করার সময়ও নেই। আমি কেঁদে বাড়ি মাথায় করতাম। স্কুলে না যাওয়ার বাহানা শুরু হয়ে যেত। মা কিন্তু এ ব্যাপারে ভয়ঙ্কর কঠোর, যাই করো, স্কুলে যেতেই হবে। আমি মা'কে টানতে টানতে নিয়ে যেতাম সেদিন, স্যারকে বলে দেওয়ার জন্যে, যে আমার হোমটাস্ক হয়নি। কোন দরকার ছিল না, প্রাইমারীতে আমার মেধার জন্যে না হলেও চেহারার জন্যে গায়ে কেউ হাত তুলতেন না। তবুও এ রকম মাঝে মাঝেই হত।

কারো সাথে মিশতে পারতাম না, সবাইকে ক্লাশে কানমলা দিতে হত, ফলতঃ আমার কোনো বন্ধু ছিল না। ক্লাশের পান্ডা বরুণ, সে অলরেডি বার দুয়েক ফেল করে ক্লাশে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে, আমাকে একদিন বললো, ভগবান দেখবি?

ইউনিয়ন বোর্ডের মাঠে দুর্গাপুজো-কালীপুজো হয়, কিন্তু এখন তো পুজোর সময় নয়। আমি বরুণকে বললাম, এখন কী পুজো?
বরুণ বললো, 'পুজো না। আমি জানি, কী করে ভগবান দেখা যায়। দেখবি?'
'দ্যাখা'।

'এখানে কোথায় দ্যাখাবো? ইস্কুলে ভগবান দ্যাখা যায় নাকি? আর সবার সামনে ভগবান কখনো আসে না। শোন, বাড়িতে এক নিরিবিলি জায়গায় চুপিচুপি যাবি যেখানে কেউ দেখতে না পায়। একটা শুকনো গামছা নিবি সঙ্গে। তারপর ঐখানে গিয়ে ওই গামছাটা দিয়ে একশো আটবার কপালে ঘষবি, আর প্রতিবার 'হরেকৃষ্ণ হরেরাম, দ্যাখা দাও ভগবান' এইটা বলবি। বুঝলি? ভালো করে চেপে ঘষতে হবে'।
'তাহলে কী হবে?'
'তোর কপালে একটা চোখ খুলে যাবে, সেটা দিয়ে ভগবান দেখতে পাবি। কী বলতে হবে মনে থাকবে?'
'হ্যাঁ, হ্যাঁ'। আমি মনে মনে শ্লোকটা একবার স্মরণ করে নিলাম। এর চেয়ে কত বড় বড় পদ্য আমি গড়গড়িয়ে বলতে পারি আমি। বীরপুরুষ মুখস্ত। আর এই একলাইন মনে রাখতে পারবো না? এরা পারে না বলেই তো আমার কাছে কানমলা খায়।
'কতবার বলবি, মনে আছে?'
'একশো আটবার'।

আমার তৃতীয় নয়ন দেখে মা শিউরে উঠলো। 'এটা কী করে হল? পড়ে গেছিলি কোথাও?'

একশো আটবার ঘষে কপাল ছিঁড়ে যাবার পর আমি চোখে সর্ষেফুল দেখলাম, কিন্তু ওটাকে ভগবান বলে মেনে নিতে পারিনি। তাই ভাবছিলাম গুণতিতে কি ভুল হল? মন্ত্র তো ঠিকই বলেছি, ওই সামান্য পাঁচটা শব্দ, ওর আর কী ভুল হবে। তাই আরো বার পঁচিশেক এক্সট্রা ঘষে যখন দেখলাম আর ঘষা যাচ্ছে না মোটেই, গামছাটা ছোঁয়ালেই ভীষণ ব্যথা লাগছে, তখন রণে ভঙ্গ দিলাম। ততক্ষণে বুঝে গেছি বরুণ আমায় ঠকিয়েছে। কিন্তু মাকে তো আর বলা যায়না আমি ঠকেছি।

মা কিন্তু ডিটেকটিভ। আমার মুখ থেকে কী করে কথা টেনে বের করতে হয়, তার পুরো ফর্মুলা মা'র জানা। ফলে গড়গড় করে সব বলে ফেলতেই হল। মায় সেই অকুস্থলের কথা, যেখানে গিয়ে কম্মোটি করেছি। খুকুদের ঘরের সিঁড়ির নীচে কয়লার গাদা থাকে, ওখানে সকালে ছাড়া কেউ যায় না। ওটাকেই উপযুক্ত মনে হয়েছিল আমার।
কপালে দগদগে ঘা হয়ে গেল। যমুনা কাকিমা গরম জলে ধুয়ে অ্যান্টিব্যাক্ট্রিন লাগিয়ে দিতেন বেশ কিছু দিন।

এর পর বরুণকে কানমলা দিতে হলে আমি বেশ জোরে জোরে দিতাম। ওর অবশ্য তাতে কিছু যেত আসতো না। ততদিনে ও ঐ ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু অন্ততঃ কিছুটা অপমান যে হত, সেটা জানতে পারলাম আরো মাস ছয়েক পরে।

দুষ্টুবুদ্ধি থাকলেও বরুণের ক্রিয়েটিভিটি কম। স্কুলে ও আবার আমাকে ফাঁদে ফেলার জন্যে বললো, 'ভগবান দেখবি?'

আমি কি আর সেই ফাঁদে পড়ি? বললাম, 'শুকনো গামছা দিয়ে একশো আট বার ঘষা তো? নাঃ, তুই দ্যাখ'।

'না রে, ওটা না। ওটা তো একটা ঠাট্টা ছিল। তুই করেছিলি নাকি? দেখি দেখি, ও এই তো, তোর কপালে দাগ। আরে, আমি তো তখন ঠাট্টা করেছিলাম'।
'তাহলে? কী করলে ভগবান দ্যাখা যায়? বাড়িতে নিরিবিলি জায়গা খুঁজে ছুরি দিয়ে হাত কাটলে?'

'না, না, ওসব কিছু করতে হবে না। এতো কষ্ট না। আমি এখানেই দ্যাখাতে পারি'।

'তো দ্যাখা'।

বরুণ ওর দু'হাত দিয়ে আমার দু'হাত ধরে দু'তিনবার আস্তে আস্তে ঘুরপাক খেলো। তারপর স্পীড বাড়িয়ে আমাকে জোরে বাঁইবাঁই করে ঘুরাতে লাগলো। আমার পা দুটো শূন্যে উঠে গেল। এভাবে দশ বারো বা তারো বেশি রাউন্ড ঘুরিয়ে ও হঠাৎ আমার হাত দিলো ছেড়ে। আমি দূরে গিয়ে ছিটকে পড়লাম। একটা পাথরের টুকরোয় আমার মাথাটা ঠুকে গেল। আশেপাশে সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও সঙ্গে সঙ্গে আমাকে মাটি থেকে তুলতে ছুটে এলো। মাথায় হাত দিয়ে যেই দেখলো টপটপ করে রক্ত পড়ছে, অমনি সব পগার পার।

মা সন্ধ্যেবেলায় ব্যান্ডেজ বাঁধা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, 'তুই এত বোকা কেন রে মিঠু? এত যে পড়া পারিস, সবাই তোর কত প্রশংসা করে, আর তুই বোকার মত ভগবান দেখতে যাস বারে বারে। যে যা বলে তাই বিশ্বাস করে ঠকিস'।

আমার জ্বর এসে গেছিলো। শরীরের কিছু বেকায়দা হলেই আমার জ্বর এসে যায়। মাথায় প্রবল ব্যথা। কপাল দপদপ করছে। তার মধ্যে মা'র ঐ কথা আমার কানে দৈববাণীর মত লাগলো। আমি দুটো জিনিষ হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছি এতদিনে। ভগবান বলে কিছু নেই, সব ধোঁকা। আর মা ঠিক বলেছে। আমি অন্যের কথা শুনে আর কিছুতেই চলবো না। যে যা বলে বলুক, আমি আমার যা ঠিক মনে হবে, তাই করবো এখন থেকে।

মঙ্গলবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২

ইস্কুল ~ অমিতাভ প্রামাণিক

বাচ্চারা কেন স্কুলে যায়? রবীন্দ্রনাথ কেন বেশিদিন যাননি, সে তো আমরা জানি। অন্যরা কেন যায়? ওঁর মত বিদ্রোহ করতে পারে না বলে?

আমার স্কুলে যাওয়ার গল্পটাও বেশ মজার। মানে যতটুকু মনে আছে, বাকিটা মা-র আর অন্যান্যদের মুখে শোনা। 

আমি খুব সরল সাদাসিধে বাচ্চা ছিলাম না তো। ঘ্যানঘ্যানানি লেগে থাকতো খুব। আর থাকবে নাই বা কেন? আমার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল একেবারে শূন্য। ফলতঃ একের পর এক রোগ লেগেই থাকতো আমার। একটু ঠা
ন্ডা পড়লেই আমার অবধারিত নিউমোনিয়া, সেটার থেকে ব্রঙ্কাইটিস, তা থেকে হুপিং কাশি। এখন হুপিং কাফ রোগটা আর দেখি না, এমনকি ছোটখাটো ডাক্তারের কাছেও নেবুলাইজার বলে একটা মেশিন থাকে, লাগিয়ে দিলেই কাশির দমক কমে যায় অনেক। আমার তো কাশতে কাশতে ফুসফুসটাই প্রায় গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতো, থামতোই না কাশি। সেটা কোনক্রমে ম্যানেজ হয়ে গেলেই প্রবল ডাইরিয়া শুরু হতো, তার পরে টাইফয়েড। ডাক্তার টাইফয়েডের মিক্‌চার দিতো, সেটা খেয়ে দুদিন পরে গেলে বলতো, না হে, মনে হচ্ছে জন্ডিস।

বস্তুতঃ পোলিও আর রিকেট – এই দুটো রোগ ছাড়া আর বাচ্চাদের বাকি যা যা রোগ হতে পারে, সেই সবকিছু হয়েছে আমার বারো-তেরো বছর বয়স অবধি। চেহারাটা ছিলো সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষপীড়িত বাচ্চাদের মত, বন্ধুরা বলতো ঝ্যাঁটার কাঠির মাথায় ভাটাম ফল। পেট ভর্তি পিলে, পটলডাঙার প্যালারামের চেয়ে অনেক বেশি বড়। কালমেঘের বড়ি, বাসক পাতার রস, চুনের জল, কচি খেজুর চারার শিকড়, আখের গুড় দিয়ে কাঁচা হলুদ - সব ফেল মেরে গেছে পিলে কমাতে। বাচ্চারা যখন লুকোচুরি, হুশ-হুশ, এক্কা-দোক্কা, কিরিং-কিরিং, হা-ডু-ডু এসব খেলতো, আমি জুলজুল করে ডাকঘরের অমলের মতন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতাম।

খুব বেশিদিন যে আমি টানতে পারবো, এ বিশ্বাস প্রায় কারো ছিল না। পাড়ায় ডাক্তার নেই বললেই চলে, হোমিওপ্যাথি গুলি খেয়ে যা হয় তাই ভরসা। এক এক সন্ধ্যেবেলা আমার পেট ফুলতে শুরু করতো। তখন পেট ঠান্ডা করার জন্যে - না, বরফ নয়, বরফ কোথায় পাবে - পুকুরের পাঁক তুলে এনে পেটের ওপর চাপানো হত। তাতেও ফোলা না কমলে বেশি রাত্রে হোমিওপ্যাথি ডাক্তারকে হয়তো তলব করা হত, তিনি তাঁর মোক্ষম অস্ত্রটি পরীক্ষা করতেন আমার ওপর। ব্যর্থ হয়ে 'সবই তাঁর ইচ্ছা, ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখো' টাইপের একটা আশ্বাসবাণী শুনিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বাড়ি ফিরে যেতেন। আমার পেটের ওপর তখন পাঁকের পুরু চাদর, তার ওপর টপটপ করে ঝরে পড়তো মায়ের চোখের জল।

এখন হাসি পায়, যখন শুনি কেউ অসুস্থ হয়ে বড়ো হাসপাতালে গেল, আর বিভিন্ন অত্যাধুনিক চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে 'ফাইটার' খেতাব পেয়ে গেল। আমি জ্ঞানতঃ রোগ সারানোর জন্যে কোন ফাইট করতাম না। বেশি ঘ্যানঘ্যান করলে মা মাঝেমাঝে রেগে গিয়ে আমাকে যে বলতো 'যমের অরুচি', সেটাই বোধ হয় একের পর এক এইসব মারণব্যাধি থেকে ন্যূনতম চিকিৎসায় আমার বেঁচে যাওয়ার একমাত্র কারণ। 

পড়াশুনার কথা বলবো বলে রোগব্যাধি নিয়ে এই যে সাতকাহন শুনাচ্ছি, তার একটাই কারণ, একেবারে অন্যরকম ছিল আমার জগত। আমরা তখন ভাড়াবাড়িতে থাকতাম। আমাদের একটাই শোবার ঘর, তাতে দুটো তক্তাপোষ পাতা। আর একটা রান্নাঘর। বাড়িওয়ালা সীতানাথ বিশ্বাসকে আমি দাদু ডাকতাম। তিনি অবস্থাপন্ন মানুষ, ব্যবসা করেন, কাছে বাজিতপুর গ্রামে তার জমিজমাও আছে। একটা ছোট উঠোনের তিনপাশ ঘিরে অনেকগুলো গায়ে লাগা ঘর, তাতে তিন-চারটে ভাড়াটে। বাকি ঘরগুলো তার নিজের পরিবারের বসবাসের জন্যে। উঠোনের মধ্যে একটা শান-বাঁধানো টিউব-ওয়েল, সেখানে জামাকাপড় কাচাকাচি হত, বাসন ধোয়া হত, পুরুষরা সেখানেই স্নান করতো। পাশে একটা ঘেরা কমন বাথরুম, শুধু মহিলাদের জন্যে। একদিকে সারি দেওয়া তিনটে পায়খানা, যেটা খালি পাওয়া যায়, সেটাই ব্যবহার করতে হত।

সেই দাদুর স্ত্রীকে আমি ঠাকমা বলতাম, আর আমার মা তাঁকে মা বলেই ডাকতো। তার দুই ছেলে জিতেনকাকু আর শৈলেনকাকু, আর এক মেয়ে ফুটিপিসি। জিতেনকাকু আর যমুনা কাকিমার মেয়ে খুকু আর ছেলে সৌমেন আমার বোনের চেয়ে অল্প ছোট। শৈলেনকাকু আর ফুটিপিসি দুজনাই স্কুলে আমার বাবার স্টুডেন্ট ছিল। আমাদের পাশের ঘরের ভাড়াটে ছিলেন শ্যামলকাকু, উনি মাজদিয়া কলেজে পড়াতেন। উনি আর ওঁর স্ত্রী অঞ্জলিকাকিমার মত নরম মনের মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। মাঝে মাঝে তাদের ঘরে আড্ডার জন্যে হানা দিতেন ওঁর সহকর্মী মানসকাকু, তিনিও খুব মজাদার মানুষ। শ্যামলকাকুর, আমাদের আর জিতেনকাকুর শোবার ঘর পাশাপাশি, দরজা খুললেই সামনে টানা বারান্দা। তার সামনে একফালি জমি, দশ বারো পা পেরোলেই মেন রাস্তা, যশোর রোড, কলকাতার উপকন্ঠ থেকে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেছে অধুনা বাংলাদেশের ভিতর।

যখন রোগে বিছানায় শুয়ে থাকতাম না, সেই বিরল কিছু রাত্রে নৈশাহারের পর সামনের বারান্দায় বসে শ্যামলকাকু আমাকে দেশ-বিদেশের গল্প শোনাতেন। ওঁর গল্প বলার একটা মনোমুগ্ধকর ধরণ ছিল। কথার মাঝে স্বর উচ্চনীচ করে আর বিরতি দিয়ে দিয়ে একটা দারুণ আবহ তৈরী করতেন, তাতে গল্প শোনার উৎসাহ অনেক বেড়ে যেত। আর কেউ কেউ যেমন কথার মাঝে মুদ্রাদোষের মত ব্যবহার করে 'তোমার ধর গিয়ে', 'এই হল গিয়ে ব্যাপার', উনি বলতেন 'গিয়ে গা'। আমি তাই মাঝে মাঝেই বায়না ধরতাম, 'কাকু, আমাকে গিয়েগার গল্প বলো'। পায়েস জাতীয় ঘন দুধের কোন খাবার আমার পেটে সহ্য হত না বলে ঘটা করে জন্মদিন পালন ছিল অনাবশ্যক। তবু উনি আমাকে কখনো কখনো কিছু কিছু বই উপহার দিতেন। উপেন্দ্রকিশোরের টুনটুনির গল্প আর ছোটদের রামায়ণ, ছোটদের মহাভারত দিয়ে আমার কল্পজগতে প্রবেশ হয় সেই সময়ে।

বাবা স্কুলে খুব কড়া শিক্ষক ছিল, আর বাড়িতে টিউশানি করত। সেই সময়, যখন আমি খুব ছোট, বাবা বাড়িতে হায়ার সেকেন্ডারির ছাত্রদের কমার্সের বুক-কীপিং শেখাত। জার্নাল-লেজার-ট্রায়াল ব্যালেন্স-গোল্ডেন রুল্‌স্‌ অফ ডেবিট অ্যান্ড ক্রেডিট-প্রফিট অ্যান্ড লস অ্যাকাউন্ট এইসব আকছার শুনতে পেতাম সেই টিউশানির জায়গা থেকে। আর কেউ ভুল বললেই ধুপধাপ পিঠে পড়তো বাবার কিল। ছাত্ররা বাবার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত। আমার অবশ্য তখন বাবাকে ভয় পাওয়া উচিৎ, না সমীহ করা, সে সম্বন্ধে ধ্যানজ্ঞান তৈরী হয়নি।

অনেক সকালে ঘুম থেকে তুলে আমাকে পাশে শুইয়ে বাবা আমাকে মুখে মুখে সহজ পাটিগণিত আর ইংরাজী গ্রামার-ট্রানস্লেশন শেখাত। বাংলা ইংরাজী অক্ষরপরিচয় এর মধ্যেই কখন হয়ে গেছে। বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় বা রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠ চোখে দেখার আগেই। তাই এক বছর সরস্বতীপুজোর সময় বাবা যখন স্কুলের সহকর্মী ভবানীবাবুকে ধরলেন আমাকে হাতেখড়ি দেওয়ানোর জন্যে, আর ভবানীজ্যেঠু আমার হাত ধরে স্লেটের ওপর গোটা গোটা করে লিখলেন 'অ', আমি বললাম, অ এ রকম না, এই রকম হবে। আমার বাবার হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর, ক্যালিগ্রাফির মত। কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং লেখা তাই আমার ছিল বিলকুল না পসন্দ।

আমাদের ভাড়াবাড়ির পাশে এক সরু গলি দিয়ে একটু গেলেই একটা বাড়ি, সেই বাড়ির দুটো মেয়ে তখন প্রাইমারী স্কুলে পড়ে। ওদের ছোটটার নাম ঘুম, আর বড়োটার নাম ছোটি। ঘুম ছিল একেবারে টমবয় ধরণের, ছেলেদের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করে হারিয়ে দিত। ওদের ভাই সন্টু প্রায় আমার সমবয়েসী, সে তখনো স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। প্রাইমারী স্কুল শুরু ক্লাশ ওয়ান দিয়ে, এখনকার মত প্লে স্কুল, নার্সারী, কেজি ওয়ান, কেজি টু – এসবের বালাই ছিল না। 

মা একদিন ছোটিকে ধরলো, 'এই আমাদের মিঠুকে একটু ইস্কুলে নিয়ে যাবি? কিচ্ছু করতে হবে না, শুধু এক জায়গায় বসিয়ে দিবি। আর একটু নজরে রাখিস, যেন এদিক ওদিক চলে না যায়। দু'দিন অভ্যেস হয়ে গেলেই ওর বাবা ভর্তি করে দিয়ে আসবে'।

সেই প্রাইমারী স্কুল আর হাইস্কুল একেবারে গায়ে লাগা। কোনটাতেই বাউন্ডারী ওয়াল ছিল না তখন, ইউনিফর্ম বোধ হয় এখনো নেই। আমার বাবা হাইস্কুলের শিক্ষক, প্রাইমারীর সব শিক্ষক তাকে চেনেনই শুধু নয়, মান্যও করেন, আমার পক্ষে এভাবে হুট করে একটা ক্লাসে গিয়ে বসে যাওয়া মারাত্মক গোলযোগের কোন ব্যাপার নয়। বললেই হল, অজিতবাবুর ছেলে।

কদিন পরেই মা আমাকে চান করিয়ে নতুন জামা পরিয়ে ভাত খাইয়ে হাতে শেলেট পেন্সিল ধরিয়ে দিয়ে ছোটির সাথে ইস্কুলে পাঠিয়ে দিল। আমিও নাচতে নাচতে চলে গেলাম। ক্লাসে বসেই অবশ্য আমার নাচুনি থেমে গেল। তারাপদ স্যার পড়াচ্ছিলেন, অ-এ অজগর। সবাই বললো, অয়ে অজগর। উনি ছোটিকে জিজ্ঞেস করলেন, আ-এ কী? ছোটি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো। উনি এবার গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আ-এ কী? ছোটি চুপ। তারাপদ স্যার এবার ক্লাশের অন্যদিকে তাকিয়ে একজনকে টার্গেট করে জিজ্ঞেস করলেন, এই পরাণ, তুই বল, আ-এ কী? পরাণ বললো, আয়ে আম ছার। তারাপদ স্যার বললেন, গুড। দে, দুগ্‌গার কানটা মলে দে। অমনি পরাণ এসে ছোটির দুই কান পেছন থেকে ধরে মলে দিল। আমি ওর পাশে বসে ভয়ে আধমরা হয়ে গেলাম। এবার কি আমাকে ধরবে, আর কান মলে দেবে?

তারাপদ স্যার আরো কিছুক্ষণ ছোটিকে কী সব বললেন। তারপর অন্যদের দিয়ে 'ই', 'ঈ' শেষ করে ছোটিকে আবার ফিরে ধরলেন, দুগ্‌গা বল, হ্রস্ব-উ-এ কী? ছোটি আবার নিস্পন্দ, নির্বাক। আমি ভাবছি ওকে পাশ থেকে বলে দেব কিনা, উট বল, উট। কিন্তু ছোটি চুপ, আবার ভয়ে গুটিয়ে গেছে। আমি ভাবছি, আবার কেউ বলে দেবে, আর ছোটি আবার কানমলা খাবে। কিন্তু না, তারাপদ স্যার ওকে এবার মোক্ষম প্রশ্ন করলেন। 'এক্ষুণি কী যেন তোকে জিজ্ঞেস করলাম? ও হ্যাঁ, বল দেখি, আ-এ কী?' ছোটি তাও চুপ। তারাপদ স্যার এবার কাছে এসে ছোটির চুল ধরে দিলেন এক টান। ছোটি উঃ করে উঠলো, আর তারপর পিঠে গুম করে এক কিল। আমার বাবা হায়ার সেকেন্ডারীর ছাত্রদের যত জোরে মারে, তার চেয়েও বেশি জোরে। ছোটি ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো। আমিও ভয়ে পাথর।

পরদিন মা চান করিয়ে ভাত দিতেই আমি 'পেটে কী ব্যথা' বলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। পেটে ব্যথা আমার জন্মসঙ্গী, তা নিয়ে কারো কোন সংশয় নেই। ফলে আমার স্কুলে যাওয়া হল না সেদিন। তার পরদিনও। এবং তারও পরদিন।
রোজ রোজ পেটে ব্যথা বললে বৈচিত্র চলে যায়, তাই আমি নিত্যনতুন ফিকির আমদানি করতে লাগলাম, আর ধরাও পড়ে গেলাম। মা যত বোঝায়, ওরে, তোকে কিছু বলবে না, ঠিক আছে আমি তারাপদ স্যারকে বলে দেব তোকে পড়া না ধরতে, আর তুই তো এসব জানিস, আমার কিছুতে চিঁড়ে ভেজে না। কেউ আমাকে পেছন থেকে কানমলা দিচ্ছে, কি স্যার চুল ধরে টেনে পিঠে কিল মারছে, আমি ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগলাম। তিন চারমাস কি তারো বেশি আমার স্কুলে যাওয়া হল না।

বাবা এসব কিছু জানতো না। মা ভেবেছিল একাই এসব ছোটখাট ব্যাপার ম্যানেজ করে নেবে। হল না দেখে এবার বাবার কোর্টে বলটা ঠেলে দিল একদিন নৈশাহারের সময়। বাবা অল্প কথার মানুষ। 'ঠিক আছে, কাল ও আমার সঙ্গে যাবে', বলে আমাকে কোন চান্স না দিয়ে প্রসঙ্গের ইতি টেনে দিল।

পরদিন সকালেই আমার ধুম জ্বর। কদিন পর সে জ্বর সেরে গেলে যখন আর নতুন কোন অজুহাত বের করতে পারলাম না, বাবা খেয়ে দেয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্যে রেডি, আমি বললাম, আজ না, কাল যাবো। পরদিনও, কাল যাবো। এই ভাবে দিন চলে যায়, 'কাল' আর আসে না। কদিন বাদে নিজেই বুঝতে পারলাম, বাবা রেগে যাচ্ছে, তাই পলিসি পালটে বললাম, মঙ্গলবার যাবো। কোন মঙ্গলবার, কেন মঙ্গলবার, সেই ডিটেল্‌সে যাইনি। পরের মঙ্গলবারেও বললাম, মঙ্গলবারে যাবো। মা বললো, আজ তো মঙ্গলবার, আজ যা। আমি বললাম, আজ না, আর এক মঙ্গলবার।

রোগা টিংটিঙে সদা অসুস্থ বাচ্চার গায়ে হাত তুলতে যে কোন পুরুষেরই মায়া লাগবে। কিন্তু মানুষের ধৈর্যের তো সীমা আছে। এক মঙ্গলবারে আমি আবার নতুন মঙ্গলবারের বাহানা তুলতেই বাবার রাগের বাঁধন টুটে গেল।

কী মার যে খেয়েছিলাম, বলতে পারবো না। আশে পাশের অনেক বাড়ির লোক ছুটে এসেছিল। বাড়িওয়ালা দাদু-ঠাকমা এসে আমাকে কোলে করে নিয়ে গেল তাদের ঘরে, আর আমার বাবাকে বকতে লাগলো, একটা দুধের বাচ্চাকে ঐভাবে কেউ মারে? 

আমি মোটেও দুধের বাচ্চা নই তখন। ছ'বছর পুরতে আর দু'মাস মাত্র বাকি। এখন এই বয়সে বাচ্চারা স্কুলে গিয়ে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞ। আর আমি স্কুলের চৌকাঠই পেরোতে পারছি না। পরের সপ্তাহে বাবার সঙ্গে যেতেই হল স্কুলে। আমার যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই, বাবাও ছাড়বে না। আমি রাস্তায় তিনপা হাঁটি তো একপা পিছাই, বাবার অভ্যেস দ্রুত হেঁটে যাওয়ার, আমাকে নিয়ে প্রায় নাজেহাল অবস্থা বাবার। ভীষণ সময়ানুবর্তী বাবার স্কুলে কোনদিন এক মিনিট লেট হবার উপায় নেই। গোঁজ হয়ে থাকা আমাকে কোনমতে প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টারের কক্ষে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে বাবা 'আমার ছেলে, একটু দেখবেন' বলে হনহন করে বেরিয়ে পাশে নিজের ইস্কুলে চলে গেল।

হেডমাস্টারমশাই আমাকে 'যাও, ঐ ক্লাশে গিয়ে বসো' বলে একটা ঘর দেখিয়ে দিলেন। সেখানে তখনো জল পড়ে, পাতা নড়ে চর্চা হচ্ছে।

পরদিন বাবার সঙ্গে আবার এলাম, এবার ভর্তি হবো। হেডমাস্টারমশাই বাবাকে কী একটা বলতেই আমি বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, না, আমি ঐ ক্লাশটায় যাবো না, আমি ও সব জানি। আমার মুখস্থ। হেডমাস্টারমশাই আমার কঠোর আস্থা দেখে আমাকে একেবারে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করে নিলেন কোন প্রশ্ন না করেই। 

এর ঠিক দুমাস বাদেই পুজোর ছুটি, স্কুল খুললেই পরীক্ষা, আর সব পরীক্ষাতে আমি ফুল মার্ক্স পেয়ে ক্লাশ থ্রীতে উঠে গেলাম। এর মধ্যে আর এক রাউন্ড টাইফয়েড-রক্ত আমাশা হয়ে গেছে। 

আমার বয়স তখন ছ বছর তিন মাস। এখন এই বয়সে ক্লাশ ওয়ানে ভর্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সমস্ত শিক্ষায়তনে।

----------------------------------------

যে ভাড়াবাড়িতে জীবনের প্রথম আট-ন'বছর কেটেছে, তার স্মৃতি এখন প্রায় ফিকে হয়ে এসেছে। বাড়ির মালকিন ঠাকমা, যাকে আমার মা 'মা' বলে ডাকতো, নিজের নাতি-নাতনীদের সাথে আমাদের কোন পার্থক্য করতেন না। আমাদের বাচ্চাদের সকাল দুপুরের খাওয়া দাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট মেনু বা সময় ছিল না, যেখানে কেউ মুখে কিছু ঢুকিয়ে দিত, সেটাই খাওয়া হয়ে যেত। পোড়া শুকনো লঙ্কা দিয়ে আলুভাতে মেখে সকালে পান্তাভাত খাইয়ে দিতেন ঠাকমা নিজের বড়ছে
লে জিতেনকাকুর ছেলে-মেয়ে খুকু-সৌমেনকে, কাছাকাছি আমি থাকলে আমাকেও। আমার মা জানতেও পারত না। একটু পরে মা যদি ডাকতো, মিঠু খাবি আয়, আমি বলতাম, আমি ওদের ঘরে খেয়ে নিয়েছি। ওদের মা যমুনা কাকিমা আর আমার মা বোধ হয় সমবয়েসী, উনিও আমাকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসতেন। জ্বর বা পেট খারাপ না থাকলে আমার সারা গায়ের এখানে ওখানে ঘা-প্যাঁচড়া হত। যমুনা কাকিমা কত যত্ন করে গরম জল দিয়ে সেগুলো ধুইয়ে লাগিয়ে দিতেন লাল ওষুধ (মারকিউরোক্রোম), বা সবুজ রঙের বোঁটকা গন্ধওলা অ্যান্টিব্যাকট্রিন।

অসুস্থতার জন্যে বাইরের জগতের সঙ্গে আমার সংস্পর্শ ছিল বড়ো কম। আমার দৌড় ছিল শোবার ঘরের দরজার বাইরে যে লম্বা টানা বারান্দাটা, সেই পর্যন্ত। ভাটামের গোল গোল ফল পা দিয়ে কিক করে সেখানে আমরা ফুটবল খেলতাম। পার্মানেন্ট গোলকীপার আমি অবশ্য বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম না, একটু পরেই হাঁপিয়ে গিয়ে বসে বা শুয়ে পড়ে সারা শরীর দিয়ে গোল বাঁচিয়ে দিতাম। সারা গায়ে জামা কাপড়ে ধুলো লেগে যেত, আর মা-র কাছে বকুনি খেতাম। যেদিকে জিতেনকাকু-যমুনা কাকিমাদের শোবার ঘর, সেইদিকে বারান্দা পেরোলে একটা সরু গলি, যেটা দিয়ে ঘুম-ছোটি-সন্টুদের বাড়ি যেতে হত। ঐ গলির উলটো দিকেই যশোর রোডের দিকে মুখ করে ছিল সন্টুর বাবার টিমটিমে মুদিখানা দোকান। কখনো কখনো আমাকে বাবা সেখান থেকে বিড়ি বা চারমিনার সিগারেট কিনে আনতে বলতো। সন্টুর বাবা আমার হাতে জিনিষ দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, ইস্কুলে যাচ্ছিস এখন?
খুবই সামান্য দোকান, যা পণ্য-সামগ্রী ছিল তা বিক্রি করে কী করে সংসার চলতো তা ভাবলে এখন অবাক লাগে। বাবার জন্যে বিড়ি-সিগারেট ছাড়া সেখানে আর একটা জিনিষ কিনতেই আমি মাঝে মাঝে যেতাম। সেটা হল বাতাসা। মা আমার হাতে গুণে গুণে কিছু পয়সা দিয়ে বলত, যা স' পাঁচানার বাতাসা নিয়ে আয় তো, হরির লুঠ দেব।

আমাদের সেই বাড়ির সামনেই যশোর রোডের ঠিক উলটো দিকে ছিলো একটা ফাঁকা মাঠ, সেটাকে বলা হত ইউনিয়ান বোর্ডের মাঠ। ইউনিয়ান বোর্ড-টা যে কী, সেটা কেউ জানতো না, সবাই বলতো ইন্নান বোড। সেখানে একটা লাল রঙের সিমেন্টের বাঁধানো চাতাল, তার ওপর দুর্গা বা কালীপুজো হত পুজোর সময় প্যান্ডেল বেঁধে ধুমধাম করে। অন্য সময় সেই মাঠে বাচ্চারা বাতাবিলেবুর ফুটবল, ডাঙ্গুলি, মার্বেল, লাট্টু এইসব খেলতো, আর ঘুড়ি ওড়াতো। মাঝে মাঝে কোথা থেকে বাস নিয়ে এক পার্টি এসে বায়োস্কোপ দ্যাখাতো সেখানে সন্ধ্যেবেলা। তখন শরীর খারাপ থাকলেও আমি রাস্তা পেরিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে মাঠে যেতাম বায়োস্কোপ দেখতে। বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন কি করে ঘুড়ি উড়িয়ে আকাশের বিদ্যুৎ মাটিতে নিয়ে এসেছিলেন, তার সেই অবাক কার্যকলাপের সবাক প্রতিফলন ছবির পর্দায় দেখে শিহরিত হতাম।

ঘন ঘন শরীর খারাপ হওয়া সত্ত্বেও মা প্রতিবারই ঠাকুরের কাছে মানত করত আমার দ্রুত আরোগ্যলাভের জন্যে। সেজন্য কতটা দ্রুত আমি সেরে উঠতাম তা বলা মুশকিল, কিন্তু প্রতিবার আমি সুস্থ হয়ে দুপুরে ভাত খেলেই মা বিকেলে বলতো, যা, স' পাঁচানার বাতাসা নিয়ে আয়। আগে চার পয়সায় আনা ছিল, সেই হিসাবে সোয়া পাঁচ আনা হল টায়ে টায়ে একুশ পয়সা। পরে নয়া পয়সা এসে যাওয়ায় আনা হয়ে গেল সওয়া ছ'পয়সা, তাহলে সওয়া পাঁচ আনায় কত পয়সা হবে, এ ছিল বেশ জটিল ধাঁধাঁ। কিন্তু যে অন্য সব ইহলৌকিক ব্যাপারে মোটামুটি অক্ষম, তার কাছে এটা ততোটা কঠিন সমস্যা ছিল না। আমি সন্টুর বাবাকে তেত্রিশ পয়সা দিয়ে বলতাম, বাতাসা দাও। কেন যে প্রত্যেকবার সওয়া পাঁচ আনার মত এক বদখৎ ডিনোমিনেশনের বাতাসা মানত করা হত, জানিনা। ইউনিয়ান বোর্ডের সিমেন্টের চাতালে মা একটা সর্ষের তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে আমার রোগমুক্তির জন্যে ভগবানের কাছে অসংখ্য প্রণাম জানিয়ে হলুদ রঙের সেই গুড়ের বাতাসা ছড়িয়ে দিত আকাশে। আমি আর আমার মত কিছু কাচ্চাবাচ্চা সেগুলো কুড়িয়ে কপাকপ খেয়ে নিতাম।

ইউনিয়ান বোর্ডের ঠিক পাশে একটা বড়োসড়ো বিল্ডিং ছিল, তার নাম অজন্তা কুঠি। সেটা প্রায় সবসময় বন্ধ থাকতো। 'মুগুর মার্কা অজন্তা হাওয়াই' লেখা কিছু কাগজ পড়ে থাকত আশেপাশে, হাওয়াই চপ্পলের ছবি দেওয়া। বোধহয় আগে ওয়্যারহাউস ছিল অজন্তা ব্র্যান্ড চপ্পলের। সেই অজন্তা কুঠির ঠিক সামনে একটা কাঠের বাটাম দেওয়া স্ট্রাকচার ছিল, অনেকটা সিনেমায় দেখা কোর্টের কাঠগড়ার মত। তার সামনে একটা কাঠের হোর্ডিঙে লেখা ছিল, কৃত্রিম গো-প্রজনন কেন্দ্র। জিনিষটা কী, সেটা তখন জানতাম না। আমি আমার ঘরের জানলা দিয়ে মাঝে মাঝেই দেখতে পেতাম, রোদের মধ্যে সেই কাঠগড়ায় একটা গরুকে দাঁড় করিয়ে রাখা। 

আমাদের ওই বাড়িতে রান্না হত তোলা উনুনে। কয়লার উনুন, নীচে ঘুঁটে দিয়ে আগুন বানিয়ে তার ওপরে কয়লা সাজানো। এখন যারা বাড়িতে ফুরুৎ করে একটা নব ঘুরিয়ে গ্যাস জ্বালিয়ে নেয়, তারা ভাবতেও পারবে না, কী ঝামেলার কাজ ছিল সেই নিত্য উনুন ধরানো। বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। শুধু তাই না, কয়লা পাওয়াও ছিল দুস্কর। বাজারে মাঝে মাঝেই কয়লা হাওয়া হয়ে যেত, আর এখনকার মত ধূমহীন গুল তখনো আবিস্কারই হয়নি। পাড়ার দু একজন জানতো, কী করে অসাধু উপায়ে কয়লা জোগাড় করা যায়। খুব সহজ পদ্ধতি। তখন যাত্রীবাহী ট্রেনের ইঞ্জিন কয়লায় চলতো। মাজদিয়া ষ্টেশন ছেড়ে কোনো ট্রেন পূবদিকে যাত্রা শুরু করলে রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে তারা একটা লম্বা কঞ্চির মাথাটা চিরে একটা দুই বা পাঁচটাকার নোট আটকে সেটা ট্রেনের চালকের কামরার দিকে বাড়িয়ে ধরতো। চালক টাকাটা কঞ্চির মাথা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কয়লার ষ্টোর থেকে কিছু অংশ গড়িয়ে দিত চলন্ত গাড়ি থেকে কামরার বাইরে। সেগুলো কুড়িয়ে এনে বাজারে বেশি দামে বিক্রি করতো তারা। বাজারে যখন কয়লা পাওয়া যেত না, আমার মা বাবা-বাছা করে তাদের কাউকে ধরে নিজের রেশন মজুত করে রাখত। আর ঘুঁটে দিত নিজেই, গোবর টোবর জোগাড় করে। সেই বাড়িতে দু-তিনটে গরু পোষা থাকত সব সময়।
গোবরে কাঠের গুঁড়ো মিশিয়ে ঘুঁটে দিলে আগুন তাড়াতাড়ি জ্বলে আর সে আগুন চট করে নিভেও যায় না। মা তাই আমাকে চুপিচুপি বলতো, মিঠু, একটু কাঠের গুঁড়ো এনে দিতে পারবি?

আমাদের বাড়ীওয়ালা সীতানাথ বিশ্বাসের জমির পাশেই তখন নতুন তৈরী হয়েছে ফটিক স'মিল। আমি একদিন সেখানে ঢুকে দেখেছি কী আশ্চর্য সব ব্যাপার স্যাপার। রেললাইনের মত সমান্তরাল দুটো লাইনের ওপরে চাকা লাগানো একটা লোহার পাটাতন, তার ওপর মোটা কাঠের গুঁড়ি রাখা হত। লোহার শিকল দিয়ে সেই পাটাতন লাগানো থাকতো একটা গোল পুলির সঙ্গে। পুলির হ্যান্ডেল ঘোরাতে আরম্ভ করলেই সেই শিকল লাইনের ওপর দিয়ে টেনে আনতো পাটাতনটাকে, কাঠের গুঁড়ি সমেত। যাত্রাপথে সেই গুঁড়ির সাথে মোলাকাৎ হত একটা ঘূর্ণায়মান ইলেক্ট্রিক করাতের, একটা নির্দিষ্ট উচ্চতা বজায় রেখে যে অবিরাম ঘুরে চলেছে। গুঁড়ির ওপরের লেভেল থাকতো করাতের লেভেলের থেকে একটু ওপরে, তাই করাতের উচ্চতা বরাবর তার মাথাটা ছেঁটে যেত, আর বেরিয়ে আসতো সুন্দর এক স্ল্যাব। প্রতিবার করাতের লেভেল একটু একটু করে নীচু করে নেওয়া হত। করাতের সঙ্গে কাঠের ছোঁয়া লাগলেই চ্যাঁ করে একটা একটানা শব্দ হত, আর ফুলকির মত উড়ে যেত কাঠের গুঁড়ো, সেগুলো জমা হতে হতে একটা ডাঁই হয়ে যেত।
আমি একটা চটের থলে নিয়ে তার মধ্যে যতটা পারি সেই কাঠের গুঁড়ো ভরে এনে মাকে দিতাম। কিছুদিন পরে কাঠকলের মালিক আবিস্কার করলো, তার এই আপাত নিরীহ জিনিষটার বেশ চাহিদা। সঙ্গে সঙ্গে ওটা একটা পণ্য হয়ে গেল, মানে এমনি এমনি দেবে না, পয়সা দিয়ে কিনতে হবে। যে জিনিষ এত দিন ফেলে দিচ্ছিল, সেটা নিতে এখন পয়সা লাগবে, এ তো মহা অন্যায়। আমারো রোখ চেপে গেল। কেউ জানতে না পারে এমন ভাবে পা টিপে টিপে আমি থলে নিয়ে চলে যেতাম পাঁচিলের পেছনের একটা ফোকর দিয়ে, আর বিজয়ীর মত মা-র জন্যে নিয়ে আসতাম মহার্ঘ কাঠের গুঁড়ো। 'না বলিয়া পরের দ্রব্য লইলে চুরি করা হয়', এটা জেনেও এই কাজের জন্যে আমার মনে কোন অনুশোচনা হতনা।

প্রাইমারী ইস্কুলেও আমার তখন কিছু কিছু প্রতিপত্তি শুরু হয়েছে। অঙ্ক ক্লাশে সব অঙ্ক আমি মুহূর্তের মধ্যেই কষে ফেলতে পারি। তারাপদ স্যার, নির্মল স্যার, সুবল স্যার সবাই আমাকে খুব ভালোবাসেন। স্কুলে একজন দিদিমণি, আভা দিদিমণি, তিনি আমার মা কে চিনতেন আগে থেকেই, কৃষ্ণনগরে এক কলেজে পড়েছেন। তাঁর বড় মেয়ে টিঙ্কু আর আমি এক ক্লাশে। কেউ পড়া না পারলে যে পারবে সে কানমলা দেবে, এটাই বিধান। অসহ্য লাগলেও আমি আমার ক্লাশের প্রায় সবাইকেই কানমলা দিয়েছি কোন না কোন সময়। ঘা-প্যাঁচড়ার মত কান পাকাও একটা রোগ ছিল তখন, মানে কানে পুঁজ জমতো। কান মলে দিলেই সেই পুঁজ বেরিয়ে হাতে লেগে যেত। আমার নিজের শরীরে অসংখ্য খুঁত, তাও পরের কানের পুঁজ হাতে লেগে গেলে গা ঘিনঘিন করে উঠতো। টিঙ্কু আর আমি আলাদা সেকশানে ছিলাম। একদিন আভা দিদিমণি ওদের ক্লাশে কিছু পড়া ধরেছিলেন, কেউ পারেনি, সবাইকে দাঁড় করিয়ে রেখে উনি পাশের সেকশান থেকে আমাকে ডাকিয়ে সেই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করলেন। আমি পেরে যেতে বললেন সবার কান মলে দিতে। যে দু একজনকে আমার অত্যন্ত বকাটে মনে হত, তাদেরই আমি কানমলা দিলাম, বাকিদের বেলায় কানমলার অভিনয় করে গেলাম। টিঙ্কু বা অন্যান্য কোন মেয়েদের আমি কান স্পর্শ করলাম না। নির্জীব সরীসৃপের মত আমার অবস্থা হলেও মেয়েদের অপদস্থ করতে সেই আমার প্রথম পুরুষকারে লাগল।

বেশি নড়াচড়া করতে কষ্ট হলেও আমার একটা বাজে অভ্যাস হয়ে গেছিল সব সময় তর্জনী দিয়ে হাওয়ায় কিছু লেখা। অধিকাংশ সময় সেটা বাংলা বা ইংরাজী কোনো অ্যালফ্যাবেট। ছবি আঁকতে পারতাম না, কিন্তু যাকে আমরা ফন্ট বলি, সেগুলো হাতের লেখায় আরো কী করে সুন্দর করা যায়, আমি সর্বদা তার শ্যাডো প্র্যাকটিশ করে চলতাম। 'ঞ্জ' আর 'জ্ঞ'-তে যে বর্গীয় 'জ'-টা হুবহু ওর নিজের মতো নেই, আগে বা পরে 'ঞ' লেগে ওর শারীরিক বিবর্তন হয়েছে, সে রকম দন্ত্য 'স'-এর নীচে 'ত' লাগালে যে 'স্ত' তৈরী হয়, সেখানে 'স'-টা অনেক আলাদা দেখতে, সেগুলো বইতে যেমন ছাপা সেরকম লিখতে না পারলে আমার শান্তি হত না। আর তার জন্যে সবসময় হাওয়ায় আমার ডান হাতের তর্জনী নকশা বুনে চলতো। বাবা বলতো, ইংরাজী শিখতে গেলে ভালো করে ট্রানস্লেশন শিখতে হবে। কোনো একটা লেখা, যেমন ইংরাজী ঈশপের গল্প, আমাকে প্রথমে ইংরাজী থেকে বাংলা করতে হত। বাবা তারপর ইংরাজী বইটা নিয়ে নিত, আর বলতো, এবার তোমার নিজের ওই বাংলা তর্জমাটা আবার ইংরাজীতে ট্র্যানস্লেট করো। অনেক কিছুই এখন ভুল মনে হয়, বিশেষতঃ বিদেশী ভাষা শিখতে গেলে সেই ভাষায় লেখা সাহিত্য পড়া ও অনর্গল কথা বলা যে গ্রামার বা ট্রানস্লেশনের চেয়ে অনেক বেশি জরুরী, সেটা। কিন্তু আমাদের সেই অজ গাঁয়ে কোথায় বিদেশী সাহিত্য পাঠের সুযোগ, কার সাথেই বা ইংরাজীতে কথা বলব? ইংরাজী শেখানোর শিক্ষকরাই বাংলায় পড়ান যেখানে! 

গরু রচনা দিয়ে আমাদের বাঙালীদের সাহিত্যের অঙ্গনে প্রবেশ। গরুর পরেই বর্ষাকাল। ক্লাশ থ্রী-র ছাত্রবন্ধু বইতে গরু রচনা ছিল সাত-আট লাইনের, আর বর্ষাকাল ন'দশ লাইনের। পরীক্ষায় এ দুটোই আসতো সাধারণতঃ, দুটোর মধ্যে একটা লিখতে হত। গরু লিখলে কুড়িতে বারো, আর বর্ষাকাল লিখলে তেরো পাওয়া যেত, কেউ যদি বানান ভুল না করে ছাত্রবন্ধু উগরে দিয়ে আসতে পারে। হাতের লেখা ভালো হলে আরো এক-আধ নম্বর বেশি পাওয়া অসম্ভব ছিল না। সেবার কী কারণে বর্ষাকাল আর দুর্গাপুজো – এই দুটো রচনা এলো অ্যানুয়াল পরীক্ষায়। যারা শুধু গরু মুখস্থ করে গেছিল তাদের তো মাথায় হাত। বাকিরা সবাই বর্ষাকাল লিখলো, কেননা দুর্গাপুজো রচনা ছাত্রবন্ধুতে নেই।

সেবার পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবার পর আভা দিদিমণি আমাদের বাড়ি এসে মাকে বলেছিলেন, তোমার ছেলেটা কী সুন্দর রচনা লিখেছে গো, পড়ছি আর মনে হচ্ছে আমি পুজো মন্ডপে বসে আছি। কী সুন্দর হাতের লেখা। তোমরা ওর শরীরের দিকটা একটু দ্যাখো। ও তো বাড়ছেই না। ক্লাশে বসে, ওর মাথা হাইবেঞ্চের ওপার থেকে দ্যাখাই যায় না। একটু ছানা টানা খাইয়ে দ্যাখো।

অথচ হাইবেঞ্চের ওপারে না, আমার নজর তখন প্রাইমারী আর হাইস্কুলের মাঝখানে যে দেওয়াল, তার ওপারে নিবদ্ধ। কত বড়ো স্কুল, সামনে কতো বড়ো মাঠ, পেছনে কত বড়ো মাঠ, একটা বিশাল পুকুর। আর কতোদিন লাগবে ঐ স্কুলে যেতে?

এ তো হওয়ারই ছিল ~ শুভংকর আদিত্য

এ তো হওয়ারই ছিল !

আমার বোনের জরায়ু বেআব্রু হয়েছে

আদিম হিংস্রতার সনাতন কামনায়।

আমি কী টেস্ট ক্রিকেট দেখতে যাব?

নাকী আমার ফুসফুসে আগুন জ্বলবে?

আমার ভাইয়ের হিমোগ্লোবিনে প্লাবিত 

উঠোনে কী আর কখনও কী রজনীগন্ধার চারা লাগাবো?

নাকী ধুলোমাখা উঠোনের একমুঠো মাটি 

তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারব কালো পর্দার মুখে?ওরাও আসেনা আমার পাশে।

কীভাবেই বা আসবে!ওদের প্রতিবাদী শক্তি যে আমিই শুষে নিয়েছি।

পাঁচদিন ধরে খোলা আকাশের নীচে পড়ে থাকা লাশটার

দিকে তাকানোর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।

সন্তানহারা বৃদ্ধার চোখভেজা জল দেখে উঃ কী আনন্দটাই না পেয়েছিলাম!

আজ কেন তবে এমনটা হল?

আমার চোখের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে!

সেদিন ওদের সমস্ত রক্ত চুষে নিয়েছিলাম 

আমার শাশ্বত তাত্‍ক্ষণিকতায় আর নৃশংস মানবিকতায়।

আমি ভুল ট্রেনে উঠে পড়েছি ! এ যে এক্সপ্রেস! 

চেন টেনে মাঝপথে থামাবো চোখের জল?

তবু ওরা গভীর রাতে এসেছিল কাল।

রুমালটা সাথে করেই এনেছিল আজও।

চোর ~ অমিতাভ প্রামাণিক

'সবুজ দ্বীপের রাজা'র কাকাবাবুর হাত ধরে যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচিত হলাম 'মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি'র আনাচে কানাচে ঘুরে। আধুনিক লেখকদের মধ্যে এঁর মত পল্লীনির্ভর ছোটদের গল্প তেমন লিখেছেন কি? সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, অনেক গল্পেই চরিত্র হিসাবে ছড়িয়ে থাকত একটা পিসি, একটা চোর আর একজন দারোগা। পিসিটা দয়ালু, চোরটা ছিঁচকে কিন্তু ভীতুর ডিম, আর দারোগাটা গল্পের ঠিক শেষ 
সীনের আগে অবধি কোনো কম্মের না। এগুলোকে সম্বল করে বেশ কিছু গল্পের জাল বুনেছেন শীর্ষেন্দু। মজার গল্প নিঃসন্দেহে, কিন্তু শহরের শিশুরা সেই গল্পে কতটুকু নিজের ছায়া দেখতে পায়, জানি না।

মাজদিয়ায় ভাড়া বাড়ি ছেড়ে আমরা যখন আমাদের নিজের বাড়িতে উঠে এলাম, তখন আমাদেরটাই ঐ পাড়ার একমাত্র ইঁটের বাড়ি, বাকি সব মাটির। দু তিন বছরের মধ্যে অবশ্য আরো কিছু পাকা বাড়ি তৈরি হয়ে গেল। আমাদের বাড়ির ঠিক পাশ দিয়েই উত্তর-দক্ষিণ বরাবর একটা সরু কাঁচা রাস্তা। তার ঠিক উলটো দিকে, আমাদের বাড়ির পূবদিকে প্রতাপকাকু বাড়ি বানালেন। প্রতাপকাকু একটা প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ওঁর বড়ো ছেলে পরেশ আমার ক্লাশমেট ছিল। এই বাড়ির পূবদিকে আর একটা ইঁটের বাড়ি উঠলো, যিনি বানালেন, তাঁর নাম মনে আসছে না, বোধ হয় সরকারী চাকুরে ছিলেন। কয়েক বছর পর সেই বাড়ি বিক্রি করে ওরা চলে যান। তার বাড়ির দক্ষিণে ছিল কাশীকাকার বাড়ি, উনার বাজারে টেলারিঙের দোকান ছিল। আমাদের যাবতীয় জামাকাপড় উনি সেলাই করে বানাতেন। কাশীকাকার দাদা ছিলেন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক, তার বাড়িও ওটার লাগোয়া। প্রতাপকাকুর বাড়ির দক্ষিণে হারুকাকার মাটির বাড়ি। হারুকাকা বাজারে কারো দোকানে ফাইফরমাশ খাটতেন। হারুকাকা আর কাশীকাকার বাড়ির দক্ষিণে কামারবাড়ি, সে বাড়ির পুরুষরা অকম্মার ধাড়ি, মহিলারা এর ওর বাড়ি ঠিকে কাজ করতো। রোজ ভোরবেলা সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যেত ওদের প্রভাতী গালাগালি অনুষ্ঠান। বাপ মা তুলে এ অন্যকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিত ওরা, কেন কে জানে। আমাদের বাড়ির দক্ষিণে আর হারুকাকার বাড়ির পশ্চিমে থাকতো গজে, ওর মা আর ঠাকুমাকে নিয়ে। গজে রিক্সা চালাতো, আর ওর মা, তাকে আমরা পিসি বলতাম, ছাগল টাগল পুষতো। ওদের বাড়ির উঠোনে ছিল এক মস্ত কুলগাছ, যাতে শীতকালে প্রচুর কুল হত। বাড়িতে কেউ নেই ভেবে আমরা ঐ গাছে ঢিল মেরে কুল কুড়োতে গেলেই গজের ঠাকুমার চোস্ত গালাগালি ভেসে আসতো। আমরা ওঁকে খ্যাপানোর জন্যে বলতাম, 'ভাটাম গাছে ঢেঁকির ছিয়া'। এই কথাটার কোনো মানে নেই, কিন্তু এটা কানে গেলেই অশীতিপর বুড়ির মুখ হয়ে যেত কাঁচা নর্দমা। সে যা ভাষা, তা দিয়ে আর একটা চলন্তিকা লেখা যেতে পারে। আমাদের বাড়ির পশ্চিমে ছিল হালদার বাড়ি। তাদের চার ভাই আমার মাকে বৌদি ডাকতো বলে আমার কাকা, যদিও ছোটজন আমার সহপাঠী ছিল। ওদের বাবা আর মেজভাই পুজোর প্রতিমা বানাতেন, দুর্গা-কালী-সরস্বতীর। গজের আর হালদারদের বাড়িও ছিল মাটির।

আমার বাবা গ্রামের সেকেন্ডারী আর হায়ার সেকেন্ডারী স্কুলে শিক্ষকতা করে সেই প্রাক-বামফ্রন্ট আমলে যা আয় করতেন, তা দিয়ে সংসার চলতো না, কেননা বেতন নিয়মিত পাওয়া যেত না, আর যা পাওয়ার কথা, তা থেকে কম দেওয়া হত। সেইজন্যে বাধ্য হয়ে বাড়িতে টিউশানি করতে হত। আমাদের বাড়িতে দুটো ঘর, তাতে তক্তাপোষ পাতা, আর একটা বারান্দা। পড়ুয়ারা বারান্দায় বসতো, রোদ-বৃষ্টি বা সংখ্যায় বেশি হলে ঘরের মধ্যেও। একটা ঘর, যেটাতে আমি আর আমার ছোটবোন শুতাম, তার লাগোয়া রান্নাঘর, সেটায় টালির ছাওনি।

আমার মা বেশ অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে হলেও নিজের সংসার চালানোর জন্যে অসম্ভব পরিশ্রম করতো। বর্ষা ছেড়ে একটু শীত পড়লেই আমরা রান্নাঘরের পাশে জমিতে টমেটো, বেগুন, পালংশাক, পেঁয়াজকলি, শিম, বরবটি, শশা, ফুলকপি – এসবের চাষ করতাম। আমার বোন আর আমি নিয়ম করে রোজ বিকেলে জল দিতাম চারাগাছে। চালকুমড়ো আর পুঁইশাক লাগাতে হত না, এমনি এমনিই কী করে গজিয়ে যেত কোথা থেকে বীজ টীজ পড়ে।

শহুরে সম্বোধন, যেমন, 'দাদা, কেমন আছেন' বা 'আজ ওয়েদারটা বেশ ভালো, না?' এসব আমাদের গ্রামের জন্যে না। ওখানে হাঁড়ির খবর জানতেই লোকজন বেশি উৎসাহী। তাই, 'দিদি, কী রান্না করছেন' বলে কারো হেঁসেলে ঢুকে পড়া মোটেও অশালীন আচরণ বলে গণ্য হত না, বরং এটা বেশ সাবলীল। অনেকেই আমাদের বাড়ি এসে কুটনো কুটে দিয়ে যেত। আমার মা-ও অন্যের বাড়ি গিয়ে আটা মেখে দিয়ে আসতো বা দুটো লুচি ভেজে দিলো। মা বিভিন্ন রকমের বড়ি বানানোয় ছিল বিশেষ পারদর্শী। শীত পড়লেই আশেপাশের সব বাড়িতে বড়ি দেওয়ার হিড়িক পড়তো, আর মা-র ডাক পড়তো বড়ি দেওয়ার কাজে। রোদে পিঠ দিয়ে গল্প করতে করতে ঝোলের বড়ি, ভাজা বড়ি, কুমড়োর বিচি দেওয়া ক্রিস্পি বড়ি – এই সব নানান বড়ি দেওয়া, লাল লঙ্কা মাথায় গুঁজে বড়ির বিয়ে, কোন ব্রত পালনের চেয়ে কম নয়। বড়ি দেওয়ার দিন রোদ না উঠলে বিপদ, বড়ির নাক সুন্দর হতে হবে, ঝোলের বড়ি মুখে দিলেই যেন গলে যায়, ভাজা বড়ি কুড়মুড়ে হতে হবে, মোট কথা সহজ ব্যাপার নয় মোটেও।

কলাই বা বিউলির ডালের এই বড়ির এক অন্যতম উপাদান হল পাকা চালকুমড়ো। কচি কুমড়োর তরকারি হয় বিভিন্ন রকমের, সর্ষে দিয়ে ঝালঝাল এক প্রপারেশন খুবই মুখরোচক। কিন্তু বড়ির জন্যে সব বাড়িতেই সাদা খড়ি ওঠা পাকা চালকুমড়ো বাঁচিয়ে রাখতেই হত। আমাদের বাগানে কুমড়োর ফুল থেকে ফলের গুটি এলেই মা দাগিয়ে রাখতো, এটা বড়ির জন্যে। মানে ওটাকে কাটা হবে না, যতদিন না পেকে সাদা হয়ে যায়।

বাকি কুমড়ো পেড়ে খাওয়া হয়ে গেল, গোটা তিনেক বাড়তে লাগলো সেই গোকুলে। তারমধ্যে একটা আমাদের জন্যে, আর বাকি দুটো প্রতিবেশীদের কাউকে দেওয়ার জন্যে। সময় এলে তারা তাদের দুটো নিয়ে গেল, মা বললো, আমার তো বড়ি দেওয়ার আরো এক সপ্তা বাকি, আরো একটু বাড়ুক, এখনো তো সাদা দাগ ধরেনি। আমরা রোজ সকালে উঠে সেই নধর কুমড়ো কতটা বাড়ছে রোজ, সাদা খড়ি এলো কি না, তার খতেন রাখতাম।

আমাদের সব আশায় জল ঢেলে একদিন সকালে সেই প্রায়-পক্ক কুমড়ো গাছ থেকে হাওয়া হয়ে গেল। কেউ টেনে হিঁচড়ে ছিঁড়ে নিয়ে গেছে, বেশ বোঝা গেল। মা-র খুব মন খারাপ হয়ে গেল। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মা ঘুমাতে যায়, ওঠে সব্বার আগে, আর মা-র ঘুম খুব পাতলা, একটু আওয়াজেই ঘুম ভেঙে যায়, তা সত্বেও কী করে পাকা কুমড়ো চুরি হয়ে গেল, এই ভেবে মা খুব আপসেট। একজন প্রবোধ দিতে মাকে এসে বললো, 'ও দিদি, আমার কুমড়োটাতো বেশ বড়ো, আমি এবার বেশি বড়ি দেব না, আপনি আধখানা নিন'।

তার দু' দিনের মধ্যেই ঘটলো আর এক কান্ড।

মাঝরাত্রে ঘটাং করে একটা শব্দ এলো রান্নাঘর থেকে। বাড়িতে একগাদা বেড়াল, তারা হুটোপুটি করে নিত্য, হয়তো কেউ কিছু উলটে দিয়েছে, এই ভেবে মা ঘুম ভেঙে গেলেও উঠবো কি উঠবো না করে শেষে উঠে যে ঘরে আমি আর বোন শুই, সেটার খিল খুলে রান্নাঘরে ঢুকে দেখে একটা কালো লোক, বাইরের ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে। ছাদের টালিতে একটা বড়ো গর্ত।
মা-র চীৎকারে আমাদের ঘুম ভেঙে গেল, আর আমরাও তারস্বরে চোর-চোর বলে চ্যাঁচাতে লাগলাম। পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যে যাবতীয় পাড়ার লোক আমাদের উঠোনে। প্রতাপকাকুর বাড়ির বাইরে রাখা মইটা দেখা গেল আমাদের রান্নাঘরের চালে লাগানো। ওটা দিয়ে চালে উঠে চোর টালি সরিয়ে ভেতরে ঢুকেছে। ভাগ্য খারাপ লাফিয়ে যেখানে পড়েছে, সেখানে রাখা ছিল এক লোহার বালতি, তাতে পা লাগায় সেই ঘটাং শব্দ।

প্রথমে কুমড়ো চুরি, তার দুদিন পরেই টালি খুলে চোর ঘরে ঢুকে পড়লো, স্বাভাবিকভাবেই আমরা সবাই খুব উদ্বিগ্ন। কুমড়োর ব্যাপারে গজের মা পিসির ওপর মা-র একটু সন্দেহ ছিল, কিন্তু উনি তো আর টালি খুলে চালে চড়তে পারবেন না, আর মা স্পষ্ট দেখেছে ওটা একজন পুরুষ। 

আমাদের বাড়িতে সারাদিন কত লোক আসে যায়, দরজা বন্ধ করার কোন দরকার পড়ে নি এতদিন। কিন্তু এই বিপর্যয়ে মা মুষড়ে পড়ে এর পর থেকে কয়েকদিন বাড়ির দরজা বন্ধ করে দুপুরে এর ওর বাড়ি গল্প করতে কি রান্নায় সাহায্য করতে গিয়ে পুরো রহস্যটার সমাধান করে ফেললো। হারুকাকার এক কামরার মাটির বাড়িতে মা দেখলো একটা কুমড়ো, যে রকম কুমড়ো বাজারে পাওয়া যায় না। কচি নয় মোটেই, সুতরাং তরকারি খাওয়ার মতো নয়, আবার তার গায়ে সাদা খড়িও পড়ে নি। আর তার ডাঁটিটা দেখেই বোঝা যায় ওটা কাঁচি দিয়ে কাটা না, গাছ থেকে টেনে ছেঁড়া। তার থেকেও বড়ো কথা, হারুকাকার পায়ের পাতায় একটা গামছা জড়ানো। বাজারে নাকি তার পায়ে পেরেকের গজাল ঢুকে গেছে, তিন দিন কাজে যায় নি হারুকাকা।

পাড়ার ছেলে ছোকরার দল রাত্রে পাহারার ব্যবস্থা করবে ভাবছিল, এ খবর পাঁচকান হওয়ার পর তার আর দরকার হয়নি। কয়েক মাস পর হারুকাকারা ঐ পাড়া ছেড়ে কোথায় চলে গেল। চিত্তকাকা সেই জমি কিনে মাটির বাড়ি ভেঙে সেখানে পাকা বাড়ি তুললো। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগের ঘটনা, হারুকাকাদের আর আমরা কোনদিন দেখিনি।

একটা চোর, একটা পিসি আর প্রায়-দারোগা আমার মা-র মত একটা ডিটেকটিভ নিয়ে আমার এই ঘটনা যেন শীর্ষেন্দুরই গল্প। গজের মা-ঠাকুমা, প্রতাপকাকু, হালদারদাদু, কাশীকাকা – এরা কেউ আজ বেঁচে নেই। আমার বোনের বিয়ের পর আমাদের বাড়ির উঠোন আগাছায় ভরে গেছে, সেখানে আর শীতের সবজি চাষ করার কেউ নেই। বড়ি দেওয়ার প্রথাও প্রায় উঠে যাচ্ছে, আমার মা হাঁটুর ব্যথায় শয্যাশায়ী, সিঁড়ি ভেঙে কারো বাড়ির ছাদে উঠে বড়ি দেওয়ার ক্ষমতা আর তার নেই। 

ভোরের স্বপ্ন ~ অরুণাচল দত্তচৌধুরী

স্বপ্ন এল ভোরবেলা,
সেই স্বপ্ন সত্যি হয় জেনে 
আমি সকালের বাঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছি।

সূর্য দিগন্তের কাছে, উলটো দিকে উড়ে গেছে ছায়া
ইতিহাস মাখা এই দুরূহ ভুগোল
কিছুটা আলোয় তার বাকিটুকু আধোঅন্ধকারে,
আমার স্বপ্ন এসে এই যজ্ঞবেদীতে দাঁড়াবে
নবজাত তাকে আমি সযত্নে শোয়াই 
মৃত পূর্বসূরীদের পাশে
যে সব স্বপ্নগুলো সত্যি ছিল গতকাল ... 
আরও কতকাল

অভিজ্ঞ করোটিগুলি, নতুনকে ডেকে বলে, শোন
এ'মরণ তুইও পাবি। আমাদের কপাললিখন
বর্ণে বর্ণে সত্যি হবে। 
এ'টুকুই ইতিহাস, বাকিটুকু অলৌকিক দিন

দেখে নিস, সুসময়ে ঠিক
আলোবৃত্তে নেচে উঠবে সোনার হরিণ!

ভূত ~ অমিতাভ প্রামানিক

শহরে থাকার এক সমস্যা হচ্ছে, অন্ধকার ঠিকমতো উপলব্ধি করা যায় না। নিকষ কালো ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, যেখানে চোখ খুলে রাখা আর বন্ধ রাখার মধ্যে কোন তফাৎ নেই, তার এক আলাদা সৌন্দর্য আছে। এখানে মাঝরাতেও কোত্থেকে একফালি আলো হানা দেয় আঁধারের রাজত্বে, আর তার সেই অধরা মাধুরীর ছন্দ-লয়-তাল কেটে খানখান হয়ে যায়।
যখন ক্লাশ ইলেভেনে পড়তাম, আমাদের স্কুলের শিক্ষক নিতাইবাবুর কাছে রাত্রে অঙ্ক শিখতে যেতাম। আমাদের বাড়ি থেকে স্য
ারের বাড়ি খুব কাছে নয়, আবার খুব দূরেও নয়। একটা হ্যারিকেন আর বই-খাতা সঙ্গে থাকত। আর বর্ষার সময় একটা ছাতা। আমাদের বাড়ি থেকে শুরু করে কিছুদূর গেলে পাড়া শেষ, মানে ঘরবাড়ি নেই, সরু কাঁচা রাস্তা ধরে পেরোতে হত একটা ঘন বাঁশ-জঙ্গল, তার পরে একদিকে ফাঁকা মাঠ, অন্যদিকে একটা পুকুর, সেটা পেরিয়ে গেলে একপাশে একটা পুরনো ইঁটভাটা আর অন্যপাশে একটা গরুর ভাগাড়, যেখানে মাঝেমধ্যে মরা গরু পড়ে থাকত আর একগাদা হুঁদো হুঁদো চেহারার শকুন আর কুকুর তাদের ক্ষুন্নিবৃত্তি করত সেই অবশেষ থেকে। এইগুলো পেরিয়ে গেলে আর একটা পাড়া এসে যেত, আর একটা বড় রাস্তা, সেটা ধরে কিছুটা গেলেই স্যারের বাড়ি।

ঐ পুকুরটাতে পাড়ার দু'একটা বাচ্চা ছেলে ডুবে মারা গেছে। ঐ বাঁশঝাড়ে নাকি মাঝে মাঝেই সাদা কাপড় পরা প্রেতিনীরা ঝুলে থাকে, অনেকেই বলত। খুব ছোটবেলা থেকে আমি ঈশ্বরে অবিশ্বাসী বলে এসবে পাত্তা দিই নি। বাদুড়ের মত এক ধরণের প্রাণী, আমরা বলতাম ভাম, বাঁশের মাথায় বসলে তার ভারে বাঁশ অনেকটা নুয়ে যায়। সেটা হুট করে উড়ে গেলে ফটাস করে বাঁশটা আবার সোজা হয়ে যায়, তাতে কারো ভয় পেয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। তাছাড়া আমি দেখেছি বেশ কিছু সাদা রঙের ঘুড়ি, তাদের কোনটার ইয়াব্বড় ল্যাজ, ঐ বাঁশঝাড়ের ডগায় লটকে আছে। পেত্নী না ছাই!

সেদিনও টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল, তার আগে কদিন তো তুমুল বৃষ্টি। রাত্রি দশটার আগে স্যার ছাড়তেন না, সেদিন কী মনে হতে সাড়ে ন'টাতেই ছেড়ে দিলেন। আর যারা পড়তে আসতো, তারা ঐ পাড়াতেই থাকে, ওরা চলে গেল। আমি আমার গলিতে ঢুকলাম। আমার এক হাতে হ্যারিকেন, তার কাঁচটা ইতিমধ্যে কালো হয়ে গেছে। অন্য হাতে অঙ্কখাতা, মোটা কেশব নাগ আর ছাতা। ভাগাড়টা পেরিয়েই বুঝতে পারলাম রাস্তায় কাদা প্রায় হাঁটু সমান হয়ে গেছে। পরণে পাজামা, সেটা হাঁটুর ওপর পর্যন্ত গোটানো, কিন্তু হতচ্ছাড়া মাঝে মাঝে ফস করে একটু নেমে যায়, তাই হ্যারিকেন ধরা হাতে সেটাও সামাল দিতে হচ্ছে। হাওয়াই চটিটা গেঁথে যাচ্ছে, কাদার সঙ্গে তার গলাগলি সম্পর্ক তো। বাধ্য হয়ে চটি খুলে হাতে নিতেই হল, কিন্তু হাত তো মাত্র দুটো।

একেবারে যাতে হাঁটু অবধি ডুবে না যাই, তাই রাস্তার একেবারে বাঁ সাইড ধরে আসছিলাম, ঢোলকলমীর বেড়া ধরে ধরে। হয়তো কাদার গভীরতা বিঘৎখানেক কম সেই দিকে। হঠাৎ বাঁ হাতটা গিয়ে পড়লো একটা কম্বলের মত নরম কিছুর ওপর, আর একটা তীব্র জ্বলুনি অনুভুত হতেই আমি ডানদিকে সেই থকথকে দইয়ের মত কর্দমশয্যায় পপাত ধরণীতল। 
ঢোলকলমীর রাজ্যে হঠাৎই এক হতভাগা সজনে গাছ, আর তার গায়ে বিশাল এশিয়ার ম্যাপের মত লাখখানেক শুঁয়োপোকার দঙ্গল। আমার হাত পড়েছে সেই বিভীষিকাময় রাজ্যে।

আমি উল্টাতেই টিমটিমে হ্যারিকেনটা দেহ রাখলো। অসম্ভব জ্বলুনির মধ্যে আমি টের পেলাম অনন্ত নরকের মত আমি এক অন্ধকার পাতালে শুয়ে আছি। ঘোর অমাবস্যা, আকাশে কালো মেঘ, ঢোলকলমীর পাতায় বৃষ্টি পড়ার শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। নিজের হাত পা-ও দেখা যাচ্ছে না।

কোনক্রমে উঠে দাঁড়ালাম। কোনদিকে হাঁটবো কিছুই বুঝতে পারছি না। আবার সেই শুঁয়োপোকার রাজ্যে অনুপ্রবেশের কোন বাসনা নেই। কিন্তু যাবো কোথায়? কীভাবে?
মিনিট দশেক চললো ট্রায়াল-এরর। তারপর দৈব অনুগ্রহেই হয়ত দেখতে পেলাম অনেক দূর থেকে একটা আলোর শিখা এগিয়ে আসছে। যাক, ভাগ্য ভালো। আলোটা অনেক কাছে এগিয়ে এলে আমি আওয়াজ দিলাম, কে? আমার দিকে এক পলক তাকালো সেই আলোকধারী, তারপর গঁ গঁ শব্দ করে কাদার বুকে লুটিয়ে পড়লো সে। আর তার ওই অবস্থা দেখে আমিও। আবার...

বাড়ি ফিরতে রাত্রি হয়েছিল অনেক। আমাকে দেখে কারো পক্ষে ভূত ভাবা মোটেও অসঙ্গত ছিল না। বিশেষতঃ যারা ভূত দেখেনি আগে। নিতাইবাবু এই ঘটনা জেনে এর পর থেকে আমাকে সকালের ব্যাচে আসতে বলে দিলেন।

অন্ধকারের করাল গ্রাসে না পড়লে আলোর মহিমা ঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করা যায় না। আমরা আলোতেই অভ্যস্ত, দিন হোক বা রাত। ঠিক এই মুহূর্তে আমি চাইছি একটা ঘন অন্ধকার পৃথিবী, না, দরজা-জানালা বন্ধ করা একটা কুঠরি নয়, আলোহীন একটা ঘুমন্ত প্রকৃতি। অন্ধ নাবিকের মত আমি তার বুকের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে চাই সারা রাত্রি ধরে, সূর্যোদয়ের পথে।

শনিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২

হে মোর জননী ~ দেবজ্যোতি মুখার্জী


ক্ষতিপূরণের হিসেব হয়েছে পাকা 

ধর্ষিত হলে পাওয়া যাবে কাঁচা টাকা; 

হে মোর জননী, হে মোর জন্মভূমি 

বল আর কত ধর্ষিত হবে তুমি!!


শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১২

নোনাডাঙার যমুনাবতী ~ অনামিকা

স্কুলে গিয়েছে যমুনাবতী। দাদা চায়ের দোকান।
জনক কোনও আবাসনের সিকিউরিটি স্টাফ
ঢাল তরোয়াল বিহীন শুধু ইউনিফর্ম আছে
আর রয়েছে দিনযাপনের পাপ

দড়মা বেড়া তার ওপরে ভাঙা টালির ছাঁদ
আলো ছিল না বাতাসও নয় তবু তো সেটা ঘর
পাঁচফ্ল্যাটের ঠিকে খাটেন যমুনাবতীর মা
ফিরে আসেন সাঁঝবেলার পর

দিনেও সেই অন্ধকারই গিলতে আসে রোজ
নিরন্ন সব পেটে যখন অপরিসীম খিদে
বস্তি ভেঙে দিচ্ছে হুজুর টাওয়ার হবে বলে
বেঁচে থাকার হাজার অসুবিধে

এখান থেকে ওখানে ওড়ে ঝরা পাতার দল
তাড়া করেছে রক্তচোখ ঘাতক বুলডোজার।
কারা চালায়? একদা যারা বন্ধু সেজেছিল
সুযোগ নেই তাদের ভুল বোঝার!

যমুনাবতী দখল হবে একটু বড় হলে
জমানা আছে একই কেবল বদলে গেছে জামা
বোম্বেটেরা আগুন দেবে প্রশাসনিক সাজে
পৌঁছে দেবে নয়া আদেশনামা

আজকে কোনও ইস্কুল না, আজকে পুড়ে যাওয়া
আজকে বৃথা ঘর পাহারা, বাতাসে ওড়ে ধুলো
তোবড়ানো সব থালাবটির পাশেই হবে ছাই
যমুনাবতীর বইপত্তরগুলো

ভূমিকম্প বন্যা হলে শঙ্খ বাজাতাম
ঘোলাটে রঙ আকাশে শুধু নগর প্ররোচনা
মানুষ যদি মানুষকেই দুর্বিপাকে ফেলে
আমরা ভীতু নিঃশ্বাস ফেলবনা

একটু দূরে মাছের ভেরি। রঙিন রিসর্টেরা
সেজে উঠেছে। উথলে ওঠে বিদ্যাধরী খাল।
নোনাডাঙার উন্নয়নে কাট আউটের মুখে
প্রচার আলো জ্বলেছে আজকাল 

যমুনাবতীর মা বাপ ভাই পাখির বাসা ফেলে
তৃষ্ণা নিয়ে ছড়িয়ে যাবে শহরে কোনাকানায় 
ওদের ছবি না চিনলেও খুঁজলে পাওয়া যাবে
জমা রয়েছে স্থানীয় কোনও থানায়