বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

ঈশ্বর ~ অমিতাভ প্রামাণিক

মহামতি গোখলে একদা বলেছিলেন, হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্ক্‌স্‌ টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্ক্‌স্‌ টুমরো।

সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। তবে আস্ফালন তো রয়েই গেছে। অথচ ইতিহাস বলে, বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের মানুষ আদতে ছিল অনগ্রসর আদিবাসী। যে সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলার উদ্ভব, বাংলায় সেই সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন না বললেই চলে। সেন রাজাদের আমলে পুজো-আচ্চার কারণে কনৌজ থেকে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ভাড়া করে আনতে হত। পরে শ্রীচৈতন্যের আমলে সে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে বটে, তবে সাধারণ বাঙালি বহুকাল ছিল অশিক্ষিত। লেখাপড়া ব্যাপারটা বঙ্গজদের মধ্যে তেমন ছিল না।


প্রায় একক প্রচেষ্টায় অশিক্ষিত বাঙালিকে শিক্ষিত করার প্রয়াস নিয়েছিলেন এক একগুঁয়ে বাঙালি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যে সময় সংস্কৃত ভাষাশিক্ষাকেই শিক্ষা বলে গণ্য করা হত, সেই সময়ে বাঙালিকে বাংলা শেখানোর কাজে ব্রতী হলেন তিনি। ব্রিটিশ আমলের শতবর্ষ পূর্তির তখনো কিছু বাকি, অসন্তোষ বাড়ছে গ্রামবাংলায়, নীলকর চাষীদের ওপর অত্যাচার চরমে উঠছে। নবজাগরণের পথিকৃত রামমোহন মারা গেছেন বছর কুড়ি আগে। গদাধর চট্টোপাধ্যায় রামকৃষ্ণদেব হয়ে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির পুরোহিত হয়েছেন সদ্য। বহু পরিশ্রমে বিধবা বিবাহ আইন প্রচলন করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র। মাইকেল মধুসূদন বাংলায় বিচিত্র রসের কাব্যরচনা করছেন বটে, তবে তা আপামর বাঙালির বোধবুদ্ধির আয়ত্বের বাইরে। তাঁর মেঘনাদবধ কাব্য রচনা বা রবি ঠাকুরের জন্ম হতে তখনো ছ'বছর বাকি।

তখন ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স পঁয়ত্রিশ বছর। মফস্বলে স্কুল পরিদর্শনে যাওয়ার পথে পালকিতে বসে তিনি রচনা করলেন বর্ণপরিচয়ের পাণ্ডুলিপি। ১৮৫৫ সালের এপ্রিলে প্রথম ভাগ ও জুনে দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হল। দু'পয়সা দামের এই পুস্তিকা এক জাতির মেরুদণ্ড গঠনে এক যুগান্তকারী বিপ্লব এনে দিল।

এর আগে রাধাকান্ত দেব, ক্ষেত্রমোহন দত্ত, মদনমোহন তর্কালঙ্কার ও স্কুল বুক সোসাইটি শিশুপাঠ্য কিছু বই বাংলায় প্রকাশ করলেও সেগুলো জনপ্রিয় হয়নি। শিশুদের সামাজিক অবস্থান, শিশুশিক্ষা ও শিক্ষণপদ্ধতির বিষয়ে প্রয়োজনীয় সম্যক জ্ঞান এবং সর্বোপরি নিজস্ব প্রয়াসকে সর্বাঙ্গীন রূপ দেওয়ার একগুঁয়েমি অনুশীলনে এরা কেউ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ধারেকাছে ছিলেন না।

বাংলা বর্ণমালার আমূল সংস্কার, উপযুক্ত যতিচিহ্নের ব্যবহার এবং প্রাঞ্জল সহজ গদ্যে নিজেকে প্রকাশের সুষম দিগ্‌দর্শনে বর্ণপরিচয়ের অবদান অসীম। নিজে হিন্দু কুলীন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হয়েও এই গ্রন্থের কোথাও ধর্মীয় অনুশাসনের কোন উল্লেখ নেই, বরং নীতিশিক্ষাকেই শিশুশিক্ষার প্রকৃত রূপ বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।


বর্ণপরিচয় প্রকাশের পর বিদ্যাসাগর আরও পঁয়ত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন। এই সময়ে বর্ণপরিচয়ের ১৫২টি মুদ্রণ সংস্করণ প্রকাশিত হয়, যার শেষের দিকে প্রতিটি সংস্করণে দেড় লক্ষেরও বেশি কপি ছাপা হত। ঐ সময়ে বাংলার জনসংখ্যা, শিশুমৃত্যু ও শিক্ষার হার বিবেচনা করলে বোঝা যায়, প্রতিটি বাঙালিই বর্ণপরিচয় পাঠ করেই শিক্ষার প্রথম সোপান অতিক্রম করেছে। বর্ণপরিচয়ের 'জল পড়ে, পাতা নড়ে' দিয়েই পরবর্তী এক শিক্ষাসাধকের কবিতার অঙ্গনে প্রবেশ ও বিশ্বজয়।

১৮২০ সালে আজকের দিনটিতে জন্মেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। দুশো বছর হতে চলল, বঙ্গমাতা আর একটিও এমন নাছোড়বান্দা সুসন্তান প্রসব করেন নি।

২৬শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩


মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

​ছড়া থেকে কবিতায় উত্তরণ ~ তমাল রাহা

কিছুদিন আগে হঠাত এক বন্ধুর ইমেইল এলো। তমাল, মহায়ন এর একটা কপি পেয়েছি ! পড়লুম, আর প্রচুর হাসলুম। সত্যি, কি অদ্ভূত প্রতিভা বাঙালীর ছড়া বানানো নিয়ে ! আসলে বাঙালীর রক্তে ছড়া। ছোটবেলাটা বোধহয় সবারই ছড়াময়। তাই দু-লাইন ছড়া কাটা আমাদের বাঙালীর জন্মগত প্রতিভা। সেটা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান থেকে রাজনীতির আঙ্গিনা অথবা ইস্কুল এর মাস্টারমশায় দের নিয়ে মজা করা …. কোথায় নেই ?
বাঙালী-র ঘরে জন্ম।তাই ছোটবেলা থেকেই ছড়ার সাথে পরিচয়। প্রথম ছড়া যা স্মৃতির পাতায় প্রথম দাগ কেটেছিল সেটা মা-এর মুখে ঘুমপাড়ানি ছড়া …. ¨ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি আমাদের বাড়ি এসো¨ কিম্বা ´খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়াল/ বর্গী এল দেশে´…. ঠাম্মা-কে বলতে শুনতাম ¨আয় আয় চাঁদ মামা, টিপ দিয়ে যা/চাঁদের কপালে চাঁদ, টিপ দিয়ে যা¨। অবাক হয়ে ভাবতুম খোকা এতো দুষ্টু যে ঘুমোলে পাড়া জুড়ায় …. কিন্তু খোকা ঘুমোলে চাঁদ মামা কিন্তু টিপ দিয়ে যেতে ভোলেন না ! একটা সময় ছিলো যখন এই ছড়া ছাড়া ঘুম আসাটাই ছিলো দায় ! ক্রমশ ছড়া ব্যাপারটা হে উঠলো জীবনের অঙ্গ। খেলতে গিয়ে ছড়া … আমপাতা জোড়া জোড়া/ মারব চাবুক ছুটবে ঘোড়া … শাসনের সময় ছড়া …পারিব না এ কথাটি বলিও না আর/ কেন পারিবে না তাহা ভাব এক বার।
বাড়িতে তো ঠাম্মা-র নির্দেশে সকালে ঘুম থেকে উঠে চালু করে দিলাম ¨সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি¨ …. আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়/ লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়¨ ইত্যাদি ও প্রভৃতি। ঘুম থেকে উঠতে দেরী হলে ঠাম্মার বিছানা থেকে তুলে দেওয়ার মধ্যেও সেই ছড়া ¨পাখী সব করে রব, রাতি পোহাইল/ কাননে কুসুমকলি, সকলি ফুটিল¨। তখন অবশ্য মদনমোহন তর্কালঙ্কার বা হরিশচন্দ্র মিত্র মহাশয়দের নাম জানা ছিলো না। সব তো শুনে শুনে শেখা ! প্রচন্ড হতাশ হয়েছিলাম প্রথম ঠাম্মা আমায় আসল হাট্টিমাটিম দেখালো। .. আমি ছড়া পড়ে মনে মনে কি জানি কি ভেবে রেখেছিলাম ! মনে হলো …. ধুসস …. জমলো না ঠিক।
ক্রমশ বড় হার সাথে সাথে নিজের ছড়া বলা শুরু। বাবুরাম সাপুড়ে, কথা যাস বাপুরে? ….. জন্মদিনে পাওয়া ´আবোল-তাবোল´…. 'হাঁস ছিল সজারু ( ব্যাকরণ মানি না) হয়ে গেল 'হাঁসজারু' কেমনে তা জানি না´……. চরিত্র গুলোর সাথে আলাপ হার প্রবল ইচ্ছে।অদ্ভূত একটা মানসিক অবস্থা। কোথায় পাব হাসিমুখ আহ্লাদী দের, কিম্বা কুমড়োপটাশ, রামগরুড়ের ছানা, গঙ্গারাম, কাঠবুড়ো, বোম্বাগড়ের রাজা কে ? অসাধারণ সব চরিত্র। একদিকে মনে মনে ভিজে কাধ সেদ্ধ করে খাওয়ার প্রবল সাধ আর অন্যদিকে হুঁকোমুখো হ্যাংলার জন্যে মনে তখন ভারী কষ্ট। কিন্তু কে বোঝে আমার কথা? মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার/সবাই বলে 'মিথ্যে বাজে বকিস নে আর খবরদার!'
এগুলোর সাথে সাথেই চলল বড় হয়ে ওঠা।
আলাপ কাজী নজরুল এর সাথে …. কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও? কিম্বা ভোর হোলো , দোর্ খোলো … অথবা বাবুদের তাল-পুকুরে গিয়ে হাবুদের ডাল-কুকুরে-র কথা ভেবে ভয়ে মাঝরাতে ঘুমভেঙে যাওয়া। প্রায় একই সময় আলাপ কবিগুরুর সাথে … তালগাছ এর মতো এক পায়ে দাড়িয়ে থাকার অভ্যেস করার মধ্যে দিয়ে, মনে মনে আকাশেতে বেড়িয়ে, তারাদের এড়িয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে ভাবতে। এরিই মাঝে মা-কে নিয়ে বিদেশ ঘুরতে গিয়ে ডাকাত দলের সাথে মনে মনে যুদ্ধটাও চলছে। বিদেশ মানে কলকাতা বা বড়োজোর আসাম (মাসি থাকতেন) হবে ভাবতাম ! ওদিকে কবিগুরুর ছড়াতেও বিভ্রান্তি কাটছে না … ক্ষান্তবুড়ি র দিদিশাশুড়ি দের নিয়ে ভীষণ বিপদে পরা গেল। কিছুতেই বুঝতে পারি না কেন তারা শাড়ি গুলো উনোনে বিছায়, হাড়িগুলো রাখে আলনায় ! ওদিকে ইস্কুল এও কবিতা ! পরীক্ষার খাতায় দশ লাইন মুখস্থ লিখতে হবে, দাড়ি-কমার ভুল হলেই নম্বর কাটা ! ছড়া আর পিছু ছাড়ে না ! কিন্তু ভারী মজা। নতুন ক্লাস এর বই এলে প্রথম কাজই ছিলো ছড়াগুলোকে পড়ে ফেলা। কেমন যেন মাথার মধ্যে গেথে গিয়েছিল।মনে রাখার অভ্যেসটা সেই ছড়া দিয়েই শুরু।
বাবা নিয়ে গেলেন দামদর বাঁধ দেখাতে। ছিপখান তিনদাঁড়, তিনজন মাল্লা/ চৌপর দিনভর, দেয় দূরপাল্লা।এবার সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এসে গেলেন।এ যেন নতুন করে ছড়া-ছন্দের সাথে আলাপ ! অসম্ভব রকম আলোড়ন তুলেছিলো মনে …
পাড়ময় ঝোপঝাড়
জঙ্গল,–জঞ্জাল,
জলময় শৈবাল
পান্নার টাঁকশাল। ..
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের হাত ধরেই কখন যে ছড়া আর কবিতা মিশে গেল মনের মধ্যে তা টের-ও পেলুম না। এক নিঃশ্বাসে পড়তে লাগলুম ´পালকির গান´, কোন দেশেতে তরুলতা, মানুষ জাতি, উত্তম অধম ….. কী সহজ সাবলীল ভাষা আর শব্দের ব্যবহার!
বর্ষার নবীন মেঘ এল ধরণীর পূর্বদ্বারে,
বাজাইল বজ্রভেরী। হে কবি, দিবে না সাড়া তারে
তোমার নবীন ছন্দে?
আবার ফিরে আসা কবিগুরুর কাছে। কবিগুরু তখন যেন সমুদ্দুর। বালিশের পাশে সঞ্চয়িতা নিয়ে শোয়া। নজরুলের বিদ্রোহী , সুকান্তর ছাড়পত্র, আগ্নেয়গিরি … একেরপর এক পড়ে চলেছি পাগলের মতো। গোঁফ গজানোর সময় থেকে জীবনান্দ।সব মেয়েকেই প্রায় সুচেতনা বা আকাশলীনা লাগা শুরু ! নাটোরের বনলতা সেন কে জানার ইচ্ছে আর মনে প্রশ্ন লাশকাটা ঘরে পরে থাকা লোকটাকে নিয়ে। চলছিলো বেশ, বাবা হাতে ধরিয়ে দিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যা, বিষ্ণু দে, শামসুর রহমান, দীনেশ মজুমদার, নীরেন চক্রবর্তী , জসীম উদ্দীন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ শামসুল হক। কবিতা আর গদ্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে এলেন পূর্ণেন্দু পত্রী।জয় গোস্বামী এলেন একটু বাদে ´যমুনাবতী´কে নিয়ে। তবে সবার সব কবিতা ভালো লাগত না। selective ভালো লাগা শুরু হলো। সব অপূর্ণতা পূর্ণ করার জন্যে বারবার কবিগুরু তো রইলেন-ই।
কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান
আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি।
মাঝে হঠাত একটা সময় এলো যখন ভালোলাগা টা কেমন যেন মিইয়ে যেতে লাগলো। ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত। একটা অস্থিরতা ছিল। ভালো লাগছিলো না বেশিরভাগ কবিতা। ভাবছিলুম বয়স বাড়ার সাথে সাথে হয়তো এই পরিবর্তন !
কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো।
কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না
রাত কাটে তো ভোর দেখি না
কেন আমার হাতের মাঝে হাত থাকে না কেউ জানেনা।
হঠাত সেই সময়ে আবার আবিস্কার করলুম হেলাল হাফিজ, হুমায়ুন আজাদ, নির্মলেন্দু গুন, হাবীব কাশফি, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লা , আল মাহমুদ, মহাদেব সাহা, আবুল হোসেন, শহীদ কাদরী, আবুল হাসান, আহসান হাবীব কে। এরা ছিলেন, কিন্তু আমার সাথে পরিচয় ছিলো না !
তোমাকে হারানোর প্রয়োজন ছিল।
প্রয়োজন ছিল সময়কে মিথ্যে ভেবে
অসমাপ্ত কবিতা লেখার।
প্রয়োজন ছিল-
ধূসর রাতে একাকী থাকার,
দুঃস্বপ্নের ঘোরে … (জাবীর রিজভী)
আবার ভালো লাগাটা ফিরে এলো। বুঝলুম, মধ্যবয়সের চাহিদা একটু আলাদা। এখন তাই,
কষ্টে-সৃষ্টে আছি
কবিতা সুখেই আছে,–থাক,
এতো দিন-রাত যদি গিয়ে থাকে
যাক তবে জীবনের আরো কিছু যাক।
…..শুধু কবিতা পড়ার জন্য আরেকবার জন্মাতে ইচ্ছে করে।

শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

​​খিদে ~ অমিতাভ প্রামাণিক

​​
বিকেল চারটে হ'লে
আজকাল খিদে পায় আমার
কেমন এক ঝিমধরা খিদে খিদে ভাব।

সকালে ওঠার তাড়া থাকে
মুখ ধুয়ে স্নান করে অফিসে বেরোনো
দেরী হলে বাস মিস, মানে লাল দাগ।
অফিসে কাজের চাপ
বড় বস মেজ বস সেজ-ছোট চুনোপুঁটিদের
অহরহ কথা শুনে শুধু ঘষে যাওয়া।
দুপুর ঘনিয়ে এলে নাকে মুখে গুঁজে ফের
ফাইলে প্রবেশ।
সন্ধ্যেয় ঘরে ফিরি, তার একটা তাড়া আছে
বাসে ঘন ভিড়।
বাড়ি ফিরে বৌয়ের পাঁচালি
ছেলেমেয়েদের ঘ্যানঘ্যান
মাসের মেন্টেন্যান্স, টেলিফোন বিল
এটা ওটা সাত-সতেরোশো।
টিভিতে সারেগামাপা দাদাগিরি বিগবস
হতে হতে ঘুমের প্রবেশ।

শুধু বেলা চারটেয় এইসব থাকে না আমার।
তাই রোজ খিদে পায়
বিচিত্র খিদে খিদে ভাব।

১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩

বুধবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

মেয়ে ~ অনামিকা

রাস্তা মোড়ে মোড়ে মদের ঠেক,
রঙ ও বেরঙের জয় নিশান।
একলা মেয়ে দ্যাখো ঘর ফেরে। 
পুরুষ দণ্ডতে দাওনি শান?

দখল করো ওকে নির্দ্বিধায়,
রাষ্ট্র পাশে আছে, ভয় কী? যাও।।
ও কারও কন্যা বা ভগ্নী নয়।
ও মেয়ে নয় কারও সে প্রেমিকাও।

পাবে না ভালোবাসা মেয়েবেলায়।
মেয়েরা শুধু হবে ভোগদখল।
পুরাণকাল থেকে এক নিয়ম।
তেমনই বলে গেছে মনু সকল।

এ' গণতন্ত্রেরও সেই নিয়ম।
ভোটের মানে স্রেফ মুখ বদল।
মেয়েটা মরে গেলে তর্ক হোক,
খুনিরা তোর না কী আমার দল?

এক টানেতে যেমন তেমন ~ তমাল রাহা

প্রথম হোস্টেল এ থাকতে গিয়ে আলাপ এক দাদার সাথে। ইউনিভার্সিটি topper, সাহিত্যে। রোজ সকালে দেখতাম বাংলা মদের বোতল খুলে বসতে।আর ছিলো গঞ্জিকা বা সাদা বাংলায় যাকে বলে গাঁজা। আমায় স্নেহ করতেন। একদিন প্রশ্ন করলাম, ¨দাদা, তোমায় দাঁত মাজতে দেখি না তো!¨ উত্তরে বললেন, ¨বাঘ কি দাত মাজে রে খোকা?¨ দাদা গাঁজা-মদে ডুবে থাকলেও পড়াশোনাটা করতেন আর বছর বছর পরীক্ষায় প্রথম হতেন। এমন ছেলে তো আবার অনুজদের আদর্শ , বিশেষত হোস্টেল লাইফ এ। অনেককেই দেখেছি ওই দাদা কে নকল করতে গিয়ে নিজেদের পড়াশোনা গোল্লায় পাঠিয়েছে।আমার এক সহপাঠি তো দাদার ভক্ত হয়ে গাঁজা-র নেশা করে পাগল হয়ে গেলো ! অথচ ইকোনমিক্স এর কতো ভালো ছাত্র ছিলো , ছিলো জুনিয়র বাংলা দলের গোল-কিপার।ভাবা যায় ! দোষ আর দি কাকে ! আমরা বাঙালিরা মনে করি নিষিদ্ধপল্লী তে যাতায়াত করলেই শার্ল বোদলেয়ার হওয়া যাবে, অর্শ হলেই রবীন্দ্রনাথ হওয়া যাবে আর প্রথাবিরোধী হলেই হুমায়ুন আজাদ হওয়া যাবে।তাই বন্ধুরা যখন ভাবতো সকাল বিকেল গাঁজা-মদে ডুবে থাকলেই ওই দাদার মতো হিরো হওয়া আটকায় কে ….. তখন আর কিই বা বলি !

নেশার এরকম অনেক effect আমরা অল্পবিস্তর সবাই জানি। তবে আজ ভাবছিলুম একটু অন্যরকম কথা বলি। নেশা সংক্রান্ত কিছু মজার গল্প। কিছু নিজের অভিজ্ঞতা, কিছু শোনা, কিছুটা পড়া।

আবার সেই হোস্টেল এর গল্পে যাই। একবার ইচ্ছে হলো হুকো তে তামুক পান করার। থাকতাম ইডেন হোস্টেল-এ। কলেজ স্ট্রিট-এ। কাছেই নাখোদা মসজিদ। অম্বুরি তামাক পাওয়া যেতো। হুকো এলো, তামাক এলো। রাতে ডিনার এর পর বারো জন বন্ধু একসাথে বসা হলো। নাহ …. সে যাত্রায় তামাক খাওয়া হয় নি। সারারাতের চেষ্টাতেও হুকো জ্বালানো গেল না। ভোর রাতে শেষে বিড়ি খেয়ে গাল পরতে পরতে শুতে গিয়েছিলাম মনে আছে।

নাগা সন্ন্যাসী বলতে ছিলিমভর্তি গাঁজা আর শৈশবের পোশাকে ঘুরে বেড়ানো সাধু-সন্তরাই মনে আসেন। গাঁজা -র নেশা না থাকলে কি আর ওই অবস্থায় ঘোরা যায় ! এক সাধু কে বলতে শুনেছিলাম যে গাঁজা খেলে পরমব্রহ্ম কে সাকার রূপে দেখা যায় ! শিবঠাকুর তো দিব্য গাঁজা-ভাং খেয়ে কচুরিপানার ওপর হেঁটে বেড়াতেন। অষ্টম শতকে (কেউ কেউ বলেন ষষ্ঠ শতক) রচিত বানভট্টের কাদম্বরীতে রয়েছে, রাজধানী বিদিশায় বসে শুদ্রক রাজা স্নানাহারের পর কষে গাঁজা খেতেন। কারণ তখনও ভারতে তামাক আসেনি। অবশ্য তামাক জ্বালানোর করুণ অভিজ্ঞতা ওনার-ও হযেছিলো কিনা সেটা জানার উপায় নেই। গাঁজা , সিদ্ধি …. আরো কিছু কথা 

তপস্যার চার পথ-- স্থূল, পর্বত, ছাতক ও সিদ্ধি। গুরুর নামে যখন গাঁজা খাওয়া হয়, তখন সেটা সিদ্ধি আর এমনি এমনি খেলে তা নেশা করা, পাগলামি।

দেহের ভেতর আত্মা রাজা। 

সে খায় গাঁজা।

গাঁজা খাওয়ার জন্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কলকি। এগুলোকে বলা হয় বাঁশি। রয়েছে, কৃষ্ণ বাঁশি, নাগিনী বাঁশি, শঙ্খ বাঁশি, বিচ্চু বাঁশি, গণেশ বাঁশি, মেগনেট বাঁশি ও সাধারন বাঁশি। কারুকার্য, বানানোর নিপুণতার দিক দিয়ে বাঁশির দাম ১০টাকা থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। তবে সবচেয়ে বেশি চলে কৃষ্ণ বাঁশিই।

গাঁজা আর byproducts 
গাঁজা : স্ত্রীপুষ্পকে ৪৮ ঘণ্টা রৌদ্রে শুকালে ফুলগুলো জমাট বেধে যায়। এই জমাটফুলই গাঁজা নামে বিক্রয় হয়। সাধারণত কল্কিতে গাঁজা ভরে অগ্নিসংযোগ করে এর ধোঁয়া গ্রহণ করা হয়। এছাড়া সিগারেট বা বিড়ির মতো করে গাঁজা ভরে এর ধুমপান করা হয়।
ভাং :
 স্ত্রী উদ্ভিদের ভূ-উপরিস্থ অংশ শুকিয়ে বা কাঁচা অবস্থায় পিষে পানির সাথে মিশিয়ে সরবত বানিয়ে পান করা হয়। নেশাকারক উপাদান কম থাকে বলে গাঁজা অপেক্ষা ভাং কম দামে বিক্রয় হয়।
চরস্ : গাছের আঠা থেকে চরস তৈরি হয়ে থাকে। অনেক সময় গাঁজার ফুল শুকানোর সময় যে গুঁড়া উৎপন্ন হয়, তা আঠার সাথে যুক্ত করে চরস তৈরি হয়ে থাকে। অনেক সময় এই আঠা পাওয়ার জন্য গাঁজার গাছ কেটে দেওয়া হয়।
সিদ্ধি : গাঁজা গাছের পাতা শুকিয়ে সিদ্ধি তৈরি করা হয়। সিদ্ধি থেকে অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে ঔষধ তৈরি করা হয়। এছাড়া সিদ্ধি মুখে পুরে চিবিয়ে নেশা করে অনেকে।
হাসিস : গাঁজার স্ত্রীপুষ্পের নির্যাস থেকে হাসিস তৈরি করা হয়। গাঁজা গাছ থেকে ঊৎপন্ন সকল নেশা দ্রব্যের মধ্যে হাসিসকে শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করা হয়।


ফিরে আসি আবার হোস্টেল এর গল্পে।

হোস্টেল-এ অনেক কেই গাঁজার নেশায় বুঁদ হতে দেখেছি দিনের পর দিন।এক দাদা কে গাইতে শুনতাম দ্বিজেন্দ্র লাল রায়-এর গান

গাঁজা গুলি চরস
...তার চেয়ে ভাঙ
লক্ষ গুণে সরস।

একদিন হোস্টেল ই প্রচন্ড হৈ - চৈ। বাইরে বেরিয়ে দেখি সেই দাদা তারস্বরে চেচাচ্ছে , ¨শালা কেস করে দেবো ¨বলে। বুঝলুম নেশার ঘোর। জানতে পারলাম বান্ধবী ল্যাং মেরেছে। তাই কেস করে দেবে বলে হুমকি দিচ্ছে। বলা হলো, এসব ব্যাপারে কেস দেওয়া যায় না, খালি কেস খাওয়া যায়। শুনে তার কি রাগ! বললো, ¨আমার কাছে evidence আছে। আমি জানি সেই কি রঙের অন্তর্বাস পড়ে।¨ তারপর থেকে সেই দাদা হোস্টেল-এ গনখোরাক হয়ে গেলেন।

সৈয়দ মুজতবা আলীর গাঁজা নিয়ে একটা মজার গল্প আছে। অনেকেই পড়েছেন হয়তো। যারা পড়েননি তাদের জন্য স্মৃতি থেকে একটু তুলে দিচ্ছি। দেশভাগের পর কোন এক নিয়মের গ্যাড়াকলে পড়ে তৎকালীন পূর্ব বঙ্গ থেকে ভারতে গাঁজা রপ্তানি বন্ধ। গাঁজা রপ্তানি বন্ধ হওয়াতে গুদামে গাঁজা জমে আছে মণকে মণ। নতুন গাঁজা উৎপাদিত হয়ে, প্রস্তুত হয়ে গুদামে ঢোকার অপেক্ষায়। বাধ্য হয়ে পুরানো গাঁজা নষ্ট করে ফেলতে হবে। কোনো কারণে আলী সাহেব সেখানে উপস্থিত ছিলেন। খুব সম্ভব দায়িত্বরত অফিসার তার আত্মীয় (ভাই?) ছিলেন। আলী সাহেবকে বললেন, চল দেখবি। জীপে করে যথাস্থানে গিয়ে দেখলেন পুরানো গাঁজা জড় করে রাখা হয়েছে পোড়ানোর জন্য। সমগ্র গ্রামবাসীও (নারী, শিশু, যুবক, বৃদ্ধ) হাজির হয়েছে অগ্নুত্সব যোগ দিতে। মজা শুরু হোলো আগুন লাগানোর পর। বাতাস যেদিকে যায় সমগ্র গ্রামবাসী সেইদিকে দৌড়ায়। বেশিক্ষণ আলী সাহেবের পক্ষে সেখানে অবস্থান করা হয়ে ওঠেনি। তবে ফেরার সময় তিনি জীপে করে ফিরে এসেছেন নাকি হাতির পিঠে করে ফেরত এসেছিলেন তা আর মনে করতে পারেননি। বাতাস তো সব দিকেই দৌড়িয়েছে, আর উনিও তো এক দিকে ছিলেন।

ইস্টবেঙ্গল মাঠে এক কালে রোজ যেতুম। দু-টাকার গ্যালারি তে উত্তমকুমার বলে একজন আসতেন।ওটা অবশ্যই ওনার আসল নাম ছিলো না। সবাই আদর করে ওই নামে ডাকতো। গাঁজা-র ছিলিম বানাতেন মাঠে বসে। আর কল্কে সারা মাঠে ঘুরতো।দু-একবার টান দেওয়ার কথা আমার-ও মনে পরে।

গাঁজা পরিবারের নিজস্ব কিছু টার্ম রয়েছে। যেমন, গাঁজা কাটার ছুরি নাম 'রতন কাটারি'। যে পিঁড়িতে গাঁজা কাটা হয় তা 'প্রেমতক্তি' আর ধোঁয়া ছাঁকবার ভিজে ন্যাকড়ার নাম 'জামিয়ার'। আর গাঁজাতন্ত্রের শেষ আচার হলো একটানে কলকে ফাটানো। ছিলিম আর কলকে হলো একই জিনিস।ছিলিমের মূল আরবি 'ছিলম' আর কল্কের মূল সংস্কৃত 'কলিকা'। আর ফারসি ´নাইচা´থেকে বাংলায় এসেছে ´নলচে।
অন্যদিকে গাঁজা এসেছে সংস্কৃত ´গঞ্জিকা ´ থেকে। সংস্কৃত 'গাঁজ' (ফেনা) থেকেও বাংলায় গাঁজা শব্দটি এসেছে। এ গাঁজার অর্থ ফেনিল হয়ে ওঠা, টক হয়ে যাওয়া।

গাঁজা গাছ দুরকমের হয়। স্ত্রী - পুরুষ ভেদ আছে। স্ত্রী গাছে নেশা বেশি। সেটাই তো স্বাভাবিক, তাই না ? গাঁজা-র ব্যবহার শুরু নাকি শক-জাতির আমল থেকে। আদর করে ´কুনবু´বলে ডাকতো ওরা। ওরা কি জানতো যে গাঁজা-র সাইন্টিফিক নাম Canabis sativa ? Canabis এর আদুরে নাম কুনবু ! হোস্টেল-এ অনেক কে বলতে শুনেছি ´পাতা´।

ওপার বাংলায় একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। একদিন লোকমান হেকিম রাস্তা যাচ্ছেন। যেতে যেতে গিয়ে পড়লেন এক জঙ্গলের সামনে। লোকমান হেকিম জঙ্গলের পাশ দিয়া হাটেন আর নতুন নতুন গাছ দেখেন । গাছের সামনে হেকিম দাড়ালেই গাছ তাকে সম্মান জানায়। যেই গাছ সামনে পড়ে হেকিম তারে জিগায়, তোর নাম কি, আর কি কামে লাগছ? গাছ উত্তর তারে সম্মান জানাইয়া উত্তর দিলো আমার নাম আমলকি। আমি ভিটামিন সি এর ভান্ডার বিভিন্ন কাজে লাগি, এই সব। এরপর আস্তে আস্তে আম, কলা, জাম, বাসক, লজ্জাবতী, কাটানটি, চুতরা, করমচা, হিজল, বট সব গাছের প্রশ্ন করতে করতে যাইতে লাগলো। হঠাৎ হেকিম দেখেন একটা নতুন গাছ। এর আগে লোকমান হেকিম দেখে নাই। যথারীতি সে সেই গাছের সামনে দাড়ালেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, করো ওরে গাছ তোর নাম কি আর কি কামে লাগছ?

গাছ নিশ্চুপ।

লোকমান আবার জিগায়।
গাছ আবারও নিশ্চুপ।

এইবার লোকমান রেগে গিয়ে জিগায় -
ওরে বেয়াদপ গাছ তোর নাম কি আর কি কামে লাগস?
গাছ ও সামান তেজে উত্তর দেয়
"তোর মতো হাজার হাজার লোকমান হেকিম পয়দা করাই আমরা কাম"

চুপিচুপি আরেকটা জিনিস জানিয়ে যাই, গাঁজা গাছ হলো একমাত্তর গাছ যা স্বর্গেও পাওয়া যায়। গল্পটা ঠিক এইরকম ….

শিবঠাকুরের মনে সুখ নেই। কোনো নেশাই তাকে খুশি করতে পারছে না। এলেন তখন লোকমান হেকিম। বোধহয় ওই আলাপচারিতার পরের ঘটনা ! শিবঠাকুর কে বললেন গাঁজার নেশা করতে। শিববাবাজি গাঁজা খেয়ে এতো খুশি হলেন যে স্বর্গে নিয়ে গেলেন সাথে করে গাঁজাগাছ।

সেই সাহিত্যের ছাত্র আমার হোস্টেলের দাদার কথা দিয়েই শেষ করি। পরবর্তীকালে সেই দাদা রাজধানীর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের বিভাগীয় প্রধান হযেছিলেন। কয়েকবছর আগে খবর পেলুম তিনি আত্মহত্যা করেছেন। খোজ নিয়ে জানলুম নেশাটা ছেড়ে উঠতে পারেন নি। মানসিক অবসাদ হয়তো ….
আজ এই পর্যন্ত থাক।