মহামতি গোখলে একদা বলেছিলেন, হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্ক্স্ টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্ক্স্ টুমরো।
সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। তবে আস্ফালন তো রয়েই গেছে। অথচ ইতিহাস বলে, বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের মানুষ আদতে ছিল অনগ্রসর আদিবাসী। যে সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলার উদ্ভব, বাংলায় সেই সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন না বললেই চলে। সেন রাজাদের আমলে পুজো-আচ্চার কারণে কনৌজ থেকে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ভাড়া করে আনতে হত। পরে শ্রীচৈতন্যের আমলে সে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে বটে, তবে সাধারণ বাঙালি বহুকাল ছিল অশিক্ষিত। লেখাপড়া ব্যাপারটা বঙ্গজদের মধ্যে তেমন ছিল না।
প্রায় একক প্রচেষ্টায় অশিক্ষিত বাঙালিকে শিক্ষিত করার প্রয়াস নিয়েছিলেন এক একগুঁয়ে বাঙালি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যে সময় সংস্কৃত ভাষাশিক্ষাকেই শিক্ষা বলে গণ্য করা হত, সেই সময়ে বাঙালিকে বাংলা শেখানোর কাজে ব্রতী হলেন তিনি। ব্রিটিশ আমলের শতবর্ষ পূর্তির তখনো কিছু বাকি, অসন্তোষ বাড়ছে গ্রামবাংলায়, নীলকর চাষীদের ওপর অত্যাচার চরমে উঠছে। নবজাগরণের পথিকৃত রামমোহন মারা গেছেন বছর কুড়ি আগে। গদাধর চট্টোপাধ্যায় রামকৃষ্ণদেব হয়ে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির পুরোহিত হয়েছেন সদ্য। বহু পরিশ্রমে বিধবা বিবাহ আইন প্রচলন করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র। মাইকেল মধুসূদন বাংলায় বিচিত্র রসের কাব্যরচনা করছেন বটে, তবে তা আপামর বাঙালির বোধবুদ্ধির আয়ত্বের বাইরে। তাঁর মেঘনাদবধ কাব্য রচনা বা রবি ঠাকুরের জন্ম হতে তখনো ছ'বছর বাকি।
তখন ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স পঁয়ত্রিশ বছর। মফস্বলে স্কুল পরিদর্শনে যাওয়ার পথে পালকিতে বসে তিনি রচনা করলেন বর্ণপরিচয়ের পাণ্ডুলিপি। ১৮৫৫ সালের এপ্রিলে প্রথম ভাগ ও জুনে দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হল। দু'পয়সা দামের এই পুস্তিকা এক জাতির মেরুদণ্ড গঠনে এক যুগান্তকারী বিপ্লব এনে দিল।
এর আগে রাধাকান্ত দেব, ক্ষেত্রমোহন দত্ত, মদনমোহন তর্কালঙ্কার ও স্কুল বুক সোসাইটি শিশুপাঠ্য কিছু বই বাংলায় প্রকাশ করলেও সেগুলো জনপ্রিয় হয়নি। শিশুদের সামাজিক অবস্থান, শিশুশিক্ষা ও শিক্ষণপদ্ধতির বিষয়ে প্রয়োজনীয় সম্যক জ্ঞান এবং সর্বোপরি নিজস্ব প্রয়াসকে সর্বাঙ্গীন রূপ দেওয়ার একগুঁয়েমি অনুশীলনে এরা কেউ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ধারেকাছে ছিলেন না।
বাংলা বর্ণমালার আমূল সংস্কার, উপযুক্ত যতিচিহ্নের ব্যবহার এবং প্রাঞ্জল সহজ গদ্যে নিজেকে প্রকাশের সুষম দিগ্দর্শনে বর্ণপরিচয়ের অবদান অসীম। নিজে হিন্দু কুলীন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হয়েও এই গ্রন্থের কোথাও ধর্মীয় অনুশাসনের কোন উল্লেখ নেই, বরং নীতিশিক্ষাকেই শিশুশিক্ষার প্রকৃত রূপ বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
বর্ণপরিচয় প্রকাশের পর বিদ্যাসাগর আরও পঁয়ত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন। এই সময়ে বর্ণপরিচয়ের ১৫২টি মুদ্রণ সংস্করণ প্রকাশিত হয়, যার শেষের দিকে প্রতিটি সংস্করণে দেড় লক্ষেরও বেশি কপি ছাপা হত। ঐ সময়ে বাংলার জনসংখ্যা, শিশুমৃত্যু ও শিক্ষার হার বিবেচনা করলে বোঝা যায়, প্রতিটি বাঙালিই বর্ণপরিচয় পাঠ করেই শিক্ষার প্রথম সোপান অতিক্রম করেছে। বর্ণপরিচয়ের 'জল পড়ে, পাতা নড়ে' দিয়েই পরবর্তী এক শিক্ষাসাধকের কবিতার অঙ্গনে প্রবেশ ও বিশ্বজয়।
১৮২০ সালে আজকের দিনটিতে জন্মেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। দুশো বছর হতে চলল, বঙ্গমাতা আর একটিও এমন নাছোড়বান্দা সুসন্তান প্রসব করেন নি।
২৬শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩
সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। তবে আস্ফালন তো রয়েই গেছে। অথচ ইতিহাস বলে, বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের মানুষ আদতে ছিল অনগ্রসর আদিবাসী। যে সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলার উদ্ভব, বাংলায় সেই সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন না বললেই চলে। সেন রাজাদের আমলে পুজো-আচ্চার কারণে কনৌজ থেকে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ভাড়া করে আনতে হত। পরে শ্রীচৈতন্যের আমলে সে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে বটে, তবে সাধারণ বাঙালি বহুকাল ছিল অশিক্ষিত। লেখাপড়া ব্যাপারটা বঙ্গজদের মধ্যে তেমন ছিল না।
প্রায় একক প্রচেষ্টায় অশিক্ষিত বাঙালিকে শিক্ষিত করার প্রয়াস নিয়েছিলেন এক একগুঁয়ে বাঙালি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যে সময় সংস্কৃত ভাষাশিক্ষাকেই শিক্ষা বলে গণ্য করা হত, সেই সময়ে বাঙালিকে বাংলা শেখানোর কাজে ব্রতী হলেন তিনি। ব্রিটিশ আমলের শতবর্ষ পূর্তির তখনো কিছু বাকি, অসন্তোষ বাড়ছে গ্রামবাংলায়, নীলকর চাষীদের ওপর অত্যাচার চরমে উঠছে। নবজাগরণের পথিকৃত রামমোহন মারা গেছেন বছর কুড়ি আগে। গদাধর চট্টোপাধ্যায় রামকৃষ্ণদেব হয়ে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির পুরোহিত হয়েছেন সদ্য। বহু পরিশ্রমে বিধবা বিবাহ আইন প্রচলন করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র। মাইকেল মধুসূদন বাংলায় বিচিত্র রসের কাব্যরচনা করছেন বটে, তবে তা আপামর বাঙালির বোধবুদ্ধির আয়ত্বের বাইরে। তাঁর মেঘনাদবধ কাব্য রচনা বা রবি ঠাকুরের জন্ম হতে তখনো ছ'বছর বাকি।
তখন ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স পঁয়ত্রিশ বছর। মফস্বলে স্কুল পরিদর্শনে যাওয়ার পথে পালকিতে বসে তিনি রচনা করলেন বর্ণপরিচয়ের পাণ্ডুলিপি। ১৮৫৫ সালের এপ্রিলে প্রথম ভাগ ও জুনে দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হল। দু'পয়সা দামের এই পুস্তিকা এক জাতির মেরুদণ্ড গঠনে এক যুগান্তকারী বিপ্লব এনে দিল।
এর আগে রাধাকান্ত দেব, ক্ষেত্রমোহন দত্ত, মদনমোহন তর্কালঙ্কার ও স্কুল বুক সোসাইটি শিশুপাঠ্য কিছু বই বাংলায় প্রকাশ করলেও সেগুলো জনপ্রিয় হয়নি। শিশুদের সামাজিক অবস্থান, শিশুশিক্ষা ও শিক্ষণপদ্ধতির বিষয়ে প্রয়োজনীয় সম্যক জ্ঞান এবং সর্বোপরি নিজস্ব প্রয়াসকে সর্বাঙ্গীন রূপ দেওয়ার একগুঁয়েমি অনুশীলনে এরা কেউ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ধারেকাছে ছিলেন না।
বাংলা বর্ণমালার আমূল সংস্কার, উপযুক্ত যতিচিহ্নের ব্যবহার এবং প্রাঞ্জল সহজ গদ্যে নিজেকে প্রকাশের সুষম দিগ্দর্শনে বর্ণপরিচয়ের অবদান অসীম। নিজে হিন্দু কুলীন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হয়েও এই গ্রন্থের কোথাও ধর্মীয় অনুশাসনের কোন উল্লেখ নেই, বরং নীতিশিক্ষাকেই শিশুশিক্ষার প্রকৃত রূপ বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
বর্ণপরিচয় প্রকাশের পর বিদ্যাসাগর আরও পঁয়ত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন। এই সময়ে বর্ণপরিচয়ের ১৫২টি মুদ্রণ সংস্করণ প্রকাশিত হয়, যার শেষের দিকে প্রতিটি সংস্করণে দেড় লক্ষেরও বেশি কপি ছাপা হত। ঐ সময়ে বাংলার জনসংখ্যা, শিশুমৃত্যু ও শিক্ষার হার বিবেচনা করলে বোঝা যায়, প্রতিটি বাঙালিই বর্ণপরিচয় পাঠ করেই শিক্ষার প্রথম সোপান অতিক্রম করেছে। বর্ণপরিচয়ের 'জল পড়ে, পাতা নড়ে' দিয়েই পরবর্তী এক শিক্ষাসাধকের কবিতার অঙ্গনে প্রবেশ ও বিশ্বজয়।
১৮২০ সালে আজকের দিনটিতে জন্মেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। দুশো বছর হতে চলল, বঙ্গমাতা আর একটিও এমন নাছোড়বান্দা সুসন্তান প্রসব করেন নি।
২৬শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩