বুধবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২০

কৃষক বিল ~ সুশোভন পাত্র

দিলপ্রীত আজকাল লন্ডনে থাকে। আর দিলপ্রীতের বাবা ৩ লক্ষ কৃষকের একজন হয়ে রাত কাটাচ্ছে, দিল্লির টিকরি সীমান্তে।
দিলপ্রীত আমার প্রাক্তন কলিগ। দু-বছরের জুনিয়র। পাঞ্জাবের মোগার স্বচ্ছল কৃষক পরিবারের মেয়ে। ঐ যে বলে না 'পাঞ্জাব দি কুড়ি'; সরোষ কা সাগ, মাক্কি কি রোটি, লোরি, ভাংরার ককটেলে দিলপ্রীত বিলকুল তাই। দিলপ্রীতের IAS পরীক্ষার প্রস্তুতির সময়, অফিসের ভেন্ডিং মেশিনের সামনের করিডোরে দাঁড়িয়ে দিলপ্রীত প্রায়ই বলত

- আপ লোগো কা ইয়ে কমিউনিস্ট ওয়ালি ফান্ডা ইন্ডিয়া ম্যা নেহি চলেগি।

অর্থনীতি, ধর্ম, সংরক্ষণ, বেসরকারিকরণ -গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে দিলপ্রীতের অবস্থান আমার ১৮০ ডিগ্রী বিপরীতে। ২০১৪-য় মিডিয়ায় মোদীর হাই-পিচ ক্যাম্পেনে ভেসে 'ভারত ভাগ্য বিধাতার' ৩৬০ ডিগ্রী উন্নতির স্বপ্নে মশগুল দিলপ্রীত বলেছিল

- কুছ তো আচ্ছা করেগা লাগতা হ্যা ইয়ে বান্দা!

প্রায় ৮ মাস পর, শুক্রবার হোয়াটস-অ্যাপে কথা হল, দিলপ্রীতের সাথে। লন্ডনের সাউথব্যাঙ্কের IBM-র অফিসে বসে বলা দিলপ্রীতের কথা গুলো এখনও কানে বাজছে

- আপ তো জরুর ফার্মারস কে সাইড হি হোঙ্গে? ভরসা হ্যা আপ লোগো পে। কিউকি পাপা কি ভরোসে টিকি হুয়ি হ্যা লাল ঝাণ্ডে পে!

দিলপ্রীত কে বলেছি, ভরসা থাকুক। লড়াই হবে শেষ তক। লড়াই হবে এসপার-ওসপার। লড়াই হচ্ছেও, রাজপথে, হৃদযন্ত্রে আলোড়ন তুলে। জ্যোতি বাবু বলতেন, "মানুষ অভিজ্ঞতা দিয়েই বোঝে।" লন্ডনে বসে দিলপ্রীত বুঝেছে, 'অভিজ্ঞতা দিয়েই'। দিল্লির কৃষক আন্দোলনের লিটমাস টেস্টের রিপোর্টে কার্ডে বুঝছে অনেকেই। বুঝছে যে, এখন সংসদীয় রাজনীতির পাটিগণিতে তুরুপের তাস না হলেও সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার যন্ত্রণটার শীতলপাটি হওয়ার ক্ষমতা বামপন্থীদের আগেও ছিল, এখনও আছে আর পরেও থাকবে। জান কবুল, মান কবুল লড়াই'র হিম্মতটা বামপন্থীদের আগেও ছিল, এখনও আছে আর পরেও থাকবে।
১২দিনের ব্যবধানে দু-বার স্তব্ধ হয়েছে দেশ। ঐ লাল ঝাণ্ডার নেতৃত্বেই। আলপথ থেকে গলিপথ -সম্বিৎ ফিরছে দেশের। চোখ ফুটেছে ভাড়াটে মিডিয়ার। কৃষকদের দাবীর সমর্থনে মিছিল হয়েছে বার্মিংহামে, মিছিল হয়েছে মেলবোর্নে। মিছিল হয়েছে, ক্যালিফোর্নিয়ায়, মিছিল হয়েছে কানাডায়। মিছিল হয়েছে দাঙ্গাবাজদের আখড়া গুজরাটেও। ভয়ে হিন্দুত্ববাদের নব্য ল্যাবেরোটারি উত্তরপ্রদেশে গৃহবন্দী করে রাখতে হয়েছে লাল ঝাণ্ডার সৈনিক সুভাষিণী আলিকে। টেনে হিঁচড়ে প্রিজন ভ্যানে তুলতে হয়েছে লাল ঝাণ্ডার নেত্রী মারিয়াম ধাওয়ালে কে। মিডিয়ার তৈরি মেকি চাণক্যদের গলদঘর্ম কৃষক আন্দোলন কে সামাল দিতে মাঝরাত পর্যন্ত নতজানু হয়ে বসে থাকতে হয়েছে লাল ঝাণ্ডার কৃষক নেতা হান্নান মোল্লাদের সামনে।

সার্কাসের রিং মাস্টার নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন 'কৃষকদরদী বিল'। বলেছিলেন 'ঐতিহাসিক বিল'। আমরা বলেছিলাম হিসেব হবে। হিসেব হবে 'ঐতিহাসিক বিল' মুখ লুকিয়ে পাশ হল কেন? হিসেব হবে, 'কৃষকদরদী বিল' যখন দেশের কিষানরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে কেন? হিসেব হবে, কোনও রাজ্য সরকারের মতামত নেওয়া হল না কেন? হিসেব হবে, সম্প্রচার বন্ধ করে রাজ্যসভায় মার্শাল লেলিয়ে গলার জোরে ভোট করাতে হল কেন? আসলে 'ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি'! বিল ঐতিহাসিকই, তবে কিষানদের জন্য নয়, রিং মাস্টারের পীরিতের কর্পোরেট শিল্পপতি আম্বানি-আদানিদের জন্য।

আম্বানি-আদানিদের স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর মুখে লাথি মেরে, ৫৬ বছরের পুরনো 'প্ল্যানিং কমিশন' প্যারালাইজড করে, ২০১৫-তে মোদী ঘটা করে নামিয়েছিলেন 'নীতি আয়োগ'। গতকাল সেই নীতি আয়োগেরই CEO অমিতাভ কান্ত, বিগ-বিজনেস হাউস ভেদান্তের স্পন্সরড, সঙ্ঘ পরিবারের মুখপত্র এবং ফেক নিউজের এপিসেন্টার 'স্বরাজ ম্যাগাজিনের' সান্ধ্য আড্ডায় অন ক্যামেরা বলেছেন, "আমাদের দেশের অর্থনীতি তে বড় ধরণের আর্থিক সংস্কার সম্ভব হচ্ছে না কারণ, too much of democracy"
আমাদের দেশে Democracy-র D-র অবস্থা কেমন? জানে কাশ্মীর। জানেন স্ট্যান স্বামী, সাফুরা জারগর। জানেন গৌরি লঙ্কেশ, বিলকিস বানো। জানেন দিল্লি সীমান্তে পুলিশের লাঠিতে আক্রান্ত কৃষক। আর জানে, বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের ধারণাকে পরিমাপ করা সুইডেনের গথেনবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ সংস্থা V-Dem Institute। তাঁদের সাম্প্রতিক রিসার্চে উঠে এসেছে Academic Freedom, Civil Liberties, Rule Of Law এবং Freedom of Expression Index -গত ৬ বছরে Liberal Democracy-র  চারটি সূচকের প্রতিটিতে ক্রমশ নেমেছে ভারত। এমনকি Academic Freedom, Civil Liberties-র সূচকে বর্তমান ভারতের পয়েন্ট স্কোর ১৯৭৫-৭৭ এমারজেন্সির সময়ের তুলানতেও খারাপ।

আসলে অমিতাভ কান্ত নতুন কিছুই বলেননি। ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে, পুঁজিবাদের ভাষায় 'বড় আর্থিক সংস্কারের' নামে দেশের সম্পদ বেচে দেওয়ার, আম্বানি-আদানি'দের পকেটে ভরিয়ে দেওয়ার অঙ্কের নিয়মেই 'গণতন্ত্র' ধ্বংসের প্রয়োজন পড়ে। কৃষক-শ্রমিকদের অধিকার বন্দুক-বারুদের বিনিময়ে রক্তাক্ত করার প্রয়োজন পড়ে। হিটলার, মুসোলিনি, ফ্রাঙ্কোর মত ফ্যাসিস্ট ম্যাসকটদের জন্ম দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। নিও লিবারেল জমানায় যার শুরুটা হয়েছিল চিলি তে। মিল্টন ফ্রিডম্যানের নীতির বাস্তবায়নে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সালভাদোর অ্যালেন্দের সরকারের বিরুদ্ধে সিআইএ লেলিয়ে সামরিক অভ্যুত্থানের বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে সেবার জন্ম হয়েছিল মার্কা মারা আরেক ফ্যাসিস্টের, পিনোচেতে!

শেষ রক্ষা অবশ্য হয়নি। এই অক্টোবরে চিলি গণভোটের মাধ্যমে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছে পিনোচেতের আমলের সংবিধান। সান্তিয়াগোর রাস্তা আবার সেজেছে সালভাদোরের ছবিতে। চিলির বিহ্বল যৌবন আবার গলা মিলিয়েছে ভিক্টর জারার সুরে। হ্যাঁ, লাল ঝাণ্ডার নেতৃত্বেই। তাই যারা বিদ্রূপ করে আপনাকে জিজ্ঞেস করেন, '৫রাজ্যে বামপন্থীরা কটা আসন পেল?', কিম্বা ঔদ্ধত্যের সাথে ঘোষণা করেন '১৯টি রাজ্যে আমরা ক্ষমতায়', তোরা কটায়?', কিম্বা ব্যাঙ্গ করে বলেন "তোরা তো ৭%। পরের বার তো শূন্য হয়ে যাবি।" তাঁদের ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপে মুচকি হাসুন।

আর বিনয়ের সাথে, ওঁদের কাঁধে হাত রেখে, দিল্লির কৃষক আন্দোলনের ভরকেন্দ্রে উড়তে থাকা লাল পতাকার দিকে চোখ রাখতে বলুন। মনে করিয়ে দিন যে, পৃথিবীর প্রত্যেকটা মহাদেশের, প্রত্যেকটা দেশের, প্রত্যেকটা শহরের, প্রত্যেকটা গ্রামের, প্রত্যেকটা জনপদে; হয়ত কোন ফ্যাক্টরির গেটের সামনে, কিম্বা হয়ত কৃষকের এক ফালি জমির মাঝে, হয়ত কংক্রিটের মিছিলে বেকারের কাঁধে, কিম্বা স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে মেহনতির প্রতিবাদের ভাষায়, কখনও লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে উদ্ধত শ্লোগানে সেজে, কখনও যুদ্ধবিরোধী মিছিলে শান্তির পতাকা হয়ে কাস্তে-হাতুড়ি আঁকা ঐ একটুকরো লাল কাপড় কিন্তু ঠিক উড়ছে। আর উড়ছে, মহম্মদ আর রামের নামে মানুষ ক্ষ্যাপাতে নয়, উৎসব আর মেলায় মাতিয়ে রাখতে নয়।

শোষণ-বঞ্চনাহীন নতুন ভোরের স্বপ্নটাকে সাচ্চা করতে। দুনিয়ার মেহনতি মানুষ কে আগলে রাখতে। কিম্বা হয়ত ঠিক এই মুহূর্তে  দিল্লির শীতে, হক আদায়ের লড়াইয়ের স্বার্থে কৃষকদের অস্থায়ী তাবুতে।
----------------------------------------------------------------------
কৃষক সংগঠনগুলো একযোগে সরকারের নতুন দেওয়া রফাসুত্র খারিজ করে জানিয়েছে যে চাষীদের এই আন্দোলন আরো জোরদার হবে।

◾১২ই ডিসেম্বর - সারা দেশের টোলপ্লাজাগুলোকে টোল-মুক্ত করে দেওয়া হবে।
◾১২ই ডিসেম্বর - দিল্লী জয়পুর হাইওয়ে বন্ধ করে দেওয়া হবে।
◾১৪ই ডিসেম্বর - উত্তর ভারতের সমস্ত চাষীদের উদ্দেশ্যে "দিল্লী চলো" আহ্বান।
◾১৪ই ডিসেম্বর - অন্য সমস্ত রাজ্যে চাষীদের উদ্দেশ্যে আহ্বান আঞ্চলিক স্তরে বিক্ষোভ কর্মসূচী নেওয়ার।
◾সমস্ত জিও প্রোডাক্ট, আম্বানি/আদানিদের শপিং মল, পেট্রোল পাম্প বয়কটের ডাক
◾সারা দেশ জুড়ে বিজেপি নেতৃত্ব, তাদের জেলা ও রাজ্য অফিস ঘেরাও
◾আন্দোলনের নতুন স্লোগান - "সরকার কি আসলি মজবুরি - আদানি, আম্বানি, জমাখোড়ি"

দড়িতে এবার টান পড়েছে। এসপার, নয় উসপার। ইয়ে ইনকিলাব হ্যায় স্যার, দিস ইজ রেভোলিউশন।

#standwithfarmerschallenge #জয়কিসান

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন