শুক্রবার, ৪ এপ্রিল, ২০২৫

শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি ও তৃণমূলের শ্রেণী চরিত্র ~ বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী

যা হয়েছে এবং হচ্ছে তা যে খুব খারাপ হচ্ছে তা প্রায় সবাই বোঝে ('প্রায়' বললাম কারণ আমার ফ্রেন্ডলিস্টেই এমন লোকজন আছে যারা মনে করে যে দুর্নীতিটা ততটা খারাপ নয় কিন্তু রায়টা জঘন্য)। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন হচ্ছে।

'স্টাডিজ় ইন ইন্ডিয়ান পলিটিক্স'-এ জ়াদ মাহমুদ এবং সোহম ভট্টাচার্য লিখিত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে- 'দ্য রুটস অফ আ পপুলিস্ট রেজিম: এগজ়ামিনিং দ্য তৃণমূল কংগ্রেস ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল'। ওরা সেখানে নজর দিয়েছে বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের যে প্রার্থীরা ভোটে দাঁড়ান, তাঁদের শ্রেণি ও পেশাগত পরিচিতির দিকে। এবং ওরা এটা দেখিয়েছে যে তাঁদের এই শ্রেণি এবং পেশা কী ভাবে রাজ্যের বাজেট ও নীতিকে প্রভাবিত করেছে।

প্রথমত, এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের কাছে ঘোষিত সম্পদের নিক্তিতে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীরা সব থেকে ধনী। ২০২১ সালে তৃণমূল প্রার্থীদের গড় সম্পদ ২ কোটি ৮৫ লক্ষ ৮৭ হাজার ৬১৪ টাকা। কিন্তু তার থেকেও উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ২০১১ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এই সম্পদ বেড়েছে ৮.৮৫ শতাংশ হারে, কিন্তু ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে এই বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ২০.১০ শতাংশ। এই প্রার্থীদের সঙ্গে জনসাধারণের গড় সম্পদের ফারাক কত? ২০১৮-১৯ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গে মানুষের গড় সম্পদের পরিমাণ ৭ লক্ষ ৮৯ হাজার টাকা, আর শহরাঞ্চলে তার মান ১৯ লক্ষ ৬৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ, তৃণমূল প্রার্থীরা রাজ্যের বিত্তশালী মানুষজন। প্রশ্ন হল, এই বিত্তের উৎস কোন পেশা?

২০১১ সালের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ব্যবসায়িক শ্রেণির আধিপত্য বেড়েছে। বাম দলগুলি ছাড়া সব দলেই। তারই সঙ্গে আরও একটি ঘটনা ঘটেছে তৃণমূলের প্রার্থী বিন্যাসে। চাকুরিজীবী শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব ক্রমশ কমেছে। তৃণমূল প্রার্থীদের মধ্যে ২০১১ সালের নির্বাচনে চাকুরিজীবী লোকজনের অনুপাত ছিল ৪৫.৭৪ শতাংশ, তা ২০১৬ সালে হয়েছে ৪১.৭৫ শতাংশ এবং ২০২১ সালের নির্বাচনে ৩৪.৪৮ শতাংশ। এই ব্যবসায়ীরা কিন্তু বৃহৎ কর্পোরেট শিল্পপতি নন। এঁরা মূলত স্থানীয় পুঁজির মালিক, যাদের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি নির্ভর করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার উপর। অর্থাৎ, রিসর্ট, ট্র‌্যাভেল এজেন্সি, খুচরো ও পাইকারি বাণিজ্য, চালকল, অনেক ক্ষেত্রেই বেসরকারি স্কুল এবং নার্সিং হোম। 
শাসক দলের এই শ্রেণিচরিত্রের প্রভাব পড়েছে তাদের বাজেট বরাদ্দেও। ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে রাজ্য সরকারের যে মূলধনী ব্যয়, তার মাত্র ৬.২ শতাংশ বরাদ্দ হয়েছে শিল্পক্ষেত্রের জন্য, মাত্র ১০.৯ শতাংশ কৃষিক্ষেত্রের জন্য। অথচ গ্রামোন্নয়ন এবং বিশেষ এলাকা উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ হয়েছে ২১.৫ শতাংশ, পরিবহণ খাতে ২৬.৪ শতাংশ। ফলে শিল্পক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ক্রমাগত কমলেও বেড়েছে পাইকারি ও খুচরো ব্যবসা এবং রিয়েল এস্টেট, এই দু'টি ক্ষেত্রের বৃদ্ধির হার।  

বাম আমলে সরকারি চাকুরে, শিক্ষক এবং অধ্যাপকরা নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই আধিপত্যের কিছু যথার্থ সমালোচনা হতেই পারে। কিন্তু নিজেদের স্বার্থেই এই শ্রেণির সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় একটা 'স্টেক' ছিল। তখনও সে ভাবে বেসরকারি স্কুল-কলেজ তৈরি হয়নি, এবং হলেও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অধিকাংশের পক্ষেই সেখানে ছেলেমেয়েদের পাঠানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু জ়াদ এবং সোহমের গবেষণায় যে শ্রেণিকে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতে দেখা যাচ্ছে, সেই নয়া এলিটদের ব্যক্তিগত স্বার্থের সঙ্গে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির বিশেষ সাযুজ্য নেই। ধনী হওয়ার সুবাদে তারা সহজেই বেসরকারি স্কুলে ছেলেমেয়েকে পাঠাতে পারে, এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই সেই স্কুল-কলেজের মালিক।
তাদের ব্যবসায়িক উন্নতির জন্য শিক্ষার গড় গুণমান খুব উন্নত হওয়ার প্রয়োজন, এমনও নয়। মনে রাখা দরকার, ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এক লাফে আড়াই লক্ষ কমে গিয়েছে। ক্রমশ ভালো স্কুলগুলো নিজেদের রাজ্য বোর্ড থেকে সরিয়ে নিচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি সব ক্ষেত্রেই বোঝা যাবে, কিন্তু আপাতত স্থানীয় পুঁজির তেমন কোনও ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। 
আপাতদৃষ্টিতে ভোটেও এর প্রভাব পড়ে না। কারণ, বেসরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য যতই নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাবে, ততই বাড়বে 'রিলিফ'-এর প্রয়োজনীয়তা, অর্থাৎ নানা রকম অনুদানমূলক স্কিম, এবং যারা এই 'রিলিফ' জোগাচ্ছে, তাদের প্রতি সমর্থন। এই ঘটনা সারা ভারতেই দেখা যাচ্ছে, তবে পশ্চিমবঙ্গের মতো তুলনামূলক ভাবে দরিদ্র রাজ্যে তা আরও প্রকট।
মোটের উপর ছবিটা এ রকমই। যা ঘটল, তা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন