আজ বছর দশ পর....
দশ বছর আগের ক্রিসমাস ইভ। ২০০৮ সালের ২৪শে ডিসেম্বর। তখন আজকের মত পার্ক স্ট্রিটে 'বড়দিনের কার্নিভাল' ছিল না। তবে উৎসব ছিল বই কি! কলকাতা শহর, শহরতলি, মফস্বল থেকে তখনও মানুষ আসতেন বড়দিনে কলকাতায়।
চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, নিকো পার্কে তখনও বড়দিনের আগের দিন থেকেই ছিল বেলুনের জন্য শৈশবের বায়না। তখনও ছিল আইসক্রিমের জন্য কৈশোরের নাছোড়বান্দা আবদার। দশ বছর আগে বড়দিনের আগের দিন তখনও ছিল পার্ক স্ট্রিটে ভিড়।
যাই হোক, ২০০৮ সালের ২৪শে ডিসেম্বর। দশ বছর আগের ঠিক এই দিন ছিল বুধবার। আলো ঝলমলে বড়দিনের আগের দিন আলো ঝলমল ছিল মিলনমেলা আর উল্টোদিকের সায়েন্স সিটিতে।
দশ বছর আগে, ২০০৮ সালের ২৪শে ডিসেম্বর। সায়েন্স সিটিতে সেদিনের সন্ধ্যায় শুরু হয়েছিল 'ইন্ডিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেগা ট্রেড ফেয়ার'। দশ বছর আগে ঠিক এই দিনে শিল্পমেলার উদ্বোধন করেছিলেন নিরুপম সেন।
২০০৮ সালে মানে মহামন্দার শুরু। ঝাঁপ পড়েছে লেম্যান ব্রাদার্সে। ঝাঁপ পড়েছে মেরিল লিঞ্চে। নাসড্যাক থেকে সেনসেক্স দুনিয়ার সব শেয়ার বাজারে লালবাতি।
আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে ২০০৮ সালের ২৪শে ডিসেম্বর 'ইন্ডিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেগা ট্রেড ফেয়ার' উদ্বোধন করে নিরুপম সেন বলেছিলেন 'দুনিয়া জোড়া মন্দার আঁচ পড়েনি পশ্চিম বাংলায়। এখনও পর্যন্ত রাজ্যের একটিও নির্মীয়মান শিল্পে প্রভাব পড়েনি।'
মোট ৩০০টি শিল্প সংস্থা যোগ দিয়েছিল সেই মেলায়।
সেই সময়। কদিন আগেই সিঙ্গুর থেকে চলে গেছে মোটর গাড়ির প্রকল্প।
..................................
দশ বছর পর আজকের ক্রিসমাস ইভ। আজ পার্ক স্ট্রিটে 'কার্নিভাল' আছে চার দিন আগে থেকেই।
ঠিক দশ বছর পর ২০১৮ সালের ২৪শে ডিসেম্বরের সন্ধ্যা। 'পিস ওয়ার্ল্ড'-র বরফে ঢাকা কফিনে ঘুমিয়ে আছেন নিরুপম সেন।
ভোর ৫টা দশ মিনিট। প্রয়াত হয়েছেন নিরুপম সেন।
এছাড়াও আজকের সন্ধ্যায় আরেকটা বড় খবর। রথযাত্রা নিয়ে বিজেপি-র চটজলদি শুনানির আবেদন বাতিল হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে!
দশ বছর আগের ২৪শে ডিসেম্বর। বাধা স্বত্তেও কর্মসংস্থানের স্বার্থে শিল্পে এগোনো। দশ বছর পর আজকের ২৪শে ডিসেম্বর। কাজ নয়, শিল্প নয়। বিতর্ক রথের পথ নিয়ে!
..............................
আজ থেকে ঠিক দশ বছরেরও বেশি আরেকটু সময়। সিঙ্গুরে মোটরগাড়ির কারখানা তখনও জিন্দা ছিল। রোজ সন্ধ্যায় প্রকল্প থেকে মনের আনন্দে বাড়ি ফিরতেন মৃণাল কান্তি খাঁড়া। তাঁর ঠাকুমা প্রয়াতা মঙ্গলা খাঁড়া ছিলেন প্রকল্পে প্রথম জমি দাতা। প্রয়াতা মঙ্গলা খাঁড়ার নাতি মৃণালকান্তি খাঁড়া। সিঙ্গুর প্রকল্পের প্রথম জমিদাতা হিসাবে এখনও তাঁদের পরিবারের গর্ববোধ রয়েছে। সিঙ্গুর প্রকল্পে চার বিঘা জমি দিয়েছিলেন তাঁদের পরিবার।
'সেদিনটা এখনও ভুলতে পারি না, ২০০৬ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর। আমিই ঠাকুমাকে বাইক চাপিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হল। বাইরের গেটে ভিড় বাড়ছে। বিডিও অপিস ঘিরে রেখেছে তৃণমূল। মমতা এলেন, আরও ঝামেলা বাঁধলো। বুড়ি ঠাকুমাকে নিয়ে কিভাবে বাড়ি যাব ভেবে পাচ্ছিলাম না, বাইরে ঝামেলা হচ্ছে, কোন মতে ডি এম সাহেব একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে ঠাকুমাকে বাড়ি পাঠিয়েছিলেন, সেদিন থেকে জমি দেওয়ার কারণে আমরা ছিলাম তৃণমূলের টার্গেট', বলেছেন মৃণালকান্তি।
এমন একটা দিন যায়নি যেদিন খাঁড়া পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়নি। মোটরগাড়ির কারখানা উঠে যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত ওঁদের বাড়িতে ঢিল পড়েছে, দরজা জানলা ভাংচুর হয়েছে। 'রোজ লুকিয়ে বাড়ি ফিরতাম, এই বুঝি কেউ মেরে দেয়, সব সময়ে থাকতাম ভয়ে ভয়ে', বলেছেন মৃণালকান্তি।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ মৃণাল কান্তি খাঁড়া কারখানায় চাকরির জন্য ট্রেনিং নিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ মিশন বেলুড়ের পর গিয়েছিলেন পুনায়, উত্তরাখন্ডে টাটা মোটরস্ কারখানায় হাতে কলমে কাজ শিখতে। টাটা মোটরস্-র অফার লেটার, টাটা ভোল্টাস কোম্পানির সার্টিফিকেট সব এখনও সযত্নে রেখে দিয়েছেন মৃণালকান্তি।
দশ বছর পার করে মৃণাল কান্তি আজকের রাতে ভাঙা মন নিয়ে বাড়ি ফেরেন, যেমন ফেরেন গত দশ বছর ধরেই।
এখন মৃণালকান্তি সিঙ্গুরের বাজেমেলিয়া মোড়ে দোকান দিয়েছেন। কালিমাতা রিপেয়ারিং শপ। স্টোভ আর গ্যাসের ওভেন সারান।
............................................
৮এবং ৯ই জানুয়ারির ধর্মঘটের বড় দাবি এরাজ্যে বন্ধ কারখানা খোলা। ধর্মঘটের বড় দাবি কর্মসংস্থান।
৮এবং৯ই জানুয়ারি অচল হবে দেশ। অচল করতে হবে বাংলা।
ধর্মঘটে জবাব দিতে হবে আজকের শাসককে। আসুন প্রস্তুতি নিই। আর নয়। আর নয় আমাদের অনুজ,সন্তান সন্ততিদের ভবিষ্যৎ এই নরখাদকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া।
৮এবং ৯ই জানুয়ারির ধর্মঘট সফল করেই আসুন আমরা সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা জানাই কমরেড নিরুপম সেনকে।
কমরেড নিরুপম সেন লাল সেলাম। কমরেড নিরুপম সেন অমর রহে।
পুনশ্চ: সঙ্গে রইলো দশ বছর আগের ও দশ বছর পরের ঘটনাগুলির ছবি।