মঙ্গলবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৮

নিরুপম সেন ~ অর্ক রাজপন্ডিত

আজ বছর দশ পর....

দশ বছর আগের ক্রিসমাস ইভ। ২০০৮ সালের ২৪শে ডিসেম্বর। তখন আজকের মত পার্ক স্ট্রিটে 'বড়দিনের কার্নিভাল' ছিল না। তবে উৎসব ছিল বই কি! কলকাতা শহর, শহরতলি, মফস্বল থেকে তখনও মানুষ আসতেন বড়দিনে কলকাতায়।

চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, নিকো পার্কে তখনও বড়দিনের আগের দিন থেকেই ছিল বেলুনের জন্য শৈশবের বায়না। তখনও ছিল আইসক্রিমের জন্য কৈশোরের নাছোড়বান্দা আবদার। দশ বছর আগে বড়দিনের আগের দিন তখনও ছিল পার্ক স্ট্রিটে ভিড়।

যাই হোক, ২০০৮ সালের ২৪শে ডিসেম্বর। দশ বছর আগের ঠিক এই দিন ছিল বুধবার। আলো ঝলমলে বড়দিনের আগের দিন আলো ঝলমল ছিল মিলনমেলা আর উল্টোদিকের সায়েন্স সিটিতে।

দশ বছর আগে, ২০০৮ সালের ২৪শে ডিসেম্বর। সায়েন্স সিটিতে সেদিনের সন্ধ্যায় শুরু হয়েছিল 'ইন্ডিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেগা ট্রেড ফেয়ার'। দশ বছর আগে ঠিক এই দিনে শিল্পমেলার উদ্বোধন করেছিলেন নিরুপম সেন।

২০০৮ সালে মানে মহামন্দার শুরু। ঝাঁপ পড়েছে লেম্যান ব্রাদার্সে। ঝাঁপ পড়েছে মেরিল লিঞ্চে। নাসড্যাক থেকে সেনসেক্স দুনিয়ার সব শেয়ার বাজারে লালবাতি।

আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে ২০০৮ সালের ২৪শে ডিসেম্বর 'ইন্ডিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেগা ট্রেড ফেয়ার' উদ্বোধন করে নিরুপম সেন বলেছিলেন 'দুনিয়া জোড়া মন্দার আঁচ পড়েনি পশ্চিম বাংলায়। এখনও পর্যন্ত রাজ্যের একটিও নির্মীয়মান শিল্পে প্রভাব পড়েনি।'

মোট ৩০০টি শিল্প সংস্থা যোগ দিয়েছিল সেই মেলায়।

সেই সময়। কদিন আগেই সিঙ্গুর থেকে চলে গেছে মোটর গাড়ির প্রকল্প।

..................................

দশ বছর পর আজকের ক্রিসমাস ইভ। আজ পার্ক স্ট্রিটে 'কার্নিভাল' আছে চার দিন আগে থেকেই।

ঠিক দশ বছর পর ২০১৮ সালের ২৪শে ডিসেম্বরের সন্ধ্যা। 'পিস ওয়ার্ল্ড'-র বরফে ঢাকা কফিনে ঘুমিয়ে আছেন নিরুপম সেন।

ভোর ৫টা দশ মিনিট। প্রয়াত হয়েছেন নিরুপম সেন।

এছাড়াও আজকের সন্ধ্যায় আরেকটা বড় খবর। রথযাত্রা নিয়ে বিজেপি-র চটজলদি শুনানির আবেদন বাতিল হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে!

দশ বছর আগের ২৪শে ডিসেম্বর। বাধা স্বত্তেও কর্মসংস্থানের স্বার্থে শিল্পে এগোনো। দশ বছর পর আজকের ২৪শে ডিসেম্বর। কাজ নয়, শিল্প নয়। বিতর্ক রথের পথ নিয়ে!

..............................

আজ থেকে ঠিক দশ বছরেরও বেশি আরেকটু সময়। সিঙ্গুরে মোটরগাড়ির কারখানা তখনও জিন্দা ছিল। রোজ সন্ধ্যায় প্রকল্প থেকে মনের আনন্দে বাড়ি ফিরতেন মৃণাল কান্তি খাঁড়া। তাঁর ঠাকুমা প্রয়াতা মঙ্গলা খাঁড়া ছিলেন প্রকল্পে প্রথম জমি দাতা। প্রয়াতা মঙ্গলা খাঁড়ার নাতি মৃণালকান্তি খাঁড়া। সিঙ্গুর প্রকল্পের প্রথম জমিদাতা হিসাবে এখনও তাঁদের পরিবারের গর্ববোধ রয়েছে। সিঙ্গুর প্রকল্পে চার বিঘা জমি দিয়েছিলেন তাঁদের পরিবার।

'সেদিনটা এখনও ভুলতে পারি না, ২০০৬ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর। আমিই ঠাকুমাকে বাইক চাপিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হল। বাইরের গেটে ভিড় বাড়ছে। বিডিও অপিস ঘিরে রেখেছে তৃণমূল। মমতা এলেন, আরও ঝামেলা বাঁধলো। বুড়ি ঠাকুমাকে নিয়ে কিভাবে বাড়ি যাব ভেবে পাচ্ছিলাম না, বাইরে ঝামেলা হচ্ছে, কোন মতে ডি এম সাহেব একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে ঠাকুমাকে বাড়ি পাঠিয়েছিলেন, সেদিন থেকে জমি দেওয়ার কারণে আমরা ছিলাম তৃণমূলের টার্গেট', বলেছেন মৃণালকান্তি।

এমন একটা দিন যায়নি যেদিন খাঁড়া পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়নি। মোটরগাড়ির কারখানা উঠে যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত ওঁদের বাড়িতে ঢিল পড়েছে, দরজা জানলা ভাংচুর হয়েছে। 'রোজ লুকিয়ে বাড়ি ফিরতাম, এই বুঝি কেউ মেরে দেয়, সব সময়ে থাকতাম ভয়ে ভয়ে', বলেছেন মৃণালকান্তি।

উচ্চ মাধ্যমিক পাশ মৃণাল কান্তি খাঁড়া কারখানায় চাকরির জন্য ট্রেনিং নিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ মিশন বেলুড়ের পর গিয়েছিলেন পুনায়, উত্তরাখন্ডে টাটা মোটরস্‌ কারখানায় হাতে কলমে কাজ শিখতে। টাটা মোটরস্‌-র অফার লেটার, টাটা ভোল্টাস কোম্পানির সার্টিফিকেট সব এখনও সযত্নে রেখে দিয়েছেন মৃণালকান্তি।

দশ বছর পার করে মৃণাল কান্তি আজকের রাতে ভাঙা মন নিয়ে বাড়ি ফেরেন, যেমন ফেরেন গত দশ বছর ধরেই।

এখন মৃণালকান্তি সিঙ্গুরের বাজেমেলিয়া মোড়ে দোকান দিয়েছেন। কালিমাতা রিপেয়ারিং শপ। স্টোভ আর গ্যাসের ওভেন সারান।

............................................

৮এবং ৯ই জানুয়ারির ধর্মঘটের বড় দাবি এরাজ্যে বন্ধ কারখানা খোলা। ধর্মঘটের বড় দাবি কর্মসংস্থান।

৮এবং৯ই জানুয়ারি অচল হবে দেশ। অচল করতে হবে বাংলা।

ধর্মঘটে জবাব দিতে হবে আজকের শাসককে। আসুন প্রস্তুতি নিই। আর নয়। আর নয় আমাদের অনুজ,সন্তান সন্ততিদের ভবিষ্যৎ এই নরখাদকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া।

৮এবং ৯ই জানুয়ারির ধর্মঘট সফল করেই আসুন আমরা সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা জানাই কমরেড নিরুপম সেনকে।

কমরেড নিরুপম সেন লাল সেলাম। কমরেড নিরুপম সেন অমর রহে।

পুনশ্চ: সঙ্গে রইলো দশ বছর আগের ও দশ বছর পরের ঘটনাগুলির ছবি।

সোমবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৮

কেবলই স্বপন, করেছি বপন ~ অনামিকা

কেন আজ সিপিএম নেই ক্ষমতায়?
বিপ্লবীদের সে'টা দারুণ ভাবায়।
'অতি' বলে 'প্রতি' তোর মাথা অতি মোটা
বুঝিস না কিছুতেই সোজা অঙ্কটা।
অমুক সে বইটার তমুক পাতায়
লেখা আছে কী আগুন কত খাওয়া যায়।

প্রতি বলে, দাঁড়া আগে বেচে নিই ছবি।
সুবোধ্য হেসে ওঠে নেট বিপ্লবী।
নিও কম্যুনিজমের সোজা অঙ্কটি। 
ঢুকে যায় ফোকটিয়া প্রায় দুই কোটি।
গুরুতর চণ্ডাল আঁচ পেয়ে ঢিমে
আত্মপ্রসাদে মন ঢেলে দেয় মিমএ।

ফেসবুক বিপ্লবী বলে সাদা চুল
কমিউনে আজও কেন? এইটেই ভুল।
আলোকিত করেছে যে রাজ্য কমিটি
সপুত্র চেটে নিল নিজের বমিটি।
মহা বিপ্লবী হুঁ হুঁ... চাষার ব্যাটা সে
গলায় গামছা দিয়ে ক্ষমতার পাশে।

দু' বগলে ডিও যার। সেন্ট পারসেন্ট
ঘন বিপ্লবী হাঁকে চাই মুভমেন্ট
যে কৃষক হাঁটে, যার পা গিয়েছে ফেটে,
নেই বটে সে মিছিলে, এই মার্কেটে
মানসিক ভাবে আছি। ক'জনে তা' থাকে?
টিভিতে তরজা শুনি। চেনো তো আমাকে!

গরু বিপ্লবী বলে খেলবই জুয়া।
ত্রিপুরায় 'বিপ্লব'... এনেছে গেরুয়া।
ইভিএমে ডুবে মরে পাতি বিপ্লবী।
এত কথা শোনে, তবু ভুলছে না ভবি।
সে এত বোঝে না কিছু। হতাশা ও প্রেম
তার সব কিছু আজও বোকা সিপিএম।

শনিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৮

রাফাল ও মোদী সরকার ~ অবিন দত্তগুপ্ত

আমি আইন কানুন বিশেষ বুঝি না । কালকে একটা রুলিং দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট । তাতে বলেছে রাফায়েল বিমান কেনার ক্ষেত্রে কোন গড়মিলের হদিস তারা পায়নি । এই শুনে ব্রেনলেস্‌ বিজেপি সমর্থকরা যারপরনাই উল্লসিত । তা হতেই পারেন ,আসুন সকলেই একটু ভালো করে বুঝে নিয়ে উল্লাস প্রকাশ করি ।

১। রায় দেওয়ার বেসিস্‌ হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট যে ডকুমেন্টের কথা বলেছে সেটা হলো সি এ জি রিপোর্ট বা Comptroller and General Audit Report . এই রিপোর্টে নাকি সরকার প্লেনের দাম সম্পর্কিত সমস্ত ডিটেল দিয়েছে । এবং এই ডিটেল নাকি শেয়ার করা হয়েছে Public Accounts Committe বা PAC-এর সাথে । উল্লেখ্য PAC একটি পার্লামেন্টারি কমিটি ।

২। এই রায়ের পর গতকাল-ই PAC-এর চেয়ারম্যান একটি প্রেস কনফারেন্স করেন এবং জানান সি এ জি কোন রিপোর্ট তাদের জমা দেন নি । শুধু তাই নয় , তিনি এটাও জানান যে সি এ জি-র কাছেও এই রিপোর্ট নেই বলে সি এ জি-র ডেপুটি কমিশনার তাকে মিটিং-এ জানিয়েছেন ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে ,যে রিপোর্টটা বাস্তবে কোথাও নেই ,তার উপর ভিত্তি করে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিল কেন ? অথবা সুপ্রিম কোর্ট তাহলে কি রিপোর্ট দেখে রায় দিল । রিপোর্ট তো সুপ্রিম কোর্টকে পেশ করেছে কেন্দ্র সরকার , তারা তবে কোথাকার PAC-র রিপোর্টের কথা বলছে ? কোথায় বসে সেই কমিটি ? আম্বানির বাড়িতে ? তার চেয়ারম্যান কে ? 

এই একটা প্রশ্নের উত্তরো কাল কেন্দ্রিয় সরকার দিতে পারে নি । এই দুরন্ত মিথ্যার উপর দাড়িয়ে গতকালের রায় ।
বাস্তব হচ্ছে , নরেন্দ্র মোদী তার প্রভু অনিল আম্বানিকে ৩০হাজার কোটি টাকা চুরি করতে সাহায্য করেছেন । যে লোকটা পেরেক পর্যন্ত ম্যানুফ্যাকচার্‌ করতে পারে না তাকে প্লেনের বরাত দিয়েছেন । রাষ্ট্রায়ত্ত HAL বা Hindustan Aeronautics Limited বহু বছর ধরে প্লেন বানালেও তারা বরাত পাননি । 
এখন অনিল আম্বানি তো পেরেক-ও বানাতে পারেন না ,প্লেন বানাবেন কিভাবে ? অতএব নরেন্দ্র মোদী ,ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিজে ফ্রান্সে গিয়ে ফ্রান্সের একটি কোম্পানিকে ৩৬টি রাফায়েল বিমান বানিয়ে অনিল বাবুকে বেচতে বলেছেন (ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি এটা কনফার্ম করেছেন) । কতো দামে অনিল বাবু প্লেন কিনলেন সেটা জানতে চাওয়া হলে , আমাদের দেশের সরকার বলেছে এটা ন্যাশানাল সিক্রেট্‌। ফ্রান্সের প্রধান্মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে উনি অবাক হয়ে বলেছেন ,"আপনাদের দেশের লোকের ট্যাক্সের টাকায় কেনা জিনিস, আপনাদের দেশের লোকের কাছে সিক্রেট্‌ হবে কেন?" । এই দামের ব্যাপারেই সি এ জি রিপোর্ট আলোকপাত করতে পারত । এবং আপাতত সেটা কোথায় ,একমাত্র নরেন্দ্র বাবু বলতে পারবেন ।  অনিল বাবু তারপর আরও চড়া দামে এই প্লেন গুলি ভারতের সরকারকে বেচবে । 
অর্থাৎ আমার আপনার টাকা দিয়ে আম্বানিদের সিন্দুক ভরবে । ৭০০ কোটি টাকা ব্যয় করে আম্বানির মেয়ের বিয়ে হবে । সেই বিয়ের ভিডিও আপনার কাছে আসবে ,আপনি আম্বানির জিও ডেটা খরচা করে সেটা গোগ্রাসে গিলবেন ।

বৃহস্পতিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৮

স্বপ্ন যখন যৌথখামার.. ~ সুশোভন পাত্র

কি আছে বামপন্থীদের? কতটুকু ক্ষমতা? ঐ তো মরু রাজ্যের দুটো আসন। মেরেকেটে ৫রাজ্যে ৭.৮২ লক্ষ ভোট। গোটা দেশে ৪%। ২০টা সাংসদ নেই। দেড়শটা বিধায়ক নেই। কেরালা ছাড়া একটা রাজ্যেও সরকার নেই। সরকার গঠনে নির্ণায়ক কোন ভূমিকা নেই। ভোটের পরে কেনা-বেচার ২-৪টা ডাগর ঘোড়া নেই। রুদ্ধশ্বাস ক্যাবিনেট মিটিং'-এ ফটো ফিনিশেরও চান্স নেই। 
কি আছে বামপন্থীদের? রাস্তায় বেরোলে ১৫ ফুট হোর্ডিং-এ নেতাদের সদা হাস্য মুখ নেই। পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন নেই। পার্টি ফান্ডে আম্বানি-আদানি'দের পয়সা নেই। সেলেব একটা ব্র্যান্ড-অ্যাম্বেসেডার নেই। চার্টার্ড বিমান চেপে নির্বাচনী প্রচার নেই। ভোটের মুখে রাম নাম নেই। পেট ভরে দু-মুঠো ঘুষ খাওয়ার স্টিং অপারেশন নেই। একটা তাগড়া আইটি সেল? ধুর ছাই, সেটাও নেই। 
কি আছে বামপন্থীদের? তৃণমূলের ৩৪টা সাংসদ, ২১জনই কোটিপতি। ৬জন ফিল্মস্টার। তাছাড়াও সরকারী প্রসাদপুষ্ট বুদ্ধিজীবীরা আছেন। লেজুড়বৃত্তি করার লেখক-কবিরা আছেন। মঞ্চ আলো করে নায়ক-নায়িকারা আছেন। গৃহপালিত মিডিয়া আছে। ক্লাবে পোষা গুণ্ডা আছে। সিভিক-পুলিশ-প্রশাসন-সিআইডি-কমিশন, সব আছে। 
কি আছে বামপন্থীদের? বিজেপির ২৭২জন সাংসদ, ২৩৭জনই কোটিপতি। দিল্লির দীনদয়াল মার্গে ১.৭০লক্ষ বর্গফুটের অট্টালিকায় পার্টি অফিস আছে। বার্ষিক ১,০৩৪কোটি আয় আছে। ৫৩২কোটির কর্পোরেট ডোনেশেন আছে। আশোকা রোডে দু-তলা বাড়িতে সাজানো মিডিয়া সেল আছে। হিন্দু ধর্মের উপর নাকি বাপের জমিদারি আছে। 'স্বয়ং সেবক'দের লেলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে। গুজরাট-মুজ্জাফরনগর কে নরক বানানোর গোলিয়াথরা আছে। 
কিন্তু মুশকিল হল, ইতিহাসে কোনদিন শেষ অবধি এই গোলিয়াথরা জেতেনি। জিতেছে ডেভিডরাই। ৫রাজ্যে ভোটের ফলের সংশ্লেষ বলছে, গ্রাম ভারতে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে বিজেপি। মধ্যপ্রদেশের গ্রামে দখলে থাকা ৭৫টির বেশি বিধানসভা খুইয়েছে বিজেপি। রাজস্থানের প্রায় ৪০। ছত্তিসগড়ে ৩০। দেশে ৬২% মানুষ কৃষিজীবী। নাসিক থেকে মুম্বাইয়ের 'কিষান 'লং মার্চ' কিম্বা দিল্লির সংসদ মার্গে 'কিষান মুক্তি মার্চ' –গত দু'তিন বছরে চাষিরা যখন বারবার ফসলের ন্যায্য দাম চেয়ে পথে নেমেছেন, যখন ঋণ মকুবের দাবিতে সোচ্চার  হয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী তখন নিরভ মোদীর সঙ্গে দাভোসে গিয়ে ফটো সেশেন করেছেন। ৫রাজ্যের ভোটে কৃষক অসন্তোষের যে ট্রেলর গোলিয়াথরা আজ দেখছেন, সেদিন সেই কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল ঐ ডেভিডরাই। বামপন্থীরাই।
বছরে ২কোটি বেকারের চাকরি হয়নি। দেশ জুড়ে যখন বিভিন্ন মাঝারি শিল্পে ২৯লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী তখন বেকারদের পোকোড়া ভাজতে উপদেশ দিয়েছেন।  শেষ ২০বছরের সমস্ত রেকর্ড টপকে ৬.৯% হারে দেশের বেকারত্ব যখন সর্বোচ্চ বেড়েছে, গোলিয়াথরা তখন ৩হাজার কোটির সর্দার প্যাটেলের মূর্তি বানিয়েছে। ৫রাজ্যের ভোটে বেকার'দের পেটের জ্বালার যে ট্রেলর গোলিয়াথরা আজ দেখছেন, সেই বেকার'দের কাজের দাবিতেই প্রতিদিন রাস্তায় থেকেছে ঐ ডেভিডরাই। বামপন্থীরাই।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসেবে 'কালো টাকা' ফেরত আসেনি। আপনার-আমার অ্যাকাউন্টে ১৫লাখ জমা পড়েনি। জাল নোটের রমরমা কমেনি। সন্ত্রাসবাদেরও মেরুদণ্ড ভাঙ্গা যায়নি। বরং এটিএম'র লাইনে দাঁড়িয়ে যখন প্রাণ হারিয়েছে শতাধিক সাধারণ মানুষ, তখন বিজেপির বার্ষিক আয় বেড়েছে ৮৫%। পরিযায়ী শ্রমিকরা যখন কাজ হারিয়ে দিশেহারা, তখন ১৬,০০০ গুন মাল কামিয়েছে অমিত শাহ'র পুত্ররা। ৫রাজ্যের ভোটে নোট বাতিলের ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের অসন্তোষের যে ট্রেলর আজ গোলিয়াথরা দেখছেন, সেই নোট বাতিলের আপাদমস্তক দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ জানিয়েছিল ডেভিডরাই। বামপন্থীরাই।
তামাম দুনিয়ার সংগ্রামী ইতিহাস সাক্ষী, ডেভিডরা হারেনি। সংসদীয় রাজনীতির পাটিগণিতে তুরুপের তাস হয়ে উঠতে না পারলেও সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার যন্ত্রণটার শীতলপাটি হওয়ার ক্ষমতা বামপন্থীদের আগেও ছিল, এখনও আছে আর পরেও থাকবে। জান কবুল মান কবুল লড়াই'র হিম্মতটা বামপন্থীদের আগেও ছিল, এখনও আছে আর পরেও থাকবে। তাই যারা বিদ্রূপ করে জিজ্ঞেস করেন, '৫রাজ্যে বামপন্থীরা কটা আসন পেল?', কিম্বা ঔদ্ধত্যের সাথে ঘোষণা করেন '১৯টি রাজ্যে আমরা ক্ষমতায়', তোরা কটায়?', কিম্বা ব্যাঙ্গ করে বলেন 'মধ্যপ্রদেশে বিজেপি হারলে কম্যুনিস্টদের কি লাভ?' -তাঁদের বলি, লাভ বামপন্থীদের একটা আছে। যতই হোক, পাড়ার পাগল কুকুর তো, মরলে গোটা পাড়ারই লাভ আছে।
আসলে মেহনতি মানুষের পক্ষ নিতে কম্যুনিস্টদের কোনদিন ভুল হয়নি। হিটলার-মুসোলিনি-ফ্র্যাঙ্কো কিম্বা আজকের নরেন্দ্র মোদী –ফ্যাসিস্টদের ম্যাসকট'দের চিনতে কম্যুনিস্টদের কোনদিন ভুল হয়নি। ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কম্যুনিস্টরা কোনদিন কসুর রাখেনি। আর রাইখস্ট্যাগের মাথায় লালপতাকা উড়িয়ে দেওয়ার আগে অবধি কম্যুনিস্টদের সেই লড়াই থামেনি। ১১৫২ খ্রিস্ট পূর্বের মিশরে ফেরাও'র বিরুদ্ধে রেশনের দাবি তে শ্রমিক ধর্মঘটই হোক কিম্বা ১৯৫৯'র সালে পুঁজিবাদের আঁতুড় ঘর আমেরিকার রাস্তায় ৫লাখ ইস্পাত শিল্পের শ্রমিক'দের মিছিল। ৭৪'র ইন্দিরার সরকারের বিরুদ্ধে রেল ধর্মঘটই হোক কিম্বা মার্গারেট থ্যাচারের দেশে খনি শ্রমিকদের অনশন, এই সেদিনের ৫০হাজার কৃষকের সিঙ্গুর থেকে রাজভবন অভিযানই হোক কিম্বা আজকের প্যারিসে পেট্রো-পণ্যের মূল্যের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ -পৃথিবীর যে প্রান্তে, যে কোণায় যখনই মেহনতি মানুষরা শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে, সেই লড়াইয়ে নেতৃত্বে কম্যুনিস্টরাই থেকেছে। 
তাই ঐ সব ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপে মুচকি হাসুন। আর বিনয়ের সাথে, ওঁদের কাঁধে হাত রেখে, মনে করিয়ে দিন যে, পৃথিবীর প্রত্যেকটা মহাদেশের, প্রত্যেকটা দেশের, প্রত্যেকটা শহরের, প্রত্যেকটা গ্রামের, প্রত্যেকটা জনপদে; হয়ত কোন ফ্যাক্টরির গেটের সামনে, কিম্বা হয়ত কৃষকের এক ফালি জমির মাঝে, হয়ত কংক্রিটের মিছিলে বেকারের কাঁধে, কিম্বা স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে মেহনতির প্রতিবাদের ভাষায়, কখনও লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে উদ্ধত শ্লোগানে সেজে, কখনও যুদ্ধবিরোধী মিছিলে শান্তির পতাকা হয়ে কেস্তা-হাতুড়ি আঁকা ঐ একটুকরো লাল কাপড় কিন্তু ঠিক উড়ছে। আর উড়ছে, অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠার দাবি তে নয়, মহম্মদ আর রামের নামে মানুষ ক্ষ্যাপাতে নয়, উৎসব আর মেলায় মাতিয়ে রাখতে নয়। হক আদায়ের লড়াই করতে। দুনিয়ার মেহনতি মানুষ কে আগলে রাখতে। শোষণ-বঞ্চনাহীন নতুন ভোরের স্বপ্নটাকে সাচ্চা করতে।

চিকিৎসা ব্যবস্থা ~ ড: গৌতম মিস্ত্রি

যে ভাবে আমরা এখন হৃদরোগের চিকিৎসা করছি, তাতে সমাজের বৃহদাংশের সুচিকিৎসা সম্ভব নয়। একটা কাল্পনিক গল্পের মাধ্যমে প্রসঙ্গটা ব্যাখ্যা করি। একজন উচ্চশিক্ষিত সদ্য পাশ করা নবীন চিকিৎসক নদীর পাড়ে হাওয়া খেতে গেছে। হঠাৎ দেখে, একজন মানুষ নদীতে ভেসে যাচ্ছে। নদীতে ঝাঁপিয়ে তাকে তুলে, নিজের সদ্যপ্রাপ্ত চিকিৎসাবিদ্যার প্রয়োগে তাকে সুস্থ করে তুললো। এর পর সেই নবীন চিকিৎসক দেখল,  কোন আশ্চর্য্য কারণে নদীতে ভেসে আসা মৃতপ্রায় মানুষের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। বুদ্ধিমান নবীন চিকিৎসক তার বেশ কিছু সহকর্মীদের সাথে নিয়ে অক্লান্ত  প্রচেষ্টায় আরও কিছু মানুষকে বাঁচাতে পারলো। কিন্তু সেই নদীতে ভেসে আসা মৃতপ্রায়ের সংখা ক্রমেই বাড়তে লাগলো।  এরপর নবীন চিকিৎসকের দল যেটা করলো, তাতে সবাই সাধুবাদ দিলো। নদীর পাড়ে একটা হাসপাতাল গড়ে উঠলো চিকিৎসকদের উদ্যোগে আর পরোপকারী(!) কিছু ব্যবসায়ীদের অর্থে। অধিকাংশ মরণাপন্ন মানুষ নদীর জলে ভেসে গেলেও নদীতে ভেসে আসা কিছু মানুষ অবশ্য বেঁচে গেলো।  নদীপাড়ে গড়ে উঠলো বড় জনপদ, অনেক চিকিৎসকের কাজের সংস্থান হল আর হল ব্যবসায়ীদের অর্থ সমাগমের সুবন্দোবস্ত।  

এই সমাজকল্যাণ মূলক কর্মকান্ডে বাধ সাধলো গুটিকয় খুঁতখুঁতে চিকিৎসক।  এরা নদীর উজান বেয়ে অন্যভাবে হাওয়া খেতে গিয়ে দেখলো, এক দৈত্য একটা প্রকান্ড মুগুর নিয়ে মানুষ মেরে চলেছে। এই খুঁতখুঁতে চিকিৎসকের দল দৈত্যকে মেরে ফেললো।  হাসপাতালের ব্যবসায় মন্দা পড়লো, নবীন চিকিৎসকরা ক্ষুন্ন হলো, তবে সাধারন মানুষ বললো একটা সুচিকিৎসা হলো।

স্বাস্থ্যখাতে সরকারি আর বেসরকারি প্রচেষ্টায় যে পরিমান অর্থ ব্যয় হয়, তার মুখ্যভাগই খরচ হয়ে যায় গুটিকয় শহরের বড় হাসপাতালে।  কোন বেসরকারি হাসপাতালে কালেভদ্রে কোন জটিল অপারেশন হলে খবরের কাগজের প্রথম পাতায় স্থান পায়। কিন্তু এতে সামগ্রিকভাবে সমাজের মোট রোগভোগের আর সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কোন হেরফের হয় না। খবরের কাগজের এই চমক জাগানো খবরে হরিপদ কেরানির হাঁপানি রোগের সুরাহা হয় না। এই দৃষ্টিভঙ্গি কোনমতেই আমাদেও মত উন্নয়নশীল দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যরক্ষায় সফলকাম হতে পারেনা।  আপৎকালীন চিকিৎসায় যৎকিঞ্চিত সরকারি পয়সাকড়ি আর স্বেছাসেবী সংস্থার উদ্যোগ নিশেঃষ না করে, প্রতিরোধমুলক চিকিৎসায় জোর দেওয়া হলে হরিপদদের মত মানুষগুলোর রোগের ফাঁদে পড়া আটকানো যায়।  ব্যক্তিগত ও সরকারি চিকিৎসাখাতে খরচের মুখ্যভাগই হৃদরোগ আর ডায়াবেটিস রোগে ব্যয় হয়ে যায়, যদিও এই দুই রোগের প্রকোপ অনেক অল্প খরচেই নিবারণযোগ্য।  যে দৃষ্টিভঙ্গিতে চিকিৎসা চলছে, তাতে মুষ্টিমেয় সচ্ছলের রোগউপশম (paliation), চিকিৎসকের আত্মশ্লাঘা পূরণ, আর সর্বোপরি বহুজাতিক ঔষধপ্রস্তুতকারি ও প্রযুক্তি নির্মাণকারী সংস্থার অর্থসমাগমের সুবন্দোবস্ত হচ্ছে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের আশু প্রয়োজন। প্রশ্ন উঠতে পারে, এই সহজবোধ্য অথচ সস্তা রোগ নিবারণে উদ্যেগের অভাব কেন?

আমার মত অল্পবুদ্ধি নগন্যকে এই সহজ প্রশ্নটা বেশ পীড়া দিলেও এর উত্তরটা বেশ জটিল।  কলেরা বা ডিপথেরিয়া রোগ প্রতিষেধকের মত হৃদরোগ প্রতিরোধের কোন টিকা নেই, যেটা কিনা অল্প আয়াসে প্রয়োগ করা যায়। হৃদরোগের নিবারণের জন্য চাই বৃহত্তর সমাজের জীবনযাত্রার আর অভ্যাসের পরিবর্তন।  এই বিপুল কর্মকান্ডের সুফল চটজলদি মেলেনা।  আর এর জন্যই এই আন্দোলনটা একক ভাবে অথবা সামগ্রিকভাবে (সরকারি অথবা বেসরকারি) আকর্ষক নয়।  কেবল এই বৈষম্যটাই পীড়াদায়ক, যখন দেখি, এইডসের (aquired immune deficiency syndrome) মত রোগ, যেটা কিনা সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তকে স্পর্শ করে না, তার প্রতিরোধের বার্তা মিডিয়ার দৌলতে গ্রামে গঞ্জে পৌঁছে গেছে। প্রতিবেশী দেশ চিনেও ধূমপান বিরোধী সরকারি বিলবোর্ড আছে। চিনে প্রকাশ্যে, নিভৃতে  ঘরের কোণের বাইরে সিগারেট ফুঁকলে মোটা জরিমানা আপনাকে যৎকিঞ্চিত জরিমানার প্রতিদানে সুস্বাস্থ্য উপহার দেবে।  আমাদের দুর্ভাগ্য, মন্দির-মসজিদ আর সুউচ্চ মুর্তি খাড়া করার বাইরে সফল ও প্রয়োজনীয় জনহিতকার প্রকল্পের কল্পনাও দেশের কান্ডারীদের মাথায় নেই। হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা  জানা আছে, কেবল জানা নেই তার সফল প্রয়োগের আমলাতান্ত্রিক কুটনীতি।

একটা প্রাচীন প্রবচন আছে। চিকিৎসক তিন প্রকারের হয়। উচ্চশিক্ষিত, পরিশ্রমী ও সফলকাম চিকিৎসক জটিল ও আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার প্রয়োগে মরণাপন্ন রোগীকে সুস্থ করে তোলেন ।  এঁদের চেয়েও ভালো চিকিৎসক রোগের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা মাত্রই অল্প আয়াসে রোগমুক্তি ঘটাতে পারে।  সুচিকিৎসক তার বিদ্যার প্রয়োগে, রোগ নিবারণ করে থাকে। সুচিকিৎসকের কর্মকান্ড বৃদ্ধি পেলে, প্রথমোক্ত চিকিৎসকদেও অবশ্য কর্মহীন হবার আশঙ্কা থেকে যায়।  সুচিকিৎসকদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও তাঁদের নিষ্কন্টক কর্মকাণ্ড কামনা করি।

সোমবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৮

মমতা ও আরএসএস ~ সুশোভন পাত্র

নিউটনের ঘরের কেয়ারটেকার সেদিন পরিচারিকা কে পই পই করে বলেছিলেন, "ডিমটা সেদ্ধ করে, বাবুকে খাইয়ে, তবেই আসবি।" কিন্তু গবেষণায় বিঘ্ন ঘটবে বলে, নিউটন নিজেই ডিম সেদ্ধ করে, সময়ে খেয়ে নেবার আশ্বাস দিয়ে তাঁর পরিচারিকা কে ফেরত পাঠিয়ে দেন। একঘণ্টা পর পরিচারিকা এসে দেখেন, সসপ্যানে রিষ্ট ওয়াচটা সেদ্ধ হচ্ছে আর নিউটন উনুনের সামনে ঠাই দাঁড়িয়ে, হাতে ধরা ডিমের দিকে তাকিয়ে সময় দেখছেন।
টিকিট চেকার টিকিট চাইতেই আইনস্টাইন অনেক খুঁজেও টিকিটটা পেলেন না। টিকিট চেকার আইনস্টাইনকে চিনে বলেছিলেন, "আরে প্রফেসর, আর খুঁজতে হবে না। আমি নিশ্চিত আপনি টিকিট কেটেছেন।" কাতর স্বরে আইনস্টাইন বলেছিলেন, "না, না খুঁজতে তো হবেই। ওটা না পেলে আমি জানব কি করে কোথায় যাচ্ছি!"
ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সের পথিকৃৎ নিউটন ডিমের বদলে ভুল করে রিষ্ট ওয়াচ সেদ্ধ করেছিলেন। থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সের জাদুকর আইনস্টাইন টিকিট আনতে ভুলেছিলেন। আর দিল্লীর মসনদ দখলের দিবাস্বপ্নে মশগুল আমাদের মুখ্যমন্ত্রী স্বরচিত ইতিহাসটাই ভুলে গেছেন। আসুন দায়িত্বশীল কামাল হাসানের ভূমিকায় সদমা সিনেমার শ্রীদেবীর যত্ন নিন। কর্তব্যপরায়ণ নাগরিক হিসেবে তাঁর কৃতকর্ম স্মরণ করিয়ে দিন।  
জরুরী অবস্থায় সিদ্ধার্থশংকর রায়ের তাঁবেদারি করে, জয়প্রকাশ নারায়ণের গাড়ির বনেটে নেচে ¹, ইন্দিরা হত্যার সহানুভূতির ভোটে প্রথম সাংসদ হয়ে ², শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন আনন্দবাজারের হবু 'অগ্নিকন্যা'। ধর্মীয় মেরুকরণের চ্যাংড়ামি তে জাতীয় রাজনীতিতে দ্রুত উঠে আসছে বি.জে.পি ³ । 'লৌহ পুরুষ' রথে চেপে, বাড়ি বয়ে বলে আসছেন 'মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে'। অযোধ্যায় জুটছেন কর-সেবকরা। ৯২'র ৪ঠা ডিসেম্বর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শহীদ মিনারে জনসভা ডাকল বামফ্রন্ট। আর সেদিনই সিধো-কানহু ডহরে সভা করে 'ইন্ডিয়া ইয়ুথ কংগ্রেসের' সাধারণ সম্পাদিকা মমতা বললেন, ''সব সি.পি.এম'র ষড়যন্ত্র। বি.জে.পি অযোধ্যায় কিছুই করতে পারবে না। আসলে সি.পি.এম আমাদের আটকাতেই ক্যাডার জড়ো করছে" ⁴ ।  ৯৭'র ডিসেম্বরে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত মমতা'ই জোটসঙ্গী প্রসঙ্গে বলেছিলেন, "বি.জে.পি তো  অচ্ছুৎ নয়" ⁵।  বাস্তবেই ছুৎমার্গ শিকেয় তুলে ৯৮'র লোকসভা ভোটে‍‌ তৃণমূলের হাত ধরেই পশ্চিমবঙ্গে খাতা খুলল বি.জে.পি। আর ৯৯' এ এন.ডি.এ'র শরিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন রেলমন্ত্রী ⁶।
ম্যাডাম, আজ আপনার বি.জে.পি কে 'সাম্প্রদায়িক' মনে হচ্ছে? কিন্তু আপনিই তো বি.বি.সি'র সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন বি.জে.পি নাকি তৃণমূলের "ন্যাচারাল অ্যালি" ⁷? গুজরাট দাঙ্গার সময়ে আপনি বাজপেয়ী সরকারে মন্ত্রী ছিলেন না ⁶?  সংসদ যখন গুজরাটের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করছে তখন সরকারের পাশে দাঁড়াবার আশ্বাস দিয়ে বাজপেয়ী কে আপনি চিঠি লেখেননি ⁸? তবে যে আপনারই সাংসদ কৃষ্ণা বসু তাঁর 'অ্যান আউটসাইডার টু দি পলিটিক্স' বইয়ে লিখেছেন, লোকসভায় যেদিন গুজরাটে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়ে ভোটাভুটি হচ্ছে সেদিন আপনিই নাকি এন.ডি.এ সরকার কে ভোট দেবার হুইপ জারি করেছিলেন ⁹? আপনিই তো দাঙ্গা পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভের পর নরেন্দ্র মোদী কে অভিবাদন জানিয়ে পুষ্পস্তবক পাঠিয়েছিলেন ¹⁰। আপনিই তো ২০০৪'র লোকসভা এবং ২০০৬'র বিধানসভা নির্বাচনে বি.জে.পি'র সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন ⁴ । 
ম্যাডাম, আজ আপনি বলছেন আর.এস.এস 'ভয়ঙ্কর'? আর ২০০৩'র ১৫ই সেপ্টেম্বর দিল্লিতে 'পাঞ্চজন্য'র অনুষ্ঠানে আপনি সংঘ নেতৃত্বের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ''আপনারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। আপনারা দেশকে ভালোবাসেন। আপনাদের ১% সাহায্যে আমরা কমিউনিস্টদের সরাতে পারবো।'' মনে পড়ে গদগদ আর.এস.এস নেতারা আপনাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ''হামারি পেয়ারি মমতাদি সাক্ষাৎ দুর্গা'' ¹¹?  এই তো সেদিন 'দুর্গার' সাফল্যে খুশি হয়ে আর.এস.এস'র রাজ্য মুখপত্র 'স্বস্তিকা' সম্পাদকীয় তে লিখেছিল "দায়িত্বশীল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে দুঃশাসনের অবসান" ¹² । এই তো সেদিন আর.এস.এস'র জাতীয় মুখপত্র 'ওর্গানাইজার' স্বর্ণাক্ষরে উত্তর-সম্পাদকীয় তে ছেপেছিল, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশের সেই বিরলতম প্রজাতির রাজনীতিবিদ যিনি আর্থিক ভাবে সৎ। দেশে তাঁর মতই রাজনীতিবিদ প্রয়োজন" ¹³ ।
সাইকো-অ্যানালিস্ট গিরিন্দ্রশেখর বসু কে একদিন তাঁরই এক রোগী বললেন "স্যার, গতরাতে স্বপ্নে দেখেছি আপনি নর্দমায় পড়ে গেছেন; আর আমি আপনাকে অনেক কষ্টে ওঠাতে চেষ্টা করছি।" গিরিন্দ্রশেখের মুচকি হেসে বলেন, "আমি অত্যন্ত আনন্দিত আপনার সাহায্য পেয়ে। কিন্তু নর্দমায় আমাকে ফেলেছিল কে?" ম্যাডাম, আপনার রাজত্বে যখন গত পাঁচ বছরে পাঁচ গুন বেড়েছে আর.এস.এস'র শাখার সংখ্যা ¹⁴, আজ যখন অনাহারে মরা চা শ্রমিকের রাজ্যে যাদবপুরে 'গরু পূজার' ছ্যাবলামি করছে মাথায় গোবর ভর্তি সন্তানরা, আজ যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে তিন তালাকের সমর্থন জানাচ্ছে আপনারই মন্ত্রীরা, আজ যখন হাজিনগর থেকে ধুলাগড়ে ধর্মের নামে ঘরে ঘরে দাঙ্গার আগুন ছড়াচ্ছে আপনার ভাইরা; তখন  রাজনীতির অঙ্ক কষতে সিদিকুল্লা-তোহা সিদ্দিকী'দের মাথায় তুলে রাখছেন আপনি? মোহন ভাগবত'দের কলকাতায় সভা করে বিষ ছড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছেন আপনি? বি.জে.পি-সংঘ বিরোধিতায় ভেকধারী খড়গহস্ত হওয়ার তামাশা করছেন আপনি? গোটা রাজ্য কে ধর্মীয় মেরুকরণের বারুদে সাজিয়ে, পায়ের উপর পা তুলে মুজরা দেখছেন আপনি? আগে বলুন তো মাননীয়া, এদ্দিন এরাজ্যে আর.এস.এস আগলে রাখল কে?  বলুন সম্প্রীতির বাংলায় বি.জে.পি'র বীজ বপন করেছিল কে? নিজের গোয়ালে, নিজের আঁচলে, লুকিয়ে দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছিল কে? আমি আনন্দিত আজ আপনি বি.জে.পি-সংঘের বিরোধিতা করছেন। কিন্তু আগে বলুন তো ঐ নর্দমায় আমাদের ফেলেছিল কে?   
একদিন মার্ক টোয়েন সকালবেলা শার্ট পরতে গিয়ে দেখলেন শার্টে বোতাম নেই। একটার পর একটা, তিনটে শার্ট বার করে পরতে গিয়ে দেখেন সব সার্টেই একটা করে বোতাম নেই। রাগে অকথ্য গালিগালাজ করতে করতে মার্ক টোয়েনে যখন চতুর্থ শার্টটা বের করছেন, তখন তাঁর রুচিশীল স্ত্রী, সব শুনে, স্বামীকে অপ্রস্তুত করার জন্যেই প্রত্যেকটি গালিগালাজ স্পষ্ট করে আবার উচ্চারণ করলেন। মার্ক টোয়েন সেটা শুনে বলেছিলেন, "তোমার শব্দগুলো সব ঠিকই আছে, কিন্তু... ইমোশনটা মিসিং।"
ম্যাডাম,  আজ আপনি বি.জে.পি -সংঘের বিরোধিতা করছেন বটে।  কিন্তু ঐ যে... ইমোশনটা মিসিং।