বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০২০

বিজেপির ভয় ~ সংকলন সরকার

২০১৯ নির্বাচনে মোট ৬০.৩৭ কোটি ভোট পড়েছিলো। তারমধ্যে বিজেপি ৩৭.৩৬% ভোট পেয়ে ক্ষমতায় এসেছে, এনডিএর কম্বাইন্ড ভোট শেয়ার ছিলো ৪৫%... এই তথ্য সরকারি ওয়েবসাইট ঘাঁটলেই পাবেন। তারপর দেশের বিভিন্ন নির্বাচন উপনির্বাচনে ২০১৯ এই বিজেপির সমর্থনের হার ক্রমশ আরো কমেছে। হাতছাড়া হয়েছে বেশ কিছু রাজ্য। ২০১৪ থেকে হিসেব শুরু করলে বিজেপির জনপ্রিয়তা হ্রাসের হার উল্লেখযোগ্য ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আচ্ছা, ২০১৯ এর ১১ই এপ্রিল থেকে ১৯শে মে অবধি পড়া ৬০.৩৭ কোটি ভোটের মধ্যে ৩৭.৩৬% বিজেপি ভোটারের মধ্যে একটু বেশি করেই না হয় ধরে নিচ্ছি ৫০% ভোটার হল অন্ধভক্ত। অর্থাৎ ১৮.৬৮% ভোট বিজেপির কমিটেড ভোটার। ওই ভোটটা বিজেপি পাবেই পাবে। বাকি ভোটের ঠিকানা নেই, বেশ কিছু ভোট ১৯শে মে ২০১৯ এর পরে আজকে ৩০শে জানুয়ারী ২০২০ অবধি ইতিমধ্যে বিভিন্ন গেরুয়া রাজ্যের হিসেব পাল্টে দিয়েছে। আগামীতে আরো অনেক ছক বদলাতে চলেছে। ফলে ক্রমান্বয়ে সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ার ভয় বিজেপি সুপ্রিমোদের মাথায় কি গেড়ে বসছে? মানসিকতা মেলানোর উত্তর জানি না তবে অঙ্কমেলানো সোজা। অন্ধভক্তরা কোনো কিছু না ভেবে পরম নিশ্চিন্তে থাকলেও বিজেপি থিঙ্কট্যাংক অসম্ভব অস্বস্তিতে রয়েছে এ কথা হলফ করে বলতে পারি। বিজেপির হাতের শেষ অস্ত্র হিংসা দ্বেষ এবং সন্ত্রাস! 

সবাই যখন ভারত-পাকিস্তান, ৩৭০-কাশ্মীর, হিন্দু-মুসলিম, সিএএ, এনআরসি, এনপিআর জামিয়া জেএনইউ ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক করতে ব্যস্ত, আমরা আমাদের দেশের আশেপাশে কী ঘটছে তা খেয়াল করছি না!
৩০.০১. ২০২০ তারিখের বিভিন্ন ডেটা সার্চ করে কী কী পাই দেখি চলুন

 আমাদের দেশের সাম্প্রতিক ডেটা এবং পরিস্থিতি 👇

- Vodafone is in loss of ₹50,000 Crore.

- Airtel is in loss of ₹23,000 Crore.

- BSNL is in loss of ₹14,000 Crore.

- MTNL is in loss of ₹755 Crore.

- BPCL is in loss of ₹750 Crore.

- SAIL is in loss of ₹286 Crore.

- AIR India is in loss of ₹4600 Crore.
 
- Spice Jet is in loss of ₹463 Crore.

- Indigo is in loss of ₹1062 Crore.

- BHEL is in loss of ₹219 Crore.

- India Post is in loss of ₹15,000 Crore.

- GMR Infra is in loss of ₹561 Crore.

- YES Bank is in loss of ₹600 Crore.

- Union Bank is in loss of ₹1190 Crore.
 
- PNB Bank is in loss of ₹4750 Crore।

- Axis Bank is in loss of ₹112 Crore.
 

Apart from the above 👆👇🏼

 - Jet Airways closed.

- BSNL 54,000 may cut more jobs.

- No money to pay salary for HAL employees.

- 1 million to be laid off in Auto Industry.

- 12.76 lakhs houses unsold in 30 major cities.

- Aircel and Docomo is dead.

- JP Group finished.

- Most profitable company in India - ONGC is now making losses.

- 36 largest debtors missing from country.

 - Rs 2.4 lakh crores loan waive off for a few corporates. 

- All banks incurring huge losses.

- External debt on country 500+ Billion Dollars.

- Railways are on sale.

- Renting heritages including Red Fort.

- Largest car maker Maruti cuts production.

- Rs 55000 crores car inventory lying at factories, with no buyers.

- Builders all over stressed. Some committing Suicide, no buyers.  Construction Stopped due Mat cost rise (GST at 18% to 28%).

- OFB under corporatization affecting over 1.5 lac employee & families.

- Millions unemployed due to Demonetization.

- Highest unemployment in 45 years.

- 5 airports sold to Adani.

- Highest domestic stagflation.

- Record HNI individuals leaving India.

- Videocon bankrupt.

- Tata Docomo perished.

- CCD founder VG Siddhartha committed Sucide due to huge debt.

- Reputed Biscuits Companies like Parle-G on the verge of terminating it's employees.

...Many nationalized banks have merged, many branches have literally closed, huge numbers of ATM's Rooms are set down, 

May be many more...

Note: Nothing is shown in media. And media is busy debating India Vs Pakistan, and Hindu Vs Muslims who were living peacefully with tranquility till recently. 

বিজেপি ম্যানেজমেন্ট ভয় পাচ্ছে, তাই ক্ষমতা ছুঁয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে। দেশ ভক্তি অনেক দূরের কথা, দেশ নিয়ে এদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। এরা কথাবলা লোকজনদের ভয় পায়, শিক্ষিত সমাজকে ভয় পায়, এই দেশ ব্যবসায়ীরা দেশ ভক্তির নামে দেশকে ছিঁড়ে খুঁড়ে নিজেরা অত্যন্ত স্বল্প সংখ্যক কতিপয় শ্রেণীর পকেটে ভরে নিতে উদ্যত। দেশের মানুষকে বোকা বানিয়ে এই বানিয়ারা যখন লুটের ভাগ সামলাবে সেই মাস্টার প্ল্যানে দেশের অনেক তাবড়-তাবড় নেতা মন্ত্রী সমর্থক অবধি থাকবে না তো ছোটোখাটো স্টেটলেভেলের নেতা মন্ত্রীর কথা বাদ দিলাম। আর ভোটে জেতানো ভক্ত বা অন্ধভক্তদের কথা ধর্তব্যের মধ্যেই আনছি না। আচ্ছে দিনের নামে ২০১৪ থেকে মাত্র ৬ বছর সময়কালের হিসেবে ভারত জেট গতিতে ঠিক ৪৫ বছর পিছিয়ে গেছে। 

সামনে মার্চ ইয়ারএন্ডিং নতুন বাজেট লালশালু মুড়ে সংসদে আসতে চলেছে ফ্রেন্ডস... আপনারা দম বন্ধ করে হিন্দু মুসলমান সিএএ পাকিস্তান বাংলাদেশ নিয়ে লাট্টু হয়ে থাকুন, দুনিয়ার সবথেকে উঁচু মূর্তি দেখে আসুন, সিয়াচেন সিয়াচেন খেলুন, বাংলাদেশি খুঁজুন, তোতাপাখির মতন শেখানো বুলি কপচান। হিন্দু মুসলমান একে অপরের সঙ্গে বাকযুদ্ধ জারী রাখুন, মুখোমুখি হলে একে অপরের মাথা ফাটিয়ে দিন, মন্দির মসজিদ ভাঙুন, হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটিতে বসে মন দিয়ে পড়াশোনা করুন। স্কুল কলেজ লাইব্রেরী ইউনিভার্সিটিতে যাবেন না। নিজের ইচ্ছে মতন পড়াশোনা একদম করবেন না। নিজের ইচ্ছেমতন কথা বলবেন না, ভেদ ভাব বিভাজন দ্বেষ ছড়ান, রাম মন্দির বানান, রাম মন্দিরে বসে ঘন্টা নাড়ুন...

যদিও রামের বাপ দশরথের বাপের নাম ছিল অজ, সেই শ্রীঅজ'র অবধি ক্ষমতা নেই যে আপনাকে বাঁচায়! 

জ্জ্যায়শ্রীরাম

সংকলন সরকার
৩০/০১/২০২০

তথ্যঋণঃ ইলেকশন কমিশন, গুগল, সেমিমা হাকিম।

একটি পুজো, নায়ক, খলনায়ক, গায়ক ও একজন কবি ~ সমুদ্র সেনগুপ্ত

১৩৩৩, ১৩ই ফাল্গুন (২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৮) কলকাতার সিটি কলেজ-সংলগ্ন রামমোহন ছাত্রাবাসে সরস্বতী-প্রতিমা স্থাপন করে পুজোর দাবিতে কলেজ-কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রদের সংঘর্ষজনিত গোলযোগের সূত্রপাত হয়। 

সিটি কলেজ ব্রাহ্মদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত একটি নামকরা কলেজ সেই সময়ে। কিন্তু কলেজের অধিকাংশ ছাত্র ছিল হিন্দু। কলেজের ছাত্রাবাসটির নাম ছিল 'রামমোহন হোস্টেল'। সেই ছাত্রাবাসের অধিকাংশ আবাসিকও হিন্দু। তারা সরস্বতী পুজো আয়োজন করতে চায়। 

সে সময়ে সিটি কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন হেরম্বচন্দ্র মৈত্র। কলেজের সংবিধান অনুসারে সরস্বতী পুজোর মতন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান করতে দেওয়া চলে না, এই কারণে কর্তৃপক্ষ হস্টেলে পুজো করার অনুমতি দিতে অস্বীকৃত হন। শুরু হয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ছাত্রবিক্ষোভ। বাধাপ্রাপ্ত ছাত্ররা অনশন সত্যাগ্রহ শুরু করে। পক্ষে বিপক্ষে বহুলোক। 

এর ছয় বছর আগে ১৯২২ সালে ঐ সিটি কলেজে ইংরেজি বিভাগে যোগ দিয়েছেন এক তরুণ অধ্যাপক। ঠাকুর্দা সর্বানন্দ দাশগুপ্ত ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করাতে তিনিও তাই। বছর খানেক আগে ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরা পালক'। কবির নামের শেষে দাশগুপ্তের বদলে কেবল দাশ, শ্রী জীবনানন্দ দাশ। আমাদের ছোট্ট এই কাহিনীর নায়ক নন, স্রেফ ট্র্যাজেডির একটা চরিত্র।

নায়কদের দিকে একবার চোখ ফেরানো যাক। আন্দোলনকারী ছাত্রদের সপক্ষে সবচেয়ে বড় নাম এক তরুণ যুব ছাত্রনেতা। বছর খানেক আগে ১৯২৭ সালে মান্দালয় জেল এর কারাবাস থেকে মুক্ত হয়েছেন এই তরুণ তুর্কি নেতা। তার কাছে এটা নিছক পুজোর অনুমতি আদায়ের গোলযোগ নয়, তার চেয়েও কিছু বেশি। ছাত্রদের অধিকার রক্ষার লড়াই কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। তিনি তখন নেতা বটে তবে নেতাজি নামে খ্যাত হন নি, তখন কেবলই সুভাষ বোস। এলবার্ট হলে বিরাট সভা। জ্বালাময়ী বক্তৃতা। 

২রা মার্চ সভায় বললেন, " হিন্দু ছাত্রদের কোমল ধর্মীয় অনুভূতি কে পদদলিত করে সিটি কলেজ কর্তৃপক্ষ এর স্বেচ্ছাচারী আচরণের ফলে সিটি কলেজের ছাত্ররা বর্তমানে যে আন্দোলন শুরু করেছে, তার প্রতি আমার সাগ্রহ ও সাদর সমর্থন আছে। আলোকপ্রাপ্ত ও অগ্রসর ব্রাহ্ম ভদ্রলোকরা হিন্দু ছাত্রদের ওপর নিজেদের ধর্মবিশ্বাস চাপিযে দেয়ার জন্য এতো নিচে কি করে নামলেন তা আমি অনুধাবন করতে অক্ষম।"

কলেজ কর্তৃপক্ষ এর সপক্ষে বেশকিছু নামিদামি ব্যক্তিত্ব। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সি এফ এন্দ্রুজ, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।এবং এবং রবি ঠাকুর। তরুণ নেতার হাতিয়ার যদি হয় তার তেজস্বী বক্তৃতা, প্রৌঢ় কবির হাতিয়ার তাহলে কলম। মর্ডান রিভিউ তে প্রবাসীতে চিঠি, প্রবন্ধ। সেই কলম থেকে বেরিয়ে আসছে এই লেখা, ".....  ধর্মের স্বাধীনতাই যদি কাম্য হয় তবে সে স্বাধীনতা শুধু রামমোহন হোস্টেলের হিন্দু ছাত্ররা পাইবে এমন তো নহে, মুসলমান ছাত্ররাও পাইবে। মুসলমানদের পক্ষে গো-কোরবানি ধর্মের অঙ্গ। সুতরাং কর্তৃপক্ষ হোস্টেলে তাহাদের তাহাও করিতে দিতে বাধ্য। সুতরাং এভাবে যুক্তি চলে না। একটা প্রতিষ্ঠিত সমাজের বিধিবদ্ধ কতকগুলি নিয়ম আছে, সেগুলিকে ভাঙিতে চেষ্টা করায় সৌজন্যের অভাব প্রকাশ পায়। সিটি কলেজ ব্রাহ্মদের এবং ব্রাহ্মরা মূর্তিপূজক নয়, একথা প্রত্যেক ছাত্রই জানেন।"

এই সময়ে ময়দানে নামলো সজনীকান্ত দাসের 'শনিবারের চিঠি'। দু দিন আগেই প্রমথ হাতিয়ার নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে বাক্যবানে বিদ্ধ করার অনুতাপেই বোধহয় এবার তারা কবির পক্ষে। সুভাষ কে 'খোকা ভগবান' নাম দিয়ে লেখা হলো :- "খোকা ভগবান নামে/ গজানন  বঙ্গধামে/ সম্প্রতি খুলেছে রাজ্যপাট।..." ['মর্ত্য হইতে সরস্বতী বিদায়']।

সজনীকান্তের— "হিন্দু রিলিজিয়ন ইনসালটেড (স্বপ্নদর্শন)", অশোক চট্টোপাধ্যায়ের —"এই কি হিন্দু-জাগরণ" এবং যোগানন্দ দাসের—"নায়মাত্মা চৌর্যেন বা লভ্যতে" প্রকাশিত হল। ১৩৩৫ শ্রাবণ সংখ্যা "শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত হল এলবার্ট হলের সেই জনসভা কে ব্যঙ্গ করে :-

"খোকা ভগবান আসিল নিজে,/ চোখের জলেতে বেজায় ভিজে।/ বুকেতে কি জানি ঘটিল দোষ,/ সাক্ষী কুলীন বৈদ্য বোস।/ দেবদ্বিজে অতি ভক্তিমান/ সন্ধ্যা করিয়া তামাক খান।/...গোটে গোটে ছোটে খোকার বাণী/ নববেদ বলে তারে বাখানি। ...বিবাহযোগ্যা পাননি কনে/ কেহ নাই বামে সিংহাসনে।.../ হিন্দুয়ানির পান্ডাপাঁড়/ জয়রব তাই উঠিল তাঁর"। ইত্যাদি [ 'ধর্মরক্ষা']

পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার বদলে আরও উত্তপ হয়ে উঠলো। সুভাষ বোস সব হিন্দু ছাত্রদের ওই কলেজ (সিটি কলেজ) ছেড়ে অন্যান্য কলেজে ভর্তি হবার নির্দেশ দিলেন। ফলে অনেকেই অন্যান্য কলেজে চলে যেতে আরম্ভ করল। সেই সময়ে কলকাতা ব্রাহ্মসমাজ থেকে দেশের সব ব্রাহ্ম ছাত্রছাত্রীদের সিটি কলেজে ভর্তি হয়ে কলেজটিকে টিকিয়ে রাখার আহ্বান জানানো হ'ল।

এই যুদ্ধে কার জয় হল জানা নেই। কিন্তু দলে দলে ছাত্র সিটি কলেজ ছেড়ে দিতে লাগলো। কিছু ছাত্র রয়ে গেল। সিটি কলেজের ছাত্র কিন্ত অক্সফোর্ড মিশন হোস্টেলের আবাসিক এক তরুণ যিনি পরে হবেন জীবন বীমা নিগমের কেরানি আর তারও পরে গাইবেন গান যতদিন না পর্যন্ত তার মতো ব্রাত্যজনের সংগীত রুদ্ধ করে দেবে অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু  জর্জ বিশ্বাসরা সংখ্যালঘু। বেশির ভাগই ছেড়ে গেল কলেজ। উল্লেখ যোগ্য ভাবে ছাত্র সংখ্যা হ্রাসের ফলে কলেজ কর্তৃপক্ষ আর্থিক সংকটের মুখে পড়েন এবং তার মোকাবিলার জন্য কিছু তরুণ অধ্যাপককে ছাঁটাই করে ব্যয় সংকোচের চিরাচরিত রাস্তা নেন। এই ছাঁটাই তালিকায় নাম সেই তরুণ কবির। অধ্যক্ষ হেরম্ব চন্দ্র মৈত্র কবির বাবা সত্যানন্দ কে পরিস্থিতি জানিয়ে একটি চিঠিও দেন ও আর্থিক হাল ফিরলে পুনর্বহাল এর আশ্বাসও দেন।

না কবির ফিরে আসা হয় নি। বেকার কবি কে অর্থ কষ্টের মধ্যে পড়তে হয়। এই পোড়া বাংলাদেশে স্রেফ কবিতার বই লিখে কে কবে স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছে। বিশেষ করে সেই কবি যার সম্বল তখন কেবলমাত্র একখানি কবিতার বই। 

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি, সুভাষ বোস দেশনায়ক নেতাজি, বিশাল সব বড় মাপের মানুষ। একযুগ বাদে ১৩৪৫ সালে একজন আরেক জনকে উৎসর্গ করেছেন 'তাসের দেশ' নাটিকা। কেবল সেই কবিই সেই সংঘর্ষের কো ল্যটারাল ড্যামেজ হিসেবে রয়ে গেলেন। 

বাগদেবীকে নিয়ে সেবারের যুদ্ধে বলি হয়েছিল বাংলার 'নির্জনতম কবি'র রুটি রোজগার। আজ আবার সরস্বতী পুজো। কিন্তু বাতাসে সেই সংঘর্ষের বারুদের ঘ্রাণ। আজ যেন কোনো কবির জীবনে এমন কোনও ট্র্যাজেডি নতুন করে নেমে না আসে। নইলে  বাগদেবীর আরাধনা মিছে।

আগ্রহী পাঠকের জন্য তথ্যসূত্রঃ
১. চিঠিপত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ঊনবিংশ খন্ড), পৃষ্ঠা ১৩৭, উইকি সংকলন, একটি মুক্ত পাঠাগার
২. চতুরঙ্গ, বর্ষ ৫৬, সংখ্যা এক, ১৪০৩
লাইফ অফ জীবনানন্দ দাশ, মহীতোষ বিশ্বাস, গ্রন্থতীর্থ
৩. ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত, দেবব্রত বিশ্বাস
৪. রবি, নেতাজি ও জীবনানন্দ, গৌতম মিত্র, ব্লগ

রবিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০২০

বোলসোনারো সম্পর্কে দুতিনটে বিষয় যা জানি ~ পরিচয় পাত্র

বোলসোনারো সম্পর্কে দুতিনটে বিষয় যা জানি 

জাইর বোলসোনারো সম্পর্কে তাঁর নারী এবং সমকামবিদ্বেষ, পরিবেশধ্বংসী কাজকর্মের কথাই আসে মূলত, অর্থাৎ যা দেখা যায়। যা দেখা যায় না তা হল এর উৎস, নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ। বোলসোনারো সাতের দশকের আবিশ্ব এবং আ-লাতিন ডিক্টেটরশিপের জীবাশ্মমাত্র নন, তিনি এর অবশেষ, এর স্মৃতি এবং বর্তমান, তিনি অতীতের দেহধারী। তাঁর মিলিটারি কেরিয়ার নিতান্তই হতাশাব্যঞ্জক, কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে জনবিরোধী, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং দায়িত্বহীন ক্ষমতার অধিকারী মিলিটারি রেজিমগুলির তিনি মানসিক উত্তরাধিকারী, বাহিনীতে কেমন সার্ভিস দিলেন কী এসে যায় তাতে? 

বোলসোনারো একটি মহাদেশীয় আন্তর্জাতিক অগণতন্ত্রের অস্তিত্বে উৎসাহী, যেমন সাতের দশকে সবকটি লাতিন দেশের সামরিক সরকারের মধ্যে ছিল অপারেশন কণ্ডর, সেই অক্টোপাসের শুঁড় আপনাকে যে প্রান্তেই চলে যান টেনে আনবেই। এমনকি ইউরোপে নির্বাসনও নিরাপদ ছিল না, আর্জেন্টিনীয় ফিল্মমেকার হোরহে সেদরোন ফ্রান্সেও টিকতে পারেন নি। তাঁর আত্মীয় অপহৃত হন আর্জেন্টিনীয় উচ্চারণের কিছু রহস্যময় লোকের হাতে, আর প্যারিসীয় পুলিশ দপ্তর সাহায্যের বদলে জেরা করে তাঁকে পৌঁছে দেয় সেই আশ্চর্য চারতলায় যেখানে নিজেকে ছুরি মারতে একটুও অসুবিধা হবে না। ১৯৮১ তে হুলিও কোরতাসার একটি প্রবন্ধ লিখবেন এই আত্মঘাতীকে স্মরণ করে, পড়তে চাইলে সেজ গ্রুপের 'ইনডেক্স অন সেন্সরশিপ' ম্যাগাজিন দেখতে পারেন। 

বোলসোনারো সব কয়টি মহাদেশীয় পুণ্যশ্লোক ডিক্টেটরকেই সশ্রদ্ধ স্মরণ করেন বারেবারেই, পেরুর আলবের্তো ফুজিমোরি, চিলের আউগুস্তো পিনোচেত, পারাগুয়াইয়ের আলফ্রেদো স্ত্রোয়েসনার। শেষোক্তজন, বিখ্যাত শিশুকামী ও টিনএজার-ধর্ষক তিনি, বিরোধীদের ইলেকট্রিক করাত দিয়ে খণ্ডবিখণ্ড করাতেন, সেটা টেলিফোনে শুনতেন এল প্রেসিদেন্তে, পরে তার রেকর্ড পাঠানো হত মৃতের আত্মীয়দের কাছে। 

ব্রাজিলের ১৯৬৪ থেকে ১৯৮৫ র ডিক্টেটরশিপ নিয়ে ভারী খেদ আছে বোলসোনারোর, কেননা অত্যাচারকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেলেও ব্রাজিলীয় মিলিটারি রেজিমের হত্যার সংখ্যা কম, চিলে আর আর্জেন্টিনার বডি কাউণ্ট অনেক বেশি। তিনি আরও অনেক মৃত্যু চান। বোলসোনারো ১৯৬৪ র ক্যুয়ের দিনটিকে উদযাপন করেন, তিনি ও তাঁর ছেলে সেদিন জাতীয় পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে থেকেছেন পার্লামেন্টে, যেখানে পাশেই অন্য এক সাংসদ দাঁড়িয়ে ছিলেন ফ্রায়ার তিতোর ছবি হাতে, ব্রাজিলীয় ডিক্টেটরশিপে নির্যাতিত ও নির্বাসিত যে ফ্রায়ারের ফ্রান্সে আত্মহত্যার গল্প আগে লিখেছি। 

প্রাক্তন মানবাধিকার সচিব মারিয়া দে রোসারিওর উদ্দেশে বোলসোনারোর সেই বিখ্যাত "ওঁকে কেউ ধর্ষণ করবে না, উনি কুৎসিত" মন্তব্য কোন প্রসঙ্গহীন ঘটনা নয়। দক্ষিণ আমেরিকার মিলিটারি দশকে টর্চার ক্যাম্পগুলিতে যৌন নির্যাতনের আধিক্য প্রমাণিত। চিলের এক ধর্ষকামী সমাজবিরোধী ও গুপ্তচর সাক্ষাৎকারে তার বিরুদ্ধে ক্যাম্পে রাজনৈতিক কর্মীদের ধর্ষণ করার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছিল, "এসব জঘন্য, নোংরা, পেচ্ছাপে মাখামাখি, পা বেয়ে রক্ত গড়ানো মেয়েদের কে ধর্ষণ করতে যাবে?" (টমাস সি. রাইটের 'স্টেট টেররিজম ইন ল্যাটিন আমেরিকা' দ্রষ্টব্য)। 

এই মহাদেশে পরস্পর বিবদমান নানা রাজনৈতিক গ্রুপের মধ্যে বিসম্বাদ-হানাহানি অসহনীয় হয়ে উঠলে, সংলাপের রাস্তাটুকুও বন্ধ হয়ে গেলে সেখানে হস্তক্ষেপ করত ক্ষমতাভিলাষী মিলিটারি, উচ্চমধ্যবিত্ত গণপরিসর এবং মিডিয়ার একপ্রকার প্রশ্রয়েই, যেহেতু বোঝা যেত না কখন তাদের রাজদণ্ড একেবারে অনির্দিষ্টকালের জন্য পাকাপোক্ত হবে, বোঝা যেত না কখন তারা সব বেসামরিক দলের জন্যই রাজনৈতিক পরিসরটিই বন্ধ করে দেবে। কেউ কেউ, যেমন চিলে, ভেবেছিল প্রতিবেশী দেশগুলির মতো তারা কোনদিনই সামরিক শাসন দেখবে না, তাদের নিরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্রই থেকে যাবে। আউগুস্তো পিনোচেত নামক ধূমকেতুর তখনো উদয় হয়নি। 

জাইর বোলসোনারো এবং তাঁর সমকাল তাই এক চেকলিস্টও বটে। সবকটা বক্সে টিক পড়ছে কিনা তা দেখে নিতে হয় কেবল। 

শেষ করার আগে মারিয়েল ফ্রাঙ্কোর কথা মনে পড়ল। এই বিরোধী রাজনৈতিক নেত্রী ২০১৮ র ১৪ই মার্চ রিওতেই কৃষ্ণাঙ্গী তরুণীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের এক আলোচনা থেকে ফেরার পথে আক্রান্ত হন। একঝাঁক বুলেটবৃষ্টি তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করেছিল, সংশ্লিষ্টরা একটি ভিজিল্যান্টি মিলিশিয়া হিসেবে চিহ্নিত হয়, দুই আততায়ীই নাকি অতীতে মিলিটারি পুলিশে ছিল, দুজনকেই নাকি একদা পুরস্কৃত করেছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্টের পুত্র। বর্তমানে সেই তদন্ত কেমন চলবে আমি জানি না। কেবল জানি বর্তমান প্রেসিডেন্ট ছিলেন সেবছরের একমাত্র ভোটপ্রার্থী যিনি এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করতে অস্বীকার করেন। 

মারিয়েল ফ্রাঙ্কো কৃষ্ণাঙ্গী, উভকামী, সিঙ্গল মাদার। ফেলে আসা বছরে এই উজ্জ্বল তরুণীটির সঙ্গে তাঁর অনেকদিনের সমকামী পার্টনার মোনিকা বেনিসিওর বিয়ে হত।

বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০২০

নেতাজী ~ ত্রিদিব বাইন

বাঙালি বড়ো হয় সুভাষ বনাম গান্ধী শুনে। আর শোনে সুভাষের সেরা শত্রু নেহেরু। ঐ হারামিটাই চোরাগোপ্তায় চৌপাট করেছে নেতাজিকে।

বোধগম্য হয়না, কি করে মহাত্মাই সুভাষের নাম প্রস্তাব করেন ১৯৩৫ কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে। কি করে ৫ বছর বাদে ইলেকশনে সুভাষ পাশে পান নেহেরুকে। কি করে সুভাষ আজাদ হিন্দের দুই ব্রিগেডের নাম রাখেন 'গান্ধী ব্রিগেড' আর 'নেহেরু ব্রিগেড' ! কি করে ১৯৪৪শে গান্ধীকে "জাতির জনক" তকমা দিলেন সুভাষ।

তবে হ্যাঁ, একজন ছিলেন। ঘোষিত সুভাষ বিরোধী। গুজরাটি।যার ১৮২ মিটার ষ্ট্যাচু দেখে হাঘরে হাত্তালি সাবড়ায় ইতিহাস অশিক্ষিত কিছু সদ্য গুজরাটি ভক্ত বাঙালি ! হ্যাঁ, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। ১৯৩৯ এ সুভাষের কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হওয়া আটকাতে ধুতি ফুতি ঢিল করে ফ্যালা আয়রন ম্যান। ডিপ্লোম্যাসি করে দলে টেনেছিলেন গান্ধীকে। রাজেন্দ্র প্রসাদকে চিঠি লিখলেন সুভাষকে খিস্তিয়ে। বল্লেন সুভাষের প্রেসিডেন্ট হওয়া দেশের পক্ষে ক্ষতিকর। তারপরও যখন তার জয় আটকানো গ্যালোনা, সুভাষকে ব্যাঙ্গিয়ে বল্লেন, "সিংহরা জন্মসূত্রে রাজা হয়, সামান্য একটা জঙ্গলের নির্বাচনে জিতে নয়" ! সুভাষের প্রতি প্যাটেলের ছিলো "নীচ, বিদ্বেষ আর প্রতিহিংসা"! বলেছেন দাদা শরৎ বোস।

গান্ধী নেহেরু'র বিরুদ্ধে সুভাষ নামিয়ে, ফুরফুরে সুরসুরি দিয়ে কিছু হিন্দুত্বের গোজলে চোবানো মস্তিষ্কের দখল নেওয়া যায়। ইতিহাস বদলানো যায়না। যে ইতিহাস বলে, আজীবন হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের চাবকিয়েছেন চিত্তরঞ্জনের এই শিষ্য। ১৯৩৫ এর "ইন্ডিয়ান ষ্ট্রাগেল" বই থেকে ৪০ এর ঝাড়খণ্ড জনসভা। ছানাবড়া চোখে ১৯৪০ নাগাদ শ্যামাপ্রসাদ ডায়রিতে লিখছে 'সুভাষ যদি থাকতেন, সৃষ্টির আগেই ভাঙচুরে চুরমার হতো হিন্দু মহাসভা'! সুভাষ যখন আজাদ হিন্দ নিয়ে ইংরেজদের চামড়া গোটানোর জন্য তৈরি, আজকের শাসকের সৃষ্টিপুরুষ সাভারকার তখন ১৯৪১ এ ভাগলপুরে আহ্বান দিচ্ছেন দলে দলে হিন্দু ইংরেজদের দলে নাম লেখাক ! 
সেই কবে, ১৯৪০ এর ১২ই মে সুভাষ বলেছিলেন, "হিন্দু মহাসভাকে দেশছাড়া করুন। এরা বিশ্বাসঘাতক" ! প্রফেটিক !

আজ তার জন্মদিন। তার জীবন, তার আদর্শ, তার চেতনা সব্বাই জানে। আজ শুধু তার নাম ভাড়িয়ে ভোট চাখা ভাঁড়গুলোকে ভাঙচুর করার তাগিদ নিক বাঙালি।

বুধবার, ২২ জানুয়ারী, ২০২০

আপ ক্রনোলজি সমঝিয়ে ~ আর্কাদি গাইদার

আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে।

প্রথমে আরএসএস আসামে 'বংগাল খেদা'র আগুনে ঘী ঢালবে। বাজপেয়ী আসাম আন্দোলনকে সমর্থন করে পার্লামেন্টে বক্তৃতা দেবে। তারপর আসামে গিয়ে বলবে 'এখানে বিদেশীরা এসে সব দখল করে নিচ্ছে। পাঞ্জাবে এরকম করলে আমরা কেটে টুকরো টুকরো করে দিতাম'। এরপর ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা জুড়ে বাঙালিদের কচুকাটা আর বিতাড়ন চলবে। 
তারপর বরাক উপত্যকার বাঙালীদের আরএসএস বোঝাবে হিন্দু বাঙালী আমাদের আপন। মুসলিম বাঙালী বহিরাগত। তাদের এনআরসি করে বার করে দেবো। 
তারপর অহমীয়াদের বোঝাবে এনআরসি করে সব বাঙালিকে তাড়াবো। এরকম করে ১৯ লাখ বাঙালী আর সাথে কিছু কোল্যাটারাল হিসেবে বিহারী গোর্খা পাড়ি দেবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। সর্বানন্দ সোনেওয়াল বলবে বাজপেয়ীজি আমাদের কাছে পরম শ্রদ্ধেয়, আসাম আন্দোলনে ওনার অবদান চিরস্মরণীয়। এরপর ভীত বাঙালী হিন্দুকে বিজেপি বোঝাবে তোমাদের আবার ক্যা এনে ঢুকিয়ে নেবো। আমরাই তোমাদের রক্ষাকর্তা।

আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে।

কাশ্মীরে পন্ডিতদের ওপর আক্রমণের সময় কেন্দ্রে বিজেপির জোট সরকার। কাশ্মীরের গভর্নর আরএসএসের সদস্য জগমোহন পন্ডিতদের উদ্দেশ্য ঘোষণা করবে - ৩,৪ মাসের জন্যে জম্মুতে সাময়িক ভাবে আশ্রয় নাও। এরপর কাশ্মীরের পরিস্থিতি শান্ত করেই তোমাদের আবার ঢুকিয়ে নেবো। পন্ডিতদের স্থানান্তরিত করতে গাদা গাদা সরকারি বাস, প্লেনের আয়োজন করা হবে। এরপর দুবার বাজপেয়ীর সরকার আসবে। দুবার মোদীর সরকার আসবে। স্থানান্তরিত পন্ডিতরা সেই ক্যাম্পেই থাকবে। তার কারন প্রতিবার আপনার মতন বেয়াদবকে প্রশ্ন করবার অবকাশ রাখতে হবে - কাশ্মীরী পন্ডিতদের বিতাড়নের সময় আপনি কি করছিলেন? আর আপনি, যিনি অত খবর রাখেন না, তিনি ভুলেই যাবেন, যে বিতাড়নের সময় কেন্দ্রের সরকারের জোটসঙ্গী বিজেপি কাশ্মীরি পন্ডিতদের বিতাড়ণের সময় দেশজুড়ে রথযাত্রা করছিলো। আর কাশ্মীরি পন্ডিতদের ক্যাম্পে গিয়ে গিয়ে বছরে একবার বিজেপি নেতারা মুসলমানদের গালি দিয়ে বলবে - আমরাই তোমাদের রক্ষাকর্তা। 

আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে।

সেই পার্টিশনের পর থেকেই এই রাজ্যে এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বাঙাল উদ্বাস্তুরা আসছে। এই রাজ্যে তো রীতিমতন আন্দোলন করে, সংগ্রাম করে তারা জমি, কাজের অধিকার পেয়েছে। আস্তে আস্তে কাগজ পেয়েছে, ভোটাধিকার পেয়েছে। ভোটাধিকার মানেই নাগরিক, এমনটাই আপনি জানবেন, কারন সংবিধানেই লেখা আছে একমাত্র নাগরিকদের নামই ভোটার তালিকায় উঠবে। এমতবস্থায় ২০০৩ এ বিজেপি সরকার নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী এনে বলবে এবার থেকে 'অবৈধ অনুপ্রবেশকারী'র সংজ্ঞা তৈরি হলো। যারাই সঠিক প্রনালী বা সঠিক কাগজ ছাড়া এই দেশে ঢুকবে, তারাই 'অবৈধ অনুপ্রবেশকারী'। এই অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা আর কখনো কোন উপায় দেশের নাগরিকত্ব পাবে না। শুধু তাই নয়, কারুর বাবা বা মা যদি 'অবৈধ অনুপ্রবেশকারী' হয়, সেও নাগরিকত্ব পাবে না।
এর ফলে কি হবে? এতদিন যেই জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় এই দেশে এসেছে উদ্বাস্তু হয়ে, এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই সময়ের সাথে সাথে রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড, আধার কার্ড পেয়েছে, ২০০৩ এর এই আইনি সংশোধনীর পর তাদের এবার নাগরিকত্ব পাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ। 

আপ ক্রনোলজি সমঝিয়ে। 

২০০৩ থেকে ২০১৪, বিজেপি বলছে আহা রে, এই উদ্বাস্তুদ্বের নাগরিকত্ব পাওয়া আরও সহজ করতে চাই আমরা, তাই তো আমরা ক্যা এনেছি। চলো ভাইসকল উদ্বাস্তু, তোমাদের আমরা আসাম থেকে তাড়িয়েছি, ২০০৩ এ নাগরিকত্ব পাওয়া আটকে দিয়েছি, এবার আমরা ক্যা আনছি বলে আমাদের ভগবান মেনে লাইনে দাড়িয়ে প্রথমে নিজেদের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করো, তারপর আমাদের কাছে  নাগরিকত্ব ভিক্ষা চাও। আজ থেকে ১০ বছর পর আবার তখন আমরা সব বেয়াদবকে প্রশ্ন করবো - বাঙালি হিন্দুদের সমস্যার সময় আপনারা কি করছিলেন? 

আপ ক্রনোলজি সমঝিয়ে। 

এই ভাবেই এক হাত থেকে অন্য হাতে কয়েন চালান দেওয়ার ম্যাজিক দেখতে দেখতে আপনার চোখে যখন ঝিলিমিলি লেগে গেছে, সেই সময়কালে বাজপেয়ী আর যশবন্ত সিনহা বিলগ্নিকরণ মন্ত্রক খুলে ফেলবে, আর তাদের যোগ্য উত্তরসূরি নির্মলা সিতারমণ চুপিচুপি ঘোষণা করে দেবে, ভারতকে ৫ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতি করবার লক্ষ্যে সমস্ত রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে ঝটপট বেচে ফেলতে হবে।

আপ ক্রনোলজি সমঝিয়ে।

রবিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০২০

এন-আর-সি যদি ১০০ বছর আগে হত ~ নির্মাল্য সেনগুপ্ত

ভারতে এন-আর-সি যদি ১০০ বছর আগে হত তাহলে সেই সময়কার বিখ্যাত লেখকরা তাদের গল্পে কিভাবে ব্যবহার করতেন? 

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ

ধু ধু করিতেছে সেতুপুরের মাঠ। সোনালী বালির উপর চিকিচিকি দেখিয়া অপু ভাবিল, বাহ দিদিকে ডাকিয়া আনিলে ভাল হইত৷ দুর্গা এ যাবৎ অনেকবার তাহাকে বলিয়াছে যে সোনারঙা বালির খোঁজ লইয়া আনিলে অপুকে সে তাহার সঞ্চয় থেকে দুইখানি কড়ি দেবে৷ ওই কড়ির উপর অপুর বড়ই লোভ। সে একখানি গাছের ডাল ভাঙিয়া লইয়া বালির উপর নকশা কাটিতে ব্যস্ত হইল৷ হরিহর কখন আসিবে সে জানে না৷ অপেক্ষা করা ছাড়া এখন উপায়ও নাই৷ দলিল সম্মন্ধে অপু মা'কে জিজ্ঞেস করিয়া উত্তর মেলে নাই কোনও৷ সর্বজয়ার মুখে সে শুনিয়াছে সুদূর দিল্লী নামক কোনও এক গ্রামে নরেন্দ্র মোদী নামক এক রাজা আছেন৷ তিনি প্রজাদের দলিল দেখিতে চান, নহিলে সবাইকে দেশছাড়া করিবে৷ অপু দিদিকে জিজ্ঞেস করিয়াছিল, "দিদি, তবে কি আমাদের নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে চলে যেতে হবে? সতুদারাও যাবে?" দুর্গাও এর উত্তর দিতে পারে নাই৷ 

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ 

বৃষ্টি থামার কোনও নাম নেই আজ দুপুর থেকেই৷ ডাঁই করা ঘাসের উপর, চাল থেকে চুঁইয়ে টপ টপ করিয়া জলের ফোঁটা পড়িয়া পচা গন্ধ বাহির হইয়াছে বেশ৷ ঘরের ভিতর আদুড় গায়ে শুইয়া আছে মালতী৷ ঘরের ভিতরেও যে সুবাস ছড়াইতেছে তা বলিতে পারি না৷ মালতীর পায়ের কাছে ঘায়ের উপর মাছি ঘুরিতেছে ভনভন৷ সনাতন পাগলের মত ঘরের আনাচে কানাচে খুঁজিয়া যাইতেছে কিছু। মালতী ড্যাবড্যাব করে তাকিয়া রইয়াছে সনাতনের দিকে৷ তাহার পিঠের পেশী ওঠানামা করিতেছে জোরে জোরে। চোখেমুখে ভয়ের ছাপ৷ ঠোঁটের কাছে অল্প বিস্কুটের গুঁড়ো লাগিয়া আছে এখনও৷ সনাতন বলিল, "কাগজ না পেলে ভিটেমাটি চাটি হবে বুঝেচ? অমন করে দেখচ কী? তোমার ভয় লাগে না?" 
মালতী খিলখিলিয়া হাসিয়া ওঠে। বলে, "যেখানেই যাই, যাব তো তোমার সঙ্গেই৷ আমাকে একা ফেলে পালাবে ভেবেচ নাকি? তা হবে না বাপু..." 

জীবনানন্দ দাশঃ 

একটা চুরুট জ্বালিয়ে মাল্যবান চেয়ারে বসে জানলার দিকে তাকাল। মিহি কোনও সুর ভেসে আসে ওই বাড়ি থেকে৷ সে সুরে কোনও কথা নেই, আকুতি নেই, আলো নেই। আলো কোনওদিন নিজের জীবনে চায়ওনি মাল্যবান। উৎপলা কি চেয়েছে? এই দুর্দিনেও উৎপলা শুয়ে থাকে৷ কেবল শুয়ে থাকে৷ জঙ্গলে আগুন লাগলেও যেমন সজারুর দল ভুলে যায় নদীর দিকে ছুটে চলার কথা। ঝাঁক ঝাঁক শকুন উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করে পোড়া মাংসের গন্ধ নাকে আসার, সেই তীব্র মোদ্দাফরাসের ন্যায় কিছু হিংস্র হায়না দাপিয়ে বেড়ায় হলুদ ফুলের মধ্য দিয়ে। বাতাসে বাতাসে ছাইয়ের সঙ্গে ফুলকি সখা পাতায় কখনও সখনো৷ মাল্যবান ভাবে৷ মিহি সেই সুরের তালে তালে তার চোখের সামনে কোনও কাগজের অবয়ব ফুটে ওঠে। অমিত শাহ কি জানে তার কথা? তার এই অন্ধকার ঘরের ভিতর উৎপলার এক মুহূর্তের ভালবাসার আখাঙখা, অথবা ভালবাসা নয়, শুধু বেঁচে থাকা। একটা অন্ধকার ঘরের ভিতর, সামান্য বেঁচে থাকা ইচ্ছে। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঃ 

আমি ভাবিতাম, দেশছাড়া হওয়ার আশঙ্কা বুঝি শুধু আমার। আর কারও হৃদয়গহ্বরে তেমন কোনও উৎকণ্ঠার কারণ, তাহাদের উতলা করিতে পারে নাই আজও৷ তবু আজ এত লোকের সমবেত কণ্ঠস্বর আমাকে সামান্য একটু বল দিল৷ শুস্তা নদীটির উপলমুখরিত পথে নর্তকীর ন্যায় জলবারি, নৃত্য করিয়া চলিয়া যাইতেছে ক্রমাগত। নদীর কিনারে শৈলপদমূলে জড়ো হইয়াছে প্রায় দেড়শত লোক। গগনভেদী কণ্ঠে তাহারা সোচ্চারিত হইতেছে "হাম ছিনকে লেঙ্গে আজাদী..." 

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ 

ব্যোমকেশ সযত্নে খবরের কাগজটি পাট করিয়া টেবিলে রাখিল। একটি সিগারেট জ্বালাইয়া অন্যমনস্ক ভাবে তাকাইয়া রহিল কাগজটির দিকে৷ 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, "কী হল? নতুন কোনও কেস পেলে?" 

বাইরে হ্যারিসন রোডের উপর নবোদবুদ্ধ নগরীর পথে মানুষের ঢল৷ আমাদের এই বসিবার ঘরটির গবাক্ষপথে রাস্তার কিয়দংশ দেখা যায়। কাতারে কাতারে মানুষ নাগরিক আইনের বিরুদ্ধে মিছিলে পথ হাঁটিতেছে। 

ব্যোমকেশ আমার প্রশ্নে সজোরে মাথা নাড়াইয়া কহিল, "আমি একটি পণ করেছি অজিত। যতদিন না সরকার এই আইন ফিরিয়ে নিচ্ছে, সরকারের কোনও কেসে ব্যোমকেশ বক্সী মাথা ঘামাবে না।" 

সত্যজিত রায়ঃ 

লালমোহনবাবু উত্তেজিত স্বরে বললেন, "বলেন কী মশাই! এই এন.আর.পি আইন সত্যিই লাঘু হবে নাকি?" 

আমি আড়চোখে ফেলুদার দিকে তাকালাম৷  রাস্তায় এত যানজট এর আগে আমরা দেখিনি৷ লালমোহনবাবুর সাম্প্রতিক উপন্যাসটা প্রায় ২০০০ কপি বিক্রি হওয়ায় তিনি আমাদের চাঙোয়া নিয়ে চলেছেন। সামনের লরিটা থেকে বেরোনো কালো ধোঁয়া মাঝেমধ্যেই গাড়ির উইন্ডস্ক্রীন কালো করে দিচ্ছে। 

"ওটা এন-আর-সি। এন-আর-পি নয় লালমোহনবাবু। আর হ্যাঁ, লাঘু হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষ করতে দেবে না৷" 

"সেটাই তো।" লালমোহনবাবু উত্তেজিত হয়ে সিটের পিছনে একটা পেল্লাই ঘুষি চালিয়ে বললেন, "একি ইয়ার্কি নাকি মশাই। আমার ভোটার আইডি আছে, ভোট দিয়েছি, এখন বলছে সেটা আমার প্রমাণপত্র নয়? ভাই তপেশ, তুমিই বল, এ কী সম্ভব?" 

শিবরাম চক্রবর্তীঃ 
বাড়ি থেকে বেরিয়েই হর্ষবর্ধন ভাবিত হন। ভাইকে ডেকে বলেন, "হ্যাঁ রে গোবরা, ধর আমাদের ধরে ক্যাম্পে ঢুকিয়ে দিল। তারপরে কলকাতা ফিরতে পারব তো আবার?" 

গোবর্ধন বললে, "অত ভেব না তুমি৷ আসামে আমাদের সবাই চেনে৷ তোমারও গোটা আসাম নখদর্পনে৷ একটা কাগজ তুমি জোগাড় করতে পারবে না?"
"তা চেনে বইকি। যুদ্ধেও তো গিয়েছি আমি। যাইনি নাকি? এবার বলবে যে ডিটেনশন ক্যাম্পে যাও? এমন টেনশনে কি ফেলতে পারবে আমাদের?" 

" না না।" তুমি ভয় পেও না দাদা। বাড়ির দলিলের বন্দোবস্ত করে আমরা আমাদের বস্তিতে ফিরে আসব৷ চিন্তা হয় শিব্রামবাবুকে নিয়ে।" 

"তাকে নিয়ে আবার কিসের চিন্তা?" হর্ষবর্ধন মাথা নেড়ে বলেন, "তার আবার চিন্তা কী? তার পিছুটান বলতে তো বোন আর ভাইপোরা। সম্পত্তি বলতে তার আছে কী? ওই বইগুলো? সে নাহয় বই নিয়েই উনি বাংলাদেশে ফিরে যাবেন। এমনিও এখানে কেউ পড়ে না৷" 

"এমন বোল না৷ বন্ধু হয় কিনা আমাদের? তার জন্যেও নাহয় একটা কাগজ বের করে ফেলি আমরা। বলব, উনি হলেন বৌদির ভাই। কেমন হয়?"
"মন্দ বলিসনি তা। তবে এইসব ঝক্কি আমার পোষায় না বাপু। এইসব বন্ধ করলেই ভাল হয় সবথেকে৷ মোদীর জন্যে আমোদই করতে পারছি না শান্তিতে৷" 

"ঠিক বলেছ দাদা। তোমার সর্বধর্ম সমন্বয়ের পরিবর্তে এই ধর্মসর্বস্ব ঝঞ্ঝাট। এ কি ভাল লাগে বল?"

শনিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০২০

ফ্যাসিজম সম্পর্কে দুটো একটা কথা যা আমি জানি ~ বিষাণ বসু

১. সর্বত্রই, ফ্যাসিস্টরা শাসনক্ষমতায় আসেন বিপুল জনসমর্থন নিয়ে - অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভোটে জিতে বা তেমনই কোনো "গণতান্ত্রিক" পদ্ধতিতে। জনসমর্থন আদায়ের পরেই সেই সমর্থন যে কোনো দলের পক্ষে নয়, স্রেফ একজন শাসকের প্রতি - যিনি সমর্থনকে একটি বিশেষ আইডিওলজির প্রতি সমর্থন ও ফ্যাসিস্ট লীডার ব্যক্তিটি যে সেই আইডিওলজির সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি - এই ভাবনার নির্মাণপ্রক্রিয়ার শুরু হয়।  

২. "গণতান্ত্রিক" পদ্ধতিতে নির্বাচিত হলেও, ফ্যাসিবাদী সরকার যত দ্রুত সম্ভব গণতন্ত্রের পরিসরটি সঙ্কুচিত করে ফেলেন। 

৩. ক্ষমতায় আসার সময় তো বটেই, ক্ষমতায় থাকাকালীনও, দেশের একটা বড়ো অংশের মানুষ ফ্যাসিবাদী সরকারকে সমর্থন করেন।

৪. এই সমর্থকদের বেশীর ভাগই সরকার যে ফ্যাসিস্ট, সেইটা চিনে উঠতে পারেন না - তাঁদের সমর্থনের যুক্তি থাকে বিভিন্নধরনের - এইভাবে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ বিভিন্ন যুক্তিক্রম নিয়ে ফ্যাসিবাদী সরকারের সমর্থনে থাকেন, অনেকসময় নিজের অজ্ঞাতেই। তাছাড়া, ফ্যাসিস্ট শাসকমাত্রেই বহুরূপীর দক্ষতায় প্রয়োজন অনুসারে "যখন-যেমন-তখন-তেমন যাকে-যেমন-তাকে-তেমন" ধাঁচে নিজেদের মুখ্য এজেন্ডাকে লুকিয়ে উপযোগী পছন্দসই এজেন্ডা খাড়া করতে পারেন।

৫. এইসব সমর্থকেরা যুক্তিতর্ক বা আলোচনার পথ ধরে নিজেদের ভ্রান্তি সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন, এমন নজির নেই। যতক্ষণ না পর্যন্ত নিজেরাই ফ্যাসিবাদী আক্রমণের শিকার হচ্ছেন, ততক্ষণ সমর্থন জারি থাকে। 

৬. একমাত্র ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর এঁদের সামনে পুরো ছবিটা স্পষ্ট হয় - এবং তখন এঁদের সম্বিত ফেরে - এই সমস্ত অপকর্মের সাথে নিজেদের সমর্থন জড়িত ছিল ভেবে যারপরনাই লজ্জিত হন - কিন্তু, সে অনেক পরের কথা।

৭. দেশপ্রেম আর ফ্যাসিবাদী জাতীয়তাবাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি বিষয় - যদিও, দ্বিতীয়টি দাঁড় করানোর জন্যে প্রথমটির যুক্তি ব্যবহৃত হয়।

৮. ফ্যাসিবাদী জাতীয়তাবাদের রেটোরিক যেহেতু ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছাড়া দাঁড়াতে পারে না, কাজেই শত্রুর নির্মাণ অনিবার্য - সে শত্রু, সাধারণত, দেশের বাইরের। কিন্তু, দেশের মধ্যেকার ঘৃণা আর বিভাজন ফ্যাসিবাদের উদ্দেশ্যসিদ্ধির মুখ্য উপায়। তাহলে? সমাধান, দেশের একটি বড় অংশকে দাগিয়ে দেওয়া হয় বিদেশী শত্রুর সহকারী হিসেবে। এইটা একটা উপায়।

৯. স্বচ্ছলতার মুহূর্তে ফ্যাসিবাদের উত্থান হয় না - হয়, আর্থিক সঙ্কটের পরিস্থিতিতে। সেই সঙ্কটের পরিত্রাণের পথ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় দেশের একটা অংশের মানুষকে শায়েস্তা করা - দেশের মধ্যে ঘৃণা আর বিদ্বেষ জিইয়ে রাখার এ আরেক পথ।

১১. ফ্যাসিবাদী প্রবণতার প্রতিবাদ করতে গেলেই অতীত টেনে উদাহরণ দেওয়া ফ্যাসিস্ট শাসক ও তার সমর্থকদের বড় অস্ত্র - সে উদাহরণ প্রায়শই কাল্পনিক, অতীত প্রায়শই নির্মিত - বর্তমানের ভয়াবহতা ভোলাতে শোনানো হয় দেশবিদেশের ততোধিক ভয়াবহতার গল্প - শাসক সবসময়ই নিশ্চিত থাকেন, জনগণের স্মৃতি বেশীদিন টেকে না - আর সমর্থকদের কথার সুর দেখে সেই নিশ্চয়তা যে কতোখানি বাস্তবসম্মত, তার প্রমাণ মেলে।

১২. ইতিহাস তো বটেই, একেবারে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী, এমনকি আর্থসামাজিক পরিসংখ্যান বা তথ্যও এমন সুচতুর দক্ষতার সাথে নির্মিত হয় - নিতান্ত গভীর অনুসন্ধানের মানসিকতা ব্যতীত বাস্তব পরিস্থিতির আন্দাজ পাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়। আর, অর্থনৈতিক দুরবস্থা নেহাতই প্রকট হয়ে গেলে, অতীত রাজনীতি বা নির্মিত শত্রুকে দায়ী করার পথ তো থাকেই। 

১৩. ফ্যাসিজমের প্রতিবাদ মানেই দেশের বিরুদ্ধে যাওয়া - প্রতিবাদী মাত্রেই রাষ্ট্রদ্রোহী - রাজনৈতিক বিরোধী মানেই দেশের শত্রুর এজেন্ট - ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো মানেই দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার না দেওয়া - এই সব প্রচারই ফ্যাসিবাদের সনাতন কার্যপ্রণালী ও বহুপরীক্ষিত অস্ত্র।  

১৪. শিক্ষিত ও চিন্তাশীল মানুষদের একাংশ ফ্যাসিস্ট শাসকদের পাশে থাকলেও, তাঁদের গরিষ্ঠ অংশই দাঁড়ান বিপরীতে। অতএব, উচ্চশিক্ষিত ও চিন্তাশীল মানুষেরা যে আদতে দেশের কাজে আসেন না, সেই বার্তা বিভিন্ন পথে আমজনতার মনে ঢোকাতেই হয় - কায়িক শ্রমই দেশের উন্নতির চাবিকাঠি ও মানসিক শ্রম বা বিদ্যাচর্চা অলস সময়যাপন মাত্র - এই এজেন্ডা ফ্যাসিস্ট শাসকের বড় অস্ত্র।

১৫. দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের বৃহদংশ শাসকের পাশে থাকেন - সংবাদমাধ্যম বা তদনুসারী পথ তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন ও শাসকের পক্ষে প্রচার জারি রাখেন - অন্তত ততোদিন পর্যন্ত, যতোদিন না দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এমন তলানিতে ঠেকছে যাতে তাঁদের ব্যবসার বাজার সঙ্কুচিত হতে হতে একেবারে শেষ দশায় পৌঁছায়।  

আপাতত, এই ক'টা পয়েন্ট নিয়ে ভাবতে থাকুন।

মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২০

বর্গী এলো দেশে ~ অনির্বাণ অনিক

চাইর দিকে লোক পলাঞ ঠাঞি ঠাঞি।
ছর্ত্তিস বর্ণের লোক পলাএ তার অন্ত নাঞি।।
এইমত সব লোক পলাইয়া জাইতে।
আচম্বিত বরগি ঘেরিল আইসা সাথে।।
মাঠে ঘেরিয়া বরগী দেয় তবে সাড়া।
সোনা রুপা লুটে নেএ আর সব ছাড়া।।
কারূ হাত কাটে কারূ নাক কান।
একি চোটে কারূ বধএ পরাণ।।
ভাল ভাল স্ত্রীলোক জত ধইরা লইআ জাএ।
আঙ্গুষ্ঠে দড়ি বাঁধি দেয় তার গলাএ।।
একজনে ছাড়ে তারে আর জনা ধরে।
রমনের ভরে ত্রাহি শব্দ করে ।।'

কার লেখা জানেন? কোন ঘটনার বর্ণনা জানেন? পলাশী যুদ্ধের বহু বছর আগে এক বাঙালি কবি গঙ্গারামের লেখা। "হিন্দু পাদ পাদশাহী" অর্থাৎ হিন্দু সাম্রাজ্য গড়ার নামে মারাঠা ভাস্কর পণ্ডিত এবং তার দলবলের বর্গী আক্রমণে সেদিন সমগ্র  বাংলাদেশ  ও বাঙালি ছারখার হয়ে গিয়েছিল। বার বার বাংলা আক্রমণ করে কত বাঙালিকে যে খুন করেছিল, কত বাঙালি নারীকে যে ধর্ষণ করেছিল, কত লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ লুঠ করেছিল তার ইয়ত্তা নেই। একবার না , বার বার। বাংলার গ্রামে গ্রামে, মাঠে প্রান্তরে বছরের পর বছর তাদের আক্রমণে  নেমে এসেছিল শ্মশানের স্তব্ধতা। ৪ লক্ষ বাঙালির খুনে সেদিন লাল হয়ে গিয়েছিল বাংলার প্রান্তর। কয়েক সহস্র বাঙালি মহিলাকে লুঠ করে "হিন্দু পাদ পাদশাহীর" যোদ্ধারা যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করেছিল। সেদিনের বাঙালি কবি গঙ্গারামের বর্ণনায় প্রতিফলিত হয়েছে সেদিনের নির্মম বাস্তবতা।  "খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে/বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে" গানে মায়ের আকুতিতে ধরা পড়েছে সেদিনের বাঙালির অসহায়তা। 

অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই, বিদেশী আক্রমণকারীর ধর্ম দেখে "মুসলিম" বিচার করে নির্মমতার যে বিবরণ জনমানসে খাড়া করা হয় তার ১% শিহরণের ন্যারেটিভ "হিন্দু পাদ পাদশাহীর" নির্মমতার ক্ষেত্রে কোনদিন তৈরী করা হয়নি। 

শনিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০২০

প্রোটোকল ~ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য


দিল্লির  রাজা,সঙ্গে পেয়াদা সাথে সভাসদবর্গ
হবিদা বলেন আপনি তো স্যার ভারতবাসীর গর্ব।
এগোচ্ছে দেশ হইহই করে আপনি একাই একশো 
আরে রামরাম সিপিএম বাম হারামির হাতবাক্স।
দিলুদা হবিদা করে খুনসুটি ধনকর পান দুঃখ 
ভাবেন এসব ইনসাল্টিং কাঁটা বেধে অতি সূক্ষ্ম। 
ওদিকে তখন কিছু তিনোমূল গড়িয়াহাটার মঞ্চে
রাজাজি হাঠাও স্লোগান তুলেছে বিরিয়ানি খেয়ে লাঞ্চে।
রাজাজি শুধালো হাকিম সাহেব এসব যা শুনি সত্যি
হবিদা বলেন এসব গুজব নিউজ পেপার ভর্তি।
আছে সি বি আই, সাথে দেশি গাই দিলুদার মুখে স্বস্তি 
বিরোধীরা পাজি অপবাদ দেয় এসব সেটিং দোস্তি।
কত গ্যাড়াকল সাথে প্রোটোকল রাজভবনের কক্ষে
বাবু বলিলেন বুঝেছ উপেন পানি এসে যায় চক্ষে।।

সব চরিত্র কাল্পনিক 😐

দিল্লী পুলিশ ~ সমীক মুখোপাধ্যায়

প্রফেটের কাছে ক্ষমা চেয়ে - 

(যদি) দিল্লি পুলিশ নাচে-
খবরদার এসো না কেউ হেড আপিসের কাছে ;
চাইবে নাকো ডাইনে বাঁয়ে চাইবে নাকো পাছে ;
চার পা তুলে থাকবে ঝুলে পদ্মফুলের গাছে !

      (যদি) দিল্লি পুলিশ আসে-
      খবরদার! খবরদার! গ্রন্থাগারের পাশে
      টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটবে, লাঠির বাড়ি কাঁধে ;
      দু হাত তুলে বলতে হবে, 'জয় শ্রীরাম' আর 'রাধে' !

(যদি) দিল্লি পুলিশ হাঁচে -
আনুগত্যের ছাপ পড়বে হস্টেলের ঐ কাচে ;
মুখের ওপর রুমাল বেঁধে আসবে এবিভিপি ;
মাথার খুলি দু-ফাঁক হলেও উদাস দিল্লি-সিপি।

      (যদি) দিল্লি পুলিশ ছোটে-
      সবাই যেন তড়বড়িয়ে জানলা বেয়ে ওঠে ;
      ভাবলে কথা শাহীন বাগের চলবে নাকো মোটে;
      ভবিষ্যতের গাঁড় মারবে এফআইআরের চোটে !

 
(যদি) দিল্লি পুলিশ ডাকে-
সবাই যেন জগ্‌গু ভিসির পায়ের নিচে থাকে ;
দেশপ্রেমের ঘণ্ট বেটে মাথায় মলম মাখে ;
গরম চাটু ঘষতে থাকে অমিত শাহের নাকে !

      তুচ্ছ ভেবে এ-সব কথা করছে যারা হেলা,
      দিল্লি পুলিশ জানতে পেলে বুঝবে তখন ঠেলা ।
      দেখবে তখন কোন্‌ কথাটি কেমন করে ফলে,
      আমায় তখন দোষ দিওনা, আগেই রাখি বলে ।

হিন্দু রাষ্ট্র ~ মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায়

আমি চাই না ভারতবর্ষ হিন্দু রাষ্ট্র হোক। 

আমি চাই না ভারতবর্ষ হিন্দু রাষ্ট্র হোক, কারণ আমি এই দেশকে ভালবাসি। 

আমি ভালবাসি এই দেশের প্রাচীন দর্শন, তার ইতিহাস, তার প্রাগিতিহাস। ভারতবর্ষের ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম, জাতি, জ্ঞান - কোনকিছু একমুখী নয়। একরূপ নয়।

ধর্মে সে একেশ্বর, নিরীশ্বর, বহু-ঈশ্বরবাদী। বৈদিক উপনিষদ ও বেদ-বিরোধী বৌদ্ধধর্ম, দুই দর্শনেরই জন্ম ভারতবর্ষ। 

আর হরপ্পার মূর্তিপূজা মিশ্রিত হয়ে গেছে মূর্তিপূজাহীন বৈদিক দর্শনের সাথে। তার সাথে এসেছে চার্বাকপন্থী লোকায়ত দর্শন।

যখন এই দেশে জ্ঞানচর্চার পথ ছিল সুগম তখন আরও বিভিন্ন চিন্তার সমাবেশ হয়েছে। তারা শুধু বিশ্বাস করত না। তারা গভীর জ্ঞান অর্জন করতে চাইত। জানতে চাইত, উত্তর খুঁজত পৃথিবীর প্রাচীনতম, জটিলতম প্রশ্নগুলির। 

মানুষ তখন জীবনে ইচ্ছামত ধর্ম পরিবর্তন করতে পারত। এই দেশের প্রথম রাজারা বারেবারে ধর্ম পরিবর্তন করেছে। অশোক করেছে, তার বাবা করেছে, তার ঠাকুরদা করেছে। 

ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে মারবার দুই হাজার বছর আগে এই দেশে এক মহাপুরুষ উচ্চারণ করেছেন, 'এই মহাবিশ্ব এক continuum, আগে ছিল, এখনো আছে।' তার জন্য তাকে কেউ পুড়িয়ে মারে নি। 

এই দেশে কোন কিছু একমুখী নয়, পড়তের উপরে আছে পড়ত। 

এদের সবাইকে নিয়ে ভারতবর্ষ টিঁকে আছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বন্ধ হলে, আলোচনা ও চর্চা বন্ধ হলে সেই দেশ শুকিয়ে যাবে। 

ভারতবর্ষের মানুষের শরীরে আছে আফ্রিকান শিকারী-সংগ্রাহক, ইরানীয় শিকারী-সংগ্রাহক, ইন্দো-ইউরোপীয় পশুপালক, অস্ট্রো-এশিয়াটিক কৃষিজীবী, তিব্বতী-বর্মী মাতৃতান্ত্রিক গোষ্ঠীর জীন।
এই উপমহাদেশ ছাড়া এতো মিশ্রণ পৃথিবীর কোন দেশে, কোন অঞ্চলে নেই। 

এই দেশের মানুষ কথা বলে আদিম প্রোটো -জারোয়া, প্রাচীন দ্রাবিড়ীয়, সুললিত বৈদিক সংস্কৃত, অস্ট্রো-এশিয়াটিক, সিনো-তিব্বতী ভাষায়।

প্রশ্ন চাই, প্রশ্ন বন্ধ করা যায় না।

জাবালি প্রশ্ন করেছেন, বুদ্ধ করেছেন, মহাবীর, চার্বাক ও আজীবিক মতবাদ প্রশ্ন করেছে। যেই দেশ, যেই জীবনচর্চা, যে ধর্ম, যে জাতি প্রশ্ন করে না, শুধু মেনে নেয়, শুধু বিশ্বাস করে তার ধ্বংস অনিবার্য। আজ না হয় কাল।

হিন্দু রাষ্ট্র, ধর্ম রাষ্ট্র ভারতবর্ষকে করে তুলবে মৌলবাদী, এক মুখী। তখন প্রশ্ন উঠবে নারীদের নিয়ে, জ্ঞানের চর্চা নিয়ে, জাত নিয়ে, খাদ্যাখাদ্য নিয়ে। আমি সেই ভারত চাই না।

আমি ভারতবর্ষের ধ্বংস চাই না। 

আমি ভারতবর্ষের সাথে পাকিস্তানের তুলনা চাই না। পাকিস্তান এক দুর্ভাগা দেশ। তার দুই নোবেল লরিয়েটকে সে দেশ থেকে তাড়িয়েছে। তার মা-বোনেরা কাপড়ের আড়ালে বন্দী। আমি তাদের প্রতি গভীর সহানুভূতিশীল। আমি চাই না আমার দেশের মেয়েরা ধর্মের নামে বন্দী হোক।

উল্লেখ করছি নবম শতকের জৈন দার্শনিক জীনসেনের উক্তি, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাজাগতিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সেগান তার গ্রন্থ কসমসে এটি উল্লেখ করেছেন -

" Some foolish men declare that a creator made the world. The doctrine that the world was created is ill-advised, and should be rejected. If god created the world, where was he before creation? If you say he was transcendent then, and needed no support, where is he now? "

নবম শতকের ভারতীয় দার্শনিক যিনি প্রচলিত মতবাদ, গতেধরা চিন্তার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, আমেরিকান জ্যোতির্বিদ বিংশ শতকে বই লিখেছেন তার উক্তি স্মরণ করে, কোন ইউরোপীয়র নয়। 

এটাই ভারতের শক্তি; যেদিন থেকে সে ধর্ম রাষ্ট্র হবে সেদিন থেকে সে পিছন  দিকে হাঁটতে থাকবে। 
যেমন এখন হাঁটছে, প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম পীঠস্থান - কত আশা জাগানো আতার্তুকের তুরস্ক।  

সকল মানুষকে প্রশ্ন করতে হবে - রাষ্ট্রকে, অবিজ্ঞানকে আর সবচাইতে বেশি করে করতে হবে নিজেকে।

Madhusree Bandyopadhyay
11/01/2020

রবিবার, ৫ জানুয়ারী, ২০২০

এনারসি ~ ডঃ কৌশিক দত্ত

সাগরমেলার আগে বাবুঘাটে একটা  ক্যাম্প হয় সন্ন্যাসী আর তীর্থযাত্রীদের জন্য। সেখানে আমি যাই সুযোগ পেলে। আগে যেতাম ভারত চিনতে। এখন তার সঙ্গে অন্য কিছু আকর্ষণও থাকে। সেখানে বাবাজি আসেন প্রায় প্রতিবছর। আমার যে গণিতজ্ঞ বন্ধুটি তাঁর বিশেষ অনুরক্ত, তিনি খবর দেন, "বাবাজি এসে গেছেন।" মানুষটির সারল্য এবং সদানন্দ ভাব আমাদের টানে। ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো চুল, এলোমেলো দাড়ি। গায়ে ময়লা চাদর। ক্যাম্পের ভেতরে যেখানে আরামদায়ক তাঁবু হয়, সেখানে থাকেন না। ক্যাম্পের ঠিক বাইরে একটা গাছতলায় খড় বিছিয়ে ধ্যানাসনে বসে থাকেন। সেখানেই রাত্রিবাস। মনকে স্থির করার জন্য এনার গঞ্জিকা প্রয়োজন হয় না, যোগের মাধ্যমেই পারেন। মেলার ক্যাম্পে তীর্থযাত্রীদের জন্য খাবারের বন্দোবস্ত থাকে। কেউ রুটি তরকারি এনে দিলে খান মাঝেমাঝে। অন্য কোনো সামগ্রী গ্রহণ করতে দেখিনি। একবার একজন একটা কম্বল দিয়েছিল লাল রঙের ফুল আঁকা। শীতের রাতে তিনি সেটা আমাকে দিয়েছিলেন। গায়ে দিয়ে বাড়ি চলে যাও, পরে অন্য কাউকে দিয়ে দিয়ো। এই ছিল নির্দেশ। আমি কম্বল গায়ে মেট্রোয় চড়েছি সেই একবারই। বাবাজি কথা বলেন খুব কম লোকের সঙ্গে৷ ঘটনাচক্রে আমাদের সঙ্গে বলেন। কথাগুলো সাধারণ্যে আলোচ্য নয়। 

এন আর সি হলে বাবাজির নাম উঠবে না, কারণ তাঁর কোনো কাগজই নেই। গোবর্ধন অঞ্চলে একসময় একটি আশ্রম কুটির বানিয়েছিলেন। সেটা ঝড়ে ভেঙে যাবার পর ওঁর মনে হল কৃষ্ণ বলছেন, এসব ঘরদোর ভালো না। প্রকৃত গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীকে নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র দেবার হিম্মত রাষ্ট্রের এখনো হয়নি। কিন্তু তাঁর দেশ, মাটি, আকাশ কেড়ে নেবার ক্ষমতা অবশ্যই আছে। এন আর সি হলে বাবাজি কয়েদ হবেন। "সি এ এ", যা নাকি হিন্দুদের রক্ষাকবচ, তা এই হিন্দু সন্ন্যাসীর কাজে আসবে না, কারণ তিনি বাঙলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে আসেননি। তিনি জন্মসূত্রে ভারতীয়। 

"তাহলে কী হবে বাবাজি?" 

"কিষণ ভগবান জানে।" হাসেন বাবাজি। "আরে বো কানহাইয়া বড়া অটোমেটিক হ্যায়। সব জান লেতা হ্যায়।"

বোঝা গেল। সন্ন্যাসীর প্রাণে ভয় নেই, কারণ সেখানে কৃষ্ণ আছেন। হয়ত কারাগারেই তিনি কৃষ্ণের সাক্ষাৎ পাবেন, যেমন পেয়েছিলেন দেবকী-বসুদেব। কারাগারটি যে আদতে কংসের, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকবে না। কারাগারে কৃষ্ণ আবির্ভূত হলে কংসের কী গতি হয়, তাও আমরা জানি। তবু আমরা সামান্য মানুষ। বাবাজির জন্য চিন্তা হয়। যদি দেখি এন আর সি-র পর আর তিনি সাগরমেলায় আসছেন না… 

ও হরি! তখন আর কেই বা আসবে মেলায়? তীর্থযাত্রীদের যা দেখেছি এত বছর ধরে, কটা কাঠকুটো বস্তায় নিয়ে গঙ্গা মাঈয়ার ভরসায় বেরিয়ে পড়েছে রাজস্থানের গ্রাম থেকে… কীভাবে ফিরবে জানে না, কাগজপত্র না থাকায় এরা অনেকেই পাকিস্তানি বলে চিহ্নিত হবে। সন্ন্যাসীদের কথা তো ছেড়েই দিলাম। নিরঞ্জনী আখড়া, জুনা আখড়া, ভোলা গিরির আশ্রম উজাড় হয়ে যাবে। হৃষিকেশ, বদ্রিনাথ, নর্মদার তীর থেকে পুলিশ টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবে সহস্র সন্ন্যাসীকে। থাকবে শুধু মোদী-আম্বানি-আদানি-শাহী। আমেরিকা, সৌদি আরব থেকে তাঁরা আমদানি করবেন শকুন। রপ্তানি করবেন ভারতবর্ষ।