রবিবার, ৩০ জুন, ২০১৩

টুক্‌নামচা... ২ ~ সংগীতা দাশগুপ্তরায়

খাটের তলা মানেই রাতের বেলা একটা ভয় ভয় ব্যাপার ছিল। আমাদের ডানলপের বিখ্যাত মশা আর লোডশেডিংএর আড়তে খাটের তলা কোনোকালেই তেমন আকর্ষণীয় লাগত না আমার। এদিকে আমাদের পুরোনো বাড়ির বারান্দার একদিকে শোবার ঘর আর অন্যদিকে রান্নাঘর ইত্যাদি। এমনিতেই একটু একটেরে শোবার ঘরে একটু ভয় ভয় লাগত আমার। মার রান্নাঘরের পাট চুকতে দেরি হত অনেক। আমি আর বোন খেয়ে দেয়ে বিছানায় চলে যেতাম আগে। বোনের আবার চোখে আলো লাগলে ঘুম আসে না । এদিকে আলো নিভিয়ে খাটে উঠতে গেলেই আমার মনে হত এই বুঝি কেউ নিচে থেকে পা টেনে ধরল। অনেক সময় লাইট অফ করেই এক পেল্লায় লাফ দিয়ে খাটে ওঠার চেষ্টা করতাম। তবে সেটা করতে গিয়ে বোনের ঘাড়ে পড়ে এমন হাঁউ মাঁউ সৃষ্টি হয়েছিল কয়েকবার যে সে চেষ্টাও বন্ধ করতে হয়েছিল। 
এক দুবার বেড সুইচের কথা ওঠেনি তা নয় কিন্তু কোথায় কোন দেশের কোন বাড়িতে কবে কে জানি বেড সুইচের তার থেকে শক খেয়ে মারা গেছিল... এসব গল্পগাছার চোটে সে আর হয়ে ওঠে নি। 
এর কিছুদিন পরেই আমাদের বাড়িতে এক অদ্ভুত জিনিস এল... তার নাম খাটিয়া। খাটিয়া মানে নারকেল দড়ির খাটিয়া যাতে বসে ডানলপ, ভবানীপুর মায় চন্ডীগড় অবধি পাঞ্জাবীরা সংসার ধর্ম সেরে ফেলল সে খাটিয়া না ... একটা অদ্ভুত চ্যাটালো ক্রেপ ব্যান্ডেজ টাইপের জিনিস দিয়ে বোনা খাটিয়া। বাপীর নাকি জিনিসটা দেখে দারুন ভাল লেগেছে তাই কিনে নিয়েছে। আমারাও বসে দেখলাম বেশ একটা বাউন্সিং এফেক্ট আছে। মোটের ওপর বেশ মজার হাফ দোলনা হাফ ইজিচেয়ার টাইপ । আসলে যখন আমরা ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভির থেকে কালার টিভিতে সুইচ করতে গিয়েই আহ্লাদে আটখানা তখন এইসব ব্যাপারে বাড়িতে বেশ একটা হইচই-ই হত। 
আমি তো আবার ভেবেই ফেললাম এবার আমার মা-ও পাড়ার পাঞ্জাবী আন্টিদের মত ঢিলে সালোয়ার কামিজ পরে সারাদিন স্টিলের থালার ওপর ছুরি দিয়ে সবজী কাটবে । আমিও মীনা, রীতু, লাভলিদের মত হেব্বি সুন্দরী পাঞ্জাবী মেয়ে টাইপ হয়েই যাব আর সারাদিন উঠোনে বা বাড়ির সামনে খাটিয়ে পেতে বিভিন্ন ধাঁচে বিনুনি বাঁধব । তবে আদতে এসব কিছুই হল না। খাটিয়াটার জায়গা হল আমাদের ওই বিচ্ছিরি উঁচু খাটের তলায় যেখানে রাত হলেই ভূতেরা ওঁত পেতে থাকত আমার পা ধরে টান দেবে বলে । কোনদিন বাগে পায়নি তাই টানেনি সেটা আলাদা ব্যাপার ... সারাদিন খাটিয়াটা বড় খাটের নিচ থেকে টেনে বার করা থাকত । আমরা ওখানে বসে পড়তাম, মাঝে মাঝে মা-ও আমাদের পাশে বসে বসে মটরশুঁটি ছাড়াত আর আমরা মাকে হেল্প করার নামে সেগুল টুপটাপ মুখে পুরতাম... এর ই মধ্যে খানিক খোসা হয়ত সবুজ চাদরে হারিয়ে মিশে রইল আর মা রান্নাঘরে রান্না চাপিয়ে উল কাঁটা নিয়ে আবার ওই খাটিয়াতেই এসে বসল। মোটের ওপর মায়ের শাড়ির বদলে সালোয়ার কামিজ আর আমার সুন্দরী হয়ে যাওয়া ছাড়া বাকি অনেক কিছুই মীনা, রীতুদের বাড়ির মতই ঘটত । আর রাত্তিরে খাটিয়াটা ঠেলে বড় খাটের নিচে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। ফলে নিচের ভূতগুলো আমাকে আর ভয় দেখাতেই পারত না। 

তবে এ সুখ বেশিদিন সইল না । খাটিয়ার আধিপত্য আমাদের থেকে চালান হয়ে গেল কিছুদিন পরেই আমার মায়ের কোন এক গ্রামতুতো কাকার হাতে। ওই কাকার ভাল নাম নিশ্চই কিছু ছিল কিন্তু মা-রা ডাকত প্যালা কাকা বলে। আমরা ডাকতাম প্যালাদাদু। আসলে আমাদের অলরেডি বেশ কিছু কাকুদাদু, জেঠুদাদু ছিলই। সেগুলো জন্মানোর পর পর ই পাওয়া দাদুর ঝাঁক। কিন্তু ইনি অনেক পরে আবির্ভুত হওয়ার কারনেই বোধহয় তেমন পাত্তা পান নি আমাদের কাছে। সামনে যদিও দাদুই বলতাম তবে আড়ালে প্যালাদাদু বলাই অভ্যেস হয়ে গেছিল। খুব পান খেতেন প্যালাদাদু আর খুব আজগুবি গল্প বলতেন । মাঝে মাঝে এসে থেকে যেতেন কয়েক দিন। সেবার এসে দাদু মহা খুশি । আরে! তোরা নেওয়ারের খাটিয়া কিনেছিস? আহা, এতে শুয়ে যা সুখ! আমরা দুই বোন তো একদম ব্যাজার হয়ে গেলাম শুনে। কারন দাদু বাড়িতে থাকলেই আমাদের বেশ কাজ করতে হত। আর বোধহয় কিপ্টেও ছিলেন ফলে বাকি আত্মীয়দের মত যাওয়ার সময় তোমরা চকলেট খেও বলে হাতে কিচ্ছুটি দিতেন না (হ্যাঁ, আমরা তখন খুব চকচকে লাল দুটাকা বা ভাগ্যভাল থাকলে পাঁচ দশ টাকা করে পেয়েই যেতাম মামা মাসিদের থেকে) ... তো সেবার প্যালাদাদু বেশ কিছুদিন থেকে গেলেন। আমরা সবাই পালা করে করে তাঁর ফাইফরমাশ খাটতাম। এক রোববার আমরা সাপ্তাহিক মাটনের ঝোল ভাত খেয়ে উঠে আয়েস করব করব করছি এমন সময় দাদু ডাকলেন, আয় তো, তোর হাতটা দেখি! আমি বললাম হাতে এঁটো নেই তো! পরিস্কার করে ধোয়া । বললেন আরে ডেঁপো মেয়ে, তোর হাতটা দেখতে চাইছি, দেখা... বাড়ালাম হাত। ভুরু টুরু কুঁচকে অনেক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে মার দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বললেন এ মেয়ের তো কিস্যুই হবে না রে। কোন রকমে মাধ্যমিক। লিখে নে। আমি কাঁদো কাঁদো মুখে বললাম মানে!! মাধ্যমিক আবার কি! আমি বড় হয়ে জার্নালিস্ট হব কিংবা চার্টার্ড একাউন্টেন্ট। প্যালাদাদু পানটা গালের অন্যদিকে ঠেলে উদাস হয়ে বললেন, সে তুমি চাইলেই কি হবে দিদি! তোমার হাতেই নেই বেশিদূর। ব্যাস... মা করুন মুখ করে জিগ্যেস করল হাতে পড়াশুনো নেই কাকাবাবু? 
নাঃ, ঘরের কাজকম্ম রান্নাবাড়া শেখাও বরং তারপর ... 
আমি হাত ছাড়িয়ে সো-ও-জা আমার সেই ভাঙ্গা জানলা ড্যম্প দেওয়ালের চিলেকোঠায় গিয়ে ইন্দ্রজাল কমিক্স নিয়ে বসলাম। অরণ্যদেব, আর বাহাদুর মিলে আমার সব মনখারাপ মুছে দিল কিছুক্ষনের মধ্যেই । 
বিকেলে শুকতারাদি এসে ঘুম থেকে তুলল। বৃষ্টি হয়ে গেছে এক পশলা আর এমনই কপাল যে বৃষ্টির মধ্যে উঠোনে পা পিছলে প্যালাদাদু আছাড় খেয়েছেন। সন্ধের মধ্যে পা ফুলে ঢোল। আমার মাথায় প্রথমেই যে কথাটা এল সেটা হল "বেশ হয়েছে"... এবং সঙ্গে সঙ্গেই মনে মনে ঠাকুরকে বলে নিলাম দোষ নিওনা ঠাকুর। কে না জানে যে অন্যের খারাপে যে খুশি হয় তাকে ঠাকুর মোটেই ভাল চোখে দেখেন না । দোষ কাটাতে সেদিন রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে দাদুর পায়ে আয়োডেক্সও মালিশ করে দিলাম। কিন্তু পরের দিন থেকে তুমুল জ্বর এল আর সেই সঙ্গে ভুল বকা। প্যালাদাদুর নিজের লোক বলতে তেমন কেউ ছিল না। এই সব গ্রামতুতো জ্ঞাতি ভাইপো ভাইঝিদের বাড়িতেই ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন । বোধহয় আমাদের বাড়িতেই একটু সমাদর পেতেন আমার মায়ের কাছে তাই হয়ত এখানে এসেই বিপদ হল। ডাক্তার এসে বললেন পায়ের লিগামেন্ট-এ চোট পেয়েছেন তা ছাড়া এমনিতেও খুব দুর্বল। একটু ভাল যত্নে আর রেস্টে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবেন । 

দু মাস ছিলেন সেবার দাদু। এই দুমাসে খাটিয়ার সঙ্গে আমার ভাবসাব একটু কমে এল। দাদুই সারাক্ষন ওটার অধিকার ভোগ করতেন। আমি আর বোন কখনও মার কাছে রান্নাঘরে আবার কখনও ছোট ঘরের তক্তাপোষে বসে পড়তাম। গরম রুটিতে গুড় লাগিয়ে রোল করে দিত মা। অঙ্ক কষতে কষতেই খাওয়াদাওয়া সারা হয়ে যেত। মুঘলদের প্রবল বিক্রমের কাহিনী মুখস্ত করতে করতে আমি ঢুলে পড়তাম এক এক সময়। 

দাদু ইতিমধ্যে খুবই সুস্থ হয়ে উঠেছেন। মাঝে মাঝে আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হওয়া ছাড়া বাকি সময়ে দিব্যি ভালই থাকেন। এই সময় একদিন জামালপুর থেকে একটা পোস্টকার্ড এল। প্যালাদাদুর কোন বোনের ছেলে সপরিবারে দার্জিলিং না জয়সলমীর (আসলে এখন আর নামটা মনে নেই) কোথায় যেন যাবে কিন্তু বাড়ি খালি রেখে বেশিদিনের জন্য যাওয়া ঠিক হবে না । দাদু যদি কটা দিন ওনাদের বাড়িতে থেকে পাহারা দেন... ইত্যাদি... চিঠি পাওয়া মাত্র দাদু হুড়ুমদুড়ুম করে গোছগাছ শুরু করে দিলেন। পরের দিন সকালেই বেরোতে হবে কিনা! 

দাদু চলে যাওয়ার পরেই আমরা দুই বোনে এক লাফে খাটিয়ায়। অনেক দিন পর খাটিয়াটাও যেন একটা হালকা আর্তনাদ করে আমাদের স্বাগত জানাল... 
বেশ কয়েক বছর ওই খাটিয়াটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটা অঙ্গ হয়ে ছিল। আমি তো মাধ্যমিকের প্রিপারেশনে নিজে থেকেই একটা খাটিয়ার আত্মকথা লিখে স্কুলে দেবযানীদির থেকে একটা ভেরি গুড ও পেয়েছিলাম... 
আরও অনেক কিছুর মতই খাটিয়াটাও আমার স্মৃতির জানলা আলো করে আছে আজও...
.

বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন, ২০১৩

টুক্‌নামচা... ১ ~ সংগীতা দাশগুপ্তরায়

পরশুরামচাচার সঙ্গে আমাদের মানে ছোটদের বেশ ভাব ছিল। আমাদের পরশুরামের কুঠার ছিল না ছিল মোড়ের মাথায় একফালি এক মুদির দোকান । পাড়ায় আরও কিছু ওমনি দোকান ছিল। সেগুলো সবই লালার দোকান । কবে কোনকালে উত্তর কলকাতায় কোথা থেকে এক দঙ্গল বিহারিরা এসে মুদির দোকান করেছিল আর কেনই বা সে সব দোকানই লালার দোকান নামে পরিচিত ছিল তা জানিনা। তবে এটা জানতাম পরশুরামের দোকানের নাম ছিল পরশুরাম সওদা ঘর... আমরা বলতাম পরশুরাম সওদাগর। বিহারি ছিল সেও। কিন্তু তবু তার দোকান কোনমতেই লালার দোকান ছিল না । পরশুরামের ঘরে এক মা তিন বিবি আর সাত বাচ্চা মিলে সারাদিন ক্যাচর ম্যাচর করত আর সে নিজে দোকানে বসে জিনিস বিক্রি করতে করতে হনুমান চালিশা পড়ত দিনভর।
আমাদের দলের সঙ্গে তার ভাব ছিল খুব সাদাসিধে কারনে। আমরা কখনও তার দোকানের লজেন্স বিস্কুটের বয়ামের দিকে তাক করে ক্রিকেট বা পিট্টু খেলতাম না (প্রথম প্রথম বেশ কিছু বয়াম আমাদের পিট্টুর বল লেগে ভেঙ্গে গেছিল আর আমাদের হজমী ফুচকা ইত্যাদি স্যাক্রিফাইস করে সে বিল মেটাতে হয়েছিল) ... বদলে হনুমান জয়ন্তী আর গনেশ চতুর্দশীতে আমাদের প্রসাদ জুটত। আখের গুড় মেশানো আটাভাজা, কালো তিল ছড়ানো তিলকুট, মুগ আর গুড়ের পুর দেওয়া মিঠি লিট্টি, কালো চানার ভাজি আর পুরি থাকত প্রসাদে। অমন ইউনিক প্রসাদ আমরা কেউ মিস করতে চাইতাম না । ওর সাত ছেলেমেয়ের সবার নামই বোধহয় বুধন, লাখি অথবা গানু ছিল। এই তিনটে নাম ধরেই আমরা ওকে ডাক দিতে শুনতাম। দোকান আর ঘরের মাঝের ছেঁড়া চাদর ঝোলানো পার্টিশনের দিকে মুখ করে চাচা এই তিনটের কোন একটা নাম ধরে ডাকত আর ভেতর থেকে যে কোনো একটা ছেলে বা মেয়ে ঠিক বেরিয়ে আসত হাতে গরম চা আর প্রজাপতি প্যাঁচের বিস্কুট নিয়ে। যার সামনে থরে থরে রাখা রকমারি বিস্কুট তার জন্য ভেতর থেকে বিস্কুট কেন আসত তা আমার কাছে একটা বড় প্রশ্ন ছিল । পরে ব্যালান্স শীট-এর আঁক কষতে বসে আমি সেই প্রশ্নের উত্তর বুঝে গেছিলাম নিজে নিজেই। সেই পরশুরাম চাচা , প্রফিট এন্ড লস বোঝা সওদাঘরের পরশুরামচাচা একবার দোকান বন্ধ করে দেশে গেল তো গেলই। দেশে নাকি ক্ষেতি জমি করেছিল অনেক। সে সব সম্পত্তি জ্ঞাতিরা হাতিয়ে নিচ্ছে তাই চলে গেল দোকান ফেলে... সেই যে গেল, আর এলোও না। আমার মন কেমন করত খুব। চাচার জন্য, চাচার সুর করে পড়া হনুমান চালিশার জন্য আর সবচেয়ে বেশি মনকেমন করত একটা পাঁচমিশালি গন্ধের জন্য। তেল, বেসন , সাবান, ধূপ, চিট লজেন্স, ভেলিগুড় আরও না জানি কি কি মেশানো একটা গন্ধ ছিল দোকানটায় । কিছুদিন পরে সেইখানেই একটা লন্ড্রী খুলে গেল। আমি বাপীর শার্ট প্যান্ট ইস্ত্রী করতে দিতে গিয়েও ওই গন্ধটা খুঁজতাম কিন্তু ততদিনে গন্ধটা বদলে গেছে। ধীরে ধীরে ভিজে চাদরের ওপর চালানো লোহার ইস্ত্রীর ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধটাই কায়েমি হয়ে গেল ওখানে ।

আমাদের বাড়ির পিছনে দুটো পাশাপাশি স্কুল। সারাদিন প্রচন্ড হৈ হল্লার পর বিকেল চারটে বাজলেই সব চুপ। সন্ধের পর একদম নিস্তব্ধ হয়ে যেত বাড়ির পিছনদিকটা। প্রবল বৃষ্টির দিনে একটানা ব্যাঙের ডাকের মধ্যে দিয়ে রাত নামত আমাদের ছাদে। খুব ভালবাসতাম ওই আঁধার, ওই নির্জনতা। লোডশেডিং হত নিয়ম মাফিক। মোমবাতির আলোয় পড়া কম, মশা মারা বেশি চলত। বোনের অভ্যেস ছিল মশা মেরে আগুনে ফেলে দেওয়া। মা বারন করলে বলত মানুষ মরলে তো জ্বালিয়ে দিতে হয় তাহলে মশা মরলে জ্বালাব না কেন? এই রকম কুটিল লজিক্যাল প্রশ্নের সামনে মাও চুপ। আমার অবশ্য অন্য একটা খেলা দারুন লাগত। এক বাটি জল নিয়ে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে ওই জলের ওপর মোমটা উল্টো করে ধরতাম। ছোট্ট ছোট্ট মোমড্রপস পরত জলে আর পরেই জমে গিয়ে ছোট্ট পুঁথির মত দেখতে হয়ে যেত। কালীপূজোয় কেনা রঙিন মোমবাতি দিয়ে অমনি রং বেরঙ্গি পুঁথি বানিয়ে ছুঁচে গেঁথে মালা বানাতাম আমরা। সে মালা এমনিতে কোনোই কাজে লাগত না । তবে কোনোকোনোবার অনেকগুলো ওরকম মালা একসঙ্গে জুড়ে জুড়ে আমরা তুলির রথ সাজিয়ে দিতাম ।

তুলি ছিল রোমির পিসতুতো বোন। সেই সুবাদে আমাদের সবার পাড়াতুতো পিসতুতো বোন। বাগবাজারের কাছে থাকত । দোল, রাস, রথ এসব মালপোয়া বানানোর উৎসবে বেড়াতে আসত মামার বাড়িতে। রোমিরা থাকত আমাদের দুটো বাড়ি পরেই। ওদের বাড়ির সামনে একটা অদ্ভুত মজার গাড়ী দাঁড়িয়ে থাকত। সেই যে বাইকের সঙ্গে লাগানো নৌকো যেটা বীরু আর জয় চড়ত শোলেতে, ওইটা । আমাদের ছোটবেলায় সিইএসসি তে চাকরী করা অনেকেরই ওইরকম নৌকো কাম বাইক ছিল। রোমির মা মাঝে মাঝেই বিকেলে খুব সাজগোজ করে হাই হিল পরে দু আঙ্গুলে চিমটি করে শাড়িটা তুলে ধরে ওই নৌকায় উঠে বসে কাকুর সঙ্গে বেড়াতে যেতেন। যাবার আগে রোমিকে পইপই করে বারন করতেন বাজে কিছু না খেতে। এদিকে কাকিমা কাকু বেরনোর পরই রোমিরা দুই ভাই ওদের লক্ষ্মীর ভাঁড় আর একটা ব্লেড নিয়ে বসে যেত আমাদের রকে। আমরা খুব এক্সপার্ট ছিলাম ভাঁড়ের ওই ফিনফিনে কাটা জায়গাটায় ব্লেড ঢুকিয়ে সিকি আধুলি এসব বার করায়। মাঝে মাঝেই ওই পয়সা দিয়ে রোমি বাদাম চাকতি বা টিকটিকি লজেন্স কিনে আমাদের খাওয়াত। তবে আমি টিকটিকি লজেন্স খেতে পারতাম না । সাদা রঙ্গের হলে তো একদমই না । আমার বদ্ধমূল ধারনা ছিল ওই সাদা রঙের লজেন্সগুলোর মধ্যে অবশ্যই দু চারটে সত্যিকারের টিকটিকির ডিম ই আছে। রোমির সঙ্গে অবশ্য আমাদের খেলা তারপর আর খুব বেশিদিন হয়নি। পড়াশুনোয় অমনোযোগ এবং সারাদিন খেলে বেড়ানোর মত গুরুতর অপরাধে ওকে পুরুলিয়া রামকৃষ্ণমিশনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। 

ওই সময়টায় আমি অনেক কিছু হারিয়েছিলাম। পরশুরাম চাচাকে, রোমিকে এবং আমাদের বাড়ির শোবার ঘরের সাবেকি দেওয়াল-শেলফটাকে। খুব বড় করে কাটা ওই শেলফটায় আমরা সব কিছু রাখতাম। মানে সবকিছুই। পুরোনো ব্যাটারি, বোনের পুতুল, আমার পেন এবং গুচ্ছের ফুরিয়ে যাওয়া রিফিল, পাখির পালক , বাপীর পাঞ্জাবীর ঝিনুকের বোতাম, মায়ের চুড়ি, বারোয়ারি স্টিচিং কিট, বার বার শোনা ক্যাসেট...সব ...সব... তারপর একবার বাড়ি রং করার সময় ওই তাকটা বন্ধ করে দেওয়া হল। বন্ধ করার সময় আমি স্কুলে ছিলাম। ফিরে এসে দেখলাম ওখানে ইঁট গেঁথে দেওয়া হয়েছে। আমার যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ইতিহাসের আনারকলির মতই যেন আমাকেও ওখানে দাঁড় করিয়ে দেওয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে এমনি লাগছিল আমার। মা মনে হয় বুঝেছিল কিছু। আমাকে বলল তোর সব পালক, ক্রেয়ন, ক্যাসেট আমি সরিয়ে রেখেছি। আমি কিচ্ছু বলতে পারছিলাম না । মনে হচ্ছিল কি যেন রয়ে গেছে ওর মধ্যে। যেন তাকটারও প্রাণ ছিল, মিস্ত্রিরা দম বন্ধ করে মেরে ফেলেছে আমাদের তাকটাকেই। বার বার হাত রাখছিলাম ইটগুলোর গায়ে... বহুবছর অবধি আমি কিছু খুঁজে না পেলেই ধরে নিতাম সেটা ওই তাকে রয়ে গেছে। এমনকি কোন গানের সুর ভুলে গেলেও মনে হত ওইখানে ওই বন্ধ করা জায়গাতেই আটকে আছে সুরটাও। আজ বুঝি সবুজ রিফিলের পেন নয়, হাতির দাঁতের ক্লিপ নয়, আপেল বীজের মালাটাও নয়... আসলে বন্ধ হয়ে রয়ে গেছে আমারি ছেলেবেলার একটা বড় অংশ দেওয়ালের ওই গহ্বরে ...

ক্রমশ...

শুক্রবার, ২১ জুন, ২০১৩

চোপ! ~ সম্বুদ্ধ আচার্য্য

আঁতেল তুমি আঁতেল তুমি,
এখন কেন আঁকড়ে আছ চারণভূমি?
অনেক আগে ই এই মাটিতে বীজ পুঁতেছ,
এখন সেসব শক্ত লতায় ফাঁস লাগিয়ে-
সহ্য কর গোয়ার্তুমি.

মানুষ তুমি মানুষ তুমি,
এখন তোমার পায়ের নিচে কোথায় জমি?
লাল কাঁচের ওই সার্সি ভেঙ্গে সবুজ হলো,
যেদিক দিয়েই দেখতে গেলাম,
দাঁড়িয়ে আছ নগ্ন তুমি.

সঠিক তুমি, বেঠিক তুমি,
এখন তোমার সিংহাসনে ধর্ষকামী,
চোখ বুজে আজ তাকিয়ে থাকো,
অনেক অবহেলার পরে -
বাংলা তোমার গুলির জোরে অস্তগামী.

এখন পাথর মূর্তি তুমি,
পাথর তোমার পিছিয়ে থাকা মাতৃভূমি,
এখন তোমার বৃহন্নলা গুন্ডা যারা-
তাদের পথে হাঁটতে শেখো,
নিম্নমেধাই বাংলা জুড়ে দেখব আমি.

এখন মুখে চাবুক বাঁধা-
পচবে তুমি.

বুধবার, ১৯ জুন, ২০১৩

সুজেট - অনামিকা মিত্র

মুখে আলো এসে পড়ল, সূর্যোদয় হয়েছে যেন বা
অপমানিতার মুখে। সে' আলোর অপরূপ শোভা
অন্ধ করে দিল এই অপরাধী শহরের চোখ।
সরকারি 'বিভূষণ' ... সংস্কৃতি-ধারক-বাহক
শিউরে উঠল তারা, সাহসের পাপদৃশ্য দেখে।
মন্ত্রী রাগবে বলে দেখল না বুঝি বা অনেকে।
এই লজ্জা তাঁর নয়। আধা সভ্য এ জাদু শহরে
যারা চেনে কাস্টমার, যারা ঢোঁক গেলে তার পরে ...
বেহাল এমপি দিদি ... যার উপর রাজ্যের প্রহরা
মিছে কথা বলে চলা সেই সব নপরাজিতরা।

তিনি কিন্ত অমলিন তাঁর যুদ্ধ জারি রেখেছেন।
যে যুদ্ধটুকু চেনে শুধু বোকা দময়ন্তী সেন।
মমতা কোথাও নেই, নকল সে মমতার ছায়া
তবুও বিবৃতি দেয়। মসনদে দারুণ বেহায়া
মেয়ে হিটলার জানে সে আসলে সভ্যতার খুনি।
তাই ঘটে পার্ক স্ট্রীট, তাই মরে যায় কামদুনি।
মুখে আলো এসে পড়ল। সে শোভায় মাথা হলও হেঁট।
এই পাপী শহরকে আলো দিক সাহসী সুজেট। 

মঙ্গলবার, ১৮ জুন, ২০১৩

প্রবাস এবং ~ তমাল রাহা

এবার ফেরা যাক প্রবাসের অভিজ্ঞতা তে। ছাত্রাবস্থায় আমার সেভাবে খুব একটা ঘোরাঘুরি হয় নি। বাবা মা এর সাথে পুরী যাওয়া হযেছিল আর পাঁচটা বাঙালী পরিবারের মত। বেশ দূরে যাওয়া বলতে শিলং, গৌহাটি  আর জোরহাট।আসলে জোরহাট এ মাসি থাকতেন, গন্তব্য সেটাই থাকত। মাঝপথে গৌহাটি আর শিলং যাওয়া এই আর কি! আমার বাবা ভালোমানুষ, কিন্তু কোথাও যাওয়ার কথা হলে বোধকরি খুব একটা আরাম পেতেন না। হয়তো ছোটবেলায় বাস্তুচ্যুত হয়ে উত্বাস্তু হওয়ার ভয় টা  মনে ছিল, তাই বাসার কাছাকাছি জায়গাতেই নিজেকে নিয়ে থাকতে ভালবাসতেন। আর পাহাড়ে খুব ভয় পেতেন। মোটের ওপরে নানাকারণে "পর্বতমালা বা সিন্ধু" কোনটাই ছোটবেলায় দেখা হয় নি।
প্রথম একা দূরে যাওয়া মনে পরে। সেটা বোধহয় ১৯৯৫। সবে পিএইচডি র গবেষণা শুরু করেছি।কাজের জন্যে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সাইন্স এ যেতে হবে।আমার বাবার বেশ ভীত হয়ে  পড়লেন। ছেলে একা কি ভাবে বেঙ্গালুরু (তখন বাঙ্গালোর) যাবে। মনে আছে হাওড়া থেকে করমন্ডল এক্সপ্রেস। বাবা ট্রেন এ তুলে দিতে এসে এক বাঙালী পরিবার কে দেখে যার পর নাই আহ্লাদিত হযে বললেন "আমার ছেলে একা এই প্রথম বাইরে যাচ্ছে। একটু দেখবেন।" পরিবারের কর্তাটি বাবাকে আশ্বস্ত করে বললেন "কোনো চিন্তা করবেন না। আমরা তো আছি!" বাবা নিশ্চিন্ত মনে ফিরে গেলেন। ট্রেন যাত্রা শুরু করল। কিছুক্ষণ বাদে ওই ক্ষনিকের অভিভাবক আমায় নানা প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। আমি প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছি। তবে ধৈর্যের বাঁধ  ভাঙ্গলো যখন উনি আমায় প্রশ্ন করলেন, "জানো তো মাদ্রাজের পরে কি?"
আমি বললুম "সমুদ্দুর"
"না না, তারপর?"
আমি একটু বিরক্ত হযে তাকালুম। ভদ্রলোক না থেমে বলে চললেন "চীনের বর্ডার হবে বোধহয়!"
জানি না ভদ্রলোক রসিকতা করছিলেন কিনা! তবে ওনার কাছ থেকেই মাথা ধরার ওষুধ চেয়ে খেয়েছিলাম মনে আছে।
গুয়াহাটি তে সেবার সন্তোষ ট্রফি ফুটবল খেলে কর্নাটকের ফুটবলার রা বাঙ্গালোর ফিরছিল।তারা ছিল পাশের কম্পার্টমেন্ট এ। মনে আছে বাকি যাত্রা টা তাদের সান্নিধ্যেই কাটিয়েছিলাম। আর নিজের সিট এ ফিরে যাই নি!
আমার বংশেও কেউ কখনো বিদেশে গিয়েছেন তাও শুনি নি। কলকাতার শহরতলির (বারাকপুর) যেখানে থাকতাম সেখানেও কেউ কখনো বিদেশে গিয়েছেন বলে শুনি নি। তাই আমার বিদেশ যাত্রার আগের, পরের আর অবশ্যই প্রবাসে থাকার অনেক মজার মজার ঘটনা আছে খুব স্বাভাবিক ভাবেই।
সেটা '৯০ এর দ'শক এর শেষের দিকের কথা। আমি তখন পিএইচডি করছি। সেখানে থিসিস শেষ হলেই সব্বাই আমেরিকা তে পারি দিত। কেউ কিছুদিন থেকে ফিরত, কেউবা ফিরত না।কিন্তু সকলেরই একটাই উদ্দেশ্য, যেমন করে হোক থিসিস কমপ্লিট  আর আমেরিকা তে পারি দাও।
আমাদের ল্যাব এর এক অগ্রজ দাদা তাঁর থিসিস শেষ করে আমেরিকা যাবেন Post -doctoral রিসার্চ করতে। একদিন বললেন, "জানিস তো তমাল, কবি  কি বলেছেন ? "
"- আজব দেশ এই আমেরিকা সকল দেশের চেয়ে , হাত বাড়ালেই পয়সা আসে, চোখ টিপলেই মেয়ে!"
আমার সেই অগ্রজ দাদা আমেরিকা গিয়েছিলেন, ফিরেও এসেছেন। এখন রাজধানীর এক নামী প্রতিষ্ঠানের নামজাদা বিজ্ঞানী।
আমার দারুন লাগল। মনে তখন দোলা।আমেরিকা যাব।যেতেই হবে।
আমি বারাকপুর থেকে রোজ বালিগঞ্জ সাইন্স কলেজ এ আসতুম সকালবেলা, আর রাত্তিরে শিয়ালদা থেকে ১১:৪০ এর রানাঘাট লোকাল এ বাড়ি ফিরতুম।নিত্যযাত্রীরা কেউ ছিলেন দাদা, কেউ বা মেসমশায়, আবার কেউ বন্ধু। যখন প্রথম সব্বাইকে জানালাম যে আমি আমেরিকা যাচ্ছি, এক ভদ্রলোক এর reaction আমার আজ মনে পরে! বোধকরি উনি বড়বাজার এ কোনো দোকানে  কাজ করতেন। রোজ সকালে যেতেন আমার সাথে এক ট্রেন এ আর ফিরতেন ওই রাতের ট্রেন এ। আমার ট্রেনতুতো এক মেশোমশাই বলা যায়।সব সুনে বললেন, " পাঁচ বছর ধৈরা দেখি হেই হক্কল বেলায় যাও, আর এই মাঝ রাত্তির এ বাড়ি ফেরো , তা মালিক পার্মানেন্ট করলো না?" কি করে বোঝাই পিএইচডি তে পার্মানেন্ট হলে আমায় বাঁচানো ভগবানের অসাধ্য!
প্রায় একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখেছিলুম যে দোকানে চুল কাটতে যেতুম, তার মালিকের কাছে। চুল কাটতে গিয়েছি একদিন। বললেন, "শুনলাম নাকি তুমি আন্দামান না কোনহানে জওয়ান লাগছো, হেইর লাগ্যা কৈছিলাম তোমারে, লেদ মেশিন এর কাজ টা শিখ্যা রাখো, শোনলা না আমার কথা! এখন সব ছাইরা যাও কালাপানি! বুরহা বাপ-মা রইল হেইখানে, বাবু চললেন আন্দামান!" অনেক ভালবাসার থেকেই কথাগুলো ঐভাবে বলা। তখন খারাপ লেগেছিল। এখন লাগে না। আজকাল ওই সরল মানুষ গুলোর কথা খুব মনে পরে।
প্রথমবার আমেরিকা যাওয়া, সেটা ২০০০ সাল। থাই এয়ারওয়েজে ব্যাঙ্কক হযে সান-দিয়েগো।
ট্রাভেল এজেন্ট ব্যাঙ্ককের  ভিসা করে দিয়েছিলেন, কারণ ওয়েটিং ছিল ১২ ঘন্টা। ভয়ে ব্যাঙ্কক এয়ারপোর্ট এর বাইরে বেরোই নি। তারপর  ব্যাঙ্কক দেখার সুযোগ আর আসে নি। এখনো ওই বোকামোর জন্যে আপশোস করি।
আমার প্রথমবারের আমেরিকা যাত্রা আর থাকা টা খুব একটা মসৃন হই নি। মনে আছে, আমার মাস্টারমশাই ধ্রুবাজ্যতি বাবু ২০০ ডলার দিয়েছিলেন সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। যে ল্যাবরেটরি তে কাজ করার কথা, তারা একটা হোটেল ঠিক করে দিয়েছিল। এয়ারপোর্ট এ কেউ নিতেও আসে নি! ২৫ ডলার দিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে হোটেল এ গিয়ে শুনি ভার ৬০ ডলার প্রতিদিন! দু দিন ছিলেম। টাকা ফুরিয়ে গিয়েছিল। ইউনিভার্সিটির দুটি মেয়ে শেয়ার করে থাকত একটি এপার্টমেন্ট-এ। আমার অবস্থা দেখে তারা তাদের বাড়িতে আমায় ৭ দিন থাকতে দিয়েছিল। তারপর অগ্রিম বেতন নিয়ে নিজের এপার্টমেন্ট বুক করি! অর্থের অভাব থাকলেও, জীবনে রসের অভাব ছিল না। কোনদিন হতাশ লাগে নি! বোধহয় বয়সটাও অল্প ছিল! আজকাল তো অল্পেতেই আঁতকে উঠি!
প্রবাস থেকে প্রথমবার দেশে ফিরেছি। মনে আছে, একদিন কলকাতা থেকে ফিরছি। বারাকপুর স্টেশন থেকে রিক্সা করে বাড়ি ফিরছি। রাস্তায় দেখি, পারার এক দাদা হেঁটে ফিরছেন।বৌবাজারে বই বাঁধাই এর কাজ করতেন।ডেকে নিলাম, বললাম "আমি একাই যাচ্ছি, তুমিও চলে এসো আমার সাথে।" রিক্সায় যেতে যেতে বার বার দেখি আমার হাতের দিকে তাকাচ্ছেন। অস্বস্তি হচ্ছিল।
জিগ্যেস করলাম, "কিছু বলবে?"
উনি বললেন " একটা কথা জিগাই?"
"নিশ্চয়, বল না !"
"হক্কলে কয় যে তুমি আমেরিকায় থাক, হেইটা তো সত্য?"
আমি বললাম, "কেন বলত?"
উনি বললেন, "আমার বিশ্বাস হয় না। শুনি ঐহানে হক্কলের গায়ের রঙ সাদা, তা তোমার তো কুনো পরিবর্তন নাই!"
আমার চামড়ার রঙ টা ঠিক চিমা ওকরির মত না হলেও কাছাকাছি। কিন্তু এইভাবে কেউ চোখে আঙুল দিয়ে দেখান নি! আজ বসে বসে যখন ভাবি, ওই মানুষটার সারল্য আমায় মুগ্ধ করে, যদিও সেদিন কিন্তু রাগ হযেছিল!
আমার দ্বিতীয়বারের আমেরিকা যাত্রার একটা মজার ঘটনা আছে।
সেটা ছিল জানুয়ারি মাস। রাত ১০টায় এয়ারপোর্ট (লোগান এয়ারপোর্ট, বস্টন) এ পৌছনোর পর দেখলুম দেখলুম একটি গাড়ি, সারথী সহ দাঁড়িয়ে, আমায় নিয়ে যাবে বলে।  প্রথমবারের চেয়ে ভিন্ন  এবং  সুখকর অভিজ্ঞতা, তা বলাই বাহুল্য। লোগান এয়ারপোর্ট থেকে বর্সেস্তের শহরে যাচ্ছি। রাস্তার দু ধারে দেখি সাদা সাদা পাথরের ঢিবি। অবাক হয়ে দেখছি। শেষে থাকতে না  পেরে ড্রাইভার কে জিগ্যেস করলুম, "এখানকার সব পাথর বুঝি সাদা রঙের?".... আজও ভুলি নি ড্রাইভার এর অট্যহাস্য। বলল, "না এগুলো বরফের ঢিবি।" এরপর প্রায় তিন বছর ওই ঢিবির মধ্যেই বাস করেছিলাম।আমার জীবনের সেই প্রথম বরফ দেখা!
মাসাচুসেটস  এ থাকাকালীন একটি মজার ঘটনা মনে পড়ল। বিদেশে কারো সাথে আলাপ হলেই প্রথম পাঁচটি প্রশ্নের একটি থাকে, "দেশে বাড়ি কথায়?" এক অগ্রজ কে জবাবে বলতে শুনেছিলাম "ডাউন টাউন সোনারপুর এ।" ভারী মজা লেগেছিল শুনে।
এর কিছুদিন বাদের ঘটনা। সেই ভদ্রলোক বস্টন এর উপকন্ঠে একটি সুন্দর বাড়ি কিনলেন। গৃহ-প্রবেশে আমাদের অনেকের নিমন্ত্রণ ছিল। তার স্ত্রী আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাড়ি দেখছিলেন।রান্নাঘর এ নিয়ে গিয়ে বললেন, "দ্যাখো ভাই, আমার প্যানটি টা কত বড়! আর পেছনের দিকে (মানে রান্নাঘর সন্নিহিত বাগান) দ্যাখো …. কত্ত ছোট ছোট ধানি লঙ্কা!" তারপর সারাদিন হেসেছিলুম মনে আছে। হাসতে হাসতে শরীর  খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগার হযেছিল!!
স্পেন-এ এসেও একটা মজার অভিজ্ঞতা হযেছিল শুরুতে। পরে যেটা আমার নিজের অভ্যেসে পরিনত হযেছে।
কেউ যদি ক্রমাগত হাসিমুখে "বালে বালে বালে বালে" অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বলতে থাকে তাহলে আপনার কেমন লাগবে? হ্যা, আমারও সেরকম অবস্থ্যা হয়েছিল স্পেন এ এসে। শালা যাই বলি তাই শুনে লোকে তার দন্তবিকশিত করে "বালে বালে বালে বালে" বলে যেত। পরে জানলাম অর মানে হলো "ঠিক আছে"... আর তারপর অভ্যেসটা আমারও হে উঠলো। মাঝে মাঝে আমার বউ বলে ¨দেখ কলকাতায় গিয়ে আবার ´বালে বালে বালে বালে´বলে উঠিস না। লোকে চাদা তুলে পেটাবে!¨
শুধু আমি নই। বিদেশে গিয়ে এরকম মজাদার অভিজ্ঞতা বোধহয় অনেকেরই! আমার এক দক্ষিন ভারতীয় বন্ধুর প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা টা তো না বললেই নয়! তার নতুন সুন্দরী প্রফেসর তাকে প্রথম দিনই ডিনার এ নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে মেনু কার্ড দেখে আমার বন্ধুটি তো প্রথমে কিছুই বুঝতে পারে না! তা প্রফেসর মহিলাটি সালাড অর্ডার করাতে, সেও একই জিনিস অর্ডার করলো।
ওয়েট্রেস বিনীত ভাবে জিগ্যেস করলেন "what dressing, sir?"
আমার বন্ধুটি অত্যন্ত লজ্জিত ভাবে নিজের প্রফেসর কে বলে বসল "whatever she is wearing, is fine with me!" এই গল্পটি যে আমি কতবার শুনেছি আমার বন্ধুর কাছে তার শেষ নেই। আমিও বিভিন্ন আড্ডায় ততোধিক বার বলেছি বোধহয়!

শনিবার, ১৫ জুন, ২০১৩

পারি আর পারিনা’র গল্প - পিয়া সেন


ঘটনা ১ঃ স্থানঃ পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার একটি গ্রাম।
  বক্তাঃ প্রাইমারি স্কুলে মিড্‌-ডে-মিল রান্নায় নিযুক্ত এক রাঁধুনি।
“আমরা গ্রামের মুখ্যু মেয়ে দিদি। আমরা কি আর বুঝি আর কত’টাই বা পারি? এই সব হিসেব-পত্র মাস্টাররা আমাদের চেয়ে ঢের ভাল করতে পারেন।”

ঘটনা ২ঃ স্থানঃ কেরালার তিরুবনন্তপুরম জেলার একটি গ্রাম।
 বক্তাঃ গ্রামের এক সাধারণ মহিলা। কাঠ বিক্রি করে পেট চালান।
“আমি কাঠ বিক্রি করি গ্রামের এক ছোট কারখানায়। সেখানে তা’ দিয়ে নানা জিনিস তৈরি হয়। এ ছাড়াও আমি পঞ্চায়েতের কুড়ুম্বশ্রী শাখার সঙ্গে যুক্ত।”

ভারতবর্ষের দু’ই প্রান্তের গ্রামের দু’জন সাধারন মহিলার আপাতসাধারন মন্তব্যকে বন্ধনীর মধ্যে উল্লেখে কারোর ভ্রূ কুঞ্চিত হতেই পারে। প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।  কিন্তু একটু মনযোগী হলেই দুই সমশ্রেণীর শ্রমজীবি মহিলার বক্তব্যে আত্মবিশ্বাসের এক বিশাল ফারাক লক্ষ্য করা যায়, যে’টি যথেষ্টই কৌতূহল উদ্রেক করে।  
অধ্যাপক অমর্ত্য সেন তাঁর একটি লেখায় capability বলতে বুঝিয়েছেন প্রত্যেকটি মানুষের অন্তর্নিহিত ক্ষমতার বিকাশ ও তাকে উপলব্ধি করার স্বাধীনতা বহুলাংশে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করে। এখানেই বোধহয় উক্তি দু’টির প্রাসঙ্গিকতা।
একটু বিশ্লেষণে আসা যেতে পারে। এই দুই মহিলাই অল্প বিস্তর শিক্ষিত- প্রথম জনের পড়াশোনা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় জন পঞ্চাশোর্ধ বিধবা। অথচ যে হতাশার সুর প্রথমজনের সর্বাঙ্গ থেকে ঝ’রে পড়ছিল, তার লেশমাত্র-ও দ্বিতীয়জনের গলায় প্রতিদ্ধনিত হল না। বরং দেখা গেল এক আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা। তিনি যে শুধু কাঠ বিক্রি করেন তাই নয়, গ্রামের বিভিন্ন সমস্যা সম্বন্ধেও তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল এবং কুড়ুম্বশ্রীর শাখা অফিসে অন্যান্য মহিলাদের সাথে নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনাতেও অংশগ্রহণ করেন।
এই প্রসঙ্গে বলি কুড়ুম্বশ্রী কেরলে সরকারি সহায়তায় গঠিত এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যা প্রায় গত এক দশক ধরে মহিলাদের জন্য কাজ করে চলেছে। আজ কেরলের প্রায় প্রতিটি জেলায় কুড়ুম্বশ্রীর অফিস আছে এবং পঞ্চায়েতের সাথে যুক্ত হয়ে তারা কাজ করেন। মহিলাদের জন্য তাদের প্রকল্প ও পরিকল্পনা আছে। প্রতিটি গ্রামের সমস্ত পরিবারের অন্ততঃ একজন মহিলা সদস্য এদের গ্রামীণ শাখার সাথে যুক্ত এবং এর সাহায্যে এনারা অনেক রকমের সুযোগ সুবিধা  পেয়ে থাকেন। এই দলবদ্ধ ভাবে নিজেদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা এবং তার সমাধান খুঁজে বার করার প্রচেষ্টাই জাগিয়ে দিয়েছে গ্রামের মহিলাদের মধ্যেকার আত্মবিশ্বাস- “আমরাও পারি”- এই বোধ, চেতনা। কুড়ুম্বশ্রী খুব-ই জনপ্রিয় এবং কেন্দ্রীয় সরকারের “মডেল”রূপে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। কেরলের গ্রামের ওই বৃদ্ধা মহিলার মুখের ঔজ্জ্বল্যের- দীপ্তিময় হাসির কারণ-ও কুড়ুম্বশ্রীর সাহচর্য্যে তার নিজের মধ্যে জাগ্রত সচেতনতা। এই সচেতনতা তাকে দিয়েছে মনের জোর, ভরসা আর সব চাইতে বেশি- নিজেকে বিশ্বাস করার ক্ষমতা।
এবারে ফিরে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মহিলার কাছে। মুর্শিদাবাদ জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে ওনার বাস। গ্রামটি প্রধানতঃ মুসলমান ও অনগ্রসর শ্রেণী অধ্যুষিত। দারিদ্রসীমার নিচে বাস করা এই পরিবারগুলির দিন  গুজরানের প্রধান ভরসা ক্ষেত মজুরি ও বিড়ি বাঁধা। ফলে আর্থিক অনিশ্চয়তা ও অনটন এনাদের নিত্যদিনের সঙ্গী।
প্রথম থেকেই স্কুলে চলা মিড্‌-ডে-মিল্‌ সঙ্ক্রান্ত কোন কথাবার্তাতে অংশগ্রহণ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করছিলেন বছর তিরিশের এই রাঁধুনি। মাস্টারমশাইদের কাছে  না গিয়ে তাঁর সাথে কথা বলতে এসেছি শুনে অত্যন্ত অবাক হলেন এবং বারংবার নিজের অক্ষমতা ও অজ্ঞতার কথা তুলে ধরলেন। ধীরে ধীরে বিভিন্ন কথাবার্তার মধ্যে খাবারের হিশেব-নিকেশ রাখার প্রসঙ্গ উঠলে একদম প্রথমোক্ত উক্তিটি উনি করেন। ক্লাস্‌ এইট্‌ পাশ হওয়া সত্ত্বেও একটি ছাপা লেখা পড়ার জন্য এগিয়ে দিলে অবিশ্বাসের হাসিতে “আমি পারবনা” ছিল তার প্রথম উত্তর। বারংবার পীড়াপীড়িতে শেষে পড়তে নিলেন এবং তার পড়ার অনর্গল স্রোতকে আমি অবশেষে নিজের কাজের তাগিদে থামাতে বাধ্য হলাম। মহিলার মুখটি ততক্ষণে “আমি পেরেছি”র হাসিতে উদ্ভাসিত। কষ্টকর এটি- উনি যে পড়তে পারেন তা উনি নিজেই বিস্মৃত হয়েছিলেন।
উপযুক্ত সামাজিক পরিবেশের অভাবে শিক্ষা তাই তার মধ্যে কোন আত্মবিশ্বাসের ভিত তৈরি করেনি। দিন গুজরানের কঠর পরিশ্রম সত্ত্বেও “পারিনা”র থেকে “পারি”তে উত্তরণ ঘটেনি। অথচ আপাতদৃষ্টিতে এই দুই মহিলাই অর্থনৈতিক ভাবে যথেষ্ট দুর্বল এবং সামাজিক স্তরেও পশ্চাৎপদ। দুই পক্ষই দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারি উপরন্তু কেরলের ওই বয়ষ্কা মহিলা নিজের ছেলের সংসারে আশ্রিতা। কিন্তু পার্থক্যটা এই যে এই দুই রাজ্যের দারিদ্রসীমার মধ্যে যেমন ফারাক রয়েছে তেমন-ই তারতম্য আছে এদের সামাজিক পশ্চাৎপদতার মাত্রাতেও। পশ্চিমবঙ্গে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারি এক মুসলমান পরিবারের সঙ্গে কেরলে ওই এক-ই অবস্থায় বাস করা আর একটি নিম্নবর্গীয় পরিবারের মধ্যেকার সামাজিক অবস্থানের বিপুল তফাৎ।
বহু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কেরলে প্রত্যক্ষ করা যায় জাত-ধর্ম ও দলমত, প্রধানত রাজনৈতিক মত-অমত নির্বিশেষে এক সামূহিক উদ্যোগ যা এই রাজ্যের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক ক্ষেত্রেই এর কিছুটা বিপরীত মনোভাব লক্ষ্য করা যায় এই রাজ্যে- যেখানে উচ্চবর্গীয়রা সমাজের নিম্নবর্গীয়দের ভিতরে অত্যন্ত নিপুণভাবে “পারবিনা” মনভাবের বীজ রোপণ করে যা প্রত্যক্ষ করা যায় প্রথম মহিলার ক্ষেত্রে। অথচ ক্ষণিকের জন্য পড়তে পারার মত সামান্য সু্যোগেই নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে এই নবসচেতনতা তার মধ্যে এক অদ্ভুত আনন্দের জন্ম দিয়েছিল এবং এইখানেই যেন কোথাও এই দুই ভিন্ন প্রান্তের অপরিচিত মহিলা এক সত্তা হয়ে উঠেছিলেন।

** লেখক “প্রতীচি ইন্সটিটিউট্‌”-এ সহগবেষক (Research Associate) হিসেবে কর্মরত।

কামদুনি ~ তুহিন বসু

বড়োই ব্যাথা বড়োই জ্বালা
বুকের মাঝে শূন্যতা
বিষন্নতার গন্ধ মাখা
লাশ হয়ে যায় সিগ্ধতা
হয়তো আমার না বলা কথা
হয়তো আমার শক্তি
কিছুটা প্রতিবাদ আর
খুঁজতে চাওয়ার দৃষ্টি
হারিয়ে যাওয়া সময় মাঝে
কান্না ভেজা আকুলতা
ছিঁড়ে খাওয়া বর্বরতায়
স্বব্ধ হওয়া ব্যাকুলতা
প্রতিবাদের পরশ কোথায়
প্রতিরধের রসদ কই
লজ্জানত এই জীবনে
গর্জ্জে উঠার আগুন চাই
সিক্ত নয়ন কামদুনির
লক্ষ টাকার প্রশ্ন তাই
বর্বরদের শাস্তি কবে
তোমার আমার লড়াই কই!

শুক্রবার, ১৪ জুন, ২০১৩

"আরও কিছুদিন আমাদের মধ্যে থাকলে পারতেন না স্যার?" - তমাল রাহা


আরও কিছুদিন আমাদের মধ্যে থাকলে পারতেন না স্যার? সময়টা যে ভালো কাটছে না!
গণসঙ্গীত এর স্বর্ণযুগ-এর কান্ডারীরা আর কেউ নেই। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, ভূপেন হাজারিকা, চট্টগ্রামের প্রান্তিক শিল্পীগোষ্ঠীর হরি প্রসন্ন পাল (যাকে বলা হতো বাংলার পল রবসন), নির্মলেন্দু চৌধুরী …. সবাই তো একে একে চলে গিয়েছেন। এবার চলে গেলেন অজিত পান্ডে …............... আর ভালো লাগে না …..........
বাবার কিনে আনা প্রথম কয়েকটা রেকর্ড এর একটা ছিল অজিত পান্ডের গান …. এখনো কানে বাজে মৈনাক মহলানবীশ সুরে ও ক’থায় অজিত পান্ডের গান, “পদ্মারে, তোর ঢেউয়ে ঢেউয়ে আমি নাও বাইয়া যাই পদ্মারে ….
পদ্মারে, তোর দুই পারেতে ধানের
ক্ষেতে দোলা লাগে একই হাওয়াতে
….......
কোজাগোরী আর রমজানের চাঁদ
হাসে দেখি তোর একই জলেতে।
ভোলা কি যায়? কোথায় যে হারিয়ে গেল রেকর্ড টা!
একটা অদ্ভূত প্রবনতা ছিল, কবিতা কে গান বানানোর। কখনো সেটা “অমলকান্তির রোদ্দুর হতে চাওয়া”-র মত, কখনো বা শ্রী অরুন চট্টোপাধ্যায়-এর ‘সাঁঝ বিহান’ এর মত কবিতা নিয়ে experiment.... বাদ রাখেন নি শ্রী অন্নদা শংকর রায়ের satire কেও …. ‘যেখানেতে ঘটে যত অনিস্টি, সকলের মূলে কমিউনিস্টি।’...
নিজেকে সরিয়ে রাখেন নি কখনো গণ-আন্দোলন এর থেকেও। "নক্সালবাড়ি সংগ্রাম সহয়ক কমিটি"র হয়ে গান গান বাঁধলেন,
তরাই কান্দে গো , কান্দে আমার হিয়া
আর নক্সালবাড়ির মাঠ কান্দে গো
সপ্ত কন্যার লাগিয়া।
বড়দের কাছে শুনেছিলাম চারুবাবুকে এই গান শোনানো মাত্র অজিত পান্ডের কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বলেছিলেন, "অজিত, তরাই কাঁদছে না, তরাই জ্বলছে।” কথা পাল্টে দিলেন অজিত পান্ডে
"তরাই জ্বলছে গো, জ্বলছে আমার হিয়া
আর নক্সালবাড়ির মাঠ জ্বলে গো
সপ্ত কন্যার লাগিয়া"
চাসনালা খনি নিয়ে অজিত পান্ডের গান কে ইতিহাস বললেও বোধহয় কম বলা হয়। গানটার সুরের জাদুতে আচ্ছন্ন ছিলাম ছোটবেলা থেকে। বাবার কাছে শুনেছিলাম চাসনালা খনি-র শ্রমিকদের মৃত্যুর বিবরণ। গানটার মধ্যে যেন দেখতে পেতাম বিধবা শ্রমিক রমনীর কান্না।
ইস্কুলে পরি তখন, খাতায় লিখে দিয়েছিলেন “গুলি আর বোমা হোক ধারালো, কাস্তে টা শান দিও বন্ধু”, আর তার তলায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা “অজিত পান্ডে”...
আরও কিছুদিন আমাদের মধ্যে থাকলে পারতেন না স্যার? সময়টা যে ভালো কাটছে না!



চাসনালার খনি তে শুনুন -

সোমবার, ১০ জুন, ২০১৩

হারাধনের দশটি মেয়ে ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য্য

হারাধনের দশটি মেয়ে ঘোরে পাড়াময়,
একটি তো ধর্ষণের শিকার, রইল বাকি নয়।
হারাধনের নয়টি মেয়ে নিল স্কুলের পাঠ,
হামলাকারীর চলল গুলি, রইল বাকি আট।
হারাধনের আটটি মেয়ে, অকাল গর্ভপাত,
ক্লান্ত শরীর সইল না আর, রইল বাকি সাত।
হারাধনের সাতটি মেয়ে, ভালবাসার জয়,
ব্যর্থ প্রেমিক অ্যাসিড ছোঁড়ে, রইল বাকি ছয়।
হারাধনের ছয়টি মেয়ে, আগেই পেয়ে আঁচ,
ভ্রূণেই তাকে শেষ করে দেয়, রইল বাকি পাঁচ।
হারাধনের পাঁচটি মেয়ে, না পেয়ে খাবার,
অপুষ্টিতে মৃত্যু হল, রইল বাকি চার।
হারাধনের চারটি মেয়ে, প্রেমিক জাতে ভিন,
মান বাঁচাতে 'অনার কিলিং', রইল বাকি তিন।
হারাধনের তিনটি মেয়ে, পণের টাকা কই?
বলল স্বামী 'স্টোভ ফেটেছে'। রইল বাকি দুই।
হারাধনের দুইটি মেয়ে, গর্ভিনী প্রত্যেক,
প্রসব বেদন সইল না আর, রইল বাকি এক।
হারাধনের একটি মেয়ে, কাঁদে ভেউ ভেউ,
দুঃখে দিল গলায় দড়ি, রইল না আর কেউ।

শুক্রবার, ৭ জুন, ২০১৩

গাড়োয়ালি গাড়িওলা ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

তীর্থ দর্শন নাকি কপালে থাকলে হয়। সে কপাল যে কেমন দেখতে তা জানিনা। তবে কিনা, পাকে চক্রে আমার বেশ কিছু ঘোরার সঙ্গে তীর্থ দর্শন জড়িয়ে গেছে। পাপীদের হয়ত ইশ্বর ধরে বেঁধেই নিয়ে যান দর্শন করাতে। লিখতে বসে প্রচুর ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলি আমি আসলে হাড়-আলসে লোক তো, তাই প্রসঙ্গান্তরে যেতে যে টুকু মেহেনত-মজদুরি লাগে, সেটাও আমার কাছে অনেক। এবারে ঠিক করেছি বাহুল্য বর্জিত লিখবো। শুরুতেই বলে দিয়েছি, এ হলো এক গাড়োয়ালি গাড়িওলার গল্প। কাজেই পথের চারপাশে কি দেখলাম, স্থান মাহাত্য, সৌন্দর্য্য ইত্যাদি সব কিছু বাদ এই লেখা থেকে। সেবারে দলে আমাদের চার জন। পুজো আসতে আর দু সপ্তাহ বাকি। বর্ষার শেষের দিক, শরতের শুরু। নতুন দিল্লি ষ্টেশনে কাঠ ফাটা রোদে দাঁড়িয়ে পরের গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করতে করতে রবি ঠাকুরের প্যারোডি করে আউড়াচ্ছিলাম “এসেছে শরত, ঘামের পরশ”, মজা করেই। আরো কয়েক ঘন্টা পরে হরিদ্বার পৌঁছেছি ভ্যাপসা গরমে সেদ্ধ হতে হতে, আর মজাও টের পেয়েছি ভালোই। রাত প্রায় ৯টায় গিয়ে ঢুকলাম হরিদ্বারের ভারতসেবাশ্রম সংঘের অতিথিশালায়। এসেছি ঝটিকা সফরে, রাত পোহালেই বেরিয়ে পড়তে হবে গৌরিকুন্ডের দিকে। সেখান থেকে কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, এবং ফেরা। দরকার একটা গাড়ি। সেটা না হলে এই পুরো সফরটা পাঁচ দিনে শেষ করা যাবেনা। বস্তুতপক্ষে সবাই আমাকে বলেছিলো, এই ঘোরাটা পাঁচদিনে হয়ও না। পাঁচ দিনের দিন আমরা আবার হরিদ্বারে ফিরবো, এটাই পরিকল্পনারাত বেশী হলেও, অনেক দোকানপাঠই খোলা। কিন্তু আগামীকাল ভোরবেলা গাড়ি নিয়ে বেরোতে কেউই রাজি নয়। একের পর এক ট্রাভেল এজেন্টের কাছে ঘোরা হল। একটা দোকান থেকে বেরচ্ছি, সামনে একটা বেঞ্চিতে কয়েকটা লোক বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। তার মধ্যে একজন মুখ ঘুরিয়ে আমাদের দেখে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলো যে আমরা কি শুধু কেদার-বদ্রীই যাবো? না কি চার ধাম যাবো? চার ধাম মানে, কেদার নাথ, বদ্রীনারায়ন, গঙ্গোত্রী আর যমুনোত্রী। আমরা বললাম না, যাবো শুধু দু জায়গাতেই, কেদার আর বদ্রী লোকটা গুটখা খাচ্ছিলো। পিচিক করে থুথু ফেলে উঠে দাঁড়ালো। এবারে আলোতে ভালো করে দেখলাম। মাঝারি উচ্চতা। চওড়া গড়ন তবে ছিপছিপে চাবুকের মতো চেহারা। অনেকটা হিন্দি ছবির অভিনেতা শুশান্ত সিং এর আদল রয়েছে। বললো হাজার পাঁচেক নেবে, একটা ইন্ডিকা গাড়ি আছে ওর।আর সফর শেষে আমরা খুশি হলে আর কিছু দিয়ে দিলে আরো খুশি হয়ে যাবে। আমাদের মনে যে একটু সন্দেহ হচ্ছিলোনা এমন নয়। কিন্তু উপায় কি? এতদুর এসে তো গাড়ির অভাবে পন্ড করা যায়না সব কিছু। বললো আগামীকাল সকাল ছটায় ভারতসেবাশ্রমে হাজির হয়ে যাবে গাড়ি নিয়ে। “নাস্তা ঋষিকেশ পর্‌ অওর দো-পহর কা খানা রুদ্রপ্রয়াগ মে” বলে দিলো বিক্রম। এটাই ওর নামঅবশ্য ওর উরুশ্চারনে ভিক্‌রম্‌’। প্রসঙ্গত বলে রাখি, উচ্চারন ও বানান নিয়ে আমার নিজের ছুৎমার্গ একেবারেই নেই। কিছুদিন আগে একটা লেখায়, লেখা হয়েছিল “সায়েব”। প্রকাশিত হবার পরে দেখি, সে লেখা সম্পাদকের হাতে পড়ে “সায়েব” হয়েছেন “সাহে্ব”। “সায়েব” আর “সাহে্ব” এর পার্থক্যটা নেহাতই মার্ক্সিয়, তাই নামকরা সংবাদপত্রর সম্পাদকের চোখে সে পার্থক্য ধরা পড়বে, এমনটা আশা করাই অন্যায়।  
ঠিক কাঁটায় কাঁটায় ছটার সময় একটা ঝকঝকে ইন্ডিকা এসে দাঁড়ালো আশ্রমের চত্তরে। আমরা তৈরিই ছিলাম। ঝোলা ঝুলি সমেত উঠে বসলাম গাড়িতে। ঋষিকেশ পৌঁছতে লাগে প্রায় এক ঘন্টা। এই এক ঘন্টা রাস্তার ধারে রোমাঞ্চ কম। গঙ্গার ধার দিয়ে এগিয়ে চলা। ঋষিকেশ আগেও এসেছি। হিমালয়ে জনসমাগম বাড়ছে। ক্রমশঃ ফাঁকা জায়গা কমছে। আমি অবশ্য নিখাদ প্রকৃতি রসিক নই। একটু লোকজন আমার দিব্যি লাগে। একদম খালি আর ফাঁকা জায়গায় আমি যেন কেমন হাঁপিয়ে উঠি। ঋষিকেশ প্রায় পেরিয়ে এসে, যেখানে চড়াই শুরু হচ্ছে, সেখানে বিক্রম গাড়ি থামালো একটা খাবার দোকানের সামনে। আগের দেড় দিন ধকল কিছু কম যায়নি। রাত্রের ঘুমের পর খিদেও পেয়েছে বেশ। বেশ কয়েকটা আলুর পরটা, গলা বেয়ে নেমে যাবার পর অন্য দিকে নজর গেল। দোকানের জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি লছমনঝুলা দেখা যাচ্ছে। সকালের রোদ পড়ে গঙ্গার জল সোনার মত ঝিকমিক করছে, খালি চোখে তাকানোই যাচ্ছে না। ওদিকে বিক্রম দেখলাম তৈরি। আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকলো। এবারে আমি বসলাম গাড়ির সামনের আসনে, বিক্রমের পাশে। এতক্ষন রাস্তায় ছিলো অনেক বাইক, রিক্সা, ঠেলাগাড়ি, অটো। কিন্তু ঋষিকেশের সীমানা ছাড়ানোর পর আর এই সব গাড়ির দেখা নেই। রাস্তা অনেকটা পরিস্কার। হুহু করে গাড়ি চলছে। মাঝে মাঝে ফৌজি ট্রাকের কাফেলা চলেছে গর্জন করে। তাদের পেরিয়ে গেলেই আবার রাস্তা খালি। ডান দিকে আমাদের পাশে পাশে চলেছে গঙ্গা। কিন্তু গঙ্গার কি রূপ এখানে! খরস্রোতা, উচ্ছল পান্নার মত সবুজ রঙের জল, ভীম বেগে পাহাড় থেকে নামছে। আর আমরা সেই স্রোতের বিপরিতে পাহাড়ে উঠছি। ঋষিকেশের পর থেকেই পাহাড়ে চড়া শুরু। এতক্ষনের সোজা রাস্তা এবারে বাঁক নিতে শুরু করেছে। গাড়ি চলেছে প্রায় ৮০-৯০ কিলোমিটার গতিতে। সামনেই রাস্তাটা বাঁদিকে ৯০ ডিগ্রি ঘুরেছে। কিন্তু গাড়ির গতি কমে কই? হুহু করে গাড়ি এগিয়ে চলেছে বাঁকের দিকে। ওখানে রাস্তার পাশেই জমি খাড়া নেমে গেছে অন্ততঃ ৫০ মিটার। নিচে গঙ্গার জল ভীম বেগে ফুঁসছে। একবার রাস্তা টপকে পড়লে গাড়ি আর আমরা, কোনকিছুরই অবশিষ্ট খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। বিক্রমের দিকে তাকালাম। সে নির্বিকার। পেছন থেকে আর্তনাদ ভেসে এলো – “বাবা গো”। আমার তলপেটের ভেতরটা কেমন যেন......। হঠাৎ বিক্রম এক ঝটকায় স্টিয়ারিং ঘোরালো। গাড়ি প্রায় রাস্তার ধার ছুঁয়ে ফেলেছে। চারিদিক ঝাপসা লাগছে। কেউ যেন সিটের সঙ্গে চেপে ধরেছে আমাকে। চোখ বন্ধ করে ফেলেছি কেমন করে নিজেই বুঝিনি। খালি চোখে নিজেকে মরতে দেখা খুবই কঠিন। তাই এটা বোধহয় প্রকৃতিরই প্রতিবর্তক্রিয়া। এক মুহর্ত সময় যেন এক ঘন্টার মত। মরতে এত সময় লাগে? কিন্তু যেমনটা ভেবেছিলাম, সেটা আর হলো না। চোখের পাতা অল্প খুলে দেখতে পেলাম, তেমনই নির্বিকার চিত্তে বিক্রম স্টিয়ারিঙে বসে রয়েছে। গাড়ি রাস্তাতেই। আমার হাতের তেলো বরফের মত ঠান্ডা। পেছনে তাকিয়ে তিন খানা রক্তশূন্য ফ্যাকাসে মুখ দেখলাম। কথা বলার মত সামর্থ্য ও নেই কারোর। কয়েক মুহুর্ত পরে কথা বলার মত সামান্য শক্তি সঞ্চয় করেই দেখি, সামনে এগিয়ে আসছে আবার ও একটা ৯০ ডিগ্রির বাঁক।
সব কিছুই আস্তে আস্তে সয়ে যায়। এমনকি মৃত্যুভয় পর্য্যন্ত। এ ক্ষেত্রে, ভয় কে জয় করেছি বলবনা, বরং ভয়ে আমাদের বোধবুদ্ধি-অনুভুতি গুবলেট পাকিয়ে অসাড় হয়ে গেছে এটুকু বলতেই পারি। অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় বাঙালির ছেলে-মেয়েরা কত কি করছে। এভারেস্টে পর্যন্ত উঠে পড়ছে। তবে কিনা তাতে খরচ অনেক বেশী আর দেদার প্রস্তুতিও লাগে। কম্‌ খরচে রোমাঞ্চকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে চাইলে হরিদ্বার থেকে বিক্রমের গাড়ি ভাড়া করে যে কোন দিকে ১০০ কিলোমিটার ঘুরে আসুন। যদি প্রানে বেঁচে ফেরেন, তাহলে সারা জীবনের অ্যাডভেঞ্চারের কোটা আপনার পূর্ন হয়েই যাবে। দেবপ্রয়াগে এসে গাড়ি থামলো কিছুক্ষনের জন্য কিন্তু ধাতস্থ হবার আগেই ছেড়েও দিলো। অবশ্য, এ পর্যন্ত যা দেখলাম, তাতে ধাতস্থ হতে আমাদের সমতলভুমির আনাড়ী মানুষের হপ্তাখানেক লাগার কথা। ঋষিকেশে বেশ গরম ছিলো। দেবপ্রয়াগে এসে এই গাড়ি চড়ে গরম-ঠান্ডার বোধটাই চলে গেছে। গোটা রাস্তায় ক্ষনে ক্ষনে শিরদাঁড়ায় হিমশীতল স্রোত বয়েছে। তলপেট কন্‌কন্‌ করেছে, আর হাতের তেলো কেদারের চুড়োর বরফের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে। পেছনের সিটে তিন খানা ফ্যাকাসে, বেঁকে যাওয়া, নেতিয়ে পড়া, মূমূর্ষু মুখ দেখেছি গাড়ির পেছনের দিকে দেখার আয়না দিয়ে। ওরা অবশ্য কি দেখেছে, সেটা আর জিজ্ঞেস করা হয়নি। রাস্তার ধারে দেখছি, অনেকটা নিচে অলকানন্দা আর ভাগীরথি এসে মিশেছে। দুই নদীর দু রকম জলের রঙ। এসব দেখে মানুষের স্পর্শকাতর মন কত কিছুই না ভাবে, গভীর ভাব ও অনুভুতির জগতে বিচরন করে। কিন্তু এ হেন গাড়ির সওয়ার হয়ে, আমাদের এমনই থরহরি অবস্থা, যে ভালো করে তাকিয়েও দেখতে পারলাম না।
বিক্রম মাঝে একবার জিজ্ঞেস করেছিলো “ডর লাগ রাহা হ্যায়?”আমরা কেবল মুখ চাওয়া চাওয়ি করেছি দেখে নিজেই গম্ভীর মুখে বলেছে – “সব কুছ বাবা কে উপর ছোড় দো”। বাকিদের জানিনা। আমি অন্ততঃ তাই দিয়েছি। এবারে গাড়ি চলেছে রুদ্রপ্রয়াগের দিকে। এ হলো সেই রুদ্রপ্রয়াগ  যেখানে করবেট সাহে্ব একটা বড় মানুষথেকো চিতাবাঘ মেরেছিলেন। আমরা ছোট্ট গাড়ির মধ্যে ফুটকড়াই ভাজা হতে হতে চলেছি। বিক্রমের নির্বিকার মুখ, ও অনবরত গুটখা খাওয়া দেখে মনকে বোঝাতে চেষ্টা করছি, এখানে এটাই দস্তুর। এই ভাবেই গাড়ি চলে। কিন্তু বেয়াড়া মন, কেবলই দেখায় – ওই যে দেবপ্রয়াগের পর গোটা আশি ট্রাক আর খান পঞ্চাশেক গাড়ি কে ওভারটেক করে এলাম? ওরা তো এমন শয়তানের পানা ছুটছেনা বাপু। লোকে বলে গাড়ি ভোর বেলা হরিদ্বার ছেড়ে এসে দুপুর নাগাদ রুদ্রপ্রয়াগ পৌঁছয়, আর এ তো দেখছি রুদ্রপ্রয়াগ মোটে ১০ কিলোমিটার, ওদিকে ঘড়ির কাঁটা সবে ১১ টা ছুঁয়েছে। একটু আগে রুদ্রপ্রয়াগ পৌঁছনোর দৌলতে আমরা করবেট সাহেবের চিতাবাঘ মারার জায়গাটাও দেখলাম। একটা ফলক রাখা রয়েছে। তবে কিনা সে জায়গা এখন লোকালয়ের মধ্যে। চার পাশে দেখলাম কিছু দোকানপাটও রয়েছে। মন্দাকিনি আর অলকানন্দা যে জায়গাতে মিশেছে, সেটাও দেখলাম। গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষন কাটানোর পর একটু ধাতস্থ হলাম। একটা ভালো দোকান দেখে খাবার কথা ভাবা গেল। কিন্তু আমাদের মধ্যে দু জন দেখলাম দোকানে ঢুকেই চিঁ-চিঁ করে জিজ্ঞেস করলো – “টয়লেট কাঁহা হ্যায়?”। আর সে টয়লেটে “পানি হ্যায় কি নেহি হ্যায়” এ প্রশ্ন না করেই ভেতরে সেঁধিয়ে গেল। প্রসঙ্গত একটা উপদেশ আপনাকে দিয়ে রাখি হে সুধী পাঠক, হিমালয়ের ওপরে, কোন স্থানে, কদাচ পথিমধ্যে বাথরুমে যাবার প্রয়োজন পড়লে জল আছে কিনা অবশ্যই খোঁজ নিয়ে তার পরে সে বাথরুমে ঢুকবেন। হিমালয়ে জল অতি দুর্লভ এবং দামি বস্তু। তাকে বাথরুমে ঢেলে অপচয়ের অভ্যেস হিমালয়ের অধিকাংশ অঞ্চলেই নেই। এখানে দেখলাম, যারা ঢুকলো, তাদের অবস্থা – “সিন্ধুতে শয়ান যার, শিশিরে কি ভয় তার ”আর একটূ হলে প্যান্ট কাচতে হত হয়ত। সে আরো ঝকমারিযাই হোক, মিনিট দশেক পর অবশ্য বলে কয়ে এক বালতি জল আনানো হল দুজনের জন্যে। অবশ্যই কিছু আর্থিক মূল্য চুকিয়ে।
রুদ্রপ্রয়াগের পর গাড়ি পাহাড় বেয়ে খাড়া ওপর দিকে উঠতে থাকে। খাড়া পাহাড় এক দিকে আর অন্যদিকে খাদ। খাদের নিচে সরু সুতোর মত দেখা যাচ্ছে মন্দাকিনির জল। বেশীক্ষন নিচে তাকালে মাথা ঘোরে। মাথা অবশ্য সেই সকাল থেকেই ঘুরছে। সামনে তাকালে মনে হয়, এই আকাশ ছোঁয়া পাহাড় টপকে যাবো কি ভাবে! কিছুদুর এগিয়েই পড়লাম আটকে। সামনে লম্বা গাড়ির সারি। বিক্রম গাড়ি থেকে নেমে প্রায় এক মিনিট ধরে থুতু ফেললো এদিক ওদিক। ও সকাল থেকে প্রায় গোটা বিশেক প্যাকেট গুটখা খেয়েছে, এবং গাড়ি চালাতে চালাতে পেছনের একশ কিলোমিটার থুতু ফেলে এসেছে। গাড়ি থেকে নেমে, নতুন গুটখার প্যাকেট দাঁত দিয়ে কামড়ে ছিঁড়ে, মুখে গুটখা ঢেলে, ব্যাপারটা কি সেটা সরেজমিনে দেখতে এগিয়ে গেলো । আমরা গাড়িতেই বসে রইলাম। মিনিট কয়েক পর বিক্রমের বুলেটিন প্রকাশ পেলো। কিন্তু বুলেটিন বা বুলেট-ইন মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। এলাকার বিধায়কের বাড়ি সামনের গাঁয়ে। তাঁর পুত্র এবং তার কিছু ভাই-বেরাদর গত রাতে রুদ্রপ্রয়াগ থেকে খানাপিনা করে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছিলেন। পথে বিধায়ক পুত্রের বুলেট মোটর সাইকেল আরোহী সমেত মন্দাকিনিতে পড়ে গেছে। আজ এখনো পর্য্যন্ত কোন কিছুরই হদিশ পাওয়া যায়নি। তাই গাঁয়ের লোকজন খেপে গিয়ে রাস্তা আটকে রেখেছে। ঘটনাটা গুরুতর। চট করে কাউকে বোঝাতে যাওয়াও মুশকিল। শেষে যদি আমাদেরই মন্দাকিনিতে নামিয়ে দেয় খুঁজে আনতে। এদিকে পাহাড়ি রাস্তায় আটকে পড়ার অনেক ঝক্কি। রাত্রে পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি প্রায় চলেই না। এখানে আটকে পড়লে কাল ভোরে কেদারনাথের হাঁটা শুরু হবেনা গৌরিকুন্ড থেকে। আর আমাদের পাঁচদিনের পরিকল্পনাও যাবে ভেস্তে। বসে বসে দুশ্চিন্তা করা ছাড়া উপায় নেই। অথচ দেখুন, বেইমান মন বললো, এইটাই ভালো, পরিকল্পনা ভেস্তে গেলে ওই সাংঘাতিক গাড়িতে কম চড়তে হবে।
ঘণ্টা দুই পর দেখলাম সামনের বাঁকের মাথায় দাঁড়ানো বাসটা নড়ে উঠে চলতে শুরু করলো। আমরা গাড়িতে চড়লাম। রাস্তা এখনো অনেক দূর বাকি। গুপ্তকাশী থেকেই গৌরিকুন্ড প্রায় ৩৩ কিলোমিটার। পাহাড়ি হিসেবে এক ঘন্টার রাস্তা। আর রুদ্রপ্রয়াগ থেকে গুপ্তকাশী ৪৫ কিলোমিটার। রুদ্রপ্রয়াগ ছাড়ানোর পর খুব বেশী হলে আমরা ৫-৬ কিলোমিটার এগিয়েছি। মানে পাক্কা আড়াই ঘন্টার ধাক্কা। এদিকে ঘড়িতে প্রায় চারটে বাজতে চললো। অন্ধকারে বিক্রমের গাড়িতে বসতে হবে? বিক্রম নতুন গুটখার প্যাকেট মুখে ঢেলে যা বললো, তার সারমর্ম হলো, দিনের আলো থাকতে থাকতেই আরামসে সে আমাদের গৌরিকুন্ড পৌঁছে দেবে। এইবার পড়লাম উভয় সংকটে। ওপরেও বুদ্ধুর বাপ, নিচেও বুদ্ধুর বাপ। একদিকে বিক্রম আমাদের আড়াই ঘণ্টার রাস্তা সোওয়া ঘন্টায় পৌঁছে দেবে বলেছেঅন্য দিকে, যদি না পৌঁছয়, তো বিক্রমের গাড়িতে, রাতের অন্ধকারে হিমালয়ে চড়তে হবে। হায়রে, এখানে মন্দাকিনিতে পড়লে আমাদের হয়ে কেউ রাস্তাও অবরোধ করবেনা। শেষে সব কিছু “বাবা”র ওপরেই ছেড়ে দিলাম। আপাতত সোওয়া ঘন্টা আমাদের ভাগ্য গুলো স্টিয়ারিংএ জড়িয়ে নিয়ে বিধাতা, বিক্রম হয়ে আক্ষরিক অর্থেই আমাদের “ড্রাইভ” করবেন। কথায় বলে অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। অধিক আতংকে কি হয়, সে ব্যাপারে বাংলা প্রবচন নিশ্চুপ। অবশ্য নিশ্চুপ না হয়ে উপায় কি? আতংকে কটা কথা বেরোতে পারে মুখ দিয়ে? তাই বোধহয় অধিক ভয়ে কি হয়, সে ব্যাপারে বাংলায় ভালো প্রবচন নেই। অথবা অত্যধিক ভয়ে মানুষ যা করে, বা করে ফেলে, সে সব ঠিক পরিশিলিত সাংস্কৃতিক উপমায় অচল। সেই সোওয়া ঘন্টা যে কিভাবে কাটলো, তা বর্ননা করার মত ভাষা আমার নেই। ভেবেছিলাম প্ল্যাঁশেৎ (planchet) করে সৈয়দ মুজতবা আলী কে ডাকবো। কিন্তু বড় ভয় হলো। ধরা ধামে এসে আমার লেখার ছিরি দেখে তিনি আমাকে কোতল করবেন, সেই ভয় নয়। ভুতের ভয় আমি আপনাদের মত অত সাহসী নই। কাজেই সে রাস্তা কিভাবে পেরোলাম তার বর্ননা আর দিলাম না। শুধু গুপ্তকাশীতে বিক্রম একটা চায়ের দোকানে গাড়ি থামাতে তিন ভাঁড় চা খেয়েছিলাম দাঁতের কত্তাল বাদ্য কাটাতে, এইটুকু মনে আছে। তার কতটা ঠান্ডায় আর কতটা বিক্রমের গাড়ির জন্যে, কেবল সেইটা মনে নেই।
এ লেখার শিরোনাম, গাড়োয়ালি গাড়িওলা। কাজেই গৌরিকুন্ডে নেমে, পরের দিন কেদার পৌঁছনো, আর তার পরের দিন ফিরে আসা, সে কিস্যা এ লেখার বাইরেই রাখলাম। হরিদ্বার থেকে রওনা দেবার তৃতীয় দিন দুপুর ১২টায় কেদারনাথ থেকে গৌরিকুন্ডে ফিরলাম। বিক্রমকে খবর দেওয়াই ছিলো। একটু পরেই এসে হাজির হলো। আজকে আমাদের যাত্রা একটূ দীর্ঘ। উখিমঠ, চামোলি হয়ে জোশিমঠে গিয়ে রাত কাটানো। পরের দিন বদ্রীনাথে পৌঁছে বিশ্রাম, আর পঞ্চম দিন, বদ্রীনাথ থেকে ভোর বেলা রওনা দিয়ে রাত ৯টা নাগাদ হরিদ্বার। সেখান থেকে আমাদের ট্রেন রাত ১১টায়। গৌরিকুন্ড থেকে গুপ্তকাশী সেই চেনা রাস্তা। গুপ্তকাশীতে দুপুরের খাওয়া সারা হলো। এবারে গাড়ি উল্টোদিকের পাহাড়ে উঠবে। ওদিকেই উখিমঠ। উখিমঠ হলো কেদারনাথের শীতকালের আশ্রয়। কেদারের মন্দির বন্ধ হয় দিপাবলীতেআবার খোলে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন। বাকি সময় কেদারের পুজো হয় এই উখিমঠে। যদি কখনো শীতকালে এদিকপানে আসেন, উখিমঠে অবশ্যই একটা দিন থেকে আসবেন। এখানে ভারতসেবাশ্রমের যে আশ্রম আছে, সেটা অসাধারন। কলকাতা থেকেই বুক করে আসা যায়। উখিমঠের পরেই রাস্তা ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চললো। রাস্তার দু দিকে বড় বড় গাছ। এই গাছের ফাঁক দিয়ে একবার রোদ এসে মুখে পড়ছে, পরক্ষনেই ছায়া। যদিও আমরা আরো ওপরে উঠছি, তবুও লক্ষ্য করলাম এদিকের রাস্তায় খাদ ক্রমশঃ কমে আসছে। কিছু পরে একটা মোড় ঘুরে বিক্রম গাড়ি দাঁড় করালো। আমরা নেমে প্রথমটা বুঝিনি। তার পরে আদেখলের মতো হাঁ করে চেয়ে রইলাম সামনের দিকে। সামনে হিমালয়ের একের পর এক স্তর। আস্তে আস্তে যত উত্তরে গেছে, উচ্চতা বেড়েছে। আর সবার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে তুষারশুভ্র শৃঙ্গ সমেত হিমাদ্রী। ছবিতে দেখা শৃঙ্গ চিনতে পারলাম। ওইতো কেদার, ত্রিশুল – তিন খানা চুড়া নিয়ে, চৌখাম্বা – যার তলাতেই বদ্রীনাথ, আরো পূর্বে নন্দাদেবী, নন্দাদেবী-ইস্ট, নন্দাঘুন্টি আরো কত চিনতে না পারা শৃঙ্গ। জিজ্ঞেস করে জানলাম এই হলো চোপতা। সামনে ঘাসে ঢাকা জমি ঢালু হয়ে নেমে গেছে নিচে। পেছনের দিকে পাইনের জঙ্গল। হুহু করে হাওয়া। একটা ছবির মত সরকারি গেস্টহাউস দেখলাম, যদিও দরজা জানলা সবই তালা মারা। ইচ্ছে করছিল রাতটা এখানেই থেকে যাই। কিন্তু তখনো বহু দুরের পথ বাকি। এখান থেকে চামোলি ৮০ কিলোমিটার রাস্তা। চামোলি থেকে জোশিমঠ আরো ৪৬ কিলোমিটার। এদিকে দুপুর প্রায় ৩টে বাজে। ৩ ঘন্টায় পাহাড়ি রাস্তায় এতটা পথ যাওয়া সম্ভব? বিক্রমের পরাক্রম হিসেবে রেখেই বলছি।
এবারে রাস্তা উৎরাই। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাক খেয়ে খেয়ে নামা। বিক্রম দেখলাম দিনের মধ্যে প্রথমবার নিজের স্বমহিমায় গাড়ি চালাতে শুরু করলো। এক বার আমি ডানপাশে জানলার কাচের সঙ্গে নাক চেপ্টে ফেলি, তো পরক্ষনেই স্টিয়ারিং উলটো দিকে ঘুরলে প্রায় বিক্রমের ঘাড়ে উঠে বসি। সিট বেল্ট বেঁধে বসলাম। দম আটকে আসছে উৎকন্ঠার চোটে। আমাদের একজন তো বলেই বসলো চামোলিতে নেমে হরিদ্বার ফিরে যাবে। নিচের দিকে নামছি বলে কিনা কে জানে, পেটের ভেতরের তাবৎ বস্তু মনে হচ্ছে ওপর দিকে ঠেলা মারছে। একবার জল খেতে গেলাম। প্রথমে নাকে, তার পরে জামায় এবং শেষে যখন জলের বোতল ধাক্কা খেয়ে পেছনের সিটে গিয়ে পড়লো, ভাবলাম থাকুক গলা শুকনো। ভিজলে নাহয় আর্তনাদটাই খোলতাই হতো। এমন সময় দেখি আমরা নক্ষত্র বেগে চামোলি পেরোচ্ছি। ঘন্টাখানেকের মধ্যে বিক্রম আমাদের চামোলি পার করিয়ে দিয়েছে। ঘড়িতে তখন চারটে পাঁচ কি দশ। চামোলির লোকজন যা দেখেছিলো, তারা তার বর্ননা কাউকে দিয়েছে কিনা জানা নেই। টিনটিনের “ক্যালকুলাসের কান্ড” বইতে একজন ইতালিয় ড্রাইভার আর ইতালিয় গাড়ির বর্ননা আছে। ড্রাইভারের নাম ছিলো বোধহয় “আর্তুরো বেনেদেত্তো গিওভান্নি গিসেপ্পি লুইগি আর্কেঞ্জেলো কার্তোফলি দ্য মিলানো”, সোজা বাংলায় পুন্ডরিকাক্ষ পুরকায়স্থ। সেখানে একটা ছবি আছে, যে ভিড়ে ভর্তি বাজারের মধ্যে দিয়ে এই আর্তুরো , তার ইতালিয় গাড়িতে চড়ে সাঙ্ঘাতিক গতিতে বেরিয়ে যাচ্ছে, আর এদিকে বাজারের ভিড়ে  গাড়ির ভয়ে হুলুস্থুলু কান্ড। চামোলি বাজার আর ভিড়ে ঠাসা রাস্তা দিয়ে পেরোবার সময় ঠিক এরকমই কিছু একটা ঘটলো। চামোলি ছেড়ে এলাম। পেছনে হাওয়ায় ভেসে রইল এক গাদা ধুলো, বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যাওয়া কিছু মুখ, আর বাছা বাছা কিছু গাড়োয়ালি খিস্তি। চামোলি ছাড়িয়ে চার পাঁচ কিলোমিটার এগিয়েই চিত্তির, আর আমাদের থামতে হলো। বিক্রম দেখলাম গাড়ি থেকে নেমে সোনার কেল্লায় ফেলুদার নীল অ্যাম্বাসাডরের রাজস্থানী ড্রাইভার সিংজির মত আমাদের ডাকলো। মন্দার বোস তখনো জেল খাটছে কিনা, বা সে এই রাস্তায় আমাদের আগে যাচ্ছে কিনা, তা জানিনা। কিন্তু আমাদের ফেলুদার মতই অবস্থা হলো। টায়ার পাংচার।
এ জায়গায় লোকবসতি নেই। দোকানপাট কিস্যু নেই। অগত্যা চাকা বদল করে স্টেপনি লাগানো হলো। আবার চলা শুরু। বিক্রম আরো জোরে চালাচ্ছে। জোশিমঠ পৌঁছতেই হবে আজ। পিপলকোটি ছাড়াবার পর আবার ঘন জঙ্গল রাস্তার দু পাশে। আমাদের সঙ্গে রাস্তার ধারে ধারে চলেছে অলকানন্দা নদী। এ রাস্তা জোসিমঠ হয়ে চলে গেছে বদ্রিনাথ।  সেখান থেকে আরো একটু এগোলে ভারতের শেষ জনপদ মানা। এই গ্রামটি পেরোলেই ভারতবর্ষের সীমান্ত। ওপারে মহাচীন। আগে হলে তীব্বত বলতাম। কিন্তু এখন চীন বলাই ভালো। রাস্তায় লোক চলাচল খুবই কম। পিপলকোটির পর দেখছি কেবলই সবজে রঙের বিশাল চাকা ওয়ালা ফৌজি ট্রাক আর জোঙ্গা জিপ চলছে, তাও সংখ্যায় খুবই কম । আর কোন যানবাহন চোখে পড়ছেনা। এমন সময় ঘটলো অঘটন। আবার ফেলুদা। আবার পাংচার। এখানে মন্দার বোস নেই। কিন্তু উটও নেই, যে উটে চড়ে রামদেওরা বা জোসিমঠ যাবো । ফলে এই জঙ্গলের মধ্যে বিপদেই পড়লাম। ভিমবেগে চামোলি পৌঁছে গিয়েছিলাম দাঁতে দাঁত চেপে, বিক্রমের গাড়িকে জোর করে অভ্যেস করে নিয়েই। তাই বোধহয় বিপদ নতুন রূপে হানা দিলো। বিক্রম বললো সামনে তিন কিলোমিটার পরে একটা নদীর ওপর পুল আছে। সেটার ওধারে একটা মিলিটারিদের গাড়ির গ্যারাজ আছে। সে অবধি যেতে পারলে চাকা সারাই হয়ে যাবে। কিন্তু যাই কি করে? বিক্রম দেখলাম চাকাটা খুললো গাড়ি থেকে। স্টেপনিটাও খুললো। তার পর বললো ও আসছে চাকা সারিয়ে নিয়ে। কিন্তু দু খানা চাকা লোকটা নিয়ে যাবে কি করে? চক্ষুলজ্জার খাতিরে বলে দেখলাম আমিও যেতে পারি কিনা। বিক্রমের দেখলাম সে সব চক্ষুলজ্জার বালাই নেই। ঝট করে রাজি হয়ে আমার হাতে একটা চাকা ধরিয়ে দিলো। সে চাকার ওজন এবারে টের পেলাম। আমরা চাকা সমেত হাঁটা দিলাম সামনে। বাকি তিন জন জঙ্গলের মধ্যে বসে রইল গাড়ির দরজা জানলা বন্ধ করে। সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসছে। রোদ অনেক আগেই চলে গেছে। এখন আবছা আলো, আধো অন্ধকার। তিন কিলোমিটার হেঁটে পেরোলাম। চাকা কখনো কাঁধে, কখনো রাস্তায় গড়িয়ে। পুলের সামনে যেতেই কয়েক জন উর্দি পরা ফৌজি আটকে দিলেন। ব্রীজে ওঠার ঠিক আগে, প্রায় ১০০ মিটার রাস্তায় টাটকা ধ্বস নেমেছে।তখনো ওপর থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ছে সমানে। তাই যাতায়াত বন্ধ। কি গেরো। এ তো দেখছি বাবার ভরসায় আর থাকা যাচ্ছে না। কাকা জ্যাঠাদের ধরেও টানাটানি করতে হবে। একের পর এক শুরু হয়েছে সেই দুপুর থেকে। তিতিবিরক্ত হয়ে আমার বাংলাই-হিন্দিতে সামনের অফিসারটিকে ধরে বোঝাতে লাগলুম। তিনঠো আদমী এক খোঁড়া গাড়িমে বৈঠা হ্যায়, গাড়ি ভাগ নেহি পায়েগা, গাড়িকা ফূটো চাকা হামারে হাত মে হ্যায়। জঙ্গল মে শের, ভালু, হাথী আয়েগা আউর তিনঠো আদমী কো খা লেগা। অফিসার স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। তার পরে বললেন – “দৌড়ে চলে যান, চাকাটা মাথায় তুলে নিন, মাথাটা আড়াল হবে। থামবেন না কিছুতেই, আর একদম পেছনে তাকাবেন না”, হ্যাঁ, বাংলাতেই বললেন, পরিস্কার বাংলায়।
ছাতা ছাড়া বৃষ্টিতে রাস্তায় হাঁটলে কেমন অসহায় লাগে। কোথাও কোন আচ্ছাদন নেই মাথাগোঁজার। শুধু ভিজে যাও। উপায়ন্তর নেই। এ ক্ষেত্রেও অনেকটা একই রকম মনে হলো। যদিও মাথা বাঁচাবার জন্যে গাড়ির চাকাটা আছে। কিন্তু ওপর থেকে জলের বদলে পড়ছে পাথর। তার কোনোটা ফুটবলের মত, কোনোটা টেনিস বলের মত, আবার কোনোটা নুড়ি বা মাটির ঢেলা। সামনের একশ মিটার রাস্তা, আমার কাছে আমার জীবনের দীর্ঘতম আর কঠিনতম একশ মিটার দৌড়। ওস্তাদ দৌড়িয়ে আরামসে দশ সেকেন্ডে দৌড়ে দেবে এ দুরত্ব। আমার হয়ত আরো এক সেকেন্ড বেশী লাগবে। কিন্তু পাথরের তলায় চিঁড়ে চ্যাপ্টা হতে তো লাগে মোটে এক সেকেন্ডই সময়। ওদিকে অন্ধকারে তিনজন গাড়ির ভেতর বসে। আর সত্যি বলতে কি, ওরা এসেছে আমারই ওপর ভরসা করে। কি করি? চাকাটা মনে হচ্ছে যেন বিশমনী ভারি। এখানে সাহায্যের কেউ নেই। বিক্রমের দিকে দেখলাম। চাকাটা এক হ্যাঁচকায় মাথার ওপর তুলে নিলো, আর গুটখার পিক ফেললো পিচিক করে। পায়ের চটিটা খুলে পাশে সরিয়ে রাখলো। তার পর দৌড় শুরু করলো। আমার পায়ে জুতো, গুটখা নেই মুখে, কাজেই থুথু ফেলারও কিছু নেই। ভারি চাকাটা মাথায় তুললাম। তারপরে কি জানি কেন, ঠিক বিক্রমের মতই থুঃ করে থুথু ফেললাম মাটির ওপর, ভয়ের ওপর, আশঙ্কার ওপর, দ্বিধার ওপর। লম্বা লম্বা পায়ে দৌড় শুরু করলাম। আমার থেকে অন্ততঃ পনের মিটার আগে দৌড়চ্ছে বিক্রম। রাস্তাটা ধুলোয় ভর্তি, সমানে ওপর থেকে হড়হড়িয়ে নেমে আসছে পাথর আর মাটির স্তুপ। কেন জানি মনে হলো বিক্রম যে জায়গাটায় আছে, ওটাই একমাত্র নিরাপদ। ওকে ধরতে হবে। সামনে বিক্রমের ঝাপসা হতে থাকা অবয়ব, চারিদিকে পাথর পড়ার আওয়াজ, রাস্তায় পাথর পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে অলকানন্দার দিকে চলে যাচ্ছে। সে পাথর গুলো লাফিয়ে পেরোতে হচ্ছে, যে কোন একটা পায়ে পড়লেই শেষ। মাথার ওপরে অতখানি ওজন নিয়ে দৌড়নো, দম যেন ফেটে যাচ্ছে। কানে একটা ঝিম ধরা তালা লাগার মত শব্দ। চোখে ধুলো পড়ে প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা। তবু দৌড়ে চলেছি। পেছনে যারা গাড়িতে বসে আছে তাদের জন্যে নয়। নিজের মাথা বাঁচাবার জন্যে নয়। ওই সামনের লোকটাকে ধরবার জন্যে। ওকে ধরতেই হবে। ওর ওই থুঃ করে থুথু ফেলার মধ্যেই আছে নিরাপত্তা, বিপদ কে পাত্তা না দেওয়া বেপরোয়া পৌরুষ। কতক্ষন দৌড়েছিলাম জানিনা। দশ সেকেন্ডের কম না বেশি। তবে শেষ দিকে চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ আমাকে কেউ জড়িয়ে ধরে নিলো। “বহোৎ আচ্ছা দওড়তে হো সাব, এক সেকেন্ডকে লিয়ে বাচ্‌ গয়ে। ওহ্‌ দেখো”। চোখে হাত রগড়ে দেখি বিক্রম হাসছে। পেছনে পরে আছে সেই একশ মিটার। আর রাস্তার ঠিক মাঝখানে, চায়ের পেটির মত একটা বিশাল পাথরের চাঙড় পড়ে। আমি দৌড় শুরু করার সময় ওটা ওখানে ছিলোনা। আমাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে ফেলে দিলেও আর একবার ওখান দিয়ে পেরোতে রাজি নই আমি।
ব্রীজ পেরিয়েই একটা গুমটি দোকান। এক সর্দারজী চাকা দুটো নিয়ে বসে গেলেন। জলে টিউব ডুবিয়ে ডুবিয়ে ছ্যাঁদা খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। মিনিট কুড়ির ভেতর সর্দারজী একটা চাকা ঠিক করে দিলেন। এদিকে ততক্ষনে নদীর ওপারের পাথর বৃষ্টি একটু কমেছে। এদিকে অনেক গুলো ফৌজি গাড়ি আটকে ছিলো এতক্ষন। এবারে তারা চলতে আরম্ভ করেছে। তাদেরই একটা গাড়ি বিক্রমকে চাকা সমেত তুলে নিলো। আমি রয়ে গেলাম দোকানে বাকি চাকাটা সারাবার জন্যে। দোকানে একটা হ্যাজাক জ্বলছে হিস্‌হিস্‌ শব্দ করে। এই হ্যাজাক বস্তুটা বাংলার শহরাঞ্চলে একেবারেই বিলুপ্ত এখন। ওখানে হ্যাজাক দেখে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। দোকানের অন্য দিকে একটি ছেলে দেখি পাম্প দেওয়া স্টোভ ধরিয়ে চা করতে লেগেছে। বিকেল থেকে যা গেছে, চা খাওয়ার কথা মনেই আসেনি। আমি অবশ্য নিয়মিত চা খাই না। তবে বাইরে বেরোলে খাই। ছোকরা বিনা বাক্যব্যায়ে আমার হাতে একখানা চায়ের গেলাস ধরিয়ে দিলো একটু পরে। চারিদিকে এখন অন্ধকার। চাকা সারানোর টাকা পয়সা বিক্রমই দিয়ে গেছে। আমার কিছুই করার নেই। দোকানের পাসে একটা কাঠের বাক্সের ওপর বসে রইলাম। ধ্বসের পাথর পড়া কমে গেছে। আর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। ওদিকে ঘন অন্ধকার। একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে কতক্ষন সময় চলে গেছে খেয়াল করিনি। হঠাৎ দেখি নদীর ওপারে দুটো আলোর বিন্দু এগিয়ে আসছে দুলতে দুলতে। একটা গাড়ি। আমাদেরই গাড়ি। গাড়িটা একবার দাঁড়ালো। কেউ নামলো, কিছু একটা খুঁজলো পা দিয়ে, তারপরে আবার চলতে শুরু করলো। আমাকে তুলে নিলো দোকানের সামনে থেকে।বিক্রম বললো, ওর চটিটা, দৌড় শুরুর আগে খুলে রেখেছিলো, সেইটা এখন আবার পায়ে পরে নিলো। এতক্ষন চটিটা রাস্তার ধারেই পড়েছিলো।
রাত-বিরেতে পাহাড়ের রাস্তা নিরাপদ নয়। তার ওপরে কেদারনাথ থেকে আমরা বেরিয়েছি ভোর ছটায়। সবাই খুবই ক্লান্ত আমরা। এ অবস্থায় আর জোশিমঠ পৌঁছনো সম্ভব নয়। দোকান থেকে ৩ কিলোমিটার এগিয়ে একটা জায়গা পাওয়া গেল। একটা দোতলা বাড়ি, নিচেটা ধাবা। যদিও এই রাত্রে লোকজন কেউ নেই। একটা সিঁড়ি উঠে গেছে সোজা দোতলায়, সেখানে একটা বারান্দা। সেখানে দেখলাম দুটো দরজা। ধাবা চালায় একটি পরিবার। বাপ মা আর তাদের গোটা কয়েক ছেলে মেয়ে। বড় মেয়েটি প্রায় ১৬-১৭, ছোট ছেলেটি এখনো পাঁচ পেরোয়নি। মাঝে আরো ২ জন। মহিলা আমাদের নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলেন। হাতে একটা কাচের ডিশের ওপর মোমবাতি। দরজার তালা খুলে ভেতরে একটা খুট করে আওয়াজ হলো। ও মা, ঝলমলে আলো জ্বলে উঠলো ঘরে। এখানে তার মানে বিদ্যুৎ আছে। আরো অবাক হলাম ঘর দেখে। হাল ফ্যাশনের ঝকঝকে ঘর। টাইলস্‌ বসানো মেঝে। ইয়োরোপিয়ান কেতার বাথরুম। তাতে জল গরমেরও ব্যবস্থা আছে। সারা গায়ে ধুলোকাদা। কেদারনাথে আগের দিনের বরফ ঠান্ডায় চান হয়নি। সবার আগে জল গরম করতে দিলাম। এরকম ব্যবস্থা আশা করিনি। বিক্রম দেখলাম নিচে একটা খাটিয়া পেতে বসেছে। চান সেরে বেরোতেই গরম গরম চা এলো। আধ ঘন্টা পরেই খাবার এলো, দেরাদুন চালের ভাত, ছোট ছোট ফুলকো রুটি, ঘন ঘন অড়হর ডাল, মশলা মাখিয়ে গোটা গোটা কচি ঢ্যাঁড়শ ভাজা আর ঝাল ঝাল ডিমের কষা। সঙ্গে আচার আর পেঁয়াজ লঙ্কা। চুপ চাপ খাই, আর মনে মনে আশীর্বাদ করি বিক্রমকে। সে আমাদের জোশিমঠ পৌঁছে দিতে পারেনি বটে। কিন্তু সব রকম বিপদ আপদের মধ্যে দিয়ে নিরাপদে পার করে এনেছে, আর এই অভাবনীয় আরামের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লো সবাই তাড়াতাড়ি, কেননা পরের দিন বদ্রীনাথের জন্য রওনা দিতে হবে খুব ভোরে। জোশিমঠের পর থেকে রাস্তা খুব সরু। তাই এক দিকের গাড়িই কেবল চলতে পারে। জোশিমঠে গাড়ি ছাড়া হয় তিন ঘণ্টা পর পর। সকাল সাতটার সময় গোটা ৫০-৬০ গাড়িকে ছাড়া হবে। তারা ২০ কিলোমিটার পর গোবিন্দঘাটে পৌঁছলে তার পর ওদিকের গাড়ি ছাড়া হবে, যারা এদিকে আসবে। সে গাড়ির কাফেলা জোশিমঠ ফিরলে আবার এদিকের গাড়ি ছাড়া হবে। সারা দিন এই চলতে থাকে। আর পুরো ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রন করে ভারতীয় ফৌজ। সকাল ছটায় জোশিমঠ পৌঁছতে হলে, আমাদের আরো অনেক ভোরে বেরোতে হবে। বিক্রম বললো ৫টায় বেরোলেই চলবে। তাই শুয়ে পড়া ভালো।   
সবাই শুয়ে পড়লেও সারা দিনের উত্তেজনার চোটে আমার ঘুম আসছিলো না। ভালো করে চাদর জড়িয়ে বাইরের বারান্দায় দাঁড়ালাম। কোথাও এতটুকু আলো নেই। একমাত্র নিচে কোথাও একটা কূপি জ্বলছে হয়ত আড়ালে। তাতে দেখলাম, বিক্রম চাদর মুড়ি দিয়ে একটা খাটিয়ায় শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। সারা দিনের এই দুরন্ত জীবন। অকুতোভয় আর নানান কেরামতির লোকটা কেমন শিশুর মত ঘুমিয়ে পড়েছে। কেমন একটা মায়া লাগলো দেখে। এটাই ওর জীবিকা। ওর রোজগার। হয়ত বাড়িতে লোকে আশা করে আছে, কটা টাকা নিয়ে ফিরবে কদিন পর। হয়ত এর বাড়িতে, লোক চিন্তায় আছে, কি করছে, খেলো কিনা, কেমন ভাবে আছে এসব নিয়ে। আমরা দুদিন বাদে বাড়ি ফিরে গিয়ে গল্প শোনাবো কেমন অ্যাডভেঞ্চার করে এলাম। কেমন ধ্বসের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে পার হলাম। কিন্তু বিক্রমের কাছে এটা অ্যাডভেঞ্চার নয়। এ হলো ওর জীবনের রোজনামচার একটা পাতা। ভাবুক যখন হয়েই পড়েছি, ভাবলাম আর একটু ভাবি। আকাশের দিকে তাকালাম। এ সব কি? আকাশের গায়ে ছড়ানো অত আলো কিসের? ওই ধোঁয়াটে আলোর মেঘের ব্যাপারটাই বা কি? ও হরি, এ সব তো তারা। আকাশে এত তারা কোনকালে দেখিনি। ছোট বড়, লালচে, নীলচে। আর ওই কি তাহলে ছায়াপথ? ছায়া ছায়া আলোর মেঘের মত একটা কিছু যেন আকাশ চিরে চলে গেছে এপাশ থেকে ওপাশ। এই কি আকাশগঙ্গা নীহারিকা? যার মধ্যে আমাদের সৌরমন্ডলও পড়ে? কোথায় তার শুরু? কত দূরে? এদের সামনে আমি, এই পাহাড়, গাড়োয়াল, ভারতবর্ষ, এই পৃথিবী সব কিছুই কত ক্ষুদ্র, কত সামান্য। কি আশ্চর্য্যই না লাগলো। ধাবাওয়ালার একটা বিটলে দেখতে কালো রঙের কেঁদো চেহারার কুকুর আছে। সেটার ভাবসাব মোটেই সুবিধের লাগে্নি। খচ মচ আওয়াজ পেয়ে দেখি সে ব্যাটা সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে দেখছে। কেমন যেন একটা ক্ষুধার্ত লোভাতুর মুখের ভাব। আমার ভাবুক মন আর বেশী কিছু ভাবার সাহস পেলোনা। ঘরের মধ্যে ঢুকে চাদর মুড়ি দিয়ে আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম।
আমাদের যাত্রার চতুর্থদিন, ভোরের আলো ফোটার একটু আগেই আমরা গাড়িতে যে যার জায়গায় বসলাম। এবারের রাস্তা আগের চেয়ে অনেক আলাদা। খাড়া হয়ে ওপর দিকে উঠছে পাক খেয়ে খেয়ে। খুব অল্প অল্প আলো ফুটছে। একটু পরে বিক্রম হেডলাইট নিভিয়ে দিলো। কিছু পরে নির্দিস্ট সময়ের মধ্যেই আমরা জোশিমঠ এসে পৌঁছলাম, আর গাড়ির লাইনে দাঁড়ালাম। একটু পরেই গেট খুলবে সাতটার সময়।ওপাশের রাস্তা আরো সরু। কোনমতে একটাই গাড়ি যেতে পারে। রাস্তা তবু একটু ভালো গোবিন্দঘাট পর্য্যন্ত। সেখানে আর এক দফা গেট খোলাখুলির ব্যাপার। এই গোবিন্দঘাট থেকে খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে লোকে পায়ে চলা রাস্তায় উঠে পৌঁছে যায় ফুলের উপত্যাকায়। ফুল কি ঘাটি বা ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্সে। ইংরেজি নামটাই অবশ্য বাঙালিদের পরিচিত। ওখানেই আছে হেমকুন্ট সাহেব, শিখদের সর্বোচ্চ তীর্থক্ষেত্র। এ কদিন আকাশ ছিলো ঝকঝকে পরিস্কার। আজ দেখি ধুপছায়ার এলোমেলো খেলা চলছে। অনেক পেছনে “নর্‌” পর্বতের চুড়ায় কালচে মেঘ এসে লেগেছে। ঘন নীল আকাশ, পর্বত শৃঙ্গের শুভ্র তুষার আর মেঘের কালচে – আহা কোন কবি বা লেখক থাকলে কত কি না লিখতে পারতেন। বর্ষার শেষ বলে চারিদিকে আরো অনেক রকম রঙ। আগাছাও হয়েছে প্রচুর। গোবিন্দঘাটের পর রাস্তার আসল রূপ দেখলাম, পাহাড়ের গায়ে সরু এতটুকু দাগ। উচ্চতার কারনে বড় গাছপালাও নেই। শুধু সামান্য ঘাস হয়ে আছে। পাহাড়ের চেহারাও অদ্ভুত। কেদারনাথের রাস্তায় পাহাড় ছিলো শক্ত পাথরের। এখানে পাহাড়ের বেশীটাই নরম ভুরভুরে বালিমাটি আর ছোট বড় গোল গোল পাথর জমানো। এদিকে তাই পাকা রাস্তা তৈরি একরকম অসম্ভব। রাস্তা তৈরি করলেই ধ্বসে যায় দু দিনে। আর আমাদের বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন নিরন্তর লড়াই করে চলেছে এখানে হিমালয়ের সঙ্গে। গাড়ির চাকা বালি পাথরে ঘষটাচ্ছে, পিছলে যাচ্ছে কোথাও। কোন জায়গায় রাস্তার আধখানা নেই। একটু বড় গাড়ি হলেই যেতে পারবেনা আর। বিক্রম দেখলাম আজ অনেক সাবধানে চালাচ্ছে। তাড়াহুড়ো, অহেতুক জোরে চালানো, কোনটাই নেই। খুব সাবধানে একটূ একটু করে এগোতে থাকলাম আমরা। ওদিকে আকাশে রোদ একদম চলে গেছে। বেলা ১১টা হয়ে গেলেও আকাশ প্রায় অন্ধকার মেঘে। বৃষ্টি নামলেই আমরা গেছি। শুনলাম বৃষ্টিতে পাহাড়ের আলগা মাটি ভিজলেই , তাতে আটকে থাকা পাথর আলগা হয়ে হুড়মুড় করে নিচে নেমে আসে। আর এখানে রাস্তা একবার বন্ধ হলে, কখন খুলবে, তা কেউ জানেনা। আশা, আশঙ্কা আর তীর্থ দর্শনের উত্তেজনা সঙ্গে নিয়ে বদ্রীনাথ পৌঁছলাম। যাত্রার সব চেয়ে কঠিনতম পথ, বিক্রম আমাদের পার করে নিয়ে এলো, কোন রকম বিপদের সম্ভাবনা ছাড়াই। আমাদের যাত্রার অন্তিম বিন্দুতে আমরা পৌঁছলাম। এর পর আমাদের শুধু ফেরার পালা।
বদ্রীনাথে আমাদের থাকার পরিকল্পনা ছিলো। ভারতসেবাশ্রমে সেরকমই ব্যবস্থা ছিলো। আমাদের ইচ্ছে ছিলো পরের দিন ভোর বেলা বদ্রীনাথ থেকে বেরিয়ে, রাত্রে হরিদ্বার পৌঁছনো। এক দিনে ৩১৮ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু বদ্রীনাথ দর্শনের পরই আকাশ ক্রমশঃ ঘন অন্ধকার হয়ে এলো। টিপটিপ করে বৃষ্টিও শুরু হলো। আমরা ঠিক করলাম, দর্শন যখন হয়েই গেছে, তখন আর এখানে থেকে গিয়ে লাভ নেই। বরং নিচের দিকে নেমে যাই। সেখানে কোথাও থাকবো। জোশিমঠ পৌঁছতে পারলে খুবই ভালো, সেখানে থাকার ভালো জায়গা পাওয়া যাবে। কিন্তু বদ্রীনাথেও সেই গাড়ির সারি আর গেট খোলা বন্ধের অনুশাসন। কাজেই অপেক্ষা করতে হলো। বেলা ১টায় গেট খুললো। তখন বৃষ্টির একটূ তেজ বেড়েছে। আমরা প্রমাদ গুনতে শুরু করলাম। রাস্তার যা অবস্থা দেখেছি, তাতে করে ভরসা হচ্ছে না। বিক্রমের মুখও গম্ভির। গুটখার প্যাকেট ছিঁড়ে মুখে ঢেলে গাড়ি চালু করলো। রাস্তা আধভিজে, তার ওপরে নরম বালিবালি মাটি আর পাথরের টুকরো। অ্যাশফল্টের রাস্তা নয়। গাড়ির চাকা পিছলে যাবার মোক্ষম সুযোগ। এদিকে পেছনের পাহাড়গুলোতে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, আর আস্তে আস্তে সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। বিক্রমকে সকাল থেকে এই প্রথম বারের মত নিজের স্বমহিমায় ফিরতে দেখলাম। শুধু বললো – আপ লোগ সামহালকে বৈঠিয়ে। গাড়ি পাগলের মতো দুলছে অসমান মাটির ওপর, কাদায় অল্প পিছলেও যাচ্ছে, কিন্তু বিক্রম খুব কায়দা করে বাঁ দিকে পাহাড়ের দেওয়াল, আর ডানদিকে একটু আগে একটা ফৌজি ট্রাককে রেখেছে। আমাদের গাড়ি আছে মাঝামাঝি। কাজেই বিপদ তুলনামূলক ভাবে একটু কম। হনুমান চটি বলে একটা ছোট্ট মন্দির আছে, তার সামনে একটা নালা, যার ওপরে একটা অস্থায়ী সেতু। সে সেতু পেরিয়ে আসতে, রাস্তা একটু ভালো হলো। খানিক আগে এখান দিয়েই গেছি আমরা। বৃষ্টিও একটু কমলো। কিছু পরে গোবিন্দঘাট পেরোলাম। এবারে জোশিমঠ পৌঁছনো নিয়ে কোন আশঙ্কা নেই। বিক্রম আমাদের প্রায় বিকেল সাড়ে তিনটের সময় জোশিমঠ পৌঁছে দিলো। এখানে একটা দোকানে আমরা খেতে বসলাম। খেতে খেতে গতকাল বিকেলেই সেই ধ্বস আর দৌড়ের কথাও এলো। হঠাৎ মনে হলো আবার যদি সেই ধ্বস নামে? রাস্তা আটকায়? কাল তাহলে হরিদ্বার থেকে গাড়ি ধরবো কি করে? চিন্তায় পড়া গেল। বিক্রম বললো তাহলে এখানে না থেমে আরো নিচে চলে যাই। তাহলে ভালোই হবে। চটপট বে্রিয়ে পড়া হলো। এবারে দেখলাম বিক্রমের ওস্তাদি। আবার সেই “আর্তুরো বেনেদেত্তো গিওভান্নি গিসেপ্পি লুইগি আর্কেঞ্জেলো কার্তোফলি দ্য মিলানো”। আপনার এই নাম টুকু পড়তে যতটা সময় লাগলো, বিক্রম সেই টুকু সময়ে আমাদের নিয়ে অন্ততঃ এক কিলোমিটার পেরিয়ে গেছে। আজ ভোরবেলা এসব রাস্তা আমরা পেরিয়েছি, সূর্য্য তখন পূব দিকে উঠি উঠি করছে। আর এখন পড়ন্ত বিকেলে আমরা সেই একই রাস্তায় উলটো দিকে নেমে চলেছি। সূর্য্য ঘুরেছে পশ্চিমে, আর আকাশে মেঘও রয়েছে। সকালে যে রাস্তা দু ঘন্টায় পেরিয়েছি, সেই রাস্তা ৫০ মিনিটে পারকরে এলো বিক্রম। একবার ভাবতে চেষ্টা করলাম, কোনটা ভালো? ধ্বস? না কি গাড়ি সুদ্ধু অলকানন্দায় সমাধি? কিন্তু মনে এলো ওই বিশাল পাথরটার কথা। আর এক সেকেন্ড হলে, আমি যেটার তলায় যেতাম।
কাল রাত্রের ধাবা পেরোলাম। পেরোলাম ধ্বস নামা পুল। পেরোলাম পিপলকোটি। আর কতদুর? নক্ষত্রবেগে গাড়ি ছুটছে। সন্ধ্যের ঝোঁকে ভালো করে বুঝতেও পারছিনা কোথায় এলাম। একটু আগে কর্নপ্রয়াগ পেরিয়েছি এটূকু মনে আছে।  বদ্রীনাথ সাড়ে বারো হাজার ফুটের ওপর। এখন আমরা হুহু করে নিচে নেমে এসেছি। এ জায়গা তিন হাজার ফুট হয় কি না হয়। প্রথমে ঠান্ডা কমেছে। তার পর আরো নিচে নামাতে গরম বাড়ছে ধাপে ধাপে। আবছায়া পাহাড়ের গায়ে দেখতে পেলাম কতগুলো বাড়িঘর। আরো একটু কাছে গিয়ে দেখলাম আমরা রুদ্রপ্রয়াগ পৌঁছে গেছি। দুরত্ব হিসেব করে চমকে গেলাম। ১১৩ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়েছি কেবল জোশিমঠ থেকে। এখনো পাহাড়গুলোর মাথায় দিনের আলো লেগে আছে। পাহাড়ি রাস্তায় খুব ভালো গতিবেগ হলো প্রতি ঘন্টায় ২৫ থেকে ২৮ কিলোমিটার। অনেক সময়েই সেটা ২০ কিলোমিটারের নিচে নেমে আসে। কিন্তু দু ঘন্টার ও কম সময়ে ১১৩ কিলোমিটার, এ তো ভারতবর্ষের সমতলেই প্রায় অসম্ভব এক যদি রাস্তা খুব ভালো না হয়। হোটেল খুঁজতে সময় গেলো কিছুটা। রুদ্রপ্রয়াগে কিন্তু থাকার তেমন ভালো জায়গা পাওয়া গেলো না, সবই প্রায় ভর্তি। কি করা যায় ? এদিকে অন্ধকার হয়ে গেছে। অন্ধকার রাস্তায় হিমালয়ের ওপর বিক্রমের গাড়িতে? ভেবে দেখলাম, সবই যখন হলো, তখন এটাও আর বাকি থাকে কেন? বিক্রম বললো  আরো ৩৫ কিলোমিটার সামনে এগোলে শ্রীনগর। এই শ্রীনগর অবশ্য কাশ্মীরের ডাল লেকের ধারের শ্রীনগর নয়। এ হলো উত্তরাখন্ডের শ্রীনগর। উপায়ন্তর না দেখে আবার চড়ে বসলাম গাড়িতে। ঘন অন্ধকারের মধ্যে গাড়ি এগোচ্ছে হেডলাইট জ্বেলে। আমরা সবাই খুব ক্লান্ত। বিক্রমও যে ক্লান্ত, সেটা ওর চোখ দেখে বুঝতে পারছিলাম। টকটকে লাল চোখ। এবারে আমরা রাস্তার ধারে কিলোমিটার লেখা পাথর গুলো পড়তে পড়তে এগোচ্ছিলাম। বিক্রম আগের মতো আর চালাচ্ছিলোনা। হয়ত অন্ধকারের জন্যই। পাহাড়ে হেডলাইট জ্বালালেও দেখা যায় কেবল সামনে কয়েক মিটার। কেননা তার পরেই রাস্তা ঘুরপাক খেয়ে অন্য দিক ধরেছে। কি জানি কেন, এবারে এই ৩৫ কিলোমিটার রাস্তা মনে হচ্ছিলো বড্ড লম্বা। বিক্রম স্টিয়ারিংয়ের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। আমার যদি এতটুকুও উপায় থাকতো ওকে বলতাম গাড়ি থামিয়ে আজকের মত বিশ্রাম নিতে। কিন্তু ইচ্ছেমত দয়ালু হবার স্বাধীনতা কজনের থাকে? একটা বাঁক ঘুরতেই সামনে আলো দেখতে পেলাম। শ্রীনগর শহরের আলো।
দারুন সুন্দর একটা ঝকঝকে নতুন হোটেলের সামনে নিয়ে এলো বিক্রম। তবে জিজ্ঞেস করে জানলাম শ্রীনগর শহরে বিক্রমের চেনাজানা খুবই কম। হোটেলটা কেমন ও বলতে পারবেনা। শুধু বললো বাহারসে তো আচ্ছা হি দিখতা হ্যায়। আমার মনে হলো এ হোটেলের দক্ষিনা কিন্তু ভালোই হবে। চাপা গলায় এই কথা আলোচনা করতে করতে আমরা রিসেপশনের দিকে এগোলাম। পুছ-তাছ করে জানা গেলো, হোটেলের ঘরভাড়া, আমরা যা ভেবেছি, তার চল্লিস শতাংশ মাত্র। আমাদের অবাক হবার পালা। আসলে শ্রীনগরে ট্যুরিস্ট আসবার কোন কারন নেই। যাত্রাপথে যে কজন রাত কাটায় আমাদের মত, তারা ছাড়া কেউ আসেনা। তাই ট্যুরিস্টের গলাকাটা রেট এখানে অনুপস্থিত। গিজারে জল গরম  করে চান সেরে চা খাওয়া হলো। বিক্রম বললো ও গাড়িতেই ঘুমোবে, আর কাল সকাল ৮ টায় বেরোলে ভালো। আর বললো রাতে ভালো করে জল খেতে।আমরা নাকি গত কয়েক দিন অত্যন্ত কম জল খেয়েছি, বিমার পড়তে পারি। বিক্রম কি খেয়েছে, কোথায় শুয়েছে এসবের খোঁজ রাখিনি আমরা। কিন্তু আমরা জল খেয়েছি কিনা, সে খবরও রেখেছে লোকটা। সারা দিনের ধকলের পর বেশীকিছু খেতে ইচ্ছে করছিলো না। বিছানা টানছিলো বলে শুয়ে ঘুম দিলাম। পরের দিন সকালে ঘুম ভেঙে বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে দেখি, শ্রীনগর সত্যিই শ্রীনগর। ছবির মত চারপাশ। আর শহরটা বেশ বড় আর গম্‌গমে। এখানে শুনলাম প্রচুর নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও রয়েছে। চায়ের সঙ্গে অল্প কিছু খেয়ে আটটার সময় রওনা দিলাম আমরা। আজ আমাদের যাত্রার পঞ্চম দিন।
শ্রীনগর থেকে ঋষীকেষ হয়ে হরিদ্বার পৌঁছনোর মধ্যে আর নতুন কিছু ঘটেনি। কেবল আমার একটা ব্যাগের হাতল ছিঁড়ে গিয়ে সে ব্যাগ গাড়ির মাথা থেকে সোজা রাস্তায় পড়ে তিনবার ড্রপ খেয়েও অক্ষত রয়ে গেল। রোগশয্যায় শুয়ে লেখা, এই গপ্পের মধ্যে একটা ক্লান্তিকর দীর্ঘসূত্রতা এসেই গেছে। প্রথমে বেশি ফ্যানাবোনা বলেও প্রচুর ফেনিয়ে ফেলেছি।  হরিদ্বারে ভারতসেবাশ্রেমের চত্তরে এসে নামা হলো গাড়ি থেকে মালপত্র একে একে সব নামানো হলো। ঘড়িতে তখন সকাল ১১টা। যেমন মৌখিক চুক্তি হয়েছিলো, সেই অনুযায়ী টাকা পয়সা বুঝিয়ে দেওয়া হলো বিক্রমকে। বিক্রম টাকা গুলো গুনছে দেখে, আমার বন্ধু পকেট থেকে আরো ২০০ টাকা বের করে ওকে দিলো। বিক্রম টাকাটা নিলো। আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে, এক গাল হেসে বললো
-   দাদা, অওর ৩০০ রুপেয়া দে দেতে, তো তিন দিন মে হি আপকা পুরা সফর করওয়া দেতে হম্‌”
সাদা রঙের ইন্ডিকা গাড়ি বিক্রমের, অবশ্য এতদিনে নিশ্চই সে গাড়ি আর নেই। তাই ওই গাড়োয়ালি গাড়িওলার চেহারার বর্ননাও দিয়ে রেখেছি। হরিদ্বারে কেউ আপনাকে ৩ দিনে কেদার-বদ্রী দেখার প্রস্তাব দিলে, আমার এই লেখাটার কথা একবার স্মরন করে নেবেন।

বৃহস্পতিবার, ৬ জুন, ২০১৩

ভালো ছেলে - তমাল রাহা

ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবীরের রাগে অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।”-------- জসীমউদ্দিন

বাংলা ভাষায় একটা শব্দ আছেভালো ছেলে।অত্যন্ত ভারী শব্দ, বিশেষত যখন এই শব্দটা কারো ঘাড়ে চেপে বসে একবার। ভুক্তভোগী, তাই জানি।ভালো ছেলেআর পোষা কুকুর এর পার্থক্য করাটাও মাঝে মাঝে সমস্যা হয়।ভালো ছেলেমানেই যেন গলায় চেন বাঁধা পোষা কুকুর! খালি মনিবের শিখিয়ে দেওয়া কাজগুলোই করবে আর তারপর পুরস্কার ছুড়ে দেওয়া রুটি
 ভালো ছেলে গালি দেয় না, পড়াশোনা করে, প্রেম- পড়ে না।ভালো ছেলে রাজনীতি করে না
শুরুটা করেছিলেন বিদ্যাসাগর মশায়। সেই যেগোপাল অতি সুবোধ বালকদিয়ে শুরু! সে শুরুর আর শেষ নেই। সব বাবা -মা একটি গোপাল খোঁজেন নিজের সন্তানের মধ্যে। শিক্ষক  খোঁজেন ইস্কুল এ। আর সমাজ খোঁজে সর্বত্র। অন্যায়ের প্রতিবাদ করো না, তাহলে তুমি ভালো ছেলে।যদি একটু প্রতিবাদ করো, গতানুগতিকতার বাইরে তাহলে শুনতে হবেউছ্যন্যে গিয়েছে ছোঁড়া!” কারণ ভালো ছেলেরা শিখিয়ে দেওয়া পথেই চলে। তাদের প্রশ্ন করা মানা
ইডেন হোস্টেল- থাকার সময় দেখেছি সমাজের তথাকথিত ভালো ছেলেদের। যারা প্রেসিডেন্সি কলেজ, গোয়েনকা কলেজ- পড়াশুনো করে। দেখেছি ইউনিভার্সিটি- প্রথম হওয়া ছাত্রকে রোজ সকালে বাংলা মদে মুখ ধুতে। দেখেছি শুধু সময় কাটানোর ছলে একে অন্য কে বাপ-বাপান্ত করতে। কারোর বাবা-মা হোস্টেল দেখা করতে এলে তাকে আগে প্রায় হাত-জোর করে সবাই কে অনুরোধ করতে হত, “আমার বাবা-মা হোস্টেল ঢোকার আর বেরোনোর সময় একটু দয়া করে ঘরের ভেতরে থেকো।হাঁক পাড়তে হতএবার বেরিয়ে এস, লাইন ক্লিয়ার।
 একদিন এক অগ্রজ কে প্রশ্ন করেছিলাম, “আচ্ছা আমরা এরকম করি কেন?”
মানুষ আসলে তো জানোয়ার রে! তাই পাশবিক প্রবৃত্তি আমাদের সবার আছে। ভালো ছেলের লেবেল লাগিয়ে দেওয়ায় আমরা সেটাকে লোকসমাজের সামনে আনতে পারি না। তাই হোস্টেল- বসে এসব করি।
উত্তরটা আজও  মনে আছে।
কে যেন বলেছিলেন “life is not black and white, it is composed of different shades of grey”..... কিন্তু বিদ্যাসাগর মশায় থেকে শুরু। জীবনটাকে সাদা-কালো ভাগ করে দেওয়ার একটা চেষ্টা। একদিকেভলো ছেলেগোপাল এর দল , অন্য দিকে রাখল-রা। কিন্তু কেন? ভালো ছেলে কেন রাজনীতি করবে না? ভালো ছেলে কেন প্রেমিকাকে চুমু খেতে পারবে না? ভালো ছেলে কেন ইচ্ছে হলে কোমর দুলিয়ে নাচবে না? কেন এত রুটিন বাঁধা জীবন?
ভালো রিডিং পড়তে পারতুম ছোটবেলা থেকে। সেটা বোধহয় ক্লাস নাইন। এক সহপাঠী কোনো প্রাপ্তবয়স্ক-দের বই নিয়ে ইস্কুল হাজির। জনগনের ইচ্ছে, তাই রিডিং পরা শুরু করলাম।উফফ, কি শিহরণ জাগানো কথাবার্তা!...... পরেই চলেছি। বাংলার মাস্টার মশায় বিমানবাবু ক্লাসরুম ঢুকে পড়েছেন। কারো হুঁশ নেই। ঘটনা-টা হলো, বকা খেলুম আমি একা। একটাই কারণ। আমি বিমানবাবুর ভাষায়ভালো ছেলে”!  
তমাল, তুমি না আমাদের গর্ব! তোমায় নিয়ে আমাদের, তোমার বাবা-মা এর কত আশা! আর শেষে তুমি কিনা .....? ছিঃ ছিঃ .... তমাল আমি ভাবতেও পারছি না।
শালা ক্লাস এর বাকি পঞ্চাশ-টা ছেলে যেন বনের জলে ভেসে এসেছিল! ওদের বাপ-মা বুঝি ওদের কে অনাথ ঘোষণা করে দিয়েছেন! সেদিন যা রাগ আর দুঃখ হযেছিল তা বলে বোঝানোর নয়। নিজের ওপরে ঘেন্না হযেছিল। কারণ আমিভালো ছেলে।সবার থেকে আমায় আলাদা করে রাখার একটা চক্রান্ত। মধ্যবিত্ত বাবার মধ্যবিত্ত মানসিকতার ছেলে তো! তাই সেদিন বিদ্রোহ করে উঠতে পারি নি।
আবার উল্টোটাও হযেছে অনেক সময়েই।ভালো ছেলে তকমা থাকায় অন্যায় করেও রেহাই পাওয়া গেছে।আজ তার জন্যে আত্মশ্লাঘা হয় বৈকি!
The deal was never a fair one.....
আজ ফিরে দেখতে গিয়ে মনে হয় যে এই তকমাটার জন্যে কত কিছু হারাতে হেছে। বন্ধুদের মা-বাবা কে বলতে শুনতামতমাল কে দেখে শেখ।ফলে বন্ধু বিয়োগ! আমি ওই বয়সে কারোর বন্ধু হয়ে উঠতে পারি নি। ভালো ছেলে হয়েই থেকে গেছি
তাই কলেজ জীবনে আর কোনো সুযোগই ছাড়ার ইচ্ছে হত না। কেউ চেনে না আমায় এই বিরাট কলকাতা শহরে। একটু মন্দ হলে ক্ষতি কি? আমার মত মন্দ হওয়ার টানে মাতাল বেশ কিছু সঙ্গী-সাথিও জুটল। কিন্তুভালো ছেলেহওয়ার পিছুটান যাবে কোথায়? যতই মন্দ হওয়ার চেষ্টা করি, সেইভালো ছেলেজামা টেনে ধরে বলেসাবধান, সাবধান।সব কিছুই চেষ্টা করা হলো। কলাবাগান বস্তি থেকে কেনা নিষিদ্ধ মাংস, ড্রাই-ডে দিনে কিনে আনা ভিস্কি, অথবা ইস্ট বেঙ্গল মাঠে উত্তমকুমার এর বানিয়ে দেওয়া গাঁজার ছিলিম! কিন্তু ওইভালো ছেলেরাস্তা আগলে দাড়ালো। অগত্যা .............
কলেজ জীবন -টা কেটেছে অদ্ভূত এক দো-টানা মধ্যে। ছোট্ট শহর দুর্গাপুর  বয়োজ্যস্ট  মানেই অভিভাবক .... আর সেখান থেকে না জানা শহর কলকাতায় এসেগোপালএর কাছে  “রাখালহওয়ার হাতছানি ...... ইস্কুল জীবনে মেয়েদের পাশাপাশি দাঁড়ানোর সংকোচ আর কলেজ জীবনে তাদেরই পাশে বসে উষ্ম ছোঁয়া- ক্লাস করার ভালো লাগা .... ক্যান্টিন এর রাজনৈতিক তর্ক, সমাজ বদলের স্বপ্ন
....  আবার এরই মাঝে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বাসনা। দ্বন্দ-টা ছিল সমাজ বদলের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাফল্যের মেল-বন্ধন ঘটানোর। আজ হাসি পায়। বুঝতে পারি লক্ষ্য ছিল একটাই। সমাজের চোখে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। বাকি টা ঢপ। ওই যে শিকড় যাবে কোথায়? মধ্যবিত্ত বাবার মধ্যবিত্ত মানসিকতারভালো ছেলেযে!
এরপর বাকি গল্পটা তো খুব সোজা। আর পাঁচটা ভালো ছেলের মত। বাবা-মা এর প্রতি দায়ীত্ব, সংসারের প্রতি দায়ীত্ব, সন্তানের প্রতি দায়ীত্ব। যখন সখ ছিল তখন সঙ্গতি ছিল না। আর যখন সঙ্গতি হলো, তখন শখ আর রইলো না। অন্যের শখ- আমার শখ, অন্যের ভালো লাগায় আমার ভালো লাগা। বিদ্যাসাগর মশায় কি শুনতে পারছেন? আমি সেইভালো ছেলে”, খালি বাবা নামটাই  গোপাল রাখেন নি।আমি কিন্তু আপনার গোপাল-এর আদর্শ উদাহরণ!
হুমায়ুন আহমেদ এর কবিতা-টা তাই বারবার মনে হয়  ........ ঠিক যেন গোপালের রাখাল না তে পারার আফসোস
…........     আমি সম্ভবতখুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
এক কণা জ্যোৎস্নার জন্যে
এক টুকরো মেঘের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো টাওয়ারের একুশ তলায়
হারিয়ে যাওয়া একটি প্রজাপতির জন্যে
       এক ফোঁটা সবুজের জন্যে