রবিবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৯

আটকথা ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য্য

-"বুঝলেন মিত্তিরবাবু, আজ আমি যাকে বলে, একেবারে আহ্লাদে আটখানা!" বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতে লালমোহনবাবু জানালেন। 
সকাল থেকেই ফেলুদা আজ অন্যমনস্ক, কী যেন চিন্তা করছে। মুখ না ঘুরিয়েই উত্তর দিল, "আটখানা কেন বলে, লালমোহনবাবু? সাত বা নয়খানা নয় কেন?" 
লালমোহনবাবু হতভম্ব হয়ে তপসের দিকে তাকালেন। তপসে হেসে বললো, "আপনি বসুন। সকাল থেকে ফেলুদাকে আটে পেয়েছে।" 
-আর্ট? মানে, মডার্ণ আর্ট, নাকি মার্শাল...
-আরে না না, আট সংখ্যাটা। আচ্ছা, আজ কী উৎসব বলুন তো?
এবার লালমোহনবাবু একগাল হেসে বললেন, "এটা নিশ্চিত জানি। আজ হলো গিয়ে জন্মাষ্টমী!" 
-ঠিক। শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন। কিন্তু উনি বেছে বেছে অষ্টমী তিথিতেই জন্মালেন কেন, বলতে পারেন? 
এবার তপসে ধুয়ো ধরলো, "মাসটাও কিন্তু অগস্ট, মানে আট নম্বর!" 
-সেটা বোধহয় গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে আর কিছু মিল পাচ্ছিস কি, আট আর কৃষ্ণের মধ্যে? 
-কৃষ্ণ ছিলেন দেবকীর গর্ভের অষ্টম সন্তান... 
-রাইট। আর কিছু?
কিছুক্ষণ দু'জনেই চুপচাপ। ফেলুদাই বলল "কৃষ্ণের বদলে কংস কাকে হত্যা করতে গেছিলেন, মনে পড়ে?"
তপসে বলে উঠল "মহামায়া! আট হাতের দেবী!"
-ভেরি গুড। আর কৃষ্ণের জন্মদাতা কে ছিলেন?
-বসুদেব! আরে, অষ্টবসু ছিলেন না!
-কানেকশন থাকতেই পারে! আচ্ছা, কৃষ্ণ বললেই আর কোন নামটা মনে পড়ে?
এবার লালমোহনবাবু লাফিয়ে উঠে বললেন, "এটা আমি জানি! রাধা!"
ফেলুদা হেসে বলল, "ঠিক। রে, আর ধা। দ্বিতীয় সুর, ষষ্ঠ সুর। দুইয়ে মিলে কতো হয় বলুন তো?"
দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠলো, "আট!" 
ফেলুদা হেসে বলল, "আর কৃষ্ণ কে যদি বলি কৃ, সা, নি, তাহলে? সা হলো প্রথম সুর, নি হলো সপ্তম। দুইয়ে মিলে?" 
লালমোহনবাবু ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন। "এ তো সাঙ্ঘাতিক কানেকশন মশাই! যাকে বলে, যাকে বলে..."
-"আটার কোইন্সিডেন্স্‌, তাই তো? আসলে কী জানেন, আমার বিশ্বাস, এই সব পুরাণের গল্পগুলো আসলে প্রতীকী। কিন্তু কিসের প্রতীক? আট সংখ্যাটা বারবার এসে কী বোঝাতে চেয়েছে? আমরা যে সাষ্টাঙ্গে, মানে স অষ্ট অঙ্গে প্রণাম করি, তার সঙ্গে কোন সম্পর্ক আছে কি?" 
একটু দম নিয়ে লালমোহনবাবু বললেন, "আহা, আমি আমার পরের উপন্যাসের নাম পেয়ে গেছি!" 
ফেলুদা হেসে বলল, "কী নাম, আটেতে আটকালি?" 
-"নো স্যার, অষ্টের কষ্ট!!" 
হা-হা করে হেসে উঠলো তিনজনেই!

শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৯

আমাজনে আগুন ~ সংগ্রাম চ্যাটার্জী

বোলতার চাকে ঢিলটা মেরে কথাটা ইতোমধ্যেই এসে গেছে যে— গত ক'দিন ধরে জ্বলতে থাকা আমাজন জঙ্গলের আগুন একটা সামগ্রিক চক্রান্তের পরিণতি, এবং এর পিছনে থাকতেই পারে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত NGO গুলো!
আরে! শুধু ঐ NGO গুলোই কর্পোরেটের নিয়ন্ত্রণে আছে! রাষ্ট্র নেই!? মানে একের পর এক দেশের শাসক শ্রেণী কর্পোরেট দ্বারা পরিচালিত নয়?!?

যাই হোক্, পরিবেশ! যে কিনা বর্তমান ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান সামাজিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্র!
এক আমাজন রেইন ফরেস্ট গোটা দুনিয়ার এক পঞ্চমাংশ অক্সিজেন সাপ্লাই দেয়। এ' যদি ধ্বংস হয় তাহলে গোটা পৃথিবীর ইক্যুইলিব্রিয়াম টলে যাবে!
তো? সমস্যা কার? যারা ঘটাচ্ছে?
নাহ্! সব্বার আগে মরবে গরীবস্য গরীব মানুষগুলো। পড়ে থাকবে পৃথিবীর ধ্বংসাবশেষ! আর যারা নিজের হাতে ধ্বংস করছে এই ব্যবস্থা, তারা আরও অনেক অনেক মুনাফা নিয়ে আরও আরামের জীবনের দিকে পা বাড়াবে।

ভারত। আমার দেশ। 
গত পাঁচ বছর ধরে আমার দেশে রাষ্ট্রের সরাসরি মদতে পরিবেশকে কুচলে মারার কাজটা কার্যত 'বুলেট ট্রেন'-এর গতিতে চলছে!!
মধ্যভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পাহাড়-জঙ্গলের ওপর পড়ছে একের পর এক কোপ! পশ্চিমঘাট থেকে শুরু করে আরাবল্লী, বিন্ধ্য— সর্বত্র জল-জমিন-জঙ্গলকে কর্পোরেটকে বেচে দেওয়া অথবা সরাসরি রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে ধ্বংস করার কাজটা চলছে! চলেই যাচ্ছে! সাথে এই বনাঞ্চলকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা হাজারো-লাখো মানুষের ভবিষ্যৎ আজ একটা বড়সড় প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে!!

চাই মুনাফা! শুধুমাত্র অতিরিক্ত মুনাফা!
মহারাষ্ট্রের বিরাট বনাঞ্চল জ্বালিয়ে দেওয়া হল, মধ্যপ্রদেশের হাজার হাজার একর জঙ্গল কেটে সাফ করে দেওয়া হল! বুলেট ট্রেনের নাম করে হাজার হাজার একর ম্যানগ্রোভ অরণ্য ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা হচ্ছে! উত্তরাখণ্ডে প্রায় প্রতি বছর পরিকল্পিত দাবানল হচ্ছে!! হিমালয়ের দুর্গম অঞ্চলে এলাকার পর এলাকা বেচে দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেটকে! আরাবল্লী পাহাড় কেটে সাফ করে দেওয়া হচ্ছে!!
পরিবেশ, বর্তমান ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান সামাজিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্র!

"একটা গাছ—একটা প্রাণ"! এই স্লোগানে গলা মিলিয়ে ঘরে ঘরে গাছ লাগিয়ে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। কারণ... 
কারণ, আপনি-আমি চাই বা না চাই এই সমস্যাটা একান্তই একটি মূলগত রাজনৈতিক সমস্যা। রাজনৈতিক ভাবে এর মোকাবিলা না করে এবং রাজনৈতিক ভাবে এর শত্রুদের কোণঠাসা না করলে এই লড়াইটা জেতা যাবে না। আর, এই লড়াইটা লড়তে হবে জেতার জন্যেই।
(গাছ লাগানোর বিরোধিতা করছি— আমার এই কথা থেকে এই মানে তৈরি করবেন না দয়া করে)

সমস্যাটা যে আমার অস্তিত্বকেই নাড়া দিচ্ছে এখন— এটা আমাজন রেইন ফরেস্টের লাগাতার আগুন আরেকবার— হ্যাঁ, আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে just দেখিয়ে দিল।

আবারও লিখি— পরিবেশ, বর্তমান ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান সামাজিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্র!

ছবিতে জ্বলন্ত আমাজন রেইন ফরেস্ট

অশনিসংকেত ~ প্রসূন আচার্য্য

প্রিয় বন্ধুরা, 
মনে হয় আপনারা এখনো শোভন-বৈশাখী আর কাশ্মীরে 370 ধারা তুলে দেওয়া নিয়েই পড়ে আছেন। শোভনের আধ-বোলে মমতা-মা এর সমালোচনা, রং-মিলন্তি পোশাক, বৈশাখীর প্রসাধন করা মুখ, হাতে আটটি আংটি, আর ওরা কি একসঙ্গেই থাকে ? এই আলোচনায় বাঙালি মশগুল। একটু পিছিয়ে কিন্তু দ্বিতীয় আলোচনার বিষয়বস্তু কাশ্মীর। যাই বলো গুরু, মোদী আর অমিত শাহ বাপ কা বেটা। পাকিস্তানকে দেখিয়ে দিল। জঙ্গিদের ঘরে ঢুকিয়ে দিল। যাক এত দিনে শ্যামাপ্রসাদের আত্মা শান্তি পেল। আর তৃতীয় আলোচনার বিষয়? দিদিকে বলো। প্রশান্ত কিশোর। 2021 আর ক'মাস?

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি এবার একটু চোখ তুলে তাকান। তৃণমূলের কিছু নেতা বা কর্মীর দুর্নীতি, সুবোধ থেকে শ্রীজাতদের নব্য-দলদাস হওয়া, মমতার অন্ধ ভাইপো স্নেহের থেকে অনেক বড় বিপদ আজ আমাদের দোর গোড়ায়। আমরা এক ভয়ংকর আর্থিক মন্দার মধ্যে দ্রুত প্রবেশ করেছি। কোনও বাংলা বড় সংবাদমাধ্যম এ কথা বলছে না। ভয়। দিল্লির বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাবে। ঠিক যেমন দিদির পুলিশ রাতের অন্ধকারে আলো নিভিয়ে মহিলা পার্শ্বশিক্ষিকাদের উপর মধ্যযুগীয় কায়দায় লাঠিপেটা করে তাঁদের ব্লাউজ ছিঁড়ে দিলেও মিডিয়া চুপ করে থাকে, ঠিক তেমনি।  আমি প্রথম শ্রেণীর মিডিয়ায় চাকরি করেও বলছি, শাসকের কাছে এমন নতজানু মিডিয়া আমি 31 বছর সাংবাদিকতা জীবনে কোনোদিন দেখিনি। অবশ্য সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও একই ছবি।

বিশ্বাস করুন, মোদী-শাহ- নির্মলা সীতারামন তিনজনেই জানেন, সরকারের হাতে টাকা নেই। আজই স্টেট ব্যাংক বলেছে, এটিএম কার্ড বন্ধ করে দেবে। নতুন এপ্স নিয়ে আসবে। কেন ? আসল কারণ, লোকজনের ব্যাংক থেকে টাকা তোলা বন্ধ করতে। অবস্থা কতটা খারাপ একটা উদাহরণ দিই। আপনার হকের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা সরকারের কাছে থাকে। প্রতি বছর 1 এপ্রিল সুদের টাকা জমা হয়। এ বছর হয়নি। নাকি সার্ভার খারাপ। আরে ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় 6 মাসে সার্ভার ঠিক হলো না? গত বছরও একই যুক্তি ছিল। পিএফের টাকা সরকার ধার নেয়। বিভিন্ন খাতে খাটায়। তারপর সুদ সমেত ফেতৎ দেয়। এটাই নিয়ম। এই বছর আজও গত বছরের টাকা ফেরত দেয়নি। দিলে খাতা কলমে এক লাখ কোটি টাকা শুধু সুদ দিতে হবে। সরকারের কাছে সেই টাকা নেই। জিএসটি থেকে আয় হলে দেবে। 

আপনারা ভাসা ভাসা জানেন বিএসএনএল এর অবস্থা খারাপ। জানেন কি, শুধু কলকাতায় যাঁরা লাইন-ম্যান হিসেবে কাজ করেন, সেই 4800 কর্মচারী গত জানুয়ারির পর কোনো বেতন বা টাকা পায়নি। সাত মাস ধরে কী করে তাঁদের পরিবার চলছে তাঁরাই জানেন। অনাহারে অসুস্থ হয়ে ইতিমধ্যে 7 জন মারা গেছেন। কলকাতায় এই মুহূর্তে 25 হাজার ল্যান্ড লাইন খারাপ। দিন দিন সংখ্যা বাড়ছে। কাজ করার লোক নেই। ভাবছেন জিও তো ব্রড ব্যান্ড নিয়ে আসছে। চিন্তা কি! এই মুহূর্তে বিএসএনএল এর জন্য সরকারকে দিতে হবে মাত্র 14 হাজার কোটি টাকা। তাহলেই 1 লাখ 75 হাজার কর্মী সেইসঙ্গে ঠিকাদার ও শ্রমিক মিলে 5 লাখ পরিবার বাঁচবে। মাত্র 14 হাজার কোটি কেন বললাম ? রিলায়েন্স এর ব্যাংকের কাছে ধার প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা! সিংহভাগ জি ওর জন্য। বুঝছেন ব্যাপার টা? এয়ারটেল এর ধার এক লাখ কোটির ওপর।

লোকের হাতে টাকা নেই। ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে না। এই মুহূর্তে দেশের 30 টি বড় শহরে 12 লাখ 80 হাজার তৈরি ফ্ল্যাট পড়ে আছে। কেনার লোক নেই। শুধু কলকাতায় 20 হাজারের উপর ফ্ল্যাট অবিক্রিত।

গাড়ি বিক্রি এতই কমে গেছে নয়ডার মারুতি গাড়ির কারখানা থেকে শুরু করে জামসেদপুরের টাটা মোটর এর উৎপাদন ক'দিনের জন্য বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কর্মী ছাঁটাই শুরু হচ্ছে। একই অবস্থা বাজাজ এবং হিরো কোম্পানির। কয়েকশো গাড়ির শোরুম ঝাঁপ ফেলে ব্যাংকে জানিয়ে দিয়েছে, আমরা আর এখন টাকা শোধ করতে পারব না। কম্পিউটার এর জন্য অনুসঙ্গ বানানো কোম্পানি mosar বিয়ার এর মালিক আজই দেনার দায়ে গ্রেফতার হয়েছে। ভিডিওকন আগেই বন্ধ। মালিক বেনুগোপাল ধুত আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, হাজার কোটি টাকা ব্যাংকের দেনা তার পক্ষে শোধ করা সম্ভব নয়। বেশ কিছু সিমেন্ট কারখানা বন্ধ। ঝাড়খণ্ডের জয় বালাজি স্টিল কোম্পানি দু দিন হল উৎপাদন বন্ধ করেছে। কারণ ইস্পাত এর বাজার নেই। টাটা স্টিল ও ওই পথ নিতে পারে। গত দুই মাসে শুধু ঝাড়খণ্ড এ বেকার হয়েছে 3 লাখ শ্রমিক। লোকের হাতে টাকা না থাকায় বা থাকলেও খরচ করতে ভয় পাওয়ার ফলে হোটেলে খাওয়া কমেছে। সাবান থেকে বিস্কুট সব কিছুর বিক্রি কমছে। অর্থাৎ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের আয়ের যে অন্যতম উৎস GST সেখানেই বিপুল ঘাটতি দেখা দিতে চলেছে। কী ভাবে এই অবস্থা সামাল দেবে মোদী এন্ড কোং তা জানেন না। 

আজই কাপড় কলের মালিকরা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছেন, বস্ত্র শিল্পের অবস্থা খুব খারাপ। বাজার নেই। কাপড় কলের মধ্যে তিনভাগের একভাগ এই বছরই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। লোকসান করায় মিল মালিকরা ব্যাংকের টাকা শোধ করতে পারছে না। ওদের হিসেবেই তুলো চাষিদের নিয়ে কয়েক কোটি মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে খেয়ে পরে বাঁচে। তাঁদের ভবিষ্যৎ কী কেউ জানে না। বিদেশে রফতানিও কমেছে দ্রুত। তার থেকেও বড় কথা ক মাস বাদেই নতুন তুলো উঠবে। তার বাজার মূল্য 80 হাজার কোটি টাকা। বিক্রির বাজার না থাকলে মিল মালিকরা তা কিনবে কেন? কিংবা আরও সস্তায় কিনবে। ফলে তুলো চাষিদের আত্মহত্যা আরও বাড়বে। এই বছরই আবার ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানার ভোট। রাজনৈতিক দল গুলো তার জন্যে টাকা তুলবে! 

গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো কাশ্মীর। সেখানে কাশ্মীরি জনগণের মৌলিক অধিকার বন্দুকের বেয়নেট এর জোরে কেড়ে নিতে প্রায় 6 লাখ সেনা নিয়োগ করতে হয়েছে। তার বিপুল খরচ। কোনো যুদ্ধের থেকে খুব কম নয়। তা কিন্তু জোগাতে হবে। কারণ কাশ্মীর আগ্নেয়গিরির মত ফুটছে। ফ্যাসিস্টদের পরিয়ে দেওয়া কাজলে আমরা এতটাই অন্ধ, তা দেখতে পাচ্ছি না। আর মোদী-ভক্ত দালাল মিডিয়া দেখাচ্ছে, সব স্বাভাবিক।

পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে একটাই পথ সরকারি সম্পত্তি বিক্রি। লাভের মুখ দেখা বেঙ্গল কেমিক্যাল থেকে অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি সব বিক্রি করে দাও। রেলের টিকেট বিক্রি থেকে IRCTC সব বেসরকারি হাতে তুলে দাও। আরে কিনবে কে? পরিষেবা দেবে কে ? তা জানি না। তিন বার দরপত্র হাঁকার পর  আজ অব্দি কেউ air India কিনলো না!

প্রতিবাদ করলেই UAPA  আছে। আপনাকে দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়া হবে। কংগ্রেস কার্যত ভোকাট্টা। দুর্নীতিগ্রস্থ বিরোধীদের জন্যে  ED, CBI, IT আছে। তারাও মুখ বুঁজে আছে। অন্য ধান্দা করছে।

এ রাজ্যে আমাদের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য মমতা আছেন। যিনি গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত বিরোধী পক্ষ মানেন না। আট বছর ধরে মানুষ তাই দেখছেন। সিপিএম, কংগ্রেস এতদিন তাই বলছিল। এখন মুকুল থেকে শোভন, তাঁর তৈরি সাধের তৃণমূলের একদা ডান ও বাম হাত আজ বিজেপিতে গিয়ে একই কথা বলছেন। আর আছে কাট মানি। আর আছে দিদিকে বলো। 

বাঙালি, চোখ বন্ধ করে থাকলে কিন্তু প্রলয় বন্ধ হবে না।

প্রসূন আচার্য। সাংবাদিক ও সমাজকর্মী।

বৃহস্পতিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৯

প্রসঙ্গ চিদাম্বরম, গণতন্ত্রের কালো দিন ~ বাসব রায়

এফআইআর-এ নাম ছিল না, প্রাথমিকভাবে তিনি অভিযুক্তও ছিলেন না, তবু জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যেভাবে অভিযান করে সেনাবাহিনী কতকটা সেই ঢঙেই চিদাম্বরমকে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে সিবিআই। আইএনএক্স মিডিয়া মামলায়।
গতকাল দিল্লি হাইকোর্টে চিদাম্বরমের পূর্ববর্তী জামিনের আবেদন খারিজ হয়ে যায়। এর প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টে জামিনের আবেদন করলে, শুক্রবার সেই শুনানি হবে জানিয়েছে শীর্ষ আদালত। মাত্র ৪৮ ঘণ্টা পরই সুপ্রিম কোর্টে শুনানির ফলাফল এসে যেত। তবু চিদাম্বরমকে গ্রেফতার করতে সিবিআই এত তাড়াহুড়ো করল কেন?
এমন তো নয়, যে মামলায় চিদাম্বরমকে সিবিআই হেফাজতে নিল, স্বাধীন থাকলে চিদাম্বরম তাতে কোনো প্রভাব ফেলতে পারতেন। কেননা ঘটনাটা অনেক পুরনো। তিনি এখন আর মন্ত্রী নন যে সরকারের কোনো সিদ্ধান্তে প্রভাব খাটাতে পারবেন। ৪৮ ঘণ্টা পর তাঁকে হেফাজতে নিলে কী অসুবিধে হত সিবিআইয়ের?
এবং এই প্রশ্নের মধ্যেই চিদাম্বরমকে হেফাজতে নেওয়ার রহস্য লুকিয়ে আছে। আইএনএক্স মিডিয়া মামলার এফআইআর-এ চিদাম্বরমের নাম ছিল না, সেই মামলার কোনো চার্জশিট এখন পর্যন্ত সিবিআই দিতে পারেনি, তারপরও তাঁকে গ্রেফতারের দাবি হয়তো সুপ্রিম কোর্টে খারিজ হয়ে যেত। আর এটাই হতে দিল না সিবিআই। 
ঘটনা হল, সিবিআইয়ের আইএনএক্স মিডিয়া মামলার পাশাপাশি ইডিও একটি মামলায় চিদাম্বরমকে জড়িয়েছে। সেটা হল এয়ারবাস কেনার মামলা। তাই একবার সিবিআই একবার ইডি, এই চক্কর কাটতে হবে চিদাম্বরমকে। তারপর কিছুদিন থাকতে হবে জেলে। জামিন পাওয়া এত সহজ হবে না তাঁর, বেশ কিছুদিন তাঁর কথাবার্তা আমরা শুনতে পারব না।  
আইএনএক্স মিডিয়া মামলায় ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায় নাম করেছেন চিদাম্বরমের। সম্ভবত তিনি ওই মামলায় অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী হবেন। মজার ব্যাপার হল, চিদাম্বরমকে যাঁর কথার ভিত্তিতে আজ সিবিআই হেফাজতে নিয়েছে, তিনি হলেন সহ-অভিযুক্ত, যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিজের কন্যাকে হত্যা করার। এখন তাঁকেই সিবিআই বিশ্বাস করছে। শুধু একটা কথা, চিদাম্বরম ছিলেন ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বর্তমান সরকারের কোনো চুক্তি যদি পরে প্রমাণ হয় অনৈতিক ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বলে, আমরা কি এমন দেখব যে এই সরকারের বড় বড় মন্ত্রীকে আজকের মতোই সিবিআই গ্রেফতার করছে!
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন চিদাম্বরম, সে ৩৭০ ধারা বিলোপ কিংবা দেশের বেহাল অর্থনীতি, প্রসঙ্গ যাই হোক না কেন। 
তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধকরণ, ৩৭০ ধারা বিলোপ, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের বিধিভঙ্গের হুমকি, গরু-রক্ষা, মুসলমান-ত্রাস, এনআরসি, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল... এই সব ঢেউ একদিন থেমে যাবে, রাজনীতি হবে নিস্তরঙ্গ। তখন উঠে আসবে জগতের আদি ও অনন্ত চাহিদা – খিদে। আর তখন মানুষ প্রশ্ন করবে... 
বিশ্বাস করুন, মোদী-শাহ-নির্মলা সীতারামন তিনজনেই জানেন, সরকারের হাতে টাকা নেই। আজই স্টেট ব্যাংক বলেছে, এটিএম কার্ড বন্ধ করে দেবে। নতুন অ্যাপ নিয়ে আসবে। কেন? আসল কারণ, লোকজনের ব্যাংক থেকে টাকা তোলা বন্ধ করতে। অবস্থা কতটা খারাপ একটা উদাহরণ দিই। আপনার হকের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা সরকারের কাছে থাকে। প্রতি বছর 1 এপ্রিল সুদের টাকা জমা হয়। এ বছর হয়নি। নাকি সার্ভার খারাপ। আরে ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় 6 মাসে সার্ভার ঠিক হলো না? গত বছরও একই যুক্তি ছিল। পিএফের টাকা সরকার ধার নেয়। বিভিন্ন খাতে খাটায়। তারপর সুদ সমেত ফেরত দেয়। এটাই নিয়ম। এই বছর আজও গত বছরের টাকা ফেরত দেয়নি। দিলে খাতা কলমে এক লাখ কোটি টাকা শুধু সুদ দিতে হবে। সরকারের কাছে সেই টাকা নেই। জিএসটি থেকে আয় হলে দেবে।
আপনারা ভাসা ভাসা জানেন বিএসএনএল এর অবস্থা খারাপ। জানেন কি, শুধু কলকাতায় যাঁরা লাইন-ম্যান হিসেবে কাজ করেন, সেই 4800 কর্মচারী গত জানুয়ারির পর কোনো বেতন বা টাকা পায়নি। সাত মাস ধরে কী করে তাঁদের পরিবার চলছে তাঁরাই জানেন। অনাহারে অসুস্থ হয়ে ইতিমধ্যে 7 জন মারা গেছেন। কলকাতায় এই মুহূর্তে 25 হাজার ল্যান্ড লাইন খারাপ। দিন দিন সংখ্যা বাড়ছে। কাজ করার লোক নেই। ভাবছেন জিও তো ব্রড ব্যান্ড নিয়ে আসছে। চিন্তা কী! এই মুহূর্তে বিএসএনএল এর জন্য সরকারকে দিতে হবে মাত্র 14 হাজার কোটি টাকা। তাহলেই 1 লাখ 75 হাজার কর্মী সেইসঙ্গে ঠিকাদার ও শ্রমিক মিলে 5 লাখ পরিবার বাঁচবে। মাত্র 14 হাজার কোটি কেন বললাম? রিলায়েন্স এর ব্যাংকের কাছে ধার প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা! সিংহভাগ জি ওর জন্য। বুঝছেন ব্যাপার টা? এয়ারটেল এর ধার এক লাখ কোটির ওপর।
লোকের হাতে টাকা নেই। ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে না। এই মুহূর্তে দেশের 30 টি বড় শহরে 12 লাখ 80 হাজার তৈরি ফ্ল্যাট পড়ে আছে। কেনার লোক নেই। শুধু কলকাতায় 20 হাজারের উপর ফ্ল্যাট অবিক্রীত।
গাড়ি বিক্রি এতই কমে গেছে নয়ডার মারুতি গাড়ির কারখানা থেকে শুরু করে জামসেদপুরের টাটা মোটরের উৎপাদন ক'দিনের জন্য বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কর্মী ছাঁটাই শুরু হচ্ছে। একই অবস্থা বাজাজ এবং হিরো কোম্পানির। কয়েকশো গাড়ির শোরুম ঝাঁপ ফেলে ব্যাংকে জানিয়ে দিয়েছে, আমরা আর এখন টাকা শোধ করতে পারব না। কম্পিউটার এর জন্য অনুসঙ্গ বানানো কোম্পানি mosar বিয়ার এর মালিক আজই দেনার দায়ে গ্রেফতার হয়েছে। ভিডিওকন আগেই বন্ধ। মালিক বেনুগোপাল ধুত আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, হাজার কোটি টাকা ব্যাংকের দেনা তার পক্ষে শোধ করা সম্ভব নয়। বেশ কিছু সিমেন্ট কারখানা বন্ধ। ঝাড়খণ্ডের জয় বালাজি স্টিল কোম্পানি দু দিন হল উৎপাদন বন্ধ করেছে। কারণ ইস্পাত এর বাজার নেই। টাটা স্টিল ও ওই পথ নিতে পারে। গত দুই মাসে শুধু ঝাড়খণ্ড এ বেকার হয়েছে 3 লাখ শ্রমিক। লোকের হাতে টাকা না থাকায় বা থাকলেও খরচ করতে ভয় পাওয়ার ফলে হোটেলে খাওয়া কমেছে। সাবান থেকে বিস্কুট সব কিছুর বিক্রি কমছে। অর্থাৎ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের আয়ের যে অন্যতম উৎস GST সেখানেই বিপুল ঘাটতি দেখা দিতে চলেছে। কী ভাবে এই অবস্থা সামাল দেবে মোদী অ্যাল্ড কোং তা জানেন না।
আজই কাপড় কলের মালিকরা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছেন, বস্ত্র শিল্পের অবস্থা খুব খারাপ। বাজার নেই। কাপড় কলের মধ্যে তিনভাগের একভাগ এই বছরই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। লোকসান করায় মিল মালিকরা ব্যাংকের টাকা শোধ করতে পারছে না। ওদের হিসেবেই তুলো চাষিদের নিয়ে কয়েক কোটি মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে খেয়ে পরে বাঁচে। তাঁদের ভবিষ্যৎ কী কেউ জানে না। বিদেশে রফতানিও কমেছে দ্রুত। তার থেকেও বড় কথা ক মাস বাদেই নতুন তুলো উঠবে। তার বাজার মূল্য 80 হাজার কোটি টাকা। বিক্রির বাজার না থাকলে মিল মালিকরা তা কিনবে কেন? কিংবা আরও সস্তায় কিনবে। ফলে তুলো চাষিদের আত্মহত্যা আরও বাড়বে। এই বছরই আবার ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানার ভোট। রাজনৈতিক দল গুলো তার জন্যে টাকা তুলবে!
গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো কাশ্মীর। সেখানে কাশ্মীরি জনগণের মৌলিক অধিকার বন্দুকের বেয়নেট এর জোরে কেড়ে নিতে প্রায় 6 লাখ সেনা নিয়োগ করতে হয়েছে। তার বিপুল খরচ। কোনো যুদ্ধের থেকে খুব কম নয়। তা কিন্তু জোগাতে হবে। কারণ কাশ্মীর আগ্নেয়গিরির মত ফুটছে। ফ্যাসিস্টদের পরিয়ে দেওয়া কাজলে আমরা এতটাই অন্ধ, তা দেখতে পাচ্ছি না। আর মোদী-ভক্ত দালাল মিডিয়া দেখাচ্ছে, সব স্বাভাবিক।
পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে একটাই পথ সরকারি সম্পত্তি বিক্রি। লাভের মুখ দেখা বেঙ্গল কেমিক্যাল থেকে অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি সব বিক্রি করে দাও। রেলের টিকেট বিক্রি থেকে IRCTC সব বেসরকারি হাতে তুলে দাও। আরে কিনবে কে? পরিষেবা দেবে কে ? তা জানি না। তিনবার দরপত্র হাঁকার পর আজ অব্দি কেউ air India কিনলো না!
প্রতিবাদ করলেই UAPA আছে। আপনাকে দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়া হবে। কংগ্রেস কার্যত ভোকাট্টা। দুর্নীতিগ্রস্ত বিরোধীদের জন্যে ED, CBI, IT আছে। তারাও মুখ বুজে আছে। অন্য ধান্দা করছে।
চিদাম্বরমরা এইসব প্রশ্ন করেছেন, করতে চেয়েছেন, করে চলেছেন। আর তাই, তাঁকে এবং তাঁদের যেভাবেই হোক লোহার শিকের ওপারে রাখতেই হবে। 

(সাংবাদিক ও সমাজকর্মী প্রসূন আচার্যের লেখা থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে)

সোমবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৯

মাইকেল ও উৎপল ~ অরিজিৎ গুহ

ম্যাডান থিয়েটার ও নিউ থিয়েটার্সের বহু ও নির্বাক সবাক সিনেমার বিখ্যাত পরিচালক ছিলেন মধু বসু। বিংশ শতাব্দীর তিনের দশকে হিমাংশু রায়ের সাথে জার্মানি গিয়ে বিখ্যাত এমেলকা স্টুডিওতে ক্যামেরার কাজ শিখে দেশে ফিরে এসে বহু নির্বাক ও হিন্দি ও বাংলা দ্বিভাষিক সবাক ছবি পরিচালনা করেছিলেন। বিখ্যাত আলিবাবা সিনেমার পরিচালক ছিলেন উনি। মর্জিনার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তাঁর স্ত্রী সাধনা বসু। এছাড়াও তাঁর নিজের ব্যালের গ্রুপ ছিল 'ক্যালকাটা আর্ট প্লেয়ার্স। ক্যালকাটা আর্ট প্লেয়ার্সই প্রথম ক্ষিরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের আলিবাবা মঞ্চস্থ করে, পরে সেটাই সিনেমা হিসেবে পরিচালনা করেন মধু বসু। 
    মধু বসুর অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন বিখ্যাত কবি সুধীন দত্ত। সুধীন দত্তের ভাঁড়ারে প্রচুর বই ছিল। তাঁর বাবা ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক হীরেন দত্ত। লাইব্রেরির অধিকাংশ বই পিতার সূত্রেই পাওয়া। একদিন মধু বসু সুধীন দত্তের রাসেল স্ট্রীটের ফ্ল্যাটে গিয়ে আড্ডা মারছেন, কথায় কথায় সুধীন দত্ত বলে উঠলেন, মধু তুমি মাইকেলের জীবনী পড়েছ? মধু বসু বললেন পুরো জীবনী পড়া হয় নি, অল্প কিছু কিছু জানি। তখন সুধীন দত্ত নিজের লাইব্রেরি থেকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনীর ওপর দুটো বই নিয়ে এসে মধু বসুকে পড়তে দিলেন। বন্ধুদের মধ্যে বই এর আদান প্রদান হয়েই থাকে। 
   বাড়িতে এসে বই পড়া শুরু করলেন। যতই পড়তে থাকেন ততই চমকিত হতে থাকেন। এত নাটকীয় সঙ্ঘাত মূলক জীবনী আর কারো নেই। মনের মধ্যে মাইকেলের জীবনীর চিত্ররূপ দেওয়ার ইচ্ছে জেগে উঠল। পুরো পড়ার পর মাইকেলের জীবনীর চিত্রনাট্যের খসরা লিখতে শুরু করে দিলেন। 
    হাতে সেই সময়ে কোনো কাজ নেই। মাইকেলের জীবনীর জন্য প্রোডিউসারের খোঁজ করতে লাগলেন। কদিনের মধ্যেই প্রোডিউসার পাওয়া গেল। বাংলা ছবি নরেশ মিত্র'র পরিচালনায় 'স্বয়ংসিদ্ধা' তখন খুব হিট করেছিল। সেই ছবির প্রযোজক মণি গুহ মধু বসুকে দিয়ে ছবি করাতে চান। মধু বসু বললেন গল্প একটা আছে, তার চিত্রনাট্যের খসরাও তৈরি আছে, একবার শুনে নিন। মণি গুহ শুনে বললেন, 'সবই ঠিক আছে, কিন্তু জীবনী কি আমাদের দেশে লোকে নেবে?' মধু বসু বললেন 'দেখাই যাক না'।
   শুরু হয়ে গেল মাইকেল ছবির নির্মাণের কাজ। সাল ১৯৪৯। চিত্রনাট্যের খসরা থেকে সম্পূর্ণ চিত্রনাট্য লিখতে হবে। কবি বিমল ঘোষকে ঠিক করা হল চিত্রনাট্য লেখার জন্য। মাইকেলের বাবার ভূমিকায় অহীন্দ্র চৌধুরি এবং মায়ের ভূমিকার সাড়ে চুয়াত্তর খ্যাত মলিনা দেবীকে মনোনিত করা হল। স্ত্রী হেনরিয়েটার ভূমিকায় ঊষা বলে নতুন একটি মেয়েকে নেওয়া হল। বিদ্যাসাগরের ভূমিকায় অবিনাশ দাস, রেভারেন্ড কে এম ব্যানার্জির ভূমিকায় হরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরি নামে দুজন নতুন শিল্পীকে নেওয়া হল। আস্তে আস্তে রঙ্গলাল, গৌর বসাক, রাজনারায়ন বসু, কালীপ্রসন্ন সিংহ প্রভৃতির জন্যও অভিনেতা অভিনেত্রী পাওয়া গেল, কিন্তু পাওয়া গেল না মাইকেলকে। অনেক খোঁজাখুঁজি করা হল, কিন্তু কাউকেই পছন্দ হয় না। সেট ডিজাইন করা হয়ে গেছে, ক্যালকাটা মুভিটোনে শুটিং হবে তার জন্য স্টুডিওর ডেটও নেওয়া হয়ে গেছে, অথচ মাইকেলকে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষমেশ প্রযোজক মণি গুহ মধু বসুকে বললেন, মধু বাবু, কাউকেই যখন পাওয়া যাচ্ছে না তখন একবার শিশির বাবুকে বললে হয় না?'
মধু বসু অবাক হয়ে তাকালেন মণি গুহ'র দিকে। বললেন, 'কি বলছেন! শিশির ভাদুড়ি এই বয়সে এসে করবেন মাইকেলে অভিনয়? আমি মাইকেলকে দেখাব হিন্দু স্কুলের ছাত্র, শিশির বাবুকে কিভাবে ওই ভূমিকায় মানাবে? মঞ্চে যা মানায় সিনেমায় তা মানায় না। আমি এখনো হাল ছাড়ি নি, ঠিক পেয়ে যাব কাউকে না কাউকে।'
    এর কদিন বাদে একটি ছেলে দেখা করতে এল মধু বসুর সাথে। ছেলেটির নাম জ্যোতি সেন। ইচ্ছে মাইকেলে কোনো একটা ভূমিকায় অভিনয় করার। জ্যোতি সেনের সাথে আরেকটি ছেলে এসে দাঁড়িয়েছিল মধু বসুর সামনে। ছেলেটির চোখমুখ, ব্যক্তিত্ব, চলাফেরা সহজেই আকৃষ্ট করল মধু বসুকে। ছেলেটি মধু বসুকে নমষ্কার করে পরিষ্কার ইংরিজিতে বলে উঠল মাফ করবেন মিঃ বোস, আমি আপনার খুব বড় একজন ভক্ত। সেন যখন বলল আপনার কাছে আসছে তখন আমি আপনার সাথে আলাপ করার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমি নিজেও অভিনয় করি থিয়েটারে, তবে সে সবই ইংরিজি থিয়েটার। মূলত শেক্সপিয়ারের নাটকই করে থাকি।
   মধু বসু কথা বলার সাথে সাথে আকৃষ্ট হচ্ছিলেন বেশি বেশি করে। ইংরিজির উচ্চারণ এত স্পষ্ট যা সাধারণত কোনও বাঙালি ছেলেদের মধ্যে পাওয়া যায় না। কথায় কথায় আরো জানা গেল ছেলেটি সম্প্রতি কলেজ ছেড়ে স্টেটসম্যান পত্রিকার এডিটোরিয়ালে জয়েন করেছে। মধু বসু জিজ্ঞাসা করলেন তুমি বাঙালির ছেলে অথচ ইংরিজিতে কথা বলো? বাংলা যা কয়েকটা বলছ তাও ভাঙা ভাঙা, জড়তা রয়েছে তার মধ্যে। ছেলেটি তখন বলল কলেজে যখন ছিলাম তখন আমার বন্ধুবান্ধব সবাই ছিল অবাঙালি। ওদের সাথেই মঞ্চে নাটক করেছি মূলত ইংরিজি নাটক আর কলেজ থেকে বেরিয়েও ওদের সাথেই রয়েছি। তাই বাংলাটা আমার ঠিক বলা হয়ে ওঠে না। ছেলেটি তার নিজের ইচ্ছেপ্রকাশ করে জানাল যে মঞ্চে অভিনয় করলেও তার একবার সিনেমার পর্দায় অভিনয় করার ইচ্ছে রয়েছে। সে নিজেকে পরীক্ষা করে দেখতে চায় তার মধ্যে ক্যামেরা কনসাসনেস আছে কিনা।
   মধু বসু বুঝলেন, হলে একে দিয়েই হবে। ছেলেটির নাক চোখ মুখের ঔজ্জ্বল্য আর ইংরিজি উচ্চারণ যা তাতে ছেলেটি মাইকেলের ভূমিকায় একদম যেন পার্ফেক্ট। কিন্তু একটাই খটকা। ছেলেটির বাংলা উচ্চারণ। তাও মধু বসু তাকে বললেন পরদিন আসতে।
     পরদিন আসার পর মধু বসু তাকে বললেন, 'তোমাকে আমি মাইকেলের ভূমিকা দিতে চাই।' ছেলেটি অবাক হয়ে বলল কিন্তু শুটিং তো আর মাত্র পনেরো দিন বাদে শুরু হবে! এর মাঝে সংলাপ যা বেশিরভাগই অমিত্রাক্ষর ছন্দে তা কি আমি পারব? মধু বসু বললেন আমার ওপর ছেড়ে দাও ব্যাপারটা। তুমি শুধু অভিনয়ের ওপর জোর দাও।
   এরপর থেকে শুরু হল রিহার্সাল। দৈনিক ৫-৬ ঘন্টা ধরে চলত রিহার্সাল। স্টেটসম্যানের অফিস ছুটি হওয়ার পর বিকেল ৫ টা থেকে শুরু করে কোনো কোনোদিন রাত বারোটা একটাও বেজে যেত রিহার্সাল করতে গিয়ে। শুটিং শুরু হওয়ার দু একদিন আগেই ছেলেটি পুরোপুরি তুলে নিল মাইকেলের সংলাপ অমিত্রাক্ষর ছন্দ সহ।
  শুটিং শুরু হওয়ার পর ছেলেটিকে পরীক্ষা করার জন্য মধু বসু তার প্রথম দিনের শুটিং ফেললেন তখনকার দিনের নামকরা অভিনেত্রী মলিনা দেবীর সাথে যিনি মাইকেলে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করছিলেন। অবাক হয়ে মধু বসু লক্ষ্য করলেন নামকরা অভিনেত্রীর উলটোদিকে দাপটের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করে গেল ছেলেটি। সেটের সবাই নবাগতকে দেখে তার অভিনয় দেখে খুবই খুশি। 
   এরপরে কোনো একদিন শুটিং এ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। মাইকেল জ্বরে পড়ে আছেন আর জ্বরের ঘোরে উত্তেজিতভাবে আবৃত্তি করে চলেছেন, স্ত্রী হেনরিয়েটা মাইকেলের ঘাড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সংলাপ বলছেন। একটা বড় দৃশ্য যেখানে মাইকেল জ্বরের ঘোরে কথা বলে যাবেন। দৃশ্যের শুটিং করতে গিয়ে দেখলেন সেট আলো সব রেডি, ক্যামেরাম্যান ক্যামেরা নিয়েও তৈরি, কিন্তু মাইকেলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজ খোঁজ শুরু হল, মেক আপ রুম, ক্যান্টিন, বাথরুম কোথাও নেই। শেষে অন্য একটা ফ্লোরের এক কোণায় পাওয়া গেল সে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে রয়েছে। মিধু বসু তার কাছে গিয়ে বললেন, কি ব্যাপার? এখানে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছ? তোমার শরীর খারাপ নাকি? তাহলে শুটিং প্যাক আপ করে দিচ্ছি। ছেলেটি তখন তাড়াতাড়ি খাট ছেড়ে উঠে বলল, না না, আসলে জ্বরের ঘোরের দৃশ্যের শুটিং তো, তাই একটু মুডে আসার চেষ্টা করছিলাম।
   মধু বসু স্বগোতক্তি করলেন, শুটিং এর বাকি সবাই যখন হাসি ঠাট্টায় মেতে রয়েছে, তখন কাজের প্রতি কতটা নিষ্ঠা থাকলে নিজের চরিত্রের মধ্যে সব সময় ডুবে থাকা যায় তা একে দেখে শিখতে পারে সবাই। সেদিন থেকেই উনি বুঝে গেছিলেন ছেলেটি একদিন বিরাট বড় শিল্পী হবে।
    মাইকেল যথারীতি রিলিজ করল। দর্শকদের মন জিতে নিল মাইকেলের ভূমিকায় প্রথমবার সিনেমায় অভিনয় করা উৎপল দত্ত।

     নিজেকে উনি বলতেন আমি শিল্পী নই, প্রোপাগান্ডিস্ট। কিন্তু প্রোপাগান্ডিস্ট হওয়ার জন্যও শিল্পকে গভীরভাবে আত্তীকরণ করতে হয়। শিল্পের মধ্যে থাকতে হয়। যেটা উনি পেরেছিলেন। ১৯ শে আগস্ট তাঁর ছাব্বিশ তম প্রয়াণ বার্ষিকী।

রবিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৯

এক যে ছিল ফেরিওয়ালা ~ শ্যমলেন্দু সিনহা

তখন সবে গ্রাজুয়েট হয়েছি। না না রেজাল্ট বেরোয় নি তখনো। সে কালে অনেকদেরী করে বেরোতো রেজাল্ট। কিন্তু আমার তো অত দেরী করার উপায় নেই। তখনই আমার তিন বছরের পুরোনো প্রেমটা পেকে গেছে ফোঁড়ার মত। টনটনে ব্যাথা। যে কোনো দিন একটু অসতর্ক হলেই ফেটে যাবে ব্যথার চূড়োটা। মানে সানাই বাজিয়ে কোনো গোঁফ ওয়ালা দামড়া সেরে ফেলবে ফুলশয্যা আমার ফোঁড়ার, না না প্রেমিকার সাথে। যে কোনো একটা চাকরী চাই তখন।
যাতে ওই রহস্যময়ী, বাড়ীতে বলতে পারে আর একটু অপেক্ষা করতে চাই আমরা। বেকার প্রেমিক অনেকটা তখনকার দিনে, আজকালকার দিনের এইচ আই ভি পজিটিভের মত। কোনো চারিত্রিক দোষ নাও থাকতে পারে, তবে মেয়ের বাবার চোখে, কোনো রকম সন্দেহেরই উর্দ্ধে নয়। ওই পেঁয়াজ খাওয়া থেকে শুরু করে, আর কি....। একটা ৫০০ টাকার চাকরী করলেও, লড়াকু, সভ্য, ভদ্র, আর কিছু না হোক, ধর্মের ষাড় তো নয়। এইসব সাতপাঁচ ভেবেই পরীক্ষা দিয়েই খুঁজছিলাম কিছু। তখনই এক পাড়ার জেঠামশাই বললেন, সেলসের কাজ করবি? ওঁনাদের কলকাতায় একটা চালু ওষুধের দোকান ছিল। বললেন মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ এর কাজ। এক সেকেন্ডেরও কম সময়েই দিলাম উত্তর, করবো।

সব্যসাচী সেদিন ওর ডাক্তারী জীবনের প্রথম দিকের কথা লিখেছে। পড়তে পঢতেই মনে পড়ে গেল আমার চাকরী জীবনের প্রথম দিকের এই গল্পটা। ওরটা ভদ্রসভ্য গ্ল্যামারাস ডাক্তারী, আর আমারটা ডাক্তারদের সাধাসাধি করে তাঁদের দিয়ে ওষুধ বিক্রি করতে চাওয়া, এক নবীন ফেরিওয়ালার গল্প। হোকগে তা লজ্জার রঙে লাল। অপমানের ব্যথায় নীল। ঘামে আর বৃষ্টিতে ভেজা এক যুবকের গল্প। জীবনের রানওয়েতে উড়ানের মৃদুগতির যাত্রাশুরু। তবুও বলতেই হবে, পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, আজকের আমার বুকের গভীরে লুকিয়ে আছে, সদ্য কৈশোর পেরোনো প্রেমিক ফেরিওয়ালাটাও। লাজুক, মুখচোরা মফস্বলের একটা ছেলের রাত্রির অন্ধকারের গল্প। থ্যাঙ্ক ইউ সব্য, আমার নিদ্রাবেলাকে জাগিয়ে দেওয়ার জন্য।
পরেরদিনই চলে গেলাম কলকাতা, জেঠামশাই এর ওষুধের দোকানে। ওখান থেকে বাগরী মার্কেটের গলির গলি, তস্য গলির শেষে একটা ঘরে। বাগরী মার্কেটের ওই বাড়ীটায় যাদের যাতায়াত আছে তাঁরা জানেন, ওটা লক্ষ্ণৌ এর ভুলভুলাইয়ার ছোটভাই এটা। এই বাড়ীর একটা ঘরেই ওষুধের কোম্পানী। দুটো তাঁদের ওষুধ। কাশির আর হজমের। সিরাপ। কোনো ট্রেনিং নেই। মালিক বসেই ছিলেন ঘরে। আর আমার মত কিছু ধর্মের ষাড় না হতে চাওয়া ছেলে। কে জানে ওদেরও একটা ভয় আছে নাকি, অন্য লোকের দুঃস্বপ্নের ফুলশয্যার! তা দেখলাম মালিক খুব অমায়িক লোক। বললেন দেখুন দুটো ওষুধ আমরা বানাই। বাঙ্গালীর প্রিয় রোগ কাশির আর হজমের গন্ডোগোলের। ডাক্তারদের একদম জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। ওরা কাশী আর হজম নিয়ে মোটা মোটা বই পড়েছে। আপনার কাজ ওষুধ বেচা। সোজাসুজি বেচা না। ডাক্তার আপনার ওষুধের নাম প্রেসক্রিপশনে লিখবে, রোগী দোকানে গিয়ে আমাদের ওষুধ কিনবে। আমার লাভ হবে। আপনি মাইনে পাবেন। আপনার কাজ প্রথম কদিন এলাকায় ঘুরে ঘুরে ডাক্তারের নাম যোগাড় করা, যাদের বেশী রুগী। তারপর দেখা সেই রুগীরা কোন দোকান থেকে ওষুধ কেনে। সেই ওষুধের দোকানে আমাদের ওষুধ রাখতে হবে। ডাক্তার লিখলে দোকানদারের বাপও আমাদের ওষুধ রাখবে। আমাদের করণীয় নাকি খুব সহজ!!! ডাক্তারকে দিয়ে আমার ওষুধটা প্রেসক্রাইব করানো। নিজেকে প্রেমিক হিসেবে প্রমাণ দেওয়ার জন্য এটুকু তো করতেই হবে।

তবে এটুকু যে কেমন কাজ, টের পেলাম ধীরে ধীরে। বুঝলাম জীবনটা শালা কেবল মান্না দের গান আর সুনীল গাঙ্গুলীর কবিতা না। এই দুটো প্রিয় লোক আমার পরম শত্রু হয়ে দাঁড়ালো। এই দুটো লোকের জন্যই আমার জঘন্য রেজাল্ট। এঁদের জন্যই আমি এঁচোড়ে পাকা। এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি?  মাঝখানে নদীরূপী জীবনে, হাবুডুবু খায় কেরিয়ার। ডাক্তাররা কত পড়াশুনো করে ডাক্তারীতে চান্স পেয়েছে। তারপর রুগী তাঁদের পয়সা দিয়ে দেখায়। ভালো ওষুধ দিয়ে তাড়াতাড়ি সুস্থ করাই তাঁদের কাজ।গতকাল গজানো "জগাছা ফার্মাসিউটিকালস" এর কাশির আর হজমের ওষুধ তাঁরা প্রেসক্রিপশনে লিখবে কেনো? এটা তাঁদের ক্যারিয়ারের প্রশ্ন। রোগীর স্বাস্থ্যের প্রশ্ন। তিনি তো সবসময় ভালো কোম্পানির পরীক্ষীত ওষুধটাই খেতে বলবেন রোগীকে। তবে, এসব তো অনেক পরের কথা। প্রথম দিন ভারী চামড়ার ব্যাগটা নিয়ে বেড়িয়েছি সকালে। ধোপদুরস্ত জামা কাপড় পরে। আর দেখতেও তখন এমন জলহস্তীর মত ছিলাম না। কিন্তু আমার ঠাঁটবাট দেখে কোনো শালা জানতেই পারেনি, আমার মাইনে কেবল আড়াইশো টাকা। কোনো যাতায়াত ভাড়া নেই। চকচকে ব্যাগটাই দেখছে সবাই। কাচের বোতলে ভরা কাশির আর হজমের সিরাপের বোতলের ভারে আমার কাঁধ যে ব্যথা করে রাতে জানেই না কেউ। আমি খান্নার মোড় থেকে হেঁটে শিয়ালদা, বেলেঘাটা ঘুরে ফিরে আসি, ফ্যানহীন মেঝের পাতলা বিছানায় শুই জানেই না কেউ। রিক্সাওয়ালা আর ঠেলাওয়ালাদের পাশে বসে বড়রাস্তার ধারে একটা ছোট ঘরে বসে আমি চারটে রুটি খাই আাচার দিয়ে, একটাকায়। আমার উপার্জনের ডিনার। সকালে চিড়ে আর চিনি জল দিয়ে মেখে খাই। দুপুরে চারটাকায় ভাত ডাল তরকারী। রাত্তিরে শুই পরেশনাথের মন্দিরের পাশে  অনুকুল ঠাকুরের মন্দির আছে, পাঁচতলা বাড়ী। তার উপরের তলার একটা হলঘরে। সাত আটজন পাশাপাশি । বিনাপয়সায় থাকা। এক ভক্তদাদা খুঁজে দিয়েছিল ডেরা। তবে বিশ্বাস করুন আমি একটুও মহান সাজার জন্য বলিনি এসব। আদতে এগুলো যে কোনো কষ্ট বা জীবনযুদ্ধ জানতামই না। আমার খালি মনে হ'ত ভালো কিছু চাকরী পাওয়ার আগের দিনগুলোও বেকার থাকা যাবে না। আর মফস্বলের বাড়ী থেকে রোজ দুবেলা এসে তো ফেরিওয়ালার কাজ করা যায় না। একটা কথা মনে পড়ে কেবল। প্রথম পূজোয় এক মাসের মাইনের কিছু বেশীটাকা বোনাস পেয়েছিলাম প্রথম বছর। একটা মায়ের জন্য শাড়ী আর একটা প্রেমিকার। মায়ের শাড়ীটাও প্রেমিকাই দিল পছন্দ করে। ১৭০ টাকা দাম। নিজেরটা ১৬০ টাকা। আর ভাইয়ের একটা জামার কাপড়। সব টাকা শেষ। এত ভালো পুজোর বাজার আর করিনি জীবনে। আজ প্রায় চল্লিশ বছর পেরিয়ে শুনি বউয়ের মুখে, অত ভালো শাড়ী নাকি আর সে পায়নি কখনো। আজ জানি আমি টাকা কত কিছু পারে। আজ এও জানি আমি টাকা সবকিছু পারেনা কখনো।

গুমোট গরমে ঘুম ভেঙ্গে যায় কোনো কোনো দিন মাঝরাতে। আমার শত্রুর কবিতা মনে পড়ে যায়। যার পাগলামীতে আমর লেখাপড়াই হ'ল না ভালো। সেই সুনীল গাঙ্গুলীর কবিতা। 

"নীরা তুমি অমন সুন্দর মুখে তিনশো জানলা
খুলে হেসেছিলে, দিগন্তের মত কালো বাঁকা টিপ,
চোখে কাজল ছিল কি? না ছিল না
বাসস্টপে তিনমিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ...."

মাঝরাতে বৃষ্টি নামতো কোনো কোনো দিন, বৃষ্টির ছাঁটে ঘুম ভেঙ্গে যেত বারোয়ারী ঘরে। খানিক গুজগুজ ফিসফাস নড়াচড়া সেরে আমার এপাশ ওপাশের প্রতিবেশীরা আবার ঘুমাতো। আমার চোখের নীচে জলন্ত বৃষ্টির ফোঁটা আমায় ঘুমাতে দিত না। বহুদূরে থাকা একজনের জন্য মনে আসত..... মনে পড়তো কয়েকটা লাইন, 

"তুমি ভয় পেয়ো না, তুমি ঘুমোও, আমি বহুদূরে আছি
আমার ভয়ঙ্কর হাত তোমাকে ছোঁবে না, এই মধ্যরাত্রে
আমার অসম্ভব জেগে ওঠা, উষ্ণতা, তীব্র আকাঙ্খা ও
চাপা আর্তরব তোমাকে ভয় দেখাবে না,
আমার সম্পূর্ণ আবেগ
শুধু মোমবাতির আলোর মত ভদ্র হীম,
শব্দ ও অক্ষরের কবিতায়
তোমার শিয়রের কাছে যাবে।  '

একদিন গেছি, এক ডাক্তারের চেম্বারে, খুব ভীড়, বসে আছি তো বসেই আছি, খিদেও পেয়েছে বেজায়। আমার আবার ছোটবেলা থেকেই খিদে পেলে অভিমানী হয়ে যাই। সে যাক, অবশেষে ডাক্তারবাবুর ঘরে গেলাম। অসীম অবজ্ঞায় আমার সিরাপ দুটো দেখলেন। আমি বললাম যদি কয়েকটা প্রেসক্রাইব করেন ভালো হয়। রেগে গেলেন। বললেন কেন লিখবো? আপনার এই এক্সপেকটোরেন্টার দাম ছ'টাকা পঞ্চাশ। বেনাড্রিলের দাম ছটাকা। নামী কোম্পানিরটা না লিখে আপনারটা কেন লিখবো? এখানে ভিজিট দিয়ে যারা দেখাতে আসে আমি তাদের নামী কোম্পানীর ওষুধই প্রেসক্রাইব করবো। আমার বোধহয় খিদেতে মাথার ঠিক ছিল না। বললাম স্যার আপনারা প্রেসক্রাইব করেই তো বেনাড্রিলকে বা তাঁর কোম্পানীকে বিখ্যাত করেছেন। কে জানে ওনারও বোধহয় খিদে পেয়েছিল। মুখঝামটা দিয়ে বের করে দিলেন ঘর থেকে। কত ধাক্কা যে খেয়েছি সে সময়। মনখারাপ হ'ত। শনিবারে বাগড়ী মার্কেটে মালিকের সাথে মিটিং। মাখন মাখানো পাউরুটি, কলা, আর মিষ্টি ছিল বাঁধা টিফিন। আর সাথে মালিকের হুল ফোটানো কথা। আমরা সব অকর্মণ্য, ফাঁকিবাজ ইত্যাদি। সব টিফিন বিস্বাদ হয়ে যেত।

কিছু ডাক্তার খুব ভালো ব্যবহার করতেন। বাড়ীর গল্প করতেন সময় থাকলে। আর এই একবছরের কিছু বেশী সময় ধরে যা শিখেছিলাম, তা অমূল্য। ফেরিওয়ালা হওয়ার মত বিশ্ববিদ্যালয় আর নেই। আপনি অপমানিত হচ্ছেন, ধাক্কা খাচ্ছেন, আবার আশায় বুক বেঁধে, আপনার পশরার বোঝাটাকে ক্লান্ত কাঁধে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, পথ হাঁটছেন। সব ব্যথা বুকে চেপে পরের দোকানদারের কাছে গিয়ে হাসিমুখে দাঁড়াচ্ছেন। এটা যে কি থ্রিলিং, কি চ্যালেঞ্জিং, বোঝানো অসম্ভব। নিজের ভাঙ্গাচোরা টুকরোগুলোকে জোড়া লাগিয়ে এগিয়ে যাওয়া। আজ মনে হয় ফিরিই তো করছি আমরা সবাই। বুকে পিঠে বাঁধা অদৃশ্য পিটারা। হয়ত জ্ঞানের, অথবা প্রতিভার, খুব দামী পশরা হয় যদি। কেবল কিছু মানুষের ঝুড়িটা দেখা যায়, এটাই তফাত। 

আর এই যে বারবার নিজেকে মেলে ধরা ক্রেতার সামনে সোজাসুজি। এক শিক্ষা দিয়ে যায় জীবনের। নিরহংকার হও, নত হও, হেরেও যাও বারবার যদি, হেরো হোয়ো না। হয়ত এর পরের মানুষ, অথবা তার পরের মানুষ, কিম্বা নিশ্চিত তার পরের মানুষটা তোমায় খুশীর খবর দেবে। আলো আছে, নিশ্চই আছে, সুড়ঙ্গের শেষে।

আজ বহুবছর বাদে, আমার টেবিলের ওপারে ওরা এসে বসে। ঘামে বা বৃষ্টিতে ভেজা নবীন যুবক। ওরা বেচতে বেড়িয়েছে। অফিসের নানা দরকারী জিনিস। আমি ওদের চোখে, ভাষায়, ওদের ক্লান্তিতে, হতাশায়, শুকনো হাসিতে,  অবিরাম হেঁটে চলা পায়ের ব্যথায় আর বোঝাটানা কাঁধের ব্যথায়, আমাকেই খুঁজে পাই। যদি কিনতে নাও পারি কিছু, জলের বোতল আর চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে, ছু্ঁতে চাই ওদের লড়াই। ওদেরও বুকের গভীরে হয়ত জেগে আছে নিজস্ব 'নীরা'রা ।

ওদের ফিরে যাওয়া শরীরের দিকে চেয়ে অস্ফুটে বলি। প্রতিটা পদক্ষেপে তোরা অজান্তেই পেরোচ্ছিস অন্ধকার। আলোটা আসছে এগিয়ে ধীরে আর নিশ্চিতভাবে। আজকের এই ব্যথা এই অপমান, তোদের হৃদয়ে বাঁচবে, কোহিনূর হয়ে, সারাজীবন ধরে।

তারপর ভালোবাসার এই মায়াবী পৃথিবীতে, বহুবছর বাদে, পাশে বসে তার, বলিস শেষ পংক্তি দুটো,

"নীরা শুধু তোমার কাছে এসেই বুঝি
সময় আজো থেমে আছে"


বৃহস্পতিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৯

স্বাধীনতা ও নৌবিদ্রোহ ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

২৩শে ফেব্রুয়ারি, সকাল ৬টায় বিদ্রোহী নৌসেনারা তুললেন শান্তির সাদা পতাকা, আত্মসমর্পণ এর পতাকা। তাদের চোখে জল, বুকে আগুন। সেই পতাকা তোলার সাথে শেষ হয়ে গেল ইন্ডিয়ান রোয়াল নেভি এর সেই বীরত্বপূর্ণ অভ্যুত্থানের ইতিহাস। 

বোম্বে থেকে করাচি, বাহারিন থেকে সিঙ্গাপুর, ২০,০০০ নৌসেনা, ৭৮ খানা জাহাজ এর যে বিদ্রোহ কাঁপিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত, তাদের সাথে জাতি কি করেছিল ? সেই ভারতের সর্ববৃহৎ তিনটি রাজনৈতিক দল কংগ্রেস, মুসলিম লীগ  ও কম্যুনিস্ট পার্টির মধ্যে প্রথম দুটি দল তাদের পাশে দাঁড়ায় নি। দাঁড়িয়েছিল কেবল কম্যুনিস্ট পার্টি। 

৩০০ এর বেশি শহীদদের স্মৃতিতে কেবল বেদী বানিয়ে জাতি কৃতজ্ঞতা সেরেছে। ওই বিদ্রোহী নৌসেনাদের ঠাঁই হয়নি স্বাধীন ভারত বা পাকিস্তানের বাহিনীতে। সেই বাহিনীর সর্বাধিনায়ক যে লর্ড মাউন্টব্যাটেন। 

সারা রাত তর্কবিতর্ক এর পরে প্রস্তুত হয়েছিল সেই বিদ্রোহী সেনাদের আত্মসমর্পণ এর দলিল। আজ স্বাধীনতা দিবসের দিনে আত্মবিস্মৃত জাতি আরেকবার স্মরণ করুক সেই দলিলের শেষ ক'টি লাইন:-

আমাদের ধর্মঘট ছিল জাতির জীবনে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এই প্রথমবার একই কারণে সেমবাহিনীর রক্তের সাথে সাধারণ মানুষের রক্ত বয়ে গেল। আমরা ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পণ করিনি, করেছি আমাদের নিজেদের জনগণের কাছে"

১৯৪৬ এর ফেব্রুয়ারির ১৮ থেকে ২২ এই ভারত কাঁপানো পাঁচদিনের একটু কথা হোক আজ স্বাধীনতা দিবসে। বোম্বের রাজপথে লরিভর্তি বিদ্রোহীরা আজাদীর স্লোগান দিতে দিতে শহর পরিক্রমা করছে, তাদের একহাতে লেনিন এর ছবি, আর অন্যহাতে নেতাজির। বিদ্রোহী জাহাজ গুলোর মাস্তুল থেকে পতপত করে ওড়া তেরঙ্গা পতাকা, মুসলিম লীগের পতাকার পাশাপাশি সগৌরবে উড়ছে লাল পতাকা।

দেশের স্বাধীনতা এমনি এমনি আসেনি।

সোমবার, ১২ আগস্ট, ২০১৯

কাশ্মীর নিয়ে বামেদের অবস্থান ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

বর্তমানে কাশ্মীর নিয়ে বামেদের অবস্থান নানান বিতর্ক তৈরি হয়েছে,বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলি বামেদের দেশদ্রোহী পর্যন্ত আখ্যা দিয়েছে।কিন্তু একটু ইতিহাসের পাতা ঘাটলেই বামেদের অবস্থান পরিষ্কার হবে যা অখন্ড ভারতের পক্ষ নিয়েই জোর সওয়াল ও কর্মসূচি নিয়েছে লাগাতার।তৎকালীন কাশ্মীর সংকটের সময় কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান কতটা বাস্তব ধর্মী তা সেই সময়ের লেখনী থেকেই স্পষ্ট হয়।

শেখ আবদুল্লার পদচ্যুতির পর কাশ্মীর পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির
পলিট ব্যুরাের বিবৃতি (১৬ই আগষ্ট, ১৯৫৩ সালে 'ক্রসরােড সে' মুদ্রিত ):-

"এডলাই স্টিভেনসনের পরিদর্শনের পর কাশ্মীরের সাম্প্রতিক ঘটনাচক্রের চরম পরিণতি হল সর্দার-ই-রিয়াসৎ কর্তৃক শেখ আবদুল্লার পদচ্যুতি ও কাশ্মীরে নতুন সরকার গঠন,মার্কিন চক্রান্তকারীদের সুরে সুর মিলিয়ে শেখ আবদুল্লা জাতিসংঘ অর্থাৎ আমেরিকার গ্যারান্টিপ্রাপ্ত স্বাধীন কাশ্মীর রাষ্ট্রের আওয়াজ তুলেছিলেন। মন্ত্রিসভা এবং ন্যাশনাল কনফারেন্সের ওয়ার্কিং কমিটির বেশির ভাগ সদস্য এই নীতিকে কাশ্মীরের জনসাধারণের পক্ষে ক্ষতিকারক বলে বিরুদ্ধতা করেছেন। স্বতন্ত্র মর্যাদা এবং ভারতের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সহায়তায়
কাশ্মীরকে গণতন্ত্রে রূপায়িত করবার সব চাইতে বড় গ্যারান্টি 'সীমাবদ্ধ অন্তভুক্তি ও দিল্লী-চুক্তির শর্তানুসারে তারা ভারতের সঙ্গে অব্যাহত ঐক্য- সম্পর্ক রক্ষা করতে চান।কাশ্মীরের জনসাধারণের মধ্যে যথেষ্ট বিভ্রান্তি দেখা দেবে। পাকিস্তান-পক্ষীগণ এবং মার্কিন গুপ্তচরেরা, প্রয়ােজন হলে এমন কি সাম্প্রদায়িক মনােভাব জাগিয়ে তুলেও ভারতের বিরুদ্ধে কাশ্মীরী জনসাধারণকে উত্তেজিত
করবার সুযােগ গ্রহণ করবে। এই উদ্দেশ্যে প্রতিটি দুর্বলতা, সরকারের প্রতিটি দুর্নীতি এবং জনগণের প্রতিটি আর্থিক অসন্তোষের সুযােগ গ্রহণ করবে তারা।গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের দায়িত্ব হল সতর্ক হয়ে সরকারের জনস্বার্থ-বিরােধী প্রতিটি নীতি ও কর্মের বিরুদ্ধে উদ্যোগ নিয়ে জনগণের স্বার্থের সংরক্ষক হওয়া এবং মার্কিনপন্থী সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীলদের মুখােস খুলে দেওয়া।

তাদের বিশেষ ভাবে অবহিত থাকতে হবে যাতে কৃষিসংস্কারগুলি ব্যর্থ হয় এবং গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি ছিনিয়ে না নেওয়া হয়। আরও বেশি সংস্কারের জন্য তাদের দাবি তুলতে হবে।
কাশ্মীরে যে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন তারা হয়েছে তার গুরুত্ব ভারত সরকারকে বুঝতে হবে। তারা লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কৌশলে পড়ে জাতিসংঘে কাশ্মীর সমস্যা উপস্থাপিত করে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের কাশ্মীর সমস্যায় হস্তক্ষেপ করবার সুযােগ করে দিয়েছেন।

জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকের নামে তারা বিপুল সংখ্যক আমেরিকানকে কাশ্মীর থেকে দীর্ঘ ছয় বৎসর ধরে জঘন্য কাজ কারবার চালিয়ে যেতে দিয়েছেন।কাশ্মীর থেকে মার্কিন গুপ্তচরদের হঠিয়ে দেবার কঠিন কর্মনীতি গ্রহণ করবার মত সাহস কি ভারত সরকারের হবে ? ভারত সরকার কি ঘােষণা করবেন যে কাশ্মীরের জনগণই কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণের একমাত্র অধিকারী–তাই জাতিসংঘের মুখােস পরে কোন রকম বৃটিশ অথবা মার্কিন হস্তক্ষেপই
তারা সহ্য করবেন না ?

রাজপ্রমুখ, নিজাম অথবা সর্দার-ই-রিয়াসং ইত্যাদি নামে যে স্বেচ্ছাচার চলে তাকে খতম করে ভারত সরকার কি কৃষক এবং শ্রমজীবী জনসাধারণকে গণতান্ত্রিক সরকার, জমি ও খাদ্যের প্রতিশ্রুতি দেবেন?

কাশ্মীরের জনগণ যদি দেখেন যে ভারত সরকার এবং ভারতের গণ-আন্দোলন তাদের দুঃসহ অর্থনৈতিক অসুবিধা দূর করতে চেষ্টার ত্রুটি করছেন এবং তাদের স্বতন্ত্র মর্যাদাকে শ্রদ্ধা করছেন তবেই তারা ভারতের সঙ্গে অব্যাহত সম্পর্ক রাখবেন।ইতিমধ্যেই হিন্দুমহাসভা এবং জনসংঘের মত সাম্প্রদায়িক কায়েমী স্বার্থসম্পন্ন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি জম্মু ও ভারতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা
ছড়িয়ে এবং ভারতে কাশ্মীরের পুর্ণ অন্তভুক্তির দাবি তুলে কাশ্মীর উপত্যকায় সাম্প্রদায়িকতাবাদী এবং পাকিস্তান-পন্থীদের হাত শক্তিশালী করে তুলেছে।
তারা দাবি করছে যে শেখ আবদুলা সরকারের পদচ্যুতি তাদের জয়লাভ ,কাশ্মীরের পূর্ণ ভারতভুক্তি নিয়ে তারা হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে।

এর চাইতে বড় আত্মঘাতী আওয়াজ আর নেই। কাশ্মীরে পাকিস্তান-পন্থীদের এবং মার্কিন অনুচরদের পরাজিত করবার জন্য এবং বিশেষ করে ভারতের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বাঁচাবার জন্য ভারতের গণতান্ত্রিক শক্তি-সমূহকে জাগ্রত হয়ে শতগুণ বেশি শক্তি নিয়ে লড়াই করে সাম্প্রদায়িক প্রতি- ক্রিয়াপন্থী এবং তাদের আওয়াজ ও কাজকে উৎখাত করতে হবে।

জম্মু ও কাশ্মীরের গণতান্ত্রিক জনগণ, বিশেষ করে ন্যাশনাল কনফারেন্সের কর্মীদের প্রতি কমিউনিস্ট পার্টি আবেদন করছে "স্বাধীন কাশ্মীর উপত্যকা" আওয়াজের আড়ালে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আপনাদের প্রিয় কাশ্মীর উপত্যকার উপর যে থাবা বিস্তার করেছে তার গুরুত্ব আপনারা অনুভব করুন। গত দুই যুগ ধরে মহারাজার স্বেচ্ছাচারী শাসন এবং সামন্ততন্ত্রকে খতম করে নতুন গণতান্ত্রিক কাশ্মীরের জন্য আপনারা যে গৌরবময় সংগ্রাম করেছেন তার কথা আপনার স্মরণ রাখবেন।

১৯৪৭ সালে যে হানাদারেরা কাশ্মীর অধিকার করতে চেয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে আপনাদের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরােধের ইতিহাস আপনারা ভুলবেন না।যারা আপনাদের মার্কিন আধিপত্যের কবলে নিতে চায় আর যারা পূর্ণ অন্তর্ভুক্তির দাবি তুলে যে-স্বাতন্ত্র্য আপনারা পেয়েছেন তাকে ধ্বংস করতে চায় তাদের উভয়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় হয়ে দাড়িয়ে আপনারা সংগ্রাম করুন।এই সংগ্রাম সফল করবার জন্য ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক এক আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তুলুন আপনারা।"

শনিবার, ১০ আগস্ট, ২০১৯

ক্রিমিয়া থেকে কলকাতা ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

সাত সকালে ঘুম ভেঙে গেল ফোনের আওয়াজে। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে একটা নাম আর আরেকটা শব্দ। নামটা না হয় নাই লিখলাম। ধরে নিন ফুলেশ্বরী, ফিরোজা বা ফ্রান্সেসকা। নামে কি বা এসে যায়। নামের পরের শব্দটাই আসল। ওটা দেখেই ফোনটা তুলে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে বলে ফেললাম, "বলুন দিদি, কেমন আছেন?" 

রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি তরঙ্গ বেয়ে উত্তর আসার আগে মনের তরঙ্গে ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে। কোথায় শেষ দেখা হয়েছিল। পালস পোলিও করতে গিয়ে সেই যেই বার ধূলিয়ান এ ঘেরাও হয়ে গেছিলাম ? নাগড়াকাটার চা বাগানের টিলার ওপরে সেই হাতির পালের ভেঙে দেওয়া সাব সেন্টার এর ঘর দেখতে গিয়ে ? পাথরপ্রতিমায় গৃহ সমীক্ষায় খুঁজে পাওয়া কুষ্ঠ রোগী দেখতে গিয়ে নদীর ফেরিঘাটে অপেক্ষায় ? পাঁশকুড়ার ইটভাটায় ম্যালেরিয়া মৃত্যুর অডিট করতে গিয়ে ? কোথায় দেখা হয়েছিল ওই ANM দিদির সাথে ?

ANM শব্দটার সাথে অনেকেই পরিচিত নন। আসুন একটু পরিচয় হোক। অক্সিলিয়ারী নার্স কাম মিড ওয়াইফ। নার্স বলতে হাসপাতালে সাদা ইউনিফর্ম এ যাদের চিরকাল দেখে এসেছেন তাদের থেকে একটু আলাদা। এদের ইউনিফর্ম গোলাপি অথবা হলুদ।

এরা  দেড় বছরের প্রশিক্ষণ শেষে কাজে যোগ দেন। কাজটা মূলতঃ জনস্বাস্থ্যের। প্রতি ৫০০০ লোক পিছু একজন, সেটা বাড়তে বাড়তে কোথাও ১০,০০০ হয়ে গেছে। গ্রামীন এলাকায় এদের একটা সাব সেন্টার বা উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকে। কোনোটা নিজস্ব পাকা বাড়িতে, কোনোটা আবার ভাড়া করা এক বা দু'কামরার চালা ঘরে।

সপ্তাহে পাঁচদিন সেখানে ক্লিনিক খোলা হয়। মূলতঃ মা ও বাচ্চারাই আসে ওই ক্লিনিকে। বাচ্চাদের বিভিন্ন রকম টিকা দেওয়া হয়। প্রসূতি মা'র গর্ভাবস্থার চেক আপ হয়, আয়রন ফলিফার বড়ি দেওয়া হয়। হয় রক্তচাপ মাপা থেকে শুরু করে ছোটখাটো পরীক্ষা যেমন হিমোগ্লোবিন, সুগার, এলবুমিন মাপা। একটু বড় বাচ্চাদের দেওয়া হয় ভিটামিন A সিরাপ, কৃমির ওষুধ। পরানো হয় কপার টি জাতীয় গর্ভ নিরোধক। 

নিয়মিত ওষুধ নিতে আসেন টিবি রুগী, কুষ্ঠ রুগীরা। সামনে বসে ওষুধ খাওয়ানো হয়। ম্যালেরিয়ার রোগ নির্ণয় আর ওষুধ বিতরণ ও হয়। দেশের ড্রাগ এন্ড কসমেটিক আইন অনুযায়ী ডাক্তার ছাড়া কেবলমাত্র এই এ এন এম দিদিরাই ওষুধ প্রেসক্রাইব করতে পারেন। বাচ্চাদের পেট খারাপ এ ও আর এস, সর্দি কাশি, নিউমোনিয়াতে এন্টিবায়োটিক, ম্যালেরিয়া তে ওষুধ।

ক্লিনিক এর বাইরে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরেও নানা কাজ। জন্ম মৃত্যুর রেজিশট্রেশন, বিভিন্ন রোগের সমীক্ষা, সদ্যোজাত আর তার মায়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ছানি রুগী, জ্বরের রুগী খুঁজে বের করা, আর স্বাস্থ্য নিয়ে লাগাতার প্রচার। গর্ভনিরোধক বড়ি থেকে শুরু করে হ্যালাজন ট্যাবলেট বিতরণ। 

ক্লিনিক খোলা থাকে বছরভর। বছরে মাত্র আট দিন বন্ধ। গ্রামে ঘুরে বিরামহীন, লাগাতার কাজ। রোদ, জল, ঝড়, বৃষ্টি সব মাথায় নিয়ে। বন্যা হলেও ছুটি নেই। বরং কাজ বেড়ে যায়। 

গোটা চাকরি জীবন জুড়ে নিতে হয় অসংখ্য প্রশিক্ষণ। জমা দিতে হয় দিস্তা দিস্তা রিপোর্ট, প্রতি সপ্তাহে, প্রতি মাসে। এভাবেই চলে। পদোন্নতির সুযোগ সামান্য। চাকরি জীবনের শেষ দিকে এসে সুপারভাইজার। সেই মাঠে আর ক্লিনিকে। 

সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার স্তম্ভ হিসেবে, ফ্রন্ট লাইন কর্মী হিসেবে এই দিদিরা সকলের কাছে দায়বদ্ধ। পঞ্চায়েত সদস্য থেকে শুরু করে ব্লক এর মেডিক্যাল অফিসার, সবার নজরদারি আর খবরদারি। কাজে গাফিলতি হলে বকুনি। এভাবেই দিন কেটে যায়।

কবির ভাষায়: "ওরা চিরকাল/ ধরে থাকে হাল/ওরা কাজ করে/ নগরে, প্রান্তরে"।

মুঠো ফোনের ও ধার থেকে দিদির গলার আওয়াজ এ সম্বিৎ ফেরে আমার। "স্যার খুব বিপদে পড়ে ফোন করছি। আপনি আমাদের ট্রেনিং দিয়েছিলেন। বলেছিলেন ওষুধ খেলে টিবি সেরে যায়। আমার স্যার নিজের টিবি হয়েছে। MDR টিবি। ভালো হয়ে যাবো তো স্যার ?"

দিনের পর দিন টিবি রুগীর পরিচর্যা করতে গিয়ে রোগ হয়ে যাওয়াটা কিছু অস্বাভাবিক নয়। যতই সতর্কতা নেওয়া হোক। কিন্তু MDR টিবি ? মানে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি। প্রথম সারির ওষুধ আর কাজ করবে না। দ্বিতীয় সারির আরো কড়া ওষুধ দিতে হবে। হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে দিদি কে। 

পেশাগত ঝুঁকি। ফোনের এপার থেকে স্বান্তনা দেওয়া ছাড়া আর কি বা করতে পারি। "দিদি, ভয় পাবেন না। ঠিক ভালো হয়ে যাবেন, দেখবেন। আমরা তো আছি।"

সত্যিই কি আমরা আছি ? ওদের সাথে, ওদের পাশে ? এক শুভ্র বসনা মহিয়সী সেবিকার জন্মদিন উপলক্ষে কয়েকদিন আগেই সারা পৃথিবী জুড়ে পালন হয়েছে আন্তর্জাতিক সেবিকা দিবস, ইন্টারন্যাশনাল নার্সেস ডে। প্রজ্বলিত প্রদীপ হাতে এক নারী। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল।

নাই বা থাকলো সাদা শাড়ি, নাই বা থাকলো হাসপাতালে যন্ত্রণাকাতর রুগীর মাথায় সেবার হাতের চিরন্তন ছবি। আমার কাছে আমার ANM দিদি, নামটা যাই হোক, ফুলেশ্বরী, ফিরোজা কিংবা ফ্রান্সেসকা, সেই তো জ্বালিয়ে তুলেছে হাজার হাজার প্রদীপ। 

গতকাল থেকে এই দিদিরা তাদের পদোন্নতির সুযোগ সহ চাকুরিগত কিছু দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। এখনো অবধি কেবল লাঞ্ছনা আর ঘাড় ধাক্কা জুটেছে এটাই জানলাম। বেশি কয়েজনকে থানায় ধরেও নিয়ে গেছে।

দিন গড়িয়ে রাত। আবার আঁধার নামছে। আঁধার এর মোকাবিলায় দিদিরা নিজেরাই জ্বালিয়েছেন হাজার হাজার আলো খোলা আকাশের নীচে। সেই আকাশের থেকে এবার কি ফ্লোরেন্স এর আশীর্বাদ ঝরে পড়বে অস্নাত, অভুক্ত, নিদ্রাহীন এইসব গোলাপি শাড়ি পড়া দিদিমনিদের ওপর ?

তারাও তো "লেডি উইথ এ ল্যাম্প"। আমার, আমাদের ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল।


শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০১৯

ছিলো গরু ~ সুজাত্ৰ ব্যানার্জী

বেজায় দুর্গন্ধ। গাছতলায় দিব্যি ছায়ার মধ্যে চুপচাপ শুয়ে আছি, তবু গোবরের গন্ধে অস্থির। ঘাসের উপর গরুটা হাগছিল, তাড়ানোর জন্য যেই হ্যাট করতে গিয়েছি, অমনি গরুটা বলল, 'জ্যায় শ্রীরাম!' কি আপদ! গরুটা রামনাম করে কেন?
চেয়ে দেখি গরু তো আর গরু নেই, দিব্যি মোটা সোটা গেরুয়া পরা একটা লোক গোঁফ ফুলিয়ে প্যাট্‌ প্যাট্‌ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি বললাম, 'কি মুশকিল! ছিল গরু, হয়ে গেল একটা চাড্ডি।'
অমনি লোকটা বলে উঠল, 'মুশকিল আবার কী? ছিল একটা রাজ্য, হয়ে গেল দিব্যি একটা বিধানসভা-বিহীন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। এ তো হামেশাই হচ্ছে।'

আমি খানিক ভেবে বললাম, 'তাহলে তোমায় এখন কী বলে ডাকব? তুমি তো সত্যিকারের মানুষ নও, আসলে তুমি হচ্ছ গরু।'
লোকটা বলল, 'মানুষও বলতে পার, গরুও বলতে পার, হনুমানও বলতে পার।' আমি বললাম, 'হনুমান কেন?'
লোকটা বলল, 'তাও জানো না?' ব'লে এক চোখ বুজে ফ্যাঁচ্‌ ফ্যাঁচ্‌ করে বিশ্রী রকম হাসতে লাগল। আমি ভারি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মনে হল, ঐ হনুমানের কথাটা নিশ্চই আমার বোঝা উচিৎ ছিল। তাই থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম, 'ও হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি।'
লোকটা খুশি হয়ে বলল, 'হ্যাঁ, এ তো বোঝাই যাচ্ছে- হনুমানের আ, গরুর র, আর মানুষের দন্ত্য স- হল আরেসেস। কেমন, হল তো?'

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, কিন্তু পাছে লোকটা আবার সেই রকম বিশ্রী করে হেসে ওঠে, তাই সঙ্গে সঙ্গে হুঁ হুঁ করে গেলাম। তারপর লোকটা খানিকক্ষণ গোবরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠল, 'দুর্গন্ধ লাগে তো পাকিস্তানে গেলেই পার।' আমি বললাম, কিন্তু বললেই তো আর যাওয়া যায় না?'
লোকটা বলল, 'কেন? সে আর মুশকিল কী?'
আমি বললাম, 'কী করে যেতে হয় তুমি জানো?'
লোকটা একগাল হেসে বলল, 'তা আর জানিনে? কলকেতা, ডায়মন্ড হারবার, রানাঘাট, পাকিস্তান- ব্যাস্‌! সিধে রাস্তা, সওয়াঘণ্টার পথ, গেলেই হল ।'
আমি বললাম, 'তাহলে রাস্তাটা আমায় বাতলে দিতে পার?'
শুনে লোকটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেল । তারপর মাথা নেড়ে বলল, 'উহুঁ সে আমার কর্ম নয়। আমার নমোদাদা যদি থাকত, তাহলে সে ঠিক বলতে পারত।'
আমি বললাম, 'নমো দাদা কে? তিনি থাকেন কোথায়?'
লোকটা বলল, 'নমো দাদা আবার কোথায় থাকবে? এখানেই থাকে।'
আমি বললাম, 'কোথায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়?'
লোকটা খুব জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, 'সেটি হচ্ছে না, সে হবার যো নেই।'
আমি বললাম, 'কী রকম ?'
লোকটা বলল, 'সে কী রকম জানো? মনে কর, তুমি যখন যাবে দিল্লীতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন টোকিয়োতে। যদি টোকিয়ো যাও, তাহলে শুনবে তিনি আছেন বার্লিনে। আবার সেখানে গেলে দেখবে তিনি গেলেন জেরুসালেম। কিছুতেই দেখা হবার যো নেই।'
আমি বললাম, তাহলে তোমরা কী করে দেখা কর?'
লোকটা বলল, 'সে অনেক হাঙ্গামা। আগে হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় নেই; তারপর হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় থাকতে পারে; তারপর দেখতে হবে, দাদা এখন কোথায় আছে। তারপর দেখতে হবে, সেই হিসেব মতো যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছব, তখন দাদা কোথায় থাকবে। তারপর দেখতে হবে-'
আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম, 'সে কী রকম হিসেব?'
লোকটা বলল, 'সে ভারি শক্ত। দেখবে কী রকম?' এই বলে সে একটা কাঠি দিয়ে ঘাসের উপর লম্বা আঁচড় কেটে বলল, 'এই মনে কর নমোদাদা।' বলেই খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে চুপ করে বসে রইল।
তারপর আবার ঠিক তেমনি আঁচড় কেটে বলল, 'এই মনে কর তুমি,' বলে ঘাড় বেঁকিয়ে চুপ করে রইল।
তারপর হঠাৎ আবার একটা আঁচড় কেটে বলল, 'এই মনে কর অমিত শাহ।' এমনি করে খানিকক্ষণ কি ভাবে আর একটা করে লম্বা আঁচড় কাটে, আর বলে, 'এই মনে কর পুলওয়ামা'- 'এই মনে কর গৌরী লঙ্কেশ গুলি খেল'- 'এই মনে কর দিলীপ ঘোষ বর্ণপরিচয় পড়ছে'
এই রকম শুনতে শুনতে শেষটায় আমার কেমন রাগ ধরে গেল । আমি বললাম, 'দূর ছাই! কী সব আবোল-তাবোল বকছ, একটুও ভালো লাগে না।'
লোকটা বলল, 'আচ্ছা তাহলে আর একটু সহজ করে বলছি। চোখ বোজ, আমি যা বলব, মনে মনে তার হিসেব কর।' আমি চোখ বুজলাম।
চোখ বুজেই আছি, বুজেই আছি, লোকটার আর কোন সাড়া-শব্দ নেই। হঠাৎ কেমন সন্দেহ হল, চোখ চেয়ে দেখি লোকটা 'পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক' লেখা একটা ইয়া বড় ব্যাগ নিয়ে বাগানের বেড়া টপকিয়ে পালাচ্ছে আর ক্রমাগত ফ্যাঁচ্‌ ফ্যাঁচ্‌ করে হাসছে।

কী আর করি, গাছ তলায় একটা পাথরের উপর বসে পড়লাম। বসতেই কে যেন ভাঙা মোটা গলায় বলে উঠল, 'এগারো হাজার চারশো কোটিতে মোট কতগুলো শূন্য?'

বৃহস্পতিবার, ৮ আগস্ট, ২০১৯

কাশ্মীর ও দীন নাথ ~ সমুদ্র সেনগুপ্ত

"১৯৩২ সালে আমি কাশ্মীরি পন্ডিত আন্দোলনের সাথে যুক্ত হই। ভগত সিং আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিলেন। ওনাকে যখন হত্যা করা হয়, শোকে দুঃখে আমরা বেশ কয়েকদিন কোনো খাবার মুখে তুলতে পারিনি। এক টুকরো কাগজে লেনিন এর নামে উচ্ছসিত প্রশংসা করে কয়েকটি লাইন লিখে কাগজটা একটি বোতল বোমার ভেতরে ঢুকিয়ে দি। বোতল বোমাটা এস পি কলেজের লাইব্রেরির বাইরে রাখা ছিল। কয়েকজন ছাত্র সেটা দেখতে পেয়ে হল্লা শুরু করে যদিও বোমাটা ফাটেনি। মিস্টার ম্যাকডারমট, প্রিন্সিপাল পুলিশে খবর দেন"

সেদিনের সেই কাশ্মীরি পন্ডিত বিপ্লবী ছাত্র দিন নাথ পরবর্তী কালে নাদিম ছদ্মনামে কবিতা লিখতে শুরু করে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। (১৯১৬-১৯৮৮)। বাম শিক্ষক সংগঠনের নেতৃত্ব দেন উপত্যকার মাটিতে।

সাহিত্য একাডেমি পুরষ্কার প্রাপ্ত এই কবি ও লেখক এর একটি প্রাসঙ্গিক কবিতা আজ এই অদ্ভুত সময়ে - 

bi g'avi ni az su nagmi kanh 
ti k'azi az - ti k'azi az 
be vayi jayi jayi tapi krayi zan 
b'ehi zag h'ath 
karan chi ayi grayi yuth tsalan 
yi m'on bag h'ath...

I will not sing today, 
I will not sing 
of roses and of bulbuls 
of irises and hyacinths 
I will not sing 
Those drunken and ravishing 
Dulcet and sleepy-eyed songs. 
No more such songs for me ! 
I will not sing those songs today. 
Dust clouds of war have robbed the 
iris of her hue, 
The bulbul lies silenced by the 
thunderous roar of guns, 
Chains are all a-jingle in the 
haunts of hyacinths. 
A haze has blinded lightning's eyes, 
Hill and mountain lie crouched in fear, 
And black death 
Holds all cloud tops in its embrace,
I will not sing today 
For the wily warmonger with loins girt 
Lies in ambush for my land.

"আজ আর গাইবো না,
আজ আর গাইবো না গোলাপ আর বুলবুলের গান।
বন্দুকের গর্জনে বুলবুলের গান স্তব্ধ।
......
কোমর বন্ধ শক্ত করে এঁটে যুদ্ধবাজ রা আমার দেশের মাটিতে ওত পেতে বসেছে।
আজ আর গাইবো না।"

কবিরা সত্যদ্রষ্টা হ'ন।

শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০১৯

কলকাতার অমীমাংসিত খুনের মামলা ~ পি বিশ্বাস

ব্রিটিশ পুলিশের ইনস্পেকটর নৃপেন ঘোষ ছিল বিপ্লবী মহলে কুখ্যাত। তার অত্যাচারে বাঙালি বিপ্লবীরা অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। অনুশীলন সমিতির সদস্য নির্মলকান্ত রায়ের ওপর ভার পড়ে নৃপেনকে চিরকালের জন্য ধরাধাম থেকে সরিয়ে দেওয়ার।

১৯১৪ এর ১৯ জানুয়ারি, চিৎপুর রোড আর শোভাবাজার স্ট্রীট ক্রসিং এ ট্রাম থেকে নামার সময় নৃপেনকে লক্ষ্য করে ফায়ার করলেন নির্মল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেন। তাজ্জব কি বাত, গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ল নৃপেন! মাথায় একটা ও শরীরে দুটো গুলি। এলাকা রীতিমতো জনবহুল। নির্মলকে ফায়ার করতে দেখা গেছে ফলতঃ তাকেই ধরার জন্য পাহারারত পুলিশ ও জনতা সমবেতভাবে তেড়ে গেল। সবার আগে ছুটছে অতি উৎসাহী অনন্ত তেলী। ধরতে পারলে পুরষ্কার জুটবে।
পুরষ্কার সাথে সাথেই জুটল।
পেছনপাকা অনন্তর বুকে এসে ঢোকে আরেকটি বুলেট। সেও অক্কা পেল।

নির্মলকান্ত ধরা পড়লেন পাঁচঘরা একখানি রিভলভার সমেত। অনুশীলন সমিতির আরেক বিপ্লবী প্রিয়নাথ ব্যানার্জীও এরেস্ট হলেন অকুস্থলে৷ পুলিশের অসামান্য কর্মতৎপরতায় ধন্য ধন্য পড়ে গেল। উচ্ছ্বসিত সরকারি প্রশংসায় ভেসে গেল লালবাজার। Statesman পত্রিকা নৃপেনের মৃত্যু ও অপরাধী ধরা পড়ায় যুগপৎভাবে ভারি মর্মাহত ও খুশি হয়ে লিখল:
The unfortunate Inspector was an able and honest officer whose sole fault was his faithful discharge of his duty, and his reward is to be shot down in a crowded street where any man might suppose himself to be safe. Happily, his assassin has been caught.

হাইকোর্ট জাস্টিস স্টিফেনের এজলাসে Emperor vs Nirmal Kanta মামলার শুনানী হয়। ব্যালাস্টিক এক্সপার্ট নিশ্চিতভাবে জানালেন নিহত নৃপেনের দেহে প্রাপ্ত তিনটি বুলেটের একটিও নির্মলকান্তের রিভলভার হতে নির্গত হয়নি। অনন্ত তেলিকেও সে মারেনি। বহুজনসমক্ষে অনুষ্ঠিত হত্যাকান্ডে নির্মলকান্ত হাতে নাতে গ্রেপ্তার হলেও তার গুলিতে যে দুজনের কেউ খুন হয় এ নিঃসন্দেহ। প্রিয়নাথের কাছে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ছিলনা।
তাহলে হত্যাকারী কে!
ভৌতিক ব্যাপার নাকি?

এই রহস্যের মীমাংসা করতে পারেনি পুলিশ।
১ এপ্রিল ১৯১৪, জুরি ৭-২ সংখ্যাধিক্যের মতে আদালত নির্মলকান্তকে খালাস দিলেন। মুক্তি পেলেন প্রিয়নাথ ব্যানার্জি। নির্মল গুলি চালিয়েছিলেন, চালাবার চেষ্টা করেছেন কিছুই প্রমান করা যায়নি। জনতা তাকে খুনী মনে করেছে, তাড়া করে ধরেছে, সবই ঠিক। কিন্তু মেঘের আড়ালে মেঘনাদ কে ছিলেন অজানাই রয়ে গেল।

স্বাধীনতার অনেক পরে জানা যায় সেদিন ভিড়ের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অনুশীলন সমিতির আরেক সদস্য খগেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী। নির্মলকে ব্যর্থ হতে দেখে তিনি গুলি চালান। অব্যর্থ লক্ষ্যে ফেলে দেন প্রথমে নৃপেন ও পরে অনন্ত তেলীকে এবং ভিড়ে মিশে যান। 

খাতায় কলমে নৃপেন ঘোষ ও অনন্ত তেলীর খুনী আজো অধরা!!