শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৭

এফ আর ডি আই বিল ~ পুরন্দর ভাট

এফআরডিআই বিল নিয়ে অনেক লেখাপত্র ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যম এবং ফেসবুকে এসেছে। অনেকেই পড়েছেন, বুঝেছেন যে এ এক বিপজ্জনক আইন। অনেকে আমাকে বলেছেন এই নিয়ে লিখতে তাই একটা ছোট লেখা লিখছি, যদিও আমার নতুন করে এতে সংযোজন করার মতো কিছু নেই, সামান্য দু একটা পয়েন্ট ছাড়া।

প্রথমত, এই এফআরডিআই বিল বিষয়টা কী? কেন্দ্র সরকার একটা নতুন আইন প্রণয়ন করার ভাবনাচিন্তা করছে, আপাতত বিলটা জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে আছে, সেই আইনের নাম হলো ফিনান্সিয়াল রেজোলিউশন এন্ড ডিপোজিটরি ইনসিওরেন্স বিল, ছোট করে এফআরডিআই। দেশের ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে যে আইন সেই আইনকে সংস্কার করাই এই বিলের উদ্দেশ্য। সংস্কারের প্রয়োজন পড়ল কেন? পড়ল কারণ দেশের অধিকাংশ ব্যাংক বর্তমানে সংকটের মধ্যে দিয়ে চলেছে। বিভিন্ন ব্যাংক মোট ৬ লক্ষ কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণের ভারে ন্যুব্জ। সেই টাকা আর ফেরত আসবে না। এই অনাদায়ী ঋণের অধিকাংশটাই বড় কর্পোরেটদের কাছে পাওনা। আম্বানি-আদানি-এসার-বেদান্ত-কিংফিশার, প্রভৃতি। টাকা ফেরত না দিতে পারায় এদের কোনো শাস্তি হয়নি। কেউ লন্ডনে বসে উইম্বলডন দেখছে তো কেউ নিজের ছেলের বিয়ের কার্ড ছাপাচ্ছে যার এক একটার দাম দের লক্ষ টাকা। তো যাই হোক, অনাদায়ী ঋণ নিয়ে ভবিষ্যতে কী হবে? যে কোনো অনাদায়ী ঋণ ব্যাংকের ক্ষতির অংকে যুক্ত হয়। ব্যাংককে নিজের রোজগার থেকে অনাদায়ী ঋণের অংকের ভরণ করতে হয়। ব্যাংকের রোজগার যদি অনাদায়ী ঋণের অংক ভরণ করবার মতো যথেষ্ট না হয় তাহলে ব্যাংকটি শেয়ার বিক্রি করে বা বন্ড বিক্রি করে বা অন্য কোনো ভাবে ধার নিতে পারে। যদি ধারও না পায় তাহলে ব্যাংকটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করে, বন্ধ করে দিতে হয়। দেউলিয়া ঘোষিত হলে যাঁরা ব্যাংকে আমানত জমা করেছেন তাঁদের যত জনেরটা সম্ভব ব্যাংক ফেরত দেবে, যাদেরটা পারবে না তাদেরটা ফেরত দেবে সরকার। বর্তমানে ব্যাংকিং ব্যবস্থার যে আইন আছে তাতে এটাই দস্তুর। বর্তমান ব্যবস্থায় কিন্তু আমানতকারীদের টাকায় অনাদায়ী ঋণ বা ব্যাংকের অন্য কোনো ক্ষতির ভরণ করবার কোনো উপায় নেই, আইনত সেটা নিষিদ্ধ। বর্তমান আইনে ব্যাংক অনাদায়ী ঋণের ফলে হওয়া ক্ষতির ভরণ আমানতকারীদের টাকা দিয়ে করতে পারে না।

কিন্তু নতুন যে বিল আসছে তাতে এই নিয়ম বদলে যাবে। সেই বিলে একটি ক্লজ আছে, যাকে "বেইল ইন ক্লজ" বলা হচ্ছে, যা আমানতকারীদের টাকা দিয়ে ব্যাংকের ক্ষতি ভরণ করবার রাস্তা খুলে দেবে। এই আইন পাশ হলে ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা আটকে রাখতে পারবে যদি সে সংকটে পড়ে। এমনকি আমানতকারীদের টাকা থেকে ব্যাংক ইচ্ছে মতো ঋণ নিতে পারবে অথবা আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার বদলে তাদের ব্যাংকের শেয়ার দিয়ে দেবে যাতে ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা থেকে প্রয়োজন মত টাকা তুলে নিতে পারে ক্ষতি ভরণ করতে। অর্থাৎ সংকট এড়াতে আপনার তিন বছরের ফিক্সড ডিপোজিটের মেয়াদ বাড়িয়ে ৬ বছর করে দিতে পারে যাতে ব্যাংকের কাছে পর্যাপ্ত টাকার যোগান থাকে। 

বর্তমান আইনে আপনার আমানতের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে আপনাকে টাকা ফেরত দিতে ব্যাংক বাধ্য। যদি না দেয় আপনি কোর্টে যেতে পারেন। কোর্টে যদি ব্যাংক বলে যে তাদের ফেরত দেওয়ার মত যথেষ্ট টাকা নেই তাহলে ব্যাংকের কর্তারা ওপর কেলেঙ্কারির মামলা হবে এবং সরকার যে কোনো উপায় আপনার টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। নতুন আইনে কিন্তু এই নিশ্চয়তা আর থাকবে না। ব্যাংক টাকা ফেরত না দিলেও আপনি কোর্টে যেতে পারবেন না কারণ আইনেই এই সুযোগ ব্যাংকের কাছে থাকছে। অর্থাৎ যারা ঋণ খেলাপি করলো আর যারা বেপরোয়া ভাবে ঋণ দিলো তাদের ক্ষতি হলো না, হলো সাধারণ আমানতকারীদের। 

এই বিল নিয়ে হই চই শুরু হওয়ায় সরকার এখন বলছে যে নতুন আইনেও ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেলে সরকার আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেবে, অরুণ জেটলি প্রেস কনফারেন্স করে বলেছেন যে অযথা ভয় তৈরি করা হচ্ছে মানুষের মনে। কিন্তু যেটা উনি বললেন না সেটা হলো যে ব্যাংককে দেউলিয়া ঘোষণা করার ভিত্তিই তো বদলে যাচ্ছে নতুন আইনে। বর্তমান আইনে ব্যাংক আমানতকারীর টাকা সময়মত ফেরত না দিতে পারলেই তাকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়ে থাকে আর আমানতকারীদের টাকা ফেরতের দায়িত্ব সরকার নেয়। কিন্তু নতুন আইনে তো সময়মত টাকা ফেরত না দেওয়ার রাস্তাই খুলে দেওয়া হচ্ছে ব্যাংকগুলোর সামনে, সময় মত ফেরত না দিলেও তাকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হবে না এবং তাই সরকারের টাকা ফেরতের দায়িত্ব নেওয়ার প্রশ্নও উঠবে না।

এই অবধি মোটামুটি অনেকেই লিখেছেন, আলোচনা করেছেন মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে। কিন্তু একটা বিষয় এখনো অবধি কোনো লেখায় আমার চোখে পড়েনি। তার আগে সামান্য ইতিহাস। ব্যাংকে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার গ্যারান্টি সরকার দেওয়া শুরু করে ১৯৩৩-এ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তার আগে অবধি কোনো ব্যাংক ডুবলে তার আমানতকারীরাও ডুবত, সরকার তাদের টাকা ফেরানোর কোনো গ্যারান্টি দিত না। ১৯৩৩-এ আমেরিকায় পাশ হয় "গ্লাস স্টেইগাল এক্ট।" এই আইনে বলা হয় যে যদি কোনো ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষিত হয় তাহলে সরকার ছোট এবং মাঝারি আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার গ্যারান্টি দেবে। সকলেই জানেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটা আদ্যপান্ত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, সেখানে বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থ সব সময় প্রাধান্য পায়। তাহলে এহেন পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কেন হঠাৎ ছোট আমানতকারীদের জন্যে উতলা হয়ে উঠলো? না, আমানতকারীদের প্রতি মানবিকতা থেকে আইন বানানো হয়নি, হয়েছিল ব্যাংকগুলোর স্বার্থের কথা ভেবেই। কী রকম? ১৯২০-এর দশকে আমেরিকায় যে ভয়াবহ আর্থিক সংকট তৈরি হয়েছিল তার মূলে ছিল ব্যাংকের সংকট, তাদের দেউলিয়া হওয়া। কয়েকটি ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার মত যথেষ্ট টাকা জোগাড় করতে অক্ষম হয় এবং দেউলিয়া ঘোষিত হয়। সেই ব্যাংকে আমানতকারীরা তাদের সঞ্চয় হারান। এতে সাধারণ আমানতকারীদের মধ্যে ব্যাপক ভীতির সঞ্চার হয়। সকলেই ভাবতে থাকেন যে কোনো ব্যাংকই বোধয় আর নিরাপদ নয়। সকল আমানতকারী একযোগে সব ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে শুরু করেন, এমন কি যে ব্যাংকে কোনো সংকট নেই সেই ব্যাংক থেকেও। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ভীতি সঞ্চার হওয়া আশ্চর্য্যের কিছু না, যদি আপনার প্রতিবেশীর সব সঞ্চয় চোট হয়ে যায় তাহলে আপনিও নিজের ব্যাংকের ওপর সন্দিহান হবেন, আপনার ব্যাংক আলাদা হলেও। যেমন নোটবন্দীর সময় সবাই একসাথে ব্যাংকে দৌড়েছিলো পুরোনো নোট জমা দিয়ে ১০০ টাকার নোট তুলে, সঞ্চয় করে রাখতে যদিও অত টাকার হয়তো তক্ষুনি প্রয়োজন ছিল না। মানুষ ভীত হলে কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। সব আমানতকারী যদি একসাথে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে যায় ব্যাংক সেই টাকার যোগান দিতে পারবে না কারণ কোনো ব্যাংকই আমানতকারীদের সব টাকা জমিয়ে রেখে দেয় না, বেশিটাই সে ঋণ দিতে ব্যবহার করে। যেহেতু সাধারণত সব আমানতকারী একসাথে একদিনে টাকা তুলতে যায় না তাই আমানতকারীদের সব টাকা ধরে রাখার কোনো কারণ নেই ব্যাংকের, কিছু টাকা রাখলেই রোজের প্রয়োজন মিটে যায়। অতএব সব আমানতকারী একসাথে টাকা তুলতে এলে ব্যাংক যোগান দিতে পারবে না এবং এর ফলে একটা স্বাস্থ্যবান ব্যাংকও সংকটে পড়বে ও দেউলিয়া হয়ে যাবে। এই প্যানিক রিয়াকশনের ফলে ১৯২০-৩০ এর মধ্যে আমেরিকার অধিকাংশ ব্যাংক সংকটে পড়ে যায়। যাদের আগে কোনো সংকটই ছিল না, শুধুমাত্র ভীত আমানতকারীদের একসাথে টাকা তুলে নেওয়ার ফলে তারাও দেউলিয়া হয়। প্রায় সমস্ত ব্যাংকই ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দেয় এই ভয়ের চোটে - যে আমানতকারীরা একসাথে টাকা ফেরত চাইলে যোগান দিতে পারবে না যদি সেই টাকা থেকে ব্যবসায়ীদের  ঋণ দেয়। এতে ক্রমশ ব্যবসা বাণিজ্য সব বন্ধ হয়ে যেতে থাকে, চরম অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়। অর্থনীতির ভাষায় এর নাম হলো "Contagion" অর্থাৎ ছোঁয়াচে রোগ। একটি ব্যাংকের অসুখের ফলে সব ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাই এহেন নাম। এই সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক হলো - টাকা ফেরতের সরকারি গ্যারান্টি। সরকার যদি গ্যারান্টি দেয় তাহলে আমানতকারীরা আর প্যানিক করবে না, একসাথে সবাই টাকা তুলতেও যাবে না, এবং সংকট ছড়াবে না। এই এক্ট অব্যর্থ টিকার কাজ করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে সাধারণ আমানতকারীদের কথা ভেবে এই আইন আসেনি, এসেছিল পুঁজিবাদী সংকট থেকে বাঁচতে, ব্যাংকিং সিস্টেমকে সংকট থেকে বাঁচাতে।

যদি এফআরডিআই বিল পাশ হয় তাহলে ব্যাংকের সংকট কমার বদলে উল্টে বেড়ে যেতে পারে। এক্সিস ব্যাংক যদি সংকটে পড়ে ঘোষণা করে যে তারা আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারবে না এক্ষুনি, এক বছর পরে ফেরত দেবে, তাহলে অন্যান্য ব্যাংকের আমানতকারীরাও ভীত হয়ে উঠতে পারে যে তাদের ব্যাংকও হয়তো এমন করবে। এই ভয়ের ফলে একযোগে সবাই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়া শুরু করতে পারে। অন্য কোনো ব্যাংক, ধরা যাক পাঞ্জাব ব্যাংক, যে হয়তো কোনো সংকটেই ছিল না, সেও আমানতকারীদের একযোগে টাকা তুলে নেওয়ার হিড়িকে সংকটে পড়ে যাবে এবং এই ভাবে একটা ব্যাংকের সংকট গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ছড়িয়ে পড়বে। তাই এই বিলের বিরোধিতা শুধু আমানতকারীরা নয়, যাঁরা এইসব ব্যাংকে চাকরি করেন তাদেরও করা উচিত কারণ এই বিল তাঁদের ব্যাংককেও অনিশ্চয়তায় ফেলে দিতে পারে।

মঙ্গলবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৭

"হিন্দু রাষ্ট্র' ~ পুরন্দর ভাট

"হিন্দু রাষ্ট্র কাকে বলে?"

কোনো বিজেপি সমর্থককে এই প্রশ্ন করা হলে অবধারিত ভাবে সে উত্তর দেবে - গুজরাট। সংঘিদের ভাষায় "হিন্দু রাষ্ট্র গুজরাট।" নিন্দুকদের ভাষায় "হিন্দুত্বের ল্যাবরেটরি গুজরাট।" গুজরাটের সমস্ত কিছুতে ধর্ম। হাজার হাজার মন্দির। প্রতি অলিতে গলিতে ধর্মনাম ধর্মগান লেগেই রয়েছে সারা বছর। সেখানে মুসলমানরা একঘরে। ২০০২ এর পর থেকে ভয় সিঁটিয়ে থাকে তারা। ২২ বছর একটানা হিন্দুত্বের শাসন। সংঘ পরিবারের বিরুদ্ধে খোলাখুলি গলার আওয়াজ তোলা বারণ। নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গেলে সেখানে সিবিআইয়ের জাজ পর্যন্ত খুন হয়ে যায়। পুঁজিপতিদের কাছে মডেল গুজরাট। সেখানে কোনো শ্রমিককে ইউনিয়ন করতে দেওয়া হয় না। বন্ধ বা স্ট্রাইক নেই। হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ সেখানে প্রতি বছর। তার জন্য সাধারণ মানুষের কত লাভ হলো সেই প্রশ্ন তোলাও গুজরাটে অপরাধ। আম্বানি আদানিদের জায়গীর হলো গুজরাট। ২২ বছরের একটানা শাসনে সেখানকার সমস্ত ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করেছে হিন্দুত্ব। স্কুলের পাঠক্রম থেকে শুরু করে ইতিহাসের গবেষণা - সর্ব ক্ষেত্রে হিন্দুত্বের প্রভাব। সংঘের হাজার হাজার স্কুল। একটা গোটা প্রজন্ম তৈরি হয়েছে যাদেরকে সংঘের মতাদর্শ গেলানো হয়েছে। রাজনীতি বিজ্ঞানের গবেষকরা বলেন যে সংঘ কোনো নতুন নীতি নেওয়ার আগে তার পরীক্ষা করে নেয় গুজরাটে। গুজরাট মডেল।

এই গুজরাট থেকেই জয়যাত্রা শুরু করেছিলেন হিন্দু হৃদয় সম্রাট নরেন্দ্র মোদি। সারা ভারতকে গুজরাট বানাবেন - এই আশায় হিন্দুত্ববাদের সমর্থকরা তাকে ভোট দিয়েছিলেন। বিজেপির সভাপতিও ওই রাজ্য থেকেই। অমিত শাহ যে প্রবাদপ্রতিম পার্টি মেশিনারি তৈরি করেছে তার হাতেখড়িও গুজরাটে। নিজের হাতের তালুর চেয়েও গুজরাটের পার্টি সংগঠনকে ভালোভাবে চেনে অমিত শাহ। ভোটের আগে সমস্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, একাধিক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজেদের কাজ কম্ম ফেলে পড়েছিলেন গুজরাটে। পার্লামেন্টের শীতকালীন অধিবেশন স্থগিত রয়েছে গুজরাটের জন্য। যে রাজ্যের টানা চারবারের মুখ্যমন্ত্রী দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন সেই রাজ্যে তো এমনিতেই ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার কথা, সব কিছু বাদ দিয়ে শুধু গুজরাটি সেন্টিমেন্টের জন্য জিতে যাওয়ার কথা। তবুও কোনো ঝুঁকি নেননি প্রধানমন্ত্রী। কেন্দ্র এবং রাজ্যে তারা ক্ষমতায়, বিরোধীরা দাঁড়াবে কী ভাবে সেখানে? ২০১২-তে, যখন কংগ্রেসের সূর্য মধ্যগগনে, যখন একের পর এক নির্বাচন হারতে হারতে বিজেপি হাতে গোনা তিন চারটে রাজ্যে সীমাবদ্ধ, সেই তখনও গুজরাটে ১১৫-টা আসন জিতে নরেন্দ্র মোদি প্রমান করে দেন যে তিনিই একা কুম্ভ। সেইখানে ২০১৭-তে নির্বাচনের ফল তো পুনর্নির্ধারিত হওয়া উচিত।

কিন্তু কী হলো?

সেই হিন্দুত্বের পুণ্যভূমিতে কোনো মতে তরী পাড়ে লাগলো। মাত্র ৭ টি আসনের বহুমত। গত বিধানসভার থেকে ১৬ টি আসন কম। ভোট বেড়েছে ১ শতাংশ, কিন্তু কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে ৪ শতাংশ। আর লোকসভার তুলনায় বিজেপির ভোট কমেছে ১০ শতাংশেরও বেশি। বিহার নির্বাচনে নীতিশ কুমারের সঙ্গ হারিয়েও এত শতাংশ ভোট কমেনি বিজেপির। ৮-টি আসনে বিজেপি জিতেছে ১৮০০ ভোট বা তার কম ভোটের ব্যবধানে। কয়েকটি ৫০০ এরও কম ব্যবধানে। এই অসনগুলোয় মোট ৪৫০০ ভোট বিজেপির থেকে কংগ্রেসে ঘুরে গেলেই কংগ্রেস সরকার গড়ত। মাত্র ৪৫০০। একবার ভাবুন। একটা বড় বিয়েবাড়িতেও ওর চেয়ে বেশি মানুষ নিমন্ত্রিত থাকেন। বিভিন্ন পোল সার্ভে বলছে কংগ্রেসের ভোট সবচেয়ে বেশি অল্পবয়সীদের মধ্যে। সেই অল্পবয়সীরা যাদেরকে ২০১৪-তে বিজেপির প্রধান নির্বাচনী সম্পদ বলা হয়েছিল। হিন্দুত্বের কেন্দ্রতে হিন্দুত্ব এরকম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে কয়েক মাস আগেও কেউ ভেবেছিলেন? যে মডেলে গোটা দেশকে গড়ে তোলার কথা বলে মোদিজি প্রধানমন্ত্রী হলেন সেই মডেলই হাতছাড়া হতে পারে এরকম ভেবেছিলেন? যাঁরা তাদের দলের প্রধান সম্পদ ছিল, সেই যুবক যুবতীরা বিরোধীদের সব থেকে বড় সম্পদ হয়ে উঠবে কেউ ভেবেছিলেন?

হিন্দু রাষ্ট্রের প্রধান পীঠস্থান হলো সোমনাথ। যেখানে সোমনাথ মন্দির, যে সোমনাথ মন্দিরে ভিসিটর বুকে সই করার খবর রটিয়ে রাহুল গান্ধীকে অহিন্দু বলে রটনা করেছিল বিজেপি। সেই সোমনাথে কংগ্রেস ২০ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছে।

শুক্রবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৭

কর্পোরেট মিডিয়া ও শ্রমিক স্বার্থ ~ সুশোভন পাত্র

মিত্তির মশাই সকালে মেরি বিস্কুট চায়ে ডুবিয়ে আনন্দবাজার পড়েন। চিত্তরঞ্জন পার্কের অগ্নিমূল্য সবজি বাজারে ২টাকা বাঁচাতে দরদাম করেন। তারপর ধোঁয়া ওঠা ভাতে ঘি মেখে খেয়ে, হাতের গন্ধ শুকতে শুকতে অফিস বেরিয়ে পড়েন।

মিত্তির মশাই'র সরকারী চাকরি আছে। ই.পি.এফ আছে; মেডিক্লেম আছে। একটা মিউচুয়াল ফান্ড আর দুটো এল.আই.সি আছে। ছুটির দিনে সর্ষে ইলিশের জোগাড় আছে।
মিত্তির মশাই'র সেদিন বড্ড ভোগান্তি গেছে। পার্লামেন্ট স্ট্রিটে শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে আধ-ঘণ্টা ট্রাফিকে কেটেছে। অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টারে সই করতে গিয়ে বড় বাবুর টিপ্পনী হজম করতে হয়েছে। আসন্ন প্রমোশনে সঙ্কট মোচনের কথা ভেবে রাতে তিনবার বেশি পাশ ফিরতে হয়েছে। মিত্তির মশাই তাই বেজায় চটেছেন। স্মগে ডোবা সান্ধ্য আড্ডায় খাকিয়ে বলেছেন
- যতসব মিছিল-মিটিং। ডিসগাস্টিং পলিটিক্স। রবিবার কর, ছুটির দিন দেখে কর, আপিসের দিনগুলো বাদ দিয়ে কর। বলি, তোদের কাজ নেই বলে কি কারও নেই? সাধারণ মানুষের সুবিধা-অসুবিধাটা একবার ভাববি না ?

ব্যাসিক্যালি মিত্তির মশাই ঠিকই বলেছেন। ১৩৫ কোটি ৫০ লক্ষ'র তামাম ভারতবর্ষে ৪৮.৭ কোটি শ্রমিকের, অনেকেরই হাতে 'কাজ নেই', পেটে ভাত নেই। অনেকেরই প্রতিদিন 'রবিবার', প্রতিদিনই 'ছুটির দিন।' সেদিক থেকে মিত্তির মশাই'রা 'প্রিভিলেজড'। প্রিভিলেজড কারণ, মিত্তির মশাই'রা দেশের 'শ্রমিক শ্রেণী'র, সেই ৩.৫৫% বিরল প্রজাতি যারা সরাসরি রাজ্য কিম্বা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী। অর্থনীতির পোশাকি ভাষায় যারা 'অরগানাইজড সেক্টর'। যাদের মাস গেলে বেতনের নিশ্চয়তা আছে, চাকরি'র নিরাপত্তা আছে, ওভারটাইমে মজুরি আছে, সরকার ধার্য ছুটি আছে, শ্রম আইনে বোনাস আছে, ইনক্রিমেন্ট আছে, প্রভিডেন্ট ফান্ড আছে, প্রোমোশন আছে। সরকারী, আধা-সরকারী এবং বেসরকারি মিলিয়ে ভারতবর্ষে 'অরগানাইজড সেক্টর'র লাক্সারি উপভোগ করেন ৫.৬% শ্রমিক ¹। 'ক্রিম অফ দি ক্রপ'। 

আর মিউনিসিপালিটির যে ঝাড়ুদারটা প্রতিদিন সকালে এঁটোকাঁটা ভর্তি ব্যাগটা ডাস্টবিন থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, যে লোকটা স্কুলে-স্কুলে মিড ডে মিলের রান্না করছে, আপনার হবু স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টের স্বপ্নে যে রাজমিস্ত্রিটা একের পর এক ইট গাঁথছে, যে আশা-অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা সার্ভের জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরছে, যাঁদের প্রতিদিনের রক্ত জল করা পরিশ্রমে সভ্যতার পিরামিড আকাশে পাড়ি দিচ্ছে, ঝাঁ চকচকে স্মার্ট সিটির ইমারত গুলো ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠছে -দেশের সেই ৯৪.৬% শ্রমিকই আসলে 'আন অরগানাইজড'। যাদের মাস গেলে ন্যূনতম বেতন নেই, চাকরি'র নিরাপত্তা নেই, ওভারটাইমে মজুরি নেই, সরকার ধার্য ছুটি নেই, শ্রম আইনে বোনাস নেই, ইনক্রিমেন্ট নেই, প্রভিডেন্ট ফান্ড নেই, প্রোমোশন নেই ² ।

১৯৫৭'তে অর্থনীতিবিদ গুলজারি লাল নন্দা'র নেতৃত্ব ১৫তম ইন্ডিয়ান লেবার কংগ্রেস বলেছিল –"শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি, চারজনের পরিবারের প্রতিজন কে প্রতিদিন ২৭০০ ক্যালরির ব্যালেন্স ডায়েট, পরিবার প্রতি বছরে ৬৫ মিটার কাপড়, সরকারি আবাসন প্রকল্পে প্রদত্ত এলাকার সংশ্লিষ্ট ঘর ভাড়া এবং জ্বালানি, বিদ্যুৎ সহ বিবিধ খরচা পুরোপুরি ভাবে বহন করার উপযুক্ত হওয়া প্রয়োজন ³ ।" ১৯৯২'এ সুপ্রিম কোর্ট এই ন্যূনতম মজুরির উপর আরও ২৫% ছেলেমেয়ের পড়াশুনা, চিকিৎসা, বিনোদন এবং উৎসবের জন্য সংযোজনার নির্দেশ দেয়। সব মিলিয়ে বর্তমান বাজার মূল্যে ন্যূনতম মজুরিটা প্রায় মাসিক ২৬,০০০ টাকা। বাস্তবে, এই 'আচ্ছে দিনের' রামরাজত্বেও যে ন্যূনতম মজুরিটুকু উপার্জন করেন দেশের মাত্র ৭% শ্রমিক। আর তুলনায় মাসিক ১০,০০০ টাকারও কম উপার্জন করা শ্রমিকের সংখ্যাটা ৬৮% ⁴ । 
১৯৮৭-২০১৫, যে ২৮ বছরে সেনসেক্স-নিফটি-জিডিপি'র ঊর্ধ্বগামী অর্থনীতিতে শ্রমিক'রা ২১০% নিট মূল্য সংযোজন করেছে, সেই ২৮ বছরেই শ্রমিক'দের নিট পারিশ্রমিক নাম মাত্র ১৪% বেড়েছে ⁵ । যে ২৮ বছরে ভারতবর্ষে বিলিয়নারির সংখ্যা ১ থেকে বেড়ে ১৩২ হয়েছে, সেই ২৮ বছরেই ১০০ টাকা উৎপাদন মূল্যে শ্রমিক'দের প্রাপ্য মজুরি কমতে কমতে ৯.৯ টাকায় ঠেকেছে ⁶ ⁷ ।

শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে উদ্বৃত্ত সম্পদ বণ্টনের এই বৈষম্য দেখে যখন চক্ষু চড়ক গাছ অক্সফামের মত আন্তর্জাতিক গরিবি গবেষক সংস্থার ⁸, 'মার্কেট ফ্লেক্সিবিলিটি'র অজুহাতে যখন নতুন শ্রম আইনে মালিক শ্রেণীর হাত শক্ত করা হয়েছে ⁹, আই.এল.ও-র বুনিয়াদি শ্রমমান সম্পর্কিত ৪টি কনভেনশন কে যখন ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে ¹⁰ , ৪৩তম শ্রম সম্মেলনের 'ঠিকা শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ ও বিলোপ' আইনের সংশোধনী কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে যখন স্থায়ী কাজে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ বেড়েছে ¹¹ -মিত্তির মশাই'দের টেবিল তখন ব্লেন্ডার্স প্রাইড আর চিকেন ললিপপে সেজেছে। যে আনন্দবাজার বিরাট কোহলির ফুটওয়ার্কে খুঁত খুঁজতে কফিন থেকে ডন ব্র্যাডম্যান কে তুলে আনে, যে অর্ণব গোস্বামীরা পদ্মাবতী নিয়ে রোজ প্রাইম টাইমে মাছের বাজার বানিয়ে ফেলে, যে জি-নিউজ নতুন দু-হাজারের নোটে জি.পি.এস চিপ বসিয়ে ফেলে, যে আজতকের ক্যামেরা মঙ্গলে গিয়ে জলের ছবি তুলে আনে; সেই কর্পোরেট মিডিয়ার লেন্সেই ৯৪.৬% শ্রমিক'দের দুর্দশার ছবি ধরা পড়েনা। সেই কর্পোরেট মিডিয়ার পাতাতেই নাকের ডগার শ্রমিক বিক্ষোভের খবর দু কলম জায়গা পায়না ¹² । পায়না, কারণ কর্পোরেট মিডিয়া শ্রমিক'দের স্বার্থের কথা বলে না। বলে মালিক'দের মুনাফার কথা। পায়না, কারণ কর্পোরেট মিডিয়া শ্রমিক'দের পয়সায় চলে না। চলে আম্বানি-আদানি'দের পয়সায়। 

তাই কর্পোরেট মিডিয়া কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েই, ৩ লক্ষ শ্রমিকের সমাবেশে উত্তাল হয়েছে দিল্লি। মুষ্টিবদ্ধ হাত আর তুমুল ইনকিলাবি শ্লোগানে ভেসেছে দিল্লি। গণহত্যা কারী মাস্টার মাইন্ড'দের দিল্লি কে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে সফদারের গন্ধ মাখা দিল্লি। ধর্মীয় ভেদাভেদের পিণ্ডি চটকে লাল ঝাণ্ডার তলে হক আদায়ের শপথের সাক্ষী থেকেছে দিল্লি। শপথ, ১৮,০০০ টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবী আদায়ের। শপথ, দাবী পূরণ না হলে অনির্দিষ্ট কালের ধর্মঘটের। শপথ, কারখানার'র গেটে তালা ঝুলিয়ে রক্ত চোষা মালিকের বিরুদ্ধে হাল্লা বোলের। 

সেদিন সকালে স্তব্ধ হবে সভ্যতা, থমকে যাবে চাকা। সেদিন সকালে সিক্সটি পয়েন্ট হেডিং-এ ছাপা হবে শ্রমিক'দেরই কথা। সেদিন সকালে প্রতিটা কুঁড়ি বারুদ গন্ধে মাতাল করেই ফুটবে। সেদিন সারা শহর উথাল পাথাল, ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে।

বুধবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৭

বিপ্লব সম্প্রচারিত হবে না ~ অবিন দত্তগুপ্ত

ভেনেজুয়েলা ,২০০২ । প্রেসিডেন্ট বামপন্থী উগো চ্যাভেজ । একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে বড়লোকের কোমর ভাঙ্গছেন - শক্তিশালী হচ্ছে ভেনেজুয়েলার প্রান্তিক দরিদ্র সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ । জমিদারদের হাত থেকে জমি ছিনিয়ে নিয়ে আদিবাসী মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছেন , একের পর এক জাতীয়করণ করছেন দেশের সমস্ত তৈলখনি । আমেরিকান তেলের কোম্পানির মালিকদের আর তাদের দেশীয় দালালদের তো মাথায় হাত । এতোদিন ধরে ভেনেজুয়ালার প্রাকৃতিক সম্পদ(তেল) লুঠ করত আমেরিকান বেনিয়ারা । আর এই কাজে তাদের সহায়তা করত ভেনেজুয়ালার ধনিক শ্রেণীর দালালরা । চ্যাভেজের উত্থান অতএব আটকাতেই হবে । যে করে হোক সরাতে হবে ফিদেলের শিষ্য ,উগো চ্যাভেজকে । অতএব তারা ফন্দি আটলেন । তারা মানে কারা ? কারা কারা ফন্দি আটলেন ? ভেনেজুয়েলার ধনিক শ্রেণী , আমেরিকার সরকার,তাদের ভেনেজুয়েলার দালাল, ভেনেজুয়ালার সামরিক বাহিনীর এক অংশের সাথে হাত মেলালো ভেনেজুয়ালার বাজারি প্রচার মাধ্যম । সামরিক বাহিনী যখন চ্যাভেজকে বন্দি করছে , যখন তার পদত্যাগের মিথ্যা খবর রটাচ্ছে ধনিক শ্রেণী ঠিক তখন ভেনেজুয়ালার বাড়িতে বাড়িতে প্রতিটি টি.ভি-তে প্রতিটি চ্যানেলে মেগা সিরিয়াল বা চটূল নাচের প্রোগ্রাম দেখানো হচ্ছিল । প্ল্যান ছিল নিঃশব্দে চ্যাভেজ-কে সরিয়ে দেওয়ার । কিন্তু সেনাবাহিনীর নীচের তলার লোকজন বেঁকে বসলো । তারাই খবর পৌছালো শ্রমিক মহল্লায় ,কৃষক পাড়ায় । লক্ষ মানুষের মিছিল ৪৭ ঘন্টা বাদে উদ্ধার করলো তাদের প্রেসিডেন্টকে । তারপর থেকে মৃত্যুর আগে অব্দি চ্যাভেজ অপরাজিত ছিলেন । এই পুরো ঘটনা নিয়ে , ২০০৩ সালে একটি সিনেমা তৈরি হয় - The revolution will not be Televised . 

  হঠাত সিনেমাটার কথা মনে পড়ার কারণ , কিছুক্ষন আগে মেসেঞ্জারে পাওয়া একটি ভিডিও । এটা ভারত ,২০১৭ । ২০০৯এর ইউ পি এ (দুই) সরকার যে শ্রমিক-কৃষক বিরোধী নীতির এরোপ্লেন রানওয়ে দিয়ে দৌড় করিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন , ২০১৪র বি জে পি সরকার গত তিন বছরে সেই প্লেনকে আকাশে তুলে নিয়ে , সুপার সনিক গতিতে এগিয়ে চলেছেন । এদের গন্তব্যের নাম বিকাশ(বা ডেভেলপমেন্ট) যা আদতে এই দেশের শ্রমিক এবং কৃষকের ডেথ্‌ সেন্টেন্স । ১০০ দিনের কাজের মজুরি না পাওয়া মজুর বলুন বা অঙ্গনওয়ারীর কাজ করা শ্রমিক - ক্রমশ বেড়ে যাওয়া জিনিসপত্রের দামের কাছে , নিজেদের ছোট্ট মায়না নিয়ে তারা প্রত্যেকে অসহায় । অনেক আলাপ আলোচনার পর তাদের মূল দাবীগুলোকে এক জায়গায় করে এই সাতদিন আগে তারা দিল্লী গিয়েছিল । ভাবুন , সারা দেশ থেকে তিনদিন পর পর লক্ষ লক্ষ শ্রমিক পার্লামেন্টের সামনে ধর্নায় বসে আছেন । তাদের দাবী ,যে কোন সভ্য দেশের মৌলিক দাবীগুলির মতোই - চারজনের সংসার চালানোর জন্য মাসে ন্যুনতম ১৮,০০০ টাকা মজুরী , এক ধরনের কাজে একই বেতন ,ঠিকা শ্রমিকের সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদি । তা এর ঠিক এক সপ্তাহ সারা ভারতের লাখ লাখ কিষানের জমায়েত হচ্ছে এখন দিল্লীতে । তারা পার্লামেন্টের সামনে কৃষক সংসদ বসিয়েছেন । কেন ? আমরা সকলেই জানি , কৃষি কাজের মূল চালিকা শক্তি সরকারি ভর্তুকি । বাজারে যে ফসল কিনতে আপনার হাত পুড়ে যায় , বস্তা বস্তা সেই ফসল বেঁচেও কৃষকের এক পকেট টাকা হয় বলতে পারেন । মাঝে টাকা মেরে যায় ফড়ে - যাদের সাথে সরকারের সাঁট থাকে । তা ক্রমবর্ধমান কৃষক আত্মহত্যার কারণে আগের সরকার স্বামিনাথন কমিশন গঠিত করেন । কমিশন রিপোর্ট দেয় যে , কৃষকদের বাঁচাতে হলে তাদের ফসল দেড়গুন সহায়ক মূল্য দিয়ে সরকারকে কিনতে হবে । কিন্তু সে রিপোর্ট সার- সহায়ক মূল্যে কোন ফের বদল ঘটে না । কৃষকদের ব্যঙ্কে অনাদায়ী ঋণের পরিমান দেড়শো কোটি মতো । আম্বানি-আদানি-মালিয়া-টাটা-বিড়লার অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড়লক্ষ কোটি টাকা । বড়লোকদের দালাল সরকার বড়লোকের সব ঋণ মাফ করে দিলেও ছোট লোকের ভাগ্যে সে শিকে ছেড়েনি । অতএব কৃষক মারা গিয়েছেন হাজারে হাজারে - মধ্যপ্রদেশ,মহারাষ্ট্র, রাজস্থান,গুজ্রাট,তামিলনাডু,বাংলা ইত্যাদি সর্বত্র । এর বিরুদ্ধে সারা দেশের কৃষক আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছে - এখন ঢেউ আছড়ে পড়ছে সংসদের গেটে । কিন্তু এর কিছুই আপনি জানেন না । আপনি জানেন না কারণ একটিও সংবাদপত্র একটিও খবরের চ্যানেল এই খবর দেখাচ্ছে না । আপনি দেখছেন পদ্মিনীর নাক-কান-মাথা কাটার মেগা সিরিয়াল । 

এই মুহূর্তে আপনি রাজস্থানের ইতিহাস ঘাটছেন , কয়েকটা ছাগল টি ভি র সামনে খোলা তলোয়ার নিয়ে লাফাচ্ছে - আপনি গিলছেন , পদ্মিনী ইতিহাস না কল্পনা তর্ক করছেন , শিল্পের উপর এরকম খবরদারি একেবারে উচিৎ নয় বলে বক্তব্য রাখছেন ,টুইট্‌ করছেন । এগুলো প্রয়োজনীয় নয় , এমনটা নয় । কিন্তু ভারতবর্ষের খেটে খাওয়া মানুষের ইতিহাসে , পদ্মিনীর কোন জায়গা নাই । মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ,এই সিনেমাটির কোন অবদান থাকবে বলেও মনে হয় না । একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবলে দেখবেন , এর পুরোটাই স্ক্রিপ্টেড্‌ । ভারতের শাসক শ্রেণীর হাঁটু কাপিয়ে দিয়েছে মারুতির শ্রমিক , শীকরের-মান্দোসারের-বিদর্ভের কৃষক । অতএব তারা আপনাকে বিদ্রোহের ছবি দেখাবে না । বাজার আপনাকে তার মৃত্যুঘণ্টার শব্দ শুনতে দেবে না । আর ঠিক তাই - "The revolution Will not be Televised" 

শনিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৭

ডেঙ্গু ~ ড: রেজাউল করীম

ডেঙ্গু তরজা থামার কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছে না। শাসকদলে যে এত বড় বড় অজানা জ্বর বিশেষজ্ঞ আছেন জানা ছিল না। আজ একজন মন্ত্রী বললেন- যে জ্বর হচ্ছে তার সব ডেঙ্গু নয়, অজানা জ্বরেও মানুষ মারা যাচ্ছে, ডাক্তার বাবুরা ভুল করে ডেঙ্গু লিখে ফেলছেন। এদেশের পেশাদার রাজনীতিকরা যে অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন সে বিষয়ে আমাদের অল্পস্বল্প ধারনা ছিল কিন্তু তারা যে অবিবেচক তা আরো নতুন করে প্রতিদিন প্রমান করছেন। শুধু এই রাজ্যে নয়, গোটা দেশ জুড়েই এই অবস্থা- জনরোষ থেকে বাঁচার জন্য সবরকম অপবিজ্ঞানের চাষ হচ্ছে। যারা রাজ্য আর দেশের কর্ণধার আগামী  কোন একদিন তারা ক্ষমতা থেকে নির্বাসিত হবেন কিন্তু এই দেশ থাকবে। আজ যে অপবিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা, অযোগ্যতা আর অকর্মন্যতা ঢাকার চেষ্টা করছেন,তা কিন্তু জনমানস থেকে মুছতে অনেক সময় লেগে যাবে।
পৃথিবীর আর কোন দেশে নির্বুদ্ধিতার প্রতিযোগিতা হয় না, সাধারন মানুষের জীবনের দাম সেখানে অমূল্য। মানুষকে সেখানে মর্যাদা দেওয়া হয় এবং সরকার জনগনের ক্ষোভ প্রশমনেও আন্তরিক। এদেশের অন্যত্রও অবস্থা এত খারাপ নয়। সম্প্রতি কর্নাটকে দেখা গেল চিকিৎসকদের কথা শুনতে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী হাজির- তিনি চিকিৎসকদের অনেক দাবী দাওয়া মেনেও নিয়েছেন এবং প্রস্তাবিত বিলে প্রয়োজনীয় সংশোধনের আশ্বাস দিয়েছেন। দক্ষিনের রাজ্যগুলিতে অন্তত: স্বাস্থ্যের মত গুরুতর বিষয়ে নিয়ে অবৈজ্ঞানিক মন্তব্য করা থেকে রাজনৈতিক নেতারা অনেক সতর্ক। আমাদের নেতারা হ জ ব র ল সব নিয়ে বিশেষজ্ঞ। সুকুমারের ব্যকরণ সিংও সব কিছু খায় না, কিন্তু... তা যাক সেকথা।
এই রকম পরিস্থিতিতে এ রাজ্যে প্রতিরোধমুলক ব্যবস্থা নিয়ে সরকার যে মনোযোগ দেবে না তা বলাই বাহুল্য। রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা এই রাজ্যে উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষ দারিদ্র, নোংরা ও বসবাসের অযোগ্য পরিবেশ, বেকারি, অশিক্ষা, অপুষ্টি, অনাহার ও রাজনৈতিক কুনাট্যে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। কে বলবে বাঙালী একদিন সারা ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছিল, তার মেধা ও অধ্যাবসায় তাকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছিল। যারা শিরদাঁডায় তফাৎ নিয়ে কাব্য রচনা করছিলেন তারাও নিরাপদ দূরত্বে দাঁডিয়ে দাঁডিয়ে মজা দেখছেন। আজকাল হস্ত প্রক্ষালন করেও অনেকে পি সি সরকারের  মত ম্যাজিক-দণ্ড ছোঁয়া রত্ন  হয়ে যান। সুতরাং অধ্যাবসায়ের প্রয়োজন নেই। একটা চার আনা নেতার মাথায় অক্সিজেন সাপ্লাই নিয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বিবৃতি দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। অক্সিজেনের অভাবে কি হতে পারে সেই ব্যাখার আমরা চমৎকৃত হয়েছিলাম। কিন্তু সে ছিল অপবিজ্ঞান শুরুর দিনগুলির কথা, এখন সেটা ফুলে ফলে পল্লবিত হয়ে সমাজের মর্মমূলে স্থাপিত হচ্ছে। আমরা সচেতন ভাবে রাজনৈতিক কূট ক্ষুরস্যধারা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চেয়েছি।তা সত্বেও যারা আমাদের অভিভাবকত্ব করবেন বলে আমরা আশা করেছিলাম তাদের অন্যায় আচরনের জন্যই  প্রতিদিন পেশার উপর আক্রমণ হচ্ছে ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হচ্ছে। চিকিৎসকদের কাজ ও প্রতিদিন কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। এই অবস্থায় কর্নাটি চিকিৎসকদের মত ঐক্যের নজির সৃষ্টি করতে হবে। ঐক্য অমূল্য ও অসীম গুরুত্ব সহকারে তা অর্জন ও রক্ষা করা দরকার। আই এম এ (পশ্চিমবঙ্গ, রাজ্য শাখা) যদি কর্নাটি শাখার মত আন্দোলনে নেতৃত্ব দিত তাহলে বোধহয় ঐক্য ঐক্য বলে এত কথা বলতে হত না। কিন্তু তারা তাদের ন্যস্ত দায়িত্ব পালন না করে সবকিছুর মধ্যে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আর সিপিএমের ভুত দেখছেন। যদিও জানি ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না,  সে আসে ধীরলয়ে আপনার নিজস্ব গতিতে। ন্যায় বিচারের পথ সুগম,প্রশস্থ ও তরান্বিত করতে না পারলে কিন্তু ইতিহাসের কাছে আমরাও অপরাধী থেকে যাবো। রাজনীতির কালনেমি ভাগ নিয়ে যার ইচ্ছা কাড়াকাড়ি করুক আমরা নিজেদের পেশার  সম্মান যেন রক্ষা করতে পারি আর সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যের অধিকার সুনিশ্চিত করতে পারি, শুধু সেই কামনাই করতে চাই।

শুক্রবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৭

কর্নেল চিত্তরঞ্জন দাস ~ সাক্যজিৎ ভট্টাচার্য্য

বৃদ্ধ কর্ণেল এবং তাঁর হাঁপানিতে ভোগা স্ত্রী-এর কাছে কোনও টাকাপয়সা ছিল না। তাঁদের একমাত্র ছেলেকে নিষিদ্ধ পত্রিকা বিলি করবার অভিযোগে গুলি করে মারা হয়। কর্ণেলের কাছে ছিল একটা লড়ুয়ে মোরগ, যেটা আগামী শীতে মোরগ লড়াইতে নামবে বলে গোটা শহর তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা বাজী রেখেছে। কর্ণেল এবং তাঁর স্ত্রী নিজেরা না খেয়ে মোরগটাকে খাওয়াতেন । আর সহস্র দিনের যুদ্ধে অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়বার জন্য সরকার যে পেনশনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কর্ণেল গত পনেরো বছর ধরে সেই চিঠির  অপেক্ষায় বসে ছিলেন। প্রতি শুক্রবার নতুন মেল আসবার  দিন পোস্ট অফিসে হানা দিতেন তিনি, এবং প্রতি সপ্তাহেই পোস্টম্যান ব্যতিক্রমহীন উচ্চারণ করে যেত, 'কর্ণেলকে কেউ চিঠি লেখে না'।

চরম দারিদ্র্যের  মধ্যেও কর্ণেল তাঁর মোরগটাকে বিক্রি করেন নি। কারণ ওটা একদিন লড়াইতে জিতবে, জিতবেই। আর সেই লড়াইয়ের দিন আসার আগে নিজেদের খাবার জুটবে কীভাবে? কেন? সেই  চিঠিটা যে আসবে? সেই প্রাপ্য সম্মানটুকু? যেটার জন্য পুত্রহীন কর্ণেল সমস্ত অসম্মানকে সহ্য করে যাচ্ছেন! আর চিঠি যদি না আসে? তাহলে না খেয়ে থাকবেন, তবু মোরগটাকে লড়াইতে জেতাবেনই !

বিধাননগরের বাসিন্দা চিত্তরঞ্জন দাস।  তাঁর উনিশ বছরের মেয়ে রিয়া চলে গিয়েছে ডেঙ্গুতে  ভুগে। এবং মেয়ের মৃত্যুর পরে চিত্তরঞ্জন দাস দাঁতে দাঁত চিপে লড়াই করে গিয়েছেন।  একটা ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য, যেটাতে লেখা থাকবে মৃত্যুর কারণ আসলে ডেঙ্গু।  বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের চিকিৎসক, সম্ভবত সরকারী অদৃশ্য নির্দেশনামা মেনেই, ডেঙ্গু  লিখতে অস্বীকার করেছিলেন। সন্তানহারা চিত্তরঞ্জন সারাদিন হাসপাতালে পড়ে থেকেছেন।  ছোটাছুটি করেছেন থানাতেও।  শুধুমাত্র যেন ডেথ সার্টিফিকেটে ডেঙ্গু  লেখা হয় এটুকুই দাবী ছিল তাঁর ।  কেন এরকম দাবী ? এতে করে তো আর রিয়া ফিরে আসবে না ! কারণ, চিত্তরঞ্জনের ভাষায়, "লিখিতভাবে ডেঙ্গু  থাকলে সেটা নিয়ে  স্থানীয় পুর-প্রশাসনকে সতর্ক করা সম্ভব, যাতে অন্য অনেকের এই রোগ না হতে পারে"।

একটা মারণ রোগ সরকারী সহায়তায় যখন শহরের ওপর থাবা বিস্তার করছে, তখন এই ব্যক্তিগত প্রতিরোধগুলোর গল্পও আর্কাইভড থাকুক। এই পৃথিবীর কোনও এক গুপ্ত পোস্ট অফিসে কর্ণেলের চিঠিটি সযত্নে রক্ষিত আছে, এবং এই পৃথিবীর  এমন কোনও তৃণমূল সরকার নেই যা চিত্তরঞ্জন দাসের প্রতিজ্ঞার সামনে অটল থাকবার  ধক দেখাবে--এই বিশ্বাসটুকু না থাকলে এই লেখাটার কোনও অর্থই  থাকত না। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের , মামাটি উৎসবের , টলিউড চিত্রতারকাদের নিয়ে নাচগানের উৎসবের অথবা  বিশ্বকাপ ফুটবলের শহরজোড়া  পোস্টারে  সহাস্য নেত্রীর মুখের কদাকার ছবিটিকে ম্লান করে দিয়ে আশ্চর্য্যভাবে একদিন উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এই ব্যক্তিগত প্রতিরোধগুলির গল্প, ডাক্তার অরুণাচল দত্তচৌধুরীদের কাহিনী, যেগুলো  একদিন না একদিন সমষ্টিতে মিলবেই , এবং মোরগটা শেষ লড়াইতে জিতে যাবে তখন  -- এই বিশ্বাসটুকুকে কি বলা যেতে পারে?  ডেঙ্গুর দিনগুলিতে প্রেম?

কর্নেল চিত্তরঞ্জন দাস , মার্কেজের ভাষাতেই, 'is the orphan of his child'।  এই অনাথ পিতার প্রতিজ্ঞাকে এক  সামান্য কলমের পক্ষ থেকে সহস্র তোপধ্বনি।

(সূত্র ঃ  এবেলা, ১৪/১১/২০১৭)

বৃহস্পতিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৭

জমি অধিগ্রহণ ~ আর্কাদি গাইদার

মাত্র ৩০০ জন স্পার্টার সৈন্য নিয়ে রাজা লিওনাইডাস যখন গ্রীসকে রক্ষা করতে পারস্যের রাজা জার্ক্সিস এবং তার ১০ লাখের সেনাবাহিনীর সামনে দাড়িয়েছিলো, তখন জার্ক্সিস তাকে সুযোগ দিয়েছিলো আত্মসমর্পণ করবার। লিওনাইডাস রাজি হয়েনি। জার্ক্সিস বলেছিলো - তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে। নির্মূল হয়ে যাবে। তোমাদের কোন চিহ্নও বাকি থাকবে না। একটা পাখি বা একটা পাথরও তোমাদের সাক্ষ্য বহন করবে না। তোমাদের অস্তিত্ব বলে কোন কিছু থাকবে না এই জগতে।
লিওনাইডাস বলেছিলো - থাকবে। মানুষের মনে থাকবে। তাদের মনে থাকবে যে ৩০০ জন তোমার ১০ লাখ সেনার সামনে লড়েছিলো। বহু বহু যুগ পরে, যখন এই পৃথিবীতে আমি বা তুমি কেউই থাকবো না, তখনও মানুষ আমাদের ৩০০ জনের কথা মনে রাখবে।

বোলপুরে শিবপুর মৌজার অন্তর্গত ২৯৪ একর জমি পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগম অধিগ্রহন করেন ২০০১ এবং ২০০২ সালে বিভিন্ন পর্যায়। এই জমি হস্তান্তর করা হয় শিল্প স্থাপনের জন্যে। তারপর কেটে গেছে দীর্ঘ ১৫ বছর। সেখানে শিল্প স্থাপন হয়নি।
বর্তমান সরকার ঠিক করেছেন, সেখানে আবাসন প্রকল্প করবেন। বর্তমান সরকারের আধুনিক বিশ্ববীক্ষাতে শিল্প মানে আবাসন প্রকল্প হতেই পারে। যেমন তারা ইনফোসিসকে দেওয়া জমিতেও তাই করতে চান। কিন্তু ওই গ্রামের মানুষগুলো কিঞ্চিত প্রাচীনপন্থী বলেই হয়তো তারা বর্তমান সরকারের এই মহান উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে পারেননি। 

তাই ওই গ্রামের মানুষরা আন্দোলন শুরু করেছেন। ওনাদের দাবিগুলো খুবই সামান্য। শিল্পের জন্যে নেওয়া জমিতে শিল্পই হোক। আর শিল্প না হলে সেই জমি আবার ক্ষতিপূরন সহ ফিরিয়ে দেওয়া হোক। শিল্পের জন্যে অধিগৃহণ করা জমিতে ফ্ল্যাটবাড়ি তুলে প্রমোটার, সাপ্লায়ার আর রিয়েল এস্টেট চোরপোরেটদের রমরমায় সামিল হতে তাদের অসুবিধে আছে। 

কিন্তু বর্তমান সরকার এই অন্যায় দাবি মেনে নেবে কেন? তারা সর্বশক্তিমান, ইশ্বরের মতন আরকি, আর ইশ্বর সমালোচনা সইতে পারে না। আর এতো সমালোচনা নয়, সরাসরি বিদ্রোহ! তাই মাঠে নেমেছেন বাংলার নতুন মূক্তিসূর্য অনুব্রত মন্ডল। সামরিক কায়দায় তিনি তার ক্র্যাক ব্যাটেলিয়নদের দিয়ে গ্রামের পর গ্রাম ঘিরে সেখানে মারধোর শুরু করেছেন। সাইকোলজিকাল ওয়ারফেয়ার। মানে একটা সংখ্যার লোককে পেটালেই বাকিরা চুপ করে যাবে। অনুব্রত মন্ডলের সামরিক স্ট্র্যাটেজি দেখলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বড় বড় জেনারেলরা লজ্জা পেতে পারেন। জার্মান আর্মি প্রথমে কোন একটি অঞ্চল আক্রমন করে সেখানে আধিপত্য কায়েম করতো। তারপর তাদের ভূমিকা শেষ। এরপর ঢুকতো এস এস। এস এসের ইউনিটরা সেই অঞ্চল ধরে ধরে সিভিলিয়ানদের আস্তে আস্তে কাবু করতো, প্রতিরোধে নামগন্ধ মিটিয়ে দিতো। একই কায়দায় শিবপুরে প্রথম ঢুকছে পুলিশ। তারপর অনুব্রতর ক্র্যাক ব্যাটেলিয়ন। 

কিন্তু বোকা গ্রামবাসীরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়না। এরা তার পরেও সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। আজকের সভায় যখন অনুব্রতর বাহিনী আক্রমন করে, কয়েক রাউন্ড গুলি চালায়, তখন তাদেরকে ধাওয়া করে মেরে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। অনুব্রত প্রেসে হুংকার দিয়েছেন - এই ঝামেলা না থামলে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। এবং তা শুরু হবে কালকে থেকেই।

আমরা জানি, এই লড়াই অসম লড়াই। পুলিশ এবং অনুব্রতর বাহিনীর সামনে গ্রামবাসীদের প্রতিরোধ না টেকবার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। ২০১৭ র এই বিশ্বে এই বাস্তবকে মেনে নিয়েই আমরা বেচে আছি, থাকবো। কিন্তু আমরা তো একটা কাজ করতেই পারি।
মনে রাখা। আমরা মনে রাখবো, কতগুলো অচেনা অজানা সাধারন লোকও এই অসম লড়াই লড়েছিলো। প্রতিরোধ করেছিলো। 
বিশ্বাস করুন, একদিন অনুব্রত থাকবে না। মমতা থাকবে না। মোদীও থাকবে না। কিন্তু থেকে যাবে এই মানুষগুলোর লড়াইয়ের স্মৃতি। কারন আমরা মনে রাখবো। আমাদের মনে রাখতেই হবে।

সোমবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৭

ধর্মঘট ~ আর্কাদি গাইদার

শাবানা, দিল্লী
==========

"নোটবন্দী আর জিএসটি, দুটোই আমার পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আমাদের গ্রাম মুস্তাফাবাদের ৫০০ জন, যার মধ্যে আমি আর আমার স্বামীও রয়েছি, একজন কন্ট্র‍্যাক্টরের সাথে কাজ করতাম, কোম্পানীগুলোর জন্যে কাপড় সেলাই করে। সেলাই মেশিন কোম্পানি দিতো আর কনট্র‍্যাক্টর জনপ্রতি দিনে ১৫০ টাকা দিতো। এই জিএসটি কি সেটা আমি বুঝি না, কিন্তু যবে থেকে লাগু হয়েছে, আমরা সবাই কাজ হারিয়েছি। তিনমাস ধরে কোম্পানিগুলো কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। কন্ট্র‍্যাক্টর জানিয়েছে তার হাতে কোন কাজ আসছে না।"

শিবশংকর বন্দোপাধ্যায়, এল আই সি এজেন্ট, চূঁচুড়া
==========================

"এল আই সি কে ধ্বংস করবার প্রক্রিয়া মনমোহন সিং শুরু করেছিলেন, মোদী এসে তাকে তরান্বিত করেছেন। এল আই সি'র নিজস্ব শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে, আর সরকার নিজের স্টেক বিদেশী কোম্পানিদের বেচে দেওয়ার ফিকির করছে। এই গোটা দেশের পরিকাঠামো - রাস্তা, জল, বিদ্যুৎ তৈরিতে এল আই সি'র লাভ্যাংশের ভূমিকা বিশাল। এল আই সি'র বর্তমান ভ্যালুয়েশন ২৪ লাখ কোটি টাকা। এটাকে বেসরকারি মালিকের হাতে তুলে দিলে কার স্বার্থরক্ষা হবে? এই বেসরকারি মালিকরাই ব্যাংকগুলোর কাছে ৮.৫ লাখ কোটি টাকা ঋন নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না। তার থেকে আমাদের নজর ঘোরাতে প্রথমে এলো নোটবন্দী, তারপর জিএসটি। 
এই জিএসটির জন্যে সিংগেল প্রিমিয়াম পলিসিতে এল আই সি'র পলিসি হোল্ডারদের ১.৮% অতিরিক্ত কর দিতে হচ্ছে। দেশজুড়ে আমাদের পলিসির বিক্রি কমছে।"

লক্ষনীয়া দেবী, বিহার
===============

" আমি আর আমার বন্ধুরা নালন্দা থেকে এসেছি। আমরা সরকারি স্কুলে মিড-ডে মিল রান্না করি। আমরা কাজ করি ১২ মাস কিন্তু আমাদের মাইনে আসে ১০ মাসের। নোটবন্দীর সময় আমাদের স্কুলে রেশন আসা বন্ধ হয়ে যায়। আমি অশিক্ষিত, জিএসটি মানে বুঝি না। কিন্তু দেখছি যবে থেকে এটা লাগু হয়েছে, আমাদের মিড-ডে মিলের আনাজ আর সবজির পরিমান কন্ট্র‍্যাক্টর কমিয়ে দিয়েছে। আগে মাঝেমধ্যে ডিম আর ফল আসতো, সেগুলোও আর আসে না। কন্ট্র‍্যাক্টরকে নালিশ জানালে বলে জিএসটির পরে এর বেশি দিলে তার লস হবে। বাচ্চারা কম খেলে সেটা তার মাথাব্যাথা না।"

শত্রুঘ্ন কুমার, উত্তর প্রদেশ
==================

"জিএসটি আমাদের শেষ করে দিয়েছে। আমি গাজিয়াবাদে একটি ছোট কাপড়ের মিলে চাকরি করতাম। জিএসটির আগে আমরা ১০০০০ টাকা মাইনে পেতাম, এখন সেটা কমে ৭৫০০ হয়ে গেছে। আমার সন্তানদের স্কুল ছাড়িয়ে দিয়েছি, গ্রামেও আর টাকা পাঠাতে পারি না। মালিক বলেছে যতদিন না জিএসটি পুরোপুরি ঠিকঠাক বাস্তবায়িত হচ্ছে, সে এর বেশি মাইনে দিতে পারবে না। তাও আমার চাকরিটা আছে, অনেকের তো সেটাও চলে গেছে। 
আসলে নোটবন্দীর পরে আমাদের ক্যাশে মাইনে বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাংক একাউন্ট তো গ্রামে, তাই ব্যাংকে যে মাইনে আসছিলো তা তুলতে পারিনি, ধার করে চালিয়েছি। এখনো সেই ধার শোধ করছি, তাই অতিরিক্ত চাপ রয়েছে।"

সারবান কুমার, হরিয়ানা
=================

"আমি এখানে এসেছি দিনমজুরদের নূন্যতম বেতনবৃদ্ধির দাবিতে। আমি নির্মাণ শ্রমিক, দিনে ২০০ টাকা পাই। আমি চাই এটা নূন্যতম ৭০০ টাকা হোক। এর কমে আজকাল সংসার চালানো যায় না। এমনিতেই নোটবন্দীর পরে নির্মাণশিল্পে কাজ পেতে খুব কষ্ট হয়। এর বাইরে আমরা যে ইটভাটায় কাজ পেতাম, সেগুলোও সব বন্ধ হয়ে গেছে। এখন মাসে ১০ দিন কাজ পেতেও কষ্ট করতে হয়। 
আগে আমরা গ্রামে ক্ষেতে মজুরির কাজ করতাম খারাপ সময়ে। এখন সেই কাজও পাওয়া যায় না, চাষীদের অবস্থা খুব খারাপ, ওরা বলছে চাষে আর প্রফিট নেই।"

হেমলতা, কেরালা
============

"আমি একজন অংগনওয়াড়ি কর্মী। আমরা ৫০০০ জন এই ধর্ণায় এসেছি। আমাদের এখন মাসে ১০০০০ টাকা দেওয়া হয়। এই সরকার আসবার পরে আমাদের জন্যে বাজেটে নতুন কোন বরাদ্দ হয়নি। আমরা চাইছি আমাদের নূন্যতম বেতন ১৮,০০০ টাকা করা হোক, এবং এর সাথে আমাদের সরকারি কর্মচারীদের মতনই ছুটি আর বোনাসের সুযোগ সুবিধে দেওয়া হোক। "

যাদের জবানবন্দী ওপরে লিপিবদ্ধ করলাম, তারা এবং দেশের আরো কয়েক লাখ শ্রমিক মিলে গত সপ্তাহে তিনদিন ধরে দিল্লির পার্লামেন্ট স্ট্রীটে ধর্ণাতে বসেছিলো। ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এবং বিভিন্ন স্বাধীন ফেডারেশনের ডাকে। 

দিল্লির পার্লামেন্ট স্ট্রীটে সরকারের বিরুদ্ধে কয়েক লাখ শ্রমিকের লড়াইয়ের ঘোষনা, কোন টিভি বা খবরের কাগজ আপনাকে দেখিয়েছে? আপনি জানতে পেরেছেন যে দেশের রাজধানীতে এইরকম বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো?
না জানতে পারেননি। কারন যাদের দায়িত্ব আপনাকে জানানোর, তারা মনে করেছে হয়তো এটা আপনাকে জানানো অতটা গুরুত্বপূর্ন না। তার মানেই এই মিডিয়া সবাই সরকারের দালাল? একদমই না।সরকারের বিরুদ্ধে অন্য যে বিভিন্ন ইস্যুতে লড়াই চলছে, যেমন ধর্ম, বাকস্বাধীনতা, লিঙ্গ, জাত, খাদ্যভাস, ইত্যাদি, এই লড়াইতে সবসময়েই এই মিডিয়াদের পাশে পাবেন। কিন্তু অর্থনীতির প্রশ্ন এলেই দেখবেন এনারা  ঘুমিয়ে পড়েন। কেন বলুন তো? কারন শ্রেনী। শ্রেনী বড়ই বিষম বস্তু। তাই জিগ্নেশ মেওয়ানিকে নিয়ে খবরের কাগজগুলো আর্টিকেল লিখবে, আপনাকে জানাবে সে দলিতদের অধিকারের জন্যে লড়ছে, কিন্তু তার প্রধান দাবি যে দলিতদের মধ্যে এক্ষুনি ভূমিবন্টন করা হোক, সেটা আপনাকে জানতে দেওয়া হবে না। আপনি নারীর অধিকার, স্বাধীনতা, সুরক্ষা নিয়ে মাঠে নামুন, টেলিগ্রাফ আপনার পাশে ঝাপিয়ে পড়বে, আপনি খাদ্যের স্বাধীনতা এবং ধর্মাচরণের স্বাধীনতা নিয়ে মিছিল করুন, এনডিটিভি আপনাকে এক ঘন্টার কভারেজ দেবে। কিন্তু আপনি যদি শ্রমিকের অধিকারের জন্যে ট্রেড ইউনিয়নের লড়াইয়ের কথা বলেন, তখন দেখবেন, এনারা খুব রেগে গেছেন। 

কারন ওই একটাই, শ্রেনী। 

ওই ওরা যেটা বোঝে, আমরাও সেটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবো, ততই ভালো। আসল লড়াইটা মোদীকে সরিয়ে রাহুল কে জেতানো না। আসল লড়াইটা ২০১৯ বা ২০২১ এর না। এগুলো একেকটা battle. আসল লড়াইটা war. শ্রেনী যুদ্ধ।  আজকে মোদীর বিরুদ্ধে যাদের পাশে পাচ্ছেন, এই টেলিগ্রাফ, এনডিটিভি, ইত্যাদি, আসল লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তারা কিন্তু দিক বেছে নিতে ভুল করবে না। আপনিও যেন ভুল না করেন। 

যেমন করেননি ওই কয়েক লাখ শ্রমিক। ওনারা ঘোষনা করেছেন, এর পরেই বাজেট ঘোষনার আগেই ওনারা দেশজুড়ে 'জেল ভরো' আন্দোলন শুরু করবেন। এবং তারপরেও তাদের দাবী না মানা হলে তারা লাগাতার ধর্মঘটের দিকে এগোবেন। মানে একদিনের সাধারন ধর্মঘট না। সমস্ত দাবী না মানা অবধি দেশজুড়ে লাগাতার ধর্মঘট। যা শেষবার এমার্জেন্সির সময় হয়েছিলো। 
এই লড়াই আসল লড়াই। এই লড়াই প্রধান লড়াই। এই লড়াই পবিত্র লড়াই। এখানে নিরপেক্ষ থাকবার অবকাশ নেই। আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এই লড়াইতে আপনি কোনদিকে থাকবেন।শাবানা, দিল্লী
==========

"নোটবন্দী আর জিএসটি, দুটোই আমার পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আমাদের গ্রাম মুস্তাফাবাদের ৫০০ জন, যার মধ্যে আমি আর আমার স্বামীও রয়েছি, একজন কন্ট্র‍্যাক্টরের সাথে কাজ করতাম, কোম্পানীগুলোর জন্যে কাপড় সেলাই করে। সেলাই মেশিন কোম্পানি দিতো আর কনট্র‍্যাক্টর জনপ্রতি দিনে ১৫০ টাকা দিতো। এই জিএসটি কি সেটা আমি বুঝি না, কিন্তু যবে থেকে লাগু হয়েছে, আমরা সবাই কাজ হারিয়েছি। তিনমাস ধরে কোম্পানিগুলো কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। কন্ট্র‍্যাক্টর জানিয়েছে তার হাতে কোন কাজ আসছে না।"

শিবশংকর বন্দোপাধ্যায়, এল আই সি এজেন্ট, চূঁচুড়া
==========================

"এল আই সি কে ধ্বংস করবার প্রক্রিয়া মনমোহন সিং শুরু করেছিলেন, মোদী এসে তাকে তরান্বিত করেছেন। এল আই সি'র নিজস্ব শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে, আর সরকার নিজের স্টেক বিদেশী কোম্পানিদের বেচে দেওয়ার ফিকির করছে। এই গোটা দেশের পরিকাঠামো - রাস্তা, জল, বিদ্যুৎ তৈরিতে এল আই সি'র লাভ্যাংশের ভূমিকা বিশাল। এল আই সি'র বর্তমান ভ্যালুয়েশন ২৪ লাখ কোটি টাকা। এটাকে বেসরকারি মালিকের হাতে তুলে দিলে কার স্বার্থরক্ষা হবে? এই বেসরকারি মালিকরাই ব্যাংকগুলোর কাছে ৮.৫ লাখ কোটি টাকা ঋন নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না। তার থেকে আমাদের নজর ঘোরাতে প্রথমে এলো নোটবন্দী, তারপর জিএসটি। 
এই জিএসটির জন্যে সিংগেল প্রিমিয়াম পলিসিতে এল আই সি'র পলিসি হোল্ডারদের ১.৮% অতিরিক্ত কর দিতে হচ্ছে। দেশজুড়ে আমাদের পলিসির বিক্রি কমছে।"

লক্ষনীয়া দেবী, বিহার
===============

" আমি আর আমার বন্ধুরা নালন্দা থেকে এসেছি। আমরা সরকারি স্কুলে মিড-ডে মিল রান্না করি। আমরা কাজ করি ১২ মাস কিন্তু আমাদের মাইনে আসে ১০ মাসের। নোটবন্দীর সময় আমাদের স্কুলে রেশন আসা বন্ধ হয়ে যায়। আমি অশিক্ষিত, জিএসটি মানে বুঝি না। কিন্তু দেখছি যবে থেকে এটা লাগু হয়েছে, আমাদের মিড-ডে মিলের আনাজ আর সবজির পরিমান কন্ট্র‍্যাক্টর কমিয়ে দিয়েছে। আগে মাঝেমধ্যে ডিম আর ফল আসতো, সেগুলোও আর আসে না। কন্ট্র‍্যাক্টরকে নালিশ জানালে বলে জিএসটির পরে এর বেশি দিলে তার লস হবে। বাচ্চারা কম খেলে সেটা তার মাথাব্যাথা না।"

শত্রুঘ্ন কুমার, উত্তর প্রদেশ
==================

"জিএসটি আমাদের শেষ করে দিয়েছে। আমি গাজিয়াবাদে একটি ছোট কাপড়ের মিলে চাকরি করতাম। জিএসটির আগে আমরা ১০০০০ টাকা মাইনে পেতাম, এখন সেটা কমে ৭৫০০ হয়ে গেছে। আমার সন্তানদের স্কুল ছাড়িয়ে দিয়েছি, গ্রামেও আর টাকা পাঠাতে পারি না। মালিক বলেছে যতদিন না জিএসটি পুরোপুরি ঠিকঠাক বাস্তবায়িত হচ্ছে, সে এর বেশি মাইনে দিতে পারবে না। তাও আমার চাকরিটা আছে, অনেকের তো সেটাও চলে গেছে। 
আসলে নোটবন্দীর পরে আমাদের ক্যাশে মাইনে বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাংক একাউন্ট তো গ্রামে, তাই ব্যাংকে যে মাইনে আসছিলো তা তুলতে পারিনি, ধার করে চালিয়েছি। এখনো সেই ধার শোধ করছি, তাই অতিরিক্ত চাপ রয়েছে।"

সারবান কুমার, হরিয়ানা
=================

"আমি এখানে এসেছি দিনমজুরদের নূন্যতম বেতনবৃদ্ধির দাবিতে। আমি নির্মাণ শ্রমিক, দিনে ২০০ টাকা পাই। আমি চাই এটা নূন্যতম ৭০০ টাকা হোক। এর কমে আজকাল সংসার চালানো যায় না। এমনিতেই নোটবন্দীর পরে নির্মাণশিল্পে কাজ পেতে খুব কষ্ট হয়। এর বাইরে আমরা যে ইটভাটায় কাজ পেতাম, সেগুলোও সব বন্ধ হয়ে গেছে। এখন মাসে ১০ দিন কাজ পেতেও কষ্ট করতে হয়। 
আগে আমরা গ্রামে ক্ষেতে মজুরির কাজ করতাম খারাপ সময়ে। এখন সেই কাজও পাওয়া যায় না, চাষীদের অবস্থা খুব খারাপ, ওরা বলছে চাষে আর প্রফিট নেই।"

হেমলতা, কেরালা
============

"আমি একজন অংগনওয়াড়ি কর্মী। আমরা ৫০০০ জন এই ধর্ণায় এসেছি। আমাদের এখন মাসে ১০০০০ টাকা দেওয়া হয়। এই সরকার আসবার পরে আমাদের জন্যে বাজেটে নতুন কোন বরাদ্দ হয়নি। আমরা চাইছি আমাদের নূন্যতম বেতন ১৮,০০০ টাকা করা হোক, এবং এর সাথে আমাদের সরকারি কর্মচারীদের মতনই ছুটি আর বোনাসের সুযোগ সুবিধে দেওয়া হোক। "

যাদের জবানবন্দী ওপরে লিপিবদ্ধ করলাম, তারা এবং দেশের আরো কয়েক লাখ শ্রমিক মিলে গত সপ্তাহে তিনদিন ধরে দিল্লির পার্লামেন্ট স্ট্রীটে ধর্ণাতে বসেছিলো। ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এবং বিভিন্ন স্বাধীন ফেডারেশনের ডাকে। 

দিল্লির পার্লামেন্ট স্ট্রীটে সরকারের বিরুদ্ধে কয়েক লাখ শ্রমিকের লড়াইয়ের ঘোষনা, কোন টিভি বা খবরের কাগজ আপনাকে দেখিয়েছে? আপনি জানতে পেরেছেন যে দেশের রাজধানীতে এইরকম বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো?
না জানতে পারেননি। কারন যাদের দায়িত্ব আপনাকে জানানোর, তারা মনে করেছে হয়তো এটা আপনাকে জানানো অতটা গুরুত্বপূর্ন না। তার মানেই এই মিডিয়া সবাই সরকারের দালাল? একদমই না।সরকারের বিরুদ্ধে অন্য যে বিভিন্ন ইস্যুতে লড়াই চলছে, যেমন ধর্ম, বাকস্বাধীনতা, লিঙ্গ, জাত, খাদ্যভাস, ইত্যাদি, এই লড়াইতে সবসময়েই এই মিডিয়াদের পাশে পাবেন। কিন্তু অর্থনীতির প্রশ্ন এলেই দেখবেন এনারা  ঘুমিয়ে পড়েন। কেন বলুন তো? কারন শ্রেনী। শ্রেনী বড়ই বিষম বস্তু। তাই জিগ্নেশ মেওয়ানিকে নিয়ে খবরের কাগজগুলো আর্টিকেল লিখবে, আপনাকে জানাবে সে দলিতদের অধিকারের জন্যে লড়ছে, কিন্তু তার প্রধান দাবি যে দলিতদের মধ্যে এক্ষুনি ভূমিবন্টন করা হোক, সেটা আপনাকে জানতে দেওয়া হবে না। আপনি নারীর অধিকার, স্বাধীনতা, সুরক্ষা নিয়ে মাঠে নামুন, টেলিগ্রাফ আপনার পাশে ঝাপিয়ে পড়বে, আপনি খাদ্যের স্বাধীনতা এবং ধর্মাচরণের স্বাধীনতা নিয়ে মিছিল করুন, এনডিটিভি আপনাকে এক ঘন্টার কভারেজ দেবে। কিন্তু আপনি যদি শ্রমিকের অধিকারের জন্যে ট্রেড ইউনিয়নের লড়াইয়ের কথা বলেন, তখন দেখবেন, এনারা খুব রেগে গেছেন। 

কারন ওই একটাই, শ্রেনী। 

ওই ওরা যেটা বোঝে, আমরাও সেটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবো, ততই ভালো। আসল লড়াইটা মোদীকে সরিয়ে রাহুল কে জেতানো না। আসল লড়াইটা ২০১৯ বা ২০২১ এর না। এগুলো একেকটা battle. আসল লড়াইটা war. শ্রেনী যুদ্ধ।  আজকে মোদীর বিরুদ্ধে যাদের পাশে পাচ্ছেন, এই টেলিগ্রাফ, এনডিটিভি, ইত্যাদি, আসল লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তারা কিন্তু দিক বেছে নিতে ভুল করবে না। আপনিও যেন ভুল না করেন। 

যেমন করেননি ওই কয়েক লাখ শ্রমিক। ওনারা ঘোষনা করেছেন, এর পরেই বাজেট ঘোষনার আগেই ওনারা দেশজুড়ে 'জেল ভরো' আন্দোলন শুরু করবেন। এবং তারপরেও তাদের দাবী না মানা হলে তারা লাগাতার ধর্মঘটের দিকে এগোবেন। মানে একদিনের সাধারন ধর্মঘট না। সমস্ত দাবী না মানা অবধি দেশজুড়ে লাগাতার ধর্মঘট। যা শেষবার এমার্জেন্সির সময় হয়েছিলো। 
এই লড়াই আসল লড়াই। এই লড়াই প্রধান লড়াই। এই লড়াই পবিত্র লড়াই। এখানে নিরপেক্ষ থাকবার অবকাশ নেই। আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এই লড়াইতে আপনি কোনদিকে থাকবেন।

রবিবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৭

ডেঙ্গু ~ শাক্যজিত ভট্টাচার্য্য

আলব্যের কামুর 'দ্য প্লেগ' উপন্যাসে একটি আলজেরিয়ান শহর, ওরান, প্লেগের কবলে পড়েছিল। আস্তে আস্তে মৃতের সংখ্যা যখন বাড়ছিল, শহরটিকে অবরুদ্ধ করে দেওয়া হয়। গ্রিক ট্র্যাজেডির ফর্মে লেখা পাঁচ পরিচ্ছদে বিভক্ত উপন্যাসটিতে প্রথম পরিচ্ছদের শেষে গিয়ে গম্ভীর বিষণ্ণ কণ্ঠে প্রিফেক্টের নির্দেশ এসেছিল "ক্লোজ দ্য টাউন"। 

আর এইভাবে, নাৎসি অধিকৃত ফ্রান্সের অবরুদ্ধ হয়ে পড়া এবং তার বিরুদ্ধে মানুষের অন্তহীন সংগ্রামের কাহিনীর প্যারাবল  হয়ে উঠেছিল প্লেগের আক্রমণ, অবরোধ এবং মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম। 

আমাদের কোনও কামু নেই। তাই মৃতের সংখ্যা শতাধিক ছাড়ালেও ডেঙ্গু নিয়ে এরকম লেখা কখনো হবে না।  সরকার অস্বীকার করবে, নির্মম উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে বিশ্ববাংলা উৎসব করবে, কর্তব্যরত চিকিৎসককে সাসপেন্ড করবে, আর একটা গোটা শহরকে ধীরে ধীরে কব্জা করে নেবে একটা মারণ রোগ।  আসলে কে না জানে, আপনি যখন স্বপ্নে বিভোর, কোল্ড ক্রিম আপনার ত্বকের গভীরে কাজ করে। আমরা যখন সুপ্ত অচেতন, শোষক কীট আমাদের  সর্বাঙ্গ কুরে খায়। আপনি যখন আকাশের আনন্দে মগ্ন, ফ্যাসিবাদ তখন নিঃশব্দে প্রবেশ করে ! 

প্লেগ উপন্যাসটি শেষ হয়েছিল এই বলে 

"...the plague bacillus never dies or disappears for good; that it can lie dormant for years and years in furniture and linen-chests; that it bides its time in bedrooms, cellars, trunks, and bookshelves; and that perhaps the day would come when, for the bane and the enlightening of men, it would  rouse up its rats again and send them forth to die in a happy city." 

এই প্লেগকে কেউ কেউ ডেঙ্গু নামে  জানে, কেউ জানে তৃণমূল সরকার নামে।

শুক্রবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৭

হাসপাতালের জার্নাল ~ অরুণাচল দত্ত চৌধুরী

যাহা বলিব সত্য বলিব 
অথবা 
কার্নিভ্যাল সমগ্রঃ

গত ৬ই অক্টোবর আমার অ্যাডমিশন ডে ছিল।  সরকারি জেলা হাসপাতালে। ওয়ার্ডের নোটিসবোর্ডে আমার নাম Dr.A.D.C.
সকাল ৯টা থেকে পরের দিন সকাল ৯টা অবধি যত রোগী/রোগিনী ভর্তি হবেন সব টিকিটে লেখা আমার নাম। অর্থাৎ এই রোগীদের ভর্তি পরবর্তী চিকিৎসা,  রেফারেল, যদি মৃত্যু ঘটে সে'ই দুঃখজনক ঘটনা সব কিছুর জন্যই "আই উইল বি হেল্ড রেসপন্সিবল।"
এই ২৪ ঘণ্টা কাটানোর পর সব মিলিয়ে আমার অবস্থা কেমন? শরীরের কথা থাক। মনের কথাটা বলি। উদাহরণ দিয়ে বলি। কিশোর বেলায় ঘুড়ি ওড়ানোর সময় ঘুড়ি যখন আকাশে আর লাটাই আমার হাতে সেই সময় উত্তেজিত থাকতাম খুব। কখন সুতো ছাড়ব, কখন টানব, ঘুড়ি কোন বাতাসে কোন দিকে গোঁত্তা খাচ্ছে … সে এক তুলকালাম অবস্থা। কিন্তু সেই ঘুড়িটা কেটে গেলে, মন নিমেষে উত্তেজনা মুক্ত। কাটা ঘুড়ির পেছনে দৌড়োনো স্রেফ অভ্যেস বশে। মন জানে, লাভ নেই। এখনও প্রায় সেই রকমই। ভর্তি রোগীর সংখ্যা অকল্পনীয় হওয়ায়, মনে আর কোনও চাপ নেই। অপরাধবোধ? তা' একটু রয়েছে বটে। আশা, প্রশাসকদের দেখে সেই লজ্জা আবরণটিও সরে যাবে।
যখন আমার নামে ভর্তি হওয়া মানুষের মোট সংখ্যা পঞ্চাশ ষাট ছিল কয়েকসপ্তাহ আগেও জানতাম ঘুড়িটা উড়ছে। কান্নিক খাচ্ছিল… তবুও উড়ছিল। কিন্তু তার পরে এই জেলায় পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জ্বর, সেই কারণে প্রচুর মৃত্যু, আর অকল্পনীয় মৃত্যুভয়।
অথবা অন্য ভাবে বললে, ভর্তি রোগীর সংখ্যাটা যতদিন কম ছিল মানে কম বেশি একশ', জানতাম যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কাজ করছি। আজ যখন সে সংখ্যা পাঁচশ'র আশেপাশে, জেনে গেছি যুদ্ধ অসম্ভব। বন্যার জল ঢুকে পড়েছে, এখন একমাত্র গতি ভেসে যাওয়া।
ইতিমধ্যে কর্পোরেট হাসপাতালে জ্বরে মৃত্যুর কারণে ভাঙচুর মহামান্য মিডিয়া সাড়ম্বরে ছেপেছে। দেখিয়েছে।
সেই মিডিয়া কিন্তু প্রান্তিক হাসপাতাল দেগঙ্গা বা রুদ্রপুর হাসপাতাল ছেড়ে দিন, এমন কী জেলা হাসপাতালে উঁকি দিয়েও দেখেনি। কাজ সেরেছে সম্ভবত স্থানীয় স্বাস্থ্য প্রশাসকদের সাথে কথা বলে, যাদের একমাত্র কাজই হচ্ছে তথ্য চেপে যাওয়া।
যাই হোক, যা বলছিলাম, মেডিসিন ওয়ার্ডের মেঝে ছেড়ে উপচে ওঠা ভর্তি রোগীর ভিড় নেমে এসেছে হাসপাতাল বিল্ডিংএর অন্যান্য মেঝেতে, যেখানেই প্লাসটিক শিট পাতার সামান্যতম জায়গা রয়েছে, সে'খানে। 
পা রাখার জায়গা আক্ষরিক অর্থেই নেই। ভর্তি রোগীর মোট সংখ্যা? কেউ জানে না, শুধু কম্পিউটার জানে। 
সবার গায়ে জ্বর। অনেকের কাছেই বাইরের ল্যাবে করানো ব্লাড রিপোর্ট। সবারই এক আর্তি, রিপোর্টে ডেঙ্গু ধরা পড়েছে, অর্থাৎ এনএসওয়ান পজিটিভ আর প্লেট(পড়ুন প্লেটলেট) কমেছে। সবার বাড়ির লোকের দাবী, স্যালাইন দাও।

সবাইকে সেই দিনের ভারপ্রাপ্ত ডাক্তার ইচ্ছে থাকলেও ছুঁয়ে দেখতে পারছে না। কারণ ত্রিবিধ। প্রথমত মোট  রোগীর সংখ্যা, সম্ভবত পাঁচশ, একলা দেখতে হবে রাউন্ডে। দ্বিতীয়ত বেড হেডটিকিটের উল্লিখিত রোগীকে খুঁজে পাওয়া। কোন বারান্দার বা কোন ঘুপচির মধ্যে গাদাগাদি হয়ে রয়েছে সে হাজার ডাকাডাকি করেও পাওয়া যাচ্ছে না। তৃতীয়ত খুঁজে যদিও বা পাওয়া গেল, গায়ে গা লাগিয়ে শুয়ে থাকা মানুষগুলোর কাছে অন্যকে পায়ে না মাড়িয়ে পৌঁছোনো কার্যত অসম্ভব। 
জেলার স্বাস্থ্য প্রশাসক অতি চালাকের মত বিবৃতি দিচ্ছে হাসপাতালে সব ব্যবস্থা(পড়ুন নির্ভেজাল অব্যবস্থা) রয়েছে। হাসপাতালের প্রশাসক অসহায়। অলিখিত নির্দেশ রয়েছে অব্যবস্থার কথা বা ছবি ঢাকতে হবে যে কোনও মূল্যে। তা' নইলে নেমে আসবে ব্যক্তিগত কোপ। আর তার নিজেরও আনুগত্য দেখিয়ে স্বাস্থ্যভবনের প্রসাদকণা পাবার আকাঙ্ক্ষা বড় কম নয়। 
আর আমি? একদিনে যাকে দেখতে হবে কমবেশি পাঁচশ জন, সেই আমি অতিব্যস্ত আগামী এক দেড় দিনের মধ্যেই নমো নমো করে এ'দের অনেককে জ্বর গায়েই বাড়ি পাঠিয়ে দিতে, কেন না পরের দিন গুলোয় নতুন পাঁচশ জনের তো "সাব হিউম্যান তবু সব ব্যবস্থা থাকা" সরকারী হাসপাতালে জায়গা চাই। আক্রান্ত জনসমুদ্র ঝাঁপয়ে পড়ছে ইমারজেন্সিতে।
এর মধ্যেই মারা যাচ্ছে জ্বরের রোগী। বুঝিয়েসুজিয়ে(প্রশাসনিক জবানে কাউন্সেলিং করে), কান্না মোছানোর চেষ্টা করছি। ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ লিখছি…না না ডেঙ্গু নয়। 
এই রাজ্যে ডেঙ্গু হওয়া বারণ। এই অতি চালাক আমি… রক্তচোখের ভয়ে  ভীত কেন্নোর মত সন্ত্রস্ত এই আমি অভাগার ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ লিখছি 'ফিভার উইথ থ্রম্বোসাইটোপিনিয়া'।
আর রক্তচোখের মালকিন মালিকেরা তখন কার্নিভ্যালে কৃত্রিম একধরণের ঠোঁট প্রসারিত চালাক চালাক প্রায় অশ্লীল হাসির ভঙ্গিমায়, কখনও বিসর্জন দেখছে, কখনও দেখছে ফুটবলের কবন্ধ রাক্ষুসে মূর্তি। 

এর মধ্যে বলাই বাহুল্য জ্বর ছাড়া অন্যান্য রোগীরাও ভর্তি হয়েছেন মেডিসিন ওয়ার্ডে। মানে হার্ট অ্যাটাক, সেরিব্রাল স্ট্রোক, সিরোসিস, কাশি-বমিতে রক্তপাত, খিঁচুনি ইত্যাকার বহু দুর্ভাগা। তাঁদের দেওয়া সুচিকিৎসা(?)র কথা সহজেই অনুমেয়। আমার দেওয়া তথ্যের সমর্থনে রোগীদের দুর্দশার ছবি মোবাইলে তুলে সাঁটানোই যেত এই দেওয়ালে। কিন্তু মহামহিম স্থানীয় প্রশাসক কার যেন মোবাইল এই অপরাধে নাকি বাজেয়াপ্ত করেছেন। সরকারী গোপন তথ্য ফাঁস করা অপরাধ। 
একটা পুরোনো রাশিয়ান কৌতুকী মনে পড়ল।
শিক্ষামন্ত্রীকে গাধা বলেছিল একটা লোক। বিচারে দু'দফায় জরিমানা হয়েছিল তার। প্রথম কারণ শিক্ষামন্ত্রীকে অপমান, দ্বিতীয় কারণ রাষ্ট্রের গোপন তথ্য ফাঁস। 
জানি না আমার এই লেখায় সেই গোপন তথ্য ফাঁসের অপরাধ ঢুকে গেল কিনা।

প্রান্তিক ভোটার আপাতত জ্বরে কাঁপছে। কাঁপুক।
মরে যাচ্ছে। যাক।
অপ্রতিহত চলুক ভোগান্তি আর মৃত্যুর কার্নিভ্যাল।
নিষ্ঠুর হলেও সত্যি, আবার ভোট এলে প্রসাদ কুড়োনো করে কম্মে খাওয়া ভাইবেরাদরদের হাত দিয়ে পাঠানো হবে ভিক্ষের অনুদান। 
মশা আর ভোট বেড়ে যাবে এ'ভাবেই… ফিবছর।
-------------------------------------------------------------------
মেল মেডিসিন আর ফিমেল মেডিসিনের নোটিশ বোর্ডের ছবি দিলাম। বাহুল্যবোধে আইসোলেশন ওয়ার্ডেরটা দিলাম না।
---------------------------------------------------------

অরুণাচল ~ আর্যতীর্থ

এই তো কেমন পেয়েই গেলেন সত্যি কথা বলার ফল,
সবার মুখে কুলুপ আঁটা , বলেন  শুধু অরুণাচল।

সবাই জানে হচ্ছে যেটা, সত্যি তবু বলতে নেই,
প্রদীপগুলোর তেলের অভাব, জ্বলার মতন পলতে নেই।

যুগটা এখন অন্ধ সাজার, জিভের লালায় বশ্যতা
এমন সময় ও বেয়াদপ, এত সাহস পাস কোথা?

উপচে পড়ুক জ্বরের রোগী, তাই বলে লিখবে ছাই?
আপ্তবাক্য পড়েননি কি, শতংবদ , লিখতে নাই?

এই রাজ্যে জ্বরজ্বালা তো, বলতে পারো গুপ্তরোগ,
চোরের মতন চুপিচুপি , সইতে হবে সে দুর্ভোগ।

সাহসকে যাই বলিহারি! রাজার পরে ,রাজার খায়,
আপোষ নামক পাপোষ ছেড়ে, কলম তবু গর্জে যায়।

গর্দানটি আস্ত আছে, এটাই জেনো পূণ্যফল,
সত্যি কথার দাম দিতে হয়, জানেন সেটা অরুণাচল।

ভাবছি বসে সমস্যাটা, এতেই কি আর মিটবে সব?
অতই সহজ করা কলম জবুথবু, জরোদগব?

শব্দরা তাঁর ফুলকি হয়ে, আগুন ছড়ায় সব বুকে,
রাজার চরে আটবে কুলুপ, খুঁজে খুঁজে কয় মুখে?

উঠছে বাতাস, বইছে বাতাস, নড়বে এবার ধর্মকল,
ভালো করে দেখুন রাজা, তৈরী হাজার অরুণাচল।


বৃহস্পতিবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৭

গুল্প-সমগ্র ~ অরুণাচল দত্ত চৌধুরি

কোর্টে দেওয়া হলফনামা… 
ফালতু হাসির গল্প থামা
জ্বরের কারণ পুজোয় নাকি 
বাইরে ঘুরতে গিসল মামা।

'যাচ্ছিস যা লালপাহাড়ি, 
সঙ্গে কিন্তু নিস্ মশারি',
পিসির হুকুম।( সেই যে পিসি, 
ভাইপোরা যার বদের ধাড়ি)।

সেই মশারিই গেছিস ভুলে? 
ভিন রাজ্যের মশক ছুঁলে, 
ঘটার যে'টা ঘটল সে'টাই, 
ডেঙ্গি ছিল তাদের হুলে।

কামড়াল তো, তার পরে কী? 
অবাক হয়ে সবাই দেখি
সবার গাত্রে জ্বরের তাড়স। 
চেঁচায় পিসি রিপোর্ট মেকি।

এই সে'দিনও ঢাক পিটিয়ে
দিচ্ছিল এই বিকট ইয়ে
হঠাৎ কেন ডেঙ্গি কথা 
করছে স্বীকার কোর্টে গিয়ে?

জিভের গোড়ায় বেজায় মিথ্যে। 
ক্লাব অনুদান পাগলু নৃত্যে
ভোটের হিসেব। আজকে বুঝি 
ভয় জেগেছে ও'টার চিত্তে?

অন্য রাজ্যে ভ্রমণ পাড়ি ,
দেয় যারা সব দেগঙ্গারই?
বাদুড়িয়ার বসিরহাটের? 
এ' গুল কি কেউ মানতে পারি?

তার চাইতে বল্ না সোজা
ইচ্ছে করেই চক্ষু বোজা
কার্নিভ্যাল আর মেলায় খেলায়
যায়নিকো রাজধর্ম খোঁজা।

রবিবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৭

পশ্চিমবঙ্গে ডেঙ্গু ~ সুশোভন পাত্র

ঠিকই  তো বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মশা তো আর সরকারের হাতে নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মশার ডিমও পাড়েন না। খাল কেটে মশা ডেকেও আনেন না। জমা জলেই তো মশা ডিম পাড়ে। কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে তো আর পাড়ে না। মশার কামড়েই তো ডেঙ্গু হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চিমটি কাটলে তো আর হয় না। আপনার ঘরে মশারি কি মুখ্যমন্ত্রী  মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টাঙ্গিয়ে দিয়ে যাবেন ? নর্দমায় ব্লিচিং পাউডার কি স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছড়িয়ে দেবেন?  আরে বাবা, আপনার জ্বর হলে ব্লাডের অগ্নিপরীক্ষা কি মুখ্যমন্ত্রী দেবেন নাকি ? নো ! নেভার !  
এর পরেও কি আপনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে নূন্যতম দায়বদ্ধতা আশা করছেন? নির্বাচিত সরকারের কাছে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে রিঅ্যাক্টিভ অ্যান্ড কারেক্টিভ মেসার্স আশা করছেন? মৃত্যু মিছিল থামাতে প্রশাসনিক তৎপরতা আশা করছেন? আপনার ট্যাক্সের বিনিময়ে উন্নত পরিষেবা আশা করছেন? তাহলে কাইন্ডলি কদিন পরে আসুন! আপাতত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সরকার এবং প্রশাসন -মৃতের সংখ্যা নিয়ে জটিল অঙ্ক কষতে ব্যস্ত আছেন।  
১২'ই অক্টোবর মনিটরিং কমিটির বৈঠক শেষে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, "বেসরকারি কিছু ল্যাবরেটরি বাণিজ্যিক স্বার্থে বিভ্রান্তিকর প্রচার চালাচ্ছে৷ ডেঙ্গু পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে" ¹। ২৫শে অক্টোবর নজরুল মঞ্চে তৃণমূল কংগ্রেসের বর্ধিত কোর কমিটির বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীই আবার জানালেন "আর পাঁচটা রাজ্যের চেয়ে ঢের ভালো আছে বাংলা। এখনও পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা মাত্র ৩৪" ² । আর ৩০শে অক্টোবর নবান্নে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীই সাংবাদিক'দের বললেন "এখন পর্যন্ত রাজ্যে ডেঙ্গু মৃতের সংখ্যা মাত্র ১৩" ³ ।  
২৫শে অক্টোবরের ৩৪, ৩০শে অক্টোবর হয়ে গেলো ১৩। তাহলে কি ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা রাজ্যে প্রতিদিন কমছে? তাহলে কি 'মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায়' মৃত ব্যক্তি ডেঙ্গু সারিয়ে প্রাণও ফিরে পাচ্ছে? না, এমন বেয়াড়া প্রশ্ন করে মুখ্যমন্ত্রীর গৃহপালিত মিডিয়া সরকার কে বিব্রত করেনি। আসলে, শিলাদিত্যরা জানে, এ রাজ্যে প্রশ্ন করা মানা। অম্বিকেশরা জানে, এ রাজ্যে কার্টুন আঁকা মানা। আর ডাঃ শ্যামাপদ গড়াইরা জানে, এ রাজ্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিরদাঁড়া সোজা রাখা মানা। 
 ২৬শে মে, ২০১১। 'পরিবর্তন' তখন টাটকা। মহাকরণের রুট বদলে সেদিন গাড়িটা সটান থেমেছিল বাঙ্গুর হাসপাতালে। স্বাস্থ্য পরিষেবা সরজমিনে পরিদর্শন করবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে গণ্ডা খানেক মন্ত্রী। ডজন খানেক পারিষদ। এবং শ-খানেক সাংবাদিক। 
মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন শুনে ভিড় ঠেলে তাঁর কাছে পৌঁছন বাঙ্গুরের নিউর সায়েন্সে ডিপার্টমেন্টের অধিকর্তা ডাঃ গড়াই। শুরু হয় র‍্যাপিড ফায়ার রাউন্ড। "এম.আর.আই করতে দেরি হয় কেন?", "স্যালাইন ওয়াটারের সাপ্লাই নেই কেন?", "আউটডোরে লম্বা লাইন কেন?" – আফটার অল সি.পি.এম'র পরিত্যক্ত বাঙ্গুর তো; নবাগতা মুখ্যমন্ত্রীর তাই অভিযোগের লম্বা লিস্টি। হাসপাতাল প্রাঙ্গণে অপ্রত্যাশিত ভিড়ে রোগীদের অসুবিধা হবে বুঝে, মুখ্যমন্ত্রী কে বসে আলোচনার প্রস্তাব দেন ডাঃ গড়াই। বিরক্ত মুখ্যমন্ত্রী প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন ,"আমি এসেছি বলে আপনার কি অসুবিধা হচ্ছে? আপনি ফাইল নিয়ে কাল মহাকরণে দেখা করুন।" ডাঃ গড়াই সেদিনই জানান সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা অবধি অপারেশনের শিডিউল রয়েছে, 'কাল' দেখা করা সম্ভব নয়। আর তারই হাতে গরম জবাব দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বিদ্যুৎ গতির তৎপরতায় রাতেই সাসপেন্ড হন ডাঃ গড়াই। পরিবর্তন দাদা পরিবর্তন ! 'ডু ইট নাও' থেকে 'সাসপেন্ড হিম টু-নাইট' ⁴ !
বড্ড ভুল করেছিলেন ডাঃ গড়াই। অপারেশন ছেড়েই মহাকরণে যাওয়া উচিত ছিল। গলায় গামছা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কে 'আপনি-আজ্ঞে' করা উচিত ছিল। ডাঃ গড়াই'র বোঝা উচিত ছিল, পরিদর্শনের নামে সেদিনের সারপ্রাইজ ভিজিটটা আসলে আপাদমস্তক রাজনৈতিক ব্রাউনি পয়েন্ট কুড়ানোর গিমিক। না হলে আজকে যখন ডেঙ্গু আক্রান্তদের ভিড়ে সরকারী হাসপাতালের বারান্দা উপচে পড়ছে;  কেন্দ্রীয় ভেক্টরবোর্ন ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের নির্দেশাবলী যখন ছত্রে ছত্রে অমান্য হচ্ছে;  চিকিৎসক সংগঠন যখন পৃথক কমিশন গঠন করে সত্য প্রকাশ্যের দাবি জানাচ্ছে ⁵; হাইকোর্ট যখন ডেঙ্গু পরিস্থিতির রিপোর্ট তলব করছে  ⁶; তখন মুখ্যমন্ত্রী 'স্বাস্থ্য পরিষেবা সরজমিনে' পরিদর্শন তো দূর বরং পায়ের উপর পা তুলে সাংবাদিক সম্মেলনে মৃতের সংখ্যা নিয়ে জাগলারি করছেন। আর অ্যাডিস মশাতে'ও সিপিএম'র ভূত দেখছেন ² ।
মুখ্যমন্ত্রী আপনিই ঠিকই বলেছেন কেরালা'তে সি.পি.এম'ই আছে। ডেঙ্গু'ও হয়েছে। লোক'ও মরেছে। কিন্তু আপনি যখন মৃত্যু কে ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত, তখন কেরালার মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, "এই বিপর্যয়ে সমস্ত রাজনৈতিক দলের একসাথে কাজ করা জরুরী। প্রাইভেট হাসপাতালের ডাক্তার'দের সরকারী হাসপাতালে পরিষেবা প্রদানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। সকল মিডিয়া কে সচেতনতা মূলক প্রচার শুরু করতে অনুরোধ করছি। জন প্রতিনিধি'রা এবং স্কুলের প্রধান শিক্ষক'রা 'ক্লিন কেরালা' প্রোগ্রামের নেতৃত্ব দিন। আমরা ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। সমাজের প্রত্যেকের অংশগ্রহণ ছাড়া সেই যুদ্ধ জয় সম্ভব নয়" ⁷ ⁸ । আর সেই সার্বিক প্রচেষ্টা'তেই আপাতত বিপদমুক্ত কেরালা। অগাস্ট অবধি যেখানে ডেঙ্গু তে মৃতের সংখ্যা ছিল ২৮, সেখানে গত দু মাসে নতুন করে কাউকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মরতে হয়নি কেরালায় ⁹ ¹⁰ । 
ডিয়ার মুখ্যমন্ত্রী, ডেঙ্গু কে 'মহামারী' ঘোষণা করলেও আপনার ভোট ব্যাঙ্ক অক্ষতই থাকতো। 'অজানা জ্বরে'র জায়গায় ডেঙ্গু লিখলেও পঞ্চায়েত ভোট আপনার দলই জিতত। সমস্ত রাজনৈতিক দলের সাহায্য চাইলেও আপনার সম্মান বলবৎ'ই রইত। প্রশাসনিক তৎপরতায় কটা প্রাণ বাঁচলে মানুষ আপনাকে আশীর্বাদই করত। কিন্তু আমরা জানি, আপনি এসব কিছুই করবেন না। করবেন না, কারণ ঘোলা করে জল খাওয়া আপনার পুরনো অভ্যাস। জ্ঞানেশ্বরী থেকে ডেঙ্গু -সিপিএমের ভূত দেখা আপনার পুরনো অভ্যাস। রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে লাশ কুড়ানো আপনার পুরনো অভ্যাস। শুধু মনে রাখবেন, বিন্দু বিন্দু ক্ষোভ জমিয়ে সিন্ধু গড়ে গদি উল্টে দেওয়া কিন্তু আমাদেরও পুরনো অভ্যাস। গিমিক সর্বস্ব রাজনীতি কে নবান্নের চোদ্দতলা থেকে মাটিতে নামিয়ে আনা কিন্তু আমাদেরও পুরনো অভ্যাস। আর লাশ কুড়ানো স্বৈরাচারী শাসক'দের আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা কিন্তু ইতিহাসেরও পুরনো অভ্যাস।










বৃহস্পতিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৭

ডেঙ্গু = অজানা জ্বর

বুড়ো বলল, "তা হলে লিখে নাও—আক্রান্তের সংখ্যা ১৫০০, মৃতের সংখ্যা ১৩।"
আমি বললাম, "দুৎ! আমার জেলাতেই মৃতের সংখ্যা ৯০ ছাড়িয়ে গেছে , বলে কিনা ১৩!"
বুড়ো খানিকক্ষণ কি যেন ভেবে জিজ্ঞাসা করল, "বাড়তি না কমতি?"
আমি বললাম, "সে আবার কি?"
বুড়ো বলল, "বলি ডেঙ্গিতে মৃত্যু এখন বাড়ছে না কমছে?"
আমি বললাম, "মৃত্যু আবার কমবে কি?"
বুড়ো বলল, "তা নয় তো কেবলই বেড়ে চলবে নাকি? তা হলেই তো গেছি। কোনদিন দেখব মৃতের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে একেবারে ষাট সত্তর আশি পার হয়ে গেছে। শেষটায় পঞ্চায়েতে হারি আর কি!"
আমি বললাম, "তা তো হারবেই। এত মানুষ মরলে হারতে হবে না!"
বুড়ো বলল, "তোমার যেমন বুদ্ধি! আশি জন ডেঙ্গিতে মরবে কেন? চল্লিশ হলেই আমরা মৃতের সংখ্যা ঘুরিয়ে দিই। তখন আর একচল্লিশ বেয়াল্লিশ হয় না—উনচল্লিশ, আটত্রিশ, সাঁইত্রিশ করে মৃতের সংখ্যা নামতে থাকে। এমনি করে যখন দশ পর্যন্ত নামে তখন আবার মৃতের সংখ্যা বাড়তে দেওয়া হয়। আমার রাজ্যে তো কত উঠল নামল আবার উঠল, এখন হয়েছে তেরো৷" শুনে আমার ভয়ানক হাসি পেয়ে গেল।
কাক বলল, "তোমরা একটু আস্তে-আস্তে কথা কও, আমার হিসেবটা চট্‌পট্‌ সেরে নি।"
জন্তটার রকম-সকম দেখে আমার ভারি অদ্ভুত লাগল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "তুমি কে? তোমার কি হয়েছে?"
সে খানিকক্ষণ ভেবে বলল, "আমার অজানা জ্বর হয়েছে । আমার অজানা জ্বর হয়েছে, আমার ভাইয়ের অজানা জ্বর হয়েছে, আমার বাবার অজানা জ্বর হয়েছে, আমার পিসের অজানা জ্বর হয়েছে—"
আমি বললাম, "তার চেয়ে সোজা বললেই হয় তোমার গুষ্টিসুদ্ধ সবার অজানা জ্বর হয়েছে।"
সে আবার খানিক ভেবে বলল, "তা তো নয়, আমার সেপ্টিসিমিয়া উইথ্ লো প্লেটলেট কাউন্ট! আমার মামার সেপ্টিসিমিয়া উইথ্ লো প্লেটলেট কাউন্ট, আমার খুড়োর সেপ্টিসিমিয়া উইথ্ লো প্লেটলেট কাউন্ট, আমার মেসোর সেপ্টিসিমিয়া উইথ্ লো প্লেটলেট কাউন্ট, আমার শ্বশুরের সেপ্টিসিমিয়া উইথ্ লো প্লেটলেট কাউন্ট—"
আমি ধমক দিয়ে বললাম, "সত্যি বলছ? না, বানিয়ে?"
জন্তুটা কেমন থতমত খেয়ে বলল, "না, না, আমার শ্বশুরের প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে, ব্রেনে অক্সিজেন কম যাচ্ছে।"
আমার ভয়ানক রাগ হল, তেড়ে বললাম, "একটা কথাও বিশ্বাস করি না।"কাকটা আমনি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, "সে তোমাদের হিসেব অন্যরকম।"

বুধবার, ১ নভেম্বর, ২০১৭

মৌলবাদের আগ্রাসন ~ স্বাতী রায়

হঠাৎ করে একটি মেসেজ মোবাইলে ভাইরাল হচ্ছে, যেটার মূল বক্তব্য – রামমন্দির গড়তে ভোট চাই। খুব ভালো কথা, কোথায়? না বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপ হাটিয়ে। এখানে রাম মন্দির ছিলো, হিন্দুদের রক্তে তৈরি ইত্যাদি নানান রকম যুক্তি। মুসলিম রা হিন্দু মন্দির ভেঙেছে অতয়েব মুসলিম দের মসজিদ ভেঙে মন্দির হোক। যে এই কথাগুলি বলছে সে একটি বছর কুড়ির বাচ্চা মেয়ে। তার কথা অনুযায়ী
১. মুসলিমরা অতিশয় খারাপ। চোর, ডাকাত, রেপিস্ট ইত্যাদি।
২. এরা ধর্মান্ধ, কথায় কথায় হিন্দু মারে। ভারতে খুব শান্তিতে আছে, ভারত থেকে এদের তাড়িয়ে দেওয়া উচিত।
৩. ভারত আদতে হিন্দুস্থান, তাই এটি হিন্দুদের বাসভূমি হওয়া উচিত।
৪. মুসলিম রা খুব খারাপ, মেয়েদের বোরখায় ঢেকে রাখে, স্বাধীনতা দেয় না।
৫. ভারতের রিজার্ভেশন সিস্টেম খুব খারাপ, তুলে দেওয়া উচিত।
৬. বিভিন্ন সময়ে মুসলিম রা অনেক হিন্দু মহিলা কে রেপ করেছে, তাই হিন্দুস্থানে মুসলিম থাকা উচিত নয়।
৭. কোরানে লেখা আছে অন্য ধর্মের মানুষ কে হত্যা করার কথা।
৮. সমস্ত মসজিদে অস্ত্র মজুদ থাকে।
৯. মসজিদে মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
১০. একজন মুসলিম দিদির কাছে সে পড়ে, সে বেশ শিক্ষিত এবং "হিন্দুদের মতই"।
১১. পরিবারের উচ্চশিক্ষিত ( ডিগ্রিধারী) দাদা ও দিদিরা তাকে এই সব বোঝাচ্ছে।
ওহো মূল বক্তব্য – ১২. বাবরি মসজিদের জায়গায় হিন্দু মন্দির ছিল, বিষ্ণু মূর্তি পাওয়া গেছে। হিন্দুদের রক্ত দিয়ে বাবরি মসজিদ তৈরি হয়েছে। মন্দির ভেঙে মসজিদ বানানো হয়েছে। তাই মসজিদ ভেঙে ঠিকই করা হয়েছে, ওখানে মন্দির হওয়া উচিত।

এত কিছু শোনা/ পড়ার পর আমার যে আশঙ্কা হল বা দুশ্চিন্তা – আইসিস রাও ঠিক এই ভাবেই ব্রেইন ওয়াশ করে জঙ্গি বানায়। প্রথমত হিন্দুত্ব কোনো ধর্ম নয় এটাই সত্তর শতাংশ মানুষ জানেননা।, দাবী করেন যে এটি প্রাচীনতম ধর্ম। আশা করি তারা আসীরীয়, সুমেরীয় ব্যাবিলনীয় সভ্যতার কথা শোনেননি। এমনকি সিন্ধুসভ্যতাও যে প্রাগার্য তাও স্বীকার করেননা। তাঁদের ধারণা পুষ্পক রথ আদতে বিমান ছিল, গোমূত্র পানে ক্যান্সার নিরাময় হয়। অদ্ভুতভাবে এই সমস্ত কথা গুলি ধর্মান্ধ এবং অশিক্ষিত অশীতিপর বৃদ্ধথেকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুবসমাজ পর্যন্ত বিশ্বাস করছে, প্রশ্ন করছে না। আসলে গোয়েবলস থিয়োরি অনুযায়ী বারংবার একটি মিথ্যা বলে গেলে ও প্রচার করে গেলে সেটাই সত্যতে পর্যবসিত হয়। রাজনীতিতে এই প্রোপাগান্ডা খুব সফল। এবং অনিবার্যভাবে ধর্ম সব থেকে বড় রাজনীতি হওয়ায় এখানে "বিগ লাই" থিওরি খুবই সফল। এই থিওরি দ্বারাই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ আগামী পঞ্চাশ বছরে বিবর্তনবাদে হোমোসেপিয়েন্স কে বস ট্যরাস বানিয়ে দেবে।

এবার পূর্বোক্ত পয়েন্ট অনুযায়ী আমার উত্তরে আসি।
১. আঠেরো বছর বয়েস থেকে বাড়ি ছাড়া হওয়ার পর থেকে আমি "ভালো" মুসলিমদের সংস্পর্শেই বেশি এসেছি। চোর ছ্যাঁচোড় রেপিস্ট মুসলিম দের কথা এখনো অবধি নিউজপেপারেই পড়েছি। সেখানে লাইন দিয়ে প্রচুর হিন্দুদের নাম ও থাকে। নির্ভয়ার ধর্ষণকারী ছয়জন অপরাধীর পাঁচ জনই হিন্দু ছিলো।

২. ধর্মান্ধতায় হিন্ধুরাও কিছু কম যায় না, ডিটেলস লিখতে গেলে একটি উপন্যাস হয়ে যাবে। কিন্তু যে সমস্ত মুসলিম ভারতে জন্মেছেন, বড় হয়েছেন, জনগনমন শুনলে আমার মতই আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েন, মুসলিম দাঙ্গাবাজ দেখলে লজ্জায় মুখ লুকোন ( সংখ্যা গরিষ্ঠ) তাঁরা কি দোষ করেছেন? একটা বড় দোষ অবশ্য এই যে তাঁরা সংঘবদ্ধ ভাবে প্রতিবাদও করেন না।
যে সমস্ত হিন্দুকে দেশভাগের সময় পাকিস্তান বা বাংলাদেশ ছেড়ে আসতে হয়েছে তাঁরা কি এখনো লাহোর বা ঢাকা শুনলে স্মৃতিচারণ করেন না? "দ্যাশ" এর কথায় চোখে ঘোর লাগে না? সাদাত হাসান মান্টো শেষ জীবন অবধি তাঁর "দেস" ছেড়ে মুহাজির হওয়ার কষ্ট বয়ে বেরিয়েছেন।

৩. সিন্ধু – সিন্ধ – ইন্দাস থেকে হিন্দু – একথা কি আর পাঠক্রমে পড়ানো হয়না? না হলে কেন হয়না?

৪. পর্দাপ্রথা হিন্দুদের মধ্যেও প্রবল। আধ হাত ঘোমটা আর বোরখা-হিজাব একই জিনিস। যে সমাজে নারী পুরুষের ও পরিবারের সম্পত্তি সেখানে পর্দাপ্রথার মত বর্বরোচিত প্রথা সানন্দে পালিত হবে এ আর নতুন কি? এখনো নতুন বউয়ের শ্বশুর -ভাশুরের সামনে ঘোমটা দেওয়া সৌজন্যমূলক। এর পর নারীর অবমাননা – আবার উপন্যাস হওয়ার সম্ভাবনা রাখে, এক দুটোই যথেষ্ট। বেদে বলছে – " ভুক্ত্বোচ্ছিষ্টং বধ্বৈ দদাৎ" অর্থাৎ কি না খেয়ে এঁটোটা স্ত্রী কে দেওয়া উচিত। এ ছাড়া পুত্র‍্যার্থে ক্রিয়তে ভার্যা। সুকুমারী দেবীর কথায় বেদে এরকম অসংখ্য মণিমুক্তা আছে। সর্বগুণান্বিতা নারীও সবচেয়ে নির্গুণ পুরুষের অধম।
ব্যাপার টা অনেকটা আমার নম্বর খারাপ হয়েছে এ কথায় বকা খাওয়ার পর বাচ্চাদের বলার মত যে "অমুক তো আরোও কম পেয়েছে"। অন্যের সমালোচনা ভালো, কিন্তু তারও আগে আত্মসমালোচনা প্রয়োজন, আত্মশুদ্ধির জন্যই।
এখানে বলার কথা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্মগুরু নিজমতে ও ধ্যান ধারনা অনুযায়ী কোরান অনুবাদ করে গেছেন। এখানে আমার যা বলার তা রাহুল সাংকৃত্যায়ন ইসলাম ধর্মের রূপরেখায় বলে গেছেন, আমি হুবহু তুলে দিলাম।
" প্রবাদ আছে যে শয়তানও তার মতলব হাসিল করার জন্য শাস্ত্রের দোহাই পাড়ে, ঠিক সেই ভাবেই মুসলমান পুরুষের এটা ঘোরতর অন্যায় যে কোরানশরিফে বর্ণিত পর্দায় সন্তুষ্ট না হয়ে তারা মেয়েদের পুরু পর্দার আড়ালে বন্ধ করে রেখেছে। কোরানশরিফ তো শৃঙ্গার, আদি রসভাবের যাতে প্রকাশ না হয় সেজন্য কয়েকটি বিশেষ নারী অঙ্গকে ঢাকার কথা বলেছেন। কিন্তু সেই সুযোগে পুরুষেরা, মেয়েদের সমস্ত শরীরে বোরখা চাপিয়েও সন্তুষ্ট হয় না। তাদের অন্তঃপুরে বন্ধ করে রাখা টা কেই উচিত মনে করে।" এই পর্দাপ্রথা হিন্দুসমাজে শুধুমাত্র মুসলিমদের দান নয়, ভিক্টোরিয়ান আদব কায়দারও দায় আছে। নগ্ন টেবিলের পায়াকে মোজা পরিয়ে শ্লীলতা বজায় রাখার মত।

৫. কতজন প্রকৃত শিডিউলড কাস্ট/ ট্রাইব এর সুবিধা পান? রিজার্ভেশন হওয়া উচিত ছিল আর্থিক সঙ্গতির ভিত্তিতে। দেখা গেছে ভারতবর্ষে দারিদ্রের প্রভাব মূলঃত এই অনগ্রসর জনজাতির মধ্যেই। আম্বেদকর সাহেব যা প্রস্তাব করে গেছিলেন, সেটা সেই সময়ের নিরিখে। পরবর্তী কালে মন্ডল কমিশনে ১৯৭৯ এ ফলপ্রসু হয়। আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য যে সময় বদলের সাথে আইন বদলায় না। ভোটব্যাঙ্ক বড় বালাই।

৬. দাঙ্গা বা যুদ্ধের সময় প্রথম কোপ নেমে আসে মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধদের উপর কারণ এরা শারীরিক ভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল। যে কোনো বড় যুদ্ধ বা দাঙ্গার সময়ে একটা জনজাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে অন্যতম হাতিয়ার ধর্ষণ। সে জার্মানদের ইহুদি মহিলা ধর্ষণ হোক, বা আমেরিকার জাপানী মহিলা। দেশভাগের সময়ে কাতারে কাতারে হিন্দু ও মুসলিম মহিলা অন্য ধর্মের মানুষের হাতে ধর্ষিত, নিহত হয়েছেন। এমনকি একাত্তরের বাংলাদেশে প্রচুর বাঙালি মুসলিম মহিলা ধর্ষিত হয়েছেন খান সেনা অর্থাৎ স্বধর্মের মানুষের হাতে। যুদ্ধ স্বধর্ম -বিধর্ম রেয়াত করেনা, এটা যুদ্ধনীতি।

৭. আসলে কোরানে আছে – ইসলামে সম্পূর্ণ রূপে প্রবিষ্ট হও (২:২৫:১২), যারা ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্মকে স্বীকার করেছে, কদাপি তারা স্বীকৃতি পাবেনা এবং কেয়ামতের দিন তারা লোকসানের সম্মুখীন হবে। ( ৩:৮৫)
অন্য ধর্মের মানুষ কে হত্যা করার কথা কোরানে নেই, তা পুনরায় কোনো ধর্মান্ধ কূপমণ্ডূক ধর্মগুরুর নিজ মস্তিষ্কজাত শয়তানি। কোরান যা বলছে – " পূণ্য হল ঈশ্বর, অন্তিম দিন, ফেরেস্তাগণ, পবিত্র গ্রন্থ এবং প্রাচীন নবীগণের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা। ধনসম্পদ কে প্রেমিক, আত্মীয় সম্বন্ধী, অনাথ, দএইদ্র, পথিক, ভিক্ষুক এবং দাসত্বমোচনের জন্য ব্যয় করা। উপবাস (রোজা) রাখা, দান করা, প্রতিজ্ঞা করলে তা পালন করা, বিপত্তিতে, ক্ষতিতে এবং যুদ্ধে সহিষ্ণু থাকা। যারা এরকম করে, তারা সত্যপরায়ণ ও সংযমী।" (২: ২২:১)
বর্তমানে বিভিন্ন বাংলাদেশি সাইটে কোরানের যা ব্যাখ্যা দেখা যায় তাতে অন্য ধর্মের মানুষের মুসলিমদের ঘৃণা করাই অত্যন্ত স্বাভাবিক।

৮. এই তথ্যটি কোথায় প্রকাশিত জানা নেই, কিন্তু দাঙ্গার সময় বা নিদেন পক্ষে পাড়ার মারপিটেও সব ক্লাব থেকেই হকি স্টিক, ব্যাট বা সাইকেলের চেন জাদুবলে বেরিয়ে পড়ে। তার মানে সমস্ত ক্লাবগুলি ও সেখানকার সদস্যরা সন্ত্রাসবাদী!
এবার যদি মসজিদে সংরক্ষিত মহরমের তাজিয়া এবং শোভাযাত্রার অস্ত্রও কেউ দাঙ্গা উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত অস্ত্র ভেবে মসজিদকে সন্ত্রাসবাদের আঁতুর ঘর বলেন তাহলে সবার আগে তাঁদের দেবী দুর্গা বা কালীর হাত থেকে খাঁড়া ত্রিশুল, তরবারি ইত্যাদি কেড়ে নিয়ে নানাবিধ ফুলের তোড়া ধরিয়ে দেওয়া উচিত।

৯. ব্যক্তিগত ভাবে আমি দিল্লীর জামা মসজিদ, ফতেহপুর সিক্রীর সেলিম চিস্তির দরগা সংলগ্ন মসজিদ, মুম্বাইয়ের হাজি আলআলি দরগার, তাজমহল সংলগ্ন মসজিদ, এবং কলকাতার নাখোদা মসজিদ, টিপু সুলতান মসজিদে প্রবেশ করেছি। মহিলাদের মাথায় ওড়না দিয়ে ভালো করে ঢেকে ঢুকতে বলা হয় এবং পুরুষ হলে ফেজ টুপি বা রুমাল দিয়ে মাথা ঢেকে নেওয়া আবশ্যক। কোথাও বলা হয়নি মহিলা তাই ঢুকতে পারবে না। যেখানে বলা হয় তাঁরা আর কেরলের সবরিমালা মন্দিরের অছি'দের মধ্যে কোনোই পার্থক্য নেই যেখানে রজঃস্বলা হওয়ার "অপরাধে" দশ থেকে শুরু করে পঞ্চাশ অবধি মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।

১০. চারপাশে যত হিন্দু চোখে পড়ে তাঁদের সত্তর শতাংশই ধর্মভীরু দেখি। হিন্দুরা উন্নত বা উদার কোনদিক দিয়ে তা আমার চোখে পড়ে না। যেটুকু পড়ে তা অধিকাংশই মুখোশ।

১১. সেই শিক্ষার মানে কি যা মানুষ কে বিভ্রান্ত করে? প্রায় শত বছর আগে লিখে যাওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধে যে সমাজের চিত্র ধরা পড়েছে বর্তমানেও সেই একই চিত্র। বরং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ পরিচালিত সরস্বতী শিশুমন্দিরের বাড়বাড়ন্ত ও পাঠক্রমে দেবদেবীর বন্দনা, স্কুলে ধর্মীয় উৎসব পালন বেড়েই চলেছে।

১২. হঠাৎ করে এই রামমন্দিরের জিগির। ভারতীয় ইতিহাসের কালো দিন ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২, পঞ্চদশ শতাব্দীর বিখ্যাত স্থাপত্য বাবরি মসজিদ ধ্বংস। তালিবানদের বামীয়ান বুদ্ধ ধ্বংসের মতই এ লজ্জা লুকোবার জন্য সঙ্ঘীদেরও স্ব-স্ব গুহ্যদ্বার একমাত্র স্থান। ১৯৬৯ থেকে ১৯৮০ অব্ধি বারংবার প্রত্ন উৎখননেও কোনো রামমন্দিরের চিহ্ন তো পাওয়া যায়ই নি বরং ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক এ কে নারায়ন ও বি বি লাল বলেন ১১শ শতক থেজে ১৫শ শতক পর্যন্তকালের বহু মুসলিম গৃহস্থালির চিহ্ন পাওয়া গেছে। এর থেকে প্রমাণ হয় ওই অঞ্চলে এর আগে কোনো মন্দির ছিলনা বরং মুসলিম বসবাস ছিল।
এবার আসি রক্ত দিয়ে তৈরি মসজিদ প্রসঙ্গে – যে কোনো স্থাপত্য মজদুরের পরিশ্রম দাবী করে। বার বার এই পরিশ্রম ঘাম রক্ত ইত্যাদি দিয়ে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে এরকম ধরনের স্থাপত্য তৈরির সময়ে ডিউ পন্টের সেফটি মেজারমেন্ট না থাকায় দুর্ঘটনা খুবই স্বাভাবিক ধরে নেওয়া হত। তা বাবরি মসজিদ হোক বা তাজমহল বা কোনার্কের সূর্যমন্দির। কত শত প্রাণ বলি গেছে এই স্থাপত্যগুলি নির্মাণ করতে তা ঐতিহাসিকরা বলতে পারবেন। হালফিলের কলকাতায় সাউথ সিটি বিল্ডিং তৈরি করতে গিয়ে বেশ কিছু মজদুর অসাবধানতা বশত মারা গেছে। তাহলে গরীব মজদুরের রক্তে তৈরি সাউথ সিটি ইমারত ভেঙে ফেলা হোক!

ছোটশিশুর প্রতি বাবা মা আত্মীয় সবাই একটু বেশিই খেয়াল রাখেন, প্রকারান্তরে রক্ষণশীল হয়ে থাকেন। সপ্তম শতকের শুরুর দিকের একটি ধর্মের প্রতি যে সেই ধর্মের দালালরা অতিরিক্ত রক্ষণশীল হবেন এ আর নতুন কথা কি? প্রকৃত শিক্ষার প্রসার পাছে তাদের যুক্তিবাদি করে তোলে সেই ভয়ে "হারাম, গুনাহ'র" শিকল পরিয়ে বোরখা আবৃত করে রাখা সহজ। যেমন দীর্ঘদিন ধরে ব্রাহ্মণ পুরোহিতেরা বাকিদের পাপের ভয় দেখিয়ে করে এসেছেন। সময়ের নিরিখে বলা যায় ধর্মভীরু মুসলিম এখনো ৭০০ বছর পিছিয়ে আছে, এবং আমাদের বর্তমান রাজনীতিবিদেরা তারই ফায়দা তুলে একদা উদার হিন্দুদেরও অচ্ছেদিনের লোভ দেখিয়ে সেই আঁধারেই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, যেখানে ধর্মের বিরুদ্ধে খুব কম লোক প্রশ্ন তোলার সাহস রাখেন, প্রশ্ন তুললে পরিনাম হয় চাপাতি নয় বন্দুকের গুলি। অভিজিত ওয়াশিকুর কালবুর্গীরা প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন আসলে ধর্ম যুক্তির সামনে ভয়ে সদা কম্পমান।

হোয়াটস অ্যাপ বা ফেসবুকের যুগে টেকনোলোজির সাহায্যে নিপুণ ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে ধর্মের খোলসে সর্বনাশা বিষ। বিস্ময়কর হলো এই যে কারো রক্ত লাগবে এ কথা অতিকষ্টে প্রচার করতে হয়। অনায়াসে ছড়িয়ে যায় রামমন্দির-বাবরিমসজিদ সংক্রান্ত দ্বেষ।

সমাধান একটাই। শিক্ষা মানে শুধুই ডিগ্রী নয়, যে শিক্ষা যুক্তিবাদী করে তোলে, অন্ধের মত অনুসরণ করতে শেখায় না সেই শিক্ষায় নিজেকে শিক্ষিত করে তুলুন, মনের প্রসার বাড়ান, প্রমাণ চান- স্বর্গ বা জন্নত কে দেখেছে?

কৃতজ্ঞতা স্বীকার – রাহুল সাংকৃত্যায়ন ( ইসলাম ধর্মের রূপরেখা); সুকুমারী ভট্টাচার্য ( উত্তরাধিকার)

মঙ্গলবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৭

শীত ~ মনিপর্ণা সেনগুপ্ত মজুমদার

বছর শেষ হতে চললো, আমরাও আরেকটু এগিয়ে চললাম আমাদের শেষের দিকে। হালকা টান পড়ছে চামড়ায়, সুরভিত অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রীম বোরোলীন আর মহার্ঘ অলিভ অয়েলে সেজে উঠছে ড্রেসিং টেব্‌ল। বচ্ছরকার অতিথি এল বলে। চারদিকে তাকালেই দিব্যি মালুম হচ্ছে। অর্ধেক পাতা-ঝরা গাছগুলো হাত-পা ছড়িয়ে, দাঁড়িয়ে রয়েছে পার্কের কুয়াশাভেজা বেঞ্চের পাশে। লাল,সবুজের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আর ক'দিন বাদেই দেখা যাবে আপামর বাঙ্গালীর মাঙ্কিক্যাপে। গেরুয়াও চোখে পড়বে ইতি-উতি। তবে এসব বাদ দিলেও যে ব্যাপারটায় আমি আশ্চর্য হই, যে শীতকালে যেন শব্দরা বড্ড বেশী জীবন্ত হয়ে ওঠে। গভীর রাতে যখন টুপ্‌টাপ্‌ ঝরে পড়ছে শিশির ফোঁটা, একটা অস্পষ্ট শব্দ যেন শুনতে পাই। দূরে ডেকে ওঠা কোন একলা কুকুর বা সমবেত সারমেয় উল্লাস ফেলে যাওয়া বিবাহনুষ্ঠানের উচ্ছিষ্ট ঘিরে -- সব যেন বড় বেশী উচ্চকিত। মাঝরাতে কোন ডায়াবেটিক রুগীর বাথরুম ব্যবহার করার ছ্যাড়ছ্যাড়ানি, রাতটাকে উলঙ্গ করে দিতে চায়। জলের আওয়াজ এত কদর্য, অশ্লীল? কই, আগে তো কখনও খেয়াল করিনি! প্রতিবেশীর শীৎকার কান জ্বালিয়ে দ্যায়, অন্যসময় কিন্তু শুনতে পাইনা। তার মানে কি ওরা শুধু শীতকালেই...? ধুর, মরুগ্‌গে, কানের ওপর বালিশ চেপে ধরে মানসিক শান্তি ও শালীনতা বজায় রেখে ঘুমোনোর চেষ্টা করি।

এই শীতকাল এলেই যত রাজ্যের উদ্ভুট্টি চিন্তা আসে মাথায়। একদিকে কত মেলা, হস্তশিল্প, বস্ত্রশিল্প, সস্তাশিল্প, মহার্ঘশিল্প ইত্যাদি প্রভৃতি... আর অন্যদিকে দ্যাখো, রোগা রোগা চেহারার কেলে-কুচ্ছিত কতগুলো বাচ্চা নোংরা, খড়ি-ওঠা জেব্রা ক্রসিং মার্কা হাত বের করে কেঁদে-ককিয়ে ভিক্ষে চেয়েই চলেছে। ব্যাটাচ্ছেলেরা আবার ইন্টেনশ্যানালি ঠিক ওই মেলার গেটগুলোর কাছেই দাঁড়িয়ে থাকবে। ক্যানো বাপু? ইদিক-উদিকে গিয়েও তো দাঁড়াতে পারে, তা'লে অন্তত এই 'ইমোশন্যাল অত্যাচার' থেকে বাঁচা যায়। আবার উত্তুরে হাওয়ায় হি-হি করে কাঁপছে দ্যাখো! বলি কী-ই বা এমন শীত পড়ে কলকাতায়? যেতিস যদি এই সময় দার্জিলিং বা সিকিম, ভুটান... কী করতিস? এই যে... এই দ্যাখ আমার ইম্পোরটেড ফার-কোট (গরম লাগে বটে এখানে গায়ে চাপালে কিন্তু তাও লোকে তো টেরিয়ে দ্যাখে, সলিড জিনিস) এতেও ঠান্ডা শানাতোনা।

তারপর ধরো যে এই ঠান্ডার সময়েই তো একটু খেয়ে-পরে আরাম আছে এই শহরে, শীতের উষ্ণতায় একটা বেশ মন-ভাল-করা আমেজে চট করে ফুরিয়ে আসা বিকেলগুলোতে বেরিয়ে পড়েছি হয়তো। কিন্তু দ্যাখো কান্ড, যেই দুপুরটা বিকেলের হাত ছুঁইয়েই সন্ধ্যার গায়ে এলিয়ে পড়ে, ঠিক তক্ষুণি মনে পড়ে যায় এইরকম ...ঠিক এইরকম একটা না-বিকেল-না সন্ধ্যা সময়েই ঠাম্মা বলে উঠেছিল,"শালখান আমার গায়ে জড়্যাইয়া দে কেউ, যাওনের সময় অইলো গিয়া"। ব্যস্‌ , বুড়ির শেষ বলা ডায়লগ যেই মনে পড়া, অমনি দ্রুত জুম-আউট হতে থাকে, নীল-সাদা ব্রীজ, রোশনাই ওয়ালা সারি সারি দোকান...কিচ্ছুটি আর হাতছানি দ্যায়না...স-অ-ব ঝাপসা। নিজেকেই খিস্তাতে ইচ্ছে করে। যাচ্ছিস একটা ফান-ড্রাইভে...এই সময় সেন্টিমেন্টের ঠাম্মা-দিদা না করলেই নয়? যত্ত সাব-অল্টার্ন ন্যাকামো!

তবুও শীতার্ত উত্তাপ ছড়ায় ধমনীতে। কেঁদুলীর মেলায় বন্ধুদের সঙ্গে নিষিদ্ধ উত্তেজনা, ''চোখ বন্ধ করে টান মার, বাবার প্রসাদ...কিস্যু হবে না ...আগুন-লাগানো ঘাস জাস্ট" ...তারপর কাশতে কাশতে প্রায় টিবি রুগী...সম্মোহিতের মত বসে সারারাত বাঊল গান, অজয়ের ওপর কুয়াশার মসলিন মায়াজাল।এক চোখ বিষণ্ণতা নিয়ে বসে থাকা এক সদ্য যুবতী, জীবনানন্দ... সেই যে, "এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;
বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা, কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।"  আমি? আমি-ই ছিলাম নাকি ওটা? নাকি অন্য মৃত্যু কোনো...কে জানে। স্মৃতি বয়ে নিয়ে আসে মাঘ, এই ভরা মাঘ। এইজন্যেই বিচ্ছিরি লাগে। বড্ড বেশী বিবর্ণ যেন চারপাশ। রঙচঙে মোড়ক কত, সযত্নে সরিয়ে রাখা মনখারাপ, তবুও ন্যাপথলিন আর একফালি পুরনো রোদের গন্ধমাখা নস্ট্যালজিয়া উঁকি দেবে, দেবেই। এইখানেই বোধহয় জিতে যায় এই বেয়াড়া ঋতুটা, পুরো প্রকৃতিটাকেই ডিফ্লাওয়ার করে দেওয়া, উদ্দাম, নির্মম এক সন্ন্যাসী। কুরে কুরে বের করে নিয়ে আসা আচমকা একরাশ যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে লেপের ওমের ভেতর দুটো শরীর এক হয়ে যায়। বসন্ত নয়, শীতকেই প্রেমের শিরোপা দেওয়া উচিৎ আমার মতে, আফটার অল,"Nothing burns like cold"।

আর সেই যে না-খেতে-পাওয়া, ঠান্ডায় নীল হয়ে যাওয়া চেহারাগুলো? ওদের কথা মনে পড়েনা আর। ক্রিসমাসের 'জিংগল বেল' আর কেক, নিউ ইয়ারের উদ্দাম ফূর্তির মাঝে কোথায় ওরা? আবার কোন এক দিন...সিগ্‌ন্যালে থেমে যাওয়া গাড়ীর পাশে উদয় হবে, কয়েক মুহূর্তের অপরাধবোধ আর মন-খারাপের উস্কানি। ব্যস্‌, আবার কী? শীত তো চলেই গেল...  


শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৭

BPMO জাঠা ~ সাক্যজিত ভট্টাচার্য্য

তো, কমিউনিস্ট পার্টি আসলে কী? কেমন ছিল আমাদের যাদবপুর বেহালা টালিগঞ্জ কসবা অঞ্চলের পার্টির গল্পগুলো? পার্টি বলে কি আসলে কিছু ছিল? না কি পুরোটাই এক মায়াম্যাজিক? ছিল একমাত্র আমাদের স্বপ্নে, অথবা মাথার ভেতরে? এক অসঙ্গেয় অতিকথা হয়ে? 

বেশির ভাগ সময়ই একে একে দুই হয় না। মড়ার খাটের তলায় কে বোমার বস্তা ফেলে থাকে আমরা জানতে পারি না। জানি না কখন বেমক্কা খালি বন্দুক থেকে গুলি ছুটে খোপরি ফাঁক করে দেবে । আমাদের মগজে এই হিসেবগুলো মিলতে চায় না। একে একে দুইয়ে অভ্যস্ত মগজ বিব্রত হয়। ঘেন্না, রাগ, ভয়, ভালোবাসা, বিশ্বাস- সব মিলেমিশে এই রাজনৈতিক প্রবচনের কোন খোপে আমাদের চেনা যুক্তি আর কোথায় সেই অচেনা বোধ কাজ করে- ঠাহর হয় না। আমাদের গুলিয়ে যায়- ধর্ম। রাজনীতি। নৈতিকতা। বিশ্বাস। বিশ্বাস। এবং বিশ্বাস। নিটোল ক্ল্যাসিফিকেশন এবং নিখুঁত কম্প্যারিজন আমাদের স্বস্তি দিত- কিন্তু বেওয়াফা ইতিহাস সেই আরামটুকু দেয় না।

অশোক মিত্র একে বলেন পরিবৃত্ত- পার্টির পরিবৃত্ত। গত চল্লিশ পঞ্চাশ বছর ধরে পারিবারিক অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে, গোষ্ঠীগত লোককথা সম্বল করে, একসঙ্গে ইতিহাসের আঁচে বদলাতে বদলাতে গড়ে ওঠা এক পরিবৃত্ত। এখন কেউ দলছুট, কেউ নিরলস, কেউ বা ক্লান্ত, কেউ নিস্পৃহ- যেরকম হয় ইতিহাসে। যেরকম ভাবে মাকন্দো গড়ে উঠেছিল, এবং ভেঙ্গে গিয়েছিল। কিন্তু এই বিভিন্ন পথে চলে যাওয়া আলাদা আলাদা ব্যক্তিগত স্মৃতিগুলো জড়ো হতে হতে যে যৌথ ইতিহাস তৈরি হয়েছে সেটা এই পরিবৃত্তের সবার কাছেই একটা রেফারেন্স ফ্রেম। প্রাইভেটে পাশ করা রিফিউজি বাপকাকা, ঘোর দারিদ্র্যের মধ্যে সবকিছু ছেড়ে ঝাণ্ডা হাতে পথে নামা, আবার হয় তো শান্তিকল্যাণ এলে নিশ্চুপে কোটরে ফিরে আসা, কংগ্রেসি গুন্ডাদের আক্রমণে ফেলে আসা ধ্বস্ত ঘরদুয়ার, বুককেসে এখনও সারি সারি হালকা সবুজ মলাটের  কালেক্টেড ওয়ার্ক্স অফ ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, সাদা লাল মলাটে দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন, পার্টি অফিসে জড়ো হতে থাকা ফড়ে দালালদের ছায়াপুঞ্জ। এই যৌথ ইতিহাসের উত্তরাধিকার, আমরা- এই পরিবৃত্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রত্যেকে  বহন করি। জ্ঞানে ও অজ্ঞানে আমাদের রাজনৈতিক সত্তায় এই ইতিহাস ছায়া ফেলে- আপাতত: উল্টোপথে চলা প্রাক্তন কর্মী, বা ক্রমশ: নির্জন অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া বৃদ্ধ কমরেড, কিম্বা ইদানীং ডান বা বাম কোনোদিকেই না থাকা সফল পুরুষটি- কেউই এই উত্তরাধিকার থেকে মুক্ত হতে পারি না। এই উত্তরাধিকার ঘেন্না-রাগ-ভয়-নিস্পৃহতা, এবং সর্বোপরি ভালোবাসার ইতিহাস- বাস্তবের ইতিহাস এবং ম্যাজিকের ইতিহাস- যুক্তির নিয়মমাফিক প্রকোষ্ঠের বারমহলে এই ইতিহাসের আনাগোনা। কেই বা জানে কেন এখনও ঠাকুরদার ফেলে যাওয়া চশমা, ট্রাঙ্কে তোলা আম্মার পুরোনো শাড়ির গন্ধ, ষাট সালে রাস্তা থেকে বাবার কেনা ফুটনোটসম্বলিত জেম্‌স জয়েস আমাদের ভালোবাসার শেষ সম্বল!

জীবনের সব ভালোবাসা এবং বিষাদ খুব ভেবেচিন্ত হিসেব করে হয় না। রাজনীতিও না। পিতৃপ্রেম এবং পিতৃদ্রোহ- দুইই একে অন্যের হাত ধরাধরি করে চলে। পঞ্চাশ ষাট  বছর ধরে বৌদ্ধিক সত্তায় , এবং প্রাত্যহিক জীবনচর্যায় আঁকশিলতার মতো জড়িয়ে যেতে থাকে এতদিন শুনে আসা যাবতীয় অতিকথা, কাহিনী এবং প্রবাদ। যে সময় পেরিয়ে আসতে হয়েছে সেই সময়ের হাত এড়াবার স্পর্ধা কারই বা থাকে? মায়া রহিয়াই যায়। এই মায়ার কোনো ইউনিভার্সালিটির দাবী নেই। যাদের ছুঁয়ে থাকে তাদেরই ছুঁয়ে থাকে। এই মায়ার কোনো লোক জড়ো করার তাগিদ নেই, অন্যকে দলভুক্ত করার ইচ্ছা নেই। পার্টিগত রাজনীতির হৈচৈ উল্লাস রক্তপাতের সীমানার বাইরে এই মায়া নিয়ে আমরা মরে যেতে থাকি।

(ভেবেছিলাম জাঠা নিয়ে লিখব। হল না। পার্টির  ভেতরে বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সামান্য সমর্থকের মাথার ভেতর অবিরত বহমান জাঠা নিয়েও লেখার কেউ থাকুক। যদিও সঙ্গের ছবিটি এক ভোরবেলার গ্রামের পথে জাঠারই ছবি। বাকিটা ব্যক্তিগত, হয়ত বা )


বুধবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৭

ভূতচতুর্দশী ~ অর্ক ভাদুরী

ভূতচতুর্দশীর রাতে পৃথিবীতে আত্মারা নেমে আসে। কাতারে কাতারে, ধোঁয়া ধোঁয়া। আঙুলকাটা হাত তুলে গোঙাতে গোঙাতে নেমে আসেন পূর্ববঙ্গের নীল চাষি। তাঁকে সঙ্গ দেন পাবনা আর রংপুরের কৃষক। আসেন বীরসা মুন্ডা, তিতুমীর, সিধু-কানহুর লোকজন, ওয়াহাবি আর মোপলা বিদ্রোহের শহীদ। বেনিয়ানে পিস্তল লুকিয়ে কলেজ স্ট্রিট থেকে কলুটোলার দিকে চলে যায় ঝকঝকে যুবক। বউবাজার মোড়ের শহীদবেদি ভেঙে বেরিয়ে আসেন লতিকা, প্রতিভা, অমিয়া, গীতা। মির্জাপুর স্ট্রীট ধরে হেঁটে যায় শান্তি-সুনীতি, টেগরা আর ক্ষুদিরাম। হিন্দ সিনেমার সামনে রডা কোম্পানির অস্ত্র লুঠের কুশীলবেরা-  শ্রীশ মিত্র, গিরীন বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপীন গাঙ্গুলি, আশুতোষ লাহিড়ি। বিনয়-বাদল-দিনেশ আর মেজর সত্য বক্সীর পাশাপাশি হেঁটে আসছে শহীদ রামেশ্বর। জানবাজারের পুজোমন্ডপের পাশে বিড়ি ধরালেন কানপুরের সিপাহী, গলায় ফাঁসির দাগ। হেদুয়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বেথুন কলেজের প্রীতিলতা। ব্যারাকপুর থেকে, আলিপুর থেকে, বরাহনগর-কাশীপুর থেকে, ব্যারাকপুর যখন ব্যারাকপুর নয়, সেই চনকের নৌকোঘাট থেকে, রামপ্রসাদ সেনের ধুঁতির খুঁট থেকে, চল্লিশের কঙ্কালসার লাশের গন্ধ থেকে, দক্ষিণের সোনারপুর, যাদবপুর থেকে, কাকদ্বীপ থেকে উঠে আসছেন বৃদ্ধ-অতিবৃদ্ধ আত্মারা। ভূতচতুদর্শীর সন্ধ্যে রাতের দিকে বেঁকে যাচ্ছে।

ভূত চতুর্দশী ~ আশুতোষ ভট্টাচার্য

ভূতপেত্নি দৈত্যদানো
আজকে সবাই দারুণ খুশি
পঞ্জিকাতে পষ্ট লেখা
আজকে তো ভূত চতুর্দশী।।

ভূতের ছেলে বায়না ধরে
ক্যাপ পিস্তল আতসবাজি
শাস্ত্রে এসব বারণ আছে
ব্রহ্মদৈত্য তাতেই রাজি।।

পান্ত ভূতের খুড়শাশুড়ি
বনগাঁ যাবেন লোকাল ট্রেনে
মুড়কি নাড়ু সঙ্গে নেবেন
ফেমাস ভীষণ, সবাই চেনে।।

কিপটে ভূতের ঘুম আসেনা
নিমগাছে কি পয়সা ফলে
সখ দেখে গা পিত্তি জ্বলে
বাজার করে শপিং মলে।।

জম্মে যে ভূত চান করে না
সে'ও দেখি আজ সাবান মাখে
খড়ম পায়ে,গগস চোখে
ডান পকেটে রুমাল রাখে।।

ভূতের মেয়ে সবুজ সাথী
সাইকেলে যায় হাই ইস্কুলে
আজকে সেও খুব সেজেছে
ঘাগরা চোলি কানের দুলে।।

আনন্দে আজ নৃত্য করে
ক্লান্ত ভূতের শান্ত পিসি
ভূতের শ্বশুর গাইছে ভজন
আজকে তো ভূত চতুর্দশী।।

সোমবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৭

মশা ও ডারউইন ~ আর্কাদি গাইদার

মশাদের জগতে একটা বেশ মজার ঘটনা ঘটে চলেছে। ধরুন প্রথম যখন মশা মারবার জন্যে মানুষ কোন কীটনাশক আবিষ্কার করলো। সেই সময় যত মশা ছিলো তার মধ্যে ৯৫% এর ওপর এই কীটনাশক কাজ করে। বাকি ৫% এর ওপর করে না। এবার কীটনাশক আবিষ্কারের আগে এই ৫%কে সেই ৯৫% এর সাথে প্রতিযোগীতা করে টিকে থাকতে হতো। মশার জগতে তাদের অনুপাতও ওই ৫% এর আশেপাশেই থাকতো। এবার কীটনাশক আবিষ্কারের পরে এই ৯৫% এর মধ্যে অনেক মশা ধ্বংস হতে শুরু করলো। একটা পরিসরে তখন এই ৫% যারা ছিলো, তাদের বৃদ্ধি ঘটতে শুরু করলো। বেশ কিছু প্রজন্ম পরে দেখা গেলো যে ওই ৫% কীটনাশক-প্রতিরোধী মশারা বৃদ্ধি পেয়ে এখন সংখ্যাগুরু। তাই মশা ধ্বংস করবার কাজে ওই কীটনাশকের উপকারিতা নিম্নগামী। এখন মানুষকে নতুন কীটনাশক তৈরি করতে হবে। 
এই হলো Darwinism. এইতো কয়েকদিন আগেই বিজেপির অঘোষিত মুখপত্র 'স্বরাজ্যম্যাগ' একটি সম্পাদকীয় লিখে আমাদের আলোকিত করলো - বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার নাকি আমাদের ওপর এই Darwinism প্রয়োগ করতেই একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে। সরকার চায় এই 'চ্যালেঞ্জ'গুলোর দ্বারা পরীক্ষিত হয়ে দেশের মানুষ শক্তিশালী হোক, উন্নততর হোক। আমাদের কান্নাকাটির কোন মানে নেই। কারন সবশেষে, এই সুবিশাল Darwinian experiment এর পর, যে মানুষগুলো টিকে থাকবে, তারা হবে fittest. যেটা উহ্য রাখা হয়েছে, সেটা হলো যে যারা fittest না, তাদেরকে এই এক্সপেরিমেন্টের স্বার্থে খরচের খাতায় ফেলতে হবে। তারা expendable. কারন তারা যথেষ্ট fit নয়।
Darwinism কে সহজভাবে বোঝাতে অনেকেই survival of the fittest বলে এক লাইনে অভিহিত করেন। এটা বৃহৎভাবে ভুল বোঝাপড়া। Darwin নিজে কোনদিন এই লাইনটা ব্যাবহার করেননি। ওনার থিওরীকে যদি এক লাইনে প্রকাশ করতেই হয় - তাহলে সেটা হতে পারে survival of the most adaptable. কিন্তু ডারউইন নিয়ে বিতর্কের জন্যে এই লেখা না। এই লেখা মশা আর কীটনাশক নিয়ে। 
মশা - যার নাম সোনিকা কুমারী। ১১ বছর বয়স। দূর্গা পুজোর ছুটি বলে স্কুল বন্ধ। মিড ডে মিল নেই। আধার কার্ড নেই বলে বাড়িতে রেশন বন্ধ হয়ে গেছে। ৮দিন অভুক্ত থেকে মারা গেছে। 
 যদিও সুপ্রীম কোর্ট রায় দিয়েছে যে আধার কার্ডের সাথে কোনরকম বেনিফিট লিংক করা যাবে না। তাও। কারন উন্নততর দেশ বানানোর লক্ষ্যে সুপ্রীম কোর্ট, সোনিকা কুমারী, এদের নিয়ে মাথা ঘামালে চলবে না। কীটনাশক তৈরি আমাদের প্রধান লক্ষ্য। আমরা একের পর এক কীটনাশক তৈরি করে যাবো। এবং প্রতিবার যারা টিকে থাকবে তাদের জন্যে তৈরি হবে নতুন কীটনাশক। নোটবন্দী। আধার। জিএসটি। সব শেষে যারা টিকে থাকবে তারাই হবে উন্নততর ভারতের উন্নততর নাগরিক। তাদের বেচে থাকতে রেশন লাগবে না। গ্যাসে ভর্তুকি লাগবে না। চাষে নূন্যতম মূল্য নির্ধারন লাগবে না। সারে ভর্তুকি লাগবে না। মিড ডে মীল লাগবে না। ১০০ দিনের কাজ লাগবে না। হাসপাতালে অক্সিজেন লাগবে না।
তাদের শুধু লাগবে ১০০ কোটি টাকার রামমূর্তি। তার পদতলে বসে তারা গান করে, আড্ডা মেরে, হাওয়া খেয়ে সুখে দিন কাটাবে। আর লাগবে আধার কার্ড। মরার পর গলায় কার্ড ঝুলিয়ে চুল্লিতে বা কবরে প্রবেশ করবে। সোনিকা কুমারীর যদিও আধার কার্ড নেই। তাই না খেয়ে মরে গেছে। আপাতত সরকারি ব্যাবস্থায় দাহও করা যাবে না বোধহয়। চলুন স্লোগান তুলি - জয় শ্রী ডারউইন।