"ফ্রানজ কাফকার বিশ্রুত উপন্যাস 'দ্য ট্রায়াল'-এ নায়ক জোসেফ কে একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখেছিল তার ঘরে পুলিশ। তার অপরাধের বিচারের জন্য আদালতের শমন নিয়ে এসেছে। জোসেফ কে জানত না তার অপরাধ কী। পুলিশ, আদালত, আমলাতন্ত্র সকলের কাছে প্রশ্ন করলেও উত্তর মেলে না। এদিকে বিচার চলতে থাকে নিজের নিয়মে। আর এই প্রক্রিয়াতেই আস্তে আস্তে কে-র ব্যক্তিগত জীবনে, সম্পর্কে, এমনকি শোবার ঘরে পর্যন্ত রাষ্ট্র ঢুকে পড়ে। তার গতিবিধি, চলাফেরা, কার সাথে সে মেলামেশা করছে সবকিছুর হিসেব অলক্ষ্যে পৌঁছে যেতে থাকে আদালতের কাছে।
জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা এই বছরের জানুয়ারি মাসে বস্তারে পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের তদন্ত করছিল। এক রাত্রিবেলা সংস্থার সদস্য এবং পরিচিত মানবাধিকার কর্মী বেলা ভাটিয়ার ছত্তিশগড়ের বাড়িতে জনা তিরিশ সশস্ত্র দুষ্কৃতি হানা দেয়। তারা হুমকি দেয় বেলাকে এই মুহূর্তে এই রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হবে। কথা না শুনলে বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হবে এবং মেরে ফেলা হবে বেলার আদরের পোষ্যটিকে। বারবার বেলা ভাটিয়া জিজ্ঞাসা করেন তাঁর অপরাধ কী। উত্তর মেলেনি। চলতে থাকে অকথ্য গালিগালাজ। নিরুপায় বেলা পুলিশ ডাকেন। পুলিশ আসে, সঙ্গে আসেন গ্রামের সরপঞ্চ। এবং বেলা সবিস্ময়ে দেখেন, পুলিশ এবং সরপঞ্চ দুজনেই দুরে দাঁড়িয়ে মজা দেখার ভঙ্গীতে গোটা ব্যাপারটার পর্যবেক্ষণ করছে। বেলার বাড়িওয়ালিকে দিয়ে পুলিশের সামনে দস্তখৎ দেওয়ানো হয় যে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিনি দায়ীত্ব নিয়ে বেলাকে বাড়িছাড়া করাবেন। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। বাড়ির মালিক এবং তাঁর ছেলেদের স্থানীয় থানায় ডাকা হয় এই ঘটনার পরদিন। পুলিশ শাসায় যে বেলা এই অঞ্চল না ছাড়লে তার ফলাফল ভাল হবে না।
ঠিক একই পদ্ধতিতে এর আগে ভয় দেখিয়ে অথবা মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে বস্তার থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল সাংবাদিক মালিনী সুব্রমণিয়াম, আইনজীবি শালিনী ঘেরা এবং ঈশা খাণ্ডেলওয়ালকে। এঁরা সকলেই জগদলপুর লিগাল এইড নামক প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বস্তারের ডিআইজি এসআরপি কাল্লুরির নেতৃত্বে পুলিশবাহিনীর দমনমূলক কার্যকলাপ, হত্যা, ধর্ষণ, মিথ্যে কেসে মাওবাদী অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেওয়া ইত্যাদি ডজন ডজন অভিযোগ নিয়ে এই লিগাল এইড বহুদিন ধরেই সরব। এই কারণে কিছুদিন আগেই বস্তার পুলিশের পক্ষ থেকে এই লিগাল এইডের নেতৃত্বের কুশপুতুল পোড়ানো হয়েছিল। যদিও প্রতিটি নিগ্রহের ঘটনার পরেই পুলিশ হয় হীরন্ময় নীরবতা পালন করেছে, নাহলে সব দায় চাপিয়েছে স্থানীয় দুস্কৃতিদের উপর।
নাজিব আহমেদ। জে এন ইউ-র ছাত্র ছিল। গত বছরের ১৫ই অক্টোবর হস্টেলে রাষ্ট্রীয় বিদ্যার্থী পরিষদের কিছু সদস্যদের সঙ্গে তার রাজনৈতিক বচসা হয়েছিল। সেই দিন থেকেই নাজিব নিখোঁজ। তার বন্ধুরা এবং পরিবারের তরফ থেকে দিল্লি পুলিশ ও সরকারের কাছে বারবার আবেদন করেও কোনো লাভ হয়নি। গত ২৯শে জানুয়ারি নাজিবের বাড়িতে দিল্লি পুলিশের প্রায় ৫০ জনের একটি দল হানা দেয়। তারা বাড়ি ঘর তছ্নছ করে, সমস্ত ঘরের আসবাবপত্রের ছবি তুলে নিয়ে যায়, এবং বাড়ির সদস্যদের ঠারেঠোরে হুমকি দেয় মামলা প্রত্যাহার করার জন্য। নাজিব যে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত এরকম কথাও বলা হয়। এমনকি নাজিবের নব্বই বছরের বৃদ্ধ মাতামহও পুলিশি নিগ্রহের হাত থেকে রেহাই পাননি। যথারীতি দিল্লি পুলিশ সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে ঠাণ্ডা গলায় জানিয়ে দিয়েছে যে তদন্তের স্বার্থেই যা হবার হয়েছে।
ঘটনাগুলো কি অভিনব? না, এগুলো আজ প্রথম ঘটছে না। পুলিশ বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গলা তোলার ফলে হেনস্থা হতে হয়েছে, এরকম অভিযোগ বিজেপি অথবা কংগ্রেস, কোনো কেন্দ্রীয় সরকারের আমলেই কম নয়। কিন্তু যে জিনিসটা অভিনব, সেটা হল প্রায় শৈল্পিক দক্ষতায় নাগরিকের শোবার ঘরে রাষ্ট্রের ঢুকে পড়া। মানতেই হবে, এই দক্ষতার আমদানি করেছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। এর আগে এই সমস্ত কাজ হত অনেক মোটা দাগে, খুন জখমের মাধ্যমে । তাই সেগুলোর বিরুদ্ধে গলা চড়ানোটাও ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ। এখন সম্ভবত রাষ্ট্রব্যবস্থা বুঝে গেছে যে প্রতিবাদীর শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত বইয়ে দিতে গেলে সূক্ষ মনস্তাত্বিক চাপটুকু অনেক বেশি কার্যকরী। উপরের ঘটনাগুলো তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
বেলা ভাটিয়ার বাড়িতে আক্রমণ করেছে কারা? পুলিশ? মোটেও না। পুলিশ বরং চক্ষুলজ্জার খাতিরে হলেও একবার এসেছিল। আক্রমণ করেছে কিছু স্থানীয় গুণ্ডা। পুলিশের সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে তাদের সম্পর্ক থাকার কথা নয়। আক্রমণ হয়েছে রাত্রিবেলা, ঠিক যে সময়টাতে মানুষ সবথেকে ক্লান্ত থাকে, থাকে মানসিকভাবে অগোছালো। লক্ষ্যণীয়, আক্রমণকারীর দল কিন্তু বেলাকে প্রাণে মারবার হুমকি দেয়নি। বরং হুমকি দিয়ে গেছে যে বেলার কুকুরটাকে মেরে ফেলবে। এই প্রায় অ্যাবসার্ড একটা হুমকি যে মানসিকভাবে একজন মানুষকে কী ভয়ংকরভাবে দুমরে মুচড়ে ফেলে, সেটা তাঁরাই বুঝবেন যাঁদের পোষ্য আছে। বেলাকে প্রাণে মারার হুমকি দিলে সেটা বরং অনেক চেনা ছক হত, তার মোকাবিলাও তেমনভাবেই করা যেত। কিন্তু একটি অবোলা জীবকে হত্যার দায়ভার নেবার যে মনস্তাত্বিক চাপ, বেলার মত সংবেদনশীল সমাজকর্মী সেটা স্বাভাবিকভাবেই নিতে পারবেন না। এখানেই শেষ নয়। পুলিশ বেলার বাড়িওয়ালিকে হুমকি দিল যাতে বাড়ি ফাঁকা করে দেওয়া হয়। নিশ্চয়, পুলিশ তো বেলার ভালর জন্যেই এই কথা বলেছে, যাতে তাঁর কোনো অনিষ্টসাধন না হয়! মনে রাখতে হবে, বস্তারে পুলিশবিরোধী আন্দোলন শুরু হবার কয়েক মাসের মাথাতেই 2015 সালে একইভাবে পুলিশ চাপ দিয়ে বেলাকে আগেও একবার নিজের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছিল। তখনো শোনা গিয়েছিল যে পুলিশ নাকি বেলার নিরাপত্তার জন্যই এটা করেছে।
নাজিবের ক্ষেত্রেও, একটি সাধারণ বাড়িতে রাত্রিবেলা পুলিশ হানা এবং নব্বই বছরের বৃদ্ধকে হেনস্থা করা আসলে মনস্তাত্বিক ছকটিকেই অনুসরণ করছে। সমাজের দুর্বল এবং আত্মরক্ষায় অক্ষম অংশটিকে নিগ্রহের মাধ্যমে বিপক্ষকে নুইয়ে দেবার পদ্ধতিটি চেনা । এবং পদ্ধতিটার প্রয়োগ করা হচ্ছে তথাকথিত আইনের গণ্ডীর মধ্যে থেকেই। পুলিশ কোনো আইন ভাংছে না, কাউকে পিটিয়ে মারছে না, প্রাণে মারার হুমকিও দিচ্ছে না। এগুলো না করে শুধুমাত্র মানসিক নির্যাতন করতে করতে রাষ্ট্র ঢুকে যাচ্ছে আমাদের অন্দরমহলে। তাকে পুরোদমে সহায়তা করছে আমলাতন্ত্র। এবং তাই খুব মসৃণ গতিতে মালিনী সুব্রমণিয়ামদের বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা তুলে নাস্তানাবুদ করা হয়। বেলা ভাটিয়াকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে নিজের বাড়ি ছাড়তে হয়। এবং খুব শান্ত গতিতে, যেন কিছুই হচ্ছে না এমন ভাব নিয়ে জগদলপুর লিগাল এইডের একাধিক সক্রিয় কর্মীর পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন আটকে যায়, অথবা রেশন কার্ড জালিয়াতি করার অভিযোগে বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। কোনো বেআইনি পথ অবলম্বল না করে এবং এক ফোঁটাও বিতর্ক না বাড়িয়ে রাষ্ট্র প্রমাণ করে দিচ্ছে তার দাঁতের ধার। একে খুব উন্নতমানের ফ্যাসিবাদ না বললে আর কাকে বলা হবে?
আর সংবাদমাধ্যমগুলির ভূমিকা? জরুরী অবস্থার সময়ে সংবাদপত্রের ভূমিকা নিয়ে লালকৃষ্ণ আদবাণি বলেছিলেন "তাদের ঝুঁকতে আদেশ দেওয়া হয়েছিল, আর তারা হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছিল"। বর্তমানে জরুরি অবস্থা জারি করবার আর দরকার পড়ছে না। রাজনৈতিকভাবে অশান্ত অঞ্চলে কোনো নক্সালপন্থী দলের নেত্রী গেলে বাংলার বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রটি মড়াকান্না জুড়ে দিচ্ছে "ভাঙ্গরে নক্সালদের অনুপ্রবেশ"! যেন নক্সালদের ওখানে যাওয়া বেআইনি কোনো ঘটনা! জেএনইউ-র অধ্যাপিকা নিবেদিতা মেনন যখন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন কাশ্মীরকে বলপূর্বক ভারতের অংশ করে রাখার যৌক্তিকতা কতখানি, সংবাদমাধ্যমগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ছে নিবেদিতাকে দেশদ্রোহী প্রমাণ করবার জন্য। মানুষের গতিবিধি, স্বাধীন মতামত, এমনকি কার সাথে মেলামেশা করা হচ্ছে সেই জিনিসগুলির ওপর প্রায় গোয়েন্দার মত নজর রাখছে সংবাদমাধ্যম। আর এভাবেই তারাও চমস্কি কথিত 'সম্মতি নির্মাণের' রাষ্ট্রীয় হাতিয়ার হিসেবে সফলভাবে ঢুকে পড়ছে আমাদের অন্দরমহলে।
কাফকা জানতেন, ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। যদি একদিন মাঝরাতে গুণ্ডারা আপনার দরজায় কড়া নাড়ে, অথবা সকালে যদি একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখেন আপনার সংগ্রহের 'দাস ক্যাপিটাল'টি হাতে নিয়ে পুলিশ জিজ্ঞাসা করছে আপনি মাওবাদী কি না, বুঝবেন এই ভারতবর্ষে বেলা ভাটিয়া কোনো বিচ্ছিন্ন নাম নয়। আর মনে রাখবেন, জোসেফ কে-র বিচারের রায় ছিল মৃত্যুদণ্ড। এবং মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সে নিজের অপরাধ জানতে পারেনি। "
আরেক রকম পত্রিকার ফেব্রুয়ারি মাসের সম্পাদকীয়, যেটা আবার ঘটনাচক্রে আমারই লেখা। লেখবার সময়েও ভাবতে পারিনি কয়েকদিনের মধ্যেই আমার জীবনেও এটা সত্যি হয়ে যাবে। পুলিশের এফআইআর, আইন আদালত ইত্যাদি তো ছেড়েই দিলাম, আমার ব্যক্তিগত জীবন, আত্মীয় স্বজন এবং বান্ধবীদের নিয়ে পর্যন্ত রসালো কেচ্ছা, প্রায় পর্নোগ্রাফি লেখা, এগুলো আসলে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এগুলো সবই ঘরের অন্দরমহলে রাষ্ট্রের সহস্র চোখ ঢুকে যাবার একটা পদ্ধতি। যে কাজে শামিল হিন্দুত্ববাদীরা এবং তাদের অন্যান্য কিছু সহযোগী । কাজেই কাল যদি সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার দুই বছরের আগে করা একটা আলটপকা কমেন্টের স্ক্রিনশট হাতে নিয়ে পুলিশ আমার দরজাতে কড়া নাড়ছে আর জিজ্ঞাসা করছে আমার আইএসআই কানেকশন আছে কি না, তাহলে বুঝতে হবে ভারতরাষ্ট্রের গৈরিকীকরণ সম্পূর্ণ । Eppur si muove? ahimè, la terra è morto!