বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০১৩

বড় অপরাধী করে চলে গেলে ঋতু – অরুনাচল দত্তচৌধুরি

বড় অপরাধী করে চলে গেলে ঋতু
এখানে জীবন সেই আগের মতই
সিউডো-সাহসী কিন্তু আদতে যা ভিতু
এই ভুল তন্তুজাল ছিঁড়ে
ঋতুপর্ন হেঁটে গেল, অন্তহীন আলোর গভিরে
আমরা যাবোনা সাথে, আঁধার গসিপে
নির্বোধের হাসি হাসবো মুখ টিপে টিপে
যতবার ঋতু আসবে, তা প্রতিবার
পৃথিবী মৃত্যু দেখবে অযাচিত গাঢ় প্রতিভার

বুধবার, ২৯ মে, ২০১৩

হবেনা শেষ। হতে দেওয়া হবে না - সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

সকালবেলা অফিস বেরোবার আগে একবার কাগজে চোখটা বোলাই। আমার আবার বড় সড় খবরে চোখ যায়না খুব একটা। বড় সড় বলতে, ওই যে, মুখ্যমন্ত্রি কাকে যেন বলেছেন হিম্মত থাকলে করে দেখান, ছত্তিসগড়ে এক গাদা কংগ্রেসি নেতার ওপরে মাওবাদীরা টারগেট প্র্যাকটিস করেছে, সচিন আর আইপিএল খেলবেনা, ওয়েন রুনির ছেলে হয়েছে ইত্যাদি প্রভৃতি। আমার নজর থাকে, একটু আড়ালে থাকা, কিঞ্চিত ছোট হরফের হেডিংওয়ালা খবর গুলোতে। মূলতঃ খেলার খবরই। কোথায় যেন পড়েছিলাম যে সমস্ত মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি বেশি, তাঁরা সাধরনতঃ মনোনিবেশ করেন শিল্পে, সাহিত্যে, সঙ্গীতে। আর বাকি যারা, কম বুদ্ধির দলে (সংখ্যায় এনারাই বেশি), মাতামাতি করেন কিছু হুড়োহুড়ি মার্কা ব্যাপার স্যাপার নিয়ে। এবং এই হুড়োহুড়ি মার্কা ব্যাপার স্যাপারের একটা উদাহরনও দেওয়া হয়েছিলো – ফুটবল। বিশ্বাস করুন, নিজেকে বুদ্ধিহীনের দলে আবিস্কার করে যত না গ্লানি জমেছিলো, তার চেয়ে অনেক বেশি খুশি হয়েছিলাম, যে পৃথিবীর সংখ্যাগুরু লোক, এই একটা গোলাকার বস্তু নিয়ে মাতামাতি করে, এবং আমিও তাদেরই দলে। ছোটবেলায় ফুটবল দেখতাম কেমন ঘোরলাগা চোখে। তেমন নির্দিষ্ট কোন খেলোয়াড় নয়, পুরো খেলাটাই কেমন যেন একটা রূপকথা মনে হতো। বড়হতে দেখলাম, ছোটবেলার বেশিরভাগ ভালোলাগাগুলো একে একে বিদায় হলো, কিন্তু ফুটবলের ঘোর আর কাটলোনা।
রুনির ছেলে, বেকহ্যামের উল্কি, মারাদোনার জামাই, বেকেনবাউয়ারের বিবাহবিচ্ছেদ, খবরের কাগজের ফুটবল সংক্রান্ত এই সব মুখরোচক খবরে আমার একেবারেই উৎসাহ নেই। আমার উৎসাহ ফুটবলে, ফুটবলারে নয়। আর আজকাল যেমন দেখি, বার্সিলোনা, ম্যাঞ্চেস্টার বা মিলান নিয়ে মাতামাতি, তার থেকে অনেক অনেক দূরে আমার ফুটবল এখনো ঘুরপাক খায় গড়ের মাঠে। সেই মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল বা মহামেডান স্পোর্টিং। আমার কাছে, একটা ফুটবল দলের তিনটে অবিচ্ছেদ্য অংশ থাকতেই হবে। প্রথম খেলোয়াড় ও কোচ, দ্বিতীয় কর্মকর্তা ও তৃতীয় সমর্থকরা। আজকাল টাকা ঢেলে ভুঁইফোড় অনেক ক্লাব গজাচ্ছে। আমার কাছে এরা কখনোই ফুটবল দল নয়, কেননা এদের সমর্থক নেই। সমর্থক ছাড়া ফুটবল কিসের মশাই? আর আমার খারাপ লাগে ম্যাকডাওয়েল মোহনবাগান, বা কিংফিশার ইস্টবেঙ্গল শুনতে। কোনদিন শুনেছেন এমিরেটস্‌ আর্সেনাল, ইউনিসেফ বার্সিলোনা বা স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড লিভারপুল? এমিরেটস্‌ কি ম্যাকডাওয়েলের চেয়ে কম টাকা দেয়? তাহলে কেন আমাদের ক্লাবের নামের আগে ম্যাকডাওয়েল বা কিংফিশার বসবে?
এসব নিয়ে আলোচনা, কোর্ট-কাছারি কম হয়নি। আমার এখানে এসব নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছেও নেই, মুখও নেই। গঙ্গাপারের যে দলটাকে সমর্থন করি, গত দু বছর সেখানে ট্রফির নামগন্ধ নেই। ওয়াকওভার পাওয়া ট্রফিকে হিসেবে ধরিনা। গত মরশুমে একের পর এক পরাজয়। আমি বোধহয় আমার জীবনের প্রথম ২৫ বছরে মোহনবাগান কে মোট যতগুলো খেলায় হারতে দেখেছি, গত দু বছরে দলটা তার চেয়ে বেশি খেলায় হেরেছে। অথচ দেখুন, দলটা কিন্তু এত খারাপ নয়। বছরের শুরুতে দেখি এক জন কাউকে কোচ করা হয় অনেক ঢাক পিটিয়ে। বছরের মাঝামাঝি তাকে কুলোর বাতাস দিয়ে তাড়ানো হয়। আবার এক জন আসে, এবং আই-লিগের দ্বিতীয় পর্যায়ে খুব ভালো খেলার পরেও তাকে আবার তাড়ানো হয়। এই যে সুভাষ ভৌমিকের কোচিং পেয়ে এবারে চার্চিল ব্রাদার্স আই-লিগ ঘরে নিয়ে গেলো, এই সুভাষ ভৌমিককেও কিন্তু আমরা বাতিল করেছিলাম। সে সময়ে এনাকে কোচ রেখে দিলে, কি ক্ষতি বৃদ্ধি হত? ট্রফি বিহীন তো সেই থাকতেই হলো। গত বছর শেষে বাবলুদা এসে টিমটাকে তবু কিছুটা দাঁড় করালো। কিন্তু তাকেও সরিয়ে দেওয়া হলো। আমি কিন্তু কর্মকর্তাদের সমালোচনা করতে বসিনি। তাঁরা ক্লাবের অবিছেদ্য অংশ। তাঁরা না থাকলে ক্লাব থাকেনা। আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়। প্রথমে একটু পেছিয়ে যাই।
তখন আমার বয়স ১২ কি ১৩। একদিন বিকেল বেলা বাবার হাত ধরে ক্লাবে ঢুকছি। কেমন যেন স্বপ্নের মত লাগত মোহনবাগান ক্লাব কে। ক্লাব ঘরের সামনে একটা চেয়ার পেতে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসে আছেন সাদা ধুতি আর হাতা গোটানো সাদা সার্ট পরে। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, পায়ে বিদ্যাসাগরি চটি। বাবাকে দেখে বললেন, নিয়ে যাও ভেতরে, ক্লাব দেখুক। মোহনবাগান কে চিনুক। আমাত মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলো একটু ঘেঁটে দিলেন সেই বৃদ্ধ। দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে বাবা ফিস্ফিস করে বললেন, ওই বৃদ্ধ হলেন উমাপতি কুমার, সে সময় ক্লাবের সহ-সভাপতি। কেমন যেন টলে গেছিলাম কথাটা শুনে। ইনিই কুমার বাবু? সেই ভুবন বিখ্যাত ডিফেন্স চেরা থ্রু-পাশ বেরোত এনারই পা থেকে? বই পত্রে এনারই ছবি দেখেছি? পেছন ফিরলাম আবার, দেখলাম বৃদ্ধ আমাদের দিকে ফিরে আছেন। হাসলেন, বললেন দেখো ঘুরে ঘুরে, এখানে যা দেখবে, মনে রেখো, তোমরাই তো পরে ক্লাবকে ধরে রাখবে। সেবারে ক্লাবে ঘুরতে ঘুরতে এবং তার পরেও দেখেছি কর্মকর্তাদের। শৈলেন মান্না ছিলেন, ছিলেন চুনি গোস্বামী। ছিলেন ধীরেন দে সবার ওপরে ছাতার মত, মহীরুহের মত। এনাদের কথা পাড়লাম কেন? একটু ভেবে দেখুন তো, এনাদের ইতিহাস গুলো কি। এনারা প্রত্যেকেই খ্যাতনামা খেলোয়াড়। ধীরেন দে ফুটবল খেলেননি, কিন্তু মোহনবাগানের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ছিলেন বহু বছর। মাঠের প্রতিটি ঘাস, খেলোয়াড়দের প্রতিটা ঘাম আর রক্তের ফোঁটাকে এনারা চিনতেন। এ ছাড়া ছিলেন বিরু চ্যাটার্জি, গজু বসু। কলকাতার আসেপাশে এবং দূর দুরান্তের গ্রাম ঘুরে খেলোয়াড় তুলে আনতেন এনারা। খেলা দেখে চিনতেন। জহুরির চোখ ছিলো। যদি আমার কথা বিশ্বাস না হয়, কখনো বিদেশ বসু বা সুরজিৎ সেনগুপ্তদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।
মোদ্দা কথা হলো, মোহনবাগান চিরকাল ছিলো খেলোয়াড়দের ক্লাব। খেলোয়াড়রাই চালাতেন, খেলোয়াড়রাই দল তৈরি করতেন, এগিয়ে নিয়ে যেতেন। এটাই তো দস্তুর, আপনি ইয়োরোপে দেখুননা, উয়েফার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হলেন মিশেল প্লাতিনি। জার্মান ফুটবলে শেষ কথা বলেন বেকেনবাউয়ার। আমাদের এখানে কেন সেটা হবেনা? মোহনবাগানে প্রাক্তন ফুটবলারের অভাব ঘটেছে? শিশির ঘোষ, সত্যজিত চ্যাটার্জি রা নেই? প্রদীপ চৌধুরি কোথায় গেলেন? অলক মুখার্জি দূরে সরে আছেন কেন? মানস – বিদেশ কই? তনুময় বসু, দেবাশিষ মুখার্জি, প্রতাপ ঘোষরা কই? চুনি গোস্বামী কেন আসেন না ক্লাবে? কিসের অভিমান? মোহনবাগানের ওপর অভিমান করে থাকতে পারবেন চুনি বাবু? প্রসূন ব্যানার্জি ভোটে লড়তে পারছেন, আর মোহনবাগানের বাঁচার ম্যাচটা খেলবেন না? বাবু মানি, উলগানাথন, আবদুল মজিদ কে কোনদিন জিজ্ঞেস করে দেখুন, ওনারা মোহনবাগানের নামে কি কি দিতে প্রস্তুত। শেষে আসছি চিরবিতর্কিত বাবলু ভট্‌চাজের কথায়। এই লোকটা কিন্তু পারে সব কিছু ঘোরাতে। আমি মন থেকে বিশ্বাস করি এটা। আমার চোখে সেই ছোটবেলা থেকে ও সুপারম্যান। হতে পারে ও ঝগড়ুটে, ও ঘোঁট পাকায়, ও নিজেকে ফোকাসে রাখতে চায়। কিন্তু আদ্যন্ত মোহনবাগানী এই লোকটা। শুধু এনারাই কেন? তথাকথিত ইস্টবেঙ্গলের লোক সুরজিৎ সেনগুপ্ত কে জিজ্ঞেস করে দেখুন না। নিজের এক মাসে মাইনে বাজি রেখে বলছি, সুরজিৎ সেনগুপ্ত আসবেন। আসবেন সমরেশ চৌধুরি, ভাস্কর গাঙ্গুলি, গৌতম সরকার, মইদুল ইসলাম। মোহনবাগান কোথাও না কোথাও বড্ড বেশী করে জড়িয়ে আছে এনাদের রক্তে। চার্চিলের কাছে মোহনবাগান ৩ গোল খেলে, এই তথাকথিত ইস্টবেঙ্গলের লোকগুলোও শান্তিতে ঘুমোতে পারেনা। যে দাপট, যে অহংকারের জন্ম এনারা দিয়ে গেছেন আমাদের ভেতরে, গোটা দেশের ফুটবলকে শাষন করে, তাতে করে এনারা চুপ থাকতে পারেন না। এই হার ওনাদেরও অহংবোধে ধাক্কা দেয়।
এ তো গেল একটা দিক। সমর্থকদের জন্যেও কয়েকটা কথা আছে। আমরা হারছি, মনে কষ্টও পাচ্ছি। কিন্তু সেটার প্রকাশ সঠিক ভাবে হচ্ছে না। ফেসবুক বা টুইটারে কিছু পোস্ট, ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের সঙ্গে ঝগড়া, মাঠে আর না যাওয়া। নিজেদের কিছু আবদ্ধ জায়গায় দেবাশিষ দত্ত, অঞ্জন মিত্রদের ওপর ক্ষোভ উগরে দেওয়া, আর একজন দোষী খুঁজে চলা। কিন্তু এর বাইরে কি কিছু নেই? দায়িত্ব নেই কোন? ফিরিয়ে আনুন খেলোয়াড়দের। তুলেদিন ক্লাব ওনাদের হাতে। তাই বলে কর্মকর্তাদের তাড়িয়ে দেবার কথা একবারও বলিনি কিন্তু। খেলার দায়িত্বে থাকুন খেলোয়াড়রা। মাঠ, দল, কোচ এদের দায় নিন পুরোনো খেলোয়াড়দের কমিটি। এনাদের হাতে এক বছরের জন্য তুলে দেওয়া হোক দলকে। কর্মকর্তারা থাকুন পেছনে। এ বছর আর হবার নয়, কিন্তু সামনের বছরের জন্য এটা হোক। এখন থেকে প্রাক্তনীরা খেলোয়াড় বাছুন। ক্লাবের সঙ্গে থাকুন, টিমের হাল দেখুন। আর সামনের বছরের জন্য পরিকল্পনা করুন। কোচ তাড়াবেন না। অন্ততঃ আগামী পাঁচ বছর, সে করিম ই হোক বা অন্য কেউ। সমর্থকদের আরো বলি, হঠাৎ করে দিন বদলাবে না। ধৈর্য্য ধরতে শিখুন। এক দিনে ক্লাবটা তলায়নি। এক দিনে সব শুধরেও যাবেনা। প্রথমে কিছু ফলাফল আশা করা উচিত নয়। কেউ ম্যাজিক জানেন না। ক্লাবের পাশে থাকুন। সমালোচনা যেন ব্যক্তিকেন্দ্রিক না হয়ে পড়ে। ফুটবল মাঠে সবাই পরিশীলিত আচরন করবেন, এটা কেউ আশা করেন না। কিন্তু তার মধ্যেও একটা সংযম আমাদের আনতেই হবে। অহেতুক চাপে ফেলা নয়, বরং পাশে থাকা। চিৎকার করে সমর্থন করা, গালাগাল দেওয়া নয়। আর জনমত গড়ে তোলা, যেন ক্লাবে প্রাক্তনীরা ফিরে আসেন। বর্তমান কর্মকর্তাদের বোঝান যে সবাই আমরা ক্লাবটার ভালোই চাই। পাড়ায় পাড়ায় মাইক নিয়ে ঘুরুন, পোস্টার সাঁটুন, ওয়েব সাইটে লিখুন। তবে হ্যাঁ, কিছু জঞ্জাল অবশ্যই আছে। ক্লাবের নাম করে নিজের আখের গোছানোর ধান্ধাবাজ লোক। এদের ক্ষমা করা উচিত নয়। এদের চিহ্নিত করতে হবে। আর লক্ষ্য রাখতে হবে দলকে সমর্থন করার নামে কেউ যেন মাঠে অশান্তি না করতে পারে।
মাঠে অশান্তি করা আটকাবার উপায় কি? যেখানে এক লাখ লোক, কে কাকে চেনে? কিন্তু এরও উপায় আছে। সমর্থকদের সংগঠন তৈরি হোক আরো। কয়েকটা আছে। আরো হোক। সবুজ মেরুন জার্সি পরে মাঠে আসুক “HOWRAH HOARDS, “BAGBAZAR BULLS”, “BEHALA BLASTERS” বা “MIGRANT MARINERS”। কিছু ব্লকের টিকিট এনাদের হাতে দেওয়া হোক, আর বাকিটার দায়িত্ব নিক পুলিস। ঠিক যে ভাবে ইংল্যান্ডে খেলা দেখেন দর্শক। মারকুটে খুনে ইংরেজ দর্শকদের কটা ইপিএলের খেলায় আপনি মারামারি করতে দেখেছেন? আস্তে আস্তে গোটা মাঠেরই দখল নিক সমর্থকদের সংগঠন। আর সেখানে গন্ডগোল ঘটলে সেই সংগঠনটি দায়ী থাকুক, ক্লাব নয়।
এবছর ক্লাবের দল তৈরি করার টাকা নেই। স্পনসর তো দরকার বটেই। কিন্তু তার চেয়েও বেশী দরকার নিজেদের পায়ে দাঁড়ানো। আমাদের কর্মকর্তারা চেষ্টা করলেই পারেন। জোট বাঁধুন না কোন বিদেশী ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে। এতবড় ফুটবলের বাজার কটা পাবেন? তবে ওই লেস্টার সিটি মার্কা জোট নয়। দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক তৈরি হোক। কি দিতে পারি আমরা? তার খতিয়ান নেওয়া হোক। প্রথমে হয়ত কিছুই না। কিন্তু আস্তে আস্তে দিতে পারবো নিশ্চই। সে চেষ্টা হোক। ফিফা তে আমাদের সভাপতির খাতির আছে। সেখানে গিয়ে দেখা হোক। ফিফা সব সময় ক্লাবের পাশে থেকেছে। ক্লাব ফুটবলই বাঁচিয়ে রেখেছে ফুটবলকে। আমাদের মোহনবাগান না থাকলে, কাল ইস্টবেঙ্গল মাঠে লোক হবে তো? স্পনসর টাকা দেবে তো? ইস্টবেঙ্গলের যে সব বন্ধুরা এতক্ষ্যন মুচকি হাসতে হাসতে পড়ছিলেন, এবারে ভেবে দেখুন। মহামেডানে প্রশাসন চলে গেছিলো খেলোয়াড়দের হাত থেকে সেই ষাঠের দশকে। আশীর শেষ থেকে মহামেডান তৃতীয় শক্তি থেকে একেবারে তলানিতে। মোহনবাগানে নব্বই এর শুরু থেকে আর খেলোয়াড়রা প্রশাসনে নেই। গত দশ বছরে কিন্তু ইস্টবেঙ্গলেও নেই। সিঁদুরে মেঘটা আমার লোটা বন্ধুরাও দেখুন। নয়তো মাচাদের দেখে হাসি, শেষে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রজনীগন্ধার মালা দিতে হবে। আমি চাই, শুধু মোহনবাগান নয়, ইস্টবেঙ্গল ও ঘুরে দাঁড়াক। গত দশ বছর ও ক্লাবেও আই-লিগ ঢোকেনি। দুটো ফেডেরেশন কাপ আর তিনটে কলকাতা লিগ নিয়ে খুশি থাকতে মনেহয় আপনারাও পছন্দ করবেন না।
ছোট মুখে অনেক গুলো বড় কথা বলে ফেললাম। শুধু একটা বিশ্বাস থেকে। আমি জানি, কলকাতা ফুটবল মরবেনা। মোহনবাগান মরবেনা। থাকবে। এবং নিজের মত করেই থাকবে। সন্মানের সঙ্গে। মোহনবাগান হবেনা শেষ।  হতে দেওয়া হবে না।

সোমবার, ২০ মে, ২০১৩

গোধুলিয়া থেকে দশাশ্বমেধ - সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

জয় বাবা ফেলুনাথ ছবি যখন প্রথম দেখি, তখন কিশোর মনে ফেলুদা আর মগনলাল মেঘরাজের উপস্থিতি বড়ই প্রবল। আর বেশি কিছু চোখে পড়েনি। আমার সেই বয়সে পরিবেশ বেশ দুষিতই ছিলো, মানে বইমেলাটেলা সব কাছেপিঠেই হত, নাগালের মধ্যেসেরকমই একটা বইমেলা থেকে পেয়েছিলাম সত্যজিত রায়ের লেখা “একেই বলে শ্যুটিং"। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে পড়েছিলাম ফেলুদার সঙ্গে কাশীতেসেই প্রথম কাশীকে চেনা। তারপরে খুঁজে পেলাম, অপুর সঙ্গেও কাশীর যোগাযোগ রয়েছে। সেই থেকে বেনারসের ওপরে একটা টান জন্মে গিয়েছিলো। তার পরে বিভিন্ন ছবি আর লেখায় বেনারসকে পেয়েছি। টোয়েন্টি সেভেন ডাউনবলে একটা ছবিতে বেনারস এসেছিলো একদম শেষে। আর লাগা চুনরি মে দাগছবিতে একদম শুরুতেই। মোটের ওপর সব মিলিয়ে কাশী বা বেনারস বা বারানসি, যাই বলুন, দেখার বড়ই সখ ছিলো। আমার আবার ভ্রমনের ঝুলিটি বেশ বিদঘুটে। হিমালয়ের বরফ, রাজস্থানের মরুভুমি ( থার মরুভূমি থর নয়), কচ্ছের রান, দক্ষিনের মন্দির এমনকি ক্যালিফোর্নিয়াও দেখা হয়ে গেছে । কিন্তু দেখিনি বেনারস। পুরি ও প্রথম গেছি বছর আষ্টেক আগে প্রথম বার। শিলং টিলং তো দেখাই হয়নি। মোটের ওপর ভ্রমনের ঝোলাটা বেখাপ্পা আর জোড়াতাপ্পি দেওয়া। আমি ঘুরেছি হয়ত কিছু জায়গায়, কিন্তু কিছু দেখে তার স্থানমাহাত্য অনুভব করার মত স্পর্শকাতর মন আমার নেই। আমি আধ্যাত্মিক নই, ধর্মের টান আমার নেই। আমি লেখক নই, ভ্রমনকারি নই, ফোটোগ্রাফার নই, বার্ধক্যেও আসিনি এখনো। কাজেই বাঙালির বেনারস ভ্রমনের কোনো কারনই আমার নেই। কিন্তু যাঁরা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন, তাঁরা এই পর্যন্ত এসে মুচকি হাসছেন। ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের একটা সাক্ষাতকারে শুনেছিলাম, বিসমিল্লাহ বলছেন বানারস যো বনা রস্‌ সেএইবার ঠিক ধরেছেন। রসের খোঁজেই এই অধম ছুটেছিলো কাশী। বেনারস নাকি বিখ্যাত ষাঁড়,পাঁড় অউর রাঁড়এর জন্যে। ষাঁড় তো জানি। পাঁড় হলো বাবা বিশ্বনাথের পান্ডা। আর রাঁড় হলো রূপজীবিনি। কিন্তু আমি গিয়েছিলাম কোন রসের খোঁজে? সঙ্গীত বিষয়ে আমার জ্ঞানগম্মি প্রবাদপ্রতিম। একবার চেন্নাইতে অফিসের অনুষ্ঠানে দু কলি বাংলা গান গেয়েছিলামদক্ষিনি বন্ধুরা স্থির চোখে তাকিয়েছিলেন, আর আমার এক দেশোয়ালি সহকর্মী চুপি চুপি বলেছিলেন, গানখানি রবী ঠাকুরের হলেও সুরে আর গায়কিতে আমার নিজস্বতা স্পষ্ট। কিন্তু এসব ছাড়া রস নেই, সেকথা কে বলেছে? জিলিপিতে রস নেই? রাবড়ি? আর গরম কচুরি কিম্বা গাজরের হালুয়া? যাক। আপনাকে বেশি বোঝাতে হয়নি। আমার বেনারস যাবার কারন সম্পর্কে আপনি তাহলে পরিস্কার।

বেনারসের ধর্মতলা হলো গোধুলিয়ার মোড়। ধর্মতলা বললে হয়তো ঠিক বোঝানো হয়না। ধর্মতলায় চওড়া রাজপথ আছে, ফাইভ স্টার হোটেল আছে, পাতাল রেল, বাস ডিপো আছে। গোধুলিয়ায় এসব কিছুই নেই। কিন্তু গোধুলিয়ার আছে বিটকেল জটআছে থিকথিকে ভিড়, সরু রাস্তা, কান ফাটানো চিৎকার, গানের জগঝম্প, ছাই মাখা সাধু, গরম জিলিপি আর কচুরি, ষাঁড়, ঠেলা গাড়ি, শয়ে শয়ে রিক্সা, বাঙালি ট্যুরিস্টের দোকানে ঢুকে বিকট হিন্দিতে দরাদরি, বিদেশী ট্যুরিস্টের দামি ক্যামেরা আর কামানের মত দেখতে লেন্স ঝুলিয়ে হাঁটা, বৌদ্ধ লামাদের হাসি হাসি মঙ্গোলীয় মুখ, দক্ষিনি তীর্থযাত্রিদের হাত আর জামা ধরে লাইন করে হাঁটা, খাস বেনারসি পুরুত পান্ডার পান খাওয়া ঠোঁটে শুদ্ধ হিন্দি, নিশ্চিন্ত আর ঘুমন্ত পুলিস, ঘাড়ে উঠে পড়া মোটর সাইকেল, কখনো গাড়ি, আর আছে এক হাত অন্তর হোটেলের দালাল আর নৌকার মাঝি। আপনাকে ওপারে নিয়ে যাবার জন্য বড়ই ব্যস্ত। তবে সেটা গঙ্গা না বৈতরণী সেটা তর্কসাপেক্ষ। ফুটপাথ বলে একটা কিছু হয়ত হাজার খানেক বছর আগে ছিলো, কিন্তু এখন সেখানে কেবলই দোকান। সেই দোকানের চালা ভেদ করে পেছনের বাড়ি গুলো দেখার চেষ্টা করা বৃথা। শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে গেছে স্বয়ং সুর্য্যদেব সেখানে ঢুকতে পারেননি, আপনি আমি তো কোন ছার। কিন্তু আধুনিকতা যাবে কোথায়? হাল ফ্যাশনের ঝকঝকে ল্যাপটপ বা ট্যাব, মিউজিক সিস্টেম, ইলেক্ট্রনিক্সের টুকিটাকি সবই পাবেন সূর্যের আলোর মতো সোজা চলবার বালাই নেই, তাই বিশ্বায়ন ঢোকে চোরা পথে। গোধুলিয়া আসলে একটা চৌমাথার মোড়, গঙ্গার দিকে দু পা এগোলেই বাঁ হাতি বিশ্বনাথের গলি, আর সোজা একটূ এগোলেই দশাশ্বমেধ ঘাট। এই রাস্তা হলো দশাশ্বমেধ রোড। যদিও হাঁটা দুস্কর, তবুও হিউয়েন সাং, ঔরঙ্গজেব, মার্ক টোয়েন, বিভুতিভূষন, ফেলুদা, সবাই হেঁটেছেন এ রাস্তায়। তবে কিনা এ স্থল বাবা বিশ্বনাথের খাস জায়গীর, কাজেই নন্দী-ভৃঙ্গী দের কথা না বলে ছাড়ি কি করে? আজ্ঞে হ্যাঁ, মহাকায় কিছু ষাঁড় ও আছেন। দিব্যি নিশ্চিন্তে ঘুরছেন এদিক ওদিক। একটু ক্লান্ত হয়ে পড়লে রাস্তার একদম মাঝখানে আয়েস করে বসে বসে জাবর কাটছেনআয়েস দেখে মনে হতেই পারে, নন্দী মশায় বোধহয় গুলকন্দ-জর্দা দেওয়া মঘাই পানই মুখে পুরেছেন। তবে কিনা রাস্তায় ইতি-উতি প্রাকৃতিক কর্মও করছেন। এক সায়েব কে দেখলাম কয়েক লাখ টাকা দামের এক খানা বিশাল ক্যামেরা বাগিয়ে গোবরের ছবি তুলতেকেন বাওয়া? তোমার দেশে কি গরু বা ষাঁড়ের ইয়ে অন্য রকম দেখতে? নাকি তুমি আমাদের গোবরে তাজমহলের কারুকাজ আশা করছো? ও তো আর কমোডে বসে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে কম্মটি করতে পারে না, আর এখানে এ হোল ওর খাস জায়গা। অগত্যা রাস্তাতেই। তোমাদের গরুর খোঁয়াড় কনক্রিটের। এখানে তো খোলা রাস্তা, ওখানে তো সায়েব, তোমার গরু, তোমার ঘরের ভেতর কম্মটি করে। সে দিক দিয়ে দেখলে আমাদের এনাদের সিভিক সেন্স বেশি

দশাশ্বমেধ রোড দিয়ে গাড়ি চলা নিষেধসে নিয়ম বেনারসি আম আদমী নিষ্ঠা ভরে মানেন। যদিও এনাদের বেশ কয়েক হাজার বছরের নাগরিক জীবন, তবুও ওই রাস্তায় গাড়ি ঢোকাবার মত হিম্মত, কারোর কলিজায় থাকতে পারেনা। রাস্তায় কি কি আছে, তা আগেই বলেছি। তা, সে তো ভারতের বহু রাস্তায়ই আছে। এখানে নতুন কি? নতুন যেটা, সেটা হলো, এ রাস্তায় পা দিয়ে, সবাই একটু বাবা বিশ্বনাথের ভক্ত হয়ে পড়ে বোধহয়, তাই জাগতিক ব্যাপারে কিঞ্চিত অনিহা এসে যায়। ধীর গতি, কেউ সরেনা, নড়ে না, গপ্প জমায়, ষাঁড়ের মতই অলস ভাবে রোমন্থন করে চলে, স্মৃতির। শুধু ব্যস্ততা কিছুটা থাকে কচুরি-মিঠাইয়ের দোকানির আর নৌকোর মাঝির। আইনষ্টাইন বলেছিলেন, সবই আপেক্ষিক। এখানে সেটা কিছুটা আক্ষরিক এবং একটু অন্য অর্থে প্রয়োগ করা যায়। এত ভিড় কিন্তু কেউ ব্যস্ত নয়। অপেক্ষা এখানে গত কয়েক হাজার বছরের ঐতিহ্য। আজ্ঞে হ্যাঁ, আসল ভারতবর্ষের বৈঠকি মেজাজ, এখানে আজও বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে। পাশ্চাত্য কুইক টার্নওভারের বর্বরতা এ রাস্তায় এখনো ঢোকেনি। গোধুলিয়া পেরিয়ে দশাশ্বমেধ রোডে ঢুকতেই ডানহাতি এক বিরাট আস্তাঁকুড়। ওদিকে তাকাবেনা। আপনি ওটা দেখতে এখানে আসেন নি। আস্তাঁকুড় কোন দেশে নেই মশায়? সভ্যতা থাকলে সে সভ্যতার পরিষিষ্টও থাকবে প্লাস্টিকের প্যাকেট হয়ে, কখনো ফলের খোসা হয়ে, কখনো অন্য কোন জঞ্জাল হয়ে ওগুলোর জন্য আস্তাঁকুড় আছে বলেই না আপনার ঘরখানা এমন খাশা ঝকঝকে। আর সে জঞ্জাল জড়ো করে জাহাজে চড়িয়ে আটলান্টিক পেরিয়ে আফ্রিকার কোন গরিব দেশে জমা করার মত রেস্ত আমাদের নেই বলে, আমেরিকান ট্যুরিস্ট ভারতের রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিশ্চিন্তে নোংরার ছবি তুলতে পারেন। রাস্তার মোড়ে বেশ কিছু পুলিস, কিন্তু তাদের মধ্যেও কেমন যেন বৈঠকি মেজাজ। চৌমাথার ওদিকে রাস্তার দু ধারে কতগুলো খাবারের দোকান। তাতে মিঠাই রাবড়ি আছে, চাট ভান্ডার আছে, এমনকি বাংলায় জলখাবারলেখা একটা দোকানও আছে। আর আছে রাস্তার একদম মোড়ে পানের দোকান। মঘাই পান। কিন্তু ওদিকে যাবোনা। যাবো গঙ্গার দিকে। রাস্তার মাঝামাঝি লোহার রেলিং দিয়ে রাস্তা ডাইনে বাঁয়ে ভাগ করা। রেলিঙের ধার ঘেঁসে দাঁড়িয়ে এক গাদা ঠেলাগাড়ি। তাতে সাজানো হরেক রকম পশরা। তাতে আছে জিলিপি, আছে আমসত্ত্ব, আছে পেঠা বা কুমড়োমেঠাই, আছে বাদাম ভাজা, আছে চুড়ি, জামাকাপড় আরো কত কি। রাস্তার দু ধারেও এরকম জিনিসের দোকান। দশাশ্বমেধের দিকে যত এগোবেন, ততই দোকানের পরিসর ছোট হবে আর বৈচিত্র বাড়বে।

বিশ্বনাথের গলির মুখটায় একটা তোরন। তবে সেটা বোধহয় অতটা পুরোন নয়। সামনে দাঁড়িয়ে দু জন বন্দুকধারী সেপাই। আজকাল ভগবানও নিরাপত্তার অভাবে ভুগছেন। ও গলির ভেতরে আলাদা জগৎ, আর তার আলাদা গল্প। আমাদের আজকের দৌড় ওই দশাশ্বমেধ ঘাট পর্যন্ত।  বিশ্বনাথের গলি পেরিয়ে রাস্তার বাঁ দিকে পড়বে একটা মিঠাইয়ের দোকান। স্বয়ং বাবা বিশ্বনাথের স্নেহধন্য নিশ্চই, না হলে সাদামাটা প্যাঁড়ায় অমন স্বাদ আসতেই পারেনা। এইখানে এসে রাস্তাটা দু ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটা রাস্তা সরু হয়ে সোজা গিয়ে পড়েছে ঘাটে। সে রাস্তা নোংরার বেহদ্দ, সবজির বাজার আর দুর্গন্ধ। তবে ঘাটে যাবার এটাই সোজা রাস্তা। আর একটা রাস্তা ডান দিকে ঘুরে গেছে। সেদিকটায় বেশ বাজার মত। দু ধারে মনিহারি দোকান সাজানো। রাস্তার মুখেই গোটাকতক পানের মশলার দোকান। আজ্ঞে হ্যাঁ পানে যে মশলা দিয়ে খাই, সেই মশলার দোকান। এমন তার জাঁক জমক, দেখলে মনে হয় যেন গয়নার দোকান। তবে খ্যাতিতে বেনারসি পান, গয়নার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে বইকি। যদিও আমার মনে হলো, বেনারসি মঘাই পানের ঐতিহ্যে যেন কিঞ্চিত ভাটার টান লেগেছে। সে দোকানের পরেই একটা সিঙ্গাড়া কচুরির দোকান। এইখানেই রাস্তার ডান দিকে বাঁক সুরু, আর ঠিক এখানেই আপনার কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকবে একটা সাইনবোর্ড দেখে। রঙচটা লাল রঙের একটা বোর্ড। আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছেন, বিশ্বনাথের গলির ঠিক উলটো প্রান্তে ওটা সিপিআইএমের জোনাল অফিসই বটে। শুনলুম এই বাড়িগুলোর পেছন থেকেই কাশীর বিখ্যাত বাঙালিটোলার শুরু।

যাই হোক, ডান হাতি বাঁক নিয়ে এগোতে থাকলে ক্রমশঃ এ রাস্তাও সরু হয়ে আসে। বেনারসে সাধারনতঃ আর পাঁচটা হিন্দু তীর্থস্থানের মত আমিষ নিরামিষের ছুৎমার্গ নেই। যদিও রাস্তায় রাস্তায় যা বিক্রি হয় তার পনেরো আনাই নিরামিষ। আমিষ রয়েছে বটে, তবে একটু যেন তফাতে, একটু রেখে ঢেকে। গোধুলিয়া থেকে দশাশ্বমেধের রাস্তায় তো একেবারেই নেই। কিন্তু এ রাস্তায় আরো কয়েক পা এগোলে সন্ধ্যের দিকে একটা জিভে জল আনা গন্ধ পা্বেন। ডিম ভাজার গন্ধ। সামনেই দু খানা দোকানে ঝড়ের গতিতে ডিম ভাজা চলছে। ডিম সেদ্ধ ও পাওয়া যাচ্ছে। হাঁসের বা মুরগির, যেমন ডিম চান পাবেন। এরকম নির্ভেজাল ডিমের দোকান আমাদের এদিকে দেখিনি। সামনে রাস্তাটা আবার বাঁহাতি ঘুরে গিয়ে পড়েছে ঘাটের সিঁড়ি তে। সিঁড়ির ঠিক সামনেই একটা ছোট্ট মন্দির। ভেতরে হনুমানের মূর্তি। এ তল্লাটে হনুমান খুবই জাগ্রত দেবতা। সামনে দেখেছিলাম এক সুদর্শন ছোকরা জিন্সের প্যান্ট আর চামড়ার জ্যাকেট পরে দাঁড়িয়ে। পায়ে হাই হিল বুট, পকেট থেকে ঝুলছে হাল ফ্যাশনের রোদচশমা। ছোকরার বাবরি চুল কোঁকড়ানো, থাকে থাকে নেমে এসেছে ঘাড়ের ওপর। পান খেয়ে ঠোঁট দুটি রাঙা লঙ্কা, আর কপালে মস্ত এক খানা সিঁদুরের টিকা। আরো দু পা এগোলে বাঁ হাতি এক খানা চায়ের দোকান। সে দোকানের মালিক ও কর্মী একজনই গম্ভীর মুখের প্রৌঢ়। সম্ভব হলে এ দোকানে একবার চা খেয়ে দেখতে পারেন। কর্পূর আর তুলসীপাতা যে আমাদের চেনা চায়ে এতটা বৈচিত্র আনতে পারে তা আন্দাজ করিনি।

সিঁড়িতে পা রাখলেই ঘাটের চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকে পড়া। এতক্ষনের চেনা রাস্তার সঙ্গে কিন্তু ঘাটের কোন মিল নেই। রাস্তা পুরোপুরি বেনারসি, কিন্তু ঘাট একেবারেই আন্তর্জাতিক। এক আন্তরাষ্ট্রীয় বিমান বন্দর ছাড়া এই এত রকম জাতের জগাখিচুড়ি আর কোথাও দেখিনি। বাঙালি পরিবার আছে, খাস বেনারসের লোকজন আছে, আছে মঙ্গোলিয় মুখের লামা, আছে জাপানি ট্যুরিস্টের দল, আছে একলা আমেরিকান - চরস বা গাঁজার সাহায্যে কিঞ্চিত সাধনাতীত মোক্ষের লক্ষ্যে, আছে উত্তর ইয়োরোপের ইয়া ঢ্যাঙ্গা সোনালী চুলের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আছে ভাষা সমস্যায় পড়া ইতালিয়ান দম্পতি, আছে বাংলাদেশ থেকে আসা আজমিড়ের যাত্রি, আছে পাঠান, তাদের সিলওয়ার মেহেদি রাঙানো দাড়ি সমেত, খুব আশ্চর্য হলেও আছে কিছু আরব ট্যুরিস্ট, প্রধানত সিরিয়ান, এদের নিজেদের খাবারের দোকান ও আছে বেনারসে, আছে কোরিয়ান ব্যাবসাদার, আছে সাধু, আছে আরো সাধু, আধা-সাধু, সাজা সাধু, ভন্ড, দালাল, ভিখিরি, দোকানদার, ফুল ওয়ালি, নাপিত, পূরোহিত আরো কত কে তার ঠিক নেই। তবে এত রকমের লোকজন থাকলেও তাদের উদ্দ্যেশ্য কিন্তু মোটামুটি তিন রকম। প্রথম হলো ভক্তি ও গঙ্গা স্নান। এরাই হলো ঘাটের লোকজনের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশী। এর পর রয়েছে ফোটোগ্রাফারের দল। বিশালাকৃতির ক্যামেরা ও ভিষনদর্শন লেন্স সমেত তারা চারিদিকে ভনভন করছে। একটু সাজু গুজু করা সাধু, উদাস ভিখিরি বা ষাঁড় দেখলেই তারা ময়রার দোকানে মাছির মত ভিড় করে ঠেলাঠেলি করে ছবি তুলছে। এদের সিংহভাগই বিদেশি অথবা বাঙালি। তৃতীয় ভাগে আছে দোকানি, পুরোহিত, দালাল, মাঝি, নাপিতের দল। অর্থাৎ যারা প্রথম দলের ওপরে নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে।


ঘাটের সিঁড়িতে মাঝে মধ্যেই একটা করে চত্ত্বর মতো করা। সেখানে চৌকি পাতা। কিছু জায়গায় বাবাজিরা সেগুলো দখল করে আছেন। কিছু ফাঁকা। বসলে কেউ কিছু বলেনা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামলে ঘাটে লোকসমাগম বাড়ে। আস্তে আস্তে আলো জ্বলে ওঠে। ঘাটের ধাপগুলোতে লোকজন এসে বসতে থাকে। ফুলওয়ালিরা পুজোর ডালি নিয়ে ঘুরছে। একটা ছোট্ট চ্যাঙাড়ি, তাতে গোটা কয়েক ফুল, একটা ছোট্ট প্রদীপ। প্রদীপ জ্বেলে ওগুলো গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে হয়। এ হলো সন্ধ্যার গঙ্গা পূজো। ভোরবেলায় অবশ্য স্নানার্থীরা কোমরজলে দাঁড়িয়ে, গঙ্গা জলেই গঙ্গাপূজো করেন। ভিড়ের বাড়তে থাকা গুঞ্জন একসময়ে হঠাৎ ধাক্কা খায়। ডুগ্‌ ডুগ্‌ করে ডমরু বেজে উঠেছে কোথাও। এক মুহর্ত পরে তার সঙ্গে যোগ হলো মৃদঙ্গ। বহুমুখি জনসমাগম এক লহমায় অ্যাটেনশন্‌ ভঙ্গি তে তাকালো সামনের চত্ত্বরের দিকে। দেখি সেখানে আবির্ভূত হয়েছেন জনা পাঁচেক পুরোহিত। পরনে পট্টবস্ত্র, উত্তরীয়, কামিজ। বেশ কায়দা করে পরা। বয়স সকলেরই ২৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে। একটা স্ট্যান্ডে মাইকের মাউথপিস লাগানো। সেখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে গান ধরলেন পাঁচজনে এক সঙ্গে। গঙ্গার স্তব জয় জয় গঙ্গে , জয় মা গঙ্গে। অবাক হয়ে দেখুন, চারিদিকে নানা জাতীর মানুষ চুপ করে বসে শুনছেন, এবং গান প্রথম বার অন্তরা ঘুরে এলে, অনেকেই আস্তে আস্তে গলা মেলাতে শুরু করেছেন। যেখানে পুরোহীতরা দাঁড়িয়ে তার ঠিক ডান দিকে একজন মহাকায় প্রৌঢ় একটা মোটা কাছি ধরে প্রানপনে টান লাগালেন। প্রথমটা বোঝা যায়না কি ঘটছে। তারপরে মাথার ওপরে ঢং করে বেজে ওঠে এক মহা্কায় ঘন্টা। তার পর এদিক ওদিক আর অনেক গুলো ঘন্টা বেজে ওঠে। সম্বিৎ ফিরে পেতে একটু সময় লাগে, তার পরে তাকালেই দেখাযায় পূরোহিতরা মাইকের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়েছেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখুন, ওনারা আলাদা আলাদা চৌকির সামনে গিয়ে বসেছেন। সেখানে বসানো অতিকায় পিলসূজ প্রদীপ, আরতীর জন্য। আরো কত কি।

এবারে আবার গান আরম্ভ হলো। ঘণ্টা এবারে তালে তালে বাজছে। পূরোহিতরা উঠে দাঁড়ালেন। হাতে একটা বড় আঙটা, যাতে কর্পুরের আগুন জ্বলছে। আঙটার মাপ প্রায় আমাদের ভাত খাবার থালার মতো। এবারে আরম্ভ হলো আরতী। পূরোহীতরা নেচে নেচে আরতী করছেন জ্বলন্ত আঙটা হাতে নিয়ে। প্রত্যেকের এক ভঙ্গি, এক মুদ্রা একই পদক্ষেপ। এতটাই তাল মেলানো, যে এর কাছে হয়ত সোনা জেতা অলিম্পিকের সিনক্রোনাইজড সুইমারও লজ্জা পাবেন। এ নাচের মধ্যে চটুলতা নেই, বরং আছে মনকে আচ্ছন্ন করা ছন্দ। আঙটার পর প্রদীপ, তারপর চামর। চারিদিকের থিকথিকে ভিড় তন্ময়, নিশ্চুপ। মায়ের কোলের বাচ্ছারাও কাঁদেনা। কেন কাঁদেনা, বলতে পারবো না। হয়তো এই অপার্থীব মুহুর্তের স্বাদ তারাও পায়। এ তো যুক্তি দিয়ে বোঝার ব্যাপার না। শুধুই অনুভুতি। এর মধ্যে ধর্ম নেই, ভগবান নেই, বিশ্বাস নেই। আছে শুধু ওই অনুভুতি। জাগতিক বাস্তব সমস্ত কিছুর বাইরে, কিছুর অস্তিত্ব। নিজের সম্পর্কে নতুন করে ধারনা তৈরি হওয়া। একদিকে আমি কে, আমার পরিচয় কি, আমি কোথা থেকে এসেছি এসব কিছু ভুলে যাওয়া, অন্য দিকে এই পরিবেশে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া। আরতীর শেষ। পুরোহীতরা গঙ্গায় ফুল ভাসালেন। ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় একজন পুরোহিতকে কেমন চেনা চেনা লাগলো। ও হরি, এ তো সেই হনুমান মন্দিরের সামনে দাঁড়ানো জিন্স পরা ছোকরা। ঠিক সেই মুহুর্তে আমার মনে হলো, আমরা সকলেই আসলে ওই জিন্স পরা ছোকরা। ওপর থেকে অনেক কিছু পরে আছি। এক এক রকমের আস্তরন। এক এক রকমের অহংকার, যা হয়তো আমার মধ্যে থাকা আসল আমিকেই ঢেকে ফেলেছে। যেদিন সেই আস্তরন, অহংবোধ থেকে মুক্ত করতে পারবো নিজেকে, সেদিন হয়ত চারিদিকের এই জগৎটাই আমার কাছে নতুন করে ধরা দেবে।

ঘাটের সিঁড়ি ধাপে থাপে নেমে গেছে গঙ্গার জল পর্য্যন্ত। ছলাত ছলাত করছে জল। ঠিক এইখানে এসে, বেনারসের যাবতীয় হই হট্টগোল থেমে যায়। এর সীমানা এই পর্যন্ত। এর পরেই আবহমানকালের গঙ্গা। হাজার বছর ধরে এই ভাবে বয়ে চলেছে। শত পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে। যদিও নিজে পাল্টায়নি একটুও। গঙ্গার ওপাড়ে ধু ধু বালিয়াড়ি। পশ্চিম দিকে রামনগর, দেখা যায়না। বেনারসের হইচই কে যেন ব্যালেন্স করে দিয়েছে ওপারের নৈশব্দ আর শান্ত সমাহিত রূপ। বেনারস যদি আবার যাই, তাহলে যাবো ঐ লোভেই, আর পারলে নিজের কয়েকটা আস্তরন খুলে ফেলে।

[যদি কেউ উৎসাহী হন, তাহলে লেখকের অপটু হাতের তোলা কয়েকটি ছবি দেখতে পারেন নিচের লিঙ্কে ক্লিক করে

রবিবার, ১৯ মে, ২০১৩

ভাবনা চিন্তা ~ অমিতাভ প্রামানিক

চিত্রশিল্পী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তার নিজস্ব ফেসবুক পেজে আজ লিখেছেন - Tomorrow, on the 20th of May, our Government would complete two years in office.

সংবিধান বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী দলকে পাঁচ বছর শাসন চালানোর ছাড়পত্র দিয়েছে। তবুও পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে শাসনে অনভিজ্ঞ এই সরকারকে প্রথম দু বছর অতিবাহিত করার জন্য অভিনন্দন জানাতেই হবে। পরাজিত বামফ্রন্ট দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর গদিতে থেকে সরকারী অফিসকে প্রায় দলের পার্টি অফিস মতোই বানিয়ে বসেছিল বলে অনেকের অভিযোগ। সেই পার্টিকে বিপুল ভোটে হারিয়ে বর্তমান সরকার গদিতে বসার সময় অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন – যাক বাবা, বাঁচা গেল। এবার শান্তিতে বাঁচা যাবে। 

গত দু'বছর তাদের কতজন শান্তিতে বেঁচেছেন, তাদের সংখ্যা বেড়েছে না কমেছে, তার চিত্র আর কিছুদিন পরে পঞ্চায়েত ভোটে জানা যাবে ভোটের মার্জিন থেকে। 

পোস্টটির বাকি অংশে ফিরে আসি। আগাগোড়া ইংরাজীতে লেখা পোস্টটিতে মাত্র দুবার মা-মাটি-মানুষের উল্লেখ আছে, আর বাংলায় দুটো রবীন্দ্রনাথের কোটেশন। তার প্রথমটা হচ্ছে "আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে..."। মা-মাটি-মানুষের উদ্দেশেই নিবেদিত রবি ঠাকুরের এই গানের বাণী খুব প্রাসঙ্গিক ও অর্থবহ এখানে। রবিবাবু এই গান ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে সমর্পণ করেছিলেন। ঈশ্বরের প্রতি নিবেদিত প্রার্থনা সর্বসাধারণের প্রতি ব্যবহার করলে একটা অতিভক্তির ব্যাপার (কিসের লক্ষণ যেন এটা?) সহজেই চোখে পড়ে। বিশেষ করে যখন একের পর এক ধর্ষণের মত ঘৃণ্য অভিযোগের উত্তরে কেউ 'চক্রান্ত', 'ষড়যন্ত্র' বা 'সাজানো ঘটনা' বলে উড়িয়ে দেয়। তবে কি এটা সেই মানহারা মানবীদের উদ্দেশ্যে সমর্পিত? খোলসা করে বললে পুলিশ ও বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের সুবিধে হয়। 

দ্বিতীয় কোটেশনটি হচ্ছে "বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল / পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক…"। রবীন্দ্রনাথের এই দুটো লাইন বোঝাই যাচ্ছে অসম্পূর্ণতা দোষে দুষ্ট। বিস্ময়করভাবে এতে বাংলার মা এবং বাংলার মানুষের উল্লেখ নেই। দূরদর্শী কবি বোধহয় জানতেন এমন এক সময় আসবে যখন দৌরাত্ম-নির্ভর বাংলার গদিতে মা আর মানুষের প্রকৃতই অভাব ঘটবে। ওদের পুণ্য হওয়ার বাসনা থেকে তাই তিনি নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন। 

দু'বার উল্লেখ আছে বিগত চৌত্রিশ বছরের অপশাসনেরও। হতাশ পরিস্থিতি থেকে পরিবর্তনের হাহাকার বর্তমান সরকারকে গদিতে বসিয়েছে। কিন্তু মাথার ওপর করের বোঝা (দু লক্ষ কোটি টাকার), সরকারী শাসনযন্ত্র সকলই বিকল। এই পরিস্থিতি থেকে মাত্র দু বছরে এই সরকার কী দুর্দান্ত ফল ফলিয়েছে তার খতিয়ান দেওয়া আছে এই পোস্টে।

বলা হচ্ছে কৃষি ও কৃষিসংক্রান্ত সেক্টরে, শিল্পে ও সার্ভিসে পশ্চিমবঙ্গের অগ্রগতি ভারতবর্ষের গড় অগ্রগতির দেড়গুণ। এই চার সেক্টরে ভারতের গড় বৃদ্ধি যেখানে ৫%, ১.৮%, ৩.১% ও ৬.৬%, রাজ্য এগিয়েছে সেখানে যথাক্রমে ৭.৬%, ২.৬%, ৬.২% ও ৯.৫% হারে। ফ্যান্টাস্টিক। শিল্পে রাজ্য এগিয়েছে, খুব খুশির কথা। কোন শিল্পে এগিয়েছে, সে প্রশ্ন এখন থাক। অমিত মিত্রের মত গুণী মানুষ যেখানে বসে আছেন, সেখানে ভাল কিছু আশা করা মোটেও অসঙ্গত নয়। গত দু বছরে অমিতবাবুর মুখ দিয়ে কোন কথাই শোনা যায় না, বস্তুত বর্তমান সরকারে তিনি কতখানি গুরুত্ব পান, সে নিয়েই বরং অনেক কথা এদিক ওদিক শুনতে পাওয়া যায়। আগের সরকার কথায় কথায় বলত, বিহারকে দেখুন, আমরা সে তুলনায় কত এগিয়ে। এখন অবশ্য এরা তা আর বলছেন না। বিহার বোধ হয় সব ব্যাপারেই নাক কেটে নিচ্ছে বাঙালীদের। 

এ বছরের রাজস্ব আদায় ৩২০০০ কোটি টাকার, গত বছরের তুলনায় যা ৩০% বেশী। এটা নাকি একটা রেকর্ড। তবে এর মধ্যে ২৬০০০ কোটি টাকা কেন্দ্রকে সুদ দিতেই বেরিয়ে গেছে (কেননা আগের সরকার ধার করেছিল), তাই উন্নয়ন খাতে পড়ে আছে তলানিটুকু।

বলা হয়েছে, বছরে ১০০ দিনের আবশ্যিক কর্মসংস্থান প্রকল্পে পশ্চিমবঙ্গ এখন ভারতের এক নম্বর রাজ্য। এই খাতে যা ব্যয় করা হবে ধরা হয়েছিল, সেই বাজেটেরও ৭% অতিরিক্ত (অর্থাৎ বাজেটের ১০৭%) খরচ করা হয়েছে। আগের সরকার খরচ করত বাজেটের মাত্র ১৭-২৩%। সকলেই জানেন, এই খরচ পুরোপুরি সরকারি যন্ত্র দিয়েই খরচ করা হয়। এই বিপুল অর্থরাশি কার পকেটস্থ হয়েছে, কতটা পেয়েছে দুঃস্থ মানুষ, তা খতিয়ে দেখলে অনেক চিত্তাকর্ষক জিনিস জানা যাবে। 

রাজ্য এখন বোরো চাষে, যাতে কম জলসেচে চাষ হয়, দেশের এক নম্বরে। চাষীদের ধন্যবাদ দেওয়া হয়েছে। চাষীভাই, অভিনন্দন তোমাকে।

রাজ্যে নাকি কর্মসংস্কৃতির তীব্র উন্নয়ন হয়েছে। বাংলা বন্ধ উঠে গেছে। সারা বছরে কর্মহানির পরিমাণ ৭৮ লক্ষ মানব-দিবস থেকে কমে হয়েছে মাত্র ৫ হাজারে। আপনি আমি সকলেই জানি – এটা একটা ডাহা মিথ্যে। চিত্রশিল্পী নিজে কাজের ফাঁকে ছবি এঁকে যে কর্মহানির উদাহরণ রেখেছেন, তা এই খতিয়ানে উঠে আসেনি। বাংলা বন্ধে অংশগ্রহণকারী স্কুল টীচারদের ওপর মাতব্বরির পরিসংখ্যানও এতে নেই। আগের সরকারের শাসনকালে মুহুর্মুহু বাংলা বন্ধের ডাক কারা দিত, সে সম্বন্ধেও মুখে কুলুপ। মিথ্যে কথা বলা একটা অভ্যাস। যে কোন বিষয়ে একটা মিথ্যে প্রমাণ হলেই অন্যগুলো নিয়ে চর্চা করার খুব প্রয়োজন হয় না। দুধওলা সোমবারে দুধে জল মেশালে মঙ্গলবারেও যে মেশাবে, তাতে আর সন্দেহ কী?

পরিশেষে সমাজের সর্বস্তরে – নারী, শিশু, ছাত্র, কর্মী, চাষী, শ্রমিক, মাইনরিটি সম্প্রদায়, মৎস্যচাষী, শিল্পী, স্বাস্থ্যকর্মী – সকলের উন্নয়নসাধনে রাজ্যসরকার নাকি ব্রতী হয়েছেন। হলেই ভাল। 

এই কথাগুলোই লেখা আছে। যা লেখা নেই, তা হল, টাটাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার পর কোন শিল্পসংস্থা পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগে রাজী নয়। যারা আছে, সুযোগ পেলেই কেটে পড়ার উপক্রম করছে। ভারতের ও বিভিন্ন দেশের শিল্পপ্রতিনিধিদের নিয়ে বেঙ্গল লীড্‌স্‌ নামে প্রহসন যে সামগ্রিক রাজ্যবাসীর প্রবল লজ্জার কারণ হয়েছে, তা কহতব্য নয়। ভাষা, প্রাথমিক ভুগোল, ব্যবহারবিধি ইত্যাদি বিষয়ে চূড়ান্ত অজ্ঞ একজনের শীর্ষাসনে বসে থাকা কতটা যুক্তিসঙ্গত, তা নিয়ে ব্যপক সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষিত মহলে। সাম্প্রতিক দুই সুদীপ্ত কাণ্ডে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নেতৃবৃন্দের সামগ্রিক কোরাপশনের চিত্র জনসমক্ষে চলে এসেছে।

স্বাধীনতার সময় থেকেই বাঙালী সর্বভারতীয় স্তরে উচ্চশিক্ষায় সদাসর্বদাই এক অগ্রণী জাতি। সে গরিমা দিন দিন স্থিমিত হয়ে আসছে। তবু আত্মাভিমানী বাঙালী কতদিন তাদের শাসনের গদিতে এমন মানুষকে (মা-মাটির প্রসঙ্গ থাক) রাখবেন, যিনি কার সাথে কেমনভাবে কথা বলতে হয় তাই জানেন না, সেটাই এখন দেখার।

বুধবার, ১৫ মে, ২০১৩

যাযাবর, তার দৃষ্টিপাত আর আমি .... ~ তমাল রাহা


প্রথম পর্ব:

আজও মুখস্ত কথাগুলি, হয়ত আরও অনেক বাঙালী ছেলের মতো, ........:প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা। কিন্তু প্রবঞ্চিতকে দেয় কি? তাকে দেয় দাহ। যে আগুন আলো দেয় না অথচ দহন করে, সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য চারুদত্ত আধারকার।

ভাবা যায়? ...........

বয়সটা তখন ১৬-১৭, বইটা পড়তে পড়তে আমি নিজেকে যে কখন চারুদত্ত ভাবতে শুরু করেছিলাম, নিজেই জানি না! আসলে তখন বয়সটাই ছিল ঐরকম। সুন্দরী দেখলে মনের কোণে কথায় কথায় হেমান্তবাবুর গান বেজে ওঠে " আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি, আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছি।"

আর বারবার পরা "দৃষ্টিপাত" এর সেই লাইনগুলো ........ যে নারী, প্রেম তার পক্ষে একটা সাধারণ ঘটনা মাত্র। আবিষ্কার নয়, যেমন পুরুষের কাছে। মেয়েরা স্বভাবত সাবধানী, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর বাঁধে। ছেলেরা স্বভাবতই বেপরোয়া, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর ভাঙ্গে। প্রেম মেয়েদের কাছে একটা প্রয়োজন, সেটা আটপৌরে শাড়ির মতই নিতান্ত সাধারণ। তাতে না আছে উল্লাস, না আছে বিষ্ময়, না আছে উচ্ছ্বলতা। ছেলেদের পক্ষে প্রেম জীবনের দুর্লভ বিলাস, গরীবের ঘরে ঘরে বেনারসী শাড়ির মতো ঐশ্বর্যময়, যে পায় সে অনেক দাম দিয়েই পায়। তাই প্রেমে পড়ে একমাত্র পুরুষেরাই করতে পারে দুরূহ ত্যাগ এবং দুঃসাধ্যসাধন।

পড়তাম, আর ভাবতাম প্রেম টা বোধহয় ছেলেদের জিন-এ আছে। তাই প্রেম পেতেই হবে ... যেনতেন প্রকারেণ।

জানি না বাকিরা একমত হবেন কিনা, তবে এই বইটা ছিল qoute -এর খনি। আমার নিজের সৌভাগ্য হয় নি সেভাবে এর সুযোগ নেওয়ার। তবে পরোক্ষ ভাবে কিছুটা হলেও কাজে লেগেছিল। একটু গুছিয়ে লিখতে পারতাম বলে বন্ধুদের অনেকের প্রেমপত্র লেখার ভার ছিল আমার ওপরে। সেখানে চুটিয়ে quote করেছি এই বইটা থেকে। উফফ, সে কি লেখা! আমার বন্ধুরা তো মুগ্ধ হতই, ওদের বান্ধবীরাও নিশ্চয় হতেন!

বিনয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়  (যাযাবর), তার এই উপন্যাসের জন্যে এক অসাধারণ আঙ্গিক বেছেছিলেন। বিলেত ফেরত এক বাঙালী যুবক আসেন দিল্লি তে, ক্রিপস মিশন সম্পর্কে লেখার জন্য। কাজের ফাঁকে সে তার বান্ধবী-কে যে চিঠি লিখত তারই সংকলন এই উপন্যাসের আঙ্গিক। যুবক-এর নাম জানা যায় না। সবাই 'মিনি সাহেব' বলেই ডাকত। কি অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা দিল্লি শহরের! আমি দিল্লি অনেক বড় হয়ে গিয়েছিলাম।কিন্তু শহরের অনেক কিছুই চেনা মনে হযেছিল 'মিনি সাহেব' এর দিল্লি-র বর্ণনা পড়ে। কিন্তু, এই লেখার বিষয় 'মিনি সাহেব' এর দিল্লির বর্ণনা নয়। কাজের সুত্রে মিনি সাহেব এর আলাপ হয় এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ-এর, নাম চারুদত্ত অধারকার। আমার লেখার উপজীব্য আজ সেই চারুদত্ত অধারকার এর সাথে এক বিবাহিতা বাঙালী রমনীর 'ভালবাসা', কাছে আসা, আবার দূরে সরে যাওয়া। হ্যা, সুনন্দা বানার্জি-র কথাই বলছি, যার প্রেম চারুদত্ত অধারকার-এর জীবনকে দিয়েছিল ঐশ্বর্য্য আর প্রবঞ্চনা দিয়েছিল 'দাহ।

মারাঠি যুবক চারুদত্ত আধারকারের সঙ্গে এক বিবাহিতা বাঙালিনী সুনন্দার প্রেমকাহিনী। সুনন্দাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে আধারকার বাঙলা শিখলেন, পড়লেন রবীন্দ্রনাথ। সুনন্দাও অকুণ্ঠ চিত্তে আধারকারকে দিলেন তাঁর হৃদয়। আর মিনি সাহেব লিখলেন …..উভয়ের উদ্বেলহৃদয়ের গভীর ভাবাবেগ সমাজ-সংসারের সমস্ত ক্ষুদ্রতা ও কলঙ্কের উর্ধে দেবমন্দিরের পবিত্র হোমাগ্নির মত যেন জ্বলতে লাগল।

বিজ্ঞানের চোখে ভালোবাসা- "পেরেন্টাল ইনভেস্টমেন্ট" "সারভাইভাল স্ট্রাটেজি" "ইনস্টীঙ্কট".... সাহিত্যের চোখে তা- "দিবস রজনী বেদনা"..... ধর্মের চোখে- "ব্যভিচ্যার".... আধ্যাত্মবাদিদের চোখে- "সাধনা"।
ফলে, যা হওয়ার তাই হলো। নিভে গেল সেই আগুনের শিখা। কেন? হ'তে পারে সুনন্দার  মোহমুক্তি …. কিম্বা কলঙ্কের দায়।মিনি সাহেব কি লিখছেন এরপর বান্ধবীকে তাঁর চিঠিতে?.... সে (সুনন্দা) নারী। প্রেম তার পক্ষে একটা সাধারণ ঘটনা মাত্র। আবিষ্কার নয়, যেমন পুরুষের কাছে.....তাই প্রেমে পড়ে একমাত্র পুরুষেরাই করতে পারে দুরূহ ত্যাগ এবং দুঃসাধ্যসাধন

সুনন্দা-কে ভালো লাগত। যদিও কখনই সে  "কালবেলা"-র অনিমেষের মাধবীলতা নয়। তবে ভালো লাগাটা কিন্তু নির্মল। আর, চারুদত্ত তো বাঙালী প্রেমিক-দের রোল মডেল! আসলে চারুদত্ত নাম-টাও বোধহয় এই উপন্যাসের একটা strategic choice ছিল।

স্বভাববসত-ই মিনিসাহেব, স্পষ্টতই পক্ষপাতদুষ্ট।  আর যাযাবর-এ লেখক প্রেম-এ প্রত্যাখ্যাত চারুদত্ত কে দিয়ে বলালেন ... , (আমি) পরিহাসকে মনে করেছি প্রেম; খেলাকে ভেবেছি সত্য। কিন্তু আমি তো একা নই। জগতে আমার মতো মুর্খরাই তো জীবনকে করেছ বিচিত্র; সুখে দুঃখে অনন্ত মিশ্রিত। .....তাদের , ত্রুটি, বুদ্ধিহীনতা নিয়ে কবি রচনা করেছেন কাব্য, সাধক বেঁধেছেন গান, শিল্পী অঙ্কন করেছেন চিত্র, ভাস্কর পাষাণখণ্ডে উত্কীর্ণ করেছেন অপূর্ব সুষমা

হয়ত চারুদত্ত ওই কথাগুলোর মধ্যে খুঁজে বেড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন সুনন্দা কে হারানোর সান্তনা। হয়ত বা তা ছিল 'মিনি সাহেব' এর চারুদত্ত-র ওপরে অন্ধ ভালবাসার আর মুগ্ধতার বহিঃপ্রকাশ। বাঙালী কিন্তু চারুদত্ত অধারকার-কে নায়কের সম্মানই দিয়েছে। এযাবৎ অনেক বন্ধু বা পরিচিতকে দেখেছি "চারুদত্ত অধারকার" হতে, বিবাহিত বা অবিবাহিত মহিলার প্রেম-এ পরে। চারুদত্ত অধারকার তো তখন আমারও নায়ক। ভাবতুম, আহা আমি যদি চারুদত্ত-র মত গুছিয়ে বলতে পারতাম! নিদেন পক্ষে 'মিনি সাহেব' এর মত। এত প্রতিভাবান ব্যক্তি কেন তার ভালবাসা-কে পেলেন না, যত ভেবেছি ততই অবাক হযেছি। চারুদত্ত তো তখন সেই ট্রাজিক হিরো! গভীর অভিমান সুনন্দ দেবীর প্রতি ......... আর মনের মধ্যে ওই কথাটাই বারবার ঘুরেফিরে আসত ...

..........:প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা। কিন্তু প্রবঞ্চিতকে দেয় কি? তাকে দেয় দাহ। যে আগুন আলো দেয় না অথচ দহন করে, সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য চারুদত্ত আধারকার।

কোনো কথা হবে না …..

আরেক চারুদত্ত-কে মনে পরে?
শূদ্রক রাজার রচিত 'মৃচ্ছকটিক' নাটকে  দেখা যায় চারুদত্ত নামে একজন সম্ভ্রান্ত ও উচ্চ শিক্ষিত ব্যাক্তি বসন্তসেনা নামে এক বারাঙ্গনার জন্যে শূলে মৃত্যু পর্যন্ত বরণ করতে গিয়েছিলেন। যাযাবর-এর চারুদত্ত শূলে চড়ে মৃত্যুবরণ না করলেও দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দহনে পলে পলে দগ্ধ  হয়ে হয়ে মরেছিলেন।

বাঙালী প্রেম-এ পরলেও খোজে রবীন্দ্রনাথ কে, আবার বিরহেও …..  আমার চারুদত্ত-এর কথা পড়তে গিয়ে তখন মনে হত সেই লাইন গুলি ….

…........ ছায়া ঘনাইছে বনে বনে,   গগনে গগনে ডাকে দেয়া।
কবে নবঘন-বরিষনে গোপনে গোপনে এলি কেয়া ॥
পুরবে নীরব ইশারাতে   একদা নিদ্রাহীন রাতে
হাওয়াতে কী পথে দিলি খেয়া--
আষাঢ়ের খেয়ালের কোন্‌ খেয়া ॥
যে মধু হৃদয়ে ছিল মাখা   কাঁটাতে কী ভয়ে দিলি ঢাকা।
বুঝি এলি যার অভিসারে   মনে মনে দেখা হল তারে,
আড়ালে আড়ালে দেয়া-নেয়া--
আপনায় লুকায়ে দেয়া-

আহা, চারুদত্ত-র জন্যে যে কত কষ্ট পেয়েছি ওই বয়সে!

বাংলা সাহিত্য আমার মতে শ্রেষ্ট দেবদাস কে জানেন? চারুদত্ত আধারকর।
মিনি সাহেব কিন্তু খুব সুন্দর ভাবে এই আবেগটা পাঠকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন। হ্যা, আমার মধ্যেও। মিনি সাহেব এর মত আমরাও বিশ্বাস করতে শুরু করেছি তখন ... সত্যি হতভাগ্য চারুদত্ত আধারকার।
একটা সময় তো মনে হয়েছিল খুঁজে বের করি সুনন্দা বানার্জি কে। একবার জিগ্যেস করি "কেন এমন করলেন বলুন তো চারুদত্ত-র সাথে?"

সময় বদলেছে। এখন বয়সটা পাকা। তাই একটু অন্যভাবে ভাবি আজকাল। সুনন্দা বানার্জি-র নিশ্চয় কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল। মিনি সাহেব যেটা আমাদের বলেন নি।

এখন আবার মনে হয় একবার সুনন্দা বানার্জি-র সাথে দেখা হলে মন্দ হয় না। তবে এবার কোনো প্রশ্ন করব না। শুধু শুনব, মিনি সাহেব শুধু চারুদত্ত-র কথাটাই বলেছিলেন। সুনন্দা দেবীর কথা কিন্তু শোনা হই নি আমাদের কারো! হয়ত ওনার-ও কিছু বলার ছিল, যা আমরা আজো জানতে পারি নি।  কিন্তু চারুদত্ত আধারকারের বঞ্চনার জন্য সুনন্দা কতটা দায়ী সে বিতর্ক এখনো আমার মনে রয়ে গেছে।

দ্বিতীয় পর্ব

লেখাটা আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। খাপছাড়া ছিল, কিন্তু কিভাবে শেষ করব জানা ছিল না। কিন্তু প্রথম পর্বটা ঘটনা চক্রে গিয়ে পরলো সুনন্দা বানার্জি-র হাতে। জিগ্যেস করতে হয় নি। সুনন্দা শোনালো তার কথা। আসলে সুনন্দ-র কথাগুলো আমায় বার ভাবাল। তাই ভাবলাম যে সুনন্দার ক´থাটাও লেখা দরকার।

সুনন্দা-ও খুঁজছিলেন কাউকে। কিন্তু সে বোধহয় মিনি সাহেবের "চারুদত্ত" নয়। হতে পারে সে "কালবেলা"-র অনিমেষ। এই সুনন্দা লেখাটা পরে বলল, কে বলেছে  যে  নারী মাত্রেই প্রেম-এ উল্লাস নেই? কে বলেছে যে তার কাছে প্রেম নিতান্তই সাধারণ ঘটনা?বিশ্বাস করি না . হ্যা, তবে এটা সত্যি যে নারী স্বভাবজাত সাবধানী ....

ঠিক এই ভাবে ভেবে দেখি নি। তবে একটা প্রশ্ন এলো মনে, নারী যদি সাবধানী হয় তবে শুরুতেই সে সাবধানী ছিল না কেন? নাকি সেটা ছিল চারুদত্ত বা মিনি সাহেব-এর বোঝার ভুল?

… সুনান্দারা ভাবে বোধহয় যে তাদের প্রেম-এ কেউ পরে না। তাই চারুদত্ত-দের সাথে  মেলামেশার সময় তার মাথায় আসে না যে এটা প্রেম। যখন সে বোঝে তখন তখন সে হয়ে ওঠে সাবধানী। কিন্তু যখন তারা সাবধানী হয়, তখন চারুদত্ত-কে বোঝার ক্ষমতাও থাকে না। না, আমি সুনান্দাদের দায়ী করছি না। this just mere ignorance from her side... অকপট স্বীকারোক্তি সুনন্দার ….

ঠিক তা নয়, আমার অপ্রতিরোধ্য দামাল স্বভাব সব উড়িয়ে দিতে চায়, জানো? বোধহয় কেমন একটা নিজের কাছেই লজ্জা পাই। তাই এসব আমল না  দেবার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা আছে আমার। হয়ত, আমি চাই নি চারুদত্ত কে ! ভালোলাগা আর ভালবাসার ভেদ করে উঠতে পারি নি। এটাই আমার ভুল ….....
অস্বীকার করি না যে নারীসুলভ সাবধানতা থেকে হয়েছিলাম স্খলিত … ওটা একটা  টানাপোড়েন … টানা আর পোড়েন -এর মাঝে কখনো কখনো  সাবধানতা স্খলিত হয়। আমারও হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে উপলব্ধি করেছিলাম এ সম্পর্কের কোনো পরিনতি নেই। মেয়েরা পরিনতি চায়। বোধহয় কেমন নিজের কাছেই লজ্জা পেয়েছিলাম ….......

পরের কথা গুলো  মনে দাগ কেটে গেল … সুনন্দা-র গলায় নির্মলেন্দু গুনের কবিতা-টা বড় অদ্ভূত সুন্দর শোনালো …

"বৃথাই বুকে পুষে বেড়াও গ্লানি
বৃথাই তুমি নিজেকে দাও দণ্ড;
দুই খণ্ডে সমাপ্ত যে-বইখানি
তুমি ছিলে মাত্র তার এক খণ্ড!!

… না গ্লানি নেই আমার কোনো। সেই মুহুর্তে  সেই ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত।

এরপরই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরে আজকের সুনন্দা, "কালবেলা"-র অনিমেষ কে কোথায় পাই বলো তো? তাহলে সত্যি আমি প্রেম-এ  পরবো এবার।

আজকের সুনন্দা। যে তার ভালোলাগা আর ভালবাসা কে আলাদা করতে জানে।

আজকের সুনন্দা। যে মিনি সাহেব এর লাগিয়ে দেওয়া ছাপ-এর থেকে বেরিয়ে এসে নিজের মত জানাতে দ্বিধা বোধ করে না।

আমি ভাবি সুনন্দা-রা কি বদলে গেছে? নাকি ´মিনি সাহেব´-এর বোঝার ভুল! কে জানে? …...