বুধবার, ২৯ জুন, ২০২২

​গর্ভপাতের অধিকার প্রসঙ্গে ~ বিষাণ বসু

মার্কিন শীর্ষ আদালত মেয়েদের গর্ভপাতের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে। এটুকু নিশ্চিত। সেই রায়ের সূত্র ধরে সেদেশের বিভিন্ন রাজ্য নিজেদের আইনে ঠিক কী কী বদল আনবে, তা এখুনি বলা মুশকিল। তবে আসছে। ভবিষ্যতে আরও আসবে বলেই মনে হয়। মার্কিন দেশে মেয়েরা গর্ভপাতের অধিকার সহজে পায়নি। এদেশে যত অবাধে গর্ভপাত সংক্রান্ত আইন পাস হয়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তা এসেছিল বিস্তর জটিলতা সহকারে।
Abortion is Legal 1971 India

ইহুদিরা বিশ্বাস করে, মনুষ্যজীবন শুরু হয় জন্মের মুহূর্ত থেকে। তাঁদের গর্ভপাত নিয়ে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু খ্রিষ্টানদের, বিশেষত ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের, বিশ্বাস - মনুষ্যজীবনের শুরু শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর নিষেক ঘটার মুহূর্ত থেকেই (পরবর্তীতে জিনবিজ্ঞান থেকে লব্জ ধার করে যুক্তি সাজানো হয়, নিষেকের মুহূর্তেই জাইগোট তার একান্ত নিজস্ব জেনেটিক গঠন পেয়ে থাকে, যা জারি থাকবে জীবনভর)। অতএব, যেকোনও গর্ভপাতই হত্যা। সুতরাং ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের দ্বারা চালিত আমেরিকায় গর্ভপাত নিয়ে আপত্তি থাকবে, সে তো বলাই বাহুল্য। সে তুলনায়, হিন্দুধর্মের অপরিবর্তনীয় ও দেহাতীত আত্মায় বিশ্বাস - যে আত্মা কিনা ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে - এদেশে, সম্ভবত, গর্ভপাত বিষয়ক আইন নিয়ে বিচলিত না হওয়ার কারণ। তাছাড়া, এদেশে যখন সে আইন পাস হয়, তখন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ব্যক্তিগত ধর্মের খুব একটা মাখামাখি বা সঙ্ঘাত ছিল না, কাজেই ধর্মসংক্রান্ত আপত্তি - যা হওয়ার এমনিতেও কারণ ছিল না - বা তদসংশ্লিষ্ট শোরগোল ওঠেনি।
কিন্তু গর্ভপাতের বিরুদ্ধে ধর্মীয় যুক্তি বাদ দিয়েও এথিক্সের দিক থেকে আপত্তিগুলো ঠিক কী ছিল? সে যুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিযুক্তিই বা কী কী? সেই কথাগুলো ফিরে দেখা যাক। তবে সে আলোচনায় যাওয়ার আগে মানবশিশুর জন্মের আগেকার পর্যায়গুলো বুঝে নেওয়া দরকার।
একেবারে শুরুর পর্যায়টা হলো নিষেক - ফার্টিলাইজেশন। শুক্রাণু ডিম্বানুর মিলন - দুইপক্ষের জিনের মিশ্রণে তৈরি হলো জাইগোট-এর জেনেটিক গঠন। এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে জাইগোট এসে আঁকড়ে ধরবে জয়ায়ুর দেওয়াল। ইমপ্ল্যান্টেশন। মায়ের জরায়ু আগলে রাখবে তাকে। (ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের মত অনুসারে, ফার্টিলাইজেশন থেকেই জাইগোট-টি মানুষ। অতএব, ইমপ্ল্যান্টেশন আটকানোটাও অনুচিত।) জাইগোট থেকে এমব্রায়ো, অর্থাৎ ভ্রূণে পরিবর্তন, ঘটতে থাকবে ধীরে ধীরে। শুরুর পর্যায়ের কোষগুলো থেকে শরীরের সবরকম কোষ তৈরি হতে পারে, কিন্তু আস্তে আস্তে 'বিশেষজ্ঞ কোষ' তৈরি হতে থাকে, যা থেকে কিনা নির্দিষ্ট অঙ্গ বা তন্ত্রের কোষই তৈরি হওয়া সম্ভব। ভ্রূণের রূপও বদলে যেতে থাকে। বারো থেকে ষোল সপ্তাহের মধ্যে ভ্রূণটি মানব-ভ্রূণের চেহারা নেয়। তার আগে অব্দি ভ্রূণটিকে আর পাঁচটা স্তন্যপায়ী প্রাণীর ভ্রূণ থেকে আলাদা করা মুশকিল। আগে ভাবা হতো, চব্বিশ থেকে আটাশ সপ্তাহ বয়সের মাথায় গর্ভস্থ শিশু মাতৃজঠরের বাইরে এসে বেঁচে থাকতে সক্ষম। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সময়টা এগিয়ে এসেছে - মাতৃগর্ভে বাইশ সপ্তাহ কাটিয়ে আসা শিশুকেও বাঁচানো সম্ভব। ঠিকঠাক পরিকাঠামো থাকলে চব্বিশ সপ্তাহে জন্মানো শিশুর বাঁচার সম্ভাবনা প্রায় পঞ্চাশ-ষাট শতাংশ, বাইশ সপ্তাহে সেটা পঁচিশ শতাংশ।
এই সময়কালের মধ্যে ভ্রূণ ঠিক কবে মানবশিশু হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য হয়ে উঠল, তা বুঝে ওঠা মুশকিল। ২০১০ সালে নেব্রাস্কায় কুড়ি সপ্তাহের বেশি বয়সের ভ্রূণের গর্ভপাত নিষিদ্ধ হয়। কেননা, কুড়ি সপ্তাহে নাকি ভ্রূণ ব্যথা-যন্ত্রণা অনুভবে সক্ষম (যদিও ধাত্রীবিদরা এ বিষয়ে সহমত নন)। নেব্রাস্কার দেখাদেখি আরও বেশ কিছু রাজ্যে অনুরূপ আইন পাস হয়, যদিও ২০১৫ সালে মার্কিন সংসদে এই বাবদ বিল (Pain-capable Unborn Child Protection Act) পাস করানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এবারে আসা যাক এথিক্সের প্রশ্নে।
গর্ভপাতের বিরুদ্ধে প্রাথমিক যুক্তিটা ধর্মীয়, যা শুরুতেই বললাম। কিন্তু এথিক্স ব্যাপারটা ধর্মের হাত ধরেই এসেছে, সুতরাং ধর্মীয় যুক্তিটা কিয়দংশে এথিক্সেরও যুক্তি। সেই যুক্তি অনুসারে, গর্ভাবস্থার প্রতিটি পর্যায়েই ভ্রূণটি মানব-ভ্রূণই। অতএব তাকে হত্যা মানব-হত্যা। আবার ধরুন, চব্বিশ সপ্তাহে গর্ভস্থ শিশু শরীরের বাইরে বেঁচে থাকতে সক্ষম - অন্তত এক-চতুর্থাংশ ক্ষেত্রে বাইশ সপ্তাহের শিশুও তা-ই। মানুষ হিসেবেই। তাহলে কোনও একটি বিশেষ দিনে কেমন করে বলা সম্ভব, যে, ঠিক তার আগের দিনটিতে গর্ভস্থ ভ্রূণটি - নাকি শিশুটি - 'মানুষ' হিসেবে গণ্য হওয়ার উপযুক্ত নয়? এমন করে একদিন একদিন করে পেছোতে থাকলে একেবারে শুরুর মুহূর্ত, অর্থাৎ ফার্টিলাইজেশন, অব্দি যুক্তি পাওয়া যায়।
এটা অবশ্য লজিকের ভাষায় স্লিপারি স্লোপ আর্গুমেন্ট। এমন যুক্তি ধরতে থাকলে পরীক্ষায় পাসমার্ক বা গাড়ির স্পিড লিমিট, সবকিছুর বিরুদ্ধেই অনুরূপ যুক্তি দেওয়া সম্ভব। অর্থাৎ, পরীক্ষায় তেত্রিশ পাওয়া মেয়েটি কি চৌত্রিশ পাওয়ার থেকে খারাপ? তাহলে কোন যুক্তিতে সে ফেল? আবার তেত্রিশকে যদি মানেন, বত্রিশ নয় কেন? এমন করে শূন্য অব্দি অনায়াসে পৌঁছে যাওয়া যায়।
পরের যুক্তিটা আরেকটু জটিল। যেকোনও মানুষকে হত্যা অনুচিত কেন? মানে, এ তো জানা-ই কথা যে, মানুষটা একদিন না একদিন মরতই। কী এমন ক্ষতি যদি সেই অনিবার্য দিনটিকে কয়েক বছর এগিয়ে আনা হয়? গ্রহণযোগ্য উত্তর হলো, অন্যায়, কেননা মানুষটা তার ভবিষ্যত বেঁচে থাকার অধিকার, তার জীবনের পুরো ক্ষমতা, জীবনের পুরো সম্ভাবনা - আর পাঁচজন মানুষের মতো জীবন - তা উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত হলো। একটি মানব-ভ্রূণের ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা জন্মানো মানবশিশুর থেকে খুব আলাদা কি? এবং সেই সম্ভাবনা ভ্রূণাবস্থার প্রতিটি পর্যায়েই সমান (স্বাভাবিক কোনও কারণে গর্ভপাত হয়ে গেলে তা সেই সম্ভাবনার অপমৃত্যু)। অতএব, গর্ভপাত মানে সেই সম্ভাবনাকে বিকশিত হতে না দেওয়া। মানুষ খুনেও যেমনটা ঘটে, তেমনই।
প্রথমত, এই যুক্তি মানলে, গুরুতর রোগগ্রস্ত মানুষ বা মানবশিশু - যাদের 'আর পাঁচজন মানুষের মতো জীবন' গড়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই - তাদেরকে মেরে ফেলার যুক্তিও পাওয়া যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, 'আর পাঁচজন মানুষের মতো জীবন' এই সম্ভাবনা একজন মানুষেরই থাকে - 'পার্সন' অর্থে মানুষের, যার একটা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও চিন্তাশক্তিসম্পন্ন মন রয়েছে। তার আগে অব্দি সে স্রেফ জিন-পরিচয় বা প্রজাতি-পরিচয়ে মানুষ - 'অর্গানিজম' হিসেবে মানুষ, 'পার্সন' হিসেবে নয়। অতএব, গর্ভপাত মানে 'অর্গানিজম' থেকে 'পার্সন'-এ পরিণত হতে না দেওয়া। অর্থাৎ 'পার্সন'-টি তৈরি হতে পারল না - যা তৈরি হলে আনুষঙ্গিক মনুষ্য-সম্ভাবনাও তৈরি হতো - কিন্তু যেহেতু 'পার্সন'-টি এক্ষেত্রে তৈরিই হয়নি, সেক্ষেত্রে সম্ভাবনার অপমৃত্যু হিসেবে ভাবার যুক্তি নেই। অর্থাৎ, গর্ভপাত সেই অর্থে 'পার্সন' তৈরি হওয়া প্রতিরোধ করছে - গর্ভনিরোধকের ব্যবহারকে যদি 'সম্ভাবনার অপমৃত্যু' হিসেবে না দেখেন, গর্ভপাতকেও তেমন করে দেখার কারণ নেই।
যাঁরা গর্ভপাতের পক্ষে, তাঁরা মানব-ভ্রূণ ও মানবশিশুর মধ্যে এই 'পার্সন' কি 'পার্সন' নয়, এই যুক্তির উপরেই ভরসা করেন। অন্তত করতেন।
পরবর্তীতে জুডিথ থমসন ভ্রূণকে মনুষ্য-পদভুক্ত হিসেবে ধরেও চমৎকার এক যুক্তি সাজান। তাঁর বক্তব্য, ধরা যাক, মানব-ভ্রূণ একটি সম্পূর্ণ জীবন ও তাকে মায়ের দেহ ও অস্তিত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে এক পৃথক অস্তিত্ব হিসেবে ভাবা সম্ভব। কিন্তু এক 'পৃথক অস্তিত্ব' যখন অপর একজনের শরীরকে আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করছে, তখন তা তো পারস্পরিক সম্মতি ভিন্ন উচিত নয়। অর্থাৎ ভ্রূণ যদি পৃথক অস্তিত্বসম্পন্ন হয়, তাহলে যে নারীর শরীর - অর্থাৎ মায়ের শরীর - সে আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করছে, তা মায়ের সম্মতি ব্যতিরেকে হওয়া অনুচিত। সুতরাং, মা যদি চায়, ভ্রূণকে আশ্রয়চ্যুত - মাতৃজঠর থেকে বিচ্যুত - করতে পারে।
মূল যুক্তি-প্রতিযুক্তির জায়গাগুলো এই।
এছাড়া নারীর নিজের শরীরের উপর অধিকার, নিজের শরীর-বিষয়ক সিদ্ধান্তগ্রহণের অধিকার ইত্যাদি যুক্তি তো আছেই। কিন্তু সেক্ষেত্রে ভ্রূণের বাকি অর্ধেক জিন যে তরফ থেকে আসে - অর্থাৎ পুরুষ বা পিতার অধিকার, তাঁর সিদ্ধান্তগ্রহণের অধিকার - সেসব যুক্তিও উঠে আসতে পারে।
ধর্ষণ বা বলাৎকারের ফলে গর্ভবতী হয়ে পড়া নারীর গর্ভপাতের অধিকারের বিরুদ্ধে অবশ্য খুব জোরালো গলায় কেউই বলেন না, কিন্তু বাস্তবটা হলো, গর্ভপাতের ব্যাপারে আইন জটিল হলে তেমন নারীর পক্ষেও গর্ভপাত করাতে পারা দুস্তর হয়ে যায়।
পাশাপাশি এও বলে রাখা প্রয়োজন, গর্ভধারণ সংক্রান্ত জটিলতার কারণে গর্ভবতী নারীর প্রাণসংশয় ঘটলে গর্ভপাত করানোর অধিকার - যা কিনা চিকিৎসকের সিদ্ধান্ত - সে নিয়ে বিশেষ বিতর্ক ছিল না।
এবারে সেই রায়ের প্রসঙ্গ, যা কিনা বারবার উঠে আসছে গত কয়েকদিন। মার্কিন শীর্ষ আদালতের Roe vs Wade মামলা, যেখানে আদালতের রায়ে সেদেশের মেয়েরা গর্ভপাতের যুক্তিসিদ্ধ অধিকার - নারীদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতার স্বীকৃতির পথে একটি বড় ধাপ- তা অর্জন করতে পেরেছিলেন। মামলাটি বিষয়ে বিশদে জানতে হলে উইকিপিডিয়া থেকে দেখে নিতে পারেন। আমি সংক্ষেপে সারকথাটুকু বলব।
মামলার রায় আসে ১৯৭৩ সালে। কিন্তু ঘটনাটা ১৯৬৯ সালের। টেক্সাসের নর্মা ম্যাককর্ভে - বহুলপরিচিত এই মামলায় ব্যক্তিপরিচিতি গোপন রাখার জন্য আইনি ছদ্মনাম জেন রো - তৃতীয়বারের জন্য গর্ভবতী হন, এবং উপলব্ধি করেন যে তাঁর পক্ষে তৃতীয় সন্তানকে মানুষ করা সম্ভব নয়। এমন ক্ষেত্রে, টেক্সাসে আইন অনুযায়ী, গর্ভপাতের অধিকার স্বীকৃত নয়। অতএব মামলা স্থানীয় ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি, হেনরি ওয়েড, তাঁর বিপক্ষে। রো বনাম ওয়েড।
মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট রায় দেন মূলত দুটি দিক থেকে। প্রথমত, মানব-ভ্রূণের ক্ষেত্রে আইনি অবস্থান - লিগাল স্টেটাস। আদালতের পর্যবেক্ষণ, এই গর্ভপাত আইন বাদে আর কোথাওই মানব-ভ্রূণের আর পাঁচটা মানুষের সমতুল্য আইনি পরিচিতি বা অধিকার - যেমন সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি - সেসব নেই। অতএব, মানব-ভ্রূণ সম্পূর্ণ মানুষের সমান কিনা সেসব পৃথক তর্কের বিষয়। দ্বিতীয়টি হলো, একজন মানুষের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার। তেমন তেমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র সে অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে, ঠিকই - কিন্তু এই বিশেষ ক্ষেত্রে তেমন পরিস্থিতি ঘটেছে কি? তাহলে রাষ্ট্র কোন অধিকারে এক নাগরিকের এমন একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে চাইছে?
রো বনাম ওয়েড মামলায় শীর্ষ আদালতের রায়ে গর্ভপাতের অধিকার স্বীকৃত হয় - অন্তত কিয়দংশে, কেননা রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের সুযোগ খানিক থাকেই, বিশেষত বারো সপ্তাহের পরে গর্ভপাত চাইলে। তবুও মার্কিন দেশের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে এই রায় যথার্থই বৈপ্লবিক। কিন্তু বর্তমান রায়ে উলটপুরাণ ঘটল। পুনর্মূষিকোভবর সম্ভাবনা। সম্ভাবনা নয়, খুবই বাস্তব।
গত কয়েক দশকে মার্কিন বিচারব্যবস্থায় রক্ষণশীলদের প্রভাব বেড়েছে। গত দুই দশকে অন্তত শীর্ষ আদালতে অন্তত এমন পাঁচজন বিচারপতি নিযুক্ত হয়েছেন, যাঁরা গর্ভপাতের বিরুদ্ধে। গত বছর টেক্সাসে এমন আইন পাস হয়, যাতে ভ্রূণের হৃদস্পন্দন পাওয়া গেলে গর্ভপাত নিষিদ্ধ। ভ্রূণের হৃদস্পন্দন ধরা পড়তে পারে মাত্র ছয় সপ্তাহেই। ওকলাহোমায় বিল পাস হয়, আইনবিরুদ্ধ গর্ভপাতের সাজা দশ বছরের জেল। লুইজিয়ানায় বিল আনা হয়, গর্ভপাতের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা মানুষ খুনের সমান - বিলটি যদিও আইনে পরিণত হয়নি। ওকলাহোমা-র নতুন আইন অনুসারে, নিষেক থেকেই মনুষ্যজীবনের শুরু - গর্ভনিরোধক হিসেবে আইইউডি (কপার-টি ইত্যাদি) কাজ করে অনেকাংশে নিষেকের পর, তার উপরও নিষেধাজ্ঞা আসবে না তো? গর্ভধারণের কারণে গর্ভবতী মহিলার প্রাণসংশয় ঘটলে গর্ভপাত এখনও আইনসিদ্ধ। কিন্তু গর্ভপাত আর মানুষ খুন সমান, এমন আইন হলে কজন ডাক্তার সাহস পাবে গর্ভপাত করাতে!!
আরও বড় সংশয়, রো বনাম ওয়েড মামলার রায়ের মূল বিবেচ্য ছিল, নাগরিকের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে রাষ্ট্রের নাক-গলানোর অধিকারের উচিত নাকি অনুচিত। শেষ বিচারে এটুকুর ভিত্তিতেই এসেছিল ঐতিহাসিক রায়। সেই রায় বাতিল হওয়ার পথ ধরে আসবে না তো ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তগ্রহণের স্বাধীনতার উপর আরও বড় কোনও আঘাত?
বিশ্বের রাজনীতিতে তো বটেই, গণতন্ত্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রক্ষণশীলদের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। বেড়ে চলেছে। সব দেশেই। এদেশেও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়া ঘর অব্দি পৌঁছে না যায়, এই জন্যই না এত শত ভাবনা।

© বিষাণ বসু


রবিবার, ২৬ জুন, ২০২২

ভারতের গর্ভপাত আইন ~ স্বাতী রায়

আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট গতকাল এক কলমের খোঁচায় সেখানকার মেয়েদের সংবিধানগত গর্ভপাতের অধিকারটিকে খারিজ করে দিয়েছেন। তারপরই বেশ একটু ভারতের প্রগতিশীলতা নিয়ে আনন্দ দেখা গেছে। হওয়ারই কথা। বলে কিনা সেই ১৯৭১ সাল থেকে এদেশে গর্ভপাত আর অপরাধ নয়। ০-১২ সপ্তাহের মধ্যে ( দুই ডাক্তারের অনুমতিক্রমে ২০ সপ্তাহ অবধি )। (সাম্প্রতিক বদলে অবশ্য উভয় সময়সীমা বেড়েছে।)   সেই '৭১ সালের আইনে অবশ্য বিবাহিত মেয়েদেরই শুধু আরও সন্তান আনতে না চেয়ে ব্যবহৃত কন্ট্রাসেপশন ফেলিয়রের সম্ভাবনা বলা ছিল। ধর্ষণজাত ভ্রূণের গর্ভপাত করতে হলে অবশ্য বিবাহিত-অবিবাহিত বাধা নেই। এই সবে ২০২১ সালে সেই বিবাহিত-অবিবাহিতের ফ্যাঁকড়া সরিয়ে বলা হল মহিলা ও তার পার্টনার, আর জোড়া হল সন্তান না চেয়ে ব্যবহার করা কন্ট্রাসেপশন মেথডের কথা । এইটুকুই ভারতের আধুনিকতার অর্জন।   

 কিন্তু সত্যিই সেই আইনের কতটা ছাপ পড়েছে সমাজের উপর? পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের অভিজ্ঞতা কি বলে? মেয়েদের কথা বাদ দিন, এমনিতেই ওদের বারোহাত কাপড়ে কাছা জোটে না, তাদের আবার মতামত! তার থেকে ডেটা দেখুন। ডেটা পাওয়া গেছে  http://www.johnstonsarchive.net/policy/abortion/india/ab-indias.html থেকে।  এখানে এই যে ১৯৯৩-৯৪ সালে রিপোর্টেড এবরশনের সংখ্যা ৬৪ হাজারের বেশি হল, এমন তো নয় যে সেবার কোন গ্রহ নক্ষত্রের যোগে সংখ্যাটা ওই মাত্রায় পৌঁছাল। বরং প্রশ্ন উঠুক, অন্যান্য বছর এত কম কেন? সত্যিই কি আবর্শনের দরকার পড়েনি ? নাকি দরকার পড়েছে, আর দরকার মেটাতে মেয়েরা বাধ্য হয়েছেন হাতুড়ের কাছে যেতে, বাড়িতে বিভিন্ন উপায় চেষ্টা করতে? 



কমিউনিটি মেডিসিনের চার অধ্যাপক ২০১৫-১৬ সালে নক্সালবাড়ি ব্লকে ৪২০ জন ১৫-৪৯ বছরের মহিলার মধ্যে সার্ভে করে জানিয়েছিলেন যে যদিও গড়ে প্রতি মহিলার ১.৩ টি গর্ভপাতের অভিজ্ঞতা রয়েছে, এর মধ্যে ৪৮.৩%ই আপনাআপনি হয় না, অর্থাৎ কিনা সেগুলো ইনডিউসড এবরশন, ওষুধ দিয়ে বা সার্জিক্যালি করা হয়। আর তার ৫৮% হয় বাড়িতে, হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে ইত্যাদি। অনুমান করছি সেগুলো নিশ্চয় আর কোনভাবে রিপোর্টেড হয়না। ১৭৮টা এবর্শনে ৫০ টা  হিসেবের বাইরে থেকে গেল। আরও ৭১ টা হয় বেসরকারি জায়গায় – তারই বা কটা রিপোর্টেড হয় তা কে জানে! এই অবস্থায় প্রথম ছবির ওই পেন্ডুলামের মতন একবার চাগিয়ে উপরে ওঠা আবার ঝপ করে নেমে যাওয়া দেখলে কেমন সন্দেহজনক লাগে না? ( সূত্রঃ https://www.ijph.in/article.asp?issn=0019-557X;year=2019;volume=63;issue=4;spage=298;epage=304;aulast=Dasgupta )

আরও অবাক হতে হয়, দ্বিতীয় ছবিটা দেখলে। ডেটা সোর্স ঃ http://www.johnstonsarchive.net/policy/abortion/india/ab-indiad-westbengal.html  এটা ২০১০-১১ সালের ডেটা। কলকাতায় যেখানে প্রায় ১৫০০০ এবর্শন, সেখানে বীরভূমে মাত্র ৮২ টা, বাঁকুড়ায় মাত্র ৩২৭ টা। কী জানি হয়ত সেখানকার মানুষের জীবন খুবই সংযমী, কোনও উল্টোপাল্টা পা পড়ে না সেখানকার মানুষের, তবে আমি পাপী তাপী মানুষ আমার কেমন মনে হয় যে আসল কারণটা হয়ত অন্যত্র। রিপোর্ট যতদূরে দেখতে পায়, তার বাইরে হয়ত থেকে যায় অনেকটাই। সেই বাইরে যেটা থেকে যাচ্ছে,  তার কতটা সেফ এবর্শন? দেবা ন জানন্তি, কুতো মনুষ্যাঃ … 

বিবাহিত মেয়েদেরই হাতের আওতায় এল না সেফ এবর্শন, অবিবাহিত হলে তো কথাই নেই! কত যে কথা শুনতে হয়! একটি এমটিপি করতে আসা মেয়েকে নার্স বিভিন্ন ব্যক্তিগত প্রশ্ন করায় এক বেসরকারি হাসপাতালের (পশ্চিমবঙ্গের বাইরের) ডাক্তার নার্সকে ডেকে কাউন্সেল করেছিলেন, বলেছিলেন এই সব কথা তো তোমার জানার দরকার নেই। ও একটা সার্ভিস নিতে এসেছে আমাদের কাছে, আমরা দেব এইটাই ওর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক, বাকিটা ওকে বুঝে নিতে দাও। এই ডাক্তার মহিলাকে অসীম শ্রদ্ধা জানাই। এর পাশে রাখি সেই সব কলকাত্তাই ডাক্তারদের যারা শুধু সিঁদূর দেখতে না পাওয়ার জন্য একটি মেয়েকে কুমারী ধরে নিয়ে মোরাল পিসিমা হয়ে এমটিপি করা নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতে চেষ্টা করেছিলেন।  

এমনিতেই ভারতের এবর্শন সংক্রান্ত আইন নিয়ে একটা বড় বক্তব্য যে গর্ভ রাখা না রাখা গর্ভবতী জনের ইচ্ছার অধীন না, ডাক্তারের মতামতের দ্বারা পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত। তারউপর পিএনডিটি এক্টের জন্য এখন ডাক্তাররা চাপে থাকেন কি? গর্ভপাত করাতে হেজিটেট করেন? তাহলে কিন্তু আনসেফ এবর্শন বাড়বে বই কমবে না। আরও একটা কথা এই প্রাইড মাসে না তুললে অন্যায় হবে, এই আইন কিন্তু আগাগোড়া মেয়েদের কথাই বলে গেছে শুধু। অন্যদের কি হবে?
     
তবে এসব তো পরের কথা, এমনকি আইনে যেটুকু আছে, সেটুকুও যে কতটা হয় এই ছবিগুলো তার প্রমাণ। আইন থাকলেই হয় না, আইনকে সবার হাতের আওতায় পৌঁছে দিতে হয়। সেজন্য ইনফ্রাস্ট্রাকচার লাগে, মানুষ লাগে, সদিচ্ছা লাগে। নাহলে হয়ত প্রগতিশীলতার খাতায় অফিসিয়াল টিকটা মারা যায়, কিন্তু আখেরে কাজের কাজ কিছু হয় না। সংবিধানসম্মত অধিকারের আওতায় থাকা ভারত আর আওতার বাইরে থাকা আমেরিকার তফাৎটা তখন ঝাপসা হয়ে যায়।

সোমবার, ২০ জুন, ২০২২

পুড়ছ্যে রাবন ~ সুস্মিতা ওঝা

বল্যেছিলিস দেশট জুড়্যে চালাইন্ দিবিস 'বিকাশ' রথ!
দেশের বেকার ছেল্যা পাল্য কেমন ধারা 'অগ্নিপথ'!
বিকাশ যাঁয়্যে গড়গড়ায়্যেঁ ঢুকল্য পুঁজিপতির ঘর,
কাজ হারাল্যেক কত মানুষ, মরল্য কত পথের পর। 
কাঠ-কুচরি কুড়াইঁ আন্যে রাঁধত্য হামার গরীব মা,
দেখ্যে ত তর চ'খের আঁশু বাঁধন যেমন মানথ্য না!
একট ফিরি সিলিণ্ডারে, মায়ের সাথে ফটক ট,
গরীব মানুষ সাধাসিধা, বুঝল্য বাদে রগড় ট। 
দাম বাঢ়ালিস চড়চড়ায়্যেঁ, সব ল'কেরই মাথায় হাত,
দ্যাখ হুলক্যে উনানশালে, উনানে ফের পাল্হা-পাত। 
নোটবন্দী, সেটও ছিল তর কাছে এক মজার খেল,
কাল' টাকা করলি সাদা, ন্যাড়ার মাথায় ভাঙলি বেল! 
বল্যেছিলিস ফি বছরে দু'কোটি চাকরি হব্যেক,
আজ শুনাছিস দেড় বছরে চুক্তি কর‍্যে লাখ দশেক!
বারে বারে ভাঁওতা দিবিস, করবি তবে মস্ত ভুল,
চার বছরের চুক্তি সেনা! লড়ব্যে যারা জান কবুল! 
ভণ্ডামি তর দেখলি বহুত, ভণ্ডামি তর বেলাগাম,
'অগ্নিপথেই' পুড়ছ্যে রাবন, যতই সাজিস নকল রাম।
                      ----------------

সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

পাঠশালা কেন বন্ধ ~ ঊর্বা চৌধুরী

কয়েকটা বিষয় নজরে আনতে চাইছি -

১) নানা ছুতোয় স্কুলে লম্বা লম্বা ছুটি দেওয়ার ও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আদ্যন্ত অস্বাভাবিক একটি সরকারি শিক্ষানীতি। শিক্ষা প্রসঙ্গে কোনো সরকার সাধারণত এসব ক্রুড ঘটনা ঘটিয়ে ফেলার সাহস চট্ করে দেখানোর কথা ভাবতে পারে না। আজকের জমানায় ধনতান্ত্রিক দেশেও না। 

কারণ, স্কুল বন্ধ থাকা কেবল বাচ্চার জীবনযাত্রাকে বদলে দেয় না, অভিভাবকদের জীবনযাত্রাকেও চোখে পড়ার মতো করে বদলে দেয় - সকলে সহজেই বুঝতে পারেন যে, স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত তাঁদের জীবনকে সম্পূর্ণ তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে। কুরাজনীতির সরকার এতটা বড় গোলমাল সমাজে পাকাতে চায় না।

এটি চরিত্রে কেবল ব্যতিক্রমী রকমের ক্ষতিকর নয়, সম্পূর্ণ "উৎকট" ব্যতিক্রমী রকমের ক্ষতিকর। আড়াই বছর হতে চলল এ রাজ্যে এই "একশ' শতাংশ উৎকট" ঘটনাটাই ঘটে চলেছে। 

অতএব এত বড় অনাচারের পিছনে গূঢ় কোনো বিপজ্জনক পরিকল্পনা, এবং বড়সড় পৃষ্ঠপোষকতা যে আছে - সে কথা নিশ্চিত। যা সরকারকে এ জাতীয় মোটাদাগের অনাচার চালাতে সহায়তা করছে।

২) বিপজ্জনক পরিকল্পনা সম্বন্ধে নিশ্চিত হচ্ছি কারণ, এ রাজ্যে আড়াই বছর ধরে স্কুল বন্ধ করে রাখা হয়েছে কেবল নয়, বন্ধ হয়ে থাকা সরকারি স্কুলের লাখ লাখ ছাত্রের জন্য ন্যূনতম কার্যকরী কোনো বিকল্প ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি, হচ্ছে না। 

আবারও উল্লেখ করছি - আড়াই বছর ধরে লাখ লাখ বাচ্চাদের সরকারি স্কুলগুলি বন্ধ করে রাখা হয়েছে এমনটাই নয় - বিকল্প কোনো বন্দোবস্ত চালু করা তো দূরের কথা, সরকারি তরফে তা কোনো চর্চার মধ্যেই নেই। 

অর্থাৎ বিদ্যালয় শিক্ষা প্রসঙ্গে এ রাজ্যের সরকার নিজেকে একশ' শতাংশ দায়হীন করে ফেলছে। দেশে রাইট অফ চিলড্রেন টু ফ্রি অ্যান্ড কমপালসারি এডুকেশন অ্যাক্ট ২০০৯ থাকা সত্ত্বেও সে দায়হীন হয়ে থাকতে পারছে। এবং এই আইনটি সংবিধানের মৌলিক অধিকার-এর ভিত্তিতে তৈরি করা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের দরাজদিলীর ব্যাপার নয়, এটি সরকারের একটি  বাধ্যতামূলক দায় সংক্রান্ত আইন। 

সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতির কারণে কোনো সরকার এই দায় অস্বীকার করার জায়গায় দর্শনগত দিকে থেকে ১৯৫০ সাল থেকেই ছিল না , এবং পরবর্তীকালে আইনতও ২০০৯ সাল থেকে এমন কাজ সরকার করার জায়গায় নাই।

৩) বাচ্চাদের লেখাপড়া, পুষ্টি, শারীরিক, বুদ্ধিগত, প্রাক্ষোভিক, সামাজিক, ভাব প্রকাশগত, ও নৈতিক বিকাশ, যা জড়ো করলে "শিক্ষা", তা সম্পর্কে এমন উৎকট সরকারি নীতির কথা শিক্ষাক্ষেত্রে কর্মরত কর্মীরা, শিক্ষাবিদেরা, শিক্ষা গবেষকেরা আজগুবি কল্পনাতেও আনতে পারেন কি না সন্দেহ! 

৪) যে স্কুলগুলি বন্ধ রাখা হচ্ছে সেগুলি সরকারি, সরকার পোষিত, সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ পরিচালিত - অর্থাৎ কি না এগুলি স্থায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কোনো সাময়িক প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্পের প্রতিষ্ঠান নয় - প্রকল্পের শুরু আর শেষ উদ্বায়ী। মূলস্রোতের প্রতিষ্ঠান কিন্তু তা নয় - এগুলি সাময়িক আপৎকালীন পরিস্থিতিতে তৈরি হওয়া প্রতিষ্ঠান নয়। এই স্কুলগুলি সমাজে কোনো ইভেন্ট ঘটানোর জন্য বা প্রতীকী কাণ্ড ঘটানোর জন্য তৈরি হয়নি। জনগণের ৩৬৫ দিনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা দরকার মেটানোর জায়গা এই স্কুলগুলি। 

গোটা রাজ্যে আড়াই বছর ধরে বিদ্যুৎ, জল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া আর এই আড়াই বছর ধরে স্কুল বন্ধ রাখার মানে যে এক্কেবারে এক - সে কথা কাউকে বোঝাতে হয় না।

নজর করাতে চাই এই সিদ্ধান্তের প্রশাসনিক তাৎপর্যটির দিকে - এমন কাছাখোলা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত কোনো স্বাভাবিক মাথা গ্রহণ করতেই পারে না।

নজর করাতে চাই এই সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক তাৎপর্যটির দিকে - এমন ডেসপারেট রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও কোনো স্বাভাবিক মাথা গ্রহণ করতে পারে না...

...যদি না শাসককে কোনো না কোনো শক্তপোক্ত ফোর্স পিছন থেকে মনোবল, কায়িক বল অবিশ্রাম জোগান দিতেই থাকে। 

এছাড়াও যেটি বলার - লক্ষ করবেন জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ -র "স্কুল ক্লাস্টার/ স্কুল কমপ্লেক্স " অংশটিতে - বোঝা যাবে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ করে দেওয়ার বন্দোবস্ত সেখান থেকেই শুরু। নতুন নতুন স্কুল তৈরি করার নীতি গত শতাব্দীর ছয়ের দশক থেকে এ শতাব্দীর প্রথম দশক অবধি বাধ্যতামূলকভাবে নেওয়া হয়েছে। হঠাৎ করে পরিস্থিতির গুণগত তফাত না ঘটা সত্ত্বেও, একাধিক সরকারি স্কুল বন্ধ করে "ক্লাস্টার" করে ফেলার পিছনে কোনো  সৎ উদ্দেশ্য থাকা সম্ভবই না - সরকারি স্কুল কমাতে কমাতে শূন্য করে ফেলাই একমাত্র জাস্টিফিকেশন। 

প্রসঙ্গত, বিরাট বিরাট কর্পোরেট স্কুলের ব্যবসা করে কিন্তু বিশাল মুনাফা করে। সরকারি স্কুলের নথিভুক্ত শিশুরা এখনো তাদের খরিদ্দার নয়। তবে খরিদ্দার যে তাদের বানাতে হবেই - তা নিয়ে ব্যবসাদারের মাথা দৃঢ়নিশ্চয়। কারণ সরকারি স্কুলের বাচ্চাদের সংখ্যা বিশাল। ফলে মুনাফাও অনেক।

কর্পোরেটদের ব্যবসার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল কর্পোরেট সোশাল রেসপন্সিবিলিটি (সিএসআর)। মুনাফা কামিয়ে না, কর ছাড় পেয়ে। এই সিএসআর-এর আওতাভুক্ত কাজকর্ম করে বিরাট কর ছাড় পাওয়া যায় - শিক্ষাক্ষেত্রও এই কাজকর্মের মধ্যে একটি এবং এদের কাজকর্মের দর্শন, মতাদর্শগত অবস্থান, কার্যপ্রক্রিয়া, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য - গোটাটাই নানা প্রকারে গভর্নেন্সের মিনিমাইজেশানকে সুনিশ্চিত করে, যাতে সেই সূত্রে কর্পোরেটদের ব্যবসায়িক আবাদ জমিকে সুবিধাজনক অবস্থায় রাখা যায়। এ কোনো তত্ত্ব চাবানোর ব্যাপার না - ব্যবহারিক ব্যাপার। 

আবারও উল্লেখ করছি - এ রাজ্যে আড়াই বছর ধরে স্কুল বন্ধ রাখার এ জাতীয় সিদ্ধান্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হল - 

স্কুল বন্ধ রেখে বিকল্প যদি কিছু বন্দোবস্ত হত, তাহলে অন্তত তা নিয়ে চর্চা, তার মানোন্নয়ন করা সম্ভব হত। 

কিন্তু এক্ষেত্রে স্কুল শিক্ষা ক্ষেত্রে এইরকম সিদ্ধান্ত নজিরবিহীন কারণ -

আড়াই বছর ধরে স্কুল বন্ধ রাখা হচ্ছে কেবল নয় - আড়াই বছর ধরে শিক্ষা প্রসঙ্গে কোনোরকম সরকারি বিকল্পের চর্চাই হচ্ছে না। গোটা সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাটাকে একটি "অনালোচ্য" বিষয়বস্তু বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। 

সরকারের মুখে শিক্ষা নিয়ে কার্যত তালা চাবি দিয়ে রাখা হয়েছে।

সিদ্ধান্তটি মামুলি বঞ্চনার নয়। অস্বাভাবিক। আনপ্রিসিডেন্টেড।

বৃহস্পতিবার, ২ জুন, ২০২২

কেকের মৃত্যু~ সুশোভন পাত্র

- আর ইউ নট এন্টারটেন্ড?
রোমান কলজিয়ামে গ্ল্যাডিয়েটর ফাইটে, সশস্ত্র যোদ্ধাদের খুন করে প্রশ্ন করেছিলেন, ট্র্যাজিক হিরো ম্যাক্সিমাস! হয়ত নজরুল মঞ্চের কনসার্ট শেষে গতকালও একই প্রশ্ন করেছিলেন কেকে! 'আর ইউ নট এন্টারটেন্ড?'  
সামাজিক মাধ্যমে ভাসছে হোয়াইট বোর্ডের ছবি। কেকের ২০টি হিট গানের লিস্ট! সম্ভবত লিস্টটা কালকের কনসার্টে কেকের গাওয়া গানের। মোটামুটি একটা সাদামাটা হিসেব, সবমিলিয়ে ১০০ মিনিটের গান। আড়াই থেকে পৌনে তিন ঘণ্টার কনসার্ট! কলকাতার ভ্যাপসা গরম, নজরুল মঞ্চের ক্যাপাসিটির তিন-চার গুণ বেশি ভিড়, বন্ধ এসি, মঞ্চ জুড়ে উদ্যোক্তাদের উদ্ধত দাপাদাপি, বাহারি আলোর তীব্র ঝলকানি, আর অত্যুৎসাহী মাতব্বরদের র‍্যাম্পে উঠে কমপ্রেসড কার্বন ডাই-অক্সাইডের ফায়ার এক্সটিংগুইশার স্প্রে! 
সবকিছু উপেক্ষা করেই কনসার্ট শেষ করেছিলেন কেকে! কেন? কেউ বলছে, প্রফেসেনালিসজম। কেউ বলছে মোটা টাকা। কেউ বলছে উদ্যোক্তাদের চাপ। হয়ত তাই! কিম্বা হয়ত সকালে একজন শিল্পী যেমনটা বলছিলেন তেমনটাই! এত গুলো মানুষের গানের তালে উদ্বেলিত হওয়া, সুর-লয়ের মূর্ছনায় সাইন কার্ভের মত দুলে ওঠা, উচ্ছ্বাসে পাগল হয়ে ফেটে পড়া, ভালোবাসা, মুহূর্তের আনন্দে সমস্ত কষ্ট ভুলে যাওয়া ঐ মায়াবী পরিবেশের মোহময়তা –যে কোন শিল্পীই তো থ্রাইভস ফর দিস!  
সামান্য একটা গুগল সার্চ আপনাকে বলে দেবে কেকের মত প্রথিতযশা একজন প্লে-ব্যাক সিঙ্গারের আড়াই থেকে পৌনে তিন ঘণ্টার কনসার্টের আনুমানিক চার্জ ২৫-৩০ লাখ! সঙ্গে নজরুল মঞ্চের বুকিং। আনুষঙ্গিক খরচা আর পুরো ট্রুপের লজিস্টিক মিলিয়ে, জাস্ট একটা সন্ধ্যার কনসার্টের খরচা প্রায় ৩৫-৪০ লাখ! কলকাতার বহু কলেজের মধ্যে এই গুরুদাস মহাবিদ্যালয়ের একটা ফেস্টের একটা কনসার্টে এই বিপুল খরচা! চোখে লাগে না আপনার? এত টাকা আসছে কোথা থেকে? কিভাবে, কোন নিয়মে খরচা হচ্ছে টাকা? কারা এই ফেস্টের স্পন্সরার? উত্তর কলকাতার গলিতে কান পাতলে যে নাম গুলো উঠে আসবে সেগুলো কোন ছাত্র সংসদের চুনোপুঁটিদের না বরং লাল বাতি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো রাঘব বোয়ালদের! 
বাঙলার কলেজে নির্বাচন হয়না বহুদিন। 'শিক্ষায় অনিলায়ন'র থিওরি নামানো কাগুজে বাঘরা খবরই পাননা যে প্রত্যেক কলেজে বকলমে ছাত্র সংসদের নামে লোকাল তৃণমূলে নেতার সিন্ডিকেট চলছে। নিন্দুকে বলে গুরুদাস মহাবিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নাকি প্রয়াত সাধন পাণ্ডের স্নেহধন্য! পেট্রোল-ডিজেলে সেস বেড়েছে, টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে, বাজার আরও অগ্নিমূল্য হয়েছে; তাই মা-মাটি-মানুষের দামাল ভাইরাও কন্যাশ্রীর বোন'দের আর যুবশ্রীর ভাই'দের জন্য ফি-বছরে কলেজে কলেজে অনার্সের 'রেটে' ইনক্রিমেন্ট দিচ্ছে। কোথাও ইংরেজি যাচ্ছে ৬৫হাজার! আবার কোথাও ইতিহাসে লাগছে ৩৫হাজার! 
মেধা-অধ্যবসায়-নিয়ম-নীতি এসব এখন ব্যাকডেটেড, কনটেম্পোরারি ফ্যাশনে টাকা দিলে ইউনিয়ন রুমেই মার্কশিট জমা হয়ে যাবে, পছন্দের অনার্সের রেট ঠিক হয়ে যাবে, ভর্তির জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের আনুষ্ঠানিকতা -ইউনিয়নের দাদারা নির্ঝঞ্ঝাটে সব করে দেবে। আর দাদা'দের সাথে 'হাই-হ্যালোর' সম্পর্ক থাকলে তো কেল্লা ফতে; মদের বোতলেই কেরিয়ার একদম 'সেট' হয়ে যাবে।
নির্বাচিত ছাত্র সংসদের অবর্তমানে তৃণমূলের 'গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল' ছাত্র সংসদের হাতে কলেজ কর্তৃপক্ষ ফি বছর ফেস্ট-ফ্রেশারের নামে কত টাকা তুলে দিচ্ছেন? ভর্তির সময়ে সাধারণ গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা তোলাই কি খরচা হচ্ছে এই মোচ্ছবে? সরকারের কাছে এই আয়-ব্যয়ের অডিট রিপোর্ট আছে? যে কলেজে কোন নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই তারা টাকা পাচ্ছে কোন আইনি ভিত্তিতে? পাস ছাড়া কালকে কেকের অনুষ্ঠানে তো কেউ ঢুকতে পারারই কথা না। তিনগুণ ভিড় হল কি করে? জাল পাস? দায় কার? কলেজের হোতাদের না 'গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল' তৃণমূল ছাত্র সংসদের? 
হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মত প্রজন্ম কে বিমোহিত করেছেন কেকে! সারাদিন ধরে সামাজিক মাধ্যমের দেওয়াল ভেসে যাচ্ছে আবেগে। এই মাপের একজন শিল্পীর মৃত্যুর সামাজিকরণ হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজনীতি কে বাদ দিয়ে তো এই সমাজ নয়, শিল্প কর্মও নয়। বরং সমাজের ও শিল্পের নিয়ন্ত্রক এই রাজনীতি!  আর তাই একজন শিল্পীর মৃত্যু তে বাঙলার এই রাজনীতির স্খলনটা বে-আব্রু হয়ে যাচ্ছে। 'সততা', 'রাজনৈতিক আদর্শ', 'মূল্যবোধ'–সব ক্লিশে হয়ে গিয়ে বাঙলার রাজনীতির পর্যবসিত হচ্ছে লাভ-লোকসানের অঙ্কে! পর্যবসিত হচ্ছে 'করে খাওয়ার' রসায়নে! খেলা হচ্ছে আগুন নিয়ে। খেলা হচ্ছে বাঙলার ভবিষ্যৎ নিয়ে। কেকে থেকে তুহিনা খাতুন, আনিস থেকে বিদ্যুৎ মণ্ডল -খেলা হচ্ছে মানুষের জীবন নিয়ে। 
বাঙলার শিল্পীদের বানানো হচ্ছে রাজনৈতিক বোড়ে! কেউ ভোটে দাঁড়াচ্ছেন, কেউ ২১শে জুলাইয়ের মঞ্চ আলো করছেন, কেউ কমিটি তে জায়গা পাচ্ছেন, কেউ তো সরাসরি তৃণমূলের পদাধিকারী সেজে যাচ্ছেন! সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, চার্লি চ্যাপলিন, জোন বায়েজ, বব ডিলানদের মত সত্যের প্রতি, সমাজের বহমান বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দায়বদ্ধতা, আপোষহীনতা তো দূরের কথা কোদাল কে কোদাল বলার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে বাঙলার শিল্পীদের কাছ থেকে! আর যারা আত্মসমর্পণ করছেন না? তাঁদের ভাতে মারার ফন্দি হচ্ছে ১৪ তলা থেকেই! তাই কেকের মৃত্যু ঘিরে সামাজিক আবেগের বাইরে গুরুতর রাজনৈতিক প্রশ্ন গুলো কে যত্ন করে ডজ করছেন বাঙালী শিল্পীরা!
রূপঙ্করের লাইভ, কলকাতার কালচার, বাঙালির চয়েস, জনগণের সচেতনতা -এই সব এন্টিটির ফিলজফির সাবজেক্টিভিজমে কেকের মৃত্যু কে আড়াল করে আদপে লাভ নেই! কেকের মৃত্যুকে ঘিরে প্রশ্নটা অবজেক্টিভ! প্রশ্নটা নিয়ন্ত্রক শক্তির কোয়ালিটির! প্রশ্নটা তৃণমূলের রাজনৈতিক সংস্কৃতির! 
বাঙালি দীর্ঘদিন এই রাজ্যে ছাত্র সংসদের নির্বাচন দেখেছে। নির্বাচিত ছাত্র সংসদের কলেজ পরিচালনা দেখেছে। ফেস্ট দেখেছে, ফ্রেশার দেখেছে, কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়াও দেখেছে। ছাত্র সংসদের আয় ব্যয়ের অডিট হয়েছে। হোপ ৮৬-এ বোম্বের তামাম সুপারস্টারদের অনুষ্ঠান দেখেছে। ইন্দিরা গান্ধীর উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর গলায় 'জয় ভারত/জয় বাংলাদেশের' শ্লোগানে এই তিলোত্তমা কল্লোলিত হয়েছে। ৯০'র শীতে দীর্ঘ ২৭ বছর কারাগারে কাটানোর পর ম্যান্ডেলার কলকাতা সফরে ইডেন গার্ডেনস মানবসমুদ্রের উষ্ণতা মেপেছে। দেশ বিদেশের বহু কীর্তিমানদের বাঙালি সমাদর করেছে। আপ্যায়ন করেছে। আপন করেছে। দশকের পর দশক বাঙালি বহু আবেগের সাক্ষী থেকেছে! 
এই আবেগটাই ফাইন লাইন পেরিয়ে বেলাল্লাপনা তে বদলে যায় যখন তৃণমূলের মত একটা লুম্পেন সর্বস্ব দল রাজনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তি হয়ে ওঠে! কেকের মৃত্যু আপামর দেশের কাছে যে প্রশ্নটা আবার একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেলো, শুধু গান স্যালুটের গর্জনে কি সেই প্রশ্ন ঢেকে রাখা যাবে মাননীয়া?