ভোটের বাজারে আমি কেমিস্ট্রি ছুঁড়ছি না মানে ভাববেন না, ভোটের নিজস্ব কোনো কেমিস্ট্রি নেই। অবশ্যই আছে এবং সেই রসায়ন বেশ রসসিক্ত।
আপনি যখন আপনার মহামূল্যবান ভোটটি কোনো প্রার্থীকে দান করতে বুথে ঢোকেন, তখন আপনার আঙুলের মাথায় কেউ একজন আলতো করে একটা তুলি বুলিয়ে দেয়। সেই জায়গাটায় কিছুক্ষণ পরে কালো দাগ হয়ে যায়। এই কালো দাগ থাকে যতক্ষণ না ওই জায়গার চামড়াটা খসে পড়ে ভেতর থেকে নতুন চামড়া গজায়। নখের ওপর অবশ্য দাগটা তার আগেই উঠে যায়। এই দাগটা কী? মহামূল্যবান রুপো। যা থেকে আমাদের কারেন্সির নাম রুপিয়া। যে তার রূপের জন্য বিখ্যাত।
ভোটকেন্দ্রের শিশিতে যে তুলি ডুবিয়ে আপনার আঙুলে লাগিয়ে দিয়েছে, তাতে যে বস্তুটা থাকে, তা এক 'গোপন' ফর্মুলা, যা তৈরি করে দিয়েছে ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা। সারা ভারতে মাত্র একটা কোম্পানি তা প্রস্তুত করে এবং যেখানে যত ইলেকশন হয় – লোকসভা, বিধানসভা, কর্পোরেশন, পঞ্চায়েত, এনিথিং – যেখানে আঙুলে এই ছাপ দেওয়া হয়, তার সমস্ত কালি সেখান থেকে যায়। তারাই একমাত্র জানে ওটাতে হুবহু কী আছে। তবে এটা জানা যে ওর মধ্যে আছে একটা বেগুনি রং আর সিলভার নাইট্রেট, বাকিটা জল আর কিঞ্চিৎ আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল। রং থাকে যাতে আঙুলে যে লাগানো হ'ল কিছু তা বোঝা যায়। সেটা জলে গোলা থাকে। অ্যালকোহল দেওয়া হয় জলটা তাড়াতাড়ি উবে যাওয়ার জন্য। তবে আসলি কেমিস্ট্রিটা হচ্ছে ওই সিলভার নাইট্রেটের। সূর্যের আলো পেলেই ওটা বিজারিত হয়ে তৈরি করে পাতলা সিলভারের 'ফিল্ম' যা চামড়ার সঙ্গে সেঁটে থাকে। প্রতি ১০০ মিলিলিটার দ্রবণে ১০ থেকে ১৮ গ্রাম সিলভার নাইট্রেট থাকে। বুথে ভোটারের সংখ্যার ওপর এই শিশির সাইজ নির্ভর করে। কোথাও খুদে ৫ এম এল, কোথাও ৭.৫, কোথাও ১০, ২০ বা ৫০ এম এল। একটা ৫ মিলিলিটার শিশির কালি থেকে তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো ভোটারের 'উঙ্গলি কালা' করা যায়।
যে কোম্পানিটা এই কালি তৈরি করে, সেটা আমাদের ব্যাঙ্গালোরের প্রতিবেশী শহর মহীশূরে অবস্থিত, তার নাম মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড বার্নিশ লিমিটেড। আগে এর নাম ছিল মাইসোর ল্যাক অ্যান্ড পেন্টস। রং ও লাক্ষা তৈরির জন্য ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহীশূরের রাজা চতুর্থ ওয়াড়িয়ার, যিনি তার আগে ব্যাঙ্গালোরে জমি দান করেছিলেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিট্যুট অভ সায়েন্স প্রতিষ্ঠার জন্যও। দশ বছর পরে দেশ স্বাধীন হলে এটি একটি পাব্লিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়। এখন এই কোম্পানি কর্ণাটক রাজ্য সরকারের অধীনে পরিচালিত। প্রথম যে লোকসভা নির্বাচন হয়েছিল, তখন থেকেই আঙুলে কালি লাগানোর ব্যবস্থা চালু হয় এবং সেই কাজের জন্য সারা দেশের ভোটারদের আঙুলে লাগানোর কালি সরবরাহের দায়িত্ব পড়ে এই কোম্পানির ঘাড়ে। প্রথম সাধারণ নির্বাচনে প্রায় চার লক্ষ শিশি অর্ডার হয়েছিল, তার দাম ছিল সওয়া দু' লক্ষ টাকার কিছু বেশি। সেদিন থেকে আজ অবধি তারা এই গুরুদায়িত্ব পালন করে চলেছে।
এবারের ৭ দফা লোকসভা নির্বাচনের জন্য এই কোম্পানিতে ইলেকশন কমিশন থেকে অর্ডার গেছে ২৬ লক্ষ ৫৫ হাজার শিশি কালি সরবরাহের, যার মোট দাম ৫৫ কোটি টাকা। সোনারুপোর দাম বাড়ছে মানে সিলভার নাইট্রেটের দাম বাড়ছে, ফলে ভোটের কালির দামও বাড়ছে। একটা ১০ এম এল শিশির দাম এখন ১৭৬ টাকা। আপনি আপনার মহামূল্যবান ভোট দিয়ে এলেন, আপনার হাতে যে কালি লাগানো হ'ল তার দাম প্রায় আটানা! কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মহম্মদ ইরফান জানিয়েছেন, এ বারের অর্ডারটাই সবচেয়ে বড় অর্ডার। স্বাভাবিক। মা ষষ্ঠীর কৃপা কম নয় আমাদের দেশের ওপর।
১৪০ কোটি জনগণের দেশে ৯৭ কোটির ওপর ভোটার, তাদের হাতের আঙুলে কালি লাগানো হয় কেবলমাত্র ইলেকশন কমিশন পরিচালিত ভোটের সময়। আইনবলে এর আর অন্য কোনো ব্যবহার নেই, একমাত্র ব্যতিক্রম হয়েছিল আপৎকালীন কোভিডের টিকা দেওয়ার বেলায়।
ভাবছেন, এর আর তেমন গুরুত্ব কী! এ তো যে-কেউ করতে পারে। আজ্ঞে না। ২৫টারও বেশি দেশ থেকে অর্ডার পায় মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড বার্নিশ লিমিটেড সেই দেশে ভোটের সময় এই কালি ব্যবহারের জন্য। ক্যানাডা, ঘানা, নাইজেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নেপাল, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, কাম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশগুলো তাদের নির্বাচনের কালির জন্য এই ক্ষুদ্র কোম্পানির সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল।