শুক্রবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

দুর্গা ও মনুস্মৃতি ইরানি ~ অবিন দত্তগুপ্ত

গতকাল মনুস্মৃতি ইরানির রাজ্যসভার বক্তব্যের একটি অংশ নিয়ে , আমার হাল্কা কিছু অশিক্ষিত সি পি এম সুলভ বক্তব্য আছে । আগে কোট-টা করি ,

"What is Mahishasur Martyrdom Day, madam speaker? Our government has been accused. I miss today Sugata Bose and Saugata Roy in the House - champions of free speech, because I want to know if they will discuss this particular topic which I am about to enunciate in the House, on the streets of Kolkata. I dare them this.
Posted on October 4, 2014. A statement by the SC, ST and minority students of JNU. And what do they condemn? May my God forgive me for reading this.
"Durga Puja is the most controversial racial festival, where a fair-skinned beautiful goddess Durga is depicted brutally killing a dark-skinned native called Mahishasur. Mahishasur, a brave self-respecting leader, tricked into marriage by Aryans. They hired a sex worker called Durga, who enticed Mahishasur into marriage and killed him after nine nights of honeymooning during sleep."
Freedom of speech, ladies and gentleman. Who wants to have this discussion on the streets of Kolkata? "

আচ্ছা প্রথম লাইনে উনি জিজ্ঞেস করেছেন , মহিষাসুর শহীদ দিবস আবার কি ? এবং শেষ লাইনে বলেছেন , এমন কথা কোলকাতার রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলতে পারবেন ?? জোট সঙ্গি সুগত আর সৌগত বাবুর উপর একটু রুষ্ট হয়েছেন , সে হতেই পারেন , ওদের নিজস্ব ব্যপার । এবার ভারতবর্ষের একজন মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী , যদি নিজের দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় প্র্যাকটিসের ব্যপারে সম্পূর্ণ মূর্খ হন , তো দায় কার ? ভারতবর্ষের বিভিন্ন আদিবাসী- মূল নিবাসি জনগোষ্ঠী দুর্গা পুজার সময় মহিষাসুর উপাসনা করেন । তারা মনে করেন , ফর্সা চেহারার দুর্গা আসলে আর্য আক্রমণকারীর রূপক এবং মহিষাসুর ভারতের মুলনিবাসী অনার্য গোষ্ঠীর রাজা , যোদ্ধা । উনি টাইমস নাওএর ছাগল অর্ণব গোস্বামীর উপর এতো ভরসা রাখেন , চ্যানেলে ফোন করে ক্রন্দনরত জেনারেলকে সান্ত্বনা দেন , অথচ টাইমস গ্রুপের কাগজ পরেন না । এই খবর , এর আগে টাইমস অফ ইন্ডিয়াতেই বেরিয়েছে । লিঙ্ক ঃ ( http://timesofindia.indiatimes.com/…/articlesh…/23927688.cms ) । এবং হ্যা কোলকাতা গুজরাট নয় , কোলকাতার মানুষ অসহিষ্ণু নয় । কোলকাতা, ডায়েলেক্টিক বা ডিবেটে ভরসা রাখে । কলকাতায় , আপনি যা ইচ্ছে নিয়ে আলোচনা করতে পারেন , নইলে আপনাদের হনুমান ভাইয়েরা প্রকাশ্যে ঘর বাপসি নিয়ে আলোচনা করে ৮বি থেকে অক্ষত ফিরতে পারত না ।

এবার একটু ডাইগ্রেস করব । মেঘনাদ বধ কাব্য পড়েছেন মনু বাদী ইরানি ? মেঘনাদ কে ? অনার্য রাক্ষসদের সেরা যোদ্ধা , ট্র্যাজিক হিরো । রাক্ষস কারা ? যারা বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে থাকত । আপনার দেশের মূল নিবাসী , পৌরাণিক ভারতবর্ষের আসল বাসিন্দা । তাদের গায়ের রঙ কালো , নাক চোখ থ্যাবড়া । আর্যরা দারুণ দেখতে , চোখা নাক , ফর্সা । কিন্তু আদি ভারতবর্ষে তারা আগ্রাসনকারি । আর আদিবাসীদের তাদের চেহারার কারণে ডেমোনাইজ করার লক্ষেই , তারা রাক্ষস । ঠিক যেমন ডেমোনাইজ আপনারা করে থাকেন । মুসলমান মানেই সন্ত্রাসবাদী , বামপন্থী মানেই দেশদ্রোহী , লম্বা দাড়ি -বুরখা মানেই সন্ত্রাসের মদতদাতা , দলিত মাত্রেই নোংরা-অচ্ছুত । এই আর্যদের বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধে , নিজের বাসস্থান রক্ষার আদিম ভারতের জনগোষ্ঠীর লড়াইয়ের নেতা ছিলেন এই রাবন , মেঘনাদ বা মহিষাসুর । তারা জানতেন , তাদের হেরে যাওয়া মানে তাদের ইতিহাসের বিকৃতি , তাদের গানের বিকৃতি , তাদের সংস্কৃতির বিকৃতি, তাদের ভাষার বিকৃতি । রাবণদের মতোই কালো আফ্রিকার এক সাহিত্যিক বহু বছর পরে , এই কারণেই বলেছিলেন " Until The Lions have their Own Historian , the history of the hunt will always Glorify the Hunter . " যতদিন না সিংহের নিজের ঐতিহাসিক জন্ম নিচ্ছে , ততদিন ইতিহাস শিকারির ছল-চাতুরিকেই গৌরবান্বিত করবে । সিংহের লড়াই কেউ জানতে পারবে না । মাইকেল মধুসূদন ছিলেন সিংহের ঐতিহাসিক । তিনি সিংহের দুর্দমনীয় লড়াই এবং কপটতার কাছে হার স্বীকারের গল্প নথিভুক্ত করে গেছেন । আপনি মধু কবি পড়েন নি , স্মৃতি ইরানি । বাংলার বাচ্চারা ৯-১০ ক্লাসে পরার সময় থেকেই পড়েছে । তাদের মনন আপনার মতো হিন্দুত্ববাদীর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় ।

তা রাবন হেরে যাওয়ার পর কি হল ? বা মহিষাসুর বধের পর কি হল ? ইতিহাস রাবণদের খারাপ এবং আগ্রাসনকারিদের ভালো বানিয়ে দিল । কারণ ইতিহাস লিখলেন বিজয়ীদলের স্তাবক ঐতিহাসিকরা । রাবণদের গোষ্ঠীর , ভারতের মুল নিবাসী মানুষের সংস্কৃতি , তাদের গান , তাদের ভাষা , তাদের বসবাসের অধিকার সব হারিয়ে যেতে লাগল , হু হু করে । ভারতবর্ষের এক ভগ্নাংশ মানুষের বলা হিন্দী ভাষাকে , তাদের মাতৃভাষার উপর চাপিয়ে দেওয়া হল । তারা সরে গেলেন , লোক চক্ষুর অন্তরালে । এমনকি আমাদের বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও , আমি যে ভাষা লিখছি ,সে ভাষাও অনেক আংশেই অন্য ডায়ালেক্টকে একরকম একঘরে করে রেখেছে ।

সে যাই হোক , এক বন্ধু জিজ্ঞেস করেছেন , জে এন ইউ তে এই কর্মসুচীতে বামন্থীরাও অংশগ্রহণ করেছিল কি ? এবং আমরা বাম্পন্থীরা এই বক্তব্য সমর্থন করি কি না ? তার উত্তরে এবং স্মৃতি ইরানির "Freedom of speech, ladies and gentleman. Who wants to have this discussion on the streets of Kolkata? " উত্তরে এটুকুই বলার , দুর্গা পূজা বা অসুর পুজা কোনটাকেই বিরোধিতা বা সমর্থন করে না বামপন্থীরা । তবে হ্যা , বিজয়ীর উৎসব যদি বিজিতের রিচুয়ালকে বেয়াইনি ঘোষিত করতে চায় ,সেক্ষেত্রে বাম্পন্থীরা বিজিতের পাশেই দাঁড়াবে । তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার , নিজেকে প্রকাশ করার অধিকার , তার দুঃখের গানের অধিকারকেই রক্ষা করবে ।

এমনটা নয় , যে মূলনিবাসী মানুষ আমাদের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে আছেন । সব হারালেও , লড়াইটা হারান নি । জঙ্গলের অধিকারের জন্য , কখনো বিদেশী শক্তির থেকে কখনো উঁচু জাতের নিষ্পেষণের থেকে আজদির জন্য তারা বার বার যুদ্ধ করেছেন , হেরে গেছেন, আবার যুদ্ধ করেছেন । লড়াই করেছেন বিরসা মুন্ডা , লড়াই করেছেন সিধু-কানহু ,লড়াই করেছেন রোহিত ভেমুলা । পাওনা এটাই ,এখন মূলনিবাসীদের পাশে বামপন্থীরাও লড়াই করছে । ভেমুলার পাশে লড়ছেন ,কানহাইয়া । এবারের ইতিহাসটা আপনারা লিখবেন না মনু স্মৃতি ইরানি । আমাদের-ও ইরফান হাবিবরা আছেন ।

জয় ভীম ।
ইনকিলাব জিন্দাবাদ ।

বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

দূর্গা পুজো ~ পূরন্দর ভাট

মাননীয়া মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি কাল পার্লামেন্টে ভাষণ দিয়েছেন তার বিরুদ্ধে ওঠা নানান অভিযোগকে নস্যাৎ করতে। ভাষণে অনেক অসত্য কথাই তিনি বলেছেন এবং নাটুকেপনার মধ্যে দিয়ে অনেক কিছুই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সেইসব বাদ দিয়েও ওনার ভাষণের একটা অত্যন্ত সমস্যাজনক দিক রয়েছে। স্মৃতি ইরানি জেএনইউর ছাত্র ছাত্রীদের অপরাধমূলক কাজকর্মের তালিকা দেওয়ার সময় দূর্গা পুজোতে বিলি হওয়া একটি রাজনৈতিক প্যামফ্লেটের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন যে সেই প্যামফ্লেট দেবী দুর্গার হাতে মহিষাসুর বধকে আর্য্যদের হাতে অনার্য্যদের দমন করবার প্রতিকী রূপ বলে বর্ণনা করা হয়েছিলো। তাতে মহিষাসুরকে মহান এবং দেবী দুর্গাকে এক ছলনাময়ী নারী বলা হয়েছে যে ছল চাতুরীর ব্যবহার করে মহিষাসুরকে বধ করেছে। স্মৃতি ইরানি বলেছেন যে এরকম প্যামফ্লেট লেখা বাকস্বাধীনতার চূড়ান্ত অপব্যবহার এবং অপরাধমূলক কাজের মধ্যেই এগুলো পড়ে। তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি-দের চ্যালেঞ্জ করেছেন সংসদে দাঁড়িয়ে যে তারা এইরকম প্যামফ্লেট কলকাতার রাস্তায় বরদাস্ত করতেন কিনা। (লিংক: http://goo.gl/RYOmGx)

যে প্যামফ্লেট নিয়ে এতো আলোচনা সেই প্যামফ্লেটটি আসলে সাঁওতালদের "হুদুর দূর্গা" উত্সব নিয়ে ছিলো। সাঁওতালদের কিছু উপজাতি বহু বহু যুগ ধরে "হুদুর দূর্গা" উত্সব পালন করে আসেন যে উত্সবে তাঁরা সাঁওতাল রাজা মহিষাসুরকে স্মরণ করে। তাদের মধ্যে যে কিংবদন্তি প্রচলিত তা হলো মহিষাসুর ছিলেন এক সাঁওতাল রাজা যাকে দূর্গা নামের এক বেশ্যা ছলে বলে ভুলিয়ে বিষ খাইয়ে খুন করে। তাঁরা ওই জন্যে দূর্গা পুজোতে আনন্দ না করে শোকের দিবস হিসেবে পালন করেন। এই নিয়ে এখন কিছু ইতিহাসবিদ গবেষণা শুরু করেছেন এবং ইংরেজি মাধ্যমের সংবাদপত্রতেও এই উত্সবের কথা প্রকাশিত হয়েছে গত বছর। (লিংক: http://goo.gl/rhkdcN)

স্মৃতি ইরানি হয়তো "হুদুর দূর্গা" উত্সব সম্পর্কে জানেন না। নাই জানতে পারেন, কলকাতার উচ্চবর্ণ বাঙালিরাও জানে না। কিন্তু পার্লামেন্টে এই উত্সবকে "অপরাধ" বলে দাগিয়ে দেওয়ার আগে কি একবার খোঁজ নেওয়া উচিত ছিলো না? না কি খোঁজ নিয়েও এই কথা বলেছেন? আসলে এতে সংঘ পরিবারের মানসিকতাই প্রকাশ পায়। তারা যাকে ভারতীয় সংস্কৃতি বলে আখ্যা দেয় তাতে প্রান্তিক মানুষের সংস্কৃতির কোনো জায়গা নেই, তাদের নিয়ে ভাবনাচিন্তা করবার কোনো অবকাশ নেই। কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোরের মতো শহরের উচ্চবর্ণকেন্দ্রিক সংস্কৃতিকেই তারা ভারতীয় সংস্কৃতি বলে মনে করে, সেখানে বহুত্ববাদ নেই। জেএনইউতে বেশ ধুম ধাম করেই কালী পুজো, সরস্বতী পুজো বা দূর্গা পুজো উদযাপিত হয় প্রতি বছর, যাতে হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রী, কর্মচারী এবং অধ্যাপকরা অংশগ্রহন করেন। তার মধ্যে যদি কোথাও প্রান্তিক মানুষের আওয়াজ উঠে আসে তাকে "অপরাধ" এবং "বাকস্বাধীনতার অপব্যবহার" বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে? এমনিতেই তো ভারতের অর্থনৈতিক প্রগতি অথবা উচ্চশিক্ষা থেকে আদিবাসী এবং দলিতদের ব্রাত্যই করে রাখা হয়েছে। "শাইনিং ইন্ডিয়া"-র ঝলমলে আলোর চারপাশে যে ঘোর অন্ধকার তার মধ্যে যারা রয়েছেন তাদেরকে আমরা আলোর ঝলকানির চোটে দেখতেই পাই না অধিকাংশ সময়। সেই অন্ধকার থেকে যদি কোনো এক টুকরো আওয়াজ, ফাঁক গলে দেশের উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রে ঢুকে পড়ে তাকে "অপরাধ" বলে দেবেন সংসদে দাঁড়িয়ে? এই হলো সংঘ পরিবার কল্পিত ভারতবর্ষ। যে ভারতবর্ষ নির্মাণে সাঁওতালরা প্রাণপাত করেছেন বিদ্রোহ করে সেই ভারতবর্ষে তাদের সংস্কৃতিটুকুরও জায়গা নেই। বীরসা মুন্ডা যখন শহীদ হচ্ছিলেন তখন স্মৃতি ইরানির পূর্বপুরুষরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মন্ত্রী হতে আর মুচলেকা লিখতে ব্যস্ত ছিলো। আজকে তারাই পার্লামেন্টের মধ্যে দাঁড়িয়ে কত সহজে বলে দিচ্ছেন যে হুদুর দূর্গা উত্সবের কথা বলাও অপরাধ।

আপনাকে ধন্যবাদ স্মৃতি দেবী, একটা গোটা উপজাতির সংস্কৃতিকে সংসদে দাঁড়িয়ে অপমান করে "মনুস্মৃতি" ইরানি নামের সার্থকতা প্রমাণ করলেন।

সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

সেবার শীতকালে - সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

আমার আবার বরাবরের গরম গরম বাতিক ছিল একটু গরম হলেই ছাওয়া চাই, হাওয়া চাই। হাঁসফাঁস অবস্থা। কিন্তু কি জানি কেন, বয়স বাড়ছে বলেই বোধহয়, আজকাল আর তেমন গরম করেনা। বরং শীতের কাঁপুনি প্রতি বছর একটু একটু করে বেড়ে যাচ্ছে। আগে যেখানে হাতকাটা সোয়েটার পরতুম, এখন সেখান টুপি আর জ্যাকেট চাপাই। সারা রাত গায়ে কম্বল নিয়ে ঘুমোতে পারি, যেটা আগে পারতুম না এবার শীত অবিশ্যি কমসমের ওপর দিয়েই গেল। কদিন হলো “বসন্ত এসে গেছে” বলে ফোনে অনেক মেসেজ আর ছবিও পেয়ে চলেছি। তবে আমাদের এখানের শীত আর কতটুকু? যেতে হয় দার্জিলিং কি সিমলা। শীত বলে শীত? বাপরে! হাড়ের ভেতর মজ্জা পর্যন্ত জমিয়ে দেয়। আমার বাঙালি ধাতে এর চেয়ে বেশী ঠান্ডা কল্পনা করা অসম্ভব। তাই ভাবি, যেখানে শূন্যের নিচে ৩৫-৪০ ডিগ্রি নেমে যায় থার্মোমিটারের পারা, সেখানে কেমন পারা অনুভুতি হয়!

শনিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

হিরক রাজার দেশ ~ শাক্যজিৎ

​সত্যজিৎ রায় মারা যাবার পর পশ্চিমবংগ সরকার থেকে ওনার ওপর একটা বিশেষ সংখ্যা করা হয়েছিল। সেখানে একটা লেখায় উৎপল দত্ত একটা ইন্টারেস্টিং গল্প শুনিয়েছিলেন। যখন হীরক রাজার দেশে শুটিং হচ্ছে, উৎপল দত্ত-র প্রথম দিনের শুটিং-এ কয়েকটা ডায়ালগ থ্রো করার পর মাণিকবাবু ওনার কানে কানে বললেন "উচ্চারণে একটু গ্রাম্যতা আর অশিক্ষার ছাপ আনো। 'করেছিল' না বলে বলো 'কইরেছিল'"।

উৎপল জিজ্ঞাসু চোখে তাঁর দিকে তাকাতে দীর্ঘদেহী মানুষটি একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন "আসলে এই জোতদার ধরণের লোক বেশ ক্রুড আর অশিক্ষিত হয়। নাহলে অন্য লোকেদের অপ্রেস করবার চিন্তা এদের মাথায় আসত না। তাই এই ধরণের লোককে ডিমীন করে দাও। যাতে ভয় পাবার বদলে লোকে তোমায় দেখে হাসাহাসি করে"।

উৎপল তারপর লিখছেন "আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। মনে পড়ছিল চেয়ারম্যান মাও-এর কাগুজে বাঘের তত্ব। শত্রুকে সবসময় হাস্যকর করে খড়ের সৈনিকের স্ট্যান্ডার্ডে নামিয়ে আনতে হবে। এই তত্বের এরকম প্রয়োগ যে হতে পারে আমি ভাবতে পারিনি এর আগে"।

এই মুহূর্তে ভারতে যে ব্যাটল অফ আইডিয়াজ চলছে সেখানে কাগুজে বাঘেদের লাফালাফি দেখে হীরক রাজের কথাই মনে পড়ছিল। এই ব্যাটলের একদিকে মেধাবী ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবিরা। অন্যদিকে রাইটিস্টরা যাদের উপন্যাস পড়ার দৌড় চেতন ভগত এবং বিজ্ঞানচর্চার দৌড় গণেশের শুঁড়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কারীকুরী আবিষ্কারেই জিভ বার করে হ্যা হ্যা হাঁপাতে থাকে। একদিকে চমস্কি, পামুক, প্রভাত পটনায়েকরা, অন্যদিকে সাদ্ধ্বী ঋতাম্ভরা, বাবা রামদেব এবং যোগী আদিত্যনাথেরা। এরকম অ্যাবসার্ড ব্যাটল অফ আইডিয়াজ যখন স্ট্রিট ফাইটিং-এর পর্যায়ে নেমে আসে এবং উজ্জ্বল ছেলেমেয়েরা ব্যারিকেড রক্ষার্থে ছুটে যায়, সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে কাগুজে বাঘেদের রিঅ্যাকশন দেখার মত হয়। 'আমার ট্যাক্সের টাকায় কেন ইউনিভার্সিটিতে দেশদ্রোহী স্লোগান দেওয়া হবে', 'জেএনইউ তে পর্ন ফিল্ম তোলা হয়', 'কোনো আইআইটি ছাত্র কেন আর্মীতে যোগদান করে না', 'ইউনিভার্সিটির ছেলেরা মহিষাসুরের পুজো করে তাই তাদের বিরুদ্ধে সিডিশন অ্যাক্ট আনা উচিত' এরকম অসংখ্য পেটফাটা কমেডির ডায়লগ বেরিয়ে আসতে থাকে। অশিক্ষিত, ক্রুড এবং অসংস্কৃত রাইটিস্টদের হাতে দেশের সরকার থাকলে ভয়ের পাশাপাশি এরকম হাসির জিনিসপত্র-ও আসার সম্ভাবনা আছে আজ বুঝছি। দেশপ্রেমকে ইন্সটিটিউশনালাইজ করতে গেলে যে মিনিমাম শিক্ষা এবং রুচি লাগে সেটা এদের নেই। তাই দেশজোড়া ইন্টেলিজেনশিয়ার ডিসকোর্সে এদের অবস্থান গ্রাম্য ভাঁড় হয়েই থেকে গেল।

আজকের এই ২০১৬ সালে দেশজুড়ে যে হীরক রাজার সিনেমা অভিনীত হচ্ছে, সেখানে উৎপল দত্তদের তাই আর আলাদা করে নিজ-অভিনীত চরিত্রকে ভাঁড় সাজাতে হয় না। হীরক রাজ বাস্তব জীবনে যা যা বলছেন হুবহু সেইগুলো রিপীট করে গেলেই দর্শকদের পেটে খিল ধরে যায়।

বৃহস্পতিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

যাদবপুরে দ্রৌপদী ~ অনির্বাণ মাইতি

অতঃপর দ্রৌপদী একশো লেঠেল লইয়া ভ্যানিটি ভ্যানে চড়িয়া যাদবপুর আক্রমণ করিয়া বসিলেন। পথিমধ্যে নগরকোটাল পথ আটকাইয়া কহিল ভদ্রে এ বড় অবিবেচকের কার্য হইবে। যাদবকুল নেশাড়ু ও আক্রমণাত্মক তাহাদিগের সহিত যুদ্ধে আপনি কেন?  সেনাপতি তপনভানু কই? দ্রৌপদী হুঙ্কার  দিলেন কাহারেও লাগিবে না যাদবকুলের রক্ত দিয়া কেশবিন্যাস করিব। নগরকোটাল তবু রাজি নন  দেখিয়া দ্রৌপদী পথ অবরোধ করিয়া  বসিলেন। শকটযাত্রীরা শকট হইতে দ্রৌপদীকে ফ্রেমে রাখিয়া  সেলফি তুলিতে  উদ্যত হইলেন। বেগতিক দেখিয়া নগরকোটাল  দ্রৌপদীকে বলিলেন যাদবকুল অশালীন বিদ্রোহী ওখানে আপনি আক্রান্ত হইলে কে আপনার সম্ভ্রম  রক্ষা করিবে ?  কানহাইয়া তো কারাগারে। দ্রৌপদীর সম্বিত ফিরিল কানহাকে কে কারারুদ্ধ করিয়াছে?  নগরকোটাল  উত্তর করিলেন আপনি তো কানহাইয়ার মিত্রোদের ই আক্রমণ করিয়াছেন। যাদবকুল যে কানহাইয়ার  কুল। উহারা কানহাইয়ার  মুক্তির  দাবী করিয়াছে। অতঃপর  দ্রৌপদী হা কানহাইয়া  বলিয়া মূর্ছা  গেলেন । আকাশে বাতাসে ধ্বনিত  হইল তার চীৎকার। কখন যে কানহাইয়ার মুক্তির স্লোগান আর দ্রৌপদীর কান্না মিলিয়া গেল তা তিনি নিজেও বুঝিলেন না।

***ইহা মহাভারতে লিখিত নাই। যদি কখনো মহাভারতবিদ্বেষ বলিয়া  কোন মহাকাব্য লিখা হয় সেখানে থাকিবে।

মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

জে এন ইউ ~ পরিচয় পাত্র

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ রতন টাটার পরেই এক বিশেষ টুইট ঘোষণায় জেএনইউয়ের ছাত্রদের নিয়োগ করতে অস্বীকার করেন অ্যাপল আবিষ্কর্তা স্টিভ জোবস। জোবসের এই ঘোষণার পরে সাংবাদিক সম্মেলন করে তাঁকে বিরাট হিন্দু বলে দাবী করেন আদিত্যনাথ এবং (বিজয়)বর্গী। এইসময় জোবসের বায়োলজিক্যাল পিতা মধ্যপ্রাচ্যের লোক এই তথ্য উপস্থিত সাংবাদিকরা জানানোয় বর্গীরা উদাসীন হয়ে পড়েন। এরপর তাঁদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটিতে যত্রতত্র ফ্রি সেক্সের কুফল সম্পর্কে আলোচনা করতে দেখা যায়।

মার্ক জুকারবার্গ ঘোষণা করেন দেশভক্তিহীনদের ফেসবুক প্রোফাইল গায়েব করে দেওয়া হবে। পরীক্ষামূলকভাবে শুরুতেই উমর খালেদ এবং ধ্রুপদী ঘোষের প্রোফাইল গায়েব করা হয়েছে বলে তিনি জানান। তাঁর এই উষ্মার কারণ ফ্রী বেসিকসের ট্রাইতে পরাজিত হওয়া কিনা তা জানতে চাইলে জুকারবার্গ হাত তুলে বলেন, "থাক, আর গভীরে যাওয়ার দরকার নেই"। 

মানবসম্পদোন্নয়নমন্ত্রী একটি প্রেস রিলিজে জানিয়েছেন আলোচ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের পাঠ্য তালিকায় 'তারাপীঠের বামাবতার' এবং সাহিত্য বিভাগে দেশের প্রথম এবং একমাত্র সচিত্র ইন্দ্রজাল কমিক্স 'বাল নরেন্দ্র' বইদুটি যোগ করা হবে।

ওয়েটলিস্টেড মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী থেকে আরএসি (রিজার্ভেশন এগেনস্ট ক্যানসেলেশন) মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী পদে প্রোমোশনপ্রাপ্ত মধু কিশওয়ার তাঁর আকস্মিক পদোন্নতির জন্য বর্তমান মন্ত্রীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন। বর্তমান মন্ত্রী তাঁর পদের উপযুক্ত কিনা জানতে চাওয়া হলে দৃশ্যত উত্তেজিত মধু বলেন "কালে কালে কত হল কাল কাল রাতি/মোগল পাঠান হদ্দ হল ফার্সি পড়ে তাঁতি"।

আবিশ্ব বিভিন্ন নেতা দিল্লির সংগ্রামী উকিল, পুলিশ এবং এবিভিপিকে অভিনন্দন জানান। এক তারবার্তায় ডোনাল্ড ট্রাম্প এদের চলমান আন্দোলনকে সমর্থন জানান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ আইভি লীগ ইউনিভার্সিটি উকিল-পুলিশের বিরুদ্ধে গিয়ে জেএনইউকে সমর্থন করেছে জানায় উত্তেজিত ট্রাম্প বলেন তিনি ক্ষমতায় এসে কলাম্বিয়া, শিকাগো সহ এইসব ইউনিভার্সিটি বন্ধ করে দেবেন। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে (বিজয়)বর্গী বলেন ইউনিভার্সিটি ভাল নহে, সেখানে সকলে সেক্স করে, ইউনিভার্সিটি না থাকিলে জোবস এবং তাহার আপেল কেহই থাকিত না।

অ্যান্টার্কটিকা সফররত প্রধানমন্ত্রী স্বল্পকালীন ভারত সফরে এলে ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে সাংবাদিকরা তাঁকে ছেঁকে ধরলেও তিনি তাঁর পূর্বসূরির মত মৌনব্রত অবলম্বন করেন। তাঁর সঙ্গে দফায় দফায় অন্য মন্ত্রীদের বৈঠক হয়। পরে এক প্রকাশ্য জনসভায় প্রধানমন্ত্রী জানান জরুরি অবস্থার স্মৃতিবিজড়িত ইন্দিরা গান্ধী এয়ারপোর্ট থাকুক এটা তিনি চান না। যেহেতু জরুরি অবস্থার আরেক স্মৃতি বাজপেয়ীজির স্মৃতি লোপ পেয়েছে তাই এয়ারপোর্টের নাম বদলালেই জরুরি অবস্থা স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন ২০১৯ এর নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় ফিরলেই ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের নাম বদলে দেওয়া হবে।

২০১৯ এ তাঁরা ক্ষমতায় ফিরবেন কিনা এই প্রশ্ন তোলায় প্রধানমন্ত্রী কিছুক্ষণ নীরব থাকেন। এইসময় দৃশ্যতই ঘর্মাক্ত প্রধানমন্ত্রীকে গলায় জড়ানো জাতীয় পতাকায় ঘাম মুছতে দেখা যায়। এরপর তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তাঁর হয়ে প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য ইশারা করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং আবেগঘন কণ্ঠে 'একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি' গানটি পরিবেশন করেন। 

যোগগুরু রামদেব জানিয়েছেন সমকামিতার মতই সোশ্যাল সায়েন্স এবং সামগ্রিকভাবে ইউনিভার্সিটি একটি রোগ। এই রোগের উপশম কিভাবে হতে পারে জানতে চাওয়া হলে তিনি সর্বসমক্ষে তাঁর বিখ্যাত গেরুয়া লুঙ্গিটি পরে শীর্ষাসন করেন।

শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

পেট্রোল - সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকা বড় বড় পাথরের টুকরোর আড়ালে দু চার জন করে সৈনিক বসে আছে চারিদিকে চোখ ধাঁধানো সাদা। বরফের পুরু আস্তরন সব কিছুর ওপর। এই ধপধপে সাদার ওপর সূর্‍্যের রোদ পড়লে সেদিকে খালি চোখে তাকানো মুশকিল। তাই সব ফৌজির মুখেই, কপাল থেকে গাল পর্যন্ত বিশাল বড় আর  মোটা কালো চশমায় ঢাকা। একে সকলেই সাদা হাই অল্টিচিউড ফৌজি উর্দী পরে আছে। মাইনাস চল্লিস কি পঞ্চাশ ডিগ্রিতে দাড়ি গোঁফ কামানোর প্রশ্নও ওঠেনা। তার ওপর মুখের আধখানা ঢাকা বিশেষ ভাবে তৈরি রোদ চশমায়। কাজেই সকলকেই কেমন এক রকম দেখতে লাগছে। তবুও ফৌজিরা নিজেদের চিনে নেয় কোনো ভাবে। ওই যে লোকটা একবালতি বরফ নিয়ে অল্প লেংচে লেংচে আসছে গরম করে খাবার জল তৈরি করবে বলে, ও হলো হাবিলদার রামদত। অনেক উঁচু থেকে দড়িতে ঝুলতে ঝুলতে পড়ে গিয়েছিল। সে আঘাত এখনো সারেনি হয়ত। তাই চলার সময় খুব ভাল করে নজর করলে ওকে হালকা ল্যাংচাতে দেখা যায়। সামনে প্যাকিং বাক্সর ওপর বসে থাকা লেফটেন্যান্ট চেঁচিয়ে রামদতকে চা চাপাতে বললেন। ইনিই বোধহয় এ চৌকির কম্যান্ডার। এ জায়গাটা বোধহয় পাকিস্তানি ফৌজের সরাসরি গুলির পাল্লার বাইরে। কারন এখানে লোকজন বাংকার বা পরিখার মধ্যে ঢুকে বসে নেই। বরং বেশ নিরাপদেই ঘুরছে। লেফটেন্যান্টের উর্দীতে নামের ট্যাগটা পড়া যাচ্ছে। রাজীব পান্ডে। আইডি আর ট্যাগ খুঁটিয়ে দেখে লেফটেন্যান্ট তাকালেন সামনের দিকে -

শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

মনে পড়ে? ~ সুশোভন পাত্র

ডিয়ার ম্যাডাম, অজিত লোহার কে মনে পড়ে? পড়ন্ত বিকেলে, লোডশেডিং'র অন্ধকারে, অজ গাঁয়ের হাসপাতালে যখন আনা হয়েছিল নিথর দেহটা, তখনও অবশ্য আপনি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথই গ্রহণ করেননি। বিজয়োল্লাসে আপনার দুষ্টু, দামাল ভাইরা স্রেফ পিটিয়ে খুন করলো অজিত লোহার কে। আপনার মনে আছে বর্ধমানের পূর্ণিমা ঘড়ুই কে? কিম্বা গড়বেতার জিতেন নন্দী কে? 

জানেন ম্যাডাম, মধ্যমকুমারির জঙ্গলে সালকু সরেনের মরদেহটা যখন পাওয়া গেলো তখন তাঁর গলায় ছ-খানা টাঙ্গির কোপ। সবার চোখের সামনে লাশটার শরীরের চামড়া পচে গলে যাচ্ছে, পোকাতে কুরে কুরে খাচ্ছে সারা দেহ, চোখ গুলো ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে আসছে, চারিদিকে দুর্গন্ধ। অথচ মাওবাদীদের ফতোয়ায়, বৃদ্ধা বিধবা মা'র শত অনুরোধেও, মৃতদেহ সৎকারে সাহস করছে না ধরমপুর গ্রামের কেউ! আপনার মনে পড়ে ভালুকবাসা জঙ্গলঘেরা পাথরপাড়া গ্রামের বাদল আহিরের কথা? জ্যান্ত অবস্থায় যার গোটা দেহে গুনগুনে একশ আটটা পেরেক পুঁতেছিল মাওবাদীরা। ২০০১-১১ দশ বছরেই জঙ্গলমহলে ২৩ ব্লকে মাওবাদীদের হাতে শহীদ হয়েছিলেন ২৭৫ জন। আর আপনি বলেছিলেন "মাউ-ফাউ কিছুই নেই"। গত পাঁচ বছরে অজিত লোহারদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭৫। সর্বশেষ সংযোজন উচিতপুর গ্রামের শীর্ণকায়,এই স্বপন মালিক। আপনার কাছে দু-মুঠো চাল-ডাল চাইতে গিয়ে গুলি-বোমা আর রক্তে মাখা হয়ে মরলো যে। 

আজ লাল পতাকায় মোড়া স্বপন মালিকের নিশ্চল দেহটা যখন বর্ধমান মেডিকেল কলেজ মর্গ থেকে শেষ বারের মত বেরোল আপনি তখন নেতাজী ইন্ডোরে দলের কেষ্ট বিষ্টু-দের সাথে আপকামিং 'অল ইম্পরট্যান্ট ইলেকশনের' রণকৌশল তৈরিতে ব্যস্ত। আপনি এখন মুখ্যমন্ত্রী, সর্বময়ী নেত্রী। আপনি ব্যানার, আপনিই পোস্টার। আপনি বিজ্ঞাপন, আপনিই সরকার। আপনিই মালিক। আপনি রাখলে রাখবেন। মারলে মারবেন। শুধু বলে দিন এই স্বপন মালিকের লাশের সাইজটা কেমন? সুদীপ্তর মতই 'ছোট্ট'? সৈফুদ্দিনের মতই 'তুচ্ছ'? না প্রদীপ তা-কমল গায়েনের মত 'বিক্ষিপ্ত'? 

৩রা ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯। ম্যাডাম, আপনি তখনও আঁতুড় ঘরে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জনবিরোধী খাদ্যনীতির বিরুদ্ধে বিধানসভা অধিবেশনের প্রথম দিনেই ১৫ দফা মুলতুবি প্রস্তাব জমা পড়ে ১১ টি বিরোধী দলের পক্ষ থেকে। স্পিকার শঙ্করদাস ব্যানার্জি বিবেচনা প্রস্তাব দিলেও পরে তা অস্বীকার করেন। ২৫'ই জুন রাজ্যব্যাপী ধর্মঘট ও হরতালের পর বামপন্থী দলগুলি ২০'ই অগাস্ট থেকে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে শান্তিপূর্ণ ভাবে খাদ্যের দাবীতে গনআন্দোলনের ঘোষণা করে। আতঙ্কিত সরকারের আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয় প্রমোদ দাসগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙার, হেমন্ত বসু,  জ্যোতি বসুর নামে।  নিরঞ্জন সেন, গণেশ ঘোষ, বিনয় চৌধুরী, গীতা মুখার্জি, প্রশান্ত শূর সহ ২৭ অগাস্ট অবধি রাজ্য জুড়ে মোট গ্রেপ্তার হন, ৭০,০০০। ৩১'শে অগাস্ট খাদ্য-মন্ত্রীর অপসারণ ও খাদ্যের দাবীতে শহীদ মিনার ময়দানে ৩ লক্ষ মানুষের ব্যাপক জমায়েতের মহাকরণ মুখী অভিযানে গুলি চালায় পুলিশ। আহত সহস্রাধিক। ১৩০ জন আশঙ্কাজনক। পরে শহীদ ৮০ জন। ১'লা সেপ্টেম্বর পুলিশের এই হিংস্র তাণ্ডবের বিরুদ্ধে আবার গুলি চালায় পুলিশ। নিহত আরও ৮। আহত ৭৭। জারি হয় ১৪৪ ধারা। ২১'শে সেপ্টেম্বর খাদ্য আন্দোলন  শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে বিধানসভায় এক মিনিট নীরবতা পালন করতে অস্বীকার করে কংগ্রেস। বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়ও। হতাহতের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে অস্বীকার করেন পুলিশ-মন্ত্রী কালি মুখার্জি। 

কেমন লাগবে বলুন, যদি স্পার্টাকাসের জন্য দু মিনিট নীরবতা পালন করতেন জুলিয়াস সিজার? সিপাহী বিদ্রোহের শহীদ মঙ্গল পাণ্ডের প্রতি শোক ও শ্রদ্ধায় নিজের রত্নখচিত বহুমূল্য মুকুট থেকে রানী ভিক্টোরিয়া খুলে ফেলতেন বেশ কিছু মরকতমণি? হিরোশিমা-নাগাসাকির পরমাণু বোমার জন্য শোকপ্রস্তাব এনে নীরবে অশ্রু ঝরাতেন মার্কিন কংগ্রেসের সনেট বৃন্দ? 

তাই ম্যাডাম, আপনি স্বপন মালিকদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করবেন না। খবরদার করবেন না। ওঁদের জীবনের মূল্য যখন লাল ঝাণ্ডা, অধিকার আদায়ের রং যখন লাল ঝাণ্ডা, ন্যায্য চাল-ডালের ছিনিয়ে নেওয়ার রং যখন লাল ঝাণ্ডা, শহীদের রক্তে ভেজা যে লাল ঝাণ্ডা তখন আপনি দুঃখ প্রকাশ করে ওঁদের অসম্মান করবেন না। লালঝাণ্ডার অপমান করবেন না। ইতিহাসই ওঁদের মনে রাখবে। ইতিহাসই ওঁদের বাঁচিয়ে রাখবে। আর মানুষ আপনার বিচার করবে।করবেই ...

অথ রেশন কথা ~ অনামিকা

চাইলে রেশন মরতে হবে, বুঝিয়ে দিল রায়না
নেহাত ছোট্ট দুর্ঘটনা বুঝতে কেউই চায় না।

ভোট এসেছে, গদির দখল রাখতে হলে আজ যে
ভরসা নিছক বোমা-বুলেট, জিগির সারা রাজ্যে।
সবাই নাকি জোট বেঁধেছে, বুঝছে না তো বোকারা
অবাধ্যদের মরতে হবেই, যেমন মরে পোকারা।
বাঁচতে হলে ভক্তিতে নয়, শুদ্ধ ভয়েই কাঁপো।
কলেজমোড়ে পাড়ায় ঘোরে হাজারটা গেস্টাপো।

চাকরি চাওয়া খাবার খোঁজা, ফালতু এ'সব বায়না।
উন্নয়নের রক্তধারায় ভিজতে থাকুক রায়না।

মৃত্যুশীতল গ্রামবাংলার অশ্রু পরুক চলকে।  
সাধ্যটি কার সামলাবে এই ডালকুত্তার দলকে?
একটা কণ্ঠ মানুক সবাই, একটা থাকুক পার্টি,
উঁচিয়ে আঙুল নির্দেশ দেয় মহিলা হিটলারটি।
নিজেও তবু কাঁপছে রানী নিজের ভেতর আজ।
নিজের ধ্বংসআভাস সে ঠিক পেয়েছে আন্দাজ।

রাক্ষসীরূপ দেখছে রাণী, সামনে ধরে আয়না।
কাঁদছে শোকে… ফুঁসছে ক্রোধে, প্রতিবাদের রায়না।