মধ্য ও উত্তর কলকাতার অনেকটা জায়গা জুড়ে, এই যেমন ধরুন মেডিকেল কলেজের সামনের ফুটপাথে, সেন্ট্রাল এভিনিউয়ের বেশ কিছু অংশে, আজ হকার নেই তেমন। পুলিশ বসতে দেননি তাঁদের।
কেন?
বাঃ!! কিছুই খবর রাখেন না দেখছি। এটুকুও জানেন না, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী আজ বিদ্যাসাগরের মূর্তির আবরণ উন্মোচন করবেন। ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আমরা যেমন করে পারি, গুজরাটিরা পারবে না, শিওরলি। এগিয়ে বাংলা!!
বাই দ্য ওয়ে, মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে হাজারো রাজকার্যের মাঝে এত তুচ্ছ দিকে নজর দেওয়া সম্ভব নয় জানি, তবুও বলা যায়, ওই রাস্তার থেকে আর একটু এগোলেই জানতে পারবেন, গত রাত্রে কিছু শ্রদ্ধাশীল তাজা ছেলে লরিতে করে এসে, নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজে ভাঙচুর চালিয়ে গেল। বেধড়ক মেরে গেল জুনিয়র ডাক্তারদের। নার্সদের গায়েও হাত পড়েছে। পালিয়ে না বাঁচলে, আরো…….
বেশ কয়েকজন আহত। তার মধ্যে, একজন জুনিয়র ডাক্তারের খুলির বেশ কিছু অংশ ভেঙে মস্তিষ্কের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। আইটিইউ-তে ভর্তি সে। খিঁচুনি হচ্ছে। প্রায় কোমায়।
এই রাজ্যে চিকিৎসক নিগ্রহের লাগাতার ঘটনাক্রমের আপাতত চূড়ান্ত সাফল্য এইটিই। থুতু ছেটানো, গু দিয়ে স্নান করানো থেকে শুরু করে চড়থাপ্পড় কিলঘুঁষি - সেসব এখন অতীত - লরিতে চেপে দেড়শো-দুশোজন এসে ভাঙচুর ও সশস্ত্র আক্রমণ - আশা করা যায়, নতুন ট্রেন্ড এইটাই। এবং পরবর্তীকালে, এই লাইনে যাঁরা হাত পাকাতে চাইবেন, তাঁদের এই বেসিক জায়গা থেকেই শুরু করতে হবে।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মুণ্ডুখানা, থুড়ি তাঁর মূর্তির মুণ্ডুখানা মাটিতে গড়াগড়ি যাওয়ায়, দোষারোপের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। দুইদল আঙুল তুলেছিলেন পরস্পরের দিকে।
কর্তব্যরত জুনিয়র ডাক্তারের মুণ্ডু ভাঙার পরেও, না এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই, কোনো দলই জোর গলায় এর প্রতিবাদ করে উঠতে পারেন নি।
রাজ্যের রাজনীতি, মিডিয়া জানিয়েছে, আপাতত দ্বিদলীয়। না, এই দুই দলের কেউই এমনকি মৃদু গলায়ও এই ঘটনায় প্রতিবাদ জানান নি।
এও জেনেছি, সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে এরাজ্য থেকে নির্বাচিত সাংসদদের একটা বড় অংশ পেশায় চিকিৎসক। নাঃ, সেই সাংসদ-চিকিৎসকদেরও কেউ এই নিয়ে মুখ খুলেছেন, এমন খবর নেই।
চিকিৎসকদের সর্ববৃহৎ সংগঠন, যাঁর রাজ্যের হর্তাকর্তা এখন জাতীয়স্তরের সর্বোচ্চপদে আসীন, তাঁরাও টুঁ শব্দটি করেননি।
তাহলে চিকিৎসকেরা কী করবেন?
প্রতিবাদ?
রাস্তায় নামা?? কাজ বন্ধ??? ক্ষোভে ফেটে পড়বেন????
না, টেনশন করবেন না।
তেমন কিছুই হবে না। কেননা, চিকিৎসকেরা আইনজীবী নন, যে, কোর্ট অচল করে দেবেন (বিচারালয় তো অত্যাবশ্যক পরিষেবা নয়, স্রেফ বড়লোকের লাক্সারি)। ওই কিছু প্রতিবাদ, কালো ব্যাজ, প্রোফাইল পিকচার কালো করে রাখা...
আমরা মেনে নিতে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি।
আমরা মেনে নিয়েছি, চিকিৎসার এক এবং একমাত্র দায় আমাদের। অতএব, পরিকাঠামোহীন, স্বাস্থ্যকর্মীহীন প্রতিশ্রুতিতেও প্রতিবাদ করিনি।
আমরা বিশ্বাস করে নিয়েছি, সঠিক ব্যবস্থা, উপযুক্ত পরিকাঠামো থাকলে মানুষ অমর। অতএব, যেকোনো মানুষের যেকোনো পর্যায়েই অসুখ সারিয়ে দেওয়ার চিকিৎসা করা যেতে পারে। চিকিৎসা ছেড়ে স্রেফ শুশ্রূষার পরামর্শ দেওয়ার কথা ভাবাও পাপ। (গতকাল, যাঁর মৃত্যুতে এত ভাঙচুর, তাঁর বয়স পঁচাশি।)
আবার, সবকিছুকেই অগভীর চোখে দেখতে দেখতে আমরা এমনই অগভীর ভাবনায় অভ্যস্ত হয়েছি, যে, হাসপাতালে হবু ডাক্তারদের মার্শাল আর্ট ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা দেখলে, সেই ভাঁড়ামোকে সমর্থন করি। বলি, চিকিৎসক নিগ্রহের ক্ষেত্রেও পালটা মারই একমাত্র পথ। (মার্শাল আর্ট ট্রেনিং-এর ভাবনা যাঁর উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত, তিনি একারণে পুরস্কার-টুরস্কারও পেয়ে যান।)
আমরা মেনে নিয়েছি, আমাদের কাজের কোনো টাইম নেই, আমরা পরিবারহীন, আমাদের ডিউটি আওয়ার্স বলে কিছু হতে নেই, সেই ডিউটির শেষেও আমাদের অজস্র ফোন আসবে এবং সেইসব ফোনে যথোপযুক্ত সময় না দেওয়াও দায়িত্বচ্যুতি। অতএব, হোর্ডিং-এ তোমার ছুটি আমার নয় দেখলে আমরা গৌরববোধ করি।
আমরা মেনে নিয়েছি, চিকিৎসা পয়সা দিয়েই কিনতে হয়। না পারলে সরকারি হাসপাতাল। এই বার্তার মধ্যেই যে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখার ভাবনা রয়ে গিয়েছে, এমনটা তলিয়ে দেখিনি। আর, যারা বাধ্যত সেই সেকন্ড ক্লাস পরিষেবা নিতে যাচ্ছেন, তাঁদের ভেতরের ক্ষোভের লাভা যেদিন আগ্নেয়গিরির উদগীরণ হয়ে বেরোচ্ছে, তখন, আবারও ভেবে দেখছি না। ভাবনার এই প্যারাডাইম থেকে বেরোতেই পারছি না, যে, আধুনিক ও উন্নত মানেই ব্যয়বহুল। একবারও বলতে পারছি না, ইয়েস, দেয়ার মাস্ট বি অ্যান অল্টারনেটিভ।
আমরা বিশ্বাস করে নিয়েছি, এক হাতে তালি বাজে না। মেনে নিয়েছি, নিশ্চয়ই কোনো গণ্ডগোল ছিল, নাহলে…..কই, পাশের বেডের পার্টি তো কিছু ঝামেলা করেনি ইত্যাদি ইত্যাদি….অতএব, একেবারে নিজের দোরগোড়ায় অশান্তি না পৌঁছালে…..আর তাছাড়া, জানেনই তো, রোগীর প্রতি দায়বদ্ধতা ইত্যাদি প্রভৃতি।
আর প্রতিবাদ ব্যাপারটা আমাদের তেমন একটা আসেও না। কর্পোরেট হাসপাতালে আমাদেরই কোনো বন্ধুকে অযৌক্তিক সরিয়ে দিলে, সেই পোস্টে নিজে জয়েন করতে আমাদের বাধে না। মার্কেটিং-এর চাপের সামনে মাথা নোয়াতেও অস্বস্তি হয় না। সরকারি হাসপাতালে ট্রান্সফারের ভয়, আর বেসরকারিতে জায়গাটা হারানোর ভয় - শিরদাঁড়া হারিয়েছি কবেই!! কিন্তু, খবরদার, এসব বলা চলবে না একদম!! ওসব পলিটিক্স আমাদের কম্মো নয়….জানেনই তো, আমরা একটু বেটার আপনার চেয়ে…..
শুধু একটু ক্ষমতার গায়ে গায়ে থাকতে পারলে….একটু মার্কেটিং-এর দুচারটে ছেলেকে কব্জা করতে পারলে….আর ওই একটু কনফারেন্স-টনফারেন্স….
না, বিশ্বাস করুন, এগুলো একটুও ধান ভানতে শিবের গীত নয়….
আসলে, সাধারণ মানুষের থেকে কবে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি, কবে যেন পুরো পেশাটাই চূড়ান্ত অবিশ্বাসের পাত্র হয়ে গিয়েছে, আমরা ধরতেই পারিনি…
যিনি এই নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজেই কুকুর মারার ঘটনায় বলেছিলেন, যে, সেইসব ডাক্তারদেরও পিটিয়ে মারা উচিত, খেয়াল করে দেখেছিলেন একবার, ঠিক কত লাইক পড়েছিল সেই পোস্টে!!!! মনে রাখুন, আইটিইউ-তে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া আমাদের ভাইয়ের ব্যাপারে তাঁর নীরব থাকাটাও একটা স্টেটমেন্ট - উচ্চকিত স্টেটমেন্ট - এবং এই স্টেটমেন্টে লাইকের সংখ্যা অগুন্তি।
একটু দাঁড়ান। কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে ভাবুন। আমরা যাঁদের চিকিৎসা করি, তাঁদের আর আমাদের মধ্যেকার সেতুখানা সারাই না করলেই নয়। আর মনে রাখুন, এই সেতুর ইঁটকাঠ প্রতিনিয়ত খুলে নিচ্ছেন রাজনীতির কারবারিরা।
মনে রাখুন, আমার আর আপনার মধ্যে অবিশ্বাস জিইয়ে না রাখলে, রাজনীতিকদের প্রতি বিশ্বাস বজায় রাখা মুশকিল হয়ে যাবে আপনার পক্ষে।
হাত পেতে ঘুষ নেওয়া রাজনীতিকটি আপনার কল্যাণে ব্রতী, এই বিশ্বাস তো টিকতেই পারে না, যদি না আপনি বিশ্বাস করেন, যে, আপনাকে সারিয়ে তুলছেন যিনি, তিনি আসলে সেটা করছেন স্রেফ পয়সার লোভে।
অতএব…..অতএব…..
এই চক্রব্যূহ থেকে মুক্তি নেই।
সরকারের কাছে গিয়ে বলাই যায়, নিরাপত্তা জোরদার করুন। হ্যাঁ, করলে কিছু কাজ হতে পারে। কিন্তু, সে তো আপাত কার্পেট বিছিয়ে গর্তগুলো চাপা দেওয়া - কার্পেটের তলায় অবিশ্বাসের মূষিক তো কাঠামো ভঙ্গুর করেই চলেছে, চলবেও।
আর, তাছাড়া, কোনো রাজনৈতিক দলই কি চায় এই অশান্তি মেটাতে? ওই যে বললাম, এই অবিশ্বাস মিটে গেলে….অবিশ্বাস যদি অন্য সত্যের সন্ধানে ব্রতী হয়….অত বড় ঝুঁকি নেবেন কে!!!!
কয়েক ঘন্টার মধ্যে লরি ভাড়া করে শতাধিক মানুষ জোগাড় করে এনে সশস্ত্র আক্রমণ - প্লীজ, এইটার পেছনে সচেতন রাজনৈতিক মদত নেই, একথা বিশ্বাস করতে বলবেন না!! আর, এই ডেলিবারেট আক্রমণকে তবে-ডাক্তারদেরও-আরো -মানবিক-হতে-হবে টাইপের বাঁধা বুলি দিয়ে মোলায়েম করার চেষ্টা করবেন না - যেটা প্রায় এই আক্রমণের জাস্টিফিকেশানের সমান।
সব মিলিয়ে…..
জানি না, পথ কী….পরবর্তী পদক্ষেপ কী……
".................তখনও সে
দূর দেশে দূর কালে দূর পৃথিবীকে ডেকে বলে :
এত যদি ব্যূহ চক্র তীর তীরন্দাজ, তবে কেন
শরীর দিয়েছ শুধু, বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে !"
(শঙখ ঘোষ)
ভাই, শুধু তুই সুস্থ হয়ে ওঠ তাড়াতাড়ি……