শুরুর কথা
-------
।।১।।
"শাধআঢঢাশআচেবাপযভুশেঝষেএঢ়"।
ধরা যাক ক্যাপ্টেন স্পার্ক ছোট্ট একটা চিরকুটে এই বিদঘুটে শব্দটি লিখে ধরিয়ে দিল ফেলুদার হাতে। ফিসফিস করে বলেও দিল, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে খুব গোপন একটি বার্তা। কী সেই বার্তা, সেটা উদ্ধার করাই রজনী সেন রোডের প্রদোষচন্দ্র মিত্রের কাজ।
এর আগে তিনি 'রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য'-তে 'মুড়ো হয় বুড়ো গাছ, হাত গোন ভাত পাঁচ'-এর রহস্যভেদ করেছেন। ঘুরঘুটিয়াতে 'ত্রিনয়ন' আর 'একটু' যে যথাক্রমে 'থ্রি-নাইন' এবং 'এইট-টু', তাও ধরে ফেলেছেন ঝট করে। কিন্তু, এ বার?
তোপসে বলল, এ আবার কী ফেলুদা! আগে তো তাও কিছু শব্দ শুনেছিলাম, তার কিছু অর্থ-টর্থ ছিল, এর তো না আছে মাথা না আছে মুণ্ডু!
ফেলুদা বলল, সেটাই তো চ্যালেঞ্জ রে তোপসে। মাথা আর মুণ্ডুটা খুঁজে বের করতে হবে। দ্যাখ, একটা ক্লু তো স্পার্ক দিয়েই দিয়েছে। এটা একটা বার্তা। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, যাদের মধ্যে এই কথার দেওয়া-নেওয়া, তারা চায় না যে অন্য কেউ এর হদিস পাক, তাই না?
তোপসে বলল, নির্ঘাত! তা না হলে আর গোপন কেন হবে?
ফেলুদা বলল, ওই দু'জন তেমনই যুক্তি কষেছে, এমন একটা সুরক্ষিত যোগাযোগ ব্যবস্থা বানিয়ে ফেলবে যেখানে গোপনীয়তা বজায় রেখেই যোগাযোগ রাখা যায়। পরিচিত ভাষায় কথা বলে লাভ নেই। একটা আড়াল দরকার। ওই আপাত ভাবে হিজিবিজি অক্ষরগুলোই সেই আড়াল।
তোপসে বলল, তার মানে তুমি বলতে চাইছ, এটা একেবারেই পাগলামি নয়, বরং এর পিছনেও একটা কোনও যুক্তির কাঠামো আছে।
এগজ্যাক্টলি! — একটা চারমিনার ধরাল ফেলুদা, একে বলে মেথড ইন ম্যাডনেস! তুই যদি ওই বিদঘুটে কথাটা রাস্তার দেওয়ালেও লিখে দিস, কেউ কিস্যু বুঝবে না। শুধু দু'টি মানুষ ছাড়া। যারা জানে, কী ভাবে ভেতরের আসল কথাটাকে আড়াল করা হয়েছে। কিছু একটা সাংকেতিক সূত্র আছে এর মধ্যে। সেটা এক বার ধরতে পারলেই কেল্লা ফতে।
কী জানি, সেটা ধরার কোনও রাস্তা আছে বলে তো মনে হচ্ছে না, হতাশ শোনাল তোপসের গলা।
ফেলুদা একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, কেসটা খুব ইজি হলে আর ফেলু মিত্তিরের কাছে আসবে কেন বল? ব্রেনের সেলগুলো একটু খাটাতে হবে।
রাত বেড়েছে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে তোপসে শুয়ে পড়ল। রাত্তিরে স্বপ্ন দেখল, বিশাল একটা ক্রসওয়ার্ডের মধ্যে সে হেঁটে বেড়াচ্ছে, সেখানে ফাঁকা ঘরগুলো এক-একটা গভীর গর্ত!
সকালে ঘুম ভেঙে দাঁতটাত মেজেই সোজা ফেলুদার ঘরে। যথারীতি যোগব্যায়াম-ট্যায়াম সেরে ফেলুদা রেডি। সামনে চায়ের পেয়ালা। তোপসে জিজ্ঞেস করল, কী হল? পারলে?
উত্তর না দিয়ে টোস্টে একটা কামড় দিল ফেলুদা, তারপর বলল, ক্রিপ্টোলজি কাকে বলে জানিস?
সে আবার কী? তোপসে থতমত। অনেক 'লজি' শুনেছি, কিন্তু এ রকম তো ...
বাংলায় বলতে পারিস, সংকেতবিদ্যা। এরকম প্রচুর উপায় এখন জানা আছে যার মাধ্যমে সুরক্ষিত উপায়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গোপনে বার্তা পাঠানো সম্ভব।
তোপসে বুঝল, ফেলুদা এখন একটু জ্ঞান দেওয়ার মুডে আছে। চুপচাপ শোনা ছাড়া গতি নেই।
ফেলুদা বলে চলল, সংকেতের চাবিটা কী তা না জানলে কারও ক্ষমতা নেই এই হেঁয়ালির কোনও তল পায়! এ ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন স্পার্ক যে কায়দাটা ব্যবহার করেছে, বিজ্ঞানের পরিভাষায় তার নাম 'সিমেট্রিক কী ক্রিপ্টোগ্রাফি'।
তোপসে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে। যাক, ফেলুদা তা হলে ওই হযবরল-র মানে বই পেয়ে গেছে!
'সিমেট্রিক কী ক্রিপ্টোগ্রাফি'র ইতিহাস খুঁজতে খ্রিস্টপূর্বাব্দে ফিরতে হবে, বুঝলি। "সিমেট্রিক" অর্থে দুজনের কাছে একই "কী", অর্থাৎ গোপন চাবিকাঠি আছে। ইনিও জানেন, উনিও জানেন। প্রশ্ন হল, সেই চাবিটা এখানে কী?
উফ, ফেলুদা! তুমি মাঝে মাঝে এমন সাসপেন্সে রাখো! বলেই ফেলল তোপসে।
ফেলুদা বলল, ধরা যাক আগে থেকে নির্দিষ্ট করে রাখা হল যে কথাটার মধ্যে স্বরবর্ণগুলোকে একই রকম রেখে দেওয়া হবে, কিন্তু প্রতিটি ব্যঞ্জনবর্ণের জায়গায় তার পরের তৃতীয় অক্ষরটি লেখা হবে। ধর, তুই পড়ছিস শ, কিন্তু আসলে বলতে চাওয়া হয়েছে র। আর হ্যাঁ, এটাও সাজিয়ে নেওয়া হয়েছিল যে, দুটো শব্দের মাঝখানে ফাঁকগুলো আর থাকবে না। তাতেও দেখতে একটু বিচিত্র লাগবে। দেখ তো, এই দুটো জিনিস মাথায় রাখলে কথাটা কী দাঁড়ায়! এই নে, খাতায় লেখ! কাগজ-কলম এগিয়ে দিল ফেলুদা। তোপসে আস্তে আস্তে লিখে ফেলল আস্ত একটি বাক্য।
"রাত আটটার আগে যাদবপুরে চলে এস"
।।২।।
ফেলুদা আর তোপসের এই কাল্পনিক কথাবার্তা আসলে এটুকুই বোঝানোর জন্য যে, ক্রিপ্টোলজি, কী ভাবে কাজ করে। হতে পারে দু'জন মানুষ, এমনকী হতেই পারে দুটি কম্পিউটারের মধ্যে বার্তা চালাচালি হবে। কী ভাবে গোপনীয়তা বজায় রেখে সেই যোগাযোগটা রাখা যায়, সেটাই প্রশ্ন।
আগের উদাহরণটি টেনে বলি, যিনি জানেন কী উপায়ে এই শব্দগুলোকে ঘেঁটে দেওয়া হয়েছে, তিনি তিনটি করে ব্যঞ্জনবর্ণ পিছিয়ে পড়ে নেবেন আর স্বরবর্ণগুলো বদলাবেন না। যারা এটা জানে না, তারা হাবুডুবু খাবে।
এটাই ক্রিপ্টোলজির একেবারে গোড়ার কথা। গোপন চাবিকাঠিটুকু জানা থাকলে যেমন অর্থপূর্ণ ভাষা থেকে অর্থহীন সংকেতে চলে যাওয়া যায়, তেমনই অর্থহীন শব্দরাশির জাল সরিয়ে সহজেই ফিরে আসা যায় অর্থপূর্ণ একটি বার্তায়।
আজকের দিনে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিতে সুযোগ সুবিধে প্রচুর। মুঠোফোনে আঙুল ছুঁইয়ে কাজ হয়ে যাচ্ছে অনেকটা। ইলেকট্রিকের বিল দেওয়ার জন্যে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে না, ব্যাঙ্কে গিয়ে এক কাউন্টার থেকে আর এক কাউন্টারে ছুটে বেড়ানোর হয়রানি নেই।
অবশ্য এই সব স্বস্তির গায়ে লেপটে আছে এক টুকরো অস্বস্তি। আসলে, প্রবল অস্বস্তি। মুঠোফোনের মাধ্যমে যে সমস্ত তথ্য যোগাযোগের খোলা রাস্তায় গিয়ে পড়ল, সে সব সুরক্ষিত থাকবে তো? এন্তার যে নেটব্যাঙ্কিং করছি, রেস্তোরাঁয় খেয়ে বিল মেটাচ্ছি কার্ডে, অনলাইনে জিনিস কিনে রাস্তাঘাটেই সোয়াইপ করছি কার্ড, যদি তথ্যগুলো চলে যায় চোরেদের হাতে! কী করে এদের রেখে দেওয়া যায় জালের নিরাপদ ঘেরাটোপে?
উত্তরটি সংক্ষিপ্ত, একে সুরক্ষিত রাখাই যায়, কিন্তু তার জন্যে বেশ কিছু সতর্কতা জরুরি। সেই সব সতর্কতারই হদিস দেয় ক্রিপ্টোলজি।
———
দু'রকমের চাবি এবং উৎপাদকে বিশ্লেষণ
--------------------------
।।১।।
"বুঝলেন মশাই, এবার পুজোয় ক্রিপ্টোলজি নিয়ে লিখছি। আগের দিন আপনার আর তপেশ ভাইয়ের কথোপকথন শুনে বেশ উৎসাহ পেলাম। চট করে বলুন তো 'বেবুধা' মানে কি?" বক্তা কে তা আর বলে দিতে হয় না।
আমি তো অক্ষর এগিয়ে পিছিয়ে চেষ্টা করছি, কিন্তু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। দেখি পদ্মাসনে বসে চোখ বন্ধ করে মিটি মিটি হাসছে ফেলুদা। মিনিট খানেক দেরি হল বুঝতে, তবে তার জন্যে বাংলার দুটো 'ব' দায়ী। একটা 'ব'-এর আগের অক্ষর 'ফ' আর অন্যটার 'ল'। আগের দিন 'সিমেট্রিক কি ক্রিপ্টোগ্রাফি' শিখে সে বিদ্যে কাজে লাগাতে শুরু করেছেন জটায়ু। এবার পুজোয় তাঁর উপন্যাসে যে এলোমেলো অক্ষর গড়াগড়ি খাবে সে তো বোঝাই যাচ্ছে। এর মধ্যেই পরের বোমাটা ছাড়লেন তিনি।
"বুঝলে ভাই তপেশ, দুজনের কাছে একই কি, মানে গোপন চাবিকাঠি থাকলে তো সুরক্ষিত যোগাযোগ বেশ সহজ। কিন্তু ধর তুমি কলকাতায়, আর তোমার দাদা গেছেন লন্ডনে। গোপনে খুব জরুরি একটা খবর পৌঁছতে হবে। আর তোমাদের কাছে কোন গোপন চাবিকাঠি নেই। তখন কি করবে?"
উত্তরটা আমার জানাই ছিল, কিন্তু তাড়াতাড়ি উত্তর দিয়ে জটায়ুকে হতাশ করতে চাইলাম না। তাই একটু সময় নিয়ে ভাবার ভান করতেই হল। এর মধ্যে জটায়ু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। আসন পরিবর্তন করার ফাঁকে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে ফেলুদা বলল, "৬৭ গুণ ৩৭ কত হয় বলুন তো?"
লালমোহনবাবু পকেট থেকে মোবাইল ফোন বার করে গুণ করতে যাচ্ছিলেন। "ওইটির অনুমতি নেই, গুণটা মনে মনে করতে হবে, যাকে বলে মুখে মুখে"। ফেলুদার কথা শুনে বিড় বিড় করে গুণ শুরু করলেন ভদ্রলোক। পাক্কা এক মিনিটের মাথায় বলে দিলেন ২৪৭৯।
"বাহ বেশ তাড়াতাড়ি করলেন তো।"
ফেলুদার প্রশংসায় জটায়ু আপ্লুত। "বুঝলেন কিনা, সেদিন বাজারে ১২২ টাকা কিলো পিঁয়াজ ৩৭৫ গ্রাম কিনেছি। সেই হিসেবের তুলনায় এটা তো নস্যি। গুণ-ভাগ আমি ছোটবেলা থেকেই বেশ তাড়াতাড়ি করে ফেলতে পারি।"
"তা হলে একটা সহজ ভাগের অঙ্ক করুন। বলুন তো কোন দু'টো সংখ্যা গুণ করলে ১১৮৯ হয়?"
এ বার শুধু জটায়ু নন, আমিও বিপাকে পড়লাম। কিছুতেই ঝট করে সংখ্যা দুটো খুঁজে বার করতে পারছি না। এদিকে ফেলুদা নিশ্চিন্তে শবাসনে। লালমোহনবাবু সেই যে চায়ের কাপটা আঙুলে আঁকড়ে টেবিল আর মুখের মাঝামাঝি জায়গায় নিয়ে গেছিলেন, সেই অবস্থাতেই স্ট্যাচু। পাক্কা দু মিনিট চেষ্টা করার পর আমার মাথায় এল ২৯ কে ৪১ দিয়ে গুণ করলে এমনটা হয়। এ বার কিন্তু লালমোহনবাবু ফেল।
"এটা কি রকম ভাগের অঙ্ক মশাই? এ তো উৎপাদকে বিশ্লেষণ।"
"এক্কেবারে আসল কথা বলে ফেলেছেন।" ফেলুদার শবাসনের তিন মিনিট শেষ। "ভাজক আর ভাজ্য দেওয়া থাকলে ভাগফল আর ভাগশেষ বার করা সহজ। কিন্তু তার থেকে উৎপাদকে বিশ্লেষণ অনেক বেশি শক্ত। তারপর সেই উৎপাদক যদি হয় দুটো বড় বড় মৌলিক সংখ্যা, তাহলে মুশকিল আরও বেড়ে যায়। তখন শুধু আপনি কেন? আপনার প্রখর রুদ্রও পাশ করতে পারবে না। সত্তরের দশকে রিভেস্ট, শামির আর অ্যাডলেম্যান নামের তিন ইহুদি সঙ্কেতবিদ এই তত্ত্ব থেকেই শুরু করেন ক্রিপ্টোলজির নতুন দিগন্ত, যার নাম 'পাবলিক কী ক্রিপ্টোলজি'। এদের নামের প্রথম অক্ষরগুলো নিয়ে এই তত্ত্ব 'আরএসএ' বলে পরিচিত। বুঝতেই পারছেন, এরপর থেকে গোপনে যোগাযোগ করার জন্যে দুজনকে আর একই চাবিকাঠি ব্যবহার করতে হয় না। ফলে কলকাতায় থেকে তোপসের আমাকে গোপন বার্তা পাঠাতে খুব অসুবিধে নেই। সে আমি লন্ডনেই থাকি বা হংকং-এ"।
।।২।।
ওপরে কাল্পনিক বাক্যালাপ ক্রিপ্টোলজির আর একটু গভীরে উঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে। ধরুন যে দুজন খোলা রাস্তা ব্যবহার করে গোপন সংকেতের মাধ্যমে বার্তা পাঠাতে চান, তাঁদের আগে কখনও দেখা হয়নি। এমন হতেই পারে যে অন্তর্জাল ব্যবহার করে আপনি যার কাছ থেকে জিনিস কিনছেন তিনি অন্য দেশের নাগরিক, থাকেনও সেই দেশে। সেক্ষেত্রে গোপন চাবিকাঠিটি দুজন মিলে এক টেবিলে বসে স্থির করা যাবে না। অর্থাৎ এই সমস্যার সমাধানের জন্যে 'সিমেট্রিক কি ক্রিপ্টোগ্রাফি'-র থেকে আর একটু বেশি কিছু ভাবতে হবে। আর সেই সুরক্ষা অর্জন করতে হবে অরক্ষিত যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে দিয়েই। এই ধরণের উপায় "পাবলিক কি ক্রিপ্টোগ্রাফি" নামে পরিচিত।
একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি কিছুটা পরিষ্কার হবে। ধরা যাক কোন এক শিক্ষকের (ক) সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের (খ) মুখ দেখাদেখি বন্ধ। এদিকে সময় মতো প্রশ্নপত্রটি পাঠাতে হবে। একমাত্র উপায় অফিসের কর্মচারির সাহায্য নেওয়া। কিন্তু সেই কর্মচারি (গ) মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে কী উপায় আছে দেখা যাক। একটি বাক্সে তালা মেরে চাবি নিজের কাছে রেখে দেবেন ক-বাবু। তারপর তালাবন্দি বাক্স দেবেন গ-কে। যেহেতু বাক্সে তালা দেওয়া, তাই গ-এর পক্ষে সেই প্রশ্ন দেখা সম্ভব নয়। সে বাক্স নিয়ে গেল খ-বাবুর কাছে। তিনি বাক্সের আঁকড়ায় আর একটি তালা লাগিয়ে দিলেন, চাবি রাখলেন নিজের কাছে।
এবার গ সেই ডবল-তালা লাগানো বাক্স নিয়ে ফিরে গেল ক-এর কাছে। ক-বাবু নিজের চাবি দিয়ে নিজের তালা খুলে নিলেন। কিন্তু বাক্সের মুখ তখনও আটকে থাকল খ-বাবুর তালার সুরক্ষায়। গ আবার সেই বাক্স নিয়ে ফিরে গেল খ-এর কাছে। তিনি এবার তাঁর চাবি নিয়ে খুলে ফেললেন বাক্স। অর্থাৎ দুজন নিজের নিজের তালা-চাবি কাজে লাগিয়ে একটি সুরক্ষিত বার্তা পাঠিয়ে দিলেন অবিশ্বাসী কোন ব্যক্তির মাধ্যমে। তবে একবারের বদলে যাতায়াত হল মোট তিনবার। একই ধরনের নীতি কাজ করে দুটি কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে, যদিও সেখানে তালা-চাবির বদলে ব্যবহার করা হয় অঙ্কের কিছু নিয়ম। কিন্তু অবিশ্বাসী ব্যক্তি যদি বাক্স ভেঙে চিঠি পড়ে নেয়? সে ক্ষেত্রে ভাঙা বাক্স দেখে ক অথবা খ-বাবু প্রশ্নপত্র যে চুরি হয়েছে সেটা বুঝতে পারবেন। তখন আবার নতুন করে প্রশ্ন বানাতে হবে।
।।৩।।
দুটি উদাহরণ দিয়ে এই আলোচনা শেষ করা যাক। ধরা যাক আপনার এবং আপনার স্ত্রীর কাছে আছে একই আলমারির দুটি একই ধরনের চাবি। আপনার স্ত্রী সেই আলমারিতে টাকা রেখে চাবি বন্ধ করে দিলে তিনি ছাড়াও আর একজন সেই টাকা সরাতে পারেন। আর তার নাম বলে দেওয়ার জন্যে কোনও পুরস্কার নেই। এখানে দুটি চাবি কিংবা 'কি' একই। অর্থাৎ এটি 'সিমেট্রিক কি'-র উদাহরণ।
এবার ভাবুন আপনার বাড়ির পয়সা জমানোর পেতলের ঘটের কথা। সেই ঘটের ওপরের দিকে আছে একটি ছোট ফাঁক, যেখান দিয়ে টাকা পয়সা ভরে দেওয়া যায়, কিন্তু বার করে আনা যায় না। ঘটের নিচের দিকে একটি আঁকড়ায় ঝোলানো আছে চাবিবন্ধ তালা। সেই চাবি যার কাছে, তিনিই তালা খুলে ঘটের ভেতরের মণিমাণিক্য হাতাতে পারবেন। এক্ষেত্রে ঘটের ওপরের ফাঁকটি হল 'পাবলিক কি', যে রাস্তায় টাকা পয়সা ছাড়াও জনগণ আপনাকে গোপন বার্তা কাগজে লিখে গুঁজে দিয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ আপনার 'পাবলিক কি' জানা আছে সকলেরই, যা দিয়ে আপনাকে লুকোনো চিঠি পাঠানো যায়। কিন্তু একবার সেই কাগজ ঘটে ঢুকে গেলে আর তাকে ছোট্ট ফাঁক দিয়ে উদ্ধারের রাস্তা নেই। একমাত্র আপনি যদি নিচের তালা খুলে ফেলেন তখন সেই বার্তা আপনার হাতের মুঠোয়।
এই চাবিটিকে বলে 'প্রাইভেট কি', যার সাহায্যে আপনি ফিরে পান আপনাকে লেখা গোপন চিঠি, কিংবা বহুদিনের জমানো টাকাপয়সা। আর কম্পিউটারের জগতে এই সুরক্ষাব্যবস্থার মূল তত্ত্ব হল দুটি বিশাল মৌলিক সংখ্যার গুণফল নির্ধারণ করা সহজ, কিন্তু শুধু গুণফল দিয়ে দিলে সেখান থেকে উৎপাদকে বিশ্লেষণ করে সেই মৌলিক সংখ্যাদুটিকে বার করা প্রায় অসম্ভব।
একটি সাবধানবাণী দিয়ে এই অংশটি শেষ করা যাক। আজকের দিনে কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে অনেক, আর সেই কম্পিউটার আর একটু উন্নত হলে 'পাবলিক কি'-এর সুরক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বে। তবে সেদিন আসতে এখনও কিছুটা দেরি আছে। আপাতত তাই প্রখর রুদ্র খুব তাড়াতাড়ি উৎপাদকে বিশ্লেষণ না করতে পারলেই নিশ্চিন্ত!
-----------
তথ্যশূন্য প্রমাণ
----------
।।১।।
পুজোর বই আজকাল অনেক আগে থেকেই বেরোতে শুরু করে। সেদিনই লালমোহনবাবু বলছিলেন, "বুঝলে ভাই তপেশ, এখন তো ইংরিজি বছর শুরু হতে না হতেই পুজোর উপন্যাসে হাত দিতে হয়। তবে কম্পিউটার আর প্রিন্টারের ব্যাপার স্যাপার অনেকটা এগিয়ে যাওয়ায় ছাপার সময় এখন লাগে কম, সেটুকুই যা ভরসা। তাও মে-জুনের মধ্যে লেখা শেষ করে ফেলতে হয়।"
"তা এবার লিখছেন কী নিয়ে?"
"সে অনেক বড় গল্প। প্রখর রুদ্র যাচ্ছেন মেঘালয়ে। গোটা রাস্তা ঢেকে ফেলেছে মেঘ, একপাশে পাহাড়, অন্যদিকে খাড়াই নেমে গেছে খাদ। সেই রাস্তায় চেজ। শেষের দিকটায় সাসপেন্স নিয়ে গিয়ে ফেলছি একেবারে একটা গুহার সামনে। সেখানে গুহার মুখ থেকে ভেতরে ঢোকার দুটো পথ। সেই দুটো সুড়ঙ্গ ঢুকে গিয়ে মিশেছে একটাই ঘরে। আর সেখানেই আছে অমূল্য এক অষ্টধাতুর মূর্তি।"
"বাহ, দিব্যি ফেঁদেছেন তো!"
"কীসের আর দিব্যি? শেষটায় নিজের জালে নিজেই খানিক জড়িয়ে গেছি।"
"মানে?"
"সহজ। নিজেই নিজের কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না।" বলল ফেলুদা। এতক্ষণ ধরে সে খুঁটিয়ে কাগজ পড়ছিল। চোখ এখনও কাগজেই, তবে কানটা যে এ দিকেই ছিল, তা বুঝলাম।
"প্রবলেমটা কিন্তু জম্পেশ ফেঁদেছি, ইউ মাস্ট অ্যাডমিট স্যর! তবে কি না শেষে ওই ইয়েটা একটু ..."
"সেটাই শুনি না, কী ইয়ে ..."
ফেলুদার এই কথায় জটায়ুর আহ্লাদের সীমা থাকল না। আনন্দের চোটে 'ডিমটোস্ট' গুলিয়ে 'মিটাডোস্ট' চেয়ে বসলেন, তারপর চায়ের পেয়ালায় লম্বা একটা চুমুক দিয়ে যা বললেন, তার সারমর্মটুকু এ রকম:
দুটি সুড়ঙ্গই শেষ হচ্ছে একটি করে দরজায়। তার মানে দরজা হল দুটি, যদিও দুটি দরজা দিয়েই একটাই মাত্র ঘরে গিয়ে ঢোকা যায়। অর্থাৎ, সেই ঘরটা কমন ফ্যাক্টর। দুটি দরজাই তালা লাগানো। ভেতর আর বাইরে দুদিক থেকেই খোলা যায় সেই তালা, আজকের দিনে ঘরবাড়িতে যেমন থাকে। ঘরের ভেতর থেকে বাইরে বেরোনোর জন্যে চাবি লাগে না, কবজা ঘোরালেই খুলে যাবে। কিন্তু বাইরে থেকে, অর্থাৎ সুড়ঙ্গ থেকে ঘরে ঢুকতে গেলে চাবি লাগবেই, আবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় আটকেও দেওয়া যাবে সেই তালা। দুটো তালা একই রকম, অর্থাৎ চাবি একটাই।
"সবই তো বুঝলাম, কিন্তু আপনার ইয়েটা গেল কোনখানে?"
জটায়ু একটু কাঁচুমাচু মুখে বললেন, "ধরুন, অনেকেই দাবি করছে যে তার কাছে আসল চাবিটা আছে। আরও দাবি করছে, তারা প্রত্যেকেই নাকি ওই মন্দিরের কুলপুরোহিতের বংশধর। ঘরে ঢোকার ব্যাপারটা, বুঝতেই পারছেন, হাইলি সেনসিটিভ। প্রাচীন উপজাতি সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস। পুলিশ তো দূরে থাক, ওই বিশেষ ট্রাইবটি ছাড়া একটি মাছিরও ক্ষমতা নেই যে সেই গুপ্তঘরে সেঁধোয়। এ দিকে সরকার জানতে চায় আসল চাবি কার কাছে।"
"প্রখর রুদ্রকে সেটা বলে দিতে হবে তো?" এতক্ষণে খবরের কাগজ থেকে মুখ তুললো ফেলুদা।
"এগজ্যাক্টলি স্যর। কিন্তু, ফ্যাকড়া আছে। লোকগুলোকে ইন্টারোগেট করা যাবে না, বাড়ি সার্চ করা যাবে না, বডি সার্চফার্চ তো ছেড়েই দিন। তাই সত্যিমিথ্যে কী বলছে, জানার উপায় নেই।"
"অর্থাৎ ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই দিয়ে চলবে না, তাই আপনার হিরো পড়েছেন বেকায়দায়, এই তো?"
লালমোহনবাবুর মৌনব্রত সম্মতির লক্ষণ হয়েই দেখা দিল।
ফেলুদা বলল, "জটায়ুজি, হিরোকে মগজাস্ত্র অ্যাপ্লাই করতে বলুন।"
লালমোহনবাবু এ কথায় এমন করুণ চোখে তাকালেন যে, ফেলুদা একটু হেসেই ফেলল। তারপর বলল, "এক এক করে লোকগুলোকে একটা সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকতে বলুন ওই গুহায়, আর বেরিয়ে আসতে বলুন অন্য সুড়ঙ্গটা দিয়ে। যে পারবে তার কাছেই আছে আসল চাবি।"
"তাই তো!" লালমোহনবাবুর চোখেমুখে আলো দেখা দিল, আবার নিভেও গেল অচিরেই। বললেন, "কিন্তু, ঘরে ঢুকে পড়লে তো বেরোনো কোনও ব্যাপারই না। তখন তো আর চাবি লাগবে না। অন্য সুড়ঙ্গটা দিয়ে গটগট করে বেরিয়ে আসবে।"
"বুঝলাম বেরিয়ে আসবে। কিন্তু, ঘরে যদি নাই ঢুকতে পারে, তা হলে অন্য সুড়ঙ্গটা দিয়ে বেরোবে কী করে? টানেলগুলো তো ইন্টারকানেক্টেড নয়।"
এ বার আমার মাথার মধ্যেও আলো জ্বলেছে। আমি বললাম, "দেখুন, একটা সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকে অন্যটা দিয়ে বেরোতে তখনই পারবে, যখন সে ঘরে ঢুকতে পেরেছে। আর ঘরে ঢুকতে সে-ই পারবে, যার কাছে আসল চাবিটা আছে। যাদের কাছে আসল চাবি নেই তাদের ফিরতে হবে ঢোকার দিক দিয়েই।"
"ব্রাভো, এই তো সলিউশন!" জটায়ু আনন্দে প্রায় তুড়িলাফ খেলেন।
ফেলুদা বলল, "আপনার বুদ্ধিটা যে কিছুটা হলেও পাকছে তার প্রমাণ যে, আপনি এই জিনিসটা অন্তত ভাবতে পেরেছেন। ক্রিপ্টোলজির ভাষায় একে বলে 'জিরো নলেজ প্রুফ'।"
জটায়ুর মুখটা একটু ফ্যালফেলে আর দু'চোখ গোলগোল হয়ে গেল। ফেলুদা বলল, "এটা একটা টার্ম। আপনার গপ্পেরও এটাই প্রাণভোমরা। যার কাছে চাবিটা আছে, তার কাছ থেকে সরকার চাবিটা নিতে চায় না বটে, কিন্তু জেনে নিতে চায়, আদতে কার কাছে চাবিটা আছে। অন্য দিকে, ওই ট্রাইবের লোকজনও চাইছে, প্রমাণ দেব যে চাবিটা আমার কাছেই আছে, কিন্তু চাবিটা দেব না।"
"কিন্তু, ওই ক্রিপ্টোলজির ইয়েটা..." বললেন জটায়ু।
"হ্যাঁ, জিরো নলেজ প্রুফ। ধরুন, আপনি আমার থেকে একটা তথ্য জানতে চাইছেন। আমি তার জন্য আপনার থেকে টাকা চাইব। কিন্তু, আপনিই বা নিশ্চিত না হয়ে আমাকে টাকা দেবেন কেন? তখন আমি আপনাকে প্রমাণ দেব যে, তথ্যটি আমি জানি, কিন্তু আপনি কখনওই জানতে পারবেন না যে তথ্যটা আসলে কী।"
জটায়ু সোল্লাসে বললেন, "এ তো একেবারে জলবৎ! অর্থাৎ চাবিটা থেকে গেল উপজাতি পুরোহিতের কাছেই। কেউ সে চাবি পেল না। কিন্তু প্রখর রুদ্র এবং সরকার নিশ্চিত হয়ে গেল কে ওই গুপ্তমন্দিরের পুরোহিতের আসল বংশধর।"
"যাক!" সংক্ষিপ্ত হাঁফ ছেড়ে ফেলুদা বলল, "আর এক কাপ চা খাবেন না কি?"
||২||
ধরা যাক, একটি লোক বব, আর অন্য একজন হল অ্যালিস। ধরা যাক, ববের আছে এমন একটা গোপন খবর আছে, যার জন্যে অ্যালিস অনেক টাকা দিতে রাজি, কিন্তু ...
হ্যাঁ, ক্রিপ্টোলজিতে এই 'কিন্তু'-টা খুব জরুরি, কারণ এখান থেকে কথাটা অনেকগুলো দিকে এগোতে পারে। এক, বব যদি গোপন খবরটি অ্যালিসকে আগেই দিয়ে দেয়, তাহলে অ্যালিস হয়ত বিনিময়ে পয়সাটা আর দিলই না। অন্য দিকে আগে পয়সা দিয়ে দিলে বব হয়তো তারপর খবরটাই দিতে অস্বীকার করল। আবার এমনটাও হতে পারে যে ববের কাছে আদতে আসল খবরটিই নেই, তাই লেনদেনে যাওয়ার আগে অ্যালিস নিশ্চিত হতে চায় যে, বব মিথ্যে বলছে না, বাস্তবিকই খবরটা তার কাছে আছে। আজকের অন্তর্জালের যুগে কিন্তু এই সমস্যা অনেক তীব্র। যাদের মধ্যে দেওয়া নেওয়া, তাদের একজন হয়ত কলকাতায়, অন্য জন কোলনে। ফলে এক্ষেত্রে কোনও একটি চুক্তির ক্ষেত্রে গণ্ডগোল হলে মুখোমুখি ঝগড়া করে মিটিয়ে নেওয়ার কোনও সুযোগই নেই।
সে ক্ষেত্রে দু'তরফকেই একটা চুক্তিতে আসতে হবে।
এই ধরণের চুক্তিভিত্তিক বহু বিষয় নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে গত শতাব্দীর গোড়া থেকেই। আর তারপর নব্বুইয়ের দশক থেকে যখন বোঝা গেল যে যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্তর্জলি যাত্রায় গেছে (অর্থাৎ, ইংরিজিতে যাকে বলে ইন্টারনেট, বাংলায় অন্তর্জাল), তখন ইলেকট্রনিক মাধ্যমে নানারকম চুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ের সমাধানের প্রসঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির এই ধারায় বিভিন্ন ধরণের প্রশ্ন উঠে আসতে লাগল একের পর এক। এর মধ্যে আমরা এখন যে বিশেষ সমস্যাটির দিকে নজর দিচ্ছি, সেখানে একপক্ষের হাতে আছে খুবই মূল্যবান এবং গোপন কোনও তথ্য। তিনি প্রমাণ করবেন যে তাঁর কাছে সেই তথ্যটি আছে, কিন্তু কখনওই সেই তথ্যটি জানাবেন না।
ক্রিপ্টোলজির ভাষায় একেই বলে 'জিরো নলেজ প্রুফ' অর্থাৎ প্রমাণ দেব যে তথ্যটি আমি জানি, কিন্তু যে প্রমাণ চাইছে সে কখনওই জানতে পারবে না যে তথ্যটি কী। বিষয়টি বোঝার জন্যে অনেক রকমের উদাহরণ আছে। তার মধ্যে একটি উপায় ফেলুদাই বুঝিয়ে দিয়েছেন লালমোহনবাবুকে।
আর এক বার সেটা মনে করে নেওয়া ভাল। ধরা যাক, একটি ঘরে ঢোকার দুটো দরজা। যে কোন দরজা খোলার জন্যে আছে একটি গোপন চাবিকাঠি, কম্বিনেশন লকে যেমন হয়। একটি দরজা দিয়ে ঢুকে সেটি বা অন্যদিকের দরজা দিয়ে বেরোনো যায়। আর ঢুকে যাওয়া বা বেরিয়ে আসার পরে বন্ধ হয়ে যায় সেই ঘরের দরজা। ধরুন, সেখানে রাখা আছে কোনও গুপ্তধনের সংকেত। অর্থাৎ চাবিটা পেয়ে গেলেই কেল্লা ফতে।
বুঝতে অসুবিধে নেই যে সেই ঘরের চাবি পেতে একগাদা টাকা দিতে রাজি থাকবে অনেকেই। ববের কাছে আছে এই ঘরে ঢোকার চাবি, যা কিনা অন্তর্জালের বৈদ্যুতিন জগতে একটি গোপন সংখ্যা। কিন্তু আগেই বলেছি, শুরুতেই সংখ্যাটা জানিয়ে দিলে ববের চলবে না, অথচ বোঝাতে হবে যে সেটা তার জানা আছে। আর অ্যালিস শুধু নিশ্চিত হতে চায় ববের কাছে সত্যিই ঘরের চাবিটা অর্থাৎ সেই গোপন সংখ্যাটা আছে কিনা।
এটা বোঝার জন্যে অ্যালিস কী করবে? সে নজর রাখবে যে বব কোন দরজা দিয়ে ঢুকছে আর কোন দরজা দিয়ে বেরোচ্ছে। এক দিকের দরজা দিয়ে ঢুকে যদি অন্য দিকের দরজা দিয়ে বব বেরিয়ে আসতে পারে, তার মানে বোঝাই যাবে যে চাবিটা তার কাছে আছে। ফলে এক্ষেত্রে সমস্যার সমাধান পরিষ্কার।
কিন্তু মানুষের ঝামেলা সহজে মেটে না। তাই ববও এ ক্ষেত্রে কিছুটা গোলমাল পাকাতে পারে। ধরা যাক, সে একেবারেই চায় না যে অ্যালিস জেনে যাক, কোন সুড়ঙ্গ দিয়ে সে ঢুকছে। তাই বব চাইছে, সুড়ঙ্গের কাছে যাওয়া পর্যন্ত একটু দূরে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকবে অ্যালিস। বব কিছুটা ঢোকার পরে চিৎকার করে জানালে তখন অ্যালিস ঘুরে দাঁড়াতে পারে। অর্থাৎ অ্যালিস জানতে পারবে না যে বব কোন সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকছে, কিন্তু দেখতে পাবে যে সে কোন সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরোচ্ছে। এ বার তা হলে সমাধান কী ভাবে সম্ভব?
এখানেই কাজে লাগানো হয় সম্ভাবনাতত্ত্ব। বব ঢুকে যাওয়ার পর অ্যালিস উঁচু গলায় জানিয়ে দেবে যে কোন দরজা দিয়ে বেরোতে হবে। বব যে সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকেছে, অ্যালিস যদি সেই সুড়ঙ্গের কথাই বলে তা হলে ববকে আর চাবি খুলতে হবে না, যেখান দিয়ে ঢুকেছে, স্রেফ বেরিয়ে এলেই হল। কিন্তু অ্যালিস যদি অন্য দরজার কথা বলে, তখন চাবি খুলে ঘরে ঢোকা অন্য দরজা দিয়ে বেরোনো ছাড়া উপায় নেই।
তর্কের খাতিরে না হয় ধরে নেওয়া গেল যে, অ্যালিস এক বার এমন দরজার কথা বলল, যেখানে ববকে চাবিটা খুলতে হল না। কিন্তু, এই ঢোকা-বেরোনোর কাজটা যদি বারবার করা হয়, তা হলে বোঝাই যায় যে, একবার না একবার বব ধরা পড়ে যাবেই। আছেই দু'টি মাত্র সুড়ঙ্গ, তাই অ্যালিস একবার কোনও একটার কথা বললেও বারবার সেটাই বলবে, তা হওয়ার সম্ভাবনা কম, আসলে নেই বললেই চলে। তাই, একবার না একবার ববকে দরজা খুলতে হবেই। আর, সেটা করতে গেলে চাবিটি থাকতেই হবে।
পুনশ্চ: লালমোহনবাবুর খুব ইচ্ছা যে প্রখর রুদ্রের জ্ঞানের বহর বোঝাতে এই সম্ভাবনাতত্ত্বের বিষয়টিও রহস্যপোন্যাসে ঢুকিয়ে দেবেন। ফেলুদা অবশ্য তা শুনে হাঁ হাঁ করে উঠেছে। আপনারা বুঝতেই পারছেন, কেন।
———
ভাইরাস — জীবন থেকে মুঠোফোন
----------------------
।।১।।
ভাগ্যিস করোনার আক্রমণে বাড়াবাড়ি হতে পারে বুঝে লালমোহনবাবুকে আগেই সাবধান করেছিল ফেলুদা। কয়েকদিন আগে পর্যন্ত তিনি একেবারে সাদামাটা ছোট্ট মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন। গত কয়েক বছরে ফেলুদা বেশ কয়েকবার চাপাচাপি করে হাল ছেড়ে দিয়েছিল।
— "আমার দ্বারা এসব হবে না ফেলুবাবু। কতদিন ধরে পাবলিশার বলছে উপন্যাসগুলো কম্পিউটারে টাইপ করে দিতে। আমাকে একটা ভালো ল্যাপটপও দিয়েছিল। কিন্তু বাংলা টাইপ দূরে থাক, কম্পিউটারের সুইচ অন্য করতেই আমার গায়ে জ্বর আসে। আমার হল — কালি, কলম, মন, লেখে তিনজন। কী-বোর্ড আর মাউসের ভয়ে মাথা থেকে প্রখর রুদ্র তিন লাফ মেরে ভ্যানিশ হয়ে যায়।"
তবে কোভিদ-১৯ এর আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই ফেলুদা অনেক বেশি সিরিয়াস হয়ে গেছিল। শুরুতে কয়েকদিন চোখ কুঁচকে ভাবছিলও অনেকটা সময় ধরে। শীতের সকালে যোগব্যায়াম শেষ করে উঠে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল,
— "বুঝলি তোপসে, এবারের ভাইরাসটা কিন্তু অত সহজ সরল বলে মনে হচ্ছে না। সার্স বা মার্স গোত্রের হলেও এর চরিত্রে অনেক বেশি গোলমাল আছে। সত্যিই উহানের উদ্ভট পশুপাখির বাজার থেকে ভাইরাসটা এলো, নাকি বানানো হল কোন ল্যাবরেটরিতে, তা হয়ত কোনদিনই জানা যাবে না। তবে জীবাণুটা এমনই সাংঘাতিক যে দুতিন মাসের মধ্যে কিন্তু একেবারে সভ্যতার সংকট ঘটে যেতে পারে।"
জানুয়ারি শেষের দিকে এক সন্ধেয় সেই গল্পই হচ্ছিল। ফেলুদা আবার মনে করিয়ে দিল।
— "শুনুন লালমোহনবাবু, এযাত্রা খুব তাড়াতাড়ি স্মার্টফোন নিয়ে নিন। করোনার উপদ্রবে কিন্তু দেশের সব কিছু থমকে যেতে পারে। স্মার্টফোন না থাকলে যে কত ঝামেলা তা তখন হাড়ে হাড়ে টের পাবেন।"
ভাগ্যিস লালমোহনবাবু কথা শুনেছিলেন। আর কথা শোনা শুধু নয়। মাসখানেকের চেষ্টায় একেবারে এক্সপার্ট। এই মার্চের শেষ রবিবারে "লকডাউনে লালমোহন" গড়পাড়ের বাড়িতে বসে যে ২১ রজনী সেন রোডে উঁকি মারছেন, তার কৃতিত্ব ফেলুদার সঙ্গে জটায়ুকেও দিতে হবে। একেবারে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল। কত কি যে শিখে নিয়েছেন এরমধ্যে। এমনকি খাতায় লিখে তার ছবি তুলে পাঠিয়ে দিচ্ছেন প্রকাশককে।
জানালেন এবারের পুজোতে একেবারে হাইটেক প্রখর রুদ্রকে খুঁজে পাওয়া যাবে। এমনিতে শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি ঘুরে বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চার করবেন হিরো। গত শীতে জটায়ু যেহেতু ওইদিকটা ঘুরে এসেছিলেন তাই উপন্যাস নিয়ে গিয়ে ফেলেছেন আসামে। তবে শেষমেশ যখন বললেন যে প্রখর রুদ্র নাকি এমন যন্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেছে যে একেবারে তরঙ্গপথে অন্যের কম্পিউটারে ঢুকে যাবে, তখন বাধ্য হয়ে ফেলুদাকে আবার নাক গলাতে হল।
— "এতোটা বাড়াবাড়ি করবেন না লালমোহনবাবু। বাংলার ছেলেমেয়েরা চট করে এতোটা গাঁজা টানতে চাইবে না। তার থেকে বরং প্রখরবাবুকে সফটওয়্যার বিশারদ করে দিন, যিনি কিনা ভাইরাসের প্রোগ্রাম লিখতে পারেন। সেই ভাইরাস তিনি অন্তর্জালের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেবেন ভিলেনের কম্পিউটারে। সেখান থেকে তথ্য চুরি করে আনবে প্রখরবাবুর প্রোগ্রাম।"
এর মধ্যে মুঠোফোনের দৌলতে প্রযুক্তির অনেকটাই শিখেছেন লালমোহনবাবু। কিন্তু সর্দিজ্বর থেকে কোভিড-১৯ পর্যন্ত জীবনমুখী ভাইরাসের কথা জানলেও, কম্পিউটারের ভাইরাস সম্পর্কে খুব কিছু বুঝে উঠতে পারেন নি। তাই ফেলুদাকে আবার একটা ছোট্ট লেকচার দিতে হল। সেটাই হুবহু টুকে দিলাম নিচে।
।।২।।
কম্পিউটার বলুন কিংবা মুঠোফোন, সবেরই মূলত দুটো ভাগ — হার্ডওয়্যার আর সফটওয়্যার। প্রথমটা হল যন্ত্রটা, যার মধ্যে আছে বিভিন্ন বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি। আর তার ওপরে লেখা হয় কিছু নির্দেশ। একেবারে মানুষের ভাষায় নয়, তবে অনেকটা সেই রকমই নিয়ম মেনে। সেই নির্দেশগুলো পরপর কাজ করে যন্ত্রের ওপর। এদের বলা হয় কম্পিউটার প্রোগ্রাম, যা সফটওয়্যারের অন্তর্গত। আজকাল অন্তর্জালের কল্যাণে আপনি সবসময়েই অনলাইন। অর্থাৎ সারা বিশ্বের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ একেবারে খোলা রাস্তায়। ফলে আপনি সুবিধেমত যখন তখন অন্যের লেখা প্রোগ্রাম নিজের কম্পিউটারে নামিয়ে নিতে পারেন। স্মার্টফোনও একধরণের কম্পিউটার। সেখানে আমরা যে প্রোগ্রামগুলো নামিয়ে আনি তাদের বলে অ্যাপ্লিকেশান, বা ছোট করে বহুবচনে অ্যাপস। একটু ভেবে দেখলেই বুঝবেন যে এই সমস্ত প্রোগ্রাম যে আসলে কি কাজ করে সেটা বোঝার মত প্রযুক্তিগত জ্ঞান সাধারণ মানুষের নেই। এ বিষয়ে প্রচুর জানা থাকলেও এই যে হাজার হাজার অ্যাপস তাদের মধ্যে আদতে কি কি লেখা আছে তা বোঝা খুব শক্ত। আর এই পথেই আসে বিপদ। ধরুন অন্তর্জালের মাধ্যমে ডাউনলোড করেছেন কোন সিনেমা দেখার সফটওয়্যার। সঙ্গে ঢুকে পড়েছে অন্য কোন চর। যে কিনা আবার আপনার যন্ত্র থেকে সুযোগ পেলেই ইন্টারনেট বেয়ে ঢুকে পড়বে অন্যের যন্ত্রে। এবার নিজের কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনে যে সমস্ত গোপন তথ্য রাখা আছে তা যদি সঠিকভাবে সুরক্ষিত না থাকে তাহলে সমস্ত কিছুই চলে যাবে দুষ্টু লোকের হাতে। এমনকি আপনার যন্ত্রে সঠিকভাবে কাজ করা বেশ কিছু সফটওয়্যারকেও গোলমাল করে দিতে পারে সেই প্রোগ্রাম। অর্থাৎ এই ধরণের প্রোগ্রাম কাজ করে ভাইরাসের মতই। আপনার যন্ত্রে ঢুকে পড়ে ক্ষতি করে আর সুযোগমত সেখান থেকে পাড়ি দেয় অন্য কোন যন্ত্রে।
"সাবধানে লিখবেন লালমোহনবাবু। ভুলভাল প্রোগ্রাম লিখে ফেলে উল্টে প্রখর রুদ্রের কম্পিউটারে যেন ভিলেনের ভাইরাস ঢুকে না যায়", ফেলুদা অবশ্যই বিধিসম্মত সতর্কীকরণ শুনিয়ে দিয়েছে।
-----------