শনিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৯

পূর্ণেন্দু পত্রী মশাই মার্জনা করবেন ~ রৌহীন ব্যানার্জি

তোকে আমরা কী দিইনি নরেন?

আগুন জ্বালিয়ে হোলি খেলবি বলে আমরা তোকে দিয়েছি এক ট্রেন ভর্তি করসেবক। দেদার মুসলমান মারবি বলে তুলে দিয়েছি পুরো গুজরাট। তোর রাজধর্ম পালন করতে ইচ্ছে করে বলে পাঠিয়ে দিয়েছি স্বয়ং আদবানীজীকে, কড়ি নিন্দার সাথে আশীর্বাণী পাঞ্চ করিয়ে খাইয়েছি তোকে। সমস্ত বিরোধী দল, বিরোধী জাতকে বলেছি সরে যাও, নরেন এখন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার খেলা খেলবে।

তোকে আমরা কী দিইনি নরেন?

মঞ্চে আদবাণী, মুরলী মনোহরদের সাইড করে সবার আগে বসতে দিয়েছি তোকেই। রেডিওতে সবার আগে মন কী বাত। তোর যখন উড়তে ইচ্ছে হয়েছে, হাজার কোটির বিমান দিয়েছি তোকে, সাজতে ইচ্ছে করলে দশ লাখি স্যুট। সারা পৃথিবী ঘুরে বেরিয়েছিস তুই, আমরা অনাহারক্লিষ্ট মুখে তোকে শুভযাত্রা বলেছি বারবার।

তোকে আমরা কী দিইনি নরেন?

তুই রেডিওয় বক্তৃতা দিবি, জাতির উদ্দেশে ভাষণ, ঘন্টার পর ঘন্টা এটিএম এর লাইনে দাঁড়িয়ে তার দাম মিটিয়েছি আমরা। তুই অর্থনীতির কোমর ভেঙেছিস ইচ্ছামত, আমরা বলেছি সিয়াচেনে পাহারা দিচ্ছে সৈন্য। তুই জি এস টি র নামে ধ্বংস করেছিস ছোট ব্যবসা, আমরা বলেছি এসব দুর্নীতি দমন, দেশের জন্য ত্যাগ। তুই দুই কোটি বেকারকে পকোড়া ভাজতে বলেছিস, আমরা বুঁদ হয়েছি চপশিল্পের স্বপ্নে।

তোকে আমরা কী দিইনি নরেন?

তিনশোর কমে তোর আসন যেন না থাকে তা নিশ্চিত করেছি আমরা। তুই একের পর এক নির্বাচিত সরকার ভাঙিয়েছিস অমিতকে দিয়ে, আমরা চাণক্য বলে চিৎকার করে পাড়া মাৎ করে দিয়েছি। তুই আখলাক, আফরাজুল, পেহলুদের খুনের পর খুন করিয়ে গেছিস, আমরা বলেছি স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ। উন্নাও, কাঠুয়া, লক্ষ্ণৌ, হায়দরাবাদ - তুই ধর্ষকদের আশ্রয় দিয়ে গেছিস, আমরা বলেছি বিরোধিদের ফ্রাসট্রেশন। বেকারত্ব পৌঁছেছে সর্বোচ্চ হারে, বৃদ্ধি তলানিতে, আমরা বলেছি মন্দা নয়। পেঁয়াজের দাম একশো টাকা হলে বলেছি কদিন পেঁয়াজ খাবেন না।

তোকে আমরা কী দিইনি নরেন?

তোর বন্ধু মুকেশ, গৌতম ব্যাঙ্ক থেকে নিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি - আমরা বলেছি তুলে দাও অলাভজনক ব্যাঙ্ক। তোর প্রিয় মেহুল, নীরব, বিজয়, ললিতেরা পালিয়েছে লন্ডনে, আমরা বলেছি ফেরৎ আসবেই কালো টাকা। দাউদের টাকায় সরকার গড়তে চেয়েছিস মহারাষ্ট্রে, আমরা বলেছি ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবে। ভাইপো জয় লক্ষ কোটি চুরি করে হয়ে গেছে বিসিসিআই সেক্রেটারি, আমরা সৌরভ গাঙ্গুলিকে বশংবদ ভৃত্যের মত দাঁড় করিয়ে দিয়েছি পিছনে। তোর প্রিয় মোটাভাইকে দিয়েছি ক্লিনচিট - "নোবডি কিলড জাস্টিস লোহিয়া" বলে।

তোকে আমরা কী দিইনি নরেন?

তোর জন্য বিচারবিভাগ ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে উপেক্ষা করে মান্যতা দিয়েছে ধর্মীয় "বিশ্বাস" কে। তোর জন্য বাতিল হয়ে গেছে রাফালের তদন্ত। তোর জন্য আমরা বিনা দোষে ঢুকে পড়েছি ডিটেনশন ক্যাম্পে, মুখে তুলে নিয়েছি ফলিডলের শিশি - শুধু তুই নিশ্চিন্তে সাম্প্রদায়িক তাস খেলবি বলে। তোরই জন্য মেনে নিয়েছি দেড়শো দিন বিচ্ছিন্ন থেকে কাশ্মিরে বয়ে যাবে উন্নয়নের জোয়ার। শুধু তোরই জন্য গলায় দড়ি দিতেও দ্বিধা করেননি সহস্র কৃষক।

তোকে আমরা কী দিইনি নরেন?

তোরই কথা ভেবে আমরা আজও স্বপ্ন দেখি, নাগপুর একদিন ভারতের ন্যুরেমবার্গ হবে। তোর শরীরে সোনালি গয়নার মত আদর করবে রোদ্দুর রায়ের স্বপ্ন। আচ্ছে দিন আসবেই ভারতভূমিতে।

পিতৃতান্ত্রিক ধর্ষণ সংস্কৃতি ~ শতাব্দী দাস

বর্তমান ভারতে হিন্দু-মুসলিম মিলে হাতে হাত ধরে তাহলে একটি কাজই সম্পন্ন করতে পারে। ২৬ বছরের একটি মেয়ের গণধর্ষণ। তারপর পুড়িয়ে দেওয়া। এ আদিম বিকারই সাম্প্রদায়িক সমন্বয় ঘটায়, এমনকি বিজেপির ভারতেও। 

কেউ বলছেন, হায়দ্রাবাদ হজম করে ওঠা গেল না, তারপরেই রাঁচি...তারপরেই কলকাতায় কালীঘাট...এ কী! হঠাৎ গণধর্ষণের মরশুম শুরু হল নাকি? 

তাঁদের জানাই, গণধর্ষণের মরশুম বছরভর চলে, স্ট্যাটিস্টিক্স বলছে। কিন্তু যেহেতু একটি নির্মম গণধর্ষণের খবর ভেসে উঠেছে, তাই এখন কিছুদিন সংবাদপত্রগুলো গণধর্ষণের খবর বেশি কাভার করবে। এমনিতে এসব রোজই ঘটে। রোজই। 

যাঁরা (ধরে নিচ্ছি প্রচণ্ড আঘাত পেয়েই) হায়দ্রাবাদের মেয়েটির উপর ঘটে যাওয়া নির্মমতার গ্রাফিক বর্ণনা দিচ্ছেন, তাঁদের অনুরোধ, এটা করা বন্ধ করুন। আমরা খবরের কাগজে পড়ে নিয়েছি।  না, 'বারবার পড়ে আমার অসুস্থ লাগছে' ধরণের কোনো ব্যক্তিগত কারণে নয়। দেখা গেছিল, জ্যোতির মৃত্যুর পর যোনিতে রড-টড ঢুকিয়ে দেওয়ার ঘটনা আরও বেশ কিছু ঘটেছিল। কে জানে,  এইবার পুড়িয়ে দেওয়াটাই ট্রেন্ড হবে কিনা! 

আর হ্যাঁ, এবার ফাঁসিবাদীরা জেগে উঠবেন৷ 'ফাঁসি দাও, লিঙ্গকর্তন করো, জনসমক্ষে কোরো' ইত্যাদি শোনা যাবে।  ধর্ষকের মানবাধিকার নিয়ে কি আমি   চিন্তিত?  না।।

 আমি শঙ্কিত, কারণ আজ যাঁরা ফাঁসি চাইবেন, তাঁদেরই কাল  রেপ জোক বলতে শুনব, রেপ রেটরিক ব্যবহার করতে শুনব। এঁরা বলবেন, ভারতের ক্রিকেট টিম তো বাংলাদেশকে রেপ করে দিল! এরা সামান্য ঝগড়া হলেই প্রতিপক্ষের মাকে চুদে দিতে চাইবেন৷ একে আমরা 'রেপ কালচার' বলি। ধর্ষণ সংস্কৃতি৷ যেখানে রেপ আসলে এতই সামান্য ঘটনা যে তাকে নিয়ে মস্করা চলে। মস্করার প্রতিবাদ  যারা করে, তারা  'ফেমিনিস্ট কিলজয়'। আমরা রেপ কালচারে বাস করি। এখানে মুড়ি মুড়কির মতো রেপ ঘটবে, এ আর আশ্চর্য কী? 

ধর্ষক এই সমাজ থেকেই স্বাভাবিক ভাবে  উদ্ভুত। তারা বহিরাগত নয়।  তারা শিং-লেজ-নখ বিশিষ্ট আজিব প্রাণী নয়। কিংবা ওরকম জন্তু আসলে সবার মধ্যেই থাকতে পারে, পিতৃতাতন্ত্রিক জলহাওয়ায় বাড়তে পারে তারা। জান্তবতার দায় হাতে গোণা কয়েকজন ধর্ষকের উপর চাপিয়ে তাদের শূলে চড়িয়ে দিলেও কাল থেকে আমি বা আমার মেয়ে  এই কারণেই নিরাপদ নই৷ আর ঠিক এই কারণেই সম্পূর্ণ ধর্ষণ সংস্কৃতির বিরোধিতা করা কর্তব্য মনে করি। এ'কারণেই স্বেচ্ছায়
 'ফেমিনিস্ট কিলজয়'। 

  কালিঘাটের ভিখারি মেয়েদুটির ধর্ষণ  যারা ঘটিয়েছে, তাদের বয়স তের ও চোদ্দ। এদের ভিতরে জন্তুকে জাগিয়ে তোলার দায় আপনি ও আপনার পিতৃতান্ত্রিক ধর্ষণ সংস্কৃতি  ঝেড়ে ফেলতে পারবে তো?

ভারতবর্ষ ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

একটা বেঞ্চে ধরুন পাশাপাশি বসে আছে ওরা। পেশেন্ট নম্বর এক। মহিলা মাঝবয়সী, মাছের বাজারে প্রতি সপ্তাহেই দেখি। সামান্য পয়সার বিনিময়ে মাছ কেটে কুটে দেন। সেটাই পেশা। মাছ কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলে ফিনকি দিয়ে রক্ত। জল দিয়ে ধোয়ার পরে রুমাল বের করে বেঁধে দিলাম। মাছের বাজারে ফার্স্ট এইড আর কি বা হবে। হাসপাতালে যেতে বললাম। সেলাই লাগবে। মহিলার দু চোখ দিয়ে অঝোরে জলের ধারা। কেন মাসি কাঁদছো কেন। খুব ব্যথা ? ব্যাথা নয় বাবু। সেলাই মানেই তো সাত দিন কাজ বন্ধ। রোজগার বন্ধ। খাবো কি ?

পেশেন্ট নম্বর দুই। বছর দশেক এর একটি বালিকা। বেআইনি বাজি কারখানায় ততোধিক বাজি বানাতে গিয়ে মুখের ওপরেই ফেটেছে। চোখ মুখ আগুনে ঝলসে গেছে। পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে। চোখটা বোধ হয় বাঁচবে না। সঙ্গে আসা স্বামী পরিত্যক্ত মায়ের আরো বড় চিন্তা, পরিবারে রোজগারের একটা লোক কমে গেল।

বেঞ্চে বসে থাকা তিন নম্বর। সতেরো আঠেরো বছরের কিশোর। গ্যারেজে কাজ করে। হেড মিস্ত্রির হেল্পার। কালি ঝুলি মাখা কিশোরটি কে সেই নিয়ে এসেছে। গাড়ির তলায় শুয়ে কাজ করছিল। জ্যাক উল্টে গিয়ে গোটা গাড়িটা তার সমস্ত ওজন নিয়ে পায়ের ওপরে পড়েছে। দুটো পাই বিশ্রী রকম থেঁতলে গেছে। একটা পা সম্ভবতঃ এমপুট করতে হবে। হেড মিস্ত্রির আকুল জিজ্ঞাসা, পা টা কোনভাবেই বাঁচানো যাবে না ডাক্তারবাবু ? পা চলে যাওয়া মানে তো বেকার হয়ে যাবে আবার।

পেশেন্ট নম্বর চার। চব্বিশ পঁচিশ এর যুবক। এ কাঁদছে না। ক্লান্ত দেহটা নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। জন্ডিস হয়েছে, আমাদের ভাষায় ইফেক্টিভ হেপাটাইটিস। অন্ততঃ একমাস বিশ্রাম নিতে হবে এই পরার্মশ শুনে একটু বাদেই ছেলেটার মুখ থমথমে হয়ে যাবে। কেনরে ছেলে ?  বিএ পরীক্ষা দেব ডাক্তারবাবু। অভাবের সংসারে লেখাপড়ার খরচ চালানোর জন্য রোজ সকালে আপনাদের বাড়িতে খবরের কাগজ বিলি করি একটা সাইকেল নিয়ে। বিশ্রাম মানে কাজটাই চলে যাবে। শুধু রোজগার না। পড়বো কি করে ? 

বেঞ্চের পাঁচ নম্বর ব্যক্তি মাঝবয়সী লোক। চিন্তা ভাবনায় বয়সের থেকে বেশি বুড়ো লাগছে। টিবি রোগ ধরা পরতে শপিং মলের সেলস ক্লার্ক এর চাকরিটা গেছে। দু মাস তো ওষুধ খেলাম ডাক্তারবাবু।  আমার অসুখটা কি এখনো ছোঁয়াচে ? একবারটি লিখে দেবেন আমি সেরে গেছি। যদি চাকরিটা আবার ফিরে পাই ?

হাসপাতালের আউটডোর/এমার্জেন্সির বেঞ্চে বসা কয়েকটা লোক। মানুষ। পেশেন্ট আমাদের কাছে। আসলে এক টুকরো ভারতবর্ষ। ডাক্তারের অপেক্ষায় আছে। কখন সেই ধন্বন্তরীর দেখা পাওয়া যাবে। যিনি দেখা দিলেই সব ভালো হয়ে যাবে। ঠিক হয়ে যাবে। 

আউটডোর/ ইমারজেন্সিতে আজ আমার যে বন্ধু বসবেন গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে এই ভারতবর্ষ কে দেখতে, তার ভূমিকায় একবার নিজেকে কল্পনা করে দেখবেন একটি বার ? স্টেথো ঝুলিয়ে ডাক্তার সেজে সারিয়ে তোলা যাবে তো এই ভারতবর্ষ কে ?

কাটা হাত, পোড়া মুখ, ভাঙা পা, বেড়ে যাওয়া লিভার, ফোপরা ফুসফুস নিয়ে ভারতবর্ষ বসে আছে পাশাপাশি। কাছাকাছি ঘেঁষাঘেষি করে। অপেক্ষায় আছে। আমার আপনার অপেক্ষায় ।

রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৯

জামুন কা পেড় ~ অরিজিৎ গুহ

বেলা আর বাতুল এর গল্প শুনেছেন? অনেকেই শোনেন নি হয়ত। আসুন শুনে নি। গল্পটা আমরা শুনছি বোম্বের প্রসিদ্ধ ফরাস রোডের এক তওয়াইফের মুখ থেকে।
    বেলা ছিল রাওয়ালপান্ডির কাছের একটা গ্রামের মেয়ে। ক্লাস ফোরে পড়ত। বাবার খুব আদরের মেয়ে ছিল। এগারো বছর বয়স। আর কয়েকবছর পরেই হয়ত গ্রামেরই কোনো গরীব ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হত, তারপর সুখে ঘরকন্না করতে পারত। 
    কিন্তু হঠাৎ করেই কী হল, একদিন আল্লাহ হো আকবর বলে একদল লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল বেলার বাড়ির ওপর। বেলার বাবাকে তরোয়ালের কোপে ধর থেকে মুন্ডুটা আলাদা করে দিল, মায়ের স্তন কেটে দিল, আর আরো যেসব হিন্দু বাড়ি ছিল সব বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল। গ্রান্ট রোডের এপারে ফরাস রোডে জিন্নাহ্ সাহেব কোনোদিনও আসবেন না। শরিফ আদমিরা কখনো গ্রান্ট রোড ক্রস করেন না।কিন্তু জিন্নাহ্ সাহেব একবার যদি বেলার সাথে দেখা করতেন, তাহলে হয়ত বেলাকে বোঝাতে পারতেন বেলার সাথে যা হয়েছে তা করার অধিকার কোরাণে কোনো মুসলমানকে দেয় নি। 
    বেলা এরপর পালিয়ে চলে আসে রাওয়ালপিন্ডি। সেখানে এক মুসলিম দালাল ওকে নিজের হেপাজতে করে নেয়। সেই দালালের থেকে আরেক দালাল ওকে কিনে নেয়। তারপর বেলার ঠাঁই হয় ফরাস রোডের তওয়াইফখানায়। বেলার মুখটা যদি জিন্নাহ্ সাহেব দেখতে পেতেন, তাহলে বুঝতেন 'মাসুমিয়াত কি কোই মজহব নেহি হোতি'। এক সরল নিষ্পাপ বাচ্চা মেয়ের মুখ। সেই মুখে ধর্ম লেখা নেই। সেই মুখে হিন্দুস্তান পাকিস্তান লেখা নেই। সেই মুখ হিন্দু মুসলিম শিখ ইসাই যে কারো মুখ হতে পারে। জিন্নাহ্ সাহেবের বাংলোতে যে বেলার চিৎকারের আওয়াজ পৌঁছায় না!

   বাতুল থাকত জলন্ধরের কাছের এক গ্রামে। বাবা খুবই গরীব। মুটে মজুরি করে চালায়। অনেকগুলো দিদি আর ভাইদের নিয়ে তার মধ্যেও শান্তিতে থাকত ওরা। বাতুলদের গ্রামে 'নমাজ আদা' করার কোনো হুকুম ছিল না। বাতুল কোনোসময়ে জিন্নাহ্ সাহেবের গল্প শুনেছিল। সেই থেকে জিন্নাহ্ সাহেবকে খুব পছন্দ করত। গলায় একটা লকেট ঝুলিয়েছিল জিন্নাহ্ সাহেবের ছবি দিয়ে। 
    হিন্দুস্থান পাকিস্থান ভাগ হওয়ার পর বাতুল স্লোগান দিয়ে ফেলেছিল পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে। ঠিক যেরকমভাবে পাঁচ ছ'বছরের বাচ্চা কোনো কিছু না বুঝেই ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়ে ফেলে, সেরকমই আরকি। 
   সেই স্লোগান শুনে গ্রামের জাঠরা এসে প্রথমে ওর বাবার জামা কাপড় খোলাল, তারপর মুখে পেচ্ছাপ করল, তারপর বাবার বুকে ছুরি ঢুকিয়ে দিল। দিদিদের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলে গেল আড়ালে। 
   এরপর বাতুলকে যখন এক হিন্দু দালালের থেকে ফরাস রোডের ওই তওয়াইফ কিনে নিল, তখন সে দেখেছিল বাতুলের সারা গায়ে আঁচড় কামড়ের দাগ।  পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু তো অনেক পণ্ডিত মানুষ আর উনিও অনেক শরিফ আদমি। তাই উনিও কখনো ফরাস রোডের তওয়াইফখানায় ঢুকবেন না কোনোদিন। কাজেই বাতুলকেও দেখতে পাবেন না কোনোদিন। যদি দেখতে পেতেন, তাহলে হয়ত উনি বোঝাতে পারতেন যখন বাতুলের সাথে এরকম হচ্ছিল, তখন ঋকবেদ স্তম্ভিত হয়ে গেছিল। গুরু গ্রন্থসাহিব বোবা হয়ে গেছিল। কারণ দুই কিতাবের কোথাও যে লেখা ছিল না বাতুলের সাথে এরকম ব্যবহার করার কথা।
    নেহেরুজি'র বাংলোতে যে বাতুলের চিৎকারের আওয়াজ পৌঁছায় নি। নেহেরু জি কী করবেন!

 কৃষণ চন্দর যখন 'এক তওয়াইফ কি খৎ জিন্নাহ্ সাব অউর নেহেরু জি কো' লিখেছেন তার কিছু আগেই আজাদি এসেছে। কিন্তু তাও বারেবারে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করে গেছেন কৃষণ চন্দর।
    'মহালক্সমী কা পুল' গল্পে মহালক্সমী পুলের পাশে বসবাসকারী নিম্নবিত্ত শ্রমিক বস্তির যে ছবি এঁকেছেন তার প্রতিটা ছত্রে লুকিয়ে রয়েছে ভদ্র সভ্য উচ্চবিত্তদের প্রতি বিদ্রুপ। 
   পুলের পাশে মিল মজদুররা তাদের নিজেদের নিজেদের চওলে থাকে। পুলের ওপর ওদের স্ত্রীদের শাড়ি শুকোতে দেওয়া হয়। পাশাপাশি ছটা শাড়ি শুকোতে দেওয়া হয়েছে। শান্তাবাঈ এর ফ্যাকাসে বাদামী রঙের শাড়ির পাশে যে শাড়িটা ঝুলছে শুকোতে দেওয়ার জন্য, সেই শাড়িটাও পাঠকদের চোখে ফ্যাকাসে বাদামী রঙই মনে হবে। কিন্তু কথক, যিনি একজন পয়ষট্টি টাকা মাইনের ক্লাস টেন পাস করা ক্লার্ক, যখন থেকে শাড়িটা দেখেছেন তখন সেটার রঙ ছিল গাঢ় বাদামী। পুরনো হয়ে রঙ হাল্কা হয়ে হয়ে সেটা ফ্যাকাসি বাদামী রঙে পর্যবসিত হয়েছে। তার পাশে রয়েছে মিল থেকে বহিষ্কৃত শ্রমিক ঝাব্বুর স্ত্রী লোড়ির শাড়ি। লোড়ির শাড়ির পাশে ঝুলছে মঞ্জুলার শাড়ি। সব থেকে ঝকমকে শাড়ি ওটা। কারণ মঞ্জুলার কয়েকমার আগে বিয়ে হয়েছে আর বিয়ের শাড়িটাই ঝুলছে। মঞ্জুলার স্বামী কিন্তু অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। মঞ্জুলার পাশে শেষ সে শাড়িটা ঝুলছিল সেটা ছিল বুড়ি মা। যার ছেলে সিতু এখন জেলে। সরকার থেকে যখন হরতাল বে আইনি ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন সিতুরা জুলুস বের করেছিল হরতালের সমর্থনে। পুলিশ থেকে মহালক্সমি পুলের পাশের চওলে গুলিবৃষ্টি চলে। সবাই ভয় পেয়ে নিজের নিজের চওলের দরজা বন্ধ করে দেয়। পরে যখন সব শান্ত হয়ে যায় তখন দেখা যায় সিতুর মা গুলি খেয়ে মরে পড়ে আছে। বুড়ি মানুষ, হয়ত তাড়াহুড়ো করে নিজের খোপরে ঢুকতে পারে নি। সেই লাল শাড়িটা এখন পরে সিতুর বৌ। সিতু হরতাল করার জন্য জেলে রয়েছে।
    একটু পরই মহালক্সমী পুলের ওপর দিয়ে 'ওয়াজির এ আজম' মানে প্রধানমন্ত্রীর কনভয় যাবে। প্রধানমন্ত্রীর চোখেও সেই ঝোলানো শাড়িগুলো চোখে পড়বে না। যতক্ষণ না প্রধানমন্ত্রীর কনভয় যায় ততক্ষণ ধরে সেই শান্তাবাঈদের কলোনির গল্প শুনিয়েছেন কৃষণ চন্দর। 
   যুবতী শান্তাবাঈ, বৃদ্ধা জীবনা বাঈ বা কথকের মধ্যবয়সী স্ত্রী সবার গল্প মোটামুটি একইরকমের। প্রতি পদে অর্থের হাহাকার, ছোট্ট ছোট্ট সাধ আহ্লাদ আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ না হওয়ায় জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা আর তারই সাথে কুসংস্কার, সব যেন একসাথে হাত ধরাধরি করে রয়েছে। সবার শাড়িগুলো একসাথে যখন পাশাপাশি উড়তে থাকে তখন প্রত্যেকের শাড়ির রঙগুলো আর আলাদা করে চেনা যায় না।
   প্রত্যেকের গল্প বলতে বলতেই কখন যে প্রধানমন্ত্রীর কনভয় চলে যায় বোঝাও যায় না। আসলে কনভয় তো এই মহালক্সমী পুলের পাশে দাঁড়াবে না, প্রধানমন্ত্রীর অত ঠেকাও পড়ে নি। কিন্তু ওই ছ'টা শাড়ি যেন ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতিদিনের গল্প বলে যায়।
   ১৯৩৬ সালে যখন প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন তৈরি হয় প্রেমচন্দকে সভাপতি আর সাজ্জাদ জাহিরকে সম্পাদক করে, তখন সেই সংগঠন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইকবাল আর নজরুলের আশীর্বাদ ধন্য হয়ে ওঠে। উর্দু সাহিত্য সেই সময়ে মোটামুটি আগের অবাস্তব আবেগের জায়গা থেকে অনেকটাই সরে এসেছে বাস্তবের মাটিতে। 
    প্রথম সম্মেলনে আহম্মদ আলি, আলি আব্বাস হুসায়নী, মুলকরাজ আনন্দ, খাজা আহমেদ আব্বাস, শওকত সিদ্দিকে, গোলাম আব্বাস, আহমেদ নাদিম কাশমী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য নাম হলেও চারজন যারা পরবর্তীকালে উর্দু সাহিত্যের স্তম্ভে পরিণত হয়েছিলেন তারা হলেন সাদাত হাসান মান্টো, রাজিন্দার সিং বেদি, ইসমাত চুঘতাই আর কৃষণ চন্দর। বলা যায় এই চারজন উর্দু সাহিত্যকে শাসন করেছেন। তবে বাকি তিনজন যেমন চরিত্রদের মনস্তাত্ত্বিক জগৎ নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা করেছেন কৃষণ চন্দর আবার চিরকাল সাহিত্য রচনা করে গেছেন শোষিত শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে। প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের পতাকা সার্থক ভাবে বয়ে নিয়ে গেছেন। মান্টোর মতই দাঙ্গা আর দেশভাগকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন।
    'গাদ্দার' গল্পে বৃদ্ধ বুলাকি শাহ চারিদিকের শয়ে শয়ে পড়ে থাকা লাশের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে কী যেন খুঁজতে থাকে। বৈজনাথের কন্ঠে চমকে উঠে বলে 'আমি মুসলমান। আমাকে মেরো না।' জবাবে বৈজনাথ যখন বলে মুসলমান হলে এখানেই তোর লাশ ফেলে দেব, তখন উত্তরে বুলাকি শাহ জানায় আমি বুলাকি শাহ। বৈজনাথ এবার আশ্চর্য হয়। গ্রামের সব থেকে বড় মহাজন বুলাকি শাহ! বৈজনাথ জিজ্ঞাসা করে এখানে কী করছ? ততক্ষণে বুলাকি শাহ ভয় কাটিয়ে উঠেছে। বলে সব তো মরে পড়ে রয়েছে এখানে। আমার পরিবারেও কেউ বেঁচে নেই, সম্পত্তিও সব লুঠপাট হয়ে গেছে। শুধু মেয়েটা বেঁচে রয়েছে। তা মেয়েটাকে তো বিয়ে দিতে হবে। যা পাচ্চি এখান থেকে সোনাদানা তাই হাতিয়ে নিচ্ছি পকেট থেকে। তুমিও এসো না। যা পাব ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে নেব।
    স্তম্ভিত হয়ে যায় বৈজনাথ। মানুষ কোথায় নামতে পারে ভেবে! বুলাকি শাহ বলে মেয়ের বিয়ের যৌতুক ছাড়া কেউ তো মেয়েকে বিয়ে করবে না।
    দেশভাগ আর দাঙ্গার নানারূপ দেখেছেন কৃষণ চন্দর। বরাবর গল্প বলেছেন নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া গরীব মানুষের। তাঁদের দুঃখ দুর্দশা, লড়াই করা হেরে যাওয়া এবং আবার জানকবুল লড়াই এর জন্য উঠে পড়া, এই গল্পই শুনিয়ে গেছেন। তেলেঙ্গানা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে 'রোটি কাপড়া মকান' এক অদ্ভুত গল্প। 
   খাজা আহমেদ আব্বাস যখন সিনেমা করবেন বলে ঠিক করলেন, তখন বাংলার বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন' আর 'জবানবন্দি' এই দুটো নাটকের গল্প শোনা হয়ে গেছে। ৪৩ এর মন্বন্তরকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন আব্বাস। এরপর কৃষণ চন্দরের 'অন্নদাতা' গল্পে পড়ে ঠিক করলেন তিনটে গল্পকে একসাথে নিয়ে একটা সিনেমা বানাবেন বাংলার ৪৩ এর মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে।
    যথা সময়ে 'ধরতি কে লাল' সিনেমা তৈরি হল আইপিটিএ র সব রথী মহারথীর সাহায্যে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিও পেল সেই সিনেমা। এটাই একমাত্র সিনেমা যা আইপিটিএর নিজস্ব প্রযোজনায় তৈরি। সেখান থেকেই ফিল্ম জগতের সাথে যোগাযোগ তৈরি হয় কৃষণ চন্দরের। 
   এক সময়ে সিনেমার স্ক্রিপ্ট আর গল্প লেখার পেছনে এত সময় দিতে হয়েছিল যে তাঁর নিজের গল্পে সেই প্রভাব পড়েছিল। গল্পের ধার গেছিল কমে। 
    নীহাররঞ্জন গুপ্তের লেখা 'উত্তর ফাল্গুনি' হিন্দি স্ক্রিপ্ট 'মমতা' কৃষণ চন্দরেরই লেখা। এছাড়াও অসিত সেনের আরেকটি সিনেমা 'সরাফত' যেখানে ধর্মেন্দ্র হিরো ছিল তার গল্পও কৃষণ চন্দরের। কিন্তু তিনি নিজেও বুঝতে পারছিলেন যে সিনেমার জগতে থাকলে তার গল্পের মান নেমে আসছে। অবশেষে ছেড়ে দিলেন সিনেমার জগত। ১৯৭৭ এ যখন মৃত্যু হয় তখন হাসপাতালে তার বেডের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন দ্বিতীয় স্ত্রী  সালমা সিদ্দিকি। লিখতে শুরু করেছিলেন নতুন একটি গল্প। কয়েক লাইন লেখার পরই ঢলে পড়েন মৃত্যুর মুখে। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে নিভে যায় উর্দু সাহিত্যের এক স্তম্ভ কৃষণ চন্দরের জীবন দীপ। 
   
    ১৯৭৭ এ মৃত্যু হলেও একজন লেখক কতটা প্রভাবশালী হতে পারেন তার পরিচয় পাওয়া গেছে এই ২০১৯ এ এসে। গত মাসে এক সার্কুলার জারি করে আইসিএসসি বোর্ডের দশম শ্রেনীর সিলেবাস থেকে 'জামুন কা পেড়' বলে একটি গল্প বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। গল্পটিতে খুব তীক্ষ্ণভাবে মজার ছলে ভারতের ব্যুরোক্রেসির প্রতি, লাল ফিতের ফাঁসের প্রতি প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। সরকারের সেসব পছন্দ না হওয়াই স্বাভাবিক। কাজেই আজও কৃষণ চন্দর কতটা প্রাসঙ্গিক বোঝা যায়।

    ১৯১৪ সালের আজকের দিনেই অর্থাৎ ২৩ শে নভেম্বর জন্ম হয়েছিল কৃষণ চন্দরের।

শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৯

শওকত আজমী ~ অরিজিৎ গুহ

শওকত আর কাইফির যখন বিয়ে হয়, তখন শওকতের বয়স খুবই অল্প। সাংসারিক কোনোরকম অভিজ্ঞতাই নেই প্রায় বললেই চলে। স্বামী কাইফি কমিউনিস্ট পার্টির হোল টাইমার। পার্টির দেয় ভাতাতেই চালাতে হত সংসার। পার্টি থেকেই ওদের জন্য একটা কমিউন দেওয়া হয়েছিল যেখানে আরো তিনটে পরিবারের সাথে বোম্বেতে মাথা গোঁজার ঠাই হয়েছিল। 
   কাইফি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যের সাথে সাথেই ছিল প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। আর যুক্ত ছিল আইপিটিএ র সাথে। বাকি যে তিনটে পরিবার ছিল তারাও ছিল আইপিটিএর সদস্য। কাজে কাজেই অরঙ্গাবাদ থেকে আসা কিশোরী শওকতের থিয়েটার আর স্টেজ শো'র প্রতি আগ্রহ বেড়ে ওঠে। নিজেও যুক্ত হতে চায় থিয়েটারের সাথে। আর্থিক অনটনও একটা কারণ ছিল অবশ্য। থিয়েটার করলে কিছু অতিরিক্ত আয় করা যেত। 
   থিয়েটার করতে করতেই জড়িয়ে পড়লেন বোম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। আইপিটিএ'র সদস্যপদও ততদিনে নেওয়া হয়ে গেছে শওকতের। সন্তান হওয়ার পর সন্তানের পরিচর্যার সাথে সাথে অভিনয়ও চলতে থাকল। স্বামী কাইফি আজমি ততদিনে কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন সাহিত্য সমাজে। সিনেমার গানের লিরিক লিখে রোজগার বাড়তে শুরু করেছে। 
   আস্তে আস্তে একার হাতে সংসার আর ছেলে মেয়ে সামলে অভিনয় জগতে নিজের একটা স্বীকৃতি জোটাতে সক্ষম হলেন শওকত কাইফি বা শওকত আজমি। বোম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে স্বামীর পরিচয়ও কাজে দিয়েছিল অবশ্য এক্ষেত্রে। আস্তে আস্তে স্বছলতা এলো সংসারে। সেই সময়েই তাঁরা উঠে এলেন জুহুতে।
     
     মেয়ে শাবানাকে অভিনয় জগতে নিয়ে আসার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা ছিল মায়ের। চারের দশকের শেষদিক থেকে ২০০২ এ কাইফি আজমির মারা যাওয়া অব্দি দুজনের সম্পর্ক শুধুমাত্র দাম্পত্য সম্পর্কই ছিল না। দুজনেই ছিলেন দুজনের কমরেড। 
   সব থেকে কাছের কমরেড ২০০২ এ মারা যাওয়ার ১৭ বছর পর শেষ হল আরেক কমরেডের জার্নি। কিছুক্ষণ আগে মারা গেলেন শওকত কইফি বা শওকত আজমি। আজকের বলিউডের অনেকেই হয়ত এসেছেন ইতিমধ্যে শ্রদ্ধা জানাতে বা আসবেন, কিন্তু তাঁদের অনেকেই সেই আইপিটিএ'র লড়াইয়ের দিনগুলোর কথা জানবেন না।

   কমরেড শওকত আজমি লাল সেলাম।

সোমবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৯

শুভ চৌর কার্তিক পূজা ~ কৃষ্ণা সর্বরী দাশগুপ্ত

--'যাত্রা দেখে আলেন বুঝি, মাঠান?' প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে গেলেন নিভাননী। হেমন্তের ভোর। সবে আলো ফুটছে। সে আলোয় যেটুকু ঠাহর হয়, তাতে মনে হল, বারান্দায় চাদর মুড়ি দিয়ে চেয়ারে বসে আছে যেন কেউ। প্রশ্নটা তারই। হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে আসছিলেন তিনি। পাড়ার বাকি মেয়ে-বউরা পিছনে পড়ে গেছে। চেয়ার ছেড়ে ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে লোকটা। হাতের কাঁসার গেলাসটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে বলল," একটু চা করে খেয়েছি। তা' আমি কায়েতের ব্যাটা, রান্নাঘর অশুদ্দু করিনি আপনের।"
--"কিন্তু তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না, বাবা--"
--"চেনার কথাও নয়, আজ্ঞে। আমি চোর।" বিনীতভাবে কথাটা বলেই বারান্দার কোন থেকে কাপড়ের পুঁটলিটা তুলে নিয়ে একলাফে নিমেষে ধাঁ হয়ে গেলো লোকটা। নিভাননী ততক্ষণে সিঁড়িতেই বসে পড়েছেন ধপ করে।
কর্তা ঘুম থেকে উঠে সব শুনে বললেন," বাঃ, বেশ সপ্রতিভ চোর তো! পাকা চোরকে কেমন হতে হয়, জানো? শূদ্রকের 'মৃচ্ছকটিকে' শর্বিলক নামে আর এক চোরই বলে দিয়েছে সে কথা। সে হবে আক্রমণে বিড়াল, পলায়নে হরিণ, লুঠে বাজ, গৃহস্থ জেগে না ঘুমিয়ে, তা শুঁকে বোঝায় কুকুর, চলনে সাপ, স্থিরতায় পর্বত, গতিতে পক্ষীরাজ,পর্যবেক্ষণে গরুড়, কেড়ে নিতে চিতা আর শক্তিতে সিংহের তুল্য।" এদিকে ঘরে ঢুকে নিভাননীর তখন মাথায় হাত।, রান্নাঘরের বাসন বেবাক ফাঁকা করে গেছে এযুগের শর্বিলক। মৃচ্ছকটিক শোনার চেয়ে তাঁর কাছে জরুরি এখন, দুপুরে ভাত বাড়ার জন্যে কলাপাতা কেটে আনা।
চুরি ব্যাপারটা গৃহস্থের কাছে সুখকর না-হতে পারে, কিন্তু একে চৌষট্টি কলার অন্যতম বলে স্বীকৃতি দিয়ে জাতে তুলে দিয়েছেন  বাৎস্যায়ন। বাকি সব বিদ্যার মতো এই চৌর্যকলাও যে রীতিমত গুরুসঙ্গ করে 'অধ্যয়ন' করতে হত, তার প্রমান, 'ষন্মুখকল্পম' বা 'চৌরচর্যা'র মতো চৌরশাস্ত্র। এই 'ষন্মুখ' বা ষট মুখ হলেন দেবসেনাপতি, কুমার কার্তিকেয়। তস্করকুল 'শুভকাজে' হাত দেবার আগে ছয় মুখ, বারো হাত, সোনার বরণ এই সুদর্শন দেবতাটিকেই যথাবিহিত আরাধনা করে। "ওঁ বন্দেঅহং মহাত্মানং ময়ুরোপরি সংস্থিতম। / বিশ্বেশং শত্রূহন্তারম দ্বাদশাস্ত্রৈচ শোভিতম।/ তপ্তকাঞ্চনবর্ণাভম নানালংকারভূষিতম।/ ষন্মুখং পুত্রদায়কম তস্করাধিপতিম সুরম।" একদিকে যিনি সুরলোকের রক্ষক, অন্যদিকে তিনিই   চোর চূড়ামণি ।
তস্কর সমাজে গোত্রভেদ অতি প্রবল। ডাকাতের সঙ্গে সিঁধেল চোরকে, ছিঁচকের সঙ্গে গাঁটকাটাকে গুলিয়ে ফেলা সেখানে অমার্জনীয় অপরাধ। ডাকাতিতেপ্রাধান্য পায় পেশিশক্তি আর নৃশংসতা, তুলনায় চুরির কারুকাজ অনেক বেশি। চৌর্যকর্মটি নির্বিঘ্ন করতে শাস্ত্রমতে চোরকে মারণ, উচাটন, স্তম্ভন, বশীকরণ ও শান্তিকর্ম এই পাঁচটি তান্ত্রিক আভিচারিক ক্রিয়া করতে হত বটে, কিন্তু সচরাচর খুনির তকমাটি তারা এড়িয়েই চলত। চুরিবিদ্যায় হাতেকলমে শিক্ষার ছবি পাই মনোজ বসুর 'নিশিকুটুম্ব'তে। .
'...ঘরে ক'জন?
-- দু-জন।
--ঠিক করে বলছ বটে?
-- হ্যাঁ, দু'রকমের নিশ্বাস ঘরের মধ্যে। দুরকম ছাড়া তিনরকম নয়, একরকমও নয়। তবে মানুষ নয় দুজনাই, একটি ওর মধ্যে বিড়াল। বিড়াল ঘুমুলে ঘু-উ -উ একটা শব্দ হয়।
--সাবাস বেটা। কী মানুষ,দেখি বলতে পারিস কিনা।
--মেয়েমানুষ। সধবা।
--পুরুষ নয় কেন? সধবাই বা কেন?
--পাশ ফিরলেই চুড়ির আওয়াজ। বিধবা বা পুরুষ হলে হাতে চুড়ি থাকতনা।
কিন্তু এমন চোরচক্রবর্তী তো সকলে হয় না। কোথাও আবার বুদ্ধিতে গৃহস্থ তাকে হারিয়ে দেন। একা মহিলা ঘুমিয়ে আছেন কোলে শিশুটি নিয়ে। চোরের খুটখাট শুনে বুকের মধ্যে হাতুড়ি পড়ে। কিন্তু চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করার বোকামিটি না করে মরীয়া হয়ে শুধু একটু অভিনয় করলেন তিনি। পাশের কোলবালিশে আপাদমস্তক চাদর মুড়ে ফিসফিস করে (যা পাশের ঘরে শোনা যায়) বললেন, "শুনছ, ঘরে মনে হয় চোর ঢুকেছে। ওঠ শিগগির। তোমার পিস্তলটা কি বালিশের তলায় নাকি দেরাজে তুলে রেখেছ আবার? কতবার বলেছি লোডেড বন্দুক নাগালের মধ্যে বাচ্চার নাগালের মধ্যে রাখবে না। নাও ওঠ এখন। প্রাণের মায়া বড় মায়া। বালিশে মাথা রেখেই একাকিনী টের পান, 'অতিথি'র নিঃশব্দ নিষ্ক্রমণ।
সে একটা সময় ছিল, যখন চোরেদের মধ্যে সিঁধেলরা ছিল কুলীন। শিক্ষাশেষে গুরুর আশীর্বাদধন্য সিঁধকাঠি হাতে পাওয়াই ছিল যৌবরাজ্যে অভিষেক। শ্মশানের কয়লা আর রক্ত দিয়ে রাক্ষসমুখ, নারীমুখ, মৎস্যমুখ, চাঁদ, সূর্য বা পদ্ম এঁকে সেই বরাবর সিঁধ কেটে ঢুকতে হবে। ওস্তাদেরা বলতেন, সিঁধ এমন হবে যে পরদিন প্রতিবেশী চোরের বাপান্ত করলেও সিঁধের প্রশংসায় যেন পঞ্চমুখ হন।  সিঁধ কেটে প্রথমেই মাথা গলিয়ে দিতে নেই। আগে নকলি বা পুতুল ঢুকিয়ে ভিতরের পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে প্রথমে গলাতে হবে পা। তারপর সন্তর্পণে এমন ভাবে গলিয়ে দিতে হবে শরীর। বরাত খারাপ হলে তার আগেই গৃহস্থ যদি পা ধরে ফেলে তাহলে মুশকিল। একজন ধরা পড়লে পুরো দলটাই ধরা পড়ে যেতে পারে, সেই ভয়ে কোন সময় হতভাগ্য চোরটির পরিচয় হাপিস করতে তার মাথাটাই কেটে নিয়ে গেছে স্যাঙাতরা এমন নজিরও আছে।
কথায় বলে, 'চোরে কামারে দেখা হয় না'। চৌর্যশাস্ত্রের বিধিই তাই। কামারের ঘরে চুপি চুপি এসে কাঁচা টাকা রেখে সিঁধকাঠির বরাত দিয়ে চলে যাবে চোর। নির্দিষ্ট সময় পরে ঠিক সেখানেই তৈরি থাকবে কাঠি। ক্রেতা-বিক্রেতা সাক্ষাৎ হওয়া মানা। ঘুমপাড়ানি মন্ত্রবলে ঘরের মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে চোর যখন ঢুকবে তার সঙ্গে থাকবে আলোর পোকা আর বীজ। পোকা ডানার ঝাপটায় প্রদীপ নিভিয়ে দেবে। মাটিতে টাকাকড়ি, সোনাদানা পোঁতা থাকলে মন্ত্রপূত বীজ সেখানে পড়লে ফুটে যাবে ফটফট করে। চোখে মায়াকাজল লাগিয়ে অদৃশ্য হওয়া বা চুরিতে কেউ বাধা দিলে গুপী গায়েনের মন্ত্রী মশাইয়ের মতো 'থেমে থাক' বলে তাকে স্থানু করে দেওয়ারও তন্ত্রবিধি রয়েছে শাস্ত্রে।
সিঁধ কাঠি আবার শহরে অচল। রাত দুপুরে খড়খড়ি জানালার তলা দিয়ে ঢুকে আসে লম্বা লগি। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ছেলে-ছোকরারা কাটা ঘুড়ি ধরে যা দিয়ে, তেমনি। সত্তরোর্ধ বৃদ্ধা বিছানা থেকে দেখেন, সে লগির চলন সিধে তার আলনাটির দিকে। বাটা খুলে একটি পান মুখে দিয়ে তিনি ধীরেসুস্থে গিয়ে জেঁকে বসেন লগির ওপর। চোর পড়ল বিপাকে। লগি নড়ে না কেন দেখতে কার্নিশে উঠে সোজা বুড়ির সঙ্গে চোখাচোখি -- "ওমা, হারু! তুই আবার চুরি ধরলি কবে থেকে?" হারু ততক্ষণে লগি-টগি ফেলে দে-ছুট! বুড়ি চিনে ফেলেছে। আজকে চোর হলেও তারও একটা টুনটুনির বইয়ের শৈশব ছিল। ঊর্ধশ্বাসে পালাবার সময় সেই বইয়ের ঝাপসা হয়ে যাওয়া স্মৃতির পাতা থেকে যেন জ্যান্ত হয়ে ওঠে পান্তা বুড়ির অবয়ব। পান্তা চোরকে শিক্ষা দিতে যে কিনা হাঁড়িতে শিঙি মাছ, উনানে বেল, দোরে গোবর আর ঘাসে ক্ষুর রেখে দিয়েছিল। হারুর বোধের মধ্যে কোথায় যেন পাড়ার এই খুনখুনে ঠাকমা আর পান্তাবুড়ি একাকার হয়ে যায়।
চোরেদের কথা উঠলে আশপাশে সকলের ঝুলি থেকে চোর-পাকড়ানো, চোর-তাড়ানো বা নিদেন চোর-পালানোর এক-আধটা গল্প উঁকি দেবেই। তারমধ্যে রোমহর্ষক ভয়ের গল্পের পাশাপাশি থেকে যান পঞ্চার পিসে, যিনি নাকি পূর্ণিমা রাতে চাঁদের আলোয় ঘুম চোখে আয়নায় নিজের গেঞ্জিপরা চেহারা দেখে চোর সন্দেহে গুটিগুটি এগিয়ে রামধাক্কা খেয়েছিলেন আলমারিতে। শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে পিসি চিৎকার জোড়েন, "পাকড়ো পাকড়ো , চোর হ্যায়।" পিসে তার মুখে হাত চাপা দিয়েও থামাতে পারেন না। রঘুর বোন-ভগ্নিপতি জামাই-ষষ্ঠীতে এসেছে। পাশাপাশি দু'ঘরের মাঝে একটিই বাথরুম। মাঝরাতে জামাই সেখানে যেতে গিয়ে শাশুড়ির ঘরের শিকল তুলে খুলতে ভুলে গেছে। ওদিকে দরজা খুলছে না দেখে মা-ছেলে ভাবল, নির্ঘাত চোর পড়েছে। ছেলে রাম ভীতু। বলল, "দাঁড়াও, আমরা সজাগ আছি দেখলে চোর পালাবে। রাত আড়াইটায় তবলা টেনে নিয়ে বাজাতে বসল রঘু। রাতের নিস্তব্ধতা খান-খান করে তবলার বোল পিলে চমকে দিল গোটা পাড়ার।
সময়ের সঙ্গে চুরিও তার চরিত্র বদলেছে। সাইবারক্রাইমের হাইটেক শিল্পসুষমা মানুষকে সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে অনায়াসে। নব অবতারে সিঁধ হয়েছে গ্যাস-কাটার, কংক্রিট থেকে ইস্পাত কিছুই তার অভেদ্য নয়। আরও মহিমময় হয়েছে সাহিত্যে চুরি -- কুম্ভীলকবৃত্তি। তার বাড়বাড়ন্তে দোসর হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াও। তবে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক চুরি বোধহয় সেটি যা চোরকে বিন্দুমাত্র ধনী না করেও তার শিকারকে করে দেয় নির্ধন, নিরালম্ব। নিছক স্বার্থসিদ্ধির জন্যে বেমালুম লোপাট হয় ব্যক্তির সম্মান।  মনে পড়ে ওথেলো নাটকের সেই দীর্ঘশ্বাস – "But he that filches me my good name / Robs me of that which not enriches him / And makes me poor indeed."
আজ সাতসকালে এই চোর-চর্চার মূলে আছেন চৌর্য কূলাধিপতি কুমার কার্তিক। বাঙালির মাসাধিককাল লম্বা পুজো-মরসুম আজ শেষ হচ্ছে তাঁর আরাধনা দিয়ে।
শুভ চৌর কার্তিক পূজা!
তথ্যসূত্র:  
 চৌর্যসমীক্ষা -- ডঃ পুরীপ্রিয়া কুনডু 
 নিশিকুটুম্ব -- মনোজ বসু

রবিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৯

অসাম্য ~ মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায়

পুরানো দিনে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে? সত্যি করে? 

ষাট সত্তর দশকে কলকাতা শহরে কটা বাড়িতে ফ্রিজ ছিল? ল্যান্ড লাইন ফোন ছিল? ছিল পাম্পের জল? ক'জনা গিয়েছেন বেসরকারি নার্সিং হোমে চিকিৎসার প্রয়োজনে? কজন বাড়িতে এসি মেশিন চালিয়ে নিদ্রাসুখ উপভোগ করতেন? আর গাড়ি চালিয়ে উইকেন্ড ট্যুরে যেতেন? কজনের বাড়িতে আলাদা একটা ঘর ছিল শুধুমাত্র বসবার প্রয়োজনে? তার সাথে চিন্তা করুন বছরে, দু-বছরে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ। 

এগুলো এখন ভারতীয় মধ্যবিত্তর জীবন ধারণের অপরিহার্য অংশ। 

এখন দেশে মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত ফুরফুর করে হাওয়ায় উড়ছে। আছে কিছু অবসর, বাড়িতে আছে ফাঁকা জায়গা, আছে পার্সোনাল স্পেস। এসব কিছু ছিল না তখন। তবু আমরা এত ক্ষুব্ধ কেন? সত্যি কথা বলতে আমাদের ক্ষুব্ধ হবার কোন কারণ নেই। 

আমাদের দেশের মধ্যবিত্তর অবস্থার উন্নতি হয়েছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে, প্রায় উন্নত দেশগুলোর কাছাকাছি। আবার আমরা পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর সব সুবিধাও পাই। এই যেমন প্রায় সবার বাড়িতে গড়পড়তা দুজন সাহায্যকারি আছেন। বাড়ির কাজ প্রায় কিছু করতে হয় না।

নয় দশকে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতাম তখন কোন এক কনফারেন্সে যোগদান করতে গিয়েছিলাম বার্সেলোনাতে। গিয়ে দেখি, ওমা, এ যে শুধু ছেলেদের রাজত্ব। পরে বুঝলাম, পরিবার সন্তান রেখে কনফারেন্স করা তথাকথিত উন্নয়নশীল দেশের নারীর পক্ষে যতটা সুবিধাজনক ততটা নয় উন্নত দেশের মেয়েদের পক্ষে। এতে অবশ্য নেচে উঠবার কিছু নেই। এটা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ওদের দেশে তবু আয়ের কিছুটা সমতা আছে, আমাদের নেই। আমরা প্রয়োজনে দু চারটে কাজের লোক রেখে যেতে পারি এদিক-ওদিক।

পৃথিবীতে দারিদ্র্য মোটে কমছে না। আর দুস্তর ব্যবধান হয়ে যাচ্ছে দরিদ্র ও ধনীর মধ্যে। প্রথম ১০% এর ধন বৃদ্ধি পাচ্ছে অতি দ্রুত। আমি আপনি আছি ওই ১০% এ। নিচের ছবিটা দেখুন।  আমাদের দেশের মত অসাম্য আর কোন দেশে এত দ্রুত বাড়ছে না। 

দক্ষিণ এশিয়াতে পৃথিবীর অধিকাংশ দরিদ্র, অশিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত, রুগ্ন, স্বাস্থ্যহীন, মৃত শিশু, বালিকা বধূ আর যা যা খারাপ ব্যাপার হয়  - সব আছে সবচাইতে বেশি। 

তবে এদের আমরা দেখি না, এরা থাকে অদৃশ্য। এরা অদৃশ্য হতে হতে আমাদের চোখে মিলিয়ে গেছে। এক সময়ে কিন্তু ছিল। দেওয়ালে দেওয়ালে ছিল।

আমাদের গল্প, কথা, মেসেজ ফরওয়ার্ডে, কোথাও এরা নেই। সেখানে আছে রাম মন্দির, হিন্দু মুসলমান, এই সব। 

ওরা যেভাবে চলাতে চান আমরা ঠিক সেই ভাবেই চলি যে। আমাদের নিজেদের নেই কোন কথা, নেই চিন্তা। তাই আমাদেরও ওভাবেই চলতে ভাল লাগে। 

ওই বিশাল দরিদ্র, মূর্খ মানুষের কোন দায় কেউ নেয় না, কেউ নেবে না। 

এই বেশ ভাল আছি। এই বেশ ভাল আছি।

Madhusree Bandyopadhyay
10/11/2019

অযোধ্যা রায় ~ ডঃ রেজাউল করীম

সুপ্রিম কোর্টের এই রায় মোট ১০৪৫ পাতার। সেসব পড়তে ও পড়ে বুঝতে অনেক সময় লাগবে। এই রায়ে অনেক ফাঁকফোকর আবিষ্কার করে সমালোচনা হবে। প্রশংসা হবে, নিন্দা হবে। সেসব ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক। অনেকদিন পর একটা সমাধান এসেছে। মন্দির মসজিদ পিছনে ফেলে সামনের দিকে তাকাতে হবে। 
যারা হতাশ হয়েছেন তাঁদের বলি, এই রায় শুনে আমার বিখ্যাত হোদায়বিয়ার সন্ধির কথা মনে হয়েছে। যুযুধান "মুসলিম পক্ষ" যে পাঁচ একর জমি পেয়েছেন সেখানে এমন কিছু করুন যা বিশ্বের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে। দেশে হাজার হাজার মসজিদ আছে।অনেকে আবেদন করছেন, আর মসজিদ না বানিয়ে সেখানে একটি হাসপাতাল বা বিশ্ববিদ্যালয় হোক। এই দাবী অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য ও বর্তমান সময়ের যুগোপযোগী দাবী। এই জমিতে গড়ে উঠুক নালন্দার মত একটি বিশ্বমানের শিক্ষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র। এর নাম যেন কোন রাজা বাদশার নামে না হয়।  এর দায়িত্ব দিন ইরফান হাবিব, ,সায়েদা হামিদ, জোয়া হাসান, জে কে ফয়জান, মালিক জাফর মাহমুদ, হামিদ আনসারি প্রভৃতি  মুক্ত মনের শিক্ষাবিদদের। আজিম প্রেমজি শিক্ষার জন্য হাজার হাজার কোটি খরচ করছেন। তাঁর সাহায্য নেওয়া হোক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হোক অমর্ত্য সেনকে যিনি তিল তিল করে নালন্দার পুনর্জন্ম দিতে সাহায্য করেছেন। 
এ আমার একান্ত ব্যক্তিগত মত। কিন্তু মুসলিমদের নিয়ে এ দেশে যে কুৎসিত রাজনীতি হয়, অন্য ধর্মের অনেক মানুষ যে মুসলিমদের সম্পর্কে ভুল ধারনা পোষণ করেন তা দূর করার একটি সুবর্ণ সুযোগ পাওয়া গেছে। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করুন। নাহলে, মুসলিম সেমিনারিদের হাতে পড়ে আরেকটি দেওবন্দ গড়ে উঠলে তা এই সম্প্রদায়ের জন্য অত্যন্ত হানিকর হবে।

শনিবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৯

কাজ একটা পুঁজিবাদী ষড়যন্ত্র ~ দেবরায়া মুখোপাধ্যায়

আমি বহুদিন ধরেই একটা কথা বলি – "কাজ একটা পুঁজিবাদী ষড়যন্ত্র। এই কাজ করতে করতে মরে যাওয়াটা একটা পুঁজিবাদী ষড়যন্ত্র"। 

শুনে আমার সহকর্মীরা হাসে। কেউ কেউ আমাকে পাগল বলে। কেউ বিশ্বাস করে না।

বিশ্বাস করুন, আমি একফোঁটা মিথ্যে বলিনা।

সভ্যতার গোড়ায় মানুষকে বেঁচে থাকতে উদয়াস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হতো। শুধু বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু মানবসভ্যতার শুরুর থেকেই পথ চলা শুরু করেছে বিজ্ঞান, এবং তার ঘাড়ে চেপে প্রযুক্তি। প্রতি পদক্ষেপে তারা মানুষের কাজের বোঝা নিজেদের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে, কমিয়েছে মানুষের পরিশ্রম, পরিশ্রমের প্রয়োজনীয়তা।

এর সাথে পুঁজি বা বাজারের বা অর্থনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। এটাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নিকষ স্বভাব। তাদের একমাত্র কাজ মানুষের জীবনকে সহজ করা, মানুষের পরিশ্রমের বোঝা লাঘব করা।

সেই সভ্যতার শুরু থেকে এই সহস্র সহস্র বছর মানুষের সাথে পথ চলে আজ বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাতে তার উপকারিতার সমবণ্টন হলে পৃথিবীর মানুষের দিনে গড়ে দু'ঘন্টার বেশি কাজ করতে হওয়ার কথা নয়।

সত্যিই দরকার নেই। অবিশ্বাস্য শোনালেও সেটা সত্যি।

আমি আমার অজ্ঞতার ফলে পরিসংখ্যানটা বাড়িয়েও বলে থাকতে পারি, কারণ আমি বিজ্ঞানী বা প্রযুক্তিবিদ নই। আমি সঠিক জানিনা বর্তমানে প্রযুক্তি বা বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। ওই সময়টা দৈনিক দেড় ঘন্টা বা এক ঘন্টাও হতে পারে। আমি নিশ্চিত ওটা দু'ঘন্টার বেশি নয়।

কিন্তু তা হয় না। সমস্যাটা বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিতে নয়। সমস্যাটা বাজার-কেন্দ্রিক অর্থনীতিতে। সমস্যাটা আমাদের ভাবনায়।

বুঝলেন না তো?

আচ্ছা, একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলছি। ধরুন একটা কারখানায় ১০০ জন শ্রমিক প্রতিদিন ৮ ঘন্টা কাজ করেন। মানে দৈনিক ৮০০ ম্যান-আওয়ারের* কাজ হয়। মালিকের মুনাফা নিশ্চিত করতে ওটার প্রয়োজন।

এবার বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের জন্য সেই কারখানার মালিক নামমাত্র খরচে এমন একটা প্রযুক্তি সেই কারখানায় নিয়োগ করলেন যার ফলে ৪০০ ম্যান-আওয়ারের কাজ সেই প্রযুক্তি করে দেবে।

ফলে সেই ১০০ জন শ্রমিকের গড়ে দৈনিক ৪ ঘন্টা উদ্বৃত্ত হয়ে গেল, কিন্তু মালিকের মুনাফার পরিমাণ (প্রফিট মার্জিন) একই থাকলো।

ভাবুন এবার। ৪০০ ম্যান-আওয়ার উদ্বৃত্ত।

কি মনে হয়? মালিক কি করবেন? সেই ১০০ জন শ্রমিককে বলবেন যে এখন আর তোমাদের দিনে ৮ ঘন্টা কাজ করার দরকার নেই? তোমরা দিনে ৪ ঘন্টা কাজ করো আর বাকি বেঁচে যাওয়া ৪ ঘন্টা নিজের বউ বা গার্লফ্রেন্ডের সাথে প্রেম করতে, কবিতা লিখতে, ছবি আঁকতে, গল্পের বই পড়তে, বা নিছক ল্যাদ খেতে ব্যবহার করো?

ভাবতে পারছেন? সম্ভব এটা?

না, আমরা সবাই জানি সেটা সম্ভব নয়। মালিক ওই ১০০ জনের মধ্যে ৫০ জনকে ছাঁটাই করে দেবেন আর বাকি ৫০ জনকে বলবেন দিনে ৮ ঘন্টা কাজ চালিয়ে যাও। 

এর ফলে তিনি বিজ্ঞান/প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে যে লাভটা এলো সেটা সম্পূর্ণ একাই ঘরে তুললেন। ওনার মুনাফার জন্য দরকারি ৮০০ ম্যান-আওয়ারের ৪০০ ম্যান-আওয়ার প্রযুক্তি দিয়ে দিল, বাকি ৪০০ ওই ছাঁটাই না হওয়া শ্রমিকরা। ৫০% শ্রমিকের চাকরি গেল, আর বাকি ৫০%কে সেই আগের মতোই দিনে ৮ ঘন্টা কাজ করে যেতে হলো।

সমস্যাটা এখানেই।

এই সমস্যাটাও সহস্র সহস্র বছর ধরে একই থেকে গেছে। বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে এর কোনো পরিবর্তন হয়নি।

সমস্যাটা শুধু পুঁজির বা সম্পদের সমবণ্টনের নয়। সমস্যাটা বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির থেকে লব্ধ উপকারিতার পুঁজির কুক্ষিগত হয়ে যাওয়াটাও। সমস্যাটা বহুমাত্রিক।

আজ পৃথিবীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে তার উপকারিতার সমবণ্টন হলে সত্যিই মানুষকে গড়ে দিনে দু'ঘন্টার বেশি পরিশ্রম করতে হবে না। মানবসভ্যতার বাকি যা কাজ দরকার তা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি করে দেবে।

আমার আপনার অনেক সময় উদ্বৃত্ত হয়ে যাবে আমরা নিজেরা যা পছন্দ করি তার পেছনে দেওয়ার জন্য। পরিবারকে, শখকে, নেশাকে অনেক বেশি সময় দিতে পারব। 

পাশ্চাত্যের সভ্য এবং সম্পদশালী দেশগুলোতে এই নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও শুরু হয়েছে। ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপের অনেক দেশেই শ্রম-সপ্তাহ এবং শ্রম-দিবস কমিয়ে আনা হয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে কাজ করতে বাধ্য করাকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে।

মাইরি বলছি, এক ফোঁটাও মিথ্যে বলিনি যখন বলেছি "কাজ একটা পুঁজিবাদী ষড়যন্ত্র"!

শুধু আমাদের মতন নয়া-উদারনৈতিক পুঁজিবাদ-শাসিত দারিদ্র্য-জর্জরিত দেশেই ছোটবেলা থেকে আমাদের শেখানো হয়েছে কাজ করতে করতে মরে যাওয়াটাই আমাদের অলঙ্ঘনীয় ভবিতব্য। এর বাইরে ভাবতে আমাদের শেখানো হয়নি।

আপনারা বরং আরেকটু পড়াশুনো করুন। আরেকটু ভাবুন। চোখগুলো খুলুন।

________________________________________

*"ম্যান-আওয়ার" কথাটা লোকের বোঝার সুবিধার জন্য ব্যবহার করলাম। নারীবাদী এবং জেন্ডার-অ্যাক্টিভিস্টরা ক্ষমাঘেন্না করে দিন। আমার পেশাদার ব্যবহারিক জীবনে আমি পার্সন-আওয়ারই ব্যবহার করি।

মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৯

গরু... একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু ~ মলয় ভট্টচার্য্য

অদ্ভুত আজগুবি চিন্তা ভাবনা এবং যখন তখন আইডিয়া প্রসব করার সুনাম বা দুর্নাম আমার আজকের নয়, বহুদিনের সঙ্গী। আজকে লিখবো এরকম ই এক আইডিয়া এবং তার অকালমৃত্যু নিয়ে। 

অনেক অনেক অনেক দিন আগে, যেদিন কলেজ হস্টেলে ল্যান্ড করেছিলাম, মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে...  ঘটনাটা সেই কালের।

আমাদের হস্টেল গুলো, কলেজ বিল্ডিং থেকে খুব দূরে না হলেও, বেশ দূরে ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই অতটা হেঁটে কলেজ যাওয়ার জন্য তো অনেকটাই দূর৷ তাই আমরা অধিকাংশই সাইকেলে ভরসা করতাম। সাইকেল অবশ্য নতুন কেউই কিনতাম না। পাসিং আউট ইয়ারের দাদারা ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের দিয়ে যেতো।  দিয়ে মানে দান করে যাওয়া নয়, বেচে দিয়ে যেত। তিনশো,চারশো এরকম সব দামে। যে দাদারা ক্যাম্পাস থেকেই সাত আটশো টাকা মায়নার একটা চাকরি লড়িয়ে দিত... তারা দু এক জন দানছত্র করে থাকলেও থাকতে পারে। আমার জানা নেই। সেই সাইকেল কেনাটাও হত শেয়ারে। ফার্স্ট ইয়ারের দুই রুমমেট মিলে একটা সাইকেল কিনলো শেয়ার করে...  এই সব হত। আমিও কিনেছিলাম। জোট বেধে আমার রুমমেট কৌশিকের সাথে। আমরা বলতাম ডাব্লিং। মানে একজন চালাবো আরেকজন সামনের রডে। এভাবেই চার বছর...

সাইকেল ছাড়া আমরা অসহায় ছিলাম। শুধু তো কলেজ যাওয়া নয়, ক্যান্টিন, টাউনে বিকেলে গিয়ে টাউনের মেয়েদের সাথে তিস্তা উদ্যানে লাইন মারা, সিনেমা হলে যাওয়া, টাউনে টিউশন করতে যাওয়া, টাউনে ক্যালাকেলির খবর এলে দ্রুতগতিতে স্পটে পৌঁছে যাওয়া....  প্রচুর প্রচুর কাজ ছিল সাইকেলের। 

এই সাইকেলের অপরিহার্যতা কে আমি একটা অপরচুনিটি হিসেবে দেখেছিলাম। একটা স্কোপ, একটা স্টার্ট আপ...  

মাথায় অনেকদিন ধরে ব্যাপারটাকে খেলিয়ে তারপর কোন এক ইউনিয়ন মিটিং এ প্রস্তাব টা রেখেছিলাম।.... " হোয়াই সাইকেল? হোয়াই নট গরু?!!" 

আমরা সাইকেল ব্যবহার না করে যদি গরু ব্যবহার করি তাহলে কত গুলো দিগন্ত খুলে যাবে আমাদের সামনে ভেবে দেখুন জনগণ। 

সাইকেলের বদলে গরু কেনার প্রথম ইনভেস্টমেন্ট করতে হবে যার যার বাবাকে৷ পে ব্যাক ইন সিক্স মান্থস। দুই রুমমেট মিলে ভাগাভাগি করে যদি এই কচি বয়সে আমরা সাইকেল কিনে ফেলতে পারি তাহলে দুই বাবা এই দামড়া বয়সে ভাগাভাগি করে একটা গরু কিনতেই পারে। নো বিগ ডীল। ইউনিয়নে সর্বাসম্মতিক্রমে পাস হলে আমিই প্রথম আমার বাবাকে পোস্ট কার্ডে লিখে জানাতে রাজি... এতদূর পর্যন্ত কমিটমেন্ট ছিল আমার৷ 

প্রথমেই যা হয়। পিপুল উইথ নো আইডিয়া, খিল্লি,খিস্তি এসব ই করে। আমার সাথেও সেটাই হয়েছিল। আমি দমে যাই নি। এক এক করে, চুন চুন কে অ্যাডভান্টেজ ব্যাখ্যা করেছিলাম। কি রকম?

প্রথম : ক্যাম্পাসে একমাত্র দুধের সাপ্লায়ার ভজুয়া। ওর আছে তিনটে গরু। আজ নয়। বহুকাল ধরেই আছে। গরু বাড়ে না কিন্তু নতুন নতুন খরিদ্দার যতই বাড়ুক ওর, মানা করে না।  কারণ...  ওর পাতকুঁয়াটা। আজ ক্যাম্পাসের চারশো জনের মধ্যে দুশো জন ওর থেকে দুধ নেয়। কাল, রাতারাতি তিনশো লোক চাইলেও ও ঘাড় নাড়িয়ে রাজি হয়ে যায় এবং সাপ্লাই ও দেয়। হাউ?  এমন কি প্রফেসর কোয়ার্টারেও ঐ একটাই পাতকুঁয়া দুধ দেয়। আর আমরা, বাবাদের এত কষ্টের পয়সা, দুধ খাবো বলে নির্লজ্জের মত পোস্টকার্ডে লিখে লিখে এক্সট্রা টাকা চাই... সে কি না ঐ কুঁয়ার জল কেনার জন্য?!!!  

নিজের নিজের গরু থাকলে খাটি টাটকা দুধ। এক বালতি করে রোজ। ব্রেকফাস্ট এ দুধ মুড়ি, লাঞ্চে দুধ কলা ভাত, ডিনারে দুধ রুটি। ভাবা যায় কি সেভিংস!! মেস বিলের এই চোখ রাঙানির অন্তর্জলি যাত্রা, পার্মানেন্টলি। 

নেক্সট : গোবর৷ 

ভজুয়ার তিনটে গরুর পিছন পিছন কতগুলো গোবর কুড়ানি মেয়ে, বউ ঘোরে রোজ, খেয়াল করেছিস?  একটা বাইপ্রোডাক্ট নিয়েও ভজুয়া রংবাজি এবং *গীবাজি...  দুটোই করে যাচ্ছে... বছরের পর বছর৷ কি অপরিসীম সম্ভাবনা আছে কারো নজরেই আসছে না? 

ঠিক এইসময় আমাদের প্রদ্যোত দা নড়েচড়ে বসেছিল মনে আছে আমার। ওর ফ্যান্টাসি ছিল গোবরকুড়ানিরা। যা হয়... মহিলা বিহীন ক্যাম্পাস...আগুণের মত বয়স। যেই না বলেছি... আমাদের নিজস্ব অত গুলো গরু, কত্ত কত্ত গোবর, অনেক অনেক গোবরকুড়ানি মেয়ে বউ... প্রদ্যোত দা.... " সহমত গুরু, পাশে আছি " ঝেড়েই দিয়েছিল উত্তেজনায়। ওকে শান্ত করে... গোবরকুড়ানি এবং ঘুঁটে বেচার লভ্যাংশ ইকনমিক্স টা বোঝানোর পরে....  আনন্দে হল ছেড়ে ঘরে গিয়ে জানলা দিয়ে বিড়ি ধরিয়ে কার যেন গোবর কোড়ানো দেখাও শুরু করে দিয়েছিল, লোকে বলে।

এতো গেল অর্থনৈতিক দিক। এবারে আসছে প্রতিরক্ষা মানে ডিফেন্স। 

টাউনের ছেলেদের সাথে মারামারি লেগেছে... আমরা কতগুলো মর্চে পড়া সাইকেল নিয়ে ডাবলিং করে ক্যাঁচকোঁচ করে  হাজির হচ্ছি ... এটা কারেন্ট সিচুয়েশন। একটা গ্ল্যামার হীন, ক্যারিশমাহীন, শিভালরিহীন এন্ট্রি৷ এবারে ভাব...  পঞ্চাশ টা ইঞ্জিনয়ারিং কলেজের ছেলে... হাতে টী স্কেল.,হকি স্টীক,ক্রিকেট ব্যাট.. পঁচিশটা গরুর পিঠে চেপে ঠ্যাকাঠ্যাক ঠ্যাকাঠ্যাক করে রূপমায়া হলে ঢুকছি.,ক্যালাকেলি করতে..... এমনিতেই টাউন কেঁপে উঠবে। তখন তো বাহুবলী সিনেমাটা হয় নি। নয়তো আমার বোঝাতে সুবিধাই হত৷

এত দূর বলার পরেই,  অ্যান্টি গোষ্ঠী জেগে উঠলো। আমার প্রোপজালটাকে নস্যাৎ করে দিতে। 

পুরুলিয়ার কোন এক গ্রাম থেকে আসা এক পাকা ছেলে... প্রথম ইস্যুটা ছাড়লো।..... " সারা বছর দুধ পেতে গেলে অনেক ষাঁড় লাগবে। ভজুয়া মাঝে মাঝে যে রোমিওটাকে ধরে এনে ওর তিনটে গরুর সাথে নষ্টামি করায়... তার একার পক্ষে দুশো গরুর সাথে ইয়ে করা সম্ভব হবে না। আর আমরা কেউ ষাঁড় কিনতে রাজি নই। দুধের ডিল না হলে... শুধু গোবর দিয়ে আমাদের বাবাদের ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট পে ব্যাক হবে না। বে ফালতু ষাঁড় গুলো মস্তি নেবে আর আমরা আঙুল চুষবো...  এটা হতে পারে না। 

ইন্দ্রজিৎ দা তখন টাউনের কেতকীর সাথে হেব্বি লাইন মারছে। সাহস পেয়ে ও বলে উঠলো... " সামনের রডে বসিয়ে ঘুরে বেড়ানো একটা আলাদা চার্ম৷ গরুর পিঠে শাড়ি পরে ওঠা ডিফিকাল্ট। আর পিডি গার্লস এর ইউনিফর্ম শাড়ি করে দিয়েছে ক্লাস নাইন থেকেই। বেরোলে কলেজ কেটেই বেড়োতে হয়। "...  এটাতে দেখলাম প্রবল সমর্থন পেয়ে গেল প্রতিপক্ষ। 

আমার বুকটা একেবারেই ভেঙে গেল যখন আমার নিজের রুমমেট... চূড়ান্ত ঘষু ( ঘষু মানে.. সারাদিন বই ঘষা পাব্লিক) কৌশিক বলে বসলো... অতগুলো গরুকে কলেজের ঐ টুকু সাইকেল স্ট্যান্ডে রেখে ক্লাসে গিয়ে যদি দেখে সবকটা মিলে হাম্বা হাম্বা করছে... কিচ্ছু শুনতে পাবে না, নোট নিতে পারবে না... তাছাড়াও বিকেলে একটা টাউনের মেয়েকে টিউশন পড়াতে যায়। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছেলে বলে মাসে একশো টাকা দেয়, নয়তো এমনিতে রেট সত্তর টাকা। সেখানে ও ছাত্রীবাড়ির বাইরে গরু বেঁধে পড়াতে ঢুকলে ওর এবং কলেজের মান সম্মান দুটোই যাবে। স্যাট করে একশোটা সত্তর হয়ে গেলে ওকে আবার চার্মিনার স্পেশাল ছেড়ে বিড়িতে ফিরতে হবে। একেবারেই আনডিজায়ারেবেল সিচুয়েশন হবে সেটা।

গুরুর ফ্যান... সোমদত্ত... প্রতি সিনেমা ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো আজ ও মারে... ও দেখলাম প্রতিবাদ করে উঠলো...।  হলে দুটাকায় সাইকেল রেখে ঢোকা যায়৷ এত গুলো গরু সাইকেল স্ট্যান্ডে রেখে গুরুর সিনেমায় কন্সেন্ট্রেট করা যাবে না। সাইকেলে চেন মেরে, লক করে যাওয়া যায়। গরু কেউ স্ট্যান্ড থেকে খুলে নিয়ে চলে গেলে বাবার যখন চিঠি আসবে... " বাঃ গরু,  তুমি গরুটাও হারালে?"...  খুব বাজে ইজ্জতে লেগে যাবে। " 

শেষ বারের মত ডিফেন্ড করার চেষ্টা করেছিলাম...." ভেবে দেখ, আজ টায়ার,কাল ব্রেক,পরশু স্পোক হাজার মেইন্টেনেন্স ঝামেলা। গরুতে এসব ঝামেলাই থাকবে না। " 

উড়িয়ে দিল আমাকে সবাই৷ 

আজ খুব খুব কষ্ট হচ্ছে মনে৷ 

এই দিলীপদার দেওয়া তথ্য গুলো যদি সেদিন জানতাম...জাস্ট অর্থনৈতিক অ্যাঙ্গেল দিয়েই বাজি মাত করে বেরিয়ে আসতাম। ক্যাম্পাস আজ গরুতে গরুতে ভরে থাকতো... আর ফার্স্ট ইয়ার থেকে লাস্ট ইয়ার মায় আমাদের ফ্লুইড ডায়নামিক্স, স্ট্রেংথ অফ মেটেরিয়াল,  কম্বাশচন ইঞ্জিন পড়ানো প্রফেসর গুলোও এই মোটা মোটা সোনার হার,বালা,বাউটি পরে বাপ্পি লাহিড়ীর মত ঘুরতো। 

একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু...  এ ছাড়া আর কি ই বা বলবো একে?