বৃহস্পতিবার, ২৩ মে, ২০১৯

ডক্টর্স ডাইলেমা : হোসেন আলির গল্প ~ ড: বিষাণ বসু

চলতি শতকের প্রথম দশকের মাঝামাঝি। তখন মেডিকেল কলেজে। ছাত্র, অর্থাৎ পিজিটি, মানে পোস্ট-গ্র‍্যাজুয়েট ট্রেনি। ক্যানসারের চিকিৎসা বিষয়ে কিছুটা জানাচেনার চেষ্টা করছি। কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, এইসব। সেই সময়ে যাঁদের চিকিৎসার সাথে যুক্ত থেকেছি, তাঁদের কয়েকজনের কথা খুব মনে আছে। ক্যানসার এমনই এক অসুখ, যেখানে জেতার পাশাপাশি হারের সংখ্যা অনেক। আবার, তিনবছরের ছাত্রজীবনে এমন সংখ্যাও কম নয়, যেখানে জয় নাকি পরাজয় ঠিক কোনটা ঘটেছে, সেই খবর পাওয়ার সুযোগটুকুও ঘটেনি। 

আউটডোর ইনডোর রেডিয়েশন মেশিনের মধ্যে দিয়ে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রত্যেকদিন চিকিৎসা পেতেন, তাঁদের মধ্যে অনেক মুখই স্মৃতিতে ফিরে আসে। বারবার। কিছু কিছু মুখ প্রায় হন্ট করতে থাকে। সে স্মৃতি কখনও আনন্দের, প্রায়শই বিষাদের।
 
যেমন ধরুন, হোসেন আলি। মুর্শিদাবাদের মানুষ। পরিস্থিতি এমনই, চিকিৎসা করানোর পক্ষে নিকটতম গন্তব্য কলকাতা। (তখনও বহরমপুরে মেডিকেল কলেজ চালু হয় নি।) কুচকুচে কালো গায়ের রঙ। তাগড়াই চেহারা। বয়স বছর পঞ্চাশেক। 

তাঁর সমস্যা, ইদানিং একটু ওজন কমেছে। রাত্রে জ্বরও আসে। গলায় আর বগলে কিছু কিছু ডেলা জাতীয় ফোলা। স্থানীয় ডাক্তারবাবু, সঙ্গত কারণেই, টিবি সন্দেহ করেছিলেন। কিন্তু, ছুঁচ ফুটিয়ে পরীক্ষায় দেখা গেল, লিম্ফোমা। অগত্যা কলকাতা। ক্যানসার বিভাগ।

পরীক্ষানিরীক্ষায় দেখা গেল, অসুখ বেশ কিছুটা ছড়িয়েছে। পেটের ভেতরেও লিম্ফ নোড বেড়েছে। সব মিলিয়ে স্টেজ থ্রী। ক্যানসার কতখানি বেড়েছে, শরীরে কতোখানি ছড়িয়েছে, তার ভিত্তিতে অসুখের সারার সম্ভাবনা কতোখানি, সেই হিসেবনিকেশের অন্যতম এই স্টেজিং। সাধারণত চারটি ধাপ। হোসেনসাহেব আছেন তৃতীয় পর্যায়ে।

অসুখটি লিম্ফোমা। নন-হজকিন্স লিম্ফোমা। তার মধ্যেও হাই গ্রেড। অর্থাৎ, দ্রুত ডালপালা ছড়ানোর স্বভাব। কিন্তু, আবার অন্যদিকে, লিম্ফোমা চিকিৎসায় সাড়াও দেয় চটপট। সেইসময়, ওই স্বল্প অভিজ্ঞতাতেই দেখেছি, দুই কি তিন দফা কেমো দিতেই লিম্ফোমা স্রেফ উধাও হয়ে গিয়েছে। বেশ কিছুটা অ্যাডভান্সড স্টেজেও লিম্ফোমা কিউরেবল, অর্থাৎ নিরাময়যোগ্য, এমনই জেনেছি।

হোসেনসাহেবের গলা-বগলের ফোলা অনেকটাই কমে গেল প্রথম দফার কেমোথেরাপির পরে। কিন্তু, পরিস্থিতির আন্দাজ পাওয়া গেল দ্বিতীয় দফার পরে। ফোলা কমা তো দূরে থাক, তৃতীয় দফার কেমো নেওয়ার সময় দেখা গেল, ফোলা ফিরে এসেছে প্রথম দফার আগের পর্যায়ে। হোসেনসাহেব সচেতন মানুষ। বললেন, ফোলা প্রায় মিলিয়েই গিয়েছিল দ্বিতীয় কেমোর সপ্তাহখানেক বাদেই। কিন্তু, দুসপ্তাহ যেতে না যেতেই অসুখ বাড়তে শুরু করে।

তৃতীয় দফা, মানে থার্ড সাইকেলের পরেও পরিস্থিতি তাই। অসুখ যেটুকু কমার, দুসপ্তাহের মধ্যেই ফিরে আসছে বাড়তি গতিতে। স্যারেরা আলোচনায় বসলেন। সিদ্ধান্ত হল, অসুখ যেহেতু ফিরে আসছে দু'সপ্তাহের মাথায়, কেমোথেরাপির সাইকেলের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনা যাক। এমনিতে তিন সপ্তাহের মাথায় দেওয়া হয়, কিন্তু এক্ষেত্রে দুটি কেমো সাইকেলের ব্যবধান হোক, ওই দুসপ্তাহ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম, ডোজ ডেনস (dose dense) থেরাপি।

কথাটা শুনতে সহজ লাগলেও বিষয়টা একটু জটিল। কেমোথেরাপির দুটি দফার মধ্যে ব্যবধানের পেছনে কিছু আপোষ রয়েছে। আমরা ভাবতে ভালোবাসি, যে, কেমোথেরাপির বিষে শুধু ক্যানসার কোষ ধ্বংস হচ্ছে আর বাকি সব সুস্থ কোষ থাকছে বহাল তবিয়তে। কিন্তু, এ শুধুই উইশফুল থিঙ্কিং। ক্যানসার কোষের পাশাপাশি অসংখ্য সুস্থ-সবল কোষও বেঘোরে মারা যাচ্ছে কেমোর উপদ্রবে। কোন কোষ? শরীরের যেসব অংশে কোষ বিভাজন ঘটে দ্রুত, ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারাই। যেমন, অস্থিমজ্জা বা বোন ম্যারো, যেখানে রক্ত বা রক্তের বিভিন্ন উপাদান তৈরী হয়। যেমন, অন্ডকোষ বা ডিম্বাশয়, যেখানে প্রজননের জন্যে প্রয়োজনীয় কোষ বিভাজিত হয়। যেমন, অন্ত্র বা ইন্টেস্টাইনের ভিতরের অংশ, যেখানে প্রতিনিয়ত পুরোনো কোষ নষ্ট হয়ে নতুন কোষ তার জায়গা নেয়। মৃত কোষের জায়গা নেওয়ার জন্যে আসবে নতুন কোষ, শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ কিছুটা মেরামত হয়ে নিতে পারবে - শরীরের মধ্যেই বন্দোবস্ত মজুত, শুধু সেই বন্দোবস্ত কার্যকরী হওয়ার জন্যে সময় জরুরী। কিন্তু, দুই দফার মধ্যের ফাঁকে ক্যানসারটিও তো নিজেকে গুছিয়ে নেবে, সেইখানেও ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি সেরেসুরে উঠতে চাইবে। তাহলে?? ওই আপোষ। একটু ফাঁক থাকুক, যাতে শরীরটা একটু গুছিয়ে নিতে পারে, অথচ ক্যানসারটি যাতে বেড়ে না যেতে পারে।

ডোজ ডেনস চিকিৎসা করতে গেলে এই ভারসাম্য রক্ষার খেলাটাই নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। হোসেন আলির ক্ষেত্রে ঝুঁকি নেওয়ার সাহস পাওয়া গেল, কারণ তাঁর সুঠাম স্বাস্থ্য। কিন্তু, রক্ত কমে গেলে, বিশেষত সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার মূল অস্ত্র শ্বেত কণিকা কমে গেলে তো মুশকিল। বিশেষত, কলকাতা থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সমস্যায় পড়লে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। অতএব, রক্ত বাড়ানোর ইঞ্জেকশনও জোড়া হল কেমোর পরের দিন। সেই সময়ে এই ইঞ্জেকশন বেশ দামী, হাসপাতালে পাওয়াও যায় না। হোসেনসাহেবের ছেলেকে বলা হল। খরচ শুনে ঘাবড়ে গেল সে। কিন্তু, বাবার চিকিৎসা। কোথা থেকে টাকার জোগাড় হল জানি না, কিন্তু, হোসেন আলির ইঞ্জেকশনের অভাব হল না।

চিকিৎসা একটু এগোতেই বোঝা গেল, হোসেন আলির ক্যানসারটি বড়ই বেয়াড়া প্রকৃতির। যে অসুখ আগে ফিরে আসছিল দু'সপ্তাহের মাথায়, এখন সেই ব্যবধান কমে দাঁড়ালো সাত কি দশদিনে। সত্যি বলতে কি, হোসেন আলির ক্যানসার যেন আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রকে ভেংচি কেটে বিদ্রুপ করতে থাকল। শরীরও ভাঙতে লাগলো দ্রুত। পেটের ভেতরের কিছু লিম্ফ নোড ফুলে স্নায়ুর উপর চাপ দিয়ে বিভিন্ন নিত্যনতুন উপসর্গের জন্ম দিতে থাকল।

বোঝা গেল, আর যাই হোক, এই পথে সমাধানের কোনো সম্ভাবনা নেই। অতএব, অন্য ভাবনা। শুরু হল, সেকেন্ড লাইন কেমোথেরাপি। এইখানে বলে রাখা ভালো, অন্তত সেই সময়ে, বেশীর ভাগ ক্যানসারের ক্ষেত্রে, দ্বিতীয় পর্যায়ের যে কেমোথেরাপি, মানে সেকেন্ড লাইন কেমোথেরাপি, তার ওষুধের কার্যকারিতা কম, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশী, বেশ দুর্মূল্য, এবং সেই ওষুধ সরকারি হাসপাতালে বিনেপয়সাতে পাওয়াও যেত না। দরিদ্র হোসেন আলির পক্ষে সেই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। কিন্তু, হোসেন আলির ছেলের সিদ্ধান্ত, যে করেই হোক, বাবাকে সে সুস্থ করে তুলবেই। অতএব…….

ক্যানসার চিকিৎসার অন্যতম সমস্যা, একই রোগীকে বারবার দেখতে দেখতে, তার বাড়ির লোকের সাথে এটাসেটা গল্প করতে করতে কোনো এক সময় যেন তাদের সাথে একটা টান, একটা আন্তরিকতার সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায় - সেই টান কাটিয়ে উঠে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে মানুষটাকে বা তার রোগটাকে বিচার করা মুশকিল হয়ে যায়। একটা পরিবারের মধ্যের অংশ হিসেবে যে মানুষটা, তাঁকে শুধুমাত্র রোগী হিসেবে দেখে নির্মোক দৃষ্টিতে বৈজ্ঞানিকসুলভ নির্লিপ্তিতে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া, এ বড় কঠিন কাজ। অনেক ডাক্তারকেই এই বাঁধন উপেক্ষা করে পেশাদারের দৃষ্টিতে বিষয়টাকে দেখতে দেখেছি, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েও বিদ্যেটা রপ্ত করে উঠতে পারিনি।

মাসখানেক যেতে না যেতেই বুঝলাম, হোসেনসাহেবের পরিবারের পক্ষে এই খরচ টানা দুঃসহ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ওষুধের দাম, মুর্শিদাবাদ-কলকাতা দৌড়াদৌড়ি, বাবা ভর্তি থাকলেও সাথে আসা ছেলের তিনচারদিন কলকাতায় থাকাখাওয়ার বন্দোবস্ত করা, সব মিলিয়ে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অন্যদিকে, হোসেন আলিও চিকিৎসায় তেমন সাড়া দিচ্ছেন না। অসুখ যেটুকু নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে, শরীর ভাঙছে তার বহুগুণ দ্রুততায়। পেটাই চেহারা এখন সুদূর স্মৃতি। ওয়ার্ডের লাগোয়া শৌচালয়ে যেতে তাঁর সাহায্য লাগে, বেডে ফিরে হাঁফাতে থাকেন।  

ছেলের সাথে গল্প করতে গিয়ে জানলাম, বাবার অসুস্থতা-চিকিৎসার প্রয়োজনে, এগারো ক্লাসে পড়তে পড়তে তাকে পড়া ছেড়ে দিতে হয়েছে। মা আর দুই ভাইয়ের খাবার জোগানোর দায়িত্ব তার। গ্রামে যে কদিন থাকে, দিনমজুর খাটে। কলকাতায় বাবার চিকিৎসার জন্যে আসতে হলে রোজগার নেই। 

এমনই এক দফা কেমোর জন্যে হোসেন আলি শেষবার যখন ভর্তি হলেন, ছেলের পাংশুমুখ দেখে প্রশ্নের উত্তরে জানা গেল, ভিটেটুকু বন্ধক দিয়ে এই দফা আসা হয়েছে। পরের দফায় কী হবে, সেই নিয়ে আপাতত ছেলে দুশ্চিন্তায়।

কথাটা অনেক আগেই বলা উচিত ছিল হয়ত। কিন্তু, ওই যে, বেটার লেট দ্যান নেভার। ছেলেকে আলাদা নিয়ে গিয়ে বোঝালাম, দ্যাখো, বাবার তো কিছুই হওয়ার নেই। ভিটে বাঁধা দিয়ে মা আর ছোট দুই ভাইকে নিয়ে ভেসে যেয়ে লাভ কী!! বাবার আর কেমোর দরকার নেই। টাকাটা নিয়ে বাড়িতে যাও, জমিটা ছাড়িয়ে নাও। এই দফা বাবাকে স্যালাইন দিয়ে ছুটি করে দিচ্ছি।

খুব যে এককথায় রাজি হল, তা নয়। কিন্তু, পিতৃহীন অদূর ভবিষ্যতে মাথার উপর থেকে ছাদটুকুও চলে গেলে কী হতে পারে, সেইটুকু বোঝানো গেল। পইপই করে এও বলা হল, এইবারের ভিটে বাঁধা দেওয়ার টাকাটুকু যেন অক্ষত থাকে এবং বাড়ি পৌঁছেই টাকা ফেরত দিয়ে যেন জমির কাগজ ফিরিয়ে নেয়।

হোসেন আলির এত কথা জানার কথা নয়। কিন্তু, মানুষ বুঝতে পারে। বিশেষত, ক্যানসারের ডাক্তারের জীবনে এমন মুহূর্ত প্রায়শই আসে, যখন তিনি মুখে হাসি টেনে রোগীর সাথে আপাত স্বাভাবিকতার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন, শুধু সেই কথোপকথনের সময়টুকুতে রোগীর চোখের দিকে তাকাতে পারেন না।

হোসেন আলিও বুঝতে পেরেছিলেন হয়ত।

যেকোনো হাসপাতালেই, মেডিকেল কলেজগুলোতে তো আরো বিশেষ করে, ক্যানসারের চিকিৎসা একটি দলগত প্রয়াস। কিন্তু, হোসেনসাহেবের কেমোথেরাপি চালানোর সময় বারবার আমিই সামনে থাকতাম, এজন্যেই হোক বা স্বভাবগত খেজুড়ে আলাপের অভ্যেসের জন্য এটাসেটা গল্প জুড়তাম বলেই হোক, হোসেন আলির সাথে আমার একটা বেশ আলাদা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

সেইদিন ছুটির সময় সামনে যাচ্ছিলাম না। ছেলে এসে বলল, বাবা জিজ্ঞেস করছে, আমার ডাক্তারবাবু কোথায়? অগত্যা যেতেই হল। হোসেন আলি সহজভাবে জিজ্ঞেস করলেন, এর পরে আবার কবে কেমোর ডেট স্যার? আমতা আমতা করে বললাম, এখন তো অনেক কেমো হল। শরীরটাও দুর্বল। বাড়িতে খাবার ওষুধ দেওয়া হল। মাসখানেক মাসদেড়েকের মাথায় আরেকবার দেখে ঠিক করা যাবে।

হোসেন আলি চুপ করে রইলেন। তারপর আচমকাই নিজের দুটো হাতের মধ্যে আমার ডান হাতখানা নিয়ে বললেন, ডাক্তারবাবু, আপনি আমায় একেবারে ছেড়ে দিলেন!!!    

###################

এর বোধহয় বছরখানেক বাদের কথা।

প্রবল গরমে ঘামতে ঘামতে ভিড় আউটডোরে। রোগী দেখছি নাকি চালু ডাক্তারি ভাষায় পেশেন্ট ছাড়ছি, বলা মুশকিল।

হঠাৎ একটি ছেলে বলল, ডাক্তারবাবু চিনতে পারছেন? 

চেনা চেনা লাগলেও ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। আমার চোখে অনিশ্চয়তা দেখে ছেলেটিই জিজ্ঞেস করল, হোসেন আলিকে মনে আছে, স্যার?

####################

হোসেন আলিকে মনে আছে!!!!!!

সেই শেষবারের "ডাক্তারবাবু, আপনি আমাকে একেবারে ছেড়ে দিলেন" এর পরে কতবার কত অদ্ভুত সময়ে হোসেন আলি আমাকে তাড়া করেছে, সে কি তাঁর ছেলে একটুও আন্দাজ করতে পারবে!!! 

ওই একটি বাক্যের মধ্যে ঠিক কোন কথাটায় শেষবার জোর দিয়েছিলেন হোসেন? 

ডাক্তারবাবু? মানে ডাক্তার হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়াটা ভুল, এই কথাই কি ছিল সেই অমোঘ বাক্যে? ডাক্তার হলে কি চেষ্টা করে যাওয়া, করেই যাওয়াটা অনিবার্য ধর্ম? এমনকি চেষ্টা অসার জেনেও? সেই বৃথা চেষ্টার মূল্য চোকাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে একখানা আস্ত পরিবার, সেই পরিস্থিতিতেও?

নাকি হোসেনের জোর ছিল ওই "আপনি" শব্দেই? আর পাঁচজন হাল ছাড়লেও আপনি ছাড়বেন কেন? আপনার সাথে এত কথাবার্তা, এত গল্পগুজবের পরেও আপনি সেই হাল ছেড়ে দিলেন? নিশ্চিত মৃত্যুর হাতে আমাকে ফেলে দিলেন অসহায়? হোসেন কি এই প্রশ্নই করতে চেয়েছিলেন?  

নাকি জোর ছিল সেই "আমায়" শব্দটির উপর? অর্থাৎ, আমার পরিবারের স্বার্থ দেখতে গিয়ে আপনি আমার মৃত্যু ঠেকানোর চেষ্টা করলেন না? যেখানে আমি বনাম আমার পরিবারের স্বার্থের সংঘাত হয়ে দাঁড়িয়েছে সমস্যাটা, সেইখানে আপনি, যিনি কিনা আমার চিকিৎসক, আপনি আমার পরিবারের কথাটা আগে ভাবলেন? নিজের রোগীর প্রতি আপনার দায়িত্ব তখন কোথায় গেল, ডাক্তারবাবু??      

###################

বলা বাহুল্য, এই ঘটনার পরে এক দশকেরও বেশী সময় পার হয়ে গেলেও হোসেন আলি আর তাঁর প্রশ্ন আমি ভুলতে পারিনি।

পরবর্তীকালে, ঝাঁচকচকে কর্পোরেট হাসপাতালের কেতাদুরস্ত বড় ডাক্তারবাবু আমাকে বুঝিয়েছিলেন, শোন, ডাক্তার হিসেবে তোর দায়বদ্ধতা উল্টোদিকের চেয়ারে বসে রোগীটির প্রতি, একমাত্র ও শুধুমাত্র সেই রোগীটির প্রতি।  

কিন্তু, সেই দায়বদ্ধতার সীমা কোনখানে? স্পষ্টতই নিষ্ফলা চিকিৎসার চেষ্টার ফলে একটা পরিবার ভেসে যেতে চলেছে, সেই অবস্থাতেও দায়বদ্ধতা সীমাবদ্ধ থাকবে এক এবং একমাত্র রোগীর প্রতিই?

চিকিৎসকের চেষ্টার সীমারেখাই বা কোথায় থাকবে? ঠিক কোনখানে বলা যাবে, ব্যাস, দিস ফার অ্যান্ড নো ফারদার? ঠিক ক'শতাংশ আশা থাকলে ব্যয়বহুল চিকিৎসার চেষ্টা যুক্তিযুক্ত? নাকি, চিকিৎসকের দায় চেষ্টা করে যাওয়ার? সেইখানে খরচের চিন্তার দায়িত্ব তাঁর নয়?

এমনকি, বৃহত্তর ক্ষেত্রের কথা যদি বলি, এই প্রশ্নের সাধারণীকরণ যদি করা যায়, তথাকথিত শেষ চেষ্টা বা হাল-না-ছাড়া যদি ব্যয়বহুল পথে মৃত্যুকে দীর্ঘায়িত করার পদ্ধতি হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে চিকিৎসক ঠিক কোন ভূমিকায় থাকবেন? চিকিৎসকের হাল না ছাড়ার অনিবার্য ফল হিসেবে যদি প্রায় যেকোনো মানুষের যেকোনো স্তরের অসুখই চিকিৎসাযোগ্য এই বার্তা ছড়ায়, তার পরেও চিকিৎসকের দায়িত্বটি ঠিক কেমন কেমন দাঁড়াতে পারে?   

মেডিকেল এথিক্স ব্যাপারটা অনেকদিনই মেডিকেল ল-য়ের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছে। আর, মেডিকেল ল-এর সাথে ওতপ্রোত জড়িয়ে গিয়েছে ক্রেতা সুরক্ষা আইন। এই ঘন দ্রবণের মাঝখান থেকে মেডিকেল এথিক্সের দুধটুকু বেছে নেওয়া কতদূর সম্ভব?

মেডিকেল এথিক্সের ধারণার শুরুতে যে সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং মর‍্যালিটির অবশ্যম্ভাবী যোগাযোগ ছিল, তার কতটুকু এই বাজার-শাসিত সমাজে প্রাসঙ্গিক? তার কতটুকু এই সময়ে প্রয়োগ করা সম্ভব?

হবু ডাক্তারদের জন্যে যে আসন্ন পাঠক্রম, সেইখানে গুরুত্ব পেতে চলেছে মেডিকেল এথিক্স এবং ডাক্তারবাবুদের কমিউনিকেশন স্কিল। কেমন দাঁড়াবে সেই এথিক্সের চেহারা? নিজের ভাবনাকে রোগী-পরিজনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে কমিউনিকেশন স্কিল, নিঃসন্দেহে, জরুরী। কিন্তু, সেই ভাবনাটার চেহারা কী দাঁড়াবে? সেই ভাবনাটা ঠিক কী হওয়া উচিত? সেই দিকনির্দেশিকা চিকিৎসাশিক্ষার পাঠক্রম তৈরীর বড়বাবুদের মাথায় থাকবে তো? 

############################

হোসেন আলির কথা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলাম। অবশ্য, তাঁকে নিয়ে আর বেশী কিছু বলারও নেই।

ছেলে জানায়, আমরা হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার পরে, ঠিক ষোল দিনের মাথায় বাবা মারা যান। আমাদের কথায়, সে বাড়ি গিয়েই টাকা ফেরত দিয়ে ভিটের জমিটুকু ফিরিয়ে নেয়। না, মহাজন রাজি হয়নি সহজে। পঞ্চায়েতের মধ্যস্থতায় কাজ হয়। এই দফায় গ্রামেরই অন্য একজনকে ডাক্তার দেখাতে কলকাতায় আসা। মনে হয়েছে, যে ডাক্তারবাবুরা না বললে তার জমিটুকুও থাকত না, তাঁদের সাথে দেখা করার প্রয়োজন।

বেশী কিছু আমারও বলার ছিল না।

হোসেন আলির শেষ প্রশ্নটুকু থেকে আরো অনেক অনেক প্রশ্ন আমার মনে আসতে থাকে, আসতেই থাকে, সে হয়ত আমারই মনের ভুল।

লিখেছেন ড: বিষাণ বসু

বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০১৯

বিভাজনের রাজনীতি ~ ড: রেজাউল করীম

আনন্দবাজার একটা আবেগময় পোস্ট এডিটে  মমতা বন্দোপাধ্যায়কে জেতানোর আবেদন জানিয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছি, বিজেপি একটি মুসলিম বিরোধী, সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিবাদী দল। সেদিন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে ব্যর্থ, হতাশাগ্রস্ত হয়ে তারা বাঙালী-প্রাণপুরুষ বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছে। এ বিষয়ে ও কোন মতভেদ নেই যে, অনেক, হয়ত শতাংশের বিচারে বেশি নয় তাঁরা তবুও অনেক, শিক্ষিত মানুষ "মোদি মোদি" বলে চিৎকারের মূল কারণ যেমন মমতা বন্দোপাধ্যায়ের প্রতি বিতৃষ্ণা, তেমনি বা তারচেয়ে বেশি সুপ্ত মুসলিম বিদ্বেষ । নরেন মোদির প্রচার তাঁদের অনেকের প্রাণে দোলা দিয়েছে,  "হাম পাঁচ, হামারা পঁচিশ" এই তত্বেও তাদের অগাধ বিশ্বাস। তারা এমন ও বিশ্বাস করেন যে, খুব শিগগিরই মুসলিম জনসংখ্যা হিন্দুকে ছাড়িয়ে যাবে। কোন তত্বগত ভিত্তি এর জন্য দরকার নেই, বিশ্বাস ই যথেষ্ট।  যুগে যুগে ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আবির্ভাবের যে সংকল্প শ্রীভগবানের মুখ থেকে নিঃসৃত হয়েছে সেই যুগবতারের আবির্ভাব হয়েছে। তিনি অপাপবিদ্ধ, তিনিই এই দেশের একমাত্র সমাধান-দুর্নীতি থেকে, বেরোজগারি থেকে, অর্থনৈতিক মন্দা থেকে এই পুণ্যভূমি তিনি রক্ষা করবেন! "ধন্য আশা কুহকিনী। তোমার মায়া অসার সংসার চক্র ঘোরে নিরবধি।"

অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষ আমার কাছে একান্তে স্বীকার করেছেন যে, মুসলিম জনসংখ্যার "স্ফীতি যথেষ্ট আশঙ্কার কারন"। ভাবনার জগতে  এই পরিবর্তন রীতিমতো স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে দুটি কারণে। প্রথম কারণ অবশ্যই মুসলিম সম্প্রদায়ের লুম্পেন অংশকে কোন রাখঢাক না রেখে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার। সব দলই এই অংশকে ব্যবহার করে, তৃণমূল এই ব্যাপারে নির্লজ্জ, দুকানকাটা। দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই , মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সংখ্যালঘু নীতি। তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার ছিল  শিক্ষার বিস্তার ও অর্থনৈতিক মানোন্নয়ন। তিনি সে পথে না গিয়ে মাদ্রাসা প্রীতি দেখাতে শুরু করলেন, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কর্মসংস্থানের কথা না ভেবে ইমামদের ভাতার ব্যবস্থা করলেন।  মুসলিমদের আলাদা বাজার , এমনকি আলাদা মেডিকেল কলেজ ঘোষনা করলেন। সাচ্চার রিপোর্টে দেখা যায়, মুসলিমদের মাত্র চার শতাংশ মাদ্রাসা শিক্ষায় আগ্রহী ও শতকরা তিরিশ ভাগ বেশি পয়সা খরচ করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের পাঠাতে আগ্রহী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কার  প্ররোচনায়  মাদ্রাসা ও ইমাম ভাতার কথা ভেবেছেন জানিনা। কিন্তু, আম ভদ্র হিন্দুর কাছে যে বার্তা পৌঁছালো তা খুব মর্মস্পর্শী- তাঁরা মুসলিম মানেই মাদ্রাসা, মুসলিম মানেই ইমাম ভাতা, মুসলিম মানেই ওবিসি এই ধারনায় আক্রান্ত হলেন। 

"নাচায় পুতুল যথা দক্ষ বাজিকরে/নাচাও তেমনি তুমি অর্বাচীন নরে" এই পংক্তিটি শুধু কথার কথা নয়। কবির সুমন বাবু একদিন আমাকে বলেছিলেন- মমতা বন্দোপাধ্যায় হলেন খনা। দুশো বছর পর তার নামে মন্দির তৈরী হবে। তাঁর সেই কথা সত্য হবে কিনা জানিনা তবে এই রাজ্যের দরিদ্র জনতা যে তাঁকে গ্রহন করেছিলেন তার প্রমান ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। কিন্তু তিনি সবাইকে হতাশ করেছেন ও বাংলায় বিভাজন তরান্বিত করতে তাঁর ইন্দ্রজাল কাজে লাগিয়েছেন। বিশেষতঃ সচেতন অসাম্প্রদায়িক মানুষের ভাবনার জগতে হিন্দু মুসলিম বিভাজন আরো বেশি গাঢ় হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর আচরণে। মুসলিম ভোটের জন্য পাগল হয়ে তিনি বিশেষ বিশেষ মহল্লায় বেশবাশে সচেতন যত্ন নিতে শুরু করলেন। গ্রামে গঞ্জে চাষী মুসলমান, যারা এ রাজ্যের মুসলমান জনসংখ্যার সিংহভাগ, তারা আর পাঁচজন বাঙালীর মত মাথায় ঘোমটা দেন। কিন্তু বিশেষ পোষাক পরে মুখ্যমন্ত্রী একটি নতুন ঘরাণার সাথে মুসলিম সম্প্রদায়ের একাত্মতা তৈরীর চেষ্টা করলেন। তাঁর ইন্দ্রজালে মুগ্ধ হল নিরক্ষর, অনভিজ্ঞ, সহজ সরল গ্রামীন মানুষগুলি।  ওয়াহাবি চেতনার সাথে যুক্ত এই বেশবাস গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করলো। যে ভাবে ওপার বাংলায় বাঙালী-মুসলিম, মুসলিম-বাঙালীতে রূপান্তরিত হয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী সেই পরম্পরা তৈরিতে বিশেষ উদ্যোগ নিলেন। একশ্রেণীর মুসলিমদের ভোট তিনি পেলেন কিন্তু বিভাজনও হল সম্পূর্ণ । 
এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী তাঁর স্বাভাবিক অভিনয় জারি রেখে বিজেপিকে হারাতে ভোট যাঞ্ছা  করছেন। এই সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির স্রষ্টা  তিনিই, খুব সচেতন ভাবে তিনি এই মহাযেজ্ঞ সম্পন্ন করেছেন। আর ফেরার কোন পথ বাকি নেই। সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির উন্নতির স্বার্থে তাঁর বিদায় প্রয়োজন, হয়ত সেটাই অবধারিতও।  আনন্দবাজার যতই আবেগময়, ওজস্বীতা দেখাক, বিভাজনের রাজনীতি ঢাকিসহ বিসর্জন ভবিতব্য। বাঙালী যেমন বিজেপি কে চিনতে ভুল করে নি, তাঁর বিভাজনের রাজনীতি সম্পর্কে ও সম্যক অবহিত।

ইভিএম কারচুপি ~ প্রতিভা সরকার

মোদীমুক্ত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখছেন বুঝি ? ভেবেছেন জানমাল বাঁচিয়ে সন্তানের লেখাপড়া, কাজকামের পথ সুগম হবে ? চাষীশ্রমিক আত্মহত্যা না করে বিরাট মিছিলে নিজের দাবী বুঝে নেবে, এইরকম ভাবনা আপনার ? বেসরকারি করণ রুখে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় মসৃণ কাজ হবে,কর্পোরেটকে জলজঙ্গলজমি বেচা কমবে আর গরীবকে জাতধর্মখাদ্যের কারণে পিটিয়ে মারা হবে না, এইরকম খোয়াব দেখেন বুঝি, সাহেব ? দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে লাটে তোলা আর ঘোটালার বিরুদ্ধে লড়াকু মানুষগুলোকে গুলি করে মারা এই গডসের ভজনাকারী সরকার নিপাত যাক, এইরকম আপনার চাওয়া ?

সে গুড়ে কড়কড়ে বালি পড়ার সম্ভাবনাই বেশি।

শুনুন দাদাদিদি, ভাইবহেনরা, নির্বাচনের শেষ ভাগে দাঁড়িয়ে এখনো যদি জোট না বাঁধেন, যদি নোটায় ভোট দেবার কথা ভাবেন, শুধু খিল্লি ওড়ান বালনরেন্দ্রের ত্রেতাযুগে ইন্টারনেট আর ডিজিটাল ক্যামেরা ব্যবহার নিয়ে,সন্দেহভাজন অর্থলোভী, গদিলোভী দলত্যাগীদের বিরুদ্ধে হাতে হাত না মেলান, যদি প্রতিরোধ গড়ে না তোলেন, তবে আপনার জন্য থাকবে শুধু স্বপ্নের বুজকুড়ি আর ঘুম ভাঙার পর মুখে তেতো স্বাদ। 

আপনার মনে পড়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর উড়োজাহাজ থেকে নামানো বিরাট বাক্স হাতে হাতে ভ্যানিশ হয়ে যাবার কথা ?  কী ছিল তাতে কেউ জানেনা এখনো, কিন্তু যে সৎ প্রশাসক হুজুরের হেলিকপ্টারে নিয়ম মাফিক তল্লাশি চালিয়েছিলেন ইতোমধ্যে তিনি ছাঁটাই হয়েছেন। 
পুরো রহস্য উপন্যাসের ধাঁচে নির্বাচনের এক একটি চ্যাপ্টার লেখা হচ্ছে বহুদিন ধরে। ফ্রন্টলাইনের মতো ইনভেস্টিগেটিভ জার্ণাল তথ্যপ্রমাণ দিয়ে ইভিএম লোপাট হবার কথা লিখেছে। একটা আধটা নয়, ২০ লাখ ইভিএম ভোটের আগেই উধাও হয়ে গেছে, আপনি জানেন ? মুম্বাই হাইকোর্টে পি আই এল করে এই তথ্য সামনে এসেছে, কিন্তু আমাদের কাছে তা হয়তো পৌঁছবে ভোটের পর। 

ইভিএমের কাজে নানা গড়বড়ির অভিযোগ বহু পুরনো। বিরোধী দলের এইসব অভিযোগে কান দেয়নি সব-দেখেও-কিছু-না-দেখা নির্বাচন কমিশন। এমনকি বিরোধীদের ন্যায্যতম দাবী, প্রত্যেক এসেম্বলি সেগমেন্টে ৫০% ভিভিপ্যাটের সঙ্গে ইভিএমের ফলাফল মিলিয়ে দেখার দাবীও কমিশন হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছে। 

কিন্তু মুম্বাই হাইকোর্টে পি আই এল করে ঝুলি থেকে বেড়াল বার করে এনেছেন আর টি আই এক্টিভিস্ট বঙ্গসন্তান মনোরঞ্জন রায়। ইভিএম এবং ভিভিপ্যাট সংরক্ষণের দায়িত্ব যাদের সেই কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য ইলেকশন কমিশনের হাঁড়ি হাটে ভেঙে দিয়েছেন। দেখা গেছে  ইভিএমের অর্ডার, সাপ্লাই, ডেলিভারি, তিনটে ধাপেই বিস্তর গোলযোগ। শুধু তাই নয়, এতে করে বিস্তর টাকা নয়ছয় করা হয়েছে, যার পরিমাণ ১১৬.৫৫ কোটি। পিএলআইতে পরিষ্কার দেখানো হয়েছে যতো ইভিএম, ভিভিপ্যাটের অর্ডার গেছে এসেছে তার থেকে বহুগুণ কম। ইলেকশন কমিশনের কাছে অর্ডারমাফিক যতো ইভিএম থাকার কথা, আছে তার থেকে ২০ লক্ষ কম। ম্যানুফ্যাকচারিং কম্পানি কিন্তু জানিয়েছে তারা ঠিকঠাক ডেলিভারি দিয়েছে। সে সংক্রান্ত কাগজপত্রও তৈরি আছে তাদের কাছে। 

তাহলে এই ইভিএমগুলি গেল কই ? গোটা নির্বাচনী সময় ধরে সেগুলোতে কারসাজি করা হচ্ছে নাকি ? জেতা নিয়ে সন্দেহ আছে এইরকম নির্বাচনী ক্ষেত্রে কোন বিশেষ দলকে জিতিয়ে দেবার জন্য ? 

আর কি বিপুল টাকাকড়ির নয়ছয় ! গত দশ বছরে, নির্বাচন কমিশন জানিয়েছিল, ইভিএম বাবদ খরচ হয়েছে ৫৩৬,০১,৭৫,৪৮৫ টাকা। যেই না আর টি আই করার পর চুলচেরা বিচার হলো, অমনি সেটা দাঁড়িয়ে গেল ৬৫২,৫৬,৪৪,০০০ টাকায়। কাকেশ্বর কুচকুচকে ডাকতে হবে নাকি ? 

ইলেকশন কমিশন আদালতে হলফনামা দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে কোনো ইভিএম সে স্ক্র‍্যাপ হিসেবেও বিক্রি করেনি কখনো। এই বাড়তি মেশিন কোথায়, বাড়তি টাকা কোন নেপোর পকেটে সে রহস্যের মীমাংসা কোনদিন হবে কিনা জানা নেই, ভোট ফুরোবার আগে তো নয়ই। মামলাটাই চলছিল এক বছরের বেশি সময় ধরে। 

স্বৈরাচারীর ভেক অনেক। 
গ্রাম নগর হাট বাজার বন্দরে তৈরি হও।

বুধবার, ১৫ মে, ২০১৯

বিদ্দ্বজ্জনদের বিবৃতি ~ ড: অরুণাচল দত্ত চৌধুরী

ছিঃ সিপিএম, ছিঃ সিপিএম, ছিঃ সিপিএম
ছিঃ...
অ্যান্টেনাতে গোপন কাণ্ড বামাল ধরেছি।
আমরা যারা বিদ্দ্বজ্জন, চিন্তা-ভাবনা করি,
দেশের জন্য চিন্তাযুক্ত দিবস ও শর্বরী, 
ভাবতে ভাবতে ষড়যন্ত্র সবটা পরিষ্কার!
বিদ্যাসাগর মূর্তি ভাঙার দোষটা ধরিস কার?
ঘাসফুল না পদ্মও না, ধরেছি... শেম শেম.
তলায় তলায় কলকাঠিটা নাড়ল সিপিএম!

হাজার খানিক জঙ্গি ক্যাডার সাজিয়ে গেরুয়াতে
অমিত বাবুর মিছিলটাতে লাঠি ও রড হাতে
আর কয়েকটা গুন্ডা ছোঁড়া...ছদ্ম এসএফআই
ইট-পাটকেল, মূর্তি ভাঙার মাসতুতো সব ভাই...
বিদ্যাসাগর আর সিইউএ মজুত। বাধায় হামলা।
এ কাণ্ড সেই সিপিএমের... অতি সহজ মামলা।
এই সঙ্গেই প্রকাশ পেল, জানা উচিত সবার...
জ্ঞানেশ্বরী...  ভাঙচুর সেই প্রাচীন বিধানসভার,
তাণ্ডব সব সিপিএমের নিখুঁত ষড়যন্ত্র।
সিপিএমকে ঘায়েল করে বাঁচাও গণতন্ত্র!!!

ভুবনের মাসিগণের কুম্ভীরাশ্রু ~ ডঃ বিষাণ বসু

বিদ্যেসাগরের মাথা কাটা গ্যাছে। তাই নিয়ে জোর শোরগোল। আপামর বাঙালীর নাকি মাথা কাটা গ্যাছে। তা বেশ! কথায় বলে, মাথা নেই, তার মাথাব্যথা।
রামকৃষ্ণদেব নাকি ঈশ্বরচন্দ্রকে বলেছিলেন, তুমি তো বাবা এমনিতেই সিদ্ধ। সিদ্ধ হলে কী হয়। নরম হয়। তা, বাবা, তোমার মনটি তো গরীব-দুঃখীর দুখে কাঁদে, এমনই নরম। তুমি যদি সিদ্ধ না হও, তাহলে সিদ্ধপুরুষ কে!!
তা গদাধরবাবুর জানা ছিল না, শুধু সিদ্ধ হয়েই নরম হয় না, মাছ নরম হয় পচলে। এই যে বাঙালী ঝাঁকের কই নরম হয়েছে, মূর্তি ভাঙার শোকে একদম ভেঙে পড়েছে, তার মূলে ওই, পচন।
সে নরম আবার এমনই নরম, যে, একেবারে ন্যাতপেতে হয়ে আছে। হাড়-মাস-মাথা-শিরদাঁড়া আলাদা করাই মুশকিল, এক্কেরে জেলিফিশতুল্য। একটা পুরো জাতি চোদু গোপাল হয়ে বসে আছে। যাহা পায়, তাহা খায়, সে এমনকি এবিপি আনন্দ হলেও।
প্রতিবাদ থেকে পোতিবাদ হয়ে অভ্যেসটাই যখন বাদ হয়ে গেল, বিদ্যাসাগর মশাইকে এর মধ্যে টানাহেঁচড়া করা কেন!!!
শিক্ষাদীক্ষায় হইহই করে পেছনের দিকে এগিয়ে চলার সময়, এমনকি লেখাপড়ার মত একটা ব্যাপারের মধ্যে প্রাইভেট স্কুল এডুকেশন ব্যবস্থা লাগু করে সরকারি ইস্কুলগুলো লাটে তুলে দেওয়ার সময় বিদ্যেসাগরমশাইকে ফুলবেলপাতা দেওয়া হচ্ছিল। আজ মূর্তি ভাঙার মুহূর্তে হাহাকার করা তো আমাদেরই সাজে!!!!
দুচারটে ধর্ষণ-টর্ষণ খবরের কাগজের মাঝের পাতায় ছাপা হয়। রেপিস্টকে পালাতে সাহায্য করে দিব্যি ভোটে দাঁড়ানো যেতে পারে। বিদ্যেসাগরের মূর্তিতে ফুলবেলপাতা আমরা চড়াচ্ছিলাম। দায়িত্ব নিয়ে।
ধর্ম, না ধর্মাচরণকে প্রকাশ্য রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায় এনে ফেলে জাতিবিদ্বেষ-ধর্মবিদ্বেষকে যখন ভোটে কনভার্ট করার স্ট্র‍্যাটেজি সাজানো হচ্ছিল, তখনও বিশ্বাস করুন স্যার, আমরা কিন্তু কিচ্ছুটি বলিনি। শুধু আপনার মূর্তির পাদদেশে সাজানোর জন্য বেলপাতা বাছছিলাম। যে নবজাগরণের হাত ধরে দেশের জাতীয়তাবাদের সূচনা হয়েছিল, সেইসব "ভুলভাল" ইতিহাস ছেড়ে আমরা নতুনভাবে "জাতীয়তাবাদী" হচ্ছিলাম। আর বলছিলাম, ওরা যদি মহরমে অস্ত্র নিয়ে মিছিল করে, তাহলে এরাই বা করবে না কেন, রামনবমীতে!!! বিদ্যাসাগর স্যার, বিশ্বাস করুন, আমরা কিন্তু "ওরা" নই, আবার "এরা"-ও নই, আমরা জাস্ট নিরপেক্ষ। আসলে ডমিন্যান্ট মেজরিটির হয়ে "নিরপেক্ষতা"-র অর্থ ঠিক কী, আমরা বুঝতে চাইনি। কেননা, আমাদের পেছনে অত দম কোথায়!!!
যাক গে সেসব কথা।
মোদ্দা ব্যাপারটা হল, বিদ্যাসাগরমশাই বেঁচে থাকতেই পালিয়েছিলেন। লোকটার, আর কিছু না থাক, দূরদৃষ্টি ছিল। তাঁর নামের কলেজটিতে বাছাই কিছু খিস্তি এবং পকেটে ইঁট নিয়ে যাঁরা শ্রদ্ধা জানাতে জড়ো হয়েছিলেন, সেইসব ক্ষুরধার বিদ্যার্থীদের মানসচক্ষে দেখতে পেয়েই তিনি সাঁওতাল পরগণায় পালিয়েছিলেন। সময় থাকতে থাকতেই। কাজেই, সেই খিস্তি ও ইঁটের প্রতিবাদে যাঁরা মিছিল থেকে হইহই করে বিদ্যাসাগর কলেজে সগৌরবে প্রবেশ করলেন, তাঁদের মুখোমুখি তাঁকে হতে হয় নি।
কাজেই, চোখের জল মুছুন। বিদ্যাসাগরমশাই তেমন একটা চোট পান নি। রিল্যাক্স।
বর্ণপরিচয় পড়েছেন তো? গল্পটল্পগুলো তো জানা আছে নিশ্চয়ই?
তা ভুবনের গল্পটা মনে পড়ে? পুরোনো গল্প। একটু বাসি হয়ে গিয়েছে। আজকাল চুরিটুরিতে শাস্তি তেমন একটা হয় না (ফাঁসির তো প্রশ্নই নেই)। একজন ভোটপ্রার্থী তো বুক ফুলিয়ে বলেইছেন, জেলে থাকাটাই ভোট পাওয়ার জন্যে তাঁর ইউএসপি। কিন্তু, কথাটা সেই নিয়ে নয়।
গল্পের শেষটা মনে করে দেখুন।
সাজাপ্রাপ্ত ভুবন তার সাজার আগের মুহূর্তে মাসিকে ডেকে পাঠায়। বলে, মাসিকে কানেকানে কিছু বলতে চায়। হ্যাঁ, সেই মাসি, যিনি কিনা ভুবনের ছোটখাটো অপরাধ দেখে চুপ থেকে, দেখেও না দেখার ভান করে মাধবকে দাগী অপরাধীতে পরিণত হতে সাহায্য করেছিলেন।
তা সেই মাসি ভুবনের মুখের কাছে কান নিয়ে আসতেই, ভুবন মাসির সেই কান কামড়ে কেটে নেয়। পরের কথাটুকু বর্ণপরিচয় থেকেই।
"পরে ভর্ৎসনা করিয়া কহিল, মাসি! তুমিই আমার এই ফাঁসির কারণ। যখন আমি প্রথম চুরি করিয়াছিলাম, তুমি জানিতে পারিয়াছিলে। সে সময়ে যদি তুমি শাসন ও নিবারণ করিতে, তাহা হইলে আমার এ দশা ঘটিত না। তাহা কর নাই, এজন্য তোমার এই পুরস্কার হইল।"
না, এইসব ঘটনা আর কিছু নয়। জাস্ট একটু একটু করে কানের কামড়। ভুবনরা বেড়েছে। বাড়ছে। অবাধে।
আমরা সবাই ভুবনের কানকাটা মাসি।  

শুক্রবার, ১০ মে, ২০১৯

শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোনো ওই ~ সুশোভন পাত্র

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন বাংলায় কমিউনিস্টদের খুঁজতে দূরবীন লাগবে। অমিত শাহর খোয়াবনামা কমিউনিস্ট মুক্ত দেশ গড়বেন। স্টুডিওর ইনফো-গ্রাফিক্সে অর্ণব গোস্বামীরা লিখে দিয়েছেন কমিউনিস্টরা শূন্য। পোষ্ট মর্ডানিস্ট তাত্ত্বিকরা গবেষণা করে জানিয়ে দিয়েছেন বিশ্বে কমিউনিজম ব্যর্থ। ঐ দোকানের মার্ক্স ভালো, সেই দোকানের এঙ্গেলস, কিম্বা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ -এসব এখন অতীত। এখন নাকি পুঁজিবাদের তিন তলা বাড়ি, সবটাই শাড়ি। 
অথচ তুরস্কের মধ্য-পূর্বে পাহাড় ঘেরা টুনজেলি প্রভিন্স নতুন করে সেজে উঠেছে লাল ঝাণ্ডায়। সম্প্রতি নির্বাচনে সাক্ষরতার হারে এবং জীবনযাত্রার সূচকে তুরস্কের শীর্ষ শহর ডারসিম বেছে নিয়েছে কমিউনিস্টদেরই। তুরস্কের ইতিহাসে প্রথম। সেই তুরস্কে, যে তুরস্কের রাজনীতি তে ধর্মের আফিম আজ আকছার। সেই তুরস্কে, যে তুরস্কে বিগত ১৬ বছর ক্ষমতায় চরম দক্ষিণপন্থী তায়িপ এরদোগান। বদলে ফেলেছেন সংবিধান, বদলে ফেলেছেন নির্বাচনী ব্যবস্থা, নিষিদ্ধ কুর্দিসরা, সরকারের বিরুদ্ধে বলার জন্য খুন হয়েছেন সাংবাদিকরা, লগ্নি পুঁজির জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জন্য দরজা। সেই তুরস্কেই বেপরোয়া মূল্যবৃদ্ধি আর বেকারত্বের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন মানুষ। ২৫ বছর পর এরদোগানের পার্টি হেরেছে ইস্তানবুলে। হেরেছে রাজধানী শহর আঙ্কারাতে। 
প্যারিসের রাজপথ আজ স্তব্ধ প্রতিবাদে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রচারে আর্থিক উদারীকরণের নীতির বিরুদ্ধেই ঝড় তুলে ইমানুয়েল ম্যাক্রনের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছেন বামপন্থী প্রার্থী জ্যাঁ-লুক মেলেশোঁ। একলাফে ভোটের হার বেড়েছে ৮.৫%। মেলেশোঁ চেয়েছিলেন ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, সবার জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যপরিষেবা, কর্পোরেটদের আয়কর বৃদ্ধি। চেয়েছিলেন সমরাস্ত্র শিল্প এবং বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের জাতীয়করণ। 
আজ মোহন ভাগবতরা বলছেন 'কমিউনিস্টরা দেশের শত্রু, এঁদের উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার'। কমিউনিস্ট'দের উচিত শিক্ষা সেদিন গোয়েরিং'ও দিতে চেয়েছিলেন। হিটলারের জন্য মাইলের পর মাইল অস্বাস্থ্যকর জলাভূমি'টাকে বেড়া দিয়ে বেঁধে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বানাবার মাস্টারস্ট্রোকটা যার মস্তিষ্ক প্রসূত ছিল, সেই হেরমান গোয়েরিং। আশি হাজার ক্লেদক্লিষ্ট বন্দীর সামনে বুখেনভাল্ড ক্যাম্পের উদ্বোধনী ভাষণে গোয়েরিং বলেছিলেন "উচিত শিক্ষা দিয়ে কমিউনিস্ট'দের সমাজের উপযুক্ত করেত এই সামান্য আয়োজন।" স্বপ্ন মুসোলিনিও দেখেছিলেন একার হাতেই কমিউনিস্টদের চিতা সাজানোর। সোভিয়েত পতনের উল্লাসে বিগলিত মার্গারেট থ্যাচারও সেদিন বলেছিলেন, 'There is no alternative to Capatalism'  
অথচ আজ ব্রিটেনেই থ্যাচারের কনজারভেটিভ পার্টির থেরিসা মে'র সরকার ঝুলছে সুতোর উপর। ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের কুর্সি দখলের লড়াইয়ের ফালক্রামে এখন লেবার পার্টির সোশ্যালিস্ট নেতা জেরেমি করবিন। যে ব্রিটেনে বেসরকারিকরণ কে 'সরকার পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান' বলেছিলেন থ্যাচার; গ্যাস, ইলেকট্রিক এমনকি পানীয় জল সহ ৪৭ বিলিয়ন পাউন্ড রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তি পুঁজিপতিদের বিলিয়ে দিয়েছিলেন থ্যাচার; ট্রেড ইউনিয়ন কে অর্থনীতির জন্য 'ক্ষতিকারক' হিসেবে দাগিয়ে দিয়েছিলেন থ্যাচার; সেই ব্রিটেনেই করবিনের হাত ধরে আজ রাজনীতির ন্যারেটিভে পুনর্জাতীয়করণের কথা। ট্রেড ইউনিয়নের প্রসারের কথা। ধনীদের উপর কর, ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর কথা। কর্মসংস্থান, সামাজিক কর্মসূচীতে ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা। 
ভালো নেই পুঁজিবাদের আঁতুড় ঘর আমেরিকাও। ২০০৮-র রিসেশেনের পর তুমুল বেড়েছে বেকারত্ব, ৮১% নাগরিকের কমেছে আয়। উগ্র দক্ষিণপন্থী ট্রাম্পের রিপাবলিকান সরকারের মহিলা বিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ, অভিবাসী বিরোধিতা, যুদ্ধ জিগির ছুঁড়ে ফেলে তাই বিকল্প খুঁজে নিচ্ছে আমেরিকার সাধারণ মানুষই। মধ্যবর্তী নির্বাচনে জয়জয়কার ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট'দের। লাতিনের মহিলা হিসেবে প্রথমবার জিতেছেন ভেরোনিকা এসকোবার, সিলভিয়া গার্সিয়া। আদি জনগোষ্ঠীর ডেব হালান্ডরা। জিতেছেন প্যালেস্তিনীয় উদ্বাস্তু পরিবারের সন্তান রাশিদা তালিব, কেনিয়ার রিফিউজি ক্যাম্পে বেড়ে ওঠা ইলহান ওমররা। টেক্সাস-মিশিগানের অলিতে  গলিতে তাঁরা বলছেন 'আমেরিকা কর্পোরেট লুটের শিকার। শ্রমজীবী মানুষ আর তাঁদের পায়ের তলায় থাকবে না।' আর এই বিকল্প পথের নেতৃত্বে বার্নি স্যান্ডারস। কি বিকল্প চান স্যান্ডারস? সরকারি স্বাস্থ্যবীমা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ফি মকুব, ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট-র অবসান, মহিলা-সংখ্যালঘুদের অধিকার, ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, আর ধনীদের উপর চড়া হারে কর।
গর্ভাচেভ আর ইয়েলৎসিন দেখানো মুক্তবাজার অর্থনীতির রঙিন স্বপ্নে বুঁদ হয়ে তখন ভাঙ্গছে সোভিয়েত। জনৈক মিখাইল'র সেই সময়ের অভিজ্ঞতা তাঁর নোবেল জয়ী "সেকেন্ড-হ্যান্ড টাইমঃ দ্য লাস্ট অফ দ্য সোভিয়েতস" বইয়ে লিখেছেন বেলারুশিয়ান সাংবাদিকা স্বেতলানা অ্যালেক্সিভিচ -"সোভিয়েত ভাঙ্গার খুশিতে আমি মস্কোর হোয়াইট হাউসের সামনে মানব বন্ধনে হাত মিলিয়ে ছিলাম। কমিউনিজম আর যাতে কোনদিন ফিরে না আসে তার জন্য জীবন বাজি রেখেছিলাম। আমরা বলেছিলাম কমিউনিজম চিরকালের জন্য মৃত। তারপর কেটে গেছে ২৫টা বছর। আমার ছেলে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কদিন আগে গিয়েছিলাম তার হোস্টেলে। দেখি ডেস্কের উপর পড়ে আছে মার্ক্সের দাস ক্যাপিটাল। আড়ি পেতে শুনলাম আমার ছেলে আলোচনা করছে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো নিয়ে। নিজের চোখ, আর কান'কেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হয়েছিল নিজের হাতে যে মার্ক্স কে কফিন বন্দী করে এসেছিলাম সেই মার্ক্সই কি আবার ফিরে এলো?" 
হ্যাঁ, এলো। আসলে স্তালিনের নাম শুনলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে আপনি উঠতেই পারেন, সোভিয়েতের প্রশংসায় 'অ্যানিম্যাল ফার্মের' অর্গাজমে স্বর্গসুখ আপনি পেতেই পারেন, বলিভিয়ার নিবিড় অরণ্যে ঐ দাড়িওয়ালা গ্ল্যামারাস ডাক্তার ছেলেটার মৃত্যুর প্রতি নিরাসক্ত আপনি থাকতেই পারেন, তীব্র শৈত্য প্রবাহে রেড আর্মির লং-মার্চ কিংবা পাভেল করচাগিনের ইস্পাত কঠিন লড়াই কে ব্যঙ্গ আপনি করতেই পারেন, এমনকি ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিনের দাড়ির থেকে রামদেবের দাড়িই আপনার বেশি পছন্দ হতেই পারে; কিন্তু গীতার 'শ্লোক' থেকে কোরানের 'সূরা' হয়ে বাইবেলের টেস্টামেন্ট -কোথাও এই ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের অর্থনীতির বিশল্যকরণী খুঁজে আপনি পাবেন না। পুঁজিবাদী বাজারে হিন্দু-মুসলমানের ক্যালোরির আলাদা হিসাব কষতে আপনি পারবেন না। মুক্তবাজারের মুনাফা তে ব্রাহ্মণ-দলিত'র 'উদ্বৃত্ত শ্রমের' পার্থক্য করতে আপনি পারবেন না। ধর্মের বুলি কপচে দু'বেলা দু'মুঠো ভাতও জুটিয়ে আপনি দিতে পারবেন না। কারণ বাস্তব এটাই যে আপনার-আমার শ্রম আজ 'বাজারের পণ্য'। বাস্তব এটাই যে শ্রমের শোষণেই পৃথিবী জোড়া সম্পদের এই প্রবল বৈষম্য। আর বাস্তব এটাও যে ধর্মশাস্ত্র বা অ্যাডাম স্মিথের 'দি ওয়েলথ অফ নেশনশ'র পুঁজিবাদী মুক্ত বাজারে নয়; দাড়ি বুড়োর 'দাস ক্যাপিটাল'ই বন্দী আছে অর্থনীতির সাম্য।

সোমবার, ৬ মে, ২০১৯

ছবির গল্প, গল্পের ছবি ~ মিহিররঞ্জন মন্ডল

Joseph Goebbels
      ১৯৩৩ সাল। বিখ্যাত " লাইফ " ফটোগ্রাফার আলফ্রেড আইজেনেস্তাদ এসেছেন জেনিভায়, লিগ অফ নেশনস্- এর পঞ্চদশ অধিবেশন কভার করতে। শুনলেন হিটলারের  প্রধান প্রচার সচিব ড. গোয়েবেলস্ তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে উঠেছেন জেনিভার কার্লটন হোটেলে। তক্ষুনি তিনি কার্লটন হোটেলে ছুটলেন ছবি তুলতে। ওখানে গিয়ে দেখলেন গোয়েবেলস্ হোটেলের বাগানে একটা চেয়ারে বসে আছেন। কয়েকজনের সঙ্গে হেসে কথা বলছেন। পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি আর হিটলারের দোভাষী ড. পল স্কিমিট। দূর থেকে তাঁর কয়েকটি ছবি তুললেন আইজেনেস্তাদ। এরপর একেবারে কাছে এগিয়ে এলেন তিনি গোয়েবেলস্-এর কিছু ছবি তুলতে।
     গোয়েবেলস্ তখন পাশে কারও দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন। হঠাৎ আইজেনেস্তাদের দিকে তাঁর চোখ পড়ল। মুহূর্তে তাঁর মুখেরভাব পাল্টে গেল। দুচোখে ফুটে উঠল তীব্র ঘৃণা আর বিদ্বেষ। চেয়ারের হাতলটা শক্ত করে চেপে ধরলেন। এই ইহুদিটা কিনা তাঁর ছবি তুলছে! 
     আইজেনেস্তাদ এই মুহূর্তটির জন্যই যেন এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। এই সেই ছবিতোলার প্রকৃষ্ট সময়, ডিসাইসিভ মোমেন্ট। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ক্যামেরার শাটারে হাত পড়ল। টুক করে ছবিটি তিনি তুলে ফেললেন। গোয়েবেলস্- এর কিছুই করার নেই। কারণ লাইফ পত্রিকার অ্যাক্রেডিটেড ফটোগ্রাফার আইজেনেস্তাদ। তাই ছবি তিনি তুলতেই পারেন। 
    ছবিটি সম্পর্কে অনেকপরে আইজেনেস্তাদ বলেছিলেন- " ছবিটার ক্যাপশন হওয়া উচিত ছিল- ফ্রম গোয়েবেলস্ উইথ লাভ। "
    আইজেনেস্তাদ ছিলেন জার্মান- ইহুদি। নাৎসিদের অত্যাচারে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন ইউরোপে।  তখন দলেদলে জার্মান আর অস্ট্রিয়ান ইহুদিরা দেশ ছেড়ে চলে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন সুইৎজারল্যান্ড, সোভিয়েট ইউনিয়ন ও আমেরিকায়।
 চিত্র সাংবাদিক হিসাবে আইজেনেস্তাদ অনেক আগে থেকেই পরিচিত ছিলেন। নাৎসি নেতাদের উপর ছিল তাঁর প্রচন্ড ঘৃণা।
     জোসেফ গোয়েবেলস্ নিজে ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্মান ফিলসফিতে ডক্টরেট করেছিলেন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন রুগ্ন। একটা পা ছিল খোঁড়া। শৈশবে পোলিও রোগে আক্রান্ত হওয়ার ফলে এমন হয়েছিল। গোয়েবেলস্ ছিলেন প্রচন্ড উচ্চাভিলাষী। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাঁর পথে বাধা সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু তাঁর প্রচন্ড ইহুূদি বিদ্বেষের জন্য তিনি হিটলারের নজরে পড়েছিলেন। হিটলার তাঁকে করেছিলেন তাঁর প্রধান প্রচারসচিব।
     নাৎসিদের প্রচার সচিব হিসাবে গোয়েবেলস্- এর বৈশিষ্ট হল জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে তাঁর মতবাদ, ইহুদিদের ধ্বংস ও কমিউনিজম বিরোধিতা। তাঁর মতে জনসাধারণকে প্রভাবিত করতে হলে দরকার হলে মিথ্যা বলতে হবে এবং তা বারবার। তাহলে একসময় মিথ্যাটাই তাদের কাছে সত্য বলে মনে হবে। জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে পারতেন গোয়েবেলস্। জার্মান যুবসম্প্রদায়কে উদ্বুদ্ধ করতেন এভাবেই। 
     গোয়েবেলস্ জার্মান গণমাধ্যমগুলি দখল করে নিয়েছিলেন। দেশের সমস্ত পত্রপত্রিকাকে বাধ্য করা হয়েছিল নাৎসি মতবাদ প্রচার করতে। সে সময় সবে রেডিও এসেছে। গোয়েবেলস্ রেডিও সম্প্রচারের উপর একচেটিয়া অধিকার কায়েম করেছিলেন। যুদ্ধের সময় শোনা যেত হিটলার আর গোয়েবেলস্- এর রণহুঙ্কার। মিথ্যা প্রচার করে দেশের প্রকৃত অবস্থা জার্মান জনসাধারণকে জানতে দেওয়া হত না। এমনকি জার্মানি যখন যুদ্ধে পিছু হটছে তখনও নাৎসিদের সপক্ষে ক্রমাগত প্রচার করে গেছেন গোয়েবেলস্।
     ১৯৪৫ সাল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষের দিকে মিত্রশক্তি তখন ক্রমাগত বার্লিন শহরের বুকে বোমাবর্ষণ করে ছারখার করে দিচ্ছে। জার্মানির পরাজয় আসন্ন। রেড আর্মি এগিয়ে আসছে। গোয়েবেলস্ ঠিক করলেন সপরিবারে তিনি আত্মহত্যা করবেন। কিছুতেই শত্রুর হাতে ধরা দেবেন না। ১লা মে স্ত্রী মাগডা আর ছয়টি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে প্রবেশ করলেন মাটির নীচে হিটলারের বাঙ্কারে।
     ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কিছুই জানে না। কী হতে চলেছে তাদের কোন ধারনাই নেই। হেলগা- ১২, হেলডেগার্ড- ১১, হেলমুট- ৯, হোলডি- ৮, হেডুউইগ- ৬ এবং  হেইডা - ৪....... নিজেদের ফুলের মতো  এই শিশুদের মেরে ফেলার নির্দেশ দিলেন তাদের নিজের বাবা- মা। মরফিন আর সাইনাইড দিয়ে শিশুদের মেরে ফেলা হল। পরে আত্মহত্যা করলেন গোয়েবেলস্ আর মাগদা।
     এভাবেই শেষ হল হিটলারের প্রধান প্রচারসচিব গোয়েবেলস্- এর গোটা পরিবার।

বুধবার, ১ মে, ২০১৯

এটা একটা ভূতের গল্প ~ আর্কাদি গাইদার

May Day
গল্পজুড়ে অনেকগুলো ভূত। ১৮৮৬ সালে হে মার্কেটে আট ঘন্টা কাজের দাবীতে যে শ্রমিকরা ডাইনামাইট ছুড়েছিলো, এবং তারপর যাদের ফাঁসি হয়, সেই শ্রমিকদের ভূত, ডাইনামাইটের ভূত, ফাঁসির দড়ির ভূত। ঠিক ১৯ বছর পরে আবার সেই ডাইনামাইট ব্যাবহার হবে রাশিয়াতে। আবার ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে বহু লোক।
ইউরোপের এক ছোট্ট শহর স্যারাএভোতে এক নৈরাজ্যবাদী গুলি চালাবে অস্ট্রিয়ান রাজকুমার ফার্ডিনান্ডকে লক্ষ্য করে। এইরকমভাবেই শুরু হবে বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস। সেই ইতিহাসের সমাপ্তিও ঘটবে ঠিক ৮০ বছর পরে, এই একই শহরে। ইউটোপিয়া চেয়েছিলো যারা, তাদের দিকে আঙ্গুল তুলে হাসবে গোটা বিশ্ব। ইউগোস্লাভিয়া ভেঙে টুকরো হবে। ইউটোপিয়ার শবদেহের ওপর মেমোরিয়াল স্টোনের মতন জেগে থাকবে সারাএভোর ভূত।

শতাব্দীর শুরুর দিকেই, জার্মানিতে একদিন ব্রাউনশার্টরা পিটিয়ে মারবে রোজা লাক্সেমবার্গ নামক এক শীর্ণকায় মহিলাকে। তারপর তার দেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হবে। ওয়াইমার রিপাব্লিকের ভূত আকাশে উড়তে উড়তে দেখবে, রাইখস্ট্যাগে আগুন লেগেছে। যে রাতে আগুন লাগবে, তার পরেরদিনই বিভিন্ন খবরের কাগজে খবর হবে, যদিও আগুন লাগবার আগেই প্রেসে কাগজ ছাপা হয়ে গেছে। সেই আগুনের ভূত আবার জ্বলবে গ্যেরনিকায়, যখন ফ্রাঙ্কোকে সাহায্য করতে হিটলার আর মুসোলিনির বিমান বাহিনী গোটা শহরটিকে বোমায় মুড়ে দেবে, আর স্পেনের আকাশে উড়ে বেড়াবে কমিউনিষ্ট আর রিপাব্লিকানদের পোড়া ভূত। তবুও সেই আগুনের ক্ষিদে মিটবে না, আউশউইতজের ফার্নেসে সে জ্বলতে থাকবে ধিকিধিকি করে। আর ফার্নেসের বাইরের ঘরে পড়ে থাকবে ডাই করে রাখা চুল, যা ইহুদিদের মাথা থেকে কেটে জড়ো করা হয়েছে। ঠিক এরকম চুলের পাহাড় পাওয়া যাবে ইস্ট পাকিস্তানের পাকিস্তানি আর্মি ব্যারাকগুলোর মধ্যে। আশেপাশের গ্রামের মহিলাদের তুলে আনবার পরে দিনের পর দিন ধর্ষণ করবার আগে তাদের চুল কেটে রাখা হবে, যাতে নিজেদের চুল ব্যাবহার করে ঝুলে পড়ে নিজেরা আত্মহত্যা না করতে পারে। 

গ্রীস, ইতালি আর ইউগোস্লোভিয়ার পার্টিজান ব্রিগেডের হাতে যে রাইফেল দেখা যেতো, ঠিক সেইরকম রাইফেল দেখতে পাওয়া যাবে তেলেঙ্গানার কৃষক রমণীদের হাতে। তাদের ট্রেনিং দেবেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মি থেকে পালিয়ে আসা মেজর জয়পাল সিং। তারপর নিজামের রাজাকার আর পটেলের সেনাবাহিনীর হাতে খুন হয়ে যাওয়ার পর সেই রাইফেলের ভূতগুলো ঘুমিয়ে থাকবে বেশ কিছুদিন, যতক্ষন না আবার ভিয়েতনামে আধপেটা খেয়ে থাকা চাষীরা তাদের হাতে তুলে নেয়।

জার্মানিতে, ফ্রান্সে দুই আর তিনের দশকে রাস্তা জুড়ে যে মিছিল আর ব্যারিকেড দেখা যেতো ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে সেই মিছিল আর ব্যারিকেডের ভুতগুলো এলোমেলো হয়ে ঘুরে বেড়াবে ১৯৬৮ অবধি, যখন আবার একদল ছাত্র তাদের জীবন্ত করে তুলবে বার্লিন আর প্যারিসের ইউনিভার্সিটিগুলোর মধ্যে। 
বার্লিনের দেওয়াল ভেঙে ফেলবার পর স্যুভেনির হিসেবে ইটগুলো সংগ্রহ করবে বহু কালেক্টর। দেওয়ালের ভূত দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। ইটগুলোর ভূতেরা ছত্রাখান সেনাবাহিনীর মতন ছড়িয়ে পড়বে ইউরোপ থেকে সারা পৃথিবী। ইউটোপিয়ার ভুত হাসবে, কারন নিজের অদৃষ্ট সে বহুদিন আগে বুঝেছিলো, যখন তার দেহথেকে পচা গন্ধ বেরোতে শুরু করেছে। কিন্তু দিশেহারা ইটের ভূতগুলোও সবাই শেষ হয়ে যাবে না। 
এরকমই একটা ইট ছোড়া হবে পুলিশকে লক্ষ্য করে, আমেরিকার সিয়াটেল শহরে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সামিটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলে। 

এরকম বহু ব্যারিকেড, মিছিল, ইট, বুলেট, দেওয়াল, আগুন, কবিতা গানের ভূত উড়ে বেড়াবে পৃথিবীর আকাশে। মাঝেমধ্যে উঁকিঝুকি মারতে থাকবে হাউড পার্কে, কুর্দিস্তান, শাহবাগ চত্বরে, বেগুসারাইতে।

তারপর অনেক অনেকদিন পরে কোন এক পয়লা মে'র আগের রাতে, নিজেদের বন্ধ দরজার পেছনে নিশ্চিন্তে ঘুমোবে সব রাষ্ট্রনেতা, মিলিটারি জেনারেল, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মালিক,  পাদ্রী, ইমাম, পুরোহিতরা। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। হাওয়া বইবে মৃদু তালে। হয়তো চাঁদ ঢাকা পড়বে মেঘের আড়ালে।
তারপর খুব মন দিয়ে কান পাতলে শোনা যাবে, কারা যেন ফিসফিস করছে। রাস্তায়, গলিতে, ডকে, কারখানায়, জনমানবশূন্য নদীর তীরে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে ভৌতিক সমাগম। ফিসফিসানির আওয়াজ তীব্রতর হবে। শোনা যাবে পায়ে পা মিলিয়ে কারা যেন মার্চ করছে। নিঃশ্বাস ফেলছে। গান গাইছে। কোন এক পয়লা মে'র আগের রাতে ভৌতিক কাগজে, ভৌতিক কালিতে পৃথিবীর প্রতিটা মহাদেশে, প্রতিটা শহরে, প্রতিটা গ্রামে দেওয়ালে দেওয়ালে সাঁটা হবে ভৌতিক পোস্টার। অশরীরী অক্ষরে কারা যেন তাতে লিখে যাবে - আজাদি।