চলতি শতকের প্রথম দশকের মাঝামাঝি। তখন মেডিকেল কলেজে। ছাত্র, অর্থাৎ পিজিটি, মানে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি। ক্যানসারের চিকিৎসা বিষয়ে কিছুটা জানাচেনার চেষ্টা করছি। কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, এইসব। সেই সময়ে যাঁদের চিকিৎসার সাথে যুক্ত থেকেছি, তাঁদের কয়েকজনের কথা খুব মনে আছে। ক্যানসার এমনই এক অসুখ, যেখানে জেতার পাশাপাশি হারের সংখ্যা অনেক। আবার, তিনবছরের ছাত্রজীবনে এমন সংখ্যাও কম নয়, যেখানে জয় নাকি পরাজয় ঠিক কোনটা ঘটেছে, সেই খবর পাওয়ার সুযোগটুকুও ঘটেনি।
আউটডোর ইনডোর রেডিয়েশন মেশিনের মধ্যে দিয়ে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রত্যেকদিন চিকিৎসা পেতেন, তাঁদের মধ্যে অনেক মুখই স্মৃতিতে ফিরে আসে। বারবার। কিছু কিছু মুখ প্রায় হন্ট করতে থাকে। সে স্মৃতি কখনও আনন্দের, প্রায়শই বিষাদের।
যেমন ধরুন, হোসেন আলি। মুর্শিদাবাদের মানুষ। পরিস্থিতি এমনই, চিকিৎসা করানোর পক্ষে নিকটতম গন্তব্য কলকাতা। (তখনও বহরমপুরে মেডিকেল কলেজ চালু হয় নি।) কুচকুচে কালো গায়ের রঙ। তাগড়াই চেহারা। বয়স বছর পঞ্চাশেক।
তাঁর সমস্যা, ইদানিং একটু ওজন কমেছে। রাত্রে জ্বরও আসে। গলায় আর বগলে কিছু কিছু ডেলা জাতীয় ফোলা। স্থানীয় ডাক্তারবাবু, সঙ্গত কারণেই, টিবি সন্দেহ করেছিলেন। কিন্তু, ছুঁচ ফুটিয়ে পরীক্ষায় দেখা গেল, লিম্ফোমা। অগত্যা কলকাতা। ক্যানসার বিভাগ।
পরীক্ষানিরীক্ষায় দেখা গেল, অসুখ বেশ কিছুটা ছড়িয়েছে। পেটের ভেতরেও লিম্ফ নোড বেড়েছে। সব মিলিয়ে স্টেজ থ্রী। ক্যানসার কতখানি বেড়েছে, শরীরে কতোখানি ছড়িয়েছে, তার ভিত্তিতে অসুখের সারার সম্ভাবনা কতোখানি, সেই হিসেবনিকেশের অন্যতম এই স্টেজিং। সাধারণত চারটি ধাপ। হোসেনসাহেব আছেন তৃতীয় পর্যায়ে।
অসুখটি লিম্ফোমা। নন-হজকিন্স লিম্ফোমা। তার মধ্যেও হাই গ্রেড। অর্থাৎ, দ্রুত ডালপালা ছড়ানোর স্বভাব। কিন্তু, আবার অন্যদিকে, লিম্ফোমা চিকিৎসায় সাড়াও দেয় চটপট। সেইসময়, ওই স্বল্প অভিজ্ঞতাতেই দেখেছি, দুই কি তিন দফা কেমো দিতেই লিম্ফোমা স্রেফ উধাও হয়ে গিয়েছে। বেশ কিছুটা অ্যাডভান্সড স্টেজেও লিম্ফোমা কিউরেবল, অর্থাৎ নিরাময়যোগ্য, এমনই জেনেছি।
হোসেনসাহেবের গলা-বগলের ফোলা অনেকটাই কমে গেল প্রথম দফার কেমোথেরাপির পরে। কিন্তু, পরিস্থিতির আন্দাজ পাওয়া গেল দ্বিতীয় দফার পরে। ফোলা কমা তো দূরে থাক, তৃতীয় দফার কেমো নেওয়ার সময় দেখা গেল, ফোলা ফিরে এসেছে প্রথম দফার আগের পর্যায়ে। হোসেনসাহেব সচেতন মানুষ। বললেন, ফোলা প্রায় মিলিয়েই গিয়েছিল দ্বিতীয় কেমোর সপ্তাহখানেক বাদেই। কিন্তু, দুসপ্তাহ যেতে না যেতেই অসুখ বাড়তে শুরু করে।
তৃতীয় দফা, মানে থার্ড সাইকেলের পরেও পরিস্থিতি তাই। অসুখ যেটুকু কমার, দুসপ্তাহের মধ্যেই ফিরে আসছে বাড়তি গতিতে। স্যারেরা আলোচনায় বসলেন। সিদ্ধান্ত হল, অসুখ যেহেতু ফিরে আসছে দু'সপ্তাহের মাথায়, কেমোথেরাপির সাইকেলের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনা যাক। এমনিতে তিন সপ্তাহের মাথায় দেওয়া হয়, কিন্তু এক্ষেত্রে দুটি কেমো সাইকেলের ব্যবধান হোক, ওই দুসপ্তাহ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম, ডোজ ডেনস (dose dense) থেরাপি।
কথাটা শুনতে সহজ লাগলেও বিষয়টা একটু জটিল। কেমোথেরাপির দুটি দফার মধ্যে ব্যবধানের পেছনে কিছু আপোষ রয়েছে। আমরা ভাবতে ভালোবাসি, যে, কেমোথেরাপির বিষে শুধু ক্যানসার কোষ ধ্বংস হচ্ছে আর বাকি সব সুস্থ কোষ থাকছে বহাল তবিয়তে। কিন্তু, এ শুধুই উইশফুল থিঙ্কিং। ক্যানসার কোষের পাশাপাশি অসংখ্য সুস্থ-সবল কোষও বেঘোরে মারা যাচ্ছে কেমোর উপদ্রবে। কোন কোষ? শরীরের যেসব অংশে কোষ বিভাজন ঘটে দ্রুত, ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারাই। যেমন, অস্থিমজ্জা বা বোন ম্যারো, যেখানে রক্ত বা রক্তের বিভিন্ন উপাদান তৈরী হয়। যেমন, অন্ডকোষ বা ডিম্বাশয়, যেখানে প্রজননের জন্যে প্রয়োজনীয় কোষ বিভাজিত হয়। যেমন, অন্ত্র বা ইন্টেস্টাইনের ভিতরের অংশ, যেখানে প্রতিনিয়ত পুরোনো কোষ নষ্ট হয়ে নতুন কোষ তার জায়গা নেয়। মৃত কোষের জায়গা নেওয়ার জন্যে আসবে নতুন কোষ, শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ কিছুটা মেরামত হয়ে নিতে পারবে - শরীরের মধ্যেই বন্দোবস্ত মজুত, শুধু সেই বন্দোবস্ত কার্যকরী হওয়ার জন্যে সময় জরুরী। কিন্তু, দুই দফার মধ্যের ফাঁকে ক্যানসারটিও তো নিজেকে গুছিয়ে নেবে, সেইখানেও ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি সেরেসুরে উঠতে চাইবে। তাহলে?? ওই আপোষ। একটু ফাঁক থাকুক, যাতে শরীরটা একটু গুছিয়ে নিতে পারে, অথচ ক্যানসারটি যাতে বেড়ে না যেতে পারে।
ডোজ ডেনস চিকিৎসা করতে গেলে এই ভারসাম্য রক্ষার খেলাটাই নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। হোসেন আলির ক্ষেত্রে ঝুঁকি নেওয়ার সাহস পাওয়া গেল, কারণ তাঁর সুঠাম স্বাস্থ্য। কিন্তু, রক্ত কমে গেলে, বিশেষত সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার মূল অস্ত্র শ্বেত কণিকা কমে গেলে তো মুশকিল। বিশেষত, কলকাতা থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সমস্যায় পড়লে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। অতএব, রক্ত বাড়ানোর ইঞ্জেকশনও জোড়া হল কেমোর পরের দিন। সেই সময়ে এই ইঞ্জেকশন বেশ দামী, হাসপাতালে পাওয়াও যায় না। হোসেনসাহেবের ছেলেকে বলা হল। খরচ শুনে ঘাবড়ে গেল সে। কিন্তু, বাবার চিকিৎসা। কোথা থেকে টাকার জোগাড় হল জানি না, কিন্তু, হোসেন আলির ইঞ্জেকশনের অভাব হল না।
চিকিৎসা একটু এগোতেই বোঝা গেল, হোসেন আলির ক্যানসারটি বড়ই বেয়াড়া প্রকৃতির। যে অসুখ আগে ফিরে আসছিল দু'সপ্তাহের মাথায়, এখন সেই ব্যবধান কমে দাঁড়ালো সাত কি দশদিনে। সত্যি বলতে কি, হোসেন আলির ক্যানসার যেন আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রকে ভেংচি কেটে বিদ্রুপ করতে থাকল। শরীরও ভাঙতে লাগলো দ্রুত। পেটের ভেতরের কিছু লিম্ফ নোড ফুলে স্নায়ুর উপর চাপ দিয়ে বিভিন্ন নিত্যনতুন উপসর্গের জন্ম দিতে থাকল।
বোঝা গেল, আর যাই হোক, এই পথে সমাধানের কোনো সম্ভাবনা নেই। অতএব, অন্য ভাবনা। শুরু হল, সেকেন্ড লাইন কেমোথেরাপি। এইখানে বলে রাখা ভালো, অন্তত সেই সময়ে, বেশীর ভাগ ক্যানসারের ক্ষেত্রে, দ্বিতীয় পর্যায়ের যে কেমোথেরাপি, মানে সেকেন্ড লাইন কেমোথেরাপি, তার ওষুধের কার্যকারিতা কম, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশী, বেশ দুর্মূল্য, এবং সেই ওষুধ সরকারি হাসপাতালে বিনেপয়সাতে পাওয়াও যেত না। দরিদ্র হোসেন আলির পক্ষে সেই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। কিন্তু, হোসেন আলির ছেলের সিদ্ধান্ত, যে করেই হোক, বাবাকে সে সুস্থ করে তুলবেই। অতএব…….
ক্যানসার চিকিৎসার অন্যতম সমস্যা, একই রোগীকে বারবার দেখতে দেখতে, তার বাড়ির লোকের সাথে এটাসেটা গল্প করতে করতে কোনো এক সময় যেন তাদের সাথে একটা টান, একটা আন্তরিকতার সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায় - সেই টান কাটিয়ে উঠে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে মানুষটাকে বা তার রোগটাকে বিচার করা মুশকিল হয়ে যায়। একটা পরিবারের মধ্যের অংশ হিসেবে যে মানুষটা, তাঁকে শুধুমাত্র রোগী হিসেবে দেখে নির্মোক দৃষ্টিতে বৈজ্ঞানিকসুলভ নির্লিপ্তিতে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া, এ বড় কঠিন কাজ। অনেক ডাক্তারকেই এই বাঁধন উপেক্ষা করে পেশাদারের দৃষ্টিতে বিষয়টাকে দেখতে দেখেছি, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েও বিদ্যেটা রপ্ত করে উঠতে পারিনি।
মাসখানেক যেতে না যেতেই বুঝলাম, হোসেনসাহেবের পরিবারের পক্ষে এই খরচ টানা দুঃসহ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ওষুধের দাম, মুর্শিদাবাদ-কলকাতা দৌড়াদৌড়ি, বাবা ভর্তি থাকলেও সাথে আসা ছেলের তিনচারদিন কলকাতায় থাকাখাওয়ার বন্দোবস্ত করা, সব মিলিয়ে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অন্যদিকে, হোসেন আলিও চিকিৎসায় তেমন সাড়া দিচ্ছেন না। অসুখ যেটুকু নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে, শরীর ভাঙছে তার বহুগুণ দ্রুততায়। পেটাই চেহারা এখন সুদূর স্মৃতি। ওয়ার্ডের লাগোয়া শৌচালয়ে যেতে তাঁর সাহায্য লাগে, বেডে ফিরে হাঁফাতে থাকেন।
ছেলের সাথে গল্প করতে গিয়ে জানলাম, বাবার অসুস্থতা-চিকিৎসার প্রয়োজনে, এগারো ক্লাসে পড়তে পড়তে তাকে পড়া ছেড়ে দিতে হয়েছে। মা আর দুই ভাইয়ের খাবার জোগানোর দায়িত্ব তার। গ্রামে যে কদিন থাকে, দিনমজুর খাটে। কলকাতায় বাবার চিকিৎসার জন্যে আসতে হলে রোজগার নেই।
এমনই এক দফা কেমোর জন্যে হোসেন আলি শেষবার যখন ভর্তি হলেন, ছেলের পাংশুমুখ দেখে প্রশ্নের উত্তরে জানা গেল, ভিটেটুকু বন্ধক দিয়ে এই দফা আসা হয়েছে। পরের দফায় কী হবে, সেই নিয়ে আপাতত ছেলে দুশ্চিন্তায়।
কথাটা অনেক আগেই বলা উচিত ছিল হয়ত। কিন্তু, ওই যে, বেটার লেট দ্যান নেভার। ছেলেকে আলাদা নিয়ে গিয়ে বোঝালাম, দ্যাখো, বাবার তো কিছুই হওয়ার নেই। ভিটে বাঁধা দিয়ে মা আর ছোট দুই ভাইকে নিয়ে ভেসে যেয়ে লাভ কী!! বাবার আর কেমোর দরকার নেই। টাকাটা নিয়ে বাড়িতে যাও, জমিটা ছাড়িয়ে নাও। এই দফা বাবাকে স্যালাইন দিয়ে ছুটি করে দিচ্ছি।
খুব যে এককথায় রাজি হল, তা নয়। কিন্তু, পিতৃহীন অদূর ভবিষ্যতে মাথার উপর থেকে ছাদটুকুও চলে গেলে কী হতে পারে, সেইটুকু বোঝানো গেল। পইপই করে এও বলা হল, এইবারের ভিটে বাঁধা দেওয়ার টাকাটুকু যেন অক্ষত থাকে এবং বাড়ি পৌঁছেই টাকা ফেরত দিয়ে যেন জমির কাগজ ফিরিয়ে নেয়।
হোসেন আলির এত কথা জানার কথা নয়। কিন্তু, মানুষ বুঝতে পারে। বিশেষত, ক্যানসারের ডাক্তারের জীবনে এমন মুহূর্ত প্রায়শই আসে, যখন তিনি মুখে হাসি টেনে রোগীর সাথে আপাত স্বাভাবিকতার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন, শুধু সেই কথোপকথনের সময়টুকুতে রোগীর চোখের দিকে তাকাতে পারেন না।
হোসেন আলিও বুঝতে পেরেছিলেন হয়ত।
যেকোনো হাসপাতালেই, মেডিকেল কলেজগুলোতে তো আরো বিশেষ করে, ক্যানসারের চিকিৎসা একটি দলগত প্রয়াস। কিন্তু, হোসেনসাহেবের কেমোথেরাপি চালানোর সময় বারবার আমিই সামনে থাকতাম, এজন্যেই হোক বা স্বভাবগত খেজুড়ে আলাপের অভ্যেসের জন্য এটাসেটা গল্প জুড়তাম বলেই হোক, হোসেন আলির সাথে আমার একটা বেশ আলাদা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
সেইদিন ছুটির সময় সামনে যাচ্ছিলাম না। ছেলে এসে বলল, বাবা জিজ্ঞেস করছে, আমার ডাক্তারবাবু কোথায়? অগত্যা যেতেই হল। হোসেন আলি সহজভাবে জিজ্ঞেস করলেন, এর পরে আবার কবে কেমোর ডেট স্যার? আমতা আমতা করে বললাম, এখন তো অনেক কেমো হল। শরীরটাও দুর্বল। বাড়িতে খাবার ওষুধ দেওয়া হল। মাসখানেক মাসদেড়েকের মাথায় আরেকবার দেখে ঠিক করা যাবে।
হোসেন আলি চুপ করে রইলেন। তারপর আচমকাই নিজের দুটো হাতের মধ্যে আমার ডান হাতখানা নিয়ে বললেন, ডাক্তারবাবু, আপনি আমায় একেবারে ছেড়ে দিলেন!!!
###################
এর বোধহয় বছরখানেক বাদের কথা।
প্রবল গরমে ঘামতে ঘামতে ভিড় আউটডোরে। রোগী দেখছি নাকি চালু ডাক্তারি ভাষায় পেশেন্ট ছাড়ছি, বলা মুশকিল।
হঠাৎ একটি ছেলে বলল, ডাক্তারবাবু চিনতে পারছেন?
চেনা চেনা লাগলেও ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। আমার চোখে অনিশ্চয়তা দেখে ছেলেটিই জিজ্ঞেস করল, হোসেন আলিকে মনে আছে, স্যার?
####################
হোসেন আলিকে মনে আছে!!!!!!
সেই শেষবারের "ডাক্তারবাবু, আপনি আমাকে একেবারে ছেড়ে দিলেন" এর পরে কতবার কত অদ্ভুত সময়ে হোসেন আলি আমাকে তাড়া করেছে, সে কি তাঁর ছেলে একটুও আন্দাজ করতে পারবে!!!
ওই একটি বাক্যের মধ্যে ঠিক কোন কথাটায় শেষবার জোর দিয়েছিলেন হোসেন?
ডাক্তারবাবু? মানে ডাক্তার হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়াটা ভুল, এই কথাই কি ছিল সেই অমোঘ বাক্যে? ডাক্তার হলে কি চেষ্টা করে যাওয়া, করেই যাওয়াটা অনিবার্য ধর্ম? এমনকি চেষ্টা অসার জেনেও? সেই বৃথা চেষ্টার মূল্য চোকাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে একখানা আস্ত পরিবার, সেই পরিস্থিতিতেও?
নাকি হোসেনের জোর ছিল ওই "আপনি" শব্দেই? আর পাঁচজন হাল ছাড়লেও আপনি ছাড়বেন কেন? আপনার সাথে এত কথাবার্তা, এত গল্পগুজবের পরেও আপনি সেই হাল ছেড়ে দিলেন? নিশ্চিত মৃত্যুর হাতে আমাকে ফেলে দিলেন অসহায়? হোসেন কি এই প্রশ্নই করতে চেয়েছিলেন?
নাকি জোর ছিল সেই "আমায়" শব্দটির উপর? অর্থাৎ, আমার পরিবারের স্বার্থ দেখতে গিয়ে আপনি আমার মৃত্যু ঠেকানোর চেষ্টা করলেন না? যেখানে আমি বনাম আমার পরিবারের স্বার্থের সংঘাত হয়ে দাঁড়িয়েছে সমস্যাটা, সেইখানে আপনি, যিনি কিনা আমার চিকিৎসক, আপনি আমার পরিবারের কথাটা আগে ভাবলেন? নিজের রোগীর প্রতি আপনার দায়িত্ব তখন কোথায় গেল, ডাক্তারবাবু??
###################
বলা বাহুল্য, এই ঘটনার পরে এক দশকেরও বেশী সময় পার হয়ে গেলেও হোসেন আলি আর তাঁর প্রশ্ন আমি ভুলতে পারিনি।
পরবর্তীকালে, ঝাঁচকচকে কর্পোরেট হাসপাতালের কেতাদুরস্ত বড় ডাক্তারবাবু আমাকে বুঝিয়েছিলেন, শোন, ডাক্তার হিসেবে তোর দায়বদ্ধতা উল্টোদিকের চেয়ারে বসে রোগীটির প্রতি, একমাত্র ও শুধুমাত্র সেই রোগীটির প্রতি।
কিন্তু, সেই দায়বদ্ধতার সীমা কোনখানে? স্পষ্টতই নিষ্ফলা চিকিৎসার চেষ্টার ফলে একটা পরিবার ভেসে যেতে চলেছে, সেই অবস্থাতেও দায়বদ্ধতা সীমাবদ্ধ থাকবে এক এবং একমাত্র রোগীর প্রতিই?
চিকিৎসকের চেষ্টার সীমারেখাই বা কোথায় থাকবে? ঠিক কোনখানে বলা যাবে, ব্যাস, দিস ফার অ্যান্ড নো ফারদার? ঠিক ক'শতাংশ আশা থাকলে ব্যয়বহুল চিকিৎসার চেষ্টা যুক্তিযুক্ত? নাকি, চিকিৎসকের দায় চেষ্টা করে যাওয়ার? সেইখানে খরচের চিন্তার দায়িত্ব তাঁর নয়?
এমনকি, বৃহত্তর ক্ষেত্রের কথা যদি বলি, এই প্রশ্নের সাধারণীকরণ যদি করা যায়, তথাকথিত শেষ চেষ্টা বা হাল-না-ছাড়া যদি ব্যয়বহুল পথে মৃত্যুকে দীর্ঘায়িত করার পদ্ধতি হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে চিকিৎসক ঠিক কোন ভূমিকায় থাকবেন? চিকিৎসকের হাল না ছাড়ার অনিবার্য ফল হিসেবে যদি প্রায় যেকোনো মানুষের যেকোনো স্তরের অসুখই চিকিৎসাযোগ্য এই বার্তা ছড়ায়, তার পরেও চিকিৎসকের দায়িত্বটি ঠিক কেমন কেমন দাঁড়াতে পারে?
মেডিকেল এথিক্স ব্যাপারটা অনেকদিনই মেডিকেল ল-য়ের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছে। আর, মেডিকেল ল-এর সাথে ওতপ্রোত জড়িয়ে গিয়েছে ক্রেতা সুরক্ষা আইন। এই ঘন দ্রবণের মাঝখান থেকে মেডিকেল এথিক্সের দুধটুকু বেছে নেওয়া কতদূর সম্ভব?
মেডিকেল এথিক্সের ধারণার শুরুতে যে সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং মর্যালিটির অবশ্যম্ভাবী যোগাযোগ ছিল, তার কতটুকু এই বাজার-শাসিত সমাজে প্রাসঙ্গিক? তার কতটুকু এই সময়ে প্রয়োগ করা সম্ভব?
হবু ডাক্তারদের জন্যে যে আসন্ন পাঠক্রম, সেইখানে গুরুত্ব পেতে চলেছে মেডিকেল এথিক্স এবং ডাক্তারবাবুদের কমিউনিকেশন স্কিল। কেমন দাঁড়াবে সেই এথিক্সের চেহারা? নিজের ভাবনাকে রোগী-পরিজনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে কমিউনিকেশন স্কিল, নিঃসন্দেহে, জরুরী। কিন্তু, সেই ভাবনাটার চেহারা কী দাঁড়াবে? সেই ভাবনাটা ঠিক কী হওয়া উচিত? সেই দিকনির্দেশিকা চিকিৎসাশিক্ষার পাঠক্রম তৈরীর বড়বাবুদের মাথায় থাকবে তো?
############################
হোসেন আলির কথা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলাম। অবশ্য, তাঁকে নিয়ে আর বেশী কিছু বলারও নেই।
ছেলে জানায়, আমরা হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার পরে, ঠিক ষোল দিনের মাথায় বাবা মারা যান। আমাদের কথায়, সে বাড়ি গিয়েই টাকা ফেরত দিয়ে ভিটের জমিটুকু ফিরিয়ে নেয়। না, মহাজন রাজি হয়নি সহজে। পঞ্চায়েতের মধ্যস্থতায় কাজ হয়। এই দফায় গ্রামেরই অন্য একজনকে ডাক্তার দেখাতে কলকাতায় আসা। মনে হয়েছে, যে ডাক্তারবাবুরা না বললে তার জমিটুকুও থাকত না, তাঁদের সাথে দেখা করার প্রয়োজন।
বেশী কিছু আমারও বলার ছিল না।
হোসেন আলির শেষ প্রশ্নটুকু থেকে আরো অনেক অনেক প্রশ্ন আমার মনে আসতে থাকে, আসতেই থাকে, সে হয়ত আমারই মনের ভুল।
লিখেছেন ড: বিষাণ বসু