শুক্রবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৮

দিল্লি চলো ~ অবীন দত্তগুপ্ত

বহুকাল লিখি না । কিছু কিছু মাহেন্দ্রক্ষনে লিখতে হাত নিশপিশ করে,কিন্তু লেখা বেরোয় না । আজকে লিখতেই হবে ,যে করে হোক , কিন্তু কিভাবে ? কোথায় একটা শুনেছিলাম , রবিকবি নাকি বলেছিলেন " লেখা না এলে ,অনুবাদ করো ।" আদপে বলেছিলেন কিনা জানি না ,কিন্তু আজ দুপুরে নিজের সুবিধার্থে বিশ্বাস করলাম । লেখার মতোই টিভিতে খবরও দেখিনা বহুদিন । কাহাতক আর বড়লোকের দালালি গেলা যায় ? গতকাল এক বন্ধু বললো , এন ডি টি ভি-তে রাভিশ কুমারের কাজগুলো দ্যাখ - অন্যরকম । আজ দুপুরে এন ডি টি ভি-তে কিষান মুক্তি মার্চের কভারেজ দেখলাম । সৎ মানুষ দেখলে আজকাল গায়ে কাঁটা দেয় , সৎ সাংবাদিক - ডায়নোসরের ডিম। আজ রাবিশবাবুকে দেখলাম । রাবিশ কুমার ইউনিকর্নের মতো ,বিলুপ্ত প্রজাতির । অদ্ভুত সুন্দর সাংবাদিকতা । শেষে একটা চিঠি পড়লেন ( চিঠির ছবি নীচে দিলাম) । বললেন লাল ঝান্ডা কাঁধে এক কৃষক গতকাল ওনাকে চিঠিটা দিয়েছে ।  শুনেই ঠিক করলাম এইবার আমার হাতের আড় ভাঙ্গার সময় হয়েছে । চিঠিটা অনুবাদ করব ।  অতএব ...

                         মাফ করবেন
আমাদের আজকের মিছিলে আপনার হয়তো অনেক অসুবিধে হয়েছে ।

আমরা কৃষক । আপনাকে বিরক্ত করার কোন ইচ্ছে আমাদের নেই । আমরা নিজেরাই খুব অসুবিধের মধ্যে রয়েছি । আপনাকে এবং সরকারকে নিজেদের কষ্টের কথা বলতেই আমরা আজ বহুদূর থেকে এসেছি । আমরা আপনার ঠিক এক মিনিট সময় চাই । 

আপনি কি জানেন , ডাল,সব্জি,ফল বেচে আমরা কতো টাকা পাই আর আপনি কতোতে কেনেন ? 

মুগ ডালঃ আমরা বেচি - ৪৬টাকা কিলো । আপনি কেনেন ১২০টাকা কিলো ।
  টমেটোঃ আমরা বেচি - ৫টাকা কিলো  । আপনি কেনেন ৩০টাকা কিলো ।
  আপেলঃ আমরা বেচি - ১০টাকা কিলো  । আপনি কেনেন ১১০টাকা কিলো ।
      দুধঃ আমরা বেচি - ২০টাকা লিটার  । আপনি কেনেন ৪২টাকা লিটার ।

এটাই আমাদের অসুবিধা । আমরা সমস্ত জিনিস সস্তায় বেচি আর বেশী টাকায় কিনি । আমাদের জিবনটাও খুব সস্তা জানেন। গত ২০ বছরে তিন লাখের বেশী ,'আমরা' আত্মহত্যা করেছি । আমাদের মুশকিল আসান করতে পারে একমাত্র কেন্দ্র সরকার , কিন্তু আমাদের কথা তারা শোনে না । সরকার একমাত্র মিডিয়ার কথা শোনে , কিন্তু মিডিয়া আমাদের খুঁজেই পায় না । এই মিডিয়ার ঝুটিটা কিন্তু আপনার হাতেই ধরা । তাই আমরা নিজেদের দুঃখের- দুর্দশার গল্প আপনাকে বলতে এসেছি ।

আমরা শুধু চাই যে কৃষকদের সমস্যার কথা আলোচনা করার জন্য সংসদের একটি অধিবেশন ডাকা হোক । আমরা চাই, সেই অধিবেশনে দুটো আইন পাশ হোক ।
১। কৃষকের ফসলের সঠিক দাম ঠিক করার আইন
২। সমস্ত কৃষককে ঋণমুক্ত করার আইন । 
আমরা কি ভুল কিছু চাইছি ?

আমাদের কথা আপনার ঠিক মনে হলে ,আজকে আমাদের সাথে দুকদম হাটুন । কাল ৩০ নভেম্বর সংসদের সামনের রাস্তায় আমরা সকলে থাকবো । আপনি এলে আমাদের মনোবল বাড়বে । আসবেন তো ? "

বুধবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৮

বাংলা মিডিয়া ~ সুশোভন পাত্র

জাস্ট একবার ভাবুন। বুদ্ধবাবু মুখ্যমন্ত্রী। বুদ্ধবাবু ফি-বছরে ২লক্ষ চাকরি দেবেন বলে স্বপ্ন দেখান। সরকারী পয়সায় 'বেঙ্গল মিন্স বিজনেস'র আসর বসান। অমুক লগ্নি, তুমুক বিনিয়োগের গল্প শোনান। শিল্প ধরতে বিদেশ গিয়ে মিকি মাউসের পিয়ানো বাজান। অথচ, সেই বুদ্ধবাবুর নাকের ডগায় রাইটার্সে, বেকারির জ্বালায় গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করলেন সঞ্জয় সাহা। দুধের শিশু কোলে নিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে স্ত্রী শর্মিষ্ঠা বলছেন, এলাকার প্রভাবশালীর সিপিএম নেতার ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা প্রোমোটারের দৌরাত্ম্যের প্রতিবাদ করায় দুদিন আগেই হেনস্তা হতে হয়েছিল তাঁর স্বামী কে। 
জাস্ট একবার ভাবুন। বুদ্ধবাবু গলার শিরা ফুলিয়ে 'জঙ্গলমহল হাসছে' বলে মঞ্চ কাঁপান। অলিতে গলিতে ২টাকা/কেজি চালের বাতেলা শোনান। সরকারী পয়সায় নিজের হোর্ডিং টাঙ্গিয়ে ফুটুনি মারান। আর পূর্ণাপানির শবররা অনাহারে-অপুষ্টি তে প্রিয়জন'দের লাশ কুড়ান। রেকর্ড ৩৪% বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা পঞ্চায়েতে লুটের রাজত্ব। 'হার্মাদ'দের তোলাবাজি তে বন্ধ গ্রামের রেশন। অবশ্য মুখে ভাত না থাক, এলাকায় চোলাই মদের কোন অভাব রাখেন না সিপিএম নেতারা। 
জাস্ট একবার ভাবুন, বুদ্ধবাবু বলছেন, 'উৎসব করব না তো কি শ্রাদ্ধ করব?।' বুদ্ধবাবু শবরদের গ্রামের বাইরে খাকি পোশাকের পুলিশ লেলিয়ে দিচ্ছেন। তাক লাগানো মেনুর সম্ভারে আহারে বাংলায় অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন। হেলিকপ্টারে উড়ে জগদ্ধাত্রী পূজার উদ্বোধন করছেন। বুদ্ধবাবু ফিরে এসে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ক্যাডার মিটিং-এ দিল্লি জয়ের ডাক দিচ্ছেন।  
বুদ্ধবাবু-সিপিএম-আত্মহত্যা-চোলাই-অনাহার-হেলিকপ্টারর-পুলিশ। জমকালো স্টোরি লাইন না? ব্রেকিং নিউজে 'রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের' সাজানো প্লেট। প্লেটের উপর বামফ্রন্ট সরকার কে কচুকাটা করে সাজানো ডিশ। আর মুখ্যমন্ত্রীর ঔদ্ধত্য তো 'আইস অন দি কেক'। শর্মিষ্ঠা সাহা কে স্টুডিও তে বসিয়ে এক্সক্লুসিভ ইন্টার্ভিউ হবে। শবরের শব সাজিয়ে সিক্সটি পয়েন্টের হেডিং হবে। অনাহারদীর্ণ জঙ্গলমহল আর আহারে বাংলা -পাশাপাশি রেখে ভিসুয়াল হবে। বুদ্ধিজীবীরা ঘণ্টাখানেকে সিপিএম'র বাপ-বাপান্ত উদ্ধার করে দেবে। জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী প্রতিদিন সকালে পাঁচ জন সিপিএম'র লাশ দেখতে চেয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলে দেবে। লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন, দুধ জমে ক্ষীর হয়ে যাবে।  
কিন্তু কি আশ্চর্য, এসব কিছুই হল না। ৯৯-র সাইক্লোনে গল্পের গরু গাছে চড়ানো মিডিয়া জানতেই পারলো না, সঞ্জয় সাহা খোদ নবান্নের সামনে গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করল। মাননীয়া ছাড়া কারও তাঁবেদারি না করা মিডিয়া দেখতেই পেল না, সাতটা লাশের বিনিময়ে শবরদের পাতে আজ ভাত জুটল। সেদিন জঙ্গলমহলে আতস কাঁচে 'হার্মাদ ক্যাম্প' খোঁজা মিডিয়া প্রশ্নই করল না যে রেশনহীন গ্রামে বে-আইনি চোলাই মদের ভাটি চলছিল কার অনুপ্রেরণায়? আর শবর'দের লাশ সাজিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হেলিকপ্টার চাপার আহ্লাদিপনা করেন কার বাপের পয়সায়? করল না কারণ, মুখ্যমন্ত্রীর নামটা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নয়। গত ১৫দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো সিপিএম'র আমলে নয়। শাসক দলের সদর দপ্তর আলিমুদ্দিনে নয়। বরং কালীঘাটে। আর ঘটনা গুলো তৃণমূলের রাজত্বে। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুকুমতে। 
রেজ্জাক মোল্লা তখন সিপিএম। "হেলে ধরতে পারেনা কেউটে ধরতে গেছে" মন্তব্য তখন হট কেক। 'বাম বিদায়ের' কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে রেজ্জাক মোল্লার বিদ্রূপ কে দায়িত্ব নিয়ে বেডরুমে পৌঁছে দিয়েছিল মিডিয়া। আর আজকে সিঙ্গুরের তৃণমূল বিধায়ক, পাঁচ বছর ক্যাবিনেটের সদস্য রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলছেন, "সিঙ্গুরে টাটারা কারখানা শুরু হলে সব কৃষকই জমি দিয়ে দিতেন। তাঁরা বুঝতেন এতে কাজ হবে, প্রশিক্ষণ মিলবে। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই টাটারা পুরো জমিটাই পেয়ে যেতেন। আর এটা সরকারের বিরাট সাফল্য হতো। সিপিএম আরও বেশ কিছুদিন রাজ্যের সরকারে থাকতে পারতো।" সেদিন রেজ্জাক মোল্লা কে বুদ্ধবাবুর "জনবিরোধী শিল্পনীতির" বিরুদ্ধে প্রক্সি-ওয়ারের ক্রুসেডর বানানো কোন মিডিয়ার হিম্মত আছে নাকি রবীন্দ্রনাথ বাবুর বিবৃতি মুখ্যমন্ত্রীর মুখে ছুঁড়ে মেরে সিঙ্গুরের 'জমি আন্দোলনের' ন্যাকামির কৈফিয়ত চাওয়ার? কোন মিডিয়ার হিম্মত আছে নাকি সিঙ্গুরের কৃষক'দের চাওয়া পাওয়ার সাচ্চা ময়নাতদন্ত করার? বাংলার বেকার'দের জীবন যন্ত্রণার আর্তনাদের প্রতিধ্বনি ছাপার?
নেই! কারণ এই গৃহপালিত মিডিয়াই তো সেদিন মমতা কে মসিহা বানিয়েছিল। চ্যাংড়া তৃণমূল কে 'কৃষক দরদী' সাজিয়ে পাড়া মাথায় তুলেছিল। 'পরিবর্তন চাই' বলে কাঁদুনি গেয়েছিল। আর এই গৃহপালিত মিডিয়াই সেদিন আপনাকে "৩৪ বছরে কিছুই হয়নি" বলতে শিখিয়েছিল। 
১৯৯৮-২০১০, রাজ্যে প্রতি বছর এস.এস.সি'র মাধ্যমে নিয়োগ হয়েছিল ১,৮৫,৮৪৫ জন। পেটো মস্তানদের ৮-১০লক্ষ ঘুষ দিতে হয়নি। হাইকোর্টের কাছে বারবার মুখ ঝামা খেতে হয়নি। ২০০৪-২০১০, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সাধের 'গুজরাট মডেল' কে টেক্কা দিয়ে সেরা হয়েছিল বাংলা। সরকারী পয়সায় মুখ্যমন্ত্রী কে বিদেশ সফরে যেতে হয়নি। 'বেঙ্গল মিন্স বিজনেস'র আদিখ্যেতা করতে হয়নি। ৩৪ বছরে কোনদিন, বাংলার মন্ত্রী-মেয়র'দের ক্যামেরার সামনে ঘুষ খেতে হয়নি। সাংসদ'দের চিট-ফান্ডের চিটিং বাজির জন্য জেলে যেতে হয়নি। ৩৪ বছরে কোনদিন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী'দের ১.৮৬ কোটির ছবি বিক্রি করতে হয়নি। ডেলোতে সুদীপ্ত সেন'দের সাথে গভীর রাতে বৈঠক করতে হয়নি। ৩৪ বছরে কোনদিন, দলের চোর-লম্পট'দের আড়াল করতে সিবিআই তদন্তে বাধা দিতে হয়নি। বিজেপির সাথে সেটিং করে সিবিআই'র জুজুতে রাফালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতে হয়নি। ৩৪ বছরে কোনদিন, ১লক্ষ সরকারী শূন্যপদে নিয়োগ বাকি রেখে সরকার মোচ্ছবে মাতেনি। মহার্ঘ্য ভাতা বকেয়া রেখে ক্লাবে ক্লাবে গুণ্ডা পুষতে হয়নি। ৩৪ বছরে কোনদিন, বাংলার রাজনীতি তে ধর্মের নামে ভোট চাইতে হয়নি, জীবন-জীবিকার সমস্যা কে আড়াল করে রথের চাকায় সাম্প্রদায়িকতার বারুদ সাজাতে হয়নি। ৩৪ বছরে কোনদিন, বুদ্ধিজীবী'দের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে সরীসৃপ সাজতে হয়নি। মিডিয়া কে এই নজিরবিহীন নির্লজ্জ স্তাবকতা করতে হয়নি। সীমাহীন ঔদ্ধত্য কে 'সততার প্রতীক' বলে চালাতে হয়নি। 
সত্যিই তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো ঠিকই বলেন, ৩৪ বছরে তো কিছুই হয়নি। গৃহপালিত মিডিয়া তো ঠিকই বলে ৩৪ বছরে তো কিছুই হয়নি। জাস্ট একবার ভাবুন তো, ৩৪ বছরে তো কত কিছুই হয়নি।

মঙ্গলবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৮

দাংগা ও দিদি ~ আরকাদি গাইদার

- তাড়াতাড়ি শেষ করো, অনেকক্ষন ধরে বসে আছি, এবার ক্লান্ত লাগছে।

- হ্যা, আর কয়েকটা বিষয় বাকি, সেগুলো আলোচনা করে নিলেই মিটিং শেষ।

- বলো, বলো।

- বিজেপি - আরএসএসের রথযাত্রা নিয়ে সেরকমভাবে কোন বিশেষ প্রশাসনিক পদক্ষেপের নির্দেশ পাইনি। ওটা কি করবো?

- কিছুই করবে না।

- কিছুই করবো না!

- না। পারমিশন আছে তো। নিয়ম মেনে সাথে এসকর্ট দেবে। ব্যাস, আরকি।

- কিন্তু..আসলে, মানে ব্যাপারটা তো এত সহজ না। এটা তো সাদামাটা রাজনৈতিক প্রচারযাত্রা নয়। এটার উদ্দেশ্য তো অন্য। সেই '৯২তে রথযাত্রা করেছিলো। যেখান দিয়ে রথ গেছিলো সেখানেই দাঙা লাগিয়েছিলো। এবারেও তাই করবে। গোটা বাংলা জুড়ে রথ চলবে, পেছনে গুন্ডা, দাঙাবাজদের দলবল থাকবে, সব জায়গায় দাঙার আগুন লাগবে।

- হুম।

- তাই বলছিলাম, একটু কড়া ভাবে যদি কন্ট্রোল করা যেতো। সেরকম নির্দেশ..

- আচ্ছা, এত বয়স হলো তোমার। রাজনীতি কবে বুঝবে? ধরো তোমার কথাই সত্যি। ওরা রথযাত্রা করলো। দাঙা লাগালো। সেটা ভালো না খারাপ?

- ভালো না খারাপ? ইয়ে, মানে?

- আরে ছাগল, দাঙা লাগলে কি হবে? বাড়ি ঘর জ্বলবে, অনেক লোক ঘরছাড়া হবে, ক্যাম্পে যাবে। কয়েকজন খুনও হতে পারে। তারপর সেই সমস্ত ছবি টিভিতে দেখানো হবে, পেপারে বেরোবে। তাতে কি হবে? লোক ভয় পাবে। ভয়, ভীতি, প্যানিক - এইগুলো হলেই মানুষ পরিত্রাতা খুজবে। সামনের বছরে নির্বাচন। ভয় পেলে মানুষ এই দাঙাবাজদের আটকাতে আমাদের দিকেই আসবে। 

- কিন্তু আগে থেকেই দাঙা আটকানো ভালো না?

- আগে থেকে আটকালে তো কোন ক্রাইসিসই হলো না। ভয় নেই। প্যানিক নেই। তখন দাঙা নিয়ে মানুষ চিন্তাভাবনা করবে? নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে না হলে মানুষ তখন অন্যান্য জিনিস নিয়ে ভাববে তো। তখন কি হবে ভেবে দেখেছো? 

- না, সেটা ভাবিনি।

- তাহলে ভাবো। কল্পনা করে নাও বাংলায় আমরা এর আগের কয়েকবছরে একটাও দাঙা ঘটতে দিইনি। কড়া হাতে দমন করেছি। কেউ মারা যায়েনি। কোন রক্ত ঝরেনি।  আজকের মতন মানুষ সাম্প্রদায়িক হিংসে নিয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে নেই। এরকম পরিস্থিতিতে এই যে আমাদের দলের প্রমোটারের অত্যাচারে বেকার যুবক নবান্নের সামনে এসে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করলো বা তারপর ধরো ৭টা শবর অনাহারে মারা গেলো। তখন টিভি, পেপার, পাব্লিক স্পেসের আলোচনা-আড্ডা কি নিয়ে হতো? সেখানে আমাদের কি হাল হতো?

- এটা ভাবিনি।

- জানি। তাই ভাবতে বলছি। ধরো রথযাত্রা পরবর্তী হিংসেয় একজন মারা গেলো।  এই যে ৭জন শবর না খেতে পেয়ে মারা গেলো, তার থেকে দশগুন বেশি দৃশ্যমান হবে সেই ঘটনা। সবাই অনেক বেশি নাচানাচি করবে। কারন আপাতত বাজারে সাম্প্রদায়িকতার টিআরপি বেশি। তাহলে সেটা আমাদের জন্যে ভালো, না খারাপ?

- আপনি কি ব্যাটম্যান দেখেছেন? ওখানে জোকার এরকমই বলেছিলো - No one bothers when things go according to 'plan'..

- তুমিও কি বোকা লিবারবাল হয়ে গেলে নাকি? এরকম জ্ঞানপাপীদের মতন ডায়ালগ ঝাড়ছো কেন? যাই হোক, তাহলে এই নিয়ে আর কনফিউশন নেই তো? একটু ঝামেলা হলে ভালো। বাদবাকি দায়িত্ব লিবারবালরা নিয়ে নেবে। নেচে কেদে সমস্ত স্পটলাইট ওই দাঙাতেই ফোকাস করাবে। আর কিছু আছে?

- হ্যা, আর দুটো বিষয়। ওই শ্রমিক-কৃষক সংগঠনগুলোর পর পর কিছু দেশব্যাপী কর্মসূচী আছে।

- তাতে আমাদের কি?

- ওই কর্মসূচীগুলোর মধ্যে একটা ৮-৯ই জানুয়ারীর সারা ভারত সাধারন ধর্মঘট আছে। সেটা তো আমাদের রাজ্যেও হবে।

- সর্বশক্তি দিয়ে আটকাতে হবে। আমাদের রাজ্যে কোন শ্রমিক কৃষকের ব্যাপার নেই। ওসব যেন এখানে দৃশ্যমান না হয়। আজকে বলছে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে, কালকেই একই ইস্যুগুলো আমাদের দিকে ঘুরিয়ে দেবে। চাষ নিয়ে যা বলছে তা তো আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রেও সত্যি। তখন সামলাবো কি দিয়ে? আমাদের রাজ্যে যা হবে স্রেফ এই হিন্দু-মুসলমান-সেকুলার-দাঙাবাজ লাইনে, বুঝলে? নাহলে আমাদের চাপ আছে। শেষ বিষয় কি?

- ওই যে আপনি সরকারি ফুড ফেস্টিভাল করছেন না - আহারে বাংলা, আজ ওটার বাইরে বিরোধী বিধায়ক বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন ওই ৭ শবরের অনাহারে মৃত্যু নিয়ে। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে তো আবার ওই কয়েকটা ছেলেকে মাওবাদী বলে গ্রেপ্তার করা হলো। এই ঘটনাটা সামনে চলে আসছে বারবার। 

- হুম। দেখি মিডিয়ার লোকজনের সাথে কথা বলে। শোভন আর বৈশাখীর ব্যাপারটা বেশি বেশি করে প্রচার করলেই লোকে আর অন্যকিছু নিয়ে মাথা ঘামাবে না। দলেও বলে দেবো, এই বিষয় কিছু বাইট ফাইট দিয়ে পাব্লিক কে একটু বিভ্রান্ত রাখতে। আর কিছু?

- না। আসি তাহলে।

- এসো।

(প্রায় দু দশক আগে, লালুপ্রসাদ যাদব এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন - 'সরকার না চাওয়া, তো দাঙা না হোওয়া')


শনিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৮

বনপলাশীর পাখ-পাখালি ~ মিনহাজ

এই যে আমরা শহুরে বাঙালিরা ইট কাঠ পাথরের জঙ্গলে দৌড়তে দৌড়তে হাঁপিয়ে গিয়ে একটু খানি দম ফেলার ফুরসত পেলেই ছুটে যাই গ্রাম বাংলায় তার একটা উদ্দেশ্য নিশ্চিত ভাবে গাছপালা নদী নালা পাহাড় টিলা র সৌন্দর্য্য আর সঙ্গে দূষন মুক্ত পরিবেশে ফুসফুসে কিছুটা বাড়তি অক্সিজেন জুগিয়ে নেওয়া। তারপর ফিরে এসে নতুন উদ্যমে আবার দৌড় শুরু করা। কেউ ইঁদূরর আর কেউ বা বেড়াল হিসাবে।এরকম ই এক উদ্দেশ্যে গত পুজোয় ১১ জন বন্ধু বান্ধব কাচ্চা বাচ্চা মিলে ঘুরে এলাম মুরুগুমা। পুরুলিয়ার পশ্চিম প্রান্তে অযোধ্যা পাহাড়ের ঢালে মুরুগুমা ড্যাম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্রের যৌথ উদ্যোগে প্রকৃতির কোলে ছবির মত সুন্দর রিসর্ট-বনপলাশী ইকো হাট। ছিম ছাম-খোলা মেলা গাছ গাছালি পুকুর- আড্ডা ঘর-গেজিবা সমেত একটা দারুণ ব্যাপার।প্রয়োজনীয় সব আছে কিন্তু বাহুল্য নেই। ড্যামের পাশে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা- পাকদন্ডি ধরে গাড়িচালিয়ে উঠে যাওয়া পাহাড়ে জঙ্গলে আদিবাসী গ্রামে ঘুরে বেড়িয়ে তিনটে দিন কেটে গেল হুস করে। মাঝে একটা দিন বাঁশপোড়া চিকেন আর ঝলসানো শোল মাছ সহযোগে খানাপিনা আর একটা সন্ধে পুরুলিয়ার বিখ্যাত ছৌ নাচের আসর আমাদের বেড়ানোর আনন্দ কানায় কানায় ভরিয়ে দিয়েছিল। সে কথা বিস্তারে লেখা যাবে অন্য কোন সময় । আজ লিখব একটু অন্য বিষয়ে।











এরকম পারিবারিক বেড়ানোর পাশাপাশি আমার ব্যক্তিগত আগ্রহের একটি বিষয় হল পাখি। রঙ বেরঙ এর বিভিন্ন ধরনের দেশ বিদেশের পাখি বিভিন্ন সময় আসে আমাদের এই বাংলার আনাচে কানাচে। তাদের দেখা আর ছবি তোলার মধ্যে একটা অনাবিল আনন্দ আছে। সেই কারণে কোথাও বেড়াতে গেলে আমার ক্যামেরার ব্যাগ টা সঙ্গে নিয়ে নিই।

মুরুগুমা আলাদা করে পাখির জন্য খুব একটা বিখ্যাত জায়গা না হলেও গাছ পালা-খাল বিল আছে আর পাখি থাকবে না এমন হয়?
পৌঁছনর পরের দিন তাই একটু ভোর ভোর উঠে আশপাশ টা ঘুরে দেখার বাসনায় বেরতে যাব ওমনি দেখি আড্ডা ঘরের খড়ের চালে বাসা বানাতে ব্যস্ত বেশ কয়েকটা মুনিয়া পাখি। এদের ইংরেজী তে বলে Silver bill। পাশেই ছোট্ট পুকুর। পুকুর পাড়ে মাছ কিম্বা ব্যাঙ পাকড়ানোর ধান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ধবধবে সাদা বক (Little egret) আর ল্যাজ নেড়ে নেড়ে খেলা করছে ছোট্ট পাখি খঞ্জনা (White Wagtail)। সারা গরম কাল ইউরোপ আর উত্তরের দেশগুলোতে কাটিয়ে শীত পড়তে না পড়তে সে চলে এসেছে আমাদের বাংলায়। 

গেটের মুখে পৌঁছে দেখি মিস্টার অ্যান্ড মিসেস রবিন (Indian robin)খেলা করছেন ইতি উতি। রিসর্টের নামের সাথে সাযুজ্য রেখেই বনপলাশীর আঙিনায় রয়েছে বেশ কয়েকটা পলাশ গাছ। পলাশের ডালে ডালে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট সব পাখি। বসন্তে যখন পলাশ ফুটবে -পাখিদের আনা গোনাও নিশ্চয় বাড়বে। আপাতত দুর্গা টুনটনি (purple sunbird) আর pale billed flowerpecker দেখতে পেলাম। দূরে ক্ষেতের মধ্যে একটা ছোট পলাশ চারার ওপর চুপটি করে বসে আছে কাজল পাখি (Brown shrike)। চোখের ওপর কালো দাগ থেকেই এমন নাম তার। ওই টুকু ছোটো পাখি-কিন্তু কি জোর তার ওই টুকুনি ডানায়! যার ওপর ভরসা করে সুদূর মোঙ্গলিয়া কিম্বা সাইবেরিয়া থেকে পাড়ি দিয়েছিল আকাশ পথে একটু উষ্ণতার জন্য। জিপিএস নেই কম্পাস নেই-শুধু অভিজ্ঞতা আর দুডানায় ভরসা করে হাজার হাজার নটিক্যাল মাইল জিওডেসিক পেরিয়ে সে পৌঁছে গেছে আমাদের দেশে।সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল আমাদের সাথে কাটিয়ে আবার ফিরে যাবে ওদেশে। ভিসা ও লাগবে না-ইমিগ্রেশনের ঝামেলা ও নেই। সংস্কৃত দেশ কথাটা র অর্থ যে ভৌগলিক সীমাবদ্ধ ভূখন্ড মাত্র নয়- এক ব্যাপক বিশাল পরিসর তা তথাকথিত সভ্য মানুষেরা না বুঝলেও এই পুঁচকে পরিযায়ী রা বোঝে।আর তাই বুঝি ছুটে আসে সেই সূর্যের দেশে যেখানে সংগীত এর নাম দেশ।
আমাদের দলনেত্রী অঙ্কের অধ্যাপিকা নীলাঞ্জনার (বউ এর ও বন্ধু আমার ও বন্ধু) ও পাখি দেখার সখ আর বেশ ভালো কোম্পানির দূরবীন দুই ই রয়েছে। সে ও দেখি ভোর ভোর উঠে রাস্তার ওপর থেকে ড্যাম এর দিকে তাক করে পাখি খুঁজছে। তার দূরবীনের অভিমুখ অনুসরণ করে দেখি একদল বেশ বড়সড় বাঁকাঠোঁট ওয়ালা পাখি আপন মনে খাওয়া দাওয়া সারছে। ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে দেখলাম লাল ঝুটি ওলা Black Ibis বা Red Naped Ibis (কালো দোচারা) এর দল রাস্তার ওপারে প্রায় ২০০ মিটার দূরে ড্যামের অর্ধেক শুকিয়ে যাওয়া অংশটায় চরে বেড়াচ্ছে। মিশরীয় হায়রোগ্লিফিক হরফে খুব দেখা যায় এই ধরণের পাখি র ছবি।আমিও গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম যদি একটু কাছ থেকে ওদের ছবি পাওয়া যায়। এইখানে বলে রাখি, পাখিরা কিন্ত খুব সহজেই বুঝতে পারে কেউ তাদের দিকে বাড়তি নজর দিচ্ছে কিনা।তাই যে পাখির ছবি তুলতে চান তার কাছাকাছি যাওয়ার উপায় হল তার দিকে নজর না দিয়ে এটা ওটা করতে করতে অন্যান্য দিকে তাকিয়ে রয়ে বসে এগোতে থাকা। মানে এমন একটা ভাব করা যেন ওই পাখি গুলিই সব থেকে তুচ্ছ আর বাকি সব কিছুই আপনার কাছে ভীষণ মূল্যবান। যাওয়ার পথে দেখা হয়ে গেল বেশ কিছু মাঠ চড়াই (Paddy Field Pipit) এর সাথে। তারা বেশ জোড়ায় জোড়ায় খেলা করছে নিজেদের মধ্যে। তা এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে পৌঁছে গেলাম প্রায় আধ ঘন্টা মত সময় নিয়ে আইবিস গুলোর ৩০/৪০ মিটার এর মধ্যে। তারাও খুব বেশী গুরুত্ব দিলনা আমাকে। আর আমিও প্রাণ ভরে ছবি তুল্লাম। কিছুক্ষণ পরে দেখি উল্টো দিক থেকে দুজন মানুষ দুটো সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে আসছেন পাখি গুলোর দিকে। এমনি তে পাখিরা এলাকার পরিচিত পোষাক আসাক পরা মানুষ দের খুব একটা পাত্তা দেয়না। তা বলে খুব কাছে চলে এলে ওরাই বা চান্স নেবে কেন? সাইকেল আরোহীদের কৃপায় আমিও পেয়ে গেলাম ফ্লাইং শট্। ব্ল্যাক আইবিস এর ডানার সাদা দাগ গুলো উড়ন্ত অবস্থায় যতটা পরিস্কার হয় বসা অবস্থায় ততটা হয় না। আইবিস এর ছবি তুলে ফিরছি তখন। রাস্তায় ওঠার মুখে একটা বন কলমি র জঙ্গল আছে।ওটার পাশ দিয়ে আসার সময় দেখি একজোড়া ছোট্ট পাখি মাটি ঘেসে উড়ে বেড়াচ্ছে। হাভভাব আর আকারে অনেকটা ভিরিরি বা Bengal bush lark এর মত। কিন্তু দেখতে যেন একটু আলাদা! ক্যামেরার টেলি লেন্স এ চোখ লাগিয়ে বুঝলাম ইনিও Lark তবে Bushlark নন Sparrowlark। বাড়ি ফিরে Inskipp এর বই দেখে চিনলাম এর নাম Ashy Crowned Sparrowlark. এইটুকু রাস্তায় আরো চমক অপেক্ষা করছিল আমার জন্য! Sparrow Lark এর ছবি তুলে রাস্তায় উঠেছি অমনি দেখি মিহি সুরেলা গলায় ডেকে চলেছে একটি হলুদ চোখো ছাতারে (Yellow Eyed Babbler)। নামে এরা ছাতারে হলেও আমাদের পরিচিত ছাতারে বা সাতভাই এর থেকে আকারে অনেকটাই ছোটো, সুন্দর আর সুরেলা। 

ফিরে এসে আড্ডা ঘরে বসে নাস্তা সারতে সারতে ই দেখি পশ্চিমের মাঠে খেলা করছে একজোড়া ল্যাপউইং। বাংলায় আমরা যাদের বলি হো টি টি (Red Wattled Lapwing) এরা তাদের জাতভাই Yellow Wattled Lapwing. নীচে দেওয়া ছবি দেখলেই বোঝা যাবে এদের নামের উৎস কি। ব্রেক ফাস্টের পর আমি আর আমার সদ্য কৈশোর পার করা ভাইপো প্রত্যয় মিলে একটু চরতে বেরোলাম যদি আর কিছু পাখির দেখা মেলে। রাস্তা ধরেই একটু এগিয়েছি-ওমনি দেখি একটা চন্দনা মাথার ওপর চক্কর কাটছে। ইংরেজি তে এদের বলে Alexandrine parakeet। চক্কর কাটতে কাটতে কি হল কে জানে-আমাদের বুঝি তার ভীষণ পছন্দ হয়ে গেল-সে এসে বসল আমার একেবারে কয়েক হাতের মধ্যে একটা পলাশ চারার ওপর। আর আমিও কন্টিনিউয়াস মোড এ কতকগুলো স্ন্যাপ নিয়ে নিতে কসুর করলাম না। আর একটু ঘোরাঘুরি করে ভাইপো কে কিছু গাছ-পাখি চেনাতে চেনাতে ই বেশ রোদ উঠে গেল। আর রোদ কড়া হয়ে গেলে পোকা মাকড় রা ও গাছের পাতা- ছালের আড়ালে চলে যায়। ফলে পাখি দের ও আনা গোনা কমে যায়। তাই আমরা ও নিলাম ফেরার পথ। বনপলাশীর গেটে ঢোকার ঠিক আগে দেখলাম একটা কাঠ শালিখ বা Chestnut Tailed Starling শুকনো ডালের ওপর বসে আড়মোড়া ভাঙছে। কাঠ শালিখের ভঙ্গিমা ক্যামেরা বন্দি করে আর ক্যামেরা ব্যাগবন্দি করে ফেললাম সেদিন এর মত। কোলকাতা ফেরার দিন প্যাকিং এর ঠিক আগে সকাল সকাল একবার বেরিয়েছিলাম। সূর্য তখন উঠে গেছে।আগে শুনেছিলাম মুরুগুমা র ড্যামে পরিযায়ী হাঁসেরা নামে না। কিন্ত আকাশে ওগুলো কি উড়ছে দল বেঁধে? দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে। ক্যামেরার টেলি তে চোখ লাগিয়ে পরিস্কার দেখলাম বেশ বড় আকারের হাঁস! আলোর উল্টো দিকে থাকায় রঙ বুঝতে পারলাম না। কিন্ত এটা আশা করাই যায় যে মুরুগুমার জলে এবার হাঁস নামবে। 

আজ আর সময় নেই-ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে এখনি। প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। 'আবার আসিব ফিরে' -বনপলাশীর আঙিনায়-এবার বসন্তে।
  

নভেম্বর, ২০১৮

বৃহস্পতিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৮

ছবি ~ অভিজিৎ মজুমদার

বাঙালির কাঁদুনি গাইবার অভ্যেস আর গেল না। এখন নতুন কান্না, চলচ্চিত্র উৎসবে কেন মুখ্যমন্ত্রীর ছবি? আরে বাবা. এমন মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছিস আগে, যিনি আঁকেন, কবিতা লেখেন, গান লেখেন, গল্প লেখেন, গল্প মারেন, গানে সুর দেন, রাস্তায় গান গাইতে গাইতে পথ হাঁটেন? যাকে বলে সংস্কৃতির হদ্দমুদ্দ। সাধে কি আর কলকাতাকে ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে? এমনকি রানীধানীও বলা যায়। তাহলে?



আন্তর্জাতিক উত্সবে এমন সংস্কৃতিময়ী মুখ্যমন্ত্রীর ছবি থাকবে না তো কি বুড়ো হাবড়া মৃণাল সেনের ছবি থাকবে? যত্তসব। দেখছিস, সুশীলরা চুপ আছে তবু তোদের ঘ্যানঘ্যান থামে না। তোরা কি বেশি বুঝিস? আর চাদ্দিকে যে বচ্ছরের পর বচ্ছর ধরে এত রঙ্গতামাশা চলছে তার পরিচালনা কে করছে শুনি? শহীদ দিবসে নাচাগানা হয়, আগে কখনো শুনেছিলিস? তবে? আর বাকি রাজ্য? সে তো যাকে বলে,  ব্লকব্লাস্টার। ভায়োলেন্স চাই? আছে। হাস্যরস চাই? আছে। প্যাথোস চাই? আছে। পরকীয়া চাই? আছে। পেটমোটা ভিলেন চাই? আছে। হাত কচলানো পুলিশ চাই? আছে। তাহলে? তার ওপর আছে স্পেশাল এফেক্ট। কখনো হুড়ুম করে ব্রীজ ভেঙে পড়ছে, কখনো দুম করে হাসপাতালে আগুন লেগে যাচ্ছে। যাকে  বলে নাচে গানে অভিনয়ে জমজমাট। পুরো হুতোমের নক্সা।

এর পরেও বলবি ওনার ছবি কেন? তোদের তাহলে সংস্কৃতির প্রথম পাঠটাই হয় নি। 

যাহ্, কথাঞ্জলি পড় গিয়ে। তাপ্পর আসবি সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলতে। এখানে পাঁচতলার মল, পুরোটাই শাড়ি।


বুধবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৮

মূর্তি ও সভ্যতা ~ পুরন্দর ভাট

অনেকেই ইস্টার আইল্যান্ডের নাম শুনেছেন। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে সেই জনমানবহীন দ্বীপ যেখানে শ'য়ে শ'য়েঅতিকায় পাথরের মূর্তি খুঁজে পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্বিকরা গবেষণা করে জানতে পারেন যে আনুমানিক এক হাজার বছর আগে এই দ্বীপে 'রাপানুই' নামের এক বৃহৎ সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল, যারা এই অতিকায় মূর্তিগুলো বানিয়েছিল। রাপানুইয়ের মানুষজন এই হাজার হাজার টনের পাথরের মূর্তি খোদাই করে, মাইলের পর মাইল তাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মত প্রযুক্তি আয়ত্ত্ব করতে পেরেছিল। প্রশান্ত মহাসাগরে যতগুলো দ্বীপপুঞ্জ আছে তার কোথাওই এত উন্নত আদিম সভ্যতার অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। বাকি সব দ্বীপেই আদিবাসীরা সামান্য কৃষিকাজ আর মাছ-শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো বা এখনো করে, কোথাওই কোনো নগর সভ্যতা বা বৃহৎ নির্মাণকাজের ইতিহাস নেই। সেই কারণেই ইস্টার আইল্যান্ড ব্যতিক্রম এবং রহস্য। তার চেয়েও রহস্যজনক হলো যে এই আদিম সভ্যতার সম্পূর্ণ বিলুপ্তিকরণ। ১৮ শতকে যখন প্রথম ইউরোপীয় নাবিকেরা দ্বীপটির খোঁজ পান তখন সেই দ্বীপে বসবাস করছিল মাত্র কয়েকশো আদিবাসী, যাঁদের মধ্যে রাপানুইয়ের উন্নত সভ্যতার কোনো চিহ্নই ছিল না। প্রশান্ত মহাসাগরের বাকি দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীদের মতোই তারা ছিল প্রযুক্তিগত ভাবে অনুন্নত। সেই সুবিশাল পাথরের মূর্তি খোদাই করা এবং তাদের টেনে নিয়ে আসার পদ্ধতি সম্পর্কেও সেই আদিবাসীদের কোনো ধারণা নেই। প্রত্নতাত্ত্বিকরা ইস্টার আইল্যান্ডের কবর ও ধ্বংসাবশেষ খোঁড়াখুঁড়ি করে অনুমান করেছেন যে রাপানুই সভ্যতার স্বর্ণযুগে এই দ্বীপের জনসংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি ছিল। তাহলে সেই রাপানুই সভ্যতার মানুষরা কোথায় গেল? সভ্যতার এক শিখরে পৌঁছে কী ভাবে তারা সম্পূর্ণ হারিয়ে গেল? শত্রুর আক্রমণ? কোনো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ? মহামারী? না, এর কোনটারই প্রমাণ কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিকরা খুঁজে পাননি। যা প্রমাণ মিলেছে তা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে হঠাৎ করে কোনো একটা ঘটনার জন্য সভ্যতাটা ধ্বংস হয়ে যায়নি। বরং দু তিনটে প্রজন্ম ধরে ক্ষয় হতে হতে ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু কেন হলো এমন ক্ষয়? তার আগে ইস্টার আইল্যান্ড নিয়ে আরেকটা রহস্য সম্পর্কে বলা প্রয়োজন। প্রথম দিকে বিজ্ঞানীরা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না যে এই হাজার হাজার টনের পাথরের মূর্তিগুলো দ্বীপের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কী ভাবে। ইস্টার আইল্যান্ড প্রায় সম্পূর্ণভাবে গাছপালশূণ্য, শুধু ঘাসে ঢাকা। তাই কাঠের চাকা অথবা গাছের গুঁড়ি ব্যবহার করে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। এই রহস্যের কিনারা করেন শেষ অবধি উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা। তাদের গবেষণায় উঠে আসে যে এই দ্বীপ একসময় বড় বড় গাছপালায় ঢাকা ছিল, চাষাবাদও হত খুব ভালো কারণ দ্বীপের মাটি ছিল উর্বর। কী হলো সেই গাছপালা, চাষাবাদের? এর উত্তর আছে সেই অতিকায় মুর্তিগুলোতেই। বিশ্ববিখ্যাত নৃতত্ববিদ জ্যারেড ডায়মন্ড দীর্ঘ গবেষণার পর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছন যে এই অতিকায় সব মূর্তিই কাল হয়েছিল রাপানুইয়ের। মূর্তিগুলো সবই রাজা বা প্রভাবশালী পূর্বপুরুষদের। রাপানুইয়ের মানুষজন কোনো অজানা কারণে এই অতিকায় মূর্তি নির্মাণে এতটাই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে সমাজের একটা বড় অংশের মানুষের সমস্ত শ্রম, উৎপাদনের সমস্ত উদ্বৃত্ত ব্যয় হতো শুধুই মূর্তি বানাতে। এর ফলে এক সময় ব্যাহত হতে থাকে চাষাবাদ, মাছ-শিকার। অর্থাৎ একটা সভ্যতা নিজের সমস্ত ধন দৌলত দিয়ে, সমস্ত পুঁজি দিয়ে শুধুই অতিকায় মূর্তি বানিয়ে চলেছে, উৎপাদনবৃদ্ধি বা প্রযুক্তিগত উন্নতির কথা না ভেবে। এই মূর্তি বানানোর পাগলামির ফলে আরেকটি ক্ষতিও হয়। পাথর টেনে আনার জন্য দ্বীপের অধিকাংশ বনস্পতিই কেটে ফেলে রাপানুইয়ের মানুষজন। সেই কাঠ দিয়ে তৈরি হতে থাকে চাকা, সিঁড়ি। পরিবেশের ওপর এর প্রভাব নিয়ে বিন্দুমাত্র না ভেবে তারা এই ধ্বংসকাজে লিপ্ত হয়। এর ফলে একটা সময় গিয়ে জমির উর্বরতা নষ্ট হতে থাকে, চাষাবাদ ভেঙে পড়ে, যে টুকু গাছ অবশিষ্ট ছিল তাও নষ্ট হয়ে যেতে থাকে জমি অনুর্বর হয়ে যাওয়ার ফলে। দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। ক্রমশ উন্নত নগরসভ্যতার পতন হয়, জনসংখ্যা কমতে থাকে। একটা সভ্যতা পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যায় কারণ নিজের উদ্বৃত্তকে উন্নতির কাজে না লাগিয়ে, উৎপাদনের কাজে না লাগিয়ে, তাই দিয়ে শুধু মূর্তি বানানোর ফলে।
 
গুজরাটে বল্লবভাই প্যাটেলের মূর্তি বসেছে, উচ্চতা ১৮২ মিটার, খরচ ৩ হাজার কোটি টাকা। মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকার শিবাজির একটি মূর্তি নির্মাণ করছে যার উচ্ছতা হবে ২১২ মিটার, খরচ ৪ হাজার কোটি টাকা। যোগী আদিত্যনাথ বলেছে উত্তর প্রদেশে একটি রামের মূর্তি নির্মাণ করা হবে ১০০ মিটার উচ্চতার, যার জন্য আনুমানিক খরচ হবে ২ হাজার কোটি টাকা।

বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১৮

স্ট্যাচু ~ সুদীপ মিঠি খবরওয়ালা

তিন হাজার কোটি টাকা। মানে ৩০,০০০,০০০,০০০ টাকা। ঠিক কী কী হয় তিন হাজার কোটি টাকায়? ধরা যাক আপনি শ্যামবাজার ক্রসিংয়ে। শতচ্ছিন্ন নাকে-সর্দি বাচ্চাটা এসে ঝুলে পড়ল, কাকু দুটো পয়সা দাও। আপনি খানিক মাছি তাড়ানোর চেষ্টা করেও যখন পারলেন না, নিতান্ত নিরুপায় হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী করবি? উত্তর এল, ভাত  কিনে খাব। অমনি আপনি ক্যাঁক করে চেপে ধরলেন। ইয়ার্কি পায়া হ্যায়? খাবার নামে অন্য ধান্দা! চল দেখি কোথায় ভাত পাওয়া যায়। তোকে বসিয়ে খাওয়াবো। যাস কোথায় বাছাধন? পাশের এঁদো গলিটা ঘুরেই বেঞ্চিপাতা একটা দোকানে হাঁক দিলেন, একটা সবজি ভাত দিন তো দাদা। তাড়াতাড়ি। আর ওমা, হাভাতের মতো গিলতে লাগল ছেলেটা ! এক্কেবারে হাভাতের মতো ! আপনাকে লুকিয়ে দোকানদারটা এক পিস মাছের টুকরোও তুলে দিল পাতে। আপনি আড়চোখে দেখলেন। মগের জলের ছলাৎছল পেরিয়ে প্যান্টের পেছনে হাত মুছে কালো কালো দাঁত বের করে যখন ঢিপ করে পেন্নাম করল ছোঁড়াটা, আর আপনি লংহর্নের ওয়ালেট থেকে তিরিশটা টাকা বের করলেন, অমনি দোকানদার আপনার হাতদুটো ধরে বলল, দাদা, কুড়ি টাকা দিন, মাছটা আমিই দিলাম। বেশ। আপনি আত্ম্ভরিতার ঢেকুর তুলে গাড়ির সীটে মাথা এলিয়ে দিলেন। হালকা এসিতে  তন্দ্রা এসেছে সবে। আধোঘুমে কে যেন হঠাৎ বলে উঠল, তিন হাজার কোটি টাকা ! ঐ তিন হাজার কোটি টাকায় এরকম হাকুচ্ছিত হাড়হাভাতে ১৫০ কোটি ছেলেমেয়েকে একবেলা পেটপুরে খাওয়ানো যেত !  ১৫০ কোটি জনকে ! আরে মোলো যা ! বড্ড জ্বালাতন করছে মাছিটা !

কিংবা ধরুন আপনার  ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর খানিক বাতিক আছে। জঙ্গলমহল বা অযোধ্যার কোলে গাঁয়ে গাঁয়ে চলে যান কখনো। শাল-মহুয়ার দেশে। আপনার পায়ের তলায় আলতো আলতো ভাঙে শুকনো পাতার সারি। পাশে পাশে হাঁটে পাহাড়ী নদী তিরতির। আর আগুনরঙা পলাশ কৃষ্ণচূড়া রাঙিয়ে থাকে প্রান্তর থেকে প্রান্তরে। ঊষর টাঁড় মাটির বুকে ভূমিপুত্ররা আখ-টম্যাটো ফলায়। টম্যাটো বেচে পঞ্চাশ পয়সা কিলো। হ্যাঁ, পঞ্চাশ পয়সা ! মুখযুগুলো জানেও না ওদের বেচে দেওয়া  টম্যাটো আপনি -- আপনারা কেনেন কুড়ি টাকায়। মানিকতলা-ফুলবাগানে স্করপিও থামিয়ে। তা ধরা যাক আপনারা গুটিকয় বন্ধু তাদের মাঝে করেন মেডিক্যাল ক্যাম্প, একদিন পেটপুরে খিচুড়ি লাবড়া খাওয়ান, বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার উৎসাহ জোগাতে হাতে তুলে দেন খাতা-পেন।  মেডিক্যাল ক্যাম্পটা আপনার চিকিৎসক বন্ধুদের নীরব সেবা। দিনের শেষে আপনি যখন খতিয়ান নিয়ে বসেন, দেখেন খরচ হয়েছে সাকুল্যে হাজার পনেরো-কুড়ি।  আর আপনি মাটির ভাঁড়ে গরম চায়ে চুমুক দিয়ে চমকে ওঠেন। তিন হাজার কোটি টাকা ! এই তিন হাজার কোটিতে তো এরকম পনেরো লক্ষ আদিবাসী গ্রামকে সেবা করা যেত ! আর আপনার পায়ের তলায় টলে ওঠে মাটি !  কে জানে প্রেসারটা বাড়ল কিনা !

বাড়বেই। যা চাপ নিচ্ছেন ! তারচে' বরং চলুন মানভূমের ছোট্ট একটা গ্রামে। যেখানে কোনো কোনো দেবী, কোনো কোনো দেবতার বাস। সেইসব দেবদেবীরা তৈরি করেছেন গুটিকয় স্কুল। প্রবল বাধাবিপত্তি পেরিয়ে জুটিয়েছেন অর্ধউলঙ্গ বাচ্চাগুলোকে। হামদের ছিলাগুলান পেন্দাই লিখাপঢ়া শিখ্যে  কী কইরবেক গ ! বুঝিয়েছেন অবুঝ মানুষগুলোকে। আর চমকে উঠেছেন এই জেনে যে এই স্বচ্ছ আলোকপাতের  যুগেও এমন জায়গা আছে যেখানে প্রাতঃকৃত্য যে এক দৈনন্দিন স্বাস্থকর শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, এটুকু ধারণাও নেই।  সেইসব কপর্দকহীন বোধহীন মাড়ভাতভোজী ছেলেপুলেদের জন্য তাঁরা গড়ে তুলেছেন অবৈতনিক আবাসিক বিদ্যালয়। সব দায়িত্ব সমেত। ধরা যাক আপনারা কয়জন পথচলতি হাজির হয়ে গেছেন অকুস্থলে। জনসেবার আত্মপ্রসাদবলে জানতে চেয়েছেন প্রয়োজন। উত্তর পেয়েছেন, মাসে হাজার কুড়ি হলে দেড়শো-দুশো বাচ্চার থাকা-খাওয়া-পরা-শিক্ষার সব খরচ চালানো যায়। আর নিমেষে আপনার চোখ চলে গিয়েছে আপনারই খুলে-রাখা পাঁচহাজারী উডল্যান্ডসের জুতোজোড়ার দিকে। চোখ যখন তুললেন, ভিজে গেছে চশমার কাঁচ।  বাঁশের খুঁটিতে শরীর ছেড়ে দিয়েছেন আপনি। আপনার মাথা কাজ করছে অল্পই। তবু হিসেব করে চলেছেন, তিন হাজার কোটি ! তিন হাজার কোটি টাকা মানে এরকম প্রতি দেড়শো-দুশো বাচ্চার দশ হাজারটা স্কুলের এক মাসের যাবতীয় খরচ ! খানিক দূরেই ভেসে আসছে খলবলে শিশুগুলোর কলকাকলি।       

কী সব ভ্যাজর ভ্যাজর করছেন মশাই ! এ হল নয়া ভারত। শাইনিং ইন্ডিয়া।তার মাঝে এইসব বস্তাপচা সেন্টিমেন্ট আনলে চলে?  বেশ ! তবে খানিক অন্য কথা হোক। সামান্যই। এই ধরুন, ভারতের মঙ্গল অভিযান, মার্স মিশন, যা নিয়ে তদানীন্তন দেশপ্রেমী জনতা রে রে করে উঠেছিল, "ভারতের মতো গরীব দেশে এসব চূড়ান্ত  বিলাসিতা"। সেই মার্স মিশন সারা বিশ্বের নজর কেড়েছিল অভাবনীয় কম খরচে এত বড় সাফল্যের পরাকাষ্ঠা হিসেবে। বিশ্ববিজ্ঞানের দরবারে সামান্য হলেও এগিয়ে দিয়েছিল দেশকে।  তা সেই মার্স মিশনে কত খরচ হয়েছিল জানেন? সাকুল্যে ৪৫০ কোটি টাকা। এইবার ভাবুন, ঐ তিন হাজার কোটি টাকায় মেরেকেটে এরকম খানছয়েক বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের সফল রূপায়ণ ঘটানো যেত। যার যে-কোনো একটাই ঐ স্ট্যাচুর চেয়ে অনেক অনেক উঁচুতে মাথা তুলে ধরতে পারত দেশের। জানি, আপনি বলবেন, কিছু হচ্ছে তো! যে দেশে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমতে কমতে জি-ডি-পি-র মাত্র ২.৭ শতাংশ (তুলনীয় ডেনমার্ক ৮.৭, নিউজিল্যান্ড ৭.২, সুইডেন ৭.০, জার্মানি ৫.১, মায় চীন ৭.৫ শতাংশ। ছোট দেশগুলো, যাদের ১২-১৩ শতাংশ, তাদের কথা বাদই দিলাম। -- তথ্য উইকি), সে দেশে এই 'কিছু'টা যে কতোখানি, এ আপনি দিব্যি জানেন মশাই !  তা যাকগে। তখন থেকে বড্ড জ্বালাতন করছে মাছিটা ! 

ও হ্যাঁ, তিন হাজার কোটিতে একটা স্ট্যাচু হয়। একটা অর্থহীন স্ট্যাচু। সে যত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরই হোক না কেন। আদপে অর্থহীন।  
 

পুনঃ -- আপনার পাল্টা যুক্তি থাকতেই পারে।