মঙ্গলবার, ৩০ জুন, ২০২০

জলিমোহন কৌল ~ আর্কাদি গাইদার

আমাদের একদম নিজস্ব দুটো কলকাতা শহর আছে। আমরা মানে তারা, যারা নয়ের দশকে বড় হয়েছি, স্কুলে বা কলেজে গেছি। আজকালকার নেটদুনিয়ার পরিভাষায় যাদের 'মিলেনিয়াল' বলে। 

উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ, বিশ্বায়ন, গ্যাট চুক্তি, নরসিমহা রাওদের আঁকা সীমানার দুপারে দুটো আলাদা শহর - এই দুই কলকাতাকে চেটেপুটে খেতে খেতে প্রাপ্তবয়স্ক  হয়েছি আমি, পাড়ার একটা বাড়িতে টেলিফোনের শৈশবের শহর থেকে এসটিডি বুথের ব্যবসাটাই সম্পূর্ন উঠে যাওয়ার মধ্যবয়সের শহরের মধ্যেই বিশ্বায়িত হয়েছি।

এসবের মধ্যেই খবর আসে, জলি কৌল মারা গেলেন। কমরেড জলিমোহন কৌল - অবিভক্ত কমিউনিষ্ট পার্টির কলকাতা জেলার শেষ সম্পাদক। উনি মারা না গেলে হয়তো জানতেও পারতাম না উনি বেচে ছিলেন। 

দুই কলকাতার বিশ্বায়িত নাগরিক আমরা যে কজন, আমরা নিয়ম মেনে পৃথিবীর আর দশটা শহরের মতনই বিশ্বায়নের টেমপ্লেট আপন করেছি। আমাদের দ্বিতীয় কলকাতায় আছে ধুসর কম্পোজিট ফাইবার আর কাচের উঁচু উঁচু অফিস বিল্ডিং। আছে আর্টিফিশিয়াল ল্যান্ডস্কেপিং, জিম আর কমিউনিটি সেন্টারওয়ালা এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স। আছে একটা স্টারবাক্স, গোটা কয়েক ম্যাকডোনাল্ডস, কয়েকটা কেএফসি। আছে মল, যেগুলোতে বারবেরির আউটলেট খোলবার তারিখের অধীর আগ্রহে আমরা অপেক্ষা করি। এইভাবে আমরা মনে মনে বিশ্বায়নের সূচকে নিজেদের ওঠাই নামাই - ব্যাংগালোরে এদের দুটো আউটলেট আছে, আমাদের নেই, সূচকে নেমে গেলাম। দিল্লিতে খোলবার আগে আমাদের এখানে ওরা আউটলেট খুললো, সূচকে একটু উঠে গেলাম। একদম একইরকম টেমপ্লেট মেনে অফিস বিল্ডিং, এপার্টমেন্ট, স্টারবাকস, ম্যাকডি, বার্গার কিং কে আপন করেছে সমস্ত বিশ্বায়িত শহর - সবার আছে একটা স্বতন্ত্র চরিত্রের মুমূর্ষু ওল্ডটাউন,  আর আছে নিউটাউন, যেখানে হংকং, সিংগাপুর, ব্যাংগালোর, মুম্বাই, কলকাতা সবাইকে একটু একটু করে একইরকম হয়ে যেতে হবে - একটি গ্লোবাল ভিলেজ, যার অভিন্নতাই আমাদের পরিচয়। 

এই ২০২০ র হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি - অবাঙালির বিশ্বায়িত কলকাতায় বসে আমার ভাবতে ভালো লাগে, আমার প্রথম কলকাতায় একদা কমিউনিষ্ট পার্টির নেতা ছিলেন একজন কাশ্মীরি পন্ডিত - জলিমোহন কৌল। আমার ভাবতে ভালো লাগে, ১৯৪৬ এর ডাইরেক্ট একশন ডে'র দাঙ্গা মোকাবিলা, বন্দরের শ্রমিক আন্দোলন, শহরের উপকন্ঠে উদ্বাস্তু আন্দোলনে লাল ঝাণ্ডা হাতে জলি কৌলের সাথে একসাথে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তার বাঙালি স্ত্রী মনিকুন্তলা সেন, তার কমরেড উত্তরপ্রদেশের উর্দুভাষী শ্রমিক মহম্মদ ইসমাইল। 
বিশ্বায়িত এই দ্বিতীয় কলকাতায় বসে আমার ভাবতে ভালো লাগে, কমরেড জলিমোহন কৌলদের কলকাতা নিয়ে - ছাত্র, শ্রমিক, উদ্বাস্তুদের কলকাতা - টিরেট্টিবাজার, ছাতাওয়ালা গলি, বো ব্যারাকস, আর্মেনিয়ান চার্চ, পার্ক স্ট্রীট, পার্ক সার্কাস, খিদিরপুর, নিউমার্কেট, বালিগঞ্জ - পেয়াঁজের খোসার মতন অগুনতি স্তরগুলো নিয়ে, একেকটা গলি, একেকটা চৌমাথা পেরোলেই পালটে যাচ্ছে ভাষা, পালটে যাচ্ছে মানুষগুলো, পালটাচ্ছে চামড়ার রঙ, পোশাকের ধরন, পালটে যাচ্ছে স্থাপত্য, যেন একটা শহর নয়, সম্পূর্ণ আলাদা চরিত্রের কিছু জনবসতি বাড়তে বাড়তে একে অপরের সাথে ধাক্কা খেতে খেতে চাপাচাপি করে জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। 

প্রাক বিশ্বায়ন যুগের সেই প্রকৃত বিশ্বজনীন প্রথম কলকাতার  ধীরমৃত্যুর সাক্ষ্য বহন করে আমার গ্লোবালাইজড, ইউনিফর্ম দ্বিতীয় কলকাতা। সেই তালিকায় যুক্ত হলেন কমরেড জলিমোহন কৌল।

শুক্রবার, ২৬ জুন, ২০২০

ধর্ষকাম IT Cell এবং আমরা ~ অর্কপ্রভ মুখোপাধ্যায়

সাফুরা জার্গারকে নিয়ে একটা পোস্ট। "এখন জেলে বসে কান্না ? দিল্লির দাঙ্গায় ইন্ধন দেওয়ার সময় মনে ছিল না?" আপনি স্বাভাবিকভাবেই কমেন্ট থ্রেডে বোঝাতে শুরু করেছেন, গর্ভবতী অবস্থায় একজন ব্যক্তিকে বিনা বিচারে জেলবন্দী করে রাখাটা কতটা অমানবিক, হঠাৎ আপনাকে মেনশন করে কমেন্ট "তোর মা কটা মোল্লার সাথে রাত কাটিয়ে তোকে পয়দা করেছিল রে? " আপাদমস্তক বিরক্ত হয়ে আপনি তখনও তর্ক চালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন যুক্তি দিয়ে। আবার আপনি কমেন্ট থ্রেডে মেনশনড। আপনার প্রোফাইল থেকে, আপনার প্রেমিকার ছবি ডাউনলোড করে, কমেন্টে দেওয়া হয়েছে, সাথে লেখা "দেখে তো মনে হচ্ছে না আমার সামনে ঠিকমতো পা ফাঁক করতে পারবে !" আপনি স্তম্ভিত। শকড। কী লিখবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। কাঁপা হাতে ফেসবুকের ট্যাবটা অফ করে দিতে চাইছেন আপনি। কিন্তু ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারছেন না। 

বিজেপির কুখ্যাত আইটি সেলের ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে এইধরণের কদর্য আক্রমণ কমবেশি সবারই দেখা। ওদের পোস্টের কন্টেন্ট, শব্দচয়ন, আন্ডারটোন সুস্থ রুচির মানুষকে রীতিমতো ট্রমাটাইজড করার ক্ষমতা রাখে। অমর্ত্য সেনের দ্বিতীয় বিয়ে থেকে শুরু করে ঐশী ঘোষের শরীর – কুৎসিত রুচিহীনতার নজিরবিহীন মাইলস্টোন। 

ফ্যাসিস্ত রাজত্বে বিষাক্ত মানসিকতার চাষ। সোশ্যাল সায়েন্স, নিউরোসায়েন্স সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চর্চিত বিষয়। নারীবিরোধী, যৌন হিংসাকে খুল্লমখুল্লা উদযাপন করার খোলাবাজার। বহুদিনের, পুরোনো অভ্যেস।

১৯১৯ নাগাদ নারীমুক্তি বিরোধী ফিউচারিস্ট আন্দোলনের সাথে নিজেকে একাত্ম করে গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছিল ফ্যাসিবাদ। ক্ষমতায় আসার পর বেনিতো মুসোলিনির প্রকাশ্য ঘোষণা ছিল "l'eroismo dei vostri figlioli, dei vostri mariti, dei vostri fratelli, si deve anche a voi, o donne di Roma e 'Italia" – "the heroism of your sons, of your husbands, of your brothers, is also your merit, oh women of Rome and of Italy"। বটেই তো ! নারীর গৌরব তো ঠিক হবে তার সন্তান/স্বামী/ভাইয়ের বীরত্বের মাপকাঠিতে! 

ভার্জিনিয়া উলফ, ১৯৪০-এর দশকে স্পষ্টই বলেছিলেন নাৎসি জমানার রিগ্রেসিভ চরিত্র এবং নারী-নির্যাতন দুয়েরই শেকড়ে রয়েছে শোষণ। সামাজিক শোষণকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে মহিলাদের কেবলমাত্র সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে চরিত্রায়িত করে ফ্যাসিবাদ। আর ঢাকের বাঁয়া হয়ে প্রশ্রয় দেয় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, যেগুলোর ভিত্তিতে জ্বলজ্বল করছে মিসোজিনি বা নারীবিদ্বেষ। উইচহান্ট কিংবা দেবদাসী প্রথার স্রোত ফ্যাসিবাদ বয়ে নিয়ে চলে তার ধমনীতে। রোজা লুক্সেমবার্গকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে তবেই রাইখস্ট্যাগ দখল করতে পেরেছিল নাৎসি বাহিনী। 'দ্য বার্লিন রেপ' কিংবা গুলাগে টর্চারের রোমহর্ষক গল্প বাজারে ছেড়েও ফ্যাসিবাদের দালালরা ভোলাতে পারেনি নাৎসি ঘেটো আর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে ইহুদি কিংবা কমিউনিস্ট মহিলাদের ওপর এসএস অফিসারদের গণধর্ষণের কথা; এবং অত্যাচারের পর রক্তাক্ত নিগৃহীতার গায়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর লেলিয়ে দেওয়ার একের পর এক ঘটনা। প্রায় দুই মিলিয়ন মহিলাকে খুন করা হয় এই নাৎসি জমানায়, যাদের খুনের আগে অমানবিক সব এক্সপেরিমেন্ট কিংবা ধর্ষণ করা ছিল দস্তুর। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভয়াবহতম গণহত্যার মঞ্চ ছিল ১৯৭১-এর অব্যবহিত আগের পূর্ব পাকিস্তান। ধর্মান্ধ, স্বৈরাচারী আয়ুব খান কিংবা ইয়াহিয়ার সরকার হিংস্র টার্গেটে ছিঁড়ে খেয়েছিল ওপার বাংলার শরীর – একরাতে একশোরও বেশি পাক মিলিটারি কর্তৃক একজন নাবালিকাকে ধর্ষণ রিপোর্টেড ছিল একাধিক সময়ে। ২০০২-এর গুজরাট দেখেছে যোনিতে ত্রিশূল ঢুকিয়ে ভ্রূণ বের করে আনার নৃশংসতা। 

এগুলো তো তথ্য; ঘটনা। এই প্রতিটা ক্ষেত্রে বিকৃত পাশবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রোপাগেট করেছিল রাষ্ট্র। কেননা, ফ্যাসিবাদ প্রতিবারই মুখ থুবড়ে পড়েছে নারী ক্ষমতায়নের, সমানাধিকারের সুস্থ মানসিকতার সামনে। স্তালিনগ্রাদের অসম যুদ্ধে পুরুষ-নির্ভর নাৎসি বাহিনীর মনোবলকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে উড়িয়ে দিয়েছিল লাল ফৌজের নারী-ক্ষমতায়ন। বর্বর নাৎসিদের কাছে বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মোসিন-নাগান্ত রাইফেল কাঁধে সোভিয়েত লাল ফৌজের মহিলা জেনারেলরা, স্নাইপাররা। তাঁদেরই একজন, ল্যুডমিলা প্যাভলিশেংকোকে যুদ্ধের পর যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, "কতজনকে খুন করেছেন আপনি ?" – ওনার দৃপ্ত জবাব ছিল "একজনও মানুষকে মারিনি। ৩০৯ জন ফ্যাসিস্তকে মেরেছি!" 

প্রগতির বিরুদ্ধে নীতিগত অবস্থান ফ্যাসিবাদের – ঠিক তার বিপ্রতীপেই মানবতাবাদ, প্রগতিশীল আদর্শের দৃঢ় ব্যারিকেড। যেখানে অন্য বসন্তে মহাকাশে পৌঁছে যান ভ্যালেন্তনা তেরেস্কোভা। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা কাঁধে গেরিলা যুদ্ধে ধর্মোন্মাদদের ধ্বংসস্তূপের ওপর পা রাখেন মুক্তিযোদ্ধা নারীপুরুষ। মধ্যপ্রাচ্যে কিংবা সুদানে কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ায় খিলখিল করে হেসে ওঠেন আইসিসের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা তরুণী - একুশ শতকের কমরেড। কমরেড। যে শব্দের নারী-পুরুষ লিঙ্গভেদ নেই। 

ডিয়ার চাড্ডি বাহিনী, আইটি সেলের ফ্রাস্ট্রেটেড জানোয়ার! আপনাদের জেনে রাখা জরুরী, আপনাদের ধর্ষকাম আগ্রাসী ভঙ্গিতে আমাদের কপালে একফোঁটা ঘামও যাতে না ঝরে, তার জন্য তৈরি হয়ে নিচ্ছি আমরা। আপনাদের বিকৃতরুচিকে কফিনে পুরে দিতে শুভবুদ্ধির লংমার্চে পা মেলান রবীন্দ্রনাথ; পা মেলান রোমা র‍্যঁলা, লোরকা, সিগার, জোন বায়েজ, ভিক্টর জারা। ভুলে যাবেন না, এই লংমার্চকে থামাতে চেয়ে স্যুইসাইডাল স্টেপে খতম হয়ে গেছে আপনাদের অনেক গডফাদার। আমাদের চেতনাকে সংহত করেন মিশেল ব্যাসেলেট – ২১ বছর বয়সে সান্তিয়াগোর অদূরে ভিল্লা গ্রিমালদির কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে তীব্র শারীরিক নির্যাতন সহ্য করে ২০০৬-এ মেজর কামব্যাক – চিলির ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য একজন মহিলা রাষ্ট্রপতি। যে ইতিহাস আর বর্তমানকে না জেনে আদালতে, জেলখানায়, ফেসবুকে আর হোয়াটস্যাপে উল্টোদিকে ঘোরাতে চাইছেন সভ্যতার চাকা, সেই সিরিজের লেটেস্ট এপিসোডে দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ হবে রাস্তাতেই।

"হে আমার স্বদেশ! আহত তুমি হতে পারো, কিন্তু বিজিত কখনও না।" বলেছিলেন পাবলো নেরুদা। ভারতবর্ষও কারুর কেনা জমিদারি নয়। এই দেশ কোনও যুদ্ধবাজ ধর্মোন্মাদ ফ্রেঞ্চকাটের সামনে নতজানু হয়ে থাকবে না।

"La historia nos absolverá"! ইতিহাস আমাদের মুক্ত করবে !

চ্যালেঞ্জ !

বুধবার, ২৪ জুন, ২০২০

হারিয়ে যাওয়া পার্বত্য রেলপথ ~ অরুণাভ দাস

হারিয়ে যাওয়া পার্বত্য রেলপথ 

(১)
রেল সংক্রান্ত কিছু লেখালিখির জন্য কয়েকটা কাগজ জেরক্স করাতে গিয়েছিলাম। দোকানে পাড়ার পরিতোষদার সঙ্গে দেখা। আমার চেনা প্রথম ও একমাত্র প্রতিবেশী রেলফ্যান। এমন কী, সারা দেশের রেলওয়ে টাইম টেবিল মুখস্থ করে রেখেছেন। আমাকে দেখেই বললেন, 'দার্জিলিঙয়ের টয়ট্রেন নিয়ে তোমার বইটা বেশ কাজের হয়েছে। এবার নতুন কী লিখছ?' 
      বললাম, 'একটা নতুন লেখায় হাত দিয়েছি। সময় হলে আপনাকে বলব।'
      'বেশ বেশ। তাহলে তোমার বুদ্ধির গোড়ায় একটু শান দেয়ার ব্যবস্থা করি। বল তো দেখি, আমাদের দেশে পাহাড়ি রেলপথ কটি?' 
      'এ তো খুব সহজ প্রশ্ন, পাঁচটি।'
      পরিতোষ দা হেসে ফেললেন। 'একটা ছ-নম্বর ছিল, এখন আর নেই। মানে বিলুপ্ত।'
      'মানে, বলেন কী? কোনটা সেটা?' 
      'বললে তো হয়েই গেল। সেটা খুঁজে বার করাই তো তোমার কাজ। দুদিন নাও। না পারলে ফোন কোরো, বলে দেব। আর পারলে বাড়িতেই চলে এসো। তোমার বউদির হাতের চায়ের নেমন্তন্ন।' 
      ভালোই বুঝলাম, এবার আমার ঘুম ছুটল। ছয় নম্বর হিল রেলওয়ে সম্পর্কে কোনো ধারনাই নেই। কিন্তু খুঁজে বার করতেই হবে। মনে মনে নিজেকে এক দিন সময় দিলাম। পরিতোষ দার পরিতোষ হয়, এমন তথ্য পেয়ে গেলাম সহজেই। ভদ্রলোক অনুসন্ধিৎসার আলোটা জ্বালিয়ে দিতে ভালোই পারেন। 

(২) 
আমাদের দেশে চালু আছে পাঁচটি পার্বত্য রেলপথ। এর মধ্যে কয়েকটা আবার ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায়। পাঁচটি হল; দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে, কালকা-সিমলা রেলওয়ে, নীলগিরি রেলওয়ে, কাঙড়া ভ্যালি রেলওয়ে এবং নেরাল-মাথেরন রেলওয়ে। ছিল একটি ছয় নম্বরও, এখন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। সেটি ছিল চাবাগানের জন্য বিখ্যাত কেরালার হিলস্টেশন মুন্নারে। নাম কুন্ডালা ভ্যালি রেলওয়ে। মানুষ পরিবহনের থেকে মুন্নারের চা বদিয়াকান্নুর হয়ে বাইরের দুনিয়ায় পৌঁছে দিতে বেসরকারি উদ্যোগে এই অভিনব রেলপথের প্রবর্তন। 
      ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভারতের এই প্রথম মোনোরেল প্রকল্প চালু হয় ১৯০২ সালে। মুন্নার বা কুন্ডালা ভ্যালি থেকে রেলপথ গিয়েছিল প্রায় ৩৫ কিমি দূরবর্তী কান্নান দেবান পাহাড়ের মাথায়। উচ্চতম প্রান্ত বলে এই অন্তিম বিন্দু টপ স্টেশন নামে পরিচিত হয়, যার উচ্চতা ১৭০০ মিটার। অভিনব ব্যাপার হল, প্রথম পর্বে একটি রাস্তা বরাবর একটাই রেললাইন পাতা হয়। লাইনের ওপর থাকত ছোটো চাকা ও রাস্তায় থাকত বড়ো চাকা। এইভাবে কামরার ভারসাম্য বজায় রাখা হত। ট্রেন টানত বলদে। অতীতে উত্তর ভারতে পাঞ্জাবের পাতিয়ালা রাজ্যে একই ধরনের রেলপথ ছিল। ৬ বছর বলদে ট্রেন টানলেও পরে ১৯০৮ সালে ন্যারোগেজ রেলপথ তৈরি করা হয় ও ইঞ্জিনের ব্যবহার আরম্ভ হয়। এই পর্বেই কুন্ডলা উপত্যকায় বিখ্যাত এলুমিনিয়াম রেলব্রিজ নির্মিত হয়। ৬১০ মিলিমিটারের ন্যারোগেজ রেলপথ ১৯২৪ সাল পর্যন্ত চা ও বাগিচার অন্যান্য দ্রব্য পরিবহন করত। কুন্ডালা ভ্যালি ও মাদুপেট্টি অঞ্চল থেকে চা টপ স্টেশনে পৌঁছানোর পর পাত্রগুলিকে রোপওয়েতে চাপিয়ে ৫ কিমি দূরে কোট্টাগুড়ির দক্ষিণে নিম্নবর্তী স্থানে নিয়ে যাওয়া হত। এই জায়গাটি পরিচিত ছিল বটম স্টেশন নামে। জায়গাটি বর্তমান তামিলনাড়ু রাজ্যে। বটম স্টেশন থেকে গরুর গাড়িতে চা যেত ১৫ কিমি দূরে বদিয়াকান্নুর। সেখান থেকে ট্রেনযোগে সারা দেশে। এমন কী বন্দর থেকে জাহাজে ইউরোপের বাজারেও পৌঁছাত।
      ১৯২৪ সালে কুন্ডালা ভ্যালি রেলপথের অন্তিম দিন ঘনিয়ে আসে। পাহাড়ে হঠাত ভয়াবহ বন্যা হলে ছোটো রেলপথ ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায়। কেরালার নিজস্ব ক্যালেন্ডারের হিসাব অনুযায়ী এই বন্যা ৯৯ এর বন্যা নামে কুখ্যাত।
      এখন মুন্নার বা টপ স্টেশনে রেলপথ, স্টেশন বা সেতু ইত্যাদির কোনো চিহ্ন নেই। মুন্নারে যেখানে স্টেশন বিল্ডিং ছিল, সেটি সংস্কার করে টাটা-টির আঞ্চলিক অফিস করা হয়েছে। প্লাটফর্ম এখন রাস্তা। চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্যের জন্য টপ স্টেশন একটি জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। মুন্নার থেকে গাড়িতে অনেকে ঘুরতে যান।

(৩)
পরিতোষ দা ভারতের ষষ্ঠ পার্বত্য রেলপথের গল্প শুনে এমনই খুশি, চায়ের সঙ্গে মুখরোচক টা সহ একশয় একশ দিলেন৷ তার সঙ্গে রেল বিষয়ক নতুন একটা হোমটাস্ক। সে গল্প পরে আর একদিন।

ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত।

শুক্রবার, ১৯ জুন, ২০২০

ভারত-চীন সীমান্তে উত্তেজনা ~ অর্কপ্রভ ও শঙ্খনীল

বর্তমানে ভারত-চীন সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজমান অবস্থায় আইটি সেলের কর্মীদের একাংশ কেন্দ্রীয় সরকারের চরম কুটনৈতিক ব্যর্থতাকে আড়াল করতে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে বঙ্গ কমিউনিস্টদের চীনের সাথে জড়িয়ে এর ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন।
আজকে এর কিছুটা জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম।।
১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ৩১শে অক্টোবর The Statesman পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে জ্যোতি বসু বলেন-
"Our stands is clear. I think India's border defence should be strengthened and my party will not hesitate to put in all its efforts for the defence of India's freedom, irrespective of the political character of the attacking country."
এরপর ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা হিসেবে দলের পক্ষ থেকে ভারত – চীন যুদ্ধ প্রসঙ্গে তাঁর দেওয়ার বক্তৃতার খণ্ডাংশ উদ্ধৃত করলাম। কিঞ্চির লম্বা হলেও পড়তে অনুরোধ করব। অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জারি থাকুক –
-এইরকম প্ররোচনামূলক বক্তৃতা সত্ত্বেও আমরা এখনও বলতে চাই এই ব্যপারে ভারতবর্ষের কোথাও যেন কোনো দ্বিমত না থাকে। আমরা চাই দেশ রক্ষার ব্যপারে সমস্ত জাতিকে একতাবদ্ধ করতে। আমাদের এই পার্টি প্রস্তাব পাশ হবার পর আপনি জানেন, দিকে দিকে এই প্রস্তাব সমর্থিত হয়েছে, দিকে দিকে এই প্রস্তাব কার্যকরী করবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে এও আপনি জানেন ...আপনি জানেন, 'সংগ্রাম যতই কষ্টসাধ্য দীর্ঘ হোক না-কেন চীন আক্রমণকারীদের পবিত্র ভারতভূমি হতে বিতাড়ন করার দৃঢ় সঙ্কল্প' একথা ঘোষণা দ্বারা সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করে পার্লামেন্ট নেতৃত্ব দিয়েছেন।...দ্বিতীয় কথা, ...আমি এটা পরিষ্কার বলতে চাই আমাদের কথা, ভারতবর্ষের কমিউনিস্টদের কথা যে চীন থেকে বা চীনের কমিউনিস্ট পার্টি যে কথা প্রচার করছেন কদিন ধরে, তাতে তাঁরা বলছেন যে পণ্ডিত নেহেরু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীর দিকে চলে গিয়েছেন, শুধু চলে যাননি তাঁদের তাঁবেদারি করছেন। শুধু তাই নয় তাঁরা বলছেন ভারতের জোট নিরপেক্ষতা নীতি অতীতের ঘটনায় পর্যবসিত হয়েছে। ভারতবর্ষের কমিউনিস্টরা একথা আগেও মানেননি, এখনও মানছেন না। অস্ত্র নেওয়া সত্ত্বেও একথা জোর করে পণ্ডিত নেহেরু ঘোষণা করেছেন যে, জোট নিরপেক্ষ নীতি বজায় আছে। আমরাও একথা মনে করি। ...চীনের এই প্রচার অত্যন্ত ক্ষতিকারক বলে আমরা মনে করি। ...যখন কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রস্তাবের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তাঁরা ভারতবর্ষের জনগণকে চীনা আক্রমণ রুখবার জন্য যখন ঐক্যবদ্ধ করবার আবেদন জানিয়েছেন, তখন পশ্চিমবাংলায় দেখছি সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা। এখানে অনৈক্য সৃষ্টি করা হচ্ছে, জনসাধারণকে বিভক্ত করা হচ্ছে, এখানে কমিউনিস্ট পার্টির অফিস আক্রান্ত হচ্ছে।
কংগ্রেস বিধায়ক নেপাল চন্দ্র রায়ঃ খুব ভালো করেছে, আরও হবে।
-এখানে কোথাও কোথাও অফিসের কাগজপত্র বের করে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং বিভিন্ন কমিউনিস্টদের বাড়িতে গিয়ে ধমকানো হচ্ছে, অপমান ও আক্রমণ করবার চেষ্টা হচ্ছে। ...প্রতাপবাবু এখানে যে বক্তৃতা দিয়েছেন এটাতো কল টু মার্ডার কমিউনিস্ট। এর মানে হচ্ছে
– তোমরা আজ কমিউনিস্টদের খুন কর, তাদের বারিঘর আক্রমণ করো, তাদের অফিস জ্বালিয়ে দাও, তা হলে তোমরা দেশপ্রেমিক।
-পন্ডিত নেহেরু বলেছেন চীনারা ভেবেছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তাদের সমর্থন করবেন কিন্তু সে সমর্থনও তাঁরা পায়নি। ...প্রকাশ্যে সভায় সভায় এই কথা বলা হচ্ছে দাঁড়িয়ে যে, কমিউনিস্টদের টেনে টেনে বাড়ি থেকে বের করো, তাদের জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারো, চাবুক মারো, খুন করো। এইসব কথা বলা হচ্ছে যেন আইনের মধ্যে পড়ে।
নেপাল চন্দ্র রায়ঃ ওদের খাঁচায় পুরে থুথু দিয়ে মারা দরকার।
অধ্যক্ষর নেপাল চন্দ্র রায়কে সতর্কীকরণ।
-স্পিকার মহাশয়, আমি বলি নেপালবাবুদের চেঁচিয়ে লাভ কি ? ...দু-একটা কমিউনিস্টকে খুন করলে যদি দেশ রক্ষা হয় চীন আক্রমণ ঠেকানো যায় আমার দুঃখ নেই, - আমি এখানেই পেতে দিচ্ছি আমার বুক রিভলভারের সামনে। ...আমাদের বাড়ির চারদিকে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের লোকেরা ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে।...দেশের যখন বিপদ এবং আমাদের জওয়ানরা যখন আত্মত্যাগ করছে তখন এইভাবে হানাহানি খুনোখুনি সৃষ্টি করবেন না, আপনারা আপনাদের দায়িত্ব ঠিক করুন। আমি আপনাদের প্ররোচনার কোন জবাব দিতে চাই না। কোন কটূক্তি করতে চাই না। দেশপ্রেমের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা কাজ করতে চাই। দেশ রক্ষা আমাদের কর্তব্য এবং সমস্ত কমিউনিস্ট সেই কাজ করবে। আপনারা খুন করে যান, বে-আইনি কাজ করে যান, যে পথে চলতে চান চলুন, আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করে যাব।
এর পাঁচ দিন পরে জ্যোতি বসু সহ বেশ কয়েকজন নেতাকে প্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পরদিন আনন্দবাজারের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল 'সারা দেশে দেশদ্রোহীদের ধরপাকড়।
ভোররাতে ঘুমন্ত অবস্থায় গ্ৰেফতার হলেন জ্যোতি বসু। টানা ১ বছর হাজতবাসের পর পেলেন ছাড়া।
দক্ষিণ কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির অফিস পুড়ল। পাড়ায় পাড়ায় চৌ এন লাইয়ের পাশাপাশি বাংলার কমিউনিস্ট নেতাদের কুশপুতুল পোড়ানো হল। বিপুল চাহিদা দেখে কালীঘাটে একটা কুশপুতুল বিক্রির দোকান তৈরি হয়েছিল। সামান্য দামে সহজপাচ্য দেশপ্রেম।
এর ঠিক চার বছর পর ১৯৬৬ সাল। খাদ্য আন্দোলন। পরের বছর ১৯৬৭। যুক্তফ্রন্ট সরকার, নকশালবাড়ি।
আর তার ঠিক দশবছর পর ব্যাপক জনমতের সঙ্গে রাজ্যে বামেদের সরকার গঠন। মূখ্যমন্ত্রী সেই জ্যোতি বসু।। নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রে একাই পেলেন প্রায় ৮০ শতাংশ ভোট ।।
তাই সত্য কখনো চাপা থাকা না।