আমাদের একদম নিজস্ব দুটো কলকাতা শহর আছে। আমরা মানে তারা, যারা নয়ের দশকে বড় হয়েছি, স্কুলে বা কলেজে গেছি। আজকালকার নেটদুনিয়ার পরিভাষায় যাদের 'মিলেনিয়াল' বলে।
উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ, বিশ্বায়ন, গ্যাট চুক্তি, নরসিমহা রাওদের আঁকা সীমানার দুপারে দুটো আলাদা শহর - এই দুই কলকাতাকে চেটেপুটে খেতে খেতে প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি আমি, পাড়ার একটা বাড়িতে টেলিফোনের শৈশবের শহর থেকে এসটিডি বুথের ব্যবসাটাই সম্পূর্ন উঠে যাওয়ার মধ্যবয়সের শহরের মধ্যেই বিশ্বায়িত হয়েছি।
এসবের মধ্যেই খবর আসে, জলি কৌল মারা গেলেন। কমরেড জলিমোহন কৌল - অবিভক্ত কমিউনিষ্ট পার্টির কলকাতা জেলার শেষ সম্পাদক। উনি মারা না গেলে হয়তো জানতেও পারতাম না উনি বেচে ছিলেন।
দুই কলকাতার বিশ্বায়িত নাগরিক আমরা যে কজন, আমরা নিয়ম মেনে পৃথিবীর আর দশটা শহরের মতনই বিশ্বায়নের টেমপ্লেট আপন করেছি। আমাদের দ্বিতীয় কলকাতায় আছে ধুসর কম্পোজিট ফাইবার আর কাচের উঁচু উঁচু অফিস বিল্ডিং। আছে আর্টিফিশিয়াল ল্যান্ডস্কেপিং, জিম আর কমিউনিটি সেন্টারওয়ালা এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স। আছে একটা স্টারবাক্স, গোটা কয়েক ম্যাকডোনাল্ডস, কয়েকটা কেএফসি। আছে মল, যেগুলোতে বারবেরির আউটলেট খোলবার তারিখের অধীর আগ্রহে আমরা অপেক্ষা করি। এইভাবে আমরা মনে মনে বিশ্বায়নের সূচকে নিজেদের ওঠাই নামাই - ব্যাংগালোরে এদের দুটো আউটলেট আছে, আমাদের নেই, সূচকে নেমে গেলাম। দিল্লিতে খোলবার আগে আমাদের এখানে ওরা আউটলেট খুললো, সূচকে একটু উঠে গেলাম। একদম একইরকম টেমপ্লেট মেনে অফিস বিল্ডিং, এপার্টমেন্ট, স্টারবাকস, ম্যাকডি, বার্গার কিং কে আপন করেছে সমস্ত বিশ্বায়িত শহর - সবার আছে একটা স্বতন্ত্র চরিত্রের মুমূর্ষু ওল্ডটাউন, আর আছে নিউটাউন, যেখানে হংকং, সিংগাপুর, ব্যাংগালোর, মুম্বাই, কলকাতা সবাইকে একটু একটু করে একইরকম হয়ে যেতে হবে - একটি গ্লোবাল ভিলেজ, যার অভিন্নতাই আমাদের পরিচয়।
এই ২০২০ র হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি - অবাঙালির বিশ্বায়িত কলকাতায় বসে আমার ভাবতে ভালো লাগে, আমার প্রথম কলকাতায় একদা কমিউনিষ্ট পার্টির নেতা ছিলেন একজন কাশ্মীরি পন্ডিত - জলিমোহন কৌল। আমার ভাবতে ভালো লাগে, ১৯৪৬ এর ডাইরেক্ট একশন ডে'র দাঙ্গা মোকাবিলা, বন্দরের শ্রমিক আন্দোলন, শহরের উপকন্ঠে উদ্বাস্তু আন্দোলনে লাল ঝাণ্ডা হাতে জলি কৌলের সাথে একসাথে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তার বাঙালি স্ত্রী মনিকুন্তলা সেন, তার কমরেড উত্তরপ্রদেশের উর্দুভাষী শ্রমিক মহম্মদ ইসমাইল।
বিশ্বায়িত এই দ্বিতীয় কলকাতায় বসে আমার ভাবতে ভালো লাগে, কমরেড জলিমোহন কৌলদের কলকাতা নিয়ে - ছাত্র, শ্রমিক, উদ্বাস্তুদের কলকাতা - টিরেট্টিবাজার, ছাতাওয়ালা গলি, বো ব্যারাকস, আর্মেনিয়ান চার্চ, পার্ক স্ট্রীট, পার্ক সার্কাস, খিদিরপুর, নিউমার্কেট, বালিগঞ্জ - পেয়াঁজের খোসার মতন অগুনতি স্তরগুলো নিয়ে, একেকটা গলি, একেকটা চৌমাথা পেরোলেই পালটে যাচ্ছে ভাষা, পালটে যাচ্ছে মানুষগুলো, পালটাচ্ছে চামড়ার রঙ, পোশাকের ধরন, পালটে যাচ্ছে স্থাপত্য, যেন একটা শহর নয়, সম্পূর্ণ আলাদা চরিত্রের কিছু জনবসতি বাড়তে বাড়তে একে অপরের সাথে ধাক্কা খেতে খেতে চাপাচাপি করে জায়গা তৈরি করে নিয়েছে।
প্রাক বিশ্বায়ন যুগের সেই প্রকৃত বিশ্বজনীন প্রথম কলকাতার ধীরমৃত্যুর সাক্ষ্য বহন করে আমার গ্লোবালাইজড, ইউনিফর্ম দ্বিতীয় কলকাতা। সেই তালিকায় যুক্ত হলেন কমরেড জলিমোহন কৌল।