রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

অতিভক্তি ~ অনীক চক্রবর্তী

তারপর সেই ভয়ানক দিন আসিয়া পড়িল। চন্দ্রবিন্দু কে তলব করা হইল 'আমার ভিনদেশী তারা' গানটি গাওয়ার অপরাধে। স্পষ্টতই ভিনদেশী বলিয়া কোনও শব্দ যে নাই এবং থাকিলেও তাকে আমার বলিয়া সম্বোধনের অপরাধ যে ক্ষমার অযোগ্য, তাহা বুঝাইয়া দিয়া হইল। চন্দ্রিল তাহার শেষ দু ছক্কা পাঁচ এ লিখিলেন, 'আমরা সক্কলে আ-মোদিত। সরকার চন্দ্রবিন্দু প্রাপ্ত হইয়াছে।' এতে চটিয়া গিয়া এক পাব্লিক চন্দ্রিলকে উদ্দেশ্য করিয়া একটি কড়া চিঠি লিখিল আনন্দবাজারে। তার শুরুটা হইল, 'আপনার মত আঁতেল যে ভিনদেশকে আমার বলিবেন এতে আর আশ্চর্য কী? আপনি এদেশের কলঙ্ক, কোনোদিনই বুঝা যায় নাই আপনি কোনদিকে, তাই আপনি দেশদ্রোহী হইতে বাধ্য। অতএব আপনার মা ও বোনকে...' ইত্যাদি ইত্যাদি

একইভাবে 'পরদেশী পরদেশী যানা নেহি' গানটির লিরিসিস্ট ও সুরকারের তলব পড়িল। তারা সমস্বরে বলিল, 'আমরা কিছু জানি না, আমির জানে'। ব্যাপার স্পষ্ট হইল। আমিরকে আগেও একবার চেতাবনি দিয়া হইয়াছিল, লাস্ট ওয়ার্নিং আর কি। ফলে এবার ঝটিতি 'শালা দেশ ছাড়, পাকিস্তান যা' বলিয়া দেশের লোক ট্যুইটারে লাফাইয়া পড়িল। আমির মুচকি হাসিয়া দেশ ছাড়িলেন- তবে পাকিস্তান নয়, আমেরিকা চলিয়া গেলেন। দু বছর পরে সেখেনে তারান্তিনোর পরবর্তী ছবিতে লিড রোল করিয়া অস্কার তুলিলেন। দেশের লোক ঝটিতি 'আমির আমাদের গর্ব' বলিয়া আবেগমথিত হইয়া কাঁদিয়া কাটিয়া ট্যুইটার ভাসাইয়া দিল। আমির মুচকি হাসিয়া শুধু বলিলেন, 'শালা'

তারপর তো আরেক কান্ড। সমস্ত 'কড়াপাক' মিষ্টি নিষিদ্ধ হইল। লোকে বলিল তাই তো, যে মিষ্টির নামেই 'কড়াপাক' সে ভারতীয় হয় কি করিয়া। বাঙালিরা গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলিতে লাগিল, তবে মুখে বলিল 'হ্যাঁ, বটেই তো। কেমন ডায়াবিটিস বাধাইয়াছিলাম বাবা, খাইতেই চাইতাম না, তবু টানিত। এ মিষ্টি শত্তুর না হইয়া যায় না'। বাবা রামদেব সক্কলকে আশ্বস্ত করিয়া পতঞ্জলির 'কড়াদেশি মিষ্টি' আনিলেন মার্কেটে, খাইলে সুগার হয় না। একমাসে হু হু সেল-- বাবা আরেকটি আইল্যান্ড কিনিয়া তাতে প্রাচীন ভারতীয় 'কপালভাতি নাচ' করিতে লাগিলেন।
ক্রমে লোকে আয়ুর্বেদিক পদ্ধতিতে চুলকুনি, বাচ্চা উৎপাদন, আয়ুর্বেদিক বিড়ি পান হইতে ট্যাক্স প্রদান- সবই করিতে লাগিল। ট্যাক্সের টাকা গুলি পাব্লিকের দিকে ফিরিয়া মুচকি হাসিয়া বলিল, 'শালা'।

সারাদেশ জুড়িয়া ক্রমে প্রবল আলোড়ন উঠিল। পাব্লিক বাচ্চা পকেটমারকে ধরিয়া আর পিটাইলো না। ল্যাম্পপোস্টে শক্ত করিয়া বাঁধিয়া বন্দেমাতরম ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করিয়া দিল। মেট্রোতে জিন্স পরা মেয়ে দেখিয়া জ্যেঠুদের লাল পড়িল না, গেরুয়া পড়িতে লাগিল। প্রসঙ্গত, লাল যে চৈনিক জিনিস এ কথা এখন সবাই জানেন। মোবাইল- টিভি- হেডফোন- সাউন্ড সিস্টেম- জাঙিয়া ঘড়ি জুতো বডি স্প্রে সাবান-- জাস্ট এইকটি ছাড়া দেশের মানুষ আর কোনও চৈনিক প্রোডাক্ট ব্যবহার করেন না। টোটাল অসহযোগ। অরিজিতের 'লাল ইশক' গানটিও ব্যান হইল। কমিউনিজম যে একটি ভয়ানক রোগ- অর্ণবের অনুষ্ঠানে আসিয়া সাধ্বী প্রাচী তা বলিয়া গেলেন। এর বিরুদ্ধে 'দেশভ্যাক- টি' নামের যে ভ্যাকসিনটি আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহাও জানাইতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু অর্ণব 'নেশন ওয়ান্টস টু নো, নেশন ওয়ান্টস টু নো' বলিয়া চিৎকার করিয়া উঠিলে উহা আর শুনা গেল না। অর্ণবের বিভূষণ এক বছর পিছাইয়া গেল-- কারা যেন ইহাকে 'ঐতিহাসিক চিৎকার' বলিয়া চিহ্নিত করিল।

অতঃপর 'মা মা' ডাকে স্বর্গ-মর্ত্য-পার্লামেন্ট ভরিয়া উঠিল। ছেলে 'মা, মাগোও' বলিয়া ছলোছলো চক্ষে মাকে বৃদ্ধাশ্রমের গেটে ড্রপ করিয়া গেল। কড়া এক্সটারনাল আসিয়া ভাইভা টেবিলে যখন টুঁটি চাপিয়া ধরিয়াছে তখন ছাত্র চোখ টিপিয়া শুধু বলিল 'মায়ের দিব্যি, আমি সব পড়িয়াছি', সে হায়েস্ট নম্বর পাইয়া সবাইকে চমকাইয়া দিল। দুষ্টু ছেলে পুলিশকে 'মা, মা' বলিলে তারা ভারী খুশি হইয়া তাকে তিনশ বিরানব্বইয়ের চারের এ ধারা অনুসারে একটি গোলাপ ফুল গিফট করিল। পান্নালাল ভট্টাচার্যকে জাতীয় গায়ক এবং চিরঞ্জিত কে জাতীয় নায়কের সম্মান দেওয়া হইল। তৃণমূলের কে একজন নেতা বলিল, আমাদের ক্যাচলাইনে তিনখানা মা-- মা তেও মা, মাটিতেও মা, মানুষেও মা-- আমরা দেশের সবচেয়ে জাতীয়তাবাদী দল। উপরমহল থেকে 'অ্যাই চোওপ, একদম চোপ, আমরা সেকুলার' বলিয়া তাকে খুব কড়কাইয়া দেওয়া হইল আর ব্যাটা ইলেকশানে টিকিট মিস করিল। বেচারা ঘরে আসিয়া ডিকশনারিতে বহু খুঁজিল, কিন্তু সেকুলার শব্দটি খুঁজিয়া পাইল না।

এবং তলে তলে গুটিকত লোক দেশকে পঞ্চাশ- ষাট গ্রামের ছোট ছোট পিস করিয়া দাঁড়িপাল্লায় চাপাইয়া একশ চল্লিশ টাকা কেজিতে বেস্পতিবারের হাটে বিক্রি করিতে লাগিল। সে হাটে পাবলিক যেতে পারে না, খোঁজও নাই কারোর কাছে। সে হাটের খবর, বেচাকেনার খবর যারা রাখিত লোকে তাদের আঁতেল, সিপিয়েম, দেশদ্রোহী ইত্যাদি বলিয়া কিছু জনকে খুন করিয়াছে, কিছুজন কে ভাগাইয়া দিয়াছে দেশ থেকে। আর যারা বাঁচিয়া আছে তারা এমনিতেই চুপ করিয়া গিয়াছে। এমনি করিয়া বেশ কয় বচ্ছর কাটিল। তখন কারো কারো সন্দেহ হইল। আরে চাকরি নাই, খাবার নাই, টাকাকড়ি শান্তিফান্তি নাই শুধু মা ডাকিয়া আর জওয়ানের ছবি শেয়ার করিয়া দিন চলে কেমনে! কেস কী? খোঁজ, খোঁজ। অবশেষে খুঁজিয়া দেখে শুধু বাউন্ডারিখানা পড়িয়া আছে, দেশখানা আর নাই।
শুনা যায়, তখন অনেকে চিৎকার করিতে চাহিয়াছিল। কিন্তু ম্যাট্রিক্সের শুরুতে মিস্টার অ্যান্ডারসন তার হকের দাবী জানাইবার পর নিজের মুখটিকে যেভাবে খুঁজিয়া পাইয়াছিলেন, তাহারাও নিজের মুখ সেইরকম চামড়া ও মাংস দিয়া আটকানো দেখিতে পাইয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, তখন আর কোথাও মরফিয়াস তার লাল এবং নীল পিল দুটি লইয়া অপেক্ষারত ছিলেন না।

বোবা শান্তিতে সেদিন চরাচর ভরিয়া গিয়াছিল...


শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

গল্পের গল্প ~ আর্কাদি গাইদার

ওদের দলটা সেদিন রাতের মতন বিশাল স্তেপভূমির এক কোনে আস্তানা গেড়েছিলো। এখন যেখানে কাজাকস্তানের বেরেল শহর, সেই সময় সেখানে ছিলো এক বিশাল হৃদ আর ধুধু ঘাসজমির প্রান্তর। বেশ কয়েকদিন ধরে এই অঞ্চলটাতেই ঘুরছিলো ওদের গোটা দলটা। এখানে শিকার করবার সুযোগ প্রচুর, হৃদে মাছ ধরা যায়, আর তার সাথে সাথে এদিক ওদিকে মাটির ওপর একধরনের খাটো গাছে একধরনের ফল হয়, যা দিয়ে খিদে মেটে। 

ওদের দলের একটাই সমস্যা, এই জায়গাটায় একটা বিশাল খড়্গ-দন্ত বাঘের উৎপাত। ইতিমধ্যেই দুজন তার পেটে গেছে। দিনের আলোতে ওরা খাবার আর শিকারের সন্ধানে দলবদ্ধ হয়ে থাকে, ওদের নিজেদের তৈরি অস্ত্রও সাথে থাকে, কিন্তু অন্ধকার নামতেই ওদের ভয় শুরু হয়। অন্ধকার ওদের শত্রু, আর বাঘের বন্ধু। কখন যে একদম ঘাড়ের ওপর থাবা এসে আছড়ে পড়বে, বোঝা যাবে না, হয়তো অন্তিম মুহুর্তে এক ফালি চাঁদের আলোয় শুধু ঝলসে উঠবে সাদা দুটো দাঁত। আর তাই, সূর্য ডুবলেই একটুকরো আগুনের পাশে জড়সড়ো হয়ে বসে ওরা ঝিমোতে থাকে, আগুনের শিখা যেটুকু জায়গায় আলো দিচ্ছে, সেই সীমানার বাইরেই বিশাল অন্ধকার যেন ওত পেতে থাকে ওদের গ্রাস করতে। আগুনের নাচানাচির সাথে সাথে আগুপিছু করতে থাকে অন্ধকার নামের ভয়ানক দানবটা, যেন ওদের সাথে খেলা করে, আর মাঝেমধ্যেই সেই জমাট কালোর মধ্যে থেকে ভেসে ভেসে আসে বাঘের ডাক। ওদের মধ্যে সবচেয়ে বুড়ো যে, তার চারপাশে তখন জোনাকির মতন ঘুরঘুর করে অনেক গল্প, সে তখন গল্প বলতে চায়, বলতে চায় কিভাবে বহুদিন আগে, যখন ওদের দলটা আরো উত্তর দিকে বরফঢাকা উপত্যকার মধ্যে বিচরণ করতো, সেইসময় ওদের দলের সবচেয়ে শক্তিশালী দুজন মিলে অনেকগুলো গাছের গুড়ির মাথা ঘষে ঘষে ছুচলোঁ বল্লম বানিয়েছিলো, আর তাই দিয়ে একসাথে একটি খড়্গ-দন্ত বাঘকে মেরেছিলো। বুড়োটা ভাবে, এই গল্পটা বলতে পারলেই অন্ধকার ওদের দিকে এগিয়ে আসতে ভয় পাবে। বুড়োটা চায়, সারারাত এরকম অনেক অনেক গল্প বলতে, যাতে কালো ভয়টা দুরেই থাকে। কিন্তু পারে না। কারন ওদের তো ভাষা নেই। শব্দ নেই। ওদের কারুর নামও নেই। বুড়োটা চেষ্টা করে অঙ্গভঙ্গি করে গল্প বলতে, কিন্তু সবাই বোঝে না। এরকম ভাবেই রোজ চেষ্টা করতে করতে কয়েকদিন পর বুড়ো এক নতুন কায়দা আবিষ্কার করে। আগুনের পাশে যেখানে মাটির ওপর আলো পড়েছে, সেখানে আঙুল দিয়ে সে প্রথমে একটা বাঘ আঁকে। সময় নিয়ে তার দাঁতগুলো বড় বড় করে আঁকে। তারপর আঁকে শক্তিশালী দুই মানুষকে। বাকিরা অবাক হয়ে বুড়োকে ঘিরে বসে আঁকা দেখে। মানুষগুলোর হাতে বল্লম আঁকে বুড়ো। শিখার আলো ছবিটার ওপর লাফাতে লাফাতে তাকে জীবন্ত করে তোলে। ওদের সবার চোখ চকচক করে, আর ওদের চারপাশের ভয়মিশ্রিত অন্ধকারটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটু পিছিয়ে যায়।

এরকমভাবে সারারাত ধরে একের পর এক গল্প আঁকে বুড়ো। কখনও কখনও বাকিরা ঝিমিয়ে পড়ে। কিন্তু বুড়ো এঁকেই চলে। একটা করে গল্প আঁকে, আবার মুছে ফেলে, আবার আঁকে। সারারাত ধরে গল্প আর অন্ধকারের মধ্যে চলে অবিরাম লড়াই। আর ওদের দলটা এরপর যেখানেই যায়, তাদের সাথে বস্তাবন্দি হয়ে সঙ্গী হিসেবে গল্পেরাও থাকে। তারপর কোন একদিন নদী পার হওয়ার সময় চোরাস্রোতে ভেসে যায় নামহীন বুড়োটা।

এরও বহুদিন পরে, যখন ওদের বংশধররা কয়েকটা শব্দ শিখেছে, হয়তো আদিম কিছু আওয়াজকে জীব দিয়ে খেলাতে শিখেছে, যখন ওদের দল সংখ্যায় বেড়েছে, তখনো অন্ধকার হলে ওরা আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে, আর আবার শুরু হয় গল্প বনাম কালোর লড়াই। ভাঙা ভাঙা শব্দ দিয়ে, হাত পা ছুড়ে, কখনো মাটিতে কিছু অবয়ব এঁকে, কখনো শিকার করা জন্তুর চামড়ার ওপর খোদাই করে, ওরা পালা করে গল্প বলতে থাকে, আর কুস্তি চলতে থাকে অন্ধকারের সাথে। আর তার মধ্যে অতি অবশ্যই থাকে বুড়োর সেই বাঘের গল্প, যা সময়ের সাথে সাথে ফুলেফেঁপে আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে, আর সেই গল্পটা বললেই অন্ধকার নামের রাক্ষসটা ভয়ে গুটিসুটি মেরে পিছিয়ে যেতে থাকে, আর সেই নিরেট কালোর পেট চিরে নিষ্ফল ক্রোধে গর্জন করতে থাকে ক্ষুদার্ত খড়্গ-দন্ত বাঘ।

হাজার হাজার বছর পরেও, বহু পথ পেরিয়ে এসে যখন ওদেরই কোন বংশধর মাটির ঘরে বাসা বাঁধে নদীর পারে, জঙ্গলের একদম সীমানায়, তখনো রাত হলে বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে সে, আর হাতমুঠো করে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে পাশে রাখা বল্লমকে, আর গাছের পাতা দিয়ে তৈরি পলকা দরজার দিকে মুখ করে বসে। ঘরের এক কোনে জ্বলতে থাকে পুঁচকে একটা আগুন। বাইরে শিকারের আশায় ঠোঁট চাটতে চাটতে পায়চারি শুরু করে ডোরাকাটা বাঘ। আর  বাচ্চাটাকে বুকের কাছে এনে কানে কানে সে বলতে থাকে বুড়োর সেই বাঘের গল্প। গল্প আর অন্ধকারের অন্তহীন লড়াই আবার হয় শুরু।

লীলা মজুমদার বলেছিলেন, গল্প মোটে চার রকমের হয়।
ভূতের গল্প। 
চোরের গল্প।
প্রেমের গল্প। 
বাঘের গল্প। 
আর এই চাররকমের গল্প বলতে আমাদের রয়েছে ছয় হাজারেরও বেশি ভাষা। ভাষা দিবসের কসম, আমরা যেন গল্প বলা না থামাই। আমরা যেন অন্ধকারকে জিততে না দিই।

মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

যত গপ্পো জুতো নিয়ে ~ যূথিকা আচার্য্য

আমাদের শরীরের যত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে তাদের পায়ের পাতাদুটো হলো সবচাইতে বেশী লো মেইনটেনান্স। পা চাটা,পায়ের জুতো,পায়ের তলা এই শব্দগুলির প্রত্যেকটাই নেগেটিভিটি বহন করে। অথচ বলুন দেখি, এতে পা দুটোর কী দোষ? পুরো শরীরটাকে বয়ে নিয়ে বেড়ায় তারা সর্বক্ষণ। কোনো দাবী-দাওয়া নেই। আদর যত্নের বালাই নেই। মাথা ব্যথা হলে হাজারখানা দাবাই আছে,কিন্তু পা ব্যথা হলে আমরা বলি "ও কিছু না,সেরে যাবে!"

    আমাদের পায়ের পাতা দুটো হল সমাজের ওই অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষগুলোর মতো। যারা বড় কিছু দাবী করে না, শুধু একটু পেট ভরে খাওয়া। দুটো রুটি, বা একটুকরো পেঁয়াজ সহযোগে একথালা পান্তা খেতে পেলেই তারা ঐরাবতের মতো মহাতেজা হয়ে ওঠে । রোগভোগের বালাই নেই। অথচ আমাদের মতো লোকগুলোর অবস্থা দেখুন। দিনরাত গন্ডেপিন্ডে ভালোমন্দ গিলছি কিন্তু আজ অম্বল, কাল আমাশা, পরশু আর্থারাইটিস আমাদের লেগেই রয়েছে। 

     চরণকমলদুখানা বাদ দিলে দেখবেন শরীরের বাকী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গদের হাজারটা বায়নাক্কা। মুখের কথা তো ছেড়েই দিন। রকমারী রূপটানের দায় মিটোতে জেরবার হয়না এমন মানুষ নেই। 

কী বললেন, পুরুষদের সেসব বালাই নেই !

ও মশাই থামুন দিকি। বলি আছেন কোথায়? 

  আফটার শেভ, শেভিং ক্রীম, কোলন, মেনস্ ফেস ওয়াস এগুলো কী? এমনি এমনি এই কোম্পানীগুলো মিলিয়ন ডলারের বিজনেস করছে নাকি! 

তারপর গলা বা হাতের কথাই ধরুন। মালা-চুড়ি-নেকলেস-ব্রেসলেট-কড়া-আংটি ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। গয়নাগাটির লম্বা লিস্টি শুরু হলে শেষ কবে হবে তা বলা মুশকিল। সেই তুলনায় নিজের পদযুগলের কথা একবার ভাবুন তো। নারী হলে নূপুর বা তোড়ার অলঙ্করণ জুটলেও জুটতে পারে,পুরুষ হলে বাপু জুতোটুকুই সার। মোটের উপর দেখবেন,পাদুটো বেশী বায়না করে না,দুপাটি আরামদায়ক পাঢাকনি অর্থাৎ জুতো পেলেই তারা দিব্যি খুশি!

   তাই এহেন নির্বাক সেবকদের প্রতি অবহেলা আসে খুব সহজে। পা দুখানা যত্নের দাবী করে না, অতএব তার যত্ন করে কী লাভ। এমতাবস্থায় যিনি পাদুটোকে যত্নআত্তি করে,ভালোবেসে রাখেন তিনি প্রকৃত অর্থেই তার নিজের শরীরের মর্যাদা দিতে জানেন,তার আভিজাত্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করাটা বোকামো।

     জুতো নিয়ে গপ্পো হলেই সিরাজদৌল্লার কাহিনী মনে পড়ে। বাংলার শেষ নবাব সিরাজ যখন ছদ্মবেশ ধারণ করে, স্ত্রী লুৎফা ও কন্যা কে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তিনি জুতোটি পরিবর্তন করতে ভুলে গিয়েছিলেন আর সেই জুতো দেখেই এক পীর তাকে চিনে ফেলছিল এবং ধরিয়ে দিয়েছিল। অবশ্য গোরার দল বিশ্বাসঘাতকতা মাফ করেনি। সিরাজের মৃত্যুর পর সেই পীরকেও প্রাণদন্ডে পুরস্কৃত করা হয়েছিলো। যেমন কর্ম তেমন ফল!
    
     মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত জুতো জোড়াও ইতিহাস রচনা করেছিল। ব্যাপারটা মোটামুটি হয়েছিল এমন যে,শোভাবাজারের রাজবাড়িতে জলসা হবে, বিরাট আয়োজন। শহরের অর্ধেক লোক জমা হবে সেখানে; যত বড়ো বড়ো লোক, রাজরাজড়া সকলের নেমন্তন্ন হয়েছে। তখন ঠাকুরবাড়ির বিষয়সম্পত্তির অবস্থা বড়ো খারাপ। পিতা দ্বারকানাথের দেনা মেটানোর পর পুত্র দেবেন্দ্রনাথের হাত একবারেই শূন্য।  বড়ো বড়ো লোকেরা মজা দেখার অপেক্ষায় রইলেন। সবার মনে একই প্রশ্ন,ঠাকুরবাড়ির দিন গেছে, প্রিন্স দ্বারকানাথের ছেলে কী ভাবে নিজের মানরক্ষা করবেন? এবারে দেবেন্দ্রনাথ কী সাজে আসবেন নেমন্তন্ন রক্ষা করতে যাতে সাপও মরে এবং লাঠিও না ভাঙে! 

   এসব কথা বোধহয়  দেবেন্দ্রনাথের কানেও এসেছিল। তিনি বাড়ির দেওয়ানকে দিয়ে করমচাঁদ জহুরীকে বৈঠকখানায় ডাকিয়ে আনালেন। করমচাঁদ জহুরী সেকালের খুব পুরোনো জহুরী। ঠাকুরবাড়ির "বাবামশায়"-এর পছন্দ তার বেশ জানা ছিল। 
  দেবেন্দ্রনাথ তাকে বললেন, একজোড়া মখমলের জুতোয় আগাগোড়া মুক্তো দিয়ে কাজ করে আনতে। সেই আদেশমতো করমচাঁদ জহুরী দানা দানা মুক্তো সেলাই করে সাজানো সুন্দর একজোড়া মখমলের জুতো তৈরি করে এনে দিলেন। 

  জুতোর ঝামেলা তো মিটলো। এবার চিন্তা, কেমন জামা,কেমনই বা সাজপোশাক হবে ? রাজবাড়িতে নেমন্তন্ন বলে কথা, যেমন তেমন পোশাকে কী যাওয়া যায় ? সবাই ভাবছে তোষাখানা থেকে কাশ্মিরী পশমিনা শাল বের করবে, না রেশমের জোব্বা। দেবেন্দ্রনাথ হুকুম দিলেন,

"ও সব কিছুই নয়! আমি সাদা কাপড়ে যাব।" 

জলসার দিন তিনি পরলেন ধবধবে সাদা আচকানজোড়া। মাথার মোড়াসা পাগড়িটি অবধি সাদা, কোথাও জরি,কিংখাব বা জরোয়ার নামগন্ধ নেই। আগাগোড়া সাদা। পায়ে কেবল সেই মুক্তো বসানো মখমলের জুতোজোড়াটি।

    ভাবুন একবার অবস্থাখানা! রাজবাড়ির সভাস্থলে সবাই বসে রয়েছেন কিংখাব-জড়ি-মখমলের পোশাক পরে,হীরেমোতি-চুনিপান্না গলায় ঝুলিয়ে। এমন সময়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সেখানে প্রবেশ। সভাস্থলে সবাই নিস্তব্ধ। একখানা সূঁচ পড়লেও বুঝি আওয়াজ শোনা যাবে। দেবেন্দ্রনাথ কৌচে বসলেন পা-দুখানি একটু বের করে। সবাই চুপচাপ। শোভাবাজারের রাজামশাই ছিলেন তার বন্ধু। তিনি তখন ওনার পায়ের দিকে ইশারা করে হইহই করে উঠলেন,

 "ওরে দেখ, দেখ, তোরা দেখ, একবার চেয়ে দেখ এ দিকে, একেই বলে আভিজাত্য। আমরা ঝুলিয়েছি গলায়, মাথায়, আর ইনি তা পায়ে রেখেছেন।"

এই দুখানা গল্প বললাম বাঙলার ইতিহাসের পাতা থেকে। এবার একখানা বিদেশী গপ্পো শোনাই। এই গল্পটা আমার বন্ধু পিট টেয়লরের মুখে শোনা। পিটের প্রেমিকা পামেলা জুতোর ব্যাপারে বড় খুঁতখুতে। মানে জামা-টুপি-ব্যাগ এদিক ওদিক হলেও চলবে কিন্তু জুতোর ব্যাপারে এতটুকুও নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। তো সে যাকগে, ওদের নেমন্তন্ন ছিল প্রতিবেশী মিস্টার তাকাশাকির বাড়িতে। তাকাশাকিমশাই জাপানের মানুষ, একটু বয়স্ক এবং আদ্যোপান্ত পুরাতন জাপানী রীতিনীতিতে বিশ্বাসী। সেই হিসেবমতো পিট ও পামেলা দুজনেই হাল্কা, সুতির ঢিলেঢালা পোশাক পরলো, যাতে তাকাশাকি মশাইয়ের বাড়ির পরিবেশে তা বেশ মানানসই হয়। কিন্তু গোল বাঁধলো জুতো নিয়ে। প্যামির ইচ্ছে একটু দামী হাই হিল পরে, ওদিকে পিটের তা নিয়ে আপত্তি, প্যামির জামার সঙ্গে নাকি ফ্ল্যাট চটিজোড়া পরলেই বেশী মানাবে। আসল ব্যাপারটা আমরা জানি, পিট বেচারার হাইটটা একটু কম, সেই কারণে প্রেমিকা হাই হিল পরে তার সঙ্গে ঘুরলে সে ইনসিকিউরিটিতে ভোগে।  ঝগড়া শুরু হয়েছিল বেশ খাদের সুরে"ডার্লিং-হানি" এসব বলে, কিছুক্ষণ পরেই থার্মোমিটারের পারা চড়তে চড়তে বিবাদের সুর সপ্তকে পহুছিল। শেষকালে পিটের এনগেজমেন্ট প্রায় ভেঙে যায় যায় দশা।

    এতকিছু ঝামেলা করে পিট ও পামেলা দুজনে তাকাশাকিমশায়ের বাড়িতে গিয়ে পৌছল পার্টি শুরু হওয়ার ঘন্টাদেড়েক পর। পামেলা নিজে হীলস্ তো পরেছেই তার ওপর পিটারকেও হাই হীলড্ ফর্ম্যাল শ্যুজ পরিয়েছে ( হুঁ হুঁ বাওয়া, দেশী হোক বা বিদেশী,বৌ ইজ বৌ!) কিন্তু তাকাশাকি ভবনের দোরগোড়ায় পৌছতেই জোর কা ঝটকা লাগলো ধীরেসে ! সুসজ্জিতা ম্যাডাম তাকাশাকি ভারী মিষ্টিসুরে জানালেন, 

" দয়া করে জুতো খুলে ভেতরে আসবেন। জুতো জিনিসটা বাইরের, ওটাকে আমরা ঘরের ভেতর স্থান দিই না।" 

এই ঘটনার পর  পিটের প্রেমিকা নাকি তিনদিন তার সঙ্গে কথা কননি। রাগে না অনুরাগে তা অবশ্য জানা হয়নি। 

      সিন্ডেরেলা আর তার কাঁচের জুতোর গল্প সবাই জানে। রাত বারোটার সময় সিন্ডেরেলা প্রিন্স চার্মিংয়ের পার্টি থেকে ছুটে বেরিয়ে যান। যাওয়ার পথে তার পা থেকে একপাটি কাঁচের জুতো খুলে পড়ে যায়। পরে সেই জুতোর সাহায্যে রাজকুমার সিন্ডেরেলাকে খুঁজে পান অ্যান্ড দে লিভড্ হ্যাপিলি এভার আফটার! মোটের উপর এই হচ্ছে গল্পখানা। কিন্তু গল্প পড়ে একটু ভাবলেই বুঝবেন যে জুতো খুলে যাওয়া ব্যাপারটার মধ্যে যথেষ্ট ফাঁক রয়েছে। চমৎকার মাপে মাপে পায়ে বসে যাওয়া জুতো অমনি অমনি পা থেকে খুললো কী করে? বারোটা অবধি হইহুল্লোর নাচগান করা অবধি জুতো দিব্যি ঠিক ছিলো, ঠিক দৌড়ে পালানোর সময়ই তাকে খুলে পড়তে হল ! সিন্ডেরেলা কী তবে ইচ্ছে করেই জুতোখানা ওখানে ফেলে রেখে এসেছিল যাতে তাকে খুঁজে পেতে রাজকুমারের অসুবিধে না হয়! একটু ভাবুন, ভাবলেই বুঝবেন সিন্ডেরেলাকে আমি আপনি  যতটা সোজা সরল ভেবেছিলাম, ততটা ইনোসেন্ট সে মোটেই নয়। সিন্ডেরেলা যথেষ্ট সেয়ানা মেয়ে।

   আমার এক বাংলাদেশী বন্ধুর মুখে শোনা মোহাম্মদ নাসির আলির লেখা জুতো নিয়ে আরেকখানা গল্প দিয়ে শেষ করি।  গল্পের নাম "অলক্ষুণে জুতো।" গল্পখানা এমন, আলি আবু বাগদাদ শহরের অত্যন্ত ধনী অথচ কৃপণ লোক। তার কৃপণতার শ্রেষ্ঠ পরিচয় তার জুতো। তিনি বহু বছর ধরে জুতো বদলাননি। বছরের পর বছর সেলাই করিয়ে, পেরেক লাগিয়ে, তালি লাগিয়ে একই নাগরাই জুতা পরতেন। সময়ে এমন হল যে, আলি আবুকে সবাই তার জুতোর নামে চেনে। 
তা একদিন হল কী, একদিন আলি আবুর বন্ধু তার জুতো নিয়ে মজাক করলেন তার সঙ্গে। আবু এবং তার বন্ধু দুজনেই তখন হামামে। গোসল করছেন। বন্ধুটি সুযোগ বুঝে তার ছেঁড়াখোঁড়া, তালি মারা নাগরা জোড়া লুকিয়ে রাখলেন অন্য জায়গায়। মতলবখানা এই যে, জুতো হারিয়ে আবুর দশা কেমন হয়! 
  
     এদিকে আলি আবু তো এসব কিছুই জানেন না। তিনি গোসলখানা থেকে বেড়িয়ে দেখলেন তার জুতোর জায়গায় অন্য একটি কারুকাজময় সুন্দর,নতুন জুতো রাখা আছে। তিনি ভাবলেন এই জুতোজোড়া নিশ্চয় তার বন্ধু তার জন্যই রেখে গেছে। তিনি বিনি পয়সায় নতুন জুতো পেয়ে আল্লাহ্তালা কে সুক্রিয়া জানিয়ে, নতুন জুতো পরে ফিরে এলেন বাড়িতে।

   কিন্তু আসলে সেই নতুন জুতোটি ছিল কাজিসাহেবের। কাজিসাহেব বের হয়ে দেখলেন তার জুতোজোড়া গায়েব। অনেক খুঁজে দেখা গেল শুধু আবুর জুতোজোড়া পড়ে রয়েছে সেখানে। ব্যস আর কী, কাজিসাহেব ভেবে নিলেন আলি আবুই তার জুতো নিয়ে গেছেন।
এর জন্য জুতো চোর হিসেবে আবু আলির শাস্তি হয়। রাগে দুঃখে আলী আবু জুতো নদীতে ফেলে দেন। সেখানে এক জেলে জুতোটি পায়। সে আবুর জুতোজোড়া ঠিক চিনতে পারে এবং সরলমনে সে ভাবে হয়ত আবুর জুতোটি হারিয়ে গেছে। কারণ সবাই জানত এই জুতোজোড়া আবুর বড়ই প্রিয়। ভেবেচিন্তে পুরস্কারের লোভে জেলে বেচারা জুতোটি নিয়ে আসে আবুর বাড়িতে। আবু তখন বাড়িতে ছিলেন না। অনেক হাঁকডাক করে বিরক্ত হয়ে জেলে আবুর বাড়ির জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দেয় জুতো জোড়া। জুতো ভেতরে গিয়ে পড়ে আতরের বোতলে। এই বোতলগুলোর ভেতরে খাস আতর ছিল আবু বড়ই পেয়ারের। সব নষ্ট হয়।

বাড়িতে ফিরে সবকিছু দেখেশুনে রাগে দিশাহারা হন আলি আবু। তিনি সেই রাতেই জুতোজোড়া কে দফন করার জন্য গর্ত খুঁড়তে শুরু করেন প্রতিবেশীর দেয়ালের ধারে। কিছু লোক তাঁকে সেই অবস্থায় দেখে ভাবে তিনি হয়ত সিঁদ কেটে চুরি করতে যাচ্ছেন। অতএব আবার তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া  হয় কাজির কাছে। কাজিসাহেব শুধোলে আলি বলেন তিনি জুতোজোড়া মাটি চাপা দিচ্ছিলেন। কিন্তু কে আর সেকথা বিশ্বাস করবে! প্রাণের চেয়েও প্রিয় জুতো তিনি দফন করবেন, একথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় বইকি! ফলস্বরূপ পুনরায় শাস্তি পেতে হয় তাকে।
এরপর আবু জুতো ছুঁড়ে ফেলে দেন। ঘটনাক্রমে তা গিয়ে পড়ে এক ছেলের ঘাড়ে। সে অজ্ঞান হয়ে যায়। লোকেরা আবুর নাগরাই জুতা চিনতে পারে। তারা বিচার নিয়ে যায় কাজির কাছে। আলি আবার শাস্তি পান।

    আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় "অলক্ষুণে জুতো"গল্পটির সারাংশ হল অত্যধিক কৃপণতা ভালো নয়, কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই বুঝবেন আসল কথা তা নয়। গল্পটি রূপকধর্মী। আমাদের মধ্যে অনেকেরই এই  অভ্যাস রয়েছে, যে আমরা সচেতনভাবে বা অবচেতনে কিছু বস্তুকে নিজের পরিচয়ের অংশ করে তুলি। যেমন এই গল্পের ক্ষেত্রে, গল্পের নায়ক আলি আবু তার ছেঁড়া জুতোজোড়াকে নিজের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তুলেছিলেন। ফলস্বরূপ জুতোর গুরুত্ব একসময় তার মালিককেও ছাড়িয়ে যায়। সাধারণ অবস্থাতেও মানুষ যেসব দুর্দশায় পড়েন তার বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কারণ কিন্তু তুচ্ছ বস্তু অথবা অপদার্থ পরিজনের ওপর অনর্থক বিশ্বাস এবং নির্ভরশীলতা। তাই সাধু সাবধান! তুচ্ছ বস্তু, খারাপ অভ্যাস এবং অযোগ্য মানুষ (সে আপনার যত প্রিয়ই হোক না কেন) এই তিনের সম্পর্কে সদা সতর্ক থাকবেন। এই ত্রয়ীর যে কোনো একটি যদি আপনার পরিচয়ের সর্বাধিক শক্তিশালী অংশ হয়ে ওঠে তাহলে খারাপ সময়ে তা আপনার অস্তিত্ব‍ ও স্বাধীনতা দুয়েরই বারোটা বাজাবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

সর্বজনীন স্যার ডঃ শংকর সেন ~ দেবেশ দাস

ব্রিটিশ ভারতে ছাত্রাবস্হা থেকেই দেশপ্রেমে অবিচল। এক বিকেলে একটা বাড়ী থেকে গ্রেফতার হয়ে গেল দুই স্কুল ছাত্র। পরের দিনের সকালের ধর্মঘটে তাদের রেলে নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা ছিল, সেই উদ্দেশ্যেই উঠেছিল ওখানে। স্যার বললেন, গ্রেফতার হতাম না জানো, যে বাড়ীতে উঠেছিলাম, বন্ধুর বোন পাড়ায় গল্প করেছিল যে বাইরে থেকে দাদার বন্ধুরা এসেছে, ব্যস খবরটা পুলিসের কানে পৌঁছল। সেই ছাত্রই শংকর  সেন। স্কুলশিক্ষা শেষে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া, অধ্যাপনায় ঢোকা। ইংল্যান্ডে বিশ্ববিখ্যাত এক অধ্যাপক এম জি সে এর কাছে পিএইচডি। 
কলেজে চলছে বার্ষিক পরীক্ষা, তারই অংশ হিসাবেই প্রত্যেককে মৌখিক পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। সেই সময়ে করিডোরে ডঃ শংকর  সেন দেখলেন একটি ছাত্রকে। 'এই তোমার পরীক্ষা না? এখানে ঘুরছ কেন?' ছাত্রটি বলল, মৌখিক পরীক্ষা দিতে তার প্রথমেই ডাক পড়েছিল, যা প্রশ্ন করেছিল কিছু পারেনি, স্যার ঘর থেকে বার করে দিয়েছেন, বলেছে, একদম শেষে এসো, সবার শেষে তোমায় আবার ধরবো। ছাত্রটিকে বললেন, শিগগিরি তার ঘরে যেতে, ঘরে গিয়ে কী কী প্রশ্ন তাকে করা হয়েছিল শুনলেন, তারপর সেটাই ছাত্রটিকে দীর্ঘক্ষন ধরে বোঝালেন। সবার শেষে ছাত্রটির যখন আবার ডাক পড়লো, সেই একই প্রশ্নে ছাত্রটি সফল, প্রশ্নকর্তা অবাক।



শুধু পড়াশোনা না, যে কোনও ছাত্রকে যে কোনও সাহায্য করার জন্য সবসময় মুখিয়ে থাকতেন স্যার। 'ছাত্র' শব্দটাতেই এক অদ্ভুত দুর্বলতা। কখনো কোনও একটা প্রোগ্রামে হয়তো যেতে চাইছেন না, বকাবকি করছেন, একটা মোক্ষম অস্ত্র ছিল, 'ছাত্রকে আপনি সাহায্য করবেন না?' ব্যস কাত হয়ে যেতেন। তার মৃত্যুর দিনে তাই অগণিত ছাত্রদের ভীড়, সকলেই তার সরাসরি ছাত্র না, কিন্তু তাও প্রত্যেকেই এই সার্বজনীন শিক্ষকের ছাত্রই, কোনও না কোনও ভাবে তার কাছে চলার পথে সাহায্য পেয়েছে, জীবনের উপদেশ পেয়েছে। মেধাবী ছাত্র, গবেষক, অধ্যাপক, উপাচার্য, মন্ত্রী, সব কিছু ছাপিয়েই তার মূল পরিচয় তিনি অগণিত ছাত্রদের স্যার।
মন্ত্রিত্বের পর অবসর জীবনে এক বিখ্যাত তথ্য প্রযুক্তি কোম্পানি তাকে বলেছিল পাওয়ার প্লান্ট পরিচালনার ব্যাপারে একটা সফটওয়্যার বানাতে তাদের সাহায্য করতে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রয়োগের ব্যাপার, সাথে সাথে রাজী হয়েছিলেন, তবে দুটি শর্তে। এক, যেদিন কোম্পানিতে যাবেন তাকে গাড়ী দিতে হবে, আর যতক্ষন থাকবেন, তাকে সামান্য কিছু খেতে দিতে হবে। না, কোনও কনসালটেন্সী ফি তিনি নেবেন না। কোম্পানিটি অবাক। অথচ, তার খুব স্বচ্ছল অবস্হা ছিল না। দীর্ঘদিন শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ানো, তারপর কয়েকবছর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, পেনশন পাওয়ার সময়ে যে কোনও কারণেই হোক তার শিবপুর ও যাদবপুরের সার্ভিস পিরিয়ডের সংযোগ না হওয়ায় পেনশন যা পাওয়ার কথা তার থেকে বেশ কম পেতেন। তাই নিয়েই চালাতেন।     
চিরকাল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো, তা নিয়ে বই লেখা, অথচ স্কুল শিক্ষা উন্নত করার জন্য বিশেষ ভাবিত ছিলেন। কখনো হয়তো কোনও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক এসেছে তাকে সমাবর্তনে ভাষণ দেওয়ার জন্য, তিনি রাজী হননি, বলেছেন তিনি এখন স্কুলশিক্ষা নিয়ে বেশী চিন্তিত। সপ্তম বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভায় তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের স্কুলে স্লাইড সহযোগে পড়ানোর উদ্যোগে খুবই সক্রিয় হয়েছিলেন। মন্ত্রিত্বের পরেও বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভার কোনও কোনও দফতরকে সাহায্য করেছেন।
রাজ্য সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের কাজে একদিন তাকে গাড়ী পাঠানো হয়েছে। যাতায়াতের পথে সেই গাড়ী নিয়ে তিনি ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলেন। যেহেতু ব্যক্তিগত কাজে সরকারী গাড়ী ব্যবহার করছেন, তাই সরকারী দফতরে হিসেব করে তার জন্য টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সরকারী অফিসার তো হতবাক, মন্ত্রীকে ধরলেন, এই টাকা কিভাবে নেওয়া হবে? মন্ত্রী বললেন, নিতেই হবে, এই টাকা ফেরত নিতে তার স্যারকে বলার সাহস নেই। উপাচার্য থাকার সময়ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ী নিয়ে বিয়েবাড়িতে গেলে গাড়ীর ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। কলকাতার একটি কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটা কাজে দু-একবার যাওয়ার সময়ে, প্রতিষ্ঠানটি তাকে একটা বড়ো গাড়ী পাঠিয়ে দিত, তাতে তার কি সংকোচ!
পার্টির সদস্য ছিলেন না। কিন্তু শৃঙ্খলা পরায়ণায় ঘাটতি ছিল না। কত রথী-মহারথী  তো পার্টির সাথে বিচ্ছিন্ন হওযার পর নানা কথা বলেছেন। তার সাথে কোনও না কোনও মতবিরোধেই তো তিনি বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভা ছেড়েছিলেন, কিন্তু একটা কথা তার মুখ দিয়ে কেউ বার করতে পারেনি। না, শত একান্ত আলোচনাতেও আমরা ছাত্ররাও এ ব্যাপারে কোনদিন কিছু জানতে পারিনি। জ্যোতি বসুর প্রতি ছিল অগাধ আস্হা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা। মৃত্যুর আগে জ্যোতি বসু যখন দীর্ঘদিন হাসপাতালে ছিলেন, তখন হাসপাতালের চারপাশে বহু লোক রোজ জড়ো হতেন। স্যারও একদিন গিয়েছিলেন, বহু লোকের সাথে বাইরে দাড়িয়ে চলে এসেছিলেন। 
মেয়েদের প্রতি দারুন সম্ভ্রম দেখিয়ে গেছেন চিরকাল। মন্ত্রী থাকাকালীনও তার সাথে দেখা করতে আসা ব্যক্তিদের সাথে কোনও মহিলা এলে সাথে সাথে উঠে দাড়াতেন। অবসর জীবনে নানা জায়গায় যেতেন। মানুষের সাথে কথা বলতেন। একবার কোনও এক জায়গায় খুব সাধারণ মহিলারা তাকে একটা প্রশ্ন করেন, মহিলা বিধবা হলে তার মাছ-মাংস খাওয়া বারণ, কিন্তু পুরুষ বিপত্নীক হলে তো সে সব খায়, এটা কেন চলবে? স্যারের তখন কয়েক বছর হল স্ত্রী মারা গেছেন, ট্রেনে ফিরতে ফিরতে তার মনে হল, এদেশের মেয়েদের ভীষন বঞ্চনা করা হচ্ছে, বাড়ী ফিরে মাছ-মাংস খাওয়া বন্ধ করে দিলেন। 
জীবনে স্ত্রীর অবদানের কথা সোচ্চারে বলতেন।  তাঁর ছাত্র বাৎসল্যকে মদত দিতে তাঁর স্ত্রীও ছিলেন একেবারে উদারহস্ত, আর অসহায় মানুষের প্রতি স্যারের মতোই আন্তরিক। স্যারের কাছেই গল্প শুনেছিলাম, একবার কোন একটা জায়গায় স্যারের সাথে গিয়ে মানুষের দারিদ্র্য দেখে কেঁদে ফেলেছিলেন। একবার একটা প্রোগ্রামে স্যারের যাওয়ার কথা হচ্ছিল, কিন্তু কিছুতেই কেন যেতে চাইছেন না বুঝতে পারছিলাম না। পরে বললেন, ঐদিন তাদের বিবাহবার্ষিকী, ওদিন তিনি একা থাকবেন, কোথাও যাবেন না, তাঁর স্ত্রী তখন ১০-১২ বছর মারা গেছেন।  
স্যারের সম্বন্ধে বলতে গেলে নানা গল্প আর শেষ হবে না। গত কয়েক দশকে অনেক বুদ্ধিজীবি তো রাজ্যে দেখা গেল। কেন জানিনা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির লোকদের কেউ বুদ্ধিজীবির পর্যায়ে ফেলে না। দেশপ্রেম, শিক্ষাঅনুরাগ, সমাজবোধ, সমাজ-সচেতনতা, মূল্যবোধ, প্রগতিশীল চিন্তা, মানুষের প্রতি দরদ, সব কিছুতেই স্যার একবাক্যে অনন্য। আজীবন প্রচারবিমুখ আদর্শের প্রতিমূর্তি মানুষটি নীরবেই চলে গেলেন।

আপের জয় ও এইরাজ্যের বাজেট ~ বিষাণ বসু

দিল্লিতে আপের জয়জয়কারে আপনার মতো আমিও খুশী - উচ্ছ্বসিত। আদার ব্যাপারী - তাই রাজধানীর খবর তেমন একটা পাই না -  তবে হাইএন্ড বন্ধুদের মুখে শুনেছি, সেখানকার সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা আর সরকারি ইশকুলের ভোল বদলে দিয়েছেন কেজরিওয়ালের সরকার - মহল্লা ক্লিনিকের কথা শুনেছি - কাগজেই পড়েছি, পরীক্ষাটরীক্ষায় দিল্লিতে বড়লোকি প্রাইভেট ইশকুলের চাইতে ভালো রেজাল্ট করছে সরকারি ইশকুল।  

গেরস্ত মধ্যবিত্ত মানুষ - দাঙ্গাহাঙ্গামায় বড় ভয় পাই। কাজেই, এরাজ্যেও বিজেপি না আসুক, এমনটাই চাই। প্লাস, ওই মধ্যবিত্ত বলেই, স্বাস্থ্য আর শিক্ষা নিয়ে খুব চিন্তায় থাকি - ভাবি, ওই পথেই উন্নতি-টুন্নতির আশা।

এইরাজ্যে আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র - তিনি খুবই হাইফাই অর্থনীতির লোক, শুনেছি।

রাজ্যের বাজেটের খোঁজ আজকাল কেউ রাখে না - খুব একটা খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ কেউ করেন, এমনও দেখিনি। তবু, আমার মতো আনাড়ির চোখে একটু কেমন কেমন ঠেকল -      

গতবছরের রাজ্য বাজেটে -

স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়বরাদ্দ - ৯৫৫৬ কোটি টাকা
স্কুল শিক্ষায় - ২৭৫৪০ কোটি টাকা
উচ্চশিক্ষায় - ৩৯৬৪ কোটি টাকা
বৃত্তিমূলক শিক্ষায় - ১১০৬ কোটি টাকা

এবছরের বাজেট -

স্বাস্থ্যখাতে - ৪৬০৮ কোটি টাকা (গতবছরের আটচল্লিশ শতাংশ - অর্ধেকেরও কম) 
স্কুল শিক্ষায় - ৮৭৫০ কোটি টাকা (গতবছরের একতিরিশ শতাংশ - এক-তৃতীয়াংশেরও কম)
উচ্চশিক্ষা - ৭০০ কোটি টাকা (গতবছরের সতের শতাংশ - ছয় ভাগের এক ভাগ) 
বৃত্তিমূলক শিক্ষায় - ৯০০ কোটি টাকা (গতবছরের আশি শতাংশ) 

এসব নিয়ে কেউ হইচই করছেন, এমন খবর দেখিনি। মিডিয়াতেও শোরগোল চলছে, এমনও দেখিনি। আপনি কিছু খবর পেলে জানাবেন, প্লীজ।

হ্যাঁ, খুশীর খবরও কি নেই? আছে তো!! জাতপাতের ভিত্তিতে পেনশন চালু হবে এরকম অনেক খবরই আছে।

তা, এই পথেই বিভাজন আর জাতপাত আর হানাহানির রাজনীতি প্রতিহত হবে? শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ছেড়ে পাইয়ে-দেওয়ার রাজনীতি দিয়ে ঘৃণা-বিদ্বেষের বয়ানের মোকাবিলা হতে পারবে? 

প্রসঙ্গত, দুই রাজ্যেই নাকি কর্ণধারদের স্ট্র‍্যাটেজি সাজিয়ে দিচ্ছেন প্রশান্ত কিশোর। তাহলে? আমরা, এই রাজ্যের নাগরিক তথা ভোটারেরা কি এমনই অর্বাচীন যে চুষিকাঠির বাইরে ভাবতে শিখিনি?? শিক্ষা-স্বাস্থ্য আমাদের অগ্রাধিকার নয়??? 

আপনি কী বলেন??

(তথ্যসূত্র - মাননীয় শ্রী অমিত মিত্র মহাশয়ের ২০১৯ ও ২০২০ সালের বাজেট বক্তৃতা)