রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

ভাষা বিদ্বেষ ~ সৌরদীপ চ্যাটার্জী

আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সারা পৃথিবীর সমস্ত মাতৃভাষার দিন আজ—ঊনসত্তর বছর আগে যার পথ দেখিয়েছিল একদল বাঙালি ছাত্র। ভাষা বড় বিচিত্র এক বস্তু, বিচিত্র তার ইতিহাস। বোধ হয় তার থেকেও বিচিত্র হল—তাকে নিয়ে ঝগড়া করা। মজার কথা হল, এই ঝগড়া করতে গেলেই প্রায়ই সেমসাইড গোল হয়ে যায়। অথচ আমরা খেলাটা এতই কম বুঝি যে, ওতেই ধেই ধেই করে নাচতে থাকি, বুঝিও না যে বল কোন পোস্টে ঢুকল। চলুন সেরকমই কিছু গল্প হোক একটু।

আজ থেকে এক হাজার বছর আগে হিন্দুকুশ পেরিয়ে ভারতে অভিযান চালিয়েছিলেন মুহম্মদ ঘুরী, তার পাঁচশো বছর পরে বাবর। আজ একশ্রেণির বাঙালি রোজ ভয়ে দিন গুনছেন, এই বুঝি সেইরকম কোনও সৈন্য ইছামতী পেরিয়ে বনগাঁর দিকে ধেয়ে আসে। তাঁরা সেই যুদ্ধের বিরুদ্ধে চোলায় চোলায় জয়ের ভেরি বাজাতে চান। ফলে বাংলায় কেন আরবি শব্দ থাকবে, কেন ফারসি থাকবে, 'পানি' বলা হবে, কেন 'গোসল' শব্দটি থাকবে—সেসব নিয়ে ঘোর আপত্তি তুলছেন। খুবই সঙ্গত দাবি। তবে তাহলে বোধ হয় তাঁদের উচিত, আইনকানুনের জন্য উকিলের কাছে না যাওয়া, মহকুমা কোনটা সেটাও না দেখা, অন্যকে হাজতবাসের ভয় না দেখানো বা কলকাতার বাইরে কোনও জেলার বাসিন্দা হলে সেটাও না বলা। কেননা—'আইন', 'কানুন', 'উকিল', 'মহকুমা', 'হাজত', 'জেলা' (দিলা) ইত্যাদি সবই আসলে আরবি শব্দ। আপনি ইংরেজিতে পেন না বলে বাংলায় কলম বলুন, সে কলমও আসলে আরবি। কাউকে বিদায় দিতে চাইবেন, সেই 'বিদায়'-ও আরবি। আমার কথা নয়, স্বয়ং সুকুমার সেন 'ভাষার ইতিহাস' বইতে এসব লিখে গেছেন। চাইলে কোনও অভিধান খুলেও শব্দমূল দেখে নিতে পারেন।

শুধু কি তাই? আপনি যে শব্দের আগে বসান 'আম-আদমি', 'আমজনতা', 'খাসজমি', 'খাসমহল'—সেই আম বা খাস সবই আরবির দেওয়া। গরম লাগলে যে একটু হাওয়াবাতাস গায়ে লাগাবেন তারও উপায় নেই। 'হাওয়া' আরবি; 'বাতাস' ফারসি। এদিকে আপনি যদি সংস্কৃত শব্দটা ধরে বলেন, একটু 'বায়ু' খেতে যাচ্ছি; পাবলিক অন্যকিছু ধরে নেবে। বায়ুত্যাগ বললে আরও জ্বালা, লোকে গ্যাস ছাড়া ধরে নিয়ে নাকে রুমাল দিতে পারে। সেই যে রবীন্দ্রনাথের উপেন বলেছিল, 'শুধু বিঘে দুই, ছিল মোর ভুঁই...', ব্যাস, তারপর আর কেউই ভুঁই (তদ্ভব) কেনে না, সবাই 'জমি' (ফারসি) কেনে। তা, জমি থাকলে একটা বাগানবাড়িও তুলে ফেলতে পারেন। ওহো, আবার গোলমাল হল—'বাগান' তো তুর্কি। আপনাকে 'উদ্যানবাটী' বানাতে হয় তাহলে। দেখবেন, বানান ভুল করবেন না যেন! অবশ্য বাগানবাড়ি তুলতে খুবই খরচ। এই 'খরচ' আবার ফারসি। খরচ বেশি না করাই ভাল যদিও। অমুক ডেটে অমুক খরচা বলে অনেকে হিসেব করে। অবশ্য ডেট আবার কী, আজ মাতৃভাষা দিবস, বলুন, তারিখ। কিন্তু এও এক জ্বালা... 'তারিখ' আবার আরবি। দোকানে জিনিসপত্র দর করবেন, সেই 'দর'-ও তাই, আরবি। 'দোকান'—ফারসি। কী জ্বালা বলুন দিকি!

সবচেয়ে বড় কথা, এই যে 'পানি'-র বিরুদ্ধে জিহাদ করছেন...সরি, যুদ্ধ করছেন, সে পানি আদপেই আরবি নয়, তা সংস্কৃত 'পানীয়' থেকেই এসেছে। 

এমনকি আরবি-ফারসি ঠেকাতে এই বোদ্ধা এবং যোদ্ধারা যার হাত ধরছেন, সেই হিন্দিতেই কি সমস্যা কম? কম তো নয়, বরং বেশি—বাংলার চেয়ে হিন্দির অনেক বেশি শব্দ আরবি-ফারসি থেকে নেওয়া। বেশিদূর যেতে হবে না, এই যে গান করেন, 'অগর' তুম মিল যাও, এই 'অগর' (যদি) এসেছে ফারসি থেকে। অমিতাভের ব্লগবাস্টার সিনেমা দিওয়ার—শব্দটা আসলে ফারসি। 'শহর' ফারসি, 'নগর' সংস্কৃত। 'হাম আভি জিন্দা হ্যায়'—সেই 'জিন্দা' ফারসি, 'কুদরত' আরবি, 'দুনিয়া'—বাংলা হিন্দি উভয়েই আছে—আরবি। 'গুজরনা' ফারসি, 'বাবু কো কুর্সি দো'—এই কুর্সি আরবি। 'ওয়াক্ত' (সময়)—আরবি, 'তকরীবন' (ওই মোটের ওপর), 'মুশকিল', 'খবর', 'অখবর' (বহুবচন), 'মহব্বত', 'বিলকুল', 'আখির', 'আজিজ', 'ফিলহাল' (বর্তমানে), 'মওত' (মৃত্যু), 'সহি', 'ইজাজত' (অনুমতি)—এসবই হল আরবি থেকে আসা। বল মা তারা, দাঁড়াই কোথা—!

আমাদের দেশে ঝালে-ঝোলে, অম্বলে, ডায়োভলে, প্যানফর্টিতে ধর্ম গুঁজে দেওয়ার রীতি আছে। ফলে এইভাবেই ভাষার সঙ্গেও ধর্মকে ভিড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হিন্দি হিন্দুর ভাষা, উর্দু মুসলমানের ভাষা, বাঙালি না মুসলমান—ইত্যাদি অনেক কিছুই চলে। এ' অবশ্য আজকের নয়, বহুদিনের। ১৮৭৭ সালে ভরতেন্দু হরিশচন্দ্র—যাঁকে বলা হয় আধুনিক হিন্দি ভাষার জনক—তিনি একে প্রায় গণ-অভ্যুত্থানের রূপ দিয়েছিলেন। তার আগে অবধি উত্তরপদেশে—তৎকালীন যুক্তপ্রদেশে উর্দুই ছিল সরকারি ভাষা, দপ্তরের ভাষা। পরে ব্রিটিশের আগমনে ইংরেজি এসেছিল সঙ্গে। অথচ মজার কথা, হিন্দি বা উর্দু আসলে একই ভাষার দুই সন্তান, যাকে বলে হিন্দুস্তানি। এই হিন্দুস্তানি বা হিন্দভি ভাষাই ছিল যুক্তপ্রদেশ থেকে রাজপুতানার এক বিরাট অংশের ভাষা। আঠারো শতকের আগে সম্ভবত 'উর্দু' বলে কোনও শব্দের অস্তিত্বই ছিল না। উর্দু আরবের ভাষা নয়, পারস্যের ভাষা নয়, এমনকি আফগানিস্তানের ভাষাও নয়। উর্দুর জন্ম এদেশে, এই ভারতবর্ষেই। তাও একেবারে ভারতের মধ্যভাগে, গাঙ্গেয় সমভূমিতে। বাংলা, ওড়িয়া, তামিল, অসমীয়ার মত উর্দুও একটি খাঁটি ভারতীয় ভাষা।

উর্দু সম্পর্কে এও বলা হয়—উর্দু নাকি 'লস্করি জবান'—অর্থাৎ সৈনিকের ভাষা। কারণ অনেকে মনে করেন, উর্দুর জন্ম হয় মুঘল সৈন্যবাহিনীতে। এ মতও আজ আর চলে না। উর্দু বলে যা আমরা চিনি, সেই হিন্দুস্তানির জন্ম ভারতীয় অপভ্রংশ অবহটঠ থেকেই। মুঘলযুগের আগেও এর অস্তিত্ব ছিল, স্বয়ং আমির খসরুও এই ভাষাতেই কাব্যচর্চা করেছেন। 

হিন্দিকে আজ মানা হয় হিন্দুর ভাষা বলে, পবিত্র ভাষা বলে। হিন্দি কীভাবে পবিত্রতা পেল তা অবশ্য জানা নেই। তবু বহু বঙ্গসন্তান আজ পশ্চিমবঙ্গকে আরব-পারস্যের দস্যুদের হাত থেকে বাঁচাতে হিন্দিতে কথা বলার পথ ধরছেন। যদিও এও আজকের কথা নয়। ১৯২৯ সালে বেরিয়েছিল 'হিন্দি সাহিত্য কা ইতিহাস', লেখক বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা পণ্ডিত আচার্য রামচন্দ্র শুক্লা। তিনিই অত্যন্ত সুচারুভাবে হিন্দিকে সংস্কৃতের উত্তরসূরি হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন এবং উর্দুর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। মজার কথা, 'হিন্দি' শব্দটাই আসলে সংস্কৃত নয়, সম্ভবত বৈদিকও নয়। 'হিন্দি' এসেছে ফারসি থেকে, যার অর্থ হিন্দের অধিবাসী। এমনকি 'হিন্দু' শব্দটিও তাই—পারস্যের। বেশিদূর যেতে হবে না, এনসিইআরটির সরকারি বইতেই এই তথ্য মিলবে, স্কুলে পড়ানো হয়।

উর্দু নিয়েও সে কি টানাটানি! দেশভাগের পর স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হল, তার অফিশিয়াল ভাষা করা হল উর্দুকে। অথচ পাকিস্তান যে যে অংশ নিয়ে তৈরি, তা হল সিন্ধ—যার ভাষা সিন্ধ্রি, পশ্চিম পাঞ্জাব—যার ভাষা পাঞ্জাবি, বালোচিস্তানের একাংশ—যার ভাষা বালোচ, খাইবার পাখতুনখোয়ার ভাষা পশতো এবং এদিকে পূর্ব বাংলা—যার ভাষা বাংলা। এছাড়া দুইদিকেই রয়েছে প্রচুর ছোটোখাটো ভাষাগোষ্ঠী। আজও গোটা পাকিস্তানের সম্ভবত ১০%-এরও কম লোকের মাতৃভাষা উর্দু। তারপরেও উর্দুই পাকিস্তানের 'লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা'—ইসলামের প্রতীক। এ এক বিচিত্র প্যারাডক্স! পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্না নিজেও এর চেয়ে কম বৈচিত্র্যময় ছিলেন না। জিন্না নিজে খিলাফত আন্দোলনেও যোগ দেননি, কোনোদিন দাড়ি রাখেননি, বিবাহ করেছিলেন এক অমুসলিমকে এবং শোনা যায় কোনোদিন নাকি নমাজ অবধি পড়েননি। এককালে ছিলেন কামাল আতাতুর্কের ভক্ত। অথচ সেই তিনিই পরে দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রচার করলেন।

আরও একটা কথা কী জানেন? আমাদের দেশের প্রথম ফারসি সংবাদপত্র দিল্লি, হায়দরাবাদ, লাহোর বা আগ্রাতে নয়, প্রকাশিত হয়েছিল এই কলকাতায়। নাম ছিল—'মীরাট-উল-অখবর'। প্রকাশক কোনও মুঘল বা পাঠান ছিলেন না। তাঁর নাম ছিল রামমোহন রায়। ভাষাবিদ সুকুমার সেন যার সম্পর্কে লিখেছেন, "তিনি সংস্কৃত জানিতেন, ফারসী (এবং আরবীও সম্ভবত) আরও ভাল করিয়া জানিতেন, তিনি ভারতবর্ষের ইংরেজি শিক্ষিতদের অগ্রণী।..." 

আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে তাই ভাষা নিয়ে আবেগের পাশাপাশি কিছু সহজ সত্যিকেও জেনে রাখা জরুরি। নিজের দেশকে নিয়ে গর্বিত হওয়াই যায়, কিন্তু সেই গর্বের কারণগুলো ঠিকমত বেছে নিতে পারলে আরও ভাল হয় আরকি। বেদে সব আছে, পুরাণে সব আছে, মহাভারতে প্লাস্টিক সার্জারি ছিল, দুধে সোনা পাওয়া যায়—এসবের চেয়েও জানা জরুরি সেই সব দিকগুলো, যেদিক দিয়ে সত্যিই "এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি!" ভারতবর্ষই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যাতে বাইশটা সরকারি ভাষা আছে। ২০১১ সালের জনগণনায় দেখা গেছে, ভারতে ১৯,৫৬৯-টি মাতৃভাষা আছে! এরকম ভাষার বৈচিত্র পৃথিবীতে ইন্দোনেশিয়া ছাড়া আর দেখা যায় না। তাদের মধ্যে অন্তত পাঁচশোটা ভাষা বিলুপ্তির পথে। আজ এক কেন্দ্রীয় শক্তি দেশে হিন্দিকেই জাতীয় ভাষা করার দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ ভারতের কোনও 'ন্যাশনাল ল্যাঙ্গোয়েজ' নেই। তাই সর্বত্র সুচারুভাবে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ আমরা ঝগড়া করছি, কেন বাবাকে 'আব্বা' বলব। মজার কথা, এই 'আব্বা' শব্দটি আরবি ভাষাটার চেয়েই অনেক পুরনো, সম্ভবত প্রায় এক হাজার বছরেরও বেশি। আরও মজার কথা, এই শব্দের উৎস সম্ভবত সেমিটিক, যা থেকে হিব্রু বাইবেলে ঈশ্বর বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই যে আমরা খুব মান্যগন্য কাউকে বোঝাতে 'বাবা' বলি, সেই বাবা এসেছে ফারসি থেকে, আবার বাংলায় পিতা অর্থে বাবা এসেছে সংস্কৃত 'বপ্র' থেকে। ঝগড়া করতে গিয়ে যেন নিজের পায়ের দিকে খেয়াল রাখি, কুড়ুলটা কোথায় পড়ছে।

ওই যে বললাম, ভাষা বড় বিচিত্র। আমরা তাস পেটাই, অথচ জানি না যে 'হরতন', 'রুইতন' আসলে আর্জেন রবেন, ভ্যান ডার সরের দেশ থেকে এসেছে। বালতি বালতি জলে স্নান করি, করে জামা পরে বোতাম আটকাই, তারপর বাসনে খাওয়াদাওয়া করি, খেয়ে তোয়ালেতে হাত মুছি—এই 'বালতি', 'বোতাম', 'বাসন', 'তোয়ালে' ইত্যাদি সবই আসলে এসেছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর দেশ থেকে। এমনকি আমরা বাংলায় ডাচদের 'ওলন্দাজ' বলি, এই 'ওলন্দাজ' শব্দটিও আসলে এসেছে পোর্তুগিজ 'holandes' থেকে। বিশ্বাস না হলে গুগল ট্রান্সলেটে দেখে নিন। বরং এই রোববারের সন্ধ্যেতে একটু চা খেতে খেতেই দেখুন না হয়। চা হল সেই কয়েকটা বস্তুর একটি, পৃথিবীর বেশিরভাগ ভাষাতেই যার প্রতিশব্দ একই। জাপানি, চিনে, কোরিয়ান, হিন্দি, বাংলা, তুর্কি, ইউক্রেনিয়ান, গ্রিক, পর্তুগিজ, গুজরাতি, আরবি, পাঞ্জাবি, উজবেক ও রুশ ভাষায় চায়ের প্রতিশব্দ চা/চায়ে/চায়/চ'! এদিকে ইংরেজি, লাতিন, হিব্রু, কাতালান, বাস্ক, জার্মান, ফরাসি, এস্তোনিয়ান বা মালয় ভাষায় বলে টি/টে।

শুক্রবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

এসএফআই ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

"ঐশীদের দাঁড় করাবেন শুনলাম। মহিলা প্রার্থী ? ছোহ্ এদের দিয়ে আর কিস্যু হবে না দাদা। এত সব বড় বড় ভাষণ, অমুক সে আজাদী, তমুক সে আজাদী। খালি ওই জেএনইউ ক্যাম্পাসের মধ্যে লাফ ঝাঁপই সার। এবারে ক'টা সিট জিতবেন? আরে জিতবেন কি, নোটার থেকেও কম ভোট পাবেন। ওসব ঐশী টইসির কম্ম নয়। এ লড়াই অন্য লড়াই। বুইলেন দাদা।"

সত্যিই তো। সারাদিন কাজের শেষে মন খারাপ।খালি মাঝে মধ্যে ক্লান্ত মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজলে একটা মেয়ের মুখ ভেসে আসে, বড় বড় চোখ, মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ। সত্যিই হল না আর। এ লড়াই অন্য লড়াই। 

চোখ বুঁজে থাকুন। খুলবেন না। আস্তে করে আপনাকে এমনি একটা জায়গায় নিয়ে যাবো। একবছর আগের একটা জায়াগায়। কোন জায়াগায় ? ধৈর্য্য হারাবেন না। আসুন আমার সাথে। চারদিকে ক্ষেত, আর সবুজ জঙ্গল। দূরে একটা কালো পাহাড়। চা এর বাগান। কিছু খোলা, কিছু বন্ধ। দু'চারটে বাড়ি। কাঠের দেয়াল, টিনের চাল। সেই ঢালু চাল বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা। আমার মাতৃভূমি। 

তেমনই একটা ঘরে আবছা আলোয় মেঝেতে চাটাই পেতে গুটিকয় ছেলে মেয়ে। মিটিং করে ওরা। গাল ভরা নাম আছে, "সম্মেলন"। মিটিং শেষে সাদার মধ্যে লাল তারা আঁকা পতাকা হাতে ওদের ছবি ওঠে সস্তার মোবাইলে। জাফরীকাটা রোদের আলোয়। ছবিটা তোলার আগে আধা পেটা খাওয়া অপুষ্টিতে শীর্ন মুখগুলো তে অদ্ভুত হাসি। ওরা স্লোগান তোলে, "স্বাধীনতা, গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র জিন্দাবাদ।"

ওরা মানে ? হ্যাঁ, এইবার চোখ খুলতে পারেন। চোখ খুলে দেখে নিন, ওরা মানে শবনম, প্রিয়াঙ্কা, অঞ্জলি , স্বপ্না আর দীপা। ওরা স্লোগান তোলে, "ঐশী দিদি করো লড়াই, সাথে আছি আমরা সবাই"। স্লোগানের দমকে ছেঁড়া ফ্রকে লাগানো সেফটিপিনটা খুলে আসে, আবার লাগিয়ে নেয়। আবার স্লোগান দিতে হবে যে। লড়াই এর স্লোগান। ঠিকই বলেছেন একদম। এ লড়াই অন্য লড়াই। এ লড়াই জিততে হবে। লড়াই এর মানেটা কেবল বুঝে নিতে হবে।

ছবি: এসএফআই এর বীরপাড়া চা বাগান ইউনিট। কমঃ শবনম খাতুন (সভাপতি), কমঃ প্রিয়াঙ্কা মহাজন (সহ সভাপতি), কমঃ অঞ্জলি খাড়িয়া (সম্পাদক), কমঃ স্বপ্না কেরকেট্টা (সহ সম্পাদক), কমঃ দীপা লাকড়া (পত্রপত্রিকা)। এক বছর আগে।

মঙ্গলবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

EIA2020, উত্তরাখন্ডের বিপর্যয় এবং... ~ সংগ্রাম চ্যাটার্জী

২০২০ সালে লকডাউনের মধ্যেই একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিল কেন্দ্রের BJP সরকার— পরিবেশ সংক্রান্ত আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ভাবনাটাকেই নস্যাৎ করে দেওয়ার সরকারি বন্দোবস্ত করার জন্য ড্রাফ্ট্ EIA2020 পেশ করে!
এ'নিয়ে সাধারণ মানুষের মতামত দেওয়ার সুযোগ সংকুচিত করার প্রতিবাদে বহু মানুষ ব্যক্তিগতভাবে এবং বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে আদালতের দারস্থ হন, যার পরিনতিতে ২০২০'র ১১ আগস্ট পর্যন্ত মতামত দেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায় এবং বহু মানুষ (প্রায় ১৭ লক্ষ!) এই প্রশ্নে কার্যত কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধেই মতামত দেন। 
যদিও তারপর গোটা প্রক্রিয়ার ফলাফল সামনে আসে নি, অন্ততঃ আমার কাছে! আর, এই সময়েই ঘটে গেল গতকালের উত্তরাখন্ডের ভয়াবহ ঘটনাটা! 

* EIA কী? 
পুরো কথাটা: Environment Impact Assessment, বাংলা করলে দাঁড়ায় পরিবেশের উপর প্রভাবের পরিমাপ।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, কোনও একটি ডেভেলপমেন্টাল প্রজেক্ট বা উন্নয়নমূলক কাজের জন্য প্রকৃতি আর পরিবেশ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সেই সম্ভবনা আগেভাগেই জরিপ করে নেওয়া হয়৷ কারণ প্রকৃতি বা পরিবেশের ক্ষতি দীর্ঘস্থায়ী কোনও বিপদ ডেকে আনতে পারে৷ তাই, উন্নয়নকে টেকসই করার আগে দরকার উপযুক্তভাবে প্রকৃতি, পরিবেশের ওপর তার সুদূরপ্রসারী প্রভাবের ঠিকঠাক অ্যাসেসমেন্ট! সেইটে করা হলেই, কোনো উন্নয়নমূলক প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবুজ সংকেত পাওয়া যায়৷ এই অ্যাসেসমেন্টে প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারের চরিত্র যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনই একইভাবে প্রজেক্ট সাইটে বসবাসকারী লোকজন, জীববৈচিত্র্য এবং সামগ্রিকভাবে বাস্তুতন্ত্রের ওপর এর প্রভাবও এই অ্যাসেসমেন্টে বিবেচনা করা হয়৷ যাতে করে প্রকৃতি-পরিবেশকে যথাসম্ভব বাঁচিয়ে কার্যত একপ্রকার টেকসই উন্নয়নকে বা স্থিতিশীল উন্নয়নকে নিশ্চিত করা যায়।

* সমস্যা কী কী?
খুব বেশি কথায় না গিয়ে আরেকবার এই পাঁচটা পয়েন্টে একটু নজর দিন:
১) Post - Facto clearance! 
অর্থাৎ পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই কোনো প্রকল্পের কাজ চলতে পারে। ড্রাফ্ট অনুযায়ী এই ক্লিয়ারেন্স কাজ শুরুর পরেও পাওয়া যেতে পারে (যদিও এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্ট একটি জাজমেন্টে একে ভুল এবং এমন আইন করা উচিৎ নয় বলে জানিয়েছে)।

২) কোনও একটা প্রজেক্ট নিয়ে সংশ্লিষ্ট মানুষদের বক্তব্য নথিভুক্ত করে পাবলিক হিয়ারিংয়ের সময় ক্রমাগত কমিয়ে এনে (এর আগে এর সময় ছিল ৩০ দিন, এখন ২০ দিন) বিষয়টা যথাসম্ভব গোপনে পাশ করার চেষ্টা! 

৩) নতুন ড্রাফট অনুযায়ী, যদি কোনো প্রকল্প পরিবেশ আইনকে উলঙ্ঘন করে তবে সাধারণ মানুষের অধিকার নেই সেটা চিহ্নিত করার বা সেটি নিয়ে কোনো অভিযোগ জানানোর। যদি উলঙ্ঘন হয় তবে শুধুমাত্র উলঙ্ঘনকারী (প্রকল্পকারী) বা সরকার বলতে পারে সেটা। 
ভাবুন— খুনি খুন করে এসে নিজেই বলবে— খুন করে ফেলেছি স্যর! 😀

৪)  কোনও প্রজেক্টের সাথে জাতীয় নিরাপত্তার কোনও সম্পর্ক না থাকলেও সরকার যেকোন প্রজেক্টকেই স্ট্র্যাটেজিক প্রজেক্ট বলতে পারে, আমি আপনি সেক্ষেত্রে কিস্যু বলতে পারবোনা। 
আর, এ'তো জানা কথাই যে— মহামান্য(!) সরকার যে কোনও প্রজেক্টকেই স্ট্র্যাটেজিক প্রজেক্ট বলে দিতে পারে! 

৫) ড্রাফটে বর্ডার এরিয়ার সংজ্ঞা দিয়ে যা বলেছে তার মানে দাঁড়ায় সীমান্ত থেকে মোটামুটি ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল! এবং এই অঞ্চলে কোনো এধরনের কাজে জনতার মতামত নেওয়া হবে না! মানে! 
মোদ্দা কথা পুরো গাড়োয়াল কুমায়ূণ হিমালয় থেকে শুরু করে একদম উত্তর পূর্ব হিমালয়ের ঘন জঙ্গল ওদের টার্গেট! এমনকি চাইলে সুন্দরবনও! যেখানে যতটুকু জঙ্গল বেঁচে ছিল নজর এখন সেইদিকে! 

আপাততঃ এইটুকুই থাকল।
এবার আপনি মিলিয়ে নিন গত কয়েক বছর ধরে কী কী চলছে গোটা দেশ জুড়ে!

আচ্ছা, সময়ের অভাবে না হয় গোটা দেশের কথা বাদই দিলাম। বাদ দিচ্ছি ছত্রিশগড়, ঝাড়খণ্ড, ওডিশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, সিকিম জুড়ে যা চলছে— সেই সব। 
শুধু এই উত্তরাখন্ড রাজ্যে 
১) নামে ৩৩ টা হলেও আদপে শতাধিক হাইড্রলিক প্রজেক্টের কাজ চলছে বা শুরু হয়েছে!! এবং এতে কোন নদী বাদ আছে? কেউ না!
হিমালয়ের দুর্গম ভুখণ্ডে 'উন্নয়ন' এর নাম করে একটার পর একটা তাগড়া প্রজেক্ট আদপে ভারী হয়ে দাঁড়িয়েছে গোটা বাস্তুতন্ত্রটার ওপরেই!
এই যে ঋষিগঙ্গার উপরের যে প্রজেক্টটা জলের তোড়ে কার্যত ভেসে গেল, এটা নিয়ে পরিবেশবিদরা আপত্তি করেন নি? করে গেছেন! কিন্ত ঐ কাকস্য পরিবেদনা! কাজ চলেছে! শুধু চলেছে না, আরো দ্রুততার সাথে চলেছে! মরছে কারা? গরীব মানুষ। শ্রমিকরা। 

২) ২০১৬ সালে শুরু হল প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রজেক্ট— #চারধাম_প্রকল্প! মনে রাখা দরকার, এর আগেই ২০১৩ সালে ঘটে গেছে কেদারনাথে সেই ভয়াবহ ঘটনা! তার পরেও ঐ ২০১৬ থেকে শুরু হল যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী, কেদারনাথ ও বদ্রিনাথকে চওড়া সড়কপথে নতুন করে জোড়বার কাজ! শুরু হল পাহাড় ফাটিয়ে অবাধে রাস্তা চওড়া করার অপকাণ্ড! 
কোর্ট বলছে প্রস্থ কমাও! কে শোনে কার কথা! প্রায ৪৭ হাজারেরও বেশি গাছ কাটা হল! ধ্বংস হয়ে গেল ৭০০ হেক্টর বনাঞ্চল! 
শুধু ২০২০ সালেই এই প্রকল্পের রাস্তা জুড়ে ৬টা বড় বড় ধ্বস নেমেছে! মারা গেছেন বহু শ্রমিক! 
এর পরেও অনুমতি পেতে জোচ্চুরি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার— এই প্রজেক্টটাকে দেখিয়েছে আলাদা আলাদা ৫৩টা প্রজেক্ট, যার প্রতিটিই ১০০ কিলোমিটারের কম দূরত্বের! 
এই চারধামের ৯০০ কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে পাথর পড়েছে পাশের নদীখাতগুলোতে। ক্রমশই বুজে আসছে নদীখাতগুলো! ফলে... 

৩) উত্তরাখন্ডের প্রচলিত ট্রেক রুট গুলিতে যান। দেখবেন, যেগুলো চীন সীমান্তের কাছাকাছি তার সবকটাতেই (মিলাম গ্লেসিয়ার, কিংবা পঞ্চচুল্লী বেস ক্যাম্প) চলছে পাকা সড়ক নির্মাণের কাজ! নরম হিমালয় মাঝেমধ্যেই এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে ঝটকা দিচ্ছে, আর তখনই নামছে ব্যাপক বিপর্যয়!
এমনকি এই নন্দাদেবী স্যাংচুয়ারির মত বৈচিত্র্যময় ও বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর অরণ্যের লাগোয়া এলাকাগুলোতেও এই কাজ করে চলেছে অবাধে!! ধ্বংস হচ্ছে সব কিছু! সব...!!! 

৪) পাঁচ/সাত বছর আগে ছুঁয়ে আসা কোনও একটা গ্লেসিয়ারে আবার ট্রেক করে আসেন। চমকে যাবেন #পরিবর্তন দেখে! বুঝতে পারবেন কতটা পিছিয়ে গেছে হিমবাহটা! 
হ্যাঁ, ছোট হচ্ছে সবগুলো। সে আপনি গঙ্গোত্রী বলুন, আর বাগিনীই বলুন— সব। বিশ্ব উষ্ণায়ণের ফল। 
এভারেস্টের উচ্চতা কয়েক মিলিমিটার বাড়তেই পারে, কিন্তু সব মিলিয়ে হিমবাহগুলোর গড় উচ্চতা বছরে ফুট দেড়েক করে কমছে! মানেটা কি বুঝতে পারছি!?  
এই রেটে যদি বরফ গলে, তাহলে হিমালয়ের জমে থাকা বরফের উপর নির্ভর করে থাকা গোটা উত্তর ও মধ্য ভারতের অজস্র নদী প্রথমে বন্যায় ভাসাবে, তারপর জলের অভাবে সারা বছর ধুঁকবে! আর গোটা দেশের কৃষি পড়ে যাবে এক ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে! 
এই রেটে যদি বরফ গলে, সমুদ্রের জলতল যদি বাড়ে তাহলে উপকূলবর্তী হাজারো গ্রাম আর কোটি কোটি মানুষের জীবন জীবিকা সব শেষ!! 
আর এই দুইয়ের যোগফল?? বোঝাই যাচ্ছে। 

আবারও মনে করা— পরিবেশকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া দ্বন্দ্বটা আসলে বিশ্বজোড়া শ্রম ও পুঁজির বেসিক যে দ্বন্দ্ব, তারই একটা সামাজিক বহিঃপ্রকাশ মাত্র। 
তীব্র থেকে তীব্রতম মুনাফার লোভ গোটা পৃথিবীর সামনে নামিয়ে আনছে ঘোর বিপদ। যার প্রথম বলি হবেন এবং হচ্ছেনও সেই গরীব মানুষ, সাথে মধ্যবিত্তও। 
আজকের আমার দেশের সরকারের এই পদক্ষেপ (#EIA2020) গোটা দেশের জল-জঙ্গল-জমিকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার একটা ধাপ। গতকালের ঘটনাটা আলাদা কিছু না, মুনাফার লোভে প্রকৃতিকে ধ্বংস করার পুঁজিবাদী অপপ্রয়াসের একটা ফল মাত্র! ফলে পরিবেশ নিয়ে এই লড়াইটা দিনের শেষে মূল লড়াইয়েরই একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
তবে, সেই লড়াইটা কীভাবে লড়ব সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা...

বৃহস্পতিবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

প্রাউড টু বি অ্যান এমবিবিএস ~ ডঃ বিষাণ বসু

প্রাউড টু বি অ্যান এমবিবিএস। এ নিয়ে প্রচুর পোস্ট হচ্ছে। ডাক্তারি পাস করার বেসিক ডিগ্রী এমবিবিএস, কথাটা সবাই জানেন। এবং সেই ডিগ্রী অর্জন করার শেষে - এবং তদপরবর্তী প্রশিক্ষণের পর্ব পার হলে - সকলেই ডাক্তারি করার পক্ষে ন্যূনতম যোগ্যতা অর্জন করে থাকেন। পাস করতে পাঁচ বছর - হাতেকলমে শিক্ষার বাড়তি বছরগুলো, অর্থাৎ ইন্টার্নশিপ-হাউসস্টাফশিপ ধরলে সাত বছর। জেনারেল লাইনে পড়লে ওর চেয়ে কম সময়ে মাস্টার ডিগ্রী হয়ে যায়। কাজেই, এমবিবিএস ডিগ্রীখানা সাধারণ ব্যাচেলর ডিগ্রীর থেকে কিঞ্চিৎ ভিন্ন গোত্রের - উন্নততর দাবী করছি না, বলছি ভিন্ন।

কথাগুলো কারোরই অজানা নয়। কিন্তু, নতুন বিতর্কের পেছনে সংবাদপত্রের একটি খবর। যেখানে হেডলাইন, "স্রেফ এমবিবিএস" করলেন প্রসূতির জটিল অস্ত্রোপচার - কথাটা ওই স্রেফ বিশেষণটি নিয়ে। 

সকলের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখা যাক, এমবিবিএস ডিগ্রীটিই কিন্তু শল্যচিকিৎসা এবং প্রসূতির চিকিৎসার পক্ষে যথেষ্ট ডিগ্রী। অন্তত, মেডিকেল কাউন্সিল তেমনই বলে থাকেন। অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে জটিলতা অনেকক্ষেত্রেই তৈরী হয় - চিকিৎসক এমবিবিএস বলেই হয়েছে, এমন নয়। কাজেই, অন্তত আমার চোখে, স্রেফ এমবিবিএস শব্দবন্ধ এক্ষেত্রে অনুচিত।

সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক অবশ্য জানিয়েছেন, এমবিবিএস-এর আগে স্রেফ বিশেষণটি তাঁর নয় - রাজ্যের ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট রেগুলেটরি কমিশন-এর প্রধান, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অসীম কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনিই রায়দানের মুহূর্তে বলেছেন, ওনলি এমবিবিএস - স্রেফ শব্দটি ওনলি-র বঙ্গানুবাদ মাত্র।

সহমত। এক্ষেত্রে সাংবাদিকের দোষ দেখছি না।

যেকোনো বিষয়ে মতামত দেওয়ার আগে সে বিষয়ে অল্পবিস্তর জ্ঞান অর্জন জরুরী - আমাদের শাস্ত্রে বলত, বলার আগে অধিকারী হও, অর্থাৎ বলার অধিকার তথা বিষয়ের উপর দখল অর্জন করো। মেডিকেল সায়েন্স ব্যাপারটা ইদানীং যেন সুলভ শৌচালয়ে পরিণত হয়েছে - পকেটে দুটি টাকা থাকলেই সকলেরই মলমূত্র ত্যাগের অধিকার জন্মে যাচ্ছে - থুতু ফেলা তো বিলকুল ফ্রী। সেখানে বিচারপতি এমন মন্তব্য করলে আপত্তির কী-ই বা আছে!!  

শুধু দুইখান কথা কইতে চাই।

আইন মোতাবেক ওনলি এমবিবিএস হলে ডাক্তারবাবু অমন অপারেশন করতে পারবেন না, এমনটি কোথায় লিখিত রয়েছে? (এই বিশেষ ঘটনাটিতে অবশ্য চিকিৎসক নিজেকে বিশেষজ্ঞ বলে দাবী করেছিলেন - এবং তেমন হলে, ঘটনাটি অবশ্যই প্রতারণার। কিন্তু, রায় এবং সংবাদপত্রের হেডলাইন, সর্বত্রই মিথ্যে দাবী এবং প্রতারণার দিকটাকে ছাপিয়ে গিয়েছে "স্রেফ এমবিবিএস")

দ্বিতীয়ত, ডাক্তারি লাইনটিই, অন্তত এদেশে, বোধহয় দুনিয়ার একমাত্র পেশায় পরিণত হয়েছে, যেখানে অভিজ্ঞতা ও চর্চার কোনো স্বীকৃতি নেই। তিরিশ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন জেনারেল প্র‍্যাকটিশনারের চাইতে পরশু এমডি পাস করা ডাক্তারের কদর বেশী - কেননা, প্রথমজন "স্রেফ এমবিবিএস"। এতে ক্ষতি চিকিৎসকদের যতখানি, তার চাইতে অনেকগুণে বেশী ক্ষতি আপনাদের সকলের। বিশেষজ্ঞ ট্রেনিং-এর অনিবার্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া - নোয়িং মোর অ্যান্ড মোর অ্যাবাউট লেস অ্যান্ড লেস - আরো পরিমিত বিষয়ে আরো অনেকখানি বিস্তারে ও গভীরে জ্ঞান অর্জন করা। আমরা যারা তথাকথিত বিশেষজ্ঞ, তারা গাছখানা খুবই খুঁটিয়ে দেখতে শিখি - জঙ্গলের অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে। জঙ্গলের আর পাঁচটা গাছের চাইতে এই বিশেষ গাছটিকেই খুঁটিয়ে দেখা প্রয়োজন কিনা, সেই বিচার সবচেয়ে ভালো করতে পারেন একজন জেনারেল প্র‍্যাকটিশনার - স্রেফ এমবিবিএস-ই। এর উল্টোপথে হাঁটলে প্রতিটি গাছকেই বিশেষ গাছ হিসেবে দেখার প্রবণতা বাড়ে - পরীক্ষানিরীক্ষার সংখ্যা এবং চিকিৎসার খরচ, দুইই বাড়ে। বিপণনমুখী চিকিৎসা অবশ্য তেমনটিই চায় - আর সেজন্যেই এমবিবিএস পরিণত হয়েছে পাতি বা স্রেফ এমবিবিএস-এ। লাগামছাড়া চিকিৎসার খরচে তিতিবিরক্ত আপনিও অন্য কিছু ভাববেন না? এখনও ভাবা শুরু করবেন না?

এরই উল্টোপিঠে, এমবিবিএস-এর গুরুত্ব হ্রাসের কারণে, তরুণ চিকিৎসকরাও আর স্রেফ এমবিবিএস থাকতে চাইছেন না। এমবিবিএস ব্যাপারটাকেই উচ্চমাধ্যমিকের আগে মাধ্যমিকের মতো এমডি-র প্রাথমিক ধাপ হিসেবে দায়সারা গোছের ভাবতে শিখছেন - যত্ন নিয়ে সার্বিক দৃষ্টি অর্জনের চেষ্টাটাই লুপ্ত হতে চলেছে। অতএব, তেমন দিন আর দূরে নেই, যখন পেটখারাপের চিকিৎসার জন্যেও গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্টের শরণাপন্ন না হয়ে গতি থাকবে না - কর্পোরেট স্বাস্থ্যব্যবস্থার রমরমা অবশ্য সেক্ষেত্রে আরো বাড়বে - আপনিও কি তেমনটাই চান? এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে অভিজ্ঞ জেনারেল প্র‍্যাক্টিশনার ব্যাপারটাই অবলুপ্ত হয়ে যাবে। সেটাই চাইছেন তাহলে??

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার বলছেন, চিকিৎসাকে মানবিক করে তুলতে আমাদের ফিরতে হবে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের ধারণায় - স্বাস্থ্যব্যবস্থায় জেনারেল প্র‍্যাক্টিশনারের গুরুত্ব হবে সর্বাধিক। আমরা উল্টোপথে হাঁটব??

বাই দ্য ওয়ে, ওনলি এমবিবিএস কথাটা যিনি বললেন, জাস্টিস অসীম কুমার ব্যানার্জি, খুঁজে দেখলাম, তাঁর ডিগ্রি বলতে বিএ এলএলবি। ওনলি ব্যাচেলর ডিগ্রি - উইদাউট এনি মাস্টার ডিগ্রি। ইদানীং তো আইনবিদ্যায় মাস্টার ডিগ্রি - এলএলএম বা পিএইচডি - সবই হয়। বিচারপতি হতে গেলে - এমনকি হাইকোর্টের বিচারপতি - দুরূহ মামলার জটিল যুক্তি বিচার করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্যে অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট, ডিগ্রী নয়। কিন্তু, চিকিৎসার ক্ষেত্রে, অভিজ্ঞতার বিচার নয়, শুধুই ডিগ্রীর হিসেবই শেষ কথা?? 

বিচারপতিরা কি বাড়িতে আয়না রাখেন না? দাড়ি কামান কীভাবে??

সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

আগ্রাসন – ফিরে দেখা ~ রাজা সিংহ

বাংলার থুড়ি কলকাতার বুদ্ধিজীবী কুলে গেল গেল রব, বিহারি, গুজরাতি, মারাঠি, কাশ্মীরি, এস্কিমো সবাই মিলে নাকি কলকাতার কালচার গ্রাস করে ফেলছে। তারা বাংলা বলে না, তারা হনুমান পুজো করে, করওয়া চৌথে সোনালি চুমকি বসানো লাল শাড়ি পরে য়সরাজ ফিল্ম বা সুরজ বরজাতিয়ার ফ্যামিলি ড্রামার ধরণে ছাদে গিয়ে চালনি দিয়ে চাঁদ ও বরের মুখ দেখে। আগ্রাসন বলে আগ্রাসন। এমন তেজের সঙ্গে স্বয়ং অগ্নিদেবতাও বোধহয় খাণ্ডবদাহন করেন নি।  কলকাতার বুকে (আজ্ঞে বাঙলা মানে তো কলকাতাই) বুকে রাজস্থান আর গুজরাতের মহল্লা নাকি বেড়ে উঠছে ফনফন করে। এক ভয়াবহ চক্রান্তের করাল ছায়া ধীরে ধীরে গ্রাস করছে বঙ্গদেশকে। ঠিক কি না? কান পাতুন চারদিক থেকে ধ্বনি উঠবে ঠিক ঠিক।

এবার একটু অন্যভাবে দেখা যাক।  আমার শৈশব ও কৈশোরের বেড়ে ওঠা বিহারের এক প্রত্যন্ত শহরে। শহরটি ছিল দুইভাগে বিভক্ত,  দুর্গন্ধময় নালা, পুরনো রংচটা গায়ে গায়ে লাগানো কদর্য বাড়ি, শ্যাওলা পড়া প্রায়ান্ধকার গলির সিভিল এরিয়া আর চওড়া পিচ রাস্তা, সবুজ মাঠ, লাইব্রেরী, থিয়েটার হল, ফুটবল মাঠ আর সুন্দর কোয়ার্টারে ঘেরা রেলওয়ে কলোনি। সিভিল এরিয়ায় বাস ছিল স্থানীয়, বিহারি, ভোজপুরি অর্থাৎ বিহারের স্থানীয় বাসিন্দাদের আর সুন্দর সাজানো রেলওয়ে কলোনি জুড়ে ছিল বাঙালী রেল বাবুদের বাস। সেই ছোট্ট শহরটিতে অন্তত: পঞ্চাশটি দুর্গাপূজা হত। আর এত ধুমধাম আর খরচ করে দুর্গাপুজো হত যে তাদের স্থানীয় ও সর্ববৃহৎ উৎসব ছটপুজোতেও অমন চাকচিক্য ও জাঁকজমক চোখে পড়ত না। বাঙালির বারোমাসে তেরো পার্বণের যাবতীয় উপকরণ তা শীতল ষষ্ঠীর তালপাতার পাখা, কচি বাঁশের কোড়ল, ডাঁট শুদ্ধ খেজুর যেমন বিক্রি হত তেমনি লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতীপুজোর যাবতীয় উপকরণের মেলা বসে যেত উৎসবের দিনগুলিতে। আড়াইটি বাংলা স্কুলে নিয়ম করে পালন হত রবীন্দ্র-নজরুল। বাংলার সংস্কৃতি ধরে রাখার যাবতীয় বন্দোবস্ত ছিল সেখানে। চাকুরীজীবী বাঙালীরা শুধু যে স্থায়ী বাসস্থান গড়ে তুলেছিলেন তাই নয় তাদের সংস্কৃতি, উৎসব সব কিছুই বজায় রেখেছিলেন বহুল প্রাচুর্যে। 

দেওঘর, গিরিডি, যশিডি, শিমুলতলা এদিকে বেনারস, এলাহাবাদ, কানপুর, দিল্লী, মুম্বাই, পুনে তে বঙ্গ-সন্তানেরা তাদের উৎসব, সংস্কৃতির চর্চা অব্যাহত রেখেছেন বহু বছর ধরে। বাবার চাকরি সূত্রে ঘুরতে হয়েছে বহু জায়গায়। কোথাও শুনি নি, সেখানকার বাসিন্দারা আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেছে, মার শালাদের, আমাদের উৎসব সংস্কৃতি বানের জলে ভেসে গেল, সবই  গ্রাস করে ফেলছে এই বঙ্গ-পুঙ্গবরা। আজ নয় বহু বছর ধরেই বাঙালি যে শহরে বাসা বেঁধেছে তারা নির্মাণ করেছেন কালীবাড়ি। দিল্লী, পুনে, মুম্বই, ব্যাঙ্গালোর কোথাও তার ব্যতিক্রম নেই। স্থানীয় মানুষকে বলতে শুনি নি এই রে, এবার তো আমাদের আইয়াপ্পা মন্দিরের কিংবা গণেশ টেম্পলের খ্যাতিতে ভাগ বসবে। 

আজ ব্যাঙ্গালোরের যে কোন রেস্টুরেন্টে ঢুকে আমি নির্দ্বিধায় যে কোন ওয়েটারের সাথে বাংলায় কথা বলি। কারণ তাদের নব্বই শতাংশ বাঙালী। শুধু ব্যাঙ্গালোর কেন খোঁজ নিয়ে দেখুন গত তিরিশ বছরে ভারতের অন্যান্য সব শহরগুলিতে বাঙালির সংখ্যা বেড়েছে হু-হু করে। তারা ভাগ বসিয়েছে স্থানীয়দের কর্মসংস্থানে। কলকাতা থেকে বেড়াতে আসা বন্ধুবান্ধবরা বেশ গর্বের হাসি হেসে বলেন, 'বাওয়া সব জায়গায় বাঙালি, অ্যাঁ?' শপিং মলে দক্ষিনী পাঁপড়ের পাশেই বাংলা হরফে লেখা গোবিন্দ ভোগ চালের প্যাকেট, বাংলার বড়ি, খেজুর গুড়। মাছের দোকানে আঁকাবাঁকা বাংলা হরফে লেখা 'এখানে কলকাতার মাছ পাওয়া যায়।' দক্ষিণের মত ভাষা সচেতন প্রদেশগুলিতে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর ধরে বসবাসকারী বাঙালিরা বেশীরভাগই এখনো স্থানীয় ভাষা শেখেন নি। খোদ ব্যাঙ্গালোরের বুকে হ্যাল মার্কেট যেন লেক-মার্কেট বা গড়িয়া-হাট মার্কেটের মিনি সংস্করণ। স্থানীয় বাসিন্দাদের কখনো বলতে শুনিনি, এইরে এই বঙ্গ-সন্তানেরা তো মিনি কলকাতা বানিয়ে ফেলেছে। তাদের কেন মনে হয় না, তাদের মহল্লা, টোলা, হাল্লি গুলো সব বাগবাজার, বৌবাজার কিংবা বাঘাযতীন হয়ে যাচ্ছে। এমনই তো হবে, চাকরি কিংবা ব্যবসার সূত্রে মানুষ বহমান হবে এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে, সাথে করে নিয়ে আসবে তাদের খাদ্যাভ্যাস, ভাষা, সংস্কৃতি, অচেনা প্রদেশে গড়ে তুলবে তাদের সুখ-বসত বা কমফোর্ট জোন। সেখানে পালন করবে তাদের নিজস্ব উৎসব। গড়ে তুলবে নিজের প্রার্থনা-ক্ষেত্র। বাংলার বাইরে ছড়িয়ে থাকা ও ছড়িয়ে পড়া বাঙালিদের উৎসব, সাহিত্য, সংস্কৃতি পালন দেখতে যদি আপনাদের ভালো লাগে, বেশ 'অ্যাট হোম' বোধ হয় তবে একই জিনিস বাংলার বুকে প্রত্যক্ষ করলে এত প্রতিরোধ কেন? বাঙালি রিক্সা টানবে না, মোট বইবে না, ঠেলা চালাবে না। সে কাজ নির্দ্বিধায় তুলে নিল শ্রমজীবী বিহারের লোক। দিনের শেষে বাড়ি ফিরে তারা মাছ ভাত কেন খাবে? তারা লিট্টি চোখাই খাবে। তারা কৃত্তিবাসী রামায়ণ নয় বরং তুলসিদাসী রামায়ণ ও হনুমান চালিশাই পড়বে। সুদূর মারোয়ার, গুজরাত থেকে ব্যবসা করতে আসা মানুষজন নিজের চেষ্টায় গড়ে তুলেছে, বাড়িয়েছে বাণিজ্য। তারা পালন করবে তাদের চৌথ, তিজ কিংবা রাস উৎসব। যেমন আমরা করি 'বছরে তেইশ বার চিত্রাঙ্গদা আর শ্যামা, শাপমোচনের অশ্রুমোচন, বাংলায় কিংবা বাংলার বাইরে। 

বাংলার বুদ্ধিজীবীদের এই হঠাৎ 'তফাৎ যাও' মনোভাব যদি ছড়িয়ে পড়ে দেশে এবং বিদেশেও, বাংলার বাইরে বসবাসকারী বাঙালিদের কিন্তু এর মাসুল গুণতে হবে পুরোদস্তুর। যেমন নিউটন সাহেব তার তৃতীয় সূত্রে বলেছেন আর কি।

কুড়ি বছর আগের সেন্সাস অনুযায়ী ভারতবর্ষে হিন্দি ভাষীর সংখ্যা (তেরটি রাজ্য মিলিয়ে) ৫৩.৬ শতাংশ ছিল। তার পরেই ইংরেজি, ৪১ শতাংশ। এটা কুড়ি বছর আগের অর্থাৎ ২০০১ এর সেন্সাস। তার মানে দাঁড়ায় একটি 'নানা ভাষার দেশে' এই দুটি ভাষা 'মাস ল্যাঙ্গুয়েজ' বা 'মাস কমিউনিকেশন ল্যাংগুয়েজ'   হিসেবে কাজ করতে পারে। ঠিক তার ভিত্তিতেই স্থানীয় ভাষার পাশাপাশি, হিন্দি ও ইংরেজির ব্যবহার হয় রেলওয়ে স্টেশনের নেম-বোর্ড হিসেবে। ওড়িয়া বা কোঙ্কনি ব্যবহার হয় না।
আর কেন এই তেরোটি প্রদেশ হিন্দি বলেন, বোঝেন তার কারণ হিসবে স্থানীয় ভাষার উৎপত্তিগত ছোট্ট চার্টটি দিলাম। এবার হিন্দি প্রচার প্রসারের জন্য সরাসরি দেবভাষাকে দোষারোপ করতে পারেন। 

আর যারা চান স্থানীয় ভাষাই হোক কমিউনিকেশন ল্যাঙ্গুয়েজ তাদের বলি শুধু স্থানীয় ভাষায় বাস, ঠিকানা, দোকান ইত্যাদি লেখা থাকলে যে কি পরিমাণ অসুবিধেয় পড়তে হয় তার চাক্ষুষ প্রমাণ দেখা যায় বাংলা থেকে দক্ষিণে বেড়াতে, ডাক্তার দেখাতে আসা বাঙালির বিরক্তি ও হতাশা দেখলে।  

'মাস কমিউনিকেশন ল্যাঙ্গুয়েজ' না থাকলে আপনাকে ২৯টি রাজ্য সাতটি ইউনিয়ন টেরিটরিজ এর ভাষা শিখতে হবে, পড়তে ও বলতে পারার মত। আমার কিছু শ্রদ্ধেয় বন্ধু যারা 'আগ্রাসনের' ধুয়ো তুলেছেন তাঁদের কেউ কেউ বাংলার বাইরে তাঁদের গোটা চাকুরী জীবন স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে, বাংলায় ফিরে গেছেন স্থানীয় ভাষাটি বিলকুল না শিখেই। কি ভাবে? ঐ 'মাস কমিউনিকেশন ল্যাঙ্গুয়েজ' – ইংরেজি বা হিন্দির কল্যাণে। কোন ভাষা সেই প্রয়োজন মেটাবে তা নির্ভর করবে তা নির্ভর করবে কয়েকটি বিষয়ের উপর ১। তার বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে সেই ভাষার ব্যবহার। এই প্রয়োজন মেটাতেই বাঙালি একদিন ইংরেজ প্রভুর ভাষা আত্মস্থ করেছিল। ২। ভাষার সহজবোধ্যতা – এটি না থাকলে সে ভাষার প্রচার ও প্রসার মুশকিল, তার আদ্যন্ত প্রমাণ মালয়ালম ভাষা, এমনকি দক্ষিণের তামিল, তেলেগু ও কন্নড়রাও স্বীকার করেন মালয়ালম শিখে নেওয়া তেমন সহজ সাধ্য নয়। ৩। সে ভাষাটি রাজভাষা কিনা (এখানে তুমুল আলোড়ন উঠতে পারে) কিন্তু একথা অস্বীকার করা যায় না যে ৭৩ বছরের বেশিরভাগ সময়টাই দিল্লীর মসনদে যারা আরোহণ করেছেন তাঁদের ভাষা ছিল হিন্দি। রাজভাষার কারণেই ভারতে ব্যুৎপত্তি পেয়েছিল ফারসি, উর্দু ও পরবর্তীকালে ইংরেজি।

স্থানীয় ভাষার সিরিয়ালে হিন্দি ব্যবহার হবে না কোঙ্কনি? তা নির্ধারণ করেন সেই সিরিয়ালের দর্শক, তাঁরা ডিক্টেট করেন টি আর পি, পরিচালক শুধু সেই নির্ধারিত দর্শক সমূহ বা টার্গেট অডিয়েন্সকে পরিবেশন করেন। তাই হিন্দি ব্যবহার অগ্রাহ্য করে নিজের ভাষাটিকে আরও আরও বেশি জনপ্রিয় করলে তা কাজ দেবে বেশি।

আমার এক প্রিয় সুহৃদের প্রশ্নের উত্তরে বলি, 'না দক্ষিণে হিন্দি 'চাপিয়ে' দেওয়া সম্ভব হয় না।' বরং এঁরা যথেষ্ট সুচারু ও নির্মম ভাবে, স্থানীয় ভাষা চাপিয়ে দেন। বাংলায় কোন ব্যাঙ্কে গেলে তাকে হিন্দিতে কথা বলতে বাধ্য করা হয় এমন তথ্য আমার জানা নেই। তবে দক্ষিণে সমস্ত সরকারি আপিস, কাছাড়ি, প্রপার্টি রেজিস্ট্রেশন থেকে ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন সব ফর্ম স্থানীয় ভাষায় লেখা। তাঁরা কিছুতেই অন্য ভাষায় কথা বলবেন না। আমার এক সুহৃদ একটি অ্যাকসিডেন্ট কেসের কারণে বাধ্য হয়েছিল কন্নড় শিখতে। কারণ পুলিশ এবং তার আইনজীবী মায় জজ সাহেব পর্যন্ত কেউ তাঁর সাথে মাস কমিউনিকেশন ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করেন নি কঠোর এবং স্বেচ্ছা অভিপ্রেত ভাবে। এই চাপিয়ে দেওয়া গুলি কিন্তু আমার মত অনেকেরই যথেষ্ট অসুবিধের কারণ হয়, আপনারও হবে। তাই চাপিয়ে দেওয়াটা যে একতরফা নয় সেটা বুঝতেই পারছেন। সেই অসুবিধেটা আপনিও করবেন কিনা ভেবে দেখবেন।

আরও একটা কথা দক্ষিণে স্থানীয় ভাষাগুলিকে সংরক্ষণ করা হয় নিষ্ঠাভরে। তাঁরা শুধু উষ্মা প্রকাশ করে ক্ষান্ত থাকেন না। শিক্ষক, পুলিশ, প্রযুক্তিবিদ, নাট্য-ব্যক্তিত্ব এমন কি ওলা ড্রাইভার নিখরচায় কন্নড় ক্লাস করান সপ্তাহান্তে অস্থানীয় ভাষাভাষীদের জন্যে। হাতে গুনুন তো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো মানে নিজের গাঁটগচ্চা দিয়ে নিজের ভাষা শেখানোর কটি প্রকল্পের সাথে আপনি জড়িত। 

আরেকটা কথা বলি, আগেই বলেছি রাজভাষা শিখতেই হয়, বাংলার মতই দক্ষিণেও বা সারা ভারতবর্ষেই 'ব্যবসাজীবি' যে সম্প্রদায়রা রয়েছেন তাঁরা কিন্তু স্থানীয় ভাষা শিখে নিয়েছেন পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে। হ্যাঁ তাঁদের উচ্চারণ নিখুঁত নয়, যাকে বলে অ্যাক্সেন্টেড। তা সে তো ইংরেজির ক্ষেত্রেও হয় বাঙালি থেকে অস্ট্রেলিয়ান সবার ইংরেজিতেই স্থানীয় প্রভাব রয়েছে এবং তা স্বীকৃত।

যারা প্রবাসে বাঙালিদের লাঞ্ছিত হতে হয় বলে কমেন্ট করেছেন, সে উত্তর গুলি এখানে দিলাম না, কারণ সে অন্য প্রসঙ্গ। এই পোস্টের উদ্দেশ্য ছিল 'চাপানো' সংস্কৃতি বা কালচার শাঁখের করাতের মত। তাই  নিজেকে সেখানে বসিয়ে দেখা যায় কি না। 

অনেকে উল্লেখ করেছেন বটে তবে প্রবাসের যাতনা নিয়ে এ পোস্ট নয়।  আমার কাছের এক দক্ষিণী মানুষ যারা তিনপুরুষ কলকাতায় এবং যে কোন বাঙালির মত স্বচ্ছন্দ বাংলা বলেন তাকেও মাঝে মধ্যে তির্যক 'তেঁতুল' মন্তব্যটি শুনতে হয়। 'খোট্টা, মেড়ো, গুজ্জু' শব্দগুলি বাঙালি শব্দ ভাণ্ডারে এমনি এমনি উঠে আসে নি। না কারো প্রবাস জীবনই ফুলশয্যা হয় না। তাই বিহারে আমাদের যখন 'বঙ্গালী মচ্ছি কা কাঙ্গালি'  বলে কৌতুক করেছে তখন আমরাও 'বিহারী ভূত, খাটিয়া পর সুত, টিক্কি মে আগ লগি, ধরফড়াকে উঠ' ইত্যাদি বলতে ছাড়ি নি। আরও আরও অনেক আছে। বাঙালিদের উদার মেলামেশার  সংস্কৃতির জন্য বাঙালি মেয়েদের সহজলভ্য মনে করা হয়েছে। এমন অনেক আছে। যেমন 'জাদু-টোনাওয়ালি বঙ্গালন' আপনি শুনেছেন তেমনি আসামের নারীরা যুগ যুগ ধরে তকমা বয়ে বেরিয়েছেন যে তারা পুরুষদের 'ভেড়া' বানিয়ে রাখেন। কিন্তু সে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গ, এগুলির সাথে ভাষার আগ্রাসনের সম্পর্ক নেই। আছে মানসিকতার, মানবিকতার সম্পর্ক।