মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল, ২০২০

হিন্দু মুসলমান বিদ্বেষ ~ ডঃ রেজাউল করীম

ক্রিষ্টোফার মার্লোর নাম সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীদের অজানা নয়।তাঁর The Jews of Malta নাটক ইউরোপ জুড়ে  ভরপুর ইহুদি বিদ্বেষ ছড়ায়।ষোড়শ শতকে রডরিগো লোপেজ নামে একজন চিকিৎসক  যিনি  রাণীর ব্যক্তিগত চিকিৎসার কাজে নিয়োজিত ছিলেন, রাণীকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্রে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। রাণী নিজেও জানতেন যে এই অভিযোগ মিথ্যা কিন্তু সাকেক্সের ডিউকের  অভিযোগে ও প্রাসাদের ষড়যন্ত্রীদের প্রত্যক্ষ মদতে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র, এই চিকিৎসকের প্রাণদণ্ড হয়। তিনি জন্মসূত্রে ইহুদি ছিলেন। কিন্তু, পরে তিনি খৃষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হন। তাঁর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগের একটা ছিল যে তিনি লুকিয়ে ইহুদি ধর্ম পালন করেন। এর ফলে সারা ইউরোপ জুড়ে ইহুদি বিদ্বেষ  আরো বেড়ে যায়।সমসাময়িক কালে লেখা মার্চেন্ট অব ভেনিস বা জুস অব মাল্টাতে যে প্রত্যক্ষ ইহুদি বিদ্বেষ দেখা মেলে ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দশকে সেটাই ছিল ইউরোপের চলতি সংস্কৃতি। মার্লো নিজে নাস্তিক হলেও ইহুদি চরিত্রটিকে এমন খলনায়ক বানিয়েছিলেন যে বিদ্যাসাগর মহাশয় থাকলে চটি জুতো অবধারিত ছিল।

বিদ্বেষের কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের অভাব থেকে হয়। ইহুদিদের সম্পর্কে তৎকালীন ঘৃণা যা চারশো বছর পরে 70 লক্ষ ইহুদি হত্যায় পরিণতি লাভ  করেছে তার এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি, শুধু ধরন পাল্টেছে।  মধ্য এশিয়া জুড়ে জিওনিষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই দাঁড়িয়েছে ইহুদিদের বিরুদ্ধে লড়াই  হয়ে। ধর্ম, সম্প্রদায়, রাজ্য ও বিশেষ ধর্মের মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের জটিলতা ও টানাপোড়েন কেউ বুঝতে চাননি। সাধারণীকরণ করেই ক্ষোভের পরিসমাপ্তি করতে চান। একজন শত্রু পেলেই হল, তার ঘাড়ে সব কলঙ্কের ভার চাপিয়ে সাময়িক মানসিক শান্তি।

ইহুদিদের যে বর্ণনা সেক্সপিয়র দিয়েছেন তার সাথে মার্লোর বর্ণনার কোন ফারাক তেমন নেই। "that Jew: he lives upon pickled grasshoppers and sauced mushrumps … He never put on clean shirt since he was circumcised"  নোংরা, জঘন্য, যা-তা খায়, যা-তা পরে, চান করে না ইত্যাদি। 

আমার চেনা একজন বিপ্লবী ডাক্তার আমাকে পড়াতে গিয়ে বলেছিলেনঃ মুসলমানদের এত টিবি হয় কেন জানো? আমি বললামঃ পুষ্টির অভাবের জন্য। পুষ্টি ও টিবির ঘনিষ্ট সম্পর্ক। তিনি বললেনঃ তুমি জান না। ওরা থুতু গিলে ফেলে। একটা পুরোপুরি অনৈচ্ছিক ক্রিয়া যে কি করে সম্প্রদায় বিশেষে পরিবর্তন হয় কে জানে? কিছুদিন পর মুসলিমদের রমজান মাস চলছে। আমি কলকাতা থেকে বহরমপুর যাবো। ট্রেনে যাতায়াত করতাম না। বাসে টিকিট কেটেছি । তিনি আমাকে খুব ভালবাসতেন, বললেন, "বাসে যাবে না।" মুর্শিদাবাদের মুসলমানরা বাসে যাবে, সারা রাস্তা থুথু ফেলতে ফেলতে যাবে"। আমি তো থ। হতে পারে কেউ থুথু গিলে ফেলে, কেউ রাস্তায় ফেলে- এর সাথে ও যে ধর্মের প্রত্যক্ষ যোগ আছে তা শুনে অবাক হয়েছিলাম। শুনেছি তিনি একসময় বড় বিপ্লবী ছিলেন। অথচ, কেবলমাত্র শিক্ষিত আচরণ ও অশিক্ষিত আচরণে সাম্প্রদায়িক রং লাগাতে তার বাধে নি। তিনি সাম্প্রদায়িক এটা কখনো সত্য ও নয়। মনকে শিক্ষিত না করতে পারলে এই চেতনা অবলুপ্ত করা সম্ভব নয় ।

আজকের মধ্য এশিয়া জুড়ে ইহুদিরা শুধু Dog- ইহুদি কুকুর। অথচ, লোপেজের মৃত্যুর 428 বছর পরে বিশ্বে নোবেল লরিয়েটদের তালিকা বানালে হয়তো বার আনাই ইহুদি বলে দেখা যাবে। যারা ঘৃণা করতো, যারা ঘৃণা করে ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম কালো অক্ষরে লেখা আছে। কিন্তু, ঘৃণিতরা উঠে দাঁড়ায়। তারা যেন তাদের সব কালোকে বজ্রে আগুন করে তোলে। ইহুদি রাষ্ট্র বিদ্বেষ আর ইহুদির প্রতি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এক নয় আজকের আরব এখনো সেটা বুঝতে পারছে না।

একবিংশ শতক তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লব ঘটিয়েছে। অন্য মানুষকে চেনা, জানা বা বোঝার জন্য উইলিয়াম মূয়রের মত সাধনার দরকার নেই। ভাষা বা সংস্কৃতি ও বড় বাধা নয়। শুধু আবশ্যকের ঠেলাঠেলি ভীড়ে অনাবশ্যক নিয়ে কৌতুহলের অবকাশ নেই। তাছাড়া, অন্যকে জানতে চাইনে কারণ আর জানার কিছু বাকি নেই,  সবকিছু জানি,  এই অন্ধ বিশ্বাস  অহমিকা ও গরিমা বড় তখন শত্রু হয়ে ওঠে। কিন্তু, জগতের নিয়ম হল সবার জন্য মঙ্গল কামনা না করলে নিজের মঙ্গল হয় না। কল্যাণের বদলে কল্যাণ আর ঘৃণার বদলে ঘৃণা ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না।

অজানার প্রতি ভয়, শঙ্কা আর তা থেকে আসে ঘৃণা। করোনা চিকিৎসা করে ফিরে আসা ডাক্তারের দিকে তাই ছুটে আসে ঘৃণার তীর। কত অক্লেশে সমাজের উদ্বেলিত ঘৃণার পাহাড়  গড়ে তোলে "Ay policy! That's their profession, / And not simplicity as they suggest." তুমি তো এমনি, তোমাদের পুরো পেশাই হল কলঙ্কিত। যতই তুমি ভালো মানুষ সাজো, আসলে তোমার মধ্যে আছে এক লোভী,অর্থগৃধ্নু, টাকার কাঙাল, অমানুষ। Reductio ad absardum তত্ত্ব সপ্রমাণে উন্মুখ সমাজের সেই সমষ্টিগত চিন্তার প্রতিফলন হয় সাংবাদিকের ভাষ্যে, খবরের কাগজের পাতা জোড়া চিকিৎসকের অমানবিক গল্পে, ফেসবুকের ওজস্বিতা বা নেতার অশিক্ষিত কথনে। মায়া, স্নেহ, মমতা হীন একদল মানুষ- কোন কিছু যাদের মথিত করে না। 

"First, be thou void of these affections: Compassion, love, vain hope, and heartless fear; Be moved at nothing; see thou pity none." না, এই বর্ণনা আধুনিক তথাকথিত ভিলেন চিকিৎসক সংক্রান্ত সাধারণ ভাষ্যের সাথে যতই অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাক এ বর্ণনা আসলে একটি সম্প্রদায় সম্পর্কে ষোড়শ শতাব্দীর প্রান্তদেশে আরেক সম্প্রদায়ের বর্ণনা। ঘৃণার ভাষা অত্যন্ত ক্লিশে- একের নাম পাল্টে অন্যের নামে তা চালান করার জন্য বিশেষ বাহাদুরি লাগে না। 

কয়েকদিন আগে কয়েকজন ডাক্তারের লেখা সাম্প্রদায়িক  কিছু কথা নিয়ে ফেসবুক মুখরিত ছিল। সে ছিল ঘৃণার ভাষা- সমাজের সুপ্ত সাম্প্রদায়িক স্রোতে গা ভাসিয়ে তারা যা লিখেছে সবটা তার সচেতন বহিঃপ্রকাশ নয়, খানিকটা মিথ, খানিকটা সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের আকাঙ্ক্ষা। এই  এখন সমাজের চলিত ট্রেণ্ড,পরিভাষা।চোরাগোপ্তা, গেরিলা লড়াই। সরাসরি যুদ্ধ নয়। ঝিকে মেরে বৌকে শেখানোর চিরন্তন বাঙালী ঘরোয়া অপেরা।মেলোড্রামাটিক কিন্তু হাততালির অভাব হয় না। শিক্ষিত, মননশীল, সংস্কৃতিমানের কাছে মোটা দাগের রসিকতা বা farce. কিন্তু, সমাজের চালক তো আর মননশীল বোদ্ধাদের হাতে নেই, আছে উরুতে আঘাত করা ভীমের হাতে- নৈতিকতা না থাকুক, বাহুতে শক্তির অভাব নেই।তাদের লেখা যেমন অনেকের বিরক্তি ও ক্ষোভের কারণ তেমনি অনেকে সমর্থনও করেছে, আরো আরো অনেকে তার বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয়েছে। এই ভালো-মন্দ মেশানো মিশ্র সমষ্টি নিয়ে সমাজ। তার চাকা তেজে করে বলে ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। আজ যা ট্রেণ্ড,  কাল তা পুরনো ক্লিশে। 

একজন দেখলাম লিখেছে, অমর্ত্য সেন অর্থনীতি ছাড়া সব বিষয়ে নোবেল পেতে পারেন। তার উষ্মার কারণটি বাহ্য- যুগপুরুষ প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে অমর্ত্য সেন একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। বোঝা খেল প্রবন্ধটি তিনি পড়ার প্রয়োজন মনে করেন নি। কারণ, এই লেখাটিতে তিনি তাঁর চিরাচরিত তাত্ত্বিক কথা না বলে বরং শাসকের প্রতি কিছু উপদেশ দিয়েছেন। যা শুনলে আখেরে তাদের লাভ ই হবে। এরা কেউ সরাসরি তাঁর মুখ থেকে  তার কথাশোনে নি, তাঁর লেখা পড়ে নি কিন্তু তবু "তিনি খারাপ, তিনি নোবেল পাননি, তিনি অর্থনীতির কিছু বোঝেন না"। অথচ, যারা তার লেখা পড়েছে, তাঁর সাথে দ্বিমত হতে পারেন কিন্তু তাঁর জ্ঞানের দীপ্তি, চিন্তার প্রখরতা, ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস নিয়ে তাঁর গভীর চর্চা, মমত্ববোধ ও ভালবাসার কথা অনুভব করবেন। তাঁর একটি সুনির্দিষ্ট সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে, সে দায়বদ্ধতা ও তার অবশ্যম্ভাবী রাজনৈতিক চেতনা অন্য কারো চেতনার বিরোধী হতে পারে কিন্তু তার লেখায় অন্যের প্রতি কোন অসূয়া নেই, মালিন্য নেই, কলহের মোটা দাগের রূঢ়তা নেই। বস্তুতঃ তাঁর মতো পণ্ডিত অতি বিরল। অর্থনীতির জটিল তত্ব কিম্বা জটিল দার্শনিকতা কত সুমধুর, নান্দনিকতায় ভরপুর তা তাঁর মুখে না শুনলে অনুভব করা অসম্ভব।তাঁর লেখা উচ্চ মার্গের সাহিত্যিক উপাদানেও ভরপুর, তার তাত্বিক মেধার উচ্চতা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই অবশ্য। সে তত্ত্ব  যত অন্যের বেহেড অজ্ঞনতা পরিস্ফুট করে তোলে তার প্রতি ঘৃণা সেই হারে প্রকট হয়ে ওঠে। অবশ্য, রবীন্দ্রনাথকেই বা সমসাময়িক ভারত কতটা বুঝেছিল? গান্ধী ও কি তাঁর কবি সত্ত্বার ব্যাপ্তি ততটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন? 

মুসলমানদের ধর্মান্ধতা ও ধর্মের রীতিনীতি নিয়ে বাচালতা  গত কয়েক দশকে বাড়তে বাড়তে ষোড়শ শতকের ইহুদিদের মত অবস্থায় পৌঁচেছে। আজ যদি মার্চেন্ট অব ভেনিসে সেক্সপিয়র বা জুস অব মাল্টায় মার্লো যা লিখেছিলেন সেখানে  jews বদলে মুসলিম করে দেওয়া হয় ফেসবুক-ভারত বোধহয় তাকে গ্রহণ করতে অত্যুক্তি করবে না। তা বরং তাদের মানসিক স্বস্তি দেবে- শুধু, তারা কেউ স্বীকার করবেন না, তাদের মানসিক ভাবনায় মুসলমানদের সম্পর্কে যে ভয়াবহ চিত্রটি রচিত হয়েছে সেই মহাজ্ঞানটি  তারা কোন সন্ধিক্ষণে লাভ করলেন? হাজার বছর একসাথে কাটালেও কেউ তো একবার অন্যের উঠোনে বা রান্নাঘরে উঁকি মেরেও দেখেনি এরা কতটা আলাদা, কতটা বেমানান, কতটা অর্বাচীন, কতটা পাপী, কতটা দেশদ্রোহী!  কেউ তো মূহুর্তে তরে ও ভাবেন নি, এই লোকগুলো আদতে ধর্মটাকেই বা পাল্টাতে গেছিল কেন? এরাও কি "ইহুদিদের মত" "ফড়িংয়ের আচার "(!) খায়? দিনরাত পাকিস্তান জপ করে? না, যে মানসিকভাব মুসলমানদের সম্পর্কে সব খারাপকেই বিশ্বাস করতে শেখায় সে শিক্ষা এরা কেউ পুঁথিগত ভাবে পায় নি, তারা সমাজের অন্তর্লীন নিস্তব্ধ স্রোত থেকে লাভ করেছেন।হিন্দু, খৃষ্টান ও ইহুদিদির সম্পর্কে মুসলমানের ঘৃণার ইতিহাস ও প্রায় এক। হিন্দু তবু বাকিদের রেহাই দেয়। মুসলমান কাউকে ছাড়ে না। ব্যক্তির অন্যায়ের বোঝা সম্প্রদায়ের উপরে চাপানোর শিক্ষা ও এসেছে পরিবার থেকে। এ শিক্ষা কোন বিদ্যালয়ে পড়ানো হয় না।  তার সাথে যুক্ত হয়েছে নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে চেতনার অভাব। "হিন্দু" বলতে যে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আচার সেখানে অপরকে ঘৃণার কোন প্রয়োজন নেই, সব বিভিন্নতাকে গ্রহণ করেই তার ব্যাপ্তি। নিজের সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতা যে হীনমন্যতা তৈরী করে তা সর্বনেশে, নিজের সব শুভ আর কল্যান শুষে নিয়ে হৃদয়বৃত্তি ধ্বংস করে নিষ্প্রাণ করে তোলে। অতীতে এই ঘটনা ঘটেছে, ভবিষ্যতে ও ঘটবে। ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। লোপেজ যেমন ঘৃণার আগুনে দগ্ধ হয়েছিলেন, মার্লো তার কাহিনি লিখেছেন। ব্যক্তি জীবনে মার্লো স্পাই ছিলেন। লোপেজের কথা রাবাবাসের চিন্তায় ফিরে ফিরে আসে- একজন অর্থগৃধ্নু, ঘৃণিত ইহুদির সার্থক চিত্রায়ণ। শেক্সপিয়রের মতো মোটে নয়। সাইলকের চরিত্রে একজন দুঃখী মানুষ ফুটে ওঠে। কিন্তু মার্লোর ইহুদি চরিত্র বিলক্ষণ ঘৃণার পাথর কুঁদে তৈরী। কি নির্মম পরিহাস যে মার্লো প্রায় একই ভাবে ধর্মদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। যে লেখকের লেখায় একসময় উঠে এসেছে ধর্মের অসারতার কথাও "I count religion but a childish toy/And hold there is no sin but ignorance" তার কাছে এটা খুব একটা আশ্চর্যের কথা ছিল না। তবে, মার্লোর মত বড় লেখকের হাত দিয়ে এরকম অপরিপক্ক লেখা অসম্ভব ছিল।মার্লোকে যখন ধর্মদ্রোহীতার অপরাধে অভিযুক্ত করা হয় তখন  যে প্রমাণ দেখানো হয় তা ছিল ক টুকরো কাগজ। তাতে  সেখানে লেখা ছিল
" He affirmeth that Moses was but a Juggler
- That the first beginning of Religion was only to keep men in awe
- That Christ was a bastard and his mother dishonest" মার্লো এই অকবিতা লিখতে পারতেন না তা তার লেখা যে কোন একটা নাটক পড়লেই বুঝবেন (downliafable).
অবশেষে একদিন এক প্রাইভেট পার্টি চলাকালীন তার চোখে ছুরি ঢুকিয়ে খুন করা হয়। মৃত্যুর আসল কারণ জানা না গেলেও ধর্মীয় ঘৃণা একমাত্র না হলেও অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। 
জানিনা কোন দিন দুই খণ্ড সত্বার মিলন হবে কিনা! তবে, অনেকের মতো আমার ও স্বপ্ন ঘৃণার পাহাড়ে অন্তহীন পথ চলা কোন একদিন শেষ হবে। নতুন সূর্য উঠবে পাহাড়ের গা বেয়ে, সেই ভারতের মহামিলনের সাগর তীরে ভবিষ্যতে মানুষ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে- হিন্দু মুসলমানের ছদ্ম পরিচয়  সেখানে গৌণ হয়ে উঠবে।

"এ ভারতভূমি নহেকো তোমার, নহকো আমার একা,
হেথায় পড়েছে হিন্দুর ছাপ,- মুসলমানের রেখা;
-হিন্দু মনীষা জেগেছে এখানে আদিম উষার ক্ষণে,
ইন্দ্রদ্যুম্নে উজ্জয়িনীতে মথুরা বৃন্দাবনে!
পাটলিপুত্র শ্রাবস্তী কাশী কোশল তক্ষশীলা।
অজন্তা আর নালন্দা তার রটিছে কীর্তিলীলা!
                                     -ভারতী কমলাসীনা
কালের বুকেতে বাজায় তাহার নব প্রতিভার বীণা!(জীবনানন্দ)"

(21শে এপ্রিল। 2020)

শনিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২০

করোনা হবি ~ ডাঃ তপোব্রত বসু

কত রকমের যে হবি রয়েছে জগতে !

ক্লাস সিক্স থেকে মেয়েদের প্রেমপত্র পাঠানো মনোজিৎ এখন মাস্টার হয়েছে। সে  ছোট থেকেই প্রেমপত্র থেকে খুলে খুলে ডাক টিকিট জমায়।

বুড়ো আমাদের বন্ধুদের সবাইকেই ক্লাস ফাইভে বিড়ি খেতে শিখিয়েছিল,  সে সেই স্কুল জীবন থেকেই দেশলাই বাক্স জমায়।

আমার ছোটকাকা, এখন মারা গ্যাছেন, তিনি পুরনো গানের রেকর্ড জমাতেন। 

আমার এক বন্ধু আছে বুবাই। আই টি  সেক্টরে। কথায় কথায় চাকরি ছাড়ে। সন্ধেবেলার আড্ডায় প্রায়ই বলে, আজ ম্যানেজারের মুখের ওপর পাতা ফেলে দিলাম। পকেটে রেজিগনেশন লেটার নিয়েই অফিস আসে। এত চাকরি ব্যাটা পায় কিকরে সেটাই রহস্য। সে হারামজাদা আবার একটা ফাইল বানিয়ে তাতে এপয়েন্টমেন্ট লেটার জমায়।

মামাতো ভাই গাবুল, সে জমায় দেশি বিদেশি মুদ্রা। নতুন যখন দশ টাকার কয়েন বেরোল, ট্রেনে করে বাঁকুড়া থেকে ডালহৌসি এসে জিপিও র সামনে থেকে পনের টাকা দিয়ে দশ টাকার করেন কিনে নিয়ে গেছিল। আমি ওকে মুদ্রারাক্ষস বলে ডাকি।

আমার নিজের কাছেই নতুন পুরোনো মিলিয়ে চারটে বুলেট মোটরসাইকেল আছে। বলতে পারেন আমি বুলেট জমাই।

আমার বউ যেমন আমার করা ভুলগুলোকে যত্ন করে জমায়। আমি বিয়ের পর থেকে কবে কি ভুল বলেছি আর ভুল করেছি সেগুলো পোঁটলা বেঁধে জমিয়ে রাখে, এখনো প্রতিদিন জমাচ্ছে।

ছেলে পেন জমাচ্ছে। এটা বোধহয় আমরা সবাই ছোটবেলায় জমাই।

পাগলা চিরঞ্জীব ডজন খানেক হার্ড ডিস্ক কিনে তাতে যত রাজ্যের বইয়ের পিডিএফ জোগাড় করে জমাচ্ছে।

আপনারা জ্ঞানী গুণী মানুষ, হয়তো আরও অনেক হবির কথা জানেন। 

কিন্তু এই যে করোনার টেস্ট কিট জমিয়ে রাখা, এমন হবি দেখেছেন কখনো?


বুধবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২০

করোনার প্রেতাত্মা ~ ইন্দ্রনীল মজুমদার

সহসা অস্থিসন্ধি ও পেশীতে প্রবল ব্যথা অনুভব করিলাম। সঙ্গে খকখক কাশি। শ্বাসরোধ হইবার উপক্রম হইলো। গৃহিনী এক প্রৌঢ় বিলাতফেরত বৈদ্যের শরনাপন্ন হইলেন। তিনি অবিলম্বে আমাকে এক বৃহৎ চিকিৎসালয়ে ভর্তি করিয়া লইলেন। কিছু পরেই মহাকাশচারীর বেশ ধরিয়া আবার বৈদ্যমহাশয় আবির্ভূত হইলেন।
 বলিলেন, হাঁ করুন। সিগারেট কলঙ্কিত দন্ত বিকশিত করিলাম। লালারস লইলেন। হাঁ করিয়াই রহিলাম। বৈদ্য গম্ভীরভাবে বলিলেন মুখ বন্ধ করুন। করিলাম। বৈকালে সংবাদ আসিলো। সম্প্রতি এক রোগ আসিয়াছে নাকরো-৯১। উহাই আমার ফুসফুসে চাপিয়াছে। নাসিকায় নল ঢুকাইয়া বিশুদ্ধ বায়ু প্রবেশ করানো হইলো। তথাপি খাবি খাইতেছি দেখিয়া বৈদ্যমহাশয় বিজাতীয় ভাষায় বলিলেন... ভেন্টিলেটর। কিছুতেই কিছু হইলো না। সহসা ফট করিয়া একটি আওয়াজ শুনিলাম। দেখিলাম আমি জানালার ওপর বসিয়া আছি। আবার শয্যাতেও শুইয়া আছি। বুঝিলাম আমি মরিয়া গিয়াছি। ওই আমার পার্থিব দেহ। এতোদিন বৃথাই বস্তুবাদের সাধনা করিয়াছি। আজ বুঝিলাম আত্মা আছে। ঈশ্বর, আল্লা, গড, ভূত, প্রেত, ঘোস্ট, জিন, স্বর্গ, দোজখ সঅঅঅব সত্য। যাহা হউক, জানালায় ঝুলন্ত অবস্থায় সব দেখিতেছিলাম। বিলাতফেরত বৈদ্য পরিস্কার লিখিয়া দিলেন যে আমি নাকরো-৯১ রোগে মরিয়াছি। চিকিৎসালয়ের প্রধান আসিয়া বলিলেন আপনি বলিলে তো আর হইবে না। নদীর তীরে জমিদারনীর 'দুর্ভিক্ষ' নামের প্রাসাদ হইতে যতোক্ষণ না বলা হইতেছে...। বিলাতফেরত বৈদ্য জ্বলিয়া উঠিলেন। বলিলেন, আমি চিকিৎসা করিলাম... আর কি রোগে মরিলো বলিবে পঞ্চা তেলী? প্রধান জানাইলেন তিনি নিরুপায়। আর জমিদারনীর নিজেরও বিদেশী ডিগ্রী আছে। তদুপরি তিনি ৯১ টি বই লিখিয়াছেন। তাই নাকরো-৯১ রোগ সম্পর্কে  বলিবার তিনি বিশেষ অধিকারিনী। বিলাতফেরত বিখ্যাত বৈদ্য অপমানিত বোধ করিয়া চিকিৎসালয় ত্যাগ করিলেন। ধাপার মাঠে দেহের সদ্গতি হইলো।
আমার লঘু আত্মা হাওয়ায় ভাসিয়া ' দুর্ভিক্ষ' প্রাসাদে উপনীত হইলো। খুব ইচ্ছা করিতেছিলো এই প্রবলপ্রতাপশালিনী জমিদারনীকে একটি প্রণাম ঠুকিবার। প্রাসাদের সর্বোচ্চ তলে তিনি অধিষ্ঠিতা। বামপার্শ্বে বসিয়া আছেন বৈদ্যকূলের পিতামহপ্রতিম অতিপ্রবীন 'সুমু'- বাবু। দক্ষিণে বসিয়াছেন তাঁহারই ছাত্রতুল্য 'অচ'- বাবু। অচ- বাবু যকৃত লইয়া কাজ করেন। ফুসফুসের রোগের সহিত তাঁহার ওঠাবসা নাই। তবে মাঝে মাঝে কবিতা বলেন বলিয়া কবিতাপ্রেমী জমিদারনী তাঁহাকে দলে টানিয়াছেন‌। সুমুবাবু এবং অচবাবু'র মধ্যে বয়সের প্রভূত ফারাক। জমিদারনী তথাপি দুজনকেই সুমুদা এবং অচদা বলিয়া ডাকিতেছিলেন। জমিদারনী বলিতেছিলেন একটা লোক মরিয়াছে আজ। অমুক বৈদ্য বলিতেছে নাকোরো- ৯১... কি করা যায়? সুমুদার বয়স হইয়াছে। বলিয়া ফেলিলেন, ও... অমুক বলিয়াছে? খুব ভালো শিষ্য ছিলো আমার। ও যখন বলিয়াছে তখন নাকরো -৯১ হইবেই। জমিদারনীর মুখ ভার হইলো। অচদা উঠিয়া গিয়া সুমুদার কানে কানে কি বলিলেন। বৈদ্যরাজ সুমুদা যেন সহসা ঘুম হইতে জাগিয়া উঠিলেন। বলিলেন... উহার কি পূর্বতন কোনো রোগ ছিলো? অচদা বলিলেন উনি লকডাউনে ঘরে বসিয়া কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগিতেছিলেন। ওনার স্ত্রী সিগারেট বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন। জমিদারনী বলিয়া উঠিলেন... ইউরেকা। তাহা হইলে লিখুন লোকটা অর্শে মরিয়াছে। দেখিলেন তো কেমন ফটাফট সমাধান দিলাম। তাহা হইলে মৃত্যুসংখ্যা আর বাড়াইয়া কাজ নাই। ওই সাতজনই রহিল। অচদা আপনি ফেরার সময় ভবানীপুরে আমার ওই তাজা ছেলেটাকে একটু দেখিয়া আসিবেন তো! পরপর দু'বার নির্বাচনে পরাজিত হইয়া কারনসেবা বাড়াইয়া দিয়াছে। উহার যকৃতটা একটু দেখিয়া আসিবেন। অচদা বলিলেন আমাদের দুজনকেও একটু দেখিবেন। জমিদারনী মুচকি হাসিলেন।
আমি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে উড়িয়া চলিলাম। শেষ অবধি কোষ্ঠকাঠিন্যে মৃত্যু!! উড়িতে উড়িতে অনেক বন্ধু পাইলাম। সকলেই দুঃখিত। কেউ নতুন জীবাণুতে মৃত্যুর সম্মান পায় নাই। জমিদারনী প্রাসাদে বসিয়া সুমুদা, অচদার সাহায্যে  সবার ভাগ্য বদলাইয়া দিতেছেন। এমত ক্ষমতাশালী জমিদারনীর প্রজা ছিলাম বলিয়া গর্ব অনুভব করিলাম। দুঃখ ঘুচিয়া গেলো। মহানন্দে উড়িয়া বেড়াইতে লাগিলাম।

মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০

পরিযায়ী শ্রমিক ও আমাদের সরকার ~ উদিত সেনগুপ্ত

কয়েক ঘন্টা আগেই দেখলেন কী কান্ড টা ঘটে গেছে বান্দ্রা স্টেশন চত্বরে? প্রায় সহস্রাধিক পরিযায়ী শ্রমিক জড়' হয়েছিলেন এই ভেবে যে আজ লকডাউনের পরিসমাপ্তি ঘটছে এবং তাঁরা বাড়ি ফিরতে পারবেন। সকাল ১০টার স্পীচ শোনার সুযোগ তাদের ঘটেনি কিংবা ঘটে থাকলেও তা মান্য করার মত বাস্তবতা তাদের ছিল না। কেন' ছিলনা সেই বাস্তবতা? কারণ তাঁদের নো ওয়ার্ক নো পে জীবনের রোজগার বন্ধ গত তিন সপ্তাহ ধরে লকডাউনের কল্যাণে, NGO দের মারফৎ পাওয়া চাল আলু ও হয় শেষ হয়ে গেছে, বা হওয়ার মুখে। তাঁরা তো কেউ প্যাকেজ ট্যুরে মুম্বই দর্শন করতে আসেন নি উত্তর প্রদেশ, মালদা, মুর্শিদাবাদ থেকে, এসেছিলেন পেটের দায়ে মূলতঃ নির্মাণকর্মী কিংবা দর্জির কাজ নিয়ে। এবং তাঁরা বাড়ি ফিরতে চান আরো একটা কারণে। তাঁদের করোনা হলে তার দায়িত্ব বা চাল আলু ফুরোলে তা পুনরায় তাদের কে তা পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব কারা নেবে, সে বিষয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা। কেন অনিশ্চয়তা? কারণ একটা জরুরি শব্দ ইতিমধ্যে আপনারা মিস করে গেছেন।

 কোনো সরকার নয়, NGO নিয়েছিল গত তিন সপ্তাহে তাদের ত্রাণের ব্যবস্থা। খেয়াল করে দেখুন বা টিভি/অনলাইন খবর পড়ে দেখুন শ্রমিকরা বলছে যে কিছু NGO এইটুকু অন্ততঃ করেছে, তাদের মালিক/ঠিকেদার নয়, সরকার নয়। এই সকল NGO শব্দবন্ধের সাথে তাদের পরিচিতি অল্প কিছুদিনের, কিন্তু চিরপরিচিত মালিক/ঠিকেদার/সরকার, অর্থাৎ যে কোনো শ্রমিকের প্রাথমিক নিরাপত্তাবোধের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের জন্য এগিয়ে আসে নি। এতএব, প্রবল এই নিরাপত্তাহীনতা। ফলতঃ ঘটল' লাঠিচার্জ এবং বর্তমানে টুইটার যুদ্ধ চলছে মহারাষ্ট্র সরকার আর কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে, কে কার দায়িত্ব পালন করেনি, সেই নিয়ে। আর আমি প্রবল আতঙ্কে টিভি চ্যানেলে এই সব দেখে প্রেডিক্ট করার চেষ্টা করছি যে সমষ্ঠিগত সংক্রমণ বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের ফলে আগামীকালের করোনা কাউন্ট কত' দাঁড়াবে। 

কোনোদিন নির্মীয়মাণ বান্দ্রা মেট্রো স্টেশনের সাইটে গিয়ে দাঁড়ান কয়েক মুহূর্ত। হঠাৎ ই আপনার মনে হবে ২০০০ কিমি দূরে আরব সাগরের পাড়ে এত বাংলা ভাষার স্রোত কোথেকে ভেসে আসছে?! সেখান থেকে হাঁটতে শুরু করুন এ দেশের "ক্যানারি ওয়ার্ফ" বান্দ্রা কুরলা কমপ্লেক্সের দিকে। নির্মীয়মাণ মেট্রোর লাইন বরাবর শুনতে পাবেন মুর্শিদাবাদ, মালদা, এমনকি পুরুলিয়ার ডায়ালেক্টে বাংলা ভাষা। পাশেই নির্মীয়মাণ বহুতল বাণিজ্যিক বিল্ডিংগুলোর দিকে এগিয়ে যান। শুনতে পাবেন ছাপড়া, সিওয়ান, সীতামরহি, বারাবাঁকি, সাসারাম, বিজনৌর, শামলির ভাষা। অপেক্ষা করুন দিনের আলো ফুরনো অবধি। তারপরে ভাষার এই কলকল স্রোতের পিছু পিছু হাঁটতে থাকুন। পৌছে যাবেন প্যাটেল নগর, কালিনা হয়ে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মার্গ ধরে সুন্দরনগর, আজাদ নগর, ভীম নগর, সূর্যনগর, কাজুপাড়া, মোহিলিগাঁও, মিলিন্দনগর। এই প্রত্যেকটি অঞ্চল আসলে একেকটি বৃহৎ বস্তি অঞ্চল। এই সব মানবস্রোতের আশ্রয়স্থল। বান্দ্রা থেকে একদিকে গেলে ধারাভি (এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি অঞ্চল) হয়ে সায়ন-মাহিম; আরেকদিকে কুরলা থেকে ঘাটকোপার হয়ে মুলুন্ড অবধি, প্রায় ১৩ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৮০% মানুষ বাস করে এই সকল বস্তিতে। এই সকল গতরে খেটে খাওয়া মানুষ ২১ দিন ধরে কোনো রোজগার না করে, কিছু NGOর ভরসায় বেঁচে আছে। তারাই আজ বাড়ি ফেরার তাগিদে, প্রাণের দায়ে জড়' হয়েছিল' বান্দ্রা স্টেশনে। 

না না, আমি জানি যে আপনি এর মধ্যে পদবী খুঁজতে চাইছেন এবারে!! ব্যাপার টা কে "that one particular community" বলার জন্য আপনার জিভ সকসক করছে এই মুহূর্তে!! দাঁড়ান! এরা কেউ কোনো মার্কাজ বা কেত্তন বা অমুকনবমী বা অমুকলালা'র উৎসব পালন করতে জড়' হয়নি। ভরসার অভাবে, মানে রাষ্ট্রের কোনোরকম আস্থাপ্রদানকারী পদক্ষেপের অভাবে এরা নিজেদের সংসারে, পরিবারে ফিরতে চেয়েছেন। টাকা নয়, জমি নয়, মন্দির নয়, মসজিদ নয়, এরা মরিয়া হয়ে উঠেছেন উপার্জনের অভাবে, খাদ্যের অনিশ্চয়তায় তাদের শেষ নিরাপত্তার খুঁটিটাকেই আঁকড়ে ধরতে, নিজের গ্রামে, নিজের ঘরে ফিরতে। করোনায় মৃত্যু হতে পারে, এই জ্ঞানটুকু থাকা সত্ত্বেও তারা মরিয়া। 

এইবারে আপনি ওই "দ্যাট পার্টিকুলার কমিউইনিটি" থেকে হাল্কা সরে গিয়ে "কী আর করা যাবে বল' " বলতে চাইছেন। উত্তর টা হলঃ অনেক কিছুই করা যেত'। ২২শে মার্চ অবধি বিদেশী বিমান চলতে না দেওয়া যেত'। ৩০শে জানুয়ারি এলার্ম পাওয়ার পর থেকে দু তিন সপ্তাহের মধ্যে স্পেশাল ট্রেনের এরেঞ্জমেন্ট করে এই সকল পরিযায়ী শ্রমিক কে বাড়ি ফিরিয়ে এনে ফুড কর্পোরেশনের পর্যাপ্ত স্টক থেকে খাদ্যশষ্যের রেশনের ব্যবস্থা করা যেত', এককালীন পদক্ষেপ হিসেবেই ১৫ লাখ না হোক, ৫০০০ টাকা করেই না হয় এদের জন ধন একাউন্টে ঢালা যেত' এবং প্রতিটা স্টেশনে অন্ততঃ থার্মাল স্ক্যানিং করানো যেত' (অবশ্যই সম্ভব)। সরকার বাহাদুর তিনটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নিপীড়িত মানুষকে নাগরিকত্ব প্রদান করতে মানবিক আশঙ্কায় সদা উদগ্রীব আর নিজের দেশের এই বিশ্বকর্মাদের প্রতি এত অনীহা, এত অবহেলা?! নাকি এঁরা নাগরিক ন'ন? যদি নাই হ'ন, এঁদের ঘামের মধ্যে দিয়ে সৃষ্ঠ শ্রমদিবস মেনে নিচ্ছিলেন কেন? এঁদের কে দিয়ে সব শয়ে শয়ে কোটি টাকার নির্মাণ প্রকল্প করাচ্ছিলেন কেন? কোথায় এদের ঠিকেদার রা? সেই ঠিকেদার দের রাজনৈতিক মুরুব্বি রা? লাঠিচার্জ টা আজ বিকেলে এদের ওপর হল' কেন? করোনা ছড়ানোর দায়ে মহামারি আইন ও পীনাল কোডের আওতায় এঁদের ঠিকেদার আর সরকারের শ্রম দপ্তর বা সমাজকল্যাণ দপ্তরের কর্তা-কত্রীদের উপর লাঠি চার্জ বা জামিন-অযোগ্য ধারায় কেস করা হচ্ছে না কেন? কেন' লাঠিচার্জ হবে না সেই সকল রাজ্যসরকারের বিরুদ্ধে যাদের কাছে জনগণের অর্থে নিজ নিজ রাজ্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সৎ প্রয়াসের বদলে মন্দির- কুম্ভমেলা- ক্লাবতোষণ- পীরভাতা- মস্তানদের Y category র নিরাপত্তাপ্রদাণ অগ্রাধিকার পায়? কেন' লাঠিচার্জ হবে না সেই সকল রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধে যারা এই জাতীয় সঙ্কটের সময়েও বিধায়ক কেনা বেচার জন্য রোলস রয়েস থেকে বিলাসবহুল রিসর্টে অর্থের হড়কা বান এনে ফেলছেন অথচ' রিলিফ দেওয়ার বেলায় রেশনের আটা, চালের বস্তায় নিজেদের "বিকাশপুরুষ", "মা জননী", "লৌহপুরুষ" দের সহাস্য ছবি লাগিয়ে "দান" করছেন? কেন' লাঠিচার্জ করা হবে না সেই সকল রাজ্যের সরকার কে, যাদের রাজ্য থেকে এই সকল পরিযায়ী শ্রমিক কাজ করতে গিয়ে আটকে পড়েছেন অথচ' তারা স্রেফ সরকারি লেটারহেডে একটা করে চার লাইনের চিঠি লিখে দায়িত্ব সম্পাদন করে ফেলেছে? 

এই সকল শ্রমিকের এই সব শহরের বাসস্থানগুলিতে ঢুকুন। বুঝবেন যে আন্দামানের সেই কুখ্যাত সেলুলার জেলের একেকটি খুপড়িতে মাথাপিছু যতখানি স্কোয়ারফুটের মধ্যে দ্বীপান্তরী মানুষরা বাস করতেন, তার চেয়েও মাথাপিছু কম স্পেসে এই সব অঞ্চলে পেটের দায়ে একেকটি শ্রমিক বাস করে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর (প্রোফেসর  ইন্দ্রনীল দাশগুপ্তর কাছে কৃতজ্ঞ এই বস্তুনিষ্ঠ তুলনাটা আজ সকালেই করার জন্য)। এদের কে "বিপ্লবী" বলবেন না আপনারা, বর্ষাকালে ধ্বস নামার ফলে (হ্যাঁ, মুম্বই শহরের বহু বস্তি অঞ্চলে ফী বর্ষায় ধ্বসে যায় মাটি) যখন এঁদের কেউ না কেউ অকালে মরে যায়, তাঁদের "শহীদ" বলেন না আপনারা। অথচ' খেয়াল করে দেখুন, আপনার পিপিটি প্রেজেন্টেশনের যাবতীয় সুচারু বক্তব্যে যখন এ দেশটা কে "ইনভেস্টমেন্ট ডেস্টিনেশন" প্রমাণ করতে আপনি ব্যাগ্র হয়ে ওঠেন, আপনি আদতে এই শ্রমিকগুলোর কথাই বলছেন কিন্তু। আপনার অর্থনৈতিক মহাযুদ্ধের শহীদ এঁরাই, আপনার যাবতীয় লক্ষ্মীদেবীর মহাযজ্ঞের সমিধ থেকে হবি সবটাই এঁরা। 

কিন্তু এতখানি পড়ার পর ও আপনি ওই কমিউনিটি ট্রান্সমিশন নিয়েই ভেবে ঘেমে যাছেন। অবিশ্বাসের, অসহায়তার কমিউনিটি ট্রান্সমিশন গত ৩০ বছর ধরে উত্তোরত্তর বৃদ্ধিই পেয়েছে, যা বিগত ছ' বছরে বিমুদ্রাকরণ থেকে আজকের ওই চূড়ান্ত অপরিকল্পিত লকডাউনের মধ্যে দিয়ে, হিন্দু-মুসলমান প্রফিটেব্ল ব্যবসার মধ্য দিয়ে তা প্রায় প্রতিটি গৃহস্থালি অবধি পৌছে গেছে ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে। স্যানিটাইজার খুঁজছেন? আছে। কিন্তু তা বোতলে বিক্রী হয়না। একমাত্র বোধ ও চেতনার বিকাশেই তা পাওয়া যাবে। আর তদ্দিন অবধি দেখতে থাকুন কোন বারুদ কোথায় কখন সামাজিক অগ্ন্যুৎপাত ঘটায়।

সোমবার, ৬ এপ্রিল, ২০২০

ঐক্যপুজো ~ আর্যতীর্থ

ফাটছে বাজি দড়াম দুড়ুম , হুররা হো হুররা হো,
আয় করোনা আমার বাড়ি, নিয়মটিয়ম দূর রহো।
তিনহাজারে গেছে রোগী, মৃত্যু হলো একশো পার,
আও বাবাজী, ফাটাও বাজি, আয়েশ করি সব ইয়ার!

এটাই যদি ঐক্যধ্বনি, গড় করি ভাই দূর থেকে
ঢোলক নিয়ে নাচন কোদন, বাইরে গেলো ঘুরতে কে?
এই মারীতেও এমন বাজি, তবে কোথায় ভয় শুনি?
আপন মনে ছড়াক কোভিড, আমরা বরং নয় গুনি।

বিশ্ববাসীর কাছে গেলো ভারত থেকে এই আওয়াজ
ষাট হাজারের মৃত্যু তো কি, দ্যাখ কিরকম ফূর্তি আজ।
মোবাইল আলো আর প্রদীপে কম পড়ে দেশভক্তিতে
ঐক্যপুজোয় নিয়ম বোধহয় পটকা দিয়ে ভোগ দিতে।

লকডাউন আর করা কেন, দেশ আছে বেশ উৎসবে,
ফালতু নাটক শেষ করা হোক, কজনে আর ভূত হবে!
চিন্তাবিহীন তাকধিনাধিন, কে খুঁজে যায় বিপর্যয়?
বাকি আছে হাঁকা শুধু, বোল করোনা মাঈকি জয়!

ঐক্যপুজো আবার কবে, পাঁজি দেখে নিই শিখে,
কোভিডবাবার থানে এবার ভেট চড়াবো পাঁচসিকে।

শনিবার, ৪ এপ্রিল, ২০২০

কোরোনা ও সরকার ~ ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী

কত্তা, একটু রোসেন। কিছুতেই যে কথাটা ফাইজলামি করে বোঝানো যাচ্ছে না সেটা একটু ঘুরিয়ে কই। ঠাকুর বলেছিলেন পথ দুটো ।একটা ভক্তির আর একটা তর্কের। আমার মতো অনেকেরই পথটা তর্কের। কিন্তু তাতে করে আপনার ভক্তির পথ নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। কাজেই আমার প্রশ্ন করার অভ্যাস নিয়ে আপনার রেগে যাওয়ার কিছু হয়নি। আমি ওভাবেই বুঝি। যেমন আপনি বোঝেন , মোদিজী যখন বলেছেন তখন নিশ্চই কিছু একটা ভেবেই বলেছেন। নিশ্চই মঙ্গলের দ, চাঁদের প, আর ৯এর ছ মিশিয়ে কিছু একটা দারুন হবে। ছোটবেলা ক্লাসে মনে নেই? কয়েকজন প্রশ্ন করতো আর বাকিরা মুখস্ত করতো এই ভেবে যে বইতে যখন লেখা আছে নিশ্চই ঠিকই হবে। এখন তারা ঠিক সেই অভ্যেসটা whatsapp এও চালু রেখেছেন। ওতেও সমস্যার কিছু নেই। আমি প্রশ্ন করতে করতে বুঝবো, আপনিও একদিন বিশ্বাস করতে করতেই বুঝবেন। । সেই সম্ভাবনা খোলা থাক। কালকেই পৃথিবী শেষ হচ্ছে না। প্রশ্নের কোনো ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতাও নেই। প্রশ্ন প্রশ্নই। যেমন ভক্তি ভক্তিই। নাড়ু কেন আমার বাড়ির দেওয়ালে হিসি করলো এই নিয়ে প্রশ্ন করলে আপনি বলতে পারেন না নাড়ুর বাপ জাঙ্গিয়া না পরে পাতলা লুঙ্গি জড়িয়ে যখন বাজারে যেত তখন তুমি কোথায় ছিলে? ঠিক যেমন আমি আপনাকে জিগাই না, তোমার এত ভক্তি এখন, আদবানি যখন একটা রাম লেখা ইঁট বানাতে বলেছিল… সেই ইঁট তোমার বাপ বানিয়েছিল? নাড়ু বা আপনার বাপ কারো দায় আমাদের নয়। আমরা এখন নিয়ে কথা বলছি, অতীত নিয়েও। কিন্তু তখন তুমি কোথায় ছিলে বল্লে খেলব না। তখন আমি নাক খুঁটছিলাম, আপনি ছোঁচাচ্ছিলেন। কাজেই শোধবোধ হেগো পোঁদ। বাদ দিন।
ঠাকুরে আসি। ঠাকুর ভক্ত হতে বলেছিলেন। দাস হতে একবারও বলেননি। দাস আর ভক্তের বিস্তর ফারাক। একজন মাইনে পায় একজন ফ্রিতে খাটে। এইটা ঠাকুর বলেননি।কারন ঠাকুর আপনাকে দেখেননি। আপনার মত জীব দেশে তখন খুব কম ছিল। যে কটা ছিল তাদের জন্যে যা বলার নরেনই বলে গেছেন। একটু ভক্তিভরে ওর জীবনী পরবেন… গোসেবক নিয়ে ওনার মতামত খুব পষ্ট। মুশকিল হল আপনি গোসেবক আর হিঁদু গুলিয়ে ফেলেছেন whatsapp পড়ে। আপনার তালগোল পাকিয়ে গেছে। ঠিক যেমন আপনি সরকার আর জনগণে গুলিয়ে ফেলছেন।
সরকার পরিকল্পনা করে।তার কাছে সাধারন মানুষের থেকে অনেক বেশি তথ্য থাকে। সেগুলি সে সমন্বয় করে। তার থেকে নীতি তৈরি হয়। ভবিষ্যতের দিশা দেয়। দুর্বলের পাশে এসে দাঁড়ায়। না পারলে তার যুক্তি দেয়।খতিয়ান দেয়। এগুলি বইতে লেখা ছিল মনে আছে? তখন না বুঝে দুলে দুলে মুখস্ত করেছিলেন বলে ভুলে গেছেন। এগুলো সরকারের কাজ। সেই জন্য সরকারকে মানুষ নির্বাচিত করে। এটাও বইতে লেখা ছিল। তার জন্য আপনার আমার পকেট থেকে অনেক অনেক টাকা খসে।এইবার একটু খেয়াল করুন এই সরকার এই করোনা  নিয়ে কি কি করেছে? ( রাহুল গান্ধী রাহুল গান্ধী করবেন না।ও টুইট করে আর থাইল্যান্ড যায়… নিজের পার্টি ছাড়া কারুর ভিটে মাটি চাঁটি আপাতত ও করছে না)। সরকার দুমাস আগাম সময় পেয়েছিল।সরকার পাড়ার ছেলু গয়লা নয়। তার বহু মাইনে করা ইয়াব্বড় শলাহকার আছে। তারা Whatsapp এর ডিগ্রীধারি নয়।তারা কি বলেছিল আর সরকার কি বুঝেছিল আমাদের কেউ জানায়নি। এই রোগ আমদানিকৃত। অনেক আগে বর্ডার সীল করলে আজ হয়ত আপনি আমি কেউ বাড়ি বসে নেই। যখন WHO বলেছিল গ্লোবাল হেলথ এমার্জেন্সি, সরকার বলেছিল তেমন ভয়ের কিছু নেই। সরকার তখন ব্যাস্ত ছিল। ট্রাম্পের নধর নিতম্ব, শাহীনবাগের কারেন্ট, শালাদের গুলি আর মধ্যপ্রদেশের এমএলএ দের খুলি নিয়ে। এগুলো আপনিও দেখেছেন। এই দুই মাসে টেস্টিং, PPE, মাস্ক, ভেণ্টিলেটর কিচ্ছুটির কিছু হয়নি। রাজ্যগুলি অনেক আগে মাঠে নেমেছিল। তারা কেন্দ্রের থেকে বেটার নয়।তাদের মানুষের খিস্তি ডাইরেক্ট খেতে হয় তাই। কিন্তু তারা GSTর হাজার হাজার কোটি প্রাপ্য টাকা পায়নি মাসের পর মাস। কেরালা সরকার হাইকোর্টে গিয়ে মানুষ যাতে নেক্সট তিন মাস কোনো ট্যাক্স না দেয় তার রায় নিয়ে এসেছিল। কেন্দ্র সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে সেটা ক্যান্সেল করিয়ে এসেছে। 
তারপর প্রথম বার্তা সরকারবাহাদুর দিলেন একটা চুকিতকিত কার্ফুর আর থালা বাজানোর। তার জন্য টাইম দিলেন চার দিন। দ্বিতীয়বার এসে ২১ দিনের লকডাউন। সময় দিলেন চার ঘন্টার। এর ফলে কি হয়েছে আপনি গুহায় না বাস করলে জানেন। এর মধ্যে আপনিও দেখেছেন সরকার যে প্যাকেজ ঘোষনা করেছে তার আর্ধেক NREGA আর পিএম কিষানের পুর্ব ঘোষিত টাকা। সেটাকে প্যাকেজে জুড়ে দিয়ে মালটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। আপনি হাফিইয়ারলির ইতিহাসের নম্বরটা ফাইনালের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে পাশের বাড়ির ঘোঁতনকে ঢপ দিলে সেও এটা একদিন ধরে ফেলতো। ঘোঁতন যদি আপনার ভক্ত না হয়। যারা ভক্ত নয় তারাও তাই করেছে। আপনি ভক্ত বলে বাকিরা ঢপটা গিলবে কেন? যে গালভরা ইএমাই মকুব হয়েছে সেটা না দিলে সুদ সমেত সেটাও আপনাকে পরে শুধতে হবে সেটাও সরকার আপনাকে পরিষ্কার করে একবারো বলেনি।আপনার একবারো মনে হয়নি এটা সরকার বললো না কেন? সরকার কি জনগণের ভাসুর? এত আকার ইঙ্গিতে কথা বলার কি প্রয়োজন? 
 যে লক্ষ কোটি টাকা সরকার তেলের জন্য বাঁচাচ্ছে তার এক পয়সাও মানুষ কে ট্রানফার করছে না। একটা সরকারি পিএম রিলিফ ফান্ড থাকতে সরকার একটা ট্রাস্ট খুলে মানুষের থেকে টাকা তুলছে। একটু দুলে দুলে মোদি মোদি না করলেই দেখবেন আপনি ক্লাস টু এর ফাইনালের আগে যেটুকু হোমওয়ার্ক করতেন সেটুকুও এই গরমেন্ট করেনি। এই অবস্থায় সে এসে আপনাকে বলছে একটু পদিপ জ্বালাবি ভাই? আমরা সবাই দেখবি কেমন মনে বল পাব!
আপনি দুবার ফেল করে আপনার বাপকে যদি বলতেন একটু রেহমানিয়ার বিরিয়ানি খাওয়াবে বাবা? তাহলে এই কঠিন সময় আমি একটু মনে বল পাই। কি হত? নিজের বাপের মুখটা একটু মনে করুন। মালুম পাবেন। আমাদেরো না ঠিক এইরকম লাগছে।
আপনি গুলিয়ে ফেলেছেন কাকু। সারা পৃথিবীতে মানুষ নিজের উদ্যোগে ঘন্টা বাজায়, গান গায়, কবিতা পড়ে, মোমবাতি জ্বালায়। সরকার তাকে কিছু বলে না। সরকার ত্রাণ দেয়, খাবার দেয়। চিকিৎসা দেয়।এখানে সাধারন মানুষ (that includes স্বাস্থ্যকর্মী) ত্রাণ, খাবার, চিকিৎসার প্রাণপণ চেষ্টা করছে আর সরকার মন দিয়ে ধুপ, কাঁসর, প্রদীপ, ন মিনিট এসব করে যাচ্ছে। উলটে গেছে পুরোটা। মানুষের দ্বায়িত্ব নিজেকে বাঁচানো। সরকার শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দেবে।
উলটে গেলে ভীষন বিপদ জানেন। মানুষের দেহে ব্রেন আর রেক্টাম খুব কাজের জিনিস। কিন্তু এরা জায়গা পাল্টালে ঘোর দুর্দিন। ভাবুন তো কি বিপদ? 
তাই আমরা প্রদীপ টদীপ জ্বালাবো না বুইলেন। আপনি জ্বালান। আপনার মঙ্গল হোক। আমরা তো একই সুতোয় বাঁধা। তাই আপনার হলে আমাদেরো হবে। চিন্তা করবেন না।
পুঃ পাছে কমিউনিস্ট জেহাদি টেহাদি ভাবেন তাই আবার ঠাকুর দিয়েই শেষ করি। ঠাকুর ভক্ত হতে বলেছিলেন ঠিক। কিন্তু মার। বা গুরুর । বা আরাধ্য যা কিছুর।রাজার ভক্ত হতে একবারো বলেননি। আপনি রাজার ভক্ত হয়েছেন। রাজা খুব ডেঞ্জার জিনিস। সে রাজা হিন্দু হোক বা খ্রিশটান বা মোছলমান বা কমিউনিস্ট। রাজা শুধু নৈবেদ্যি বোঝে। আর বোঝে লাঠি, তেল ও গুহ্যদ্বার। আর গুহ্যদ্বারের হিঁদু মোছলমান হয়না।

বৃহস্পতিবার, ২ এপ্রিল, ২০২০

করোনা ও মানুষ ~ বিষাণ বসু

এই শালা মাইগ্র‍্যান্ট ওয়ার্কারদের জন্যে দেশে করোনা এবার মহামারী হয়ে যাবে। 

ঠিকই। একেবারে ১০০% সহমত।

দেখেছেন? দেখেছেন শালাদের গাদাগাদি করে বাসস্ট্যান্ডে ভিড় জমাতে? লকডাউন ফেইল করবে না এরপরেও? বাস নেই, তো হেঁটে হেঁটে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যাচ্ছে - কে ট্র‍্যাক করবে এদের? কে টেস্ট করবে? মিনিমাম সচেতনতা না থাকলে…

একদম ঠিক জায়গাটা ধরেছেন, সিরিয়াসলি। আমি তো আরেকটু আগের কথা বলছি। এই ধরুন, বিলেত-আমেরিকার ডলার-পাউন্ডের মাইগ্র‍্যান্ট বাবুরা যদি এমন করে তাঁদের ফেলে যাওয়া দেশটিতে  না ফিরতে থাকতেন, ফেরার পর তাঁদের যদি এমন করে বাজারে ছেড়ে না দেওয়া হত, কে জানে, লকডাউন না করেই হয়ত আমরা বেঁচে যেতাম, তাই না? আরেকটু আগেই যদি মাইগ্র‍্যান্ট ওয়ার্কারদের দেশে ফেরার ঢল বন্ধ করতে প্লেনগুলো আটকানো যেত? প্লেনে চেপে যাঁরা ফিরলেন, তাঁদের সবাইকে  যদি কোয়ার‍্যান্টাইন করে টেস্ট হত, তাহলে??    

এই হচ্ছে আপনাদের প্রবলেম। রাজনীতি বাদ দিয়ে কথা বলতে শেখেন নি।

ঠিকই। কাদের মাইগ্র‍্যান্ট ওয়ার্কার বলা হবে আর কাদের নয়, এটা তো একেবারেই রাজনীতির সিলেবাসের বাইরে, তাই না? উন্নত দেশে বসে চাকরি করে মাসে কয়েক লাখ কামালে তাঁকে তো আর ওয়ার্কার বলা যাবে না, তাই তো? ভালো আয়ের সুযোগ বুঝে এদেশ থেকে ওদেশে পাড়ি জমালে, বিপাকে পড়ে ওদেশ থেকে এদেশে ফিরে এলে, তাকে মাইগ্রেশন বলাও নেহাত অনুচিত। মাইগ্র‍্যান্ট ওয়ার্কার মানে শুধুই তারা যারা দিনমজুরির কাজ হারিয়ে মাথায় হাঁড়িকুঁড়ি চাপিয়ে ঠা ঠা রোদ্দুরে হেঁটে চলেছেন। এবং, এই সংজ্ঞায় রাজনীতি নেই। তাই না??

আরে, তারা আর এরা?? এদের মধ্যে কোনো কনশাসনেস আছে??

সে তো বটেই। করোনার সংস্পর্শ জেনেও লন্ডন থেকে ফিরে যিনি বাজার-শপিং মলে ঘুরে বেড়ালেন, বিদেশ থেকে ফিরে যাঁরা মস্ত পার্টিতে হুল্লোড় করলেন, এমনকি যাঁরা বিদেশ থেকে ফিরেই স্রেফ গাঢাকা দিয়ে হাওয়া হয়ে গেলেন, হয়ে গেলেন ননট্রেসেবল - তাঁরা সাঙ্ঘাতিক সচেতন নাগরিক বই কি!!

দেখুন, আপনার এই সব কথাতেই সো-কলড গরীবের ছুতো দেওয়া বন্ধ করবেন, প্লীজ??

বেশ, বন্ধ করলাম। মধ্যবিত্তদের কথা বলি তাহলে? আচ্ছা, ফ্ল্যাটে যেসব বুড়োবুড়িরা থাকেন, তাদের অবস্থাটা ভেবেছেন?? তাঁরা কিন্তু কাজের লোক রান্নার লোকের উপর খুব নির্ভরশীল। এই বাজারে তাঁরা কেমন আছেন, জানেন?? এঁরা খাবার পাচ্ছেন কিনা, কী খেয়ে থাকছেন, জানার চেষ্টা করেছেন? ওষুধের দোকানের সামনে লাইনটা দেখেছেন? হয়ত খবর রাখেন না, নিখিল বিশ্বে করোনা-ই এক এবং একমাত্র অসুখ নয়। আপনি যখন মধ্যবিত্তদের কথা ভাবছেন, এটুকু নিশ্চয়ই জানেন, এইসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের অধিকাংশই দিনে চারপাঁচটা ওষুধ খান - সুগার-প্রেসার ইত্যাদি। সে ওষুধ বন্ধ করার জো নেই। এনারা যদি ওষুধের দোকানে লাইন দিয়ে করোনা বাধিয়ে বসেন - জানেন তো, করোনায় মরার ভয় মেইনলি এঁদেরই।           

হুমমমমম…. 

আর হ্যাঁ, মাথায় রাখুন, এঁদের অনেকেই নির্ভর করেন সঞ্চয়ের টাকার উপর যে মাসিক সুদটুকু মেলে, তার উপরে। সরকার যে আচমকা সুদ কমিয়ে দিল - আমার-আপনার সঞ্চয়ে যে সুদ কমলো, তার থেকেও কিছুটা বেশী করে কমে গেল বয়স্কদের সঞ্চয়ে - এনাদের দিন চলবে কী করে, ভেবেছেন?? হ্যাঁ, এঁরা কিন্তু আমার-আপনার মতোই মধ্যবিত্ত - মানে, সেরকমই ছিলেন - করোনার দিনগুলো কাটলে, এবং বেঁচে থাকলে, এঁরা হয়ত নিম্ববিত্তের জীবনযাত্রায় নতুন করে অভ্যস্ত হবেন। নাঃ, থাক - আপনি তো আবার রাজনীতির কথা পছন্দ করেন না!!

© বিষাণ বসু

বুধবার, ১ এপ্রিল, ২০২০

কোরোনা ভাইরাস ও কিউবা ~ সুশোভন পাত্র

ধরুন, লকডাউনে আপনি ঘরবন্দী। খাচ্ছেন-দাচ্ছেন-ঘুমোচ্ছেন। হয়ত অ্যামাজন প্রাইমে প্যারাসাইট দেখছেন কিম্বা নেটফ্লিক্সে মানি হেইস্ট রিভাইজ দিচ্ছেন। এমন সময় কেউ আপনার দরজায় কড়া নাড়ল। 'অসময়ে আবার কে?' -বলে ব্যাজার মুখে দরজা খুলে দেখলেন দাঁড়িয়ে আছে পাড়ার সরকারী মেডিক্যাল টিম। একজন ডাক্তার, একজন নার্স আর দু-জন মেডিক্যাল স্টুডেন্ট। তাঁরা আপনার গত কয়েকদিনের মেডিক্যাল হিস্ট্রি নোট করলেন। COVID-19-এ আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ আছে কিনা টেস্ট করলেন। যদি টেস্ট নেগেটিভ হয় তাহলে 'থ্যাঙ্কু, গুড বাই' বলে, আপনাকে আবার নেটফ্লিক্স-অ্যামাজন প্রাইমের দুনিয়ায় ছেড়ে আপনার প্রতিবেশীর ঘরে চলে গেলেন। 
কিন্তু ধরুন, আপনার জ্বর, কাশি, সর্দি, শ্বাসকষ্টের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা গেলো। তখন ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আপনার দুয়ারে অপেক্ষা করবে অ্যাম্বুলেন্স। আপনার পরিবারের সকলকে আবশ্যিক কোয়ারেন্টাইনে পৌঁছে দিতে আর আপনাকে নিকটবর্তী পলিক্লিনিকে নিয়ে যেতে। পলিক্লিনিক মানে, অত্যাধুনিক প্যাথলজি, এক্স-রে, আলট্রাসাউন্ড, অপ্টোমেট্রি, এন্ডোস্কোপি, ম্যাটনারনাল চাইল্ড কেয়ার, ডায়াবেটিক, প্যাডিয়াট্রিক্স, গাইনকোলজি, কার্ডিওলজি সহ ২২টি জরুরী পরিষেবা যুক্ত সরকারী স্বাস্থ্য-পরিষেবার দ্বিতীয় স্তর। পলিক্লিনিকে জরুরী পরীক্ষায় যদি দেখা যায় আপনার সংক্রমণ গুরুতর এবং অচিরেই ভেন্টিলেশেনের প্রয়োজন পড়তে পারে তাহলে আপনাকে স্থানান্তরিত করা হবে সরকারী স্বাস্থ্য-পরিষেবার তৃতীয় কিম্বা চতুর্থ স্তরে। অর্থাৎ হসপিটালে কিম্বা মেডিক্যাল স্কুলে। না হলে আপনি বিন্দাস রইলেন পলিক্লিনিকে। আইসোলেশেনে আর অবজারভেশেনে¹। 
কি ভাবছেন স্বপ্ন দেখছি? ঘরে বসে খেয়ালি পোলাও রান্না করছি? বাড়ি বাড়ি ঘুরে মেডিক্যাল টিমের এভাবে রোগ নির্ণয় সম্ভব নাকি? সম্ভব! হচ্ছেও! তবে সেটা কিউবা তে। আসলে কমিউনিটি ক্লিনিক-পলিক্লিনিক-হসপিটাল-মেডিক্যাল স্কুল, কিউবার স্বাস্থ্য-পরিষেবার এই পিরামিড প্যান্ডেমিকের মোকাবিলায় ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা কোন স্ট্রাকচার নয় বরং গত ৫০ বছরের ধারাবাহিক সরকারী স্বাস্থ্য নীতির ফসল। 'Alma-Ata'; WHO যখন প্রাথমিক স্বাস্থ্য-পরিষেবা কে গোটা বিশ্বে মৌলিক নাগরিক অধিকার হিসেবে সার্বজনীন করার ডাক দিয়েছিল ১৯৭৮-এ, কিউবার এই প্রজেক্ট তারও আগের, ১৯৭০-র²। 
সেই প্রজেক্টের হাতধরেই কিউবা জুড়ে গড়ে ওঠে সরকারী স্বাস্থ্য-পরিষেবার নিউক্লিয়াস 'কমিউনিটি ক্লিনিক'। নির্দিষ্ট ভৌগোলিক বৃত্তে প্রতি ১৫০টি পরিবার পিছু গড়ে একটি। ডাক্তার, নার্স ছাড়াও মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের তিন বছর দেশের কোন একটি কমিউনিটি ক্লিনিকে কাজ করা কিউবায় বাধ্যতামূলক। বছরের প্রতিদিন সকালে কমিউনিটি ক্লিনিকে বসে আউটডোর। বিকেলে ঐ ভৌগোলিক বৃত্তে মেডিক্যাল টিমের ফিল্ড ভিজিট, ক্রনিক রুগীদের চেক-আপ। আর সপ্তাহান্তে কমিউনিটি ক্লিনিকের জরুরী রুগীদের নিয়ে মেডিক্যাল টিম যায় পলিক্লিনিকে।দেশের মোট ৪৯৮টি পলিক্লিনিকের ঘাড়ে গড়ে ২০-৪০টি কমিউনিটি ক্লিনিকের রোগীদের সেকেন্ডারি স্বাস্থ্য-পরিষেবার গুরু দায়িত্ব ন্যস্ত। মোটামুটি কিউবার ৯৫% চিকিৎসা কমিউনিটি ক্লিনিক কিম্বা পলিক্লিনিকেই সীমায়িত³। বাকি ৫%-র জন্য আছে ১৫০টি ন্যাশনাল হসপিটাল। ১৪টি মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার। এবং অবশ্যই দুনিয়ার বৃহত্তম মেডিক্যাল স্কুল ELAM। যেখানে পড়াশোনা করে ১১০টি দেশের ২০,০০০ স্টুডেন্ট। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে, স্ট্রাইপেন সহ⁴। 
অবশ্য শুধু পড়াশুনা না, কিউবার স্বাস্থ্য-পরিষেবার আলপিন টু এলিফ্যান্ট সবটাই সরকারী এবং বিনামূল্যে। ওষুধও বিনামূল্যে কিম্বা ভর্তুকিতে⁵। উন্নয়নশীল দেশ তো ছেড়েই দিন, এমনকি উন্নত দেশের তুলনাতেও স্বাস্থ্য-পরিষেবার সূচকে কয়েক ক্রোশ এগিয়ে কিউবা। প্রতি ১০০০ জনে কিউবা তে ডাক্তার ৮.২। আমেরিকায় ২.৬, ভারতে ০.৮⁶। নাগরিকদের গড় আয়ু ৭৯। আমেরিকায় ৭৮, ভারতে ৬৮⁷। স্কিল্ড তত্ত্বাবধানে প্রসব কিউবায় ১০০%। আমেরিকায় ৯৯%, ভারতে মেরে কেটে ৮১%⁸। কিউবা তে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ জিডিপির ১২.১৯%, ভারতে ১.২% ⁹ ¹⁰। এমনকি শুনলে অবাক হবেন যে উত্তাল আটলান্টিকের কোলে বসেও শেষ ১৭টি ঘূর্ণি ঝড়ে কিউবা তে মারা গেছেন মাত্র ৩৫জন। আর শুধু ২০০৮-র ঘূর্ণিঝড়ে আমেরিকা তে মারা গিয়েছিল ১৮০০জন¹¹।  
'বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হবে' বলে পাড়া মাথায় তোলা দাদা-বৌদিরা রাগ করবেন না প্লিজ। ক্যাপিটালিজমের পা চাটা দালালরা বিরক্ত হবেনা না প্লিজ। কারণ উপরের তথ্য গুলো চে গেভেরার 'মোটরসাইকেল ডাইরিজ'-এ নেই বরং আছে WHO-র ওয়েবসাইটে। তাই আজকে যে শুনছেন কিউবার অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ Interferon Alfa-2B করোনার চিকিৎসাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে¹², আজকে যে শুনছেন বিশ্বের ৪৫টি দেশে কিউবার ডাক্তাররা করোনা ভাইরাসের আক্রান্তদের চিকিৎসা করছে¹³, আজকে যে শুনছেন করোনা আক্রান্ত যাত্রীসহ জাহাজ কে বিশ্বের তাবড় দেশ নোঙর ফেলতে না দিলেও কিউবা বুকে টেনে নিচ্ছে, -এর কোনটাই ফ্লুক কিম্বা পিসি সরকারের ম্যাজিক নয়¹⁴।
আসলে, হোক না কিউবা বহু দেশের তুলনায় অর্থনীতি তে চুনোপুঁটি, থাক না যতই বিপ্লব পরবর্তী ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে আমেরিকার অর্থনৈতিক বয়কট, হলেই বা ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের পারিশ্রমিক কম; তবুও লড়াইয়ে হার মানতে, বশ্যতা স্বীকার করতে জানেনা একরত্তির ঐ কিউবা। স্বাস্থ্য-পরিষেবা নিয়ে ব্যবসা করেনা কিউবা। মানুষের জীবন কে প্রফিট মেকিং-র পণ্য করে ফি-বাজারে বিক্রি করেনা কিউবা। ফিদেল কাস্ত্রো বলতেন কিউবার ডাক্তাররা কেবল ডাক্তার না, তারা 'সাদা পোশাকের সৈনিক'¹⁵। 
আমাদের দেশেও তাই! করোনা প্যান্ডেমিকে দেশের মানুষ কে বাঁচাতে প্রতিদিন যে অসংখ্য ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্য কর্মীরা অবিশ্বাস্য নিষ্ঠায় প্রাণপাত পরিশ্রম করছেন তারাও আমাদের দেশের 'সাদা পোশাকের সৈনিক'। আমরা জানি যে দেশে গড়ে হসপিটাল বেড ১টি/১,৮২৬জন, ডাক্তার ১টি/১১,৬৬০জন, আইশোলেশেন বেড ১টি/৮৪,০০০জন আর ভেন্টিলেটর ১টি/৩,৩৩,৩৩৩জন -সে দেশের 'সাদা পোশাকের সৈনিক'দের জন্য যুদ্ধটা আরও কঠিন¹⁶। আমরা জানি রাতারাতি আমাদের দেশের স্বাস্থ্য-পরিষেবা কিউবার মত হয়ে যাবে না। কিন্তু সরকারী পলিসি মেকিং-র অগ্রাধিকার তো বদলাতে পারে। তাই ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্য-পরিষেবার কঙ্কালসার চিত্রের বদল চাইলে, আমাদের 'সাদা পোশাকের সৈনিক'দের ঢাল তরোয়ালহীন নিধিরাম সর্দার বানানো বন্ধ করার স্বার্থে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে কি "এই সময় রাজনীতি করবেন না" বলে হুমকি দেবেন?
দিলে দেবেন! কিন্তু প্রশ্ন আমরা করবই! প্রশ্ন করব যে প্যান্ডেমিকের প্রাদুর্ভাবে দেশ যখন জর্জরিত তখন সরকার কেন ৮৮০কোটি দিয়ে ইজরাইল থেকে ১৬,৪৭৯টি মেশিনগান কিনছে¹⁷? যেখানে ঐ একই পরিমাণ টাকায় এই মুহূর্তে দেশে ১৬,০০০ নতুন ভেন্টিলেটর বানানো যেত¹⁸। প্রশ্ন করব যে প্যান্ডেমিকের প্রাদুর্ভাবে সরকার কেন আপনার-আমার ট্যাক্সের ২০হাজার কোটি খরচা করে সেন্ট্রাল দিল্লি ও পার্লামেন্টে কে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা করছে¹⁹? যখন করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য-খাতে মাত্র ১৫ হাজার কোটি বরাদ্দ হয়েছে। প্রশ্ন করব যে সরকার স্রেফ কলমের খোঁচায় ৭.২৭লক্ষ কোটির কর্পোরেট ট্যাক্স মকুব করতে পারছে²⁰, সেই সরকার কেন নতুন বোতলে পুরনো মদ ভরে, মাত্র ১.৭লক্ষ কোটির আর্থিক প্যাকেজে আই-অয়াশ করছে? সরকার কে ছাড়ুন, আপনিই না হয় বলুন। এখন কোনটা বেশি জরুরী মেশিনগান না ভেন্টিলেটরর? পার্লামেন্টে সাজানো না পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপদে ঘরে ফেরানো? কর্পোরেট ট্যাক্স মকুব না স্বাস্থ্য-কর্মীদের মাস্ক, কিট? 
কিউবা না হয় নাইবা হলেন, ট্রাম্পের নমক খেয়ে ফিদেলের প্রশংসা না হয় নাইবা করলেন, সমাজতন্ত্র না হয় নাইবা চাইলেন, কমিউনিস্টদের না হয় ঘেন্নাই করলেন; কিন্তু মানবিক তো হতেই পারেন। সুলভ স্বাস্থ্য-পরিষেবার দাবীতে আওয়াজ তো তুলতেই পারেন। মানুষের জীবন কে পণ্য করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তো করতেই পারেন। না ক্যাপিটালিজমের আফিমে বুঁদ হয়ে 'প্রফিট'র অঙ্ক কষলে অমানবিক হতেই হয়?