শুক্রবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৮

আসিফা ~ অনির্বান মাইতি

আজকে সকালে ফেসবুক খুলতেই দেখি আবারো এক ধর্ষণ। সত্যিই বিরক্তি নিয়ে বন্ধ করে দিচ্ছিলাম একটি স্টেটাসে চোখ গেল। গীতাকে নিয়ে বামপন্থীরা কিছু বলছে না সেই নিয়ে সেখানে দরবার বসেছে।
একটা পরিষ্কার কথা আবারো বলি আসিফার ঘটনা স্বতন্ত্র কয়েকটি কারণে।
১) একজন এম এল এ এবং একজন আই পি এস অভিযুক্ত ধর্ষক হিসেবে
২) ধর্ষণে অভিযুক্তদের বাঁচাতে ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দল থেকে মিছিল করা হয়।
৩) জাতীয় পতাকা কে ধর্ষকের স্বপক্ষে ব্যবহার করা হয়।
৪) আসিফার প্রতি অসম্মানসূচক পোস্টে ভরে গিয়েছিল ফেসবুক তার অধিকাংশই ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক গোষ্ঠীর লোকেরা করেছিল।
৫)অভূতপূর্ব ভাবে গোটা বার এসোসিয়েশন আসিফার উকিলের বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে কোনঠাসা করে। বার এসোসিয়েশন বিজেপি পরিচালিত।
৬) তদন্তকারী অফিসারকে হিন্দুত্ববাদীরা ক্রমাগত চাপ দিয়েছে তদন্ত না করতে।
বামপন্থীরা আসিফার ঘটনাটিকে রাজনৈতিক বানায় নি, উপরিউক্ত ঘটনাগুলিই কি যথেষ্ট না কোন ঘটনায় রাজনৈতিক রঙ চড়াতে? তাই আসিফার ঘটনা শুধু বামপন্থী কেন হবে আপামর ভারতবাসীকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।
এবার আসি গীতার কথায়, গীতা মাদ্রাসার ভিতরে নিগৃহীত হওয়ায় হিন্দুকুল কিন্তু আসলে রাজনৈতিক অক্সিজেন পেয়েছেন। গীতার ধর্ষকের জন্য কেউ মিছিল করে নি, কোন ধর্ম তার পাশে দাঁড়ায় নি, কেউ তাকে বাঁচাতে চায় নি, তবে গীতার ঘটনা আর আসিফার ঘটনায় মানুষের প্রতিক্রিয়া এক হবে কি করে? গীতার ধর্ষক সমাজের গণ্যমান্য নন যে তাকে শাস্তি দিতে গোটা দেশকে পথে নামতে হবে, শাস্তি তার হবেই সেটাই কাম্য। যে ঘৃণ্য অপরাধ এরা সকলেই করে চলেছে অবিরত তার শাস্তি চাই।
দয়া করে ব্যালেন্সের খেলা খেলবেন না। মনে রাখবেন দুর্জন শত্রু কখনো চোখে আঙুল দিয়ে ভুল দেখিয়ে দিলে পরিষ্কার বুঝে নেবেন ওটা ফাঁদ, ওদিকে যাবেন না। আর যদি একান্তই খেলেনই তবে ভারতীয় পরিসংখ্যান বলছে কাল গোটা দিনে প্রায় নব্বই টি শিশুর যৌন নিগ্রহ হয়েছে এই দেশে। তাদের সকলের নাম এবং ধর্ম খুঁজে এনে ধর্ম, ধর্ম আর রেপ প্রতিবাদ, রেপ প্রতিবাদ খেলুন, ব্যাপারটা অথেনটিক হবে।

বৃহস্পতিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৮

কুত্তার বাচ্চা ~ ঋষেণ ভট্টাচার্য্য

গত শনিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ শেয়ালদায় 9C প্লাটফর্ম ধরে হাঁটছিলাম গঙ্গাসাগর এক্সপ্রেস ধরবো বলে। শনিবার সাধারণত ওটাই ধরি। ট্রেন প্লাটফর্মে দিয়ে দিয়েছে বলে বেশ তাড়াতাড়ি হাঁটছি। প্লাটফর্ম ফাঁকা। আমি ট্রেনের মাঝামাঝি, আর একদম সামনের দিকে জেনারলে উঠতে হবে। কম্পার্টমেন্টে উঠে প্লাটফর্মের দিকেই একটা জানলার ধার পেয়ে গেলাম। ট্রেন ছাড়তে এখনো মিনিট দশেক দেরি। কম্পার্টমেন্টের ভেতর ভ্যাপসা গরম, দুর্গন্ধ, মেঝেতে জল পড়ে লোকের পায়ের ধুলোয় কাদা কাদা ছাপ, মাথার ওপর আলু লঙ্কার বস্তার ঝাঁঝ, এখনো আলো পাখা জ্বালানো হয়নি - সব মিলিয়ে নরক। ফ্রান্স জার্মান ডেনমার্কে আমার মত সাধারণ মানুষ কেমন ভাবে ট্রেন জার্নি করে আর কার কোন পাপে আমি এদেশে জন্মে কি ভাবে ট্রেন জার্নি করি ভাবতে ভাবতে, গন্ধ থেকে বাঁচতে জানলায় মুখ লাগিয়ে প্লাটফর্মের দিকে তাকিয়ে বসলাম।

হঠাৎ দেখি একটা সাদা কালো ছোপ ছোপ নেড়ি কুকুরের বাচ্চা তার খয়রি রঙের মায়ের সাথে খেলছে। মা শুয়ে শুয়ে ল্যাজ নাড়াচ্ছে আর বাচ্চাটা নানাদিক থেকে ছুটে ছুটে এসে মায়ের গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। মাও শুয়ে শুয়ে বাচ্চাটাকে হাত পা দিয়ে ধরার চেষ্টা করছে, উল্টে যাচ্ছে, বাচ্চাটাও মায়ের নাগাল ছাড়িয়ে একটু দূরে ছুটে গিয়ে প্রবল বিক্রমে ফিরে এসে আবার মায়ের গায়েই ঝাঁপিয়ে পড়ছে। মা বাচ্ছাটাকে খেলাচ্ছে আবার মাঝে মাঝে দেখে নিচ্ছে লোকজনের যাতায়াতের পথে কেউ যেন মাড়িয়ে না দেয়। বাচ্ছাটাও হুঁশিয়ার, মাঝে সাঝেই দেখে নিচ্ছে সে যেন মায়ের থেকে যেন বেশি দূরে চলে না যায়। কাছাকাছি কোনো বসার জায়গা বা থামের আড়ালে একটু লুকিয়েই আবার মায়ের গায়ে লাফিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়া। আর মায়েরও সেই ল্যাজ নেড়ে নেড়ে বাচ্ছাকে খেলানো। বেশ লাগছে দেখতে।

কতক্ষণ সময় কাটলো জানিনা, দুজন আর.পি.এফ বা জি.আর.পি. স্টাফ একটা কুচকুচে কালো ল্যাব্রাডর নিয়ে ধিরে সুস্থে আমার কম্পার্টমেন্টে এসে উঠলো। ট্রেন্ড ল্যাব্রাডর নিঁখুতভাবে সমস্ত কম্পার্টমেন্ট শোঁকাশুঁকি করে পুলিশদের সাথেই কম্পার্টমেন্ট থেকে নেমে পড়লো। পুলিশ দুটো আমার কম্পার্টমেন্টের সামনেই বসার জায়গায় ল্যাব্রাডরের স্ট্র‍্যাপটা হাত থেকে ছেড়ে, একটু বসলো, হয়তো অনেকগুলো কম্পার্টমেন্ট সার্চ করে ক্লান্ত কিম্বা হয়তো ইন্সট্রাক্সন থাকে ট্রেন না ছাড়া অবধি প্লাটফর্মেই ডিউটি দিতে হবে। ল্যাব্রাডরটাও শক্ত কাঁধে মাথা উঁচু করে সাবধানী ভঙ্গিতে পাশে দাঁড়িয়ে।

এদিকে সেই মা আর বাচ্চার খেলা একটুর জন্য থেমেছে। মা ভীষণ উৎকণ্ঠার সাথে ভারী চেহারার বিজাতীয় কুকুরকে দেখছে। বাচ্ছাটার কিন্তু ভ্রক্ষেপও নেই। মা খেলা বন্ধ করতেই বাচ্ছাটা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো ল্যাব্রাডরটার দিকে। বাচ্ছাটা একটু ভয়ে ভয়ে বিরাট বড়সড় চেহারার ফরেনারকে দেখছে, মাথাটা যতটা সম্ভব উঁচু করা যায় করতে গিয়ে উল্টে পড়লো তার পায়ের কাছে। মাও ওদিকে গা ঝাড়া দিয়ে বসে পড়েছে, আমার হাসি পেলেও তার মা কিন্তু ভীষণ উত্তেজিত - যদি অতো বড় চেহারার কুকুরটা কামড়ে দেয় তার বাচ্ছাকে। পুলিশ অফিসারটিও সাংঘাতিক বিভ্রান্ত। অন ডিউটিতে কি খেলা করা উচিত? নাকি দুধের শিশু দেখলে অন ডিউটিতেও একটু চুমু খাওয়া যায়? অফিসার খুব তাড়াতাড়ি আলগোছে বাচ্ছাটার মাথায় একটা চুমু দিলো। ব্যাস, বাচ্ছাটা পেয়ে গেলো নতুন বন্ধু। এক পাক গড়িয়েই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বাচ্ছাটা ছুট মারলো মায়ের কাছে। মায়ের পিঠে একটা গুঁতো মেরেই আবার ছুট অফিসারের দিকে। ওদিকে জাঁদরেল অফিসারও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ল্যাজ নাড়ছেন, আর মাঝে মাঝে একবার তাঁর হায়ার অথরিটি বা বসেদের দিকে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছেন, তাঁরা কিছু মনে করছেন কিনা। পুলিশ দুটির কোনো ভ্রুক্ষেপও নেই সে দিকে। তারা নিজেদের মধ্যেই গল্পে মশগুল। আমি হাসছি। ভাগ্যিস জাপান ইংল্যাণ্ড অস্ট্রেলিয়ার বদলে ভারতবর্ষে জন্মেছি। তাইতো প্লাটফর্মে স্ট্রে-ডগের বাচ্ছার সাথে পুলিশ কুকুরের খেলা দেখতে পাচ্ছি। মা শুয়ে শুয়ে ল্যাজ নাড়ছে, বাচ্ছাটা ছুটে ছুটে এসে মায়ের ল্যাজ ছুঁয়ে দিচ্ছে, মা ধরতে গেলেই পালাচ্ছে পুলিশ কুকুরটার কাছে। সেও কান নামিয়ে ল্যাজ নেড়েই চলেছে, তার ল্যাজ ছুঁতে এলেই সে বাচ্ছাটার মাথা চাটছে। বাচ্ছাটা আবার ছুটে মায়ের কাছে।

নাইন-সি প্লাটফর্মে সামনের দিকে রেলিং নেই। এই ছোটাছুটি করতে করতেই বাচ্ছাটা হঠাৎ পড়লো লাইনে। মাও এক নিমেষে ঝাঁপ মারলো লাইনে। আমিও ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্মের ধারে গেলাম দেখার জন্য। বাচ্ছাটা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। মা বার দুয়েক বাচ্ছার পেছনে আর পেটে ধাক্কা দিলো মুখ দিয়ে। বাচ্ছাটা কাঠের স্লিপার থেকে লাইনের ওপর দাঁড়ালো, ব্যালেন্স নেই। উল্টে পড়লো। মা চারপায়ে ব্যালেন্স করে লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে। বাচ্ছাটাও উঠলো লাইনের ওপর। মা আবার ধাক্কা দিলো পেছেন দিকে। বাচ্ছাটা উল্টে পড়লো স্লিপারে। আমার বিরক্ত লাগছে মায়ের ওপর, কেন যে ওইটুকু বাচ্ছা কে ঠেলে লাইন থেকে প্লাটফর্মেই তুলতে হবে কে জানে! ওইটুকু বাচ্ছা কি অতটা লাফাতে পারে? ওকে একটু ঘুরিয়ে সামনের স্লোপ দিয়ে প্লাটফর্মে তুলে নিলেইতো হয়! শেয়ালদা স্টেশন, ব্যস্ত লাইন। কখন ট্রেন চলে আসবে আট নম্বরে। আবার ধাক্কাধাক্কি চললো কিছুক্ষণ। লাইন থেকে প্ল্যাটফর্ম, একটা প্রমাণ সাইজ মানুষের বুক সমান উঁচু লাফানো সম্ভব নয় বাচ্ছাটার। এবার মা চেষ্টা করছে মুখে করে তুলে নিতে। মা ভাবলো, বাচ্ছার ঘাড়ের কাছে কামড়ে ধরে লাফিয়ে উঠবে। আমিও নিশ্চিন্ত। কিন্তু হলো না। মা বাচ্ছাটাকে মুখে নিয়ে মুখ উঁচু করে লাফাতে পারছে না। মুখে নিয়ে লাফাতে গেলেই বাচ্ছাটা পড়ে যাচ্ছে মুখ থেকে।

মা লাফিয়ে উঠলো প্লাটফর্মে। পুলিশ কুকুরটার দিকে স্পষ্টভাবে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত গলায় ঠিক দু'বার ডাকলো। সাধারণ চিৎকার নয়, কেমন যেন একটু চাপা গলার আওয়াজ।

শুনেছি ল্যাব্রাডর রেস্কিউ ডগ, গান ডগ। অনায়াসেই বিশাল ওয়েট ক্যারি করতে পারে। চোয়াল অ্যাতোই শক্তপোক্ত যে ভুজের ভূমিকম্পের সময় মাটির ১২ ফুট নিচ থেকে জামার কলার ধরে টেনে তুলতো মৃতদেহ। কিন্তু সে সব নয়, আমি দেখলাম এক অদ্ভুত জিনিস।

মা কুকুরটা একবার সাহায্য চাইতেই তড়াক করে লাইনে নেমে পড়লো ল্যাব্রাডরটা। আর.পি.এফ. বা জি.আর.পি. স্টাফদুটোও অবাক। ট্রেন্ড ডগ কখনো ওভাবে চলে যায় নাকি? ওরা দাঁড়িয়ে পড়েছে অবাক হয়ে। মা কুকুরটা আবার লাফ মারলো লাইনে। ল্যাব্রাডরটার লাফানোতে ভয় কিনা জানিনা, বাচ্ছাটা মারতে গেল এক ছুট, কিন্তু মা টা ঠিক তার আগেই ধরে ফেলেছে বাচ্ছাটাকে। আমি দেখেছি যে কোনো শ্বাপদ দাঁত দিয়ে বাচ্ছার ঘাড়ের কাছটা ধরে তোলে। ঠিক যেভাবে মা এখন বাচ্ছাটাকে ধরে আছে। আর আশ্চর্য, ল্যাব্রাডরটা বিশাল হাঁ করে বাচ্ছাটার পেটের কাছে ধরলো। মা ছেড়ে দিয়েছে বাচ্ছাটাকে। ল্যাব্রাডরটা অবলীলাক্রমে বাচ্ছাটাকে মুখে নিয়ে নিজের দেহটা একদম নিচু করে এক লাফ মারলো প্লাটফর্মে। অবাক কাণ্ড, উঠেও মুখ থেকে নামাচ্ছে না বাচ্ছাটাকে। প্লাটফর্মের ধারে দাঁড়িয়ে আছে লাইনের দিকে তাকিয়ে। এবার মা উঠলো লাফ মেরে। বাচ্ছাটা ছটফট করছে মুখের ভেতর। তাও ছাড়েনা।  দুজন পুলিশের একজন ডাকলো, "জয়!" ল্যাব্রাডরটা তাকালো পুলিশটার দিকে, মুখে বাচ্ছা। নামাবার নামও নেই। মা প্লাটফর্মে উঠে মাঝামাঝি চলে এসেছে। এবার জয় বাচ্ছাটাকে ছাড়লো, একেবারে মার কাছে গিয়ে।

এখন জয় বসেছে  পুলিশ দুটোর পাশে। আবার সেই শক্ত কাঁধে মাথা উচু করে কম্পার্টমেন্টের দিকে তাকিয়ে থাকা, হাজার হাজার লোকের মধ্যে সন্দেহভাজনকে খুঁজে বের করে চিনিয়ে দেওয়া, গাদা গাদা মালপত্রের মাঝে আসল মালকে শুঁকে আলাদা করা।

আমার ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। কি জানি, ওই শেয়ালদার উদ্বাস্তু মা বোধ হয় বাচ্ছাটাকে ওখানেই মানুষ করবে। ট্রেন ছাড়ার পর অফিসার আবার নীল বকলসটা পরে নিয়ে অন্য ট্রেনে ডিউটি করতে উঠবে বা অন্য প্লাটফর্মে টহল দেবে। কিন্তু এই অফিসারের কাছে যখন এক একা অসহায় নারী তার শিশুর জন্য সাহায্য চায়, সেই নারীকে সে রেপ করতে যায় না। বলে না ওটা আমার জুরিসডিক্সান নয়। কিম্বা অসহায়ের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিশেষ রকম কিছু প্রত্যাশাও করে না। অত্যন্ত দায়িত্বসহকারে তার কর্তব্য পালন করে। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার ভাষা। অ্যাতো অনুন্নত মনুষ্যেতর জীব হয়েও দুটি বিজাতীয় নারী পুরুষ কেমন সুন্দর একে অপরকে সমস্যা বোঝালো আর সমাধান করলো।

আমি জানতাম, পুলিশ ডগ স্পেশালি ট্রেন্ড। তারা কখনই বিশেষ কিছু গন্ধ ছাড়া অন্য কিছুকে পাত্তা দেয়না। অন্য জীবজন্তুর ধারে কাছেও যায় না। তারা অত্যন্ত পরিচ্ছন্নভাবে থাকে। অনান্য জীবজন্তু থেকে আগত ভাইরাস ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণের ব্যাপারেও তারা সচেতন, এমনিই তাদের প্রশিক্ষণ। প্রভুর আদেশ ছাড়া নাকি তারা জৈবিক তাড়নাতেও সাড়া দিতে দ্বিধা বোধ করে। কিন্তু না, তারা চোখ বন্ধ করে আইনের কথা ভাবে না, তারা মানবিক, তাদের বিচারবুদ্ধি সুস্থ। আমাদের মত শুকনো নয়।

আমি কিন্তু অফিস যাওয়া আসার পথে রাস্তার ফুটপাতে বসে থাকা ভিখিরিগুলোকে ঘেন্না করি। দামি সাবান আর পার্ফিউম্ মেখে অফিসে যাই তো - পাগল নাকি! কোনো উদ্ববাস্তুর বাচ্ছা ড্রেনে পড়ে গেলে কোলে করে তুলে আনবো? সময় থাকলে বড় জোর মোবাইলে একটা ছবি তোলা যেতে পারে।

ওটাতো একটা কুকুর, আমিতো আর কুকুর নই।

মঙ্গলবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৮

ভাগাভাগি ~ অরুণাচল দত্তচৌধুরী

মরল যারা আমার শহিদ,
আর খুনিরা? ও'দের।
প্রেসকে ডেকে বিবৃতি দিই
সফল প্রতিরোধের।

গণতন্ত্রের এই খেলাতে
গোটা কতক লোককে
মরতে সে'তো হবেই বাপু
পৌঁছে যেতে লক্ষ্যে।

জিতলে পরে? ব্যাপক মজা
স্বদেশ লুঠের বখরা
পাবার লোভে ঝকঝকে আজ
দন্ত এবং নখরা।

বিপ্লব? সে কবেই উধাও
ধর্মতাসের কড়চা
সঠিক ভাবে খেললে হবেই
দু'চারটি প্রাণ খরচা।

বাংলার এই ভাগ্যাকাশে 
দর্শন নেই রোদের
ডেডবডি সব আমার ভাগে
অস্ত্র? সে' সব ও'দের।

শনিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৮

ফাতিমা ~ দেবাশীষ সেনগুপ্ত

লক্ষ্নৌ এয়ারপোর্টটা আমার খুব প্রিয়। ছোট্টখাট্টো জাঁকজমক শূন্য একটা এয়ারপোর্ট। সাকুল্যে পাঁচখানা বোর্ডিং গেট, ইতিউতি ছড়ানো বসার জায়গা। দুএকটা খাবারের দোকান, একটা খাদি স্টোর আর একটা চিক্কনের কাপড়ের দোকান। ব্যস, খেল খতম! কেমন একটা ঘরোয়া পরিবেশ। বড় বড় এয়ারপোর্টগুলোর মত গিলে খেয়ে নেয় না।
ফ্লাইট মাত্র পনেরো মিনিট লেট, এখন আর অস্বাভাবিক লাগে না। তায় এ আবার দীর্ঘ দুরত্বের ফ্লাইট! দিল্লী-লক্ষ্নৌ-পাটনা-কলকাতা-বেঙ্গালুরু। আকাশপথে ভারতদর্শন!

বোর্ডিংয়ের পরই মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। আমার পেছনের সারিতেই এসে বসল পাঁচজন ষন্ডামার্কা ভাইয়া গোছের মক্কেল। সাদা শার্ট, চোখে কালোচশমা, গলায় মোটা সোনার চেইন আর মুখে ভকভক করছে বীয়ারের গন্ধ।  
এরা চারপাশের কাউকে মানুষ বলে গন্য করে না। তারস্বরে চেঁচিয়ে কথা বলে, হ্যা হ্যা করে হাসে, মেয়ে দেখলে চোখ দিয়ে গেলে বেহায়ার মত! গোটা উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই বলদগুলো।
যাই হোক, আমি বুঝে গেলাম আমার টুকরো ঘুমের দফারফা। তবে কথাবার্তায় বুঝলাম দলটা পাটনায় নেমে যাবে। আপাততঃ ওটুকুই সান্ত্বনা।

টেকঅফের পরেই এইসব ছোটদূরত্বের ফ্লাইটে বিমানবালাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। আধঘন্টার মধ্যে সবাইকে খাবার / জল পরিবেশন করে, উচ্ছিষ্ট সাফ করে ওঠা চারজনের পক্ষে চাট্টখানি কথা নয়। সীটনম্বর অনুযায়ী দায়িত্ব ভাগ করে নিলেও একেকজনের ভাগে ৩০ / ৩৫ জন প্যাসেঞ্জার তো পড়েই।
আমাদের ব্লকে যে মেয়েটি ট্রলি গড়িয়ে খাবার দিতে শুরু করল সে দেখলাম একটু ধীর স্থির। পেশাদারী হুটোপুটি এখনও রপ্ত হয়নি হয়ত। আমার পিছনের সীটের একভাইয়া তাকে হাত উঁচিয়ে ডাকলো, সে অল্প হেসে অপেক্ষা করতে বলল। দুমিনিট পরই আবার বেল বাজিয়ে ডাক। এবার মেয়েটি বলেই ফেলল - প্লীজ ওয়েট! একেক করে আসছি।
দুমিনিট পরই আবার ডাক, এবার উদ্ধতভাবে - হেই! হ্যালো! শুনো ইধার! 
মেয়েটি এলো খানিকটা - স্যর, ইয়ে রুল হ্যায়। সিরিয়ালী আনা হ্যায় মুঝে।
ভাইয়াজীর মুখটা দেখা গেল না, তবে গলায় ঝাঁজ একইরকম - পানি দেনা জারা।

হ্যাঁ, জল চাইলে দেওয়াই যায়। নিয়ম বা খিদের চেয়ে তেষ্টা সবসময় জরুরী।
মেয়েটা জল হাতে এগিয়ে এলো, আমি ঘাড় ঘোরালাম। একমিনিটের নিস্তব্ধতা, লোকটা একঝলক নজর বুলিয়ে নিল মেয়েটার বুকে আর তারপরই মুখ ঘুরিয়ে - রহনে দিজিয়ে। নেহী চাহিয়ে!
আমি অবাক, আরো দুচারজন ঘাড় ঘোরানো পাবলিকও অবাক! একমুহূর্তের জন্য মনে হল উঠে গিয়ে কষিয়ে চড় বসিয়ে দিই গালে। জল তেষ্টাটা অছিলা ছিল! আসলে কাছে ডেকে দেখার জন্যই তবে ....... ! ছিঃ
কিন্তু পরমুহূর্তেই চোখ চলে গেল ফর্সা মেয়েটার অপমানে প্রায় লাল হয়ে আসা মুখের দিকে। তারপর বুকে বসানো ব্যাজটার দিকে। মনকে আপ্রাণ বোঝাচ্ছি, না হতে পারে না। আগে যেটা ভেবেছিলাম সেটাই ঠিক নিশ্চয়ই।

ভাবতে ভাবতে অজান্তেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছি আমি। গ্লাসটা আমার হাতে ধরিয়ে মেয়েটা টানটান হয়ে দাঁড়াতেই আমার পাশের সর্দারজী হাঁক দিলেন - মুঝে ভী দিজিয়ে পানি। 
প্রায় একইসঙ্গে পাশে বসা তাঁর স্ত্রীও বলে উঠলেন - মুঝে ভি! ওপাশের যে দুজন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিল ঘটনাটা, তারাও বাড়িয়েছে হাত - ওয়াটার প্লীজ! কি সর্বনাশ! এরা সবাই দেখেছে! সবাই বুঝেছে! তাই অন্ততঃ সাত আটজন যাত্রী তেষ্টা না পাওয়া সত্বেও জল চেয়ে খাচ্ছে!
পিছনের সারিতে তখন স্তব্ধতা। অপরাধবোধ? কে জানে! কয়েক সেকেন্ডের ফিসফাসের পর সব চুপ।
মিনিট দশেক পর মেয়েটি আমাদের সারিতে সার্ভ করা শেষ করতেই অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় তার টীমলিডার এসে ট্রলির ভার নিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে সেই পরিচিত গলা - জারা পানি দিজিয়েগা তো!
ঠান্ডা বরফচোখে তাকালো টীমলিডার মেয়েটি, তারপর গলাটা একটু চড়িয়ে ডাক দিলো আগের মেয়েটিকেই - ফতিমা! ইনকো পানি দেনা প্লীজ!
তারপর? তারপর আর কি! ৩৪০০০ ফুট ওপরে একটা ছোট্ট লড়াইতে জিতে গেল একদল মেয়ে!


জাস্টিস ফর আসিফা ~ আশীষ দাস

আমেরিকায় গত কয়েক বছর ধরে একটা আন্দোলন হয়েছিল, "ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার" বলে। একটু খোঁজখবর রাখা লোকমাত্রেই জানবেন আমেরিকায় বর্ণবিদ্বেষ এখনো বেশ ভালই রয়েছে। বিশেষত পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের হেনস্থা হবার ঘটনা আকছার হয়। সামান্য ট্রাফিক ভায়োলেশন যেখানে শ্বেতাঙ্গদের সতর্ক করে বা সামান্য জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয় সেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের গ্রেপ্তার করা, কৃষ্ণাঙ্গ কেউ দামী গাড়িতে গেলে চোর সন্দেহে তার কাগজপত্র চেক করা এসব তো রয়েইছে, ২০১৩ সালে এক কৃষ্ণাঙ্গ নাবালকের পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর পর আন্দোলনের তীব্রতা আরো বাড়ে। এবার এই আন্দোলনের সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় #ব্ল্যাকলাইভসম্যাটার বলে একটি ট্রেন্ড চালু হয়। কিছু রাইট উইঙ্গ, মূলত শ্বেতাঙ্গ, এই সময়ে একটি অন্য হ্যাশট্যাগ চালু করে। সেটি ছিল #অললাইভসম্যাটার। আপাত দৃষ্টিতে খুব সত্যি কথা। সবার জীবনেরই দাম আছে। কিন্তু ভেবে দেখুন যেখানে অত্যাচারের শিকার হচ্ছে মূলত কৃষ্ণাঙ্গরা, আন্দোলনটাই সেইজন্য, সেখানে এরকম ভাবে জেনারালাইজ করার কারণ কী? সকল মানবের জীবনের প্রতি ভালবাসা? না এই যে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি পার্টিকুলার অবিচার, সেটাকে লঘু করে দেখানো? একটি নির্দিষ্ট অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে পৃথিবীর সকল অবিচার দিয়ে ঢেকে দেওয়া কি উদ্দেশ্যপ্রাণোদিত নয়? আপনি চাইলে অন্য অবিচারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামুন, নামতেই পারেন। কিন্তু ঘরে বসে থেকে যারা একটা অবিচারের বিরুদ্ধে লড়ছে তাদের আন্দোলনটাকে লঘু করে দিলে আমি বুঝবো আপনি আসলে অবিচারকারীর হাতই শক্ত করছেন।

***

এই একই জিনিস দেখা যাচ্ছে আসিফার ঘটনাটি নিয়ে। এটি রেপ, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে আতঙ্কিত করার জন্য ঘটানো পরিকল্পিত রেপ। আপনি এখানে অল রেপিস্ট শুড বি পানিশড বলে সেই কাজটাই করছেন যেটা মডারেট হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্টরা করেছিল ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের সময়। অবশ্যই অল রেপিস্ট শুড বি পানিশড, আপনি প্রতিটা রেপের পর প্রতিবাদ করুন না। কিন্তু এই রেপটির যে ধর্মীয়-রাজনৈতিক চরিত্র সেটিকে মুছে দেওয়াই যদি আপনার "অল রেপিস্ট শুড বি পানিশড" বলার উদ্দেশ্য হয়, তাহলে আপনিও এক্ষেত্রে সেই মৌলবাদী বর্বরগুলোর হাতই শক্ত করছেন। মনে রাখবেন ধর্ষকের ধর্ম হয়না, কিন্তু ভারতে রাজনীতির ধর্ম হয়। আর এই ধর্ষণটি একটি রাজনৈতিক ধর্ষণ, তাই এখানে ধর্ম নেই হলে এড়িয়ে গেলে হবেনা। যেমন আমেরিকায় সেই কৃষ্ণাঙ্গ নাবালকের হত্যাটি শুধুই পুলিশি গাফিলতি বলে রেসিজমকে এড়িয়ে গেলে সেটা সত্যগোপনই হবে।
আখলাক, পেহলু খান, আফরাজুল হয়ে আসিফা - এটা একটা প্যাটার্ন। এগুলোর বিরুদ্ধে বিশেষ ভাবে সরব হবার কারণ এগুলো র‍্যাণ্ডম অপরাধ নয়, একটা পার্টিকুলার কমিউনিটিকে অপ্রেস করার, ভয় দেখানোর ধারাবাহিক প্রচেষ্টা।

***

এবার আরেকটা কথা বলে নেওয়া দরকার। আমি কোনভাবেই রেপিস্টকে প্রকাশ্যে থেঁতলে মারা, পুরুষাঙ্গ কেটে লঙ্কা ডলে দেওয়া এসব সমর্থন করিনা। পার্সোনালি আমি ক্যাপিটাল পানিশমেন্টেরও বিরোধী, তবে ভারতে যেহেতু এখন তা চালু আছে তাই সেটা হলে আপত্তি অন্তত করবোনা। ভারতের সংবিধান অনুযায়ীই এই রেপিস্টদেরও বিচার এবং সাজা হওয়া উচিত। বড়জোর ফাস্টট্র‍্যাক কোর্ট বসানো যায় যত শীঘ্র সম্ভব সাজা সুনিশ্চিত করতে। যদি আপনি বলেন "নিজের মা বোনের সাথে হলে কী করতে?" তাহলে আমার উত্তর হবে আমি খুন করে ফেলতে চাইতাম রেপিস্টকে। আর ঠিক এই কারণেই আমার হাতে শাস্তির ভার দেওয়া নেই। কারণ আমি সেই কাজটা করলে সেটা বিচার হত না, প্রতিহিংসা হত। ট্যারান্টিনোর হেটফুল এইট সিনেমায় একটা ডায়লগ আছে। "আ জাস্টিস সার্ভড উইদাউট ডিসপ্যাশন ইস নো জাস্টিস অ্যাট অল" (এক্স্যাক্ট কোট মনে নেই, এরকমই খানিকটা)। অর্থাৎ বিচার এবং শাস্তি তারই দেওয়া উচিত যার মনে আসামীর সম্পর্কে কোন আবেগ নেই। সেই বিচার আসামীর বন্ধু করলে যেমন অবিচার হবার সম্ভাবনা তেমনই আসামীর সম্পর্কে মনে ঘৃণা পোষণকারী করলেও। তাই ধর্ষিতার বাড়ির লোক ধর্ষককে সর্বসমক্ষে থেঁতলে মেরে ফেললে সেটা বিচার না, প্রতিহিংসা। আর প্রতিহিংসাকে বিচারের নামে চালালে কবে যে প্রতি উড়ে গিয়ে শুধু হিংসাকেও বিচার বলে চালানোর চেষ্টা হবে, সেটা নির্ণয় করা অসম্ভব।

ঈশ্বর পৃথিবীর সবথেকে বড় গুজব ~ চিত্রদিপ সোম

ভগবানের অস্তিত্বের দাবীদারদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেওয়া কিছু প্রশ্ন-

১) সমস্ত সৃষ্টির পিছনে যদি একজন সৃষ্টিকর্তার হাত থাকে, স্রষ্টা ছাড়া সৃষ্টি যদি অসম্ভব হয়, তাহলে  ভগবানের স্রষ্টা কে?  

২) ভগবান স্থান (space) ও সময় (time) সৃষ্টি করেছেন কোন স্থানে বসে এবং কোন সময়ে?

৩) ঈশ্বর কি সাকার না নিরাকার? এক্ষেত্রে কোন ধর্মের কথা  মানবো এবং কেন? 

৪) যদি নিরাকার হন, তাহলে প্রায় সমস্ত ধর্মেই ঈশ্বরকে 'পুরুষ' বলে মনে করা হয় কেন? 'পিতা' সম্ভাষণ করা হয় কেন?  নিরাকারের কি কোনো লিঙ্গ পরিচয় সম্ভব? 

৫) যদি সাকার হন, তাহলে বিভিন্ন ধর্ম যারা ঈশ্বরকে সাকার বলে মানে, তাদের একের বর্ণিত ঈশ্বরের চেহারার সাথে অন্য ধর্মে বর্ণিত ঈশ্বরের চেহারার বিন্দুমাত্র মিল নেই কেন? উদাহরণ হিসাবে হিন্দু ও গ্রীক দেবদেবীদের একটা তুলনামূলক আলোচনা তুলে ধরা যাক।  ভারতীয় দেবদেবীরা চেহারা, পোশাক, ভাষায় পুরোপুরি ভারতীয়, আবার গ্রীক দেবদেবীরা চেহারা, পোশাক, ভাষায় পুরোপুরি গ্রীক। ভারতীয় সব দেবদেবীদের চুলের রঙ ভারতীয়দের মতই কালো, আবার গ্রীক দেবদেবীদের চুলের রঙ গ্রীকদের মতই বাদামী। ভারতীয় দেবীরা ভারতীয় মহিলাদের পোশাক শাড়ি পড়েন, আবার গ্রীক দেবীরা ঝুলওয়ালা গাউন পরেন। কেন?  কেন ভারতীয় দেবীদের পরণে গাউন আর গ্রীক দেবীদের পরণে শাড়ি নেই? কেন গ্রীক দেবতাদের চুল কালো এবং ভারতীয় দেবতাদের চুল বাদামী নয়?  অনান্য ধর্ম সম্পর্কেও একথা খাটে। গ্রীক  দেবরাজ জিউস কেন অলিম্পাস পর্বতে এবং শিব কেন কৈলাস পর্বতে থাকেন?  মাঝে মধ্যে একে অন্যের জায়গায় ঘুরতেও কেন যান না?

৬)  সমস্ত হিন্দু ধর্মের অবতাররা বেছে বেছে ভারতেই জন্ম নিলো কেন? পৃথিবীতে আর দেশ ছিলো না?  তারা ভগবান মানতো না?  নাকি ভারতই সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ ছিলো বরাবর? তাই বারেবারে এই অবতারজন্ম গ্রহন?  অনান্যরা ধোয়া তুলসীপাতা ছিলো? আবার, সমস্ত পয়গম্বররা আরবেই জন্ম নিলো কেন বেছে বেছে?  অন্য জায়গায় মানুষ থাকতো না?

৭) আজ থেকে অত হাজার হাজার বছর আগে, যখন স্বাভাবিক ভাবেই সহজ সরল জীবনযাত্রার কারণে দূর্নীতি আজকের থেকে অনেক কম ছিলো, তখন ভগবান এতবার জন্ম নিলেন। অথচ আজকের এই ভয়ংকর দুর্নীতি, অবক্ষয়ের যুগেও ভগবান জন্ম নিচ্ছেন না কেন? যখন ইথিওপিয়া থেকে কালাহান্ডি দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে ধুঁকছে, না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ, যখন কর্পোরেট কোম্পানীগুলো জল জমি জঙ্গল দখল করে কারখানা তৈরী করছে, যখন মণিপুর, কাশ্মীর,  গুয়াতেমালা বা মায়ানমারে সামরিক বাহিনীর হাতে বারংবার মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, তখন ভগবান কোথায় থাকেন?  কেন একবার অবতার হিসাবে জন্ম নিয়ে এর প্রতিকার করার প্রয়োজন মনে করেন না?

৮) ভারতীয়রা সরস্বতী পুজা করে ধুমধাম করে, অথচ ভারতেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী নিরক্ষর মানুষ বাস করে। আবার বছর বছর লক্ষ্মীপুজো করেও পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলির একটা হল ভারত। অন্যদিকে সরস্বতী বা লক্ষ্মীপুজা না করেও পাশ্চাত্যের দেশগুলি আমাদের চেয়ে সম্পদবান, শিক্ষার হার আমাদের চেয়ে অনেক বেশী। কেন?

৯) বিশ্বজগৎ সৃষ্টির ব্যাপারে এক এক ধর্ম এক একরকম বর্ণনা দিয়েছে, এবং তাদের কারো সাথে কারো বর্ণনা মেলে না। এদের যেকোনো একটাকে বিশ্বাস করতে গেলে বাকিগুলিকে অবিশ্বাস করতে হয়। কেন?  এদের মধ্যে কোনটাকে আমি ঠিক বলে ধরব এবং কিসের ভিত্তিতে ধরবো? 

১০) কেন বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের বিশ্বসৃষ্টির তত্ত্বের সাথে বিজ্ঞানের বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব বিন্দুমাত্র মেলে না?  বিজ্ঞান যে ব্যাখ্যা দেয় তার পিছনে যুক্তি ও প্রমান হাজির করে। ধর্মের বিশ্বতত্ত্ব সৃষ্টির পিছনে কোন প্রমান হাজির করা গেছে আজ অবধি?

১১) বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থগুলি পড়লে একথাই মনে হয় যে  ভগবান সরাসরি মানুষ, বিভিন্ন পশুপাখি, গাছপালা ইত্যাদিকে তাদের বর্তমান আকৃতিতে সৃষ্টি করে গেছেন। অথচ আমরা জানি তা সত্য নয়। বিবর্তনের পথ ধরে দীর্ঘ পথ হাঁটার পরে সমস্ত পশুপাখি, গাছপালা তাদের বর্তমান চেহারা পেয়েছে। পূর্বে এদের চেহারা সম্পূর্ণ অন্যপ্রকার ছিলো। এর কোনো উল্লেখ কোনো ধর্মগ্রন্থেই নেই কেন? বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে 'ভগবান মানুষ সৃষ্টি করলেন' বা 'ভগবান বাঘ সৃষ্টি করলেন' জাতীয় কথা থাকলেও 'ভগবান অ্যামিবা সৃষ্টি করলেন' বা 'ভিব্রিও কলেরি সৃষ্টি করলেন' জাতীয় কোনো কথা নেই কেন? কেন কোনো ধর্মগ্রন্থেই নেই ভগবানের 'ডাইনোসর' সৃষ্টির কথা? যারা ধর্মগ্রন্থগুলো লিখেছিলেন তারা না হয় পুরানো দিনের মানুষ, তখনও বিজ্ঞান বা প্রত্নতত্ত্ব এত অগ্রসর হয় নি,  অণুবীক্ষণযন্ত্রও আবিষ্কার হয় নি, তাই এদের অস্তিত্বের কথা জানতো না। কিন্তু ভগবান তো জানতেন। তিনি তো সর্বজ্ঞ।  এদের সতর্ক করেন নি কেন? 

১২) যে ধর্ম যে অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে, সেই ধর্মের ধর্মগ্রন্থের সৃষ্টিতত্ত্বে শুধু সেই অঞ্চলের স্থানীয় পশুপাখি, গাছপালার নাম উল্লেখ করা হয়েছে।  কেন হিন্দু ধর্মে বিভিন্ন গাছপালা পশুপাখি ভগবানের সৃষ্টি বলে লেখা থাকলেও লেখা নেই 'ভগবান ক্যাঙ্গারু সৃষ্টি করলেন' বা আরবদের ধর্মে অনান্য পশুপাখির কথা লেখা থাকলেও লেখা নেই 'ভগবান উটপাখি তৈরী করলেন' জাতীয় কথা?  হিন্দুরা সেইযুগে ক্যাঙ্গারুর বা আরবরা উটপাখির অস্তিত্বের কথা জানতেন না, যেহেতু যোগাযোগ ব্যবস্থার অনুন্নয়নের কারণে  সেইসময়কার মানুষের ভৌগলিক জ্ঞান সীমাবদ্ধ ছিলো। ঠিক আছে। কিন্তু ভগবান তো জানতেন। কেন তাদের সংশোধন করে দেন নি? 

১৩) স্বর্গ এবং নরক জায়গাগুলো ঠিক কোথায়?  আজ বিজ্ঞান বহুগুন উন্নত হয়েছে। কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের জিনিষও আজ আমরা অতিশক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্তের কল্যানে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু স্বর্গ বা নরকটা ঠিক কোনখানে অবস্থিত?  পৃথিবী আর মঙ্গলের মাঝখানে, নাকি বৃহষ্পতি আর শনির মাঝখানে, নাকি এই সৌরজগতের বাইরে কোথাও?  যদি বাইরে হয়, তাহলে ঠিক কোনখানে?  জায়গাটির আয়তন কত?  সেটা কি কোনো গ্রহ?  সেখানে দিন রাত হয় শুনেছি। তারমানে কোনো গ্রহেই অবস্থিত স্বর্গ নরক। তা কোন নক্ষত্র সেখানে বিরাজ করছে, যার চারপাশে স্বর্গ বা নরক নামক গ্রহগুলি ঘুরছে? সেখানকার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর চেয়ে বেশী না কম?  বেশী কম হলে কতগুন বেশী বা কম? সেখানে কটি মহাদেশ বা মহাসাগর আছে?

১৪) সমস্ত ধর্মেই নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, নানা তাচ্ছিল্য ও ঘৃণা সূচক উক্তি ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে। কেন?  ভগবানও কি তবে পুরুষতান্ত্রিকতার শিকার?

১৫) জীবহত্যায় পাপ হয় না পুন্য হয়?  এ ব্যাপারে আপনার অবস্থান পরিষ্কার করুন। কারণ এক এক ধর্মে এ ব্যাপারে এক এক প্রকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মানুষ বিভ্রান্ত হতে বাধ্য।

১৬) মানুষ বা অনান্য প্রাণীরা নাকি পূর্বজন্মের কর্মফল অনুসারে এ জন্মে জন্মগ্রহন করে। অর্থাৎ পূর্বজন্মে ভালো কাজ করলে এ জন্মে মানুষ হয়ে জন্মাবে বা মানুষ হয়ে জন্মে খারাপ কাজ করলে পরবর্তী জন্মে পশু হয়ে জন্মাবে ইত্যাদি। তা পূর্বজন্ম পূর্বজন্ম করে পিছাতে পিছাতে পৃথিবীতে প্রথম যে প্রাণের উন্মেষ ঘটেছিলো, সেটি তার কোন পূর্বজন্মের কর্মফলে পৃথিবীতে এসেছিলো?  আর তাছাড়া মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রানীর তো ন্যায় অন্যায় বোধই নেই। তাদের পাপপূন্য নির্নয় হয় কিভাবে?  কিভাবে নির্ণয় করবেন আমার বাড়ির সজনে গাছটার পাপপূণ্যের খতিয়ান?
     
                                                        
এবার রইলো আস্তিকদের সম্ভাব্য কিছু মন্তব্য ও তার জবাব

১) বহু বিশিষ্ট মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন নিউটন, রবীন্দ্রনাথ ঠকুর থেকে আব্দুল কালামের মত প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিরা।  তারা সবাই ভুল করেছেন?  আপনি একা খালি ঠিক? 

উত্তর- রবীন্দ্রনাথ থেকে আবদুল কালাম,  এদের ঈশ্বরবিশ্বাস কখনোই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রমান করে না। এ থেকে এটুকুই প্রমানিত হয় তারা এই কাল্পনিক শক্তিতে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু বিজ্ঞানের কাছে ব্যক্তিবিশ্বাসের কানাকড়িও মূল্য নেই, যতক্ষন না তা প্রমাণিত হচ্ছে।  এই কারণেই কয়েকশো বছর ধরে কিংবদন্তী বৈজ্ঞানিক হিসাবে পূজিত নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বকে বাতিল করে আইনষ্টাইন নামের এক অজ্ঞাতকূলশীল (সেই সময়) যুবকের আপেক্ষিকবাদ কে আপন করে নিয়েছে বিজ্ঞান। ডালটনের পরমাণুবাদ পরবর্তীকালে পৃথিবী বাতিল করে দিয়েছে, পালটা যুক্তি প্রমানের কাছে তাদের তত্ত্ব হেরে গেছে বলে। 'নিউটন বা ডালটন কিংবদন্তী বৈজ্ঞানিক, অতএব তিনি যাহা বলিবেন তাহাই ধ্রুব সত্য' এই বলে বিজ্ঞান বসে থাকে নি। এভাবেই বিজ্ঞান সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে তোলে। কোপার্নিকাস থেকে গ্যালিলিও মনে করতেন পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে বৃত্তাকার পথে ঘোরে, কিন্তু পরবর্তীকালে কেপলার প্রমান করেছিলেন তারা ঘোরে উপবৃত্তাকার পথে। বিজ্ঞান কোপার্নিকাস গ্যালিলিওর তত্ত্বকে বাতিল করে কেপলারের তত্ত্বকে গ্রহন করেছে। কাজেই ব্যক্তিবিশ্বাস দিয়ে কিচ্ছু প্রমাণিত হয় না। আজ যদি প্রমাণিত হয় রবীন্দ্রনাথ বউকে ধরে পেটাতেন (কথার কথা), তাহলে আমরাও কি চোখ বুজে তাই আদর্শ ধরে নিয়ে যে যার বউকে পেটাতে শুরু করবো?  এরকম অন্ধ গুরুবাদী মানসিকতা হলে তো মুশকিল!

২) সমস্ত ধর্মেই ঈশ্বর বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে। ঈশ্বর যদি নাই থাকবেন তাহলে এরা প্রত্যেকেই এক কথা বলেছে কেন? 

উত্তর- হীনযান বৌদ্ধধর্ম ছাড়া সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই ঈশ্বরবিশ্বাসী। যদিও তাদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য, এমনকি নিজেদের মধ্যেই অনেক স্ববিরোধিতা আছে। কিন্তু তাতেও কিচ্ছু কাঁচকলা প্রমাণিত হয় না। প্রতিটি ধর্মই অমানবিক অজস্র নির্দেশে ভরপুর। ইসলামে আছে স্ত্রীকে বেত্রাঘাত করার বিধান, স্ত্রীকে বর্ণনা করা হয়েছে স্বামীর শস্যক্ষেত্র হিসাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। একই ধরনের বহু খারাপ কথা নারী ও শুদ্রদের সম্পর্কে বলা হয়েছে হিন্দুধর্মেও। সেখানে নারীকে বিষাক্ত সাপের সাথে তুলনা করা হয়েছে। তারা প্রকৃতিগতভাবে চরিত্রহীনা বলা হয়েছে। শূদ্ররা বেদপাঠ শুনলে কানে গরম সীসা ঢেলে দেবার বিধান রয়েছে।  তা থেকে কচুপোড়া কিছু প্রমান হয় কি?  নাকি 'যেহেতু ধর্মে রয়েছে অতএব তা মান্য' ধরে নিয়ে এগুলোও আমরা ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করা শুরু করবো? 

৩) ধর্মবিশ্বাসী মাত্রেই মৌলবাদী নন। অনেকেই আছেন নিজের ধর্মে আস্থাশীল থেকেও অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। 

উত্তর- ধর্ম বিশ্বাসী মানেই ISIS বা RSS এটাও কোথাও বলে নি কোনো নাস্তিক। এটা যারা বলেন তারা নিজের ধর্মের মৌলবাদে আকন্ঠ নিমজ্জিত। মৌলবাদীদের বলা কথা নাস্তিকদের গায়ে সেঁটে দেবেন না।

৪) ঈশ্বরবিশ্বাস যদি 'ভুল' হবে, তাহলে আজও কেন পৃথিবীর কোটি কোটি লোক ঈশ্বরবিশ্বাসী?  তারা সবাই ভুল?  নাস্তিকদের সংখ্যা তো গুটিকয় মাত্র। 

উত্তর- সারা পৃথিবীতেই ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসছে। ইউরোপের অনেক দেশেই আজ নাস্তিকরা মোট জনসংখ্যার ৫০% এরও বেশী। একটু দয়া করে গুগল করে দেখে নিন। কিন্তু সেটা যদি নাও হত, পৃথিবীর ১০০% মানুষই যদি ঈশ্বরবিশ্বাসী হত  তাতেও বা হাতিঘোড়া কিচ্ছু প্রমাণিত হত না। 'পৃথিবীর সব মানুষ স্বীকৃতি দেয়, অতএব তা সত্য' এটা বিজ্ঞানের কথা নয়। সত্য কখোনো সংখ্যা দিয়ে নির্ধারিত হয় না। একসময় গোটা পৃথিবীর মানুষ মনে করত পৃথিবী স্থির, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরপাক খায়। গ্যালিলিও প্রমান করেছিলেন তা ভুল। বিজ্ঞান সারা পৃথিবীর কথাকে না মেনে গ্যালিলিওর কথাকে মেনে নিয়েছিলো, কারণ তার পিছনে যুক্তি প্রমান ছিলো। একসময় সারা পৃথিবীর মানুষ মনে করত রোগের কারণ ভগবানের অভিশাপ। প্যারাসেলসাস প্রমাণ করেছিলেন রোগের কারণ জীবানু। বিজ্ঞান প্যারাসেলসাসের তত্ত্বকে গ্রহন করেছে,  সারা পৃথিবীর তত্ত্বকে নয়। এরকম আরো অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। কাজেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে রাজনীতি চলতে পারে, বিজ্ঞান চলে না।

৫) বিজ্ঞান কি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে?  সামান্য একটা এককোষী জীব তৈরী করেও কি বিজ্ঞান দেখাতে পারবে? পারবে না। ঈশ্বরের অস্তিত্বকে শেষ অবধি স্বীকার করতেই হবে।

উত্তর- ধরে নিলাম বিজ্ঞান কৃত্রিম কোষ কেন, এমাইনো এসিডও তৈরী করতে পারে নি। তাতেই বা কি এসে গেলো?  আজ পারে নি, ভবিষ্যতে পারবে। বা হয়ত পারবে না। আজ বিজ্ঞান বহু জিনিষের কারণ খুঁজে বের করেছে যা অতীতে জানা ছিলো না। অতীতে আমরা জানতাম না গাছের পাতা সবুজ কেন, আকাশ নীল কেন। আজ জেনেছি। কিন্তু 'ভগবান আকাশকে নীল রঙে তৈরী করেছে, তাই আকাশ নীল', এটা ধরে বসে থাকলে আমরা কোনোদিনই জানতে পারতাম না আকাশের নীলের প্রকৃত কারণ। তেমনি আজ যা জানি না ভবিষ্যতে তা জানা যাবে। কিন্তু বিজ্ঞানের অসফলতা ভগবানের অস্তিত্বের প্রমান হয় কি করে?  ধরা যাক আমি বললাম রামগোড়ুরের ছানারা বাস্তবে আছে। তারা আকাশে থাকে। কোনো নাস্তিক আমাকে বোঝাতে আসলো এরকম কিছুর অস্তিত্ব নেই। আমি তাকে বললাম 'তোমার বিজ্ঞান একটা কোষও তৈরী করে দেখাতে পারে নি, অতএব এটা থেকেই প্রমান হয় রামগোড়ুরের ছানার বাস্তব অস্তিত্ব আছে'। মানবেন তো সেই যুক্তি?  তলিয়ে ভাবলেই বুঝতে পারবেন এটা আসলে কোনো যুক্তিই নয়। 'রাম পরীক্ষায় পাস করতে পারে নি, অতএব শ্যামকে ফুল মার্কস দিতে হবে' মার্কা বোকা বোকা কথা এটা।

তাই, এই দীর্ঘ আলোচনার শেষে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতেই পারি, 'ঈশ্বর হচ্ছেন সর্বকালের সেরা গুজব'। তাই নয় কি বন্ধুরা?

শুক্রবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৮

আসিফা ~ আর্কাদি গাইদার

যারা এখন আসিফার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার বিবরণ পড়ে চমকে উঠছেন, তাদের কাছে অনুরোধ, একে নিছক খুন না ধর্ষণ হিসেবে দেখবেন না। একের পর এক ঘটনাবলী দেখুন।
আসিফা একটি ৮ বছরের শিশু। কাশ্মীরের বাখারওয়াল মুসলিম উপজাতির সদস্য। জম্মুর কাঠুয়া অঞ্চল থেকে এই উপজাতি দলটিকে বিতাড়ন করবার উদ্দ্যেশ্যে তাদের ভয় দেখাতে হবে। তাই আসিফাকে অপহরণ এবং ধর্ষণ। এখানে ধর্ষণ হলো রাজনৈতিক রণকৌশল। বা হয়তো শুধু কৌশল নয়, ধর্ষণই রণনীতি।
এক এক করে দেখি আসুন। আসিফাকে অপহরণ করে তাকে একটি মন্দিরের পুজোগৃহে হাত পা বেধে রাখা হলো প্রায় ৭ দিন ধরে। তাকে ওষুধ খাইয়ে আছন্ন রাখা হলো। বারংবার ধর্ষণ করা হলো। ধর্ষণের সময় অঞ্চল থেকে বাখরাওয়ালদের পলায়ন চেয়ে ধর্ষকরা পুজোআচ্চাও করলো। ধর্ষকরা ডেকে আনলো স্পেশ্যাল পুলিশ অফিসারকে। সেও ধর্ষণ করলো। এরমধ্যে একজন মীরাট থেকে তার বন্ধুকে ডেকে পাঠালো। সে মীরাট থেকে ধর্ষণ করতে চলে এলো। রেপ ট্যুরিজম। এরপর আসিফাকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হলো। তারপর তার দেহ ফেলে দেওয়ার আগে শেষবারের মতন আরেকজন ধর্ষণ করলো। এরপর তার মৃতদেহকে বনে ফেলে দিয়ে পাথর দিয়ে মাথা থেতলে দেওয়া হলো।
পুলিশ প্রথমে মিসিং পার্সনস কমপ্লেন নেয়নি। নেওয়ার পর একে একে যখন গ্রেপ্তার করা শুরু করলো তখন অপরাধীদের সমর্থনে মিছিল মোর্চা মিটিং শুরু হয়ে গেলো। হিন্দু একতা মঞ্চ তৈরি হলো। বিজেপির এমএলএ, মন্ত্রী ধর্ষকদের সমর্থনে দাঁড়িয়ে গেলো। মহিলারা ধর্ষকদের সমর্থনে গায়ে আগুন দেওয়ার হুমকি দিলো। হিন্দু একতা মঞ্চ জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল করলো। হ্যা, আমাদের তেরঙ্গা পতাকা কে ওড়ানো হলো ধর্ষণের বিজয়োৎসব পালন করতে। এই গোটা সার্কাসটার পরে যখন কোর্টে চার্জশীট ফাইল করতে গেলো পুলিশ, তখন জম্মু বার এসোশিয়েশনের উকিলরা অবরোধ করে স্লোগান দিলো 'জয় শ্রী রাম'। তারও পরে কোর্টের বিচারপতিরা পুলিশকে ৬ ঘন্টা অপেক্ষা করালো। চার্জশিট তারা নেবে না। ৬ ঘন্টা অপেক্ষারত পুলিশের থেকে শেষমেষ চার্জশিট গ্রহণ করা হলো।
আপনারা ভাবছেন এরকম কেন? ধর্ষকের সমর্থনে কি করে এতগুলো মানুষ মিছিল করে, জাতীয় পতাকা ওড়ায়, জয় শ্রীরাম স্লোগান দেয়? এতক্ষনে তাহলে আপনি সঠিক প্রশ্নটি করেছেন।
পুলিশ, এসপিও, এমএলএ, মন্ত্রী, উকিল, জাজ - এটাই হলো ভারত রাষ্ট্র। আর ওই ৮বছরের শিশু আসিফা - ওটা হলো কাশ্মীর। এই প্রত্যেকটি লোক যারা মিছিল করছে, স্লোগান করছে - তাদের মাথায়, চেতনায়, তাই। তাই জন্যে ওদের কাছে এটা স্রেফ ধর্ষণ নয়, এখানে অপরাধীরা স্রেফ ধর্ষক নয়, আসিফা স্রেফ একটি বাচ্চা মেয়ে না। ওরাও জানে, একদম সবার চোখের সামনে ওরা প্রকাশ করে ফেলেছে ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্র আর কাশ্মীরের সম্পর্কটা ঠিক কি। সেই কাশ্মীর, যেখানে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রত্যেক তিনজন পুরুষের মধ্যে একজন ধর্ষিত। হ্যা ঠিক পড়েছেন, প্রত্যেক তিনজন পুরুষের মধ্যে একজন।
ওরা আসলে ধর্ষকদের স্বপক্ষে মিছিল করছে না। করছে নিজেদের স্বপক্ষে। কারন ওরা জানে, ওরা প্রত্যেকে এই অপরাধে অংশ নিয়েছে। এবং ওরা চায় আপনিও অংশীদার হন। তাই আপনার ধর্মীয়বোধকে উস্কাতে জয় শ্রীরাম, আপনার জাতীয়তাবোধকে উস্কাতে তেরঙ্গা পতাকা।
একটি ৮ বছরের ধর্ষিতা শিশুর মৃতদেহ লড়ছে। লড়ছে শুধু ধর্ষকদের বিরুদ্ধে না, কাশ্মীরে ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে। ওদের তেরঙ্গা, ওদের ধর্ম পক্ষ বেছে নিয়েছে। ধর্ষকের পক্ষ। আপনার তেরঙ্গা, আপনার ধর্ম কোন পক্ষ বাছবে?

লুম্পেনরাজ ~ সুশোভন পাত্র

বলেন কি দাদা! এই পশ্চিমবঙ্গ আপনি চাননি? এই 'পরিবর্তন' মানুষ চায়নি? এই 'পরিবর্তন চাই' লিখে কলকাতায় পোস্টার পড়েনি? 'বুদ্ধিজীবী'রা রাজপথে মিছিল করেনি? এই পরিবর্তনের সিঁদ কাটতে জনপ্রিয় নায়িকা সানগ্লাস পরে, মিনারেল ওয়াটারের বোতল হাতে লালগড় দৌড়ায়নি? জঙ্গলমহলের 'বেতাজ বাদশা'রা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে মুখ্যমন্ত্রী দেখতে চেয়ে বেয়নেট-কার্তুজে রক্তের হোলি খেলেনি? স্টার আনন্দ হেলিকপ্টার চেপে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলপিন টু এলিফ্যান্ট আপনার ড্রয়িংরুমে যত্ন করে পৌঁছে দেয়নি? প্রতিদিন নিয়ম করে, মা-মাটি-মানুষের মনোহারী ব্যঞ্জনে নীল-সাদা হাওয়াই চপ্পলের টপিং দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে গরীবের 'মসিহা' বানিয়ে আপনার ডিশে সার্ভ করা হয়নি? 

সেদিন গদগদ আনন্দবাজার সিক্সটি পয়েন্ট হেডিং-এ লিখেছিল, 'বাম বিদায়'। লিখেছিল, 'উন্নয়ন আর সুশাসনই মন্ত্র মমতার।¹' শুধু লেখেনি, সেই 'উন্নয়ন'ই একদিন লাঠি হাতে দাড়িয়ে থাকবে আপনার পাড়ার রাস্তার মোড়ে। সেই 'উন্নয়ন'ই একদিন বাইকে চেপে, মুখ ঢেকে, বোমাবাজি করবে আপনার নিরুপদ্রব গ্রামে। শুধু লেখেনি, সেই 'সুশাসনেই' একদিন ভিন রাজ্যের মার্কা মারা মস্তানরা বিরোধী'দের পেটাতে তাবু খাটিয়ে ঘাঁটি গাড়বে মদ-মাংসর আড্ডায়। সেই সুশাসনেই একদিন পুলিশ লক আপে সাংবাদিকার তল্লাশি হবে নগ্ন অবস্থায়। ঝাঁ চকচকে নবান্নের চোদ্দতলা থেকে ম্যাডাম অবশ্য টুইট করে জানিয়ে দিয়েছেন; 'পশ্চিমবাংলায় গণতন্ত্র অটুট'। 

ম্যাডামের থেকে 'গণতন্ত্র' কেই বা আর ভালো জানবেন বলুন? টানা তিনবার জয়ের পর সেদিন যাদবপুরে সোমনাথ চ্যাটার্জির বিজয়রথ ১৯,৬৬০ ভোটের ব্যবধানে থমকে দিয়ে, তাক লাগিয়ে, পার্লামেন্টে সর্বকনিষ্ঠা সাংসদ হিসেবে অভিষিক্তা হয়েছিলেন রাজনীতির আঙ্গিনায় নিতান্তই আনকোরা ঐ কিশোরী; মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়²। রাজনৈতিক জীবনে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ১৯৮৪-২০০৯, ৯বার লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জিতেছেন ৮ বারই³। বিরোধী রাজনীতির গুল্ম থেকে পরিণত হয়েছেন মহীরুহে। বামফ্রন্ট সরকার আমলেই, মানুষের ভোটেই, নির্বিঘ্নে আর অবাধেই।

অবশ্য সোমনাথ চ্যাটার্জির নির্বাচনী হার ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। ১৯৭৭'র বিধানসভা নির্বাচনে কাশীপুর বিধানসভা কেন্দ্রে নিকটতম কংগ্রেস প্রতিদ্বন্দ্বী প্রফুল্ল কান্তি ঘোষের বিরুদ্ধে ৫,৯৭৬ ভোটে বিজিত সি.পি.আই(এম) প্রার্থী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাঁধে ন্যস্ত হয়েছিল প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রকের গুরু দায়িত্ব⁴। ১৯৮২'র বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের প্রাপ্ত আসন ১৯৭৭'র ২৩১'র তুলনায় বেড়ে দাঁড়ালো ২৩৮। প্রাপ্ত ভোটও ৪৫.৮৪% তুলনায় বেড়ে দাঁড়ালো ৫২.৭% ⁵। অথচ, ঐ কাশীপুর কেন্দ্রেই, ঐ কংগ্রেসের, ঐ প্রফুল্ল কান্তি ঘোষের কাছেই ৭২৮ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হলেন বামফ্রন্ট সরকারের 'হেভিওয়েট' মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ⁶। 

পড়ন্ত বিকেলে রাইটার্সের সিঁড়ি তে সেদিন জ্যোতি বসু'র নাগালে পেতেই সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছিলেন 
- বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নির্বাচনী হার নিয়ে আপনি কি বলবেন? 
স্বভাবসিদ্ধ শান্ত শীতল আর প্রত্যয়ী গলায় জ্যোতি বাবু জবাব দিয়েছিলেন 
- আমি কি বলব ? বলবেন তো আপনারা। রাজ্যে গণতন্ত্র কত শক্তিশালী সেটা বলুন। অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোটের এর থেকে উৎকৃষ্ট উদাহরণ কি আর হতে পারে?

উদাহরণের উৎকৃষ্টতা আরও আছে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের দৃষ্টান্তমূলক নজিরে বাংলা'তেই সূত্রপাত হল পঞ্চায়েত নির্বাচনের। ১৯৭৮'র সেই নির্বাচনে, রাজ্যের ৫৫,৯৮২টি আসনে মোট ১,৭৩,৬০০ প্রার্থীর মধ্যে, দুই কংগ্রেস ও জনতা দলের সহায়ক নির্দল সহ মোট বিরোধী প্রার্থী ছিলেন ১,০৩,৪৪৩। আর অন্যদিকে বামফ্রন্টের মোট প্রার্থী ৫৬,৪৫৭। ৬ বছর রাজ্যপাট চালানোর পরেও ১৯৮৩'র পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যের ৫৪,১৯২ আসনের মধ্যে বামফ্রন্ট জিতেছিল ২৯,৫৬৬ আসনে। ১৯৭৮'র ৩৪,১৮৯'র তুলনায় ৬.৬% কম। আর ঐ পঞ্চায়েত নির্বাচনেই কংগ্রেসের আসন বেড়েছিল ২২.৪৮%⁷। ১৯৭৮ এবং ১৯৮৩, বামফ্রন্টের আমলে প্রথম দুই পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন আসনের গড় ছিল শতকরা ০.৭৩%। আর ৩৪ বছরের সাতবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন আসনের গড় ৪.৪৪%⁸ ⁹। আসলে গণতন্ত্র রক্ষার কোন শিক্ষাই বামফ্রন্টের কাছে নেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর নেননি বলেই তৃণমূলের গণতন্ত্রে, ২০১৩'র পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন আসন ছিল ১১% ¹⁰। আর এবার সেটা কমপক্ষে ২০.৫৫% ¹¹। 

আচ্ছা, কি ভেবেছিলেন বলুন তো দাদা? ৭০'র অন্ধকারে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের ভাবশিষ্যা হয়ে যার রাজনীতিতে আগমন, জাল সার্টিফিকেটে লগ্নে যার সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু, বিধানসভা ভাঙচুরে যার রাজনৈতিক উত্থান, তিনি গুণ্ডা না পুষে চণ্ডীপাঠ করবেন? কি ভেবেছিলেন, গণতন্ত্রের পাঁচ পা দেখবেন? অবাধ ভোটাধিকার পাবেন? 'বদলা নয় বদল হবে'? কার্টুন আঁকবেন? সুদীপ্ত-সইফুদ্দিনরা বিরোধী ছাত্র রাজনীতি করবে? বরুণ বিশ্বাসেরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করে প্রাণে বেঁচে থাকবেন? রেলের জমিতে ভেলর-চেন্নাই'র মত স্বাস্থ্য পরিষেবা গড়ে উঠবে? পাহাড়ে, গুরুং অ্যান্ড গিরি কোম্পানি এক চিলতে গোর্খাল্যান্ড নিয়ে বিজয় মিছিল করবে? জঙ্গলমহলে যৌথ বাহিনী প্রত্যাহার করে চৈত্র মাসে বিশেষ সেল দেওয়া হবে? রাঢ় বাঙলা গ্রেটার ঝাড়খণ্ডে মিশে যাবে? দু-কিস্তির মহার্ঘ্য ভাতা মিটিয়ে সরকারী কর্মচারী'দের বেতন কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী'দের সাথে মিলে মিশে চমচম হয়ে বইবে? ব্যাগ নিয়ে বাজারে বেরোলে টপাস করে একটা চাকরি এসে পড়বে? ঘরের জানলা দিয়ে আলটপকা আপনার বেডরুমেও বিদেশি বিনিয়োগ এসে হামাগুড়ি দেবে ? 

এসব কিছুই হওয়ার ছিল না। হয়ও নি। তাই আজ না হয় একবার হিসেব কষেই দেখুন। আয়নায় সামনে দাড়িয়ে একবার চাওয়া-পাওয়ার অঙ্ক মিলিয়েই দেখুন। যে বাংলায় বিনিয়োগ নেই, শিল্প নেই, বেকার'দের চাকরি নেই এস.এস.সি-টেটের নিয়োগে স্বচ্ছতা নেই, ঘুষ ছাড়া ইন্দিরা আবাসের ঘর নেই, কমিশন ছাড়া পঞ্চায়েতর কাজের টেন্ডার নেই, তৃণমূল না করলে সরকারী প্রকল্পের লিস্টে নাম নেই, পাড়ার মস্তান নেতা'দের অনুমতি ছাড়া গাছের পাতা নড়ার উপায় নেই, এমনকি আজ আপনার অবাধ শান্তিপূর্ণ ভোট দেবার নুন্যতম অধিকার পর্যন্ত নেই; সেই বাংলায় লড়াইটা কি আর শুধুই একটা পঞ্চায়েত নির্বাচনের আছে? সেই বাংলায় লড়াইটা কি শুধুই সি.পি.আই(এম) আর তৃণমূলের আছে? সেই বাংলায় লড়াইটা কি শুধুই নিছক রাজনীতির অঙ্কের আছে? 

আসলে লড়াইটা এখন নিজের ভোটাধিকার রক্ষার। লড়াইটা এখন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের। লড়াইটা এই দমবন্ধ পরিবেশটা বদলে দেবার। লড়াইটা নতুন বাংলা গড়ার। লড়াইটা আমার। লড়াইটা আপনার। লড়াইটা এই লুম্পেন'দের বিরুদ্ধে বাকী সবার।











আসিফা বানু ~ উদয়ন পন্ডিত

আপনারা কেউ এশার বাতুলের নাম শুনেছেন? নাতাশা রাথার? সমরিন মুস্তাক? ইফরা বাট বা মুনাজা রশিদ? না শুনে থাকলে জেনে নিন, অবিলম্বে কিনে ফেলুন Do You Remember Kunan Poshpora, আর পড়ে ফেলুন কিভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর রাজপুতানা রাইফেলসের চার নম্বর ব্যাটেলিয়ন এক প্রাক্ বসন্তের রাতে কুপওয়ারার কুনান আর পাশপোরা নামে দুটো পাশাপাশি গ্রামের দেড়শোজনেরও বেশি মহিলাকে গণধর্ষণ করেছিল।জেনে নিন চাহানপোরার ঘটনা,'৯০-এর ৭ই মার্চ ছানবিন করার নামে কিভাবে কুড়িজন সি আর পি এফ জওয়ান চব্বিশ বছরের নূরকে রান্নাঘর থেকে টেনে এনে গণধর্ষণ করেছিল, তারপর তার ননদ জাইনা আর আরো দু'জন কিশোরীকে। জেনে নিন পাজিপোরা-বালি্রাপোর ঘটনা, কুনান-পাশপোরার মাঝারি সংস্করণ চক সৈয়দপোরা, বিজবেহরা,হায়হামা। জেনে নিন গুরিহাখরায় তার ধর্ষিতা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিভাবে অবলীলায় মা বলেছিলেন তাঁর মেয়ে নয়, তিনি ধর্ষিতা হয়েছেন। খাতায় লিখে রাখুন '৯৭-এর ১৩ই এপ্রিল, আগামীকালের তারিখ, যেদিন শ্রীনগরের উপকণ্ঠে ভারতীয় সেনা বারোজন কাশ্মীরী তরুণীকে ধর্ষণ করেছিল। গেঁথে নিন মগজে, গেঁথে নিন মনের মধ্যে- ওয়াভুসা, সোপোর, গুজ্জরদারা-মঞ্জগাঁও- যাতে আপনি চোখ বুজলেই সবুজ ঘাসে চাপ চাপ রক্তের দাগ, নীল আঙ্গিয়া, ওই তো শুয়ে আছে আশিয়া, তার একটু দূরেই নিলোফার জান, তাদের আপেলরঙা গাল, শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট, অনাবৃত তলপেট। 

আপনি ভাবুন সেই নার্সের কথা, সেই মেয়েটি, যে জন্মসূত্রে কাশ্মীরী পণ্ডিত ছিল বলে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছিল JKLF, তারপর পিটিয়ে খুন করেছিল। মনে করুন ত্রেহগাঁওয়ের সরকারি গার্লস স্কুলের সেই ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টের কথা, যে মেয়েটিকে দিনের পর দিন গণধর্ষণ করার পর কুচিকুচি করে কাটা হয়েছিল করাতকলে। মনে করুন ফারুখ আহমেদ দার নামের সেই সারমেয় সন্তানের কথা, যে একটি কিশোরীকে গণধর্ষণের পর গুলি করে খুন করেছিল, মনে করুন সেই শিক্ষিকার কথা, যাকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল তার পরিবারের সামনেই, মনে করুন সেইসব মেয়েদের কথা, যাদের মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে মুতাহ্-এর (সাময়িক বিবাহ) জন্য বাধ্য করেছে সন্ত্রাসীরা, তারপর ধর্ষণ করে গেছে দিনের পর দিন।

এবং আপনি মনে করুন জম্মু-কাশ্মীরে এখন পিডিপি-বিজেপির মিলিজুলি সরকার- তারা এই ধর্ষিতাদের জন্য কি করেছে?

এবার আপনি আপনার ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিন। নিভিয়ে দিন সবক'টা আলো। আপনার সমস্ত জামাকাপড় খুলে ফেলে মেঝেতে শুয়ে পড়ুন। আপনার পিঠে ঠাণ্ডা লাগছে। এবার আপনি মনে করুন সাতদিন ধরে আটবছরের বাচ্চা মেয়েটি একটা মন্দিরের গর্ভগৃহের স্যাঁৎসেঁতে মেঝেতে এর চেয়েও খারাপ অবস্থায় পড়ে ছিল। সে তার ছেঁড়াখোঁড়া যোনিপথে উষ্ণ রক্তের স্রোত অনুভব করছিল; সে তার জরায়ুতে গরম বীর্য অনুভব করছিল; তার ছোট্ট ছোট্ট আঙুলগুলো কাঁপছিল; সে বুঝতে পারছিল তার মধ্যে ঢুকছে আর বেরিয়ে আসছে একের পর এক মানুষ। সে আছাড়ি পিছাড়ি করছিল, সে হাত পা ছুঁড়ছিল, সে কাঁদছিল। তারপর আস্তে আস্তে সব থেমে গেল।

এরপরেও রাস্তাজুড়ে যেসব শুয়োরের বাচ্চারা রামের নামে মিছিল করে, তাদের আমি বাঞ্চোৎ বলি। মূত্রপাত না, তাদের ঘিলুতে আমি পেচ্ছাপ করি। আমি রাস্তাজুড়ে কাঁদি, আমি দেওয়ালজুড়ে লিখি আসিফা বানু, স্বপ্না কুমারী ঝা-র ঠিক পাশে, সুমিতা মণ্ডলের ঠিক পাশে। আমি ছিঁড়েখুঁড়ে দিই গেরুয়া রং, গ্রাফিতিতে লিখি বিলকিস ইয়াকুব রসুল। আমাদের শহরজুড়ে উড়তে থাকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টের পাতা, তুমি ছোট ছোট হাতে লেখ সৃজনদার গান, 'রাষ্ট্র, সে তো এখনো শোষণযন্ত্র', তুমি ছুঁয়ে দাও সেই অগুন্তি উড়তে থাকা পাতা, যাতে লেখা- কাশ্মীরে প্রতি তিনজন পুরুষের একজন ধর্ষিত, ১৯৯২ সালে ভারতীয় সেনা ৮৮২ জন মহিলাকে গণধর্ষণ করেছিল, শুভ মাথুর আর সীমা কাজীর জ্বলন্ত আখর- 'Rape is an essential element of the Indian military strategy in Kashmir' আর 'Rape is a cultural weapon of war'. তুমি ছুঁয়ে দাও আসিফা, আর এই পাতাগুলো টিউলিপ হয়ে ফুটুক হজরতবালের বাগিচা জুড়ে, গজালা আপনমনে শিকারায় বসে গাইতে থাকুক, 'হর চেহরা য়াহা চান্দ তো জরা সিতারা/ ইয়ে ওয়াদি-এ-কাশ্মীর হ্যায় জন্নত কা নজারা', আর তাতেই থেমে যাক উপত্যকা জুড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি, পেলেট গান, পাথরের গায়ে সন্ত্রাসীর ছবি মুছে যাক, ইনশা তার দৃষ্টি ফিরে পাক, পাথরের ফাঁকে ফুটুক বুনো ফুল, সোপিয়ান ছেয়ে যাক টিউলিপে, কোনো এক সন্ধ্যায় পশমিনা জড়িয়ে লিদারের পাশে বসে তুমি আমাকে 'জেহ্‌লুমাস' শুনিও গজালা, 'কদ্‌লে তার দি না কাহ্‌ জেহ্‌লমস/ নায়ভি হুন্দ পেয়ালে চুহ্‌ আয়ভু জেহ্‌লমস/ খোৎসান চস্‌ নাউভি মন্‌জ জেহ্‌লমস'।

অপেক্ষায় রইলাম।



​ছবিঃ অরিজিত সেন ​




শুক্রবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৮

আসানসোলের ইমাম ~ অর্ক ভাদুরী

"আসানসোলের চাঁদমারি মোড়ে দাঁড়িয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ওকে রোড কী ভাবে যাব। ভদ্রলোক আঁতকে উঠলেন— 'ওখানে যাবেন কেন! পুরোটাই মুসলিম মহল্লা। কখন কী হয়ে যাবে কিচ্ছু বলা যায় না। এখনও টেনশন রয়েছে। পুলিশ টহল দিচ্ছে। অন্য কোথাও যান।'' ড্রাইভারও দেখলাম ইতস্তত করছেন। করারই কথা। একটু আগেই আমরা আধপোড়া রিলায়েন্স মার্কেট পেরিয়ে এসেছি। চাঁদমারি, কল্যাণপুর, কসাই মহল্লা, শ্রীনগর, আমবাগান ঘুরেছি। রিলিফ ক্যাম্পে গিয়েছি। আমরা ভয় দেখেছি। আমরা ভয় পেয়েছি। রিলায়েন্স মার্কেটের সামনে শুনশান রাস্তা। গাড়ি চলছে না। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। মোড়ে মোড়ে গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি। সবমিলিয়ে একটা অদ্ভুত ইমেজ— শেষ মার্চের চাঁদিফাটা রোদ্দুর গায়ে মেখে অতিকায় সাপের মতো রাস্তা নেমে গিয়েছে। রাস্তার দু'পাশে অসংখ্য গেরুয়া নিশান। এক একটা ১০ থেকে ১৫ ফুট উঁচু। তার নীচে পুলিশ, আধা সামরিক বাহিনীর ফ্ল্যাগ মার্চ। বাস্তবে, এই ক'দিন আসানসোল-রাণিগঞ্জে ঘুরে নতুন করে চিনেছি গেরুয়া পতাকাকে। মহল্লার পর মহল্লা গেরুয়া ঝান্ডায় ছয়লাপ। হাজার হাজার, অসংখ্য। শিল্পশহরের শরীরে উল্কির মতো ওই নিশানগুলিই বলে দেবে, আপনি একুশ শতকের ভারতবর্ষের বাসিন্দা। আপনি এসেছেন অধিকৃত এলাকায়।

চাঁদমারি ছাড়ালাম। কিছু দূর যাওয়ার পরই শুরু হল ঘিঞ্জি, নোংরা এলাকা। গায়ে গায়ে লেগে থাকা বাড়ি। মসজিদ। ফেজ টুপির মানুষ। কয়েকটা চাঁদ-তারা আঁকা নিশান। সেই সঙ্গে গেরুয়া পতাকাও । তৃণমূল, বিজেপি'র অনেকগুলি দফতর। জমজমাট। একটা লাল পার্টির অফিস। বন্ধ। আরেকটু এগোতে এলাকার চরিত্র বদলে গেল। এখানে হিন্দুর সংখ্যা কম। রাস্তায় ভিড়। গরীব মহল্লা। মলিন পোশাক। ডাস্টবিন উপচে পড়ছে। একটা চায়ের দোকানে দাঁড়ালাম। ভিড় জমে গেল। দোকানদারের চোখে সন্দেহ। জানতে চাইলাম, নূরানী মসজিদে কী করে যাব। পাশ থেকে উত্তর এল— 'কী দরকার!' বললাম, যে ইমাম সাহেবের ছেলে মারা গিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই। ফোনে কথা হয়েছে। আসতে বলেছেন। এ বার পরিস্থিতি সহজ হল। পরিচয় জানতে চাইলেন স্থানীয়রা। কিছুক্ষণ কথা হল। রাস্তা বাতলে দিলেন দোকানদার। তারপর গলা নামিয়ে— 'আসলে বুঝতেই পারছেন, এই ক'দিন ঝড় গেছে। এখনও পুরোপুরি মেটেনি। তাই…'

স্টেশনের কাছাকাছি যখন এলাম, রাস্তায় একটাও লোক নেই। ফাঁকা। এদিকে রাস্তাঘাটও চিনি না। ইমাম সাহেবকে ফোন করছি, ধরছেন না। আচমকাই একটি মুসলিম পরিবারের সঙ্গে দেখা হল। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক, তিনি কারবালা মসজিদের ইমাম। সঙ্গে স্ত্রী এবং আরেক আত্মীয়া। বললেন, নূরানী মসজিদেই যাচ্ছেন। গাড়িতে তুলে নিলাম, গল্প শুরু হল। প্রথমে খানিক সাবধানী, তারপর মন খুলে কথা বললেন। কারা দাঙ্গা করল, কী ভাবে করল, কারা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ঘুঁটি সাজাল, কারা এই সুযোগ দখল বাড়াল কোলিয়ারিতে, কারা পড়শি রাজ্য থেকে বাইক নিয়ে ঢুকে পড়ল দলে দলে— শুনলাম। সে সব এখানে বলার নয়। শুধু একটি কথা কানে লেগে আছে— 'আপনার বয়স কম, কলকাতায় থাকেন। কী বলব আপনাকে.. আমরা তিন পুরুষ ধরে এখানে থাকি। এই দাঙ্গা যে আমাদের কাছে কতবড় লজ্জা, তা বলে বোঝাতে পারব না। অথচ, বিশ্বাস করুন, এ রকম হওয়ার কথা ছিল না। এটা করানো হল।''

গলির পর গলি, সরু রাস্তা, রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে থাকা গরু আর অসংখ্য ধর্মীয় নিশান পেরিয়ে জাহাঙ্গীরি মহল্লায় পৌঁছনো গেল। সম্পূর্ণ মুসলিম এলাকা। হিন্দু কার্যত নেই। নূরানী মসজিদে ঢোকার ঠিক আগে, গলির মুখে গাড়ি ঘিরে ধরলেন জনা কুড়ি যুবক। নামতে হল। কোথা থেকে আসছি, কী দরকার সে সব বিস্তারিত জানতে চাইলেন। বললাম। মনে হল, বিশ্বাস করছেন না। ইতিমধ্যে ফের ফোন করলাম ইমাম সাহেবকে। ধরলেন না। হাওয়া গরম হচ্ছে। আমাদের গাড়িতে করে যে ইমাম এসেছিলেন, তাঁকেও দেখতে পাচ্ছি না। একজন একটু গলা চড়িয়েই বললেন, ক্যমেরা গাড়ির ভিতরে থাকবে। রাখা হল। একটু অস্বস্তি হচ্ছে। বুঝতে পারছি না কী করব। আচমকাই ফোন বাজল। ইমাম সাহেব ফোন করেছেন। বললেন, মসজিদে চলে আসতে। এক আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন তাই কল রিসিভ করতে পারেননি। যাঁরা ঘিরে ধরেছিলেন, তাঁদের বললাম। সঙ্গে সঙ্গে সহজ হল পরিস্থিতি। সবচেয়ে উত্তেজিত ছিলেন রিয়াজ নামে এক যুবক, তিনি ক্ষমা চেয়ে বললেন, ''ভাইসাব, রাগ করবেন না। আপনার বাইরে থেকে এসে ভাবতে পারবেন না গত কয়েকদিন কী চলেছে! দুই সম্প্রদায়েরই সাধারণ মানুষের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গিয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে এমন করতে হচ্ছে।'' এরপর ঘটনাক্রমের বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন, সে সব এখানে বলার প্রয়োজন, ইচ্ছা কোনওটাই নেই।

নূরানি মসজিদ খুব বড়ো নয়। সাধারণ, মাঝারি মাপের। মসজিদের বাইরে খানিকটা খোলা জায়গা। সেখানেই গাড়ি রাখলাম। ওই জমিতেই ইমাম সাহেবের খুন হওয়া পুত্র সিবঘাতুল্লার রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত নিথর দেহটি রাখা ছিল ক'দিন আগে। জানাজার জন্য উপস্থিত হাজার হাজার উন্মত্ত জনতার সামনে বাওয়াব গাছের মতো দাঁড়িয়েছিলেন ইমাম মহম্মদ ইম্মাদুল্লাহ। শান্ত গলায় বলেছিলেন, ''আল্লাহ সিবঘাতুল্লাকে যেটুকু জীবন দিয়েছিলেন, ও সে ক'দিনই বেঁচেছে। আমরা যেন কোনও নির্দোষ ব্যক্তির উপর সে জন্য চড়াও না হই। ও আমার সন্তান। বাবা হয়ে যদি এ আঘাত সহ্য করতে পারি, তাহলে তোমরা কেন পারবে না! যদি কেউ কোনওরকম হিংসাত্মক ঘটনা ঘটাও, আমি এই মসজিদ এবং আসানসোল ছেড়ে চলে যাব।''

মসজিদের সিঁড়ি দিয়ে উঠে দো'তলা আর তিনতলার মাঝখানে একটি ছোট্ট ঘর। দেওয়ালের রং সবুজ। একটাই জানলা। মাটির উপর কম্বল পাতা। জানলার দিকে মুখ করে বসে ছিলেন ইমাম সাহেব। আমি ঘরে ঢুকতেই উঠে দাঁড়ালেন, হাত ধরে নিয়ে এসে বসালেন। জানলা দিয়ে তখন এক চিলতে আলো তাঁর মুখে এসে পড়েছে। সদ্য সন্তানহারা বাবার চোখদু'টি শান্ত, উজ্জ্বল। চোখের নীচে গভীর কালি। সম্ভবত, রাত্রি জাগার চিহ্ন। বললেন, ''কলকাতা থেকে এসেছেন! বলুন কী জানতে চান। আমার মতো সামান্য মানুষ আপনাকে কী-ই বা আর বলব!'' এরপর এক ঘন্টা আমরা অনর্গল কথা বলেছি। উনি হিন্দি আর ভাঙা বাংলা মিশিয়ে, আমি উল্টোটা। ধর্ম নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে, সংসার নিয়ে, ভালবাসা, মৃত্যু, সংস্কার-কুসংস্কার নিয়ে, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলেছি আমরা। সে সব আপাতত বিশদে লিখতে ইচ্ছে করছে না। ঘন্টাখানেক পর যখন মসজিদ ছেড়ে বেরচ্ছি, মনে হচ্ছিল, স্নান করে উঠলাম।

ইমাম বললেন, ''আমাকে অনেকে খুব অসাধারণ মানুষ ভাবছেন। আমি সত্যিই জানি না এর কারণ কী! আপনি পারতেন আপনার ছেলের মৃত্যুর জবাব হিসাবে আরও অনেকগুলো লাশ ফেলতে? তাতে কি আপনার মৃত সন্তানেরই অসম্মান হত না? এমন কেন করবে মানুষ! সকলে যা করতেন আমি সেটুকুই করেছি।'' বললেন, ''আমি আপনাদের মতো শিক্ষিত নই। খুব সাধারণ একজন মানুষ। আল্লার সেবক। ইমাম হিসাবে আমি মনে করি, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃস্টান সকলেই আমার সন্তান। তাছাড়া, মৃত্যুর জবাব কখনও মৃত্যু হতে পারে না। হওয়া সম্ভব নয়। আমি যতদিন বাঁচব, আপ্রাণ ধর্মের নামে হানাহানি আর হিংসা রুখব। এটাই আমার ধর্ম। মানুষের ধর্ম।'' বললেন, ''আমরা ভারতবর্ষের মানুষ। এ এক আশ্চর্য দেশ। কত বড় বড় ধর্মগুরুরা এ দেশে জন্মেছেন। এই দেশের মূল কথাই হল সম্প্রীতি। আমরা ছেলের স্মৃতির মধ্যে দিয়ে আমি এই চিরন্তন ভারতবর্ষের খোঁজ করছি। যে ভারতবর্ষে ধর্মের নামে হানাহানি নেই, রক্তপাত নেই, তেমন ভারতবর্ষের খোঁজ করছি আমি।'' বললেন, ''আমি রামায়ণের গল্প শুনেছি। আমি শুনেছি, রামচন্দ্র খুব বড় রাজা ছিলেন। দেশ ভাল চললে বলা হয় রামরাজ্য। আমার ছেলেকে যারা খুন করল, তারা রামকে চেনে না, হিন্দু ধর্মকেও জানে না, ইসলাম সম্পর্কেও জানে না। যদি ওরা সত্যিই ধর্ম সম্পর্কে জানত, তাহলে অমন ফুটফুটে ছেলেটাকে মারতে পারত না। ওদের হাত কাঁপত। আমি ওদের ক্ষমা করে দিয়েছি।'' প্রশ্ন করলাম, ''আপনার ছেলেকে যারা খুন করেছে, তাদের নামে অভিযোগ করবেন না পুলিশে!'' উত্তর দিলেন, ''আমি তো সেই সময় ঘটনাস্থলে ছিলাম না। কী করে নিশ্চিত হব যে ২৪ জনের নাম আমার কাছে আছে, তারাই সিবঘাতুল্লাকে মেরেছে! নির্দোষরাও তো শাস্তি পেতে পারে। তাই আমি কারও নাম বলব না। বলতে পারব না। আমি শান্তি চাই। যদি এই শহরে শান্তি ফেরে তাহলেই সিবঘাতুল্লার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে।''

ইমাম সাহেব অস্বাভাবিক শান্তভাবে উত্তর দিচ্ছিলেন আমার প্রশ্নের। একবার শুধু একটু রেগে গেলেন। বলেছিলাম— 'আপনি নিশ্চয় জানেন, আপনার সম্পর্কে বলা হচ্ছে, এই শহরের বাসিন্দাই নন আপনি। সিবঘাতুল্লাও না কি বাইরে থেকে এসেছে।'' কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর মৃত ছেলের ছবি আর কিছু ধর্মীয় বইপত্রের ভিতর থেকে দু'টো আধার কার্ড বের করে বললেন, ''ছবি তুলে নিন এগুলোর। যারা এমন বলছে, তাদের গিয়ে বলুন, আমরা শতাধিক বছর ধরে এই শহরে রয়েছি। আমার বাবাও আসানসোলেরই ইমাম ছিলেন। কেন এমন করছে ওরা! কী পাচ্ছে! আমার ছেলেটাকে মেরেও শান্তি হল না! আমি তো কাউকে কিছু বলিনি। নিজের মতো রয়েছি। কেন আমার নামে, আমার মরা ছেলের নামে এ রকম বলছে! ওরা কি জানে না মৃত্যুর পর মানুষকে বিরক্ত করতে নেই!''

ছোটবেলায় আসানসোলেই পড়াশোনা করেছেন ইম্মাদুল্লাহ। তারপর উচ্চতর ধর্মীয় শিক্ষার জন্য চলে যান সাহারানপুরে। সেখান থেকে ফিরে ১৯৮৯ সালে ২০ বছর বয়সে নূরানি মসদিজের ইমাম হন। স্ত্রীর নাম খাদিজাতুলকুব্রা। বলছিলেন, ''আমি তো কোনওরকমে ঠিক আছি, কিন্তু আমার স্ত্রীর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ছেলে মারা যাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ভুল বকছে, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। আসলে ছেলেটাকে বড্ড ভালবাসতাম আমরা। কেমন মন দিয়ে পড়াশোনা করত! ছোট থেকেই খুব পড়ুয়া ছিল। এই তো মাধ্যমিক দিল। দেখবেন, ভাল নম্বর পাবে। ইচ্ছে ছিল, আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে পড়াব। হল না! সব কী আর হয়!'' মনে হল, এই এতক্ষণ পর ঈষৎ গলা কাঁপল ইমাম সাহেবের। তারপরই সামলে নিয়ে বললেন, ''আমার একার তো ছেলে মরেনি। আরও মরেছে। সব সম্প্রদায়েরই মরেছে। আমরা যদি একসঙ্গে চেষ্টা করতে পারি, যদি আমরা প্রতিজ্ঞা করি আর হানাহানি করতে দেব না, দেখবেন অবস্থাটা বদলে যাবে।''

প্রণাম করতে গেলাম। হাত চেপে ধরলেন। জড়িয়ে নিলেন বুকে। খানিকক্ষণ চেপে ধরে রইলেন। সন্তানহারা বাবার ঘামের গন্ধ নাকে আসছিল। আমার ব্যক্তিগত ঈশ্বরের গন্ধ।"