রবিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৩

পাকী তিন পোয়া হুইস্কি ~ সোমা ব্যানার্জী

কয়েকদিন জ্বরের ঘোরে পড়েছিলাম। আর আট ভাট কত কথাই ভাবছিলাম। কেন জানিনা কফি হাউজের ভেটকির কথা খুব মনে পড়ছিল। আমি তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। কোন এক দাদা যেন ভেটকিকে দেখিয়ে আমাকে বলেছিলো, ওই দেখ ভেটকি, কফি হাউজের মহাপুরুষ। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মদ খায়। বাকি সবার সঙ্গেও মদ খায়। মাঝে লিভারটা একটু খারাপ হয়েছিল। তাই এখন লিভ ফিফটি টু  দিয়ে মদ খায়। ভেটকিকে দেখেও যেন মনে হল দ্রব্যগুণেই আছে। চোখ মুখে সামান্য একটু লালচে আভা, যেন ঝামরে জ্বর আসছে। আমি মানসচক্ষে দেখতে পেতাম যে ভেটকি এক মনে মদ খাচ্ছে আর তার পাশে রাখা আছে চাটের বদলে একটি লিভ ফিফটি টু এর কৌটো। বিগড়ে যাওয়া মেটে, রগড়ে ঠিক করে নেওয়ার জন্য গম্ভীর মুখে, কয়েক চুমুক মদের পরেই একটি করে ট্যাবলেট গলাধঃকরণ করছে সে।

আমার তখন বাস্তবে মদ খাওয়া নিয়ে ধারণা খুব একটা স্পষ্ট ছিলো না। মদ খাওয়া যা দেখেছি সব সিনেমায়। বাবার কাছে বরাবর শুনেছি যারা মদ বা সিগারেট খায় তাদের চরিত্র খুবই খারাপ হয়। আর যে সব মহিলারা ওইসব খায় তাদের সম্পর্কে তো ইয়ে, যত কম বলা যায় ততই ভালো! হাউজে কিছুদিন আসার পর, টেবিলে এর ওর থেকে সিগারেট চেয়ে দু-এক টান দিয়ে দেখলাম। ভালোই লাগলো। আমার চরিত্র কেউ টান মেরে ধরে হিড় হিড়  করে অনেক নিচে নামিয়ে নিয়ে গেল বলে তো মনে হলো না। বরং স্বামী বিবেকানন্দের মতো জিজ্ঞাসু মনে এর তার হুঁকোয় পরীক্ষামূলক টান মেরে দেখা হল জাত যায় কিনা। পরীক্ষার ফলাফল? দেখা গেল আমার মন পবিত্র হলে কি হবে আশেপাশের ছেলেরা খুবই হিংসুটে। দু'দিন যেতে না যেতেই তারা বললো তুই তোর সিগারেট কিনে খা! আমারটা দেব না, ইত্যাদি। 

তবে কফি হাউজের নিভে আসা মরা মরা আড্ডায় সবসময় দেখতাম মাতালদের নিয়ে চুটকি বলা হতো। ডজন খানেক এইধরণের চুটকি সব টেবিলেরই হট ফেভারিট ছিল। আড্ডার মরা আঁচে ফুঁ দিতে, বহু ব্যবহৃত ক্লিশে চুটকি গুলো কিন্তু বেশ কাজে দিত! মাঝে মাঝে ওই সবকটা জোকস পুনরায় বসে শোনবার ভয়েও লোকজন তাড়াতাড়ি উঠে বসে কথা শুরু করে দিত! ছেলেরা কোথাও তিনদিনের জন্য বেড়াতে গেলে ফিরে এসে সাতাশ দিন ধরে তার গল্প শোনাত। এক দিন বলতো বেড়াতে গিয়ে কি কি দেখেছে, আর ছাব্বিশ দিন ধরে বলতো কে কে মদ খেয়ে কি কি বিচিত্র আচরণ করেছে! এইসব খিল্লির ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা থেকে আমরা মেয়েরা বঞ্চিতই রয়ে যেতাম। কারণ বাড়ি থেকে কোনোভাবেই অনুমতি পাওয়া যেত না বেড়াতে যাওয়ার। একদল ছেলের সঙ্গে চার-পাঁচ দিন টানা বেড়াতে যাওয়ার প্রসঙ্গ তোলাই যেত না বাড়িতে। আমার বাড়িতে তো একটা একদিনের পিকনিক যাওয়ার জন্য অনুমতি নিতে যা পরিশ্রম করতে হতো, যে আসল পিকনিকের দিনটায় আমার খুব ক্লান্ত লাগতো। মনে হতো গাছতলায় শুয়ে একটু  বিশ্রাম নিই। বা এইসব তুশচু হাসি ঠাট্টা খাওয়া দাওয়ার প্রলোভন পরিত্যাগ করে বানপ্রস্থে চলে যাই। চিত্রকূট পাহাড়ে গিয়ে দুর্বাসা মুনির পেছনে লুকিয়ে থাকি। যে শালা আমাকে খুঁজতে আসবে সে ভস্ম হয়ে যাক বা হাফ ডজন অভিশাপের গুঁতোয় ধরাশায়ী হোক!

যাই হোক, বহু ক্লাস মিস করে, গভীর মনোযোগ সহ সব বেড়ানোর গল্প শুনে, ভালো রেজাল্টের আশা অলকানন্দার জলে ভাসিয়ে দিয়ে, আমি আমার চেনা বন্ধুদের মনে মনে কিছুটা ক্লাসিফাই করতে শুরু করি। প্রথম দল ছিলো চার আনার খেয়ে আট আনার নাটক করা টাইপ। এই দলে সবার আগে নাম ছিল বোধহয় বুম্বা আর কামুর। এরা শক্ত পানীয় দু তিন চুমুক খেয়েই, নিজ নিজ বন্ধুবৃত্তে নিজেদেরকে হলমার্ক যুক্ত 'আসল মাতাল' প্রমাণ করার জন্য মহা উৎসাহে ড্রামা আরম্ভ  করতো। টিভির সব ঝুল সিরিয়ালে এবং হলে সব হিট সিনেমায় মাতালদের যা যা করতে দেখেছে সবই এক এক করে করত এরা। কিছুই বাদ যেত না।

এদের ঠিক বিপরীত মেরুতে ছিল আরেকটি দল। এরা অনভ্যস্ত শরীরে কিছু পরিমাণ অ্যালকোহল ঢোকায় মাথা ভোঁ ভোঁ করলেও কিছুতেই তা স্বীকার করত না।  কিচ্ছুটি হয়নি ভাব দেখিয়ে, নির্লিপ্ত মুখে ঘরের এক কোনায় একটি চেয়ারে চুপ করে বসে থাকতো। হঠাৎ করে 'একটু আসছি' বলে বাইরে গিয়ে বমি করে আবার এসে অম্লানবদনে বসে থাকতো। 'কিছুই হয়নি'র প্রমাণ স্বরপ মাঝে মাঝে স্মিত হেসে 'পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে, দেয়ালে দেয়াল, কার্নিশে কার্নিশ' আবৃত্তি করে শোনাতো। তিন চার লাইন আবৃত্তির পর যেখানটাতে হোঁচট খেত, সেখানে থমকে গিয়ে আবার গোড়া থেকে শুরু করতো। তারপর কেমন একটা লুপে পড়ে যেত। এটা মোটামুটি চলতেই থাকতো।

আর একদল ছিল যারা নিজেদের মস্ত বড় কনোসার ভাবতো। কোনরকম লঘু ক্রিয়া-কলাপ বা বালখিল্যের মধ্যে এরা নিজেকে জড়াতে অপছন্দ করতো। এরা এসে থেকে আকাশে নাক তুলে বসে থাকতো আর বলতো, এই তোরা যে যা পারবি খেয়ে নে। দেখি কার কতটা দম আছে। একটু পরেই অ্যামেচারের দল কাত হয়ে গেলে এরা গম্ভীর মুখে নীলকন্ঠ অবতারের মতন এসে যেখানে যা মদ পড়ে আছে সব ঢক ঢক করে অনায়াসে খেয়ে শেষ করে ফেলত। তবে এরা নিজেদের যোগ্য সম্মান পেতো না দলের কাছে। এদেরকে সবাই ব্লটিং পেপার বলে ডাকতো। অথবা স্পঞ্জ।

এইসবের বহু বছর পরে আমি বাচ্চা নিয়ে সুকল্পদের সাথে বেড়াতে গিয়ে মোনালিসার অভিজ্ঞতা শুনি। সেটা এখানে না বললেই নয়। বিয়ের আগেই সুকল্প তার প্রেসিতে পড়া মিষ্টভাষী হবু স্ত্রীকে বলে নিয়েছিল, আমি কিন্তু বেড়াতে গেলে মদ খাই। মোনালিসা বেচারা এতে দোষের কিছুই দেখতে পায়নি । সে সোনামুখ করে আচ্ছা বলেছিল। বিয়ের দু এক মাস বাদেই সুকল্প বলে চলো, বেড়াতে চলো। তারপর সুকল্প তার তিরিশজন বন্ধুর বিশাল দলে বউ নিয়ে মহাসমারোহে দীঘা ঘুরতে গেল।
সকালবেলায়  বন্ধুদের নিয়ে সমুদ্রে চান করতে গেল। গেল তো গেল, আর ফেরার নাম নেই!  উদ্বিগ্ন মোনালিসা  তখন জনে জনে জিজ্ঞেস করতে থাকলো, হ্যাঁ গো, আমার বর কোথায়? অধিকাংশই টইটুম্বুর মদ খেয়ে ওকে পাত্তাই দিলো না। পরে, কে একজন মায়া করে আঙুল দেখিয়ে বলে দিল, ওই তো আসছে। সেদিকে তাকিয়ে মোনালিসা কিছুই দেখতে পেল না। তারপর সেদিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখতে পেল সুকল্পকে চ্যাংদোলা করে আনা হচ্ছে। হুঁশ নেই। বিকেলবেলায় মোনালিসা সুকল্পকে অনেক ডাকাডাকি করেও তার ঘুম ভাঙাতে পারেনি। সন্ধ্যেবেলায় নিরুপায় মোনালিসা দলের মধ্যে এক দাদার সঙ্গে কি সব মালা ফালা কিনতে দোকানে গেছে। সেখানে আবার এক পরিচিতের সঙ্গে দেখা হয়েছে। দু এক কথার পরেই সে জুলজুল করে চেয়ে মোনালিসাকে ফিসফিস করে বলে, তোর বরের ছবি তো আমরা দেখেছি আগে। তোর সাথে আজ যাকে দেখছি এ তো তোর বর নয়! থতমত খেয়ে মোনালিসা হ্যাঁ মানে, না মানে, বর নয় ঠিক, বরের বন্ধুর সাথে... এইসব আবলান জাবলান অসংলগ্ন উত্তর দিয়ে রাগ করে হোটেলে ফিরে আসে...

কাল বছরের শেষ দিন। তাই আজ সমস্ত মদের দোকানে প্রচণ্ড ভিড়। বুড়ো বাচ্চা লেডিজ জেন্টস সবাই লাইন দিয়েছে। বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে। হয় দুঃখে নয় আনন্দে, কি জন্যে ঠিক বলতে পারবো না। হেমিংওয়ে বলতেন, "I drink to make other people more interesting." সেটাই হল কি? আমরা সকলে কি একে অপরের মুখ দেখে খুব বোর হচ্ছি? চারপাশে সবার সবাইকে খুব বিস্বাদ লাগছে?  নিজের মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতেই ভাবি, সত্যি মাইরি, কি আত্মমগ্ন, যান্ত্রিক লোকজন আমরা সবাই। এর চেয়ে ভেটকি অনেক ভালো ছিলো, ইন্টারেস্টিং ছিলো! কাব্যলোকে আসছে কাল মনে হয় মোবাইল নিয়ে ঢোকা বারণ। মধ্যরাতে মুমূর্ষু তেইশ সালটিকে আলতো করে মদিরায় ভাসিয়ে দেবেন শক্তি আর ভেটকি। নতুন বছরের চিবুক ধরে আদর করে বলবেন, "থুৎনিপরে তিল তো তোমার আছে/ এখন? ও মন, নতুন দেশে যাবি?"

মঙ্গলবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৩

জীবনের ধাঁধা ~ রজত শুভ্র ব্যানার্জী

মানুষের মেজো ছেলে লোম পরে হুপ হাপ করে,
নিজেকে দেখিয়ে বলে, দেখো, আমি কত বড় হনু,
ওই দূরে বড় মাঠে গোটাকত গরু মোষ চরে,
মেঘ কাটে অবশেষে, আকাশে গজায় রামধনু।

উঠনে তুলসী তলা, ছাগলেরা তায় মাথা ঠোকে,
দু'খানা নেংটি এসে এক কোণে দানা পানি গোঁজে,
পাখিরা বাসায় ফেরে, ইয়ে ক'রে সম্মুখে ঝোঁকে,
পাশে কটা বুড়ো ভাম বসে থাকে সুযোগের খোঁজে।

হঠাৎ পটকা ফাটে, সবাই শিউরে ওঠে ত্রাসে,
আগুন জ্বলতে থাকে সীমানার এধারে ওধারে,
পিপীলিকা ভ্যাবাচ্যাকা, সভয়ে লুকিয়ে পড়ে ঘাসে,
দু'একটা সারমেয় ইতি উতি চেয়ে ল্যাজ নাড়ে।

আর কেউ জানুক বা না জানুক, জন্তুরা জানে
অবশেষে ভগবান ভুলেছেন জীবনের মানে। 

RSB (2023-12-19)

শনিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৩

মৎসপুরাণ ~ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য

পারশে নাহয় সর্ষে দিয়ে রেঁধে 
শীতের দুপুর ট্যাংরা পেঁয়াজকলি
বাজার গেলাম চিংড়ি দিল সেধে
ইলিশ কে কি মাছের সেরা বলি!!

গোল বাঁধাল মৌরলা আর পুঁটি
মাছ কাটবার বিভিন্ন পদ্ধতি 
আছেন মাসি, সামান্য ভুল ত্রুটি 
ভেটকি নিলেও এমন কি আর ক্ষতি।।

রুই কাতলা রাজার মত শুয়ে
কেউ খুঁজেছে চিতল মাছের পেটি
মাগুর সিঙ্গি পাবদা বরফ ছুঁয়ে 
কাজরি যেন বড়লোকের বিটি।।

বোয়াল যেন ধ্যানস্থ এক সাধু
উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে শোল
ওভাররেটেড তোপসে জানে জাদু
তেলাপিয়া বাঁধায় গন্ডগোল।। 

সাতসকালে মাছের বাজার টানে
মৎসপুরাণ স্বাদকাহনের মানে।।

শনিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২৩

সুজানা ~ কৌশিক মজুমদার

প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সাত খুন মাফ সিনেমাটা আছে না? ওই যে যেখানে উষা "দিদি" উত্থুপ আর রেখা ভরদ্বাজ মিলে "ডা-র-র-র-লিং" বলে একটা গান গেয়েছিলেন (যেটা আবার রাশিয়ান গান কালিঙ্কা থেকে অনুপ্রাণিত)...মজার ব্যাপার এই সিনেমাটার আসল শিকড় লুকিয়ে আছে চুঁচুড়ার মাটিতে। 

খাদিনা মোড় থেকে প্রিয়নগরের দিকে যেতে বাঁ হাতে জি টি রোডের ধারে সাদা মন্দির টাইপ একটা স্থাপত্য চোখে পড়ে। অচেনা লোকেরা এঁকে মন্দির ভাবেনও..কিন্তু এখানকার বাসিন্দারা জানেন এই মাটিতে শুয়ে রয়েছেন "সাত সাহেবের বিবি" সুজানা আনা মারিয়া ভারকার্ক। নামটা চেনা চেনা লাগছে? রাস্কিন বন্ড তাঁর বিখ্যাত চার পাতার গল্প Susanna's Seven Husbands এ নায়িকার ঠিক এই নামই দিয়েছিলেন। গল্পের প্লট এক কথায় বন্ড এই রকম বলেছেন "When a guy visits the ruins of an old haveli on G T Road, Old Delhi, he was told the story of the mysterious haveli owner, Susanna and killings of her husbands..."

দিল্লীকে আপাতত ভুলে জি টি রোড আর সুজানা নাম দুটো আমাদের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে। এই গল্প থেকেই কিন্তু গোটা সাত খুন মাফ সিনেমার জন্ম।

কে ছিলেন আসল সুজানা? অষ্টাদশ শতকে ওলন্দাজ ব্যবসায়ীরা দলে দলে চুঁচুড়ায় এসে ভিড় জমালেন। সাথে তাঁদের স্ত্রীরাও। এমনই একজন ছিলেন পিটার ব্রুয়িস। তিনি ১৭৫৪ নাগাদ চুঁচুড়ায় ঘাঁটি গাড়েন। সাথে স্ত্রী সুজানা।  তাঁদের একটি ছেলে , দুটি মেয়েও ছিল।  ১৭৮৩ তে পিটারের মৃত্যু হয়। সুজানা এক ইংরেজ টমাস ইয়েটস-এর প্রেমে পড়েন।  ১৭৯৫ সালের ৩০ মার্চ কলকাতার অ্যাংলিকান চার্চে তাঁদের বিবাহ হয়। সাথে সাথে পুত্র কন্যা সমেত সুজানা খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। এই ছিল সুজানার দুটি বৈধ বিবাহ। কিন্তু লোকে বলে মাত্র দুটি পুরুষে সন্তুষ্ট থাকার মহিলা ছিলেন না সুজানা। অসংখ্য প্রেমিক ছিল তাঁর। ওলন্দাজ, রাশিয়ান, ইংরেজ এমনকি কেউ কেউ বলেন দু -এক জন ভারতীয় থাকলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। পতঙ্গরা যেমন আগুনে পুড়ে মরে, সুজানার রূপের আগুনে এসে ঝাঁপ দিত পুরুষেরা, আর সবাই কোন না কোন অদ্ভুত ভাবে মারা যেত। কেউ আত্মহত্যা করত বিষ খেয়ে,কাউকে কে যেন বুকে ছুরি বসিয়ে যেত,  বাড়ি শুদ্ধু আগুনে পুড়ে মরত বা কেউ...

১৮০৯ সালের ১২ মে সুজানা মারা যান। তাঁকে কবর দেওয়া হয় আয়েস বাগে। কবরের উপর তৈরী করা হয়  ডাচ- ভারতীয় স্থাপত্যের মিশ্রনে এক অপূর্ব সৌধ। সেখানে আজও শুয়ে আছেন সুজানা। তাঁর কবরে লেখা ""SUSANNA ANNA MARIA YEATS REBOORE VERKERK OBiIT 12 MAY ANNO 1809"। এই REBOORE VERKERK মানে তাঁর আসল পদবি হল ভারকার্ক। সাত স্বামীর সাথে সম্পর্কের পরেও সুজানা তাঁর পিতৃদত্ত পদবিকে ছাড়েন নি।

সুজানার প্রথম স্বামী পিটার ব্রুয়িসও শুয়ে আছেন চুঁচুড়ার মাটিতে। তবে সুজানার থেকে অনেক দূরে। ফুলপুকুর রোডের সেই ওলন্দাজদের কবরস্থানে। কবরখানার দক্ষিন-পশ্চিম কোণের বিশাল ওবেলিস্কটা আসলে পিটারেরই সমাধি। ভাঙাচোরা ইঁট এদিক ওদিক দাঁত বের করে আছে। তার মাঝে এখনও বিবর্ণ ফলকে দেখা যায়  ৫২ বছরে মারা যাওয়া মানুষটির নাম, যারও স্ত্রীর জীবন বাস্তবিক তাঁর থেকে অনেক রঙিন ছিল।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ~ অহনা বিশ্বাস

আজ মহামহিম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মদিনে তাঁকে অনন্ত শ্রদ্ধা জানাই। আজ এই উপমহাদেশের সকল মেয়েদের, বিশেষত নবপর্দায় শোভিত মেয়েদের তাঁকে বড় প্রয়োজন।

তাঁর 'অবরোধবাসিনী' (1931) বইটি থেকে খানিক উদ্ধৃত করলাম। যদি কারুর ইচ্ছা হয় তো পড়বেন। 

'প্রায় ৪০/৪৫ বৎসর পূর্ব্বের ঘটনা-কয়েক ঘর বঙ্গীয় সম্ভ্রান্ত জমীদারের মাতা, মাসী, পিসী, কন্যা ইত্যাদি একত্রে হজ করিতে যাইতেছিলেন। তাঁহারা সংখ্যায় ২০/২৫ জন ছিলেন। তাঁহারা কলিকাতায় রেলওয়ে ষ্টেশন পৌঁছিলে পর সঙ্গের পুরুষ প্রভুগণ কার্য্যোপলক্ষে অন্যত্র গিয়াছিলেন। বেগম সাহেবাদিগকে একজন বিশ্বস্ত আত্মীয় পুরুষের হেফাজতে রাখা হয়। সে ভদ্রলোকটীকে লোকে হাজী সাহেব বলিত, আমরাও তাহাই বলিব। হাজী সাহেব বেগম সাহেবাদের ওয়েটিং রুমে বসাইতে সাহস পাইলেন না। তাঁহারা উপদেশ মতে বিবি সাহেবারা প্রত্যেক মোটা মোটা কাপড়ের বোরকা পরিয়া ষ্টেশনের প্লাটফরমে উবু হইয়া (Squat) বসিলেন; হাজী সাহেব মস্ত একটা মোটা ভারী শতরঞ্জি তাঁহাদের উপর ঢাকিয়া দিলেন। তদবস্থায় বেচারীগণ এক একটা বোচকা বা বস্তার মত দেখাইতেছিলেন। তাঁহাদিগকে ঐরূপে ঢাকিয়া রাখিয়া হাজী সাহেব এক কোণে দাঁড়াইয়া খাড়া পাহারা দিতেছিলেন। একমাত্র আল্লাহ জানেন, হজযাত্রী বিবিগণ ঐ অবস্থায় কয় ঘণ্টা অপেক্ষা করিতেছিলেন-আর ইহা কেবল আল্লাহতালারই মহিমা যে তাঁহারা দম আটকাইয়া মরেন নাই।

ট্রেণ আসিবার সময় জনৈক ইংরাজ কর্ম্মচারীটী ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে হাজী সাহেবকে বলিলেন, "মুন্সি! তোমারা আসবাব হিয়াসে হাটা লো। আভি ট্রেণ আবেগা-প্লাটফরম পর খালি আদামি রহেগা-আসবাব নেহি রহেগা।" হাজী সাহেব যোড়হস্তে বলিলেন, "হুজুর, ঐ সব আসবাব নাহি-আওরত হায়।" কর্ম্মচারিটী পুনরায় একটা "বস্তায়" জুতার ঠোকর মারিয়া বলিলেন, "হা, হা-এই সব আসবাব হাটা লো।" বিবিরা পর্দ্দার অনুরোধে জুতার গুতা খাইয়াও টু শব্দটী করেন নাই।'
******

'আমরা বহু কাল হইতে অবরোধ থাকিয়া থাকিয়া অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি সুতরাং অবরোধের বিরুদ্ধে বলিবার আমাদের-বিশেষতঃ আমার কিছুই নাই। মেছোণীকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে, "পচা মাছের দুর্গন্ধ ভাল না মন্দ?"-সে কি উত্তর দিবে?

এস্থলে আমাদের ব্যক্তিগত কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা পাঠিকা ভগিনীদেরকে উপহার দিব-আশা করি, তাঁহাদের ভাল লাগিবে।

এস্থলে বলিয়া রাখা আবশ্যক যে গোটা ভারতবর্ষে কুলবালাদের অবরোধ কেবল পুরুষের বিরুদ্ধে নহে, মেয়েমানুষদের বিরুদ্ধেও। অবিবাহিতা বালিকাদিগকে অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া এবং বাড়ীর চাকরাণী ব্যতীত অপর কোন স্ত্রীলোকে দেখিতে পায় না।

বিবাহিতা নারীগণও বাজীকর-ভানুমতী ইত্যাদি তামাসাওয়ালী স্ত্রীলোকদের বিরুদ্ধে পর্দ্দা করিয়া থাকেন। যিনি যত বেশী পর্দ্দা করিয়া গৃহকোণে যত বেশী পেঁচকের মত লুকাইয়া থাকিতে পারেন, তিনিই তত বেশী শরীফ।

শহরবাসিনী বিবিরাও মিশনারী মেমদের দেখিলে ছুটাছুটি করিয়া পলায়ন করেন। মেম ত মেম-সাড়ী পরিহিতা খ্রীষ্টান বা বাঙ্গালী স্ত্রীলোক দেখিলেও তাঁহারা কামরায় গিয়া অর্গল বন্ধ করেন।'
******

'কবির ভাষায় বলিতে ইচ্ছা করেঃ

"কাব্য উপন্যাস নহে, এ মম জীবন,
নাট্যশালা নহে, ইহা প্রকৃত ভবন!"

প্রায় তিন বৎসরের ঘটনা, আমাদের প্রথম মোটর বাস প্রস্তুত হইল। পূর্ব্বদিন আমাদের স্কুলের জনৈকা শিয়িত্রী, মেম সাহেবা মিস্ত্রীখানায় গিয়া বাস দেখিয়া আসিয়া সংবাদ দিলেন যে, মোটর ভয়ানক অন্ধকার···"না বাবা! আমি কখনও মোটরে যা'ব না।" বাস আসিয়া পৌঁছিলে দেখা গেল,—বাসের পশ্চাতের দ্বারের উপর সামান্য একটু জাল আছে এবং সম্মুখ দিকে ও উপরে একটু জাল আছে। এই তিন ইঞ্চি চওড়া ও দেড় ফুট লম্বা জাল দুই টুকরা না থাকিলে বাসখানাকে সম্পূর্ণ "এয়ার টাইট" বলা যাইতে পারিত।

প্রথম দিন ছাত্রীদের নূতন মোটরে বাড়ী পৌঁছান হইল। চাকরাণী ফিরিয়া আসিয়া সংবাদ দিল-গাড়ী বড্ড গরম হয়,—মেয়েরা বাড়ী যাইবার পথে অস্থির হইয়াছিল। কেহ কেহ বমি করিযাছিল। ছোট মেয়েরা অন্ধকারে ভয় পাইয়া কাঁদিয়াছিল।

দ্বিতীয় দিন ছাত্রী আনাইবার জন্য মোটর পাঠাইবার সময় উপরোক্তা মেম সাহেবা মোটরের দ্বারের খড়খড়িটা নামাইয়া দিয়া একটা রঙীন কাপড়ের পর্দ্দা ঝুলাইয়া দিলেন। তথাপি ছাত্রীগণ স্কুলে আসিলে দেখা গেল,—দুই তিন জন অজ্ঞান হইয়াছে, দুই চারিজনে বমি করিয়াছে, কয়েক জনের মাথা ধরিয়াছে, ইত্যাদি। অপরাহ্নে মেম সাহেবা বাসের দুই পাশের দুইটী কড়খড়ি নামাইয়া দুই খণ্ড কাপড়ের পর্দ্দা দিলেন। এইরূপে তাহাদের বাড়ী পাঠাইয়া দেওয়া গেল।

সেই দিন সন্ধ্যায় আমার এক পুরাতন বন্ধু মিসেস মুখার্জ্জি আমার সহিত দেখা করিতে আসিলেন। স্কুলের বিবিধ উন্নতির সংবাদে আনন্দ প্রকাশ করিয়া বলিলেন,—"আপনাদের মোটরবাস ত বেশ সুন্দর হয়েছে। প্রথমে রাস্তায় দেখে আমি মনে করেছি যে আলমারী যাচ্ছে না কি-চারিদিকে একেবারে বন্ধ, তাই বড় আলমারী বলে ভ্রম হয়! আমার ভাইপো এসে বলেল, "ও পিসীমা! দেখ, সে Moving Black Hole (চলন্ত অন্ধকূপ) যাচ্ছে।" তাই ত, ওর ভিতর মেয়েরা বসে কি করে?"

তৃতীয় দিন অপরাহ্নে চারি পাঁচ জন ছাত্রীর মাতা দেখা করিতে আসিয়া বলিলেন, "আপকা মোটর ত খোদা কা পানাহ! আপ লাড়কীয়োঁ কো জীতে জী ক্ববর মে ভয় রহি হয়ঁ।" আমি নিতান্ত অসহায়ভাবে বলিলাম, "কি করি, এরূপ না হইলে ত আপনারাই বলিতেন, "বেপর্দ্দা গাড়ী।" তাঁহারা অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, 'তব কেয়া আপন জান মারকে পর্দ্দা করেঙ্গী? কালসে হামারী লাড়কীয়াঁ স্ড়্গুল নেহী আয়েঙ্গী।" সে দিনও দুই তিনটী বালিকা অজ্ঞান হইয়াছিল। প্রত্যেক বাড়ী হইতে চাকরাণীর মারফতে ফরিয়াদ আসিয়াছিল যে, তাহার আর মোটর বাসে আসিবে না।

সন্ধ্যার পর চারিখানা ঠিকানারহিত ডাকের চিঠি পাইলাম। ইংরাজী চিঠির লেখক স্বাক্ষর করিয়াছেন, "Muslim Brotherhood" বাকী তিনখানা উর্দ্দু ছিল-দুইখানা বেনামী আর চতুর্থখানায় পাঁচজনের স্বাক্ষর ছিল। সকল পত্রেরই বিষয় একই-সকলেই দয়া করিয়া আমাদের স্কুলের কল্যাণ কামনায় লিখিয়াছেন যে, মোটরের দুই পার্শ্বে যে পর্দ্দা দেওয়া হইয়াছে, তাহা বাতাসে উড়িয়া গাড়ী বে-পর্দ্দা করে। যদি আগামীকল্য পর্য্যন্ত মোটরে ভাল পর্দ্দার ব্যবস্থা না করা যায়, তবে তাঁহারা তাতোধিক দয়া করিয়া "খবিছ" "পলীদ" প্রভৃতি উর্দ্দু দৈনিক পত্রিকায় স্কুলের কুৎসা রটনা করিবেন এবং দেখিয়া লইবেন, এরূপ বে-পর্দ্দা গাড়ীতে কি করিয়া মেয়েরা আসে।

এ তো ভারী বিপদ,—
"না ধরিলে রাজা বধে,—ধরিলে ভুজঙ্গ!"

রাজার আদেশে এমন করিয়া আর কেহ বোধ হয় জীবন্ত সাপ ধরে নাই! অবরোধ-বন্দিনীদের পক্ষে বলিতে ইচ্ছা করিল,—

"কেন আসিলাম হায়! এ পোড়া সংসারে,
কেন জন্ম লভিলাম পর্দ্দা-নশীন ঘরে!"

শুক্রবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২৩

পুরনো লেত্তি পুরনো লাট্টু ~ সংকলন সরকার

সে অতি অদ্ভুত বিদঘুটে ভূতুড়ে জায়গা বাপরে বাপ! সাত সক্কাল বেলা ঘুম ভেঙ্গে গেলেই খিদে পেয়ে যায়। বরং বলা ভালো অত সকালে খিদের চোটেই ঘুম ভাঙ্গে! খিদে পেলে হাতের কাছে কিছু না থাকলে চাদর দিয়ে নিজেকে মুড়ে নিয়ে হালকা কুয়াশা ঠেলে গুটি গুটি হেঁটে পৌঁছে যাও থানার পাশে পাঁড়েজীর চায়ের দোকানে। শীত এখানে ভালই পড়ে গেছে। এই সকাল সাড়ে ছটার সময় পাঁড়েজীর দোকানে গরমা গরম চা ছাড়া আর কিছুই গরম পাবে না। কিন্তু খিদে পেয়ে গেছে যে...! একটু মাথা ঘোরালে দেখবে দোকানে মোটে তিন রকমের বিস্কুট আছে, একটা কাচের ঘেরাটোপে গুটিকয় গতকাল সন্ধ্যেবেলার বানানো শিঙ্গাড়া আর গতকাল বিকেলের বানানো জিলিপি। সারারাতের ঠাণ্ডা খেয়ে সে সব খাদ্যবস্তুর গায়ে জমাট ডালডার সাদা পরতের কারুকার্য্য! প্রথম দর্শনে মনে মনে তলপেট থেকে একটা কাল্পনিক চোঁয়াঢেঁকুর খাদ্যনালী বেয়ে উঠে আলজিভের তলায় ঘুরপাক খেতেই পারে। হাজার হোক বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল খাওয়া পেট তো! কিন্তু বাস্তব ঘটনা আরো খারাপ। সেটা হল পেটের বেসমেন্ট থেকে পেটের টপ ফ্লোর অবধি এখন কম করে খান কুড়ি ছুঁচো দৌড়চ্ছে! তাই আর ডালডার আর্টওয়ার্ক না দেখে ঐ বাসি শিঙ্গাড়া আর জিলিপিই সই। চোখ কান বুজে খেয়েই নেওয়া যাক আপাতত। পরের কেস নাহয় পরে সাল্টে নেওয়া যাবেখন! 

পাঁড়েজীর লোক এখন সবে খোসা সমেত আলুর তরকারীর মালমশলা কেটে বীর বিক্রমে আটা মাখতে লেগেছে। গরমাগরম পুরি তরকারী পেতে পেতে কমকরে আরো ঘন্টা দেড়েক দেরী। সকাল আটটা সোয়া আটটার আগে কোনো মতেই নয়! এখন দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করলে ছুঁচোগুলো সংখ্যায় বেড়ে খান চল্লিশেক হয়ে গিয়ে ছুটোছুটি করে পেট ফুটো করে দিতে পারে। অতএব ছুঁচোগুলোকে ঐ আগের দিনের গোটাচারেক করে ডালডা জমা ঠাণ্ডা বাসি শিঙ্গাড়া জিলিপি খাইয়েই ঠাণ্ডা করে দাও আপাতত। তারপর ছোটো কাচের গেলাসে গরম চা দু' হাতের তালুর মধ্যে নিয়ে আয়েশ করে ছোটো ছোটো চুমুকে শেষ করে আবার গুটি গুটি হেঁটে ফিরে আসা যাক নির্ভেজাল ভূতেদের আড্ডার জন্য বিখ্যাত লালকোঠিতে। এবার এটা ওটা খুটখাট করতে করতে সকালের কাজকম্মো গুলো সেরে নেওয়ার পালা, আমাদের কাজ বলতে সামান্যই। দাঁতমাজা, দাড়িছাঁটা বড়বাইরে ইত্যাদি বাথরুমের কাজ মূলত। এ ছাড়া বেড়াতে এসে তোমার আর কাজ কী! 

অদ্ভুত রকমের রুক্ষ অথচ সতেজ প্রকৃতি শিমুলতলায়। এখানকার লোকজনদের জীবনযাপন আরো অদ্ভুত... কিছুটা সপাট সতেজ কর্মঠ সময় দেখার পরেই দেখতে পাবে, এখানে আর কোনো কাজ নেই। সব কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে... অতএব আবার যেদিকে তাকাবে দেখবে আলস্য বাবাজী সবখানে চাদর বিছিয়ে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে আছে। ভাবখানা এই... আয় আয়, আয় এবার একটু চুপটি করে আমার দালানে ঠেস দিয়ে বোস দিকিনি... হুশহুশিয়ে অনেক কাজ তো করলি রে বাপ, এখন আমায় একটু শান্ত হয়ে বল তো দেখি কী কী কাজ করলি এতক্ষণ ধরে অত হৈহল্লা করে?! তো, এই সব ভাবতে ভাবতে প্রায় পৌনে আটটা বেজে যাবে, আর আমরা আবার প্রচণ্ড অবাক হয়ে খেয়াল করব যে জানলা দিয়ে একটা মন উদাস করা মৌরীফোড়োন দেওয়া খাবারের সুগন্ধ আসছে। সেটা সম্ভবত পাঁড়েজীর দোকানে আলুর তরকারী রেডি হয়ে যাওয়ার গন্ধ... এইবার এক কড়াই গরম তেলে আটার লাল লাল পুরি ভাজা হবে! এবং আরো ভয়ানক অবাক হয়ে আমরা খেয়াল করব, পেটে গোটাপাঁচেক ছুঁচো নড়াচড়া শুরু করেছে! কোলকাতা বা তৎসংলগ্ন অঞ্চলে থাকলে কিন্তু ওই একগন্ডা বাসী শিঙ্গাড়া আমাদের বিকেল পাঁচটা অবধি খিদে পাওয়া থেকে বিরত করে রাখতে পারত। কিন্তু আমরা এখন বাড়িতে নেই... তাই এবার একটা হাফ সোয়েটার চাপিয়ে গুটি গুটি আবার রওয়ানা দেব পাঁড়েজীর দোকানের উদ্দেশ্যে। এবার অবশ্য আর আমরা আর চাদর নেব না। ঝকঝকে রোদ উঠেছে যে... রোদ মাখতে মাখতে হাঁটা যাক। 

তারপর সারাদিন অল্প ঘোরাঘুরি খানিক আড্ডা, ঘুরতে ঘুরতে চলে যাওয়া ধু ধু মাঠে পড়ে থাকা বিশাল রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষের কাছে... তারপর আবার গঞ্জের দিকে ফিরে এসে ফের আমরা ঘুরঘুর করব বিশাল বিশাল গেট ওয়ালা এক কালে জাঁকিয়ে বসা, অধুনা পলেস্তরাখসা ইটের মধ্যে থেকে গাছ গজানো পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর চারপাশে... কারো কোনো গেটের থামে মুখোমুখি বসে আছে এক জোড়া বিগতশ্রী সিমেন্টের সিংহ...  যাই হোক... দুপুরে আবার একচোট ভাত ডাল দেশীমুরগীর ঝোল দিয়ে পেটপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে নেওয়ার পরে নাহয় ভাবতে বসা হবে, আমাদের এত খিদে ছিলো কোথায়!? এবং, এই বিকট পরিমাণ খাদ্যাখাদ্য পেটের কোথায় কোথায় চালান হচ্ছে শেষ অবধি?!!!! 

শীতের বেলা ঝটপট শেষ হয়ে আসার তাড়ায় থাকবে। এখানে এখনো লো ভোল্টেজ থাকে। টিমটিমে বাল্বের আলোয় দিনের শেষে সন্ধ্যাকে বরণ করে নেওয়া হবে... এটাই এখানকার দস্তুর। ঝকঝকে তকতকে কোনো ব্যাপার কোত্থাও নেই, সবই ম্যাড়ম্যাড়ে আর ভয়ানক মায়াবী। মায়াবী সন্ধ্যে নেমে গেলেই দেখতে পাবে এই এলাকায় কী বেশী পরিমাণে থিকথিক করছে ভূত! 

এলাকার সমস্ত গহন অন্ধকার জুড়ে কনসেনট্রেটেড ঘন ভূতের দল মাইল কে মাইল ছড়িয়ে পড়ে থাকা অতীত ঘিরে গিজগিজ করছে। ভূতেদের মধ্যে সাহেব বাঙালি দেহাতি সবাই রয়েছে। দু' চারটে ঘোড়া আর অ্যালসেশিয়ান কুকুরের ভূতও রয়েছে। রাতের রাস্তা জুড়ে ঘোড়া ভূতে সওয়ার সাহেব ভূত তার সঙ্গে প্রিয় পোষ্য অ্যালসেশিয়ান কুকুরের ভূতকে সঙ্গে নিয়ে এ অঞ্চলের ভুতুড়েহাওয়া খেতে বের হয়। এখানকার ভূতের দল ভীষণ নির্লিপ্ত। এরা কাউকে একেবারেই ভয় টয় কিচ্ছু দেখায় না! শুধু লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে! কিন্তু বেড়াতে আসা কেউ কেউ হয়ত অত পরিমাণ ভূত একসঙ্গে দেখে ফেলে ভয় পেতেই পারে! তার জন্য অবশ্য এখানকার ভূতদের কোনোভাবেই দোষ দেওয়া উচিৎ নয়! 

রাতের টিমটিমে আলোমাখা জমাট অন্ধকারে ভূতেদের দু হাতে ঠেলে সরিয়ে সরিয়ে আমাদের এক পা দু' পা করে এগিয়ে যেতে হবে তাজা সবজীর দোকানে। সেই সবজীর দোকান থেকে আমরা ড্যামচিপ তাজা বেগুন কিনবো, পোকা এবং রাসায়নিক ছাড়া সস্তায় তাজা বড় বড় বেগুন কিনে আমরা আবার দু' হাতে ভূত সরাতে সরাতে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যাবো পাঁড়েজীর দোকানে। পাঁড়েজী ওই তাজা বেগুনগুলোর গায়ে মাপ মতন ছুরি চালিয়ে ছ্যাঁদা করে ঢুকিয়ে দেবে চার পাঁচ কোয়া রসুন আর কাঁচা লঙ্কা। তারপর কয়লার উনোনো বেগুনগুলোকে দেশী টমেটোর সঙ্গে খুব যত্ন করে নিজের হাতে পোড়াতে পোড়াতে পাঁড়েজী আমাদের বলবে, যে এখন তো এখানে আর কিছুই নেই... তবে একসময় এই যায়গাটার একটা 'সময়' ছিলো বটে! পাঁড়েজীর সহকারীরা মুখ বন্ধ করে একের পর এক রুটি বেলে তাওয়ায় সেঁকে উনোনে চিমটে দিয়ে ফুটবলের মতন ফুলিয়ে নরম কাপড়ের ওপর রেখে পাঁজা খানেক রেডি হয়ে গেলে চিল চিৎকার করে কর্কশ গলায় বলবে - ফুলকা তৈয়ার হো গ্যায়া হ্যায়। আমরা অবাক হয়ে নিজনিজ পেটে সেই পাঁজা পাঁজা রুটি অবলীলায় পাকস্থলীর বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলে ঠেসেঠুসে ভ্যানিশ করে দিয়ে, দু' হাত দিয়ে ঠেলেঠুলে ভূত সরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবার ভূতের ডেরার লালকোঠিতে পৌঁছে যাবো। 

হ্যাঁ মশাই শিমূলতলার কথা বলছিলাম...  আগামী সপ্তাহের মাঝখানে দিন চারেকের জন্যে আবার একবার বিহারের শিমূলতলা ঢুঁ মারতে চলেছি একটা ছোটোখাটো ড্রাইভে। যাওয়ার আগে ব্যাগ পত্তর গোছাতে গোছাতে হালকা করে স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েছিলাম তাই ছোট্টো একটা স্মৃতিনির্ভর ভূমিকা ছেড়ে রাখলাম। এরপর ফাঁকে ফোঁকরে অথবা ফিরে এসে দু একটা ছবিছাবা আপলোডিয়ে দেবোখন! আসানসোলের পর থেকে চিত্তরঞ্জন পেরিয়ে 'জামতাড়া-গোড্ডা রোড ধরে' নিলেই রাস্তার দু'পাশ পৌঁছানোর আগেই পয়সা উশুল করে দেবে! আশা করছি প্রতিবারের মতন এবারেও শিমূলতলায় পৌঁছে নেট ফেট পাবো না! আর ইয়ে, একটা ভীষণ জরুরী ইনফো দিয়ে রাখি। যাঁরা শিমূলতলা গিয়ে ইঁদারার মিনারেল মেশানো জলের বদলে প্লাস্টিকের বোতলে কেনা মিনারেল ওয়াটার খেয়ে থাকেন তাঁরা অবশ্যই অ্যান্টাসিড ক্যারি করবেন। নইলে ঐ ডালডা মাখা ঠাণ্ডা শিঙ্গাড়া জিলিপি কিন্তু আপনাদের মাথায় চড়ে চেপে বসবে। ওসব হজম করানো বা পাকস্থলীতে বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল বানানো কেনা প্লাস্টিকের জলের বোতলের কম্মো নয়... এইবেলা সবাইকে বলে কয়ে রাখলুম!

পুরনো লেত্তি পুরনো লাট্টু... 
শিমুলতলা, ডিসেম্বর ২০১৭

An idea, like a ghost, must be spoken to a little before it will explain itself... 
...Lord Sinha's place, Shimultala.