এটা একটা ভূতের গল্প।
গল্পজুড়ে অনেকগুলো ভূত। ১৮৮৬ সালে হে মার্কেটে আট ঘন্টা কাজের দাবীতে যে শ্রমিকরা ডাইনামাইট ছুড়েছিলো, এবং তারপর যাদের ফাঁসি হয়, সেই শ্রমিকদের ভূত, ডাইনামাইটের ভূত, ফাঁসির দড়ির ভূত। ঠিক ১৯ বছর পরে আবার সেই ডাইনামাইট ব্যাবহার হবে রাশিয়াতে। আবার ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে বহু লোক।
ইউরোপের এক ছোট্ট শহর স্যারাএভোতে এক নৈরাজ্যবাদী গুলি চালাবে অস্ট্রিয়ান রাজকুমার ফার্ডিনান্ডকে লক্ষ্য করে। এইরকমভাবেই শুরু হবে বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস। সেই ইতিহাসের সমাপ্তিও ঘটবে ঠিক ৮০ বছর পরে, এই একই শহরে। ইউটোপিয়া চেয়েছিলো যারা, তাদের দিকে আঙ্গুল তুলে হাসবে গোটা বিশ্ব। ইউগোস্লাভিয়া ভেঙে টুকরো হবে। ইউটোপিয়ার শবদেহের ওপর মেমোরিয়াল স্টোনের মতন জেগে থাকবে সারাএভোর ভূত।
শতাব্দীর শুরুর দিকেই, জার্মানিতে একদিন ব্রাউনশার্টরা পিটিয়ে মারবে রোজা লাক্সেমবার্গ নামক এক শীর্ণকায় মহিলাকে। তারপর তার দেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হবে। ওয়াইমার রিপাব্লিকের ভূত আকাশে উড়তে উড়তে দেখবে, রাইখস্ট্যাগে আগুন লেগেছে। যে রাতে আগুন লাগবে, তার পরেরদিনই বিভিন্ন খবরের কাগজে খবর হবে, যদিও আগুন লাগবার আগেই প্রেসে কাগজ ছাপা হয়ে গেছে। সেই আগুনের ভূত আবার জ্বলবে গ্যেরনিকায়, যখন ফ্রাঙ্কোকে সাহায্য করতে হিটলার আর মুসোলিনির বিমান বাহিনী গোটা শহরটিকে বোমায় মুড়ে দেবে, আর স্পেনের আকাশে উড়ে বেড়াবে কমিউনিষ্ট আর রিপাব্লিকানদের পোড়া ভূত। তবুও সেই আগুনের ক্ষিদে মিটবে না, আউশউইতজের ফার্নেসে সে জ্বলতে থাকবে ধিকিধিকি করে। আর ফার্নেসের বাইরের ঘরে পড়ে থাকবে ডাই করে রাখা চুল, যা ইহুদিদের মাথা থেকে কেটে জড়ো করা হয়েছে। ঠিক এরকম চুলের পাহাড় পাওয়া যাবে ইস্ট পাকিস্তানের পাকিস্তানি আর্মি ব্যারাকগুলোর মধ্যে। আশেপাশের গ্রামের মহিলাদের তুলে আনবার পরে দিনের পর দিন ধর্ষন করবার আগে তাদের চুল কেটে রাখা হবে, যাতে নিজেদের চুল ব্যাবহার করে ঝুলে পড়ে নিজেরা আত্মহত্যা না করতে পারে।
গ্রীস, ইতালি আর ইউগোস্লোভিয়ার পার্টিজান ব্রিগেডের হাতে যে রাইফেল দেখা যেতো, ঠিক সেইরকম রাইফেল দেখতে পাওয়া যাবে তেলেঙ্গানার কৃষক রমণীদের হাতে। তাদের ট্রেনিং দেবেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মি থেকে পালিয়ে আসা মেজর জয়পাল সিং। তারপর নিজামের রাজাকার আর পটেলের সেনাবাহিনীর হাতে খুন হয়ে যাওয়ার পর সেই রাইফেলের ভূতগুলো ঘুমিয়ে থাকবে বেশ কিছুদিন, যতক্ষন না আবার ভিয়েতনামে আধপেটা খেয়ে থাকা চাষীরা তাদের হাতে তুলে নেয়।
জার্মানিতে, ফ্রান্সে দুই আর তিনের দশকে রাস্তা জুড়ে যে মিছিল আর ব্যারিকেড দেখা যেতো ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে সেই মিছিল আর ব্যারিকেডের ভুতগুলো এলোমেলো হয়ে ঘুরে বেড়াবে ১৯৬৮ অবধি, যখন আবার একদল ছাত্র তাদের জীবন্ত করে তুলবে বার্লিন আর প্যারিসের ইউনিভার্সিটিগুলোর মধ্যে।
বার্লিনের দেওয়াল ভেঙে ফেলবার পর স্যুভেনির হিসেবে ইটগুলো সংগ্রহ করবে বহু কালেক্টর। দেওয়ালের ভূত দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। ইটগুলোর ভূতেরা ছত্রাখান সেনাবাহিনীর মতন ছড়িয়ে পড়বে ইউরোপ থেকে সারা পৃথিবী। ইউটোপিয়ার ভুত হাসবে, কারন নিজের অদৃষ্ট সে বহুদিন আগে বুঝেছিলো, যখন তার দেহথেকে পচা গন্ধ বেরোতে শুরু করেছে। কিন্তু দিশেহারা ইটের ভূতগুলোও সবাই শেষ হয়ে যাবে না।
এরকমই একটা ইট ছোড়া হবে পুলিশকে লক্ষ্য করে, আমেরিকার সিয়াটেল শহরে বিশ্ব বানিজ্য সংস্থার সামিটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলে।
এরকম বহু ব্যারিকেড, মিছিল, ইট, বুলেট, দেওয়াল, আগুন, কবিতা গানের ভূত উড়ে বেড়াবে পৃথিবীর আকাশে। মাঝেমধ্যে উঁকিঝুকি মারতে থাকবে হাউড পার্কে, কুর্দিস্তান, শাহবাগ চত্বরে।
তারপর অনেক অনেকদিন পরে কোন এক পয়লা মে'র আগের রাতে, নিজেদের বন্ধ দরজার পেছনে নিশ্চিন্তে ঘুমোবে সব রাষ্ট্রনেতা, মিলিটারি জেনারেল, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মালিক, পাদ্রী, ইমাম, পুরোহিতরা। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। হাওয়া বইবে মৃদু তালে। হয়তো চাঁদ ঢাকা পড়বে মেঘের আড়ালে।
তারপর খুব মন দিয়ে কান পাতলে শোনা যাবে, কারা যেন ফিসফিস করছে। রাস্তায়, গলিতে, ডকে, কারখানায়, জনমানবশূন্য নদীর তীরে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে ভৌতিক সমাগম। ফিসফিসানির আওয়াজ তীব্রতর হবে। শোনা যাবে পায়ে পা মিলিয়ে কারা যেন মার্চ করছে। নিঃশ্বাস ফেলছে। গান গাইছে। কোন এক পয়লা মে'র আগের রাতে ভৌতিক কাগজে, ভৌতিক কালিতে পৃথিবীর প্রতিটা মহাদেশে, প্রতিটা শহরে, প্রতিটা গ্রামে দেওয়ালে দেওয়ালে সাঁটা হবে ভৌতিক পোস্টার। অশরীরী অক্ষরে কারা যেন তাতে লিখে যাবে - ইউটোপিয়া।