শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

বীণা দাস ~ দিপাঞ্জন ঘোষ



আচ্ছা, আপনারা এ পাড়ায় অনেকদিন আছেন?

আমরা এসেছি নাইন্টিন এইট্টি।

ও, তাহলে আপানারা বলতে পারবেন। এখানে কি বীণা দাস বলে কেউ…

থাকতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন।

***

আজ হয়তো বীণা দাসের নাম শুনে আপনি চিনতে পারছেন না। কিন্তু আজ থেকে ৮৮ বছর আগে সবাই তাঁকে এক নামে চিনত। ১৯৩২ সালের ৬-ই ফেব্রুয়ারি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশান অনুষ্ঠান চলছে। বক্তৃতা দিতে উঠে দাঁড়ালেন ইংরেজ রাজ্যপাল, স্যার স্ট্যানলি জ্যাক্সন। হঠাৎ দর্শকের আসন থেকে উঠে এলেন এক ছাত্রি - বীণা দাস। কনভোকেশানের গাউনের ভেতর থেকে বার করলেন রিভলভার। গুলি চালালেন সোজা জ্যাকসনকে লক্ষ করে। কানের পাস দিয়ে বেরিয়ে গেলো গুলি। লাফিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হাসান সুরাওয়ার্দি। টিপে ধরলেন বীণার টুটি। ধ্বস্তাধস্তির মধ্যেও আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন বীণা। রিভলভার থেকে পর পর পাঁচটি গুলি চালালেন, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেন। ওইটুকু মেয়েকে ঠেকাতে সেদিন দুজন জোয়ান পুরুষমানুষের সমস্ত শারীরিক শক্তির দরকার পড়েছিল।

বীণাকে নিয়ে যাওয়া হল লালবাজার। ডাকা হল মা বাবাকে। পুলিশের তরফ থেকে বলা হল, বীণা যদি শুধু বলে দেন যে রিভলভার তাঁকে কে দিয়েছে, তাহলেই তাঁর সাজা অনেক কমিয়ে দেওয়া হবে। তবে বাবা বেনিমাধব ছিলেন গান্ধিবাদি শিক্ষক। কটকের র‍্যাভেনশ কলেজে যখন পড়াতেন, তাঁর প্রিয় ছাত্র ছিলেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস। বেনিমাধবের অন্য দুই সন্তান তখন স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়ে জেল খাটছেন। তিনি এ কাজ কোনভাবেই করতেন না। "আমার বাবা মেয়েকে বিশ্বাসঘাতক হতে শেখাননি", বলেন বীণা।

মাত্র একদিনের বিচার। ভাগ্যে জুটল ৯ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। কারাগারের অবস্থার উন্নতির জন্যে সেখানে অনশন করেন। ৭ বছরের মাথায় মুক্তি পান। ছাড়া পেয়ে যোগ দেন অসহযোগ আন্দোলনে। ভাগ্যে জোটে আরও তিন বছরের কারাবাস। স্বাধীনতার বছর, বিয়ে করেন আর এক স্বাধীনতা সংগ্রামী জ্যোতীশ ভৌমিককে। ১৯৫১ নাগাদ বাংলা সংবাদপত্র অমৃত বাজার পত্রিকার কর্মিরা আন্দোলন শুরু করেন বেতন বৃদ্ধির দাবিতে। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন বীণা। কিন্তু তাঁর দল, কংগ্রেস, মালিকের পক্ষ্য নেয়। কিন্তু তাও আন্দোলন চালিয়ে যান বীণা। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত বাঙালীদের দণ্ডকারণ্যে পাঠিয়ে দেওয়া, তারা পশ্চিমবঙ্গে ফিরতে চাইলে তাদের ওপর পুলিশি জুলুম, তারও প্রতিবাদ করেন।

কিন্তু বারংবার নিজের দলের কাছ থেকে বিশ্বাসঘাতকতা পেয়ে, হতাশ হয়ে দল ছাড়েন। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য সরকারি পেনশন নিতে অস্বীকার করেন। আসলে বীণার আনুগত্য কোন সরকার বা দলের প্রতি ছিলনা। বীণার আনুগত্য ছিল শুধু নিজের আদর্শের প্রতি। আদর্শের ব্যাপারে আপোশ করতে তিনি নারাজ, পরিণতি যাইই হোক না কেন। স্বামীর মৃত্যুর পর, কেমন যেন গোলমাল হয়ে যেতে থাকে বীণার জীবন। ছোট হয়ে আসতে থাকে সামাজিক বৃত্য। শেষে সব ছেড়ে দিয়ে চলে যান হরিদ্বার।

২৬-এ ডিসেম্বর ১৯৮৬ সাল। হরিদ্বারের রাস্তার ধারে পড়ে থাকতে দেখা যায় একটি মহিলার মৃতদেহ। খবর যায় পুলিশে। পুলিশ এসে দেখে মহিলার মৃত্যু হয়েছে কয়েকদিন আগেই। দেহে পচন ধরেছে। তুলে নিয়ে যাওয়া হয় মৃতদেহ। শনাক্ত করতে লাগে এক মাস সময়। হরিদ্বারের রাস্তার ধারে, কপর্দকশূন্য অবস্থায় যিনি মারা গেছেন, তিনি বাংলার অগ্নিকন্যা, বীণা দাস।

***
১৭/এ একডালিয়া প্লেস। এটাই ছিল বীণার শেষ ঠিকানা। সে বাড়ি আজ আর নেই। তার যায়গায় গড়ে উঠেছে হোটেল। একমাত্র পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠরা আজও মনে রেখেছেন বীণাকে। আপনি যদি বীণা দাসের নাম না শুনে থাকেন, তাঁর বাড়ি না দেখে থাকেন, তাতে লজ্জার কিছু নেই। আসলে আমাদের দেশে সব উৎসব, সব উন্মাদনা, কেবল ধর্ম নিয়ে। স্বাধীনতা দিবস স্রেফ একটি সরকারি ছুটির দিন। তাই জন্যেই আপনি একডালিয়ার পুজোর কথা জানেন। কিন্তু একডালিয়ার বীণা দাসের কথা জানেন না। শুনেছি বড় পুজোয় নাকি প্রায় কোটি টাকা খরচ হয়। সেই খরচের একটি ছোট অংশ বাঁচিয়ে, একটা স্মৃতিস্তম্ভ, একটা পাথরের ফলক, কিছুই কি বসানো যেত না?

কাদের জন্য আপনি আন্দোলন করেছিলেন বীণা? কাদের ওপর অভিমান করে চলে গেছিলেন? আপনার শহর, আপনার মানুষ, আপনাকে কবে ভুলে গেছে। শেষ ঠিকানা ১৭/এ, গ্রেফতারের সময় ৬৭/১ একডালিয়া প্লেস।

কৃষি আইন ~ সুশোভন পাত্র

লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন, লেটস টক অ্যাবাউট কিষান টু-নাইট! 
না এরকম কোন মিডিয়া বলেনি। বলেনি কারণ কিষান মিডিয়াতে নন ইস্যু! কিষান মানে ঐ, যাদের সৌজন্যে আপনি তুলতুলে রুটি পুরুষতান্ত্রিকতার ঝোলে ডুবিয়ে প্রাইমে টাইমে রিয়া চক্রবর্তীর গুষ্ঠি উদ্ধার করেন, সেই কিষান। কিষান মানে ঐ, যাদের সৌজন্যে আমারা ধোঁয়া ওঠা ভাতের উপর তৃপ্তির ঘি ছড়িয়ে IPL-র ফটো ফিনিশ উপভোগ করি, সেই কিষান। 
কিম্বা ধরুন, ভারতে প্রতি ১২ মিনিটে যাদের একজন কে ঋণের দায়ে আত্মঘাতী হতে হয়, সেই কিষান। কিষান মানে, যাদের রক্ত জল করা উপার্জনের টাকা সমবায় ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে, জন্মদিনের পার্টি তে  পপ গায়ক এনরিকে ইগলেসিয়াসের সুরে কোমর নাচিয়ে, নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে, বিজয় মালিয়া নিশ্চিন্তে বিদেশে গিয়ে বসে থাকতে পারেন, সেই কিষান। 
এককালের 'জয় জওয়ান জয় কিষানদের' দেশে আজকাল নাকি 'সব চাঙ্গা সি'! তাই জোরজবরদস্তি কৃষি বিল পাশ করানো ছাড়া সরকারের মনসুন সিজনে আর কোন কাজই নেই! অপরিকল্পিত লকডাউনের জন্য কত পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে -শ্রম মন্ত্রকের কাছে ডেটা নেই। কোভিড সংক্রমণের বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াইয়ে কতজন ডাক্তারের প্রাণ গেছে -স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কাছে ডেটা নেই। কত মানুষ আধ পেটা রইলো, কত মানুষ না খেতে পেয়ে মরল -খাদ্য মন্ত্রকের কাছে ডেটা নেই। দেশে কত মানুষ কাজ হারিয়েছেন -অর্থমন্ত্রকের কাছে ডেটা নেই। 
ডেটা নেই। তাই সমস্যা নেই। সমস্যা নেই তাই সমাধানের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই তাই সরকারের কাজ নেই। Ignorance is bliss, ১৭৪২-এ বলেছিলেন ব্রিটিশ কবি থমাস গ্রে। Ignorance is governacne, ২০২০ তে বুঝিয়ে দিচ্ছে বিজেপি। সরকার নয়, সার্কাস চলছে বুঝিয়ে দিচ্ছে বিজেপি।  
সার্কাসের রিং মাস্টার নরেন্দ্র মোদী কিষান'দের উদ্দেশ্যে বলেছেন 'কৃষকদরদী বিল', 'ঐতিহাসিক বিল'। তা এমন 'ঐতিহাসিক বিল' মুখ লুকিয়ে পাশ হল কেন? 'কৃষকদরদী বিল' যখন দেশের কিষানরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে কেন? যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় রাজ্য সরকারের মতামত নেওয়া হল না কেন? সম্প্রচার বন্ধ করে রাজ্যসভায় মার্শাল লেলিয়ে গলার জোরে ভোট করাতে হল কেন? চোরের মন এক পুলিশ পুলিশ কেন? আসলে ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি! বিল ঐতিহাসিকই, তবে কিষানদের জন্য নয়, রিং মাস্টারের পীরিতের কর্পোরেট শিল্পপতিদের জন্য। কেন? সিম্পল! 
অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের সংশোধনীতে বলা হচ্ছে, চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ-গম-ভোজ্য-তেল তৈলবীজ নাকি যত ইচ্ছে মজুত করা যাবে। প্রশ্ন হল মজুত করা তো যাবে, কিন্তু করবে কে? আপনার-আমার মত ছা-পোষা সাধারণ মানুষ? না, গড়ে ২ হেক্টরের কম জমির মালিক দেশের ৮৬% চাষি? আসলে মজুত করবে তারাই যাদের মজুত করার মত পকেটের জোর আছে। ব্যাঙ্কে ব্যালেন্স আছে। পরিকাঠামো আছে। পাতি অর্থে কর্পোরেট। 
কথায় বলে There is always a method in madness; একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন তো খাদ্যশস্য মজুতের ব্যবসায় এই দেশের অগ্রণী শিল্পপতি কে? নো পয়েন্ট গেসিং! তিনি মোদীর নির্বাচনী প্রচারে চার্টার্ড বিমান সাপ্লাইকারী গৌতম আদানি। আফ্রিকা-ইউরোপ ছাড়াও আদানি-উইল্মারের খাদ্যশস্য মজুতের ব্যবসায় বাংলাদেশে বিনিয়োগ ৩৫০ বিলিয়ন ডলার। বিনিয়োগ হচ্ছে বাংলাতেও। 
APMC অ্যাক্টের হাত ধরে ভারতে কিষান মান্ডির পথ চলা শুরু ষাটের দশকে। সংখ্যায় অপ্রতুল ও দুর্নীতি সহ বহু সমস্যায় জর্জরিত হলেও আজও ৭.৫ হাজার মান্ডি চাষিদের কাছে বটবৃক্ষের প্রশস্ত ছায়ার মত। যে ছায়ার শীতলতা দিনের পর দিন লোভী ব্যবসিকদের লালসা থেকে চাষিদের রক্ষা করেছে। সম্মিলিত ভাবে কৃষকদের দরকষাকষির সুযোগ দিয়েছে। অন্তত খাতায় কলমে MSP-র একটা নিশ্চয়তা রয়েছে। কৃষিপণ্য ব্যবসা বাণিজ্য উন্নয়ন অর্ডিন্যান্সের উদ্দেশ্যই হল মান্ডির বাইরেও প্রাইভেট মার্কেট তৈরি করা এবং মার্কেট গুলি কে রাজ্য সরকারের ট্যাক্স বা সেসের আওতার বাইরে রেখে সেখানেই চাষিদের ফসল বেচতে বাধ্য করা।
তাই ব্রহ্মা জানেন, রিং মাস্টার টুইটে যতই 'একদেশ একবাজারের' গুলতানি করুন না কেন, এই প্রাইভেট মার্কেট গুলি অচিরেই কিষান মান্ডি গুলির বিলুপ্তির অনুঘটক হবে। MSP-র নিশ্চয়তা কর্পূরের মত উবে যাবে। আর মান্ডির অনুপস্থিতিতে প্রাইভেট মার্কেট গুলির হাত ধরে কর্পোরেটই সরকারের রেশন ব্যবস্থার মুখ্য জোগানদার হয়ে উঠবে। এতদিনের সরকার ও চাষির মধ্যে ফসল কেনাবেচার সম্পর্কে হাড্ডি হিসেবে আবির্ভাব ঘটবে কর্পোরেট ফোঁড়েদের।  
টেকনিক্যাল দুনিয়ায় প্রোটোটাইপ মডেলিং বলে একটা টার্ম চালু আছে। ঐ ডাবু দিয়ে কয়েকটা ভাত তুলে একটু টিপে সেদ্ধ হয়েছে কিনা বুঝে নেওয়া কিম্বা সরষে ইলিশে নুনটা ঠিকঠাক পড়েছে কিনা একটু চেখে দেখে নেওয়ার মত আর কি। মান্ডি তুলে দিয়ে প্রাইভেট মার্কেট তৈরির প্রোটোটাইপ মডেল বিহারে ২০০৬ থেকেই চালু। অভিজ্ঞতা কি বলছে? বিহারের একজন কৃষকের গড় মাসিক অ্যায় ৩,৫৩৮টাকা। যা দেশের কৃষকদের মাসিক গড় আয় ৬,৪২৬টাকার তুলনায় ৪৫% কম। আর দেশের যে দুই রাজ্যে মান্ডির রমরমা সেই পাঞ্জাব ও হরিয়ানা তে কৃষকদের গড় মাসিক আয় ১৮হাজার এবং ১৪হাজারের তুলনায় ৮০% এবং ৭৫% কম। 
রইলো বাকি কন্ট্রাক্ট ফার্মিং। আমেরিকায় গত ৬দশক ধরে চালু আছে প্রাইভেট কন্ট্রাক্ট ফার্মিং-র মডেল। তবুও ১৯৬০'র পর থেকে ধারাবাহিক ভাবে কমেছে কৃষকদের আয়। বেড়েছে কৃষি ক্ষেত্রে সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ। বর্তমানে প্রায় ৪২৫ বিলিয়ন ডলার। বেড়েছে কৃষকদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা। আমেরিকার সাধারণ নাগরিকদের তুলনায় ৪৫% বেশি। ইউরোপের কৃষি ব্যবস্থাও দাঁড়িয়ে  আছে প্রাইভেট মার্কেটের জোরে না বরং ফি-বছরে সরকারের ১০০ বিলিয়ন ডলার ভর্তুকির সৌজন্যেই।    
১৯৩০-র গ্রেট ডিপ্রেশনের মোকাবিলায় সোভিয়েতে স্তালিনের হাত ধরে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার নিউ ইকনমিক পলিসিতে  ছিল দ্রুত শিল্পায়ন এবং কৃষির সমষ্টিকরণ। রাশিয়ার জমিদার-জোতদার কুলাকদের হাত থেকে জমির দখল নিয়ে ছোট-মাঝারি কৃষকদের সমষ্টি চাষের প্রথা শুরু হয় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কৃষির সমষ্টিকরণের মাধ্যমই। কৃষির অগ্রগতির ব্যাপক সাফল্যই রসদ জুগিয়েছিল সোভিয়েতর রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে দ্রুত শিল্পায়নে। পুঁজিবাদী দেশের মুখে ঝামা ঘষে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সৌজন্যেই সোভিয়েত বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল বিশাল অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে।  
প্রায় ৯০ বছর পর, প্যান্ডেমিকের ক্যাসক্যাডিং এফেক্টে বিশ্বে অনুরূপ আর্থিক মন্দার প্রেক্ষাপটে ভারত চলেছে ঠিক উল্টো পথে। রেল কিম্বা কয়লা, শিক্ষা কিম্বা রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র -আত্ম-নির্ভরতার মুখোশে প্রতিদিন ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বিক্রি হচ্ছে দেশ। কিষানদের পেটে লাথি মেরে আঁকা হচ্ছে আম্বানি-আদানিদের পকেট ভরানোর নীল নকশা। 
তাই কর্পোরেটদের মালাই চেটে চর্বি জমানো এই সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই হবে রাস্তায়। যে লড়াইয়ে হিসেব হবে ফসলের দামের। পেটের খিদের। বেকারের কাজের। যে লড়াইয়ে হিন্দুর শিরা ভেসে যাবে মুসলিম রক্তে। ব্রাহ্মণ মেয়ের হাত ধরবে দলিত ছেলে। যে লড়াইয়ে 'মহুল ফুটবে শৌখিনতার গোলাপ কুঞ্জে/সাঁওতাল তার ভাষায় বলবে রাষ্ট্রপুঞ্জে'। 
আপনি বরং ঠিক করুন সেই লড়াইয়ে আপনি কোন পক্ষে। সরকারের পক্ষ, না মানুষের পক্ষ। পক্ষ দুটো। চয়েস একটাই।

বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

শ্রীলঙ্কান ব্ল্যাক পর্ক কারি ~ স্বাতী রায়

৫০০ গ্রাম মাংসের হিসেবে সমস্ত পরিমাপ - মাংসের পিস গুলো ধুয়ে জল ঝরিয়ে নিতে হবে একদম। এবার ১৫-২০ পিস মাঝারি রসুনের কোয়া, দু ইঞ্চি আদা, একটা বড় বা দুটো মাঝারি সাইজের পেঁয়াজ বাটা, হলুদ গুঁড়ো, দু টেবল চামচ ঘন তেঁতুল গোলা জল সহ চিকেনে মাখাতে হবে৷ একটা শুকনো খোলায় দুই টেবল চামচ জিরে, এক টেবল চামচ মৌরি, দুই টেবল চামচ গোটা ধনে, একটা দু ইঞ্চি মত দারচিনির স্টিক, খান পাঁচ ছয়েক লবঙ্গ, যে যেমন ঝাল খেতে পছন্দ করেন ততগুলো শুকনো লঙ্কা একটু খয়েরি করে ভেজে নিতে হবে (আমি ৬-৭টা টা শুকনো লঙ্কা নিয়েছিলাম)৷ এবার সেটাকে মিক্সি তে গুঁড়ো করতে হবে এক চামচ গোটা গোলমরিচ সহ। এই মশলা আগে ম্যারিনেট করে রাখা চিকেনের সাথে দিয়ে চার টেবল চামচ সর্ষের তেল, স্বাদ মত নুন আর হাফ চামচ চিনি দিয়ে যে পাত্রে রান্না করা হবে তাতেই ভালো করে মেখে নিতে হবে৷ এবার গ্যাসে ওই পাত্র বসিয়ে স্লো ফ্লেমে চাপা দিয়ে রান্না করতে হবে। মাংস জল ছাড়লে তাতে তিন চার স্টিক কারিপাতা, স্টিক থেকে ছিঁড়ে মিশিয়ে দিতে হবে৷ হাফ চা চামচ কসুরি মেথি পাতা অ্যাড করবে, মাঝে মাঝে চাপা খুলে মাংস নেড়ে চেরে দিতে হবে না হলে তলা ধরে যাবে। জল শুকিয়ে এলে ফ্লেম হাই করে ভাল করে কষিয়ে নিলেই রেডি। আমি ঝাল বেশী খাই তাই এতে জল ছাড়লে খান তিন চারেক কাঁচা লঙ্কা হামানদিস্তায় থেঁতো করে মিশিয়ে দিই। একটু ঝাল ঝাল রান্না হয়।

বৃহস্পতিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০

আকাশবাণী ও মহিষাসুরমর্দিনী ~ সোহম চন্দ্র

"Mr. Mullick, Your Mahishasura-mardini will be on the air again from the next Mahalaya!"

দিনটা ছিল ১৯৭৭ সালের ২৬শে অগাস্ট। এই রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার গঠন করেছে সবে মাত্র দু'মাস হয়েছে। অল ইন্ডিয়া রেডিও বা আকাশবাণীর কলকাতা বেতারকেন্দ্রের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সেইদিন রবীন্দ্র সদনের প্রেক্ষাগৃহ কানায় কানায় পূর্ণ। মঞ্চে আসীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু; তাঁরই পাশে উপস্থিত, তৎকালীন কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতারমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণীর মুখে হঠাৎই শোনা গেল এই ঘোষণা। লক্ষ্য ছিলেন একই মঞ্চে সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থাকা ভারতীয় সঙ্গীত, সিনেমা ও বেতারজগতের কিংবদন্তী পঙ্কজ কুমার মল্লিক। পরক্ষণেই হাততালি ও উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লো গোটা রবীন্দ্র সদন!...

কিন্তু প্রতি বছর মহালয়ার ভোরে মহিষাসুরমর্দিনী শোনা তো বঙ্গজীবনের অঙ্গ, তাহলে কেনই বা এই ঘোষণা আর কিসেরই বা এত উত্তেজনা? সম্পূর্ণটা বুঝতে গেলে আমাদের শুরু করতে হবে আরো পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে গিয়ে, কলকাতা বেতারের জন্মলগ্ন থেকে...

১৯২২য়ে ইন্ডিয়ান স্টেটস অ্যান্ড ইস্টার্ন এজেন্সি লিমিটেড নামক একটি বেসরকারী সংস্থা প্রথম ঔপনিবেশিক ভারতের ব্রিটিশ সরকারকে প্রস্তাব দেয় দেশজুড়ে বেতার সম্প্রচার ব্যবস্থা চালু করার জন্য। কয়েক মাস বাদে দিল্লীতে বৈঠকের পর মেলে অনুমতি। ১৯২৩য়ের নভেম্বর মাসে বেঙ্গল রেডিও ক্লাব ও মার্কনি কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে কলকাতা থেকে শুরু হয় বেতার সম্প্রচার যদিও ট্রান্সমিশন ছিল অত্যন্ত দুর্বল, রেডিও তরঙ্গের বিস্তার সীমাবদ্ধ থাকতো অনধিক পাঁচ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যেই। মার্কনি কোম্পানির বেতার অফিস ছিল হাইকোর্টের উল্টোদিকে টেম্পল চেম্বারে, মুখ্য অধিকর্তা ছিলেন জন রাউজ স্টেপলটন। তবে সাহেব একা নন, ওনার সাথে ছিলেন আরো দুই বাঙালী; হীরেন্দ্রকুমার বসু ও বীরেন রায়। প্রথম জন সেই যুগের বিখ্যাত সুরকার ও গীতিকার এবং দ্বিতীয় জন হলেন প্রথম বাঙালী পাইলট! ১৯২৭য়ে এই কলকাতা বেতারকেন্দ্রটি অধিগ্রহণ করে বেসরকারী সংস্থা ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি এবং সেই বছরেরই ২৬শে অগাস্ট থেকে ১ নং গার্স্টিন প্লেসের বিখ্যাত বাড়িতে যাত্রা শুরু করে ক্যালকাটা রেডিও স্টেশন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত টিকে থাকতে পারেনি সংস্থাটি। উপযুক্ত মূলধনের অভাবে চরম আর্থিক সংকটে পড়ে ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি বা আইবিসি। ব্রিটিশ সরকার অবধি নাকচ করে দেয় আর্থিক সহায়তার অনুরোধ। অবশেষে প্রায় দু'লক্ষ টাকার ক্ষতি স্বীকার করে তিন বছরের মধ্যেই ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হয় এই ব্রডকাস্টার। এরপর বেতার শিল্পের সাথে যুক্ত বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের বেতার উৎসাহী মানুষের দাবী মেনে সরকার অধিগ্রহণ করে সংস্থাটি; ১লা এপ্রিল, ১৯৩০ থেকে নতুন মালিক হয় ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস, কলকাতার স্টেশন ডিরেক্টর হিসেবে বহাল থাকেন স্টেপলটনই। আরো ৬ বছর বাদে ভারতীয় বেতার সংস্থা পরিচিত হয় অল ইন্ডিয়া রেডিও নামে। ততদিনে কলকাতা বেতারের সাথে যুক্ত হয়েছেন বাণীকুমার, পঙ্কজকুমার মল্লিক, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও রাইচাঁদ বড়াল এবং জন্ম হয়েছে ভারতীয় বেতারের ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান 'মহিষাসুরমর্দিনী'র। 

কৃত্তিবাসী রামায়ণের হাত ধরে বঙ্গদেশে শারদীয়া দুর্গাপুজোর পরিচয় অকালবোধন নামেই। অতএব ঠিক সময়ের বোধন হল বসন্তকালের দুর্গাপুজো যেখানে দেবীর অর্চনা হয় বাসন্তী ও অন্নপূর্ণা রূপে, চৈত্র মাসে। মজার ব্যাপার হল, আমাদের মহিষাসুরমর্দিনী গীতি-আলেখ্যর জন্ম কিন্তু চৈত্র মাসেই। ১৯৩২ সালে, কলকাতা বেতার বিভাগের পক্ষ থেকে পরিকল্পনা করা হয় একটি বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠানের যেটি প্রচারিত হবে সেই বছরের বাসন্তী বা অন্নপূর্ণা পুজো উপলক্ষ্যে। বঙ্গাব্দের হিসেবে সালটা ছিল ১৩৩৮। চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমী তিথিতে হয় বাসন্তী পুজো ও অষ্টমী তিথিতে হয় অন্নপূর্ণা পুজো। ১৩৩৮ বঙ্গাব্দও তার ব্যতিক্রম ছিল না। অষ্টমী তিথির ভোরে বাসন্তী ও অন্নপূর্ণা পুজোর সন্ধিক্ষণে সম্প্রচার করার উদ্দেশ্যে লেখা হয় 'বসন্তেশ্বরী', মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য অনুসারে। স্তোত্র, গান ও কথাসূত্রের সমন্বয়ে এই অনুষ্ঠানটির মূল ভাবনা ছিল বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্যের, যাকে আপামর বাঙালী চেনে বাণীকুমার নামে। বসন্তেশ্বরীর সংগীত পরিচালনা করেন রাইচাঁদ বড়াল। কয়েকটি গানে সুর দেন পন্ডিত হরিশচন্দ্র বালী ও পঙ্কজকুমার মল্লিক। কথাসূত্রের দায়িত্বে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এবং শ্লোক আবৃত্তি করেন বাণীকুমার স্বয়ং। অনুষ্ঠানটি যে সফল হয়েছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই বছরেরই (১৯৩২) আশ্বিন মাসে, অর্থাৎ ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের শারদীয়া দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর সকালে আবার সম্প্রচারিত হয় বসন্তেশ্বরী। যদিও এটি ছিল মহিষাসুর বধের উপর ভিত্তি করে পরিমার্জিত একটি সংস্করণ। পরের বছর, ১৯৩৩য়ের ১৯ সেপ্টেম্বর, বাংলায় ৩রা আশ্বিন, ১৩৪০, মহালয়ার সকালে প্রচারিত হয় বসন্তেশ্বরী। ১৯৩৪ এবং ১৯৩৫য়েও অপরিবর্তিত ছিল এই অনুষ্ঠানের সম্প্রচারের সময়। ১৯৩৬য়ে নতুনভাবে সাজানো হয় গীতি-আলেখ্যটি। রচনায় ছিলেন বাণীকুমার, গ্রন্থনা ও স্তোত্রপাঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, কয়েকটি গানে সুর দেন হরিশচন্দ্র বালী ও রাইচাঁদ বড়াল এবং সামগ্রিক সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। যন্ত্রসঙ্গীতের দায়িত্বে ছিলেন সুরেন্দ্রকুমার দাস। রেডিওয় অনুষ্ঠানটি বিজ্ঞাপিত হয় ৪ঠা কার্তিক, ১৩৪৩ বঙ্গাব্দ, ২১শে অক্টোবর, ১৯৩৬, বুধবার, ষষ্ঠীর সকালের 'বিশেষ প্রভাতী অধিবেশন' হিসেবে এবং সেই প্রথম অনুষ্ঠানটি ঘোষণা করা হয় 'মহিষাসুরমর্দিনী' নামে। সেই সময় কলকাতা রেডিওয় সকালে সম্প্রচার আরম্ভ হতো সাড়ে আটটায়। মহিষাসুরমর্দিনীর নির্ধারিত সময় প্রাথমিকভাবে সকাল ৬টা থেকে এক ঘন্টা রাখা হলেও এটি সম্প্রচারিত হয় দেড় ঘন্টা ধরে। এই গীতবীথি শ্রোতাদেরকে এতটাই মুগ্ধ করে দেয় যে পরের বছর থেকে বাণীকুমার এই অনুষ্ঠানের সূচনা নির্দিষ্ট করে দেন মহালয়ার ভোর ৪টেতে, যে সময় মেনে চলা হচ্ছে আজও। এমনকি ভোরের পরিবেশের সাথে মিলিয়ে সুরেও পরিবর্তন আনেন পঙ্কজকুমার। 

মহিষাসুরমর্দিনীর এই অসম্ভব জনপ্রিয়তাকে মাথায় রেখেই পরবর্তী দশকগুলিতে সরাসরি সম্প্রচারিত হতে থাকে এই গীতবীথি। ১৯৫৭ অবধি ১ নং গার্স্টিন প্লেস থেকে এবং ১৯৫৮ ও তারপরে ইডেন গার্ডেন্সের ধারে আকাশবাণী ভবন থেকে। মূল অনুষ্ঠানের আগের দেড়-দু'মাস যাবৎ চলতো রিহার্সাল। অংশ নিতেন তৎকালীন বাংলা সঙ্গীতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পীরা। মহিষাসুরমর্দিনী রচনায় বাণীকুমারকে এবং স্তোত্র ও সংস্কৃতপাঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে সহায়তা করেছিলেন অধ্যাপক অশোকনাথ শাস্ত্রী বেদান্ততীর্থ মহাশয়। শুরুতে স্থির হয়েছিল যে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের গ্রন্থনাপাঠের মাঝের ব্যবধান পূরণ করা হবে যন্ত্রসঙ্গীতের মাধ্যমে। কিন্তু যন্ত্রীরা অনেকেই ছিলেন উর্দুভাষী মুসলমান। তারা বাংলা গদ্য ও সংস্কৃত শ্লোকের পার্থক্য ধরতে না পেরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কথার সুরেই বাজিয়ে যেতে থাকেন। এই বিষয়টি শ্রী ভদ্রের কথার সুরের সাথে এমন সুন্দর মিলে যায় যে বাঙালী যন্ত্রীরাও সেই সুরই অনুসরণ করেন। ফলে গদ্য, স্তোত্রপাঠ, গান, যন্ত্রসঙ্গীত সব মিলে এমন আবহ সৃষ্টি হয় যে মহিষাসুরমর্দিনী হয়ে ওঠে কালজয়ী। যদিও সমালোচনা পিছু ছাড়েনি। গোঁড়া হিন্দুসমাজ প্রতিবাদ করে কায়স্থ বীরেন্দ্রকৃষ্ণের চণ্ডীপাঠের অধিকার নিয়ে কিন্তু আপত্তি ধোপে টেকেনি। বাণীকুমার বলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ব্রাহ্মণের চেয়েও বড় ব্রাহ্মণ!

অনুষ্ঠানটি সম্পর্কে ভীষণ খুঁতখুঁতে ছিলেন বাণীকুমার, পঙ্কজ মল্লিক ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, তিনজনেই। সম্প্রচারের দিন রাত তিনটেরও আগে বেতারকেন্দ্রে পৌঁছতেন বাণীকুমার; স্নান সেরে গরদের কাপড় পরে অনুষ্ঠান শুরু করতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্বর্ণযুগে তাকে বাদ দিয়ে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে 'জাগো দুর্গা' গাইয়েছিলেন পঙ্কজকুমার কারণ রিহার্সাল না করে বোম্বে থেকে এসে সরাসরি অনুষ্ঠান করা না-পসন্দ ছিল তাঁর। কলকাতার কুখ্যাত দাঙ্গার বছর ১৯৪৬কে বাদ দিলে ১৯৬২ অবধি অবিচ্ছেদ্য ভাবে লাইভ ব্রডকাস্ট হয়েছে মহিষাসুরমর্দিনীর; দাঙ্গা পরবর্তী মহালয়ায় চালানো হয় রেকর্ডিং। ১৯৬২র শেষের দিকে ভারত-চীন সংঘর্ষের সময় ঘাটতি হয় সরকারী অর্থবরাদ্দে, তাই ১৯৬৩,'৬৪ ও '৬৫তে বাজানো হয় রেকর্ডেড সংস্করণ। সেই সময় ভারতের ৩৫টি বেতারকেন্দ্র থেকে একযোগে বাজানো হত এই গীতি-আলেখ্য। রেকর্ডিংয়ের যুগে বাণীকুমার বা পঙ্কজ মল্লিক না আসলেও নিয়ম করে মহালয়ার দিন সম্প্রচারের আগে আসতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ, যাঁর নাম বাঙালী মানসে মহিষাসুরমর্দিনীর সাথে সমার্থক হয়ে গিয়েছে।

১৯৬২র পর '৭৫য়ে জরুরী অবস্থা জারির আগে অবধি অনুষ্ঠানটির নতুন রেকর্ডিং হয়েছে বার চারেক। কিন্তু গোল বাধলো ১৯৭৬য়ে। দিল্লী থেকে নির্দেশ এল মহিষাসুরমর্দিনী বাতিল করে নতুন অনুষ্ঠান প্রচারের জন্য। অতএব, ধ্যানেশ নারায়ণ চক্রবর্তী রচনা করলেন 'দেবিং দুর্গতিহারিণীম', গান লিখলেন শ্যামল গুপ্ত। সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কলকাতার বিখ্যাত শিল্পীরা ছাড়াও তিনি গাওয়ালেন লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলেকে দিয়ে। বাংলায় গদ্যপাঠের জন্য প্রস্তাব গেল উত্তমকুমারের কাছে। শুরুতে নিমরাজী হলেও বসন্ত চৌধুরীর সাথে গ্রন্থনা করলেন মহানায়ক! মহালয়ার দিন সম্প্রচারের জন্য রেকর্ডিংও হয়ে গেল কিন্তু সম্পূর্ণ উদ্যোগে একটিবারের জন্যও করা হয়নি রিহার্সাল। কলকাতা বেতারকেন্দ্রের উচ্চপদস্থ কর্তারা এর পরিণতি কতটা ভেবেছিলেন তা বলা কঠিন কিন্তু মারাত্মকভাবে প্রত্যাখ্যাত হল এই পরিকল্পনা। অনুষ্ঠানটিকে সফল করতে ঘুরপথেও চেষ্টা করেছিলেন বেতারকর্তারা। ১৯৭৬য়ের ২৩শে সেপ্টেম্বর, মহালয়ার সকালে, সাড়ে পাঁচটায় সম্প্রচার শেষ হওয়ার আগেই একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক ছেপে ফেললো ভূয়সী প্রশংসা! কিন্তু আসল প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে দেবিং দুর্গতিহারিণীম শেষ হওয়ার আধঘন্টা পর থেকে। টেলিফোনে গালাগালি, আকাশবাণী ভবনের সামনে ক্ষুব্ধ জনতার ভিড়, পরবর্তী দিনগুলিতে হতাশাব্যঞ্জক চিঠিপত্রের স্তূপ, বাদ যায়নি কিছুই। সেই সময় উত্তমকুমার কলকাতার বাইরে থাকলেও পরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রতিক্রিয়া দেন তিনি, বলেন "ঠাকুরঘরকে রেনোভেট করে ড্রইংরুম বানালে যা হয়, তা-ই হয়েছে"।

ফলত, দিল্লী আর ঝুঁকি নেয়নি, দশ মাস বাদে রবীন্দ্র সদনে কলকাতা বেতারের সুবর্ণজয়ন্তীর মঞ্চ থেকেই ঐ ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আডবাণী। সেই বছরেরই পুজো থেকে আবার স্বমহিমায় ফেরে মহিষাসুরমর্দিনী। ততদিনে বাণীকুমার প্রয়াত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছেড়ে দিয়েছেন স্টুডিওয় আসা। কয়েক মাস বাদে '৭৮য়ের ফেব্রুয়ারিতে মারা যান পঙ্কজকুমার মল্লিকও। 

কিন্তু কেন এই প্রতিক্রিয়া? কেনই বা আজ ৮৮ বছর পেরিয়েও এত জনপ্রিয় কিংবদন্তির পর্যায়ে চলে যাওয়া এই অনুষ্ঠান? উত্তরটা বোধহয় লুকিয়ে আছে আমাদেরই মননে। মহিষাসুরমর্দিনী আমাদের সংস্কৃতির এমন একটা অঙ্গ যা সম্পৃক্ত হয়ে গেছে আমাদের বেড়ে ওঠার সাথে। মহিষাসুরমর্দিনী আমাদের কয়েক প্রজন্ম একসাথে বসে কোনোকিছু উপভোগ করার সাক্ষী থেকেছে বছরের পর বছর। কোনো এক জাদুকাঠির ছোঁয়ায় আমাদের পুজো আরম্ভ হয় ঠিক সেই সকালটাতেই যখন আকাশ বাতাস গমগমিয়ে, ফজরের আজানের সাথে মিশে আমাদের কানে আসে সেই বিখ্যাত ব্যারিটোন...

আশ্বিনের শারদপ্রাতে
বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর
ধরণীর বহিরাকাশে
অন্তর্হিত মেঘমালা
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত
জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমনবার্তা...

আর তো মাত্র কয়েক ঘন্টার অপেক্ষা, এলার্মটা দিয়ে রেখেছেন তো?
______________________________

পুনশ্চ: প্রতিবছর কলকাতা 'ক'য়ে জলদগম্ভীর যে কণ্ঠে আপনি মহিষাসুরমর্দিনীর ঘোষণাটি শোনেন, সেই কণ্ঠটি হল দিলীপ ঘোষের এবং সেটিও রেকর্ডেড। আকাশবাণীর আর্কাইভে থাকা মহিষাসুরমর্দিনীর বেশ কয়েকটি রেকর্ডিংয়ের মধ্যেই প্রতি বছর বাজানো হয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। আকাশবাণীর সঙ্গে যুক্ত আমার এক বন্ধু দু'দিন আগেই জানালো যে আগামীকাল সকালে আমরা যেটা শুনবো সেটা খুব সম্ভবত ১৯৬৬ এর রেকর্ডিং!
_______________________________

তথ্যসূত্র:
১) আকাশবাণীর প্রাক্তন কর্মী শ্রী মিহির বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণা, রবিবাসরীয় সংবাদ প্রতিদিন, ২০০৯

২) Indian Broadcasting in the Regional Context: A survey of the history of Radio Broadcasting Station at Calcutta, a thesis hosted at shodhganga.inflibnet.ac.in

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ছবি: The Wire

'মহিষাসুরমর্দিনী’ ~ কেয়া মুখোপাধ্যায়

১৯২৭ সাল। ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি নামে বোম্বের এক বেসরকারি সংস্থা ডালহৌসির ১নং গার্স্টিন প্লেসের একটি ভাড়া বাড়িতে চালু করল রেডিয়ো স্টেশন। অধিকর্তা স্টেপলটন সাহেব। ভারতীয় অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন ক্ল্যারিনেট বাদক নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ মজুমদার আর প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ রাইচাঁদ বড়াল। সে সময়ে হাতে-গোনা কিছু অভিজাত পরিবারেরই শুধু শোভা পেত রেডিয়ো। 

১৯৩০-এর ১লা এপ্রিল সরকারী পরিচালনাধীনে এর নতুন নামকরণ হল 'ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস'। পরে ১৯৩৬-এ এই রেডিয়ো স্টেশনের নাম হয় 'অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো', আরও পরে, ১৯৫৭ সালে 'আকাশবাণী।'

১৯২৮ সালে রাইটার স্টাফ আর্টিস্ট হয়ে রেডিয়ো স্টেশনে চাকরি নিলেন বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরাজি অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস আর সংস্কৃতে 'কাব্যসরস্বতী' উপাধি পাওয়া বৈদ্যনাথ রেডিয়োতে যোগ দিয়ে নতুন নাম নিলেন 'বাণীকুমার'। বহুমুখী সৃজনশীল প্রতিভা তাঁর। 

ওই সময়েই রেডিয়ো থেকে একটা নিজস্ব মুখপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ও চলচ্চিত্রকার প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ওরফে 'বুড়োদা' এলেন সে মুখপত্র সম্পাদনার জন্যে। ১৯২৯-এর সেপ্টেম্বর মাসে আত্মপ্রকাশ করল রেডিয়োর নিজস্ব পত্রিকা 'বেতার জগৎ'।

রেডিয়োর অনুষ্ঠানকে আরোও সৃজনশীল, আরোও জনগ্রাহী করার জন্য প্রায়ই আলাপ-আলোচনা হত। সেরকমই এক আলোচনায় একবার বুড়োদা মত প্রকাশ করলেন, যা যা অনুষ্ঠান চলছে, তার পাশাপাশি কিছু অভিনবত্ব আনাও দরকার। বললেন:
"এই তো বাণী রয়েছে- সংস্কৃতের তো আদ্যশ্রাদ্ধ করেছে। ও-ই কতকগুলো বৈদিক শ্লোক জোগাড় করে ফেলুক, আর গান লিখুক, রাই (রাইচাঁদ বড়াল) সুর দিক, বীরেন শ্লোক আওড়াক। ভোরবেলায় লাগিয়ে দাও, লোকের লাগবে ভালো৷"

কথাটা বেশ মনে ধরল নৃপেন মজুমদারের৷ বাণীকুমারও ভাবতে লাগলেন৷ এসব যখন কথা হচ্ছে, তখন দুর্গাপুজোর আর একমাস দেরি৷ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র প্রস্তাব দিলেন, যদি পুজোকে কেন্দ্র করেই কিছু করা হয় তাতে চণ্ডীপাঠ অবশ্যই থাকবে৷ সকলেই সমর্থন জানালেন৷ কিন্তু একটু দ্বিধার ছোঁয়াও ছিল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তো কায়স্থ৷ তিনি চণ্ডীপাঠ করলে, শ্রোতারা সকলে মেনে নেবেন তো? নৃপেনবাবু বললেন:
"প্রোগ্রাম করবে, তার আবার বামুন কায়েত কী হে? আমরা কি হিন্দুর মন্দিরে গিয়ে পুজো করছি? এই প্রোগ্রামে যারা বাজাবে তারা তো অর্ধেক মুসলমান- খুশী মহম্মদ, আলী, মুন্সী সবাই তো বাজাবে। তাহলে তো তাদের বাদ দিয়ে ব্রাহ্মণদের ডেকে আনতে হয়৷ তা ছাড়া আমরা একটা বিরাট উত্সবের আগে ভূমিকা হিসেবে এই প্রোগ্রাম করব। এতে কার কী বলার আছে?..."
বাণীকুমার তখন হেসে উঠে বলেছিলেন, যাই হোক না কেন, বীরেনবাবু ছাড়া আর কাউকে তিনি এ কাজের জন্যে ভাবতেই পারেন না৷

এই অনুষ্ঠানের পরিকল্পনার আগে, ১৯৩২ সালের মার্চ মাসে অর্থাৎ ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের চৈত্রমাসে 'বসন্তেশ্বরী' নামে একটি গীতিআলেখ্য সম্প্রচার করে কলকাতা বেতার৷ বসন্তেশ্বরী আলেখ্য দিয়ে সূচনার পর, সে বছরই ষষ্ঠীর দিন ভোরে বাণীকুমারের লেখা আর একটি গীতি-আলেখ্য সম্প্রচারিত হল। বিষয়- মহিষাসুর বধ। তখন নাম দেওয়া হয়েছিল 'শারদীয় বন্দনা'। 'শারদীয় বন্দনা'-র ভাষ্যকে পরিমার্জনা করেই সৃষ্টি হল কালজয়ী সঙ্গীতালেখ্য, 'মহিষাসুরমর্দিনী'।

বাণীকুমার লিখছেন:
"...বন্ধুবর সঙ্গীতপণ্ডিত হরিশচন্দ্র বালীর সুর-সর্জনে রাগ বসন্ত এবং দেশী, দেবগিরি, বরাটী, তোড়ী, ললিতা ও হিন্দোলী- এই ছয় রাগিনী বাণী সংযোগে এক অপূর্ব রসের সঞ্চার হয়৷ অন্যান্য গানের সুর দেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, কয়েকটি নাট্য- কথাসূত্র ও গীতাংশ গ্রহণ করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এবং আমি শ্রীশ্রীচণ্ডীর কতিপয় শ্লোক আবৃত্তি করি৷ বন্ধুবর রাইচাঁদ বড়ালের সঙ্গীত-পরিচালনায় ও আমার প্রবর্তনায় অনুষ্ঠানটি রসোত্তীর্ণ হয়৷ এই অনুষ্ঠানটিই 'মহিষাসুরমর্দিনী' পরিকল্পনার উত্স৷ 

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কলমেও 'মহিষাসুরমর্দিনী'র সেই প্রথম  প্রস্তুতিপর্বের বর্ণনা বড় আকর্ষক:
''পঙ্কজ সুর তুলে ও সুরারোপ করে তখনকার শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের কণ্ঠে গান তোলাতে লাগলেন। রাইচাঁদও এক বিরাট অর্কেস্ট্রা পরিচালনার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। সেকালের সবচেয়ে বড় বাজিয়েরা গানের সঙ্গে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলেন।''
১৯৩৪-এর ৮ই অক্টোবর প্রথমবার মহালয়ার ভোরে সম্প্রচারিত হল অনুষ্ঠানটি।
যেটুকু জানা যায়, প্রথম প্রচারের পর 'শারদীয় বন্দনা' খুবই ভালো লেগেছিল শ্রোতাদের। 
প্রথমদিকে কয়েক বছর পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে যৌথভাবে অনুষ্ঠানটির সঙ্গীত পরিচালনা করেন রাইচাঁদ বড়াল৷ অধিকাংশ গানের সুরই পঙ্কজ কুমার মল্লিকের। পণ্ডিত হরিশ্চন্দ্র বালী সুর দিয়েছিলেন 'অখিল বিমানে তব জয়গানে' আর 'বিমানে বিমানে আলোকের গানে' গান দু'টিতে। 'শান্তি দিলে ভরি দুখরজনী গেল তিমির হরি'-র সুর উস্তাদ সাগিরুদ্দিন খাঁ-র।  'নিখিল আজি সকল ভোলে' গানে সুর দিয়েছিলেন রাইচাঁদ বড়ালের। তবে এই গানটি পরে বাদ যায়৷

প্রতিভাবান যন্ত্রশিল্পীদের এক চমৎকার সমাবেশ ঘটেছিল 'মহিষাসুরমর্দিনী'-তে৷ আদিযুগে বাজাতেন মুন্সী (সারেঙ্গি), আলী (চেলো), খুশী মহম্মদ (হারমোনিয়াম), অবনী মুখোপাধ্যায় ও তারকনাথ দে (বেহালা), সুরেন পাল (ম্যান্ডোলিন), সুজিত নাথ (গিটার), দক্ষিণামোহন ঠাকুর (এসরাজ), শান্তি ঘোষ (ডবল বাস্), রাইচাঁদ বড়াল (পিয়ানো ও অর্গ্যান) ইত্যাদি আরও কয়েকজন৷ পরে বংশীবাদক গৌর গোস্বামী, হিমাংশু বিশ্বাস, শৈলেন দাস, অনিল দাস ও আরো অনেক যন্ত্রশিল্পীদের সমন্বয় ঘটল সেই অনুষ্ঠানে। এক সময় সঙ্গীত-আয়োজনের মূল কাজ শুরু হয় সুরেন্দ্রলাল দাসের পরিচালিত 'যন্ত্রীসঙ্ঘ'-র মাধ্যমে৷ পরবর্তীকালে, এই কাজের মূল দায়িত্ব দীর্ঘদিন সামলেছেন ভি. বালসারা৷

'মহিষাসুরমর্দিনী'-র প্রাণ তিনজন মানুষ - এই আশ্চর্য সৃজনের তিনটি স্তম্ভ। রচনা ও প্রবর্তনা- বাণীকুমার। সঙ্গীত-সর্জন- পঙ্কজ কুমার মল্লিক। গ্রন্থনা ও স্তোত্রপাঠ- বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।  

ছোটবেলায় শরতের ঝকঝকে নীল আকাশটা দেখলেই মনের মধ্যেও একদল মেঘ খুশিতে আমাদেরই মতো হুটোপাটি করে উঠত। তখনই একদিন ভোরবেলা বেজে উঠত এক অপার্থিব আলোর বেণু। মন্দ্রকন্ঠ বীরেন্দ্রকৃষ্ণের উচ্চারণে যেন কৈলাস থেকে আশ্চর্য নীলকন্ঠ পাখিটি উড়ে আসত শারদপ্রাতে। আসতেন মা দুগগা।

আজ যখন শরতের পাল্টে যাওয়া রোদ্দুরের রং জানান দেয় মহিষাসুরমর্দিনী আসছেন, এক অজানা মনখারাপ ছেয়ে ফেলে। অবাক হয়ে আবিষ্কার করি, চার পাশে প্রিয় মানুষ যত আছে, তার চেয়ে বড় কম নয়, যারা আর আমার ধরাছোঁয়ার মধ্যে নেই। আজ শরতে আমার মহালয়া মানেই এক রকমের মনখারাপের অতীতে ফেরা।

শরৎ এলে হারিয়ে যাওয়া সবাই নাকি ফিরে আসে। শরতের রোদ্দুর হয়ে, শরতের আলোর রথে চড়ে। এই ফিরে আসাটাই বোধহয় মহালয়া। এ মহালয়ায় কোনও আনুষ্ঠানিকতা থাকে না। গঙ্গা আর পুরুতমশাই থাকে না। শুধু শরতের আকাশ-বাতাসে ভেসে থাকা অদৃশ্য অতীতের ছোট ছোট কণাই অমোঘ মন্ত্র হয়ে ওঠে। তাতে মিশে থাকে কিছু সুর, কিছু ছন্দ, উচ্চারণ, অনুভব। 
বড় অনিবার্যভাবে থাকেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।  বাণীকুমার। পঙ্কজ কুমার মল্লিক।

ঋণ:  
'মহিষাসুরমর্দিনী': বাণীকুমার

বুধবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০

মুসলিম বিজ্ঞানী: মিথ না বাস্তব? ~ হাসানুজ্জামান গাজী

আত্মবিশ্লেষন ছাড়া কোনো জনগোষ্ঠী/ জাতি র অগ্ৰগমন অসম্ভব।

                     ১)আমরা যখন আইনস্টাইনের কথা বলি, তখন সবসময়ই বলি, আইনস্টাইন একজন জার্মান বিজ্ঞানী, বা পরবর্তী সময়ে আমেরিকান। বা ধরুন নিউটন/ডারউইন একজন বৃটিশ বিজ্ঞানী, নীটশে/মার্ক্স জার্মান দার্শনিক, রবীন্দ্রনাথ বাঙালি সাহিত্যিক-শেক্সপিয়র ইংরেজ সাহিত্যিক। আমি কখনও কাউকে দাবী করতে শুনিনি, আইনস্টাইন একজন ইহুদী বিজ্ঞানী, নিউটন-ডারউইন খ্রিষ্টান বিজ্ঞানী, শেক্সপিয়র খ্রিষ্টান সাহিত্যিক ছিলেন। কারণ এই সকল বিখ্যাত মানুষেরা আসলে ক্ষুদ্র ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন। কিন্তু একটি বিশেষ ধরণের হিপোক্রেসী মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভেতরে প্রায়শই দেখা যায়। যেটা হচ্ছে, তারা কোন বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাহিত্যিকের নাম বলার সময় আরব দার্শনিক বা পারশ্যের বিজ্ঞানী না বলে তাদেরকে 'মুসলিম' দার্শনিক বা বিজ্ঞানী বানিয়ে ফেলেন! তাদের ধর্ম পরিচয়টা কিভাবে যেন শুধু মুসলিমদের ক্ষেত্রেই গুরুত্বপুর্ণ হয়ে ওঠে! পৃথিবীর সকল কিছু ভাগাভাগির পরে জ্ঞান বিজ্ঞানকেও উনারা ভাগ করতে চান ধর্মের ভিত্তিতে। তাহলে কী, আপেক্ষিক তত্ত্ব একটি ইহুদী বিজ্ঞান? অভিকর্ষ তত্ত্ব একটি খ্রিস্টান বিজ্ঞান? শুণ্যের আবিষ্কার কী হিন্দু বিজ্ঞান? এরকম কেউ সাধারণত দাবী করে না। শুধুমাত্র কোন মুসলমান বিজ্ঞানী কিছু আবিষ্কার করলেই, মুসলিম বিশ্ব কিংবা মুসলমানদের জ্ঞানবিজ্ঞান ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার শুরু হয়। কেন এমনটা হয়?

মুসলিম বস্তুতপক্ষেই একটি হীনমন্য সম্প্রদায়। সত্যিকার অর্থে শিক্ষাদীক্ষা জ্ঞানবিজ্ঞানের পরোয়া না করা জ্ঞান বিজ্ঞানে বিপুল জনসংখ্যার এই সম্প্রদায়টির ভুমিকা অত্যন্ত অল্প। দিনরাত হুরগেলমান আর বেহেশত নামক অশ্লীল বেশ্যাপল্লী আর সুড়িখানার স্বপ্নে বিভোর, যৌনসুড়সুড়িমার্কা কামনা বাসনায় দিনে পাঁচবার মাথা মাটিতে ঠোকা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বর্তমান অবস্থা তারা নিজেরাও জানেন। এই হীনমন্যতাই তাদের তাড়িত করে নীল আর্মস্ট্রং থেকে শুরু করে নানান তারকাকে টানাহেচড়া করে মুসলিম বানাবার,২)বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ইসলামে বিজ্ঞান ধরণের হাস্যকর সব নিউজ ছাপাবার, যেখানে দেখা যায় বিভিন্ন বিজ্ঞানী ইসলাম গ্রহণ করে নুরের পথে আসছেন! নাসায় কোরান নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, কোরানে বিজ্ঞান খুঁজে পেয়ে বিজ্ঞানীরা তা নিজেদের নামে চালিয়ে দিচ্ছে এবং মাথামোটা উটপাখি মুমিনগন সেগুলো পড়ে মাশাল্লাহ ছোভানাল্লাহও বলে। এই এরাই একটা শব্দ বারবার ব্যবহার করেন। সেটা হচ্ছে মুসলিম বিজ্ঞানী, মুসলিম দার্শনিক, মুসলিম সাহিত্যিক!!! যেখানে অন্য কোন ধর্মগোষ্ঠী কখনই দর্শন বিজ্ঞানে গুরুত্বপুর্ণ অবদান রাখার জন্য তাদের নামের আগায় তাদের ধর্মের নাম জুড়ে দেন না। কেমন হতো, যদি বলা হতো হিন্দু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর??? সেটা না বলে বলা হচ্ছে বিশ্বকবি। যেখানে খুব সচেতনভাবেই মধ্যযুগের মধ্যপ্রাচ্যের কোন দার্শনিক বিজ্ঞানীর নাম বললেই তার আগে মুমিনগণ মুসলিম শব্দটা জুড়ে দেবেই!

পৃথিবীর ইহুদী ধর্মাবলম্বী বিজ্ঞানী (ইহুদী বিজ্ঞানী শব্দটা যদিও আপত্তিকর, তুলনীয় বলেই ব্যবহার করলাম, যদিও সেই সকল বিজ্ঞানীদের বেশিরভাগই নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদী ছিলেন) এই পর্যন্ত নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন সর্বমোট সেটা ৩০০ এর কাছাকাছি। সেই ইহুদী জনসংখ্যার একশগুন বেশি মুসলিম পৃথিবীতে রয়েছে, সেখানে মুসলিমদের নোবেল পাবার হার দেখলে একেবারেই হাসি পায়। দশটির বেশি নয়। তার মধ্যে নাগীব মাহফুজ ধর্ম সম্পর্কে সমালোচনামূলক প্রশ্ন তোলায় আক্রান্ত হয়েছিলেন ইসলামী মৌলবাদীদের দ্বারা। প্রফেসর আবদুস সালামকে তো পাকিস্তানে মুসলমান হিসেবেই গণ্য করা হয় না। হাস্যকর ব্যাপার!!!

হীনমন্যতাবোধ মানুষকে অতীতমুখী করে। তাদের কোন এক পূর্বপুরুষ কোন এক কালে ঘি খেয়েছিল, হাতে সেই গন্ধ শুঁকে তারা এক ধরণের সুখ পেতে চেষ্টা করে। মুসলিম সম্প্রদায়ও সেই কাজটাই করে। বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী বাংলাদেশ বা ভারতবর্ষের দার্শনিক, বিজ্ঞানীরা কি করেছেন, তার চাইতে বেশি মাতোয়ারা হন আরবের 'মুসলিম' কোন বিজ্ঞানী মধ্যযুগে কী কী করেছেন তা নিয়ে। যেখানে এই ভারতবর্ষে শুন্যের আবিষ্কারের মত বিশাল ব্যাপার ঘটেছিল, গৌতম বুদ্ধ সেই আমলে আধুনিক বস্তুবাদ, সংশয়বাদের মুল কথাগুলো বলে গিয়েছিলেন, সেগুলো সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। কেনই বা থাকবে? তারা স্বদেশে প্রবাসী জীবন যাপন করেন, দেশের সবুজ ছায়ায় বসে মরু আরব ইরানের স্বপ্নে বিভোর হন। এই দেশ তাদের কাছে মুখ্য নয়, তারা এই দেশকে আপন ভাবেন না। তারা আগে মুসলমান, পরে বাঙালী!!! তারা মনের সুখে গান গেয়ে ওঠেন, "মনে বড় আশা ছেল যামু মদিনায়৩)জ্ঞান বিজ্ঞান দর্শন সাহিত্য প্রভৃতি কোন বিশেষ জাতিগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মালিকানাধীন নয়। একই সাথে, ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থ কখনই জ্ঞানবিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিল না। মধ্যপ্রাচ্যে একটা সময় চমৎকার জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছিল। তারা গ্রীক এবং ভারতীয় দর্শন সহ নানান দর্শন গ্রহণ করে, তা চর্চার মাধ্যমে উৎকর্ষের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময়ের খলিফাদের চোখে ধীরে ধীরে তারা পরিণত হন কাফের নাস্তিক মুরতাদে। তারা সেই সকল জ্ঞানীদের ক্রমশ হত্যা করে আরেক অন্ধকার যুগের সুচনা করেন, যেটা এখন পর্যন্ত চলছে। যদিও বর্তমান সময়ে সেই সকল কাফের নাস্তিক মুরতাদ জ্ঞানীদের ছাড়া ইসলামিস্টদের গর্ব করার মত আর কিছুই অবশিষ্ট নাই। সেই সময়ের প্রচলিত ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধাচরণ করা কাফেররা হয়ে উঠেছেন আধুনিক ইসলামিস্টের ইসলামের স্বর্ণযুগের এবং খিলাফতের স্বপ্নদোষ।

আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল-কিন্দি  (৮০১ – ৮৭৩) ছিলেন অত্যন্ত প্রখ্যাত একজন আরব পণ্ডিত। পাশ্চাত্য বিশ্বে তিনি "আলকিন্ডাস" (Alkindus) নামে বহুল পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, বিজ্ঞানী, জ্যোতিষী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত্ববিদ, রসায়নবিদ, যুক্তিবিদ, গণিতজ্ঞ, সঙ্গীতজ্ঞ, পদার্থবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী এবং আবহবিজ্ঞানী। মুসলিম পেরিপ্যাটেটিক দার্শনিকদের মধ্যে তিনিই প্রথম। তাই তাকে মুসলিম পেরিপ্যাটেটিক দর্শনের জনক বলা যায়। তার অনেক অর্জনের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল গ্রিক এবং হেলেনীয় দর্শনকে আরব জগতে পরিচিত করে তোলা। এছাড়া বিজ্ঞানের অনেকগুলো শাখায় তিনি অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন।

আল-কিন্দিই প্রথম ভারতীয় সংখ্যা পদ্ধতিকে মুসলিম ও খ্রিস্টান বিশ্বে পরিচিত করে তোলেন। ক্রিপ্টোলজি ও ক্রিপ্ট্যানালাইসিসে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল, গুপ্ত সংকেতের মর্ম উদ্ধারের জন্য কয়েকটি নতুন গাণিতিক পদ্ধতিও আবিষ্কার করেছিলেন যা আধুনিক কম্পিউটার কোডিং এর অন্যতম ভিত্তি। গণিত ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের জ্ঞানকে ব্যবহার করে ডাক্তারদের জন্য একটি স্কেল নির্ধারণ করেছিলেন। এই স্কেল দিয়ে ডাক্তাররা তাদের প্রস্তাবিত ঔষুধের কার্যকারিতা পরিমাপ করতে পারতো। এছাড়া তিনিই প্রথম সঙ্গীত থেরাপি পরীক্ষা করে দেখেছিলেন। এরকম অসংখ্য বিষজয়ের জন্য তিনি সমত বিশ্বেরই অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভা বলে গণ্য হতে পারেন। অথচ দার্শনিক আল কিন্দিকে ধর্মদ্রোহীতার অভিযোগে শাস্তি দেয়া হয়। তাঁকে পেটানো হয় প্রচলিত ধারণার সাথে দ্বিমত পোষণের জন্য, উগ্র ধর্মবাদীদের চক্ষুশূল হওয়ার জন্য। এমনকি, তাঁকে একঘরেও করে ফেলা হয়।

আল কিন্দি দ্বারা প্রভাবিত এবং তার অনেক শিষ্য এরপরে সরাসরি ইসলামের পয়গম্বরদের সরাসরি প্রতারক এবং ভণ্ড বলে অভিহিত করে বই লেখেন। এর ফলাফল হিসেবে প্রচুর সংখ্যক মুক্তচিন্তার মানুষকে সেই সময়ে জেলে যেতে হয়, অনেককেই মৃত্যুবরণ করতে হয়।৪)ইবনে বাজা (আনু. ১০৯৫ – ১১৩৮) (ল্যাটিনকৃত আভেমপেস বলেও পরিচিত) ওরফে আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহিয়া ইবনে আস সাইগ আত তুজিবি ইবনে বাজা আল তুজিবি ছিলেন মধ্যযুগের আল আন্দালুসের একজন পলিমেথ। তিনি একাধারে ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, সঙ্গীতজ্ঞ, যুক্তিবাদী, দার্শনিক, চিকিৎসাবিজ্ঞানী, উদ্ভিদবিজ্ঞানী এবং কাব্য বিশারদ।

তার গবেষনা ইসলামের কোরান হাদিসের পরিপন্থী আখ্যায়িত করে তাকে ধর্মবিরোধী, ইসলাম বিরোধী এহেন নানা অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। বেশ কয়েকবার কারাবরণ করার পরে  ১১৩৮ সালে তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় ঠিক গ্রীসের সক্রেটিসের মত। স্বাধীন বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী মতবাদ এবং মুক্তচিন্তা প্রকাশের অপরাধে, প্রচলিত মতবাদের বিরুদ্ধে কথা বলার অপরাধে। তিনি তার লেখায় বলেছিলেন, "খাঁটি দর্শনের সঙ্গে ইসলামের সামঞ্জস্য হতে পারে না"।

পরবর্তীতে তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন অসংখ্য দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীকে। ইবনে রুশদকে কাফের এবং নাস্তিক খেতাব দেয়া হয়, নির্যাতন করা হয় নির্মমভাবে। ইবনে সিনা থেকে শুরু করে আল আল-রাজী সকলের বিরুদ্ধেই নানা ধরণের অভিযোগ ওঠে। ইবনে সিনা পরিষ্কারভাবেই বলেন,

The world is divided into men who have wit and no religion and men who have religion and no wit.

পৃথিবীতে দুরকম মানুষ আছে : একজনের ধর্ম নেই কিন্তু জ্ঞানবুদ্ধি আছে এবং দ্বিতীয়জনের জ্ঞানবুদ্ধি নেই কিন্তু ধর্ম আছে। 

ইবন রুশদ বলেছেন :
This is one of the most intricate problems of religion. For if you look into the traditional arguments (Hadith) about this problem you will find them contradictory; such also being the case with arguments of reason. The contradiction in the arguments of the first kind is found in the Qur'an and the Hadith.

আল রাজী সে সময়ে রচনা করেন কয়েকটি বই, যেগুলো হচ্ছেঃ
১) The Prophets' Fraudulent Tricks – 'নবীর ভন্ড চাতুরি'
২) The Stratagems of Those Who Claim to Be Prophets – 'নবীর দাবিওয়ালাদের ছল চাতুরি
৩) On the Refutation of Revealed Religions 'প্রত্যাদিস্ট ধর্মসমূহ খন্ডন প্রসঙ্গে'৫)সূত্রঃ

Sarah Stroumsa (1999). Freethinkers of Medieval Islam: Ibn Al-Rawandi, Abu Bakr Al-Razi and Their Impact on Islamic Thought. Brill.
Kraus, P; Pines, S (1913–1938). "Al-Razi". Encyclopedia of Islam. p. 1136.
মুসলিম বিজ্ঞানী
দার্শনিক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিকদের সে সময় এই মুসলিম ধর্মান্ধরাই হত্যা করেছিল, নির্যাতন করেছিল। প্রায় প্রতিটি জ্ঞানী মানুষ নির্যাতিত হয়েছেন কট্টর মুসলিম ধর্মান্ধদের দ্বারা। ওমর খৈয়াম, আল্লামা ইকবাল, কাজী নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধেও ধর্মদ্রোহীতার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু এখন এসে তারাই আবার সেই সকল কথিত কাফেরদের কৃতিত্বের ভাগ বসাতে ছুটে আসেন। কি হাস্যকর এদের হিপোক্রেসী।

শুধু মুসলিমদের ভেতরে নয়, পরবর্তীতে সময়ে ইউরোপেও অন্ধকার যুগের সুচনা হয়। চার্চ ক্রমশ জ্ঞানবিজ্ঞান নিয়ন্ত্রন করতে শুরু করে। কোনকিছুকে বিজ্ঞান হিসেবে প্রচারের জন্য চার্চ এবং বাইবেলে কি লেখা আছে তার সাথে মিলিয়ে নেয়া শুরু হয়, যার ফলশ্রুতিতে ব্রুনো, গ্যালিলিও, কোপারনিকাসদের নির্যাতিত হতে হয়। ধর্মান্ধতা এবং মৌলবাদ এভাবেই ধ্বংস করেছে বারবার আমাদের অগ্রযাত্রা, আমাদের প্রগতি। সূচনা করেছে অন্ধকার যুগের।

মুসলিম বিজ্ঞানী
এই হিপোক্রেসীর অবসান যতদিন না হবে, ততদিন মুসলিমদের অতীতের স্বর্ণযুগের স্বপ্নেই বিভোর থাকতে হবে, নতুবা বেহেশতের হুর গেলমানদের কথা ভেবেই উত্তেজিত হতে হবে। সময় হয়েছে সত্যের মুখোমুখি হবার, উটপাখির মত মাটিতে মুখ গুজে যদি তারা ভাবে, কেউ তাদের দেখছে না, তাতে সমস্যার সমাধান হয় না। বিজ্ঞানের ঠেকা নাই কোরানে বাইবেলে গীতায় কি লেখা আছে তা দেখার। বিজ্ঞান নিজের পথেই চলবে, যুক্তি নিজের পথেই চলবে। কোরান বাইবেলেরই নানা সময়ে অনুবাদ পালটে, আয়াত পালটে, শব্দার্থ পালটে, আগেরটা পরে পরেরটা আগে করে বিজ্ঞানের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করতে হবে, নিজেদের লজ্জা ঢাকতে হবে। নতুবা আধুনিক বিশ্ব তাদের নিয়ে হাসাহাসিই করে যাবে

বেহাল অর্থনীতি ও সুশান্ত সিং রাজপুত ~ শতদ্রু দাস

আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা ফিচ আজ ঘোষণা করেছে যে তাদের অনুমান হলো ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ভারতের জাতীয় উৎপাদন ১০.৫% হ্রাস পাবে। অর্থাৎ প্রথম ত্রৈমাসিকের ২৪% হ্রাসই শেষ নয়, বাকি বছরটাও অর্থনীতি সংকুচিতই হবে। ফিচ ঢিল ছোঁড়া অনুমান করে না, তাদের অনুমানের ওপর ভিত্তি করে হাজার হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। গোল্ডম্যান স্যাক্স আরো এক ধাপ এগিয়ে বলেছে সংকোচন হবে ১৪.৫%। কিন্তু অর্থনীতির এই ১০.৫% হ্রাস হওয়ার অর্থ কী? এর অর্থ হলো যে ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষের শেষে জাতীয় উৎপাদন যা ছিল ২০২০-২১-এর শেষে জাতীয় উৎপাদন তার চেয়েও কিছুটা কম হবে। আর ১৪.৫% হ্রাস হলে পিছিয়ে যেতে হবে ২১৬-১৭-তে। আগামী দু বছরও অর্থনীতির যদি গড়ে ৬% করে বৃদ্ধি হয় তাহলে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের শেষে জাতীয় উৎপাদন হবে মোটে করোনা পূর্ববর্তী বছরের উৎপাদনের সমান। কিন্তু এটুকু বললে সমস্যাটা সম্পূর্ণ বোঝা যায় না।

ভারতে গড়ে প্রতি বছর ৫০ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়।  কর্মসংস্থান মানে কিন্তু শুধু চাকরি নয়, কৃষিকাজ, ব্যবসা, ঠিকে শ্রমিক - সব ধরে। ৫০ লক্ষ কর্মসংস্থান যথেষ্ট নয় কারণ প্রতি বছর ৫৫ লক্ষেরও বেশি যুবক যুবতী কর্মক্ষেত্রে যোগ দেওয়ার জন্য কাজের খোঁজ করে। এবার হিসেব করে ভেবে দেখুন যে ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০ এই দু বছরে এরকম ৫০*২ = ১ কোটি নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে অর্থনীতিতে। এই ১ কোটি নতুন কর্মী এই দু বছরে জাতীয় উৎপাদনকে বাড়াতে কাজে এসেছে। কিন্তু জাতীয় উৎপাদন যদি ২০১৭-১৮-এর অবস্থায় ফিরে যায় তাহলে তো এই ১ কোটি শ্রমিকের কোনো কাজ থাকবে না অর্থনীতিতে? বসে বসে তো আর কেউ মাইনে পায় না তাই উৎপাদনে  অবদান না করতে পারার জন্য এই  ১ কোটি কাজ কমে যাবে। তা ছাড়া ২০২০-২১-এ যে আরো ৫০ লক্ষ কর্মসংস্থান হওয়ার ছিল সেটাও হবে না। অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবর্ষের শেষে দেশে মোট কর্মসংস্থান কমবে ১.৫ কোটি। করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে দেশের বেকারত্বের হার ছিল আনুমানিক ১১%। আনুমানিক বললাম কারণ মোদি সরকার গত চার বছরে মাত্র একবার কর্মসংস্থানের সমীক্ষা করেছে, ২০১৮ সালে (আগে এই সমীক্ষা প্রতি বছর হতো), তাতে ওই হার ছিল। এর উপরে বাড়তি ১.৫ কোটি কর্মসংস্থান কমলে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়াবে গিয়ে ১৪-১৫% তে। 

যদি ভেবে থাকেন যে এই বেকারত্ব সাময়িক, দু বছর পর অর্থনীতি আবার যখন করোনা পূর্ব উৎপাদনে ফিরে যাবে তখন বেকারত্বও কমে যাবে, তাহলে ভুল ভাবছেন। যদি ধরেওনি যে আগামী দু বছর অর্থনীতি গড়ে ৬% করে বাড়ল আর জাতীয় উৎপাদন করোনার আগের অবস্থায়, অর্থাৎ ২০১৯-২০ এর জাতীয় উৎপাদনে ফিরে গেল, তখনও কিন্তু ২১-২৩ এই দু বছরে যে ১ কোটি আরো কর্মসংস্থান তৈরি হওয়ার কথা ছিল সেটা হবে না, মোট কর্মসংস্থান ২০১৯-২০-এর লেভেলে থাকবে। তাই এই বেড়ে যাওয়া বেকারত্ব কমে ফের ১১-১২% তে নামতে আরো ৫-৬ বছর লাগবে অন্তত। তাও সেটুকুও হতে গেলে  অর্থনীতিকে ভালো হারে বৃদ্ধি পেতে হবে আগামী বছর থেকে।

আমি জানি না যে একজন সাধারণ মানুষের কাছে এই পরিস্থিতিতে কী ভাবে সুশান্ত সিংহ, রীয়া চক্রবর্তী, কঙ্গনা রানাওয়াত, গাঁজা, চরস ইত্যাদি এত গুরুত্ব পায়। স্বল্প শিক্ষিত মানুষ নয়, শিক্ষিত মানুষজনও এসবকে বড্ড বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে আমার মনে হয়েছে। এতে তো সরকারেরই সবচেয়ে বেশি সুবিধে। গ্ল্যাডিয়েটার ছবিটির কথা মনে পড়ে। মার্কাস অরেলিয়াসকে খুন করে তার অযোগ্য পুত্র কমোডাস যখন রোমের সিংহাসনে বসে এবং রোমের বিদ্বজনেরা যখন তাকে দেশের মানুষের সমস্যার কথা শোনায়, মানুষের জন্য তাকে ভাবতে বলে, তখন কমোডাস রোমের কলোসিয়ামে ১৫০ দিনের ক্রীড়া উৎসবের ঘোষণা করে সবাইকে চমকে দেয় । সে জানতো যে "Rome is a mob", কলোসিয়ামে গ্ল্যাডিয়েটারদের রক্তাক্ত সার্কাস মানুষকে ভুলিয়ে রাখবে আসল সমস্যার থেকে আর সেই সুযোগে কমোডাস ক্রমশ স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারবে। এই সুশান্ত সিংহকে নিয়ে যা চলছে দেশে তা  দু হাজার বছর আগেকার কলোসিয়ামের সেই ১৫০ দিন ব্যাপী সার্কাসের থেকে বোধয় আলাদা নয়।

রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

সিঙ্গাড়ার জন্ম ~ সুভাষ সাহা

ঠাণ্ডা লুচি বারংবার ফেরত পাঠানোয় রাজবাড়ির হালুইকর অনুমতি চেয়েছিলেন রাজসভায় মিষ্টান্ন পাঠাতে। রাজচিকিৎসকের পরামর্শে মধুমেহ রোগাক্রান্ত রাজা অগ্নিশর্মা হয়ে শূলে চড়ানোর হুকুম দিয়েছিলেন হালুইকরকে। অনেক অনুনয় বিনয় করে নিজের প্রাণ রক্ষা করেছেন হালুইকর। রাজা আদেশ দিয়েছেন - হালুইকরকে তিনরাত্রের মধ্যে দেশত্যাগ করতে। 

দ্বিতীয় রাত্রে হালুইকরের স্ত্রী ঠিক করেছে দেশত্যাগের আগে একবার দেখা করবে রাজার সাথে। সেইমতো তৃতীয়দিন সকাল বেলা রাজদরবারে এসে প্রণাম জানালো স্বয়ং রাজামশাইকে। রাজসভায় আসার কারণ জিজ্ঞেস করায়, রাজাকে জানায় - সে নাকি এমনভাবে লুচি তরকারি করতে পারে, যা রাজা আধঘন্টা বাদে খেলেও গরম পাবেন। এজাতীয় লুচি এবং তরকারি নাকি কিছুক্ষণ বাদে খাওয়াই দস্তুর। 

সন্দিহান রাজা কিঞ্চিৎ কৌতূহলী হয়ে হালুইকরের স্ত্রীকে পাঠালেন পাকশালে। জানিয়ে দিলেন যখন রাজসভা থেকে খবর যাবে তৎক্ষণাৎ পাকশাল থেকে খাবার পৌঁছনো চাই। হালুইকরের স্ত্রী মৃদু হেসে মহারাজকে জানিয়েছিলো - খাদ্যদ্রব্য রাজসভায় তৎক্ষণাৎই পৌঁছবে, কিন্তু অনুগ্রহ করে তিনি যেন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে খান - অন্যথায় মহামান্য রাজকীয় জিহ্বা পুড়ে যেতে পারে। বিস্মিত মহারাজের সামনে দিয়ে হাস্যমুখে হালুইকরের স্ত্রী চলে গেল পাকশালে। 

রাজ-পাচক আলুর তরকারি তৈরি করে পাকশালে দাঁড়িয়ে কাঁপছেন, হুকুম এলেই লুচি ভাজতে হবে। ময়দার তাল মাখা রয়েছে হাতের সামনে। হালুইকরের স্ত্রী পাচককে কটাক্ষ করে বসলো ময়দার তাল নিয়ে। লেচি কেটে লুচি বেলে, কাঁচা ময়দার ভেতর লুচির জন্য তৈরি সাধারণ তরকারি ভরে দিয়ে, সমভুজাকৃতি ত্রিভুজের গড়ন বানিয়ে আড়ষ্ঠ রাজ পাচকের সামনে নিজের আঁচল সামলে শুরু করলো চটুল গল্প।

রাজাজ্ঞা আসতেই তরকারির পুর ভর্তি দশটি ত্রিভুজাকৃতির লুচির ময়দা ফুটন্ত ঘি ভর্তি কড়ায় ফেলে দিয়ে, নিমেষের মধ্যে সোনালী রঙের ত্রিভুজগুলি তুলে নিয়ে স্বর্ণথালায় সাজিয়ে নিজেই চললো রাজসভায়। 

মহারাজ এরূপ অদ্ভুত দর্শন খাদ্যবস্তু দেখে স্তম্ভিত। হালুইকরের স্ত্রী অত্যন্ত বিনীতভাবে জানালো - খাদ্যদ্রব্যটির নাম সমভুজা। মহারাজ যেন সম্পূর্ণ বস্তুটি মুখে না ঢুকিয়ে একটি কামড় দিয়ে দেখেন - ঠাণ্ডা না গরম এবং অনুগ্রহ করে স্বাদটি জানান। 

মহারাজ স্বাদ জানাননি। তিনি তিনছড়া মুক্তো মালা খুলে হালুইকরের স্ত্রীয়ের হাতে দিয়েছিলেন। রাজবাড়ির হালুইকরের দণ্ডাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছিলেন। প্রায় ছ'মাস পর হেসে উঠেছিলেন মহারাজ, শান্তি পেয়েছিলো তামাম প্রজাকুল। 

মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। ১৭৬৬ সালে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার রাজ-হালুইকর, কলিঙ্গ তথা বর্তমান ওড়িষ্যা থেকে আগত গুণীনাথ হালুইকরের ষষ্ঠপুত্র গিরীধারী হালুইকরের স্ত্রী ধরিত্রী দেবী আবিষ্কার করেছিলেন সিঙ্গাড়া। 

শাক্ত সাধক, পরবর্তিকালে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি রামপ্রসাদ, স্বয়ং সন্ধ্যাহ্নিক সেরে প্রতিসন্ধ্যায় বসতেন একথালা সিঙ্গাড়া নিয়ে। 

দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায়, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দরবার থেকে বাইশটি সুসজ্জিত হস্তী ভেট নিয়ে গিয়েছিলো উমিচাঁদের কাছে - বাইশটি স্বর্ণথালা ভর্তি বাইশশোটি সিঙ্গাড়া। 

ভারতীয় খাদ্য হিসেবে সিঙ্গাড়ার সাথে রবার্ট ক্লাইভের প্রথম সাক্ষাৎ হয়, এই মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রেরই সৌজন্যে।

সিঙ্গাড়ার জন্য ইতিহাস স্বীকৃতি দিয়েছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে। নাম ভুলে গেছে তাঁর প্রধান হালুইকরের স্ত্রী ধরিত্রী বেহারার। 

ইংরিজিতে বলে, কমন সেন্স মেকস্ আ ম্যান আনকমন। ধরিত্রীদেবী সাধারণ বুদ্ধি খাটিয়ে আবিষ্কার করেছিলেন এই অসাধারণ খাদ্যদ্রব্যটির, যেটি সেই ১৭৬৬ সাল থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলা তথা সারা ভারতে। 

ঐতিহাসিকদের মতে, এর বহু আগে, নবম শতাব্দীতে পারস্যের অধিবাসীরা যব এবং ময়দার তালের সঙ্গে গাজর কড়াইশুঁটি রসুন ও মাংস মেখে সেঁকে খেতো, যাকে বর্তমান সিঙ্গাড়ার জনক হিসাবে ধরা হলেও, সুদূর পারস্য থেকে ভারতবর্ষে এসেও তাঁরা ময়দার তালে মাংসের কুঁচি ঢুকিয়ে সেঁকেই খেতেন। এরও বহুপরে তাঁরা ভারতবর্ষের উত্তরপূর্ব উপকূলে বিভিন্ন মশলা সহযোগে তৈরি আলুর তরকারি, ময়দার ভেতর ঢুকিয়ে ঘিয়ে ভাজার পদ্ধতিতে চমৎকৃত হ'ন। 

ডায়বেটিক পেশেন্টদের ঘন ঘন খিদে পায়। চিকিৎসাবিজ্ঞান উন্নত হয়েছে। ডাক্তাররা বলছেন, অনেকক্ষণ অন্তর একসাথে প্রচুর পরিমানে না খেয়ে, ক্যালোরি মেপে কিছুক্ষণ অন্তর অল্পসল্প খাবার খেতে। কিন্তু সেযুগে ডাক্তারবাবুদের হৃদয় ছিলো বিশাল। মধুমেহ রোগীরা তখন তেল ঘি মশলা, ভাজা খেলেও তাঁরা রাগ করতেন না। নিশ্চিতভাবেই আজকের যুগে ডাক্তার বাবুরা আঁতকে উঠবেন যদি দেখেন কোনো ডায়াবেটিক পেশেন্ট প্রতিঘন্টায় সিঙ্গাড়া ওড়াচ্ছেন, তবু, আঁটকানো যায়নি সিঙ্গাড়াকে। 

শহুরে অভিজাত পরিবারের বৈঠকখানায় মোটা গদির সোফায় বসা অতিথির থালাই হোক বা প্রত্যন্ত গ্রামের জরাজীর্ণ চায়ের দোকানের সামনে নড়বড়ে বাঁশের বেঞ্চে রাখা তেলচিটে কালো ভাঙ্গা বেতের চুবড়ি - বিকেল সাড়ে চারটেই হোক বা সকাল পৌনে দশটা, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রধান হালুইকরের স্ত্রীর উদ্ভাবনটি সর্বত্র সর্বদা সর্বগামী। 

যা রাজসভায় রাজ-সম্মুখে পরিবেশিত হয়, তার কৌলীন্য প্রশ্নাতীত হবে - এই তো স্বাভাবিক। 

ভাষাবিদদের মতে, সমভুজা--> সম্ভোজা--> সাম্ভোসা--> সামোসা।
মতান্তরে, সমভুজা--> সম্ভোজা--> সিভুসা--> সিঁঙুরা(নদীয়ার কথ্যভাষার প্রভাবে)--> সিঙ্গাড়া।

*লেখাটি সংগৃহিত লেখকের নাম জানতে পারলে খুব উপকৃত হব🙏🏼

শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০

বিকল্প নেই ~ সুশোভন পাত্র

অল্টারনেটিভ নেই। বিকল্প নেই। 

কেতাদুরস্ত স্টুডিও থেকে অর্ণব গোস্বামীরা ডিনারে বলে দিচ্ছে – বিকল্প নেই। সংবাদ মাধ্যমের সিক্সটি পয়েন্ট হেডিং ব্রেকফাস্টে মনে করিয়ে দিচ্ছে  – বিকল্প নেই। প্যান্ডেমিকে মুড়ি মুড়কির মত মানুষ মরছে অথচ আপনি জানছেন – বিকল্প নেই। কোটি কোটি মানুষ কাজ হারাচ্ছেন অথচ আপনি শুনছেন – বিকল্প নেই। পরিযায়ী শ্রমিক ট্রেনে কাটা পড়ছে অথচ আপনি ভাবছেন – বিকল্প নেই। জিডিপি -২৩.৯%'র গোত্তা খাচ্ছে অথচ নাকি বিকল্প নেই। 'তোরা ৭%, তোরা লোকসভায় শূন্য', অতএব বিকল্প নেই। 'তোদের সোভিয়েত ভেঙ্গে গেছে', অতএব বিকল্প নেই। চন্দ্রবিন্দু বলেছে, 'স্তালিন ছিল ধূর্ত/৬টা ডামি নিয়ে ঘুরতো' অতএব স্তালিনে বিকল্প নেই। 

স্তালিন যদি ধূর্ত, ধোয়া তুলসী পাতাটা কে? হিটলার? মুসোলিনি? ফ্রাঙ্কো? না পিনোচে? 

উত্তর খোঁজার প্রয়োজনই নেই! নেই কারণ আপনি বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন, বিকল্প নেই। মাইন কাম্ফে হিটলার লিখছেন "কমিউনিস্টদের উৎখাত করা ছাড়া জার্মানির উন্নতির বিকল্প নেই।" ফ্যাসিস্ট পার্টির মুখপত্র, Il Popolo d'Italia-র সাক্ষাৎকারে মুসোলিনি বলছেন "কমিউনিস্টদের মাথা ভেঙ্গে সরকার আর কর্পোরেটদের হাত মেলানো ছাড়া ইতালির কাছে বিকল্প নেই।" মিলিটারি ক্যুয়ের পর ফ্রাঙ্কো বলছেন, "আমি থাকতে স্পেনে কমিউনিস্টদের জায়গা নেই। আর আমি ছাড়া স্পেনের কোন বিকল্প নেই।" ভিক্টর জারার আঙুল থেঁতলে দিয়ে পিনোচে বলছেন "কমিউনিজমের চিতা সাজানো ছাড়া চিলির কোন বিকল্প নেই।"   

সময় বদলেছে, কমিউনিজমের ভূত দেখানো বন্ধ হয়নি। "বিকল্প নেই" বলা থামেনি। 

১৯৮৬, রোনাল্ড রেগানের '9 Most Terrifying Words', অর্থাৎ "রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ ছাড়া বিকল্প নেই।" ১৯৮৯, মার্গারেট থ্যাচারের TINA (There is no alternative), অর্থাৎ "ক্যাপিটালিজমের কোন বিকল্প নেই।" কিংবা, ১৯৯১, নরসিমা সরকারের অক্সফোর্ড ফেরত অর্থমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বললেন, "অর্থনৈতিক সাম্য ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, দেশের বাজার কে বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করে, উদারীকরণ ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।" 

মনমোহন সিং-র হাত ধরে এদেশে যেদিন বেসরকারিকরণ-বিলগ্নিকরণের বল্গাহীন তুরঙ্গে নিও-লিবারেলিজমের অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটানো শুরু হয়েছিল, তেন্ডুলকার তখনও ODI-এ প্রথম সেঞ্চুরি করেননি, আদবানি তখনও 'মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে-র' চ্যাংড়ামি শুরু করেননি, নেপোটিজেমের বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালতে আলিয়া তখনও ভাট পরিবারে জন্মগ্রহণ করেননি, ইয়াসির আরাফাত তখনও স্বাধীন প্যালেস্টাইনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কনসেপ্টটাই তখনও প্যায়দা হয়নি। 

আজ সেই নিও-লিবারেল অর্থনীতির প্রায় ৩০ বছর পর কি পেয়েছেন আপনি? কেমন আছেন আপনি? 

২০২০-র অক্সফ্যামের রিপোর্ট বলছে, ভারতের ধনীতম ১% মানুষের মোট সম্পত্তি দরিদ্রতম ৭০%-এর মোট সম্পদের ৪ গুণের বেশি। স্বাধীনতার পর ৫৩ বছরে যে দেশে মোট বিলিওনেয়ারের সংখ্যা ছিল ৯, শেষ কুড়ি বছরে সেই দেশেই বিলিওনেয়ারের সংখ্যাটা ১৩৮। যে ১৩৮ জন বিলিওনেয়ারের মোট সম্পদ ২০১৮-১৯'র কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষিত বাজেটের থেকে বেশি। আর অন্যদিকে প্রতিবছর ৬.৩ কোটি মানুষ নতুন করে তলিয়ে যাচ্ছেন দারিদ্র্যের অতলস্পর্শী অন্ধকারে। প্রতি সেকেন্ডে দুজন। 

বিজ্ঞাপনে বলে, पहले इस्तेमाल करें फिर विश्वास करे। তাই অক্সফ্যাম ছাড়ুন, সরকারী তথ্য দেখুন। ৪৫ বছরের সর্বোচ্চ বেকারত্ব কিম্বা পেট্রোল-ডিজেলের ঐতিহাসিক মূল্য বৃদ্ধি -আমাদের গণ্ডারের চামড়ায় এসব গা-সওয়া। তাই অপরিকল্পিত লকডাউনে প্রধানমন্ত্রীর মুখে যত্ন করে রাখা ব্যান্ডলজ দাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অর্ধাহারে-অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা, প্রায় ৫০০। কাজ হারিয়েছেন ২০ কোটি মানুষ। অর্থনীতির ল্যান্ডস্কেপে ছড়িয়ে থাকা এই বিন্দুগুলো জুড়েই ভয়ঙ্কর নকশাটা এঁকেছে ২০২০-র প্রথম কোয়ার্টার। জিডিপির ২৩.৯% সংকোচন। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এসবই নাকি 'Act of God' – ভগবানের ইচ্ছে। আর ভগবানকে দোষ দেবে কার বাপের সাধ্যি? অতএব, ব্যাক টু জিরো, Act of God তাই কোন বিকল্প নেই। 

ধনী আরও ধনী হবে আর গরীব আরও গরীব – বিকল্প নেই। ঋণের দায়ে কৃষক গলায় দড়ি দেবে – বিকল্প নেই। শ্রমিক ন্যূনতম মজুরি না পেয়ে অনাহারে মরবে – বিকল্প নেই। শিক্ষা-স্বাস্থ্য হাটে-বাজারে বিক্রি হবে – বিকল্প নেই। ধর্মের নামে মানুষ লেলিয়ে দেশ বেচা হবে – বিকল্প নেই। মামুলি ধনে পাতার ৫০০ টাকা/কেজি দর উঠবে – বিকল্প নেই। যে কোয়ার্টারে দেশের জিডিপি ২৩.৯% সংকুচিত হবে, সেই কোয়ার্টারেই মুকেশ আম্বানির সম্পত্তি ৩৫% বাড়বে – বিকল্প নেই। প্যান্ডেমিকে প্রধানমন্ত্রী ময়ূরের সাথে ফটো শুট করবেন কারণ, সিম্পল, – বিকল্প নেই। আপনি প্লিজ বিশ্বাস করুন, নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প নেই। বাজার অর্থনীতির বিকল্প নেই। ক্যাপিটালিজমের বিকল্প নেই। 

কারণ আপনি এগুলো বিশ্বাস না করলে ক্যাপিটালিজমের দালালদের বিপদ। ফ্যাসিজিমের পোস্টার-বয়দের বিপদ। বিকল্প যে আছে এটা আপনি বুঝতে পারলে, বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করলে, বিকল্পের দাবী তে লড়াই করলে বিপদ। কারণ হিটলার-থ্যাচার কিম্বা মোদী সবাই জানে বিকল্প তো আছে। বহাল তবিয়তেই আছে। আপনার চারপাশেই আছে।

বেসরকারিকরণ আর বিলগ্নিকরণের বিপক্ষে দেশেই ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, রেলের জাতীয়করণ কিম্বা নবরত্নের সাফল্যের বিকল্প আছে। ফ্যাসিস্টদের ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণের প্রবণতার বিপ্রতীপে রাজ্যেই ত্রি-স্তরীয় পঞ্চায়েতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প আছে। অর্থনীতির উন্নতির নামে কর্পোরেট ট্যাক্স ছাড় দেওয়ার বদলে MNREGA-য় দেশের প্রান্তিক মানুষদের জীবন-জীবিকার সমস্যার নিরসনের বিকল্প আছে। কৃষক আত্মহত্যার অন্য পিঠে অপারেশন বর্গার বিকল্প আছে। মন্দির-মসজিদ-স্ট্যাচু না বানিয়ে শিক্ষা খাতে সরকারী বরাদ্দ বাড়ানোর বিকল্প আছে। করোনা মোকাবিলায় উন্নত সরকারী স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার বিকল্প আছে। ক্যাপিটালিজমের আঁতুড়ঘর আমেরিকাতেই ডাইরেক্ট ক্যাশ ট্রান্সফারের মাধ্যমে প্যান্ডেমিকের বাজারে চাহিদা তৈরির বিকল্প আছে। ধনীতম ১০% ব্যক্তির সম্পদে মাত্র ২% সম্পদ কর বসিয়ে গরীবের মুশকিল আসানের বিকল্প আছে। 

আর বিকল্প যদি নাই থাকে, তাহলে ক্যাপিটালিজমের দালালদের "বিকল্প নেই" প্রমাণ করতে প্রতিদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হচ্ছে কেন? ফ্যাসিজিমের পোস্টার-বয়দের ১০০ বছর ধরে 'কমিউনিজম মৃত'- ঘোষণা করতে হচ্ছে কেন? ক্যাপিটালিজমই যদি সর্বশ্রেষ্ঠ তাহলে প্যান্ডেমিকে ক্যাপিটালিস্ট দেশগুলোরই প্যান্টালুন হলুদ হয়ে যাচ্ছে কেন? 

নরেন্দ্র মোদী তো শুনেছি দিনকে রাত করতে পারেন। মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির বানাতে পারেন। ৩৭%-র জনমত আছে, লোকসভাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা, রাজ্যসভাতে দাপট আছে, জুডিসিয়ারি ম্যানেজ আছে, ফেসবুকে আঁতাত আছে, বেডরুমে আড়ি পাতা স্বভাব আছে, পা-চাটা মিডিয়া আছে। কই এত কিছু নিয়েও তো অর্থনীতির বিশল্যকরণী খুঁজে দেবার মুরোদ নেই তো। ধর্মের বুলি কপচে সব পেটে ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই তো। মুক্ত বাজারে হিন্দু-মুসলমানের ক্যালোরির আলাদা হিসাব করার মুরোদ নেই তো। মুনাফাতে ব্রাহ্মণ-দলিতের 'উদ্বৃত্ত শ্রমের' বাছাই করার মুরোদ নেই তো। 

মুরোদ নেই, আর মুরোদ হবেও না। কারণ বাস্তব এটাই যে শ্রমের শোষণেই পৃথিবী জোড়া সম্পদের এই প্রবল বৈষম্য। বাস্তব এটাই যে ক্যাপিটালিজমে নয়; দাড়ি বুড়োর 'দাস ক্যাপিটাল'-এই বন্দী আছে অর্থনীতির সাম্য।

বুধবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২০

ভারতের অর্থনীতি ~ শতদ্রু দাস

ভারতের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে, এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে জাতীয় আয় কমেছে ২৪%। অর্থাৎ গত বছর ওই তিন মাসে ভারতীয়দের যা গড় আয় ছিল এই বছর তার থেকে ২৪%, বা প্রায় এক চতুর্থাংশ কম। কাজ হারিয়েছেন কয়েক কোটি মানুষ। এরকমটা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে আগে কখনো হয়নি। অনেকেই বলবেন যে এতে সরকারকে দোষ দেওয়া যায় না, নির্মলা সিতারামন যেমন বলেছেন যে এসব "দৈবের দোষ।" কিন্তু করোনা মহামারী আর তার জন্যে অর্থনৈতিক লকডাউন তো শুধু এদেশে হয়নি, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, ক্যানাডা, ব্রাজিল - সর্বত্রই হয়েছে। কিন্তু আর কোনো দেশের অর্থনীতির এইরকম পতন হয়নি। হ্যাঁ, করোনার জেরে হওয়া  অর্থনৈতিক পতনে ভারত প্রথম স্থান অধিকার করেছে। 

কিছু বিজেপি আইটি সেলের কর্মী সকালবেলা এদিক ওদিক লোককে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল যে আমেরিকার অর্থনীতির পতন হয়েছে ৩২%, ভারতের থেকেও বেশি কিন্তু সেসব ঢপবাজি ধরা পড়ে গেছে। চলুন আমেরিকার কথাই ধরি কারণ এখনও অবধি করোনা সংক্রমণে সব থেকে বেশি মানুষ মরেছে ওই দেশে। কতটা পতন হয়েছে ওদের অর্থনীতি? ওই তিন মাস, মানে এপ্রিল-জুনে ওদের জাতীয় আয় সংকুচিত হয়েছে গত বছরের তুলনায় ৯.২%। তাহলে যে বলছিলো ৩২%? ওটা বার্ষিক হিসেব, অর্থাৎ বাকি বছরও যদি এই হারে অর্থনীতি সংকুচিত হয় তাহলে সংখ্যাটা ৩২% তে দাঁড়াবে। ওই একই বার্ষিক হিসেব যদি ভারতের ক্ষেত্রে লাগাই তাহলে ভারতের অর্থনীতি সংকোচনের হারটা  গিয়ে দাঁড়াবে ৬৭% তে। ৬৭%! আর কোনো দেশই এত বড় অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন নয়, শুধু ব্রিটেন কিছুটা কাছাকাছি। এমন কেন হলো? কেন ভারতের চেয়ে  ১০-১২ গুন বেশি মাথাপিছু  মৃত্যু হার হওয়া সত্বেও ইউরোপ আমেরিকার অর্থনীতি এত গভীর সংকটে পড়লো না? 

কারণ হলো এই সমস্ত দেশগুলোর সরকার যাতে সাধারণ মানুষ লকডাউনে কাজ না হারায়, আর কাজ হারালেও যাতে রোজগার না হারায় তার জন্য দরাজ হাতে খরচ করেছে। ওই সমস্ত দেশে শুধু বড় ব্যবসায়ীই নয়, ছোট ছোট ব্যবসায়ী আর দোকানদারদের সরকার ক্যাশ টাকা দিয়েছে যাতে তারা কর্মচারী ছাঁটাই না করে। ও দেশের সরকার লক্ষাধিক  ক্যাশ টাকা দিয়েছে উচ্চবিত্ত বাদে সমস্ত  মানুষের একাউন্টে। এর ফলে চাহিদায় কোনো খামতি হয়নি, লকডাউন শিথিল হতেই মানুষ দোকান বাজার থেকে  সামগ্ৰী কিনেছে হাত খুলে। আমাদের দেশে মে মাস থেকে লকডাউন শিথিল হলেও কোটি কোটি রোজগার হারানো বা রোজগার কমে যাওয়া মানুষের পক্ষে খাদ্য বাদ দিয়ে আর কিছু কেনা সম্ভব হয়নি। আমাদের দেশে সরকার যে অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার ৮৫% হলো বড় ব্যবসায়ীদের জন্য, কাজ হারানো মানুষের জুটেছে শুধু মাসে বিনামূল্যে ৫ কিলো চাল, ব্যাস। তাই আমাদের অর্থনীতি মে জুন মাসেও খুঁড়িয়েছে। চাহিদা নেই বলে এখনো বহু দোকান বন্ধ পড়ে রয়েছে শহরগুলোতে। চাহিদা নেই বলে অধিকাংশ কারখানা একটা শিফটে উৎপাদন করছে। এতটা জনবিরোধী নীতি বোধয় আর কোনো দেশের সরকার নেয়নি। ট্রাম্পের আমেরিকা, জনসনের ব্রিটেন বা বলসনারোর ব্রাজিলও অনেক বেশি দরদ দেখিয়েছে সে দেশের খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি। 

তবে কেউ যদি মনে করেন যে সংকটের এখানেই শেষ তাহলে খুব ভুল ভাবছেন। ব্যবসায়ীদের হাতে টাকা আর সস্তায় ঋণ দিয়ে কোনো লাভ হয় না যখন বাজারে তাদের উৎপাদিত পণ্যের কোনো চাহিদা না থাকে। আর তাই ভারতের কর্পোরেট সেক্টরের আয়ও কমবে ব্যাপক হারে। ব্যাংকের কাছে কর্পোরেটদের প্রচুর ঋণ, আয় না হলে সেই ঋণ শোধ দেবে কী ভাবে? আগস্টের শেষ অবধি ঋণের ওপর মরাটোরিয়াম বা স্থগিতাদেশ ছিল, অর্থাৎ শোধ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে কিন্তু ফের শোধ দিতে হবে ঋণ আর তখনই টের পাওয়া যাবে অনাদায়ী ঋণের বোঝা কতটা বাড়ল। জুলাই মাসে প্রকাশিত, আরবিআইয়ের ফাইন্যান্সিয়াল স্টেবিলিটি রিপোর্ট বলছে যে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বাড়তে পারে ৪০-৭০% অবধি। এর ফলে চরম আর্থিক সংকটে পড়বে ব্যাংকগুলো, ব্যাংকের একাউন্টে সাধারণ মানুষের আমানত সুরক্ষিত থাকবে কি না সেটাও বলা যাচ্ছে না। সরকার তার ওপর সুপ্রিম কোর্টে আজকে জানিয়েছে এই মরাটোরিয়াম দু বছর অবধি বাড়ানো যেতে পারে কিন্তু আরবিআই জানিয়ে দিয়েছে যে সেরকম চেষ্টা করলে ব্যাংকগুলোকে বাঁচানো অসম্ভব হয়ে যাবে। এই যে আশু ব্যাংক সংকট, এর থেকে কী ভাবে মুক্তি আসবে কেউ জানে না। সরকার ব্যাংক বেসরকারীকরণ করার কথা বলছে কিন্তু কে কিনতে চাইবে বিপুল অনাদায়ী লোনে জর্জরিত ব্যাংক? সংকট থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় বোধয় সরকারের কোষাগার খালি করে, ব্যাংকগুলোকে টাকা দেওয়া যাতে এই অনাদায়ী ঋণের জন্য হওয়া ক্ষতি ভরণ করা যায়। কিন্তু সরকারই বা কোথা থেকে পাবে টাকা? সরকার কি ধনীদের ওপর কর চাপাবে? সেটা যে এই সরকার করবে না তা ইতিমিধ্যে সবাই বুঝে গেছে, পুরো বোঝাটাই গরিব মানুষের কাঁধেই পড়বে। বেচে দেওয়া হবে এলাইসি, রেল, হ্যাল, সেলের মত সরকারী সংস্থাগুলোকে। যেহেতু কর্পোরেটদের কাছেও টাকার টান তাই বেচতে হবে জলের দরেই। ছাঁটাই হবে বহু সরকারী কর্মচারী, বন্ধ হবে নতুন নিয়োগ। আগামী তিন চার বছরে ব্যাপক হারে খরচ কমবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামোয়। 


রেলের আর সরকারের স্টাফ সিলেকশন কমিশনের পরীক্ষার ফল বেরোচ্ছে না বলে লক্ষ লক্ষ যুবক যুবতীর হা হাকার শুরু হয়েছে, সকলেই দেখেছেন, ১০ লক্ষ যুবক যুবতি ইউটিউবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় ডিসলাইক বোতাম টিপে এসেছে। আগামী এক দু বছরে এই চাকরির হাহাকার আরো ব্যাপক হবে। অন্য অর্থনীতিগুলো সংকট থেকে বেরিয়ে আসবে কিন্তু ভারতের সামনে পথ খুব সঙ্গীন।