রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৯

সত্যি কি বহু বাঙালি অনুপ্রবেশকারী? ~ বাঁচার লড়াই

সত্যি কি বহু বাঙালি অনুপ্রবেশকারী?? Census কি বলে??

যদি পশ্চিমবঙ্গে গত ৩-৪দশক ধরে কোটি কোটি লোকজন ঢুকে কার্ড পেয়ে বসবাস শুরু করে থাকেন তাহলে এই রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার  (population growth rate) সারা দেশের তুলনায় বেশি হত, তাই তো? হিন্দু বাঙাল অথবা মুসলমান কারুর না কারুর  জনসংখ্যা তো খুব বাড়বে? কারণ  তাহলে জন্ম-মৃত্যু বৃদ্ধি ছাড়াও immigrationর জন্যেও অনেকটা যোগ হবে। তাই না?? ...এইটা এমন একটা hypothesis যেটা সহজেই পরীক্ষা করা যায়.....😊... 
শীতের ছুটির দুপুরে এইটা একটু দেখাই যায়। census তথ্য তো হাতের কাছেই আছে.... 😊 গুগল থেকে বেরোল 1981, 1991, 2001 আর 2011র census। আর ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে রিপোর্ট।

পশ্চিম বঙ্গ জনসংখ্যা:
1981: 54580647.
1991: 68077965
2001: 80176197
2011: 91276115

বৃদ্ধির হার: 
(1981-91) : 24.7%;  (1991-2001) :17.8%;  (2001-2011) :13.8%. 
কি দেখছেন? হার বাড়ার কোন লক্ষণ নেই। দিব্বি কমছে। গত তিন দশক ধরে কমছে। 

আচ্ছা , বাঙালি হিন্দুরা? তাদের জনসংখ্যা  কেমন?
1981: 42005266
1991: 50866624
2001:58104835
2011: 64385546
বাঙালি হিন্দুর বৃদ্ধির হার কেমন?
(1981-91) 21.1%; 
(1991-2001) 14.2% ;  (2001-2011)  10.8 %. 
আবার দেখুন। কমছে। গত তিন দশক ধরে কমছে। কুড়ি বছরে 21 থেকে 10এ নেমেছে। 

মুসলমানগুলোর দেখি। জনসংখ্যা
1981: 11740297
1991: 16075836 
2001: 20240543
2011: 24654825 
বাঙালি মুসলমানের বৃদ্ধির হার?
(1981-91) 36.9%; 
(1991-2001)  25.9% ;  (2001-2011) 21.8 %. 
এও কমছে! 36 থেকে 21শে নেমেছে।

এবার এর পাশে সারা দেশের হিসেব ফেলুন। জাতীয় স্তরে হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার।
1981 (24.1%), 1991 (22.7%), 2001 (19.9%), 2011 (16.8%) 
মুসলমানের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার।
1981 (30.9%), 1991 (32.9%), 2001 (29.5%), 2011 (22.6%)

কি দাঁড়াল ব্যাপারটা? ওরা যতই বলুক, 

১. গত ৩০-৪০ বছরে ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিশ্চিতভাবে কমছে।  কোন সন্দেহ নেই।

২.   গত ৩০-৪০ বছরে পশ্চিমবঙ্গ'র  জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সর্বভারতীয় গড়ের থেকেও বেশি কমেছে।  জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে পশ্চিম বঙ্গ একদম one of the best. 

৩. বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলমান দুজনেই জাতীয় গড়ের থেকে কম । 1991 থেকে বাঙালি হিন্দুরা ব্যাপারটা কন্ট্রোল আনতে ভাল শুরু করেছেন, 2001 থেকে বাঙালি মুসলমানরা। আর এটা কিছুটা বোঝাও যায়। উত্তর ভারতের অনেক লোকের থেকে বাঙালি ঘরে কম ছেলেমেয়ে হয় কি না?না না কারনে বাঙালি এই বিষয়ে বেশি সচেতন, সে তো নিজেদেরকেই আমরা চিনি।

৪.  কোটি কোটি লোক বর্ডার পার করে এলে ফলাফল যে অন্য রকম হত বুঝতেই পারছেন।

৫. যাদের ঝগড়া লাগানো কাজ তারা বলতেই পারে যে বর্ডারের পাশের জেলাগুলো'র জনসংখ্যা ভাল করে দেখতে হবে।আচ্ছা, তাই হোক।  পরিসংখ্যান তো আছেই। প্রথমেই যেটা নজরে আসে সেটা হল এই জেলাগুলির কোন নির্দিষ্ট প্রবণতা নেই। কোন কোন জেলায় বৃদ্ধির হার পশ্চিমবঙ্গের গড় হারের থেকে বেশি ( যেমন উত্তর দিনাজপুর, মালদা ); কোন কোন জেলায় গড় হারের চেয়ে কম  ( যেমন নদীয়া, দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার ). আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, যে জেলায় হিন্দুদের বৃদ্ধির হার বেশি, সেখানে মুসলমানদের বৃদ্ধির হার ও বেশি; যেখানে হিন্দুরা কম সেখানেও মুসলমানরাও কম।  

৬. এই বৃদ্ধির হার কি ভাবে কমে যাচ্ছে সেটা পশ্চিমবঙ্গের গড় মহিলার total fertility rate (এক মহিলার জীবনে কটা ছেলেমেয়ে হয়) দেখলেও বোঝা যায়। গোটা দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম। এই ব্যাপারে কেরলা যে  আরেক দারুন সচেতন রাজ্য সবাই জানি। এই দেখুন । পাশাপাশি পঃবঃ, কেরলা আর উত্তর প্রদেশ দেখুন। 

হিন্দু TFR: wb (1.64), up (2.67), kerala (1.42), India (2.13)

মুসলমান: wb (2.08), up (3.10), kerala ( 1.86), India (2.61)। UP (আর বিহার , রাজস্থান...) উচিত বাঙালি আর মালায়লিদের  দেখে শেখা!! আমরা সব ব্যাপারেই মুসলমানদের দোষ দিই। কিন্তু দেখুন, বাঙালি মুসলমান মহিলার চেয়ে বেশি বাচ্ছা হয় UP হিন্দু মহিলার !!

৭. তাহলে ব্যাপারটা ধর্মভিত্তিক নয়। রাজ্য ভিত্তিক। পড়াশোনা, মহিলাদের শিক্ষা, রাজ্যের সার্বিক চিন্তাভাবনার পরিবেশের সঙ্গে চলে। সারা পৃথিবী জুড়ে who আর unicef  জানিয়েছে যে যত মহিলারা  শিক্ষিত হবেন, কাজকর্ম চাকরিবাকরি করবেন তত এক গাদা ছেলেমেয়ে হওয়া কমে যাবে। আর দেখুন, পঃবঃ আর কেরলা সেই প্রগতিশীল পথেই হেঁটেছে। আর বাঙালি মুসলমানরা যে এখনো পিছিয়ে আছে তার অন্যতম কারণ মহিলাদের মধ্যে অশিক্ষার হার এখনো বেশি । তবে শিক্ষা বাড়ছে। বাইরে বেরোচ্ছেন। পরিবারের দায়িত্ব নিচ্ছেন। censusএ তার ফল দেখাই যাচ্ছে। একই জিনিস পঃবঃ 'র জেলাগুলির জন্যেও প্রযোজ্য।  মালদা, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর গড় শিক্ষার হার কম; অন্য জেলায় বেশি।  আর এ বিষযে বেস্ট হল কলকাতা - শিক্ষার হার সর্বোচ্চ, হিন্দু এবং মুসলমান দুজনেরই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সবচেয়ে কম; কলকাতার  মুসলমানদের তো  হিন্দুদের থেকেও কম! 

৯. তার মানে কি এই যে কেউ আসেনি? নিশ্চয়ই এসেছেন। পেটের দায়ে এসেছেন । আত্মীয়স্বজন ডেকেছেন চলে এসেছেন। আর বাঙালি তো দুবার দেশভাগ-ভোগা জাত, এই কষ্ট আর কে বুঝবে?? কিন্তু, যাবতীয় সমীক্ষা পরিষ্কার দেখিয়ে দিচ্ছে যে এমন বিশাল সংখ্যায় কেউ আসেননি যে পশ্চিমবঙ্গের জনমানচিত্র আমূল পাল্টে যাবে। ওটা ভোটের জন্যে ঢপ! ওই 15 লাখ আর গরুর দুধে সোনার মত আরেকটা গাঁজা! তাই, বাঙাল-ঘটি-বামুন-লেড়ে -কায়েত-বদ্যি-নমশূদ্র সবাইকে অনুপ্রবেশকারী না বলে নিজেরা তো ভাল করে নিজের রাজ্যে বার্থকন্ট্রল করতে পারে !!

রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৯

ফ্যাসিবাদ এবং প্রফেসর শঙ্কু! ~ সংগ্রাম চ্যাটার্জী

এই শীতের মরসুমে যখন গোটা দেশ ক্রমাগত জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদের কালো ছায়ার মোকাবিলায় উত্তপ্ত হচ্ছে ক্রমাগত, ঠিক সেই সময়েই রিলিজ করল প্রফেসর শঙ্কু'র এল ডোরাডো! ফলে এই সময়েই এই লেখাটা পোস্ট করতে ইচ্ছে হল। মূল লেখাটা অনেক বড়, প্রকাশিত হয়েছিল এই বছরের শারদীয়া পর্বে। সেটাকেই কেটে ছেঁটে এইটে হল। এটাও কম বড় না! তাও পারলে পড়েই দেখেন...

১)
স্বর্ণপর্ণী ১

"মাই ডিয়ার শঙ্কু— তোমার মহৌষধ বিশ্বের হীনতম প্রাণীর উপকারে আসবে এটা আমি চাইনি, চাইনি, চাইনি।"
চেনা অংশ? না চিনতে পারলে বলেই দিই— এটা সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত শঙ্কু কাহিনী 'স্বর্ণপর্ণী' থেকে নেওয়া। গল্পটা কার্যত শেষ হচ্ছে এই কথাটার পরেই। 
গল্পটা যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের বিরক্তির উদ্রেক না করেই যাঁরা পড়েন নি এখনও— তাঁদের জন্যে একটু বলে দেওয়া ভালো—
প্রেক্ষাপটে ১৯৩৭ সালের নভেম্বর মাস, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর ঠিক কিছুটা আগে। ফ্যাসিস্ট হিটলারের নাৎসী বাহিনী তখন জার্মানির একচেটিয়া শাসক। জার্মানি জুড়ে শুরু হয়ে গিয়েছে ইহুদীদের চিহ্নিত করে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানানোর কাজটা! সেই সময়ে জীবনদায়ী ওষুধ 'মিরাকিউরল' আবিষ্কারের পর জার্মানি গিয়ে তা দিয়ে এক জার্মান ইহুদী অধ্যাপকের জীবন বাঁচান প্রফেসর শঙ্কু। খবরটা জানাজানি হতেই ব্ল্যাকশার্ট বাহিনীর মাধ্যমে খোদ গোয়রিং (নাৎসী বাহিনীর 'নাম্বার টু', হিটলারের পরেই যার স্থান!) তুলে নিয়ে যায় শঙ্কুকে। উদ্দেশ্য— নিজের চিকিৎসা, এবং ঐ মহৌষধ নাৎসী বাহিনীর কুক্ষিগত করা। সেই পরিস্থিতিতে কীভাবে ঐ ইহুদী পরিবারটিকে দেশত্যাগ করতে সাহায্য করে তাদের জীবন রক্ষা করলেন, কীভাবে নিজের জীবন বাঁচালেন এবং সর্বোপরি কীভাবে গোয়রিং এবং গোটা নাৎসি বাহিনীকে ঐ মহৌষধ 'মিরাকিউরল' দেওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেলেন প্রফেসর শঙ্কু— এই নিয়েই এই গপ্পো!
প্রথমে যে অংশটা কোট করেছি সেটা আরেকবার পড়ে দেখুন। ফ্যাসিস্টদের সম্পর্কে সত্যজিৎ লিখছেন— "বিশ্বের হীনতম প্রাণী"।

২)
ফেলুদা এবং প্রফেসর শঙ্কু

এটা ঠিকই যে বাঙালি পাঠকের কাছে তুলনায় সত্যজিতের ফেলুদা কাহিনী অনেক বেশিই জনপ্রিয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে প্রথম শঙ্কু কাহিনী 'ব্যোমযাত্রীর ডাইরি' প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬১ সালে, অর্থাৎ ফেলুদারও আগে। এর ঠিক পরে পরেই প্রকাশ পেয়েছিল ছোটদের জন্যে লেখা গল্প 'বঙ্কুবাবুর বন্ধু'। তার আরো প্রায় বছর চারেক পর আত্মপ্রকাশ ঘটে ফেলুদার।
ফেলুদার কাহিনীগুলোয় সরাসরি রাজনীতি প্রায় আসেনি বললেই চলে। যেটুকু এসেছে সে' একমাত্র 'টিনটোরেটোর যীশু'তে। কিন্তু সেটাও ঐ একইভাবে ফ্যাসিস্ট এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েই। তবে এখানে জার্মানি আর হিটলারের বদলে পটভূমিকায় ইতালি, অর্থাৎ মুসোলিনি।
যাঁরা ঐ উপন্যাসটা পড়েছেন, তাঁদের পক্ষে মনে করা সহজ যেখানে ঐ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র চন্দ্রশেখর সম্পর্কে বলতে গিয়ে ভগওয়ানগড়ের রাজা ভূদেব সিং বলছেন—
"মুসোলিনি তখন ইটালির একচ্ছত্র অধিপতি। বেশির ভাগ ইটালিয়ানই তাকে পুজো করে। কিন্তু কিছু বুদ্ধিজীবী— শিল্পী, সাহিত্যিক, নাট্যকার, সংগীতকার— ছিলেন মুসোলিনি ও ফ্যাসিস্ট পার্টির ঘোর বিরোধী। চন্দ্র ছিল তাদেরই একজন। কিন্তু তার ছেলেই শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়। তার এক বছর আগে কার্লা মারা গেছে ক্যানসারে। এই দুই ট্র্যাজেডির ধাক্কা চন্দ্র সইতে পারে নি। তাই সে দেশে ফিরে আসে। ছেলের সঙ্গে সে কোনও যোগাযোগ রাখেনি।"

সত্যজিৎ রায়ের ফেলু কাহিনীগুলোর মধ্যে এই  'টিনটোরেটোর যীশু'তেই একমাত্র ফ্যাসিবাদের প্রতি সত্যজিতের তীব্র ঘৃণা সরাসরি প্রকাশ পেয়েছে। আর সম্ভবতঃ কোথাওই না। অথচ ঠিক এর উল্টোদিকে আরেকটু কমবয়সীদের জন্য সৃষ্ট চরিত্র' প্রফেসর শঙ্কু'র একাধিক কাহিনীতে বারবারই এসেছে সত্যজিতের এই মনোভাব। মোট ৩৮ টা পূর্ণাঙ্গ এবং দুটি অসম্পূর্ণ শঙ্কু কাহিনীর খবর আমরা জানি। এর মধ্যে ঐ 'স্বর্ণপর্ণী' ছাড়াও আরো অন্ততঃ গোটা চারেক ক্ষেত্রে তা পরিষ্কার ভাবেই দেখা গিয়েছে।
প্রথম শঙ্কু কাহিনী 'ব্যোমযাত্রীর ডাইরি'র প্রায় ১৩ বছর পরে লেখা 'ডক্টর শেরিং-এর স্মরণশক্তি'তে সরাসরি ফ্যাসিবিরোধিতা না থাকলেও, শঙ্কু কাহিনীতে সম্ভবতঃ এই প্রথমবার সত্যজিতের যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের প্রকাশ দেখা গেল। 'বি এক্স ৩৭৭' নামক আণবিক মারণাস্ত্রের ফর্মুলা যুদ্ধ ব্যবসায়ীদের হাতে পৌঁচ্ছানোর আগেই কীভাবে সেই ফর্মুলা ধ্বংস করা সম্ভব হল— সেই নিয়েই এই গপ্পো।
এর ঠিক পরের শঙ্কু কাহিনীই 'হিপনোজেন', যেখানে প্রথমবার শঙ্কু মোকাবিলা করছে এক ভয়ংকর ডিক্টেটরের— উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র আলেকজান্ডার ক্রাগ। বিজ্ঞানী, বা বলা ভালো অপবিজ্ঞানী। লক্ষ্য— একদিকে মৃত্যুর পরে পুনরুজ্জীবন, আবার আরেকদিকে সেই বেঁচে ওঠার এবং বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে গোটা পৃথিবীর একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করা। যার হাতিয়ার— একটা আবিষ্কার, একটি গ্যাস। নাম হিপনোজেন। যে গ্যাসের একটিমাত্র কণা একজন মানুষকে ২৪ ঘন্টা সম্মোহিত বা হিপনোটাইজড্ করে রাখতে সক্ষম! আর সত্যিই তো, "লোকের মন একবার দখল করতে পারলে তাদের উপর কর্তৃত্ব করতে অসুবিধা কোথায়?"
অনবদ্য চরিত্রায়ণ এক ডিক্টেটরের। চেনা লাগছে না?

এর পরের একাধিক শঙ্কু কাহিনীতে সরাসরি ফ্যাসিস্টদের প্রতি মনোভাব চিত্রিত করেছেন সত্যজিৎ। যেমন ধরুন 'শঙ্কুর কঙ্গো অভিযান'। এখানে এক জায়গায় পরিষ্কার উল্লেখ আছে বুখেনওয়ালড্ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এবং সেই ক্যাম্পে ইহুদি বন্দিদের উপর অত্যাচারের। ঐ উপন্যাসেই শঙ্কুর জবানিতে লিখছেন সত্যজিৎ— "আমি অবাক হয়ে দেখছি হাইমেনডর্ফের দিকে। চোখে ওই ক্রূর দৃষ্টি, ওই ইস্পাত শীতল কন্ঠস্বর— একজন প্রাক্তন নাৎসীর পক্ষে মানানসই বটে।"

এর আরও প্রায় এক যুগ পরের লেখা 'শঙ্কু ও ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন'। পটভূমি আবারও জার্মানি, এবং এবার ফোকাসে নিও-নাৎসীরা। আবারও দ্বন্দ্ব শুভ-অশুভের মধ্যে, এবং পরিশেষে নিও নাৎসী নেতা রেডেলকে নিও ফ্যাসিস্ট থেকে নতুন জীবনে পাঠানো, অমানুষ থেকে মানুষে রূপান্তরিত করা। যার পরিণতিতে শঙ্কুর জবানিতে লেখা হচ্ছে— "যতদূর মনে হয় হিটলারপন্থী দল এবার নিশ্চিহ্ন হবে।" 
এর বছর দুয়েক পরের লেখা 'স্বর্ণপর্ণী'।

৩)
স্বর্ণপর্ণী ২

'স্বর্ণপর্ণী' উপন্যাসটা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯০ সালে। এরপর আরও দুটো শঙ্কু কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু দুটোই অসম্পূর্ণ। ফলে এটাই শেষতম সম্পূর্ণ শঙ্কু কাহিনী।
ঘটনা পরম্পরা দেখলে আবার এটাই শঙ্কুর প্রথম কাহিনী! পুরোটাই ফ্ল্যাশব্যাকে বিবৃত। অন্য শঙ্কু-কাহিনীগুলো রোজনামচা আকারে, ডাইরির একের পর এক দিন ধরে এগিয়ে চলা কাহিনী। আর এইটেতে ডাইরির পাতা একটা দিনেই (১৬ জুন) আটকে, নিজের জন্মদিনে স্মৃতিচারণ করার ঢংয়ে বিবৃত গপ্পো।
জীবনসায়াহ্নে এসে স্মৃতিচারণা শঙ্কুর (বা হয়তো  সত্যজিতেরও)। এই স্মৃতিচারণার ফর্মেই লেখা হল শঙ্কুর সর্বশ্রেষ্ঠ কাহিনী। কোনোরকম ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা না, সরাসরি ফ্যাসিস্ট জার্মানির কথা। সরাসরি সেই মানবতার শত্রুদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং সর্বোপরি সরাসরি "বিশ্বের হীনতম প্রাণী" ফ্যাসিস্টদের সামান্য একটু হলেও হারানোর কাহিনী। মানবতার জয়ের কাহিনী।
__________________________

সত্যজিৎ দেখে যেতে পারেন নি ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের দিনটিকে, যেদিনটা আমার দেশের ইতিহাসে এক মোটা কালো লাইন টেনে দিয়েছে। সত্যজিতের দেখার প্রশ্নই নেই এখনকার এই NRC-CAA'র পর্বটা। কিন্তু জেনেছিলেন ইহুদীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানানোর ন্যূরেমবার্গ আইনের কথা। দেখেছিলেন গোটা বিশ্ব জুড়ে নিও ফ্যাসিস্ট প্রবণতার সাময়িক হলেও মাথাচাড়া দেওয়াটাকে। দেখেছিলেন নিজের দেশে সংঘ পরিবারের ক্রমশ বাড়বাড়ন্তকে।

একেবারে ছোটদের জন্য লেখা শঙ্কু কাহিনী। সবচেয়ে বেশি দিন যারা থাকবে, সবচেয়ে বেশি লড়াই যাদের করতে হবে মানবতার শত্রুদের বিরুদ্ধে— তাদের জন্যে লেখা। তার জন্যই আরেকবার ইতিহাস থেকে শেখার জন্য এবং আশার পক্ষে, মানবতার পক্ষে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে ইতিহাস থেকে শেখার জন্যেই বোধহয় একদম শেষ লগ্নে 'স্বর্ণপর্ণী'র মত লেখাটা আসে...

শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৯

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মিছিল ~ শতাব্দী দাস

লাল পতাকার পিছনে তো অনেক বার হেঁটেছি। কিন্তু লক্ষ্য করেছেন কি, যে রাগী ছেলেমেয়েগুলো স্বাধীনতা দিবস এলেই 'আমি তো দেশদ্রোহী' থিমে স্টেটাস দেয়, তাদের হাতে কাল জাতীয় পতাকাও ছিল? 

তাদের আগেও বলেছিলাম, দেশ বিজেপির বাপের নয়,  গোসন্তানদের উপর রাগ করে তিরঙ্গার অধিকার ছেড়ে দিতে নেই । বোঝাতে পারিনি৷  বিজেপি দায়িত্ব নিয়ে বুঝিয়ে দিল। ধন্যবাদ বিজেপি। 

লক্ষ্য করেছেন কি, প্রধানমন্ত্রী যে 'পোষাকের' হাতে শুধু পাথর দেখেন, সে পোষাকের হাতেও কাল জাতীয় পতাকাই ছিল? কাল ছিল প্রকৃত অর্থেই জাতীয় পতাকা রিক্লেইম করার দিন৷ কোনো বাধ্যতামূলক স্বাধীনতা দিবস বা প্রজাতন্ত্র দিবস পালনে তিন-রঙা  ততটা খোলতাই হয় না, যতটা কালকের মিছিলে হয়েছিল। 

 লক্ষ্য করেছিলেন কি, এখানে-ওখানে দুয়েকটা রামধনু নিশানও উড়ছিল?  মানে সাতরঙা জেন্ডার স্পেক্ট্রামের মানুষজন নিজেদের 'দেশ' বুঝে নিতে এসেছিলেন! 

লক্ষ্য করেছিলেন কি  ' মন্দ যে সে সিংহাসনে চড়ে'-র পরের লাইন হয়ে গেছে 'মোদী দূর হঠো'? লক্ষ্য করেছিলেন কি, ওরা রাস্তায় আটকে পড়লেই বৃত্ত রচনা করে নিচ্ছিল, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নাচছিল? লক্ষ্য করেছিলেন কি, এস এন ব্যানার্জি রোডে ম্যাটাডোরের মাথায় বসা স্থানীয় শিশু ওদের নাচের তালে তালি দিয়েছিল? 

লক্ষ্য করেছিলেন কি, রাস্তা  যেন কলেজ ক্যান্টিন? চা আসছে, বাদামভাজা, সিগ্রেট...কিছু অ্যান্টি ন্যাশনাল দোকানদার বিনে পয়সাতেও চিপস বিস্কিট খাইয়েছেন! কাউন্টারে সিগ্রেট খেয়েছি অনেক, কাউন্টারে এগরোল এই প্রথম।  সেই রোল যে হাতে দিয়ে গেল, তাকে চিনিনা। তাকে যে দোকানী দিয়েছিল,  পয়সা নিয়েছিল কি  সে-ও? 

দুটো মিছিলে হেঁটে ক্লান্ত পা টেনে মেট্রোয় ঢুকছি। গালে 'নো এনআরসি' দেখে পুলিস বলছে,  'বেশ করেছ'!  পুলিশের জন্য কষ্ট হয়। রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় থাকলে এই পুলিসকেই ফাইবারের লাঠি দিয়ে মিছিল পেটাতে হত। 

বাড়ির স্টেশন।  যে লটারি টিকিটওয়ালাকে কোনোদিন লক্ষ্য করিনি, সে গালের লেখা দেখে বলল, 'থ্যাঙ্ক ইউ'। প্রথমবার  জিগ্যেস করলাম, 'নাম কী আপনার?' একটি হিন্দু নামই বলল। 

 বাড়িতে 'নো-এন-আর-সি' গালে একটা চুমু খেল সাতবছর, 'নো সি-এ-এ' গালে আরেকটা। টিভিতে দেখলাম, মহামান্য দিলীপবাবু রামচন্দ্র গুহ সম্পর্কে বলছেন, 'কে বুদ্ধিজীবী আর কে নয়, তা সরকার ঠিক করবে।' স্পষ্ট ফ্যাসিবাদী উচ্চারণ। 

ফ্যাসিবাদ  ঘেন্না করি, ফ্যসিবাদ ভয় পাই। কিন্তু শীতের মিছিলের এমন সে আগুন, সেই মুহূর্তে আমি আর সাতবছর দু'জনেই এক বোকা অপোগণ্ডের কথায় ফ্যাক করে হেসে ফেললাম!

মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৯

আপনি কি হিন্দু? ~ সুশোভন পাত্র

এক্সকিউস মি! আপনি কি হিন্দু? তাহলে চাপ নেবেন না প্লিজ। বিজেপি ক্ষমতায় থাকতে কোন বাপের ব্যাটার হিম্মত হবে না হিন্দুদের একইঞ্চি ক্ষতি করার!
দেখলেন না কেমন কায়দা করে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে বাংলাদেশ-পাকিস্তান-আফগানিস্তানে ধর্মীয় উৎপীড়নের শিকার 'হিন্দু শরণার্থীদের' নাগরিকত্ব দেওয়ার বন্দোবস্ত করে দিল। মাস্টারস্ট্রোক! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবার বলছেন "দেশ জুড়ে NRC হবে।" হুইস্কি অন দি রক্স। জাস্ট ভাবুন, কাল সকালে পশ্চিমবঙ্গে NRC চালু হচ্ছে। এক লহমায় আপনি-আমি, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষ রাজ্যের ৯কোটি মানুষ অ-নাগরিক হয়ে যাচ্ছে। ঘরে রাত জেগে চলছে পুরনো নথি জোগাড়ের চিরুনি তল্লাশি। আপনি অফিস-স্কুল-কাছারি ছেড়ে, আপনার বৌ ছোলার ডালটা সেদ্ধ করতে ওভেনে বসিয়ে, আপনার বুড়ো বাপ হাঁপানি নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে, আপনার মা বাতের ব্যথা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে, দিনের পর দিন সরকারী অফিসের চক্কর কাটছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছেন। নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণের সম্ভাব্য নথি হাতে নিয়ে আর পরিচয় হারানোর দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে। কি থ্রিলিং ব্যাপার তাই না? আমার তো মশাই ভেবেই কেমন একটা রোমাঞ্চ হচ্ছে! আর আপনার?
জমা দেওয়া নথি বিজেপির পছন্দ হলেই কেল্লাফতে। আপনি হলেন গিয়ে 'নাগরিক'। আর বাদ পড়লে 'অ-নাগরিক'। ঐ যেমন আসামে বাদ পড়া ১৯লক্ষের ১২ লক্ষই হিন্দু। কিন্তু আপনি একদম ঘাবড়াবেন না! মনে মনে ১০৮বার বলবেন 'মাস্টারস্ট্রোক।' তারপর সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে আবেদন করবেন। সিম্পল! 
ধরুন আপনি ৫পুরুষ ধরে এদেশে আছেন, রেশন তুলেছেন, পড়াশুনা করেছেন, চাকরি পেয়েছেন, এমনকি এই লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি কে ভোটও দিয়েছেন; কিন্তু নাগরিকত্ব প্রমাণের নথি আপনি গুগল সার্চ করেও জোগাড় করতে পারেন নি। তাহলে আর কি? 'পুরানো সেই দিনের কথা' ভুলে গিয়ে, নতুন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে আবেদন করে, জাস্ট স্বীকার করে নিতে হবে যে আপনি এতদিন এদেশে ছিলেন 'অবৈধ শরণার্থী' হয়ে আর বাংলাদেশ-পাকিস্তান-আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন ধর্মীয় নিপীড়নের তাড়া খেয়ে। ব্যাস! তারপর ধর্মীয় নিপীড়নের ছোট্ট একটা প্রমাণ ঠুকে দিলেই ল্যাঠা চুকে গেলো। এবার বিজেপির আশীর্বাদ পেলেই আপনি কমপক্ষে ৫বছরের জন্য হয়ে যাবেন 'বৈধ শরণার্থী'। মানে ছিলেন 'নাগরিক' হবেন 'বৈধ শরণার্থী'। কিউট ব্যাপার না? হিন্দু হয়ে এইটুকু স্যাকরিফাইস করবেন না মশাই? কাম-অন। মনে রাখবেন বিজেপি ক্ষমতায় থাকতে কোন বাপের ব্যাটার হিম্মত হবে না হিন্দুদের একইঞ্চি ক্ষতি করার!
অমিত শাহ বলেছেন, নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনের ফলে "লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি" মানুষ উপকৃত হবেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার হিসেব, সুবিধা পাবেন গোটা দেশে মাত্র ৩১,৩১৩ জন। ২৫,৪৪৭ জন হিন্দু, ৫,৮০৭ জন শিখ, খ্রিস্টান ৫৫ জন, ২ জন বৌদ্ধ, ২ জন পার্সি। তা শুধুমাত্র এই ৩১,৩১৩ জন মানুষ কে নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য দেশের ১৩২ কোটি মানুষ কে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়াটা কি মশা মারতে কামান দাগার আদর্শ উদাহরণ হিসেবে স্কুলের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে? এরকম প্রশ্ন যদি কেউ করে তাহলে বুঝবেন সে 'দেশদ্রোহী'। হিন্দু হিসেবে আপনার কর্তব্য চোখ-কান বন্ধ রেখে, বুদ্ধি-বিবেক বেচে দিয়ে, দিনের দু-বার গোমূত্র সেবন করে, বিজেপির উপর পূর্ণ আস্থা বজায় রাখা। 
আপনার নোট বাতিল মনে নেই? আচ্ছা বুকে হাত রেখে একজনও হিন্দুর নাম আপনি বলতে পারবেন যাকে নোট বাতিলের সময় ATM-র লাইনে দাঁড়াতে হয়েছিল? পারবেন না। কারণ, হিন্দুরা তো তখন শীতের সকালে ব্যালকনির মিঠে রোদ্দুরে বসে গ্রিন টি খাচ্ছিল আর ব্যাঙ্ক গুলো হিন্দুদের বাড়ি বয়ে নগদ জোগান দিয়ে গিয়েছিল। সে RBI যতই বলুক নোট বাতিলে কোন কালো টাকা উদ্ধার হয়নি, জাল নোট ধরা পড়েনি, দেশকে ক্যাশলেশ করা যায়নি। রঘুরাম রাজন যতই চিৎকার করুক নোট বাতিলে কারও কোন লাভ হয়নি। খবরদার বিশ্বাস করবেন না। কারণ আপনি চোখের সামনে দেখেছেন নোট বাতিলের পরই জয় শাহ'র কোম্পানির রেভিনিউ বেড়েছিল ১৬,০০০%। আর অমিত শাহ পরিচালিত সমবায় ব্যাঙ্কে জমা পড়েছিল দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩,১১৮ কোটির বাতিল নোট। তাহলে কোন হরিদাস পাল বলে যে নোট বাতিলে হিন্দুদের লাভ হয়নি? এঁরা দুজন কি হিন্দু নয়? বললাম না, বিজেপি ক্ষমতায় থাকতে কোন বাপের ব্যাটার হিম্মত হবে না হিন্দুদের একইঞ্চি ক্ষতি করার!
নিন্দুকে বলছে, দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার নাকি ৪.৫%। ৬বছরে সর্বনিম্ন। এতে কি হিন্দুদের কোন ক্ষতি হচ্ছে? এক্কেবারেই না। হিন্দুদের জিডিপি তো মোদীজি আলাদা করে ক্যালকুলেশন করছেন। এই যে দেশে বেকারত্বের হার ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ। কি ভাবছেন হিন্দুদের বেকারত্বের জ্বালায় ভুগতে হচ্ছে? এক্কেবারেই না। দেশে হিন্দু বেকার গ্যালিলিও নিজেও দূরবীন দিয়ে খুঁজে পাবেন না। এই যে অটো-মোবাইল সেক্টরে সেল ২১বছরে সর্বনিম্ন, কারখানার ঝাঁপ পড়ছে। এই যে ঋণের দায়ে দেশে ১২হাজার কৃষক বছরে গড়ে আত্মহত্যা করেছ। চেষ্টা করলেও এতে আপনি একজনও ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু শ্রমিক-কৃষক দেখাতে পারবেন না!
রাম রাজত্বে বাজারে পেঁয়াজের ১৫০টাকা/কেজি বিক্রি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু হিন্দুরা আজকাল পেঁয়াজ ফ্রিতেই পাচ্ছে। উচ্চ-শিক্ষার ফিস দেশে আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু হিন্দুদের তো কলেজে ফ্রিতেই অ্যাডমিশন দিচ্ছে। বিদেশি অপশক্তির হাঙ্গার ইনডেক্সে ভারতে ১১৭ দেশের মধ্যে ১০২-এ ঠিকই, কিন্তু গুপী-বাঘার মত তালি ঠুকলেই সরকার হিন্দুদের মণ্ডা-মিঠাই সাপ্লাই দিচ্ছে। গ্যাস সিলিন্ডারে এক্সট্রা ভর্তুকি দিচ্ছে, PF-এ বর্ধিত হারে সুদ বসাচ্ছে। এমনকি হিন্দুদের পাম্পের আশে পাশে দেখতে পেলেই সরকার ধরে বেঁধে সস্তায় গাড়িতে পেট্রোল-ডিজেল ফুল টাঙ্কি করে দিচ্ছে। 
বিশ্বাস না হলে সম্প্রতি ফোর্বসে প্রকাশিত ১০০জন ধনীতম ভারতীয়দের তালিকা দেখুন। ৮ধাপ উঠে দ্বিতীয় স্থানে আছেন গৌতম আদানি। আর এই নিয়ে টানা ১২বছর প্রথম স্থানে মুকেশ আম্বানি। ২০১৪-২০১৯, মুকেশ আম্বানির সম্পত্তি ১.৬৮লক্ষ কোটি থেকে বেড়ে ৩.৬৫লক্ষ কোটি হয়েছে। বৃদ্ধির হার ১১৮%। আর  গৌতম আদানির সম্পত্তি ৫০.৪ হাজার কোটি থেকে বেড়ে ১.১লক্ষ কোটি হয়েছে। বৃদ্ধির হার ১২১%। তাহলেই বুঝুন, আদানি কিম্বা আম্বানির মত হিন্দুরা মোদীজির আশীর্বাদে এই পাঁচ বছরে কত্ত উন্নতি করেছেন। 
ও! বাই দা ওয়ে, আপনিও তো মশাই হিন্দু। তা এই ৫ বছরে মোদীজির আশীর্বাদ আপনার সম্পত্তি কত শতাংশ বেড়েছে? ১১৮%? ১২১%? না অমিত শাহ'র ব্যাটা জয় শাহর মত এক্কেরে ১৬,০০০%?

শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯

নিজের দেশে রিফিউজি হব? ~ পিপল্‌স স্টাডি সার্কেল

"নিজের দেশে রিফিউজি হব? : প্রশ্নোত্তরে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) ও নাগরিকত্ব বিল (সিএবি)" (প্রকাশক পিপল্‌স স্টাডি সার্কেল, নভেম্বর ২০১৯) থেকে কিছু তথ্য --

পশ্চিমবাংলায় এনআরসি কি আদৌ প্রয়োজন?

সারা রাজ্যের মানুষকে যদি এখন সত্তর বছরের পুরনো দলিল দেখিয়ে নিজেদের নাগরিক প্রমাণ করতে হয়, তাহলে জনজীবনে ঘোর সংকট তৈরি হবে। কে "সন্দেহভাজন নাগরিক" আর কে সাচ্চা নাগরিক, সেই নিয়ে সমাজে ব্যাপক ভীতি আর বিভেদ তৈরি হবে। এসব করে মানুষের কী লাভ হবে? বর্তমানে আমাদের রাজ্যে ৯ কোটি ৩৯ লাখ মানুষের আধার কার্ড আছে, ৬ কোটি ৯৭ লাখ মানুষের ভোটার তালিকায় নাম আছে। এছাড়াও রেশন কার্ড, প্যান কার্ড, পাসপোর্ট, ব্যাংকের খাতা ইত্যাদির মত কোনও না কোনও পরিচয়পত্র বেশিরভাগ মানুষের কাছেই আছে। এটাই তো নাগরিকত্বের জন্য যথেষ্ট। এর ওপর আবার একটা জাতীয় পরিচয়পত্র বানানোর কোনও প্রয়োজন তো নেই-ই। উপরন্তু ২০০৩-এর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মত একটা উদ্বাস্তু-বিরোধী একুশে আইনের অধীনে কোনওরকম এনপিআর, এনআরসি, বা এনআরআইসি প্রক্রিয়া চালানোর সর্বাত্মক বিরোধিতা করা দরকার। এই আইনটাকেই বাতিল করতে হবে।
       
বিজেপি বলছে হিন্দুদের ভয় নেই। আগে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা সিএবি পাশ করা হবে, তারপর এনআরসি হবে। এই সিএবি (ক্যাব) বিল ব্যাপারটা কি?

মোদী সরকার ২০১৬ সালে এই বিলটা আনে। এই বিল অনুযায়ী পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের মধ্যে কেউ হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি, শিখ বা খ্রিস্টান হলে তিনি আর ২০০৩-এর নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের সংজ্ঞা মোতাবেক "অবৈধ অভিবাসী" হিসেবে গণ্য হবেন না, এবং ছ'বছর এদেশে থাকার পর ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন। কিন্তু এই দেশগুলি থেকে আসা উদ্বাস্তুদের মধ্যে কেউ যদি মুসলমান হন তাহলে তিনি এই ছাড় পাবেন না, তাঁকে "অবৈধ অভিবাসী" হিসেবেই গণ্য করা হবে। 

তার মানে ক্যাব বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন/বিল সমস্ত হিন্দু উদ্বাস্তুদের ভারতীয় নাগরিক বানিয়ে দেবে?      

ভুল প্রচার। সিএবি (ক্যাব) বিল কাউকেই সরাসরি নাগরিকত্ব দেবে না। অন্যের মুখের কথা না শুনে নিজে সরকারের পাতা থেকে ডাইনলোড করে পড়ে দেখুন। বিল কী বলছে? বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের "অবৈধ অভিবাসী" অর্থাৎ বিদেশি হিসেবে গণ্য করা হবে না, শরণার্থী হিসেবে দেখা হবে। এটুকুই বিলের বক্তব্য। ধরে নিলাম সংসদে বিল পাশ হল, ধরে নিলাম বিল আইনও হয়ে গেল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশ থেকে এতদিন ধরে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুরা সঙ্গে সঙ্গে ভারতের নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। তাঁরা শরণার্থী হিসেবে ভারতে থাকার আইনি সুরক্ষা পাবেন, এইটুকু। তাঁদের পুলিশ তক্ষুণি জেলে পুরে দেবে না বা বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেবে না।

কিন্তু নাগরিকত্ব পেতে হলে আপনাকে প্রমাণ দিতে হবে আপনি ধর্মীয় কারণে নিপীড়িত হয়ে ভারতে এসেছেন। ধরা যাক, আপনার পরিবার পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১৯৬৫ সালে এসেছিল। ১৯৬৫-এর পর ৫৪ বছর চলে গেছে। এত বছর পর প্রমাণ করতে পারবেন যে ৫৪ বছর আগে পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মের কারণে অত্যাচারিত হয়েছিলেন? মানুষ তো এদেশে নানা কারণে এসেছেন। অনেকেই চাকরি বা রোজগারের কারণে এসেছেন। অনেকেই জ্ঞাতি-গুষ্টি বা গ্রামের লোক চলে আসাতে এসেছেন। অনেকে এসেছেন দাঙ্গার কারণে। অনেকে এসেছেন ভয়ে। অনেকে এসেছেন নিরাপত্তার খোঁজে। অনেকে সরাসরি নিপীড়িত হয়েও এসেছেন। কিন্তু সেই অত্যাচারের সেলফি অথবা লাইভ ভিডিও তুলে ফেসবুকে তো আপলোড করে রাখেননি। সে সময়ে থানায় ডায়েরি তো করেননি। কীসের প্রমাণ দেবেন? দ্বিতীয় কথা হল এই যে আপনাকে নাগরিকত্বের জন্য ছ'বছর পর আলাদা আবেদন করতে হবে। সেই আবেদন সরকার খারিজও করতে পারে। 

তার মানে কী দাঁড়াল, একবার ভেবে দেখুন। এতদিন আপনি ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড, বিপিএল কার্ড ইত্যাদি এতগুলো কাগজের সাহায্যে ন্যূনতম নাগরিক অধিকারটুকু পাচ্ছিলেন। বিলের এক খোঁচায় নাগরিক থেকে শরণার্থী হবেন। তারপর ছ'বছর পর নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবার ভিক্ষে করতে যাবেন সরকারের কাছে। এ এক বিরাট ধাপ্পা। এতে হিন্দু উদ্বাস্তুদের চরম ক্ষতি আর নাগরিক অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়া ছাড়া আর কিছু নেই।

তাহলে মোদী সরকার সিএবি (ক্যাব) বিল পাশ করাতে চাইছে কেন?

সিএবি (ক্যাব) বিল পাশ করানোর একটাই উদ্দেশ্য। গোটা দেশে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিভেদ আর মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ তৈরি করা। এই বিলে যেভাবে ইসলাম বাদ দিয়ে সমস্ত ধর্মের নাম নেওয়া হয়েছে, সেটা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান বিরোধী। মানুষে মানুষে ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা কানুন করা যাবে না এটা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের মৌলিক কথা। এর উল্টোদিকে হেঁটে নাগরিকত্ব নির্ধারণ করার আইন বানানো চলে না।

কেন্দ্রীয় সরকার যদি সত্যিই আমাদের পড়শি দেশগুলির সমস্ত নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের শরণার্থী হিসেবে ভারতের নাগরিকত্ব দিতে উদ্যোগী হত, তাহলে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানে থাকা আহমদী, সুফি সহ সংখ্যালঘু বা গৌণধর্মের যে মুসলমান গোষ্ঠীগুলি আছে, তাঁদের কথাও বিলে রাখত। যে নাস্তিকরা ধর্ম বিশ্বাস করেন না বলে সারা উপমহাদেশ জুড়ে আক্রান্ত, যে মুক্তমনা-রা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার, তাঁদের কথাও বিলে থাকত। তাছাড়া এই বিলে মায়ানমার (বার্মা), নেপাল, ভূটান আর শ্রীলঙ্কার নাম বাদ কেন? কারণটা সহজ। মায়ানমারে রোহিঙ্গারা আক্রান্ত এবং তাঁরা মুসলমান। আক্রমণকারীরা বৌদ্ধ। নেপাল বা ভুটান থেকে যে গোর্খারা এসেছেন তাঁদের ক্ষেত্রেও মুসলমানদের আক্রমণকারী হিসেবে দেখানো যাবে না। তাই এই দেশগুলি বাদ। 

তাছাড়া, ভারতের পড়শি দেশগুলিতে সংখ্যালঘু নিপীড়ন শুধুই ধর্মের নামে হয় না, ভাষা বা জাতিগত কারণেও হয়। যেমন শ্রীলঙ্কা থেকে নিপীড়িত হয়ে অনেক তামিল উদ্বাস্তুরা ভারতে এসেছেন। তাঁদের এই আইনের আওতায় আনা হয় নি কেন? বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও রাজাকার বাহিনী যে অত্যাচার চালিয়েছিল, সেটা তো ধর্মের ভিত্তিতে ছিল না। ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালিদের ওপর দমন হয়েছিল এবং বাঙালি মুসলমানেরা চরম নিপীড়নের শিকার হন। সে অত্যাচার থেকে পালিয়ে কোনও বাঙালি মুসলমান যদি ভারতে এসে আশ্রয় নিয়ে থাকেন, তাহলে তিনিও শরণার্থীর মর্যাদা পাবেন না কেন?

বোঝাই যাচ্ছে যে বিজেপি সরকার তার সাম্প্রদায়িক মুসলিম-বিদ্বেষী মতাদর্শ অনুসারেই এই বিলটা নিয়ে এসেছে। গরিব হিন্দু উদ্বাস্তুদের মিথ্যে আশা দিয়ে ঠকিয়ে বিষাক্ত হিন্দু-মুসলমান বিভাজন তৈরির কল ছাড়া এই বিলকে আর কী বলবেন?  
        
বিজেপি বলছে এগুলো বিরোধীদের অপপ্রচার। সিএবি (ক্যাব) বিল দিয়ে যে হিন্দু উদ্বাস্তুদের কোনও উপকার হবে না তার সরকারি প্রমাণ আছে?

প্রমাণ আছে। ২০১৬-র ক্যাব বিল নিয়ে একটি যৌথ সংসদীয় কমিটি (জেপিসি) আড়াই বছর ধরে আলাপ-আলোচনা এবং বিতর্ক চালিয়েছিল। বিতর্কে বিরোধী দলেরা নানা রকম প্রশ্ন করে, কেন্দ্রীয় সরকার তার জবাব দেয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সমস্তটা নিয়ে জেপিসি রিপোর্ট সংসদে পেশ হয়।

এই জেপিসি রিপোর্টের ৩৯ এবং ৪০ পাতার প্রতিটি বাক্যে যেন উদ্বাস্তুদের দুর্ভাগ্য জ্বলন্ত অক্ষরে লেখা। সরকারকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে কীভাবে নাগরিকত্ব আবেদনের সত্যি-মিথ্যে যাচাই করা হবে, আর কোন উদ্বাস্তুরা এই আইনের সুবিধে পাবেন? তারা জবাব দেয় যে এ দেশে আসার আগে থেকেই যে উদ্বাস্তুরা জানিয়ে রেখেছেন যে তাঁরা অত্যাচারিত হয়ে পালিয়ে এসেছেন এবং যাঁদের লং টার্ম ভিসা দেওয়া হয়েছে, শুধুমাত্র তাঁদেরকেই এই আইনের সুবিধে দেওয়া হবে। নতুন করে এখন যাঁরা নিজেদের অত্যাচারিত হওয়ার ইতিহাস জানাবেন, তাঁদের কেসগুলো ইনটেলিজেন্স বুরো এবং রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং বা "র" (RAW)-এর গোয়েন্দারা খতিয়ে দেখবেন। এই আধিকারিকদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে মোট কতজন মানুষ এই আইনের সাহায্যে নাগরিকত্ব পেতে পারেন? তাদের জবাব, "হিন্দু – ২৫,৪৪৭, শিখ – ৫,৮০৭, খ্রিস্টান – ৫৫, বৌদ্ধ – ২, পার্সি -২, সব মিলিয়ে সারা দেশে ৩১,৩১৩ জন"। এটা আমাদের কথা নয়, সরকারের জবাব। জেপিসি কমিটির সদস্যরা আইন বিভাগের আমলা-মন্ত্রীদের জিজ্ঞেস করেছিলেন যে দেশজুড়ে শুধুমাত্র ৩১,৩১৩ জন মানুষ এই আইনের উপকৃতের আওতায় আসবেন, না সংখ্যাটা পরে বদলাতেও পারে? এতে সরকারের জবাব, মোট ওই ৩১,৩১৩ জনকেই নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। বাকিদের বরং বিদেশি ট্রাইবুনাল এর সামনে হাজিরা দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে তারা কাগজ নকল করে নাগরিকত্ব পান নি। 

তার মানে যদি সিএবি (ক্যাব) বিল পাশ হয়, তাহলে সারা ভারতে মাত্র ৩১,৩১৩ জন উদ্বাস্তু এখন নাগরিকত্ব পাবেন। আর ২০০৩-এর একুশে আইনটার ফাঁদে বানানো এনআরসি-র ছাঁকনিতে যে ১৯ লক্ষ মানুষ আসামের নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন, তাঁদের জন্য কাঁচকলা। এছাড়া নতুন করে যে মানুষেরা ২০০৩ আইনের "বেআইনি অভিবাসী"-র ফাঁদে পড়ে নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়বেন, তাদের জন্যও কাঁচকলা। তাঁদের ভাগ্যে থাকবে ট্রাইবুনাল, কোর্টকাছারি, ডিটেনশন ক্যাম্প আর আবেদন-নিবেদন। 

তাহলে নাগরিকপঞ্জি বা ক্যাব করে কোনও লাভ নেই। কয়েকজন অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়লেও তাদের বাংলাদেশে পাঠানো সম্ভব না। খালি সাধারণ মানুষকেই হয়রানি করা হবে। তার ওপর ভারতীয়দের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে। মোটের ওপর এটা বলা যায়? 

হ্যাঁ। ২০০৩-এ পাতা ফাঁদে এনআরসি-র ছাঁকনিতে ধরা যদি পরেন, তবে ২০১৬-এর নাগরিকত্বের কল আপনাকে বাঁচাতে পারবে না। আসামের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এটাও শিখলাম যে যদি কোনওক্রমে আপনার নাম একবার নাগরিকপঞ্জিতে উঠেও যায়, তাহলেও শান্তি নেই। দেশপ্রেমিকরা সন্দেহ করে নালিশ করলে আবার সে নাম বাদও পড়তে পারে। দেশপ্রেমিকদের সন্দেহের ভিত্তিতে আপনার পিছনে নালিশের ফেউ এবং ঝুটা অবজেকশন দু'টোই লাগতে পারে। তারপর "র"-এর গোয়েন্দা বাহিনী এবং "ইন্টেলিজেন্স বুরো" আপনার ঠিকুজি কুষ্ঠি ঘাঁটতে বসবে। সবশেষে পড়ে থাকবে একটাই প্রশ্ন। বাঙাল বেলতলায় যায় কয়বার? 

এনআরসি আর ক্যাব নিয়ে মিথ্যে প্রচারটা বুঝলাম। কিন্তু একটা খটকা আছে। পশ্চিমবাংলায় কি সত্যিই দু' কোটি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী আছেন? 

না, এটা বিজেপি-র ছড়ানো গুজব। আসলে "বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী"-দের কোনও নির্দিষ্ট তথ্য বা সংখ্যা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নেই। ২০১৮-র সেপ্টেম্বরে তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা স্পষ্ট করে লিখিত ভাবেই এটা জানিয়ে দেয়।

সিটিজেন আইন ও এনআরসি ~ রোহন কুদ্দুস

যে মুসলমান সহনাগরিকের দিকে পাঁথর ছোঁড়েন, যে মুসলমান রাস্তায় আগুন জ্বালান, যে মুসলমান ক্যাবের বিরোধিতায় ভাঙচুর করেন, তাঁদের উসকানি দেয় রাজনীতি। সেই রাজনীতি, যা সংখ্যালঘুদের উন্নতির কথা আওড়ে তাদের বোড়ে হিসাবে ব্যবহার করে নিজের গদি টিকিয়ে রাখতে চায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনে এ রাজ্যে মুসলমানদের কী উন্নতি হয়েছে সে সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধারণা নেই, কিন্তু সংখ্যাগুরু সমাজ থেকে তাদের আলাদা করে এনে তাদের প্রতি রাজ্যের অবশিষ্ট মানুষের অবিশ্বাস তৈরিতে মমতা পুরোপুরি সফল। রাজ্যটা তিনি সোনার থালায় বসিয়ে বিজেপি-র হাতে তুলে দিচ্ছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ যা মুসলমানদের নিয়ে করেছেন, বিজেপি সেই একই জিনিস হিন্দুদের নিয়ে করছে। আমার ছোটবেলায় 'ভোটব্যাঙ্ক' কথাটা মুসলমান শব্দের সঙ্গে জুড়ে ছিল। এখন দেখি সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু সবাই ভোটব্যাঙ্কে পরিণত হয়েছে। ফলে মূল্যবৃদ্ধি থেকে বেকারত্ব, অর্থনীতির বৃদ্ধির হার থেকে কৃষকের দুর্দশা-- এসব নিয়ে একজোট হয়ে রাজাকে প্রশ্ন করার মতো মানুষ আর অবশিষ্ট নেই। তার ওপর বস্ত্র, বাসস্থান, খিদে-- এগুলোর থেকেও আরও গভীরে গিয়ে নাগরিকত্ব নিয়ে সংশয় মানুষের মনে ঢুকিয়ে দিয়ে রাজা নিশ্চিন্ত।

ক্যাবের ফলে হিন্দু 'শরণার্থী'রা নিরাপদ, ফলে ক্যাব সমর্থন করাই যায়-- এমন আগুনে হাত না সেঁকাই ভালো। ক্যাব কোনও বিচ্ছিন্ন আইন নয়। এর প্রয়োগ করা হচ্ছে আসামের এন আর সি-তে বিজেপি-র প্রতি তৈরি হওয়া অবিশ্বাসকে প্রশমিত করতে। আর এই এন আর সি কাকে ঘরছাড়া করবে আমরা কেউই জানি না। আবার ক্যাব মুসলমান 'রিফিউজি'দের প্রত্যাখ্যান করবে, অতএব মুসলমান হিসাবে রাস্তায় নামা দরকার, এমন চিন্তাও পাশে সরিয়ে রাখা আশু প্রয়োজন। ক্যাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হোক ধর্মনির্বিশেষে। মানুষের একজোট হওয়া জরুরি, তৃণমূল বা বিজেপি-- দু-দলেরই ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে 'না' বলা জরুরি। রাজ্যটা 'নারায়ে তকবির' আর 'জয় শ্রীরাম'-এর মধ্যে ভাগ হয়ে গেলে আগুন জ্বলবে সাধারণ মানুষের ঘরে, এই সহজ সত্যিটা আমাদের মাথায় ঢুকছে না!

রবিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৯

খেলা~ অরুণাচল দত্তচৌধুরী

এই যে দেখছ বধ্যভূমি, এবং সে'টার পাশেই ভাগাড়…
ঘাবড়িও না, সমস্তটাই বিরাট একটা পরীক্ষাগার।
এই যে কোথাও এনকাউন্টার, অন্য কোথাও জ্বলছে চিতা।
উদ্বাহু কেউ হাসছে... কাঁদছে। সমর্থন আর বিরোধিতা। 

নিয়ম এবং কানুনগুলো ভুল বোঝানোর দুই মুখো সাপ।
কোন দিকে যে বাড়ায় ফণা, কখন শাস্তি, কখন যে মাপ!
সাক্ষী লোপাট করতে পারলে যায় মুছে যায় সকল সাক্ষ্য। 
বুঝতে বুঝতে বছর গড়ায়, বিচার যখন করঞ্জাক্ষ!

নিপুন নাট্যমঞ্চে তখন গড়িয়ে যাচ্ছে নতুন পালা।
কলরবেই সার্থক হয় তার্কিকদের কর্মশালা।
চালাক অভিনেত্রী লুকোয় 'কাস্টমার'এর সেই থিয়োরি। 
প্রভাববিহীন ভাবতে থাকে... আজকে সকল দোষ কি ওরই?

এর ভেতরে বাঁচতে গেলে বাছতে হবেই একটা পক্ষ
দু চোখ বুজে কানামাছি যেমন খোঁজে নিখুঁত সখ্য।
বাক্য শানায়, যুক্তি বানায়, সব পক্ষই। অকাট্য তা।
ডেমোক্রেসির আনাচ ঘুরে উড়তে থাকে আইনি চোথা।

এবং খেলা শেষের পরে, সেই বোকাটা বুঝতে থাকে,
চালাক রাষ্ট্র খাচ্ছে মধু, সময় খাচ্ছে সময়টাকে।

শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৯

ধর্ষণ, শ্রেণী ও এনকাউন্টার ~ অনির্বান মাইতি

আপাতত হায়দ্রাবাদ ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের নিয়ে নেটিজেনরা দুই ভাগে বিভক্ত। একদল দুই হাত তুলে আশীর্বাদ করছে সিস্টেমকে, আর একদল সিস্টেমের প্রতি ঘৃণা উগরে দিচ্ছে। আমি যেহেতু অত্যন্ত ধান্দাবাজ একজন লোক, আমি দুইদিকের বক্তব্যকেই আংশিক সমর্থন যুগিয়ে চলেছি। এই ডিবেটগুলো আমি পছন্দ করি কারণ এগুলোর মাধ্যমে ক্রমশ ঘটনার মোড়ক খুলছে। অনেক কিছু সামনে আসছে।

ধর্ষকরা সমাজের ঘৃণ্যকীট তাদের মৃত্যুতে কোন দুঃখ নেই বরং এই ভেবে ভালো লাগছে যে চারটি নষ্ট হয়ে যাওয়া মানসিকতা এই পৃথিবী থেকে মুছে গেল। কিন্তু এতে উক্ত মানসিকতা নষ্ট হয়ে গেল না। এখনো রাস্তায় ঘাটে মহিলারা নিরাপদে ঘুরে বেড়াতে পারে সেরকম আশা করা যাচ্ছে না। এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা প্রয়োজন, আসুন আলোচনা করি।

সারা দেশের ধর্ষকদের প্রথমেই আমি দুইটি ভাগে ভাগ করে নেই, ১) প্রিভিলেজড ধর্ষক ২) আনপ্রিভিলেজড ধর্ষক। হায়দ্রাবাদে যারা নিহত হল তারা আনপ্রিভিলেজড ধর্ষক গোত্রীয়, এরা সমাজের নিচু স্তরের ধর্ষক। যারা অন্ধকারে লুকিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তাদের গন্ডীর মধ্যে এসে পড়া প্রিয়াঙ্কা রেড্ডিকে পেয়েই কর্ম সম্পাদন করেছে। দিল্লীর ক্ষেত্রেও এদেরই দেখা গেছিল। সারা ভারতবর্ষ তোলপাড় করে ফেলা দুটি ধর্ষণ কান্ডই আনপ্রিভিলেজড ধর্ষকদের দ্বারা সম্পন্ন হয়েছিল। এই তোলপাড়ের ব্যাপারটা অপারেট করে মূলত মিডিয়া। তারা ক্রমাগত ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানুষকে চাগিয়ে তোলে, উত্তেজিত করে, মানুষের হয়ে তারাই দাবী ছুঁড়ে দেয়। মানুষ সেইমত প্রতিক্রিয়া জানাতে জানাতে যায়। কিন্তু এই মিডিয়ায়ই আবার নিজেদের সংযত করে ফেলে প্রিভিলেজড ধর্ষকদের ক্ষেত্রে। উন্নাও বা এরকম হাজারটা ধর্ষণ কান্ড এর প্রমাণস্বরূপ দেওয়া যেতে পারে। মানু্ষ ও প্রিভিলেজড দের ভয় পায়। দুম করে এদের শাস্তিবিধান করতে পারে না। কিন্তু অসুখটা যেহেতু ধর্ষণ, আর অসুস্থ যেহেতু প্রিভিলেজড এবং আনপ্রিভিলেজড উভয় পক্ষই সেহেতু এক পক্ষের শাস্তিতে অসুখটা ফুরোচ্ছে না। বরং প্রিভিলেজডদের মনে এই সাহসটুকু ঢুকছে যে শাস্তি পেলে ওরা পাবে, আমরা সেফ। আমরা হয়তো অনেকেই ভুলে গেছি সুপ্রীম কোর্টের চিফ জাস্টিসের বিরুদ্ধেও একটি মেয়ে মলেস্টেশনের অভিযোগ এনেছিল। তারপর সেই অভিযোগ কোথায় যেন হারিয়ে যায়। সেই বিচারপতিই রামমন্দির বিতর্কের অবসান করেন তার ঐতিহাসিক রায় এ।

এবার কথা হল মানুষ যাবে কোথায়? করবে কী? উন্নাও এর অপরাধীরা ছাড়া পেয়েই মেয়েটিকে জ্বালিয়ে মেরে দিল। এর আগেও গাড়ি চাপা দিয়ে মেয়েটিকে মারার চেষ্টা হয়েছে। যেহেতু উন্নাও এর ধর্ষক দেশের শাসকদলের ঘনিষ্ঠ, সেহেতু হায়দ্রাবাদ নিয়ে আমরা যতটা উত্তেজিত, উন্নাও নিয়ে ততটা নই। কিন্তু ক্রমাগত ভিক্টিমের ওপর আক্রমণ করে এই প্রিভিলেজড ধর্ষক প্রমাণ করছেন যে তাঁরা কিন্তু "সেফ"। আর একজন ধর্ষক যেখানে সেফ সেখানে আমরা কী করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারি? যতদিন একজন ধর্ষক জীবিত থাকবে ততদিন কী করে আমাদের ভরসা ফিরতে পারে?

এনকাউন্টার স্পেশ্যালিস্ট সাজ্জনার কে দিয়ে ঘটনার পুনঃনির্মাণ এ পাঠানোর সময়েই প্রশাসন কী ঠিক করে ফেলে নি কী ঘটতে চলেছে? আমরা তো এমন আইন চেয়েছিলাম যার ইমপ্লিমেন্টেশনের মাধ্যমে ধর্ষণ নামক অভিশাপ থেকে মানুষ মুক্ত হয়। অপরাধীদের হত্যার মাধ্যমে সেই আইন প্রতিষ্ঠার পথ ব্যহত হল না? কারণ কেসটাই তো বন্ধ হয়ে যাবে এবার। হায়দ্রাবাদে অপরাধীর মৃত্যু, উন্নাও এ ভিকটিমের মৃত্যু দুটো ধর্ষণ সংক্রান্ত কেস বন্ধ হওয়া ভারতে ধর্ষণ বিরোধী শক্তিশালী আইন প্রতিষ্ঠার পথে কত বড় বাধা হল সেটা নিয়ে আলোচনা উঠবে না? দিনের শেষে লাভবান হল তো প্রিভিলেজডরাই।

অনেকে বলছেন নিজের ঘরে রেপ হলে বুঝতে কেন এই এনকাউন্টারকে সমর্থন করছি। কাউন্টারে এটাও সত্যি যে নিজের ঘরে এনকাউন্টার হলে বুঝতে কেন আমরা রেপ এবং এনকাউন্টার দুটোরই বিপক্ষে। আপনি ক্ষেত্রবিশেষে এনকাউন্টার এর সমর্থক হতে পারেন না। হয় আইন অথবা এনকাউন্টার যে কোন একটার পক্ষে দাঁড়াতে হবে। আমার দুই মামাকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যুক্ত থাকার অপরাধে পুলিশ বাড়িতে ঢুকে তাদের মায়ের সামনে গুলি করে মেরেছিল ৭২ সালে। আমি যদি এনকাউন্টার সমর্থন করে ফেলি তাহলে এই ঘটনাকেও সমর্থন জানাতে হয়। কারণ আইন না হলে এনকাউন্টার যে কোন একটাই বেছে নিতে পারেন আপনি। আর এনকাউন্টারকে বেছে নিলে প্রিভিলেজডরা যে কোনদিনই শাস্তি পাবে না সে ব্যাপারে নিঃসংশয় থাকুন। আর আরো বেশি আশঙ্কিত হোন এই ভেবে যে শুধু প্রিভিলেজড ধর্ষকে ভর্তি পৃথিবী আরো কত ভয়ঙ্কর হতে পারে।

***একটা কথা সবাই মাথায় রাখুন, গণতন্ত্রের শর্ত এই যে আমরা সকলেই সহমত না হয়েও যেন আলোচনা চালিয়ে যেতে পারি। এমন কিছু করবেন না, যাতে আলোচনা ঘেঁটে যায়।