শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০১৯

সোশ্যাল মিডিয়া ও নির্বাচন ~ সাগ্নিক দাস

২০১৯ এ এসে আমরা অনেকেই বিজেপি সোশ্যাল মিডিয়াকে কিভাবে ব্যবহার করছে সেই নিয়ে চিন্তিত হচ্ছি। সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক জনমত বা মতাদর্শ তৈরি করা বেশ কিছুদিন আগেই শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রত্যেকটি নির্বাচনের সাথে সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সোশ্যাল মিডিয়ার পেছনে খরচ বেড়েই চলেছে। 

সোশ্যাল মিডিয়াকে রাজনৈতিক ভাবে বর্তমান দুনিয়াতে কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেই নিয়ে নেটফলিক্সে একটি তথ্যচিত্র এসেছে। নাম "The Great Hack"। ব্রিটিশ সংস্থা "Cambridge Analytica" বেআইনি ভাবে ফেসবুক ড্যাটা নিয়ে  ২০১৬ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ও ব্রিটেনে ব্রেক্সিট রেফ্রেন্ডউমকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিল সেই নিয়ে এই তথ্যচিত্র। 

"Cambridge Analytica" ফেসবুক থেকে ৭ কোটি মার্কিন নাগরিকের ফেসবুক একাউন্ট থেকে, মাথাপিছু ৫০০০ ডেটা পয়েন্ট জোগাড় করে। এই ৭ কোটি মানুষের ড্যাটা এনালিসিস করে এরা বেছে নেয় সেইসব ভোটারদের, যাদের বিহেভিয়ার অন্যালিসিস করে বোঝা গেছে যে এনারা দোদুল্যমান ভোটার। তাই এই প্রত্যেকের ৫০০০ ডেটা পয়েন্ট নিয়ে প্রত্যেকের জন্য আলাদা ভাবে প্রোপাগ্যান্ডা মেটিরিয়াল তৈরি করে। ভাবুন, প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা। অর্থাৎ আপনার চিন্তাধারার সাথে খাপ খাইয়ে প্রোপাগ্যান্ডা। যেই যেই রাজ্যে দোদুল্যমান ভোটার বেশি, প্রায় প্রত্যেকটা রাজ্যে নির্বাচনে বিজয়ী হয় ট্রাম্প।

এরা কিভাবে কাজ করে, তার একটি ছোট্ট উদাহরণ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ত্রিনিদাদ আইল্যান্ডে দুটি প্রধান দল। একটি দল মূলত কৃষ্ণাঙ্গদের, অন্যটি ভারতীয়দের। ভারতীয়দের রাজনৈতিক দলটি "Cambridge Analytica" কে ভাড়া করে। "Cambridge Analytica" নির্বাচনের আগে সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি ক্যাম্পেন শুরু করে, নাম দেয় "Do So Campaign"। এটি কোন রাজনৈতিক ক্যাম্পেন নয়, সোশ্যাল ক্যাম্পেন। যুবক যুবতীদের লক্ষ্য করে এই ক্যাম্পেন। নির্বাচনের আগে এই ক্যাম্পেনটিকে রাজনৈতিক বানিয়ে দেওয়া হয়। যুব সমাজকে বলা হয় সব রাজনৈতিক দল চোর, জোচ্চোর, কেউ মানুষের কথা ভাবে না।, তাই ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। কিন্তু ভারতীয় ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে সাঙ্গাস্কৃতিক তফাৎ থাকায় এরা জানতো, যে একজন ভারতীয় যুবক বা যুবতীর গুরুজনরা তাদের কে ভোটের দিন ভোট দিতে যেতে বললে তারা চলে যাবে, কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ যুবক, যুবতীরা যাবে না।নির্বাচনে অল্পবয়েসী ভোটারদের মধ্যে, ৪০% কৃষ্ণাঙ্গ যুব, কম ভোট দেয় ভারতীয় যুবদের তুলনায়।এর ফলে ভোটে ৬% সুইং হয়ে, ভারতীয়দের রাজনৈতিক দলটি নির্বাচনে জিতে যায়। 

সোশ্যাল মিডিয়া কিভাবে একটি লাগামহীন দানবে পরিণত হয়েছে ও সেই দানবকে পৃথিবীর সব জায়গায় কিভাবে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, পুরোটা জানতে এই তথ্যচিত্রটি দেখুন। এসবের মধ্যে দুটি সব চাইতে দুঃখয়ের বিষয়। 

১) মানুষ হিসেবে আমরা সম্পূর্ণ অসহায়। আমাদের নাগালের মধ্যে কিচ্ছু নেই। আমরা কিছু বদলাতে পারবো না। কিছু মানুষ চেষ্টা করছেন সোশ্যাল মিডিয়া ড্যাটাকে মানবাধিকার আখ্যা দেবার, কিন্তু এখনো অবধি তারা বিফল।

২) এই সোশ্যাল মিডিয়ার দানোবিক দিকটা দক্ষিণপন্তীরা সম্পূর্ন নিজেদের নাগালের মধ্যে নিয়ে নিয়েছে সারা পৃথিবী জুড়ে। আমেরিকা থেকে ব্রিটেন, ব্রাজিল থেকে ভারত।

বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই, ২০১৯

শিক্ষামন্ত্রীর কুভাষা ~ শতাব্দী দাস

আজ মিউচুয়াল ট্রান্সফারের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে  নজরুল মঞ্চে এক সভায় মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, 'শিক্ষিকাদের এত স্ত্রী রোগ কেন হয়, তা ভেবে আমি অবাক।' 

তা মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহাশয়কে জানানো হোক, নারী-শরীর নিয়ে জন্মালে কিছু নারী-অঙ্গ থাকে। তাদের ঘিরে কিছু ঝঞ্ঝাট থাকে। তাদের মধ্যে প্রধানগুলি হল-

1.Dysmenorrhea ( painful menstruation)
2.Amenorrhea ( absence of period)
3.Polycystic ovarian syndrome (PCOS)
4.Fibroids
5.Endometriosis
6.Pelvic inflammatory disease
7.Vaginitis
8.Menopause
9.Cervical infection
10.Pain during sex
11.Leucorrhea (excess white vaginal discharge)

শখানেক রোগের মধ্যে কয়েকটির মাত্র নাম বললাম। এছাড়া সন্তানধারণ তো আছেই, যাকে একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা বলা হয়, কিন্তু প্রাকৃতিক হলেও যা আসলে কম ঝক্কির নয়। বরং সিজারিয়ান সেকশন ও প্রাকৃতিক উপায়ে সন্তানের জন্ম, দুটোই আলাদা আলাদা ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিমাসের মাসিক সংক্রান্ত হ্যাপাও আছে। 

তাঁকে আরও অবগত করা হোক, অস্টিওপরোসিস,  অস্টিও আর্থারাইটিস, এনিমিয়া  মহিলাদের মধ্যে মহামারীসম। পরবর্তী কথাটা তিনি আরোই বুঝবেন না, তাও তাঁকে বলা হোক, শহুরে, চাকুরীজীবী, তথাকথিত ঘর-বার সামলানো মেয়েদের মধ্যে ডিপ্রেশনও এক কালব্যাধি।

এখনও নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না, কিন্তু দ্য ওয়াল-এ প্রকাশিত খবর যদি সত্যি হয় তবে তিনি একথা বলেছেন। এবং সভায় উপস্থিত কিছু মানুষ তাতে হাততালিও দিয়েছেন।  এতটাই  অসংবেদী পিতৃতান্ত্রিক আমাদের মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর মন্ত্রক ও মন্ত্রীর তাঁবেদাররা!

মহিলা পাঠকদের কাছে  অনুরোধ, তথাকথিত 'স্ত্রী-রোগ' বিষয়ে আরও মুখর হোন বরং৷ 'স্ত্রী-রোগ' বলে কোনো রোগ হয় না৷ ওটা একটা জেনেরিক নাম।  প্রকাশ্যে একদম খোলাখুলি বলুন, বলতে থাকুন,  আপনি কখন ঠিক কীরকম শারীরিক কষ্টে ভোগেন।  গোপনীয় কিছু তো  নয়!  এই যেমন, মহিলা সহকর্মীর দিকে চোখ না মটকে, সবার সামনে বলুন, 'পিরিয়ডের ব্যথা উঠেছে, কাল মনে হয় আসতে পারব না৷' এইরকম আর কী! আসলে আপনার যে এসব রোগভোগ থাকতে পারে, তা আপনি রেখে দিচ্ছেন এঁদের পঞ্চেন্দ্রিয়-গ্রাহ্যতার বাইরে। আপনাকে শেখানো হয়েছে, এগুলো 'মেয়েলি ব্যাপার', এ নিয়ে শুধু মেয়েদের মধ্যেই আলোচনা চলে। আর দেখুন, এঁরা 'মেয়েলি' রোগ দেখা-শোনায় অভ্যস্ত না হওয়ার ফলে  তাকে প্রায় 'নেই' বানিয়ে দিয়েছেন। 

এর পরেও তাঁকে আমি 'মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী' বলেই সম্বোধন করলাম লেখায়, শুধুমাত্র  নিজের পেশার মান রাখতে৷ শিক্ষক তো আর মন্ত্রীটন্ত্রী নন, যাঁদের দেখে সৎ বাবামা সন্তানকে শেখান, 'অমনটা হোয়ো না।' শিক্ষক কুভাষা প্রয়োগ করলে ছাত্র-ছাত্রী শিখবে কী?

বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৯

লুচি ~ অনিন্দ্য

লুচি হলো  মশাই বাঙ্গালীর হেঁশেলের সুচিত্রা সেন । যতই মাধবী , সাবিত্রীর ধারালো অভিনয় , সুপ্রিয়ার চাপা যৌনতা , অপর্ণা সেনের আদ্যন্ত শহুরে বুদ্ধিদীপ্ত  ম্যানারিজম , গঙ্গা গার্ল সন্ধ্যা রায়ের গ্রাম্য সারল্য , বা অরুন্ধতি দেবীর রাবীন্দ্রিক সফিস্টিকেশনের কথা বলুন না কেন , দিনের শেষে ঘাড়টা বেঁকিয়ে , কাজল – কালো দীঘল চোখে উদ্ধত ভাবে বলা " ও আমাকে টাচ করতে পারবে না"--- এটাই বাঙ্গালী রোম্যান্টিসিজমের শেষ কথা । উফ ! কি তাকানো ! একটা ছুরি যেন বুকের এদিক দিয়ে ঢুকে ওদিক দিয়ে বেরিয়ে গেলো । মনে মনে  কল্পনা করুনতো রবিবারের সকাল , আপনার পাতে এসে পড়লো চারটি থেকে ছয়টি গরম লুচি , সাথে কালোজিরে , কাঁচালঙ্কা দেওয়া সাদা আলুচচ্চড়ি , বা চারটি বেগুনভাজা , নরম পান্তুয়ার মতো যার ওপরটা গাঢ় ব্রাউন , আর ভিতরের শাঁসটা নরম আর শাদাটে । আর সাথে অবশ্যই থাকবে একবাটি ঘিয়ে জবজবে মোহনভোগ , ভিতরে কাজুবাদাম আর কিশমিশে ঠাসা । আপনি আঙ্গুল দিয়ে গরম লুচির ওপরটায় আলতো ভাবে একটা টোকা দেবেন , যেন সপ্তপদীর কৃষ্ণেন্দু পরম মমতায় রীণা ব্রাউনের গালে হাত বোলাচ্ছে । এরপর ভিতর থেকে ফুস করে একটু ধোঁয়া বেরিয়ে এলো , যেন শঁপাঞের  ( বানান কার্টসি মানিকবাবু)বোতলের কর্কটা  খোলার পর সামান্য ভুড়ভুড়ি , আপনি তিনকোণা করে আঙ্গুল দিয়ে একটা টুকরো ছিঁড়লেন , চচ্চড়িটা বা বেগুনভাজাটা মাঝখানে দিয়ে গালে ফেললেন , এবার  চোখটা বুজে  আস্তে আস্তে চিবোন , মাইরি বলছি , আপনার অতিপরিচিত খাণ্ডার অর্ধাঙ্গীনিকেও সাত পাকে বাঁধায় গুণ্ডা ভেবে বসা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে মাসতুতো ভাইয়ের বাড়িতে কলেজের প্রফেসর হিসাবে আবিষ্কার করে  লজ্জিত সুচিত্রা সেনের মতো লাগবে । 

                   বাংলা ছবির সুপ্রতিষ্ঠিত নায়িকাটির মতো লুচিও তার সহযোগী নির্বাচনের  বিষয়েও অত্যন্ত খুঁতখুঁতে । এতো আর একথালা ভাত নয় যে যেমন তেমন করে গবগবিয়ে খেয়ে নেবেন , লুচি হলো গিয়ে বাঙ্গালির ভোজন সংস্কৃতির চুড়ান্ত রোম্যান্টিক স্বপ্নবিলাস । যদি হয় কোন নেমন্তন্ন বাড়ি তাহলে লুচির সঙ্গে আপনাকে রাখতেই হবে লম্বা করে কাটা বেগুনভাজা , ডাঁটিশুদ্ধ  লম্বমান , তার পরেই আসবে আলুর দম, শুকনো শাদা , কড়াইশুঁটি মাখানো ,আর ঘন , গাঢ়  ছোলার ডাল, যার  ভিতরে নারকোল কুচি আর কিশমিশের স্বাদে আপনি সদ্য বিবাহিত জামাইবাবুর প্রতি রহস্যময়ী  অবিবাহিতা শ্যালিকার দুষ্টুমির স্পর্শ পাবেন ।  আবার প্রাতরাশ হলে আগেই বলেছি এর সঙ্গে অবশ্যই থাকবে শাদা আলুচচ্চড়ি ,  স্বয়ং মহানায়ক উত্তমকুমারও নাকি এই দেবভোগ্য বস্তুটির একান্ত অনুরাগী ছিলেন ( বেণুদি উবাচ ) । আপনার নিশ্চয়ই এতক্ষণে মনে পড়ে গেছে  নিশিপদ্ম ছবিটার কথা , অনঙ্গবাবু ( উত্তম কুমার ) লুচি আলু চচ্চড়ি খাওয়ার আবদার করছেন পুষ্প ( সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়) এর কাছে , কাটলেট ভেজে খাওয়ানোর আমন্ত্রণ উপেক্ষা করে । গরম লুচির সাথে যদি তরকারি বা বেগুনভাজা তেমনই ঠাণ্ডা লুচির সঙ্গে মিষ্টি জাতীয় খাবারের সঙ্গতটাই ভালো । হেমন্তকালের কোজাগরী লক্ষীপুজোর ঘন সরপড়া পায়েসের সাথে ঘিয়ে ভাজা মিইয়ে যাওয়া লুচি ----- যেন ইন্দ্রাণী ছবিতে উত্তম সুচিত্রার লিপে হেমন্ত মুখুজ্জে – গীতা দত্তের ডুয়েট "  নীঢ় ছোট ক্ষতি নেই আকাশতো বড়" । আবার ধরুন গিয়ে মিয়োনো লুচির  ওপরের চামড়াটা  আলতো করে তুলে নিয়ে তলার মোটা অংশটা দিয়ে লালচে রঙের মিষ্টি দই ---- যেন দীপ জ্বেলে চাই বা মেঘ কালো ছবিতে বসন্ত চৌধুরীর দৃপ্ত পৌরুষের সঙ্গে মিসেস সেনের অনাবিল ন্যাকামি । আবার একটু বেশী ময়াম দেওয়া খড়খড়ে লুচির সঙ্গে আপনাকে খেতেই হবে সেন মহাশয়ের দোকানের ঘিয়ে ভাজা সীতাভোগ আর মিহিদানার মিশ্রণ , সাদা আর হলুদে মাখোমাখো , মাঝে মাঝে রম্বসাকৃতি রসে ভেজানো ছানার মুড়কির দ্রঢ়িমা । ঠিক যেন অসিত সেনের জীবন তৃষ্ণা , রুক্ষ অহংকারী , উত্তম কুমারের সঙ্গে ব্যক্তিত্বময়ী সুচিত্রা সেনের দুষ্টুমিষ্টি সংঘাতের মধ্যে দিয়ে প্রণয়ের ইতিহাস । 

                              আমাদের আম বাঙ্গালীর প্রাত্যহিক যাপনের সাথে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িয়ে আছে লুচি । ষষ্ঠিপদ চট্টোপাধ্যায়ের পাণ্ডব গোয়েন্দা বা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের অঘটনঘটন পটীয়সী মিতিনমাসির ভ্যাবলা স্বামী পার্থ , লুচি সবারই  হট ফেভারিট । বেড়াতে গেলে টিফিন ক্যারিয়ারে চারটি লুচি- আলুর দম , বাক্সভর্তি কড়াপাকের সন্দেশ , জলের বোতলে  জল , আর পেল্লায় সবুজ রঙের হোল্ডল ----  বাঙ্গালীর বেড়াতে যাওয়ার অনিবার্য অনুষঙ্গ ছিলো – এই প্রজন্ম যদিও তার খবর রাখে না ।  ভাবুনতো আপনার কোথাও যাবার তাড়া আছে , পরিবারের কর্ত্রী যদি " চট করে কটা লুচি ভেজে দিই" বলার পরিবর্তে বলে " কটা রুটি সেঁকে দিই" , আপনি কি একটু ইনসিকিওর্ড বোধ করবেন না ।  এমনকি  বাঙ্গালীর আল্টিমেট পরকীয়ার সাথেও কিন্তু লুচির অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে । কিরণময়ী যদি রান্নাঘরে লুচি ভাজতে ভাজতে উপেন্দ্রকে নিজের মনের কথাটা না বলতো , চরিত্রহীন উপন্যাসের ট্র্যাজেডিটা দাঁড়াতো কি ! 

                                অবশ্য একথা ঠিক সবার হাতে লুচি ঠিক ফোলে না । ফুলকো লুচি ভাজা , থোড় , মোচা আর ডুমুর কোটা , আর তিলের নাড়ুর সঠিক পাক দেওয়া ---- এই তিনটে হলো গিয়ে বাঙ্গালী গৃহিণীর সুরন্ধনকারীনি হওয়ার লিটমাস টেস্ট । মনে করুনতো পারমিতার একদিন ছবিটার কথা , সনকা ( অপর্ণা সেন)  টিভিতে আদর্শ হিন্দু হোটেল সিরিয়াল দেখছেন , দুই পুত্রবধু লুচি ভাজছে , স্বামী দুলাল লাহিড়ী খেঁকিয়ে উঠলেন লুচির  গুণমান নিয়ে । বিরক্ত সনকা উঠে লুচি ভাজতে বসলো , আর আমরা পর্দায় ফুলকো লুচি দেখলাম --- ছবিটির জন্য প্রয়োজনীয় উত্তর কলকাতার মধ্যবিত্ত জীবনের আবহটি কেমন তৈরি হয়ে গেলো । আসলে লুচি ফোলানোর একটি মেধাবী টেকনিক আছে , সেটি হলো খুব গরম তেলে লুচির লেচি ছেড়ে দিয়ে খুন্তি দিয়ে লেচির ধারটা আলতো করে চাপ দিতে হয় , তবেই লুচি ফোলে । 

                        আজ বাঙ্গালী আন্তর্জাতিক হয়েছে , তার বিবাহ অনুষ্ঠান থেকে লুচি ব্রাত্য হয়ে গেছে , এই প্রজন্মও বোধ করি জাঙ্ক ফুডের আকর্ষণে এই সব আটপৌরে খাবারের স্বাদ প্রায় ভুলতে বসেছে । আজ কষ্ট হয় সেইসব ছেলেমেয়েদের জন্য , যারা কে এফ সি , ম্যাকডোনাল্ডস , ডোমিনোজের পাঁউরুটি চিনলো কিন্তু ঘরোয়া হেঁশেলের লুচি – তরকারির অনুপম স্বাদ জানলো না ।

(লেখা ও ছবি সংগৃহীত)

মঙ্গলবার, ২৩ জুলাই, ২০১৯

মোদীজি কথা রাখেননি ~ অর্জুন দাশগুপ্ত

লোকপাল বিল মনে আছে। মনমোহন সিং সরকারের সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে লোকপাল একটা জোরালো অস্ত্র মনে করা হয়েছিলো। আন্না হাজারে অনশন করলেন। সাথে কিরণ বেদী, ভি কে সিং। 
তারপর মোদীজি ক্ষমতায় এলেন। কিরণ বেদী, ভি কে সিং বিজেপিতে চলে গেলেন। 
আর লোকপাল বিল ?? বিশ বাঁও জলে।

হুইসেল ব্লোয়ার আইন।
যখন কোনো ছোটো অফিসার বা কেরানি উচ্চপর্যায় দুর্নীতির সন্ধান পায়, এবং নিজের চাকরি, পরিবার, জীবন বাজি রেখে তা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করে তখন তাকে আইন করে সমাজের হায়না, কুকুরদের হাত থেকে রক্ষা করা সরকারের কর্তব্য। 
আমাদের দেশে এমন একটি আইন হয়েছিল ২০১৪ সালে। মোদিবাবু ৫ বছরে এখনো তা প্রণয়ন করতে পারেন নি।

তথ্যের অধিকার বা রাইট টু ইনফরমেশন আইন, দেশের সাধারণ গরীব লোকেদের হাতে এক শক্তিশালী অস্ত্র । সরকার তোমাকে জানাতে বাধ্য।কোন খাতে কত খরচ, আর বাবুদের নিয়ম দেখিয়ে  চেপে যাওয়া যাবে না।
কাল সংসদে এই আইনটির দাঁত নখ ভেঙে দিলেন মোদি সরকার। 

তিনটি আইন, গরিব মধ্যবিত্তদের হাতে জোরালো তিনটি অস্ত্র। সমাজের পচন আটকানোর তিনটি জীবনদায়ী ওষুধ, নষ্ট করে দেওয়া হলো।

ঠিক কাকে কাকে আড়াল করতে চাইছেন মোদীজি?

শুক্রবার, ১৯ জুলাই, ২০১৯

মা দুগ্গার বর ~ মনিপর্ণা সেনগুপ্ত মজুমদার

কাল রাত দু'টো নাগাদ বারান্দায় ফুল দেখতে গেছি, হঠাৎ দেখি একেবারে সামনে সাক্ষাৎ জগৎ জননী মা দুগ্গা দাঁড়িয়ে! হেব্বি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিলাম কারণ, দেখি দিব্যি দু'খানা মাত্র হাত। বাকি আটটা হাত কোন অজুহাতে কোথায় রেখে এসেছেন জিগানোর আগেই একেবারে খ্যাক খ্যাক করে উঠলেন, 

-- এত রাত অবধি জেগে থাকিস। বাদুড়ের মত ঘুরঘুর করিস সারা বাড়িময়, লজ্জা করে না? নির্ঘাৎ সিঁধেল চোর ছিলি আগের জন্মে... চিত্রগুপ্ত-কে শুধোলেই জানা যাবে... 😡

-- অপরাধ নিও না, মা। এই বেগমবাহার গাছে কুঁড়ি এসেছে, তা, দেখতে এসেছিলাম যে ফোটা'র কাজ কদ্দূর এগোলো। সব শা... ইয়ে মানে শান্তি নেই, জানো তো 😟 গাছগুলো পর্যন্ত তাড়া না লাগালে ঠিকঠাক কাজ করে না...(রাতদুপুরে উনি রোঁদে বেরিয়েছেন কেন, জিজ্ঞেস করা'র ইচ্ছে থাকলেও সাহস পেলাম না)

-- (কিঞ্চিৎ নরম হয়ে) গাছ-ফাছ লাগিয়েছিস ভাল কথা। ঠিকমত দেখভাল করবি। যা অবস্থা করে রেখেছিস দেশটা'র! 

বাই দ্য ওয়ে, ভাবছিস আমি কেন এত রাতে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তাই তো?  শোন রে অর্বাচীন, আমি মাঝেমাঝেই হারুন-অল-রশিদ-এর মত নিজের রাজ্যপাট ঘুরে ঘুরে দেখি। সামনেই তো তোদের মোচ্ছব আসছে আমায় নিয়ে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে ঘোড়াড্ডিমের প্যান্ডেল করবি কিন্তু ভুলেও ক'টা পুকুর কাটবিনা বা গাছ লাগাবিনা। ওই সব ইয়ের (খুব সন্দেহ হল বাল বলতে গেছিলেন :( ) প্যান্ডেল আমি দেখতেও যাইনা, বুঝলি? 

-- বুঝেছি, মা। ইয়ের প্যান্ডেল দেখতে আমিও যাইনা বেশ কয়েক বছর হল। তেঢ্যাঙা একটা কিম্ভূত টাইপ করে তোমাকে বানিয়েছিল একবার...ক্কি বলবো মা, সেলফিতে সেলফিতে ফেসবুক ভরে গেছিল গো... সেবার পর্যন্ত আমি যাইনি! এইসব প্যান্ডেল যারা বানায়, তাদের মাথায় চাম-উকুন দাও, মা... লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি, অর্বুদ নির্বুদ চাম-উকুন.... চুলকিয়ে মরুক বোকাইয়ের দল! 😠😠

-- এমনি উকুন দিলে কাজ হবেনা বলছিস? (একটু চিন্তিত দেখায় মা-কে) 

-- আহা! হবেনা কেন, কিন্তু টেকো যারা? তারা তো মজাসে পার পেয়ে যাবে, না?  চাম-উকুন বেস্ট। চাই কী মাথা-পেট-গুহ্যদ্বার .... সব জায়গায় দাও...😊

-- হুঁ। ঠিক বলেছিস। তোর ওপর আমি বেশ খুশি হয়েছি। বর নিবি? 

-- (আঁতকে উঠে)  নান্নান্নান্নান্না!!😢😢😢😢 তুমি এসো গিয়ে!!!!

-- আরে, দূর পাগলী, এ বর সে বর নয়। ইচ্ছেপূরণ বলছি... 

-- (কিঞ্চিৎ ধাতস্থ হয়ে) ওঃ! 

তাহলে, মা, (আহ্লাদী আদুরে স্বরে) আমার কত্তদিনের শখ একটা আসলি মসলিন-এর উপর, ওই যেগুলো নাকি আংটি দিয়ে গ'লে যেত, বুঝলে তো, ওই মসলিন, ১৮ ক্যারাট সোনার জরি দিয়ে ইন্ট্রিকেটলি এমব্রয়ডারি করা শাড়ি, সব্যসাচী এক্সক্লুসিভলি আমার-ই জন্য বানাবে...😍😍 প্লিজ, মা, প্লিজ...

-- (ভেংচি কেটে) আমারই জন্য বানাবে! ইঃ! শখ দ্যাখো! ন্যাতা জাম্বুবানি এসেছেন আমার!!  ঠিকঠাক কিছু চাওয়ার থাকলে, বল। 

-- (গোঁ গোঁ করে) এক কাজ করো তাহলে। বর দাও যে, সারাদিনে একটিমাত্র ঘন্টা রোজ আমার নিজের জন্য বরাদ্দ হবে। ওই এক ঘন্টা কেউ যেন আমায় ডিস্টার্ব করতে না পারে। নো অফিশিয়াল ফোন কল, নো মা আমার জিন্স কোথায়, নো বৌদি আজ কী রান্না হবে, নো মা'র ব্লাড সুগার রিপোর্ট আনতে হবে, নো এই যে বাজারটা রাখো, নো একি বাথরুমের কল কে ঠিকমতন বন্ধ করেনি, নো....

আবেগের বশে বেগ এসে গেছিল, বলেই যাচ্ছিলাম। এন্ডলেস লিস্ট। কিন্তু এই অবধি শুনেই কী হল কে জানে 😢 মা হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠে "তুই একটা পাষণ্ড, নরাধম... যা আমার নিজের নেই, তা তোকে আমি কী করে দেব রে...উফ! মনে করিয়ে দিল সব...!!!" বলতে বলতে সাঁত করে মিলিয়ে গেলেন। 

ভগ্ন হৃদয়ে বসে রইলাম 😟😟

শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০১৯

ইস্কনকে ৭০০ একর জমি ~ মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায়

এটা করবেন না, প্লিজ। একটা ধর্ম নিরপেক্ষ দেশে এটা করবেন না। এটা করা যায় না। এখনো আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় লেখা আছে, ভারত এক ধর্মনিরপেক্ষ দেশ।

নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে এটা করবেন না। 
এখনো এই দেশের অধিকাংশ মানুষ বুঝে, না বুঝে মেনে চলেন সোয়া দুই হাজার বছর আগের অশোকের শিলালিপির মহান সত্যকে। সভ্যতার প্রথম দার্শনিক পদক্ষেপকে।
There should not be honour of one's own (religious) sect and condemnation of others without any grounds — Ashoka, Rock Edicts XII, about 250 BCE.

সেই দেশের এক নাগরিকের, সেই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারীর অনুরোধ - এটা করবেন না।

কোন প্রয়োজন নেই শ্মশান-ব্রাহ্মণদের ভাতা দেবার। ওদের প্রতি কিন্তু কোন অসূয়া নেই। তবে প্রশ্ন, কেন এক সেক্যুলার দেশে ওরা সরকারি ভাতা পাবেন। কি ভিত্তিতে এই সরকারি বদান্যতা ঠিক হলো! ওদের থেকে গরিব মানুষ কি নেই এই রাজ্যে, এই শহরে! 

কেন ধর্মের ভিত্তিতে, বর্ণের ভিত্তিতে একবিংশ শতকে এই কলকাতা শহরে গুটিকয় মানুষ সরকারি ভাতা পাবেন! শুধু তারা হিন্দু ব্রাহ্মণ বলে!
যেই রকম অনিষ্ট হয়েছে মৌলবী ও মুয়াজ্জিনদের ভাতা দিয়ে, ঠিক তেমনই অমঙ্গল হবে এই শ্মশান ব্রাহ্মণদের ভাতায়। 

এই ক্ষতি একদিনে বোঝা যাবে না, এই ক্ষতি দীর্ঘমেয়াদি। যেমন বোঝা যায় নি মৌলবীদের ভাতায় ও অন্য বহু অনুষাঙ্গিকে।

এতে মানুষের সাথে মানুষের ব্যবধান শুধু বাড়বে, কমবে না।

ইস্কনের প্রেক্ষাপট অনেকের জানা; ওদের নিজেদের ধর্ম প্রচারের যথেষ্ট অর্থ আছে। সেই ইস্কনে গিয়ে ঘোষণা হলো সরকার ওদের ৭০০ একর জমি দেবে। কেন? ওরা ধর্ম প্রচার করছেন দীর্ঘদিন ধরে। অসুবিধা তো হয় নি। কেন ওরা সরকারি জমির সুবিধা পাবে! 

বরং সেই জমিতে শিল্প হলে বহু মানুষের দীর্ঘমেয়াদি লাভ হবে। সরকারি প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হবে।

ওদের জমি দিলে আরো যত হিন্দু, মুসলমান, শিখ, বিভিন্ন আদিবাসী উপগোষ্ঠী আছে - তারা কেন পাবে না?  এই দাবি আজকে না হলেও কালকে যে উঠবে। 

সবচাইতে বড় কথা সরকারের কাজ কি? ধর্মের ভিত্তিতে জমি, ভাতা দেওয়া নাকি রাজ্যের মানুষের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন করা!

ধর্মের ভিত্তিতে ভোট চাইবার বদ অভ্যাস অনেকদিনের, তবু দুঃখের সাথে বলি, স্বাধীনতা পরবর্তী কালে এই রাজ্যে এ জিনিস আগে দেখি নি। ধর্মের, তার বর্ণের, তার মুরুব্বিদের সরকারি ভাতা আসলে দীর্ঘদিনের বিভেদের শক্তির সরাসরি সরকারি বিধিবদ্ধ তোষণ। এর সাথে সাধারণ মানুষের, তাদের ধর্মাচারণের সম্পর্ক নেই।

আর, একটা ভুল দিয়ে আগের ভুলকে শুদ্ধ করা যায় না। 

ইস্কনে ৭০০ একর জমি ও কলকাতা শহরে শ্মশান-ব্রাহ্মণদের ভাতা দিয়ে রামের বিরুদ্ধে লড়াই চলে না। ধর্ম দিয়ে ধর্মের লড়াই হয়েছে মধ্য যুগে, ক্রুসেডে। কংগ্রেস সেই নরম হিন্দুত্ব প্রচেষ্টা নিয়েছে, হেরে ভুড্ডু হয়ে গেছে।

সে পথ পরিত্যক্ত। 

বড় বড় বক্তৃতায় গাল  ভরবে না, ভাতাতে খাঁই মিটবে না, জমিতে অসন্তোষ প্রশমিত হবে না, ভাষার আবেগ কাজ করবে না।

মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের অসম্মানের প্রচেষ্টার লড়াই দীর্ঘমেয়াদি। 

তার জন্য দরকার ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, রাজ্য ব্যতিরেকে মানুষকে একজোট করা, মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করা।

আম্বেদকর  বলেছিলেন,  Democracy is not merely a form of government. .. It is essentially an attitude of respect and reverence towards fellow men.

সেই সম্মান হারিয়ে যাচ্ছে। সেই মর্যাদা নষ্ট হচ্ছে। তাকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব সকলের। 


সোমবার, ১ জুলাই, ২০১৯

চিকিৎসক দিবস ~ ড: রেজাউল করীম

আজ চিকিৎসক দিবস। চিকিৎসকদের উপর লাগাতর নিগ্রহের বিরুদ্ধে আজকের দিন পালন করা হচ্ছে। গতকাল একজন সাংবাদিকের কাছে শুনলাম, কলকাতার হাসপাতালে নিরাপত্তা বাড়ানো হচ্ছে। শুনে ভালই লাগছে,  তবে আশঙ্কা আছে ষোল আনা। সেই অধুনা বিখ্যাত সভার পর ও প্রায় তিনটি ভাঙচুরের ঘটনা এই এত দূরে থেকেও আমি জানতে পারলাম, জানিনা হয়তো আরো বেশি ঘটেছে। যাক, আশা করি অবস্থার পরিবর্তন হবে। সারা দেশে চিকিৎসকদের সম্প্রদায় হিসেবে আক্রমনের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। যে পারস্পরিক ঘৃণা সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ছড়িয়ে পড়ছে, তা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মানুষের অসহায়তা, ক্ষোভ আর হতাশা বাড়ছে প্রতিদিন আর সে তার সব দুর্ভাগ্যের কারণ হিসেবে একটা অদৃশ্য প্রতিপক্ষ খাড়া করে সুখ খোঁজার চেষ্টা করছে। আমার দুর্ভাগ্যের জন্য আমি দায়ী নই, রাম-শ্যাম-হাসিম শেখরা দায়ী।
অনেক দুর্ভাগ্যের ইতিহাস রচিত হয়েছে পৃথিবীতে। আরো হবে কেননা অন্ধ ক্রোধ তার লেলিহান আগুনে সবাইকে জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য তৈরী হয়ে আছে। সেসব কথা কার্পেটের তলায় ঠেলে দিয়ে বরং ভাল ডাক্তার হওয়ার চেষ্টা করা যাক। দেশ, জাতি, পৃথিবী, জল-সঙ্কট, ধর্মীয় উন্মাদনা নিয়ে বাকিরা মাথা ঘামাক, আমরা ডাক্তার, ওগুলো নিয়ে বিশ্ব মাথা খুঁড়লেও আমাদের দরকার নেই!!!!

যাঁর জন্মদিন আজ পালন করছি, তিনি তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ওয়েলিংটন থেকে রাইটার্স যেতেন। সকালে বেলা হাতে গোনা কয়েকটি রোগী দেখতেন। আগে থেকে নাম লেখাতে হতো। একটা লোক রোজ এসে দাঁড়িয়ে থাকে, নাম লেখানো নেই, তাই দেখাতে পারে না। রায়বাবু দু চারদিন লোকটিকে খেয়াল করে শেষে একদিন বিরক্ত হয়ে ডেকে পাঠালেন।"কিহে, রোজ রোজ এসে দাঁড়িয়ে থাকো! ব্যাপার কি?:
-আজ্ঞে, আপনাকে দিয়ে চিকিচ্চে করাতে চাই।
-তা রোগীটি কে হে?
-আজ্ঞে, আমি।
বিধানবাবু, একবার তাকিয়ে ভাল করে দেখলেন তাকে তারপর বললেনঃ না হে, এ রোগ সারার নয়। তাছাড়া, আমার আজ সময় ও নেই। তুমি বরং কাল এসো গিয়ে।
পরদিন লোকটি আসতেই তার হাতে একটা চিঠি দিয়ে বললেনঃ এটা নিয়ে রাইটার্সে যাও, আমার সেক্রেটারির সাথে দেখা করো। দারিদ্র কি আর ওষুধ দিয়ে সারে?
 এই গল্পটি আমি তাঁর একজন রোগীর কাছে আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে শুনেছিলাম। তবে, ঘটনাটা মনে হয় বানানো নয়, কারণ বিমল মিত্র  মহাশয় ও প্রায় একই ধরনের একটি ঘটনা লিখেছেন।
এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের মূল যে সব মারণ রোগ নিয়ে  চিন্তা করার দরকার, আর সরকার যে সব রোগের জন্য পয়সা খরচা করতে চান, তার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। সরকার অপুষ্ট, নিরক্ত, অভুক্ত মানুষের কাছে চাকচিক্য খচিত নীল সাদা বাড়ি দিয়েছেন, তাতে ঘুঘু চরলেও কিছু যায় আসে না, ভোটের হিসেব আর মানুষের দুর্দশা দূর করা পরস্পরের ব্যস্তানুপাতিক। যে সীমাহীন শৈথিল্য টিকাকরণ কর্মসূচিতে দেখানো হচ্ছে, সব শিশুঘাতী মারণরোগ ফিরে আসলেও অবাক হবো না। 
এক পুরোপুরি নিরাপত্তাহীন জাতির চিকিৎসকের নিরাপত্তার জন্য ঢাল, তলোয়ারহীন কয়েকটা সেপাই আর যারা লুটেপুটে দেশটাকে ছিবড়ে করে মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, তাদের জন্য কমাণ্ডো!!!

তবু, চিকিৎসক দিবস এসেছে। সবাই মিলে তাকে সফল করতে হবে। গুরুদেব বলেছেনঃ
"আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
 তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ॥" 
মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও কি অট্টালিকা বানাই না!  তাই, কি বলে, আজকের এই পুণ্যলগ্নে যে ভালবাসার রস ফেসবুক আর হোয়াটসাপ বাহিত অমৃতের চাঙড় নিয়ে আসছে, তাকে স্বাগত জানিয়ে শুরু হোক আজকের দিন।