রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৩

কবি 'দিনেশ দাস'এর জন্ম-শতবার্ষিকীতে ~ অরুণাচল দত্ত চৌধুরী

নতুন চাঁদের বাঁকা ফালিটি,
তুমি বুঝি খুব ভালবাসতে?
চুপ! কাস্তের কথা আর নয়!
অসময়। কথা বল আস্তে।

শতক পাল্টে গেছে যদিও
ইতিহাস ঘোরে চেনা বৃত্তে
কালাশনিকভে নেই বেয়নেট
তবু তুমি পারছনা জিততে

অজ্ঞাতবাসকাল পেরিয়ে
নিজে নিজে হয়ে গেছ ত্রস্ত
কী করে ভুলেছ তুমি বলোতো
কোন শমীডালে ছিল অস্ত্র?

এখানে ওখানে কিছু ছিটিয়ে…
জং ধরা তার অধিকাংশ
তোমার নিজের প্রিয় আয়ুধে
লেগে মৃত সময়ের মাংস।

স্মৃতি ফিরে পাও। ছিঁড়ে ফেল সব
ছদ্মবেশের ভুল ধারণা।
চাঁদের আদলে প্রিয় কাস্তে
তোমারই তা'। জেনো, আর কারও না।

শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৩

জীবন ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য

এই তো রে, বেশ ভালোই আছি... দিব্যি!
ছুটকো ছাটকা, ও কিছু নয়, ঝঞ্ঝাট।
মোটের ওপর পৃথিবী খুব সুন্দর।
জীবন মানেই তাপ্পিমারা প্যান্ট শার্ট!
এই তো, কেমন হাসছি তোদের সঙ্গে!
কেউ কখনো দেখলি আমার কান্না?
চোখের জলে নাকের জলে ভাসতে?
নালিশ সালিশ অনেক হলো, আর না।
এই তো, আমি কক্ষণো নই দুঃখী।
পাইনি খানিক, পেয়েওছি তো একঝাঁক!
সব হিসেবের নিকেশ হবে শিগগির,
এই তো ক'দিন, মন, ততদিন চুপ থাক!

মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৩

নদী, আমি, ওরা ... ~ অমিতাভ প্রামাণিক

আমাদের সবই ছিল, আদিগন্ত তীব্র শ্যামলিমা,
ধানী জমি, ফল-ফুল, শতাব্দীপ্রাচীন মহীরুহ।
তিন তিনখানা নদী জুড়ে ছিল শৈশবগরিমা,
অথচ কাদের পাপে সবই হয়ে গেল চক্রব্যূহ!

চঞ্চলা ইছামতী, তার ছিল মহিমা অপার –
কবে হল জরাগ্রস্তা, ভুলে গেল যৌবনবারতা।
কখনো নদীর ঘাটে বসে কি শুনেছ হাহাকার?
এপার-ওপার খেয়া বন্ধ হলে মাঝি যাবে কোথা?

আমাদের বাল্যকাল ধোয়া ছিল যার নদীজলে,
শুধু অবহেলা পেয়ে সে শুকিয়ে গেল সহজেই।
ওপারে সর্বসুখ যারা বলে, তারা ভুল বলে,
আমি জানি, ওপারেও ওরা আজ খুব ভালো নেই।

ওরাও তো আমরাই, জানতো তা নদী-মাঝি-খেয়া।
কখন যে 'ওরা' হল, শুভদিন ফিরলো না সে আর!

১৭ ডিসেম্বর ২০১৩

মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৩

অমল ও বইওয়ালা (নো অফেন্স মেন্ট!) ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য়

বইওআলা। বই -- বই -- ভালো বই!

অমল। বইওআলা, বইওআলা, ও বইওআলা!

বইওআলা। ডাকছ কেন? বই কিনবে?

অমল। কেন কিনব! আমি তো ই-বুক পড়ি।

বইওআলা। কেমন ছেলে তুমি। কিনবে না তো আমার বেলা বইয়ে দাও কেন?

অমল। আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতুম তো অন্য ব্যবসা করতুম।

বইওআলা। অন্য ব্যবসা!

অমল। হাঁ। তুমি যে কত হাঁক পেড়েও কিছু বিক্রী করতে পারছ না তা দেখে আমার মন খারাপ লাগছে।

বইওআলা। (বইর ব্যাগ নামাইয়া) বাবা, তুমি কি বিজনেস কনসাল্ট্যান্ট?

অমল। আমি তো ফেসবুকের ওপর ডক্টরেট করছি তাই আমি সারাদিন ল্যাপটপ খুলেই বসে থাকি।

বইওআলা। আহা, বাছা তোমার কী হয়েছে?

অমল। আমি বড় হয়েছি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শিখেছি। বইওআলা, তুমি কোথা থেকে আসছ?

বইওআলা। আমাদের গ্রাম থেকে আসছি।

অমল। তোমাদের গ্রাম? অনে--ক দূরে তোমাদের গ্রাম?

বইওআলা। আমাদের গ্রাম সেই পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায়। শামলী নদীর ধারে।

অমল। পাঁচমুড়া পাহাড় -- শামলী নদী -- কী জানি,হয়তো গুগল ম্যাপে তোমাদের গ্রাম দেখেছি -- কবে সে আমার মনে পড়ে না।

বইওআলা। তুমি দেখেছ? পাহাড়তলায় কোনোদিন গিয়েছিলে নাকি?

অমল। না, কোনোদিন যাই নি। কিন্তু আমি ছবি দেখেছি। অনেক পুরোনোকালের খুব বড়ো বড়ো গাছের তলায় তোমাদের গ্রাম -- একটি লাল রঙের রাস্তার ধারে। না?

বইওআলা। ঠিক বলেছ বাবা।

অমল। সেখানে পাহাড়ের গায়ে সব গোরু চরে বেড়াচ্ছে।

বইওআলা। কী আশ্চর্য! ঠিক বলছ। আমাদের গ্রামে গোরু চরে বই কি, খুব চরে।

অমল। মেয়েরা সব নদী থেকে জল তুলে মাথায় কলসী করে নিয়ে যায় -- তাদের লাল শাড়ি পরা।

বইওআলা। বা! বা! ঠিক কথা। আমাদের সব গয়লাপাড়ার মেয়েরা নদী থেকে জল তুলে তো নিয়ে যায়ই। তবে কিনা তারা সবাই যে লাল শাড়ি পরে তা নয় -- কিন্তু বাবা, তুমি নিশ্চয় কোনোদিন সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলে!

অমল। সত্যি বলছি বইওআলা, আমি একদিনও যাই নি। ঘরে বসেই যদি সব জানা যায় তাহলে কী দরকার গিয়ে তোমাদের গ্রামে?

বইওআলা। ঠিক কথা বাবা, খুব সত্যি কথা!

অমল। আমি বরং তোমায় অনলাইন বই বেচতে শিখিয়ে দেব। ঐরকম ব্যাগ কাঁধে নিয়ে -- ঐরকম খুব দূরের রাস্তা দিয়ে আর তোমাকে ঘুরে বেড়াতে হবে না।

বইওআলা। মরে যাই! বই বেচতে যাব কেন বাবা। আমি আর তুমি মিলে বরং ও এল এক্স এর মতো কিছু সাইট খুলব।

অমল। না, না, আমি কক্‌খনো অনলাইনে ব্যবসা করব না। আমি একটা বিজনেস কন্সাল্টেন্সি ফার্ম খুলব। একে ওকে শুধু উপদেশ দেব, প্রয়োজনে ট্রেনিং ও দেব।

বইওআলা। হায় পোড়াকপাল! এ কেরিয়ার ও কি কোনো কেরিয়ার হল!

অমল। না, না, এ আমার অনেক দিনের স্বপ্ন। ওয়াই ফাই খুব স্ট্রং হলে যেমন অনেক দূর থেকে নেট কানেক্ট করা যায় -- তেমনি ঐ রাস্তার মোড় থেকে ঐ গাছের সারির মধ্যে দিয়ে যখন তোমার ডাক আসছিল, আমার মনে হচ্ছিল – ফেসবুকে ডক্টরেট করা হয়ে গেলে আমাকে কন্সাল্টেন্সি ফার্ম খুলতেই হবে!

বইওআলা। বাবা, এই এক ব্যাগ বই তুমি রাখো।

অমল। আমার তো বাজেট অ্যালোকেটেড নেই।

বইওআলা। না না না না -- বাজেটের কথা বোলো না। আমার বইগুলো বিদেয় হলে আমি কত খুশি হব।

অমল। তোমার কি অনেক দেরি হয়ে গেল?

বইওআলা। কিচ্ছু দেরি হয় নি বাবা, আমার কোনো লোকসান হয় নি। বই বেচা যে কত ওয়েস্ট অফ টাইম সে তোমার কাছে শিখে নিলুম।

সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৩

গেছো দাদার পপাত চ ~ অনির্বান সরকার

​বেজায় পেট গরম। AC চালিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছি, তবু ঘেমে অস্থির।।কাল আবার ডার্বি। ..আবার হার?| টেবিলের উপর রুমালটা ছিল, ঘাম মুছবার জন্য যেই সেটা তুলতে গিয়েছি অমনি রুমালটা বলল ``মাচা !'' কি আপদ! রুমালটা মাচা মাচা করে কেন?
চেয়ে দেখি রুমাল তো আর রুমাল নেই, দিব্যি মোটা-সোটা লাল টক্‌টকে একটা বেড়াল গোঁফ ফুলিয়ে প্যাট্ প্যাট্ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে!
আমি বললাম, ``কি মুশকিল! ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল।''
অমনি বেড়ালটা বলে উঠল, ``মুশকিল অবার কি? ছিল একটা পোকা , হয়ে গেল দিব্যি একটা মাছ । এ তো হামেশাই হচ্ছে।''
আমি খানিক ভেবে বললাম, ``তা হলে তোমায় এখন কি বলে ডাকব? তুমি তো সত্যিকারের বেড়াল নও, আসলে তুমি হচ্ছ রুমাল।''
বেড়াল বলল, ``বেড়ালও বলতে পার, রুমালও বলতে পার, অবনমন ও বলতে পার।'' আমি বললাম, ``অবনমন কেন?''
শুনে বেড়ালটা ``তাও জানো না?'' বলে এক চোখ বুজে ফ্যাচ্‌ফ্যাচ্ করে বিশ্রীরকম হাসতে লাগল। আমি ভারি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মনে হল, ঐ অবনমন এর কথাটা নিশ্চয় আমার বোঝা উচিত ছিল। তাই থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম, ``ও হ্যাঁ-হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি।''
বেড়ালটা খুশি হয়ে বলল, ``হ্যাঁ, এ তো বোঝাই যাচ্ছে--- অবনমন এর মা , বেড়ালের চন্দ্রবিন্দু, রুমালের চা --- হল মাঁচা । কেমন, হল তো?''
আমি বললাম, ``চন্দ্রবিন্দু কেন?' বেড়ালটা আবার হাসলো -- "এটাও বুঝতে পারছ না ভায়া?"
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, কিন্তু পাছে বেড়ালটা আবার সেইরকম বিশ্রী করে হেসে ওঠে, তাই সঙ্গে সঙ্গে হুঁ-হুঁ করে গেলাম। তার পর বেড়ালটা খানিকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাত্‍‌ বলে উঠল, ``গরম লাগে তো সেকেন্ড ডিভিশন এও তো খেলতে পারো।''
আমি বললাম, ``বলা ভারি সহজ, কিন্তু বললেই তো আর সেটা করা যায় না?''
বেড়াল বলল, ``কেন, সে আর মুশকিল কি?''
আমি বললাম, `পাবলিক এর ভয় , সমর্থকেরা কি বলবে? তুমি কোনো উপায় জানো? তাহলে বাতলে দাও ''
বেড়াল একগাল হেসে বলল, ``তা আর জানি নে? কলকাতা , ডায়মন্ডহারবার, রানাঘাট, তিব্বত, ব্যাস্! সিধে রাস্তা, সওয়া ঘণ্টার পথ, তারপর শীর্ষাসন , কঠিন অনুশীলন , no ফাকিবাজি। মাঝে মাঝে প্রাণায়াম ও করতে পারো তো , খুব কাজের জিনিস ।''
আমি বললাম 'প্রাণায়াম করলেই জিতে যাবো?'
বেড়াল রেগে গিয়ে বলল 'সেটা আমি কখন বললাম ।ওটা করলে ধৈর্য বাড়বে । হার টাকে sportingly মেনে নিতে পারবে '
আমি বললাম, ``'তা হলে দায়িত্ব টা তুমি নিতে পার?''
শুনে বেড়ালটা হঠাত্‍‌কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। তার পর মাথা নেড়ে বলল, ``উঁহু, সে আমার কর্ম নয়। আমার গেছোদাদা যদি থাকত, তা হলে সে ঠিক-ঠিক বলতে পারত।''
আমি বললাম, ``গেছোদাদা কে? তিনি থাকেন কোথায়?''
বেড়াল বলল, ``গেছোদাদা আবার কোথায় থাকবে? Austrelia''
আমি বললাম, ``কোথায় গেলে তাঁর সাথে দেখা হয়?''
বেড়াল খুব জোরে মাথা নেড়ে বলল, সেটি হচ্ছে না, সে হবার জো নেই।''
আমি বললাম, ``কিরকম?''
বেড়াল বলল, ``সে কিরকম জানো? মনে কর, তুমি যখন যাবে উলুবেড়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন মতিহারি গাঁজার ঠেকে। যদি মতিহারি যাও, তা হলে শুনবে তিনি আছেন রামকিষ্টপুর দুগ্গা পুজোর ভাসানে। আবার সেখানে গেলে দেখবে তিনি গেছেন কাশিমবজার ছট পুজো কমিটির মিটিং attend করতে । কিছুতেই দেখা হবার জো নেই।''
আমি বললাম, ``তা হলে তোমরা কি করে দেখা কর?''
বেড়াল বলল, ``সে অনেক হাঙ্গাম। আগে হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় নেই; তার পর হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় থাকতে পারে; তার পর দেখতে হবে, দাদা এখন কোথায় আছে। তার পর দেখতে হবে, সেই হিসেব মতো যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছবে, তখন দাদা কোথায় থাকবে। তার পর দেখতে হবে---''
আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম, ``সে কিরকম হিসেব?''
বেড়াল বলল, ``সে ভারি শক্ত। জ্যামিতি ছিল ছোটোবেলায়?'' এই বলে সে একটা কাঠি দিয়ে ঘাসের উপর লম্বা আঁচড় কেটে বলল, ``এই মনে কর গেছোদাদা ।'' বলেই খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে চুপ করে বসে রইল।
তার পর আবার ঠিক তেমনি একটা আঁচড় কেটে বলল, ``এই মনে কর তুমি,'' বলে আবার ঘাড় বাঁকিয়ে চুপ করে রইল।
তার পর হঠাত্‍‌ আবার একটা আঁচড় কেটে বলল, ``এই মনে কর চন্দ্রবিন্দু।'' এমনি করে খানিকক্ষণ কি ভাবে আর একটা করে লম্বা আঁচড় কাটে, আর বলে, ``এই মনে কর তিব্বত---'' ``এই মনে কর গেছোবৌদি ইলিশ রান্না করছে---'' ``এই মনে কর গাছের গায়ে একটা ফুটো---ইলিশ ভাপা ,ইলিশ পাতুরি, দৈ ইলিশ ... ''

এইরকম শুনতে-শুনতে শেষটায় আমার কেমন রাগ ধরে গেল। আমি বললাম, ``দূর ছাই! কি সব আবোল তাবোল বকছে, একটুও ভালো লাগে না .... ক্ষিদে পাচ্ছে''
বেড়াল বলল, ``ও আচ্ছা, তোমার তো আবার পেট গরম ..ইলিশ হজম হবে না ।'' আমি চোখ বুজলাম।
চোখ বুজেই আছি, বুজেই আছি, বেড়ালের আর কোনো সাড়া-শব্দ নেই। হঠাত্‍‌ কেমন সন্দেহ হল, চোখ চেয়ে দেখি বেড়ালটা ল্যাজ খাড়া করে বাগানের বেড়া টপকিয়ে পালাচ্ছে আর ক্রমাগত ফ্যাচ্‌ফ্যাচ্ করে হাসছে।
কি আর করি, ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ব্যলকনিতে গিয়ে বসলাম । বসতেই কে যেন ভাঙা-ভাঙা মোটা গলায় বলে উঠল, ``লাস্ট কবে বড় ট্রফি হাতে নিয়েছ খোকা ?''
আমি ভাবলাম, এ আবার কে রে? এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি, এমন সময় আবার সেই আওয়াজ হল, ``কই জবাব দিচ্ছ না যে? শেষ কবে জিতেছ?'' তখন উপর দিকে তাকিয়ে দেখি, একটা দাঁড়কাক শ্লেট পেনসিল দিয়ে কি যেন লিখছে, আর এক-একবার ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে।
আমি বললাম, ``২০১২ ''
কাকটা অমনি দুলে-দুলে মাথা নেড়ে বলল, ``হয় নি, হয় নি, ফেল্।''
আমার ভয়ানক রাগ হল। বললাম, ``নিশ্চয় হয়েছে। ২০১২ কলকাতা ফুটবল লীগ।''
কাকটা কিছু জবাব দিল না, খালি পেনসিল মুখে দিয়ে খানিকক্ষণ কি যেন ভাবল। তার পর বলল, ``দু হাজার বারোর নামে হরিবল , হাতে রইল কাচকলা , ঘন্টার মাথা !''
আমি বললাম, ``তবে যে বলছিলে ২০১২ তে পাই নি ? এখন কেন?''
কাক বলল, ``কাচকলা কোনো ট্রফির নাম নয় । তুমি যখন বলেছিলে, তখনো পুরো ট্রফি হয় নি। ওটা ছিল, রানার্স ট্রফি । আমি যদি ঠিক সময় বুঝে ধরে না ফেলতাম, তা হলে এতক্ষণে ওটাকেই বড় ট্রফি বলে চালিয়ে দিতে ।''
আমি বললাম, ``এমন আনাড়ি কথা তো কখনো শুনি নি। ট্রফি মানে ট্রফি , তা সে বড় হোক ছোটো হোক অথবা পুচকে । তা সে পাড়ার খেলা হলেও ট্রফি আবার স্বান্তনা পুরস্কার হলেও ।''
কাকটা ভারি অবাক হয়ে বলল, ``তোমাদের ক্লাবে winners ট্রফির কোনো দাম নেই বুঝি?''
আমি বললাম, ``winners ট্রফি!! সেটা কিরকম?''
কাক বলল, ``পাসের ক্লাবে কদিন থাকতে, তা হলে বুঝতে।ওদের তো ট্রফি রাখার আর জায়গাই নেই ।প্রতি বছর এত্তগুলো করে । এই তো কদিন খেটেখুটে খানিকটে সময় জমিয়েছিলাম, তাও তোমার সঙ্গে তর্ক করতে অর্ধেক খরচ হয়ে গেল।'' বলে সে আবার হিসেব করতে লাগল। আমি অপ্রস্তুত হয়ে বসে রইলাম।
এমন সময়ে হঠাত্‍‌গাছের একটা ফোকর থেকে কি যেন একটা সুড়ুত্‍‌ করে পিছলিয়ে মাটিতে নামল। চেয়ে দেখি, দেড় হাত লম্বা এক বুড়ো, তার পা পর্যন্ত সবুজ রঙের দাড়ি, হাতে একটা হুঁকো তাতে কলকে-টলকে কিচ্ছু নেই, আর মাথা ভরা টাক। টাকের উপর খড়ি দিয়ে কে যেন কি-সব লিখেছে।
বুড়ো এসেই খুব ব্যস্ত হয়ে হুঁকোতে দু-এক টান দিয়েই জিজ্ঞাসা করল, ``কই হিসেবটা হল?কবে শেষ বার ট্রফি পেয়েছিল''
কাক খানিক এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, এই হল বলে।''
বুড়ো বলল, ``কি আশ্চর্য! উনিশ দিন পার হয়ে গেল, এখনো হিসেবটা হয়ে উঠল না?''
কাক দু-চার মিনিট খুব গম্ভীর হয়ে পেনসিল চুষল তার পর জিজ্ঞাসা করল, ``কতদিন বললে উনিশ ?তা সে লাগবে না সে কি আজকের কথা -- stone age ছিল তখন ''
কাক অমনি গলা উঁচিয়ে হেঁকে বলল, ``লাগ্ লাগ্ লাগ্ দু হাজার বারো ।''
বুড়ো বলল, ``এগারো ।'' কাক বলল, ``দশ ।'' বুড়ো বলল, ``নয় ।'' ঠিক যেন নিলেম ডাকছে।
ডাকতে-ডাকতে কাকটা হঠাত্‍‌ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ``তুমি ডাকছ না যে?''
আমি বললাম, ``খামকা ডাকতে যাব কেন? আমি তো জানি ২০০৯ সুপার কাপ ''
বুড়ো এতক্ষণ আমায় দেখে নি, হঠাত্‍‌আমার আওয়াজ শুনেই সে বন্‌বন্ করে আট দশ পাক ঘুরে আমার দিকে ফিরে দাঁড়াল।
তার পরে হুঁকোটাকে দূরবীনের মতো করে চোখের সামনে ধরে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার পর পকেট থেকে কয়েকখানা রঙিন কাঁচ বের করে তাই দিয়ে আমায় বার বার দেখতে লাগল। তার পর কোত্থেকে একটা পুরনো দরজির ফিতে এনে সে আমার মাপ নিতে শুরু করল, আর হাঁকতে লাগল, ``I League (ন্যাশনাল ফুটবল League) এ ১৩-১০ ,ফেডারেশন কাপে ৮-৫,Calcutta ফুটবল লীগ এ ৪৮-৪৩ , I.F.A. শিল্ড এ ২০-৭,ডুরান্ড কাপে ৮-৬, রোভার্স কাপে ৪-৪, এয়ারলাইন্স ট্রফি তে ৭-১ -- আর পারছি না আমি হিসেব করতে ।সর্ব সাকুল্যে ১১৫-৮৫।''
আমি ভয়ানক আপত্তি করে বললাম, ``এ হতেই পারে না। বুকের মাপও ছাব্বিশ ইঞ্চি, গলাও ছাব্বিশ ইঞ্চি? আমি কি ইলতুতমিস? নিশ্চই রেফারির কারসাজি । ব্যাটাদের বিশ্বাস নেই ''
বুড়ো বলল, ``বিশ্বাস না হয়, wikipedia দেখ।''
দেখলাম ফিতের লেখা-টেখা সব উঠে গিয়েছে, খালি ২৬ লেখাটা একটু পড়া যাচ্ছে, তাই বুড়ো যা কিছু মাপে সবই ছাব্বিশ ইঞ্চি হয়ে যায়।
তার পর বুড়ো জিজ্ঞাসা করল, ``ওজন কত?''
আমি বললাম, ``জানি না!''
বুড়ো তার দুটো আঙুল দিয়ে আমায় একটুখানি টিপে-টিপে বলল, `থাক অনেক হয়েছে ওটা সবাই জানে।২-৩ তো হবেই চোখ বুজে `।''
আমি বললাম, ``সেকি, পটল টার ওজনই তো একুশ সের, সে আমার চাইতে দেড় বছরের ছোটো।''
কাকটা অমনি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ``সে তোমাদের হিসেব অন্যরকম।''
বুড়ো বলল, ``তা হলে লিখে নাও--- ওজন আড়াই সের, বয়েস একশ চব্বিশ।''
আমি বললাম, ``দূত্‍‌!আমার বয়স হল আট বছর তিনমাস, বলে কিনা একশ চব্বিশ।''
বুড়ো খানিকক্ষণ কি যেন ভেবে জিজ্ঞাসা করল, ``বাড়তি না কমতি?'' কাক মাথা নিচু করে বলল , 'পড়তি । আবার ঝরতি ও বলতে পারো।'
আমি বললাম, ``সে আবার কি?''
বুড়ো বলল, ``বলি বয়েসটা এখন বাড়ছে না কমছে?''
আমি বললাম, ``বয়েস আবার কমবে কি? তবে লাস্ট ৫-৬ বছর ধরে কোনো হিসেব কাজ করছে না''
বুড়ো বলল, ``তা নয় তো কেবলই বেড়ে চলবে নাকি? তা হলেই তো গেছি! কোনদিন দেখব বয়েস বাড়তে বাড়তে একেবারে ষাট সত্তর আশি বছর পার হয়ে গেছে। শেষটায় ঝাপি বন্ধ হয়ে যায় আর কি ! যা দিন কাল লোকের ক্ষোভ ক্রমশ যে হারে বাড়ছে নতুন ফর্মুলা আবিস্কার না হয়ে যায় আবার ।আর ওদের ই বা দোষ কিসের এইটুকু আপদার তো থাকতেই পারে ।কষ্ট হয় দেখলে ''
আমি বললাম, ``তা তো হবেই। আশি বছর বয়েস হলে মানুষ বুড়ো হবে না!''
বুড়ো বলল, ``তোমার যেমন বুদ্ধি! আশি বছর বয়েস হবে কেন? সেবার তো অবনমন ছিল, এক কম হবে''।.ঠিক কি না ?. শুনে আমার গা পিত্তি জ্বলে গেলো।
কাক বলল, ``তোমরা একটু আস্তে আস্তে কথা কও, আমার হিসেবটা চট্‌পট্ সেরে নি।

(সুকুমার রায়ের আশ্রয় নিলাম)

মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩

কুমিরডাঙা ~ অনামিকা মিত্র

খাল কেটেছি, কুমির এল তার কিছুটা পরে
আসুন হুজুর বসুন হুজুর চেঁচাই সমস্বরে
কুমির হাসেন বসব কি রে, সামনে অনেক কাজ যে!
সবকিছুতেই গিঁট বেধেছে তোদের পোড়া রাজ্যে।
আমার আবার কাজ ছাড়া আর ভাল্লাগে না কিচ্ছু।
অ্যাদ্দিন সব চলছে যা তা। আমলারা সব বিচ্ছু।
সবটা আমিই সামলে দেব। আমরা শুধোই, কবে? 
সয় না সবুর, দেশ ভরে যায় উৎসবে উৎসবে।
উৎসব কি একরকমের? হাজার রকম বায়না।
স্বদেশ থেকে ব্যাঘ্রকে চাই, বিদেশ থেকে হায়না।
বাঘ হায়নার পরেও আছেন নানান রকম জন্তু
সবার জন্য উত্তরীয়, রত্ন অধিকন্তু। 
দানছত্রেই ফুরোয় যদি কষ্টে জোগাড় অর্থ,
হতাশ বলি, উৎসবই কি এই যজ্ঞের শর্ত?
উৎসবে আর নিভছে না যে দগ্ধ পেটের অগ্নি
কুমির বলেন ঠিক বুঝেছিস প্রাজ্ঞ ভ্রাতা ভগ্নী
এই কথাটাই আজ না বুঝে বুঝতি যদি কালকে
আমার আসার আশায় থেকে কাটতি না এই খালকে।
কান্নাকাটি ঢাকতে এ'বার বাজুক কাঁসর বাদ্য।
আমারও খুব পাচ্ছে খিদে, তোরাই তো সেই খাদ্য।

শনিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৩

বাজার অর্থনীতি ~ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়

শুনতে পেলাম বাজার গিয়ে
পেঁয়াজ না কি বড্ড ইয়ে,
ওমলেট-টার আশা ছেড়ে,
থলি হাতে লেজটা নেড়ে -
গুটিগুটি আলুর দিকে,
"দাম কতো?" শুধোই হেঁকে
জবাব আসে, "কিলোয় ষাট।"
ঘোরে বনবন বাজার হাট।
ভাবি একবার - "খাবো শাক।"
মাছের গন্ধ মাতায় নাক।
থাক না কেন, পকেট ঢিলে,
ভাবলে মাথা নেবেই চিলে।
নড়েই গেল বুদ্ধির গোড়া,
রাতে ভাতে কচুপোড়া।
 

শনিবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৩

​ভবসাগর-কারণ ~ অমিতাভ প্রামাণিক

সংসারে আর মন টেঁকেনা, এ ঘরখানায় দশ ফুটে
বন্দী থাকি আর কতকাল, তাই বলে যাই অস্ফুটে
হাড্ডাহাড্ডি লড়বো না, ঘাম ঝরাবো না, কি রক্ত –
এবার আমি বেরিয়ে যাব, কী লাভ, হয়ে বিরক্ত?
খুব ভয়ে রোজ বাজারে যাই সকাল বেলা দশটাতে,
এদিক ওদিক খুঁজে বেড়াই কে দিচ্ছে কী সস্তাতে।
মাছ কিনতুম যার কাছে, আজ সমঝে গেছি, বজ্জাত এ –
কী অপমান করছে দাদা, যাচ্ছিনে তাই লজ্জাতে।
সবজি বাজার? হাল একই তার, কী দাম, কী দাম, জঘন্য!
কেজি না আজ, আড়াইশো গ্রাম, পকেটের হাল নগণ্য।
ফিরলে বাড়ি গিন্নী চ্যাঁচান, আসেন তেড়ে বাঁশ তুলে;
ভাবছি এবার জাহাজঘাটায় পাল তুলে দি মাস্তুলে।
এতদিন তো কাটলো জীবন, করে পরের দাসত্ব –
এবার একাই বেরিয়ে যাব, তাই লিখে যাই, যা সত্য।
ভুল গাছে রোজ জল দিয়েছি, একটা ফলও না ফললো,
ঐ ফেলুদা সব পেয়েছে, এই ফেলুর কী সাফল্য?
বিয়ের আগে ভেবেছিলেম, যে মেয়েটা লাবণ্য,
দু তিনটে যুগ ঘর করে আজ দেখছি তাকে, কী বন্য!

ভাবছ আমি ফ্রাস্টু খেয়ে লিখছি বসে যা সত্যি?
ভীমরতি তো একটু হবেই বয়স হলে বাষট্টি!

৯ নভেম্বর ২০১৩

শুক্রবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৩

ছাগলের সেজ ছানার গল্প ~ অরুণাচল দত্তচৌধুরি


সিরিজ খবর জানবি পরে, প্রথম খেলার খসরা নে।
তিনদিনে ম্যাচ জিতলি বটে, ঈশ্বর আউট দশ রানে।

এ'সব কথায় ঘাবড়াব না, থাকবে লেখা সব বইয়ে,
ঠিক কতটা উল্লসিত ছিলাম একশ' নব্বইএ।

অফিস কেটে… মুখোস পড়ে… হল্লাবাজির দৃশ্য ঢের। 
হেডলাইনের টেল লাইনের, সকল ছবিই ঈশ্বরের।

ঠান্ডা ঘরে টিভির ভেতর চলুক খেলার বিশ্লেষণ।
তার মধ্যেই বিজ্ঞাপনের নানান রঙিন বিষ লেসন। 

আলুর আকাল… বাংলা নাকাল, ও'সব ভাবার দিক ছাড়ো।
পাগড়ি পড়াও ইনাম সাজাও তার সাথে দাও পিকচারও। 

এরপরে কি? দিন যাপনের দুঃখ ভোলায় বল্ কে আর।
চিন্তাটি নট। আসছে বিকট… দুঃখহরণ ফিল্মফেয়ার।

​নভেম্বর মাস এলে ~ অনামিকা মিত্র

নভেম্বর মাস এলে তার কথা মনে পড়ে যায়
মনে পড়ে ইতিহাসে আমাদের লেখা ছিল নাম
নভেম্বর মাস এল। ছিঁড়ে যাওয়া লাল পতাকায়
আবার নিজেকে লিখে গর্বে আকাশে ওড়ালাম।

বিপ্লব মানে কোনও বুথজ্যাম ভোটবাজী নয়
বিপ্লব নয় কোনও সরকারি আলু বা পেঁয়াজ।
সারদার টাকা গাপ, ওয়াকফ ফান্ড নয়ছয়,
বিপ্লব নয় কোনও অভিনয়… মৌলবাদী ভাঁজ।

সময় সমস্ত খায়, প্রতিজ্ঞা প্রতিভা ও মেধা।
মধ্যবিত্ত সময়ের প্যাঁচে পড়ে কেউ পাচু রায়।
তবুও বিপ্লব থাকে মগজের মাঝখানে বেঁধা।
বিপ্লবের স্বপ্ন ছাড়া বাঁচবার থাকে না উপায়!

সভ্যতা বিক্রি করে ঝানু যত দাসব্যবসায়ী।
নষ্ট হয়ে যাই রোজ। ভুল স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে বাঁচি।
বিপ্লব আসেনি আজও। তার জন্য আমি একা দায়ী।
আমিই চাইনি তাকে। খেলে গেছি ভুল কানামাছি।

আবর্তিত হতে থাকে এ'গ্রহের ভূত ভবিষ্যৎ।
আমাদের চেতনায় জেগে থাকে বাঁচার প্রয়াস।
ভাঙা পথে ঘরে ফেরে আমাদের হারানো শপথ
বারবার ফিরে আসে বিপ্লবের নভেম্বর মাস।

মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৩

ভ্রাতৃদ্বিতীয়া ~ অমিতাভ প্রামাণিক


বিবস্বতমুনির পুত্র নরকরাজ যমদেবের বোন যমুনা। বিয়ের পর যমুনা ভাই যমরাজকে নেমন্তন্ন করলেও নরকে পাপীতাপীদের নিয়ে হাজারটা কাজে ব্যস্ত থাকায় যম বোনের শ্বশুরবাড়ি আসার সময় পায়না। অবশেষে কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ায় যম চিত্রগুপ্তকে চার্জ বুঝিয়ে কোনোরকমে একদিন ছুটি নিয়ে যমুনার বাড়ি গেল। যমুনা তো ভাইকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। নিজের হাতে ভাইয়ের কপালে সুগন্ধী চন্দনের ফোঁটা দিলো, রান্না করে ভাইকে খাওয়ালো ভালোমন্দ এটাসেটা। যমের অরুচি গেল কেটে। যমরাজ অত্যন্ত খুশি হয়ে ভুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে যমুনাকে বলল, বল, কী বর চাই তোর? যমুনা বলল, বরই যদি দিস দাদা, এমন বর দে যেন আজকের দিনে যে ভাই বোনের হাতে ফোঁটা নেবে সে কোনদিন নরকদর্শন করবে না, সে অমর হবে, তার হবে অখণ্ড পরমায়ু। 

বোনের যত্ন-আত্তি পেয়ে আর পেটপুরে খেয়ে যমরাজ খুশিই ছিল। বললো, তথাস্তু।

এই তো, গল্পটা? এ রকম আরো আছে, একাধিক। নরকাসুরকে বধ করে কৃষ্ণ ফিরে গেল দ্বারকায়, সেখানে ক্লান্ত কৃষ্ণকে বোন সুভদ্রা প্রদীপ জ্বালিয়ে ওয়েলকাম করলো, পিঁড়ি পেতে খেতে দিল মণ্ডা-মিঠাই। ভাই যেন পুনর্জন্ম পেল, হয়ে গেল দ্বিজ, তাই শুরু হল ভাই-দ্বিজ, অপভ্রংশে ভাইদুজ।

পাতালরাজ দানবীর বলির তপস্যায় খুশি হয়ে ভগবান বামদেব বিষ্ণুরূপে তার গৃহে এসে বর দিতে চাইলে বলি বললেন, ভগবন্‌, আপনি এখানেই দ্বারপাল হিসাবে থাকুন, যাতে আসতে যেতে আপনার দেখা পাই। বিষ্ণুর রাজী না হয়ে উপায় ছিল না। এদিকে লক্ষ্মী পড়েছেন ফ্যাসাদে, ঘরের মানুষের দেখা নেই। নারদের মুখে খবর পেয়ে লক্ষ্মী গরীর ভিখারিনী সেজে শাড়ি ছিঁড়ে গিঁট মেরে অজন্তা হাওয়াই ফটফট করতে করতে বলির কাছে গিয়ে ভিক্ষে চাইল। কপালে ফোঁটা দিয়ে বলল, আমার ভাই নেই, তুমি আমার ভাই। দানবীর বলির দানের অহঙ্কার, বললো, বোনটি আমার, তোর যা চাই তাই পাবি। লক্ষ্মী বলল, আমার কর্তাকে আটকে রেখেছ, প্লীজ ছেড়ে দাও। ব্যাস, বলির হাওয়া নিকলে গেল।

মহামতি চাণক্য এই নিয়ে পরে শোলোক বেঁধেছেন – অতিদর্পে হতা লঙ্কা অতিমানে চ কৌরবাঃ। অতিদানে বলির্বদ্ধঃ সর্বমত্যন্তম্‌ গর্হিতম্‌। মানে বলে দিতে চাইলে নিশ্চয় বলবে, বেশি বেশি কোরনা!

রাজা নন্দীবর্ধন বহুদিন ভাইকে না দেখে মনোকষ্টে ভুগছে। ভাই মহাবীর তপস্যায় নির্বাণলাভ করে জৈনধর্ম প্রচার করে বেড়াচ্ছে। নন্দীবর্ধনের কষ্ট লাঘবের জন্যে বোন সুদর্শনা কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ায় ভায়ের বাড়ি এসে তার সেবা করতে লাগল। 

তারপর সেই গল্পটা! অনেক আগে জঙ্গলের ধারে এক বাড়িতে থাকত এক পরিবার। দিদির যখন বিয়ে হয়ে যায়, ভাই তখন খুব ছোট। বড় হয়ে দিদির মুখ মনেও পড়ে না তার। অন্যদের দেখে মাকে জিজ্ঞেস করে, মা, আমারও তো দিদি আছে তুমি বলো, সে কেন আসে না? মা বলে, ওরে, তার যে শ্বশুরবাড়ি অনেক দূর, পরে পড়ে জঙ্গল, খরস্রোতা নদী, সে কী করে আসবে বল? 

ছেলেটা বলল, আমি দিদির শ্বশুরবাড়ি যাব। মা যত বিপদের কথা বলে, নাছোড়োবান্দা ছেলের তত জেদ বেড়ে যায়। শেষে মা পুজো-আচ্চা করে মাথায় চুমো টুমো খেয়ে যেতে দিল ছেলেকে।

জঙ্গলের পথে হাঁটছে ছেলে, ধেয়ে এল সাপ। ছেলে বলল, জানো, আমি আমার দিদির কাছে যাচ্ছি, কতদিন তাকে দেখিনি, এখন আমাকে কেটো না, প্লীজ, ফেরার পথে যা খুশি কোরো। সাপ বলল, ঠিক আছে। ছুটে এল বাঘ, তাকেও একই কথা বলল সে। পাহাড় শুরু করল তার ওপর পাথর ফেলতে, সে মিনতি করল, এখন আমায় মেরো না দয়া করে। ওরা মেনে নিল।

নদী পার হতে গিয়ে দেখে প্রবল স্রোত, ভেসে যাবার উপক্রম। নদীর কাছেও সে চাইল তাকে যেন অনওয়ার্ড জার্নিতে ডুবিয়ে দেওয়া না হয়। নদী তাকে ডলফিন-টলফিন দিয়ে পার করে দিল।

ভাইকে পেয়ে তো দিদির আনন্দের শেষ নেই। খাওয়া-দাওয়া ফোঁটা-টোঁটা তো হলই, কত গল্পগুজব, খুনসুটি, কত কী! অনেক দিন সেখানে থেকে ফেরার যখন সময় হল, দিদি বলল, আবার আসিস ভাই। ভাই বলল, জানিস দিদি, আমাদের আর দেখা হবে না। আসার সময় যা যা কাণ্ড হয়েছিল, সব দিদিকে বলল সে।

দিদি বলল, কী, আমার ভাইকে মেরে ফেলবে এরা? রসো, মজা দ্যাখাচ্ছি। সেও পোঁটলা নিয়ে রেডি হয়ে গেল, বলল, চ' আমিও তোর সাথে যাব।

নদীকে খুশি করতে পুজো দিল সে, নদী ছেড়ে দিল। বাঘ হালুম করে তেড়ে আসতেই পোঁটলা খুলে তার দিকে ছুঁড়ে দিল রান্না করা মাংসের চাঁপ-রেজালা-দোপিঁয়াজা। বাঘ তাই খেয়ে ফুটে গেল। সাপকে দুধকলা দিয়ে আর পাহাড়কে সোনা-রূপো ঘুষ দিয়ে বশ করে ফেলল সে। ভাইয়ের সব অনিষ্ট দূর হয়ে গেল।

এই গল্পটা আরো বড়, কিন্তু সেসব থাক। মূল কথা এটাই। ভাইদের মঙ্গলের জন্যে বোন বা দিদিরা পারে না, হেন কাজ নেই।

আজ সেই পরম মঙ্গলময় দিন। আজ কাকডাকা ভোরে বোনেরা ঘুম থেকে উঠে ঘাসের ডগা থেকে শিশিরকণা সংগ্রহ করে তাই দিয়ে চন্দন বেঁটে ভাইয়ের জন্যে বাঁ হাতের অনামিকায় তুলে নেয় যে ফোঁটা, প্রদীপ জ্বালিয়ে মাথায় ধানদূর্বা দিয়ে মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে দিয়ে সেই ফোঁটা এঁকে দেয় ভায়ের কপালে, তার তুল্য পবিত্র অনুষ্ঠান জগতসংসারে নেই। 

ভ্রাতস্তব ললাটে হি দদামি তিলকং শুভ। অতঃপরং যমদ্বারে ময়া দত্তং হি কন্টকম্। ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।

এরপর ভাইকে ভূরিভোজ করানো। ভ্রাতস্তবাগ্রজাতাহং (বয়সে ছোট অর্থাৎ অনুজ হলে ভ্রাতস্তবানুজাতাহং) ভুক্ষ্ব ভক্তমিদং শুভম। প্রীতয়ে যমরাজস্য যমুনায়া বিশেষতঃ। আর ভাইয়ের কাজ বসে বসে সেগুলো সাঁটানো। তত্র যম পূজা দিকমঙ্গ্ ভগিনী হস্তাদ্ ভোজনং প্রধানং কর্ম।

আজ রাতের আকাশে শুক্লা দ্বিতীয়ার প্রায়-অদৃশ্য একফালি চাঁদ। কিন্তু এর কাছে ভাই-বোনের মধুর-সম্পর্কজনিত অপর তিথি রাখীপূর্ণিমার পূর্ণচাঁদও যেন ম্লান মনে হয়। 

দিদিরা, আমার প্রণাম নিও। বোনেরা, অনেক ভালবাসা। ঘরের দেয়ালে একটা এক্সট্রা ফোঁটা কেটে রেখ তোমরা আমার জন্যে। মিষ্টির প্লেট আর গিফ্‌ট্‌ কি ক্যুরিয়ারে পাঠাবে?

ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। ৫ই নভেম্বর ২০১৩

শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৩

ছবি ~ অমিতাভ প্রামাণিক

ছেলেটা আদুর গায়। প্যান্টখানা? ছেঁড়া সে।
ধূপ বেচে সিগ্‌ন্যালে, দেখি ধনতেরাসে।
হিঁদু না মুসলমান? ভোলা, ভূতো বা বশীর?
পরদিন দেখি তারে ভূত চতুর্দশীর
বাজারে দাঁড়িয়ে, তার পরণে সেই পোষাক।
হাতে কিছু আঁটি, বলে, লিবেন চোদ্দশাক?
বেশ চালু ছেলেটাতো, নাকি খামখেয়ালি?
দিওয়ালি আছে কি ওর, ঘরে নেই দেয়ালই!
রোদে-বৃষ্টিতে-জলে খাড়া থাকে দ্বিপদে,
সেভাবেই চলে অমাবস্যা-প্রতিপদে,
ঘন্টা-মিনিট-দিন লাল-কালি তিথি যায়।
বোন আছে ওর? দেয় ভাইফোঁটা দ্বিতীয়ায়?

আমার এ পাপের হাতে এই ছবি আঁকালি
যদি মা, দেখিস ওরে – ওদেরকে – মা কালী!

১ নভেম্বর ২০১৩

বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৩

​ঊর্দ্ধগগনে ~ অমিতাভ প্রামাণিক

পেঁয়াজের কেজি একশো ছাড়ালো, আলুও তথৈবচ –
কিস্যু করার নেই, শালা যেন জেলে বসে মরে পচো!
পনেরোই অগাস্ট ঘটা করে সব মানাচ্ছি স্বাধীনতা,
তবুও দুহাত শিকলেই বাঁধা, এটা কী রকম কথা!
প্রতিবার নাকি রেকর্ড ফলন, অথচ বাজারে দ্যাখো
মিনিমাল দুটো সবজি কিনতে খালি হয়ে যাবে ট্যাঁক ও!
নেতাগুলো খালি বুলি কপচায় ঠান্ডা মিনারে বসে;
ভাবখানা, যেন পাকে পড়ে গেছি মিথ্যে কপালদোষে।
আগের নেতারা ভুল করেছিল, এসব তাদেরই দান,
দুদিনেই নাকি কমে যাবে এই গ্রোয়িং ইনফ্লেশান।
এইখান দিয়ে এই থিওরিতে কমবে স্ট্যাটিসটিক্স
ঐখান দিয়ে ভাতা গুঁজে দেব, বুঝলে তো ভায়া ট্রিক্স?
হ্যান করেঙ্গা ত্যান করেঙ্গা, গরীব না পায় ভাত –
বীর্যপাতের কন্ট্রোল নেই, ঠেকাবে বজ্রপাত!
ওরে সুমুন্দি, কর কিছু, এই আছোলা বাম্বু আর
সহ্য হয়না, ঘাড় ধাক্কালে দেখবি যমদুয়ার।

জ্ঞান দিয়ে যায় অপরকে, নিজে নিয়ত বেশ্যাধীন –
এই ন্যাতাদের ঝ্যাঁটা মেরে চল করিগে দেশ স্বাধীন।

৩১শে অক্টোবর, ২০১৩

সোমবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৩

একশো ছেচল্লিশ বছর আগে ~ অমিতাভ প্রামাণিক

মার্গারেট এলিজাবেথ নোব্‌ল্‌, আমরা যাঁকে ভগিনী নিবেদিতা বলে চিনি, তাঁর আজ জন্মদিন। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর একশো ছেচল্লিশ বছর পূর্ণ হত।

১৮৯৩ সালের সেই ঐতিহাসিক নাইন ইলেভেনের শিকাগো সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ জয় করেছিলেন আমেরিকার হৃদয়। এরপর তিন বছর ধরে তিনি আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যত্র – মূলতঃ শিকাগো, ডেট্রয়েট, বস্টন ও নিউ ইয়র্কে – হিন্দুধর্মের ওপর ভাষণ দেন। এর মধ্যে ১৮৯৫ আর ১৮৯৬ সালে দুবার কয়েক মাসের জন্যে ইংল্যান্ডেও যান। এর প্রথমবার লন্ডনে এক বক্তৃতার আসরে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় মার্গারেটের। এর পর লন্ডনে যতগুলো বক্তৃতা দেন স্বামীজী, তার প্রায় সবগুলোতেই উৎসাহী শ্রোতা ও প্রশ্নকারিণী হিসাবে দেখা যায় তাঁকে। কী গভীরভাবে তিনি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, তার প্রমাণ – বৃদ্ধা মা, অন্যান্য আত্মীয় পরিজন ও বন্ধুবান্ধব ছেড়ে ভারতে পাড়ি দেন তিনি। ১৯৯৮ সালের ২৮শে জানুয়ারী তাঁকে কলকাতায় দেখা যায়, তার তিন সপ্তাহের মধ্যেই দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে। বিবেকানন্দ স্টার থিয়েটারে মিটিং ডেকে কলকাতার জনগনের কাছে তাঁকে ভগিনী নিবেদিতা হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেন ভারতের কাজে ইংল্যান্ডের গিফ্‌ট্‌ হিসাবে। সারদা মা তাঁকে কোলে টেনে নেন খুকি ডেকে।

কলকাতায় পৌঁছাবার বর্ষপূর্তির আগেই বাগবাজারে তিনি মেয়েদের স্কুল স্থাপন করেন। পরের বছর প্লেগ কলকাতায় মহামারী রূপ ধারণ করলে নিবেদিতাকে রাস্তা থেকে হাসপাতাল সর্বত্র দেখা যায় রোগীর সেবা করতে। ভারতে মাত্র সাড়ে তেরো বছর ছিল তাঁর আয়ু, ১৯১১ সালের ১১ই অক্টোবর দার্জিলিঙে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ভারতের সেবা করে গেছেন। তৎকালীন সমস্ত প্রভাবশালী কলকাতাবাসীদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা ছিল। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু ও তাঁর স্ত্রী অবলা বসুর সঙ্গে ছিল বিশেষ হৃদ্যতা। চিত্রকলায় উৎসাহী নিবেদিতা ঘনিষ্ঠ ছিলেন অবনীন্দ্রনাথেরও।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে স্মরণ করে ভগিনী নিবেদিতা শীর্ষক এক প্রবন্ধ রচনা ও পাঠ করেন। কোন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে এই প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য প্রবন্ধের চেয়ে অনেকাংশে আলাদা। আমি এখানে তার লিঙ্কটা দিয়ে দিচ্ছি, ইচ্ছা হলে পড়ে নিতে পারেন - http://tagoreweb.in/Render/ShowContent.aspx?ct=Essays&bi=72EE92F5-BE50-40B7-BE6E-0F7410664DA3&ti=72EE92F5-BE50-4517-BE6E-0F7410664DA3

এই প্রবন্ধে অশ্রদ্ধার কোন চিহ্ন নেই, বরং কবি নিবেদিতাকে লোকমাতা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। অথচ, এ কথা অনস্বীকার্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধার অভাব না থাকলেও তাঁদের বিশেষ অন্তরঙ্গতা ছিল না। রবীন্দ্রনাথ অবলা বসুকে এক চিঠিতে নিবেদিতাকে 'মাথায় তুলে নাচতে' নিষেধ করেছিলেন, বলেছিলেন, বিবেকানন্দের কথা বড় মুখে গেয়ে গেলেও সে আসলে আমাদের ধর্মের কিছুই বোঝেনি।

রামকৃষ্ণের পৌত্তলিক পুজো-আচ্চা এবং উপাসনাধর্মী ব্রাহ্মদের পাশ্চাত্যপন্থী উদার মনোভাবের একটা কালচারাল ডিফারেন্স ছিলোই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর মেয়ে মীরাকে পড়ানোর জন্যে নিবেদিতাকে অনুরোধ করেছিলেন, যা উনি প্রত্যাখ্যান করেন, যদিও জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তাঁর বিশেষ খাতির ও অবাধ যাতায়াত ছিল। নিবেদিতা চেয়েছিলেন ব্রাহ্মদের কালীমন্দিরে নিয়ে গিয়ে তুলতে, তাতে বিবেকানন্দের প্ররোচনাও ছিল। সে নিয়ে ১৮৯৯ সালে রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দের সঙ্গে বাগবাজারের বাড়িতে বৈঠকও হয় তাঁর, কিন্তু তখন ব্রাহ্মসমাজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রবীন্দ্রনাথ স্বাভাবিকভাবেই তাতে রাজী হন নি। বিবেকানন্দ এর পর নিবেদিতাকে ঠাকুরদের সাথে মেলামেশা করতে নিষেধ করেছিলেন। নিবেদিতা এক চিঠিতে লিখেছিলেন, so we are to give up. After all, who are these Tagores?

কিন্তু তা সম্ভব হয়নি, কেননা এই ঠাকুরটি কোন হেঁজিপেঁজি লোক ছিলেন না। তিনি নিবেদিতাকে শিলাইদহে তাঁর সংস্কারমূলক নিজস্ব কাজকর্ম দেখে আসার অনুরোধ করেন নিবেদিতাকে, যদিও নিবেদিতা তক্ষুণি সেই প্রস্তাবে সাড়া দেননি।

ঠাকুরদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করলেও নিবেদিতা রবীন্দ্রনাথের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা, দেনা-পাওনা আর ছুটি গল্পের ইংরাজী অনুবাদ করেন তিনি। সেই সময় বিদেশী পত্রিকাগুলো অনুবাদ ছাপাতে খুব আগ্রহী ছিল না। একমাত্র কাবুলিওয়ালাই প্রকাশিত হয়েছিল মডার্ণ রিভিউ পত্রিকায়, তাও তাঁর মৃত্যুর কয়েক মাস পরে, জানুয়ারী ১৯১২ সালে।

নিবেদিতা-রবীন্দ্রের বিরোধের আরও একটি কারণ হল – নিবেদিতা চেয়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মডেল হোক সশস্ত্র আইরিশ বিপ্লবী সংগ্রাম। তিনি অরবিন্দ ঘোষ ও তাদের অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এবং এই নিয়ে রামকৃষ্ণ মিশন যাতে বিপদে না পড়ে, তার জন্যে মিশনের সঙ্গে সংস্রব অফিশিয়ালি ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেকোন সহিংস ও হিংস্র কার্যকলাপের ঘোর বিরোধী ছিলেন।

শিক্ষা নিয়ে অবশ্য দুজনেরই সমান উৎসাহ ও মতামত ছিল। দুজনেই লর্ড কার্জনের বিশ্ববিদ্যালয় বিলের নিন্দায় লুখর ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষকদের শিক্ষার জন্যে জোড়াসাঁকোতেই একটা স্কুল খোলার পরিকল্পনা করেছিলেন, এবং নিবেদিতাকে সেই স্কুলের ভার নিতে অনুরোধ করেছিলেন।

এর কিছুকাল পরেই রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে নিবেদিতা – সঙ্গে জগদীশচন্দ্র ও অবলা – শিলাইদহে যান ও পদ্মায় বোটে বাস করেন। সারাদিন গ্রাম দর্শন ও সন্ধ্যায় বোটে গল্প-গান-বাজনা। রবীন্দ্রনাথের 'প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী' শুনে নিবেদিতা ধ্যানস্থ হয়ে যান।

অবশ্য এখানেই এক কাণ্ড ঘটে যার ফলে নিবেদিতা রবীন্দ্রনাথের ওপর প্রণ্ড ক্ষুব্ধ হন, এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁদের সম্পর্ক তিক্তই থাকে। রবীন্দ্রনাথকে একটা গল্প বলতে অনুরোধ করলে উনি যে গল্পটা শোনান, সেটা মোটামুটি গোরা-র ড্রাফট। এক আইরিশম্যান ভারতে এসে এ দেশের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে। কিন্তু জীবনসায়াহ্নে সে বিদেশী, এই কারণে তার প্রেমিকা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। পরে গোরা উপন্যাসে তিনি অনেক অংশ বাদ দিলেও সুচরিতা স্রেফ বিদেশী বলে গোরাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, শিলাইদহে বোটে বসে রবীন্দ্রনাথের এই গল্প শুনে তিনি ভীষণ রেগে যান।

গোরা প্রকাশ হয় নিবেদিতার মৃত্যুর বেশ কিছু সময় পরে। অনেক রবীন্দ্র-গবেষকদের মতেই নিবেদিতা এমন এক চরিত্র যাকে রবীন্দ্রনাথ কোনভাবেই উপেক্ষা করতে পারতেন না। নিবেদিতাই রবীন্দ্রনাথের গোরা, পুরুষের বেশে।

নিবেদিতার মৃত্যুর পর লেখা প্রবন্ধে তিনি নিবেদিতার স্তুতি করেছেন ঠিকই, তবে তাতে একটু রাশ টেনে রাখা আছে। নিজের মৃত্যুর কয়েক মাস আগে অবশ্য সেই রাশ খুলে যায় তাঁর। রাণী চন্দকে বলেছিলেন, মেয়েদের এই যে সংবেদনশীলতা, এটাই যখন একটা দৃঢ় চরিত্রের সঙ্গে মেশে, তা হয় অত্যন্ত বিস্ময়কর কিছু। নিবেদিতা সেই রকম। নিজের হৃদয় দিয়ে সে এই দেশ আর তার মানুষকে ভালবেসে গেছে, তার সমস্ত কিছু ত্যাগ করে। তার সাহসিকতা আর ঔদার্য আমাকে প্রতিপদে বিস্মিত করে।

২৮শে সেপ্টেম্বর ২০১৩

--
~Saibal

রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৩

অসুখ ~ অরুণাচল দত্তচৌধুরী


কুশপুতুলেরা পোড়ে,
আগুনের চেহারাটি রাগী
বাইরে সে কাপালিক, অন্তরে দারুণ বিবাগী।

তাকে যারা জ্বালিয়েছে তৈরি আছে তাদেরও পুতুল
অভিজ্ঞতা বলে দেয় কারা ঠিক কতখানি দাগী!ম
জ্বলে ওঠা শিখে গেলে, 
আগুন করে না কোনও ভুল

আমাদের বুদ্ধিশুদ্ধি কম
পান্তাভাত খেতে গিয়ে ফুঁ দিয়েছি…ভেবেছি গরম।
কল্পনায় তা'তে ঢালি ঘি ও।
আমাদের পোড়া পেটে … স্বপ্ন এসেছে হেঁটে
এসেছেই যদি, বসতে দিও।

ক্ষেতে মাঠে ঘোরে হাহাকার
ডিজেল …সারের দাম বেড়ে বেড়ে কর্মটি সাবাড়।
কখন চলবে শ্যালো, বুলবুলি কবে খাবে ধান
সেই তথ্য জানে সংবিধান
আমরা জেনেছি শুধু 
এই বেঁচে থাকা বড় প্রিয়।

ভিজিটিং আওয়ার্সের নির্ধারিত কালে
শুশ্রূষার হাত রাখি সময়ের আতপ্ত কপালে

সে এখন শুয়ে
ভেন্টিলেটর চলছে হিমমাখা ছায়া আইসিসিউএ
জ্বরঘোরে ম্লান হাসে, ঠোঁটে নড়ে বিষণ্ণ প্রলাপ
এখনও দু'গালে লেগে
ভুলে যাওয়া আদরের আবছা জলছাপ
কত গান গাওয়া হয়নি
আজও কত স্বপ্ন দেখা বাকি
টিপটিপ জ্বলে নেভে চেতনার গোপন জোনাকি

আমাদের সময়ের অসুখ করেছে

বুধবার, ২ অক্টোবর, ২০১৩

কামদুনি ~ অনামিকা মিত্র

আড়াল করে মারলে তো, তাই ফোকাস নেই।
আবার যখন মারবে …মেরো প্রকাশ্যেই।

কামড়ে ছিঁড়ে… আমায় চিরে, মারার পর
পাড়ায় সেঁধোয় তোমার পোষা গুপ্তচর।

তার কায়দায় এখন টিভির খবর হয়,
সস্তা চাল আর চাকরি এবং অন্ত্যোদয়।

ভয় আর লোভের দাপট ভোলায় আমার নাম।
থাকলে বেঁচে মা ভাইদেরকে কি বলতাম!

হয়তো ওরাও গোপন গুহার কোণ খুঁজে
কান্নাশব্দ লুকিয়ে ফেলছে চোখ বুজে।

যখন বোকার মিছিল নয়া লন্ডনে
চালাক তুমি ব্যস্ত সে' প্যাঁচ খণ্ডনে।

ভাঙনখেলার নিয়ম মেনে ঘটল তা'ই
যেমন খেলা জানত কেবল বৃটিশরাই।

আমার সে' প্রাণ উধাও… ভয়ে তাও কাঁদি।
মাস্টার আর বন্ধুরা সব মাওবাদী!

বিপদ ঘটবে জেনেও ওরা খুব চেঁচায়। 
লোক জুটিয়ে আমার খুনের বিচার চায়।

কীসের বিচার? যাক বেঁচে যাক সব খুনি!
আমার প্রাণের মূল্যে বাঁচুক কামদুনি।

বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

ঈশ্বর ~ অমিতাভ প্রামাণিক

মহামতি গোখলে একদা বলেছিলেন, হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্ক্‌স্‌ টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্ক্‌স্‌ টুমরো।

সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। তবে আস্ফালন তো রয়েই গেছে। অথচ ইতিহাস বলে, বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের মানুষ আদতে ছিল অনগ্রসর আদিবাসী। যে সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলার উদ্ভব, বাংলায় সেই সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন না বললেই চলে। সেন রাজাদের আমলে পুজো-আচ্চার কারণে কনৌজ থেকে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ভাড়া করে আনতে হত। পরে শ্রীচৈতন্যের আমলে সে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে বটে, তবে সাধারণ বাঙালি বহুকাল ছিল অশিক্ষিত। লেখাপড়া ব্যাপারটা বঙ্গজদের মধ্যে তেমন ছিল না।


প্রায় একক প্রচেষ্টায় অশিক্ষিত বাঙালিকে শিক্ষিত করার প্রয়াস নিয়েছিলেন এক একগুঁয়ে বাঙালি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যে সময় সংস্কৃত ভাষাশিক্ষাকেই শিক্ষা বলে গণ্য করা হত, সেই সময়ে বাঙালিকে বাংলা শেখানোর কাজে ব্রতী হলেন তিনি। ব্রিটিশ আমলের শতবর্ষ পূর্তির তখনো কিছু বাকি, অসন্তোষ বাড়ছে গ্রামবাংলায়, নীলকর চাষীদের ওপর অত্যাচার চরমে উঠছে। নবজাগরণের পথিকৃত রামমোহন মারা গেছেন বছর কুড়ি আগে। গদাধর চট্টোপাধ্যায় রামকৃষ্ণদেব হয়ে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির পুরোহিত হয়েছেন সদ্য। বহু পরিশ্রমে বিধবা বিবাহ আইন প্রচলন করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র। মাইকেল মধুসূদন বাংলায় বিচিত্র রসের কাব্যরচনা করছেন বটে, তবে তা আপামর বাঙালির বোধবুদ্ধির আয়ত্বের বাইরে। তাঁর মেঘনাদবধ কাব্য রচনা বা রবি ঠাকুরের জন্ম হতে তখনো ছ'বছর বাকি।

তখন ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স পঁয়ত্রিশ বছর। মফস্বলে স্কুল পরিদর্শনে যাওয়ার পথে পালকিতে বসে তিনি রচনা করলেন বর্ণপরিচয়ের পাণ্ডুলিপি। ১৮৫৫ সালের এপ্রিলে প্রথম ভাগ ও জুনে দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হল। দু'পয়সা দামের এই পুস্তিকা এক জাতির মেরুদণ্ড গঠনে এক যুগান্তকারী বিপ্লব এনে দিল।

এর আগে রাধাকান্ত দেব, ক্ষেত্রমোহন দত্ত, মদনমোহন তর্কালঙ্কার ও স্কুল বুক সোসাইটি শিশুপাঠ্য কিছু বই বাংলায় প্রকাশ করলেও সেগুলো জনপ্রিয় হয়নি। শিশুদের সামাজিক অবস্থান, শিশুশিক্ষা ও শিক্ষণপদ্ধতির বিষয়ে প্রয়োজনীয় সম্যক জ্ঞান এবং সর্বোপরি নিজস্ব প্রয়াসকে সর্বাঙ্গীন রূপ দেওয়ার একগুঁয়েমি অনুশীলনে এরা কেউ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ধারেকাছে ছিলেন না।

বাংলা বর্ণমালার আমূল সংস্কার, উপযুক্ত যতিচিহ্নের ব্যবহার এবং প্রাঞ্জল সহজ গদ্যে নিজেকে প্রকাশের সুষম দিগ্‌দর্শনে বর্ণপরিচয়ের অবদান অসীম। নিজে হিন্দু কুলীন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হয়েও এই গ্রন্থের কোথাও ধর্মীয় অনুশাসনের কোন উল্লেখ নেই, বরং নীতিশিক্ষাকেই শিশুশিক্ষার প্রকৃত রূপ বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।


বর্ণপরিচয় প্রকাশের পর বিদ্যাসাগর আরও পঁয়ত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন। এই সময়ে বর্ণপরিচয়ের ১৫২টি মুদ্রণ সংস্করণ প্রকাশিত হয়, যার শেষের দিকে প্রতিটি সংস্করণে দেড় লক্ষেরও বেশি কপি ছাপা হত। ঐ সময়ে বাংলার জনসংখ্যা, শিশুমৃত্যু ও শিক্ষার হার বিবেচনা করলে বোঝা যায়, প্রতিটি বাঙালিই বর্ণপরিচয় পাঠ করেই শিক্ষার প্রথম সোপান অতিক্রম করেছে। বর্ণপরিচয়ের 'জল পড়ে, পাতা নড়ে' দিয়েই পরবর্তী এক শিক্ষাসাধকের কবিতার অঙ্গনে প্রবেশ ও বিশ্বজয়।

১৮২০ সালে আজকের দিনটিতে জন্মেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। দুশো বছর হতে চলল, বঙ্গমাতা আর একটিও এমন নাছোড়বান্দা সুসন্তান প্রসব করেন নি।

২৬শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩


মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

​ছড়া থেকে কবিতায় উত্তরণ ~ তমাল রাহা

কিছুদিন আগে হঠাত এক বন্ধুর ইমেইল এলো। তমাল, মহায়ন এর একটা কপি পেয়েছি ! পড়লুম, আর প্রচুর হাসলুম। সত্যি, কি অদ্ভূত প্রতিভা বাঙালীর ছড়া বানানো নিয়ে ! আসলে বাঙালীর রক্তে ছড়া। ছোটবেলাটা বোধহয় সবারই ছড়াময়। তাই দু-লাইন ছড়া কাটা আমাদের বাঙালীর জন্মগত প্রতিভা। সেটা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান থেকে রাজনীতির আঙ্গিনা অথবা ইস্কুল এর মাস্টারমশায় দের নিয়ে মজা করা …. কোথায় নেই ?
বাঙালী-র ঘরে জন্ম।তাই ছোটবেলা থেকেই ছড়ার সাথে পরিচয়। প্রথম ছড়া যা স্মৃতির পাতায় প্রথম দাগ কেটেছিল সেটা মা-এর মুখে ঘুমপাড়ানি ছড়া …. ¨ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি আমাদের বাড়ি এসো¨ কিম্বা ´খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়াল/ বর্গী এল দেশে´…. ঠাম্মা-কে বলতে শুনতাম ¨আয় আয় চাঁদ মামা, টিপ দিয়ে যা/চাঁদের কপালে চাঁদ, টিপ দিয়ে যা¨। অবাক হয়ে ভাবতুম খোকা এতো দুষ্টু যে ঘুমোলে পাড়া জুড়ায় …. কিন্তু খোকা ঘুমোলে চাঁদ মামা কিন্তু টিপ দিয়ে যেতে ভোলেন না ! একটা সময় ছিলো যখন এই ছড়া ছাড়া ঘুম আসাটাই ছিলো দায় ! ক্রমশ ছড়া ব্যাপারটা হে উঠলো জীবনের অঙ্গ। খেলতে গিয়ে ছড়া … আমপাতা জোড়া জোড়া/ মারব চাবুক ছুটবে ঘোড়া … শাসনের সময় ছড়া …পারিব না এ কথাটি বলিও না আর/ কেন পারিবে না তাহা ভাব এক বার।
বাড়িতে তো ঠাম্মা-র নির্দেশে সকালে ঘুম থেকে উঠে চালু করে দিলাম ¨সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি¨ …. আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়/ লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়¨ ইত্যাদি ও প্রভৃতি। ঘুম থেকে উঠতে দেরী হলে ঠাম্মার বিছানা থেকে তুলে দেওয়ার মধ্যেও সেই ছড়া ¨পাখী সব করে রব, রাতি পোহাইল/ কাননে কুসুমকলি, সকলি ফুটিল¨। তখন অবশ্য মদনমোহন তর্কালঙ্কার বা হরিশচন্দ্র মিত্র মহাশয়দের নাম জানা ছিলো না। সব তো শুনে শুনে শেখা ! প্রচন্ড হতাশ হয়েছিলাম প্রথম ঠাম্মা আমায় আসল হাট্টিমাটিম দেখালো। .. আমি ছড়া পড়ে মনে মনে কি জানি কি ভেবে রেখেছিলাম ! মনে হলো …. ধুসস …. জমলো না ঠিক।
ক্রমশ বড় হার সাথে সাথে নিজের ছড়া বলা শুরু। বাবুরাম সাপুড়ে, কথা যাস বাপুরে? ….. জন্মদিনে পাওয়া ´আবোল-তাবোল´…. 'হাঁস ছিল সজারু ( ব্যাকরণ মানি না) হয়ে গেল 'হাঁসজারু' কেমনে তা জানি না´……. চরিত্র গুলোর সাথে আলাপ হার প্রবল ইচ্ছে।অদ্ভূত একটা মানসিক অবস্থা। কোথায় পাব হাসিমুখ আহ্লাদী দের, কিম্বা কুমড়োপটাশ, রামগরুড়ের ছানা, গঙ্গারাম, কাঠবুড়ো, বোম্বাগড়ের রাজা কে ? অসাধারণ সব চরিত্র। একদিকে মনে মনে ভিজে কাধ সেদ্ধ করে খাওয়ার প্রবল সাধ আর অন্যদিকে হুঁকোমুখো হ্যাংলার জন্যে মনে তখন ভারী কষ্ট। কিন্তু কে বোঝে আমার কথা? মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার/সবাই বলে 'মিথ্যে বাজে বকিস নে আর খবরদার!'
এগুলোর সাথে সাথেই চলল বড় হয়ে ওঠা।
আলাপ কাজী নজরুল এর সাথে …. কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও? কিম্বা ভোর হোলো , দোর্ খোলো … অথবা বাবুদের তাল-পুকুরে গিয়ে হাবুদের ডাল-কুকুরে-র কথা ভেবে ভয়ে মাঝরাতে ঘুমভেঙে যাওয়া। প্রায় একই সময় আলাপ কবিগুরুর সাথে … তালগাছ এর মতো এক পায়ে দাড়িয়ে থাকার অভ্যেস করার মধ্যে দিয়ে, মনে মনে আকাশেতে বেড়িয়ে, তারাদের এড়িয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে ভাবতে। এরিই মাঝে মা-কে নিয়ে বিদেশ ঘুরতে গিয়ে ডাকাত দলের সাথে মনে মনে যুদ্ধটাও চলছে। বিদেশ মানে কলকাতা বা বড়োজোর আসাম (মাসি থাকতেন) হবে ভাবতাম ! ওদিকে কবিগুরুর ছড়াতেও বিভ্রান্তি কাটছে না … ক্ষান্তবুড়ি র দিদিশাশুড়ি দের নিয়ে ভীষণ বিপদে পরা গেল। কিছুতেই বুঝতে পারি না কেন তারা শাড়ি গুলো উনোনে বিছায়, হাড়িগুলো রাখে আলনায় ! ওদিকে ইস্কুল এও কবিতা ! পরীক্ষার খাতায় দশ লাইন মুখস্থ লিখতে হবে, দাড়ি-কমার ভুল হলেই নম্বর কাটা ! ছড়া আর পিছু ছাড়ে না ! কিন্তু ভারী মজা। নতুন ক্লাস এর বই এলে প্রথম কাজই ছিলো ছড়াগুলোকে পড়ে ফেলা। কেমন যেন মাথার মধ্যে গেথে গিয়েছিল।মনে রাখার অভ্যেসটা সেই ছড়া দিয়েই শুরু।
বাবা নিয়ে গেলেন দামদর বাঁধ দেখাতে। ছিপখান তিনদাঁড়, তিনজন মাল্লা/ চৌপর দিনভর, দেয় দূরপাল্লা।এবার সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এসে গেলেন।এ যেন নতুন করে ছড়া-ছন্দের সাথে আলাপ ! অসম্ভব রকম আলোড়ন তুলেছিলো মনে …
পাড়ময় ঝোপঝাড়
জঙ্গল,–জঞ্জাল,
জলময় শৈবাল
পান্নার টাঁকশাল। ..
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের হাত ধরেই কখন যে ছড়া আর কবিতা মিশে গেল মনের মধ্যে তা টের-ও পেলুম না। এক নিঃশ্বাসে পড়তে লাগলুম ´পালকির গান´, কোন দেশেতে তরুলতা, মানুষ জাতি, উত্তম অধম ….. কী সহজ সাবলীল ভাষা আর শব্দের ব্যবহার!
বর্ষার নবীন মেঘ এল ধরণীর পূর্বদ্বারে,
বাজাইল বজ্রভেরী। হে কবি, দিবে না সাড়া তারে
তোমার নবীন ছন্দে?
আবার ফিরে আসা কবিগুরুর কাছে। কবিগুরু তখন যেন সমুদ্দুর। বালিশের পাশে সঞ্চয়িতা নিয়ে শোয়া। নজরুলের বিদ্রোহী , সুকান্তর ছাড়পত্র, আগ্নেয়গিরি … একেরপর এক পড়ে চলেছি পাগলের মতো। গোঁফ গজানোর সময় থেকে জীবনান্দ।সব মেয়েকেই প্রায় সুচেতনা বা আকাশলীনা লাগা শুরু ! নাটোরের বনলতা সেন কে জানার ইচ্ছে আর মনে প্রশ্ন লাশকাটা ঘরে পরে থাকা লোকটাকে নিয়ে। চলছিলো বেশ, বাবা হাতে ধরিয়ে দিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যা, বিষ্ণু দে, শামসুর রহমান, দীনেশ মজুমদার, নীরেন চক্রবর্তী , জসীম উদ্দীন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ শামসুল হক। কবিতা আর গদ্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে এলেন পূর্ণেন্দু পত্রী।জয় গোস্বামী এলেন একটু বাদে ´যমুনাবতী´কে নিয়ে। তবে সবার সব কবিতা ভালো লাগত না। selective ভালো লাগা শুরু হলো। সব অপূর্ণতা পূর্ণ করার জন্যে বারবার কবিগুরু তো রইলেন-ই।
কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান
আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি।
মাঝে হঠাত একটা সময় এলো যখন ভালোলাগা টা কেমন যেন মিইয়ে যেতে লাগলো। ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত। একটা অস্থিরতা ছিল। ভালো লাগছিলো না বেশিরভাগ কবিতা। ভাবছিলুম বয়স বাড়ার সাথে সাথে হয়তো এই পরিবর্তন !
কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো।
কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না
রাত কাটে তো ভোর দেখি না
কেন আমার হাতের মাঝে হাত থাকে না কেউ জানেনা।
হঠাত সেই সময়ে আবার আবিস্কার করলুম হেলাল হাফিজ, হুমায়ুন আজাদ, নির্মলেন্দু গুন, হাবীব কাশফি, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লা , আল মাহমুদ, মহাদেব সাহা, আবুল হোসেন, শহীদ কাদরী, আবুল হাসান, আহসান হাবীব কে। এরা ছিলেন, কিন্তু আমার সাথে পরিচয় ছিলো না !
তোমাকে হারানোর প্রয়োজন ছিল।
প্রয়োজন ছিল সময়কে মিথ্যে ভেবে
অসমাপ্ত কবিতা লেখার।
প্রয়োজন ছিল-
ধূসর রাতে একাকী থাকার,
দুঃস্বপ্নের ঘোরে … (জাবীর রিজভী)
আবার ভালো লাগাটা ফিরে এলো। বুঝলুম, মধ্যবয়সের চাহিদা একটু আলাদা। এখন তাই,
কষ্টে-সৃষ্টে আছি
কবিতা সুখেই আছে,–থাক,
এতো দিন-রাত যদি গিয়ে থাকে
যাক তবে জীবনের আরো কিছু যাক।
…..শুধু কবিতা পড়ার জন্য আরেকবার জন্মাতে ইচ্ছে করে।

শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

​​খিদে ~ অমিতাভ প্রামাণিক

​​
বিকেল চারটে হ'লে
আজকাল খিদে পায় আমার
কেমন এক ঝিমধরা খিদে খিদে ভাব।

সকালে ওঠার তাড়া থাকে
মুখ ধুয়ে স্নান করে অফিসে বেরোনো
দেরী হলে বাস মিস, মানে লাল দাগ।
অফিসে কাজের চাপ
বড় বস মেজ বস সেজ-ছোট চুনোপুঁটিদের
অহরহ কথা শুনে শুধু ঘষে যাওয়া।
দুপুর ঘনিয়ে এলে নাকে মুখে গুঁজে ফের
ফাইলে প্রবেশ।
সন্ধ্যেয় ঘরে ফিরি, তার একটা তাড়া আছে
বাসে ঘন ভিড়।
বাড়ি ফিরে বৌয়ের পাঁচালি
ছেলেমেয়েদের ঘ্যানঘ্যান
মাসের মেন্টেন্যান্স, টেলিফোন বিল
এটা ওটা সাত-সতেরোশো।
টিভিতে সারেগামাপা দাদাগিরি বিগবস
হতে হতে ঘুমের প্রবেশ।

শুধু বেলা চারটেয় এইসব থাকে না আমার।
তাই রোজ খিদে পায়
বিচিত্র খিদে খিদে ভাব।

১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩

বুধবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

মেয়ে ~ অনামিকা

রাস্তা মোড়ে মোড়ে মদের ঠেক,
রঙ ও বেরঙের জয় নিশান।
একলা মেয়ে দ্যাখো ঘর ফেরে। 
পুরুষ দণ্ডতে দাওনি শান?

দখল করো ওকে নির্দ্বিধায়,
রাষ্ট্র পাশে আছে, ভয় কী? যাও।।
ও কারও কন্যা বা ভগ্নী নয়।
ও মেয়ে নয় কারও সে প্রেমিকাও।

পাবে না ভালোবাসা মেয়েবেলায়।
মেয়েরা শুধু হবে ভোগদখল।
পুরাণকাল থেকে এক নিয়ম।
তেমনই বলে গেছে মনু সকল।

এ' গণতন্ত্রেরও সেই নিয়ম।
ভোটের মানে স্রেফ মুখ বদল।
মেয়েটা মরে গেলে তর্ক হোক,
খুনিরা তোর না কী আমার দল?

এক টানেতে যেমন তেমন ~ তমাল রাহা

প্রথম হোস্টেল এ থাকতে গিয়ে আলাপ এক দাদার সাথে। ইউনিভার্সিটি topper, সাহিত্যে। রোজ সকালে দেখতাম বাংলা মদের বোতল খুলে বসতে।আর ছিলো গঞ্জিকা বা সাদা বাংলায় যাকে বলে গাঁজা। আমায় স্নেহ করতেন। একদিন প্রশ্ন করলাম, ¨দাদা, তোমায় দাঁত মাজতে দেখি না তো!¨ উত্তরে বললেন, ¨বাঘ কি দাত মাজে রে খোকা?¨ দাদা গাঁজা-মদে ডুবে থাকলেও পড়াশোনাটা করতেন আর বছর বছর পরীক্ষায় প্রথম হতেন। এমন ছেলে তো আবার অনুজদের আদর্শ , বিশেষত হোস্টেল লাইফ এ। অনেককেই দেখেছি ওই দাদা কে নকল করতে গিয়ে নিজেদের পড়াশোনা গোল্লায় পাঠিয়েছে।আমার এক সহপাঠি তো দাদার ভক্ত হয়ে গাঁজা-র নেশা করে পাগল হয়ে গেলো ! অথচ ইকোনমিক্স এর কতো ভালো ছাত্র ছিলো , ছিলো জুনিয়র বাংলা দলের গোল-কিপার।ভাবা যায় ! দোষ আর দি কাকে ! আমরা বাঙালিরা মনে করি নিষিদ্ধপল্লী তে যাতায়াত করলেই শার্ল বোদলেয়ার হওয়া যাবে, অর্শ হলেই রবীন্দ্রনাথ হওয়া যাবে আর প্রথাবিরোধী হলেই হুমায়ুন আজাদ হওয়া যাবে।তাই বন্ধুরা যখন ভাবতো সকাল বিকেল গাঁজা-মদে ডুবে থাকলেই ওই দাদার মতো হিরো হওয়া আটকায় কে ….. তখন আর কিই বা বলি !

নেশার এরকম অনেক effect আমরা অল্পবিস্তর সবাই জানি। তবে আজ ভাবছিলুম একটু অন্যরকম কথা বলি। নেশা সংক্রান্ত কিছু মজার গল্প। কিছু নিজের অভিজ্ঞতা, কিছু শোনা, কিছুটা পড়া।

আবার সেই হোস্টেল এর গল্পে যাই। একবার ইচ্ছে হলো হুকো তে তামুক পান করার। থাকতাম ইডেন হোস্টেল-এ। কলেজ স্ট্রিট-এ। কাছেই নাখোদা মসজিদ। অম্বুরি তামাক পাওয়া যেতো। হুকো এলো, তামাক এলো। রাতে ডিনার এর পর বারো জন বন্ধু একসাথে বসা হলো। নাহ …. সে যাত্রায় তামাক খাওয়া হয় নি। সারারাতের চেষ্টাতেও হুকো জ্বালানো গেল না। ভোর রাতে শেষে বিড়ি খেয়ে গাল পরতে পরতে শুতে গিয়েছিলাম মনে আছে।

নাগা সন্ন্যাসী বলতে ছিলিমভর্তি গাঁজা আর শৈশবের পোশাকে ঘুরে বেড়ানো সাধু-সন্তরাই মনে আসেন। গাঁজা -র নেশা না থাকলে কি আর ওই অবস্থায় ঘোরা যায় ! এক সাধু কে বলতে শুনেছিলাম যে গাঁজা খেলে পরমব্রহ্ম কে সাকার রূপে দেখা যায় ! শিবঠাকুর তো দিব্য গাঁজা-ভাং খেয়ে কচুরিপানার ওপর হেঁটে বেড়াতেন। অষ্টম শতকে (কেউ কেউ বলেন ষষ্ঠ শতক) রচিত বানভট্টের কাদম্বরীতে রয়েছে, রাজধানী বিদিশায় বসে শুদ্রক রাজা স্নানাহারের পর কষে গাঁজা খেতেন। কারণ তখনও ভারতে তামাক আসেনি। অবশ্য তামাক জ্বালানোর করুণ অভিজ্ঞতা ওনার-ও হযেছিলো কিনা সেটা জানার উপায় নেই। গাঁজা , সিদ্ধি …. আরো কিছু কথা 

তপস্যার চার পথ-- স্থূল, পর্বত, ছাতক ও সিদ্ধি। গুরুর নামে যখন গাঁজা খাওয়া হয়, তখন সেটা সিদ্ধি আর এমনি এমনি খেলে তা নেশা করা, পাগলামি।

দেহের ভেতর আত্মা রাজা। 

সে খায় গাঁজা।

গাঁজা খাওয়ার জন্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কলকি। এগুলোকে বলা হয় বাঁশি। রয়েছে, কৃষ্ণ বাঁশি, নাগিনী বাঁশি, শঙ্খ বাঁশি, বিচ্চু বাঁশি, গণেশ বাঁশি, মেগনেট বাঁশি ও সাধারন বাঁশি। কারুকার্য, বানানোর নিপুণতার দিক দিয়ে বাঁশির দাম ১০টাকা থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। তবে সবচেয়ে বেশি চলে কৃষ্ণ বাঁশিই।

গাঁজা আর byproducts 
গাঁজা : স্ত্রীপুষ্পকে ৪৮ ঘণ্টা রৌদ্রে শুকালে ফুলগুলো জমাট বেধে যায়। এই জমাটফুলই গাঁজা নামে বিক্রয় হয়। সাধারণত কল্কিতে গাঁজা ভরে অগ্নিসংযোগ করে এর ধোঁয়া গ্রহণ করা হয়। এছাড়া সিগারেট বা বিড়ির মতো করে গাঁজা ভরে এর ধুমপান করা হয়।
ভাং :
 স্ত্রী উদ্ভিদের ভূ-উপরিস্থ অংশ শুকিয়ে বা কাঁচা অবস্থায় পিষে পানির সাথে মিশিয়ে সরবত বানিয়ে পান করা হয়। নেশাকারক উপাদান কম থাকে বলে গাঁজা অপেক্ষা ভাং কম দামে বিক্রয় হয়।
চরস্ : গাছের আঠা থেকে চরস তৈরি হয়ে থাকে। অনেক সময় গাঁজার ফুল শুকানোর সময় যে গুঁড়া উৎপন্ন হয়, তা আঠার সাথে যুক্ত করে চরস তৈরি হয়ে থাকে। অনেক সময় এই আঠা পাওয়ার জন্য গাঁজার গাছ কেটে দেওয়া হয়।
সিদ্ধি : গাঁজা গাছের পাতা শুকিয়ে সিদ্ধি তৈরি করা হয়। সিদ্ধি থেকে অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে ঔষধ তৈরি করা হয়। এছাড়া সিদ্ধি মুখে পুরে চিবিয়ে নেশা করে অনেকে।
হাসিস : গাঁজার স্ত্রীপুষ্পের নির্যাস থেকে হাসিস তৈরি করা হয়। গাঁজা গাছ থেকে ঊৎপন্ন সকল নেশা দ্রব্যের মধ্যে হাসিসকে শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করা হয়।


ফিরে আসি আবার হোস্টেল এর গল্পে।

হোস্টেল-এ অনেক কেই গাঁজার নেশায় বুঁদ হতে দেখেছি দিনের পর দিন।এক দাদা কে গাইতে শুনতাম দ্বিজেন্দ্র লাল রায়-এর গান

গাঁজা গুলি চরস
...তার চেয়ে ভাঙ
লক্ষ গুণে সরস।

একদিন হোস্টেল ই প্রচন্ড হৈ - চৈ। বাইরে বেরিয়ে দেখি সেই দাদা তারস্বরে চেচাচ্ছে , ¨শালা কেস করে দেবো ¨বলে। বুঝলুম নেশার ঘোর। জানতে পারলাম বান্ধবী ল্যাং মেরেছে। তাই কেস করে দেবে বলে হুমকি দিচ্ছে। বলা হলো, এসব ব্যাপারে কেস দেওয়া যায় না, খালি কেস খাওয়া যায়। শুনে তার কি রাগ! বললো, ¨আমার কাছে evidence আছে। আমি জানি সেই কি রঙের অন্তর্বাস পড়ে।¨ তারপর থেকে সেই দাদা হোস্টেল-এ গনখোরাক হয়ে গেলেন।

সৈয়দ মুজতবা আলীর গাঁজা নিয়ে একটা মজার গল্প আছে। অনেকেই পড়েছেন হয়তো। যারা পড়েননি তাদের জন্য স্মৃতি থেকে একটু তুলে দিচ্ছি। দেশভাগের পর কোন এক নিয়মের গ্যাড়াকলে পড়ে তৎকালীন পূর্ব বঙ্গ থেকে ভারতে গাঁজা রপ্তানি বন্ধ। গাঁজা রপ্তানি বন্ধ হওয়াতে গুদামে গাঁজা জমে আছে মণকে মণ। নতুন গাঁজা উৎপাদিত হয়ে, প্রস্তুত হয়ে গুদামে ঢোকার অপেক্ষায়। বাধ্য হয়ে পুরানো গাঁজা নষ্ট করে ফেলতে হবে। কোনো কারণে আলী সাহেব সেখানে উপস্থিত ছিলেন। খুব সম্ভব দায়িত্বরত অফিসার তার আত্মীয় (ভাই?) ছিলেন। আলী সাহেবকে বললেন, চল দেখবি। জীপে করে যথাস্থানে গিয়ে দেখলেন পুরানো গাঁজা জড় করে রাখা হয়েছে পোড়ানোর জন্য। সমগ্র গ্রামবাসীও (নারী, শিশু, যুবক, বৃদ্ধ) হাজির হয়েছে অগ্নুত্সব যোগ দিতে। মজা শুরু হোলো আগুন লাগানোর পর। বাতাস যেদিকে যায় সমগ্র গ্রামবাসী সেইদিকে দৌড়ায়। বেশিক্ষণ আলী সাহেবের পক্ষে সেখানে অবস্থান করা হয়ে ওঠেনি। তবে ফেরার সময় তিনি জীপে করে ফিরে এসেছেন নাকি হাতির পিঠে করে ফেরত এসেছিলেন তা আর মনে করতে পারেননি। বাতাস তো সব দিকেই দৌড়িয়েছে, আর উনিও তো এক দিকে ছিলেন।

ইস্টবেঙ্গল মাঠে এক কালে রোজ যেতুম। দু-টাকার গ্যালারি তে উত্তমকুমার বলে একজন আসতেন।ওটা অবশ্যই ওনার আসল নাম ছিলো না। সবাই আদর করে ওই নামে ডাকতো। গাঁজা-র ছিলিম বানাতেন মাঠে বসে। আর কল্কে সারা মাঠে ঘুরতো।দু-একবার টান দেওয়ার কথা আমার-ও মনে পরে।

গাঁজা পরিবারের নিজস্ব কিছু টার্ম রয়েছে। যেমন, গাঁজা কাটার ছুরি নাম 'রতন কাটারি'। যে পিঁড়িতে গাঁজা কাটা হয় তা 'প্রেমতক্তি' আর ধোঁয়া ছাঁকবার ভিজে ন্যাকড়ার নাম 'জামিয়ার'। আর গাঁজাতন্ত্রের শেষ আচার হলো একটানে কলকে ফাটানো। ছিলিম আর কলকে হলো একই জিনিস।ছিলিমের মূল আরবি 'ছিলম' আর কল্কের মূল সংস্কৃত 'কলিকা'। আর ফারসি ´নাইচা´থেকে বাংলায় এসেছে ´নলচে।
অন্যদিকে গাঁজা এসেছে সংস্কৃত ´গঞ্জিকা ´ থেকে। সংস্কৃত 'গাঁজ' (ফেনা) থেকেও বাংলায় গাঁজা শব্দটি এসেছে। এ গাঁজার অর্থ ফেনিল হয়ে ওঠা, টক হয়ে যাওয়া।

গাঁজা গাছ দুরকমের হয়। স্ত্রী - পুরুষ ভেদ আছে। স্ত্রী গাছে নেশা বেশি। সেটাই তো স্বাভাবিক, তাই না ? গাঁজা-র ব্যবহার শুরু নাকি শক-জাতির আমল থেকে। আদর করে ´কুনবু´বলে ডাকতো ওরা। ওরা কি জানতো যে গাঁজা-র সাইন্টিফিক নাম Canabis sativa ? Canabis এর আদুরে নাম কুনবু ! হোস্টেল-এ অনেক কে বলতে শুনেছি ´পাতা´।

ওপার বাংলায় একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। একদিন লোকমান হেকিম রাস্তা যাচ্ছেন। যেতে যেতে গিয়ে পড়লেন এক জঙ্গলের সামনে। লোকমান হেকিম জঙ্গলের পাশ দিয়া হাটেন আর নতুন নতুন গাছ দেখেন । গাছের সামনে হেকিম দাড়ালেই গাছ তাকে সম্মান জানায়। যেই গাছ সামনে পড়ে হেকিম তারে জিগায়, তোর নাম কি, আর কি কামে লাগছ? গাছ উত্তর তারে সম্মান জানাইয়া উত্তর দিলো আমার নাম আমলকি। আমি ভিটামিন সি এর ভান্ডার বিভিন্ন কাজে লাগি, এই সব। এরপর আস্তে আস্তে আম, কলা, জাম, বাসক, লজ্জাবতী, কাটানটি, চুতরা, করমচা, হিজল, বট সব গাছের প্রশ্ন করতে করতে যাইতে লাগলো। হঠাৎ হেকিম দেখেন একটা নতুন গাছ। এর আগে লোকমান হেকিম দেখে নাই। যথারীতি সে সেই গাছের সামনে দাড়ালেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, করো ওরে গাছ তোর নাম কি আর কি কামে লাগছ?

গাছ নিশ্চুপ।

লোকমান আবার জিগায়।
গাছ আবারও নিশ্চুপ।

এইবার লোকমান রেগে গিয়ে জিগায় -
ওরে বেয়াদপ গাছ তোর নাম কি আর কি কামে লাগস?
গাছ ও সামান তেজে উত্তর দেয়
"তোর মতো হাজার হাজার লোকমান হেকিম পয়দা করাই আমরা কাম"

চুপিচুপি আরেকটা জিনিস জানিয়ে যাই, গাঁজা গাছ হলো একমাত্তর গাছ যা স্বর্গেও পাওয়া যায়। গল্পটা ঠিক এইরকম ….

শিবঠাকুরের মনে সুখ নেই। কোনো নেশাই তাকে খুশি করতে পারছে না। এলেন তখন লোকমান হেকিম। বোধহয় ওই আলাপচারিতার পরের ঘটনা ! শিবঠাকুর কে বললেন গাঁজার নেশা করতে। শিববাবাজি গাঁজা খেয়ে এতো খুশি হলেন যে স্বর্গে নিয়ে গেলেন সাথে করে গাঁজাগাছ।

সেই সাহিত্যের ছাত্র আমার হোস্টেলের দাদার কথা দিয়েই শেষ করি। পরবর্তীকালে সেই দাদা রাজধানীর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের বিভাগীয় প্রধান হযেছিলেন। কয়েকবছর আগে খবর পেলুম তিনি আত্মহত্যা করেছেন। খোজ নিয়ে জানলুম নেশাটা ছেড়ে উঠতে পারেন নি। মানসিক অবসাদ হয়তো ….
আজ এই পর্যন্ত থাক।

বুধবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৩

খুড়োর কল ~ স্বাতী দাসগুপ্ত

খুড়ো চলছে সামনে কলে কত কি খাবার
ভুখা পেট রুটি চায়, খিদে জোরদার
বাতেলা মেরো না রাজা আর......

দেশটা বেচে ন্যাংটো রাজা নাচছে ধিন তা ধিন
সঙ্গে নাচছে মন্ত্রি-সান্ত্রি,গিলছে খনি ষড়যন্ত্রি
দৈত্য খাচ্ছে কড়মড়িয়ে আস্ত আলাদীন_
বাড়ছে খিদে ধর্ম দিচ্ছে প্রাণভরে আফিং।
ভুখা পেট রুটি চায়,খিদে জোরদার
বাতেলা মেরো না রাজা আর......

বিজ্ঞাপনে যত কাব্য, গরিবের ভবিতব্য
চোখ বুজে রাজা খাবে চেটেপুটে চোষ্য চব্য ।
ভুখা পেটে রুটি আর কোটি হাতে কাজ
খিদে বলে কেড়ে খা,হক লুটে নে আজ।
মাথা তুলে আসমানেতে, শক্ত রেখে পা-
বাতেলাতে পেট না ভরে, কেড়ে নিয়ে খা।
ভুখা পেট রুটি চায়, খিদে জোরদার
বাতেলা মেরো না রাজা আর......।।

মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৩

ভাষা বিভ্রাট ~ তমাল রাহা

কেউ যদি ক্রমাগত হাসিমুখে "বালে বালে বালে বালে" অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বলতে থাকে তাহলে আপনার কেমন লাগবে? হ্যা, আমারও সেরকম অবস্থ্যা হয়েছিল স্পেন এ এসে। শালা যাই বলি তাই শুনে লোকে তার দন্তবিকশিত করে "বালে বালে বালে বালে" বলে যেত। পরে জানলাম অর মানে হলো "ঠিক আছে"........ হ্যা, ঠিক ধরেছেন, এবার বিষয় টা হলো ভাষা।
ছোটোবেলার কথা।তখন ইস্কুল এর ছুটি পরলেই বারাকপুর যাওয়া হত। আর সেখানে গেলেই আমি মেতে উঠতাম খেলায়। আর খেলাধুলো করলে একটু হাতাহাতি তো হয়ই বৈকি! আমি একটু গায়েগতরে ছিলাম বরাবরই। মামাবাড়িতে তো ডাকনাম তা "গোদা" ই রয়ে গেছে।একবার হলো কি, পাড়ার বাবু নামে একটি ছেলের সাথে লাগলো ঝামেলা। ওরা তখন বাংলাদেশ থেকে সদ্য সদ্য এদেশে এসেছে। ঝগড়া টা হাতাহাতি তে বদলাতে সময় লাগলো না। আমিও হুট করে পা চালিয়ে বসলাম ...... আর লাগবি তো লাগ একদম মোক্ষম জায়গায়। আসল ঘটনা শুরু এরপর। খেলা উঠলো মাথায়। বাড়ি ফিরে এলুম। কিছুক্ষণ বাদে বাড়ির বাইরে প্রচন্ড চিত্কার চেঁচামেচি। বেরিয়ে দেখি বাবুর মা বলছেন "তোমাগো পোলায় আমার পোলার পোতায় হেমনে লাত্থায়সে যে আমার পোলা পোতা হাতে লৈয়া কান্দতাসে।" আমার মা আর দিদি তাই শুনে কিছু বুঝতে না পেরে ক্রমাগত প্রশ্ন করে চলেছে "পোতাটা কি জিনিস?" শেষে বাবুর মা বললেন "আরে হেইটাও যেন না, মোতনের কামে লাগে যেইটা!" আমার মা আর দিদি এখনো গল্পটা বলতে বলতে হেসে কুটোপাটি হয়ে যায়।
গোলোকপতি বাবু ছিলেন আমার ইস্কুলের ইংরিজির মাস্টারমশায়।সেটা নব্বুই দশকের গোড়ার কথা।আমি তখন কলেজে পড়ি। ছুটিতে দুর্গাপুর গিয়ে শুনি আমাদের ইস্পাত ইস্কুলের দুই-জন জনপ্রিয় মাস্টারমশায় রতন বাবু, স্বাধীন বাবু, ইহলোক ত্যাগ করেছেন। মনটা খারাপ। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। হঠাত দেখা গোলোকপতি বাবুর সাথে। বললুম, "স্যার, শহরে এসে খবরটা শুনলুম। মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে।" গম্ভীর মুখে স্যার উত্তর দিলেন "হ্যা, তমাল, ব্যপারটা খুবই আশাতীত।" অত দুঃখেও সেদিন হো হো করে হেসেছিলুম মনে আছে।
যুগযুগান্ত ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল ১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর। ঐ দিনই হিটলারের নেতৃত্বে নাত্সী জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। পরবর্তীকালে ঐ ১লা সেপ্টেম্বর দিনটিকেই আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিরোধী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্বশান্তি আন্দোলন। পশিমবঙ্গে ওই দিন-টিতে বামপন্থী দলগুলি করে যুদ্ধবিরোধী শান্তি মিছিল। ছাত্র-যুব রাও যোগ দেন। আমিও যোগ দিয়েছি। একটা শ্লোগান ছিল "দাগো দাগো কামান দাগো, পেন্টাগন এ কামান দাগো।" কিন্তু মিছিলের শেষের দিকে কিছু ছেলেকে বলতে শুনেছিলাম, "দাগো দাগো কামান দাগো, প্যান্ট-টা খুলে কামান দাগো।" জানি না ওটা ওদের অজ্ঞানতা বশত না অসভ্যতা ছিলো। 
এর সাথে আরেকটা জিনিসের মিল খুঁজে পাই। ইস্কুলের প্রেয়ার-এর লাইন-এ … অনেকেরই হয়ত এই ধরনের অভিজ্ঞতা আছে। 
ভাষা ব্যবহারকারীর দিক থেকে পৃথিবীতে বাংলা চতুর্থ ভাষা। এটা গর্ব করার মতো বিষয় হলেও আমরা নিজেরাই বাংলা ভাষাকে বিপন্ন করে তুলছি।
মানুষ লিখতে শিখেছে পাঁচ-ছয় হাজার বছর আগে; কিন্তু বলতে শিখেছে অন্তত ষাট হাজার বছর আগে। এ সময়ের মধ্যে পৃথিবীতে বহু ভাষার উদ্ভব হয়েছে, আবার তা বিলীন হয়ে গেছে, যেমন অনেক সভ্যতার উত্থান ও পতন ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের অনেক বড় বড় সভ্যতা ও অসংখ্য ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ইতিহাস স্মরণীয়। একসময় উত্তর-দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায় অসংখ্য 'রেড ইন্ডিয়ান' ভাষা প্রচলিত ছিল। কয়েকশ বছর আগে ইউরোপীয় দেশের উপনিবেশে পরিণত হওয়ার ফলে সেসব ভাষা ধ্বংস হয়ে গেছে। উত্তর আমেরিকায় চালু হয়েছে ইংরেজি আর দক্ষিণ আমেরিকায় স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ ভাষা। 
ইচ্ছে করে ভাষা বিকৃতিটা নিন্দনীয়! তবে, মজা করার জন্য এদিক-ওদিক হলে মার্ডারাস হওয়ার কারণ দেখি না কারণ ভাষা নিয়ত পরিবর্তনশীল; পরিবর্তন হচ্ছে এবং হতে থাকবেই। এটা ঠেকানোর উপায় নেই কোনো। তবে, সবসময় একটা মানদণ্ড মেনে চলার বিষয়টা ভালো। তা না হলে পরিবর্তনটা বিশৃংখলায় পর্যবসিত হবে। যেমন ধরা যাক আজকাল facebook এ প্রায়ই দেখা যায়,
পষ্টিয়ে দে 
আরো পোস্টান
গুগলাইয়া
আজকাল ইল্যান্ডে অনেকেই excuse me এর জায়গায় অনেকটা মজা করেই squeeze me বলে থাকেন কিংবা লিখে থাকেন। এটা স্রেফ মজা। দেখুন ওদের শব্দদুটিতে উচ্চারনের জায়গাটা প্রায় কাছাকাছি হলেও শব্দার্থে কত ভিন্নতা। এটা প্রায় বিশ্বের সব দেশেই কম বেশী হচ্ছে।
তাছাড়া, পূর্ণবয়স্কদের জন্য ভাষায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়তো তেমন ক্ষতিকারক নয় কিংবা হবে না যতটা না শিশুদের ক্ষেত্রে হবে। শিশুরা সহজে বিভ্রান্ত হয়ে যাবে - ভুলটাকেই শুদ্ধ মনে করে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইবে। এটা নি:সন্দেহে একটা ভয়ংকর একটা ব্যাপার হবে! একটা মানদণ্ডের সাধারণ অনুশীলনকে উত্সাহ না দিলে শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষ ভাষার বিকৃতিতে সহজে আক্রান্ত হবে। ভাষার এদিক-ওদিক হলেও প্রমিত ভাষা সম্পর্কে পরিষ্কার জ্ঞান থাকা দরকার।
তাই এবার একটু ভাষাচর্চা করা যায় কি সবাই মিলে ?

শনিবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৩

রোজগেরে ~ লোপামুদ্রা মিত্র পাল

চলতে চলতেয় আজ "রোজগেরে"

১) গত সপ্তাহে ক'দিন তুমুল বৃষ্টি হওয়ায় বাস রুট ছেড়ে অফিসফেরত ট্রেন রুট ধরলাম মেট্রো অব্দি পৌঁছাতে। এমনি একদিন ট্রেনে উঠে বসতেই একটি লোক– কানে ব্যথা, দাঁতে ব্যথা, মাথায় ব্যথা, পায়ে ব্যথা, হাতে ব্যথা, পেটে ব্যথা,দীর্ঘ দিনের ব্যথা, হটাত ব্যথা সারাতে ব্যবহার করুন এই তেল। সর্ব ব্যথাহর এই তেল,দাম মাত্র ১০ টাকা। দু ফোঁটা লাগিয়ে পাঁচ মিনিট মালিশে তিন মিনিটে ব্যথা গায়েব! এতেআছে প্রাচীন আয়ুর্বেদিক শাস্ত্র অনুযায়ী হাজারো জড়িবুটি । কোন ঝামেলা বা side effect  নেই আলোপ্যাথি্রমতো। এতোটা বলার পর একজন পাশ থেকে বললেন কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই?? লোকটি বলেন"পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া" আবার কি? কোন "side effect" নেই বললাম যে!! দেখলাম দেশের লোক বাংলা নাজানলেও ইংরেজিটা বেশ জানেন। যাই হোক হুড়মুড় করে বিক্রি হতে লাগলো । বেশির ভাগ ইখেটে খাওয়া মানুষ ,সারা দিনের কাজের শেষে গায়ে- গতরে ,মনে ব্যথা নিয়ে বাড়ির মুখে। একজনআবার পকেট থেকে ভলিনি জেল বার করে বললেন আমি লেবারের কাজ করি মেট্রো রেলে, ভলিনিলাগিয়ে একটু আরাম পেলেও খানিক বাদে আবার যে কে সেই। লোকটি বলে চলেন এই আলোপ্যাথি্রমতো খারাপ আর দুনিয়ায় কিছু নেই। আমাদের নিজস্ব শাস্ত্র অনুযায়ী চলুন। কথায় বলে নাগেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। বুঝলাম এদানিং হিট আয়ুর্বেদিকের "side effect" এটা। ওদিক থেকে হটাত ফিসফাস ক'জন মহিলার। একজনঅল্পবয়সী ক্ষয়াটে চেহারার বউ কি যেন বললেন। লোকটি বলেন হ্যাঁ হ্যাঁ মা জননী ওই দিনগুলোয় পেটে একটু লাগিয়ে মালিশ করলেই আপনার ব্যথা কমে শরীল একদম ঝরঝরে!! বেশ ভালইরোজগার হয়ে গেল ১৫ মিনিটে । আমায় লোকটি একদম ই পাত্তা দিচ্ছিল না, না দেওয়ার ইকথা। কারন আমি এক্কেবারেই potential customer নই। কিন্তু জাত salesman  বলতেহবে। সেই আপ্ত বাক্য sales man দের – যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমুল্য রতন"। তাইস্মরণ করে নামার ঠিক আগে আমায় – " ম্যাডাম , একটা নিয়ে যান , দেখবেন লাগাবার আগেইব্যথা গায়েব!" আমার সরল প্রশ্ন – কোথায় লাগাব? আশ্চর্য লোকটি বলে ওঠে, "কেন?যেখানে ব্যথা সেখানে"! মুখ ফস্কে বেড়িয়ে পড়ে "দাদা সংসারে বড় জ্বালা যন্ত্রণা,কোথায় লাগাবো একটু বলবেন?" আমি জানি উনি আমায় পাগল ঠাউরালেন। দমদম এ নেমে হাঁটতে হাঁটতেমুখ ফিরিয়ে দেখি তখনো আমার দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে দেখছেন আর বিড়বিড় করছেন, বোধহয়গালাগাল।


২)আগে যখন অফিস আসতাম বাসে শ্যাম বাজার মোরে বাস দাঁড়ালেইএকটি ২০-২২ বছরের ছেলে উঠত কাছা পরা। বাবার শ্রাদ্ধের জন্য পয়সা চাইত। TargetCustomer  ছিল দক্ষিণেশ্বরে পুন্যলোভে আসা মহিলা পুন্যারথিরা। ভুলেও ডেলি পাষণ্ড দের থেকে চাইল না।

অবাক ব্যপার ৩ মাস maternity leave কাটিয়ে জয়েন করে দেখি তখনো সে বাবার শ্রাদ্ধেরজন্য পয়সা চাইছে!!


৩) আজ এক অভিনব অভিজ্ঞতা হোল। বাসে আসতে আসতে বোধহয় সবচেয়েক্ষুদে রোজগেরে দেখলাম। বাচ্চাটির বয়স মেরেকেটে দুই কি আড়াই। নাক দিয়ে অনবরত শিকনিপরছে আর এক হাতে প্যান্ট টা টেনে ধরে আছে। সাথে বছর ছয়েকের দিদি শুধু। এরিয়া হলসিঁথি মোড় থেকে বনহুগলি। উঠেই দিদি দুটো পাথরের পাতলা খণ্ড চটাস চটাস করে বাজিয়েগান ধরল " টাকি ও টাকি ও টাকি টাকি টাকি রে" সেই আদ্যিকালের গান তাও বেসুরো।কিন্তু ঘটনা সেটা নয়। গানের সাথে সাথে ওই টুকু ছোট ভাই চলন্ত বাসে ব্যালেন্সরাখছে, নাচছে আবার পয়সাও তুলছে। অবাক হয়ে দুচোখ ভরে দেখলাম আমাদের ঘরের ৭-৮ বছরের বাচ্চাকেওহাত ধরে রাস্তা পার করিয়ে দিতে হয় আর এদের বাবা – মা কত আয়াসে ছেড়ে দিয়েছে জীবনসংগ্রামে যুঝে নিতে নিজেদের, হয়ত বা এদের রোজগার ও ফুটপাথের ফুটিফাটা সংসারে ব্যয়হয় অভাবের ফুটো বোজাতে। রোজগার মন্দ হল না , এবার নিশ্চিন্ত জলখাবার। বাসের মেঝেয়বসে উচ্ছিষ্ট ব্রিটানিয়া কেক ভক্ষন ভাই ও বোনে ।

​ প্রতিবাদের বাঘ বেরুলো বনে ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য

ভোটের দিনে সকালবেলা যেই পড়েছে মনে,
চিরকালীন

​​
প্রতিবাদের বাঘ বেরুলো বনে।
আমি দেখতে পেলাম, কাছে গেলাম, মুখে বললামঃ আয়
ফেসবুকে আর টুইটারে বাঘ আটকে আছে, হায়!

আমার ভয় হল তাই দারুণ, কারণ চোখদুটো কৌতুকে
লাল, সবুজ বা গেরুয়া নয়, ভাসছিল নীল সুখে।
বাঘের গতর ভারি মুখটি হাঁড়ি অভিযোগের পাহাড়,
আমার ছোট্ট কিছু দাবী শুনে খোলে রূপের বাহার।

ভোটের দিনে সকালবেলা যেই পড়েছে মনে,
চিরকালীন প্রতিবাদের বাঘ বেরুলো বনে।
আমি দেখতে পেলাম, কাছে গেলাম, মুখে বললামঃ আয়
ফেসবুকে আর টুইটারে বাঘ আটকে আছে, হায়!

বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০১৩

মরা প্রেম ~ শ্রদ্ধা মুখোপাধ্যায়

মৈথুনে আজ আমি খুঁজবই তোকে 
ঢেকে নেব কালকের আদরের দাগ 
ধুলো ঢেকে নিভে আছে চাদরের ভাঁজে
মরে যাওয়া কঙ্কাল আর অনুরাগ.

টেনে নেওয়া ফুসফুসে জং ধরা প্রেম
আশা আর হতাশায় সব শোধ-বোধ
যে আগুন জ্বলেছিল তার হাত ছুঁয়ে
নিভিয়েছে হিম রাতে সব প্রতিরোধ.

ভেসে থাকি, ডুবে যাই পুকুরের ঘুমে
পড়ে থাকে একা ট্রেন আর কিছু কথা
ভালোবাসি, বেসে যাব বলেছিল যারা
আজ তারা ফেলে গেছে শুধু নীরবতা...

​ এ "পরিবর্তন" কাকে বলে ~ সুমন্ত্র মাইতি

মুন্নাভাই : সার্কিট, বোলে তো........
​​
এ "পরিবর্তন" কাকে বলে ?
সার্কিট : ভাই,পরিবর্তন বোলে তো :

যেখানে দেখিবে লাল
তুলে নাও চামড়ার ছাল
সবুজ বিছুটি ঘসে কর হে বার্নিশ
যদি দেখো লাল সাপ
ঝাঁটা মেরে কর সাফ
মনে রেখো সর্বদা সংখ্যাটা চৌত্রিশ

মুন্নাভাই : আচ্ছা , "শিল্প" বোলে তো ?
সার্কিট: ভাই, শিল্প বোলে তো:

লোহা কাঠ ভারী তাই তুলে নাও কলম
ছড়া গান লিখে দাও ন্যানো ক্ষতে মলম
মেলা আর ঝুলনে বেচো হে বাদাম
বেগরবাই করলে আছে এবিজির বাটাম

মুন্নাভাই : ঠিক হ্যায় সার্কিট , তো ফির উত্সব বোলে তো .....
সার্কিট : ভাই, উত্সব বোলে তো

পুলি পিঠে খেয়ে পরে নদীয়ার যাত্রায়
মাটি কেটে পানাগরে ফুটবল খাতরায়
ধেই ধেই নাচে খোকা বারোমাস নাগাড়ে
জঙ্গলে হি হি হাসে , হো হো হাসে পাহাড়ে .....

মুন্নাভাই : ফির বোলে তো.....স্সততা কি আছে ?
সার্কিট : ভাই, স্সততা বোলে তো ....

ওই দেখো দশতলা নীলরঙ্গা বাড়ি
তারই গায়ে লেগে আছে ধনেখালি শাড়ি
পাঁচ ফুট নিচে তার নীলরঙ্গা চটি
তারই নীচে লেখা আছে স্সততার বটি ....

শনিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৩

​​বহিষ্কৃত ~ অরুনাচল দত্তচৌধুরি

​​
তুমি কল্পশাস্ত্রলতা, আমি এক ঘোর অনাচারি
চাও বা না চাও আমি সব স্বর্গ ভেঙে দিতে পারি।

মন্দাকিনী পারে আসা মুখচোরা পারিজাত ঋতু
এসেও মেলেনি ফুল ... কেঁপে ওঠা লোকভয়ে ভিতু!

ভয় নেমে গেছে তার মাটিমাখা শেকড়ের কাছে।
পাপেরা ছড়ায় গল্প এ'পাড়ার আনাচে কানাচে।

না বুঝেই কেউ কেউ পারিজাতগন্ধ ভাবে তাকে
উৎসাহে সেই গল্প মেখে নেয় জিভে ও পোষাকে।

সময় ফুরোলে জানি এলে নিভে যাবে সমূহ প্রেরণা
সময়ের আগে ... তাই সেই ভুল ভাঙাতে যাবো না।

এ'রকম কত ভুল ঘটে যায় সময় বিশেষে
খবর যা কিছু রটে কিছু মিছে বাকি একপেশে।

দ্যাখো দিব্যি বেঁচে আছি। হলে হোক অতি নাটকীয়
স্বর্গের পাহারা টপকে অনাচারী প্রেমটুকু দিও।

শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৩

স্বাধীনতার চতুর্দশপদী ~ অমিতাভ প্রামাণিক

স্বাধীনতা, তুমি লুকিয়ে রয়েছ, আহা রে, একটি কোণে –
প্রভাতফেরীতে, বক্তৃতামাঠে, পতাকা উত্তোলনে।
ঐ দ্যাখো কত যুবক যুবতী গালেতে তেরঙা পেন্ট
লাগিয়ে দৃপ্ত ঘোষণা করছে, কী ইন্‌ডিপেন্‌ডেন্ট!
তুমি কেন তবে চুপসে রয়েছ, গায়ে মুখে পিঠে ঘাম –
কোথায় যাচ্ছ? যে পথে গিয়েছে প্রফুল্ল-ক্ষুদিরাম?
স্বাধীনতা, আভি হোঁশ মে তো আও, করোনাকো বিড়বিড়,
বাচ্চা নাকি হে? বুড়ো ভাম তুমি পূর্ণ ছেষট্টির।
তুমি সিপিয়েমে, তুমি তিনোমূলে, বিজেপিতে-কংগ্রেসে –
যখন গদীতে যে বসবে তুমি তার পাশে বসো ঘেঁষে।
কাগজে তোমার চলবে প্রচার, সেল হবে তুমি মলে,
সারা দেশ ছুটি, জনতা উপচে পড়বে সিনেমাহলে।

কী হল, শুনতে ভালো লাগছে না? চারিদিকে শৃংখল –
কী যন্ত্রে মেলে স্বাধীনতা তোরে, কোথা সে খুড়োর কল?

১৫ই অগাস্ট, ২০১৩

শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০১৩

সরিফুল ~ অমিতাভ প্রামাণিক

পৃথিবীর আকাশে কোথাও না কোথাও আজ চাঁদ দেখা গেছেই। পবিত্র রমজানের শেষে আজ খুশির ঈদ। আজ উৎসবের দিন, আনন্দের দিন আজ, আজ সকলের সঙ্গে মিলে সুখ বিতরণের দিন।

সরিফুলকে মনে পড়ল আজ। সরিফুল ইসলাম। ইস্কুলে আমরা এক ক্লাশে পড়তাম। ও এখন কোথায় থাকে, কী করে, কিচ্ছু জানি না।

সেটা বোধ হয় ক্লাশ সিক্স কিম্বা সেভেন। মাধ্যমিক অবধি আমার সুবিধা ছিল, যে ক্লাশে পড়তাম সেটা সেভেন্টি সেই ইয়ার, মানে নাইন্টি সিক্স-সেভেনের ঘটনা। আমার বয়স দশ কি এগার। রোগে ভুগে ভুগে ঘ্যানাপটকা চেহারা, বন্ধুরা বলত ঝ্যাঁটার কাঠির মাথায় ভাটাম ফল। কিন্তু সেটাও ঠিক না, পেটভর্তি পিলে, হাঁটলে আমার চেয়ে আমার পেটটা আগে আগে চলত, অনেকটা ভোডাফোনের জুজুদের মত।

বাবা ভোরবেলা গীতাপাঠ করত বলে মুখে মুখে সংস্কৃত শব্দ কিছু শেখা হয়ে যেত। বন্ধুবান্ধবদের নামের কী মানে, তার কী ব্যুৎপত্তি, এসব নিয়ে মাথা ঘামাতাম। শুভব্রত চিউইঙ্গাম (তখন চুনকাম বলতাম) খেয়ে কারো চুলে লাগিয়ে দিলে বলতাম, তোর ব্রত মোটেও শুভ নয়। উৎপলের হাসিটা ছিল ফোটা পদ্মের মত, প্রভাতের নাম আঁধার হলেই যেন বেশি মানাতো, মলিনও ওর নামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। আমি আমার অপরিসীম দ্যুতি দিয়ে ক্লাশ ভরিয়ে রাখতাম, অনেক সময়েই সেই দ্যুতির উৎস ছিল রোগের জীবাণু।

সরিফুলে এসে হোঁচট খেলাম। সরিষার ফুল হলে তাও এক রকম, কিন্তু সরিফুল কথার অর্থ কী? সরিফুলকে জিজ্ঞেস করলে ও উত্তর দিতে পারত না। নামের অর্থ নিয়ে ওর কোন মাথাব্যথা ছিল না। আমি একে ওকে জিজ্ঞেস করতাম, এই, সরিফুল মানে কী রে?

ক্লাশেরই একজন, কে মনে নেই, আমাকে ডেকে নিয়ে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, সরিফুল নেড়ে তো, নেড়েদের নামের মানে থাকে না। আমি বললাম, নেড়ে কী? ও বলল, জোরে বলিস না, শুনলে তোকে ধরে যা দেবে না!

অসভ্য গালাগালি আমাদের পাড়ায় লেগেই থাকত, শুনলেই বুঝে যেতাম কোনটা বলা উচিত আর কোনটা অনির্বচনীয়। দ্বিতীয়টার তালিকায় একটা নতুন শব্দ যোগ হল – নেড়ে! কিছুদিন পরে জানলাম, নেড়ে মানে মুসলমান। কালোদের যেমন কালো বলতে নেই, পাগলদেরও তাই, তেমনি মুসলমানদের কিছু কিছু শব্দ বললে অসম্মান করা হয়।

বন্ধুদের মধ্যে আবার মান-সম্মান! মাসখানেক পরেই ইস্কুলের পেছনের মাঠে ক্যাম্বিস বল দিয়ে কিরিং কিরিং খেলা হচ্ছিল টিফিন পিরিয়ডে। আমি ভাত খেয়ে ইস্কুলে যাই, টিফিনের বালাই নেই। পার্থ তাও প্রায় রোজ আমাকে কিছু না কিছু খাওয়াত। ঘুগনি, আলুকাবলি বিক্রি হত গেটের ঠিক বাইরেই। আর ছিল দুধ আইস্ক্রীম। মিষ্টি বরফের সিলিন্ডারে কাঠি ঢোকানো, তার মাথায় কোরানো নারকেল। আহ্‌, অমৃত। এই সব খাওয়ানোর বদলে আমি পার্থকে বইয়ের পেছনের কোশ্চেনের উত্তর লিখে দিতাম। সেই পার্থ সেদিন আসেনি, আমি তাই কিরিং কিরিং-এ ভিড়ে গেলাম। খেলাধূলায় আমার উৎসাহ কম, ছোটাছুটি করতে পারি না, রোগে ভোগা নিস্তেজ শরীর। কিরিং কিরিং-এ অনেক ছুটতে হয়, কেননা অপোনেন্টের কেউ কাছে থাকলেই সেই ক্যাম্বিস বল ছুঁড়ে মারবে। গায়ে লাগলেই আউট। হয় বলের গতিপথ থেকে সরে গিয়ে নিজেকে বাঁচাও, অথবা হাতে
চটি পরে নাও, সেই চটি দিয়ে বলটা ডিফ্লেক্ট করে দাও। শুধু চটিতে লাগলে আউট না।

সরিফুল আর আমি আলাদা দলে। খেলার মধ্যে কোন এক সময় সরিফুলের হাতে বল এল, আমি ওর নাগালের মধ্যেই। সরিফুল আমাকে মারতে গেল, চটি পরা হাতে আমি চিৎকার করে বললাম, জোরে মারিস না। কে শোনে কার কথা। সরিফুল গায়ের জোরে বল ছুঁড়ল, লাগলো আমার ঠিক চোখের নীচে। কালশিটে পড়ে গেল মুহূর্তে। মানে, বাড়ি গিয়ে মার হাতে আবার ঠ্যাঙানি খেতে হবে।

ক্লাশে বন্ধুবান্ধব যখন ফেরত গেলাম, আর আমার জিগ্‌রি দোস্তরা, যারা কিরিং কিরিং খেলছিল না, আমাকে জিজ্ঞেস করল, কে সেই পাষন্ড যে আমার এই হাল করেছে, যেন নাম বলে দিলেই ওরা গিয়ে তাকে কীচকের মত বধ করবে, আমি সরিফুলের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, ওই নেড়েটা!

সরিফুল এমনিতেই একটু অপ্রস্তুত ছিল – কারো লেগে যাক কেউই চায় না – যদিও খেলতে গিয়ে অনেক কিছুই হত, এ তো কিছুই না। কিন্তু আমার ওই অপভাষণ শুনে ওর মুখ সাদা হয়ে গেল। ওর চোখে আমি জ্বলন্ত ঘৃণার অভিব্যক্তি দেখলাম। বহু মাস সরিফুল আমার সাথে কথা বলেনি।

মাত্র কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত গোলাম মুরশেদের লেখা হাজার বছরের বাঙালির সংস্কৃতি বইটা পড়তে পড়তে জানলাম, বাঙালি মুসলমানদের পূর্বপুরুষ অনেকেই ছিল বৌদ্ধভিক্ষু, তাদের ন্যাড়া মাথা, সেই থেকে নেড়ে শব্দটা এসেছে। অ্যাজ ইফ, যারা ওদের নেড়ে বলছে, তাদের পূর্বপুরুষরা নেড়ে ছিল না! শুধু নেড়ে না, ওদের যবন, ম্লেচ্ছ ইত্যাদি আরো অনেক কিছু বলা হয়, বদলে ওরা বলে, কাফের!

এই সব শব্দ বাতাসে ধ্বনিত হলেই মহাসিন্ধুর ওপারে বজ্রনির্ঘোষের মত পাপ-তাপ জেগে ওঠে। মানুষ তখন আর মানুষ থাকে না।

শুধু সরিফুল না, আমাদের আরো কয়েকজন মুসলমান বন্ধু ছিল। রোজার সময় অনেকে ওদের একটু সহানুভূতির চোখে দেখত। আহা, বেচারিরা সারাদিন না খেয়ে থাকে। আমি এই জিনিসটা খুব ভাল বুঝতাম না। আমার তো হাজারটা রোগ। কিছু খাওয়ার আগে ওষুধ, পরে ওষুধ খেতে হত বলে খাওয়া জিনিসটাই পছন্দ করতাম না, খিদে তেষ্টাও বিশেষ ছিল না। তাছাড়া বাড়িতে মা-ঠাকুমা হরদম উপোষ করত। আজ বারের পুজো, কাল সন্তোষী মা, পরশু একাদশী, উপোষের ঘনঘটা। কেউ দিনের বেলা না খেয়ে আছে জানলে আমার তেমন কোন বিশেষ অনুভূতি হত না।

পরে জেনেছিলাম, ওদের অনেকেরই এমনিতেই দুবেলা খাবার জুটত না। রোজার মাসটা ধর্মপালনের নামে চলে যেত বেশ। অন্যসময়ও খাবার রুটিন খুব বেশি পাল্টাতো না। ক'বছর আগে ওদের বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন 'ওপারে' চলে গেছে, নতুন বাংলাদেশে। ওদের তাই খুব কষ্টে দিন কাটে।

রোজার পর অবশ্যম্ভাবী চলে আসত ঈদ। ইস্কুল ছুটি থাকত। আমরা শুনতাম, আমাদের যেমন দুর্গাপুজো, ওদের তেমনি ঈদ। কিন্তু কই, আমাদের যে পুজোয় প্যান্ডেল হয়, চার-পাঁচ দিন হৈ-হুল্লোড়, মাইক বাজে, বাজিপটকা ফাটে, ঠাকুর আসে, ঠাকুর যায়, আমরা নতুন জামাকাপড় পরে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরি, ওদেরও ডাকি, আয়, ওরা তো আমাদের ডাকে না!

যাদের নিজেদেরই দুবেলা দুমুঠো জোটে না, তারা কাদের ডাকবে! আমাদের চরমতম শত্রুর নাম দারিদ্র্য।

দারিদ্র্য বেড়ে যায় যত আমরা নিজেদের খন্ড-ক্ষুদ্র করি। যত বেশি ভেদাভেদ, তত দরিদ্রতা বেশি। এটা বুঝি না বলেই আমরা পূর্ব-পশ্চিম, ঘটি-বাঙাল, হিন্দু-মুসলমান, উচ্চ-নীচ! আর যতই চিল্লামিল্লি করি, পরিসংখ্যান বলে, পৃথিবীর দরিদ্রতম অঞ্চলগুলির একটা হচ্ছে এই গঙ্গা-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা।

আমি কোরাণ বা বেদ কিছুই পড়িনি, মুসলমান-হিন্দুর ব্যাপারটা এখনও বুঝি না। বইগুলো পড়া ভালো, অনেকে অনেক বছর চিন্তাভাবনা করে লিখেছেন, নিশ্চয় তার গুরুত্ব আছে। কিন্তু ভেবে দেখুন, আমাদের সভ্যতার ইতিহাস মাত্রই সাড়ে তিন-চার হাজার বছরের, আর এসব লেখা দেড়-দু হাজার বছর বা তারও আগে। এসব আঁকড়ে ধরে নিজেদের ভাগাভাগি করে সামনের দিকে কী করে চলতে পারি আমরা?

সরিফুল কাছাকাছি থাকলে আজ নিশ্চয় ডেকে নিয়ে খাওয়াত আমাকে। অথবা আমিই ওকে খাওয়াতাম।

চাঁদ দেখে পবিত্র ঈদ উদ্‌যাপন শুরু হয়। তার মাহাত্ম্যের বর্ণনা গুণীজন দেবেন। বাঁশবাগানের মাথায় চাঁদ ওঠা দেখলে আমার অবশ্য সেই হারিয়ে যাওয়া কাজলাদিদির মুখটাই ভেসে উঠবে। তাকে মাটির নীচে দাফন করা হয়েছিল, নাকি পোড়ানো হয়েছিল চিতার আগুনে, সে তথ্যে আমার প্রয়োজন নেই।

ঈদ-উল-ফিতর, ৯ অগাস্ট, ২০১৩

ভানুকাকার তেইশ-ছাব্বিশ - প্রদীপ দাশগুপ্ত

মানুষপুর।

স্থানীয় নাগরিক কমিটি বছরে যে ক’টি অনুষ্ঠান নিষ্ঠাভরে পালন করে থাকে, তার মধ্যে বছরের শুরুতেই আসে তেইশে জানুয়ারি। আর তার পরেই ছাব্বিশে।
তেইশে, সুভাষ বসুর জন্মদিনে, প্রধান বক্তা হিসাবে ডাকা হ’ল যথারীতি আমাকেই। যেহেতু, এলাকার একমাত্র হাইস্কুলের আমিই প্রধান শিক্ষক।
আমি সবিস্তারে বললাম ওঁর দীর্ঘ জীবনের বীরত্বের কাহিনী। কিভাবে কংগ্রেস ছেড়ে, ফুয়েরার হিটলারের রণ-মিত্র-দেশ জাপানে গিয়ে, - শেষমেশ – রাসবিহারী বসুর কল্যাণে - আজাদ হিন্দ বাহিনীর নেতাজী হয়ে ওঠা; এ-সবই বললাম। আমার নজর পড়েছিল বাচ্চাদের দিকে। তাই তাদের ভালোলাগার মত করেই বললাম। এতে শুধু বাচ্চারা নয়, বড়রাও সশব্দ হাততালিতে অভিনন্দন জানালেন।
সভার শেষে গোল বাধল ভানুকাকাকে নিয়ে! সবার সামনেই চীৎকার করে বলে উঠলেন,-‘হারামজাদা, ভুলইয়া গ্যাছস, তুই এককালে একখান কালেজে রাষ্ট্র-বিজ্ঞান পড়াইতিস?’
সভাপতি-সহ উপস্থিত সবাই ওকে নেহাতই খুড়ো-ভাইপোর ব্যাপার হিসাবে নিয়ে মজা পেলেও, আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম যে,  ওই সম্ভাষণটা ছিল নিছক ভূমিকা মাত্র। বাড়ী যাবার পরে, আমার কপালে দুঃখ আছে।  
বাড়ি ফিরে আমিই বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে যাদের নিয়ে অনুষ্ঠান, তাঁরা তো কেউ রাজনীতি করেননা। নাগরিক কমিটির অনুষ্ঠান দু’টির পিছনে প্রেক্ষিত হিসাবে রাজনৈতিক ইতিহাস থাকলেও, যেহেতু এখানকার নাগরিকগন এমন এক আর্থ-সামাজিক ধাপের মানুষ, দেশের শাসনকারী-প্রভুদের ঘেন্না-ধরানো রাজনীতিতে প্রভাবান্বিত হয়ে, রাজনীতির প্রতি বিবমিষা প্রকাশটাকেই এঁরা সুবিধাজনক মনে করেন। অতএব, পূর্বোক্ত দু’টি অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা বিশুদ্ধ অরাজনৈতিক অনুষ্ঠান হিসাবেই তুলে ধরার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালান। একটা অরাজনৈতিক অনুষ্ঠানে আমি কি করে .... ।
শেষ করতে না দিয়েই ভানুকাকা পড়লেন আমাকে নিয়ে।
 ‘অরে গাধা, এমন এক অসমান সমাজে অরাজনৈতিক কোন কিছু যে হয় না, হেয়া তুই জানস না? প্রকাশ্য দিবালোকে – মাইকে-মুখ-দিয়া তুই কইতে পারলি – তারা-তো কেউ রাজনীতি করেন না? সব শালা করে, লুকাইয়া করে, শোষক-শ্রেণীর মগজ-শাসনে নিজের অজান্তেও করে। নিজেদের শ্রেণী-অবস্থান টিকাইয়া রাখনের স্বার্থে, নিজেরেই ঠকাইয়া মিছা কথা কয়। এইয়ার নাম ভদ্রলোক। বোঝজো?’ বলতে লাগলেন যে, কেন রাজনীতি শব্দটা  ওঁদের কাছে ‘ট্যাবু’। ‘চউক্ষে কি দ্যাখতে পাওনা, দ্যাশের শাসকরা, দ্যাশের মাইষের টাকা লূঠ কইরা ক্যামনে ল্যাংটা হৈয়া নাচে? নিজেগো কামড়া-কামড়ি থিকা - দুই-একখান ধরা পড়লে,  নিজেগো কাগজ দিয়াই প্রচার চালায়,- কয় – “কেলেঙ্কারি”। ,  হে তো ক্যাবল, টিপ-অব-দি-আইসবার্জ! নিজেগো এক ভাগের বিরুদ্ধে এই বদনাম-এর পিছনে কৌশলডা কিয়ের লেইগগা? ভাবজোস কোন দিন? এই সকল পোলিটিক্যালি আধা-সেন্সিটিভ মানুষগো,- “সব-ঝুট-হ্যায়”-মার্কা এক দর্শনে পৌঁছাইয়া দিতে। অহন তো প্রচারের আর এক কায়দা ধরছে, হ্যাগো মুখ দিয়া এই কথা বাইর করতে সফল হইছে যে, - যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবন; দ্যাখতেই পায়না, – কে-কোন সোসিও-ইকনমিক ক্লাসের সেবা করে!  হ্যাগো ওই কৌশলেই তো এ্যারা অ-রাজ-নোইতিক! হেয়া বোজোনা?’
 ‘সীতারামাইয়ার পরাজয় আমার পরাজয়’,- কে বলেছিল? বাম-ডান, হিন্দু-মুসলিম ,- চরম-নরম, - সবাইকে নিয়ে চলতে চেয়ে উনি কোন শ্রেণীর স্বার্থে ঘা দিচ্ছিলেন, কার কার ষলা-ষড়যন্ত্রে উনি কংগ্রেস ছেড়েছিলেন?  দেশেরই স্বাধীনতার জন্য লড়তে গিয়ে ওঁকে দেশটাই কেন ছাড়তে হ’ল? যারা আজ ওঁকে মহান দেশপ্রেমিক নামে ডেকে প্রায় পুজা বেদীতে বসাচ্ছেন, কেন তাদের একথা ভুলে যাওয়া সুবিধাজনক  মনে হয় যে, স্বাধীনতার পরেও, আজাদ হিন্দ বাহিনীর বীর সেনানীদের শাস্তি দেবার জন্য বিচার সভা বসে?  কেন স্বাধীন ভারতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বীর সেনানীদের মুক্তির জন্য বামপন্থীদেরই আন্দোলন করতে হয়েছিল? ‘এসবই হইল গিয়া বিরাজনীতিকরণের কায়দা। হ্যারা  প্রকৃত গণতন্ত্রে, – অর্থাৎ সকল মানুষের অধিকার-কর্তব্য-সচেতনায় ভয় পায় দেইখাই, - মুখে গণতন্ত্র-গণতন্ত্র শান্তি-শান্তি কইরা গলা ফাডায়। এগো ভন্ড কইলে প্রকৃত ভন্ডগো, চোর কইলে চোরেগো অপমান হইব ’।  মা-বাবা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, মায় নাতিনাতনি-সহ, সকলের সামনেই বিস্তর গালি-যোগে, নাওয়া-খাওয়া ভুলে, এ ভাবেই, ভানুকাকা প্রায় তিন ঘন্টা ধরে আমাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে লাগলেন।  
     
          দ্বিতীয় তারিখটিতে, “আজকের প্রজাতন্ত্র দিবসে ---”  ইত্যাদি বলে গলা ফাটিয়ে যিনি এতক্ষণ ঘোষণা করছিলেন, সভাপতি তাঁর কানে কানে কি যেন বলতেই, তিনি দুম করে ‘সংক্ষিপ্ত’ বক্তা হিসাবে ঘোষণা করে বসলেন ভানুকাকার নাম। আমি প্রমাদ গণলাম। ভানুকাকা আজ  ইউনিভার্সিটির ক্লাস-রুম না ভেবে বসেন। এইসব ভদ্রমানুষজনেদের ‘বোর’ না করে ছাড়বেননা। এঁদের মনের মত করে, ভানুকাকা কি করে এমন এক বিষয়ে অরাজনৈতিক বক্তৃতা পরিবেশন করবেন? তা’ও আবার, সংক্ষেপে?
যথারীতি, বক্তৃতার শেষে, বাচ্চারা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। বড়রা বেশির ভাগই মুখ নীচু। আর সভাপতি এবং তাঁর পাশে দাঁড়ানো কয়েকজনের শুধু নিদারুণ-কষ্টের-হাসিমুখ নিয়ে গদ্গদ ভানুকাকার দিকে তাকিয়ে। সভাপতির তোয়াক্কা না করেই, ঘোষকই – মাইকে মুখ লাগিয়ে ছোট্ট উচ্চারণ করলেন,-‘সভা শেষ’।
আমি এমন শ্রুতিধর নই যে ভানুকাকার দীর্ঘ বক্তৃতার সবটাই আপনাদের কাছে পরিবেশন করব সংক্ষিপ্ত-সারটাই আপনাদের জানালাম।
ভানুকাকা প্রথমে ‘প্রজাতন্ত্র’ শব্দটা নিয়েই পড়লেন। প্রজাতন্ত্র আবার কি? সাধারণতন্ত্র। শব্দটা রাষ্ট্রনৈতিক। সাধারনে যাকে বলে রাজনৈতিক। এটা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শব্দ। প্রজাতন্ত্র  বললেই তো রাজার কথা চলে আসে। ইংরাজি শব্দটা হ’ল – “রিপাবলিক”,- ‘হ্যোয়ার দেয়ার ইজ নো মনার্ক, এ্যান্ড সুপ্রিম পাওয়ার ইজ ভেস্টেড উইথ দ্য পিপল’। আমি মনে মনে বললাম কি সব্বোনাশ! এ তো মারাত্মক কথারে বাবা, চরম ক্ষমতা থাকবে দেশের মানুষের হাতে!
‘রাজা থাকবে না; চূড়ান্ত ক্ষমতা থাকবে মানুষজনের হাতে’, ভানুকাকা বললেন। ‘অনেকে জিগাইবেন, হেইডা আবার ক্যামনতারা কথা? ক্ষ্যামতা তো হগলডিই – রাজার! জিগাইবেন,- তুই বইয়ের কথাগুলান এইরোম মাথায় ধইরা রাখোস ক্যান? মরবি, মরবি! এইয়াই হইতেছে দেশের একেবারে গোড়ার সমস্যা! বিচ্ছিন্নতাবাদ! বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞানচর্চা পইড়া থাকে একদিকে। ব্যবহারিক আচার-আচরণ হাঁটে আর একদিকে! উচ্চারণ আর আচরণের এই বিচ্ছিন্নতাবাদ,- শুধু দেশে বা সমাজে নয়, পেশার ক্ষেত্রে – এমনকি ব্যক্তিগত জীবনেও নানান আপদের আমদানি করে।
খুব রেগে গেলে, ভানুকাকা মাতৃভাষা ছেড়ে, বেশীরভাগ সময়ে, ক্লাস-নেবার সময়কার শুদ্ধ বাংলা ব্যবহার করেন। ভানুকাকা বলে চলেন,-‘অধিকাংশ দেশেই সকল মানুষকে - স্বাধীনতার গ্যারান্টি দিতে রাজাকে খেদিয়ে দেওয়া হ’লে কি হবে? দেশের মানুষ সে স্বাধীনতা কাকে বলে শাসকরা তা বুঝতে দিতে চাইলেই তো? অল্প সংখ্যক সুবিধাভোগী যাঁরা শিক্ষার সুযোগ তথা সব ব্যাপারটা বোঝার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরাও নিজশ্রেণী স্বার্থ ব্জায় রাখতেইবুঝতে চাননা। বেদের আমলের ধ্যান-ধারনার অভ্যাসে, মগজে রাজশাসনও অবিকল ছাপ নিয়ে আছে। রাজা যায়। রাজার আমলের সংস্কৃতি অর্থাৎ - শুধু গান-বাজনা না,- ভাবনা-চিন্তা-আচরণ দিব্যি জাঁকিয়ে বসে আছে। রাজভক্তি আর মগজ থেকে যেতেই চায়না! এখনও বহু রাজাকেই ঠাকুর-দেবতা সাজিয়ে পূজা করে!  এমনকি, নিজের ছেলের নামও, পরম স্নেহে রাখেন – ‘রাজা’! তো, এহেন মানুষদের কি করে বোঝান যাবে গণতন্ত্রের রূপে সব মানুষের স্বাধীনতা? ‘সাধারণতন্ত্র-দিবস’-কে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ বললে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়? সাধারন মানুষ তো প্রশ্ন করতেই পারে। মুশকিল হচ্ছে,- আমার ভ্রাতুষ্পুত্র, (আমি স্বগতোক্তি করি, মরেছে, বক্তৃতাতেও আবার আমাকেই আক্রমণ!) হে-তো হ্যাডমাষ্টার, হ্যাও বাদ যাননা। এ-গো বোঝানো রীতিমত মুশকিল যে, উচ্চারিত শব্দগুলো আসলে,- একজনের চিন্তার – অর্থাৎ - মগজের ‘হার্ড-ডিস্কে’,- আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রের পেয়াদাদের সাংস্কৃতিক প্রভাব-পরিবেশের দ্বারা  আগের থেকেই ‘প্রোগ্রাম’ করা চিন্তার প্রকাশ মাত্র।  ‘প্রজাতন্ত্র’ কথাটার মধ্যে ‘প্রজা’ শব্দটাই - মনের গোপন কোনে – অবচেতন মনে - চাগিয়ে তুলবে ‘রাজা’-সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণাগুলো। আমার ভ্রাতুষ্পুত্র ক’ন,- এদেশে গণতন্ত্র অনেকখানি বিকাশ লাভ করিয়াছে। কোন পর্যন্ত? ভোটদান পর্যন্ত? ভোটদানের পিছনে, বিচার-বুদ্ধির বিস্তার কতদূর? যাকে ক্ষমতা দিলাম, তিনি বা তার দল গণতন্ত্রের পক্ষে, অর্থাৎ - বেশীরভাগ মানুষের পক্ষে কাজ করেন কিনা, তার দৈনন্দিন খবর  নেবার সময় খরচ করতে আমরা রাজী থাকিতো? এই রকম খবর রাইখা ভোট দেওয়া মানেই যে এই রকম - চূড়ান্ত ক্ষমতার প্রয়োগ,- এইডা যদ্দিন না বুঝতাছেন, যদ্দিন এই দায়িত্ব বুঝিয়া না লইতেছেন- তদ্দিন গণতন্ত্র ঠিক মতো মগজে জায়গা পাইবনা। গণতন্ত্র সম্পর্কিত ধারণাগুলান – পোলাপানের মতো ইমম্যাচিওরই থাকবো। এ সম্পর্কিত সম্পূর্ণ ধারণা মগজে জায়গা  না পাইলে কি হয়?’ প্রশ্নটা তুলে, জবাব দিলেন ভানুকাকা নিজেই।
‘মগজে ভরা রাজা।- রাজার আমলের ধারণায়, জান-মালের সব দায়িত্ব রাজার। এদিকে রাজা তো খুঁইজা পাইতেছেন না। কি করা যায়? নিজেদের হাতে দায়িত্ব নেবার জন্য মগজ তৈরী হয় নাই। কারে দায়িত্ব দেওয়া যায়? ক্যান? একজন – অমুক-বাবা, অমুক-মা, কি একজন দাদা-দিদি হইলেই চলে। অতএব, কলৌ নামৈব কেবলম! কলি কালে নামই শ্রেষ্ঠ,নাম করলেই চলব। মন্ত্র-তন্ত্র, ধ্যান-জ্ঞান, পূজা-পদ্ধতি,- কিছুই জানার দরকার নাই। শুধু নাম করলেই চলব। এইয়ার চাইয়া সুবিধাজনক আর কি হইতে পারে! ব্যক্তিগত জীবনের এই আধ্যাত্মিক-ভক্তিবাদ যদি রাজনীতিতে আমদানি করি , তা’ হইলে তা’ হইবে আধ্যাত্মিক্তার ক্যারিকেচার। এই ক্যারিকেচারের পাপেই কপাল ভাঙ্গবে।
তখন আর,- পোলাটা ক্যান চাকরি পায়না, লাখের বেশি টাকা খরচ করিয়া যে পোলাটারে কম্প্যূটার-ইঞ্জিনিয়ার বানাইলাম – তারে ক্যান ভূতের মতন খাটাইয়া – একজন রাজমিস্ত্রির মজুরি দিতেও মালিক রাজি হয়না, ক্যান খাদ্যের-ওষুধের দাম বাড়তেই থাকে, দ্যাশের কারখানা বন্ধ হয়, আর বিদেশের ছাপমারা জিনিষে বাজার ছাইয়া থাকে,- এই স ক ল প্রশ্নের জবাব পাউবেন না!
অন্যদিকে,- অহন আবার, রাষ্ট্র-বিজ্ঞানে পড়া শব্দগুলার মানেটাই বদলাইবার আমল চলতাছে।  পৃথিবীর নানান দ্যাশে গণতন্ত্র আছে কিনা পরীক্ষা নেওয়ার এক স্ব-ঘোষিত মুরুব্বি জুটছে। তার কাছে, দ্যাশে দ্যাশে গণতন্ত্রের বেদী স্থাপনের মানে হইল গিয়া, সে দ্যাশটাতে দাঙ্গা লাগাইয়া, একটা হট্টচট্ট পাকাইয়া, নির্বাচনে রিগিং কইরা, নিজেগো দালাল বসানোর ঠিকা নিছে; যাতে সে মুরুব্বি তাদের সুবিধা মত, সে দ্যাশটারে পরাণ-ভইরা লুঠ করতে পারে। ইরাক থিকা ইউক্রেন – একই জিনিষ দ্যাখতেপাইবেন! আবার, ‘এম্পায়ার’ শব্দটারও, নতুন অর্থ আমাগো শিখানোর লাইগা, একদল বুদ্ধিজীবীরে কামে লাগাইছে। আর, এই পোড়া বাংলায় তো, হ্যাগো মাইষে আমাগো শিখাইবার জন্য উইঠা-পইড়া লাগছে, যাতে দলতন্ত্রের হিটলারী-পণারেই  আমরা গণতন্ত্র বলিয়াই মানিয়া লই’।      
 ভাক্তি যোগ্যরে ভক্তি করা খারাপ না। ঐটা দরকার। তবে, এইখানে, আমগো সকলেরই প্রণম্য, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের একখান কথা আপনেগো মনে করাইয়া দিতে চাই। শাস্ত্রী মশয় কইছেন,- “ভক্তিবাদ গাঢ় হইয়া একবার মস্তকে প্রবেশ করিলে লোকের বুদ্ধিখানি উচ্চতর সমালোচনায় কিরূপ অপারগ হয় তাহা আমরা প্রত্যহ দেখিতে পাইতেছি”। আইজও কি আমরা দেখিনা? আমরা নিজেরাই কি ‘গাঢ ভক্তিবাদে আক্রান্ত না? সন্দেহ নাই , এয়াতে সুবিধার অন্ত নাই। পড়া-জানা-বোঝা ,- কিছুরই দরকার নাই; ঐ যে আগেই কইছি,- মন্ত্র-তন্ত্র-ধ্যানজ্ঞানের দরকার নাই!
সুবিধা, সুবিধা, সুবিধা। অতএব, এই সুবিধাবাদেই আমরা গা ভাসাইলাম। এয়াতে আর যাই হউক।‘প্রজাতন্ত্র’ সফল হইতে পারেনা। বুদ্ধি,- কারো কম কি বেশী থাহেনা। যে যতটা কাজে লাগায়, তারে তত বুদ্ধিমান কয়। আমার ফার্ভেন্ট আপীল,- বুদ্ধি কামে লাগাইয়া, ওই চূড়ান্ত, ক্ষমতা,- এই সবের দায়িত্বটা একটু বুঝিয়া ল’ন। প্রজাতন্ত্ররে সফল করেন।
‘শেষ প্রশ্ন”। না, ভয় পাইয়েন না, আমার না,- “অমর কথা শিল্পী শরৎচন্দ্রের”। [মাইক থেকে মুখটা আমার দিকে ঘুরিয়ে নীচু স্বরে বললেন, ‘শরৎচন্দ্র কি ল্যাখছেন শোন, একটু মেমরাইজ করিস’।]
শরৎচন্দ্র লিখছেন,- ‘মানুষে অনেক ভুল, অনেক ফাঁকি নিজের চারপাশে জমা করে স্বেচ্ছায় কানা হয়ে গেছে। আজও তাকে বহু যুগ যুগ ধরে অনেক অজানা সত্য আবিষ্কার করতে হবে, তবে যদি একদিন সে মানুষ হয়ে উঠতে পারে’।
এইখানে উপস্থিত সকলেই আপনেরা সম্মানিত মানুষ, শ্রদ্ধেয় মানুষ; আপনেগো কওয়ার অধিকারি বলিয়া – আমি নিজেরে মনে করিনা। কিন্তু, আমার ভ্রাতুষ্পুত্র,- তিনিও একজন সম্মানিত। প্রধান শিক্ষক। কিন্তু, পরিবারে - আমি তার গুরুজন। - পুরানা সমাজের সেই হিসাবের সূত্রে তারেই কই যে, তুই দেবানন্দপুরের কুলাঙ্গার! দেবানন্দপুরের মানুষ হইয়া শরৎচন্দ্ররে পড়স না, জানস না, চিনস না?  নিজের চৌদিকে ‘ফাঁকি’ জমাইয়া ‘কানা’ হইয়া থাকবি?    
কয়েক সেকেন্ডের ‘পজ’ দিয়ে ভানুকাকা মন্ত্রের মতন করে উচ্চারণ  করলেন,- ‘সকলকে প্রণাম।’    
সভা শেষে, বাড়ী আসা পর্যন্ত গোটা রাস্তাটাই ভানুকাকা নিঃশব্দে এলেন। ভাবলাম, যাক বাবা, নিজের জমে থাকা কথাগুলো বলতে পেরে, ভানুকাকা নিশ্চয়ই ঠান্ডা হয়েছেন। আমার ফাঁড়া কাটল!
বাড়ীতে ঢুকতে না ঢুকতেই হাঁক দিলেন,-‘বৌঠান! অর কাকিরে ক’ন তো, আমার ল্যাখার নূতন খাতাটা লইয়া আসতে!’
কাকীমা নয় , গোলমাল আন্দাজ করে বোধ হয়, – আমার মাতা ঠাকুরাণীই স্বয়ং ফাইলটা নিয়ে এলেন। তা’ থেকে আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে, বললেন, ‘গাধা, পড়’!
এ কি! এ যে রবিঠাকুরের একগাদা উদ্ধৃতি। ‘বাতায়নিকের পত্র’। .মাথাটা ঘুলিয়ে গেল,- দেশ, সাধারণতন্ত্র, সার্ব্বভৌমত্ব, শরৎচন্দ্র,- শেষে – রবীন্দ্রনাথ! ওফ!
  “৫ই জৈষ্ঠ, ১৩২৬” (ইং ১৯১৯) “জাহাজের খোলের ভিতরটায় যখন জল বোঝাই হয়েছে – তখনি জাহাজের বাইরের জলের মার সাঙ্ঘাতিক  হয়ে ওঠে। ভিতরকার জলটা তেমন দৃশ্যমান নয়, তার চাল-চলন তেমন প্রচন্ড নয়, সে মারে ভারের দ্বারা, আঘাতের দ্বারা নয়, এই জন্যে বাইরের ঢেউয়ের চড়-চাপড়ের উপরই দোষারোপ করে তৃপ্তি লাভ করা যেতে পারে; কিন্তু হয় মরতে হবে, নয় একদিন এই সুবুদ্ধি মাথায় আসবে যে আসল মরণ ঐ ভিতরকার জলের মধ্যে, ওটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেঁচে ফেলতে হবে। ..... এ কথা মনে রাখতে হবে, বাইরের বাধা-বিঘ্ন বিরুদ্ধতা চিরদিনই থাকবে,  থাকলে ভাল বৈ মন্দ নয় – কিন্তু অন্তরে বাধা থাকলেই বাইরের বাধা ভয়ংকর হয়ে ওঠে। এই জন্য ভিক্ষার দিকে না তাকিয়ে সাধনার দিকে তাকাতে হবে, তাতে অপমানও যাবে, ফলও পাব”।
পড়া শেষে,চোখ তুলতেই, বললেন, ‘সেই বাংলা ১৩২৬ সনে, মানে আজ থিকা চৌরানব্বই বছর আগে, ত’গো শুদ্ধিকরণের লইগগা ঋষি-কবি লেইখখা গ্যাসেন! রবি ঠাকুররে ত’রা চিনস?’
    -----------
                                                            ৪ঠা আগস্ট, ২০১৩।


সোমবার, ৫ আগস্ট, ২০১৩

অঙ্ক ও তার উত্তর ~ সুমন্ত্র মাইতি

অঙ্ক আমার কোনদিনই পছন্দের বিষয় নয় ৷ অথচ দুর্ভাগ্য এই যে খাতায় অঙ্কের হিসেবগুলো ঠিক মিলে যেত এবং পরীক্ষা নামক মূল্যায়ন পদ্ধতিতে কখনই আমাকে "অঙ্কে কাঁচা" বলে অভিহিত করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে নি ৷

আমার পছন্দের বিষয় ছিল সাহিত্য, কিন্তু আমাদের মধ্যবিত্তীয় শিক্ষামনস্কতায় সেই ছেলেকে তখনই সাহিত্য নিয়ে পড়তে অনুমতি দেওয়া হয় যখন প্রমানিত হয় যে তার দ্বারা অঙ্ক বিষয়টি করায়ত্ত করা অসম্ভব এবং যতক্ষণ না পরীক্ষার নম্বর সেই ধারনায় সরকারী সিলমোহর বসাচ্ছে ৷ কতজনকে বলতে শুনেছি, "ছেলেটা না অঙ্কে কাঁচা, তাই ওকে আর্টসেই দিলাম বুঝলি?" কিম্বা "ওরে বাবা, ওসব অঙ্ক টঙ্ক আমার দ্বারা হবে না, আমার বাবা আর্টসই ভালো" ৷ অবশ্য শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কচকচানি করতে বসি নি , ওসব নিয়ে অনেক নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়ে গেছে, অনেক গুরুগম্ভীর সেমিনার আয়োজিত হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় নি ৷ আমি অঙ্ক নিয়ে কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলব ৷

পরমেশ্বরণ নামে এক দক্ষিন ভারতীয় ভদ্রলোক আমাদের অঙ্ক পড়াতেন, আড়ালে আমরা তাকে বাঘ বলে ডাকতাম ৷ ভদ্রলোক এককালে সৈন্যবাহিনীতে ছিলেন, মেজাজটা ছিল একবারে মিলিটারীয় এবং ক্লাসে ছিলেন সাক্ষাত যম ৷ আমার অবশ্য কোনদিনই পরমেশ্বরণকে পছন্দ ছিল না, কারণ বাচ্চা বাচ্চা ছেলেদের সাথে ঐরকম ব্যাঘ্রসুলভ আচরণে কি বাহাদুরি ছিল আমি এখনো বুঝে উঠতে পারি না ৷ যাইহোক, পরমেশ্বরনের অঙ্ক শেখানোর মন্ত্র ছিল নিয়মানুবর্তিতা এবং নিয়মানুবর্তিতা ৷ আমরা তখন অঙ্ক কষতাম চৌকো খোপের সেইসব খাতায়, একেকটা খোপে একেকটা সংখ্যা নিয়ে কারবার , তারপর তাকে যোগ বিয়োগ গুন ভাগ করে অবশেষে সেই কাঙ্খিত ম্যাজিক সংখ্যায় পৌছনো, যেটাকে বলা হত রেজাল্ট ৷ মাঝপথে কোনো ভুল হলে একটা সংখ্যায় পৌছনো যেত বটে, তবে তা কাঙ্খিত রেজাল্ট নয়, অতএব ভুল ৷ অবশ্য অঙ্কের এটাই নিয়ম, একই অঙ্কের কখনো দুটো উত্তর হতে পারে না ৷ পরমেশ্বরণ এই নিয়মের ব্যতিক্রম নন, তার কঠোর নির্দেশ ছিল পরীক্ষার খাতা যেন ঝকঝকে হয়, প্রত্যেকটা সংখ্যা এবং চিহ্ন যেন নির্দিষ্ট প্যাটার্ন ফলো করে, এর অন্যথা হলে ঠিক উত্তরেও নম্বর কাটা যাবে ৷ এবং এতসব পরেও যদি উত্তরটা শেষ লগ্নে গিয়ে ভুল হয়, তাহলে নম্বরের খোপে বসবে এক শুন্য ৷

স্যার রয় ছিলেন আমাদের অঙ্কের রবীন্দ্রনাথ ৷ "সায়েন্সের ছেলে" হবার দরুন বহুদিন অঙ্ক নিয়ে নাড়াঘাটা করতে হয়েছে, অনেকের ক্লাস করেছি, সবার প্রতি যথার্থ সন্মান রেখেই বলছি, ওনার কাছে যদি আরো কিছুদিন নাড়া বাঁধার সুযোগ হত, বিষয়টাকে হয়ত আরেকটু বেশি ভালবাসতে পারতাম ৷ স্যার রয়ের কোনো ধরাবাঁধা নিয়মের বিষয়ে ছুতমার্গ নেই , অঙ্কের নিয়ম মেনে উত্তরে পৌছতে পারলেই তিনি খুশি ৷ তদুপরি নিয়ম মেনেও যদি শেষবেলায় সামান্য হিসেবের ভুলে উত্তরটা বেঠিক হয়, তিনি সেই ভুলটা লালকালি দিয়ে সংশোধন করে পুরো নম্বর বসাতেও দ্বিধাবোধ করেন নি ৷

বহুদিন পর জীবনের খাতায় কিছু অঙ্কের হিসেব মেলাতে গিয়ে কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে ৷ কোনটা আসল, উত্তরটা পৌছনোর পথ, নাকি উত্তরটা? শেষ লগ্নে যদি সামান্য হিসেবের ভুলে উত্তরটা ভুল হয়ে যায়, তাহলে নম্বর কত পাব স্যার ? ফুল মার্কস, নাকি শুন্য ?