বুধবার, ২২ জুন, ২০১৬

দেশটা কাদের? ~ সুশোভন পাত্র

কিছুদিন আগেও একটা জোকস বাজার গরম করত। এক ভদ্রলোক এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে বসে প্লেন গুলোর ওঠা নামা দেখতে দেখতে আমেজ করে সিগারেট টানছেন। সেইসময় একজন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উপদেশ দিতে শুরু করলেন। "আপনি দিনে কটা সিগারেট খান? কত দামি সিগারেট খান? কতদিন ধরে সিগারেট খাচ্ছেন ?" -এইসব। তারপর একটা হিসেব কষিয়ে তিনি ধূমপায়ী কে বুঝিয়ে বললেন "আপনি যদি সিগারেট না কিনে, পয়সা গুলো জমাতেন, তাহলে আজ সামনের ঐ প্লেনটা আপনার হতে পারতো।" প্রত্যুত্তরে ঐ ধূমপায়ী তাঁকে জিজ্ঞেস করেন তিনি আদেও সিগারেট খান কিনা। নঞর্থক উত্তর পেয়ে  পরের প্রশ্ন করেন যে "তাহলে ঐ প্লেনটা কি আপনার ?" উপদেষ্টা ব্যক্তি বেশ বিব্রত হয়ে বলেন "অবশ্যই না।" তখন ধূমপায়ী একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে কিলার পাঞ্চটা দেন- "মাই নেম ইস বিজয় মালিয়া। অ্যান্ড দ্যাট প্লেন ইস মাইন।" মানে,আপনি যদি বিজয়া মালিয়ার মত ধনী এয়ারলাইন ব্যবসায়ী হন তাহলে লাউঞ্জে বসে সিগারেট টানার 'আইন অমান্য' আপনি করতেই পারেন। পয়সা থাকলেই আপনার সাতখুন মাফ। 

'কিং অফ গুড টাইমস' বিজয় মালিয়ার ৬০'তম বার্থডে সেলিব্রেশনে গোয়ার বিলাসবহুল ক্যান্ডোলিম ও সিংকুয়েরিম প্রাইভেট বিচের রাতের আকাশ যখন উদ্ভাসিত আলোক সজ্জার আতিশয্যে, ২ ঘণ্টার লাইভ কনসার্টর পর সোনু নিগমকে যখন প্রতিস্থাপিত করছেন স্পেন থেকে উড়ে আসা এনরিক ইগলেসিয়াস, শ্যাম্পেনের মাদকতা আর 'ব্যালেন্ডানো'র সুরে যখন অতিথিরা সম্মোহিত, ঠিক তখনই দেশজুড়ে বকেয়া মজুরি আদায়ের জন্য অনশনে কিংফিশার এয়ারলাইন্সের ক্রিউ মেম্বাররা। ঠিক তখনই দেশের ১৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে কিংফিশার এয়ারলাইন্সের বকেয়া ঋণের অঙ্ক ৯,০০০ কোটি। রঘুরাম রাজন বলেছিলেন "সিস্টেমের কাছে যার এতো ধার বাকি, জন্মদিনের পার্টিতে তাঁর এতো অপব্যয়র বিলাসিতা মানায় না।" নর্থ ব্লকের অনুগত আমলারা অবশ্য রাজন কে আলতো করে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন "কারও 'পারসোনাল' ব্যাপারে নাক না গলানোই ভালো।" কিন্তু কোদাল কে কোদাল বলার বদভ্যাস থেকেই কড়া জবাব দিয়েছিলেন রাজন- "যদি কেউ নিজে অনাদায়ী ব্যাংক ঋণের 'পারসোনাল' গ্যারেন্টার হন এবং বিপুল পরিমাণ ধার বকেয়া রাখেন তাহলে তাঁর 'পারসোনাল' লাইফে নাক তো গলাতেই হবে।" 

ক্রেডিট সুইসের তথ্যানুসারে দেশের ১০টি 'বিগ বিজনেস হাউস'র অনাদায়ী ঋণের মোট পরিমাণ ৭.৫ লক্ষ কোটি টাকা। ক্রেডিট রেটিং সংস্থার হিসেবে যার ৫০%'ই 'ডিফল্ট' এবং প্রয়োজনে সরকারের তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেই এই বিপুল বকেয়া ঋণ আদায় করতে পারে। কিন্তু বিজনেস হাউস নাম যখন এসার, ভেদান্ত, জিন্দাল, আম্বানি, আদানি -তখন দেশের সরকারের ঘাড়ে কটা মাথা যে এদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে? ার নিলে নির্বাচনী প্রচারে "অবকি বার/মোদী সরকারের" তুমুল প্রচারের বিপুল টাকা কে ঢালবে? হবুমন্ত্রী আর গবুরাজা কে উড়ে বেড়াতে প্রাইভেট চপারই বা কে দেবে?
কিন্তু সরকার ও বিগ বিজনেস হাউসের আন্ডার টেবিল সমঝোতার গলার কাঁটা হলেন রাজন। সমস্ত ব্যাংক কে তিনি নির্দেশ দিলেন "অন্যায় সুবিধা না দিয়ে এই বিগ বিজনেস হাউস গুলির অনাদায়ী ঋণ দ্রুত আদায় করতে হবে।" ফলত ১৯৯৯-২০০০'র 'এশিয়ান ফাইনান্সিয়াল ক্রাইসিসের' সময়েও যে এসার গ্ৰুপ প্রায় 'ঋণখেলাপি' হয়েও ব্যাঙ্ক'র দয়ায় আর নেতা-মন্ত্রী'দের আনুগত্যে পার পেয়ে যাচ্ছিলো তারাও এবার নিজেদের সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রি করে বকেয়া ঋণ আংশিক মেটাতে বাধ্য হয়েছিল। 

৩১শে মার্চ কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রকের অধীনস্থ, 'ডাইরেক্টরেট অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স', তাদের এক 'জেনারেল এলার্টে' প্রায় ৫০টি কয়লা আমদানিকারী সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা 'স্টিম' কয়লার দাম সংস্থাগুলি বে-আইনি ভাবে বাড়িয়ে রেখেছে। যেখানে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা কেনা, মালবাহী জাহাজের খরচ ও কাস্টম ডিউটি সহ কয়লার আমদানিকৃত দাম হয় উচিত ৩৩৫০ টাকা/মেট্রিক টন সেখানে এই সংস্থাগুলি বিভিন্ন স্টেট ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ড ও কর্পোরেশন কে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে ৫৪৯৪/মেট্রিক টন হিসেবে। ফলে আপনাকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ'র জন্য বেশি দিতে হচ্ছে প্রায় ১টাকা ৫০পয়সা। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রীর তথ্যানুসারে আমরা যেখানে প্রতিবছর বিদেশ থেকে মোট ১লক্ষ ৫হাজার কোটি টাকার কয়লা আমদানি করি সেখানে এই দুর্নীতির পুঞ্জীভূত মোট অঙ্ক প্রায় ৫০, ০০০ কোটি। মুম্বাইয়ের ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে আইন মন্ত্রকের জমা দেওয়া রিমান্ডে এই দুর্নীতিতে নাম আছে রিলায়েন্স, আদানি, জিন্দাল, এসার মত রাজনের চক্ষুশূল বিগ বিজনেস হাউসগুলিরই। তাই রঘুরাম রাজন কে চলে যেতে বাধ্য করা নিতান্তই রুটিন ওয়ার্ক, কিম্বা অর্থমন্ত্রীর সাথে 'লো ইন্টারেস্ট রেট' আর মুদ্রাস্ফীতির তু তু ম্যা ম্যা নয় বরং 'রিস্কলেস ক্রনি ক্যাপিটালিজমের' পথের কাঁটা সরাতে আস্ত একটা 'মোডাস অপারেন্ডি'।  ঐ যে বলে না, দেয়ার ইস অলওয়েজ অ্যা 'মেথড ইন ম্যাডনেস'। 

যে দেশে ঋণখেলাপি ললিত মোদিরা পায়ের উপর পা তুলে নিশ্চিন্তে লন্ডনে বসে থাকেন, যে দেশে বিজয় মালিয়ারা রাজ্যসভার সাংসদের পদ অলঙ্কৃত করেন, যে দেশে ওত্তাভিও কাত্রোচ্চিরা বোফোর্সের পরও কলার তুলে ঘুরে বেড়ান, যে দেশে ওয়ারেন অ্যাণ্ডারসেনরা ভোপালে নির্বিচারে মানুষ মেরে মন্ত্রীদের প্লেনে চেপে পালিয়ে গিয়ে আমেরিকায় নিশ্চিন্তে মরেন, সে দেশে রঘুরাম রাজনরা থাকতে পারেন না। সে দেশে সতেন্দ্র দুবেরা বাঁচতে পারে না। সে দেশে মুদ্রাস্ফীতি কমতে পারে না। সে দেশ ক্রনি ক্যাপিটালিজমের। সে দেশ সুব্রহ্মণ্যম স্বামীদের। সে দেশ হাম্বার। সে দেশের গোবরই ভিত্তি। সে দেশের ঘুঁটেই ভবিষ্যৎ...

শুক্রবার, ১৭ জুন, ২০১৬

ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন ও পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন ~ নগর যাযাবর



এবারের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের আলোচনার শুরুতে অবশ্যই কৃতিত্ব দিতে হবে বিজয়ী পক্ষকে | দীর্ঘদিনের শাসকদলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কারণে তৈরি হওয়া ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় আসা এক জিনিস আর পাঁচ বছর রাজ্য চালানোর পর পুনর্নির্বাচিত হওয়া আরেক জিনিস, কারণ এক্ষেত্রে বিচার হয় প্রধানত তার কাজের ভিত্তিতে, আর কারুর বিরুদ্ধে ক্ষোভের ভিত্তিতে নয় | সুতরাং তৃণমূলের এবারের জয় অবশ্যই হ্যাঁ-ভোটের ভিত্তিতে (সেই হ্যাঁ-ভোট যেভাবেই জোগাড় হয়ে থাকুক না কেন), এটা স্বীকার করেই কোনো আলোচনা শুরু করতে হবে |

নির্বাচন শুধু প্রার্থীদের পরীক্ষা নয়, রাজনৈতিক দলগুলির পরীক্ষা, এবং জনগণেরও পরীক্ষা |

প্রার্থীদের পরীক্ষার সাফল্য-অসাফল্য স্পষ্ট, ফলাফল বেরোয় তৎক্ষণাৎ, খুব একটা কিছু গন্ডগোল না হলে মেয়াদ পাঁচ বছর | বাকিদের ক্ষেত্রে হিসাবটা আরেকটু জটিল এবং বহুমুখী | সেখানে বর্তমানের সঙ্গে অনেক সময়েই মিশে থাকে অতীত ও ভবিষ্যৎ |  

যেমন ধরুন ভোটার অর্থাৎ জনসাধারণ | তাদেরও পরীক্ষা হয় নির্বাচনে | সেই পরীক্ষায় তাদের সরাসরি কোনো হারজিত হয়না, কিন্তু সেই সময়ের সমাজের একটি প্রতিচ্ছবি হিসাবে তাদের মতামত ইতিহাসে লেখা হয় | সেই ইতিহাসের ভিত্তিতে সময় সেই সমাজের, তার নৈতিকতার, মূল্যবোধের বিচার করে | বলাই বাহুল্য সেই বিচার স্বল্পমেয়াদী রাজনীতির ক্ষেত্রে কোনো তফাৎ করে না | যেমন ধরুন এই নির্বাচনের আগে ক্যামেরায় ধরা পড়ল শাসক দলের একগুচ্ছ শীর্ষ নেতা ঘুষ নিচ্ছেন, দাপুটে আঞ্চলিক নেতা থেকে ডাক্তার, অধ্যাপক | কিন্তু দেখা গেল এর ফলে জনগণ এটা মনে করেনি যে তৃণমূল দলটা এতটা অনৈতিক যে তাকে সরিয়ে দিতে হবে, বা তার জয়ের পরিমান কম করতে হবে | দেখা গেল যে বৃহত্তর জনগণ এটাও মনে করেনি যে ওই ঘুষখোর নেতারা ব্যক্তিগতভাবে এমন কোনো অনৈতিক কাজ করেছেন যে তার জন্য তাদের হারাতে হবে | সেরকম মনে করলে এমন ফলও হতে পারত যে তৃণমূল জিতল কিন্তু ওই নেতারা হারলেন | কিন্তু না, তা হয়নি | যে নেতা ঘুষ নিতে নিতে সগৌরব জানিয়েছিলেন যে তিনি এত কম টাকা ঘুষ নেন না ("ছুঁচ মেরে হাত গন্ধ" করেন না), তিনিও হাসতে হাসতে জিতেছেন | শহুরে লোকের কারুর কারুর একটু আত্মশ্লাঘা দেখা গিয়েছিল যে তাঁরা এসব অপছন্দ করেন, কিন্তু গ্রামের গরিব মানুষ এত কিছু বোঝে না, তাই এসব সত্ত্বেও তৃণমূল জিতবে | বাস্তবে দেখা গেছে, না, গ্রাম শহর কোথাও কোনো প্রভাব পরেনি, ঘুষখোররা সব জায়গাতেই জিতেছেন | এত যে কটু কথা হলো, এত যে ভয় দেখানো হলো, এই যে কার্টুন পাঠানোর জন্য অধ্যাপককে জেলে পাঠানো হলো, তার কোনো প্রভাব দেখা গেল ভোটে পড়ল না | দেখা গেল যে দু-টাকা কেজি চাল ও সাইকেল-দান প্রভাব ফেলল | আমরা এ-ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করব না, কারণ এটা আমাদের এই লেখার মূল বিষয় নয়, সাক্ষী হিসেবে এই-কথাগুলো লিপিবদ্ধ করলাম শুধু |

এ-ব্যাপারে আরেকটা কথাও বলা দরকার - এই যে মানুষ এই যে নৈতিকতার ভিত্তিতে ভোট দিল, এটা শুধু গত পাঁচ বছরের তৃণমূলের শাসনের ফসল নয়, কারণ এই ভোটাররা তাদের জীবনের বেশিরভাগ এবং দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন বামফ্রন্টের শাসনে | আর নৈতিকতা বা আদর্শ একদিনে তৈরি হয়না বা ভাঙ্গে না | এ-প্রসঙ্গে আমরা পরে ফিরব |

নির্বাচনের আরেক মূল অংশীদার রাজনৈতিক দলগুলো | তাদের ক্ষেত্রে আবার চোখে যা দেখা যাচ্ছে, সাধারণত নির্বাচনের ফলের অভিঘাত হয় তার থেকে বেশি |

যেমন ধরুন এই নির্বাচনে বামফ্রন্ট ৩২-টি আসনে জিতেছে এবং বিজেপি ৩-টি মাত্র আসনে জিতেছে | মানে হবু বিধানসভায় বামফ্রন্টের শক্তি বিজেপির প্রায় দশগুণ | এটুকু হচ্ছে স্বল্পমেয়াদী হিসাব | তার সঙ্গে এটাও পরিষ্কার যে বামফ্রন্ট এখন এই রাজ্যে একটি ক্ষয়িষ্ণু শক্তি এবং বিজেপি বর্ধিষ্ণু শক্তি | প্রায় অর্ধেক শতক বাংলার একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ শক্তি থাকার পর, সাড়ে তিন-দশক দাপটের সঙ্গে রাজ্য শাসন করার পর, নিজেদের মতাদর্শে রাজ্যের মানুষকে অনুপ্রাণিত করার প্রচুর এবং দীর্ঘ সুযোগ পাওয়ার পর বামফ্রন্ট এখন এই রাজ্যে মাত্র এক-দশমাংশ আসনে জয়ী, ভোট মোটামোটি ২৫%, যার মানে প্রতি চারজনে তিনজন মানুষ বামফ্রন্ট-কে ভোট দেননি (এই হিসাবে কংগ্রেস-কে আসন ছাড়ার প্রভাব সামান্য)| অন্যদিকে, রাজ্যের দীর্ঘ ইতিহাসে যারা প্রায় অনুপস্থিত ছিল, সেই বিজেপি প্রায় সব আসনে ভোট বাড়িয়েছে, বহু আসনে ফলাফলে নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছে এবং শুধু শহরাঞ্চলে নয়, আরএসএস-এর ধীরে ধীরে বাড়ানো সংগঠনের ভিত্তিতে তারা এমনকি মাদারিহাট আসনটি জিতে নিয়েছে এবং কালচিনিতে মাত্র দেড়হাজার ভোটে হেরেছে | তৃণমূল বা কংগ্রেসের কি হবে জানিনা, তবে এই ধারা চলতে থাকলে পরের নির্বাচনের আগে রাজ্যে বিজেপি এবং বামফ্রন্টের পারস্পরিক পরিষদীয় অবস্থাটা উল্টে যেতে পারে | সুতরাং বামফ্রন্ট-বিজেপির ওই ৩২-৩-টা নিরেট সংখ্যার বাইরেও আরো অনেক কিছু নির্দেশ করে |

এইটুকু প্রাথমিক কথার ভিত্তিতেই আমরা ঢুকব আমাদের মূল আলোচ্য প্রশ্নে - কোন দিকে যাচ্ছে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন?

এই নির্বাচনের ফলের ভিত্তিতে নিশ্চয়ই কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে ও বাইরে বহু আলোচনা হবে | পার্টির আলোচনায় অবশ্যই বুথভিত্তিক খুঁটিনাটি আলোচিত হবে এবং আলোচিত হবে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের প্রভাব | সেসব আলোচনা অনেক হয়েছে, আরো হোক |

কিন্তু শুধু তার ভিত্তিতে সমস্যাটির মূলে পৌঁছনো যাবেনা, কারণ সমস্যাটি কৌশলগত নয়, আদর্শগত |

আমাদের মনে হয় কমিউনিস্ট শক্তির এই লাগাতার শক্তিক্ষয়ের কারণ মানুষ আর কমিউনিস্ট পার্টিকে কমিউনিস্ট পার্টি বলে চিনতে পারছেনা, বুঝতে পারছেনা অন্য অনেক দলের সঙ্গে তার আদর্শগত তফাতটা কোথায়, সোজা কথায় কমিউনিস্ট পার্টির প্রয়োজনটা কী |

চিনতে পারছেনা কারণ এরা আর এখন কোনো আদর্শচালিত কর্মসূচী নেয়না বা স্লোগান দেয়না, দিলেও বোঝা যায়না | যেমন ধরুন এই নির্বাচনে এবং তার বেশ কিছুদিন আগে থেকে সিপিএম-এর পশ্চিমবঙ্গ-কেন্দ্রিক মূল স্লোগান ছিল দুটো - শিল্প করে কর্মসংস্থান করতে হবে আর রাজ্যে অপশাসনের অবসান চাই | এখন বড় পুঁজিপতিকে সুবিধা দিয়ে - কম পয়সায় জমি, কর-ছাড়, সুবিধাজনক শর্তে ঋণ, এমন কি সময় বিশেষে মুনাফার গ্যারান্টি - ডেকে এনে শিল্প করলে কিছু কর্মসংস্থান হবে, দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ হবে আর তার "সুফল" চুঁইয়ে পরে দেশের গরিব মানুষের কাছে পৌঁছবে, আর এই রাস্তায় পুঁজিপতি যত লাভ করবে তত তার ব্যবসা করার ইচ্ছা বাড়বে - প্রগতির এই ধারণা সম্পূর্ণ ধনতান্ত্রিক আদর্শের ধারণা, এই মডেলে উন্নতি করার জন্য কমিউনিস্ট পার্টিকে ভোট দেওয়ার দরকার নেই | বিজেপি-কংগ্রেস, এমন কি তৃণমূল, এই কাজ সম্ভবত আরো ভালোভাবে করবে, বহু ক্ষেত্রে বড় পুঁজিপতিরা এইসব পার্টির নেতৃত্বে আছে এবং তারা মনে প্রাণে এই তত্ত্ব বিশ্বাস করে |



দ্বিতীয় স্লোগান সুশাসন | এই দাবি সবাই করবে, এই মুহুর্তে বিশেষ করে করার দরকার, কিন্তু সুশাসনের জন্যও কমিউনিস্টদের ভোট দেওয়ার আলাদা করে দরকার নেই, পৃথিবীর উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলোতে চমৎকার সুশাসন আছে, আইন আইনের পথে চলে, কাজের জন্য কাউকে ঘুষ দিতে হয়না, ইত্যাদি |

তাহলে করণীয় কী? অদ্ভূতভাবে এই প্রশ্নটি গত কুড়ি বছরে এ-দেশের কমিউনিস্টদের কাছে জটিল এক ধাঁধা হয়ে উঠলো | পার্টি কংগ্রেসের পর পার্টি কংগ্রেস গেল, প্লেনাম গেল, কিছুতেই আর তার উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না! ক্রমশ তারা বুঝলো যে ধ্যান-ধারণায় "আধুনিক" হতে হবে | আর কমিউনিস্ট হিসাবে "আধুনিক" হওয়ার জাদুকাঠিটি খুঁজে না পাওয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির এক অদ্ভূত অবস্থা দাঁড়ালো - ভারতে সিপিএমের নেতারাসহ সম্ভবত একজনও বিশ্বাস করেনা যে সিপিএম সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য লড়ছে, বরং তাকে জঙ্গি আন্দোলনের নিরিখে যথেষ্ট নিরীহ একটি সংসদীয় দল বলে মনে হয়, কিন্তু পার্টি সশস্ত্র বিপ্লবের কথা তার কর্মসূচী থেকে সম্পূর্ণ মুছে দেয়নি | "সর্বহারার একনায়কতন্ত্র" প্রতিষ্ঠা করার কোনো ইচ্ছা বা সেদিকে কোনো ভূমিকা চোখে পরছেনা, বরং অন্য অনেক "গণতান্ত্রিক" দলের থেকে সিপিএম অনেক বেশি সংসদীয়ভাবে গণতান্ত্রিক, তবু ওই কথাটি কর্মসূচীতে আছে | "জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব" বা "সর্বহারার একনায়কতন্ত্র" আছে কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে, যদিও মানুষ বহুদূর পর্যন্ত দলের কাজে তার কোনো ব্যবহারিক প্রভাব দেখছেনা | আর সামনে দেখছে রাস্তায় নেমে আন্দোলনবিমুখ একটি দল পুঁজিপতিদের ডেকে এনে কর্মসংস্থান করে দেশের উন্নতি করতে চাইছে ! হিসেবগুলো মিলছেনা কমরেড, মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে, ভাবছে এরা ঠিক কোন পার্টি, ঠিক কাদের প্রতিনিধিত্ব করছে | আর যা হওয়ার তাই হচ্ছে, শুধু সংসদীয় বিচারে নয়, সবদিক থেকে ক্রমহ্রাসমান হয়ে যাচ্ছে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন | হিসেব মিলছে শুধু শাসক শ্রেণী ও তাদের প্রতিনিধি মিডিয়ার, যারা চায় কমিউনিস্ট আন্দোলন হয় আক্ষরিক অর্থে বা অন্তত আদর্শগতভাবে মুছে যাক |

 

তাহলে উপায় কী? করণীয় কী?

উপায় একটাই | আদর্শের মূল ভিত্তিকে ধরে থাকা এবং আদর্শচালিত আন্দোলন করা |

দু-দশক আগে যখন কলেজে ঢুকেছিলাম, শুনেছিলাম যে দর্শন জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবেনা, মাঠে নেমে পড়তে হবে, বাকি দর্শন কাজ করতে করতে শিখতে হবে | কথাটা অংশত ঠিক, যতক্ষণ পর্যন্ত দর্শনের মূল ভিত্তি নিয়ে কোনো সংশয় না থাকে | যদি সংশয় তৈরি হয়, তাহলে দর্শনের পুনঃপাঠের প্রয়োজন, যাকে ইংরিজিতে বলে "ব্যাক টু দ্য ড্রয়িং বোর্ড" | কমিউনিস্ট পার্টির মূল আদর্শ শ্রেণীসংগ্রাম | যখন থেকে মানুষ শ্রমের উদ্বৃত্ত তৈরি করতে সক্ষম হলো, মানে শুধুমাত্র জীবনধারণের উপকরণ সংগ্রহ করতে আর সারাদিন ব্যয় করতে হলো না, তখন থেকেই সেই উদ্বৃত্ত শ্রমের সাহায্যে সম্পদ তৈরি হতে শুরু করলো | সভ্যতার শুরু থেকেই ব্যাপক জনসাধারণের উদ্বৃত্ত শ্রমের ভিত্তিতে তৈরি সম্পদ ভোগ করেছে ছোট একটা শ্রেণী | সে রাজা হোক, জমিদার হোক বা পুঁজিপতি হোক | যত উদ্বৃত্ত, তত লাভ | সুতরাং যুদ্ধ, সুতরাং দাসত্ব, সুতরাং লেঠেল | কিন্তু সম্পদের এই গভীর বৈষম্য ও এই শ্রেণীবিভাজন বহু কারণে (সেগুলো এখানে আলোচনা করার প্রয়োজন বা পরিসর নেই) শোষিত শ্রেনীর জন্য শুধু নয়, সভ্যতার অগ্রগতির জন্য ভালো নয় | সুতরাং শ্রেণীহীন (বা অন্তত শ্রেণীগুলির মধ্যে ব্যাপক বৈষম্যহীন) সমাজের লক্ষ্যে শোষিত-নিপীড়িত শ্রেণীকে শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে অবিরাম লড়াই করতে হয়, আর তার সেই লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেবে তার পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি | এই সামান্য কথাটুকুই মার্কসবাদী দর্শনের মূল কথা যা মার্কস একা নন, আরো অনেক দার্শনিকের দর্শনের ভিত্তিতে তৈরি ও সমৃদ্ধ | এই মূল কথার ব্যাপারে কোনো দ্বিধা থাকলে, পার্টির আন্দোলনে-কর্মসূচিতে এ-ব্যাপারে বিন্দুমাত্র অস্পষ্টতা থাকলে কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে মানুষ বিভ্রান্ত হয়, বারবার হলে কমিউনিস্ট আন্দোলন গুরুত্ত্ব হারায় |

এই মূল বক্তব্যে আধুনিক হওয়ার কিছু নেই | আধুনিক হওয়ার প্রয়োজন, অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করার প্রয়োজন প্রয়োগে, কৌশলে | সিপিএম যে জঙ্গলে গিয়ে বোমা তৈরি করার বদলে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশ নিয়ে কাজ করছে, এটা প্রয়োজনীয় আধুনিকতা | আমাদের দেশের সংবিধান ও আইন যা সুযোগ দিয়েছে, তার মধ্যে থেকেই শোষিত শ্রেণীর আন্দোলনকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, মার্ক্সের সময় বা বলশেভিক বিপ্লবের সময় পরিস্থিতি আলাদা ছিল | সশস্ত্র বিপ্লবের বদলে শান্তিপূর্ণ পথে এগোনো প্রয়োজন, একদলীয় শাসনের বদলে বহুদলীয় শাসনের দিকে যাওয়া প্রয়োজন, কারণ শেষ কথা কেউ বলতে পারে না | কিন্তু আধুনিকতার স্বার্থে শ্রেণীসংগ্রাম পিছনে পরে গেলে কমিউনিস্ট পার্টি ও আন্দোলনের আর কিছু থাকেনা |

পাশাপাশি একবার দেখুন বাস্তবটা | মেহনতি মানুষের তৈরি বিপুল সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে জনসংখ্যার অতি ক্ষুদ্র অংশের হাতে | ২০০৭ সালে ভারতের জনসংখ্যার ৭৫% মানুষের দৈনিক আয় ছিল ২০ টাকার কম (ভারত সরকার-নিযুক্ত অর্জুন সেনগুপ্ত কমিটি রিপোর্ট), যে একই সময় ভারতের বিখ্যাত পুঁজিপতির ছেলে বিখ্যাত পুঁজিপতি মুম্বইতে ৬৫০০ কোটি টাকা দিয়ে নিজের বাড়িটি বানালেন! ২০১৩ সালের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের রিপোর্ট বলছে যে পৃথিবীর পঞ্চাশ শতাংশ সম্পদ কেন্দ্রীভূত এক শতাংশ মানুষের হাতে, পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের সম্পদের পরিমাণ ধনীতম ৮৫-জন মানুষের সম্পদের সমান | শোষিত শ্রেণীর অবস্থার হয়ত সামান্য উন্নতি হয়েছে, অন্যদিকে ধনীতমরা ধনী হয়েছে আরো অনেক বেশি | শুধুমাত্র কোন পরিবারে জন্ম এই হাতে-না-থাকা ঘটনাটির ভিত্তিতে আকাশ-পাতাল তফাৎ হয়ে যাচ্ছে একটি শিশুর শৈশবে, তার পাওয়া সুযোগে, শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, বাসস্থানে | ঠিক কোন যুক্তিতে বুদ্ধিতে নৈতিকতায় এই ব্যবস্থাটা ঠিক সেটা বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু এই প্রাচীন লুঠতরাজের ব্যবস্থার প্রতি সমর্থনে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে শাসকশ্রেণী ও তাদের তাঁবেদার ও সুবিধাভোগী সংসদ, মিডিয়া | এই ব্যবস্থা অতি প্রাচীন, তাকেই আঁকড়ে আছে শাসকশ্রেণী, কারণ তারা এর সুবিধাভোগী | তারা দখল করতে চায় সমস্ত কিছু | তাই ২০০৯-এর ভারতের সংসদীয় নির্বাচনের প্রার্থীদের সম্পত্তির হিসাবে দেখা যায় যে বামপন্থীরা ছাড়া আর প্রায় সব দলের বেশিরভাগ প্রার্থী কোটিপতি | সামাজিক ও আদর্শগত প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে অনেক তফাৎ থাকা সত্ত্বেও শ্রেণীগত প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে সবাই সমান - কংগ্রেস বিজেপি বিএসপি এডিয়েমকে ডিএমকে বিজেডি, ইত্যাদি | সোজা কথায় সংসদটা ভারতের ধনীতমদের |

আর এই ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখতে ক্রমশ বাড়ছে পণ্য ও তার প্রতি আকর্ষণ, পৃথিবী ভরে উঠছে জিনিসে | আর এইসব জিনিস তৈরির মাশুল দিচ্ছে প্রকৃতি, আমাদের বাতাস ও জল ভরে উঠছে বিষে, আমাদের সমুদ্র ভরে উঠছে বর্জ্যে | মানুষ ক্রমশ আরো দূরে চলে যাচ্ছে তার শ্রমের থেকে, আমরা বেশিরভাগ মানুষ সারাদিন যা ব্যবহার করি, তার কিছুই নিজেরা তৈরি করিনা, যা তৈরি করি, তা ব্যবহার করিনা!

আর হচ্ছে অবৈজ্ঞানিক চিন্তার প্রসার - জ্যোতিষী, আংটি, মাদুলি, লাল-সুতো, নতুন নতুন পুজো | খবরের কাগজের পাতা আর টিভি চ্যানেলের পর্দা ভরে উঠছে এদের বিজ্ঞাপনে, সমাজের গণ্যমান্যেরা হাসিমুখে পুজোর উদ্বোধন করে বেড়াচ্ছেন | সেই যে অদৃষ্টের ভয়টা সভ্যতার শুরু থেকে দেখানো শুরু হয়েছিল, রাজাই "দেবতা" হয়ে উঠেছিল বহুক্ষেত্রে, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে |

এইটুকু বলতে হলো এই কারণে যে শ্রেণীসংগ্রামের কারণ বিন্দুমাত্র কমেনি, বেড়েছে; মানুষের পণ্য-ব্যাকুলতা কমেনি, বেড়েছে, শ্রমের থেকে দুরত্ব কমেনি, বেড়েছে, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস কমেনি, বেড়েছে | কিন্তু কোনো এক রহস্যময় কারণে ভারতীয় কমিউনিস্টদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে ভাবনার অস্পষ্টতা | তাই একমাত্র স্লোগান হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে বড় পুঁজিপতিকে ডেকে শিল্প করতে হবে, যদিও ন্যুনতম মজুরির দাবিতে, পুঁজিপতিদের অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়ার বিরুদ্ধে, শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে, পড়াশোনায় সমান সুযোগের দাবিতে, পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে, লাগামহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে, কৃষিতে সমবায় আন্দোলনে, কৃষিভিত্তিক শিল্পের উন্নতির লক্ষ্যে, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের দাবি দাওয়া নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির কোনো বড় আন্দোলন দেখা যাচ্ছেনা | যদিও সিপিএম এখনো পৃথিবীর বৃহত্তম কমিউনিস্ট পার্টিগুলির একটি যার ডাকে আজও সহজেই এক লক্ষ লোক জড়ো হতে পারে |

বর্তমান পরিস্থিতিতে কোন একটি বড় শিল্প একজন বড় পুঁজিপতিকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে করতে হতেই পারে, কিন্তু সেটা সময়ের বাধ্যতা, কমিউনিস্ট পার্টির উন্নতির মূল মডেল হতে পারেনা | অর্থাৎ সেটাই প্রধান স্লোগান হতে পারেনা, আরো পাঁচটা আন্দোলনে কমিউনিস্ট আদর্শের ভিত্তি স্থাপিত থাকলে এটা কোন বড় কথা নয়, মানুষের মনে কোন বিভ্রান্তিও তৈরি হবেনা |

দ্বিতীয়ত দরকার বড় আন্দোলন, যেটা দেখা যাবে, যার দ্বারা বিপুল মানুষ অনুপ্রাণিত হবে, এমন কি পার্টির সমর্থকদের বাইরের একটা অংশও | নিবিড় জনসংযোগ ও স্থানীয় সমস্যা নিয়ে আন্দোলন জরুরি, কিন্তু সেটা বড় আইকনিক আন্দোলনের বিকল্প নয় | গত বহু বছরে ভারতে সংসদের বাইরে যে চোখে পরার মত আন্দোলন বা কর্মসূচী হয়েছে, অদ্ভুতভাবে তার একটাও বামপন্থীদের নয়! অযোধ্যায় কড়া কট্টরপন্থী ও ধ্বংসাত্মক "করসেবা", যার দ্বারা বিজেপি তার আকর্ষণকে একটা বৃহত্তর জনগোষ্টির কাছে পৌঁছে দিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাস্তা আটকে বসে থাকা, যা জমি অধিগ্রহণকে প্রশাসনিক বিষয় থেকে (যেমন বামফ্রন্ট সরকার চেয়েছিল) একটা সামাজিক এবং বড় রাজনৈতিক বিষয়ে উন্নীত করলো, মেধা পাটকারের "নর্মদা বাঁচাও" আন্দোলন যা বড় ড্যাম তৈরির (এবং সাধারণভাবে বড় "উন্নয়নমূলক" প্রকল্পের) সামাজিক ও পরিবেশগত কু-প্রভাব সম্পর্কে দেশবাসীকে অবহিত করলো, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার অঙ্গীকার এবং দিল্লি-কাঁপানো আন্দোলন, যার ভিত্তিতে রাজনীতিতে আনকোরা কিছু লোক নিয়ে আম আদমি পার্টি বিপুল জনসমর্থন নিয়ে দিল্লিতে বিজেপি-কংগ্রেসকে ধরাশায়ী করল - এগুলো বড় চোখে পরার মত আন্দোলন বা কর্মসূচী, যার প্রভাব তার স্থান-কাল-কে অতিক্রম করতে পারে | এই আন্দোলনগুলো দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন এবং অনেকাংশে পরস্পরবিরোধী শক্তি বা ব্যক্তিরা করেছে, কিন্তু এই তালিকায় কমিউনিস্ট পার্টির কোনো আন্দোলন দেখা যাচ্ছেনা! চরম দক্ষিণপন্থী শক্তি থেকে এনজিও - সবাই তাদের আদর্শ ও ইস্যু নিয়ে বাজার কাঁপিয়ে দিল, শুধু যাদের "বিপ্লব" করার কথা ছিল তারা চুপচাপ! এই আন্দোলনগুলোর কোনটা সমর্থনযোগ্য, কোনটা ক্ষতিকর, কোনটা ক্ষণস্থায়ী, সে ব্যাপারে আমরা কিছু বলছিনা, কিন্তু বড় আন্দোলনের প্রত্যক্ষ এবং ব্যাপক প্রভাব এরা প্রমাণ করে | টিভির তর্কে অংশ নেওয়া, বিধানসভার উঠোনে স্লোগান দেওয়া আর রাজ্যপালকে স্মারকলিপি দেওয়ারও হয়ত প্রয়োজন আছে, কিন্তু এর কোনটাই আবেগ ও আদর্শচালিত বড় আন্দোলনের বিকল্প নয় |

আর তৃতীয় মূল প্রয়োজন রাজনৈতিক দর্শনের ক্রমাগত ও প্রাণবন্ত চর্চা | যে নৈতিকতার কথা দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম, সেখানে একটু ফিরতে হয় | সাড়ে তিন দশক যে রাজ্যে কমিউনিস্ট পার্টি সরকার চালালো, তার বাসিন্দারা পাহাড়প্রমান দুর্নীতি চোখে দেখতে পেয়েও তার দ্বারা বিচলিত হচ্ছেনা, তোয়ালে জড়িয়ে ঘুষ নেওয়াকে আদৌ কোনো অনৈতিক কাজ বলে ভাবা হচ্ছেনা, অথবা তাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা এতই খারাপ যে এসব দেখেও কিছু ব্যক্তিগত সুবিধা পাওয়ার জন্য জনগণ ওই দুর্নীতিবাজদেরই ভোট দিচ্ছে, এর কোনটাই রাজ্যের মানুষের চেতনাকে কোনো উজ্জ্বল আলোয় দেখায় না | এর একটা বড় দায়িত্ব অবশ্যই কমিউনিস্ট পার্টিকে নিতে হয় | আগে লোকে অন্তত কমিউনিস্ট আন্দোলনের কর্মীদের দেখে বলত যে লোকগুলো আর যাই হোক, আদর্শবান, সৎ, সাহসী এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের পেছনে ছুটছে না | এখন আর এ-কথা কজনের সম্পর্কে বলা যায় নিশ্চিত নই, তবে জনমানসে সেই উঁচু আসনটি যে আর নেই তা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায় | কজন পার্টি-সদস্য নিশ্চিতভাবে জানেন যে এই মুহুর্তে ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের গুরুত্ত্ব কোথায় এবং মূল কাজ কী, এ নিয়ে সন্দেহ আছে | তাই প্রতিদিনের মিটিং, কর্মসূচী, মেম্বারশিপের হিসেবের পাশাপাশি দরকার দর্শন ও রাজনীতির নিবিড় চর্চা, আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক | সেই আলোচনা এবার এই কেন্দ্রে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করলে সুবিধা হবে কিনা, তার থেকে একটা ওপরের স্তরের হওয়া দরকার | এই আলোচনা শুধু কেন্দ্রীয় কমিটি বা রাজ্য কমিটি স্তরে হলে চলবেনা, শাখা স্তরে হতে হবে | জেলায় জেলায় নিয়মিত তাত্ত্বিক ওয়ার্কশপ হওয়া দরকার শাখা থেকে রাজ্য স্তরের সদস্যদের মধ্যে | সময় নেই বললে চলবেনা, এটাই এখন মূল কাজ |

প্রাক-স্বাধীনতা যুগ থেকেই ভারতের মানুষ, সমাজ ও রাজনীতির জন্য অসামান্য অবদান রেখেছে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন | সংসদীয় বৃত্তের মধ্যে (ভূমি সংস্কার, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ) এবং তার থেকেও গুরুত্ত্বপুর্ণভাবে, সংসদীয় বৃত্তের বাইরে (নিপীড়িত মানুষের পক্ষে সওয়াল করতে, তাকে জোটবদ্ধ করতে, অধিকারের দাবি জানাতে, প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক এবং অবৈজ্ঞানিক রীতিনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে, তাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে, বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের ধারণাকে তুলে ধরতে) ক্রমাগত বিশ্বস্ত ভূমিকা নিয়ে গেছে কমিউনিস্ট পার্টি, ভুলভ্রান্তি সত্ত্বেও | এখন দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থানের সময় তাই আরো বেশি করে প্রয়োজন বামপন্থী আদর্শের শক্তিশালী হওয়ার | আদর্শ, আবেগ ও আন্দোলনের মধ্য দিয়েই প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে কমিউনিস্ট আন্দোলন, রাস্তা বেরোবে | মনে রাখতে হবে শাসক শ্রেণী কমিউনিস্ট পার্টিকে ভয় পায়, মানুষের সংঘবদ্ধতাকে ভয় পায় | ভয় পায় পার্টির বর্তমান শক্তির জন্য নয়, আদর্শের শক্তির জন্য | আর ভয় পায় বলেই তাকে বারবার "বস্তাপচা তত্ত্ব" বলতে চায় | সত্যিই কোনো তত্ত্ব বস্তাপচা হলে বা তা ভূল প্রমাণিত হলে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না |

(লেখক ৯০এর দশকে যাদবপুরে ইঞ্জীনিয়ারিং পড়ার সময় থেকে বাম আন্দোলনের সাথে যুক্ত, বর্তমানে একটি সফটওয়্যার কম্পানিতে কর্মরত)

মঙ্গলবার, ১৪ জুন, ২০১৬

সাতশো কোটি টাকা জরিমানা ~ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য

দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী কেজরিবালের ওপর কিছু জনতার ব্যাপক ক্ষার , কারো মতে মালটা বদ্ধ উন্মাদ,যখন যা মনে আসে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, পপুলার পলিটিক্স করে ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই যে কিছুদিন আগে জোড় বিজোড় গাড়ি চালানোর বিধান দিলেন দিল্লীতে, সে পনেরো পনেরো তিরিশ দিন লোকের কি গুসসা হল, বহুত পরিশানি হল। পলুসন তো কিচ্ছু কম হল না বেকার বেকার মানুষের কষ্ট।
সম্প্রতি উনি নির্দেশ দিয়েছেন বিদ্যুৎ পরিষেবা দেয় যারা তারা কোন ব্রেকডাউন বা ফল্ট সারাই করতে নির্দিষ্ট সময়ের বেশী সময় নিলে গ্রাহককে পরের বিলে ছাড় বা ডিসকাউন্ট দিতে হবে। কি আবদার বলুন তো দেখি, এসব করলে তো ব্যাবসা লাটে উঠবে, লাভের গুড় পিঁপড়েতে খাবে।কিন্তু পরিষেবা দানকারী কোম্পানিই বা কি করে, মেনে তো নিতেই হবে। ব্যাবসা তো আর হিমালয়ে কি মরুভূমিতে করা সম্ভব নয়।

দু একদিন আগে আবার কামান দেগেছেন, এবার দিল্লীর কিছু বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে। বেসরকারি হাসপাতাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোকে সরকার অনেক কম মুল্যে জমি দেয়, এটা সব রাজ্যেই পরিকাঠামো উন্নয়নে সাহায্য করে আর সাথে সাথে কিছু শর্ত দিয়ে দেয় সরকার, যেমন হাসপাতালে ফিছু ফ্রি বেড রাখতে হবে দরিদ্র মানুষের চিকিৎসার জন্য কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছু সিট অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল মানুষের পড়াশুনার জন্য। সে নিয়ম তো অনেক আছে তা আর মানে কে? ভাবুন এক পাঁচতারা হাসপাতালে বিশাল মন্ত্রী, নেতা,শিল্পপতির চিকিৎসা চলছে আর তার পাশাপাশি এক রিকশাওয়ালা বিনি পয়সায় একই চিকিৎসার সুযোগ নিচ্ছে, এটা হয় কখনো, কিংবা আপনার আমার ছেলেমেয়ের সাথে ডিপিএস এ পড়ছে আমার বাড়ির কাজের মেয়েটির ছেলে! মেনে নেওয়া যায়। এমনিতে ট্যাক্স দিয়ে দিয়ে আমাদের পকেট খালি তাপ্পর এইসব।

হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই পরশু সেই পাগল মুখ্যমন্ত্রী দিল্লীর পাঁচ বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে সাতশো কোটি টাকা জরিমানা করেছেন, এই টাকা জমা করতে হবে ৯ই জুলাইয়ের মধ্যে কারন জমি নেবার সর্ত অনুসারে তাঁদের দরিদ্র্য মানুষের জন্য যে সেবা বিনামূল্যে দেবার কথা ছিল টা তাঁরা দেন নি।এই তালিকায় আছে ফরটিস এস্করটস হার্ট ইন্সিটিউট, ম্যাক্স সুপার স্পেশালিটি (সাকেত), শান্তি মুকুন্দ হাসপাতাল, ধরমশিলা ক্যান্সার হাসপাতাল, পুষ্পবতী সিঙ্ঘানিয়া হাসপাতাল। 

বড়লোকের কোর্ট আছে তাই হাসপাতাল সকল আদালতে যাবে শুনালি হবে, রায় বেরোবে, তারপর সুপ্রিম কোর্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। হয়তো প্রমান হবে ওই হাসপাতালগুলো নিয়ম মেনে দরিদ্র সেবা করেছেন ( দেখেছেন নাকি আপনারা এমন কাউকে)। 

তা এহেন মানুষকে লোকে ফাগল বলবে না তো কি করবে, মুখ্যমন্ত্রী তায় আবার রাজধানী শহরের অন্য কত কাজ থাকে যেমন ফ্লাইওভার বানানো, রাস্তা মেরামত করা,ফুলের গাছ লাগানো, হাসি হাসি মুখে নানা অনুষ্ঠানে ফিতে কাটা সেসব নয় পড়েছে প্রধানমন্ত্রীর সার্টিফিকেট ভেরিফাই করতে, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ কোম্পানির যথেচ্ছাচারের মুখে লাগাম পরাতে।

তা কলকাতার বাইপাসের দুপাশ ধরে লাইন দিয়ে যে হাসপাতাল তাঁদেরকেও সরকার ন্যুনতম মুল্যে জমি টমি দিয়েছিল শুনেছি( সে অবশ্য বামফ্রন্ট আমলে) আর এসব শর্তও লেখা আছে তাতে। দান বাম কোন সরকার কিছু করেছে বলে শুনিনি। এএমআরআই তে আগুন লাগার ঘটনায় কারো শাস্তি হয়েছে বলে শুনিনি, অবশ্য দিদি বিমানবাবুর হাত ধরে বলেছিলেন সব্বার নাকি শাস্তি হবে!!

কেজরিবালের এই সব কাণ্ড কারখানা দেখে বিজেপি তো রেগে আগুন, এই সব টাকা সরকার নাকি বিজ্ঞাপনের কাজে ব্যাবহার করবে তার পর ব্যাবসায়ীদের অধিকারে হস্তক্ষেপ, কি কাণ্ড।
আপনি কি বলেন?

সোমবার, ৬ জুন, ২০১৬

সংখ্যালঘু ~ মাহফুজ আলম

মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি জানিয়েছেন যে 'রমজান' মাসে রেশনে রমজান স্পেশাল প্যাকেট দেওয়া হবে।সংবাদ মাধ্যম অনুযায়ী, প্যাকেটে চাল, ময়দা, তেল, খেজুর, ছোলা এবং চিনি থাকার কথা l সংখ্যালঘু মুসলিম মানুষদের সুবিধার জন্যই এই ব্যবস্থা l তবে, শুধু সংখ্যালঘুরাই নন, চাইলে সবাই রেশন থেকে ওই প্যাকেট তুলতে পারবেন l

বেশ ধেই ধেই করে লাফাবার মতন খবর, মোহন বাগান লিগ জিতলে যেরম হয় আর কি। গোটা রোজার মাস ধরে মুসলিম ভাই-বোনেরা 'রমজান' স্পেশাল প্যাকেট পাবেন। যে গরিব মুসলিম রিকশাওলা যে ধর্ম মেনে রোজা রাখে কিন্তু অভাবে পর্যাপ্ত ইফতারি জোটেনা, তার তো ভালো হবেই।

প্লাস, নিন্দুকেরা যদি 'মোছলমান পীরিতি' খোঁজে, তার জন্যে এটাও জুড়ে দেওয়া হয়েছে যে চাইলে অমুসলিমরাও এই স্পেশাল প্যাকেট পাবে।

এই হ্যাপি এন্ডিং মার্কা গপ্পের শেষে কিছু কোশ্চেন থাকছে।

সংবিধান অনুসারে ধর্মীয় সংখ্যালঘু বলতে খালি মুসলমান বোঝায় না। বৌদ্ধ, জৈন , পারসিক, খ্রীস্টান সব্বাই সংখ্যালঘু। এদের ধর্মেও একমাস টানা না হলেও উপোস ব্যাপারটা রয়েছে।

তা, দিদিমণি এদের উপোসের সময় স্পেশাল প্যাকেট দেবেন না?

সংখ্যাগুরু হিন্দুদের মধ্যেও অনেকে নানাসময় নানাকারণে উপোস করে থাকেন। তারাই বা নিজেদের সময় এ সুবিধে থেকে বঞ্চিত হবেন ক্যানো?

তাহলে কি এই 'রমজান' প্যাকেট এর আসল উদ্দেশ্য নিতান্তই রাজনৈতিক? নিজেকে মুসলিম-প্রেমী বলে প্রমাণ করা?

সন্দেহ নেই, যে এই কাজে 'তিনি' বেশ সফল। জমিয়তও এখন বকলমে তৃণমূলের সমর্থক। তাদের সিদ্দিকুল্লা মন্ত্রীত্ব পেলেন, মৌলানারা ইমাম ভাতা পেলেন, বাকিরা মাদ্রাসা অনুমোদনের প্রতিশ্রুতি পেলেন, আর গরিব মুসলমান পেলেন 'রমজান' স্পেশাল প্যাকেট।

অতএব 'তিনি'ই বর্তমানে বাংলার মুসলমানেদের জান-মালের রক্ষাকর্তা, তাদের পরবরিশ করনে-ওয়ালা এবং খুদ-খেয়াল-মর্জি'র মালিক।

ব্যাস? গপ্পো শেষ?

দাঁড়ান সার, এট্টু খানি বাকি আছে।

আমি বা আপনি চাই বা না চাই, আমাদের এই রাজ্য এখন জামাত আর আরএসএস
এর পরীক্ষাগার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা নিজেদের স্বার্থেই চাইছে যে হিন্দু ভোট আর মুসলমান ভোট এর মেরুকরণ হোক, যাতে তারা শক্তিশালী হয়ে বিষাক্ত ছোবল মারতে পারে।

এরা খুব সন্তর্পণে এগোচ্ছে। ধর্মের মাধ্যমে কাছে টানা, মগজ-ধোলাই আর অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিষ ঢালা-এটাই এদের কাজ। আমার কথা বিশ্বাস করার দরকার নেই। এই ফেবুতেই জামাত আর আরএসএস এর পেজগুলো দেখবেন সময় করে। দেখতে পাবেন অর্ধ-শিক্ষিত লোকেরা কিভাবে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে, যাতে দাঙ্গা লাগে আর এদের শক্তি বাড়ে। যেকোনো রকম সংঘর্ষের ঘটনাকেই সাম্প্রদায়িক রূপ দেবার চেষ্টা চলছে।

শহর আর শহরতলি'র লোকেরা খেয়াল করে দেখবেন যে ধীরে ধীরে হিন্দু আর মুসলমান বসত আলাদা হচ্ছে। ধর্মের ভিত্তিতে ফ্ল্যাট বিক্রি হওয়া শুরু হয়েছে।

আজ হয়ত একটা হিন্দু বা মুসলমান খালি হিন্দু বা মুসলমানের মধ্যে বাস করে আপাত নিশ্চিন্তি বোধ করছে, কিন্তু একই সাথে হারাচ্ছে একে অপরকে চেনার সূযোগ।
এবং ভুলে যাবেন না, দাঙ্গা লাগলে কিন্তু শত্রু এলাকা বাছতেও সময় লাগবেনা।

অনেক কেই দেখি হিন্দু সন্ত্রাসবাদের অস্ত্বিত্ব স্বীকার করেননা। ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের আন্তর্জাতিক ব্যাপকতা অনেক বেশী। কিন্তু এদেশে হিন্দু সন্ত্রাসবাদও যথেষ্ট খারাপ চেহারা নিয়েছে।

এবং একটা বোকা যুক্তি দেওয়া হয় যে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতায় হিন্দু সন্ত্রাসবাদের জন্ম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই কোনকালে লিখে গেছেন স্বদেশি আমলে জল খাবার জন্য হিন্দু প্রচারক তার মুসলমান সহযোগীকে দাওয়া থেকে নেমে যেতে বলছেন।

তালিবান দেরও একসময় বিপদ হিসেবে না দেখে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লব হিসেবে দেখা হয়েছিল। সৌজন্যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। তার ফলাফল এখনও ভোগ করছি। আরএসএস এর ক্ষেত্রেও একই ভুল করলে বিপদ আছে।

বাজে ক্লিশে বকা শেষ। যদি এতটা পড়ে থাকেন, তাহলে শেষটুকুও ভেবে দেখুন, এই 'রমজান' প্যাকেটের মাধ্যমে কি বিজেপি'কে হিন্দু ভোটের মেরুকরণ এর সূযোগটাই হাতে তুলে দেওয়া হল না? 'তিনি' কি প্রকারান্তে সেটাই চাইছেন?

গরিব মানুষ কে যদি সাহায্য করাটাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে শুধু ইসলাম ধর্মটাই আসছে ক্যানো? বাকি ধর্ম গুলো কি দোষ করলো?

আর শুধু রমজান মাসই ক্যানো? সারা বছর সব বিপিএল তালিকাভুক্ত মানুষ কে এই স্পেশাল প্যাকেট দেওয়া হোক। এই দাবীটা উঠুক।

ইমাম ভাতা দেবার সময়ও একই প্রশ্ন ছিল। গরিব ইমাম রা ভাতা পেলেন। আমার বাড়ির পাশের কালীমন্দিরের গরিব পুরোহিত মশাই কি দোষ করেছিলেন? তারও তো সংসার চলে কোনোরকমে।

বিজেপি সেবারও এই ইস্যু তুলে ধর্মীয় মেরুকরণে সফল হয়েছিল। এই রমজান প্যাকেট নিয়েও তারা যথারীতি একই রকম প্রচারে নামবে।

ক্ষমতার মোহে 'তিনি' নাহয় ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত রাজ্যে ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে আরএসএস আর জামাত কে প্রশ্রয় দিচ্ছেন, কিন্তু আমরা তো আর একই ভুল করতে পারিনা।

আসুন, আমরা প্রত্যেকটি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ এই ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটাবার সুবিধেবাদী রাজনীতি'র বিরোধিতা করি।

খুব দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই...