শুক্রবার, ৪ এপ্রিল, ২০২৫

বাংলার শিক্ষক কেলেঙ্কারি আর আন্তর্জাতিক বাঙালি বুদ্ধিজীবী ~ ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত

সুপ্রিম কোর্ট বাংলার সরকারি বিদ্যালয় থেকে প্রায় ২৬,০০০ শিক্ষকের বরখাস্ত বহাল রেখেছে, কারণ তৃণমূল কংগ্রেস এই চাকরিগুলোর বেশিরভাগই সর্বোচ্চ দরের ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। বাংলার সরকারি বিদ্যালয় ব্যবস্থার এই ধ্বংস থেকে পুনরুদ্ধার হতে বেশ কয়েক দশক লাগবে। 

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসন বাংলার সরকারি বিদ্যালয় এর জন্য খরচকে তৃণমূলের ব্যক্তিগত আয়ের উৎসে পরিণত করেছে। এখন বাংলার কয়েক প্রজন্মের শিশুরা এর মূল্য দেবে। এমনিতেই রাজ্যে যথেষ্ট চাকরি নেই বলে জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষ রাজ্য ছেড়ে চলে যায়, সেই প্রবণতা আরো বাড়বে। কিন্তু রাজ্যের বাইরে অন্যান্যদের সাথে প্রতিযোগিতার জন্য যে মৌলিক সাক্ষরতা, সংখ্যাজ্ঞান বা কম্পিউটার দক্ষতা প্রয়োজন, এবার তারা সেগুলো ছাড়াই চলে যাবে। ফলে গায়ে গতরে খেটে খাওয়া ছাড়া অন্য কোনো কাজ তারা পাবেনা। 

পশ্চিমবঙ্গে ছেলেদের বিদ্যালয় ত্যাগের হার ইতিমধ্যেই বেশি এবং ক্রমাগত বাড়ছে, সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার এই ধ্বংস অবশ্যই সেটাকে আরও বাড়িয়ে দেবে। বাংলার শিশুদের ভবিষ্যতের প্রতি আগ্রহ আছে এমন কেউই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী শাসকের প্রতি গভীর ঘৃণা পোষণ করা ছাড়া অন্য কিছু করতে পারবে না।

তবে কিভাবে আমরা এখানে পৌঁছলাম, তা বুঝতে আমাদের আরও গভীরে যেতে হবে। এই সংকট এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তৈরি হয়েছে। সবাই জানত যে বাংলার সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাকরিগুলি পাইকারি হারে সর্বোচ্চ দরের ক্রেতার কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। সবাই জানত যে পুরো ব্যবস্থাটি শীঘ্রই ভেঙে পড়বে। তবুও বাংলার তথাকথিত স্বাধীন বুদ্ধিজীবীদের ফুলেফেঁপে ওঠা গোষ্ঠীর প্রায় সবাই, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র / দিল্লি / লন্ডন / নিউইয়র্ক ভিত্তিক বিশ্বব্যাপী খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিরা - এই ধীরগতির ট্রেন দুর্ঘটনার বিষয়ে নীরব ছিলেন। এমনকি এরই মধ্যে তারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছুঁড়ে দেওয়া বঙ্গশ্রী /বঙ্গবিভূষণ বা অন্য যেকোনো ছোটখাটো পুরস্কার আনন্দের সাথেই গ্রহণ করেছিলেন।

অমর্ত্য সেনের প্রতীচী ট্রাস্ট, যার প্রধান কাজ  বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলি তুলে ধরা এবং জনসমক্ষে আলোচনার সূচনা করা, তারা বাংলার শিক্ষার সবচেয়ে মৌলিক বিষয়গুলি নিয়ে কথা বলা ছাড়া সবকিছুই করেছে। বর্তমানে বাংলায় সক্রিয় ফিল্ড এক্সপেরিমেন্ট বোদ্ধা এবং ক্রমবর্ধমান RCT গোষ্ঠী - যাদের মধ্যে খুব কম জনই স্থানীয় তৃণমূল রাজনৈতিক নেতা এবং আমলাদের সমর্থন ছাড়া এক পা-ও নড়তে পারেন না - তারা নিশ্চিত করেছেন যে তারা রাজ্যের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখবেন। যারা নিউইয়র্কের ক্যাম্পাস থেকে টুইট করেন বা বার্কলে থেকে কলকাতার বার্ষিক জনসভা এবং টেলিগ্রাফ পত্রিকায় সাক্ষাৎকারের জন্য আসেন তারা তাদের টুইট, জনসভা এবং টেলিগ্রাফ সাক্ষাৎকার ট্রাম্প এবং মোদীর মতো আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পছন্দ করেছেন।

এই কেলেঙ্কারি আসলে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তৈরি হওয়া একটা ধীরগতির ট্রেন দুর্ঘটনা, যা জনসাধারণের চোখের সামনে ঘটেছে। নিছক টাকা চুরির মাধ্যমে বাংলার একটি গোটা প্রজন্মের শিশুদের জীবনযাত্রা একটু একটু করে ধ্বংস করা হয়েছে। আর যাদের যাদের বৌদ্ধিক এবং একাডেমিক দায়িত্ব ছিল এই ধরনের ট্র্যাজেডিগুলি লক্ষ্য করা, চিৎকার করে সবাইকে জানানো এবং সতর্ক করা, ঠিক সেইসব ব্যক্তিদের কাছ থেকে সামান্যতম প্রতিবাদ ছাড়াই ঘটেছে এই কেলেঙ্কারী।

এরপরও এনাদের ক্ষমা করা সম্ভব?

🖋️ প্রফেসর ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত (ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউট)

অনুবাদ: প্রফেসর শুভাশীষ মোদক চৌধুরী (ইউনিভার্সিটি অফ শেফিল্ড) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন