বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

বিদ্যাসাগর ~ মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায়

''আমার পুত্র বলিয়া পরিচিত শ্রীযুক্ত নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় যারপরনাই যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী এজন্য, ও অন্য অন্য গুরুতর কারণবশতঃ আমি তাহার সংশ্রব ও সম্পর্ক পরিত্যাগ করিয়াছি। এই হেতুবশতঃ বৃত্তিনির্বন্ধস্থলে তাঁহার নাম পরিত্যক্ত হইয়াছে এবং এই হেতুবশতঃ (তিনি)…. আমার উত্তরাধিকারী বলিয়া পরিগণিত অথবা... এই বিনিয়োগ পত্রের কার্যদর্শী নিযুক্ত হইতে পারিবেন না।''

নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাসাগরের প্রথম সন্তান ও একমাত্র পুত্র সন্তান। 

উইলে রয়েছে পঁয়তাল্লিশ জন নরনারীকে নির্দিষ্ট হারে মাসিক বৃত্তি দেবার নির্দেশ। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন চিকিৎসালয় ও বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য বিধিব্যবস্থা । 
এই উইল রচিত হয়েছে ১৮৭৫ সালে, আজ থেকে ১৪৪ বছর আগে।

এক নিরানন্দ কর্মবীর। 

কলকাতার লোভী, সংকীর্ণমনা, প্রসাদলোভী বাবু ও জমিদার শ্রেণী, তাদের বিদূষকবৃন্দ, শ্রেণী স্বার্থরক্ষাকারী ইংরেজ শাসক, নিজ পরিবার - কেউ রেয়াৎ করেনি এই মানুষটিকে।

একটা তথ্য দিলে বোঝা যাবে কতদূর বিরুদ্ধ পরিবেশে এই মানুষটি লড়াই করে গেছেন।

বিধবা বিবাহের পক্ষে বিদ্যাসাগর স্বাক্ষর পেয়েছিলেন এক হাজারেরও কম, পক্ষান্তরে রাধাকান্ত দেব পেয়েছিলেন ছত্রিশ হাজার, সাতশ তেষট্টিটি স্বাক্ষর। বহুবিবাহ বন্ধের পক্ষে সই পেয়েছিলেন পঁচিশ হাজার। বিরুদ্ধে ছিল আপামর জনগণ। 

তার সহায়তায় দাঁড়ায়নি তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদের প্রথিতযশা, জনপ্রিয় অংশ।
ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত স্থূল কবিতা লিখে মজা লুটছেন।

"বাঁধিয়াছে দলাদলি লাগিয়াছে গোল
বিধবার বিয়ে হবে‚ বাজিয়াছে ঢোল।
শরীর পড়েছে ঝুলি, চুলগুলি পাকা
কে ধরাবে মাছ তারে, কে পরাবে শাঁখা।"

বঙ্কিমচন্দ্র বিষবৃক্ষে সূর্যমুখীর পত্রে লেখেন, "ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে কলকাতায় কে না কি বড় পন্ডিত আছেন। তিনি আবার একখানি  বিধবাবিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, তিনি যদি পন্ডিত, তবে মূর্খ কে?"

আবার প্যারীচরণ সরকার, রাজনারায়ণ বসু, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, রাধানাথ শিকদার, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখ তুলনায় অনামারা বিদ্যাসাগরকে সমর্থন করেছেন ।

নিজে সংস্কৃত পন্ডিত হয়েও বুঝেছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রয়োজন, শাস্ত্রীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে হয়েছিলেন খড়্গহস্ত। ধর্মশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য ছিল অসামান্য। কিন্তু ধর্ম নিয়ে মাতামাতি ছিল তার চিন্তার পরিপন্থী।
বলেছিলেন, 'শাস্ত্রে যার বীজ আছে এমন কোনও বৈজ্ঞানিক সত্যের কথা শুনলে সেই সত্য সম্পর্কে শ্রদ্ধা ও অনুসন্ধিৎসা জাগা দূরে থাক, তার ফল হয় বিপরীত। শাস্ত্রীয় কুসংস্কার আরও বাড়তে থাকে, তারা মনে করেন যেন শেষ পর্যন্ত শাস্ত্রেরই জয় হয়েছে। বিজ্ঞানের জয় হয় নি।'

একদিন এই শহর কলকাতা থেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে আক্রান্ত মানুষটি চলে গিয়েছিলেন শহর ও সমাজ ছেড়ে দূরে, বাঙালীর সীমানার বাইরে। তার আগে আমাদের দিয়ে গেছেন বর্ণপরিচয়, ভাষা, শিক্ষা প্রসারে স্কুল ও কলেজ, নারীর ন্যূনতম মর্যাদা রক্ষার অধিকার, আর অপরিমেয় সমাজ সংস্কার।

প্রতিটি বাঙালি বিদ্যাসাগরের কাছে আকণ্ঠ ঋণী।

অনেক দুঃখে বলেছিলেন, ''আমাদের দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বে জানিলে আমি কখনই বিধবাবিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না।''

বাঙালি অসার ও অপদার্থ। সুপরিচিত বাঙালি বুদ্ধিজীবীর মুখ মুখোশে ঢাকা। তখন ও এখন।

আর এখন বিশেষভাবে বাঙালি চিন্তাহীন, ভাবনাহীন। তাদের হৃদয় আজ শকুন ও শেয়ালের খাদ্য । 

এখানে এসেছে অন্ধকারে দীর্ঘ শীত-রাত।

এই ম্লান সন্ধ্যায়, দোহাই, ওনার সম্পর্কে কথা যেন একটু কম বলি। নিজেদের চূড়ান্ত আহাম্মকি যেন বারেবারে উন্মুক্ত না করি। অথবা না হয়ে যাই পারিতোষিক প্রাপ্ত ঊনবিংশ শতাব্দীর বিদূষক। 

বরং পড়ে ফেলি  বিনয়  ঘোষের 'বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ' এবং ইন্দ্র মিত্রের 'করুণাসাগর বিদ্যাসাগর'।

আর পাঠ করি এক আপোসহীন কবির কবিতা-

মুখোশ ছিল না তার, তাই তাঁর  মুখের উপর 
দৃশ্যগুলি কুয়াশার, কান্না ছুঁয়ে অবশেষে ঝড়;
---------------------------------------------------

অথচ গভীরে তাঁর, শান্ত-স্থির করুণাসাগর।

----------------- কবি বীরেন চট্টোপাধ্যায়

Madhusree Bandyopadhyay
26/09/2019

বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

আদরের আষাঢ় আর অনাদরের ভাদর ~ কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়

আষাঢ়ের  বর্ষা আর  ভাদ্রের বর্ষার  তফাৎ  অনেকটা  নায়ক  আর পার্শ্ব  চরিত্র  অভিনেতার  মত । আষাঢ় আর  নায়কের  আসার  সময়  নিয়ে  কত  জল্পনা কল্পনা । তার  আসার  কত  তোড়জোড় ,  মেঘ  কালো  আঁধার  ঘনিয়ে  এল  । ঐ বুঝি  আসে । পরিচালকের  ব্যাস্ত  পায়চারি,  ত্রস্ত  ইউনিট ।  প্রযোজক , প্রেমিকার  ঘনঘন  ঘড়ি  দেখা ,  যদি  না  আসে  কত  লোকসান , কত  মিথ্যার  আশ্রয়ে  দেখা করতে  আসা । সে আসবে  তো ?  দেখ না  বাবা  একটু  বাইরে  বেরিয়ে । গুমগুম   ডাক  শোনা  যায়  ঐ এল  বলে । ছাতাটা নিয়ে  দাঁড়িয়ে থাক  ছাতারের মত । যদি   লোকেশন  চিনতে  না পেরে  চলে যায়  কি লোকসানটাই না  হবে । অবশেষে  অপেক্ষার  অবসান  তার  আগমন । হুড়মুড় করে  এল  সে  ।  বাকি  সব  কলরব  পড়ি  কি  মরি  করে  ঘরে  ঢুকে  এল । হাজার হাজার  ওয়াটের বিদ্যুৎ  ঝলকে উঠছে আর নিবছে। নায়কোচিত হুঙ্কার  আর পারিষদের  করতালিতে  ফেটে  পড়ছে । নায়ক  তার  সমস্ত  শক্তি   দিয়ে  আছড়ে পড়ছে  ক্যামেরার  সামনে । ছোট  অভিনেতা  অতিবয়স্ক বৃক্ষ  সব  থরথর করে কাঁপছেন । ঘন্টা  দুয়েক  দাপিয়ে  নায়ক  যখন  থামলে  নায়িকা  পরিচালক  প্রযোজক  সবার  অভিমান  ধুয়ে মুছে  সাফ । তিনি  চলে  যাবার পর ও  ছাদে  কার্নিসে  টালির  চালে  গাছের পাতা থেকে   তার আবেদন  টুপটুপ করে ঝরে  পড়ছে ।উপস্থিত   সবার  মধ্যে  তার  আবেশর রেশ  । তবে  সব  নায়ক  যেমন  মহানায়ক  হয়  না  তেমন  সব  আষাঢ়ের মেঘ যত  গর্জায়  তত  বর্ষায় না  । 

ভাদ্র মাস মল  মাস ।তার  কাছে  কারুর  কোন  চাহিদা  নেই ।পার্শ্ব চরিত্র অভিনেতার  কাছেও  কোন  অতিরিক্ত  চাহিদা  নেই ।  তার  জন্য  কোন  গল্প  নেই ,  অপেক্ষা  নেই,  আড়ম্বর  নেই । শুধু  ফাঁকটা  ভরাট করা , মাসটা উতরে  দেওয়া । অল্প মেক আপ  নিয়ে , অল্প  সংলাপে,  আধা  আলাপে যখন  কোন  কোন পার্শ্ব   অভিনেতা অনবদ্য  অভিনয়  করে  তখন  হাততালি  দেবারও কেউ  থাকে না ।  ভাদ্রের মেঘে  যখন  বিনা  আড়ম্বরে  বৃষ্টি  নামে  লোকে গুরুত্বই দেয় না,  ভাবে  এর  দৌড় জানা  আছে ।একদিন  তার  ঝমঝম মূষল ধারায় ভিজে  খেসারত  দেয়  আর  দৌড় মারে । আশ্রয়  পেলে  পরক্ষণেই  বলে  ওঠে  এ আর  কতক্ষণ ? এক্ষুনি  থেমে  যাবে । জাত  পার্শ্ব  অভিনেতা  থেমে  যায় না,  সে নায়ককেও  দৌড়  করায় এডিটিং  টেবিল  অবধি ।ভাদ্রের বর্ষা সুযোগের  অপেক্ষায় থাকে । রসিক বর্ষায়  ভিজে  আনন্দ  পায় । প্রেমিক  প্রতীক্ষায়  থাকে  আষাঢ়ের ।

সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

লাঠির মুখে বাঁশীর সুর ~ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য

দাদা গো দাদা দেখছি ভেবে অনেক দূর
যাদবপুরের সবই খারাপ
পোষাক চলন বলন খারাপ
যো হুজুরের ফলন খারাপ
ছাত্র খারাপ ছাত্রী খারাপ
রাত্রিবেলা বাওয়াল খারাপ
সওয়াল জবাব দুটোই খারাপ
স্কলার খারাপ টিচার খারাপ
বিচার চেয়ে ধর্না খারাপ
কল্কে গাঁজা চরস খারাপ
শরত হিমের পরশ খারাপ
সেমেস্টারের চমক খারাপ
ধমক ভাল, তর্ক খারাপ
পর্কও খারাপ বিফও খারাপ
মিছিল খারাপ মিটিং খারাপ
রেটিং খারাপ দালাল খারাপ
হালাল খারাপ ঝটকা খারাপ
সব কথাতে প্রশ্ন খারাপ
জোছনা, জ্ঞানের তৃষ্ণা খারাপ
বিপ্লবীদের তত্ব খারাপ
কৃষ্টি খারাপ সৃষ্টি খারাপ
লেনিন খারাপ মাও'ও খারাপ
চা বিস্কুট আড্ডা খারাপ
চিকেন খারাপ মটন খারাপ
পঠন পাঠন দুটোই খারাপ
হোক কলরব ব্যানার খারাপ
স্ক্যানার খারাপ জেরক্স খারাপ
কিন্তু সবার চাইতে খারাপ
লাঠির মুখে বাঁশীর সুর।।

রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

রাজীব কুমারের দৌড় ~ সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়

লাস্ট ল্যাপ দৌড়চ্ছেন রাজীব কুমার ।    
আই পি এস হয়ে ১৯৮৯ সালে পুলিশ একাডেমীর ১১ কিলোমিটার দৌড়ে প্রথম হয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন রাজীব । 
আজও সেই দৌড় থামলনা । এবারের দৌড়টা লম্বা । হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট আবার হাইকোর্ট  । শেষে চেপে বসল গলার ফাঁস । রাজ্যের গোয়েন্দা প্রধান বেপাত্তা । পৃথিবীর ইতিহাসে হয়তো প্রথম । তাতে কি এসে যায়  'হীরক রাণী'র । যাকে বাঁচাতে গিয়ে রাজীবের গলায় এই ফাঁস ।    

সত্যজিৎ রায় বেঁচে থাকলে বাঙালি নির্ঘাত একটা 'হীরক রাণীর দেশে' পেত । সত্যজিৎ রায় নিশ্চিত যেতেন না নজরুল মঞ্চে  কালীঘাটের কচি খুকীর আদিখ্যেতা সভায় কিন্তু  পেতেন একটা বঙ্গশ্রী কিমবা বঙ্গ বিভীষণ জাতীয় পুরষ্কার । মঞ্চে হয়তো উনি বলতেন – 'আমাদের সত্যজিৎ দা' আসতে পারেন নি । ওঁর হয়ে অরূপ নেবে পুরস্কার । পৌঁছে দেবে 'আমাদের সত্যজিৎ দা'র কাছে ......ইত্যাদি ইত্যাদি ।   
 
সেই হীরক রাণীর দৌলতেই রাজীবের প্রাণ আজ ওষ্ঠাগত । ২০১৪ এ যেদিন রাত দেড়টায় UBI ব্যাংকের লকার খুলিয়ে সুদীপ্ত সেনের স্ত্রী পিয়ালির হেফাজতে থাকা সমস্ত নথী সরিয়েছিলেন রাজীব, সেদিন কি বুঝতে  পেরেছিলেন এই দিনটা আসতে পারে যখন হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রীটের যুবরাজের দোতলায় তাঁকে রাত কাটাতে হবে । কখনো ভেবেছিলেন যে শুধু সি বি আই-য়ের অনুরাগের ছোঁয়া থেকে বাঁচতে অমিত শাহের সঙ্গে একটা এপয়েণ্টমেণ্ট পেতে দিল্লী প্রবাসী রুড়কি আই আই টির ব্যাচমেটকে ধরতে হবে ! 

ভাবেন নি । ভাবার  কোন প্রয়োজনও ছিল না । ঝকঝকে কেরিয়ার । স্কুল জীবনের পড়াশুনা শেষ করেই  রুড়কি আই আই টি । অসম্ভব ভালো রেজাল্ট নিয়ে mechanical engineer । এরপর  administrative service এ বসা । এবং উত্তীর্ণ হয়েই আই পি এস-এ আসা । বেঙ্গল ক্যাডারে । তার আগে এক বছর HCL এ চাকরি জীবন । 

বেঙ্গল ক্যাডারে যোগ দিয়েই দুর্গাপুরে পোস্টিং । বীরভূমের পুলিশ সুপার । efficient অফিসার হিসেবে ততদিনে পরিচিতি পাঁচ কান হয়েছে । বুদ্ধবাবুর  কানেও তুলেছেন সচিবরা । ২০০১ সালে যেদিন খাদিম কর্তা পার্থ রায় বর্মণকে তুলে নিয়ে গেল দুবাইবাসী আফতাব আনসারির লোকজন রাজীব তখন সি আই ডি তে । টানা সাত দিন অফিস ছেড়ে নড়েন নি । টুথ ব্রাশটাও বাড়ী থেকে আনিয়ে নিয়েছিলেন । আফতাবকে দুবাই থেকে আনিয়ে ছেড়েছিলেন । তারও আগে  মার্কিন কনস্যুলেট আক্রমণের পর এই আফতাবই দুবাই থেকে রাজীব ভাই বলে ফোনটা কেটে দিয়ে বার্তা দিয়েছিলেন ।  আলিপুরের সংশোধনাগারের আট ফুট বাই ছ ফুটের অন্ধকার কুঠুরিতে দিন কাটানো আফতাব একদিন কথায় কথায় জেলারকে বলেছিলেন – রাজীব কুমার না থাকলে আমি আজ দুবাইতেই থাকতাম । ২০০৯ এ যখন জঙ্গল মহলে ছত্রধর মাহাতোরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে পুলিশকে সাংবাদিক সাজিয়ে ছত্রধরের কাছে পাঠিয়েছিলেন । নিজে লুঙ্গি পড়ে পেছনে । ছত্রধর ধরা পড়েছিলেন । ২০০৬ এ হুব্বা শ্যামলের দাপটে পুর্ব কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ত্রাস চলছে । কলকাতার আন্ডার ওয়ার্ল্ড ডন । হুব্বা শ্যামলের মুখের কোন ছবিও নেই পুলিসের কাছে ।  পুলিশকে নাকানি চোবানি খাওয়াচ্ছে । রাজীব  সূত্র মারফৎ খবর পেলেন হুব্বা শ্যামল সল্ট লেকের মাল্টিপ্লেক্সে  কলিযুগ সিনেমা দেখতে আসবেন । প্লেন ড্রেসে একাধিক সহকর্মীকে নিয়ে মিশে গেলেন ভিড়ে । আচমকাই একজনকে পেছন থেকে রাজীব নিজেই হাঁক পাড়লেন –  শ্যামলদা ।  হুব্বা পেছন ফিরতেই রাজীব হাত বাড়িয়ে দিলেন । আজও হুব্বা শ্যামল সেন্ট্রাল জেলে । 

সহকর্মীরা বলেন রাজীব কুমারের ব্রেনটা কম্পিউটার । বাম আমলে ফোন tapping তাঁর মস্তিস্ক প্রসূত । মমতার গতিবিধি সব কিছু track করা নিপুন দক্ষতায় করতেন । মমতা জানতেন সেটা । ২০১১ এ এসে মমতা খোঁজ করেন রাজীবের । ঠিক করেন এমন জায়গায় পোস্টিং দেবেন যাতে জীবনের মত শিক্ষা হয় । মনীশ গুপ্ত  বুদ্ধি দেন  - রাজীবকে কাজে লাগান ।  he is extra-ordinary । রাজীবের সঙ্গে নয়া প্রশাসনের সমঝোতা express চালু হয় । খাগরাগড় বিস্ফোরণের মুজাহিদিন সাজিদকে পাকড়াও করেন রাজীব । আরও কাছে আসা শুরু । বিধান নগরের পুলিশ কমিশানার পদপ্রাপ্তি । ততদিনে মমতা টের পেয়ে গেছেন  রাজীব আনুগত্য বিক্রি করতে পারেন । at the cost of কেরিয়ার । রাজীবও বুঝে গেছেন কি চান তাঁর প্রভু । দ্রুতাতার সঙ্গে কাছে আসা সেই শুরু হয়   ।  EDর নাগাল এড়াতে রাত একটায় অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সুদীপ্ত সেনের স্ত্রী পিয়ালি সেনের ব্যাঙ্ক লকার খুলিয়ে সারদার সব তথ্য হাপিশ করা । সারদার অফিস থেকে সব document সরানো রাজীবের টুপিতে পালকের পর পালক গুঁজতে শুরু করেন নিজেই ।  এ সময় এমনও দিন যায় রাজ্যের ডি জি কে বাইরে বসিয়ে রেখে  কালীঘাটে রাজীবের সঙ্গে close door মিটিং করেন উনি, কয়েক ঘণ্টা । ব্যথিত ডি জি নির্বাক হয়ে অফিস ফিরে যান ।  
      এরপরই  বিধাননগর থেকে   লালাবাজারের দুরত্ব ঘুচিয়ে দেন মমতা  । অনেককে টপকে কলকাতার নতুন  নগরপাল  হন রাজীব কুমার ।  খূব দ্রুত হাঁটতে শুরু করেন রাজীব । অধীর চৌধুরী, সূর্যকান্ত মিশ্র, দিলীপ  ঘোষ, মুকুল রায় এমনকি শুভেন্দুর ফোন tap ও track  করানোর কাজগুলোতেও নিখুঁত পেশাদারিত্ব আনেন রাজীব । প্রতি বেলায় তার বয়ান চলে যায় নবান্নের নেত্রীর android সেটে । ক্রমেই হয়ে ওঠেন সাইবার বিশেষজ্ঞ । নগরপাল হয়েও বহু রাত কাটে তাঁর লর্ড সিনহা রোডের গোয়েন্দা বিভাগে । পূর্ব ভারতের transit route হিসেবে বহু criminal কলকাতাকে ব্যবহার করে । তার বিস্তৃত তথ্য থাকে রাজীবের ফোনের ডগায় । পৃথিবীর সমস্ত দেশের পুলিশ কমিশনরদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ইসরায়েল গিয়ে মোসাদের আধুনিক প্রজুক্তিকে মগজ বন্দী করে আনেন রাজীব ।      
সেই রাজীবকে মমতা কাজে লাগালেন নিজের আর দলের চৌর্যবৃত্তি আড়াল করতে । রোজভ্যালির গৌতম কুণ্ডুকে দিনের পর দিন এই রাজীব কুমার বোঝালেন – আড়াল করুন । ভুলেও নাম নেবেন না শাসক দলের beneficiary  নেতাদের । যত চাপই আসুক ।  এই রাজীব কুমারই আবার সি বি আই-এর জেরায় বলেলেন  সুদীপ্ত সেনের বিধান নগরের অফিসের কম্পিউটার মনিটারগুলো তিনি বাজেয়াপ্ত করেছিলেন । CPU গুলো নয় । কারণ তিনি নাকি জানতেন ই না যে CPU তেই জমা থাকে আসল তথ্যগুলো । CBI অফিসার রা অনেক ক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন তাঁর দিকে ।  
এই রাজীবই আবার সি বি আই কে বলেলেন – সারদা, রোজ ভ্যালি বা চিট ফান্ড-এর বিষয়ে তিনি নাকি কিছুই জানেন না । সি বি আই অফিসাররা তাঁকে মনে করান তাঁর পুরানো বয়ান যেখানে তিনি বলেছিলেন সুপ্রিম কোর্টে তিনি হাজির থাকতেন রাজ্য সরকারের উকিলদের সাহায্য করতে ।  রাজীব নিরুত্তর থাকেন । 

এই উত্তরহীন রাজীব এখন দৌড়চ্ছেন  নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে । কালীঘাটের 'উনি' এখন শেষ ভরসা, রাজীবের । ফেব্রুয়ারির এক সন্ধ্যায় এই 'উনি'ই রাজীবের জন্য পথে বসেছিলেন ধর্নায় । সেই 'উনি' এখন কালীঘাটে আড়াইশো  প্রহরীর নিশ্চিন্ত পাহারায় ঘুমোচ্ছেন  প্রতি রাতে । রাজীব এখন রাত জাগেন প্রতি রাতে । রামকৃষ্ণ মিশনের মোহন মহারাজের  গাইডেন্সে  mathematics এ Phd করছিলেন রাজীব । মাথার ওপর টাঙানো থাকে রবীন্দ্রনাথ আর আইনস্টাইনের ছবি  । সেই রাজীব আজ বড্ড আশ্রয়হীন । মাথার ওপর টাঙানো ছবিগুলো এখনো তাঁর বাংলোয়ে হয়তো আছে । মাথার ওপর ছাদটা সরে গেছে ।  অনেক পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে 'ভুবনেশ্বর' এখন প্রতি মুহূর্তে তাঁকে ডাকছে ।     

রাজীব, শুনছেন...... আপনি যান, পালিয়ে না বেড়িয়ে । ভিটে মাটি হারানো চিট ফাণ্ডের বহু রাত জাগা মানুষগুলো আপনার ভুবনেশ্বর যাওয়ার দিনে আনন্দে ডুকরে কেঁদে উঠবে । এবারের পুজোটা  জেলের মধ্যে বসেই ঢাকের আওয়াজ শুনুন আপনি । সামনের বছর, নিশ্চিত থাকুন, কালীঘাটের যুবরাজ আপনার সঙ্গ দেবে । একাকীত্ব কেটে যাবে । 

যান রাজীব যান, ভুবনেশ্বর আপনাকে ডাকছে ।

সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়  ( ৯৮৩০৪২৬০৭৮ )

শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

সিঙ্গুর থেকে নবান্ন ~ অনির্বান চক্রবর্তী

- কমরেড কোথা থেকে আসছেন ?

- বর্ধমান বাবা। তুমি ?

- এখানেই। কলকাতা। পরিবার থেকে কতজন      এসেছেন আপনারা ?

- আমরা।  .. ছেলেটা একবছর আগে বিষ খেয়ে     মরেছে। ধানের দাম পায়নি। ও তো বেঁচে থাকলে আসতো । তাই আমরা এসেছি।

- আমরা ?

- এই যে আমি, আমার ঝান্ডা আর ছেলেটার ঝান্ডা। মোট তিনজন।

- ......


বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

যদি.... ~ রজত শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

যদি,
ইলিশ মাছের আমেজ পেতুম কল্মীশাকে,
তবে,
"জয় মা" ব'লে জাপ্টে নিয়ে রাম বাবাকে,
মাংস ছেড়ে পালিয়ে যেতুম হরিদ্বারে,
ফলার খেয়ে তৃপ্তি পেতুম গঙ্গা পারে।

যদি,
শিক-কাবাবের গন্ধ পেতুম কুমড়ো ভাতে,
তবে,
জৈন হ'য়ে কল্পসুতো বাগিয়ে হাতে
দিগম্বরের মূর্তি ধরে ডাইনে বামে
আস্থা চ্যানেল ভরিয়ে দিতুম যোগ ব্যায়ামে।

যদি,
চিংড়ি মাছের মস্তি পেতুম থানকুনিতে,
তবে,
নিমাই সেজে ঢোল বাজাতুম ডানকুনিতে,
চুল কামিয়ে দু'চোখ বুজে "কেষ্ট" ব'লে
বষ্টুমীকে বসিয়ে নিতুম দুষ্টু কোলে।

যদি,
মানকচুতে চিকেন কারির স্বাদটা পেতুম,
তবে,
আমিষ ছেড়ে ঘাস বিচালি চিবিয়ে খেতুম,
তরকারি আর ফল খেয়ে বেশ তৃপ্ত মুখে
কাটিয়ে দিতুম জীবনটাকে গুপ্ত সুখে।।
.

রজত শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ~ ১৭-০৮-২০১০

(সাড়ে পাঁচ বেলা)

মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

ভালোরে ভালো ~ প্রিয়াঙ্কা মুখার্জী

দাদা গো, দেখছি ভেবে অহর্নিশ -

  ট্যাংরা ভালো, পারশে ভালো
  পোস্ত বেটে সরষে ভালো
  গুড়জালি মাছ রসায় ভালো
  বোয়াল মৎস্য কষায় ভালো
  গোটাও ভালো, কাটাও ভালো
  দইপোনা হলে সাঁটাও ভালো
  মৌরলা এক রত্তি ভালো
  শিঙি-মাগুর পথ্যি ভালো
  নেমন্তন্নে কাতলা ভালো
  তিলাপিয়া ঝোল পাতলা ভালো
  মালাইকারির গলদা ভালো
  ভাপে ফেলে বাগদা ভালো
  ভেটকি ভালো, আড়ও ভালো
  শোল কালিয়ার তারও ভালো
  মুড়িঘন্টের ডাল ও ভালো
  ভেটকি মাছের ঝাল ও ভালো
  চিতল মাছের মুইঠ্যা ভালো
  ঝুরি ঝুরি লইট্যা ভালো
  কাঁটাচচ্চড়ি খাইতে ভালো
  কিন্তু সবার চাইতে ভালো -

  ইলিশ মাছের ভাজা পিস।

(তাতাবাবু মাইন্ড করবেন না, জানি।)

সব লিখেছে ফেসবুকেতে ~ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য

সব লিখেছে ফেসবুকেতে এই দুনিয়ায় বিজ্ঞ যত 
তৃতীয় বিশ্ব অর্থনীতি বুঝিয়ে দেবেন জলের মত;
কেমন করে চন্দ্রযানের পলতেটাতে আগুন দিলে
চাঁদের পিঠে নামবে সোজা মন্ত্রী নেতা সবাই মিলে!
কেমন করে স্কোয়ার কাটে ছক্কা মারে গুগলি বলে
কি সার দিলে শরৎকালে কুমড়ো গাছে পটল ফলে!
কেমন করে লস্যি বানায় ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ করে
হলুদ ট্যাক্সি হাওড়া যাবে, যায়না কেন বিজয়গড়ে!
কেমন করে গন্ধ শোঁকে হোয়াটসএপের নানান গ্রুপে
বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে যায় তরকা রুটি চিকেন স্যুপে;
ঘোড়ার ডিমের আসল নকল কি গুন আছে আয়ুর্বেদে
গভীর রাতে লাইভ হবেন গান শোনাবেন পোস্টে বেঁধে;
হাজার হাজার ফ্যান ফলোয়ার কমন পিপুল বিরাট নেতা
হিংসাতে কেউ জ্বলতে থাকে কেউ বলবে আদিখ্যেতা ;
ঢেঁড়স কেন উর্ধমুখী গাজর আলু মাটির নীচে
কেমন করে করত সুইং ডেনিশ লিলি ঘাসের পীচে?
নোটবন্দীর সুফল কুফল জিতবে কারা নির্বাচনে 
সুভাষ কবে ফিরবে ঘরে, খড়ম কেন সিংহাসনে!
কেউ বলেনা চাদিম রাতে হাসজারু কি বকচ্ছপে
আবোল তাবোল পড়তে থাক পেঁয়াজ মুড়ি আলুর চপে!
পাচ্ছিনাকো কোথায় লেখা জ্যোৎস্না কেন চমৎকার 
কেমন করে বাঁচাতে হবে করলে তাড়া পাগলা ষাড়।।
 
** ক্ষমা করবেন স্যার (সুকুমার রায়, ৩০ অক্টোবর ১৮৮৭ – ১০ সেপ্টেম্বর ১৯২৩)

সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

বুদ্ধবাবু ~ কাজরী বসু

প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সরকারি সব সুযোগ সুবিধা প্রাপ্য তাঁর। প্রত্যাখ্যান করলেন। কখন? যখন প্রাণবায়ুর অভাবে ধুঁকছে হৃদযন্ত্র। এক পয়সাও নেবেন না, পার্টি বিল মিটিয়ে বাড়ি ফেরালো,দশ বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকার পরেও হাসপাতালের বিল মেটানোর মতো টাকা নেই যাঁর, তাঁকে, তিনি ফিরতেই চান,তাই। এক কবির লেখায় পড়েছি আমরা,তুমিও মানুষ আমিও মানুষ তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়। জানি না,কোন কবি কার উদ্দেশে কখন কী লেখেন,কিন্তু মজা হলো এই, কবিতার সেই লাইন হঠাৎ করে একদিন এমন কিছু বোঝায় যা হয়ত কবিও কখনো বলেননি। কিংবা বলেছেন,সব কী আর মনে রাখা যায়!

সে তিনি মনে রাখুন আর নাই রাখুন,আমরা অনেকেই কিন্তু মনের মণিকোঠায় রেখে দেব বাংলার এক পুরোদস্তুর সৎ উন্নতশির ঋজু শিরদাঁড়ার সেই মুখ্যমন্ত্রীকে যিনি নিজের প্রাপ্য সুযোগসুবিধা অবলীলায় ফিরিয়ে দেন ফিরিয়ে দেবেন বলেই। মাথা শ্রদ্ধায় নত হবে আজীবন, গর্বে ভরে উঠবে বুক। আমরা কেউ কেউ উপেক্ষা করব আজীবন তাঁদের,যাঁরা একদিন এই মানুষটির গায়ে কাদা ছিটিয়ে তাঁর ব্যঙ্গচিত্র এঁকে নিজেকে ধিক্কারযোগ্য প্রমাণ করার পরেও ফুটেজ খেতে নির্লজ্জের মতো হাসপাতালে তাঁরই অসুস্থতায় চলে যান আর বাইট দেন, আমরা উপেক্ষা করব আজীবন তাকে, যে সংবাদমাধ্যম নিরপেক্ষতা জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু চেটে নেওয়া ক্ষীর দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থবার চাটার আশায় পদলেহন করে তাদের যারা একদিন মিথ্যে দোষারোপ করে সেই সৎ মানুষটিকে পিছন থেকে ছুরি মেরে নিজের আখের গুছিয়ে নিয়েছে। আমরা উপেক্ষা করব সেই দুর্বুদ্ধিজীবীদের যারা শুধু গিরগিটি হবে বলেই মানুষের চামড়াটিকে বন্ধক দিয়েছে বেনিয়াদের কাছে আর তাঁকে মসনদচ্যুত করেছে কিছু অর্থের লোভে।

এদের সবাইকে উপেক্ষা করে আমরা অনেকেই শুধু সেই মানুষটিকে প্রণম্য বলে ভাবব যাঁর সততা প্রমাণের জন্য পোস্টারের প্রয়োজন হয় না,হ্যাঁ সহস্রবার ভাবব।

আমরা নিজেদের পশ্চিমবঙ্গবাসী বলে আজীবন গর্ব করব কারণ একদিন এই মানুষটি,একক প্রচেষ্টায় এ রাজ্যকে জল হাওয়া খাদ্য দিয়ে পরিপুষ্ট করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাওয়া মানুষটি আমাদের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন,যাঁর নাম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

✍©কাজরী বসু

বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

টু কমরেডস ~ অর্ক রাজপন্ডিত

২৯শে আগস্ট সকাল ঠিক ৯টা ৫৫। ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট নম্বর সিক্স ই টু ওয়ান থ্রি সিক্স সবে পাড়ি দিয়েছে শ্রীনগরের পথে।
সীতারামের সঙ্গে রয়েছেন তাঁর এক সহকর্মী। ঠিক বেলা সাড়ে এগারোটায় শ্রীনগর বিমানবন্দরের মাটি ছুঁলো বিমান। বিমান থেকে নামা মাত্রই দুই পুলিশ অফিসার এসে হাজির, একজনের নাম ইমতিয়াজ হোসেন, তিনি পুলিশের সিনিয়র সুপারিটেন্ডেন্ট। ইমতিয়াজ জানালেন সীতারামকে, তিনিই তাঁকে নিয়ে যাবেন তাঁর কমরেড তারিগামির কাছে। ইমতিয়াজ এও জানালেন সীতারামকে সেদিনই ঠিক বিকাল পাঁচটার দিল্লিগামী বিমানে তাঁকে উঠিয়ে দেওয়া হবে।
ইমতিয়াজকে থামালেন সীতারাম। স্পষ্ট বললেন, তিনি সেদিনই ফিরবেন কি না তা নির্ভর করছে কমরেড ইউসুফ তারিগামির স্বাস্থ্যের অবস্থার উপর। সিংহ গর্জে উঠলো স্বমহিমায়। কনভয়ে তোলা হল সীতারাম এবং তার সহকর্মীকে। আগে পিছে পুলিশি গাড়ি। কনভয় থামলো গুপকার রোডে তারিগামির বাড়ির সামনে।
২৯শে আগস্ট, ঘড়ির কাঁটায় ঠিক সাড়ে বারোটা। তারিগামির বাড়িতে পৌঁছলেন সীতারাম। ৫ই আগস্ট থেকে সহযোদ্ধাদের দেখেননি তারিগামী। ৫ই আগস্ট থেকে গৃহবন্দী তারিগামী। সীতারামকে দেখে আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলেন। দুই কমরেড জড়িয়ে ধরলেন পরস্পরকে। উষ্ণ আলিঙ্গনে।
তারিগামির বৈঠক খানায় বসলেন সীতারাম ও তারিগামী। পাক্কা একটি ঘন্টা অনাহুতের মত দাঁড়িয়ে রইলেন পুলিশ কর্তা ইমতিয়াজ। সীতারাম জানতে চাইলেন ইমতিয়াজের কাছে, তারিগামির অপরাধ কি? ইমতিয়াজ বলে উঠলেন তারিগামির বিরুদ্ধে আইনি কোন অভিযোগই নেই, এবং তিনি নাকি ‘মুক্ত’। ইমতিয়াজকে এবার প্রশ্ন তারিগামির। তাঁর জেড প্লাস নিরাপত্তার গাড়ি গুলি কেন উধাও হয়ে গেল? কেন গত ২৫ দিন ধরে তাঁর নিরাপত্তারক্ষীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বাইরের কেউ যাতে ঘরে আসতে না পারে? কেন তাঁকে এবং তার পরিবারের সদস্যদের বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি?
তারিগামি সীতারামকে জানান, তিনি শেষ বারের মত শ্রীনগরের ‘শের ই কাশ্মীর ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স’ চিকিৎসার জন্য যান ৩১শে জুলাই। সেদিনই চিকিৎকরা জানান হার্ট এবং ফুসফুস সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি পরীক্ষা করা দরকার।
৫ই আগস্ট এলো কারফিউ। ৫ই আগস্ট থেকে বাইরে শুধুই পুলিশি বুট। আর হাসপাতালে যাওয়া হয়নি তারিগামির। বারংবার তারিগামি এবং তার পরিবার জানিয়েছেন প্রশাসনকে চিকিৎসা করা দরকার। ১৯শে আগস্ট তাঁকে বাড়িতে পুলিশি নিরাপত্তায় দেখতে আসেন একজন কার্ডিওলজিস্ট। বার বার অনুরোধের পর ২৪শে আগস্ট পুলিশি ঘেরাটোপে তারিগামিকে নিয়ে যাওয়া হয় ‘শের ই কাশ্মীর ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স’এ। তারিগামি হার্ট এবং ফুসফুস জনিত নানান সমস্যায় ভুগছেন। ভুগছেন ডায়াবিটিসের সমস্যাতেও। জানিয়েছেন সহযোদ্ধা সীতারামকে।
বৈঠকখানায় কথা চলতে থাকে। সীতারাম পুলিশ কর্তা ইমতিয়াজকে অনুরোধ করেন ঘরের বাইরে যেতে, ইমতিয়াজ বাইরে গেলেও তারিগামির বাড়ি জুড়ে প্রহরা।
সীতারাম অনড় থাকেন। তাঁর দিল্লি ফিরে যাওয়ার আগে তাঁর সামনে একজন চিকিৎসককে ডাকতে হবে যিনি তারিগামির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে পুঙ্খানুপুঙ্খু তাঁকে জানাবেন। পুলিশ কর্তা ইমতিয়াজ সীতারামকে জানান পরের দিন সকালে অর্থাৎ ৩০শে আগস্ট সকালে একন ডাক্তার ডাকা সম্ভব।
সীতারাম পুলিশকে জানান আজ রাতটা তিনি তারিগামির বাড়িতেই থাকতে চান। পুলিশ নাছোড়বান্দা, তারা পাল্টা জানায় তারিগামির বাড়িতে থাকা যাবে না, অন্য কোথাও তাঁকে থাকতে হবে।
এরই মধ্যে বৈঠক খানায় আসেন তারিগামির স্ত্রী। তারিগামি এবং তাঁ স্ত্রী দুজনেই সীতারামকে জানিয়ে দেন তিনি যেন সুপ্রিম কোর্টে ‘হেবিয়াস কর্পাস’ চালিয়ে যান। সুপ্রিম কোর্ট যদি অনুমতি দেয় তারিগামিকে নিয়ে আসা হবে দিল্লিতে এইমস’এ। তারিগামি এবং তার পরিবার সীতারামকে এও জানান, তাঁর পরিবার এমনকি নাতি নাতনিরাও ‘গৃহবন্দী’। তাঁর বাড়ির ল্যান্ডলাইন, মোবাইল বন্ধ। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের সব পথই বন্ধ করে রেখেছে সরকার। বাড়িতে বন্দী, ফুরিয়ে আসছে টাকাও।
বিকাল সাড়ে চারটের সময় সীতারাম বিদায় নিলেন তারিগামির থেকে। বলে গেলেন কাল সকালে ফের আসবেন। তাঁর সামনেই ডাক্তাররা তাঁকে পরীক্ষা করবেন। সীতারামকে হাত মুঠো করে বিদায় জানালেন তারিগামি।
কনভয় ছুটলো রাস্তায় । ঝিলাম পেরিয়ে সরকারের গেস্টহাউসে সীতারামকে রাত্রিবাসের জন্য রাখা হল। পরের দিন সকাল সাড়ে সাতটায় সীতারাম চলে এলেন তারিগামির বাড়িতে। এসে গিয়েছেন চিকিৎসকও। ডাক্তার তাঁর নাম জানাতে চাননি!
ডাক্তারবাব স্পষ্ট জানালেন এখানে ডায়াবিটিসের চিকিৎসা সম্ভব নয়। ফুসফুস এবং চেস্ট ইনফেকশনের জন্য তারিগামির চিকিৎসা হওয়া উচিৎ এইমস’এ।
সীতারাম সব বুঝলেন, শুনলেন। সেদিন সকাল ১১টা ১০’এ সীতারাম এবং তাঁর সহকর্মী দিল্লিগামী বিমানে উঠলেন শ্রীনগর থেকে।
ও হ্যাঁ। দিল্লি থেকে শ্রীনগরের বিমান ভাড়া তো বটেই ফেরার বিমান টিকিট যা পুলিশ কেটেছিল তারও দাম মিটিয়েছেন সীতারাম।
ঝিলাম নদী পার হওয়া রাত্রিবাসের সরকারি অতিথিশালার বিলটিও মিটিয়েছেন সীতারমই!
আজ ৫ই সেপ্টেম্বর।
আজ থেকে ঠিক এক মাস আগে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ প্রশ্নে সব লিবেরালরা ন্যুড হয়েছিলেন।
এই এক মাসে কাশ্মীরে চলছে নিরন্তর অবরোধ। চলছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। পেলেটে মুখে আলপনা আঁকছে কাশ্মীরের যৌবন।
দু দু বার শ্রীনগর এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে এসেছিলেন কমরেড সীতারাম। তৃতীয় বার আর ফিরে আসেননি। কমরেড সীতারামকে রাষ্ট্র আটকাতে পারেনি।
আজ ৫ই সেপ্টেম্বর। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন তারিগামিকে নিয়ে আসতে হবে এইমস’এ।
জিতলেন সীতারাম। জিতলো সিপিআই(এম)।
ফ্যাসিস্টদের সামনে কোনদিন হাঁটু মুড়ে বসে থাকেননি কমিউনিস্টরা। সীতারামরা হারতে শেখেননি। স্থিতাবস্থাকে মেনে নিতে শেখেননি।
সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা কমরেড সীতারাম ইয়েচুরির হলফনামা ভারতের গণতন্ত্র, ফ্যাসিবিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
সহযোদ্ধার জন্য এই লড়াইনামা ঠাঁই পাবেই ফ্যাসিবিরোধী দুনিয়া জোড়া লড়াইয়ের মহাফেজ খানায়।

একটি কলঙ্কিত পরম্পরা ~ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়

                         আনুষ্ঠানিক শিক্ষক দিবস আজ।অবশ্যই ভারতবর্ষে।অন্য কোনো দেশ এই দিনে এই উদযাপন করেনা।একেক দেশের একেক তারিখ রয়েছে।এমনিতে ইউনেস্কো অক্টোবরের পাঁচ তারিখকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস বলে ঘোষণা করেছে ১৯৯৪ সালে।আমাদের দেশে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের জন্মদিনে এই শিক্ষক দিবস উদযাপন করা শুরু হয়েছিল ১৯৬২ সাল থেকে।অর্থাৎ যে বছর উনি রাষ্ট্রপতি হলেন।এটা ছিল ওঁর ছাত্রদের পরিকল্পনা।তাঁদের শিক্ষক দেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপ্রধান হচ্ছেন,এই উপলক্ষটিকে সম্মান জানাতে চেয়েছিলেন তাঁরা।কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিগত গুরুদক্ষিণা যে আজ গোটা দেশের হয়ে দাঁড়িয়েছে।সেটার পিছনে অবদান স্বয়ং রাধাকৃষ্ণানেরই।---

              " Instead of celebrating my birthday,   
                it would be my proud privilege if       September 5th is observed as Teachers' Day."
                 নিজের জন্মদিনকে এভাবেই নিজের জীবদ্দশাতেই অমর করে দিয়েছিলেন ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি।
              এমনিতে আমাদের দেশে গুরুপ্রণামের অন্য একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দিন ছিল।গুরুপূর্ণিমার দিন, যেটি এখন প্রায় বিস্মৃতির আড়ালেই চলে গেছে।হিন্দু,বৌদ্ধ,জৈন সব শাখাতেই এই তিথির উদযাপন ছিল।

                             ভারতবর্ষ ভক্তির দেশ।
সে শিক্ষকই হোন আর রাষ্ট্রপ্রধানই হোন,ভক্তির আবেগ এ দেশে যুক্তি মানে না।তবে কিনা বেসুরো গাওয়া আমার চিরকালের অভ্যেস।তাই আজ যখন ফেসবুক ছেয়ে গেছে গুরুপ্রণামীর বন্দনামন্ত্রে তখন আমি একটা অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ তুলছি আপনাদের কাছে।এটা গত বছর ফেসবুকে লিখেছিলুম।আজ ফিরে শেয়ার করছি।

জানেন কি,আমাদের দেশ এমন একজনের জন্মদিনে শিক্ষকদের শ্রদ্ধা জানায়,যিনি নিজে শিক্ষক হয়ে ছাত্রতুল্য গবেষকের গবেষণা থেকে টুকে বই লিখে ধরা পড়েছিলেন?সে অন্যায়ের জন্য তিনি শাস্তি পাননি।নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে অপরপক্ষকে বাধ্য করেছিলেন বিষয়টি মিটিয়ে নিতে।আঁতকে উঠছেন?উঠবেন না।ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান প্লেজিয়ারিজমের দায়ে আদালতের কাঠগড়ায় গিয়ে উঠেছিলেন।সেই কলঙ্কিত ইতিহাস আজ তাঁর জন্মদিনে একটু স্মরণ করি।

১৯২৯ এর জানুয়ারি।মিরাট কলেজের দর্শনের তরুণ অধ্যাপক যদুনাথ সিংহ সারা ভারতের সারস্বত সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক অধ্যাপক ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের বিরুদ্ধে ছাপার অক্ষরে প্লেজিয়ারিজমের অভিযোগ তুলে।প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তির জন্য প্রদত্ত যদুনাথের গবেষণা "ইন্ডিয়ান সাইকলজি অব পারসেপশন" প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড থেকে ব্যাপকভাবে টুকে সে সময় ধরা পড়েছিলেন রাধাকৃষ্ণান।

যদুনাথ সিংহ "ইন্ডিয়ান সাইকোলজি অব পারসেপশন" নাম দিয়ে একটি বৃহৎ গবেষণা প্রকল্পের পরিকল্পনা করেছিলেন যার প্রথম খণ্ড ১৯২২ সালে এবং দ্বিতীয় খণ্ড ১৯২৩ সালে তিনি প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তির জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দেন।পুরো গবেষণাটি শেষ হয়েছিল ১৯২৫ নাগাদ।ওই সময়েই বাকি খণ্ডগুলিও জমা দিয়েছিলেন যদুনাথ।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাথমিকভাবে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল এবং সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানকে এই গবেষণার পরীক্ষক নিযুক্ত করেছিলেন।দ্বিতীয় খণ্ড থেকে পরবর্তী খণ্ডগুলি পড়বার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় রাধাকৃষ্ণানের সঙ্গে সঙ্গে জনৈক অধ্যাপক কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্যকেও সেই সময় দায়িত্ব দিয়েছিলেন।১৯২২ সালে যদুনাথ বৃত্তিটি লাভ করেছিলেন।

১৯২৫ সালে যদুনাথের গবেষণা শেষ হয়েছিল।আর ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল রাধাকৃষ্ণানের সাড়া জাগানো বই "ইন্ডিয়ান ফিলজফি"র দ্বিতীয় খণ্ড।যদুনাথের মুশকিল ছিল এই যে সুদূর মিরাটে থাকার দরুন কলকাতার সারস্বত সমাজের সব খবর যথাযথ সময়ে ঠিকঠিক তিনি পেয়ে উঠতেন না।ফলে তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পান নি যে তাঁর মৌলিক গবেষণাকর্মটি থেকে রাধাকৃষ্ণান একপ্রকার পুকুরচুরি করে বসে ছিলেন।চুরিটা তাঁর গোচরে এল যখন পরের বছর অর্থাৎ ১৯২৮ সালে রাধাকৃষ্ণানের "দ্য বেদান্ত অ্যাকর্ডিং টু শংকর অ্যান্ড রামানুজ" নামে আরো একটি বই বেরোল।এই বইটি ছিল আসলে "ইন্ডিয়ান ফিলজফি" দ্বিতীয় খণ্ডের অষ্টম এবং নবম অধ্যায়ের একটি স্বতন্ত্র পুনর্মুদ্রণ।এই বইটি পড়েই যদুনাথ সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছিলেন যে তাঁর গবেষণার প্রথম দুটি অধ্যায় থেকে অনুচ্ছেদের পর অনুচ্ছেদ নিজের বইতে টুকে বসে আছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম জর্জ অধ্যাপক ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান।

যদুনাথ সিংহ ছিলেন প্রকৃতই সিংহপুরুষ।এযুগের একলব্য হওয়ার বাসনা তাঁর ছিল না।শ্রদ্ধেয় আচার্য রাধাকৃষ্ণানের চৌর্যকে তিনি রেহাই দেন নি।প্রাথমিকভাবে ক্রুদ্ধ ক্ষুব্ধ যদুনাথ সরাসরি রাধাকৃষ্ণানকে চুরির দায়ে অভিযুক্ত করে দীর্ঘ এক পত্র লিখে পাঠিয়েছিলেন তৎকালের বিখ্যাত "মর্ডার্ন রিভিয়্যু" ইংরেজি পত্রিকার দপ্তরে।এত কাগজ থাকতে মর্ডার্ন রিভিয়্যু কেন?কারণ রাধাকৃষ্ণানের "ইন্ডিয়ান ফিলজফি" দ্বিতীয় খণ্ড বের হওয়ার এই পত্রিকাই দেখিয়েছিল যে রাধাকৃষ্ণান তাঁর বেশ কিছু সিদ্ধান্তের পিছনে যথাযথ যুক্তিপরম্পরা এবং তথ্যসূত্র উল্লেখ করেনি।তারা সে নিয়ে প্রশ্নও তুলেছিল।কিন্তু রাধাকৃষ্ণান কোনো জবাব দেন নি।

যাই হোক,যদুনাথ সিংহ ২০ ডিসেম্বর ১৯২৮ তারিখে তাঁর প্রথম চিঠিটি লিখে পাঠালে মর্ডার্ন রিভিয়্যু সেটি ১৯২৯ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশ করে।একটি চিঠি লিখেই যদুনাথ ক্ষান্ত হননি।তাঁর আরো তিনটি চিঠি এই পত্রিকাতেই পরপর ছাপা হয় ফেব্রুয়ারি,মার্চ এবং এপ্রিলে।এখানে একটি তথ্য জানানো দরকার যে রাধাকৃষ্ণানের দুর্ভাগ্যক্রমে এবং যদুনাথের সৌভাগ্যক্রমে যদুনাথের গবেষণাকর্মের প্রথম দুই অধ্যায়ের(যেখান থেকে রাধাকৃষ্ণান টুকেছিলেন) নির্যাস নিয়ে যদুনাথ বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ রাধাকৃষ্ণানের বই প্রকাশিত হওয়ার আগেই ১৯২৪ থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে মিরাট কলেজের পত্রিকায় ছাপিয়ে ফেলেছিলেন।এই খবরটা সম্ভবত রাধাকৃষ্ণান জানতেন না।কিন্তু এর ফলে যদুনাথের পক্ষে রাধাকৃষ্ণানের চুরি প্রমাণ করার কাজটা সহজ হয়ে গিয়েছিল।মর্ডার্ন রিভিয়্যুর পাতায় নিজের লেখা থেকে এবং রাধাকৃষ্ণানের লেখা থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধৃত করে করে যদুনাথ চুরির বহর সে সময় সবিস্তারে দেখিয়েছিলেন কিস্তিতে কিস্তিতে।চুরি তো নয়,নিলাজ টুকলির এক ইতিবৃত্ত সেটি।

বিক্ষুব্ধ যদুনাথের একটি পত্রাংশ আপনাদের এখানে পড়াই।--
"It is indeed true that not only in our unfortunate land, but all over the world, self praise is sought by some by dispraise of others. But this is comparatively a trifling thing. It pales into insignificance when compared with the moral perversity involved in the violation of sacred trust by a cultured and honorable man if and when there is any. I sincerely pray, all scholars, young and old may outgrow this perversity"

আসলে যদুনাথের চিঠি মর্ডার্ন রিভিয়্যু ছাপতে শুরু করলে চারদিকে যে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল,তাতে রাধাকৃষ্ণানের পক্ষে আর চুপ করে থাকাটা তখন অস্বস্তিকর হয়ে পড়েছিল।ফলে আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনিও পালটা দুটি চিঠি মর্ডার্ন রিভিয়্যুতে লিখেছিলেন।কিন্তু সেগুলির না ছিল মাথা না ছিল মুণ্ডু।এই চিঠিগুলিতে আত্মপক্ষ সমর্থনের নামে রাধাকৃষ্ণান আসলে যদুনাথ সিংহকে কালিমালিপ্ত করতে চেয়েছিলেন।প্রাথমিকভাবে রাধাকৃষ্ণানের বক্তব্য ছিল এই যে কোনো একটি বিষয় নিয়ে দু'জনে কাজ করলে,বিশেষত দর্শনের মতো বিষয় হলে,কিছু কিছু পারিভাষিক শব্দ এক হয়েই যায়।কিন্তু মুশকিল হল,কিছু পারিভাষিক শব্দ এক হওয়া আর অনুচ্ছেদের পর অনুচ্ছেদ মিলে যাওয়া তো এক নয়।এটা রাধাকৃষ্ণানও বুঝতেন।তাই এরপরে যদুনাথের বিরুদ্ধে তিনিই উলটে প্লেজিয়ারিজমের অভিযোগ হেনে বসেন।তাঁর বক্তব্য ছিল এই যে তিনি তাঁর বইয়ে প্রকাশিত বক্তব্য আগেই নানা বক্তৃতায় এবং ক্লাসে পড়াতে গিয়ে বলেছিলেন এবং যদুনাথ সেইখান থেকে অমুদ্রিত বক্তব্যগুলি চুরি করে নিজের লেখায় ছাপিয়ে দিয়েছেন তাঁর বই বেরোবার আগেই।এবং যদুনাথ নাকি প্রসিদ্ধ চোর যিনি আগেও নানা লেখকের মত চুরি করে নিজের গবেষণাপত্রে ছাপিয়েছেন।উদাহরণ হিসেবে রাধাকৃষ্ণান নাম করেন গঙ্গানাথ ঝা'য়ের।

দ্বিতীয় বক্তব্যটা ছিল একেবারেই বাজে কথা।যদুনাথ সিংহ সম্পর্কে এরকম উদ্ভট কথা আগে বা পরে কেউই কখনো বলেননি।।রইলো প্রথমটি।যদুনাথ এম.এ. পাস করেন ১৯১৭ সালে।তখনো রাধাকৃষ্ণান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে দক্ষিণ ভারত থেকে আসেননি।কাজেই যদুনাথকে ওঁর ক্লাসের ছাত্র বলা যায় না।মিরাট কলেজে যাওয়ার আগে যদুনাথ কিছুকাল ঢাকার জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক ছিলেন।রাধাকৃষ্ণান দক্ষিণ ভারতে থাকাকালীন কিছু বক্তৃতা দিয়ে থাকলে সুদূর বঙ্গদেশে বসে তার হদিশ পাওয়া যদুনাথের পক্ষে প্রায় অসম্ভবই ছিল।রাধাকৃষ্ণান যখন কলকাতায় আসেন তখন যদুনাথ ঢাকায়।সেখান থেকেও নিয়মিত কলকাতায় এসে রাধাকৃষ্ণানের বক্তৃতা শোনা তাঁর পক্ষে কতদূর সম্ভব ছিল সে নিয়ে সন্দেহ আছে।তারপরে তো তিনি মিরাটে চলেই যান।

কিন্তু এসবের থেকেও বড়ো কথা হল এই যে যদুনাথের মূল গবেষণাটির প্রথম দুটি খণ্ড যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে তখন রাধাকৃষ্ণান নিজেই তো ছিলেন সেগুলির অন্যতম পরীক্ষক।ওই দুটি খণ্ডের নির্যাসই তো যদুনাথ মিরাট কলেজের মুখপত্রে ছাপিয়েছিলেন।কাজেই ওই প্রবন্ধগুলি না পড়লেও মূল গবেষণাটি পড়বার সময় রাধাকৃষ্ণান কি দেখেননি যে যদুনাথ সিংহ তাঁর বক্তৃতা থেকে চুরি করে কিছু লিখেছেন।১৯২২ থেকে ১৯২৯ অবধি রাধাকৃষ্ণান চুপ করে বসে ছিলেন কেন?তিনি তো আগাগোড়া যদুনাথের পরীক্ষক ছিলেন।যদুনাথকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি তো দিয়েছিলই, তাছাড়াও ১৯২৩ সালে গ্রিফিথ পুরস্কার এবং ১৯২৫ সালে মোয়াট মেডেল পেয়েছিলেন যদুনাথ।১৯২৫ সালেই তাঁর আলোচ্য গবেষণাটি শেষ হয়।এত কাণ্ড হল স্রেফ চুরির উপর দাঁড়িয়ে আর রাধাকৃষ্ণান নীরব রইলেন,এটা বিশ্বাসযোগ্য?সেই সময় যদুনাথের তুলনায় তিনি অনেক বেশি খ্যাত্যাপন্ন ছিলেন।তিনি অভিযোগ তুললে তা গুরুত্বের সঙ্গেই বিচার করা হত।ওইসব সংক্রান্ত বক্তৃতা তিনি সত্যি কিছু দিয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র তাঁর কাছে নিশ্চয় ছিল।তো প্রমাণ হিসেবে তিনি সেগুলি দেখালেন না কেন?

আসলে রাধাকৃষ্ণান হয়তো ভেবেছিলেন যে এ দেশের আর পাঁচটা ভীরু ছাত্রের মতো এই যদুনাথও তাঁর খ্যাতি আর পদকে ভয় করে চুরি হজম করে যাবেন।কিন্তু তা যখন হল না,দেখা গেল পদবীর সিংহ আদপেই সিংহ,তখন আক্রোশ প্রকাশ করে কালি ছিটোনো ছাড়া রাধাকৃষ্ণান কীই বা করতেন?তিনি সম্ভবত গোটা ব্যাপারটা মর্ডার্ন রিভিয়্যুর পাতায় ফাঁস হওয়াতেই আরো ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন।এই কাগজটির প্রতি তাঁর প্রসন্নতা ছিলনা কারণ তাঁর বইয়ের অসংগতি নিয়ে এরাই প্রথম কথা তুলেছিল।ফলে রাধাকৃষ্ণান প্রচার করতে শুরু করেন যে তাঁকে অপদস্থ করবার একটা ষড়যন্ত্র হয়েছে যাতে যদুনাথের পাশাপাশি যুক্ত আছে মর্ডার্ন রিভিয়্যু পত্রিকাও।এই মর্ডার্ন রিভিয়্যু ছিল বাংলা প্রবাসী কাগজের সহোদর প্রকাশনা।দুটিই এলাহাবাদ থেকে বের হতো আর দুইয়েরই সম্পাদক ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়।রাধাকৃষ্ণানের এই ভিত্তিহীন ও আপত্তিজনক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রামানন্দ বিরাট এক সম্পাদকীয় লিখেছিলেন সেই সময়।রাধাকৃষ্ণান আত্মপক্ষ সমর্থনে যে কথাগুলি বলছিলেন সেগুলি যে নিতান্ত জোলো ছিল তা তিনি নিজেও বুঝতে পারছিলেন।যদুনাথের আক্রমণ রাধাকৃষ্ণান সামলাতে পারেননি।ফলে যদুনাথের চারটে চিঠির উত্তরে তিনি দুটি চিঠি লিখেই ক্ষান্ত হন।

কিন্তু যদুনাথ ছেড়ে দেওয়ার পাত্র তো ছিলেন না।১৯২৯ এর আগস্টে কলকাতার উচ্চ ন্যায়ালয়ে যদুনাথ স্বত্বাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নয়ে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন এবং ক্ষতিপূরণ বাবদ দাবী করেন কুড়ি হাজার টাকা।সেই সময়ের সংবাদপত্রে প্রকাশিত লেখা থেকে জানা যায় যে যদুনাথ সিংহ আদালতে দাবী করেছিলেন রাধাকৃষ্ণানের অভিযুক্ত বইগুলির সমস্ত অবিক্রিত কপি তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার।তিনি চেয়েছিলেন হয় চুরি করে লেখা অংশগুলি বাদ দিয়ে নতুন করে বই ছাপুন রাধাকৃষ্ণান অথবা ওই অংশগুলির জন্য তাঁকে উপযুক্ত স্বীকৃতি দিন এবং বই বিক্রি বাবদ প্রাপ্ত লভ্যাংশেরও ন্যায্য  ভাগ দিন।এই খবর সে সময় ছাপা হয়েছিল "বসুমতী","বঙ্গবাণী","দ্য পাইয়নিয়র","দ্য হিন্দুস্থান টাইমস","ইস্ট বেঙ্গল টাইমস","দ্য লিডার","দ্য লিবার্টি" প্রভৃতি নামী সব খবরের কাগজে।

সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের মতো প্রভাবশালী বিদ্বজ্জনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মতো মেরুদণ্ডের জোর ছিল যে যদুনাথ সিংহের তাঁর পরিচয় রাধাকৃষ্ণানের জন্মদিনে শিক্ষকদিবস পালন করা আজকের বাঙালি বিশেষ জানেনা।এখানে সে পরিচয় একটু দিই।
১৮৯২ সালে জন্মানো যদুনাথ সিংহ ছিলেন বিশিষ্ট বাঙালি ধর্মতাত্ত্বিক,সুলেখক ও দার্শনিক।বেদান্ত,যোগ,শক্তিসাধনা,বৈষ্ণব তত্ত্ব,নীতিশাস্ত্র,তর্কশাস্ত্র,মনস্তত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে চল্লিশটিরও বেশি বই এবং অসংখ্য নিবন্ধের রচয়িতা যদুনাথ সিংহের সারস্বত কৃত্যের গুরুত্ব পণ্ডিতসমাজ মাথা পেতেই নিয়েছিল।এ দেশে তো বটেই বিদেশের নানা জায়গা থেকেও তাঁর গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে,সমাদৃতও হয়েছে।কলকাতার রিপন কলেজ,সিটি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যদুনাথের প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষালাভ ঘটেছিল।দর্শনের ছাত্র হিসেবে তাঁর কেরিয়ার ছিল তাক লাগানো।রাধাকৃষ্ণানের মতো বাধ্যত দর্শন পড়েননি তিনি।১৯১৫ সালে ফিলিপ স্যাম্যুয়েল স্মিথ পুরস্কার এবং ক্লিন্ট স্মৃতি পুরস্কার পেয়ে তিনি দর্শনে স্নাতক হন।অতঃপর ১৯১৭ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিপ্রাপ্ত হওয়া।ততদিনে তাঁর বিদ্যাবত্তার খ্যাতি এতদূর ছড়িয়েছিল যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তরের ফল প্রকাশ করার আগেই তিনি রিপন কলেজে সহকারী অধ্যাপকের পদে যোগদানের আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন।পরে যদুনাথ সিংহ রাজশাহী সরকারি কলেজ এবং ঢাকা জগন্নাথ কলেজেও অধ্যাপনা করেছেন।সবশেষে মিরাটে বিভাগীয় প্রধানের পদ নিয়ে চলে যান এবং ১৯৫৩ অবধি ওখানেই ছিলেন।তিনি চাকরির মেয়াদ পুরো করেননি।অবসরের আগেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেন।নিজের জ্ঞানচর্চার জগতে সম্বৃত হয়ে গিয়েছিলেন।আর শেষজীবনে অধ্যাত্ম ছিল যদুনাথের অবলম্বন।১৯৭৮ সালে যদুনাথ সিংহের জীবনাবসান হয়েছিল।

যাই হোক,প্রসঙ্গে ফিরি।রাধাকৃষ্ণান হয়তো ভেবেছিলেন যে যদুনাথের চিঠির উত্তরে তিনি নীরব থাকলে ব্যাপারটা মিটে যাবে,চাপা পড়বে।কিন্তু সেটা হল না।যদুনাথ আদালতে গেলেন।ফলে আক্রমণ আত্মরক্ষার সর্বোত্তম উপায়----এই নীতি নিলেন রাধাকৃষ্ণান।যদুনাথ কর্তৃক মামলা দায়ের হওয়ার একমাসের মাথায় ১৯২৯ এর সেপ্টেম্বরের গোড়ায় ওই একই ন্যায়ালয়ে রাধাকৃষ্ণানও একটি পালটা মামলা ঠুকলেন এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবী করে।তিনি মানহানির অভিযোগ এনেছিলেন যদুনাথ সিংহের পাশাপাশি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও।সেই সময় এটি ছিল কলকাতার একটি অন্যতম "গরম খবর"।
      রাধাকৃষ্ণানের আচরণ নিয়ে এখানে একটু বলি বন্ধুরা।এক তো তিনি নিজের মৌলিক ভাবনা টুকে লেখা হয়েছে এমন এক গবেষণাপত্র পরীক্ষা করে গবেষককে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি প্রদান করে তারপরে আরো সাত বছর সন্দেহজনক ভাবে  নীরব ছিলেন।তারপরে যখন বিষয়টি সামনে এলো,তখনো তাঁরই কি উচিত ছিল না প্লেজিয়ারিজমের অভিযোগে যদুনাথের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়া?যখনও বা গেলেন,অভিযোগ করলেন মানহানির।কেন?প্লেজিয়ারিজম প্রমাণ করার অসুবিধা ছিল?যদুনাথ সিংহ যখন মর্ডার্ন রিভিয়্যুতে চার কিস্তি ধরে তাঁকে নিয়ে লিখেছিলেন,তখনই কি তাঁর যথেষ্ট মানহানি হয় নি?তাহলে এপ্রিলে যদুনাথের লেখা থামার পর সেপ্টেম্বর অবধি মানহানির মামলা না করে ছিলেন কেন রাধাকৃষ্ণান?যদুনাথের আদালতে যাওয়ার অপেক্ষায় কি ছিলেন তিনি?উত্তর সহজ।চোর নিজে যেচে থানার চৌকাঠ কবেই বা মাড়ায়?আর রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কেই বা মামলায় জড়ানো কেন?মর্ডার্ন রিভিয়্যুর উপর এত ক্রোধ কেন ছিল তাঁর?তিনি কি জানতেন না যে পত্রিকা যদুনাথের চিঠিগুলি ছেপেছে বটে,কিন্তু পত্রের বক্তব্যের দায় তো পত্রলেখকেরই।তাছাড়া মর্ডার্ন রিভিয়্যু তো রাধাকৃষ্ণানেরও দুটি চিঠি ছেপেছিল।আসলে এর কি কারণ কি এই যে মর্ডার্ন রিভিয়্যু ১৯২৭ সালে রাধাকৃষ্ণানের বই সম্বন্ধে "inadequate references" ছাড়াও "faulty English","ignorance of Bengali","lack of Sanskrit learning" ইত্যাদি বিষয়ে অভিযোগ হেনেছিল?রাধাকৃষ্ণান যতই সেসময় বলুন না কেন,"I respect the rights of reviewers to hold any opinion they please regarding works which are public property",আসলে তিনি তো রক্তমাংসেরই মানুষ।

          এত কাণ্ডের পরেও যদুনাথ সিংহ কিন্তু সুবিচার পাননি।কেন জানেন?কারণ দেশটা ভারতবর্ষ।সে সময় কলকাতার তাবৎ পণ্ডিতসমাজের চোখে আসল ঘটনা কী তা বুঝিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন যদুনাথ।এখানকার শিক্ষাজগতের প্রবীণ সদস্যেরা প্রায় সকলেই যদুনাথের অভিযোগের সত্যতা মেনে নিয়েছিলেন।অনেকেই সহানুভূতিশীলও ছিলেন প্রকৃত বিদ্বান এই মানুষটির প্রতি।কিন্তু সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের খ্যাতি-প্রতিপত্তি,সারস্বতসমাজ ও রাজনৈতিক মহলে তাঁর প্রতাপের কারণে এঁরা কেউ সেদিন রাজি হননি আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে।বরং রাধাকৃষ্ণানের অপ্রত্যক্ষ প্রভাবের কারণে যদুনাথ সিংহের উপর তখন নানাভাবে চাপ তৈরি করা হয়েছিল আদালতকক্ষের বাইরে বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার জন্য।এমনকি যদুনাথের গবেষণাপত্রের অন্যতম পরীক্ষক ব্রজেন শীল মশাইও "বিশেষ অনুরোধ" করেছিলেন যাতে তাঁকে এই মামলায় সাক্ষ্য দিতে না ডাকা হয়।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকাও ছিল সেই সময় আশ্চর্যজনক।তাঁদেরই এক অধ্যাপকের সঙ্গে তাঁদেরই এক গবেষকের মামলা চলছে তাঁদেরই শিলমোহর পাওয়া গবেষণা নিয়ে,অথচ তাঁরা একটি শব্দও প্রকাশ্যে এ নিয়ে খরচ করেননি তখন।

ঘরে বাইরে নানা চাপ সত্ত্বেও যদুনাথ সিংহ মামলা হয়তো তুলতেন না যদি তাঁর আর্থিক টানাপোড়েন না তৈরি হতো।১৯২৯ এর আগস্টে শুরু হয়ে মামলা চলেছিল ১৯৩৩ এর মে মাসে।মামলার বিপুল খরচ টানা তাঁর পক্ষে অসুবিধাজনক হয়ে উঠছিল।রাধাকৃষ্ণান সেই সময় মাসিক এক হাজার টাকা বেতন পেতেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।তাঁর পক্ষে আর্থিক টান খুব বেশি ছিল না।তাঁর স্বজন বন্ধুর অভাব যেমন ছিল না তেমনি ছিল চাতুর্য।তিনি আদালতে যদুনাথের বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণ করতে পারেননি কিন্তু মামলাটিকে জটিল করে দিয়ে দীর্ঘ আয়ু দিয়েছিলেন।তবে শেষ অবধি মামলাটি চলতে দিলে কী হত বলা যায় না।কিন্তু বিষয়টির মধ্যে সহসাই নাক গলালেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।ইনি ছিলেন রাধাকৃষ্ণানের বিশেষ বন্ধু এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য।সরকারিভাবে নয় অবশ্য,শ্যামাপ্রসাদ ব্যক্তিগতভাবেই এর মধ্যে ঢুকেছিলেন তখন।আসলে ১৯২১ সালে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল উপাচার্য হয়ে মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ই রাধাকৃষ্ণানকে পঞ্চম জর্জ অধ্যাপক পদে এখানে নিয়ে আসেন।ফলে আশুতোষপুত্র শ্যামাপ্রসাদও যে রাধাকৃষ্ণানের হয়েই কাজ করবেন এটাই হয়তো স্বাভাবিক ছিল।মূলত এঁর হস্তক্ষেপেই যদুনাথ পিছু হটতে বাধ্য হন।দুটি মামলারই রফা-নিষ্পত্তি হয় আদালতের বাইরে।১৯৩৩ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে অ্যাক্টিং চিফ জাস্টিস ফণীভূষণ চক্রবর্তীর সামনে একটি ডিক্রির মধ্যে দিয়ে দুটি মামলা মিটিয়ে দেওয়া হয়।ডিক্রির শর্তগুলি কিন্তু আজও কেউ জানে না।

এখানে একটা কথা মনে আসা স্বাভাবিক,যদি বাস্তবিক যদুনাথ দোষী ও মিথ্যাভাষী ছিলেন আর রাধাকৃষ্ণান ছিলেন নিরাপরাধ,তাহলে রাধাকৃষ্ণানের তরফে কেন বারেবারে চাপ দিয়ে আপোষে মামলা মেটানো হল?রাধাকৃষ্ণান কেন আদালতের কাঠগড়ায় যদুনাথের মুখোশ খুলে দিলেন না?রাধাকৃষ্ণানের পক্ষে যে তিনজন খ্যাতকীর্তি পণ্ডিত সেই সময় আদালতে বক্তব্য রেখেছিলেন সেই নলিনী গঙ্গোপাধ্যায়,কুপ্পুস্বামী শাস্ত্রী এবং গঙ্গানাথ ঝা,এঁরা প্রত্যেকেই ওই রাধাকৃষ্ণানের ক্লাসে পড়ানোর তত্ত্বটাই তখন আওড়েছিলেন।ওঁদের বক্তব্য ছিল যদুনাথ নিশ্চয় রাধাকৃষ্ণানের ছাত্রদের কাছ থেকে ক্লাসনোটস হাতিয়ে নিজের লেখাটি তৈরি করেছিলেন।কেউ কেউ এমনকি স্বয়ং রাধাকৃষ্ণানও বলেছিলেন যে উভয়ের লেখায় সাদৃশ্যের অংশটুকু চুরি হতেই পারে না কারণ ওগুলো হল কিছু মূল সংস্কৃত রচনার সারানুবাদ।সারানুবাদে তো মিল থাকতেই পারে।কিন্তু খেয়াল করুন আপনারা,মিল যদি শুধু সারানুবাদই হবে তাহলে আবার যদুনাথের বিরুদ্ধে উলটো প্লেজিয়ারিজমের অভিযোগ তো আসতে পারে না।আরো খেয়াল করুন,গঙ্গানাথ ঝা,যাঁর লেখা থেকেও যদুনাথ টুকেছিলেন বলে রাধাকৃষ্ণান ১৯২৯ সালে অভিযোগ করেছিলেন(মূল গবেষণাটি পরীক্ষা করার সময় এই চুরিটাও রাধাকৃষ্ণান দেখেননি বোধহয়।আসলে তখন দেখার দরকারই তো ছিল না।),সেই গঙ্গানাথও আদালতে যদুনাথের বিরুদ্ধে যখন সাক্ষী দিতে এলেন একবারের জন্যও বললেন না তিনি নিজেও যদুনাথের চুরির শিকার!!কিমাশ্চর্যম!!

"ইন্ডিয়ান ফিলজফি" হল রাধাকৃষ্ণানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ।এই বইটির পরিপ্রেক্ষিতেই একের পর এক বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানপীঠগুলির দরজা রাধাকৃষ্ণানের কাছে খুলে গিয়েছিল।অজস্র সাম্মানিক ডক্টরেট,বক্তৃতার সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন রাধাকৃষ্ণান।বৃটিশ রাজদরবার তাঁকে নাইটহুড সম্মানেও অলংকৃত করেছিল সেই সময়।সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের প্রতিপত্তি কতটা ছিল সেই সময় তা বুঝতে পারি যখন দেখি ১৯৩১ সালে প্লেজিয়ারিজমের মতো অভিযোগে মামলা চলাকালীন তিনি অক্লেশে অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে চলে গিয়েছিলেন।১৯৩৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যদুনাথ সিংহকে পিএইচ.ডি. উপাধি প্রদান করে।ভাগ্যিস,তখন রাধাকৃষ্ণান তাঁর পরীক্ষক আর ছিলেন না।এই উপাধি কি তখন মামলা তুলে নেওয়ায় সান্ত্বনা পুরস্কার গোছের কিছু ছিল?কে জানে।

আমরা বুনো রামনাথের দেশের মানুষ।গৌতম বুদ্ধের মতো সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক বিশ্বকে উপহার দিয়েছে আমাদের দেশ।এ দেশের মাটিতেই জন্মেছেন অতীশ দীপঙ্করের মতো আচার্য।এ দেশে জন্মানো বিশ্ববরেণ্য মহাকবি দেশের জন্য তাঁর শিক্ষাচিন্তার ফসল হাতেকলমে তৈরি করে দেখিয়েছেন যা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে দেখা যায় না।আমাদের কি শিক্ষক দিবস পালনের জন্য তারিখের এতই দৈন্য ছিল?রাধাকৃষ্ণান নিজের জন্মদিনকে "শিক্ষক দিবস" করে দিয়ে একে যে অমরতা দিয়েছিলেন তা কি নিজেকে সর্বকালের আদর্শ শিক্ষক ভেবে নিয়ে?তাই বা কে জানে।বড়ো বিচিত্র এ আত্মশ্লাঘা।তবে আজ যখন চারপাশে তাকিয়ে দেখি কোনো সর্বজনশ্রদ্ধেয় আচার্য ভুয়ো পিএইচ.ডি. দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আসনে বসেন অথবা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্বজনপোষণের অভিযোগে কিংবা আর্থিক কেলেংকারির দায়ে জেলযাত্রা করেন,কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর কোনো অধ্যপককে বিবৃতি দিয়ে প্লেজিয়ারিস্ট ঘোষণা করার পরেও তিনি বুক ফুলিয়ে মুখে রং মেখে সং সেজে হাততালি কুড়োন অথবা ভিনদেশি লেখকের গবেষণা থেকে টুকে বই লিখে ধরা পড়া কোনো অ্যাকাডেমিশিয়ান যুগের হাওয়ায় হয়ে বসেন কোনো গবেষণাপ্রকল্পের নিয়ামক,তত্ত্বাবধায়ক তখন মনে হয় ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস হওয়াটাই এ দেশের নিয়তি।এর চেয়ে বড়ো আয়রনি আর কী হতে পারে?

আমি যাঁদের আমার আচার্য বলে শিক্ষক বলে আক্ষরিক অর্থেই মনে করি,শ্রদ্ধা করি,তাঁদের কাউকেই আমি এই দিনে আলাদা করে কোনো সম্ভাষণ বা প্রণাম জানাই না।শিক্ষক হিসেবে নিজেরও এই দিনে কোনো সম্ভাষণ পেতে কেমন ক্লিন্ন লাগে।আপনারা কী ভাবছেন?

এই গোটা লেখাটির তথ্যসূত্রঃ
★Dr. Sarvepalli Radhakrishnan: The teacher who stole from his student's thesis--Utpal Aich 
★The Strange Meaning of Teachers' Day in India----Ratnesh Katulkar
★Jadunath Sinha---Internet archive
 ★'Subcontinental plagiarism' ---Idrees Bakhtiar
★A reported case of Radhakrishnan's literary piracy---Bārīna De
★Radhakrishnan: His Life and Ideas----
K. Satchidananda Murty, Ashok Vohra
★Radhakrishnan: A Religious Biography---Robert Neil Mino

বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

বউবাজারে মেট্রোর দুর্ঘটনা ~ দীপঙ্কর সিংহ

কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন মুখ্যস্থপতি ও নগরপরিকল্পক এবং আর্কিটেক্ট দীপঙ্কর সিংহ লিখছেন বউবাজারে মেট্রোর দুর্ঘটনা নিয়ে:

"কলকাতায় প্রথম মেট্রো রেল তৈরির সময় ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশী হয়েছিল। জনজীবন অনেক বেশী বিপর্যস্ত হয়েছিল। একটা বড় প্রজেক্টে কিছু ঘটনা ঘটতেই পারে। অবশ্যই আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল মেট্রো কতৃপক্ষের। কিন্তু এটাও মনে রাখতে মূল পরিকল্পিত পথের পরিবর্তন করতে মেট্রোকে বাধ্য করা হয়েছিল। যেখানে শিয়ালদহ থেকে বউবাজার স্ট্রিট ধরে মেট্রো সরাসরি মহাকরণ পৌঁছে যেতো, তাকে রাজনৈতিক প্রতিরোধ করে ঘুরপথে যেতে বাধ্য করা হয়। এর ফলে দুটি বিপদজনক বাঁক নিতে বাধ্য হচ্ছে ঐ বউবাজার এলাকায়। এর ফলে নির্মাণ অনেক কঠিন হয়ে যায়। আজ যদি এই বিপর্যয়ের জন্য ঐ পরিবর্তনকে কেউ দায়ী করে, খুব কি ভুল হবে? মনে রাখতেই হবে যে ঐ অঞ্চলের ভূমির বিভিন্ন স্তরের চরিত্র যথেষ্ট জটিল। প্রাচীন কলকাতার প্রান্তিক অঞ্চলের দুটি খালের (মারহাট্টা ডিচ ও ক্রীক রো বরাবর খাল) সংযোগস্থল এই অঞ্চল।  কলকাতার উপকণ্ঠের বাজার ঘিরে বিভিন্ন পেশার দরিদ্র মানুষের বাস ছিল অনেক বেশী। শাঁখারিটোলা, স্বর্ণকারপট্টি ইত্যাদি নাম থেকেই এটা বোঝা যায়। এদের বাড়িগুলির নির্মাণ যথেষ্ট ভাল নয়। বাড়ির নীচের মাটি ভালো নয়। সব মিলিয়ে এই বউবাজার অঞ্চলে মেট্রোর টানেল নির্মাণ বেশ ঝুঁকির। তার মধ্যে অমন বাঁক নিয়ে টানেল করা আরও কঠিন। টানেলের নির্মাণের যন্ত্রের কম্পনে যদি উপরের মাটি জলে মিশে আঁটসাঁট ভাব চুকে গিয়ে থকথকে হয়ে যায় ও আর ভার নিতে পারেনা (known as a phenomenon of liquefaction. This area is known for poor soil)।এক্ষেত্রেও তাইই হয়েছে। নির্মাণ কাজে ঝুঁকি থাকে। এই ক্ষেত্রে একটা ব্যর্থতা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও সাবধান হতে হবে। বিশেষ করে সামনে আরও জটিল এলাকা। তবে এই বিপর্যয় থেকে কাউকে দায়ী করতে হয়, তবে মেট্রো কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারেনা। কিন্তু যারা মেট্রোকে এই দুরূহ বাঁক নিতে যারা বাধ্য করেছে, মানুষের বাড়ির নীচ দিয়ে যেতে বাধ্য করেছে, তারাও দায় এড়াতে পারেনা।"

মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

বাকি রাখা খাজনা ~ মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায়

এই মুহূর্তে ভারতের জনসংখ্যা ১৩৩.৯ কোটি। গতবছর এই জনসংখ্যার কত শতাংশ ব্যক্তিগত আয়কর দিয়েছেন? গত বছর সর্বমোট ৬.৮৭ কোটি মানুষ ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টে তাদের আয়কর ফর্ম  জমা দিয়েছেন। 
অর্থাৎ এইমুহূর্তে  দেশের ৫% মানুষ আয়কর ফর্ম জমা দিয়েছেন। 
বিগত দিনের তুলনায় এই সংখ্যা নাকি এক বিরাট উল্লম্ফন। 

একবার বুঝুন অবস্থাটা।

এদের মধ্যে আবার দুই কোটি মানুষ এই আয়কর জমা দেন শূন্য কর সহ। অর্থাৎ ওদের আয় নিম্নতম সীমারেখার নিচে।

চারিদিকে তাকিয়ে দেখুন, বড় বড় শহর দেখুন, রিসর্ট দেখুন, খুচরা কারবারি দেখুন, হোলসেল ডিলার দেখুন, রিয়্যাল এস্টেট, ফ্যাশন ডিসাইনার, পাড়ায় পাড়ায় খাবার দোকান দেখুন, খেলার মাঠের ফাটকা দেখুন, চারিদিকে সাট্টা, তোলা, কাটমানি দেখুন। জাল জুয়েলারির ব্যবসা দেখুন।

এদেশে চাষিরা আয়কর দেন না, সেই সুবাদে যারা ধনী কৃষক, পঞ্জাব, হরিয়ানার অতি সমৃদ্ধ কৃষক, তারাও আয়কর দেন না। তারা আমার আপনার মত পঞ্চাশ জনকে কিনে বেঁচে দিতে পারে।

তারপরে বিশ্বাস করতে পারেন দেশে প্রকৃত পক্ষে  ৩.৪% করযোগ্য মানুষ বাস করেন! 

মাত্র ৪.৬৭ কোটি মানুষ?

তবে এই কথা গুলি কেন তুলছি? কারণ আছে। 

এদেশে হিসাবের অনেক কারিকুরি সহ ৩৪% মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করেন। 
দরিদ্র্য মানুষের আসল সংখ্যা আরো অনেক বেশি।

যদি সরাসরি আয়কর দেওয়া না হয়, তাহলে পিছন দিয়ে প্রতিটি প্রয়োজনীয় ও বিলাস  দ্রব্যের উপরে অধিক পরিমানে কর লাগবে। GST ইত্যাদি কর বেড়ে যায়।
কারণ দেশের সরকারকে কর তুলতে হবে। 

অর্থাৎ এই যে বিরাট অংশের মানুষ যারা কর দিতে পারেন কিন্তু দেন না, তাদের বোঝা চাপে দেশের দরিদ্রতম মানুষের উপরে। 

স্কুল গুলিতে শিশুরা নুন ভাত, নুন রুটি খায়। ওদের একটু ডিম দিতেও নাকি পয়সা থাকে না। কিন্তু রাজসিক পূজায় যারা বেহেড খরচ করছেন, তাতে কর দেবার কথা বললেই ধর্ম নিপাত যায়। এমনকি ওই পূজায় যারা তাঁবু  দিয়ে, আলো দিয়ে সাজায় তাদের বকেয়া কর দেবার কথা বললেও হুমকি ওঠে।

 লজ্জা করে।

লজ্জা করে যখন গ্যাসের ভর্তুকি নিয়ে গলা ফাটাই, আর পৃথিবীর অধিকাংশ স্কুল ছুট ছাত্র থাকে এই দেশে। নিশ্চুপ থাকি যখন শিশু  কিশোররা পড়া ছেড়ে শহরে, গ্রামে খুচরা কাজ করে।

একটা উদাহরণ দেই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি পশ্চিম বঙ্গের বিপ্লবের পীঠস্থান। এই কলেজ গুলির ক্যান্টিনে দেখবেন শিশু, কিশোররা ফাইফরমাশ খেটে  খেটে হাতে হাজা ধরিয়ে দেয় ।

আর ছাত্ররা, যারা টুয়েলভ পর্যন্ত বছরে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ঢুকবার জন্য, ও পরে বছরে লক্ষ লক্ষ, কেউ কেউ কোটি টাকা পাবে পাশটি করে বেরোলেই, তারা পড়ার খরচ বাবদ বছরে কয়েক হাজার টাকাও দেবে না।

আয়কর না দেবার মূল যুক্তি, এদেশে সামাজিক নিরাপত্তা নেই - কেন দেব আয়কর? 

আমার প্রশ্ন, কেন দেশের তথা পৃথিবীর দরিদ্রতম মানুষ দেবেন পরোক্ষ কর? কেন পৃথিবীর সংখ্যাগুরু স্কুল ছুট  ছাত্র থাকবে এই দেশে?

একটু ভাববেন।

সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

অসম - কী ভাবছেন? এনআরসি, অবশ্যই - আর ডাঃ দেবেন দত্তের কথা? ~ বিষাণ বসু

অসম - কী ভাবছেন?
এনআরসি, অবশ্যই - আর ডাঃ দেবেন দত্তের কথা?

খবরটা সবাই জানেন। ঊনিশ লক্ষ, হ্যাঁ, ১৯,০০,০০০ মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে গেলেন। অসমে। সব কাগজের প্রথম পাতায় পড়া গিয়েছে এই খবর - ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও সারাদিন ধরে দেখানো হয়েছে। এই রাজ্যেও এনআরসি করলে কেমন হয়, কথা হচ্ছে সেই নিয়েও। আপনি কি চিন্তিত? ভাবছেন?

একই সময়ে অসমেরই এক চা-বাগানে চিকিৎসা করছিলেন এক ডাক্তার। বয়স পঁচাত্তর। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন আগেই - কিন্তু, চা-বাগানে ডাক্তার পাওয়া যায় না। তাই, সেই চিকিৎসক, ডাঃ দেবেন দত্ত, দায়বদ্ধতার কারণেই, রয়ে গিয়েছেন - চা-বাগানের মজুর-কামিন-শিশুগুলোর চিকিৎসা করতে।

না, রয়ে গিয়েছেন নয় - রয়ে গিয়েছিলেন। ডাঃ দেবেন দত্ত আর নেই।

পরশু বিকেলে কোনো রোগী মারা গিয়েছেন বলে তাঁর ডাক পড়ে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছালে, তিনি ক্ষুব্ধ, উন্মত্ত পরিজনের সামনে পড়ে যান। ঘিরে ধরে কয়েকশো মানুষ। হ্যাঁ, পোষাক পরে দুপায়ের উপর তো অন্য প্রজাতি দাঁড়ায় না সচরাচর। প্লাস, মুখে খিস্তি আর হাতে ধারালো অস্ত্র নিয়েও সাধারণত মনুষ্যেতর প্রাণীরা সঙ্ঘবদ্ধ হয় না। কাজেই, সেই "মানুষেরা" ঝাঁপিয়ে পড়ে ডাঃ দেবেন দত্তের ওপরে।

পুলিশ ছিল - থুড়ি, ছিলেন। তাঁরা পরিস্থিতির উপর কড়া নজর রাখছিলেন। দেবেনবাবুকে বাঁচানোর কথা সেভাবে মাথায় ছিল না।

আক্রান্ত, রক্তাক্ত দেবেনবাবু পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একটি কোণায় - সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যেখানে তাঁরই হাতে শুশ্রূষা পেয়েছেন নাম-না-জানা কতজন - জন্ম নিয়েছে কত শিশু - তাদের কেউ কেউ ওই উন্মত্ত মানুষগুলোর মধ্যে ছিলেন কি? দেবেনবাবু অত ভাবছিলেন না, সম্ভবত - তিনি রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে চাইছিলেন - তিনি রক্ত দেখে ঘাবড়ান না, শুধু জানেন, রক্ত বন্ধ না হলে কী হতে পারে।

না,,স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনো গোপন কুঠুরি ছিল না। জনতা দেবেনবাবুর খোঁজ পেয়েই যায়। বন্ধ দরজার ওপার থেকে ভেসে আসতে থাকে খিস্তি-হুমকি - কাচের জানলা ভেঙে যায় এলোপাথাড়ি ইঁটে - দেবেনবাবুর শরীরে বিঁধে যায় কাচ - রক্তক্ষরণ বাড়তেই থাকে। দেবেনবাবু ডাক্তার - তিনি রক্ত দেখে ঘাবড়ান না - তিনি শুধু জানেন, ঠিক কতক্ষণ রক্তপাত চললে - তিনি ঘড়ি দেখেন।

উন্মত্ত মানুষগুলোকে থামানোর চেষ্টা হয়নি এমন নয় - পুলিশ বাদ দিয়েও তো বাকি অনেকেই ছিলেন - থামানো যায় নি - আর জোর খাটানোর ক্ষমতা তাঁদের ছিল না - জোর খাটাতে পারতেন যাঁরা, তাঁরা তখনও পরিস্থিতির উপর কড়া নজর রাখছেন। জনতা জানান, দেবেনবাবুকে একেবারে শেষ করতে পারলেই তাঁরা থেমে যাবেন।

অনেক, অনেকক্ষণ পরে ম্যাজিস্ট্রেট আসেন - সাথে বিশেষ বাহিনী। দেবেনবাবুর ঘড়ি ততক্ষণে ভেঙেচুরে গিয়েছে সম্ভবত - চালু থাকলেও তিনি আর দেখছিলেন না। অচৈতন্য ডাঃ দেবেন দত্তকে নিয়ে যাওয়া হয় জোড়হাট মেডিকেল কলেজে। দেবেনবাবুর অত ধৈর্য ছিল না আর - তিনি, অনেকক্ষণই, চিকিৎসার উর্দ্ধে।

আপনি কি চিন্তিত? ভাবছেন কিছু?

ভাববেন না? দরকার নেই কোনো? সত্যি, ঊনিশ লাখের পাশে এক - হাস্যকর। কিন্তু, সেই এক যখন চিকিৎসক - তখন আক্রান্তের সংখ্যা কত?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেন, হাজার নাগরিকপিছু কমপক্ষে একজন ডাক্তার থাকা জরুরী। দেশে এই অনুপাত ঠিক কত, সেই নিয়ে চাপানউতোর প্রচুর। তবে, কেউই অস্বীকার করেন না, যে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডাক্তার পাওয়া কঠিন। প্রান্তিক অঞ্চলে ডাক্তারের অনুপাত - সম্ভবত ওই কুড়ি হাজারে এক। চা-বাগানে, পরিস্থিতি আরো খারাপ। সেই এক যদি নিহত হন - আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় কুড়ি হাজার এক। এই আতঙ্কে পাশের বাগান থেকেও ডাক্তার চলে গেলে - আক্রান্ত, চল্লিশ হাজার এক। সংখ্যাটা বাড়তে থাকে, বাড়তেই থাকে।

এনআরসি নিয়ে ভাবা জরুরী - ঊনিশ লক্ষ মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে যাচ্ছেন, সেই নিয়ে ভাববেন না!!

কিন্তু, ডাঃ দেবেন দত্তকে নিয়েও ভাবুন। না হয় দেবেনবাবুর কথা না-ই ভাবলেন - অন্তত ওই কুড়ি কি চল্লিশ কি ষাট কি আশি হাজার মানুষের কথা ভাবুন। এঁদের চিকিৎসাহীন হয়ে পড়ার কথা ভাবুন।

চা-বাগান কর্তৃপক্ষ নোটিশ জারি করেছেন - এই ঘটনার প্রেক্ষিতে, অনির্দিষ্টকালের জন্যে বাগান লক-আউট। নোটিশে অবশ্য উল্লেখ, কর্মীদের, তাঁদের পরিবারের জন্যে স্বাস্থ্যপরিষেবা চালু থাকবে। বিশ্বাস করুন, এতকিছুর পরে বড্ডো হাসি পেয়ে গেল। ওই স্বাস্থ্যপরিষেবা চালু থাকার কথাটুকু পড়ে। মৃত্যুর ওপারে জীবন আছে কিনা জানা নেই - কিন্তু, সেইখানে কলবুক পৌঁছায় না নিশ্চিত - স্যার, হাসপাতালে ইমার্জেন্সি পেশেন্ট এসেছে, খারাপ কন্ডিশনে লেবার পেশেন্ট স্যার, ডাঃ দত্ত তো ফোনই তুলছেন না।