শনিবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৩

লেনিন কে আমি দেখেছি ~ অর্ক ভাদুড়ী

ভ্লাদিমির লেনিনকে আমি সেই ছোট্টবেলা থেকে চিনি। শৈশবের একটা বড় অংশ যে বাড়িতে কেটেছে, সেখানে লেনিনের ছবি ছিল। বড় হয়ে জেনেছি, ওই ছবিটি যাঁর আঁকা, তাঁর নামও ভ্লাদিমির। ভ্লাদিমির আলেজান্দ্রোভিচ সেরভ। তেলরঙে আঁকা ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে তিনজন কৃষক লেনিনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তাঁদের দু'জনের এঙ্গেলসের মতো দাড়ি, অন্যজনের ঝুপো গোঁফ। তিনজনের গায়েই পশমের মোটা কোট। একজন দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তাঁর ডান হাত চেয়ারের উপর রাখা। ছোট্ট গোলাকৃতি টেবিল ঘিরে বসে তাঁরা লেনিনের সঙ্গে কথা বলছেন। মাটিতে ঘুমন্ত শুয়োরের মতো একটি পুঁটুলি। লেনিনের হাতে একটি কলম। টেবিলে কনুই রেখে কৃষক প্রতিনিধিদের কথা শুনছেন তিনি।

বহুদিন পর্যন্ত আমি ভাবতাম, যিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তিনিই বোধহয় লেনিন। সেই ধারণা যিনি ভাঙান, তাঁকে আমি বাসস্ট্যান্ড, কারখানার গেট, রাস্তার মোড়, রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের আশেপাশে বক্তৃতা করতে শুনতাম। একটি মাইক, সেটির গায়ে সরু-লম্বা ব্যানার, পিছনে বড় লাল শালু। রেল স্টেশনের পাশে বক্তৃতা হলে মাঝেমধ্যেই ছন্দ কাটত, ট্রেনের ঘোষণার সময় থামতে হত বারবার। খর্বকায় মানুষটি চিৎকার করে বলতেন। তাঁকে ঘিরে ভিড় জমে যেত। সন্ধের শুরুতে অনেকসময় রাস্তার হলুদ আলো জ্বলত না, দেরি হত। আবছায়া। আশেপাশের দোকান, বাড়ি, গ্যারাজ থেকে আসা ভাঙাচোরা আলোয় অপার্থিব মনে হত সেই ভিড়কে। স্ট্রিট কর্নার অনেকটা জীবনের মতো— মানুষ আসেন, দাঁড়ান, চলে যান। আবার নতুন কেউ এসে দাঁড়িয়ে পড়েন খানিকক্ষণ।

এরপর আমি লেনিনকে দেখেছিলাম দু'টি পার্টি অফিসে। একটি অভিজাত, অন্যটি সাদামাটা। একটির পিছনে লাইব্রেরি, ছোট্ট মাঠ। ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। মাঝেমধ্যে পার্টি অফিসের ভিতরে বল ঢুকে গেলে লেনিনের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত আমার। ভালো লাগত না। দেখতাম, কেমন রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে রয়েছে লোকটি। আশেপাশে আরও অনেক গোমড়ামুখো লোক, কেউ চেয়ারে বসে রয়েছেন, কেউ দেওয়ালে ঝুলছেন। থমথমে। অন্য অফিসটি ছিল রেললাইনের ধারে। টালির বাড়ি, বর্ষা হলে জল পড়ত। দেওয়ালে ছিল আকাশি রঙের চুনরং। একফালি ঘেরা জায়গায় বাঁশ পোঁতা। বাঁশের মাথায় লাল পতাকা। অধিকাংশ সময়েই বিবর্ণ, জ্যালজ্যালে। ওই চত্বরের হাওয়ায় তখন কয়লার গুঁড়ো উড়ত। চোখে ঢুকলে জ্বালা করত খুব। তারপর কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। কয়েককটা সুইসাইড। কিন্তু দূষণ কমল।

জুটমিলের বস্তিতেও আমি লেনিনকে দেখেছি। আমার বন্ধু মল্লেশ্বরের বাবা বলতেন— লেনিনোয়া। বড় হয়ে শুনেছি ভ্লাদিমিরকে আদর করে 'ভলোদিয়া' বলতেন কেউ কেউ। লেনিনোয়া। ভলোদিয়া। শব্দে শব্দে মিলে যায়।

এরপর আমি লেনিনকে দেখি একটি ছোটপত্রিকার ঘরে। সেখানে তিরিশ-চল্লিশ বছরের পুরনো 'সেভিয়েত দেশ' ডাঁই করে রাখা থাকত। ওই ঘরে যাঁরা আসতেন, তাঁরা প্রত্যেকেই চমৎকার লিখতেন। গল্প করতেন অনেক। এখান থেকে আমি একটা ছোট্ট লাল ব্যাজ পকেটস্থ করি, তাতে লেনিনের ছবি ছিল। পরে জেনেছি, ওটা সোভিয়েতের জিনিস। পত্রিকার সম্পাদকের জেঠু একবার গিয়েছিলেন সেখানে। নিয়ে এসেছিলেন।

 আরেকটু বড় হয়ে লেনিনের সঙ্গে আমার দেখা হল মধ্য কলকাতার এক পুরনো বাড়ির চিলেকোঠায়। ধর্মতলার মোড়ে পুলিশ যখন লাঠিচার্জ শুরু করে, পিছু হটতে থাকা মিছিল তখন দমকা হাওয়ায় উড়তে থাকা পলিথিন বা কাগজের টুকরোর মতো ছড়িয়ে যায়। মনে হয়, অসংখ্য পলাশ-পাপড়ি উড়ছে, দুলছে, টাল খাচ্ছে হাওয়ায়। লাঠির বাড়ি থেকে বাঁচতে মানুষ লেনিন সরণি, এস এন ব্যানার্জি রোডের দু'ধারের দোকানের ভিতরে ঢুকে পড়ে। ঢুকে পড়ে মেট্রো গলিতে। বয়ে যায় তালতলার দিকে বা নিউ মার্কেটের চারপাশের ছোট ছোট নদীর মতো রাস্তায়, মসজিদের আনাচে কানাচে। শাটার নামিয়ে দেওয়া হয়। বন্ধ শাটারের নীচে রক্ত চলকে ওঠে কারও।

ওই বাড়ির চিলেকোঠা থেকে সবটুকুই দেখা যেত। লেনিনের ঠিক নিচেই একটা জানলা। ছিটকিনি নেই। বৃষ্টি শুরু হলে মেঝেতে পাতা বিছানা-বালিশ, বইপত্তর, পোস্টারের কাগজ, লাল শালু ভিজত। ওই ঘরেই নিজেদের নিবিড় চিনে নিত বন্ধুরা। যৌবনের রুমালে লেনিনকে আগলে রাখত তারা। আগলে রাখত, এমনকি, লেনিনিস্ট মডেলের থেকেও।

এরপরও আমার সঙ্গে লেনিনের দেখা হয়েছে বহুবার। কখনও ইডেনের পাশ দিয়ে হাঁটছেন, বাঁহাতে ফোলিও ব্যাগ। কখনও রবিবারের বিকেলে শহীদ মিনারের নিচে, একমনে দেখছেন দড়ির উপর হাঁটতে থাকা কিশোরকে। কখনও মধ্যরাত্রের রিপন স্ট্রিটে, কখনও ভবানীপুরের পুরনো গলিতে, ঢাকা, মিউনিখ, কাঠমাণ্ডু বা ভিয়েনার রাস্তায়। আমি প্রথমে দেখতে পাই লেনিনকে, তারপর দেখি তাঁর দীর্ঘ ছায়া, লেনিনিস্ট মডেলের শরীর।

একটা ভাতের হোটেল অথবা পেচ্ছাবখানা খোঁজার সময়, প্রিয় গানের ভুলে যাওয়া লিরিকের পিছনে ছুটতে গিয়ে, মাথার মধ্যে জেঁকে বসা কোনও নাছোড় পোস্টারের সঙ্গে বোঝাপড়ার ফাঁকে—  লেনিনের সঙ্গে আমার মাঝেমধ্যেই দেখা হয়ে যায়।

(পুরনো লেখা। খানিক বদলে নতুন করে পোস্ট করতে ইচ্ছে হল।)

শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৩

চিরকুটে চাকরী ~ শঙ্কর মণ্ডল

কদিন থেকে শুনছি কথা
                             লাগছে কানে বিদঘুটে,
'বাম আমলে সবাই নাকি
                            চাকরী পেত চিরকুটে।'
ব্রাত্যবাবু মন্ত্রী এখন
                           শুনছি ভালো নাট্যকার,
চিরকুটটা কোথায় পেলেন
                            বলুন দেখি, সাধ্যকার!
শেক্সপিয়ার আর শেলী কিটসের
                           কথায় কথায় কোটেশন,
কোন চিরকুটে চাকরী পেলেন
                             বলুনতো দেবনারায়ণ ?
টিভিতে খুব কথা বলেন
                           ভাবেন ভারী ওজনদার,
চিরকুটটা খুঁজে পেলে
                           চাকরী যাবে বিজনদার ?
কোন চিরকুট কে দিয়েছে
                               বিমল শঙ্কর নন্দকে ?
এরা সবাই ভালো মানুষ
                              তাহলে আর মন্দ কে ?

পয়সা নিয়ে চাকরী বেঁচে
                                 এসব বলার অর্থ কি ?
চিরকুটটা খুঁজে পেলে
                                মুক্তি পাবেন পার্থ কি ?
সপরিবার মানিক আছেন
                             আছেন শান্তি, সুবীরেশ,
জেলখানাতে সবার সাথে
                               দিনরাত্রি কাটছে বেশ।

বাম আমলে চাকরী যাঁদের
                                তাঁদের বড় অহংকার,
বুক চিতিয়ে বলেন তাঁরা
                              'চাকরী খাবে সাধ্যকার ?'

ব্রাত্য, বিজন, দেবনারায়ণ
                                  শুনুন কথা তিতকুটে,
সেই আমলে চাকরী পেলেন
                            আপনারা কোন চিরকুটে ?

                           শঙ্কর মণ্ডল
                        ২৬/০৩/২০২৩

মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৩

সুবোধ রায় ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

চট্টগ্রামের নোয়াপাড়ার কিশোর সুবোধ বরাবরই সূর্য সেনের ভক্ত ছিল। নিজে ভাল ছাত্র। ব্যারিস্টার বাবা স্বপ্ন দেখতেন, ছেলেকে অক্সফোর্ডে পড়াবেন। কিন্তু সুবোধ জড়িয়ে পড়লেন আন্দোলনে। মাত্র চোদ্দো বছরের আদরের মাসতুতো ভাইটিকে কল্পনা দত্ত মাস্টারদার কাছে হাজির করিয়েছিলেন। কিশোরটি মুহূর্তের মধ্যে উৎসর্গীকৃত বিপ্লবী সেনানীতে রূপান্তরিত।

জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে সবার আগে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এই সুবোধই। অকথ্য অত্যাচার করেছিল পুলিশ। ছোট্টখাট্টো চেহারার সুবোধ কে ক্রমাগত কিল চড়, লাথি, ঘুঁষি। ইন্টারোগেশন রুমের এই দেওয়াল থেকে ওই দেওয়ালে ধাক্কা, যেন ফুটবল বানিয়ে খেলা। কিন্তু সঙ্গীদের হদিস সুবোধের মুখ থেকে বার করা যায়নি। আন্দামানের জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হল ওঁকে।

কারাভ্যন্তরেই যৌবনের উন্মেষ, সেই সঙ্গে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে নিজেকে পুরোপুরি বিলীন করে দেওয়া। জেল কুঠুরির চার দেওয়ালের মধ্যে চর্চা হচ্ছে হাতে লেখা, লুকিয়ে আনা ঝাপসা হয়ে যাওয়া লেনিনের "রাষ্ট্র ও বিপ্লব", কমিউনিস্ট ইশতেহার এসব মার্ক্সবাদী সাহিত্যের। তর্ক, বিতর্ক, আলোচনায় সুবোধ রায়ের নিজের ভাষায় "জীবন শিখিয়ে দিচ্ছে সেদিন থেকেই, জীবনের কাছে শিখছি, এভাবেই কম্যুনিস্ট হিসেবে বেড়ে ওঠা।"

ছাব্বিশ বছর বয়সে মুক্তিলাভের পর মুহূর্তমাত্র দ্বিধা না করে কমিউনিস্ট পার্টির দফতরে সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে প্রবেশ। প্রথাগত পড়াশোনা শেষ করেননি, ফলে চাকরিও করা হয়নি। পার্টির কাজেই সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ হল অকৃতদার সুবোধের। আলিমুদ্দিনে পার্টি অফিসেই একটা ঘরে থাকতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামীর ভাতা নিতেন না, অসুস্থ হওয়ার পরে চিকিৎসার জন্য সরকারি সাহায্যও নেননি।

অশোক মিত্রের ভাষায় "অনবচ্ছিন্ন সাড়ে ছয় দশক ধরে সুবোধ রায় পার্টির সব সময়ের সাধারণ কর্মী-ই থেকে গিয়েছিলেন। আদর্শনিষ্ঠায় নিয়ন্ত্রিত জীবন, কোনও দিন স্বার্থচিন্তা করেননি, সংসারে গুছিয়ে বসার কথা ভাবেননি, সর্বক্ষণের দলীয় কর্মী, দলীয় দফতরই দশকের পর দশক জুড়ে তাঁর আশ্রম তথা জীবনযাপনের কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর বরাবরের মন্ত্র: সম্ভোগ নয় সংবরণ। কর্মী থেকে নেতৃত্বে পৌঁছবার বাসনাবিহীন। সাধ্যের প্রত্যন্তে গিয়ে দলীয় সংগঠনের কাজে কর্তব্য সম্পাদনে প্রতিনিয়ত তাঁর অধ্যবসায়। 

শেষ বছরগুলি পর্যন্ত নিজের জামাকাপড় নিজে কেচেছেন, রোদে মেলেছেন, ইস্ত্রি করেছেন। যে ঘরে থাকতেন, নিজেই ঝাড়তেন, পুঁছতেন, জীবন নির্বাহের অতি সামান্য যে ক'টি উপকরণ, আশ্চর্য নিপুণতায় গুছিয়ে রাখতেন। নিজের জন্য ন্যূনতম রান্না সাধারণত নিজেই করতেন, অন্যথা মাঝেমধ্যে দলীয় কমিউনে আহার্যের সামান্য চাহিদা মেটানো। 

কৃচ্ছ্রসাধনায় দৃঢপ্রতিজ্ঞ, অন্তরঙ্গতর অনুরাগীরা কখনও-সখনও একটু-আধটু উপহারসাগ্রী তাঁকে পৌঁছে দিতেন, বিব্রত সুবোধ রায় বিপন্নতার সঙ্গে তা গ্রহণ করতেন, দু'দিন বাদে অনুরাগীদের মধ্যেই ফের বিলিয়ে দিতেন।

মানুষটি বরাবর আত্মপ্রচারের বাইরে থেকেছেন। যাঁদের পছন্দ করতেন, তাঁদের কাছে ডেকে চট্টগ্রাম বিদ্রোহের রোমাঞ্চকর বিভিন্ন কাহিনি শোনাতে ভালবাসতেন। সর্বস্তরের সকলের সঙ্গে নয়, ঈষৎ নিচুতলার দলীয় কমরেডদের সঙ্গেই তাঁর নিবিড়তর সখ্য, যাঁরা দলের গাড়ি চালান, যাঁরা ঘরে ঘরে কাগজপত্র বা চা-মুড়ি পৌঁছে দেন, যাঁরা অপেক্ষাকৃত উঁচু মহলের নেতাদের নির্দেশাদি পালন করেন, ইত্যাকার কমরেডদের নানা সমস্যা মেটাতে সুবোধ রায় অহরহ ব্যস্ত।

পাশাপাশি দলীয় দফতরে অনেক খুঁটিনাটি সাংগঠনিক দায়িত্বও তাঁকে সামলাতে হয়েছে। জেলা দফতরগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা, বিনিময়-প্রতি-বিনিময়, কিংবা কেন্দ্রীয় দফতর বা অন্যন্য রাজ্য দফতরের সঙ্গে চিঠিপত্রের মধ্যবর্তিতায় সেতুবন্ধনের কাজ। দীর্ঘ দশকগুলি জুড়ে পার্টি অনেক ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে গিয়েছে, বিভিন্ন ঋতুতে মতাদর্শের অনেক টানাপোড়েন, অঢেল তর্ক-বিতর্ক, পঁয়ষট্টি বছর ধরে সুবোধ রায় অনেক ইতিহাস তৈরি হতে দেখেছেন। অনেক নেতার উত্থান দেখেছেন, তাঁদের প্রস্থানও পর্যবেক্ষণ করেছেন।

দলের ভাবাদর্শ ও কর্মসূচির অবৈকল্য রক্ষায় তাঁর ইস্পাতকঠিন মানসিক দার্ঢ্য। কিন্তু কর্মী থেকে নেতাতে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রবৃত্তি তাঁর কদাপি ছিল না। দলের শৃঙ্খলা থেকে কোনও দিন বিচ্যুত হননি, কিন্তু স্পষ্টবাদিতায় তাঁর জুড়ি নেই, ছোট-মাঝারি-বড় নেতাই হোন, কিবা নেতৃত্বে তখনও পৌঁছয়নি কিন্তু পৌঁছুতে আঁকুপাকু করছেন, কারও আদর্শগত বা আচরিক স্খলন তাঁর দৃষ্টিগোচর হলে সরবে সমালোচনা করেছেন। তাঁকে তাঁকে তাই ঘাঁটাতে সাহস পেতেন না অনেকেই। দলের মধ্যে ক, খ বা গ তরতর করে সোপান বেয়ে উন্নতি ও মর্যাদার বেলাভূমিতে পৌঁছে গেছেন। সুবোধ রায় একা পড়ে থেকেছেন। তাঁর হাঁটুর বয়সিরা দ্রুততার সঙ্গে দলীয় নেতৃত্বে উত্তীর্ণ হয়েছেন, দলের মধ্যে কেষ্টবিষ্টু বলে বিবেচিত হয়েছেন, তাঁরা ফরমান জারি করেছেন, দলীয় অনুশাসন মেনে সুবোধ রায় সেই ফরমান মান্য করে নিজের কর্তব্য নিঃশব্দে পালন করে গেছেন।

এমনি করেই একটা গোটা জীবন অতিবাহন। চট্টগ্রাম বিদ্রোহের বীর যোদ্ধা, পার্টির অন্যতম প্রাচীন সদস্যদের এক জন। বহু বছর ধরে দলীয় ইতিহাস ধাপে-ধাপে সুশৃঙ্খল লিপিবদ্ধ করেছেন, কয়েক খণ্ডে যা প্রকাশিত হয়ে দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছে। তা হলেও দলের এক জন নিতান্ত সাধারণ কর্মী, নতুন প্রজন্মের দলীয় সদস্যরা তাঁর পরিচয় জানেন না, তাঁদের কাছে নিতান্ত হেজিপেঁজি কে এক জন বৃদ্ধ পার্টি দফতরে ঘাড় গুঁজে কর্মরত। তাঁর কোনও দাবিদাওয়া নেই, তাই তাঁর আলাদা আদর সম্ভাষণও নেই।"


অনেক শৌর্যের, অনেক মৃত্যুবরণের অধ্যায় পেরিয়ে বিপ্লবের প্রদীপ্ত শিখা ক্রমে স্তিমিত হয়ে এলো। নব্বই বছর বয়স অতিক্রান্ত, অবশেষে সুবোধ রায় জড়ার শিকার হলেন। রোগগ্রস্ত অবস্থায় কলকাতাস্থ একটি সরকারি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হল। তাঁর জন্য পাঁচতারা হাসপাতালের ব্যবস্থা করার প্রশ্ন ওঠে না, নিজেও সেটা অবশ্যই ঘোর অপছন্দ করতেন। এসএসকেএম হাসপাতালের নিরাবরণ মৃত্যুশয্যায় শুয়েও বলেছিলেন, "চট্টগ্রাম বিদ্রোহ আমার জীবনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।"

সাল ১৯৩০, আজকের দিনে, ১৮ই এপ্রিল, আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পরে রাত দশ টায় যুব বিদ্রোহের সেই জিরো আওয়ার, মাহেন্দ্রক্ষণ। "কম্যান্ডার" সূর্য সেন এর নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির দামাল ছেলে মেয়েরা ঝাঁপিয়ে পড়বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার এর দখল নিতে। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শুরু হবে। তারপরে জালালাবাদের পাহাড়ে কম্যান্ডার এর নেতৃত্বে অন্য সাথীদের সাথে ১৪ বছরের কিশোর সুবোধ গড়ে তুলবে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের সেই ব্যারিকেড।

আজ আবার ১৮ই এপ্রিল। কমরেড সুবোধ রায়কে স্মরণ করার দিন। তার বিপ্লবী তেজের উত্তরাধিকারকে নিজের রক্তে অনুভব করার দিন। আধা ফ্যাসিবাদী আর ফ্যাসিবাদী সমস্ত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রক্ত পতাকা হাতে নতুনভাবে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের ব্যারিকেড গড়ে তোলার শপথ গ্রহণের দিন।

সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

ফিরে দেখাঃ করোমণ্ডল এক্সপ্রেস ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য

করোমণ্ডল নামটা প্রথম শুনি ক্লাশ টু-তে পড়াকালীন। দিদি ভূগোলে পড়তো, ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূলের নাম কঙ্কন এবং মালাবার উপকূল, আর পূর্ব উপকূলের নাম করোমণ্ডল উপকূল। তার পরের বছর চাকরিসূত্রে বাবা মাদ্রাজে চলে আসেন, তখন জানতে পারি ওই নামে একটা এক্সপ্রেস ট্রেনও আছে! কে জানে কেন, পাঠ্য পুস্তকের লেখক সান্যাল-চ্যাটার্জী, বা কুণ্ডু-দাশ-কুণ্ডুর আদলে ভেবে নিয়েছিলাম, ট্রেনটির মালিক দু'জন, কর ও মণ্ডল।
ওই ট্রেনে প্রথম চড়বার সুযোগ আসে ১৯৮২ সালের অক্টোবর মাসে। মনে আছে, সেই বছর দু'বার দুর্গাপুজো পড়েছিল, একবার সেপ্টেম্বরে, একবার অক্টোবরে। দুটো পুজো মিলিয়ে ছুটি ছিল বেশ বড়। আর তখনই আমরা ট্রেনে চেপে এসেছিলাম মাদ্রাজ। আমরা মানে মা, দিদি আর আমি। বাবা তো অগষ্ট থেকেই মাদ্রাজবাসী। সেও এক মজাদার অভিজ্ঞতা। তখন অনলাইন রিজার্ভেশন ছিল না, কয়লাঘাটের কাউন্টার থেকে আমাদের টিকিট কাটা হয়েছিল। বেশ হতাশ হয়েছিলাম। এ বাবা, এ তো আমাদের মামারবাড়ি জয়নগর-মজিলপুর যাওয়ার টিকিটের মতোই দেখতে! এত দূর যাব, তার জন্যেও একটু ভালো দেখতে টিকিট দিল না!
যাই হোক, দুঃখ ভুলে প্রস্তুতি শুরু হলো। বিকেল সাড়ে তিনটেয় ট্রেন ছাড়বে, সূতরাং আমাদের দু'টোর মধ্যে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে যেতে হবে! ট্রেনে খাবার কিনতে পাওয়া গেলেও, সেগুলো খুব স্বাস্থ্যসম্মত হয় না, তাই কেক, বিস্কুট, চানাচুর, রাত্তিরের লুচি, পরদিন সকালের পরোটা তার সঙ্গে শুকনো তরকারি, সব প্ল্যান হল। শোওয়ার জন্য একটা হোল্ড অলে তিনজনের পাতবার জন্য পাতলা এবং গায়ে দেওয়ার জন্য মোটা চাদর (হোক না মাদ্রাজ, কে না জানে ছুটন্ত ট্রেনে রাতে শীত করে!) নেওয়া হলো। ফোলানো বালিশ কেনা হল। দুটো বড় জলের বোতল, তার সঙ্গে চেন লাগানো জল খাওয়ার কাপ। চলন্ত ট্রেনে যদি হাত থেকে পড়ে হারিয়ে যায়!

Coromondal Express


যাত্রার দিন তো ভোরবেলা থেকে উঠে দক্ষযজ্ঞ চলেছে। দুই পিসি এসেছেন, একজন লুচি ভাজবেন একজন পরোটা। ঠাকুমা মন্দিরে পুজো দিয়ে এসে উপদেশ দিতে লাগলেন, "লেডিস ক্যুপের টিকিট, দরজা বন্ধ করে শোবে। টিকিট চেকার ছাড়া আর কারোকে টিকিট দেখাবে না একদম! খুব বেগ না পেলে টয়লেটেও না গেলেই ভালো, কী সব নোংরা করে রাখে..." এক দাদা আমাদের সমস্ত টিকিটগুলোর নম্বর অন্য খাতায় লিখে দিল। যদি রাস্তায় টিকিট হারিয়ে যায়! তারপর ভাত খেয়ে লটবহর নিয়ে ট্যাক্সি চেপে চললাম হাওড়া স্টেশন। তিনজন যাত্রী, তাদের সি-অফ করতে আরও পাঁচ জন! আমি তখন পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা নিয়ে ব্যস্ত, দিদিও কী একটা বইতে মগ্ন। তারপর এলেন সেই মহারাণী। উফফফফ... লিস্ট মিলিয়ে, নিজেদের সিট/বার্থ পেয়ে বসে তবে শান্তি। স্যুটকেসগুলো চেন দিয়ে সিটের নীচে আটকে তালা মেরে, জলের বোতল ঝুলিয়ে, মিডল বার্থটা তোলা যায় কিনা নিশ্চিত হয়ে, পিসিরা নেমে দাঁড়ালেন। ট্রেন অবশেষে নড়লো... টা-টা করা হলো যতক্ষণ সম্ভব, তারপর আমাদের মাদ্রাজ যাত্রা পুরোদমে শুরু হলো।
তারপর খড়্গপুরে "ভাঁড়ে চা" আর "মেচেদার চপ", ভুবনেশ্বরে "পুরি" (শ্রী জগন্নাথ ধাম নয়) অন্ধকার নেমে এলে নিজেদের কৌটো খুলে লুচি-তরকারি, মাঝখানে কয়েকবার বাথরুম যাওয়ার নাম করে ভেস্টিবিউলড রাস্তাটায় ঘুরে আসা... এইসব করেই রাত নেমে এল। আমার জুটলো মিডল বার্থ, মা একটা তোয়ালে দিয়ে দুটো চেইন এর মাঝের ফাঁকাটা বেঁধে দিল, যাতে গলে পড়ে না যাই! পরদিন সকালে দেখি ওয়ালটেয়ার পেরিয়ে ট্রেন উল্টোদিকে ছুটছে! দিদি বুঝিয়ে দিল কীভাবে এটা হয়। বিশাখাপত্তনম... নামই শুনেছিলাম, সত্যি জায়গাটা আছে! ব্রেকফাস্টে পরোটা খাওয়া হলো, আর চা। বড় হয়ে গেছি, চা খাচ্ছি দিব্যি! দুপুরের লাঞ্চ অর্ডার দেওয়া হলো, স্টেশনের নামগুলো ভীষণ মজাদার! সামালকোট, টুনি, টাডেপল্লিগুডেম, রাজমুন্দ্রি... এইসব দেখতে দেখতে ভিজয়ওয়াডা তে লাঞ্চ এল। খোপকাটা থালা, ডাল ভাত তরকারি সব মিশে গেছে... তবু খেলাম, একটু টকটক সবই। নুনের ছোট্ট প্যাকেট ছিল তরকারির নীচে, সেটা শেষে আবিস্কৃত হলো। আর প্লাস্টিকের কাপে দই। একটুখানি জিভ ছোঁয়াতেই যেন শক লাগল জিভে। টক দই আগেও খেয়েছি, কিন্তু এটাকে টক বলে!! কী সাংঘাতিক! সোজা জানলা খুলে বাইরে। তখন থেকে একটু ভয় ভয় করতে লাগলো, এই টক খেয়ে থাকতে হবে নাকি!
ট্রেন ছুটেছে, আমরাও একটু গড়িয়ে নিলাম। একটানা চলে, সন্ধ্যা ছ'টা নাগাদ গিয়ে পৌঁছলাম মাদ্রাজ সেন্ট্রাল। বাবা স্টেশনে ছিল, খুব আনন্দ... কিন্তু ট্রেনটা ততক্ষণে খুব আপন, খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল আমার।
সেই শুরু। তারপর বহুবার ঐ করোমণ্ডলেই যাতায়াত করেছি। কখনো আনরিসার্ভড এ, পরে এসি থ্রি টায়ারেও। ক্লাশ ফাইভ থেকে একা যাতায়াত করতাম। মনে আছে, একবার পুজোর ছুটিতে মাদ্রাজ যাব, তো বিজয়া দশমী আর ভাইফোঁটা দুটো রাত্তিরই ট্রেনে কেটেছিল। আশেপাশের দাদা, কাকারা মিলে স্টেশনে বড়া, কালাকাঁদ যা পাওয়া যায় সবাই কিনে একসঙ্গে সেলিব্রেট করেছিলাম। তখনও খাবারে ওষুধ মিশিয়ে অজ্ঞান করে লুঠপাটের বদমায়েসী শুরু হয়নি, সহযাত্রীরা হামেশাই খাবার ভাগ করে খেতাম। কীভাবে যেন করোমণ্ডল এক্সপ্রেস আমাদের মাদ্রাজের বাঙ্গালীদের কাছে "কলকাতা" বা "বাড়ি"-র রূপক হয়ে উঠেছিল। মনে আছে, ছোটবেলায় মাদ্রাজের স্কুল থেকে ভ্যানে ফিরতাম যখন, পাশের লাইন দিয়ে করোমণ্ডল ও আসতো মাদ্রাজের দিকে। আমরা সেই ছুটন্ত গাড়ীকেই নিজেদের লোক ভেবে ভ্যান থেকেই টা-টা করতাম, খুব খুশী হতাম "আজ করোমণ্ডল দেখতে পেয়েছি!" বলে।
আরো কতো গল্প! একবার আমি আর মা মাদ্রাজ আসছি, রাজমুন্দ্রিতে স্টেশনে জল নিতে নেমেছি আর ট্রেন দিয়েছে ছেড়ে। দৌড়ে সামনের একটা বগিতে উঠে, ভিতর দিয়ে আর নিজেদের বগি চিনতে পারি না! ওদিকে মা-ও টেনশনে চেন টানে আর কি! লোকজন চেঁচামেচি করে ঠিকমতো পৌঁছে দিল আমায়। আর একবার আমাদের জানানো হলো আমাদের বগিতে কী যেন টেকনিকাল ফল্ট হয়েছে, তাই বিশাখাপত্তনম (আর ওয়ালটেয়ার নয়)এলে বগি বদলাতে হবে। সে বারও আমি আর মা যাচ্ছি। মালপত্র নিয়ে আবার অন্য বগিতে গিয়ে ওঠা...
তাও তো প্রতি বছর যে ঝড়বৃষ্টিতে লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হলে করোমণ্ডলের যাত্রীদের কিছুটা পথ বাসে করে নিয়ে গিয়ে আবার অন্য একটা ট্রেন ধরতে হতো, সে অভিজ্ঞতা হয়নি আমার। শুনেছি পরিচিতদের মুখে। শুনেছি আরও মজাদার গল্প। একজন জল খেতে স্টেশনে নেমেছিল আর ট্রেন দিয়েছিল ছেড়ে। সে দৌড়ে গার্ডের কামরায় উঠে পড়েছিল। গার্ড তাকে খুব বকেছিল, ওইভাবে ছুটে ট্রেন ধরবার জন্য। বকুনি খেয়েও, সে আরামের সীট পেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। পরের স্টেশনে গার্ড ঠেলেঠুলে তাকে নিজের সীটে পাঠান!
আর একবার, ভীষণ গরমের সময় দুপুরে স্টেশনের পানীয় জলের কলে স্নান করতে নেমেছিল এক কাকু। সবে মুখে সাবান দিয়েছে, আর ট্রেন দিয়েছে ছেড়ে! দৌড়ে ভেজা লুঙ্গি পরেই সাবান মুছতে মুছতে ট্রেনে উঠতে গিয়ে এক সহযাত্রীর পা দিলেন মাড়িয়ে। সে বেচারা 'কাল! কাল!' বলে চেঁচিয়ে উঠতে কাকু আরো রেগে বললেন, "আমার আজকের স্নানের কী হবে! কাল করবো মানে!!" তারপর তাঁকে বোঝানো হয় যে তমিড় ভাষায় 'কাল' মানে 'পা', আর তিনি বেচারার পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন!
ভিজয়ওয়াদা তে অনেকের জুতো চুরি হেয়ে গেছে, খাবারের মান অত্যন্ত বাজে হয়ে গেছে। একবার আমাদের খাবার দেয়ই নি, পরে রেল কোম্পানিকে অভিযোগ করতে টাকা ফেরত পেয়েছিলাম। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও করোমণ্ডল যেন আমার অতি প্রিয় আত্মীয়! এই বছর আষ্টেক আগেও, একবার জরুরী কাজে মা, বৌ আর ছোট্ট ছেলে নিয়ে কলকাতা যাচ্ছি। টিকিট এসি থ্রি টায়ার, কিন্তু কনফার্মড হয় নি, ওয়েটিং লিস্ট। বি-টু তে রিস্ক নিয়ে উঠে পড়লাম, সীট শেয়ার করে দিনের বেলাতা কেটে গেল, কিন্তু রাতে! টিটিই কে বলেও একটাও বার্থ ফাঁকা পাওয়া গেল না, অগত্যা দুটো সীটের মাঝখানে মাটিতে খবরের কাগজ পেতে অন্ততঃ বাচ্চাটাকে শোয়ানোর ব্যবস্থা করছি, 'ধুত্তেরি' বলে এক ভদ্রলোক নিজের বার্থটা ছেড়ে দিয়ে ছেলের সঙ্গে শুলেন। সেই বার্থে বৌ আর ছেলে শুলো। এদিকে মা কে বসে থাকতে দেখে আরও একজন নিজের বার্থ ছেড়ে বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করলেন। শেষরাতে আমাকেও একজন বার্থ ছেড়ে দিয়ে বললেন, "কী ভেবেছেন টা কি, সারারাত বসে কাটানো যায়! নিন শুয়ে পড়ুন!" এনাদের নামও জানিনা, যোগাযোগও নেই, কিন্তু সেইরাতে যে কী ভীষণ উপকার করেছিলেন এক অপরিচিত পরিবারকে, তা হয়তো ওনারা কোনোদিন জানলেনও না! এই আমার করোমণ্ডল!
এখন জীবনযাত্রা বদলে গেছে। সময় বাঁচাতে ফ্লাইটেই যাতায়াত করতে হয়। আকাশে চেনা নীল-সাদা প্লেন দেখলেই ছেলেটা চেঁচিয়ে বলে "বাবা দ্যাখো, ইণ্ডিগোর ফ্লাইট, কলকাতা যাচ্ছে!" আমার মনে পড়ে যায় করোমণ্ডল এক্সপ্রেসের কথা। এভাবেই উত্তেজিত হয়ে পড়তাম এক সময়।
কে জানে, একেই বোধহয় বড় হয়ে যাওয়া বলে!

শনিবার, ৮ এপ্রিল, ২০২৩

ভাবাবেগ ~ মাহফুজ আলম

ভাবাবেগ অতি বিষম বস্তু। 

কার ভাবাবেগ কিসে আহত হয়, তা বোঝা বড়ই দায়। ধরুন, আপনি সুকিয়া স্ট্রীটে দাঁড়িয়ে গীতিকার জিবেগজা খাচ্ছেন, আমি ডাক্তারের হুমকিতে বাঁচি, গীতিকা কি ঘোষের ধারে কাছে হাঁটিনে, আপনাকে ওই পরম আস্বাদে জিবেগজাতে কামড় দিতে দেখে কি আমার ডায়েট লাঞ্ছিত ভাবাবেগ আহত হবে না?

অথবা এই রমজান মাসে যেসব নিষ্ঠুর লোক দিনরাত নির্লজ্জের মত জাকারিয়াতে গিয়ে ছবি দিয়ে যাচ্ছেন, তা দেখে কি আমার কোলেস্টরলে ভীত কোমল ভাবাবেগ ঘা খাচ্ছে না?

আলবাত ঘা খাচ্ছে। রীতিমত হৃদয়ে গভীর ঘা লাগছে। কিন্তু , তাতেও কিছু করতে পারছি কি? আপনাকে দানিশের রোল খেতে দেখেও কেড়ে নেবার বিধান আইপিসি তে কোথাও আছে বলে তো মনে হয় না। 

তবে, পলিটিসিয়ানদের এই বাধা-টাধা নেই। তাদের ভাবাবেগ যখন তখন আহত হয়। অম্নি পুলিশ টুলিশ কবিকে দেখে টুপি খোলা ভুলে আহত ভাবাবেগ কে পুলটিস লাগাতে উঠে পড়ে।( কবি কে দেখে আর টুপি খোলে না কারণ কবি এখন মন দিয়ে চেয়ার মুছছেন। কাকীয় প্রতিচ্ছবিতে আত্মদর্শনে বিশ্বাসী আরেকজন তার কম্পিটিটর ছিলেন, তবে এখন তিনি ভাষিক গন্ডগোলে কিঞ্চিৎ পিছিয়ে পড়েছেন )। 

এই ভাবাবেগ আহত হওয়ার ঠেলায় সম্প্রতি বিপাকে পড়েছেন শহর বহরমপুরের চন্দ্রশেখর সরকার। কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে কোট করে একটি পোস্ট করেছিলেন সোসাল মিডিয়াতে। সেটিতে কোনো একটি অতি দক্ষিণপন্থী ধর্মীয় সংগঠনের ভাবাবেগ আহত হয়। অম্নি মানিনীয়ার পুলিশ 'ঝড়' পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য চন্দ্রশেখর সরকার কে আটক করে। শেষে কোর্টে জজ সায়েব কে কৃত্তিবাসী রামায়ণ খুলে দেখিয়ে জামিন পেয়েছেন তিনি।

শাসকদলের দামালরা থানায় হানা দিলে যে পুলিশ টেবিলের তলায় লুকোয়, বগটুই তে যখন জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয় মানুষকে, তখন যে পুলিশ সময়ে পৌঁছানোর সময় পায় না, তাদের এই কর্ম তৎপরতা বেশ চোখে পড়ার মত। 

তবে, পুলিশ নিয়ে বেশি কথা নয়। কারণ, শঙ্খ ঘোষ সেই কবেই লিখে গেছেন, "পুলিশ কখনো কোনো অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ।"

অতি দক্ষিণপন্থী ধর্মীয় সংগঠন তাদের কাজ করেছে। এটাই তাদের রাজনীতি। এটা নিয়ে শব্দ খরচ করার মানে হয় না। তাছাড়া সম্প্রতি শুনলাম একজন লক্ষণের শক্তিশেল থেকে কোট করেছেন বলেও তার পোস্টে নাকি কলকাতা পুলিশ কে ট্যাগ করা হয়েছে। মাইকেল এনারা পড়েছেন কিনা জানিনা।

কিন্তু, একই সাথে এটাও উল্লেখ্য যে আমরাও কিছু করছি না। আমরা বলতে বোঝাচ্ছি, আমরা, যারা নিজেদের শিক্ষিত সচেতন শ্রেণী মনে করি।  এর পরেও শহরে রবীন্দ্র সদনে একের পর এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিকে প্রশয় দেওয়া নেতাদের সাথে একমঞ্চে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে ছবি তুলব আমরা।

জাস্ট, যেকোনোভাবে এড়িয়ে যাবো চন্দ্রশেখর সরকারের ঘটনাটা। আমাদের সমষ্টিগত নীরবতা শক্তি যোগাবে দুতরফের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারবারিদের। এরপরে চোখের সামনে কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে কাউকে লাঞ্ছিত হতে দেখলেও স্রেফ চোখ বন্ধ রাস্তা পার হবো। 

জার্মানীতে ইহুদি নিধন যজ্ঞ একদিনে শুরু হয় নি। এমনকি যখন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নারকীয় এক্সপেরিমেন্টে ইহুদী দের হত্যা করা হচ্ছে, তখনও বার্লিনে রমরমিয়ে চলতো থিয়েটার আর কালচারাল প্রোগ্রাম। আমাদের দিল্লীর কর্তা ব্যক্তিরা বিরোধী দেখলেই কথায় কথায় যে প্রতিবেশী দেশের ট্যুরিজম অ্যাম্বাসাডার এর ভূমিকা পালন করেন , সেই দেশের উগ্র ধর্ম রাজনীতির কুফল দেখে আমাদের কিছু শেখার ছিল। 

এই বহরমপুর রেজাউল করিমের শহর, আমরা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলাম।

ভবিষ্যতে যা কিছু হতে যাচ্ছে, তার দায় কিন্তু আমাদের নিতে হবে। বালিতে মুখ গুঁজলে ঝড় বন্ধ হয় না।

বুধবার, ৫ এপ্রিল, ২০২৩

দাঙ্গার কুশীলব ~ অগ্নিবেশ রায়

সুমিত সাউয়ের বয়স ১৯ বছর। শালকিয়ার বাসিন্দা। বাড়িতে বাবা, মা আর দুই বোন। সুমিতের বাবা পেশায় গাড়ির ড্রাইভার। সুমিত কার্যত বেকার, মাঝেমধ্যে বাবার গাড়ির খালাসি। অল্পশিক্ষিত, কর্মহীন।

সুমিতের মা জানাচ্ছেন সুমিত ২০২১এর পর থেকে বিজেপির মিছিলে যেত। তার আগে তৃনমূলের মিছিলে যেত। মিছিলে গেলে টাকা পেত।

সুমিত রামনবমীর মিছিলে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মিছিল করায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। দোষী প্রমাণিত হলে ৭ বছরের জেল হবে। জেল থেকে বেরিয়ে সুমিতের এমনিতেই কঠিন জীবনসংগ্রাম আরও কঠিন হয়ে যাবে। বা সুমিত চিরকালের জন্য অপরাধের অন্ধকার জগতে হারিয়ে যাবে।

আর মিডিয়াতে দুই দলের, ইলেক্টোরাল বন্ডের টাকায় ভারতের ধনীতম দুই দলের, পরস্পর দোষারোপের চাপান-উতোরে হারিয়ে যাবে আসল কথাটা, যে এই দুই দলই সুমিতের মতো অসংখ্য যুবকের জীবনে এই অন্ধকার পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার জন্য দায়ী।

যে নেতারা ওকে মিছিলে গেলে হাতে টাকা গুঁজে দিত, হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ধরিয়ে দিত, তাদের বাড়ির ছেলে-মেয়েরা, তাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবৃত্তের লোকেরা কেউ এই মিছিলগুলোতে হাঁটে না। তাদের আগ্নেয়াস্ত্র তো দূর, কোনো রাজনৈতিক দলের পতাকা হাতেও কখনও রাস্তায় দেখা যায় না।

তারা নামীদামী স্কুলে, কলেজে, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে, কর্পোরেট অফিসে বা নিজের ব্যবসায়ে নিজেদের জীবনে বেশ নির্ঝঞ্ঝাট আরামে আছে।

চিরকালই দক্ষিণপন্থী দলগুলো এভাবেই প্রান্তিক মানুষদের অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতার সুযোগ নিয়ে, হাতে সামান্য কিছু পয়সা গুঁজে দিয়ে, নিজেদের নোংরা রাজনৈতিক খেলায় বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করেছে।

ঐতিহাসিকভাবে চল্লিশের দশকের কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া, এই উপমহাদেশে বরাবরই এটা হয়ে এসেছে। দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ফুটসোলজার সবসময়েই "নীচু তলার" লোকজন। "উঁচু তলা" চিরকালই তাদের উস্কানি দিয়ে, সামান্য কিছু পয়সা ছুঁড়ে দিয়ে, নানারকম অসদুদ্দেশ্যে ব্যবহার করে গেছে।

এই প্রসঙ্গে জয়দেব বসু একটা কবিতা লিখেছিলেন:

রামা বাউড়ি আর রহিম শেখ,
খায়না শুয়োর কিংবা গরু,
বানভাসি হয়, খরায় খাক,
জলে বিষ আর রাস্তা সরু।

এ ওর বন্ধু, শত্রু এর ও,
মাস্কেট আর মিলাদ-পুজোও,
এর মেয়ে ওঠে ক্লাস টেনে আর
ওর ছেলে পায় শহরে সুযোগ।

গ্রামে থাকে এরা, পঞ্চায়েতে...

রাম মুখার্জি, রহমত আলী,
পার্টনার এঁরা বেঙ্গল ক্লাবে,
বিফ স্টেক আর রোস্টেড পর্ক
আজ রাত্তিরে ডিনারে খাবেন।

বন্ধু দু'জন ক্লাব থেকে ফিরে,
টাকা পাঠাবেন দুই গোষ্ঠীকে,
এর ছেলে ভাবে ওর সাথে শুই,
ওর মেয়ে ভাবে 'চল মস্তিতে'!

শহরের লোক, মন চায় এতে...

সেই চাঁদাতেই মাস্কেট কেনা,
সেই চাঁদাতেই রক্তের দেনা...

[Agnibesh Roy আর Arijit Mukherjee-র সৌজন্যে]