ভ্লাদিমির লেনিনকে আমি সেই ছোট্টবেলা থেকে চিনি। শৈশবের একটা বড় অংশ যে বাড়িতে কেটেছে, সেখানে লেনিনের ছবি ছিল। বড় হয়ে জেনেছি, ওই ছবিটি যাঁর আঁকা, তাঁর নামও ভ্লাদিমির। ভ্লাদিমির আলেজান্দ্রোভিচ সেরভ। তেলরঙে আঁকা ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে তিনজন কৃষক লেনিনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তাঁদের দু'জনের এঙ্গেলসের মতো দাড়ি, অন্যজনের ঝুপো গোঁফ। তিনজনের গায়েই পশমের মোটা কোট। একজন দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তাঁর ডান হাত চেয়ারের উপর রাখা। ছোট্ট গোলাকৃতি টেবিল ঘিরে বসে তাঁরা লেনিনের সঙ্গে কথা বলছেন। মাটিতে ঘুমন্ত শুয়োরের মতো একটি পুঁটুলি। লেনিনের হাতে একটি কলম। টেবিলে কনুই রেখে কৃষক প্রতিনিধিদের কথা শুনছেন তিনি।
বহুদিন পর্যন্ত আমি ভাবতাম, যিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তিনিই বোধহয় লেনিন। সেই ধারণা যিনি ভাঙান, তাঁকে আমি বাসস্ট্যান্ড, কারখানার গেট, রাস্তার মোড়, রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের আশেপাশে বক্তৃতা করতে শুনতাম। একটি মাইক, সেটির গায়ে সরু-লম্বা ব্যানার, পিছনে বড় লাল শালু। রেল স্টেশনের পাশে বক্তৃতা হলে মাঝেমধ্যেই ছন্দ কাটত, ট্রেনের ঘোষণার সময় থামতে হত বারবার। খর্বকায় মানুষটি চিৎকার করে বলতেন। তাঁকে ঘিরে ভিড় জমে যেত। সন্ধের শুরুতে অনেকসময় রাস্তার হলুদ আলো জ্বলত না, দেরি হত। আবছায়া। আশেপাশের দোকান, বাড়ি, গ্যারাজ থেকে আসা ভাঙাচোরা আলোয় অপার্থিব মনে হত সেই ভিড়কে। স্ট্রিট কর্নার অনেকটা জীবনের মতো— মানুষ আসেন, দাঁড়ান, চলে যান। আবার নতুন কেউ এসে দাঁড়িয়ে পড়েন খানিকক্ষণ।
এরপর আমি লেনিনকে দেখেছিলাম দু'টি পার্টি অফিসে। একটি অভিজাত, অন্যটি সাদামাটা। একটির পিছনে লাইব্রেরি, ছোট্ট মাঠ। ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। মাঝেমধ্যে পার্টি অফিসের ভিতরে বল ঢুকে গেলে লেনিনের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত আমার। ভালো লাগত না। দেখতাম, কেমন রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে রয়েছে লোকটি। আশেপাশে আরও অনেক গোমড়ামুখো লোক, কেউ চেয়ারে বসে রয়েছেন, কেউ দেওয়ালে ঝুলছেন। থমথমে। অন্য অফিসটি ছিল রেললাইনের ধারে। টালির বাড়ি, বর্ষা হলে জল পড়ত। দেওয়ালে ছিল আকাশি রঙের চুনরং। একফালি ঘেরা জায়গায় বাঁশ পোঁতা। বাঁশের মাথায় লাল পতাকা। অধিকাংশ সময়েই বিবর্ণ, জ্যালজ্যালে। ওই চত্বরের হাওয়ায় তখন কয়লার গুঁড়ো উড়ত। চোখে ঢুকলে জ্বালা করত খুব। তারপর কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। কয়েককটা সুইসাইড। কিন্তু দূষণ কমল।
জুটমিলের বস্তিতেও আমি লেনিনকে দেখেছি। আমার বন্ধু মল্লেশ্বরের বাবা বলতেন— লেনিনোয়া। বড় হয়ে শুনেছি ভ্লাদিমিরকে আদর করে 'ভলোদিয়া' বলতেন কেউ কেউ। লেনিনোয়া। ভলোদিয়া। শব্দে শব্দে মিলে যায়।
এরপর আমি লেনিনকে দেখি একটি ছোটপত্রিকার ঘরে। সেখানে তিরিশ-চল্লিশ বছরের পুরনো 'সেভিয়েত দেশ' ডাঁই করে রাখা থাকত। ওই ঘরে যাঁরা আসতেন, তাঁরা প্রত্যেকেই চমৎকার লিখতেন। গল্প করতেন অনেক। এখান থেকে আমি একটা ছোট্ট লাল ব্যাজ পকেটস্থ করি, তাতে লেনিনের ছবি ছিল। পরে জেনেছি, ওটা সোভিয়েতের জিনিস। পত্রিকার সম্পাদকের জেঠু একবার গিয়েছিলেন সেখানে। নিয়ে এসেছিলেন।
আরেকটু বড় হয়ে লেনিনের সঙ্গে আমার দেখা হল মধ্য কলকাতার এক পুরনো বাড়ির চিলেকোঠায়। ধর্মতলার মোড়ে পুলিশ যখন লাঠিচার্জ শুরু করে, পিছু হটতে থাকা মিছিল তখন দমকা হাওয়ায় উড়তে থাকা পলিথিন বা কাগজের টুকরোর মতো ছড়িয়ে যায়। মনে হয়, অসংখ্য পলাশ-পাপড়ি উড়ছে, দুলছে, টাল খাচ্ছে হাওয়ায়। লাঠির বাড়ি থেকে বাঁচতে মানুষ লেনিন সরণি, এস এন ব্যানার্জি রোডের দু'ধারের দোকানের ভিতরে ঢুকে পড়ে। ঢুকে পড়ে মেট্রো গলিতে। বয়ে যায় তালতলার দিকে বা নিউ মার্কেটের চারপাশের ছোট ছোট নদীর মতো রাস্তায়, মসজিদের আনাচে কানাচে। শাটার নামিয়ে দেওয়া হয়। বন্ধ শাটারের নীচে রক্ত চলকে ওঠে কারও।
ওই বাড়ির চিলেকোঠা থেকে সবটুকুই দেখা যেত। লেনিনের ঠিক নিচেই একটা জানলা। ছিটকিনি নেই। বৃষ্টি শুরু হলে মেঝেতে পাতা বিছানা-বালিশ, বইপত্তর, পোস্টারের কাগজ, লাল শালু ভিজত। ওই ঘরেই নিজেদের নিবিড় চিনে নিত বন্ধুরা। যৌবনের রুমালে লেনিনকে আগলে রাখত তারা। আগলে রাখত, এমনকি, লেনিনিস্ট মডেলের থেকেও।
এরপরও আমার সঙ্গে লেনিনের দেখা হয়েছে বহুবার। কখনও ইডেনের পাশ দিয়ে হাঁটছেন, বাঁহাতে ফোলিও ব্যাগ। কখনও রবিবারের বিকেলে শহীদ মিনারের নিচে, একমনে দেখছেন দড়ির উপর হাঁটতে থাকা কিশোরকে। কখনও মধ্যরাত্রের রিপন স্ট্রিটে, কখনও ভবানীপুরের পুরনো গলিতে, ঢাকা, মিউনিখ, কাঠমাণ্ডু বা ভিয়েনার রাস্তায়। আমি প্রথমে দেখতে পাই লেনিনকে, তারপর দেখি তাঁর দীর্ঘ ছায়া, লেনিনিস্ট মডেলের শরীর।
একটা ভাতের হোটেল অথবা পেচ্ছাবখানা খোঁজার সময়, প্রিয় গানের ভুলে যাওয়া লিরিকের পিছনে ছুটতে গিয়ে, মাথার মধ্যে জেঁকে বসা কোনও নাছোড় পোস্টারের সঙ্গে বোঝাপড়ার ফাঁকে— লেনিনের সঙ্গে আমার মাঝেমধ্যেই দেখা হয়ে যায়।
(পুরনো লেখা। খানিক বদলে নতুন করে পোস্ট করতে ইচ্ছে হল।)