শুক্রবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২০

কৃষক আন্দোলন ও হান্নান মোল্লা ~ মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায়


২০১৮-র মার্চ মাসে মহারাষ্ট্রের কিষান লং মার্চ মনে আছে? প্রায় ৪০,০০০ থেকে ৫০,০০০ কৃষক মহারাষ্ট্র বিধানসভাকে ঘেরাও করার জন্য নাসিক থেকে মুম্বইয় যেতে ১৮০ কিলোমিটার পথ হেঁটেছিলেন। 
ওই অন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততা, দেশের প্রান্তিক মানুষের প্রধান বাণিজ্য নগরীতে আগমন, তাদের ছেঁড়া চপ্পল, টুটাফাটা চরণযুগল, ধ্রুপদী উপন্যাসের ভাবগম্ভীর আবহাওয়া সৃষ্টি করে। সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, অনেক গন্যমান্য দেশের দরিদ্রতম মানুষের পাশে থাকবার প্রতিশ্রুতি দেন।
তৎকালীন মহারাষ্ট্র সরকার দাবি পূরণের আশ্বাস দেওয়ার পরে এই আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। তবে অনেকেই জানেন না যে, সরকার ওদের দাবিগুলি মেনে নিলেও পরে কার্যকর করে নি।

ওই একই বছরে রাজস্থানে ন্যাশনাল হাইওয়ে ৫২-তে কয়েক হাজার কিসান বসুন্ধরা রাজে সরকারের কৃষকবিরোধী আইন ও পুলিশী দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। কৃষিকাজের ব্যয় বৃদ্ধি, লাভ হ্রাস এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে কৃষকরা উদ্বিগ্ন।

২০১৮-র শেষের দিকে নভেম্বরের শীতে লাল পতাকা ও ব্যানার বহনকারী কৃষকদের সমুদ্র পূর্ব দিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ পার্ক থেকে মধ্য দিল্লির রামলীলা ময়দান দখল করতে এগিয়ে এসেছিল।
তখন এক পুলিশকর্তা তার স্বাভাবিক উন্নাসিকতায় বলেছিলেন, "আমি বাজি ধরতে পারি যে এখানকার ৮০% কৃষক তাদের দাবি কী এমনকি তাও জানে না"। কয়েক মুহুর্ত পরে, হরিয়ানা থেকে তিনজন কৃষক তাকে বললেন, "এখনই আমাদের জিজ্ঞাসা করুন, আমরা আপনাকে বলে দেব আমাদের আন্দোলনের দাবিদাওয়াগুলি।"

২০১৩-তে বিবিসির রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৯৫ থেকে ২০১১-র মধ্যে অন্ততপক্ষে ২.৭ লক্ষ কৃষক আমাদের দেশে আত্মহত্যা করেছে।

শেষ কয়েক বছর ধরে সারা ভারতবর্ষে একের পর এক কৃষক আন্দোলন চলেছে। দাবি দাওয়া হয়তো ভিন্ন, তবে মূল সুর বাধা আছে এক তারে। ওরা দেশের মানুষকে মেসেজ দিতে চায় যে, কৃষকরা বিপন্ন। আর ওরা বিপন্ন হলে আমরা কেউ ভাল থাকব না। 

এই ফাঁকে একটা কথা একটু আলোচনা করা দরকার। কীভাবে সম্ভব হচ্ছে সারা ভারত জুড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে কৃষক আন্দোলন? কারা সংগঠিত করছে এদের?

২০১৭-তে ২৫০-টি কৃষক সংগঠন নিয়ে তৈরি হয়েছে 'অল ইন্ডিয়া কিষান সংঘর্ষ কোঅর্ডিনেশন কমিটি'। 
এই কমিটি এই বছরে সেপ্টেম্বর মাসে পাশ করা কেন্দ্রীয় সকারের তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। আর তাতে সহস্র সহস্র কৃষিজীবী মানুষ যোগ দিয়েছেন। পঞ্জাব, হরিয়ানা সহ দেশের অধিকাংশ রাজ্যের কৃষক এই আন্দোলনের পাশে আছেন।

এ এক যুগান্তকারী সময়।

আমাদের এই বহুধা বিভক্ত দেশে যেখানে প্রতিটি রাজ্যে আছে কয়েকটি আঞ্চলিক দল সেখানে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব ধরে রাখা তো সহজসাধ্য কাজ নয়।

সারা দেশ জুড়ে এই ধরণের মানুষের আন্দোলনে আছেন বামপন্থী আন্দোলনের নেতৃত্ব।

হান্নান মোল্লা 'সারা ভারত কিষান সভার সম্পাদক'। এই হাওড়ার মানুষ। বাবা ছিলেন জুট মিলের শ্রমিক। তায় আবার শৈশবেই পিতৃহারা। মায়ের সঙ্গে মামা বাড়িতে মানুষ। জুনিয়ার মাদ্রাসা থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজ। এই তার পূর্ববর্তী জীবন।
আর বর্তমানে দিল্লি পুলিশ তার বিরুদ্ধে নোটিস জারি করেছে কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্বে দেবার জন্য। কারণ সারা ভারত জুড়ে বিভিন্ন কৃষক সংগঠনগুলিকে একত্রিত করে, তাদের একসাথে চলতে শিখিয়েছে তার মত কিছু বামপন্থী মানুষ। তাদের নেতৃত্বে বিগত কয়েক বছরে কৃষক আন্দোলনগুলি ব্যাপক ভিত্তি পেয়েছে। এই নেতৃত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে এবং নিশ্চিত করেছে যে কৃষকের দাবিদাওয়াকে আর পাশ কাটিয়ে যাওয়া যাবে না।

এই আন্দোলনগুলি দেশের প্রান্তিক মানুষের জন্য সংগঠিত হয়েছে। এতে যারা যোগ দিয়েছেন, মনে ভাববার কোন কারণ নেই যে, তারা সকলে বামপন্থী। অনেকে সক্রিয় রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সরিয়ে রাখবার বাসনাই প্রকাশ করেছেন। তবে সারা ভারত কিষান সভা ও তার নেতৃত্বকে নয়। এরা ভালোই জানে, এদের ছাড়া আন্দোলনে সফলকাম হওয়া মুশকিল।

"In the ongoing farmer agitation, under the umbrella of the All India Kisan Sangharsh Coordination Committee (AIKSCC), Hannan brought together unions from different parts of the country — not just from Punjab. He has made farmer agitations broad-based in the last few years and ensured that they are not sidelined." বলেছেন সুরিন্দর সিং  কিষান সভার রোহতকের সম্পাদক।

আর অভীক সাহা, 'অল ইন্ডিয়া কিষান সংঘর্ষ কোঅর্ডিনেশন কমিটি'র সম্পাদক বললেন,"He's the most soft spoken of all the farmer leaders and has an amazing grasp of the issue as he has been a farmer leader for 40 years."

শেষ করি ছোট্ট একটা কথা দিয়ে। বাংলায় ২১-এর ভোট নিয়ে টানটান উত্তেজনা। টিভির সামনে বসলে মনে হবে টি-২০ ম্যাচ চলছে। কে কবে কোথায় আছেন সেসব মনে রাখতে মাইন্ড ম্যাপ তৈরি করতে হয়। 
এসব চলছে একটি কারণে, ভোট। ক্ষমতা দখল।

তার পাশে এই দীর্ঘ মেয়াদি আন্দোলনগুলি বড়ই পানসে। তবে এই দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন ছাড়া কোথাও মানুষের কোন দাবিদাওয়া সফলকাম হয় নি। দাবি আদায়ে গিমিক চলে না। ধর্ম, বর্ণ, জাতের লড়াইও চলে না। দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যেতে হয়। দিল্লির শীতের রাতে বা মহারাষ্ট্রে খর রদ্দুরে।

এই রাজ্যে বামপন্থীরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল। তাদের আন্দোলনে ভাটা পড়লে চলবে না। দেশের কৃষকদের থেকে এই রাজ্যকে শিখতে হবে।
মানুষের পাশে তাদের থাকার অঙ্গীকার ভোটের জন্য নয়। ক্ষমতার জন্য নয়।

ক্ষমতা চাই। তবে তা চাই প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নের জন্য। যেমন করে একদিন এই রাজ্যে দেশের মধ্যে প্রথম পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে, বর্গা প্রথা এসেছে, গ্রামের মানুষ প্রথম পয়সার মুখ দেখেছে। 
সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে হবে তাদের।

আর হ্যাঁ, সেই আন্দোলনে আসবে না হিন্দু কি মুসলমান প্রশ্ন, সে গ্রামের না শহরের মানুষ। অথবা সে কতটা জোরে আর কতটা খারাপ ভাষায় চেঁচিয়ে গালি দিতে পারে বিরোধীদের। 
সে হবে মাটি থেকে আন্দোলনের মাধ্যমে উঠে আসা নেতৃত্ব।

যেমন হান্নান মোল্লা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন