একটা পইলা বৈশাখ এসে গেল, হই হই করে, ফেসবুক কাঁপিয়ে. এই ডিজিটাল যুগে আমরা কিন্তু সেটুকু ই মাতি, যেটুকু সুযোগ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং আমাকে দেয়. মানে এই একটু স্ট্যাটাস আপডেট দিলাম: "শুভ নববর্ষ, সকলের ভালো হোক" বা দু লাইন কবিতা.একটু বিদ্রোহী যারা বা ফেসবুক এ নতুন, কিম্বা যারা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং এর নামে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন, তারা লিখবেন একটু বাঙালি হায় হায় জাতীয় বাক্য. অনেকে ই আছেন যারা ফেসবুক ইত্যাদি দু-চোখের বিষ বানিয়ে রেখেছেন, কিন্তু সুযোগ পেলেই একটু সমালোচনা, একটু কড়া ভাষায় স্ট্যাটাস আপডেট দিতে ভোলেন না. অনেকে আবার একটু মিষ্টি, একটু দই এর ছবি লাগাবেন. অনেক লাইক পড়বে, অনেকে কমেন্ট ছাড়বেন "জিভে জল এসে গেল". অনেক প্রবাসী বাঙালি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন আর পিপিটি বানাবেন অফিসে বসে. মোটের উপর, বেশ একটা সাজো সাজো রব, একদিনের জন্যে. অনলাইন কবিতা কম্যুনিটি আর লিটিল ম্যগাজিন এর সাইট গুলোতে কবিতা দেওয়ার ধুম পরে যাবে. কেউ লিখবেন রাবীন্দ্রিক ছন্দে, কেউ জীবনানন্দের ট্রামে কাটা পরা স্টাইলে আবার কেউ বা ভয়ানক বিদ্রোহ দিয়ে, তৃনমূল-সিপিয়েম এর গুষ্টি উদ্ধার করে, একটু কাঁচা খিস্তি দিয়ে ক্ষুধার্ত জেনারেশন কে ফিরিয়ে আনতে চাইবেন. ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে নতুন পোশাক টোশাক পরে ছবি লাগাবেন. ছেলেদের ছবিতে বন্ধুরা খিস্তি মেরে যাবে, মেয়েদের ছবিতে হাজার বিশেক লাইক আর কমেন্ট পড়বে. একটা দিনের উত্সব, বাঙালির নববর্ষ।
ফিরে যাই বছর কুড়ি আগে. যেদিন ১৩৯৯ থেকে ১৪০০ সন এলো. এই সময়টা আমার বিশেষ করে মনে আছে. কারণ নতুন শতাব্দিতে পা রাখার দিন. আমাদের স্কুলে এর আগের দিন একটু বিশেষ অনুষ্ঠান রাখা হয়েছিল, প্রধানশিক্ষক এর বক্তৃতা, সহ-প্রধানের স্মৃতিচারণ, গান, কবিতা পাঠ এইসব. মনে আছে সে সময়টা ছিল ভয়ানক গরম. আমাদের মফস্বল শহর, অদূরে কর্কটক্রান্তি রেখা গেছে কৃষ্ণনগর এর উপর দিয়ে. তাই চরম-ভাবাপন্ন আবহাওয়া. এই সময় স্কুল এর কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া র ছায়ায় ঢাকা চত্ত্বর, পুরনো মত কালো করিবর্গা দেওয়া ঠান্ডা আর অন্ধকার ঘর, পাশের চুর্নী নদীর ঠান্ডা বাতাস, আমাদের ঘরের চেয়ে স্কুল ই বেশি আকর্ষণ করত. আর সে সময় সোশ্যাল নেট\ওয়ার্কিং দুরে থাক, কম্পিউটার এর নাম ই পরেছি শুধু আনন্দমেলায়. আমাদের সময় কাটানোর সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিল খেলা. কাদা মাঠে ফুটবল, স্কুল শেষ হওয়ার পর স্কুল এর লম্বা করিডোর এ ৫০ গ্রাম বল এর ক্রিকেট আর কখনো স্কুল থেকে পালিয়ে হ্যাপী ক্লাব এর মাঠে "ফুল হ্যান্ড" ক্রিকেট. এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, আমাদের ক্রিকেট ছিল দু রকম. ছুড়ে বল করে ছোট করে খেলা হত "শর্ট হ্যান্ড". এখানে ৬ মারলে আউট হতে হত. আর লেদার বা টেনিসের ভারী বলে পরিপূর্ণ ক্রিকেট ছিল "ফুল হ্যান্ড". আরেকটু ছোটবেলায় খেলা হত সলিড রাবারের বলে, যাকে বলা হত "রাবার ডিউস". রাস্তায় খেলার সবচেয়ে বড় অসুবিধা ছিল ড্রেনে বল পড়া. সচরাচর ছোট ড্রেন হলে যে কেউ বল তুলে আনত. কিন্তু একটু বড় ড্রেনে বা ঘন ঝোপে বল গেলে তা খুঁজে তুলে আনার দায়িত্ব ছিল ব্যাটস্ম্যান এর, অর্থাত বলটার দুর্দশার যে কারণ, তার. আর বলাই বাহুল্য, রাবারের বলের সাথে ড্রেন এর পাঁক এর অদ্ভুত দুর্গন্ধ মিশে একটা খোলতাই গন্ধ বার হত, পরবর্তীকালে যে গন্ধ সচরাচর পেয়েছি দক্ষিনভারতীয় কুন্দরি দেওয়া রসম খাওয়ার সময় অথবা যে কোনো রোড সাইড অন্ধ্র ভাতের হোটেল এ।
সেই কুড়ি বছর আগের কথা, এখন স্মৃতিচারণ করতে গেলে একটু নস্টালজিক লাগে. সে বাড়িতে গরমের দুপুরে বসে বিকেলের কালবৈশাখীর জন্যে অপেক্ষা করাই হোক বা হালখাতায় সোনার দোকানে বাবার সাথে সাইকেল চরে গিয়ে কিছু ভালোমন্দ খাওয়াই হোক. তখন বছরের ছটা ঋতু আলাদা করে বোঝা যেত, আর দেখা যেত কালবৈশাখীর ঝড়. যারা নদীর উপরে কালবৈশাখী দেখেছেন, তারা জানেন যে সেরকম দৃশ্য শুধু বাংলাতেই দেখা যায়. আর হত শিলাবৃষ্টি. অ্যাসবেসটস আর টালির চালে চটর পটর শব্দ, মাঝে মাঝে মনে হত এই বুঝি চাল ভেঙ্গে মাথায় পড়ল. আবার কখনো স্টিলের গামলায় শীল ধরে সেটা রুটি দিয়ে খাওয়া, এখন সে সব ই স্বপ্ন মনে হয়।
নস্টালজিক হতে হতে একটা ভিশন গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বাদ চলে গেছিল. পইলা বৈশাখ এর সাথে যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত. সেটা হলো নতুন জামাকাপড়. আমার নতুন জামাকাপড় তখন সব ই আসত দাদু আর ঠাকুরদার কাছ থেকে. জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যে পইলা বৈশাখ এর কথা প্রথম মনে আছে, সেটা ছিল বোধ করি বছর ২৭ আগে. আমার বয়েস তখন ৪. তখন সকলের মুখে শুনে শুনে পয়লা বৈশাখ আমার নিজের মস্তিষ্কে পরিচিত বস্তুসমূহের সাথে সাদৃশ্য খুঁজতে গিয়ে পরিনত হয়েছে কয়লা বৈশাখে. প্রায় আরো দুই বছর আমি পয়লা বৈশাখ কে কয়লা বৈশাখ বলতাম, এবং শেষ বছর শুধু বাড়ির সকলকে নির্মল আনন্দ-প্রদানের জন্য. এটা আমার স্পষ্ট মনে আছে. তো সেই কয়লা বৈশাখে, ২৭ বছর আগে, আমার দাদু আমাকে দিয়েছিলেন একটা নীল রঙের জামা. সেই জামার কাপড়টা ছিল অত্যন্ত কড়কড়ে আর মোটা. অত গরমে বার দুয়েক পরেই ওই জামার প্রতি আমার ভয়ানক বিতৃষ্ণা জন্মেছিল. আমি বলতাম কুটকুটে জামা, আর মা জামাটা বের করলেই ছুটে পালিয়ে যেতাম, যাতে পড়তে না হয়. দাদু বোধ হয় আমার এই বিসদৃশ ব্যবহারে কিছুটা বিব্রত হয়ে কিছুদিন বাদে আমাকে একটা লাল নোটবই, একটা চেল্পার্ক এর নিবপেন আর একটা স্টিলের জগ কিনে দিয়েছিলেন।
দাদু চলে গেছেন আজ প্রায় ১০ বছর হয়ে গেল. চাকরি পাওয়ার পর, বিদেশে যাওয়ার পর, বাংলা ছাড়ার, নিজের বাড়ি ছাড়ার পর অনেক গুলো পয়লা বৈশাখ কেটে গেছে. অনেক সুন্দর, আরামদায়ক জামা ও কিনেছি আর উপহার পেয়েছি. কিন্তু সেই নীল কুটকুটে জামা আমৃত্যু ভোলা সম্ভব নয়।
আজ আমার ছেলের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে দেখিনি. কারণ জানি, এটা আলাদা সময়, যে দূরত্ত্ব, যে জেনারেশন গ্যাপ তৈরী হয়, সেটাকে জোর করে মুছে ফেলার বা অস্বীকার করার চেষ্টা না করে, সেটাকে প্যরালাল ওয়ার্ল্ড এ রেখে এগিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ, বিচক্ষনতাও বটে।
আজ যে ফেসবুক নিয়ে পয়লা বৈশাখে মেতে আছি, আমাদের আগের জেনারেশন বা আমাদের ছোটবেলায় তা কল্পনাতীত ছিল. আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা এমন একটা সন্ধিক্ষণে জন্মেছি, যারা দুটো বিশ্বকেই দেখেছে. ডিজিটাল হওয়ার আগের মানবিক সময় আর ডিজিটাল ভার্চুয়াল একটা সময়ের বিশ্ব. কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ এর বিচার করার কোনো প্রয়োজন বা সার্থকতা দেখিনা. শুধু মনে মনে আগের সেই সময়গুলো বড় বেশি করে টানে. হয়ত ঠিক সেই কারণেই, যে কারণে শিশুরা মাতৃগর্ভে থাকার সময় বা জন্মানোর পর বিচিত্র মুখভঙ্গি করে হাসে, যাকে বলে দেয়ালা, আগেকার দিনে ঠাকুমা বা দিদিমা রা বলতেন "আগের জন্মের কথা ভেবে হাসছে". আমরা ও ঠিক সেইরকম ফেলে আসা সময়ের কথা ভেবে স্বস্তি পাই, নস্টালজিক হই, হাসি বা ভালোলাগার অনুভূতি নিই. আজ পয়লা বৈশাখের দিনে সেই সময়ে ফিরে যেতে পারলে মনে হয় বেশ ভালো হত. কুড়ি বছর আগের সেই পয়লা বৈশাখ, সেই স্কুল এর মাঠ, সেই চুর্নী নদী, সেই কালো করিবর্গার ঘর, সেই গরমের দুপুরে বেল এর সরবত, সেই চৈত্রের সেল, সেই সব মানুষগুলো, যাদের বেশিরভাগ ই হারিয়ে গেছেন।