মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৩

অমল ও বইওয়ালা (নো অফেন্স মেন্ট!) ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য়

বইওআলা। বই -- বই -- ভালো বই!

অমল। বইওআলা, বইওআলা, ও বইওআলা!

বইওআলা। ডাকছ কেন? বই কিনবে?

অমল। কেন কিনব! আমি তো ই-বুক পড়ি।

বইওআলা। কেমন ছেলে তুমি। কিনবে না তো আমার বেলা বইয়ে দাও কেন?

অমল। আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতুম তো অন্য ব্যবসা করতুম।

বইওআলা। অন্য ব্যবসা!

অমল। হাঁ। তুমি যে কত হাঁক পেড়েও কিছু বিক্রী করতে পারছ না তা দেখে আমার মন খারাপ লাগছে।

বইওআলা। (বইর ব্যাগ নামাইয়া) বাবা, তুমি কি বিজনেস কনসাল্ট্যান্ট?

অমল। আমি তো ফেসবুকের ওপর ডক্টরেট করছি তাই আমি সারাদিন ল্যাপটপ খুলেই বসে থাকি।

বইওআলা। আহা, বাছা তোমার কী হয়েছে?

অমল। আমি বড় হয়েছি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শিখেছি। বইওআলা, তুমি কোথা থেকে আসছ?

বইওআলা। আমাদের গ্রাম থেকে আসছি।

অমল। তোমাদের গ্রাম? অনে--ক দূরে তোমাদের গ্রাম?

বইওআলা। আমাদের গ্রাম সেই পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায়। শামলী নদীর ধারে।

অমল। পাঁচমুড়া পাহাড় -- শামলী নদী -- কী জানি,হয়তো গুগল ম্যাপে তোমাদের গ্রাম দেখেছি -- কবে সে আমার মনে পড়ে না।

বইওআলা। তুমি দেখেছ? পাহাড়তলায় কোনোদিন গিয়েছিলে নাকি?

অমল। না, কোনোদিন যাই নি। কিন্তু আমি ছবি দেখেছি। অনেক পুরোনোকালের খুব বড়ো বড়ো গাছের তলায় তোমাদের গ্রাম -- একটি লাল রঙের রাস্তার ধারে। না?

বইওআলা। ঠিক বলেছ বাবা।

অমল। সেখানে পাহাড়ের গায়ে সব গোরু চরে বেড়াচ্ছে।

বইওআলা। কী আশ্চর্য! ঠিক বলছ। আমাদের গ্রামে গোরু চরে বই কি, খুব চরে।

অমল। মেয়েরা সব নদী থেকে জল তুলে মাথায় কলসী করে নিয়ে যায় -- তাদের লাল শাড়ি পরা।

বইওআলা। বা! বা! ঠিক কথা। আমাদের সব গয়লাপাড়ার মেয়েরা নদী থেকে জল তুলে তো নিয়ে যায়ই। তবে কিনা তারা সবাই যে লাল শাড়ি পরে তা নয় -- কিন্তু বাবা, তুমি নিশ্চয় কোনোদিন সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলে!

অমল। সত্যি বলছি বইওআলা, আমি একদিনও যাই নি। ঘরে বসেই যদি সব জানা যায় তাহলে কী দরকার গিয়ে তোমাদের গ্রামে?

বইওআলা। ঠিক কথা বাবা, খুব সত্যি কথা!

অমল। আমি বরং তোমায় অনলাইন বই বেচতে শিখিয়ে দেব। ঐরকম ব্যাগ কাঁধে নিয়ে -- ঐরকম খুব দূরের রাস্তা দিয়ে আর তোমাকে ঘুরে বেড়াতে হবে না।

বইওআলা। মরে যাই! বই বেচতে যাব কেন বাবা। আমি আর তুমি মিলে বরং ও এল এক্স এর মতো কিছু সাইট খুলব।

অমল। না, না, আমি কক্‌খনো অনলাইনে ব্যবসা করব না। আমি একটা বিজনেস কন্সাল্টেন্সি ফার্ম খুলব। একে ওকে শুধু উপদেশ দেব, প্রয়োজনে ট্রেনিং ও দেব।

বইওআলা। হায় পোড়াকপাল! এ কেরিয়ার ও কি কোনো কেরিয়ার হল!

অমল। না, না, এ আমার অনেক দিনের স্বপ্ন। ওয়াই ফাই খুব স্ট্রং হলে যেমন অনেক দূর থেকে নেট কানেক্ট করা যায় -- তেমনি ঐ রাস্তার মোড় থেকে ঐ গাছের সারির মধ্যে দিয়ে যখন তোমার ডাক আসছিল, আমার মনে হচ্ছিল – ফেসবুকে ডক্টরেট করা হয়ে গেলে আমাকে কন্সাল্টেন্সি ফার্ম খুলতেই হবে!

বইওআলা। বাবা, এই এক ব্যাগ বই তুমি রাখো।

অমল। আমার তো বাজেট অ্যালোকেটেড নেই।

বইওআলা। না না না না -- বাজেটের কথা বোলো না। আমার বইগুলো বিদেয় হলে আমি কত খুশি হব।

অমল। তোমার কি অনেক দেরি হয়ে গেল?

বইওআলা। কিচ্ছু দেরি হয় নি বাবা, আমার কোনো লোকসান হয় নি। বই বেচা যে কত ওয়েস্ট অফ টাইম সে তোমার কাছে শিখে নিলুম।

সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৩

গেছো দাদার পপাত চ ~ অনির্বান সরকার

​বেজায় পেট গরম। AC চালিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছি, তবু ঘেমে অস্থির।।কাল আবার ডার্বি। ..আবার হার?| টেবিলের উপর রুমালটা ছিল, ঘাম মুছবার জন্য যেই সেটা তুলতে গিয়েছি অমনি রুমালটা বলল ``মাচা !'' কি আপদ! রুমালটা মাচা মাচা করে কেন?
চেয়ে দেখি রুমাল তো আর রুমাল নেই, দিব্যি মোটা-সোটা লাল টক্‌টকে একটা বেড়াল গোঁফ ফুলিয়ে প্যাট্ প্যাট্ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে!
আমি বললাম, ``কি মুশকিল! ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল।''
অমনি বেড়ালটা বলে উঠল, ``মুশকিল অবার কি? ছিল একটা পোকা , হয়ে গেল দিব্যি একটা মাছ । এ তো হামেশাই হচ্ছে।''
আমি খানিক ভেবে বললাম, ``তা হলে তোমায় এখন কি বলে ডাকব? তুমি তো সত্যিকারের বেড়াল নও, আসলে তুমি হচ্ছ রুমাল।''
বেড়াল বলল, ``বেড়ালও বলতে পার, রুমালও বলতে পার, অবনমন ও বলতে পার।'' আমি বললাম, ``অবনমন কেন?''
শুনে বেড়ালটা ``তাও জানো না?'' বলে এক চোখ বুজে ফ্যাচ্‌ফ্যাচ্ করে বিশ্রীরকম হাসতে লাগল। আমি ভারি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মনে হল, ঐ অবনমন এর কথাটা নিশ্চয় আমার বোঝা উচিত ছিল। তাই থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম, ``ও হ্যাঁ-হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি।''
বেড়ালটা খুশি হয়ে বলল, ``হ্যাঁ, এ তো বোঝাই যাচ্ছে--- অবনমন এর মা , বেড়ালের চন্দ্রবিন্দু, রুমালের চা --- হল মাঁচা । কেমন, হল তো?''
আমি বললাম, ``চন্দ্রবিন্দু কেন?' বেড়ালটা আবার হাসলো -- "এটাও বুঝতে পারছ না ভায়া?"
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, কিন্তু পাছে বেড়ালটা আবার সেইরকম বিশ্রী করে হেসে ওঠে, তাই সঙ্গে সঙ্গে হুঁ-হুঁ করে গেলাম। তার পর বেড়ালটা খানিকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাত্‍‌ বলে উঠল, ``গরম লাগে তো সেকেন্ড ডিভিশন এও তো খেলতে পারো।''
আমি বললাম, ``বলা ভারি সহজ, কিন্তু বললেই তো আর সেটা করা যায় না?''
বেড়াল বলল, ``কেন, সে আর মুশকিল কি?''
আমি বললাম, `পাবলিক এর ভয় , সমর্থকেরা কি বলবে? তুমি কোনো উপায় জানো? তাহলে বাতলে দাও ''
বেড়াল একগাল হেসে বলল, ``তা আর জানি নে? কলকাতা , ডায়মন্ডহারবার, রানাঘাট, তিব্বত, ব্যাস্! সিধে রাস্তা, সওয়া ঘণ্টার পথ, তারপর শীর্ষাসন , কঠিন অনুশীলন , no ফাকিবাজি। মাঝে মাঝে প্রাণায়াম ও করতে পারো তো , খুব কাজের জিনিস ।''
আমি বললাম 'প্রাণায়াম করলেই জিতে যাবো?'
বেড়াল রেগে গিয়ে বলল 'সেটা আমি কখন বললাম ।ওটা করলে ধৈর্য বাড়বে । হার টাকে sportingly মেনে নিতে পারবে '
আমি বললাম, ``'তা হলে দায়িত্ব টা তুমি নিতে পার?''
শুনে বেড়ালটা হঠাত্‍‌কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। তার পর মাথা নেড়ে বলল, ``উঁহু, সে আমার কর্ম নয়। আমার গেছোদাদা যদি থাকত, তা হলে সে ঠিক-ঠিক বলতে পারত।''
আমি বললাম, ``গেছোদাদা কে? তিনি থাকেন কোথায়?''
বেড়াল বলল, ``গেছোদাদা আবার কোথায় থাকবে? Austrelia''
আমি বললাম, ``কোথায় গেলে তাঁর সাথে দেখা হয়?''
বেড়াল খুব জোরে মাথা নেড়ে বলল, সেটি হচ্ছে না, সে হবার জো নেই।''
আমি বললাম, ``কিরকম?''
বেড়াল বলল, ``সে কিরকম জানো? মনে কর, তুমি যখন যাবে উলুবেড়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন মতিহারি গাঁজার ঠেকে। যদি মতিহারি যাও, তা হলে শুনবে তিনি আছেন রামকিষ্টপুর দুগ্গা পুজোর ভাসানে। আবার সেখানে গেলে দেখবে তিনি গেছেন কাশিমবজার ছট পুজো কমিটির মিটিং attend করতে । কিছুতেই দেখা হবার জো নেই।''
আমি বললাম, ``তা হলে তোমরা কি করে দেখা কর?''
বেড়াল বলল, ``সে অনেক হাঙ্গাম। আগে হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় নেই; তার পর হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় থাকতে পারে; তার পর দেখতে হবে, দাদা এখন কোথায় আছে। তার পর দেখতে হবে, সেই হিসেব মতো যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছবে, তখন দাদা কোথায় থাকবে। তার পর দেখতে হবে---''
আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম, ``সে কিরকম হিসেব?''
বেড়াল বলল, ``সে ভারি শক্ত। জ্যামিতি ছিল ছোটোবেলায়?'' এই বলে সে একটা কাঠি দিয়ে ঘাসের উপর লম্বা আঁচড় কেটে বলল, ``এই মনে কর গেছোদাদা ।'' বলেই খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে চুপ করে বসে রইল।
তার পর আবার ঠিক তেমনি একটা আঁচড় কেটে বলল, ``এই মনে কর তুমি,'' বলে আবার ঘাড় বাঁকিয়ে চুপ করে রইল।
তার পর হঠাত্‍‌ আবার একটা আঁচড় কেটে বলল, ``এই মনে কর চন্দ্রবিন্দু।'' এমনি করে খানিকক্ষণ কি ভাবে আর একটা করে লম্বা আঁচড় কাটে, আর বলে, ``এই মনে কর তিব্বত---'' ``এই মনে কর গেছোবৌদি ইলিশ রান্না করছে---'' ``এই মনে কর গাছের গায়ে একটা ফুটো---ইলিশ ভাপা ,ইলিশ পাতুরি, দৈ ইলিশ ... ''

এইরকম শুনতে-শুনতে শেষটায় আমার কেমন রাগ ধরে গেল। আমি বললাম, ``দূর ছাই! কি সব আবোল তাবোল বকছে, একটুও ভালো লাগে না .... ক্ষিদে পাচ্ছে''
বেড়াল বলল, ``ও আচ্ছা, তোমার তো আবার পেট গরম ..ইলিশ হজম হবে না ।'' আমি চোখ বুজলাম।
চোখ বুজেই আছি, বুজেই আছি, বেড়ালের আর কোনো সাড়া-শব্দ নেই। হঠাত্‍‌ কেমন সন্দেহ হল, চোখ চেয়ে দেখি বেড়ালটা ল্যাজ খাড়া করে বাগানের বেড়া টপকিয়ে পালাচ্ছে আর ক্রমাগত ফ্যাচ্‌ফ্যাচ্ করে হাসছে।
কি আর করি, ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ব্যলকনিতে গিয়ে বসলাম । বসতেই কে যেন ভাঙা-ভাঙা মোটা গলায় বলে উঠল, ``লাস্ট কবে বড় ট্রফি হাতে নিয়েছ খোকা ?''
আমি ভাবলাম, এ আবার কে রে? এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি, এমন সময় আবার সেই আওয়াজ হল, ``কই জবাব দিচ্ছ না যে? শেষ কবে জিতেছ?'' তখন উপর দিকে তাকিয়ে দেখি, একটা দাঁড়কাক শ্লেট পেনসিল দিয়ে কি যেন লিখছে, আর এক-একবার ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে।
আমি বললাম, ``২০১২ ''
কাকটা অমনি দুলে-দুলে মাথা নেড়ে বলল, ``হয় নি, হয় নি, ফেল্।''
আমার ভয়ানক রাগ হল। বললাম, ``নিশ্চয় হয়েছে। ২০১২ কলকাতা ফুটবল লীগ।''
কাকটা কিছু জবাব দিল না, খালি পেনসিল মুখে দিয়ে খানিকক্ষণ কি যেন ভাবল। তার পর বলল, ``দু হাজার বারোর নামে হরিবল , হাতে রইল কাচকলা , ঘন্টার মাথা !''
আমি বললাম, ``তবে যে বলছিলে ২০১২ তে পাই নি ? এখন কেন?''
কাক বলল, ``কাচকলা কোনো ট্রফির নাম নয় । তুমি যখন বলেছিলে, তখনো পুরো ট্রফি হয় নি। ওটা ছিল, রানার্স ট্রফি । আমি যদি ঠিক সময় বুঝে ধরে না ফেলতাম, তা হলে এতক্ষণে ওটাকেই বড় ট্রফি বলে চালিয়ে দিতে ।''
আমি বললাম, ``এমন আনাড়ি কথা তো কখনো শুনি নি। ট্রফি মানে ট্রফি , তা সে বড় হোক ছোটো হোক অথবা পুচকে । তা সে পাড়ার খেলা হলেও ট্রফি আবার স্বান্তনা পুরস্কার হলেও ।''
কাকটা ভারি অবাক হয়ে বলল, ``তোমাদের ক্লাবে winners ট্রফির কোনো দাম নেই বুঝি?''
আমি বললাম, ``winners ট্রফি!! সেটা কিরকম?''
কাক বলল, ``পাসের ক্লাবে কদিন থাকতে, তা হলে বুঝতে।ওদের তো ট্রফি রাখার আর জায়গাই নেই ।প্রতি বছর এত্তগুলো করে । এই তো কদিন খেটেখুটে খানিকটে সময় জমিয়েছিলাম, তাও তোমার সঙ্গে তর্ক করতে অর্ধেক খরচ হয়ে গেল।'' বলে সে আবার হিসেব করতে লাগল। আমি অপ্রস্তুত হয়ে বসে রইলাম।
এমন সময়ে হঠাত্‍‌গাছের একটা ফোকর থেকে কি যেন একটা সুড়ুত্‍‌ করে পিছলিয়ে মাটিতে নামল। চেয়ে দেখি, দেড় হাত লম্বা এক বুড়ো, তার পা পর্যন্ত সবুজ রঙের দাড়ি, হাতে একটা হুঁকো তাতে কলকে-টলকে কিচ্ছু নেই, আর মাথা ভরা টাক। টাকের উপর খড়ি দিয়ে কে যেন কি-সব লিখেছে।
বুড়ো এসেই খুব ব্যস্ত হয়ে হুঁকোতে দু-এক টান দিয়েই জিজ্ঞাসা করল, ``কই হিসেবটা হল?কবে শেষ বার ট্রফি পেয়েছিল''
কাক খানিক এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, এই হল বলে।''
বুড়ো বলল, ``কি আশ্চর্য! উনিশ দিন পার হয়ে গেল, এখনো হিসেবটা হয়ে উঠল না?''
কাক দু-চার মিনিট খুব গম্ভীর হয়ে পেনসিল চুষল তার পর জিজ্ঞাসা করল, ``কতদিন বললে উনিশ ?তা সে লাগবে না সে কি আজকের কথা -- stone age ছিল তখন ''
কাক অমনি গলা উঁচিয়ে হেঁকে বলল, ``লাগ্ লাগ্ লাগ্ দু হাজার বারো ।''
বুড়ো বলল, ``এগারো ।'' কাক বলল, ``দশ ।'' বুড়ো বলল, ``নয় ।'' ঠিক যেন নিলেম ডাকছে।
ডাকতে-ডাকতে কাকটা হঠাত্‍‌ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ``তুমি ডাকছ না যে?''
আমি বললাম, ``খামকা ডাকতে যাব কেন? আমি তো জানি ২০০৯ সুপার কাপ ''
বুড়ো এতক্ষণ আমায় দেখে নি, হঠাত্‍‌আমার আওয়াজ শুনেই সে বন্‌বন্ করে আট দশ পাক ঘুরে আমার দিকে ফিরে দাঁড়াল।
তার পরে হুঁকোটাকে দূরবীনের মতো করে চোখের সামনে ধরে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার পর পকেট থেকে কয়েকখানা রঙিন কাঁচ বের করে তাই দিয়ে আমায় বার বার দেখতে লাগল। তার পর কোত্থেকে একটা পুরনো দরজির ফিতে এনে সে আমার মাপ নিতে শুরু করল, আর হাঁকতে লাগল, ``I League (ন্যাশনাল ফুটবল League) এ ১৩-১০ ,ফেডারেশন কাপে ৮-৫,Calcutta ফুটবল লীগ এ ৪৮-৪৩ , I.F.A. শিল্ড এ ২০-৭,ডুরান্ড কাপে ৮-৬, রোভার্স কাপে ৪-৪, এয়ারলাইন্স ট্রফি তে ৭-১ -- আর পারছি না আমি হিসেব করতে ।সর্ব সাকুল্যে ১১৫-৮৫।''
আমি ভয়ানক আপত্তি করে বললাম, ``এ হতেই পারে না। বুকের মাপও ছাব্বিশ ইঞ্চি, গলাও ছাব্বিশ ইঞ্চি? আমি কি ইলতুতমিস? নিশ্চই রেফারির কারসাজি । ব্যাটাদের বিশ্বাস নেই ''
বুড়ো বলল, ``বিশ্বাস না হয়, wikipedia দেখ।''
দেখলাম ফিতের লেখা-টেখা সব উঠে গিয়েছে, খালি ২৬ লেখাটা একটু পড়া যাচ্ছে, তাই বুড়ো যা কিছু মাপে সবই ছাব্বিশ ইঞ্চি হয়ে যায়।
তার পর বুড়ো জিজ্ঞাসা করল, ``ওজন কত?''
আমি বললাম, ``জানি না!''
বুড়ো তার দুটো আঙুল দিয়ে আমায় একটুখানি টিপে-টিপে বলল, `থাক অনেক হয়েছে ওটা সবাই জানে।২-৩ তো হবেই চোখ বুজে `।''
আমি বললাম, ``সেকি, পটল টার ওজনই তো একুশ সের, সে আমার চাইতে দেড় বছরের ছোটো।''
কাকটা অমনি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ``সে তোমাদের হিসেব অন্যরকম।''
বুড়ো বলল, ``তা হলে লিখে নাও--- ওজন আড়াই সের, বয়েস একশ চব্বিশ।''
আমি বললাম, ``দূত্‍‌!আমার বয়স হল আট বছর তিনমাস, বলে কিনা একশ চব্বিশ।''
বুড়ো খানিকক্ষণ কি যেন ভেবে জিজ্ঞাসা করল, ``বাড়তি না কমতি?'' কাক মাথা নিচু করে বলল , 'পড়তি । আবার ঝরতি ও বলতে পারো।'
আমি বললাম, ``সে আবার কি?''
বুড়ো বলল, ``বলি বয়েসটা এখন বাড়ছে না কমছে?''
আমি বললাম, ``বয়েস আবার কমবে কি? তবে লাস্ট ৫-৬ বছর ধরে কোনো হিসেব কাজ করছে না''
বুড়ো বলল, ``তা নয় তো কেবলই বেড়ে চলবে নাকি? তা হলেই তো গেছি! কোনদিন দেখব বয়েস বাড়তে বাড়তে একেবারে ষাট সত্তর আশি বছর পার হয়ে গেছে। শেষটায় ঝাপি বন্ধ হয়ে যায় আর কি ! যা দিন কাল লোকের ক্ষোভ ক্রমশ যে হারে বাড়ছে নতুন ফর্মুলা আবিস্কার না হয়ে যায় আবার ।আর ওদের ই বা দোষ কিসের এইটুকু আপদার তো থাকতেই পারে ।কষ্ট হয় দেখলে ''
আমি বললাম, ``তা তো হবেই। আশি বছর বয়েস হলে মানুষ বুড়ো হবে না!''
বুড়ো বলল, ``তোমার যেমন বুদ্ধি! আশি বছর বয়েস হবে কেন? সেবার তো অবনমন ছিল, এক কম হবে''।.ঠিক কি না ?. শুনে আমার গা পিত্তি জ্বলে গেলো।
কাক বলল, ``তোমরা একটু আস্তে আস্তে কথা কও, আমার হিসেবটা চট্‌পট্ সেরে নি।

(সুকুমার রায়ের আশ্রয় নিলাম)

মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩

কুমিরডাঙা ~ অনামিকা মিত্র

খাল কেটেছি, কুমির এল তার কিছুটা পরে
আসুন হুজুর বসুন হুজুর চেঁচাই সমস্বরে
কুমির হাসেন বসব কি রে, সামনে অনেক কাজ যে!
সবকিছুতেই গিঁট বেধেছে তোদের পোড়া রাজ্যে।
আমার আবার কাজ ছাড়া আর ভাল্লাগে না কিচ্ছু।
অ্যাদ্দিন সব চলছে যা তা। আমলারা সব বিচ্ছু।
সবটা আমিই সামলে দেব। আমরা শুধোই, কবে? 
সয় না সবুর, দেশ ভরে যায় উৎসবে উৎসবে।
উৎসব কি একরকমের? হাজার রকম বায়না।
স্বদেশ থেকে ব্যাঘ্রকে চাই, বিদেশ থেকে হায়না।
বাঘ হায়নার পরেও আছেন নানান রকম জন্তু
সবার জন্য উত্তরীয়, রত্ন অধিকন্তু। 
দানছত্রেই ফুরোয় যদি কষ্টে জোগাড় অর্থ,
হতাশ বলি, উৎসবই কি এই যজ্ঞের শর্ত?
উৎসবে আর নিভছে না যে দগ্ধ পেটের অগ্নি
কুমির বলেন ঠিক বুঝেছিস প্রাজ্ঞ ভ্রাতা ভগ্নী
এই কথাটাই আজ না বুঝে বুঝতি যদি কালকে
আমার আসার আশায় থেকে কাটতি না এই খালকে।
কান্নাকাটি ঢাকতে এ'বার বাজুক কাঁসর বাদ্য।
আমারও খুব পাচ্ছে খিদে, তোরাই তো সেই খাদ্য।

শনিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৩

বাজার অর্থনীতি ~ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়

শুনতে পেলাম বাজার গিয়ে
পেঁয়াজ না কি বড্ড ইয়ে,
ওমলেট-টার আশা ছেড়ে,
থলি হাতে লেজটা নেড়ে -
গুটিগুটি আলুর দিকে,
"দাম কতো?" শুধোই হেঁকে
জবাব আসে, "কিলোয় ষাট।"
ঘোরে বনবন বাজার হাট।
ভাবি একবার - "খাবো শাক।"
মাছের গন্ধ মাতায় নাক।
থাক না কেন, পকেট ঢিলে,
ভাবলে মাথা নেবেই চিলে।
নড়েই গেল বুদ্ধির গোড়া,
রাতে ভাতে কচুপোড়া।
 

শনিবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৩

​ভবসাগর-কারণ ~ অমিতাভ প্রামাণিক

সংসারে আর মন টেঁকেনা, এ ঘরখানায় দশ ফুটে
বন্দী থাকি আর কতকাল, তাই বলে যাই অস্ফুটে
হাড্ডাহাড্ডি লড়বো না, ঘাম ঝরাবো না, কি রক্ত –
এবার আমি বেরিয়ে যাব, কী লাভ, হয়ে বিরক্ত?
খুব ভয়ে রোজ বাজারে যাই সকাল বেলা দশটাতে,
এদিক ওদিক খুঁজে বেড়াই কে দিচ্ছে কী সস্তাতে।
মাছ কিনতুম যার কাছে, আজ সমঝে গেছি, বজ্জাত এ –
কী অপমান করছে দাদা, যাচ্ছিনে তাই লজ্জাতে।
সবজি বাজার? হাল একই তার, কী দাম, কী দাম, জঘন্য!
কেজি না আজ, আড়াইশো গ্রাম, পকেটের হাল নগণ্য।
ফিরলে বাড়ি গিন্নী চ্যাঁচান, আসেন তেড়ে বাঁশ তুলে;
ভাবছি এবার জাহাজঘাটায় পাল তুলে দি মাস্তুলে।
এতদিন তো কাটলো জীবন, করে পরের দাসত্ব –
এবার একাই বেরিয়ে যাব, তাই লিখে যাই, যা সত্য।
ভুল গাছে রোজ জল দিয়েছি, একটা ফলও না ফললো,
ঐ ফেলুদা সব পেয়েছে, এই ফেলুর কী সাফল্য?
বিয়ের আগে ভেবেছিলেম, যে মেয়েটা লাবণ্য,
দু তিনটে যুগ ঘর করে আজ দেখছি তাকে, কী বন্য!

ভাবছ আমি ফ্রাস্টু খেয়ে লিখছি বসে যা সত্যি?
ভীমরতি তো একটু হবেই বয়স হলে বাষট্টি!

৯ নভেম্বর ২০১৩

শুক্রবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৩

ছাগলের সেজ ছানার গল্প ~ অরুণাচল দত্তচৌধুরি


সিরিজ খবর জানবি পরে, প্রথম খেলার খসরা নে।
তিনদিনে ম্যাচ জিতলি বটে, ঈশ্বর আউট দশ রানে।

এ'সব কথায় ঘাবড়াব না, থাকবে লেখা সব বইয়ে,
ঠিক কতটা উল্লসিত ছিলাম একশ' নব্বইএ।

অফিস কেটে… মুখোস পড়ে… হল্লাবাজির দৃশ্য ঢের। 
হেডলাইনের টেল লাইনের, সকল ছবিই ঈশ্বরের।

ঠান্ডা ঘরে টিভির ভেতর চলুক খেলার বিশ্লেষণ।
তার মধ্যেই বিজ্ঞাপনের নানান রঙিন বিষ লেসন। 

আলুর আকাল… বাংলা নাকাল, ও'সব ভাবার দিক ছাড়ো।
পাগড়ি পড়াও ইনাম সাজাও তার সাথে দাও পিকচারও। 

এরপরে কি? দিন যাপনের দুঃখ ভোলায় বল্ কে আর।
চিন্তাটি নট। আসছে বিকট… দুঃখহরণ ফিল্মফেয়ার।

​নভেম্বর মাস এলে ~ অনামিকা মিত্র

নভেম্বর মাস এলে তার কথা মনে পড়ে যায়
মনে পড়ে ইতিহাসে আমাদের লেখা ছিল নাম
নভেম্বর মাস এল। ছিঁড়ে যাওয়া লাল পতাকায়
আবার নিজেকে লিখে গর্বে আকাশে ওড়ালাম।

বিপ্লব মানে কোনও বুথজ্যাম ভোটবাজী নয়
বিপ্লব নয় কোনও সরকারি আলু বা পেঁয়াজ।
সারদার টাকা গাপ, ওয়াকফ ফান্ড নয়ছয়,
বিপ্লব নয় কোনও অভিনয়… মৌলবাদী ভাঁজ।

সময় সমস্ত খায়, প্রতিজ্ঞা প্রতিভা ও মেধা।
মধ্যবিত্ত সময়ের প্যাঁচে পড়ে কেউ পাচু রায়।
তবুও বিপ্লব থাকে মগজের মাঝখানে বেঁধা।
বিপ্লবের স্বপ্ন ছাড়া বাঁচবার থাকে না উপায়!

সভ্যতা বিক্রি করে ঝানু যত দাসব্যবসায়ী।
নষ্ট হয়ে যাই রোজ। ভুল স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে বাঁচি।
বিপ্লব আসেনি আজও। তার জন্য আমি একা দায়ী।
আমিই চাইনি তাকে। খেলে গেছি ভুল কানামাছি।

আবর্তিত হতে থাকে এ'গ্রহের ভূত ভবিষ্যৎ।
আমাদের চেতনায় জেগে থাকে বাঁচার প্রয়াস।
ভাঙা পথে ঘরে ফেরে আমাদের হারানো শপথ
বারবার ফিরে আসে বিপ্লবের নভেম্বর মাস।

মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৩

ভ্রাতৃদ্বিতীয়া ~ অমিতাভ প্রামাণিক


বিবস্বতমুনির পুত্র নরকরাজ যমদেবের বোন যমুনা। বিয়ের পর যমুনা ভাই যমরাজকে নেমন্তন্ন করলেও নরকে পাপীতাপীদের নিয়ে হাজারটা কাজে ব্যস্ত থাকায় যম বোনের শ্বশুরবাড়ি আসার সময় পায়না। অবশেষে কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ায় যম চিত্রগুপ্তকে চার্জ বুঝিয়ে কোনোরকমে একদিন ছুটি নিয়ে যমুনার বাড়ি গেল। যমুনা তো ভাইকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। নিজের হাতে ভাইয়ের কপালে সুগন্ধী চন্দনের ফোঁটা দিলো, রান্না করে ভাইকে খাওয়ালো ভালোমন্দ এটাসেটা। যমের অরুচি গেল কেটে। যমরাজ অত্যন্ত খুশি হয়ে ভুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে যমুনাকে বলল, বল, কী বর চাই তোর? যমুনা বলল, বরই যদি দিস দাদা, এমন বর দে যেন আজকের দিনে যে ভাই বোনের হাতে ফোঁটা নেবে সে কোনদিন নরকদর্শন করবে না, সে অমর হবে, তার হবে অখণ্ড পরমায়ু। 

বোনের যত্ন-আত্তি পেয়ে আর পেটপুরে খেয়ে যমরাজ খুশিই ছিল। বললো, তথাস্তু।

এই তো, গল্পটা? এ রকম আরো আছে, একাধিক। নরকাসুরকে বধ করে কৃষ্ণ ফিরে গেল দ্বারকায়, সেখানে ক্লান্ত কৃষ্ণকে বোন সুভদ্রা প্রদীপ জ্বালিয়ে ওয়েলকাম করলো, পিঁড়ি পেতে খেতে দিল মণ্ডা-মিঠাই। ভাই যেন পুনর্জন্ম পেল, হয়ে গেল দ্বিজ, তাই শুরু হল ভাই-দ্বিজ, অপভ্রংশে ভাইদুজ।

পাতালরাজ দানবীর বলির তপস্যায় খুশি হয়ে ভগবান বামদেব বিষ্ণুরূপে তার গৃহে এসে বর দিতে চাইলে বলি বললেন, ভগবন্‌, আপনি এখানেই দ্বারপাল হিসাবে থাকুন, যাতে আসতে যেতে আপনার দেখা পাই। বিষ্ণুর রাজী না হয়ে উপায় ছিল না। এদিকে লক্ষ্মী পড়েছেন ফ্যাসাদে, ঘরের মানুষের দেখা নেই। নারদের মুখে খবর পেয়ে লক্ষ্মী গরীর ভিখারিনী সেজে শাড়ি ছিঁড়ে গিঁট মেরে অজন্তা হাওয়াই ফটফট করতে করতে বলির কাছে গিয়ে ভিক্ষে চাইল। কপালে ফোঁটা দিয়ে বলল, আমার ভাই নেই, তুমি আমার ভাই। দানবীর বলির দানের অহঙ্কার, বললো, বোনটি আমার, তোর যা চাই তাই পাবি। লক্ষ্মী বলল, আমার কর্তাকে আটকে রেখেছ, প্লীজ ছেড়ে দাও। ব্যাস, বলির হাওয়া নিকলে গেল।

মহামতি চাণক্য এই নিয়ে পরে শোলোক বেঁধেছেন – অতিদর্পে হতা লঙ্কা অতিমানে চ কৌরবাঃ। অতিদানে বলির্বদ্ধঃ সর্বমত্যন্তম্‌ গর্হিতম্‌। মানে বলে দিতে চাইলে নিশ্চয় বলবে, বেশি বেশি কোরনা!

রাজা নন্দীবর্ধন বহুদিন ভাইকে না দেখে মনোকষ্টে ভুগছে। ভাই মহাবীর তপস্যায় নির্বাণলাভ করে জৈনধর্ম প্রচার করে বেড়াচ্ছে। নন্দীবর্ধনের কষ্ট লাঘবের জন্যে বোন সুদর্শনা কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ায় ভায়ের বাড়ি এসে তার সেবা করতে লাগল। 

তারপর সেই গল্পটা! অনেক আগে জঙ্গলের ধারে এক বাড়িতে থাকত এক পরিবার। দিদির যখন বিয়ে হয়ে যায়, ভাই তখন খুব ছোট। বড় হয়ে দিদির মুখ মনেও পড়ে না তার। অন্যদের দেখে মাকে জিজ্ঞেস করে, মা, আমারও তো দিদি আছে তুমি বলো, সে কেন আসে না? মা বলে, ওরে, তার যে শ্বশুরবাড়ি অনেক দূর, পরে পড়ে জঙ্গল, খরস্রোতা নদী, সে কী করে আসবে বল? 

ছেলেটা বলল, আমি দিদির শ্বশুরবাড়ি যাব। মা যত বিপদের কথা বলে, নাছোড়োবান্দা ছেলের তত জেদ বেড়ে যায়। শেষে মা পুজো-আচ্চা করে মাথায় চুমো টুমো খেয়ে যেতে দিল ছেলেকে।

জঙ্গলের পথে হাঁটছে ছেলে, ধেয়ে এল সাপ। ছেলে বলল, জানো, আমি আমার দিদির কাছে যাচ্ছি, কতদিন তাকে দেখিনি, এখন আমাকে কেটো না, প্লীজ, ফেরার পথে যা খুশি কোরো। সাপ বলল, ঠিক আছে। ছুটে এল বাঘ, তাকেও একই কথা বলল সে। পাহাড় শুরু করল তার ওপর পাথর ফেলতে, সে মিনতি করল, এখন আমায় মেরো না দয়া করে। ওরা মেনে নিল।

নদী পার হতে গিয়ে দেখে প্রবল স্রোত, ভেসে যাবার উপক্রম। নদীর কাছেও সে চাইল তাকে যেন অনওয়ার্ড জার্নিতে ডুবিয়ে দেওয়া না হয়। নদী তাকে ডলফিন-টলফিন দিয়ে পার করে দিল।

ভাইকে পেয়ে তো দিদির আনন্দের শেষ নেই। খাওয়া-দাওয়া ফোঁটা-টোঁটা তো হলই, কত গল্পগুজব, খুনসুটি, কত কী! অনেক দিন সেখানে থেকে ফেরার যখন সময় হল, দিদি বলল, আবার আসিস ভাই। ভাই বলল, জানিস দিদি, আমাদের আর দেখা হবে না। আসার সময় যা যা কাণ্ড হয়েছিল, সব দিদিকে বলল সে।

দিদি বলল, কী, আমার ভাইকে মেরে ফেলবে এরা? রসো, মজা দ্যাখাচ্ছি। সেও পোঁটলা নিয়ে রেডি হয়ে গেল, বলল, চ' আমিও তোর সাথে যাব।

নদীকে খুশি করতে পুজো দিল সে, নদী ছেড়ে দিল। বাঘ হালুম করে তেড়ে আসতেই পোঁটলা খুলে তার দিকে ছুঁড়ে দিল রান্না করা মাংসের চাঁপ-রেজালা-দোপিঁয়াজা। বাঘ তাই খেয়ে ফুটে গেল। সাপকে দুধকলা দিয়ে আর পাহাড়কে সোনা-রূপো ঘুষ দিয়ে বশ করে ফেলল সে। ভাইয়ের সব অনিষ্ট দূর হয়ে গেল।

এই গল্পটা আরো বড়, কিন্তু সেসব থাক। মূল কথা এটাই। ভাইদের মঙ্গলের জন্যে বোন বা দিদিরা পারে না, হেন কাজ নেই।

আজ সেই পরম মঙ্গলময় দিন। আজ কাকডাকা ভোরে বোনেরা ঘুম থেকে উঠে ঘাসের ডগা থেকে শিশিরকণা সংগ্রহ করে তাই দিয়ে চন্দন বেঁটে ভাইয়ের জন্যে বাঁ হাতের অনামিকায় তুলে নেয় যে ফোঁটা, প্রদীপ জ্বালিয়ে মাথায় ধানদূর্বা দিয়ে মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে দিয়ে সেই ফোঁটা এঁকে দেয় ভায়ের কপালে, তার তুল্য পবিত্র অনুষ্ঠান জগতসংসারে নেই। 

ভ্রাতস্তব ললাটে হি দদামি তিলকং শুভ। অতঃপরং যমদ্বারে ময়া দত্তং হি কন্টকম্। ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।

এরপর ভাইকে ভূরিভোজ করানো। ভ্রাতস্তবাগ্রজাতাহং (বয়সে ছোট অর্থাৎ অনুজ হলে ভ্রাতস্তবানুজাতাহং) ভুক্ষ্ব ভক্তমিদং শুভম। প্রীতয়ে যমরাজস্য যমুনায়া বিশেষতঃ। আর ভাইয়ের কাজ বসে বসে সেগুলো সাঁটানো। তত্র যম পূজা দিকমঙ্গ্ ভগিনী হস্তাদ্ ভোজনং প্রধানং কর্ম।

আজ রাতের আকাশে শুক্লা দ্বিতীয়ার প্রায়-অদৃশ্য একফালি চাঁদ। কিন্তু এর কাছে ভাই-বোনের মধুর-সম্পর্কজনিত অপর তিথি রাখীপূর্ণিমার পূর্ণচাঁদও যেন ম্লান মনে হয়। 

দিদিরা, আমার প্রণাম নিও। বোনেরা, অনেক ভালবাসা। ঘরের দেয়ালে একটা এক্সট্রা ফোঁটা কেটে রেখ তোমরা আমার জন্যে। মিষ্টির প্লেট আর গিফ্‌ট্‌ কি ক্যুরিয়ারে পাঠাবে?

ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। ৫ই নভেম্বর ২০১৩

শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৩

ছবি ~ অমিতাভ প্রামাণিক

ছেলেটা আদুর গায়। প্যান্টখানা? ছেঁড়া সে।
ধূপ বেচে সিগ্‌ন্যালে, দেখি ধনতেরাসে।
হিঁদু না মুসলমান? ভোলা, ভূতো বা বশীর?
পরদিন দেখি তারে ভূত চতুর্দশীর
বাজারে দাঁড়িয়ে, তার পরণে সেই পোষাক।
হাতে কিছু আঁটি, বলে, লিবেন চোদ্দশাক?
বেশ চালু ছেলেটাতো, নাকি খামখেয়ালি?
দিওয়ালি আছে কি ওর, ঘরে নেই দেয়ালই!
রোদে-বৃষ্টিতে-জলে খাড়া থাকে দ্বিপদে,
সেভাবেই চলে অমাবস্যা-প্রতিপদে,
ঘন্টা-মিনিট-দিন লাল-কালি তিথি যায়।
বোন আছে ওর? দেয় ভাইফোঁটা দ্বিতীয়ায়?

আমার এ পাপের হাতে এই ছবি আঁকালি
যদি মা, দেখিস ওরে – ওদেরকে – মা কালী!

১ নভেম্বর ২০১৩