শনিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৪

​ অথ বুদ্ধিজীবী কথা (জনস্বার্থে প্রচারিত) ~ পরিচয় পাত্র

সাম্প্রতিককালের নন্দন-আকাদেমি স্বল্পদৈর্ঘ্যের মিছিল মনে রেখে

 

 এই এই, এই লেড়ো, বিস্কুট দে, সঙ্গে দুটো ডবল হাফ আর একটা চারমিনার চমকা। এই, এই শালা, কোনদিকে যাচ্ছিস? বলিনি তখন, আবে মিছিল যাবে এইদিকে রে শালা, চোখের কি মাতা খেয়েছিস? এই, এই একদম মিডিয়ার সামনে বাইট দিবিনা, কখন কি বলে ফেলবি। দাদা বলে দিয়েছে, কোনোরকম চুদুরবুদুর নয় চাঁদু। হ্যাঁ যাও, যাও না, টিবির সামনে গিয়ে পোঁদ উলটে পড়ে থাকো, একটা পয়সা পাবে না শালা বলে দিচ্চি। আগাম বললুম মাইরি, মা কালীর দিব্যি, পরে আমাকে দোষ দিবিনা শালা। একদম ফালতু কিচাইন করবি না।

 

বিশৃঙ্খল মিছিলের দিকে চোখের চশমা সামলাতে সামলাতে মতিলাল শীল এগিয়ে আসেন। এই এই, কি হচ্ছে? ঠিক করে লাইন সামলে নাও সবাই। (ক্যামেরার দিকে ফিরে) কি বললেন? মিছিল? নানা, মিছিল মুখ্যমন্ত্রীর কথায় নয়, বাংলার অপমানের বিরুদ্ধে। পেছনের দিকে এগিয়ে যান, হ্যাঁ, বাস কন্ডাক্টররা যেমন বলেন আরকি, সেইভাবে, দেখতে পাবেন কত লোক হয়েছে।  

 

হঠাৎ শোরগোল। টিভি চ্যানেলের রূপসীরা এসেছেন, সঙ্গে দৃপ্ত মহানায়ক। সামনে মহানায়ককে পেয়ে সবাই প্রশ্ন করতে মরিয়া, এই মিছিল সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য জানতে চায় সবাই। চোখের রোদচশমা সামলে নেন মহানায়ক, আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বলেন, দেখুন, আমি দিদির কথায় চলে এসেছি। দিদির কথায় আসতে হবেই। কিন্তু এও তো ঠিক, আমার জন্যেই ভিড় খানিকটা হলেও বেড়েছে, আমাকে  দেখতে লোক তো কম হয়নি।কত ছাত্তবন্ধুরা, মা বোনেরা আমাকে দেখতে দেখতে এসেচেন। থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ। বেফাঁস মন্তব্য দেখে দ্রুত সামলে দেন শীল, ব্রাত্য প্রমুখেরা। বিরক্ত শীল মহানায়ককে উদ্দেশ্য করে ব্রাত্যর কানে কানে বলেন রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি/ মূর্তি ভাবে আমি দেব... সেই কেস, বুঝলি? ব্রাত্য সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়েন।

 

টালিগঞ্জের টাকলা ওসি (পড়ুন প্রোডিউসার) ছিলেন, তিনি চাকরি যাওয়ার ভয় দেখিয়ে অনেক লোক এনেছেন। হন হন করে তিনি এগিয়ে যান।  

 

টালিগঞ্জের এক সফল দুঃসাহসী পরিচালক তাঁর নতুন ছবি অভিশপ্ত গামছার কাজ অসমাপ্ত রেখে এসেছেন মিছিলে। সাংবাদিকদের ইচ্ছে ছিল নতুন ছবির নামকরণ সম্পর্কে প্রশ্ন করার, কারণ টাকলা ওসি ব্যতীত তাঁর সব প্রযোজকই শোনা যাচ্ছে আজকাল গামছা বিক্রি করছেন। কিন্তু প্রশ্ন করার সুযোগ মিলল না।

 

এছাড়া মরশুমি নাট্যশিল্পী সহ অনেককেই দেখা গেল মিছিলে। অনেকেই নিজেকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে দাবী করছিলেন ম্যাটাডোর থেকে নামতে নামতে। শেষ কবে এমন হোলসেল বুদ্ধিজীবীর ঝাঁক শহর আক্রমণ করেছে তা কেউ মনে করতে পারলেন না।

 

হঠাৎ আবার চঞ্চল ক্যামেরাধারী সাংবাদিককুল। এসে উপস্থিত হলুদ পাঞ্জাবি ভূষিত কবি সুবোধ অতি গোপাল বালক এবং তাঁর পেছনে পেছনে ৩৬৫ পাড়ার পাঁচু। পঞ্চানন পাঁচু সরে পড়ার চেষ্টায় ছিলেন, কিন্তু তার আগেই ক্যামেরা তাকে পাকড়াও করায় তিনি সরাসরি বলেই দিলেন বিরোধীদের মতই সাংবাদিকরাও বানচোত এবং তাদের মেরে তিনি গাঁড় ভেঙ্গে দেবেন। এইসব অশ্লীলতায় ভ্রুকুঞ্চিত করে এগিয়ে এলেন কবি সুবোধ। সবার সামনে হাসি মুখে তিনি আবৃত্তি করলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'মদনের একটা চাকরি চাই'। শেষ লাইনে "একটা মানুষকে এমএ পড়তে হলে যত অক্ষর পড়তে হয় সেইসব ব্যর্থ অক্ষর মমতার গায়ে লেগে আছে" বলে তিনি চোখের জল মুছতে মুছতে এগিয়ে গেলেন।

 

মিছিল শেষ। মিছিলের পরে সভা। গরিব সিনেমা টেকনিশিয়ানরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন, যাক বাবা, নিশ্চিন্ত। কিন্তু চমকের তখনও বাকি ছিল। জানা গেল মিছিলে না আসতে পারলেও নিজের কবিতা পড়তে আসবেন প্রবীণ কবি, কবিকুলতিলক। এসেও পড়লেন কবি, কেশবিরল মাথা, চোখে চশমা, মুখে অবিন্যস্ত দাড়ি, দৃষ্টিতে ভয় আর সংশয় মিশে গেছে। বন্ধু কাকপ্রসন্ন না থাকায় কবিকে বিপন্ন লাগছে। মানসিকভাবেও কি দ্বিধাগ্রস্ত? জানা গেল কবি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর এই হেনস্তা, এই অপমানের প্রতিবাদ করবেন, সমর্থন জ্ঞাপন করবেন তাঁর প্রতি।

 

মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে কবি ধীরে ধীরে নিচুগলায় পড়তে শুরু করলেনঃ

 

পাগলী তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব

পাগলী তোমার সঙ্গে বিষমদ কাটাব জীবন

এর চোখে ধাঁধাঁ করব, ওর জল করে দেব কাদা

পাগলী তোমার সঙ্গে ডেলো বাংলো যাব দুকদম

 

অশান্তি চরমে তুলব, কাক-চিল বসবে না বাড়িতে

বিরোধীরা বাম্বু দেবে, তুমি ছুঁড়বে খিস্তির ভাষণ

পাগলী তোমার সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ জীবন কাটাব

পাগলী তোমার সঙ্গে চৌতিরিশ কাটাব জীবন  

 

মেঘে মেঘে বেলা বাড়বে, কৃষি শিল্পে লক্ষ্মী লোকসান

লোকসান না পুষিয়ে তুমি রাঁধবে খালি সিঙ্গুর ব্যঞ্জন

পাগলী তোমার সঙ্গে অপকর্ম জীবন কাটাব    

পাগলী তোমার সঙ্গে কালনিদ্রা কাটাব জীবন

 

পাগলী তোমার সঙ্গে মাকুমশলা জীবন কাটাব  

পাগলী তোমার সঙ্গে মাও-মাংস কাটাব জীবন

পাগলী তোমার সঙ্গে নিরক্ষর জীবন কাটাব

পাগলী তোমার সঙ্গে চার অক্ষর কাটাব জীবন

 

পাগলী তোমার সঙ্গে বই দেখব পাগলুদের হলে

মাঝে মাঝে মিছিলে যাব অ্যাকাডেমি রবীন্দ্রসদন

পাগলী তোমার সঙ্গে নাইট্যশালা জীবন কাটাব

পাগলী তোমার সঙ্গে শিলাদিত্য কাটাব জীবন

 

পাগলী তোমার সঙ্গে কালীঘাট জীবন কাটাব

পাগলী তোমার সঙ্গে তপসিয়া কাটাব জীবন

পাগলী তোমার সঙ্গে কি সুদীপ্ত জীবন কাটাব   

পাগলী তোমার সঙ্গে কি মিথ্যুক কাটাব জীবন

 

এক হাতে উপায় করে দুহাতে উড়িয়ে দেবে তুমি

ক্লাবে চাঁদা, ধর্ম ভাতা, ধারে কাটবে সহস্র রকম

লটারি তোমার সঙ্গে চিটফান্ড জীবন কাটাব

লটারি তোমার সঙ্গে বকেয়া ডিএ কাটাব জীবন

 

দেখতে দেখতে পুজো আসবে, সকলে চিৎকার করবে সেল

তোমার কবিতায় খুঁজব রূপসাগরে অরূপ বিশ্বাস

পাগলী তোমার সঙ্গে পুজোসংখ্যা জীবন কাটাব

বুর্জোয়া এবিপি নয়, জাগো বাংলা কাটাব জীবন

 

নতুন পার্টির সঙ্গে দেখা করব লুকিয়ে চুরিয়ে

ধরা পড়ব তোমার হাতে, নবান্নতে হেনস্তা চরম

পাগলী তোমার সঙ্গে ভ্যাবাচাকা জীবন কাটাব

পাগলী তোমার বঙ্গে বিভীষণ কাটাব জীবন  

 

পাগলী তোমার সঙ্গে শারুখ খান জীবন কাটাব

পাগলী তোমার সঙ্গে আইপিএল কাটাব জীবন

পাগলী তোমার সঙ্গে রেলরোকো জীবন কাটাব

পাগলী তোমার সঙ্গে বাংলা বনধ কাটাব জীবন

 

সন্ধেবেলা ঝগড়া হবে, হবে দুই চেয়ার আলাদা

হপ্তা হপ্তা কথা বন্ধ, ধান্দাতেই আচমকা মিলন

পাগলী তোমার সঙ্গে খাগড়াগড় জীবন কাটাব

পাগলী তোমার সঙ্গে মা সারদা কাটাব জীবন

 

কুণালকে কনুই মারব, রাস্তা করব ওকে ধাক্কা দিয়ে

পাপোশকে লেলিয়ে দেব, ঢেউ ভাঙতে কেষ্ট দুকদম

পাগলী তোমার সঙ্গে নর্দমায় জীবন কাটাব

যাদবপুরে অন্ধকারে লাঠিখেলা কাটাব জীবন

 

 

 

পুনশ্চঃ মূল কবিতা থেকে 'পাগলী তোমার সঙ্গে রামরাজ্য জীবন কাটাব' প্যারা বাদ পড়ায় রাহুল-তথাগত-অমিত শাহরা শোনা যাচ্ছে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন।


https://www.youtube.com/watch?v=pgVWpPcBXP0&feature=youtu.be


শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৪

হিন্দুত্ববাদ - সংস্কৃতি ও শ্রেণী ~ শতদ্রু দাস

​হিন্দুত্ববাদকে শুধুমাত্র একটা সাংস্কৃতিক ইস্যু বলে ভাবতে অসুবিধে আছে, যে কোনো বামপন্থীরই থাকবে। আর এটাই বোধ হয় বামপন্থীদের আর অন্যদের হিন্দুত্ববাদ নিয়ে মূল্যায়নে তফাত। আমার মতে বিজেপি  হিন্দুত্ববাদকে ব্যবহার করে তার অর্থনৈতিক এজেন্ডা গুলোকে আড়াল করতে। ধর্মের সুরসুরি দিয়ে তারা মানুষের নজর ঘুরিয়ে রাখে। হিন্দুত্ববাদকে কাজে লাগিয়ে তারা শ্রমিক শ্রেনীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে বাধা দেয়। আমার কাছে হিন্দুত্ববাদের সবচেয়ে বড় বিপদ এটাই। 


ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিজেপি যে অর্থনৈতিক দিশার দিকে এগিয়েছে সেটা কিরকম? এনরেগাকে তুলে দেয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে, বিভিন্ন সমাজ কল্যাণ মূলক সরকারী প্রোগ্রাম গুলোকে কাটছাট করছে, শ্রম আইন শিথিল করা সুরু করেছে, আরো করবে। বাজেটের রিভিশনে বিভিন্ন সামাজিক খাতে যেমন শিক্ষা স্বাস্থ্যে ৭-৮ হাজার কোটি টাকা করে আর্থিক অনুদান কমিয়েছে। এটা ব্যাকডোর দিয়ে করা হয়েছে যাতে হই চৈ না হয়। জমি অধিগ্রহণ আইন পাল্টে কর্পোরেট জমি লুঠকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করছে, বিভিন্ন লাভজনক সরকারী সংস্থা জলের দরে বেচে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে, রেশনে কেরোসিন দেয়া বন্ধ করেছে, সরকারী ব্যাঙ্ক এসবিআই-কে বাধ্য করেছে আদানিকে বিদেশে বিনিয়োগ করার জন্যে ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিতে যাতে আর. বি. আই গভর্নর বাধ্য হয়েছেন বলতে যে কর্পোরেটের অনাদায়ী ঋণ সরকারী ব্যাঙ্কগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা। এনরেগার সুফল নিয়ে অনেক অর্থনীতির পেপার লেখা হয়েছে, ভারতের বেশিরভাগ বিখ্যাত অর্থনীতিবীদ এনরেগার পক্ষে বলেছেন, এমনকি আর. বি. আই পর্য্যন্ত একটা রিপোর্ট বের করেছে যাতে এনরেগার প্রসংসা করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কথা শুনতে নারাজ মোদী সরকার। ভুলে গেলে চলবেনা যে এই এনডিএ-র আমলেই FRBM নামক কলা কানুন চালু করা হয় যার ফলে সামাজিক খাতে সরকারী খরচ ব্যাপক হারে কাটছাট করা হয়। এই কাটছাটের ফলেই ২০০০-২০০৮ এর মধ্যে আমাদের দেশ দক্ষিন এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় প্রায় সমস্ত মানব উন্নয়নের মাপকাঠিতে পিছিয়ে পড়তে থাকি। অমর্ত্য সেন এই নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলেন আউটলুক পত্রিকায়। কংগ্রেস যে এই বিষয়ে বিজেপির চেয়ে ভালো তা নয় তবুও ভোটের খাতিরে তাদের একটা মুখোশ রাখতে হয়, যাকে ওরা বলে "growth with a human face". তাই ওরা RTI, এনরেগা, চাষীদের ঋণ মকুব, খাদ্যের অধিকার আইন, অরণ্যের অধিকার আইন ইত্যাদির মত সব প্রকল্প নেয়। কিন্তু  বিজেপির হিন্দুত্ববাদের ভেক থাকার ফলে মানবিক মুখোশ টুকুও পরার দরকার হয়না, ওরা নগ্নভাবে নিও-লিবেরাল নীতি অনুসরণ করতে পারে। নিও-লিবেরাল নীতির জন্যে যে ভোট কমবে তা হিন্দুত্বর হাওয়া তুলে মেকআপ করে দেবে।              


এবার যারা উচ্চবিত্ব বা মধ্যবিত্ব তাদের কিন্তু বিজেপির এই নগ্ন নিও-লিবেরাল নীতি নিয়ে বিশেষ সমস্যা নেই। তারা বরং লাভবান হয়েছে এসব নীতির ফলে। এই শ্রেনীর মানুষের মধ্যে যারা ধর্ম নিরপেক্ষ এবং উদারপন্থী তাদের কাছেও  বিজেপির যেটুকু সমস্যা তারা দেখতে পান সেটুকু মূলত হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি নিয়ে। হিন্দুত্ববাদ একটা সামন্তবাদী সংস্কৃতিকে তোল্লাই দেয় যার নিজস্ব সমস্যা অবশ্যই আছে কিন্তু শুধুমাত্র সেই সংস্কৃতির পশ্চাত্পর চেতনাকে যদি হিন্দুত্ববাদের মূল বিপদ বলে চিন্হিত করি তাহলে তার আসল উদ্দেশ্যটা অধরা থাকে, যা হলো শ্রেণী চেতনাকে দুর্বল করা।  এখানে মুসলমান মৌলবাদের প্রসঙ্গটাও টানবো। যারা হিন্দুত্ববাদকে শুধুমাত্র একটি সাংস্কৃতিক সমস্যা বলে মনে করে তারা হিন্দু মৌলবাদ আর মুসলমান মৌলবাদের তুলনামূলক বিচার করতে গিয়ে দ্বিতীয়টাকে বেশি বড় বিপদ বিচার করতে পারে। তার কারণ হলো আধুনিকতার বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদ যতটা না জোরদার এবং আক্রমনাত্বক তার চেয়ে বেশি আক্রমনাত্বক মুসলমান মৌলবাদ। হিন্দুত্ববাদীরা যেসব প্রাক-আধুনিক সামন্তবাদী সংস্কৃতি প্রচার করে সেসব ততক্ষণ আর ততটুকুই করবে যতক্ষণ বাজার অর্থনীতি তাকে করতে দেবে, বেশি বাড়াবাড়ি করলে বাজার মেনে নেবেনা। এটা হিন্দুত্ববাদীরা ভালই জানে। মুসলমান মৌলবাদ কিন্তু বাজারের ওপর নির্ভরশীল না তাই বাজারের মন যুগিয়ে চলার দায় তার নেই, বরং বাজারের উল্টোটাই করবে। এর ফলে একটা সম্ভাবনা থাকে অনেক উদারপন্থী মানুষের এটা মনে করার যে হিন্দুত্ববাদীরা তমসাচ্ছন্ন ঠিকই কিন্তু মুসলমান মৌলবাদীরা সেই দোষে আরো বেশি দোষী। আমার মনে হয় হিন্দুত্ববাদের শ্রেণী শক্তিকে দুর্বল করার ভূমিকাকে না দেখতে পেলে এরকম সিদ্ধান্তে আসবেন অনেকেই।    


হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি দলিত চেতনা আর নারীবাদকেও দুর্বল করে যেটার প্রশ্ন শ্রেণীর থেকে ভিন্ন এবং সেটাও বড় বিপদ। কিন্তু আমি যেহেতু সেই বিষয়ে খুব বেশি জানিনা তাই লিখলাম না।  আশা করি কেউ এই লেখা পড়ে ভেবে বসবেন না যে আমি সাংস্কৃতিক প্রান্তিকীকরণকে ছোট সমস্যা বলছি। আমি শুধু বিপদের একটা দিক তুলে ধরেছি।

শনিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৪

চুরি ~ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য

কেউ করে ফুলচুরি রোজ রাতভোরে
কেউ বলে সংসদ ভরে গেছে চোরে;
বইচুরি করে কেউ উদাসীন মুখে
সময়ও তো চুরি যায় বলে নিন্দুকে;
প্রেমিকার মন চুরি নানা ছলেবলে
জানিনাকি মতলব আছে তলে তলে;
ছ- সেকেন্ড চুরি যায় প্রতি বৎসরে
পুঁথি দেখ, লেখা আছে ছাপা অক্ষরে;
অপিসের বড়বাবু, গোঁফ গেল চুরি
কবিতায় সুকুমার নেই তার জুড়ি;
প্রচলিত চোরে চুরি করে রাত্তিরে
থালা, বাটি, গ্লাস, জুত, জহরত হীরে;
কনসেপ্ট চুরি করে কেউ অগ্রণী
নোবেলের সন্মান পান মারকনি;
রেষারেষি নেই কোন সাড়ি, চুড়িদারে,
সগর্বে ঘোরে কেউ বারমুডা পড়ে;
এঁচোড়ে কি চোরে খায়,রীতিমত ভাবি
কেউ সাধে রুটি দিয়ে চচ্চড়ি খাবি?
ইস্কুলে যায় কেউ সাইকেল চড়ে
কি বিপদ গেল কই? নিল নাকি চোরে?
কচুরিতে প্রাতরাশ জিলিপির প্যাঁচে
সবকিছু নিঃশেষ দেখি শেষ ব্যাচে;
ছায়া চুরি, খোলা মাঠে খটখটে রোদে
টিফিনে তো চুরি যেত পাউরুটি বোঁদে;
সুর চুরি হলে সোজা যেও আদালতে
গল্পের প্লট চুরি হয় বাঁধা গতে;
কেউ বলে দেখছকি মেশে তেলে জলে
ছোটোখাটো চুরি? সেতো করে সক্কলে;
কেউ বলে, আমি চোর? বাকি সব সাধু?
পুকুর যে চুরি গেল, দেখলেনা চাঁদু;
মিছিলেতে হেটে কেউ রাঙা প্রতিবাদে
গুণীজনও চুরি করে, দেখি সংবাদে;
পোস্টারে বলে কেউ সব্বাই চোর
বল দেখি কি কারনে মাথাব্যাথা তোর?
স্পেকট্রাম চুরি হয়, চুরি কোল গেটে,
পাসওয়ার্ড চুরি যায় রেগুলার নেটে;
চুরি নিয়ে আলোচনা আনন্দ,স্টারে
বুঝে গেছি মোটামুটি বাঁশ কেন ঝাড়ে?
চোরেদের সভা ছেড়ে ভয়ানক রাগে
প্রতিবাদী বাম নেতা বহুদিন আগে;
তারপর চোরে চোরে মাসতুত ভ্রাতা
সংসদে 'কালিধন',হাতে কালো ছাতা;
মিছিমিছি বকো, আগে হোক প্রমানিত
মোবাইল, ট্যাব চুরি যায় নিয়মিত;
কেউ বলে আমি চোর? অভিমান ভরে,
জান যদি বল কেন এতদিন পড়ে?
মার গলা বড় হলে,ছেলে বুঝি চোর?
এ তো শুধু অনুমান, ভুল উত্তর;
আইনত সমাদর পাক চুরি, চোরে
চোরকাঁটা, চোরাবালি, চোরাস্রোত ধরে।।



শুক্রবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৪

হাসি ~ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য

কেউ হাসে খিলখিল, কেউ হাসে মেপে
অকারনে হাস যদি জ্যাঠা যাবে ক্ষেপে;
নামে কিবা আসে যায় হাসে তাই হাঁস
কেউ হাসে শত্রুকে দিয়ে কচি বাঁশ;
কেউ হাসে ফিকফিক অঙ্কের ক্লাসে
নিয়মিত হাসি চলে, ঠোকাঠুকি গ্লাসে;
ঘোড়াতেও হাসে বুঝি আজগুবি শুনে
পাঁজি দেখে হাসে কেউ, হাচিঁ দেয় গুনে;
হাসিসের নেশা হলে সারারাত ধরে
অবিরাম হাসে কেউ সিদ্ধির ঘোরে;
কারো হাসি কোলগেট, রোজ দাঁত মেজে
বড় পিসি হাসে কেন পুঁটিমাছ ভেজে?
পুলিসেও হাসে দেখ যদি পায় ঘুষ
চার্চিল, হিটলার হাসে মোদী, বুশ;
হাসত না জ্যোতি বোস, কানাঘুষো শুনি,
শুনেছ কি হাসতেন দুর্বাসা মুনি?
নেতা হাসে দেঁতো হাসি, ভয় দিনেরাতে
হাসিখুশি থাকে যারা আছে দুধেভাতে;
দেখলেই বোঝা যায় বাড়ি হাসিমারা
চা বাগানে সর্বদা হাসিতেছে তারা;
জাপানের ফুরসোয়া খুক খুক কাশে
আমি ভাবি কি বিপদ, এত কেন হাসে?
সর্বদা হাসে কেউ, হেসে গড়াগড়ি
কেউ হেসে কুটিপাটি, সাথে হাসে ভুঁড়ি;
চীনাম্যান হাসে সুখে, দুটি চোখ বুজে
Laughআlaughই কর কেন, হাস নিজে নিজে;
ক্লাবে গিয়ে হাসি শেখে আট থেকে আশি
বিয়ে হলে প্রেমিকার হাসি হয় বাসি;
হাসিনার হাসি নাকি দুর্লভ ভারী
মেসো হাসে খেয়ে লুচি বাটি চচ্চড়ি;
বাঁকা হাসি হাসে কেউ হাসি রাখে চেপে
ক্লাসে হাসাহাসি দেখে স্যার যান ক্ষেপে;
কারো কারো শেষ হাসি, কান্নায় মেশে
গোটা পাঠা খেয়ে কেউ হাসে অক্লেশে;
নায়িকার হাসি নাকি ভয়ানক দামী
হেসে হেসে ঘুঁটে দিত শিবানীর মামী;
স্বপ্নের হাসি যদি টোল পড়ে গালে
হা হা করে হাস তুমি কোন আক্কেলে?
সিনিয়ার সিটিজেন হাসে বিনা দাঁতে;
কাকা কাকী এতো হাসে কেন মাঝরাতে?
ন্যাচারাল হাসি থাকে হেরিডিটি, জিনে
অফিসেতে হাসি নাকি নিষিদ্ধ চীনে;
হাঁসফাঁস করে কেউ হেসে ক্রমাগত
মোনালিসা হাসি হেসে হন বিখ্যাত;
কেউ খুন হেসে,কেউ হাসে বোকাবোকা
প্যান্টেতে হিসি করে হাসে কচিখোকা;
শিশু হাসে আনন্দে, অনাবিল হাসি
মিঠে রোদ, প্রজাপতি বড় ভালোবাসি;
মোক্ষম কত হাসি, রয়ে গেল তবে
পড়ে যদি ভালো লাগে, ফের দেখা হবে।।

বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৪

চুমুৎকার ~ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য

কেউ গালে চুমু খায়, কেউ খায় বক্ষে
কেউ বলে কি ফ্যাসাদ,ক্ষমা কর রক্ষে;
কেউ বুঝি চুমু খায় ভালোবেসে ওষ্ঠে
দূরদেশে চুমু নাকি যায় বুকপোস্টে;
কারো চুমু ফ্লাই করে সিনেমার হলেতে,
কেউ ভাবে প্রচেষ্টা বুঝি গেল জলেতে;
হারুদা তো চুমু খায় চিলেকোঠা ছাদে তে,
ধরা পরে কানমলা, শুনি সংবাদে যে;
মুহূর্তে চুমু খায়, কারো চুমু লেনদি,
হাফ চুমু খেতে নাকি শর্বাণী সেন দি;
আরও হাফ রেখে দিত ব্যাঙ্কের ভল্টে,
দিত নাকি ফিয়াসেকে অ্যাড্রেস পালটে;
চুমু খায় বিপ্লবী, বড়বাবু, কেরানী
পেটরোগা, ভুঁড়িওয়ালা, এলোকেশী কি funny!
কেউ কেউ চুমু খায় নিরাপদে গোপনে
মাধুরীকে নাড়ু নাকি কিস করে স্বপনে;
উষ্ণতা ভালো লাগে পেয়ালার চুমুকে
চুমু খেতে গেল কেউ দিঘা,গড়চুমুকে;
কারো মুখে পাইরিয়া, ভয়ানক গন্ধ
রেগুলার দাঁত মাজে? মনে জাগে সন্দ্য;
কেউ ভারী পরিপাটি ব্রাশ করে সকালে
আশা মনে,যদি কেউ কিস করে বিকেলে;
ফুটফুটে মেম বলে 'হরে হরে কিস না'
শ্রী কৃষ্ণ বলে চুমু কালকেই দিস না;
নিষিদ্ধ চুমু বুঝি ধর্মের বিচারে
ছাত্রীকে চুমু খেল ইংলিশ টিচারে;
কেউ কেউ চুমু খায় নির্জনে লিফটে,
নিয়মিত চুমু খায় কেউ তিন শিফটে;
কবিরাও চুমু খায় বসন্তে, শ্রাবণে,
কোন মুখে চুমু খায় বল দেখি রাবনে?
খেলোয়াড় চুমু খায় ম্যাচ জিতে মাটিতে
শান্তির খোঁজে কেউ জয়রামবাটিতে;
গালে যারা চুমু খায় ব্যাঙ আর সর্পে
সবখানে আছে তারা বলে বীরদর্পে;
জ্যাঠা বলে চুম্বন মোটে ভালো কাজ না
জেঠী বলে কাল হবে, একাদশী আজ না?
কেউ কেউ চুমু খায় সশব্দে সজোরে
কলেজের মেয়ে যদি পরে যায় নজরে;
যাবে নাকি বেলেঘাটা মেগা কিস ফেয়ারে?
টালা থেকে সোজা রুট, অটো পাবে শেয়ারে;
চুমু চলে ইতালিতে, লিসবন, ফ্রান্সে
রাশিয়ান চুমু নাকি ইদানীং পানসে!
চুমু থেকে হয় বুঝি এডস কিবা ইবোলা?
বেপাড়ার ছেলে বুঝি বাঁশ দেব আছোলা!
'ঝুমা প্লিজ চুমা দিয়ো' বচ্চনী আর্তি
কি লজ্জা বল দেখি হল লোকে ভর্তি!
বল দেখি কিসমিস কথাটার অর্থ
মাদুলিটা পরে নিয়ো প্রেমে হলে ব্যার্থ;
চাঁদ মামা চুমু দিয়ে দিত ঘুম পাড়িয়ে
শৈশব,মার চুমু গেল সব হারিয়ে।।

----- চরিত্র সব কাল্পনিক ---------------

অবাধ্য মন ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

আকাশ কুসুম ভাবনা-চিন্তা সারাটা দিন অন্ধকারে
এই যে সময় বদলে যাচ্ছে ঘড়ির কাঁটায় ক্যালেন্ডারে
তাই বলে কি মান ভেঙ্গেছি? বান ঢেকেছে দু-কূল জুড়ে?
তাই বলে কি ভাববো না আর, যা ভেবেছি নির্বিচারে?
 
ঠিক বুঝেছ, পাঁচিল দেওয়াল যাই তুলি সব ভঙ্গপ্রবন
যতই কালো পর্দা টানি, যতই সাজি ভিক্ষু-শ্রমন
যতই গাঁথি চীনের প্রাচীর, যতই কালো বোরখা পরি
অবাধ্য সব ভাবনা চিন্তা করছে সে সব অতিক্রমন

মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৪

​ক্যাকফনি ~ অবিন দত্তগুপ্ত

সেবার বীরভূম বেড়াতে গেছিলাম । শান্তিনিকেতনে যাওয়ার উৎসাহ কোনদিন-ও ছিল না (মা কে বলি নি যদিও) , যাওয়ার কারণ ছিল মূলত দুটো ।প্রথমত , সেই নদীটার পারে প্রাণের গান শোনা যেত , এবং দ্বিতীয়ত ভারত সেবাশ্রমে থাকা । দ্বিতীয়টায় অবাক হচ্ছেন জানি , কিন্তু ওইটাই মূল আকর্ষণ । আমি শত্রুর ভাত খেয়ে, শত্রুর মুখ চিনতে গেছিলাম ।আমার চারআনা পড়াশুনা শিখিয়েছিল , শত্রুকে মারতে হলে , তার মুখ চিনতে হয় । জায়গাটা ঠিক শান্তিনিকেতনে নয় , পরে জেনেছিলাম জায়গাটার নাম মুলুক ।

তা ভারত সেবাশ্রমের তৎকালীন ' ভারতীয় কাল্‌চার ' জানা সর্বেসর্বা তার ব্রহ্মচর্যের আগে যাদবপুরে থাকতেন । তা তিনি , জাগতিক আনন্দ থেকে সম্পূর্ণ বিমূখ তিনি , তৃতীয় স্বর্গে সপ্তম মেঘে যার বাস তিনি , আমার বাড়ির পথ চিনতে বি.দাশগুপ্তকে ল্যান্ডমার্ক ধরলেন । যাদবপুরিইয় বা তদসম-তদ্ভব অঞ্চলের বাইরের মানুষদের সুবিধার্থে জানাই , বি দাশগুপ্ত অঞ্চলের সর্বশ্রেষ্ঠ মদের দোকান । দশমি,কালীপূজোর এবং ভোটের আগের দিন মোটামুটি সেলিম্পুর থেকে ঢাকুরিয়া অব্দি লাইন পরে । ব্রহ্মচারী উনি , ওইটাই ঠিকঠাক ল্যান্ডমার্ক ধরেছিলেন ।

সে যাই হোক , দুপুর বেলায় হাঁটতে হাঁটতে একটা গাছে ছাওয়া ধু ধু জমি দেখতে পাই আশ্রমের থেকে ঠিক দু মিনিট দূরে । স্বভাবসুলভ জানার তাড়নায় , জমিটায় ঢোকার মুখেই একটি বাচ্চা ছেলে পথ আটকে দাঁড়ায় । " এখানে আমার বাপ-দাদা শুয়ে আছে ,এটা বেড়ানোর জায়গা নয়" , গম্ভীর কিশোর কণ্ঠ পিছিয়ে আসতে বাধ্য করে ।

 

ভাগ্যিস হাতে শহুরে ক্যামেরা ছিল । ছোপ ছোপ গাল ,নাকে শিকনি, ফোকলা দাঁতের দু-তিন ফুটরা জুটে যায় । সক্কলের মুখের হাসি একরকমের , হাঁসিতে ধর্ম আলাদা করা মুশকিল । একমাত্র জল চাইলাম যখন , তখন একজন পানি আর একজন জল আনতে তাদের ঘর ছুটলেই বুঝে ছিলাম , হাসি বাঁ উচ্চতা এক হলেও আশ্রমের চোখে এরা আলাদা ।

 

সমস্ত খেলার মধ্যে , টেবিল টেনিস আর ভলিবলটা আমি মোটামুটি খেলে দিতে পারি । বিকেল বেলা সেবাশ্রমে ফিরে দেখলাম , মাঠে ভলি খেলা হচ্ছে । তো আমি আর আমার বন্ধু খেলতে শুরু করলাম । মিথ্যে বলব না ,দুজনে বেশ ভালোই খেলেছিলাম । নীল বেশ লম্বা , নেটে ভালোই খেলে, আর আমি থার্ড কোর্ট(পাড়ায়)...উলু বনে মিডল ম্যান( ডাইভ ভালো মারতাম , যে কোন বিষয় ) ।

খেলার সময় একটা ১২-১৩ বছরের বাচ্চা বার বার চোখ টানছিল । খেলতে একদম জানে না, কিন্তু ঠিক বলের কাছে পৌঁছে গিয়ে বল তুলে দিচ্ছিল । দারুণ ফিটনেস । খেলার পর, টিউবওয়েলে পা ধুতে গেলাম যখন , ছেলেটা কল টিপছিল । নাম জোসেফ । বন্ধুত্ব করে ফেললাম । বললাম তোর গ্রামটা দেখা । ও বলল "আগে ভজনটা হয়ে যাক , নইলে খেতে পাব না "...

 

সন্ধ্যা নেমছে । ওই অঞ্চলে আশ্রমে গোটা দশেক টিউব এবং আশে পাশের গ্রাম গুলোতে গোটা ৫এক ৬০ ওয়াটের বাল্ব ছাড়া কিস্যু জ্বলত না । সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায় নিকষ অন্ধকার , একটা তেলেভাজার দোকানের সামনে বসে , গ্রামের বুড়োদের গল্প শুনছিলাম । বয়স্ক মানুষদের নিজেদের মধ্যে গল্প, তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে শুনতে বেশ লাগে । তা হঠাতি ভজনের আওয়াজ শোনা গেল । আশ্রমের ভিতরে ঢুকে দেখি , মা সহ সব ভক্তরাই ভক্তি ভরে গান শুনছে । কনকনে শীতে , গায়ে চাদর জড়িয়ে গান গাইছে ,শাওতালি বাচ্চারা। বয়স ৭ থেকে ১৩ , বেশীর ভাগ আশেপাশে খোঁচাখুচি করছে, খরগোশের মতো সাদা সাদা দাঁত বের করে, কালো মুখে এক একটি পোট্রেট হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে । আমাদের জোসেফ ( ১৩ বছরের ভলি মাঠের বন্ধু) , তাদেরি মধ্যে একটি মুখ । বার বার ,মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ,অদ্ভুত সারল্যে হেসেই যাচ্ছে। সাধারণত নাগরিক আমরা এতো সহজে হাসতে পারি না , অবশ্য নাগরিক আমার এই ধারনাটা আমার-ই এক কমরেড অক্লেশে ভেঙ্গেছেন বেশ কিছুমাস হল...অবশ্যি তিনি কলকাতার নন ,তবে নাগরিক বটে । বছর পাঁচেকের একটা বাচ্চা ছেলে অবিরাম আরতি করে যাচ্ছে , আর বাকিরা বিরিবির ,এভাবেই ভজন শেষ হল । তারপর খাবার ঘরে একটা লম্বা লাইন । আমি বাইরে এসে গোল্ডফ্লেক ধরালাম । হঠাত হাতে একটা নরম হাতের ছোঁয়া । এক হাতে শালপাতায় মোড়া খাওয়ার ,জোসেফ আমার হাত টানছে ।

 

জোসেফের বাড়িটা গ্রামের একদম মাঝখানে । পাতকুয়া থেকে পুকুর অব্দি সব দেখিয়ে , এ গলি ও গলি ঘুড়িয়ে যখন বাড়ি নিয়ে এলো, ততক্ষনে আমি দেখে নিয়েছি প্রতিটাবাড়ির দরজায় ক্রস ঝোলানো । সন্ধ্যায় , বুড়োদের আড্ডায় বসে জেনেছিলাম, পাকা রাস্তা থেকে লাল রাস্তায় ঢোকার মুখে প্রথম গ্রামটা হিন্দু,ডানদিকেরটা মুসলমান এবং সেবাস্রমের পাশের দুটো সাওতালি গা ক্রিশ্চান । বুঝতে অসুবিধে হল না , কেন ঠিক এখানেই ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ ।

 

তা আমি আর নীল বাড়িতে ঢুকলে , জোসেফের দাদু আমাদের মহা সমাদরে বসতে দিলেন তার খাটিয়ায় । জোসেফের মা কোলের বাচ্চাটকে কোনক্রমে ওর দিদির কোলে দিয়ে দৌরে ভেতরে চলে গেলেন । দাদু জিজ্ঞেস করলেন " একটু চা খেয়ে যাবেন, আমাদের বাড়ি ?" কোন ভেজাল ছিল না , নাতির অসম বয়িসী বন্ধু ,'ভিনদেশী' নাগরিকদের প্রতি অকৃত্রিম আতিথেয়তাও বলতেই পারি । জোসেফের মা দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে জোসেফের হাতে কিছু একটা দিলেন । জোসেফ-ও হুট বলতেই ছুটে পালাল । ওদের বাড়িতে চিনি ছিল না । দাদু জানালেন, সবাশ্রম সাঁওতাল বাচ্চাদের ক্লাস ৫ পর্যন্ত পড়ায় , তারপর ধর্মান্তরের চেষ্টা করে। যারা হিন্দু হয় না , তাদের তাড়িয়ে দেয় । যারা ধর্মান্তরিত হয়, তারা খাওয়া পড়া পায় । জোসেফের দাদু জানিয়েছিলেন , জোসেফ ধর্মান্তরিত হবে না । জোসেফ জানিয়েছিল , ও অঙ্কতে ভালো ,ইংরিজিটা তেমন পারে না ।

 

তারপর যা হয়ে থাকে । নীল জোসেফের বোনকে কোলে নিল । আমি ছবি তুললাম । চিনি এলো । চা খেলাম । বেড়িয়েও এলাম । ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হাঁটছি , হঠাতি কানে এলো বাঁদিকের গ্রামটা থেকে সন্ধ্যের শঙ্খের আওয়াজ , প্রায় একি সাথে ডানদিকের গ্রামটা থেকে আজান ভেসে আসতে শুরু করল । রুপকথায় এমন হয় বোধহয় , সাঁওতাল গ্রামটায় বহু বহু দূরে দ্রিম দ্রিম শব্দে ধামসা বাজল । যে সেদিন ঐ নিকষ কালো রাতে ,অসংখ্য তারার নীচে,লাল কাঁকড়ে দাঁড়িয়ে ওই অদ্ভুত ক্যাকফনি শোনেনি, তাদের প্রত্যেকের জন্য খারাপ লাগে । সন্ধ্যে ভালো লাগলেই নাগরিক আমি ,নাগরিক কবিয়ালের "সন্ধ্যে হল,সন্ধ্যে হল " গানেই অভ্যস্ত। এই অদ্ভুত সুরটা অচেনা হলেও 'ছোঁয়াচ' লাগে । প্রতিটা আলাদা সুর , প্রতিটা আলাদা তাল , কিন্তু কেউ কাউকে কাটছে না-কেউ কাউকে ছাপিয়ে যাচ্ছে না। হয়ত আমার কানটাই গণ্ডগোলের ,কিন্তু সেদিন আমি কোন সুর কে কাউকে ছাপাতে শুনিনি , একটি অন্যটিকে আরও বেশী ভরাট করে তুলেছিল বোধহয় ।

 

পরদিন সকালে (আগন্তুক আমি) জোসেফকে বলেছিলাম , " তোদের কোন পরব আছে নাকি রে ? কাল আওয়াজ শুনলাম" ।

"না দাদা কাল রাতে বস্তিতে একজন মারা যায় , তাই শুনেছ"

 "তোদের নাচ হয় না ? কবে হয় "

"হয় তো পরবে।"

 

মাস খানেক পর ,অফিস থেকে বাড়ি ফিরছি ,তখনো শিত ভালোই । হঠাত মোবাইল বেজে উঠল । অপিরিচিত নাম্বার । তুললাম । ওদিক থেকে বলছে " দাদা পরশু পরব আছে , লাচ্‌ হবে , আসবে ?"

"তুই..."

"আমি জোসেফ । চিনতে পাড়ছ না ?"

" হ্যা পাড়ছি,তুই আমার নম্বর মনে রেখেছিস?"

"ও মা, দাদু লিখে রাখল যে ...আসবে ?"

"কি করে আসব ... আমার তো অনেক কাজ। মন দিয়ে অঙ্ক করছিস্‌ তো ।"

"হ্যা , একদিন কলকেতা যাব... তুমি বলেছিলে আমায় শহর দেখাবে। আমি কিন্তু গ্রাম দেখিয়েছিলাম "

"নিশ্চয়ই । তুই এলেই দেখাবো ...চিড়িয়াখানা, ভিক্টরিয়া সব । "

শেষের কথা গুলো আর মনে নেই । আমার কানে তখন সেই নিকষ কালো রাত্রের মিউজিকটা বাজছে । সরল সুন্দর একে অপরকে না ছাপিয়ে যাওয়া মানুষের সঙ্গিত ।মানুষ এভাবেও মনে রাখে ?

 

মোবাইল হারিয়েছিল কয়েকমাস পর । জোসেফ নামটা , নামের জন্য দেওয়া । নাম হারিয়েছি শহরের ভিড়ে । কিন্তু ছেলেটার মুখটা , সোজা সরল বাঁচার লড়াইটা, আর সেদিনের রাতের সুর আমায় কোনদিন-ও ছেড়ে যাবে না । আজকেও , যে কোন অন্ধকার রাতে ,যখন আলো দেখতে পাই না , তখন ওই মানুষের সুর-ই বাঁচিয়ে রাখে ।

 

সরি জোসেফ , চিড়িয়াখানা দেখানো হল না ।​

রবিবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৪

আপনার আল্টিমেট গোল মেটানোর দায় আমার রেজিস্টান্সের নয় ~ শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য্য

এই নোটটা বেশ কিছুদিন ধরেই নামাব ভেবে রেখেছিলাম। যেদিন দক্ষিণ ভারতে চুম্বন-আন্দোলনের জন্য বেশ কিছু ছেলেমেয়েকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে সেদিন থেকেই। তার মাঝখানে কলকাতাতেও যে এর রেশ ছড়িয়ে যাবে  সেটা ভাবিনি। আপাতত এই আন্দোলন অনেকের কাছেই বেশ মাথাব্যাথার কারণ হয়েছে। ঘোষিত দক্ষিণপন্থীদের অবস্থানটা মোটামুটি সহজ। তাঁরা কন্ডেম করেছেন, করবেন। এই রাজ্যের বামেরা না পারছেন ফেলতে না পারছেন গিলতে। মোটামুটি তেতো মুখ করে 'আন্দোলন যাঁরা করেছেন তাঁদের অভিরুচির ব্যাপার' বলে চালিয়ে দিয়ে সাথে ডিসক্লেইমার যোগ করে দিচ্ছেন 'কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষের দৈনন্দিন রুটি-রুজির লড়াই এভাবে সমাধান হবে না'। কোনো এক কাগজে পড়লাম মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র এই আন্দোলনকে ছেলেমানুষী আখ্যা দিয়েছেন।

তবে কিঞ্চিত মজা পেলাম তৃণমুল সরকারের প্রতিক্রিয়া দেখে। সিভিল সোসাইটির যে কোনো আন্দোলনকেই তাঁরা বিরোধীতা করাটা মোটামুটি অভ্যাসে পরিণত করেছেন। হয়ত জানেন-ও না কি কারণে কেন বিরোধীতা এদিকে তড়িঘড়ি মন্ত্রীসভার দুই বর্ষীয়ান মন্ত্রী দেখলাম এই আন্দোলনকে ধিক্কার জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। যদিও পশ্চিমবংগে এই দলীয়-রাজনীতির রংমুক্ত সিভিল সোসাইটির আন্দোলনের একটা মডেল প্রথম তৃণমূলের হাত ধরেই এসেছিল। সিংগুর নন্দীগ্রামের পর এক-ই প্ল্যাটফর্মে মমতা-কবীর সুমন-দোলা সেন-নক্সাল নেতারা, এবং আশেপাশে ঘুরছেন এপিডিআর-এর কর্মীরা, মাঝে মনে হয় একবার রাজনাথ সিং-ও এসেছিলেন। শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় সেই মঞ্চে উঠতে গিয়ে ধমক খেলেন মমতা ব্যানার্জীর কাছে। সিভিল সোসাইটির সেই আন্দোলনের এক্সটেনশনকেই এখন অস্বীকার করছেন তাঁরা।

তবে এই লেখার উদ্দেশ্য কোনও বিশেষ দলকে সমালোচনা নয়। সাম্প্রতিককালে বারে বারে সমস্ত রাজনৈতিক দল-ই বিব্রত হয়েছে সিভিল সোসাইটির নানা আন্দোলনে, কারণ পরিচিত বাম বা দক্ষিণপন্থী রাজনীতির কোনো ছকেই এদের ফেলা যাচ্ছে না। আবার সত্যি কথা বলতে কি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন শ্রেণী-সংগ্রামের সাথেও এই মুভমেন্টগুলোর কোনো প্রত্যক্ষ যোগ নেই। সে নির্ভয়া কান্ডে দিল্লীর রাজপথ অচল করে রাখাই হোক বা চুমু খাওয়া অথবা ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢোকানোর বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের রাস্তায় নামা। অস্বস্তির কারণগুলো মোটামুটি এরকম ঃ

১। কোনো আশু বা সুদুরপ্রসারী ইকনমিক প্রবলেমকে অ্যাড্রেস করছে না এই আন্দোলনগুলো।
২। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে এরা রাস্তায় নামছে না। বরং ব্যানার ছাড়া আসতে বলা হচ্ছে সকলকে।
৩। আন্দোলনের মুখ হিসেবে উঠে আসছেন আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীর, বেশিরভাগ সময়েই ছাত্র-ছাত্রী। খেটে খাওয়া গরীব নিম্নবিত্ত মানুষের সাথে কানেক্ট করা যাচ্ছে না যাঁদের।

মোটামুটি এই তিনখানা বিষয়ে বাম বা দক্ষিণ, বিশেষত বাম, সমস্ত চিরাচরিত পার্টিগুলোই বেশ কনফিউজড। কতটুকু রাখবেন কতটা ছাড়বেন, অংশগ্রহণ করবেন না বাইরে থেকে সমর্থন এসব নিয়ে নানারকম আলোচনা তর্ক-বিতর্ক শোনা যাচ্ছে বামপন্থীদের অন্দরমহলে। কিস অফ লাভ এই সমর্থন বিরোধীতার মার্জিনটা অনেকটা স্পষ্ট করে তুলেছে। যে দক্ষিণপন্থীরা নির্ভয়া আন্দোলনে ব্যানারহীন রাজনীতি নিয়ে ঢোঁক গিলতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরা মুক্তকন্ঠে কিস অফ লাভ-কে 'ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী' বলে দাগিয়ে দিতে পারছেন। যে বামেরা কামদুনির ঘটনায় পথে নেমেছিলেন তাঁরাও সহজেই ডিস্ক্লেইমার দিতে পারছেন যে 'এই আন্দোলন কোনো বেসিক ইস্যুর সমাধান করবে না'। কিন্তু তার পরেও অনেকগুলো প্রশ্ন রয়েই যায়।
সেগুলো শুধু কিস অফ লাভ নিয়েই নয়। বরং ২০১৪ সালের ভারতবর্ষের প্রতিরোধের চরিত্র নিয়ে।

১৯৯১-পরবর্তী ভারতবর্ষে শহুরে মধ্যশ্রেণীর একটা চমকপ্রদ উত্থান হয়েছে। তাদের হাতে টাকা এসেছে, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, মার্কেট এক্সপ্যানসন হয়েছে এবং সেই সাথে এসেছে অ্যাসপিরেশন। এই উচ্চাকাংখা শুধু ব্যক্তিগত উন্নতির উচ্চাকাংখা নয়, এ হল শাসন প্রক্রিয়ার অংশ হবার উচ্চাকাংখা। বাজার-ও স্বাভাবিক নিয়মেই চেয়েছে তার ক্রেতা যেন সেন্ট্রাল লেভেলে ডিসিশন মেকিং-এর জায়গায় থাকে, ফলে বাজারের নিজেকে প্রসার করতে সুবিধে হবে। নরেন্দ্র মোদীর উত্থানের পেছনে এই রাইজিং মধ্যশ্রেণীর একটা বড় অংশের আকাঙ্ক্ষা একটা বড় কাজ করেছে। এবং সেই সাথেই ভারতবর্ষের রাজনীতি একটা দক্ষিণপন্থী বাঁক নিয়েছে, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দুই দিকেই। কিন্তু এই যে মধ্যশ্রেণী এটা কোনো হোমোজিনাস এন্টিটি নয়। এর মধ্যেও নানা রঙ আছে। একটা অংশ শুধুই ইকনমিক গ্রোথকে পাখির চোখ করে। একটা অংশ তার সাথে সাথে সামাজিক বৃদ্ধিও চায়। তাদের কাছে ভারতবর্ষের বর্তমান যা অবস্থা 'আ লিবারাল ইকনমি অ্যান্ড আ কনজারভেটিভ সোসাইটি' সেটা কাম্য নয়। অর্থর্নৈতিক স্বাধীনতার সাথে সাথে ব্যক্তি-স্বাধীনতার ওপর তারা জোর দেয়। আবার আরেকটা অংশ আছে যারা চায় 'আ কনজারভেটিভ ইকনমি অ্যান্ড আ লিবারাল সোসাইটি'। এই অংশটা তুলনামুলকভাবে ছোট যারা মোটামুটি মোদী-বিরোধী। এই নানা অংশের চাহিদা পুরণের জন্য তারা সবসময়েই স্টেটের সংগে দর-কষাকষিতে নামছে। একটা অংশ দাবী করছে 'তুমি আমায় মুক্ত বাজারের সুযোগ সুবিধা দাও বদলে আমি তোমায় রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা দেব'। আরেকটা অংশ দাবী করছে 'তুমি আমায় স্টেটের চোখরাংগানী থেকে সামাজিক মুক্তি দাও বদলে আমি তোমার অর্থনৈতিক আগ্রাসনে নাক গলাব না'। এরকম আর কি!

মুশকিলটা হল বামপন্থীরা দুর্বল হয়ে যাবার কারণে সাবেকি শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের অভিমুখ অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। আগে অন্যান্য বর্গগুলোর এই দাবীদাওয়াগুলো কিছুটা বামেদের আন্দোলনের ফলে মিটত আর বেশির ভাগটাই চাপা পড়ে যেত অনেক বেশি তীব্র এবং অনেক বেশি পলিটিকালি ওরিয়েন্টেড অন্যান্য নানা আন্দোলন দিয়ে, যেমন ট্রেড ইউনিয়ন মুভমেন্ট। এখন সেই ফাঁকা জায়গাটা পুরণ করার জন্য উঠে আসছে সামাজিক শক্তিগুলো। দক্ষিণপন্থীরা এই আন্দোলন চালাতে পারবে না কারণ তারা নিজেরা রাষ্ট্রশক্তির অংশ। পড়ে থাকে
দলীয় রাজনীতির রঙমুক্ত সামাজিক বর্গগুলো, এলজিবিটি, পরিবেশরক্ষার আন্দোলন, কিস অফ লাভ, উচ্ছেদবিরোধী সংগ্রাম এসব। অনেক সময়েই এসব আন্দোলনে যুক্ত করে নেওয়া হচ্ছে প্রান্তিক নিম্নবর্গীয় মানুষজনকে, তাদের দলীয় রাজনীতির রংটুকু বাদ রেখে। আবার অনেক সময়েই এগুলো আবদ্ধ থাকছে মধ্যবিত্তের মধ্যে।

এই যে অচিরাচরিত রেজিস্টান্স, তাহলে কি একে আমরা গ্রহণ করব না? কবে বামপন্থীরা আবার শক্তিশালী হবেন সেই দিশা দেখার অপেক্ষায় বসে থাকব? ভারতবর্ষে যে ছোটবড় এতগুলো তাহিরীর স্কোয়ার ঘটে চলেছে প্রতিদিন, সেটা কপিবুক মুভমেন্ট হচ্ছে না বলে অবজ্ঞা করব? এবং আমরা, বামেরা বা নানা রঙের লিবারাল রাজনীতিকরা, বুদ্ধিজীবীরা ঠিক করে দেব কোন আন্দোলন ঠিক কোনটা ভুল? সব থেকে বড় কথা আমরা ঠিক করে দেবার কে? কেনই বা আমাদের স্বপ্নপূরণের দায় সেই প্রতিরোধের ওপর চাপাব?



একটা আন্দোলন শুরু হবার পরে সেটা কোন ফর্মে চলবে কেউ জানে না, বলতেও পারে না। সেটা অনেক সময়েই আমাদের পছন্দ নাও হতে পারে, তাতে সেই প্রসেসের কিছু যায় আসে না। এটা অনেকটা স্বতঃস্ফুর্ততার ওপর নির্ভর করে। এই রেজিস্টান্সের মধ্যে অনেক মতবাদ আলাদা আলাদা ভাবে না মিশেও পাশাপাশি আছে। বিভিন্ন মতবাদ তাদের বিভিন্ন লাইন নামায় একটা গণ-আন্দোলনে। যারা কিস অফ লাভ করছে তাদের-ই অনেকে হয়ত নরেন্দ্র মোদিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছিল। কিন্তু এক ইস্যুতে রেজিস্টান্স দেখায়নি বলে অন্য ইস্যুতে তাকে অবজ্ঞা করবই বা কেন? বরং যে্টা পারি তা হল পাশাপাশি কিছুটা চলা। যদি আমার অ্যাসপিরেশন, একটা বামপন্থী দলের রাজনৈতিক হিসেব নিকেশ এবং একটা এলজিবিটি আন্দোলন, এই তিনখানার অভিমুখ শেষ পর্যন্ত এক নাও হয়, তাহলেও যেটা করা যাবে সেটা হল কিছুটা রাস্তা পাশাপাশি হাঁটা। হয়ত এক বামপন্থী হিসেবে আমি ট্রেড ইউনিয়ন করেছি সারাজীবন। সেটা তো আমায় বাধা দেয় না সমকামীদের আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে, এটা জেনেও যে সেই সমকামীদের-ই কেউ কেউ ভারতে লেবার ল-এর তীব্র বিরোধী হতে পারেন। কিন্তু একটা ক্ষেত্রে যে শোষক সে অন্য ক্ষেত্রে শোষিত হতেই পারে এই সত্যিটা কেন অস্বীকার করব?

ক্লাসিকাল মার্ক্সিস্টরা বলেন, এবং আমাদের দেশে তাঁরাই বেশি স্বীকৃত, যে সমস্ত সমস্যা আসলে এক সুতোয় বাঁধা। জাত পাতের বৈষম্য বা লিংগ-সমতার দাবীতে আন্দোলন আসলে অর্থনৈতিক প্রশ্নগুলোর নানা আদলে রিফ্লেকশন। মনে হয় এখন সময় এসেছে এই ইউনিফায়েড থিওরির বদলে সমস্ত আন্দোলনকে তার নিজের পার্স্পেক্টিভে দেখার। নাহলে ওই 'যে যেখানে লড়ে যায় আমাদের-ই লড়া' বলে সমস্ত প্রতিরোধের ওপর আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষিত সমাজ নিজেদের আকাঙ্ক্ষা ইচ্ছে অনিচ্ছেগুলো চাপিয়ে দেবে এবং দিয়ে এসেছে এতদিন ধরে। আর তাই প্রান্তিক মানুষের উচ্ছেদ হওয়ার সংগ্রাম শুধুই উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন হিসেবে দেখা হোক। কবে সরকার বদলাবে ব্যবস্থা পাল্টাবে সেই দিকে না তাকিয়ে আশু কোন উপায়ে রেজিস্টান্স করা যায় এবং জাস্টিস আনা যায় সেটার কথা ভাবা হোক। তার জন্যে যদি রাজনৈতিক দলের হাত ধরতে হয় তো হবে। যদি রাজনৈতিক দল সেই আন্দোলনকে জোর করে নিজের প্রোগ্রামের সাথে মিলিয়ে দিতে চায় তো দলহীন ভাবেই চলতে হবে। প্রয়োজনে বিরোধী দলের-ও হাত ধরতে হবে। কিন্তু কবে ব্যাকরণ মেনে একটা স্ট্রাকচারড বামপন্থী শ্রমিক কৃষকের আন্দোলন হবে তার অপেক্ষায় বসে থেকে এই আনস্ট্রাকচারড রেজিস্টান্সগুলোকে অবজ্ঞা করার মতন জায়গায় এখন য়ার নেই আমরা।

এখন সম্ভবত বোঝার সময় এসেছে যে সমস্ত রেজিস্টান্স আসলে অধিকার রক্ষার লড়াই। সে কিস অফ লাভ-ই হোক বা নির্ভয়া। এবং এক আন্দোলনের বিরোধী হয়েও অন্য আন্দোলনে কারোর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করায় সমস্যা নেই কোনও। কিস অফ লাভ কে যে বিরোধীতা করছে ভারতীয় ঐতিহ্যের বিরোধী বলে কামদুনির ঘটনা ঘটলে সে-ই ব্যারিকেড গড়তে ছুটে যাবে এবং তার সেই ছুটে যাওয়াটাও এক-ই রকমভাবে সমান সত্যি। সেই সত্যিটাকে অস্বীকার করলে গোটা শাহবাগ বা তাহিরীর স্কোয়ারকে অস্বীকার করা হয়। বরং বামপন্থীদের কাজ হতে পারে সেই আন্দোলন তাঁদের পছন্দসই না হলেও তার পাশাপাশি হাঁটা। একটা মডেল দিল্লীতে আম আদমী পার্টি দেখিয়েছে, দেখাচ্ছে। রেজিস্টান্সের প্রয়োজনে গান্ধীবাদ, বামপন্থা, অ্যানার্কি যে কোনো মডেল বা তাদের মিশ্রণ স্বাগত। কোনোকিছুই অচ্ছ্যুত নয়, প্রতিরোধ সংগ্রামে। আর কে কেমনভাবে কোন ইস্যুতে প্রতিরোধ করবে সেটা আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে কেউ ঠিক করে দিতে পারে না। এমনকি সেই রেজিস্টান্স যদি ফর দ্য সেক অফ রেজিস্টান্স-ও হয় তো সেটাও স্বাগত। লোকদেখানো হলেও স্বাগত। এই অক্ষম সময়ে দক্ষিণপন্থার তীব্র বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে সামাজিক-অর্থনৈতিক আগ্রাসন মুখ বুজে মেনে নেবার বদলে কেউ যদি রাজভবনের গায়ে একটা মলোটভ ককটেল ছুঁড়ে মারে, কেউ যদি কলকাতার রাস্তায় সাইকেল চালানোর দাবীতে মুভ করে, অথবা কেউ যদি শুধুই লোক-দেখানোর জন্য রাস্তা অবরোধ করে চুমু খায় তো সেই সব, সবকিছুই স্বাগত।

এই আন্দোলনগুলো আল্টিমেটলি কোন ফর্ম নেবে কেউ বলতে পারে না। হয়ত মুছে গেল কিছুদিন বাদে। আবার হতেই পারে পাশাপাশি চলতে চলতে মিলে গেল একে অপরের সাথে। ভবিষ্যতের ঠিকা নিয়ে তো কেউ-ই বসে নেই! হতেই পারে যে একটা পর্যায়ে গিয়ে মধ্যবিত্তের অ্যাসপিরেশন এবং নিম্নবিত্তের চাহিদা মুখোমুখী প্রতিদ্বন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। উদাহরণস্বরূপ, কিস অফ লাভ-এর সংগঠকদের কোনো গ্রামের মেয়ে তো বলতেই পারে যে 'আপনাদের এই কাজের জন্য আমার বাড়ি থেকে আমায় কলকাতায় পড়তে পাঠাচ্ছে না'। আবার উল্টোটাও হতে পারে। হতেই পারে যে নির্ভয়া কান্ডের পর তথ্যপ্রযুক্তির মহিলা কর্মীরা প্রশ্ন তুলে দিলেন যে 'চিরাচরিত ঝুপড়ি, রাস্তার ধারের দোকান, রুটিওয়ালা ইস্তিরিওয়ালা এই চেনা পরিবেশকে উচ্ছেদ করে আর্বানাইজেশনের নামে স্টেট যে হাইরাইজ আর শপিং মল বানিয়ে চলেছে গন্ডগ্রামের মতন ফাঁকা জায়গায়, সেই অচেনা পরিবেশে অচেনা মুখের ভিড়ে আমার রাত্রিবেলা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে ভয় লাগে'। এই বিচ্ছিন্নতা আর মেলানোর প্রসেসটা কোথায় গিয়ে শেষমেষ দাঁড়াবে সেটা সময় বলবে। তবে 'সব পথ এসে মিলে যাবে শেষে' এমন স্বপ্ন আজকের দিনে না দেখাই ভাল। যদি কেউ
উদ্দেশ্যহীনতার অভিযোগ তোলেন তাহলে একটাই কথা বলার, পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত এমন কোনো রেজিস্টান্স হয়নি যেটা ভবিষ্যত চোখের সামনে দেখতে পেয়েছে। রেজিস্টান্স হয়েছে আশু সমস্যার খাতিরে। আর উদ্দেশ্য নেই বলে মানুষের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, জাস্টিসের জন্য এবং অপ্রেশনের বিরুদ্ধে তার লড়াই থেমে থাকবে না। আপনার আল্টিমেট গোল মেটানোর দায় আমার রেজিস্টান্সের নয়।

জাঁ পল সাঁর্ত্র বুড়ো বয়েসে, স্বপ্নভংগ তিতকুটে মনে এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন যে আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে যেখানে দক্ষিণপন্থী পার্টিগুলো হারামজাদা আর বামপন্থী পার্টিগুলো বিপ্লবের সব থেকে বড় শত্রু, সেখানে তিনি চেয়ে আছেন নতুন কোনো ফোর্সের উঠে আসার দিকে। কোনো এক তৃতীয় শক্তি যারা প্রতিরোধ কামনায় রাত জাগবে। আমরা সেই শক্তি দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে, দিনের পর দিন। কপিবুক মুভমেন্ট নয় তো কি এসে গেল! মলোটভের অভাবে পাঁকভরা বেলুন ছুঁড়েই আপাতত না হয় কমরেড আচার্য্যর নিদ্রাভংগ করা যাক!

বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৪

কিষাক্ত ~ পার্থ দাশগুপ্ত


হাম ভাই তুম বোন -
হবে না তো চুম্বন।
তাই ঘরে জুস খাই,
আপিসেতে ঘুষ খাই।
কেউ যদি খায় কিস
হাত করে নিশপিশ।
দিই তাকে পিটিয়ে
চুমু-ঝাল মিটিয়ে,
ডেকে দিই হরতাল
লিখি এডিটোরিয়াল।
কারও ঠোঁটে শাস্ত্র
কাহারও বা কাস্ত্রো,
কারও ঠোঁটে রামনাম
কারও ছুতো ইসলাম -
চুমু নিয়ে সব্বাই
গলাগলি সব ভাই।
রাস্তায় মুতে দাও,
ন্যাপকিন ধুতে দাও,
খুন করে পুঁতে দাও,
ফুটপাথে শুতে যাও,
কাটমানি ছুঁতে চাও
তোলা তুলে খুঁটে খাও -
তাতে নেই কোনও পাপ
সাড়ে সাত খুন মাপ।
চুমুতেই যত বিষ,
ফণা তুলে হিসহিস
বলে দিই এখনি।
ফাঁদটি তো দেখনি -
খাস কলকাত্তায়
সাঁঝবেলা সাতটায়
যদি মাঝরাস্তায়
দোকানের পাশটায়
প্রেমিকাকে চুমু খাস
পশ্চাতে দিমু বাঁশ।
ঠোঁট রাখ সামলে
শ্রীরামের নাম লে।
প্রেম কর প্লেটোনিক
বুঝেছিস বেরসিক?


Courtesy: http://thecommentator.in/2014/11/তোমাকে-ভাবাবোই-কিষাক্ত/

রবিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৪

ছিঃ! ছিঃ! এত্তা জঞ্জাল... - সুশোভন



অন্য রাজ্যে কর্মরত হওয়ার কারণে বাড়ি আসার সেভাবে সুযোগ হয় না সবমিলিয়ে বছরে হয়ত দিন পনেরো আবার এই ১৫ দিন ম্যানেজ করাও একটাস্কিল প্রথমত, প্রায় সারা বছরের প্ল্যান ভেবে-চিন্তে , ক্যালেন্ডার দেখে ছুটি ম্যানেজ তারপর 'ম্যানেজিত' ছুটির দিন সময় দেখে টিকিট করা এর সঙ্গে যদি সেটা দুর্গা বা কালির আশীর্বাদ থাকে তাহলে, ট্রেনের রিজার্ভেশেন   মাস আগেই না করলে, ‘মায়ের কৃপায়ঘেঁটে হয়ে যেতে বাধ্য এবার অফিসের ছুটির ক্যালেন্ডার দেখে, একদম ঝোপ বুঝে কোপ মেরে, ৩টি ক্যাজুয়াল লিভ নিয়ে  বাক্স-প্যাঁটরা গুটিয়ে দুর্গা দুর্গা বলে সোজা বাড়ি চলে এলাম কিন্তু, দুর্ভাগ্য আপিসের ছুটির ক্যালেন্ডার যখন তৈরি হয়েছিল তখন লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হয়নি ৫৬ ইঞ্চির প্রধানমন্ত্রীর রাজ্যাভিষেক হয়নি দেশ গেরুয়া রাজপুত্রদের হিন্দুস্থান হয়ে ওঠেনি। 'আশ্বিনের কোন এক শারদপ্রাতে...' স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মনে হল এ দেশ বড্ড নোংরা হয়ে গেছে লোকে এখানে থুতু ফেলে তো ওখানে পানের পিক, সেখানে বিস্কুটের প্যাকেট তো এখানে আধ পোড়া বিড়ির টুকরো তাই ঝাঁট দিয়ে বিদেয় করতে হবে এত্তা জঞ্জাল সুতরাং ঠিক গান্ধীজীর জন্মদিনেই (একদিন আগেও না পরেও না) উনি ক্যামেরার সামনে কিছুক্ষণ ঝাঁট দেবেন আর সবাই কে আপিস এসে স্ব-ইচ্ছায় ঝাঁট দিয়ে দেশ পরিষ্কারের অনুরোধ করবেন ব্যাস, মাসে আগের টিকিট, বছর খানেকের প্রস্তুতি শেষ ছুটি বাতিল
 
গায়ে লেগেছে ? হয়ত তাই বিরক্ত হয়েছি ? হয়ত তাই স্বার্থক্ষুন্ন হয়েছে ? হয়ত তাই কিন্তু আপত্তিটা শুধু সে কারনেই নয় বরং অনেক বেশি করে মজ্জাগত কারনে এবং চমক সর্বস্ব রাজনীতির প্রতি অবিশ্বাসের কারনে প্রশ্নটা কর্মসূচী বা উদ্যোগ নিয়ে নয় কখনই নয় নিশ্চিত ভাবেই এই উদ্যোগ কে স্বাগত এই কর্মসূচী কে সাদর আমন্ত্রন। কিন্তু তাঁর সাথে সাথেই এই কর্মসূচীর কার্যকারী সাফল্য নিয়ে যেমন সংশয় থেকে যায়, উদ্যোগের অন্তর্নিহিত কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে যেমন বারবার হোঁচট খেতে হয়, তেমনই কিছু প্রশ্নও আবার অনুত্তরিত রয়ে যায়  

যদি প্রধানমন্ত্রী আর তাঁর সাথে একমুঠো মন্ত্রী, আমলা, চিত্রতারকা, খেলোয়াড় সেলিব্রেটি মিলে রাস্তা-ঘাটে বছরে একদিন ঝাঁটা দিয়ে জঞ্জাল পরিষ্কার করলেই দেশকে ‘নির্মল’ আর ‘পরিচ্ছন্ন’ করা যেত তাহলে সেটার জন্য স্বাধীনতার ৬৭ বছর পর ‘আচ্ছে দিনে’ আসার অপেক্ষা করতে হত না। আমাদের দেশের প্রায় সর্বত্র বিশেষ করে বিভিন্ন বড় শহর গুলি আদপে কেন এতো নোংরা, সে সমস্যা, সরকারি পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও নীতির অভাব গভীরে গিয়ে গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন না করে পরিকল্পনা মাফিক রূপরেখা তৈরি করে বাস্তবায়নের চেষ্টা না করলে ‘স্বাচ্ছ ভারত অভিযানের’ বকলমে শুধু ক্যামেরায় সামনে ছবি তোলা, মিডিয়ায় ঝড় তোলারই নামান্তর হয়ে উঠবে ঠিক যেমন ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে “গরিবি হাটাও” বা রাজীব গান্ধীর সময় “সাক্ষরতা অভিযান” আজ শুধু শ্লোগানের নামান্তর হয়ে ইতিহাসে পাতার কয়েকটা লাইনেই সীমাবদ্ধ।   

২০০১ সালে দেশের শহরের সংখ্যা ৫১৬১ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৭৯৩৫টি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সেন্সাস শহরের সংখ্যা ২৫২ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৭৯২টিতে ১৯৫১ সালে আমাদের দে‍‌শের শহর বা নগরে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ছিল ৬.২ কোটি, ২০১১ সালে তা বৃদ্ধি পে‍‌য়ে হয়েছিল ৩৭.৭ কোটি যা ২০৩১ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হবে, ৬০ কোটি যদিও সাংবিধানিকভাবে প্রতিটি শহরেই পৌরসভা থাকাটা বাধ্যতামূলক কিন্তু তথাপি আমাদের দেশের অধিকাংশ শহরেই এখনও পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়নি দেশের শহরগুলির গড়ে প্রায় ১৭ শতাংশ মানুষ বসবাস করেন বস্তি এলাকায় বহু শহরে আজও পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহ ব্যবস্থা চালু হয়নি, নিকাশি ব্যবস্থা উন্মুক্ত, নর্দমার আবর্জনা ন্যূনতম পরিস্রুত না হয়ে পড়ছে নদী, জলাশয় বা সমুদ্রে, নেই স্বাস্থ্যসম্মত ও বিজ্ঞানভিত্তিক জঞ্জাল অপসারণ ব্যবস্থাপনা, এমনকি নেই বিভিন্ন ধরনের জঞ্জাল পৃথকীকরণের ব্যবস্থাও আমাদের দেশের শহরগুলিতে প্রতি বছরে সৃষ্টি হয় মোট ৬০-৭০ মিলিয়ন টন বর্জ্য পদার্থ বেশিরভাগ শহরের যে আবর্জনা দৈনিক সৃষ্টি হয় তার ৫০ ভাগও সংগৃহীত হয় না সরকারি হিসেব অনুসারে শহরেরই ৫৪ শতাংশ মানুষের এখনও বাড়িতে নিজস্ব শৌচালয় নেই গ্রামের অবস্থা আরও খারাপ  সমস্যা সব চাইতে বেশি মধ্য প্রদেশ, ছত্তিশগড় এবং ঝাড়খণ্ডে যেখানে প্রায় ৭৭ শতাংশ গৃহে‍‌ শৌচালয় নেই ৯২ শতাংশ মানুষ উন্মুক্তস্থানে শৌচকার্য করে থাকে সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ডের রিপোর্ট অনুসারে ২০১২-১৩ শহরে প্রতিদিন ১,৩৩,৭৬০ মেট্রিক টন MSW (Municipal Solid Waste) তৈরি হয় যার মাত্র ২৫, ৮৮৪ TPD-(Tons per day) সঠিক ব্যবস্থা করা হয় যদি এভাবে বার্ষিক ৬২ মিলিয়ন MSW কে সঠিক ভাবে অপসারিত ও মজুত( dump) করতে হয় তাহলে প্রতিদিন ৩,৪০,০০০ কিউবিক মিটার জমির (landfill space ) প্রয়োজন যে প্ল্যানিং কমিশন কে প্রধানমন্ত্রী তুলে দিতে চাইছেন তাঁদের রিপোর্টই বলছে২০০০ সালের Municipal Solid Waste আইনের ধার্য সময়সীমা পেরিয়ে যাবার পরও সরকার ও প্রশাসন তার সঠিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র উদ্যোগী হয়নি শহরের পরিকাঠামো উন্নয়নে কারণীয় সম্পর্কে কেন্দ্রের বিগত সরকার যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছিল, তাদের সুপারিশ মতো আমাদের দেশের শহরগুলির পানীয় জল, পয়ঃপ্রণালী, রাস্তা, বর্জ্য পদার্থ ব্যবস্থাপনা, যানজট নিরসন ইত্যাদির জন্যে ২০০৯ সালের মূল্যমানের ভিত্তিতে ২০১২ সাল থেকে ২০৩২ সাল এই ২০ বছরের জন্যে প্রয়োজন প্রায় ৪০ লক্ষ কোটি টাকার কোথা থেকে আসবে এই বিপুল পরিমান টাকা ? কিভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব এই গুরুতর সমস্যার ? সরকারি স্তরে কি ধরনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে ? কর্মসূচী রুপায়নের রূপরেখাই বা কি হবে ? ‘স্বাচ্ছ ভারত অভিযানের’ গ্ল্যামারে আড়ালে, মিডিয়ার ফ্ল্যাশের ঝলকানিতে এই প্রশ্নগুলো আগের মত একই রকম উপেক্ষিত রয়ে গেলো। তাই ৫৬ ইঞ্চির বুক ফুলিয়ে প্রধানমন্ত্রী, সমাধানটা ঠিক যতটা সহজ ভাবছেন, বাস্তবে কিন্তু বিষয়টা ততটা সহজ নয়। কি বলুন ?     

‘স্বাচ্ছ ভারত অভিযানের’ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বললেন ‘আব হামারে কর্তব্য হে কি গন্দেগি কো দূর করকে ভারতমাতা কি সেবা করে’। কিন্তু যথেষ্ট সচেতন এবং সন্তর্পণে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গেলে তা হল আমাদের দেশের জাত-পাতের সমস্যা। আর সামাজিক ভাবেই এই সমস্যা আমাদের কাছে বর্তমানে বোধহয় এতই আত্মিক এবং নিবিড় যে আমরাও মিডিয়ার সাথে সাথে এই বিষয়ে ভাবার, আলোচনা করার এবং সমস্যা সমাধানের কোনরূপ প্রয়োজন যে রয়েছে, সেটাই অনুভব করিনা। আসলে আমাদের সমাজের বৃহত্তর অংশ ধর্মাচরণের অনুমোদন নিয়েই সমাজের কিছু বিশেষ শ্রেণীকেই জন্মগত ভাবে ঝাড়ুদারের দায়িত্ব সমর্পণ করেছে। ২০০৭ সালে ‘India Stinking’ বইয়ে গীতা রামাস্বামী লিখেছেন এই মানুষগুলি, দিল্লীতে বাল্মীকি উত্তরপ্রদেশে ধনুক, পশ্চিমবাংলায় হাণ্ডি, মেথর, অন্ধপ্রদেশে পাকি আবার তামিলনাড়ুতে থোত্তি সম্প্রদায়ভুক্ত। আজ স্বাধীনতার ৬৭ বছর পর যখন আমাদের দেশের অনেকের মানিব্যাগ প্রথমবিশ্বের মানিব্যাগের সাথে টেক্কা দিচ্ছে, যখন আমরা ইংরেজি সিনেমার ‘থ্রিলিং’ দৃশ্যে মনোরঞ্জনের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাচ্ছি, টুইটারে আইস বাকেট চ্যালেঞ্জ নিচ্ছি ঠিক তখনই পেটের দায়ে এই মানুষগুলি আমাদের সমাজ ঝাঁটিয়ে পরিষ্কার করার সেই মহান কর্তব্য পালন করছেন অথচ রাষ্ট্র এই মুষ্টিমেয় মানুষ গুলি সামাজিক স্বীকৃতি তো দূরের কথা, নুন্যতম মজুরি বা কাজের স্থায়ীকরনের বিষয়েও আশ্চর্য রকমভাবেই উদাসীন। খুবই সূক্ষ্মভাবেই আমাদের বাক্যবাগীশ প্রধানমন্ত্রী তাঁর এই চমকসর্বস্ব প্রচার অভিযানের জন্য বেছে নিয়েছিলেন দিল্লীর সেই  বাল্মীকি বস্তিকেই যেখানে গিয়ে গান্ধীজী কিছুদিন ছিলেন। গান্ধীজী অনুরূপ সচেতনতামূলক কর্মসূচীতে সাধারন ঝাঁটাই ব্যবহার করেছিলেন আসলে লম্বা হাতল দেওয়া ঝাঁটায় যেমন কোমর নুইয়ে ‘মাটির কাছাকাছি’ পৌঁছান যায়না ঠিক তেমনি ধোপ-দুরস্ত কেতাবি পোশাকের ঝাড়ুদার আমাদের দেশে বড্ড বেশি ‘কসমেটিক’ এবং বেমানান। আসলে এই সমস্যার গভীরে গিয়ে সমাধান করার পথে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা বোধহয় তাঁর রাজনৈতিক চেতনা নিয়ন্ত্রনকারি আদর্শগত ধর্মীয় অনুশাসন। ২০০৭ সালে নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্যের একটি সংকলন “কর্মযোগ” নামে প্রকাশিত হয়, এক বক্তব্যে উনি গুজরাটের সাফাইকর্মী দের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- “ ...আমি মনে করিনা যে সাফাই কর্মীরা শুধুমাত্র পেট চালানোর জন্যই একাজ করেন। যদি তাই হত তাহলে তাঁরা দিনের পর দিন এই কাজ করে যেতেন না। কোন সময় নিশ্চয় এদের মধ্যে কারও বোধোদয় হয়েছে যে সমাজের স্বার্থেই  ভগবান আমাদের সাফাই কাজে নিযুক্ত করে পৃথিবী তে পাঠিয়েছেন। এটি একটি আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা। আর তাই নৈতিক কর্তব্য রূপেই তাঁদের এই কাজ পালন করা উচিত...” ( সুত্রঃ কর্মযোগ পৃষ্ঠা- ৪৮,৪৯)। নরেন্দ্র মোদী যদি নিজের জ্ঞানচক্ষু  উদ্ভাসিত করেন তাহলে দেখতে পাবেন, আম্বেদকর গান্ধীজীর অনুরূপ মন্ত্যবের প্রেক্ষিতে ঠিক কি বলেছিলেন... “ গরিবি শূদ্রদের বিধেয় অন্য কারও না, সাফাই শুধু অচ্ছুত(untouchables ) দের কাজ এটাই তাঁদের জীবনের উদ্দেশ্য  এই ধরনের মন্তব্য আমাকে, ফ্রেঞ্চ দার্শনিক Voltaire- কথা স্মরন করিয়ে দেয় যিনি বলেছিলেন... তোমার দুর্ভোগ যদি অন্য কারও সুখের কারন তাহলে তা গর্বের, এমন জ্ঞানদান উপহাস ছাড়া আর কিছুই না। তোমার দেহাবশেষ খেয়ে কিছু পোকা মাকড়ের উপকার হবে একথা মৃতপ্রায় ব্যাক্তির কাছে আর যাইহোক কোন সান্ত্বনা হতে পারে না...” (সূত্রঃ What Congress and Gandhi have done to the Untouchables, Dr Ambedkar : Writings and Speeches, Vol 9  P. 290-93)  
বাস্তব এটাই যে নরেন্দ্র মোদী মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন, ২০০৭-এ গুজরাটে “নির্মল গুজরাট” নামে অনুরূপ একটি কর্মসূচী শুরু করেছিলেন, পরবর্তী সময় ২০০৯, ২০১১ এবং ২০১৩-তে সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ডের রিপোর্ট অনুসারে ‘critically polluted areas’ ক্রমাঙ্কের প্রথমেই জায়গা করে নিয়েছে সেই সাধের নির্মল গুজরাট-ই। ২০০৯- এ গুজরাটের আঙ্কেলেশ্বর এবং ২০১১ -১৩ তে ভাপি শিল্পাঞ্চল যথাক্রমে ৮৮.৫০ এবং ৮৫.৩১ CEPI(Comprehensive Environmental Pollution Index) দেশের সবচেয়ে দূষিত জায়গার অন্যতম সেরা তাই আগেই বলেছি প্রশ্নটা একেবারেই উদ্যোগ বা কর্মসূচির নয়। প্রশ্নটা চমক সর্বস্বতার, প্রশ্নটা পরিকল্পনা অভাবের, প্রশ্নটা  সমস্যা অনুধাবনের, প্রশ্নটা গভীরে যাওয়ার অনিচ্ছায়, প্রশ্নটা বাস্তবায়নের প্রাসঙ্গিকতায়। এই প্রশ্নগুলো অনুত্তরিত থাকলে, এড়িয়ে গেলে,    মিডিয়ার প্রচার পাওয়া যেতে পারে, টুইটারে আর ফেসবুকে ঝড় উঠতে পারে, ক্যামেরার ফ্ল্যাশে সেলিব্রেটিদের মেকআপ নষ্টের কিছু সস্তা ছবি ছাপা যেতে পারে, ভোটের বাক্স কানায় কানায় পূর্ণ হতে পারে, রাজনৈতিক কৌশল ভক্ত দের কাছে সমাদৃত হতে পারে কিন্তু ভারতমাতা‘স্বাচ্ছ’ , ‘নির্মলবা পরিচ্ছন্নও  কোনটাই হবেনা আচ্ছে দিনের স্বপ্নভঙ্গ হলেই  মানুষ  আবার বলবে ... ছিঃ! ছিঃ! এত্তা জঞ্জাল ... আর তখনজঞ্জালপরিষ্কার শুরু হবে সেই পার্লামেন্ট থেকেই