বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৯

ডিটেনশন ক্যাম্পের আগে-পরে ~ সুস্মিতা ওঝা

হঁ আইজ্ঞা, হামিই ফালু দাসের বিটি, সন্ধ্যা দাস।
ঠিকানা নলবাড়ি, বরক্ষেত্রী ।
আর হঁ, লাশট  হামার বাপেরই ত বঠে!
তুমরা জীয়ন্ত মানুষটকে ক্যাম্পে লেগল্যে, 
বিদেশি ছাপ মার‍্যে! 
তারপর অত্যাচার কর‍্যে, গরু-মরা কর‍্যে 
লাশট হামদের কাছ আনল্যে! 
আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, সবই ত দিখাইনছিল,
ঘরের জমিন ট বন্ধক দিয়্যেঁ, কেস লড়ল্য বাপট।
তবু তুমরা মানল্যে নাই! 
কাঁদ্যে তুমাদের পায়ে পড়ল্যম, 
"বাপের আমার পেসার আছে, শরীলট ভাল নাই!"
তুমরা বিন চিকিচ্ছায় মার‍্যে ফেলল্যে হামার বাপ কে!
আজ তবে,  জীয়ন্ত বাপের বদলি
ই লাশট, ক্যেনে দিছ হামকে? 
ই বিদেশীটকে বিদেশে পাঠাইন দিছ নাই ক্যেনে? 
হামরা গরীব, পরের জমিতে খাট্যে খাই,
হামদের নিজদের জমিন হব্যেক কুথা লে? 
ই দেশট কি শুধই বড়লকের বঠে?
আর হামরা যারা গরীব, যাদের জমিন নাই,
খাট্যে খাই, দেশট তাদের লয়? 
হা রে, রাজার বেটারা, তুরা জমিন পালিস কুথা? 
হাজার হাজার বছর ধর‍্যে, যখন পাথর ভাঙ্যে, 
জঙ্গল কাট্যে জমিন বানাল্যম হামরা,
তুরা তখন ছিলিস কুথা? 
আজ তুরা জাত-ধম্মের লড়াই লাগাইঁ 
উঁচ'-নীচ'র বিচার সাজাইঁ,
হামদের জমিন লুঠেছিস, ঘরবাড়ি লুঠেছিস,
ইখন লুঠছিস দেশ! তবে জান্যে রাখ, 
ই দেশ ছাড়্যে হামরা কুথাকে নাই যাব।
ই লুঠেরা আইন হামরা জানতক্ মানব্য নাই! 
এদ্দিন একতরফা মার খাঁয়্যেছি হামরা,
ইবার সময় আসেছ্যে উট ফিরাইন দিবার,
তুদের ঐ ডিটেনশন্ ক্যাম্পট গুঁড়াইঁ দিয়্যেঁ, 
ইবার লড়্যে লুব হামদের দেশ, হামদের অধিকার।
           

বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৯

বিদ্রোহ আজ ~ অর্ক রাজপন্ডিত

হাতে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। আমার থেকে ঠিক চল্লিশ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে সেবাস্তিয়ান পিনেরার সৈন্য। আমি তখন স্লোগান দিচ্ছি দু হাত মুঠো করে। বন্দুক তাক করার আগে আমার দিকে সৈন্য একবার দেখলো তার পর ফায়ার!

আমি গুলিবিদ্ধ। আমার মত হাতে মাথায় কাঁধে পায়ে গুলি নিয়ে আহতরা উপচে পড়ছে স্যান্টিয়াগোর পোস্টা সেন্ট্রাল হাসপাতালে। কারোর দরকার অপারেশন, ডাক্তারবাবুরা বলছেন হাতজোড় করে অপারেশনরই খরচই কয়েক হাজার পেসো। হাসপাতাল আমাদের চিকিৎসা দিতেও অক্ষম।

তবু আমরা মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে ফিরে আসছি স্যান্টিয়াগোর রাস্তায়। তবু আমরা আবার পোস্টার সাঁটছি স্যান্টিয়াগোর মেট্রো স্টেশনের দেওয়ালে দেওয়ালে। 'ইটস নট অ্যাবাউট থার্টি পেসো'স, ইটস অ্যাবাউট থার্টি ইয়ার্স'!

আমরা যারা চিলির ছেলে মেয়ে, আমরা শুধু মেট্রো রেলের ভাড়া নিয়ে আন্দোলনে নামিনি। আমরা কুড়ি লাখ রাস্তার দখল নিইনি শুধু মেট্রোর ভাড়া কমানোর জন্য। পিনোচেত জমানা শেষে কেটে গেছে চিলিতে তিনটি দশক। আমাদের মজুরি ছাঁটাই হয়েছে, আমাদের বাপ চাচাদের পেনশন উঠে গেছে, আমাদের স্কুলে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ বেড়েছে অহরহ। আমরা রাস্তায় আমরা এর শেষ দেখেই ছাড়বো।

চিলির আগুন জ্বলে উঠেছে হাইতিতে। পোর্ট আউ প্রিন্সের দখল নিয়েছে হাইতির জনগণ। বিমানবন্দরের রানওয়ে, টারম্যাক জনতার দখলে।

'এই এয়ারপোর্টর রানওয়েতে একটাই উড়োজাহাজ নামবে, যে জোভেনেলকে নিয়ে চলে যাবে আমাদের দেশ থেকে, আমরা আর ওকে রাষ্ট্রপতি দেখতে চাই না', হাইতির রাষ্ট্রপতি জোভেনেলের সংস্কারের বিরুদ্ধে এভাবেই ঝড়ে পড়েছে অসন্তোষের তুফান। হাইতিতে এখন ন্যুনতম মজুরি মাত্র ২.৫০ ডলার! হাইতিতে এখন মুরগির মাংস থেকে ডিম খায় না হাইতির যৌবন।

চিলি, হাইতি হয়ে বিদ্রোহ ইকুয়েডরে। রাষ্ট্রপতি লেনিন মনেরো চেয়েছিলেন আইএমএফ'র দাওয়াই মেনে আর্থিক সংস্কার। প্রবল ব্যায়সঙ্কোচ। কুইটোর রাস্তা দখল নিয়ে বসে থেকেছে ইকুয়েডরের আদি জনগোষ্ঠী। পিছিয়ে আসতে হয়েছে লেনিন মনেরোকে। আইএমএফ'র ডিক্রি ৮৮৩ জ্বালিয়ে দিয়েছে জনতা।

উত্তর গোলার্ধ থেকে দক্ষিণ গোলার্ধ। বিদ্রোহ চারিদিকে বিদ্রোহ আজ।

লাতিন আমেরিকা থেকে উত্তর ইউরোপ। উত্তর ইউরোপ থেকে উত্তাল মধ্যপ্রাচ্য।

১৬৬০ লেবানিজ পাউন্ড খরচ করলে তবে ১ডলার মেলে। এমনই তীব্র সঙ্কট লেবাননে। দেশের ডলার সঞ্চয় খরচ হয় শুধু বিদেশ থেকে নেওয়া ধার শোধ করতে। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে এক সপ্তাহের বেশি বন্ধ লেবাননের সব ব্যাঙ্ক। রাস্তায় নেমে এসেছে লেবাননের যৌবন। লেবাননের বিদেশমন্ত্রী বলেই ফেলেছেন ভাঁড়ে মা ভবানী, এক বছরের মধ্যে লেবাননের কোন ডলার সঞ্চয়ই থাকবে না। বেইরুটের রাস্তার দখল গিয়েছে জনতার হাতে। লেবানন জুড়ে দ্রোহ কাল।

লেবাননের আগুন জ্বলেছে ইরাকে। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে একের পর রাজনীতিক নেতারা শুধু ঝুটা প্রতিশ্রুতিই দিয়ে গেছে। ইয়াঙ্কি যুদ্ধবাজরা শেষ করেছে বাগদাদ। একই পথে হেঁটেছে ইরাকি রাজনীতিকরা। বাগদাদের যৌবনের চাকরি নেই। বাগদাদের রাস্তার পাশাপাশি অচল হয়েছে মেসান, ভিকোয়ার, মুথান্নার মত শহরতলি।

'আমরা কিছুই পাইনি, আমাদের কেউ কিছুই দেয়নি শুধু মৃত্যু আর বুলেট জখম ছাড়া', বাগদাদের রাস্তায় বিদ্রোহে গুলি খেয়ে মরেছে ২১জন, তবু রাস্তা ছাড়েনি বাগদাদের যৌবন।

ইরাকের আগুণ জ্বলে উঠেছে মিশরে। রাষ্ট্রপতি আব্দেল ফাতা আল সিসি'র জমানায় মিশরে দারিদ্র্যসীমার নিচে এখন ১০০জনের মধ্যে ৩৪জন। সরকার খরচ করে শুধু প্রাসাদে আর রাজকীয় হোটেলে। মুখে মুখোশ নিয়ে কায়রোর রাস্তায় জনতা।

স্বাধীন কাতালান রাষ্ট্র চাই, বার্সোলোনা এয়ারপোর্ট অবরুদ্ধ হয়েছে। বিমানবন্দর ঘিরে থেকেছে জনতা, মুক্তি দিতে হবে স্বাধীন কাতালান আন্দোলনের নেতাদের। কাতালানের পাশে হংকং। টানা দুমাসের বেশি সময় হংকং'র রাস্তায় আগুণ। মেইনল্যান্ড চায়নায় প্রত্যার্পণ নীতি থেকে সরে আসার পরেও অশান্ত হংকং।

ক্ষোভের আগুন লন্ডনে। ঝাঁ চকচকে সেতু আর স্কোয়ার দখল করেছেন পরিবেশ আন্দোলনকারিরা। 'এক্সটিন্কশন রেবেলিয়ন'। ২০২৫ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমণ নামিয়ে আনতে হবে শূন্যতে। বরিস জনসন ব্রেক্সিত বিতর্ককে ছাপিয়েছে জল হাওয়া আর রোদ্দুর বাঁচাতে চেয়ে রাস্তায় নামা আন্দোলনকারিরা।

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রশ্ন ওঠা সঙ্গত।

দুনিয়া জোড়ে বিক্ষোভ অসন্তোষের শ্রেণিগত অবস্থান কি এক? উত্তর না এবং না। স্বাধীন কাতালান চেয়ে যাঁরা বার্সেলোনা এয়ারপোর্ট দখল করছেন তাঁদের শ্রেণিগত অবস্থানের সঙ্গে ফারাক রয়েছে ইকুয়েডরের আদি জনগোষ্ঠীর।

স্যান্টিয়াগো, বেইরুট, কুইটো, লেবানন আর লন্ডনের মধ্যে মিল এক জায়গাতেই।

যারা রাস্তায়, যারা স্লোগানে তারা সবাই সঙ্কটের ছেলেমেয়ে। পুঁজিবাদের জঠরেই তাদের জন্ম। ভিন্ন কারনে ভিন্ন দেশে রাস্তায় তারা সবাই নামলেও তাদের মূল লড়াই উদারনীতির বুলডোজারের বিরুদ্ধে।

লাতিন আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্য উত্তর ইউরোপের দামাল ছেলেমেয়েরা দেখেছে ব্যায়সংকোচের নামে মজুরি ছাঁটাই। দেখেছে পেনশনে কোপ। দেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের চড়া ফি'জ, দেখেছে চাকরির দরজায় তালা।

স্যান্টিয়াগো আর লেবানন, বার্সেলোনা আর লন্ডন তাই একই সময়ে টিয়ার গ্যাসের শেল পাল্টা ছুঁড়ে দেয়। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়েও ফিরে আসে প্রতিরোধে। বন্ধুর মৃতদেহ আটকে রেখে শিরায় শিরায় স্লোগান তোলে।

নয়াদিল্লির রাস্তায় নেমে আসুক লেবানন। চিলি। ইকুয়েডর। হাইতির প্রবল পরাক্রম। লাখে লাখ যৌবন অবরুদ্ধ করে রাখুক পার্লামেন্ট।

যত দিন না তোমরা উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের উপর দলিতদের উপর টার্গেট প্র্যাকটিস বন্ধ না করছো, আমরা রাস্তা ছাড়বো না।

যত দিন না তোমরা কাশ্মীরে নিরন্তর অবরোধ না তুলছো আমরা রাস্তা ছাড়বো না।

যত দিন না তোমরা আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা থেকে হাত না গোটাচ্ছ আমরা রাস্তা ছাড়বো না।

যত দিন না তোমরা গোমাতা আর ভারতমাতার নামে আমার মা কাকিমা চাচি খাল্লামার তেল নুন চিনি ডাল ভিটামিন ক্যালসিয়াম কেড়ে নেওয়া না বন্ধ করছো আমরা রাস্তা ছাড়বো না।

ভিক্টর হারার সঙ্গে লেবানন কুইটো স্যান্টিয়াগোর সঙ্গে নয়াদিল্লির রাস্তায় গান গেয়ে উঠবেন মাথা ঝাঁকিয়ে বব মার্লে।

'ডু ইউ হিয়ার মি, আই অ্যাম এ রেবেল, রেবেল ইন দ্য মর্নিং রেবেল অ্যাট মিড ডে টাইম..'।

যাঁদের কান আছে তারা শুনতে পাচ্ছেন বিদ্রোহের গান, বিরুদ্ধতার কবিতা। ব্যবস্থা পাল্টানোর স্লোগান।

সকালে। মধ্য দুপুরের গনগনে আঁচে। রাতের জ্যোৎস্নামাখা চাঁদের আলোয়। বিদ্রোহ আর বিদ্রোহ।

আর বিদ্রোহ মানেই ন্যায়সঙ্গত। টু রেবেল ইজ জাস্টিফায়েড।

রবিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৯

কালীপূজা ~ সুদেষ্ণা সান্যাল

পুরো দেশটা যখন দিওয়ালি পালন করছে সেদিন বাঙালীর আজ কালীপূজা। পুরো দেশ যখন পূজার বেদীতে ফর্সা টুকটুকে লক্ষীমেয়ে সাজাচ্ছে, তখন বাংলার প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে সাজছেন কাজলের মতন কালো মুক্তকেশী নগ্ন কালী। তাঁর গলায় মুণ্ডমালার হার, কোমরে নরহস্তের কটিবাস। তিনি আবার শিবের বুকে দাঁড়িয়ে। তাঁর পূজায় লাগে মাংস ও মদ। 

মদ শুধু এই উগ্রবাদী কালো মেয়েটাই খায়না। খান দুর্গাও। শ্রীশ্রীচণ্ডী বলছে সে কথা। যুদ্ধে মহিষাসুর অহঙ্কারে মত্ত হয়ে প্রবল গর্জন করলে দুর্গা বলেছিলেন, "গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় মধু যাবৎ পিবাম্যহম/ময়া ত্বয়ি হতেঽত্রৈব গর্জিষ্যন্ত্যাশু দেবতাঃ।" অর্থাৎ, "রে মূঢ়, যতক্ষণ আমি মধুপান করি, ততক্ষণ তুই গর্জন করে নে। আমি তোকে বধ করলেই দেবতারা এখানে শীঘ্রই গর্জন করবেন!" মধু কিন্তু এখানে মোটেও নিরীহ পানীয় নয়। সংস্কৃতে মদের একটি প্রতিশব্দ মধু। 

আবার, বেশ কিছু পুরনো পটচিত্রে দেখা যায়, দেবী সিদ্ধলক্ষ্মীও সুরাপান করছে।  চণ্ড-মুণ্ড বধের সময় দেবী কৌষিকীর কপাল থেকে উৎপন্না হয়েছিলেন যে কালিকা, তিনি আবার পান করেন কেবল রক্তই! 

কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের বৃহৎ তন্ত্রসার অনুসারে শ্মশানকালী শ্মশানে বাস করেন। তাঁর চোখদুটি রক্তপিঙ্গল। দেহ শুকনো, বাঁ-হাতে মদ ও মাংসে ভরা পানপাত্র, ডান হাতে সদ্য কাটা মানুষের মাথা। দেবী হাসিমুখে নরমাংস খাচ্ছেন। তাঁর গায়ে নানারকম অলংকার থাকলেও তিনি উলঙ্গ এবং মদ্যপান করে উন্মত্ত হয়ে উঠেছেন।
রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকরের মতে, কালীর আরেক রূপ চামুণ্ডা, বিন্ধ্য অঞ্চলের উপজাতিদের দেবী। চামুণ্ডার উদ্দেশে পশু ও নরবলি ও মদ উৎসর্গের প্রথা ছিল। আবার শোনা যায় যে মাংস ও মদ-সহকারে যে তন্ত্রসিদ্ধ পূজাপদ্ধতি বাংলায় তা এনেছিলেন ঋষি বশিষ্ঠ। জনশ্রুতি বলে, পঞ্চ ম কার অর্থাৎ মদ্য-মাংস-মৎস্য-মুদ্রা-মৈথুন সহকারে তন্ত্রমতে দেবী আরাধনা বশিষ্ঠ নিয়ে আসেন বঙ্গে। পণ্ডিতদের বক্তব্য, বৈষ্ণবদের পঞ্চগব্য অর্থাৎ দধি-দুগ্ধ-ঘৃত-গোমূত্র-গোময়ের ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই মদ্য-মাংস-মৎস্য-মুদ্রা-মৈথুন। অথচ সবই কিন্তু একটা হিন্দুধর্মের গন্ডির ভিতরেই। তাই লক্ষ্মী আর কালী - দুই মেরুর দুই ভিন্নস্বাদের মেয়েকে আমরা হিন্দুরা পূজা করি।

বাঙালীদের অন্য কোনো ভাষাভাষীদের প্রতি বিদ্বেষ নেই। তবুও তারা একটু অন্যরকম। না, শুধুমাত্র নোবেল প্রাইজে এগিয়ে নেই তারা। তারা হয়তো ধর্মীয় ক্ষেত্রেও অন্য রকম। তাই তারা কালো মেয়ে পুজো করে, তারা মাংস খায়, তারা পুরুষের বুকে স্ত্রীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পারে। আবার তারা লক্ষ্মীর পা আঁকে বাড়ির আনাচে কানাচে, খিচুরী ভোগ রান্না করে। আজকের দিনে হয়তো অনেক সামাজিক নিয়ম কানুন লেনদেনের মধ্যে বাঙালীও বিয়ের আগের দিন মেহেন্দি সংগীত করছে, আবার হয়তো কেউ কেউ চাঁদ উঠলে চালনী দিয়ে বরকে দেখে জলও খাচ্ছে। কিন্তু কোথাও যেন বাঙালী ব্যতিক্রম।

তাই যারা হিন্দুত্ববাদী বলতে কেবল নিরামিষাশী কপালে তিলক কাটা পুরুষ, ঘোমটানশীন পতিঅনুসরণকারী স্ত্রী, আর মদ্যপান বর্জন বোঝেন তারা একটু ভেবে দেখবেন, বাঙালীর মতন একাধিকত্ব ও বহুত্ববাদের হিন্দুত্বের সামনে তাদের এই ক্ষুদ্র সংকীর্ণ হিন্দুবাদ দাঁড়াতে পারে কিনা।

ছবিতে: সপ্তদশ শতকের বাশোলি চিত্রে সুরাকুম্ভ হাতে কালী এবং সুরাপানরতা সিদ্ধলক্ষ্মী।

ভিক্টর হারা ~ আর্কাদি গাইদার

বিশ্ববিখ্যাত সংগীতশিল্পী ভিক্টর হারা কে প্রথম চিনেছিলাম আইরিশ শিল্পী ক্রিস্টি মুরের গানে। ভিক্টর ততদিনে মরে ভূত হয়ে গেছেন। চিলেতে মিলিটারি ক্যুয়ের পর কমিউনিষ্ট হিসেবে ওনাকে প্রথমে গ্রেপ্তার করে স্টেডিয়ামে তৈরি হওয়া ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সৈন্যরা পিটিয়ে আগে আধমরা করে ফেলে। যেই আঙুলগুলো দিয়ে গীটার বাজাতেন, সেই আঙুলগুলো এবার এক এক করে ভেঙে ফেলা হয়। তারপর স্বাদবদল করতে, ইলেক্ট্রিক তার দিয়ে কিছুক্ষন শক দেওয়া হয়। এরপর একঘেয়েমি এসে যাওয়াতে, সৈন্যরা ওনাকে গুলি করে স্টেডিয়ামের সামনে ওনার দেহ প্রদর্শনী হিসেবে ঝুলিয়ে রাখে। 

এরও পরে, ভিক্টর হারার ভূত ক্যুতে নিহত চিলের প্রেসিডেন্ট আলেন্দের ভূতের সাথে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছিলো, নতুন সামরিক সরকারের শত্রু বামপন্থী ও কমিউনিষ্টদের এরকম আরও হাজার ভুতের সাথে। উড়তে উড়তে তারা দেখছিলো, সুদুর আমেরিকা থেকে পরিচালিত এই সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় আসা পিনোসে তখন চিলে কে বানাচ্ছে 'নয়া উদারনীতির ল্যাবরেটরি', অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান আর চিকাগো স্কুল প্রেস্ক্রিপশন দিচ্ছে 'অর্থনৈতিক শক থেরাপি'র, সেই শক খেয়ে আধমরা বোবা বাধ্য জনতা অসাড় হয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে দশকের পর দশক। 

কিন্তু মানুষ মরলেও ভূতের তো মৃত্যু নেই। ভূতেরা মহা পাজি হয়, সুযোগ পেলেই বারবার ফিরে ফিরে আসে। চিলেতে আজ হঠাত করে ঝটিকা আক্রমণে ভুতগুলো সব একসাথে ফিরে এসেছে। এসে ভর করেছে জ্যান্ত মানুষগুলোর ঘাঁড়ে। তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। ঘরে ঘরে ঢুকে ভূতগুলো মন্ত্র পড়বার মতন করে বলে আসছে - নয়া উদারবাদের এক্সপেরিনেন্ট ডাহা ফেল। সোভিয়েত ইউনিয়ন সিদ্ধান্ত নিয়ে কমইন্টার্ন ভেঙে দেওয়ার ৭০ বছর পরে চিলের প্রেসিডেন্ট পিনেরা আন্তর্জাতিক মহলে সাহায্য প্রার্থনা করছেন 'This is not a harmless protest. This is a coup by the International Communist Movement'. চিলেতে এখন রাস্তায় রাস্তায় ভিক্টর হারা আর আলেন্দের ভূত। স্টেডিয়ামে জড়ো হয়ে কয়েক হাজার ভিক্টর সমস্বরে মুক্তির গান গাইছেন। 

আর চুপিচুপি, খুব সন্তর্পণে, কাউকে জানতে না দিয়ে, পৃথিবীর সম্পূর্ন উলটোদিকে, আস্তে আস্তে নড়েচড়ে উঠছে ডিটেনশন ক্যাম্পের আকাশে চালচুলোহীন ভাবে ভেসে বেড়ানো দুলাল পাল আর ফালু দাসের ভূত। তারা শুনতে পাচ্ছে, অচেনা ভাষায়, কিন্তু চেনা সুরে, গুনগুন করে কারা যেন গান গাইছে।  হয়তো বা ঋণে জর্জরিত হয়ে গাছে ঝুলে পড়া কোন চাষী। বা উঠে যাওয়া ব্যাংকের কাছে নিজের সর্বস্ব হারিয়ে হার্ট এটাকে মরে যাওয়া কোন অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধা। হয়তো বা বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার জমিতে তৈরি বহুতলের ছাদ থেকে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করা কোন শ্রমিক। 

দুলাল দাস শুনছে, কারা যেন ডাকছে - ভিক্টর হারা?
সবাই একসাথে উত্তর দিচ্ছে - উপস্থিত!

দুলাল দাস?
আবার একসাথে -উপস্থিত!

একে একে ভুতেদের নাম ধরে ডাকা হচ্ছে।

চিলের আকাশে তখন সমস্বরে গর্জন শোনা যাচ্ছে - উপস্থিত! উপস্থিত! উপস্থিত!

মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৯

বিএসএনএল ~ সুশোভন পাত্র

আপনি তো জানেন, প্রাইভেট সেক্টর মানেই বেশ একটা স্যুট-টাই গোছের ব্যাপার। কেতাদুরস্ত অফিস। বায়োমেট্রিক অ্যাটেণ্ডেন্স। অফিস ঢুকলেই কলিগরা বগলের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে 'গুড মর্নিং' বলবে। লাঞ্চে সালমা হায়েকের ইনস্ট্রাগ্রাম নিয়ে গসিপ বসবে। রিক্রিয়েশন রুমে 'দিস সিস্টেম ইস ব্লাডি ক্র্যাপ!' ডায়লগ সহযোগে ক্লাসিক মাইল্ডসের ধোঁয়া উড়বে। এয়ার-কন্ডিশন রুমে ম্যানেজার প্রফিটের অঙ্ক কষবে। সিইও ব্যালেন্স শিটে টার্গেটের আঁকিবুঁকি কাটবে। আপনি তো জানেনই প্রাইভেট সেক্টর মানেই বেটার ডিসিপ্লিন, বেটার সার্ভিস। এবং অবশ্যই বেটার ইকনমি। 
আপনি তো অভিমন্যু। মায়ের পেটের ভেতর থেকেই আপনি শুনেছেন পাবলিক সেক্টর মানেই বেশ একটা ক্যাবলাকান্ত গোছের ব্যাপার। ভুঁড়িওয়ালা লোকজনদের আড্ডা। ঐ ঠিক যেমন সিনেমায় দেখায়; অন্ধকার বারান্দা পেরিয়ে একটা লজঝড়ে অফিস, ঘরের কোণে টিমটিম করা বাল্ব, মাথার উপর ঘড়ঘড় করা ফ্যান, টেবিলের উপর ক্যালক্যাল করা ফাইল আর চেয়ারে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা কেরানি। আপনি তো জানেনই পাবলিক সেক্টর মানেই লোকসান, ইকনমির সর্বনাশ। অতএব BSNL তুলে দাও। BPCL গুঁড়িয়ে দাও। সিম্পল। 
এমনিতে হোয়াটস-অ্যাপ ইউনিভার্সিটির কৃতি ছাত্র হিসেবে আপনি টেলিকম দুনিয়ার নাড়ি-নক্ষত্র সবই জানেন। তবুও বলুন তো, টেলিকম ম্যানুফ্যাকচারিং-এ আজকাল রাজত্ব করছে কারা? মোটোরলা, নকিয়া, এরিকসন, সিমেন্সের মত প্রাইভেট কোম্পানি? আজ্ঞে না! বরং গত ১০বছরে এই আমেরিকান, ইউরোপিয়ান মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানি গুলিকে টেকনোলজি এবং তুলনামূলক মূল্যে টেক্কা দিয়ে টেলিকম ম্যানুফ্যাকচারিং-র গ্লোবাল মার্কেটের অবিসংবাদিত নায়ক এখন চিনের Huawei এবং ZTE। গোটা বিশ্বে 5G-র পায়োনিয়ারও Huawei এবং ZTE। সারপ্রাইস, সারপ্রাইস! Huawei এবং ZTE কিন্তু তথাকথিত প্রাইভেট কোম্পানি নয়। বরং Huawei–র মালিকানা কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন কর্পোরেশনের। আর ZTE-র মালিকানা মূলত চিনে সরকারের। আসলে কি জানেন, নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা বলে কেঁদে ভাসিয়ে লাভ নেই। বরং নাচটা শিখতে হয় ¹। 
এই পর্যন্ত পড়ে যারা আমাকে 'চিনের দালাল' হিসেবে দাগিয়ে দিয়েছেন, কিম্বা আমার প্রোফাইলে 'চিনের চেয়ারম্যান/আমাদের চেয়ারম্যান' শ্লোগান খুঁজতে গোয়েন্দাগিরি করছেন তাঁরা সিট ব্যাক অ্যান্ড রিল্যাক্স! পিকচার আভি বাকি হ্যা মেরে দোস্ত! শুনুন, ৮০-র দশকে ভারত সরকার যখন প্রান্তিক মানুষের কাছে সুলভে টেলিফোনের সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার কথা ভেবেছিল, তখন এই দেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ আবহাওয়ায় এয়ার-কন্ডিশন ছাড়া এক্সচেঞ্জ রুমে কার্যকরী এবং টেকসই সুইচ বানাতে প্যান্টুল হলুদ হয়ে গিয়েছিল Bell সহ পাশ্চাত্যের বহু প্রাইভেট টেলিকম কোম্পানির। শ্যাম পিত্রোদার নেতৃত্বে, MAX সুইচ ডিজাইন করে সেদিন সবাই কে চমকে দিয়েছিল টেলিকম দুনিয়ার দুধের শিশু C-DoT। আজও ভারত ছাড়াও ৭০টি দেশে MAX সুইচই ব্যবহার করা হয়। আজও ভারতের 'টেলিকম রিভোলিউশেন' বলতে MAX সুইচ ডিজাইনের স্বর্ণময় অধ্যায়কেই বোঝানো হয়। সারপ্রাইস, সারপ্রাইস! এই C-DoT কিন্তু তথাকথিত প্রাইভেট কোম্পানি নয়। বরং ভারত সরকারের অধীনস্থ পাবলিক সেক্টর²। 
এমনিতে হোয়াটস-অ্যাপ ইউনিভার্সিটির সিলেবাসে আপনি তো পড়েছেন প্রাইভেট সেক্টর মানেই প্রফিট। তা ইদানীং কত প্রফিট করেছে ভোডাফোন, এয়ারটেল কিম্বা জিও? চলতি আর্থিক বছরের জুন কোয়ার্টরে ভোডাফোনের লোকসান ৪,৭৭৪ কোটি³, এয়ারটেলের ২,৮৬৬ কোটি⁴। এমনকি ব্রিটিশ টেলিকম রিসার্চ সংস্থা বার্নস্টাইন জানাচ্ছে ২০১৮-১৯ আর্থিক বছরের ডিসেম্বর কোয়ার্টারে জিও খাতায় কলমে ৮৩১ কোটি প্রফিটের গল্প শোনালেও আসলে লোকসানের পরিমাণ ছিল ৩,৮০০ কোটি⁵। কিন্তু আপনি তো অভিমন্যু। মায়ের পেটের ভেতর থেকেই আপনি শুনেছেন লোকসান কেবল BSNL–র হয়। আসলে মুশকিলটা হল অভিমন্যু সবটা শোনার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে।  
তাই অভিমন্যু জানেনা, BSNL-র পরিকাঠামো ব্যবহার করেই এতদিন মুনাফা লুটেছে প্রাইভেট সেক্টর। অভিমন্যু জানেনা, BSNL–কে মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে সুযোগ দেওয়া হয় হাচ, এয়ারটেল ব্যবসা শুরু করার ৭বছর পর। অভিমন্যু জানেনা, মোবাইল সার্ভিসের দুনিয়াতে পা রেখেই ২০০৪-০৫ আর্থিক বছরে ১০,০০০ কোটি প্রফিট করেছিল BSNL। অভিমন্যু জানেনা, তারপরেও 3G-4G স্পেকট্রামের নিলামে অংশগ্রহণ করার সুযোগই পায়নি BSNL। অভিমন্যু জানেনা, অস্থিরতা সত্ত্বেও এই সেপ্টেম্বরেও ১৩.৫লক্ষ নতুন গ্রাহক বাড়িয়েছে BSNL। অভিমন্যু জানেনা, আজও টেলিকম সেক্টরের সম্মিলিত মোট ৮লক্ষ কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণের ২লক্ষ কোটিই জিও-র। ২লক্ষ কোটি ভোডাফোন এবং এয়ারটেলের। আর মাত্র ২০,০০০ কোটি BSNL-র¹। 
তাই বুড়ো বয়সে ছেলেমানুষি করার ইচ্ছে হলে দুধের গ্লাসে ব্রনভিটা গুলে খেতে পারেন, খড়িমাটি দিয়ে রাস্তায় দাগ কেটে কিথ কিথ খেলতে পারেন, কিন্তু 'লোকসানর জন্য পাবলিক সেক্টর বেচে দিতে হচ্ছে' এসব গল্প দেবেন না। লাভ-লোকসান মাপকাঠি হলে গত ৫বছরে ৩৫,১৮২কোটি লাভ করা⁶, ২০১৭-তে মহারত্নের⁷ অন্তর্ভুক্ত হওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা BPCL বেচে দেওয়ার ধান্দা করে কোন আহাম্মক সরকার? 
আসলে ডিমনিটাইজেশনের গিমিকে গরীব মানুষ কে ATM-র লাইনে দাঁড় করিয়েছে এই সরকার। 'চৌকিদারের' মুখোশ পরে মালিয়া-মোদীদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে এই সরকার। গত ৫বছরে ৫.৭৬লক্ষ কোটি কর্পোরেট ট্যাক্স মকুব করেছে এই সরকার⁸। আর আজ যখন দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার ৫% এসে ঠেকেছে, শিল্পপণ্যোত্পাদী বৃদ্ধি -১.১%-এ নেমে গেছে⁹, ৪৫ বছরের সর্বোচ্চ বেকারত্ব মাথাচাড়া দিচ্ছে¹⁰, জিএসটির মত জটিল কর ব্যবস্থার চাপে লক্ষ মাত্রা থেকে ৯৮,২০২ কোটি টাকা কম রেভেনিউ আদায় হচ্ছে¹¹; তখন দেশের মানুষের করের টাকায়, অসংখ্য মানুষের রক্ত জল করা পরিশ্রমে তিল তিল করে গড়ে ওঠা, পাবলিক সেক্টর গুলি কে ধারাবাহিক ভাবে দুর্বল করে বেচে দিয়ে নিজেদের মুখ বাঁচাতে চাইছে এই সরকার। 
সম্প্রতি ফরবেসে ১০০জন ধনীতম ভারতীয়দের যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, তাতে ৮ধাপ উঠে দ্বিতীয় স্থানে আছেন গৌতম আদানি। আর এই নিয়ে টানা ১২বছর প্রথম স্থানে মুকেশ আম্বানি¹²। ২০১৪-২০১৯, মোদীর রাজত্বে মুকেশ আম্বানির সম্পত্তি ১.৬৮লক্ষ কোটি থেকে বেড়ে ৩.৬৫লক্ষ কোটি হয়েছে। বৃদ্ধির হার ১১৮%। আর গৌতম আদানির সম্পত্তি ৫০.৪ হাজার কোটি থেকে বেড়ে ১.১লক্ষ কোটি হয়েছে। বৃদ্ধির হার ১২১%¹³। তা প্রাইভেট সেক্টরের প্রফিট বাড়লেই যদি দেশের অর্থনীতির উন্নতি হয়, তাহলে বড্ড জানতে ইচ্ছে করে; আম্বানি-আদানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হোয়াটস-অ্যাপ ইউনিভার্সিটির কৃতি ছাত্রদের, পাবলিক সেক্টরের বাপ-বাপান্ত করা আজকের অভিমন্যুদের, ট্রিকল-ডাউন অর্থনীতির স্বপ্ন ফেরি করা দালালদের, নাগপুরের হাফপ্যান্ট ওয়ালা দাদুর নাতিদের, কিম্বা ভারতের ৯৯% সাধারণ মানুষের সম্পত্তি এই ৫ বছরে কত শতাংশ বেড়েছে? ১২১% ? না ১১৮% ?



অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এর অর্থনীতি ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

১# উনি যে নতুন রাস্তা টা দেখালেন সেটা হল দারিদ্র দূরীকরণ কর্মসূচির নামে মেগা প্রজেক্ট না নিয়ে সেকটার ধরে ধরে ছোট ছোট ইন্টারভেনশন নেওয়া। এবং এই সমাধানের রাস্তাটা বাস্তবে কতটা কাজ করবে সেটা আগে ছোট করে ফিল্ড ট্রায়াল এর মাধ্যমে মেপে নেওয়া। যদি সফল হয় তাহলেই সেটা লারজ স্কেলে এপ্লাই করা। যেমন ধরুন সার্বিক টিকাকরণ এর হার বৃদ্ধি। তিনটে গ্রূপ বানানো হল একই কমিউনিটিতে। একদল শুধু ভ্যাকশিন। আরেকদল মোবাইল ক্লিনিক প্লাস ভ্যাকসিন আরেকদল মোবাইল ক্লিনিক প্লাস ভ্যাকসিন প্লাস দু মুঠো মুসুরি ডাল। এবার কোন গ্রূপে টিকাকরণের হার বেশি এবং সে জন্য খরচ কত বেশি সেটা দেখা হল। এই উদাহরণটি রিয়েল লাইফ স্টাডি থেকেই দিলাম। একে বলে RCT বা রেন্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল । এটা ফার্মা কোম্পানিরা নতুন ওষুধ আবিষ্কারের সময়ে করে।
২# দরিদ্র মানুষের অর্থ সম্পদ সংগ্রহ, ব্যয় ও সঞ্চয় এর অভ্যেস বা প্রবণতা নিয়েও ওনার কাজ আছে। যেমন উনি দেখিয়ে ছিলেন যে গরিব পরিবার চেষ্টা করে তাদর্র প্রথম ছেলে সন্তান কে সমস্ত সঞ্চয় ব্যয় করে উচ্চ শিক্ষিত করে তুলতে তাতে তার অন্য সন্তানদের লেখা পড়া বেশিদূর না হলেও চলবে কারণ সেই পরিবারের প্রধানের ধারণা যে তার উচ্চ শিক্ষ প্রাপ্ত বড় ছেলে একটি চাকরি জুটিয়ে সংসারের অভাব ঘোচাবে। বাস্তবে সেই আশা খুব কম সময়েই পূরণ হয়। সেজন্য অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ছাড়া গতি নেই। যে বিষয়ে বামফ্রন্ট সরকার পথিকৃৎ ছিল।
৩# গরিবের অভ্যাস নিয়ে অভিজিৎ ব্যানার্জি ও এস্থার ডুফলোর একটি খুব ইন্টারেস্টিং পর্যবেক্ষণ আছে। তারা দেখিয়েছিলেন যে লোকে দামি ও মুখরোচক খাবার কিনছে। বিস্বাদ কিন্তু পুষ্টিকর খাদ্য কিনছে না। পুওর ইকনমিকস নামে বইয়ে ওনারা লিখছেন, "অত্যন্ত গরীব মানুষ যখন খাবারের পেছনে একটু বেশি খরচ করার সুযোগ পায়, সে আরো বেশি ক্যালরি পাওয়ার জন্য পুরো টাকাটা খরচ করে না। বরং আরেকটু ভাল খাবার জন্য, বেশি দামি ক্যালরির পেছনে খরচ করে"। তাই আর্থিক উন্নতি ঘটলেই অপুষ্টি দূর হয়ে যাবে না।
৪# বাজার অর্থনীতি নিয়েও ওনার কাজ আছে। উনি মনে করেন যে গরিবদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ালে বাজার চাঙ্গা হবে। কৃষক পেনশন, নূন্যতম মজুরি এনরেগার মজুরি বৃদ্ধি এসবের ফলে সরকারের কোষাগার থেকে যে বাড়তি টাকা টুকু যাবে তার তুলনায় বাজার বৃদ্ধি পেয়ে অর্থনীতি অনেক বেশি চাঙ্গা হবে। এটার ওপর ভিত্তি করেই কংগ্রেস গত লোকসভা নির্বাচনের ইশতেহারে "ন্যায়" প্রকল্প এনেছিল। এই দাবিগুলো দীর্ঘদিন ধরেই বামপন্থীদের দাবি। সারা ভারত কৃষক লংমার্চ স্মরণযোগ্য।
৫# প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে মাইগ্রেট চিপ লেবার নিয়েও ওনার কাজ আছে। উনি দেখিয়েছিলেন যে এর ফলে আমেরিকার পাকা নাগরিকদের চাকরি চলে যাওয়া, মজুরি কমে যাওয়া ইত্যাদি আশঙ্কা অমূলক।
৬# উনি যে কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থ্যার গুনাগুন বিচারে নৈবয়ারতিক লাভ ক্ষতির চেয়ে অঙ্ক কষে লাভ ক্ষতির বিচারের যে স্কুল অফ থট আছে তার প্রবক্তাদের অন্যতম। প বঙ্গের অপারেশন বর্গার ফলে এফিসিয়েন্সি বেড়েছে সেটা অঙ্ক কষে দেখিয়েছিলেন (প্রোডাকশন ২৩% বৃদ্ধি) ওনার ও মৈত্রেশ ঘটক এই যুগ্ম কাজ ছিল এটা। অর্থাৎ অপারেশন বর্গা যে কেবল চাষিদের মর্যাদা বৃদ্ধি বা আয় বৃদ্ধি করেছে তাই নয়, অর্থনীতিকে সামগ্রিকভাবে চাঙ্গাও করেছিল।
৭# সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামের নাম উল্লেখ করে জমি অধিগ্রহনের ক্ষেত্রে সরকারের অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার জন্য জোরালো সওয়াল করেছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, মৈত্রেশ ঘটক, প্রণব বর্ধন সহ ন জন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ। তারা কেবল সরকারের পক্ষ থেকে স্বচ্ছতা, ন্যায্য ক্ষতিপূরণ ও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের ওপর জোর দিয়েছিলেন। বাজারের হাতে ওই জমি অধিগ্রহণ ছেড়ে দিলে তার ফলাফল বিপর্যয়কর হবে এই সতর্কবাতা দিয়েছিলেন।

শনিবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৯

কার্নিভাল ~ অনামিকা

যেমন মুছেছে রাজকুমারও
দিন গেলে শোক মুছে যায় সব।
ভোট নিতে গিয়ে খুন বেচারা
আইন মুলতুবি। জারি উৎসব। 

কেন ফের খুন হল শিক্ষক?
যা হোক একটা কিছু ধরে নে!
হয়তো বা আর্থিক গোলমাল...
সম্পর্কের টানাপোড়েনে। 

কিন্তু মরল কেন বৌ তার?
এ ব্যাপারে আছে কোনও ধারণা?
বিধবা মেয়েকে খেতে দেবে কে,
এ জগতে কেউ আহা কারও না!

তাই তো মারতে হল তাকেও
মরে গেল গর্ভের ভ্রুণ ও তার
এ রকম উজ্জ্বল অজুহাত
ঘুমোনো বিবেক নিয়ে শুনো তা!

আট বছরের ছোটো শিশুটি
অনাথ বাঁচাটা খুব ঝামেলা।
তাই বাছা, গর্দানে কোপ খা!
মৃত্যুর এ মিছিলে পা মেলা।

রাষ্ট্র কোথায় তুই আজকে?
কোনখানে পোড়ামুখ মুখ লুকোলি?
বেহায়া কার্নিভাল ঝলমল...
আয় নাচি, গানও গাই দু কলি।

শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৯

শরৎ ঋতু ~ অর্ক রাজপন্ডিত

পঞ্চমীর রাত থেকেই হঠাৎ সব শুনশান। রাতে ভালো বোঝা যায় না। গাড়ি কমে গেছে রাস্তায়। বিলকুল ফাঁকা সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার, তেলেঙ্গাবাগান, মুদিয়ালি। 

হোয়াটসঅ্যাপ কাজ করছে না। ফেসবুক খুলছে না। আপনি আধো ঘুমে উঠে বসলেন। ফোন করতে থাকলেন বন্ধুদের, প্রিয়জনদের। ফোনের কানেকশন বন্ধ। 

আপনি টিভি খুললেন। এবিপি আনন্দ বন্ধ। চব্বিশ ঘন্টা বন্ধ। রিপাবলিক টিভি বন্ধ। কোন চ্যানেলই আপনি দেখতে পারছেন না। 

হঠাৎ উৎসবের আলো ঝলমলে রাতে হল কি শহরটার? আস্ত জ্যান্ত শহর কি হঠাৎ মরে গেল? 
সকাল হল। আপনার রেডিওতে আর বেজে উঠলো না প্রভাতী অনুষ্ঠান। ভেসে এলো না কোন আগমনী গানের সুর। আপনার বাড়িতে পৌঁছয়নি কোন খবরের কাগজ। 

আপনি ক্রমশ অবাক হচ্ছেন এবং ভয় পেতে শুরু করেছেন। আপনি দরজা খুলে বাইরে এলেন, আপনার পাড়ার পুজো প্যান্ডেলের সামনে দাঁড়িয়ে মিলিটারি ট্যাঙ্ক। আপনি বেজায় ভয় পেতে শুরু করলেন, আপনার দিকে ধেয়ে এলো জলপাই পোষাকের হিংস্র শ্বাপদের দল। আপনি এক ছুট্টে সেঁধিয়ে গেলেন বাড়িতে। 

আপনার বাড়ির সামনের মুদির দোকান বন্ধ। সিঙ্গারা জিলিপি বন্ধ। চায়ের দোকান বন্ধ। পুজো প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসছেন না অখিলবন্ধু ঘোষ বা তালাত মাহমুদ।  

আপনার পাড়ায় চক্কর কাটছে সাঁজোয়া গাড়ি, আর আপনি শুনছেন, শুনেই চলেছেন, 'ইউ আর আন্ডার সিজ। ইয়োর স্টেট ইজ আন্ডার সিজ'। 

আপনি পাড়ার মোড়ের ব্যানার থেকে টুকে নেওয়া 'দিদিকে বলো'র নম্বর দেখে ফোন ঘোরাতে চাইলেন, কাজ করে না ফোন। দিদি নেই, দিদি পালিয়েছেন দিল্লি। আপনি ছুটবার চেষ্টা করলেন আলিমুদ্দিনে। সব্বাই গ্রেপ্তার। সূর্য মিশ্র, বিমান বসু, মহম্মদ সেলিম সব্বাই। 

আপনি আলিমুদ্দিন থেকে পা বাড়ালেন বিধান ভবনের দিকে। সোমেন মিত্র থেকে অধীর চৌধুরী সব্বাই গ্রেপ্তার। আপনার পাড়ার কাউন্সিলার পাড়া ছাড়া। আপনার পৌরসভার দোর্দন্ডপ্রতাপ চেয়ারম্যানকে আপনি খুঁজে পাচ্ছেন না। 

আপনার ছোট শিশুকন্যা তখন বায়না জুড়েছে, আজ রাতে যেতেই হবে 'সাউথ', চষে ফেলতেই হবে বাবুবাগান, যোধপুর পার্ক। আপনি বোঝাতে পারছেন না ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদা ছোট্ট শিশুকন্যাও এখন 'আন্ডার সিজ'। 

চমকে উঠবেন না। আপনার স্নায়ুকে শিথিল করুন। আপনার স্নায়ুকে সহনশীল হতে বলুন। আপনি বাড়িতে আর আপনার স্ত্রীর বাপের বাড়ি বসিরহাট হওয়ার কারনে জলপাই পোষাকের শ্বাপদেরা তাঁকে নিয়ে যাচ্ছে ডিটেনশন ক্যাম্পে। আপনার খুড়শ্বশুড়, মেজ শালী সব্বাই পৌঁছে গেছেন ডিটেনশন ক্যাম্পে। 

মৃত এই শহরে, মৃত এই রাজ্যে আপনি একা। ভীষণ একা। 

আপনার একাকিত্ব দেখে মুচকি হাসছে শ্রীনগর। আপনার একা বোকা ন্যাকামিকে পেল্লাই জোরে সিটি মারছে কুলগাম পহেলগাঁও। আপনার বিহ্বলতাকে যার পর নাই আওয়াজ দিচ্ছে নওগাঁও, বরপেটা। 

৬০ দিন ৮ ঘন্টা এভাবেই আটকে আছে কাশ্মীর। আপনি ক্রুদ্ধ হননি। আপনি জানতে চাননি। আপনি যোগাযোগ করতে চাননি ফি শীতে আখরোট বিলি করে যাওয়া শালওয়ালার খবর। 
আসামে রাষ্ট্রহীন হয়েছেন ১৯লক্ষ মানুষ, তাঁদের মধ্যে ৮৫শতাংশ মানসিক ব্যাধিতে ভুগছেন, এই সব অশ্লীল দৃশ্যাবলী আপনাকে রাগিয়ে তোলেনি। 
আপনার ভ্যাবাচাকা মুখ দেখে বেজায় হাসছেন জলপাইগুড়ির অন্নদা রায়। আপনার শিশুকন্যার চোখের জল দেখে কান্না পাচ্ছে না দক্ষিণ দিনাজপুরের মন্টু সরকারের মেয়ের। 

কারণ তখন আপনি চুপ ছিলেন। আপনি একটি কথাও বলেননি। 
খুব অসহায় লাগছে? ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে বুকের আঙিনা? বুঝতেই পারছেন না হঠাৎ এদিন কেন আপনাকে দেখতে হল? 

অবাক হবেন না। আপনার মত অবাক আশ্চর্য হচ্ছেন আপনার সহনাগরিকেরাও। 
পরশু যা হয়েছে কাশ্মীরে, কাল যা হয়েছে আসামে, আগামী কাল তাই হতে পারে আমার আপনার বাংলায়। 

এখন অবাক হওয়ার সময় নয়। বিহ্বলতার সময় নয়। এখনও আছে সময় রুখে দাঁড়ানোর। 

এই শারদে একটা কাজ আপনি নিশ্চিত করতেই পারেন। মুদিয়ালিতে গিয়ে বলুন কুলগামের গল্প। সুরুচি সংঘের লাইনে দাঁড়িয়ে আলোচনা করুন ডাল লেকে নৌকা বাওয়া মহিলার কাজ না থাকার কথা। কলেক স্কোয়ার আর বাগবাজার সার্বজনীনে আপনি সংহতিতে গলা ফাটাতে না পারলেও ফিসফিস করে বোঝান রাষ্ট্রহীন হওয়া বরপেটা, গুয়াহাটির কথা। 

আমাদের কাছে উৎসব মানে একান্তই আমাদের। আমাদের শারদ মানে রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গান। আমাদের শারদ মানে নতুন কাকাবাবু আর মিতিন মাসি। আমাদের শারদ মানে নমবীর ধুনুচি নাচ আর দশমীর ভাসান। আমাদের শারদ মানে বিশু আর আসলানের কোলাকুলি। 

সংঘ পরিবার আমার আপনার সংস্কৃতির হদিশ জানে না। আমার আপনার সম্প্রীতির ঠাসবুনোট গল্প জানা নেই মমতার। 

বি জে পি-র সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ হানুক আমাদের আজন্মের সংস্কৃতি। যা ছড়িয়ে আছে কর্ণফুলির শেতলা থানে। ইছেমতীর মাজারে। গড়িয়াহাটের দাবার বোর্ডে। নন্দনের টিকিটের লাইনে। উত্তর কলকাতার গলির ভেতর জেগে থাকা খবরের কাগজে আলতা দিয়ে লেখা পোস্টার সাঁটা পার্টি অফিসে। বেলেঘাটার খালপাড়ের রক্তদান শিবিরে। যাদবপুর এইট বি আর চৌরঙ্গীর বুক স্টলে। 

আপনার ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদা ছোট্ট শিশুকন্যার জন্য বাড়িতে অন্তত একটা জুঁই বা গন্ধরাজ ফুলের গাছ লাগান। 

ফুল ফুটতে শুরু করলে তার হাতে অন্তত একটা কঞ্চি ধরিয়ে বলুন, পাহারা দিতে শেখ। পাহারা দিতে অভ্যাস কর। পাহারা দেওয়া জরুরি। 
উৎসবের ঋতুও হোক
 আদর্শের ঋতু। প্রতিরোধের ঋতু।

(লিখেছেন অর্ক রাজপন্ডিত, সাংবাদিক)

বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৯

এনআরসি ও আপনি ~ শতদ্রু দাস

- আপকা স্ত্রীকা নাম এনআরসি মে নেহি হ্যায়, আপকা স্ত্রী হিন্দু হ্যায়?
- হ্যাঁ স্যার, ওঁর বাবা আসলে ১৯৭১-এ পালিয়ে এসেছিলেন, জানেনই তো সেই সময়ে কী হয়েছিল, কী করবে বলুন? হিন্দু হয়ে তখন বেঁচে থাকাই মুশকিল বাংলাদেশে, সঙ্গে যুবতী স্ত্রী থাকলে তো কথাই নেই...
- ম্যারেজ সার্টিফিকেট হ্যায়?
- হ্যাঁ স্যার। এই যে..
- ইসমে তো লিকখা হ্যায় "স্পেশ্যাল ম্যারেজ এক্ট", মুসলমান থি ক্যা?
- না স্যার, হিন্দু। ওরা নমশূদ্র, আমরা ব্রাহ্মণ। আমার বাবা রাজি ছিলেন না বিয়েতে। তাই বাধ্য হয়ে পালিয়ে বিয়ে করেছি। স্পেশ্যাল ম্যারেজ এক্ট সেই জন্যই।
- উনকা বাপ কো বুলাইয়ে... বিশ্বাস, মন্ডল ইয়ে সব তো মুসলমান কা ভি নাম হোতা হ্যায়।
- ওঁর বাবা তো আর বেঁচে নেই স্যার, মা-ও আগের বছর গত হলেন...
- তো ফির ক্যায়সে পাতা করে কি ইয়ে হিন্দু থি?
- স্যার, সিঁদুর দেয়, শাঁখা পরে, এরপরেও হিন্দু নয়?
- উও সব তো দিখানে কে লিয়ে কোই ভি পেহেন সকতা হ্যায়, মেরে পাস এক মুসলিম ফ্যামিলি আয়া থা, উও কৃষ্ণ কা ফোটো রাখতা হ্যায় পার্স মে, বোলতা হ্যায় কে বাউল ইয়া কুছ হ্যায়, তো ফির উসকো ভি হিন্দু বোলনা পড়েগা। আপকে পাস ঔর কই প্রুফ হ্যায়?
- স্যার আর কী প্রমান দেব বলুন? কোনোদিন তো ভাবিনি যে প্রমান লাগবে, আপনি মাই বাপ, একবার বুঝুন যে প্রমান করা কতটা মুশকিল..
-  আপকা বেটা সরকারি নৌকরি করতা হ্যায়?
- হ্যাঁ স্যার, বিএসএফের অফিসার..
- দেখিয়ে, সুপ্রিম কোর্ট বোলা হ্যায় কি বাংলাদেশি কা বেটা ভি বাংলাদেশি মানা যায়গা জিতনা দিন ভি ইস দেশ মে রাহা হো, আপকা বেটা কা নৌকরি রাহেগা কি নাহি বোল নাহি সকতে..
- স্যার আমরা মরে যাবো, অনেক কষ্ট করে ছেলে এই চাকরিটা পেয়েছে, রাত জেগে লেখাপড়া করেছে স্যার।
- বেজাত কো শাদি করনে কে পেহলে সোচনা থা আপকো... 

নেক্সট!!!

বাংলায় এনআরসি ~ সেঁজুতি দত্ত

যেদিন প্রথম আসামে এনআরসির লিস্ট বেরোল, খুব সম্ভবত শতাক্ষীর "স্ট্রেঞ্জ ফ্রুট"-এর প্রথম শো দেখে বাড়ি ফিরেছি। এক বছর বা দুবছর আগে…মনে পড়ছে না। বাড়ি আসতে আসতেই ভাবছিলাম ওর কাজটা নিয়ে লিখবো। কিন্তু আসামের খবর পড়ে এতটাই অপমানিত লেগেছিল যে কয়েকদিন আর কিছু করতেই পারলাম না। হয়ত তখনও এতটাই সরল ছিলাম যে রাগের থেকে অপমানটা বেশি গায়ে লেগেছিল। হয়ত ভেবেছি যে বাংলায় এনআরসি হওয়া তো দূরের কথা, ভাবাও যাবে না। একটা গোটা জাতি, যারা নিজেদের উদ্বাস্তু সত্তা নিয়ে গর্ব করেন, সেখানে এধরণের কিছু ঘটাতে চাইলে রাজপথে আগুন জ্বলবে। তাই আসামের পসিবল ঠাইহীন মানুষগুলির পক্ষ নিয়েছিলাম শুধু। ভেবেছিলাম, আমার মত ওই মানুষগুলোরও বেঁচে থাকার অধিকার, নাগরিকত্বের অধিকার থাকা উচিৎ। 

কিন্তু রাজনীতি বড়ই চালাক জিনিস। তখন অনেকেই এটাকে শুধু বাংলাবিদ্বেষী তকমা দিয়ে থেকে গেলেন। এই রাজ্যের শাসক গোষ্ঠীও তাই করলেন যতদূর মনে আছে। এই যে এখন এনআরসি নিয়ে এত আলোচনা, কথা, আমাদের দৈনন্দিনতায় চলে এসেছে, সেরকম যে হতে পারে সেটা নিয়ে কেউ চিন্তিত হলেন না, পাবলিক ওপিনিয়ন তৈরি করতেও সাহায্য করলেন না। ওদিকে যখন এই থ্রেট ঘরের দোরে চলে এসেছে তখনও, এবছর ভোটের সময়, লেফট দলগুলো এটাকে নির্বাচনি প্রচারের হাতিয়ার করলেন না। তার ফলস্বরূপ, ঠিক পূজার আগে শাহবাবুকে এ রাজ্যে আসতে হয় নন-মুসলমান মানুষদের আশ্বস্ত করবার জন্য।

আসা করি আমরা এবারে নিশ্চিন্তে আছি। সবই ভোটের খেলা। একের পর এক মানুষ আতংকে আছেন, আত্মহত্যা করছেন আর ওদিকে ঘোষিত সংখ্যাগুরুর দলনেতা বলছেন মানুষের লাশের ওপর দিয়ে এনআরসি হবে। তবে আমার বিশ্বাস, যে দল উনি করেন এবং সেখানে জাতপাত এবং 'বিধর্মী' নিয়ে প্রকাশ্যেই তাদের যে রূপ দেখা যায়, সেখানে হয়ত তারা ওই লাশের মধ্যেও দলিত আর মুসলমানের লাশ এড়িয়ে যাবেন। এটাই আশার, যে ওই মৃত মানুষগুলিকে হয়ত মরণোত্তর সাবর্ণ-হিন্দু-লাথি খাবার মত অপমান সইতে হবে না।

মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ, সেই আসাম এনআরসির সময় থেকেই সিঁদুরে মেঘ দেখেছিলেন। তারা এখনও গলায় রক্ত তুলে বিরোধিতা করে চলেছেন। একটু যদি চেষ্টা করে হিন্দু আর নন-হিন্দু বাইনারি থেকে বেরনো যায় তাহলে কিন্তু এই লড়াই যেতা সম্ভব। যারা সংবিধানে বিশ্বাস রাখেন তারা অন্তত আর্টিকেল ১৫র দোহাই দিয়ে এই রক্তের দাগ নিজেদের হাতে লাগতে দেবেননা প্লিজ। যারা এই সংবিধান নির্মাণের কাণ্ডারি আম্বেদকরের ভাবনা এবং দর্শন শুধুই জেনারেল নলেজের মধ্যে আটকে রেখেছেন, তারাও অন্তত শুধুই ঠিকভুলের লজিকে এর বিরোধিতা করুন। যারা হই হই করে কাল গান্ধী বাবার নাম করলেন তারা একটু ভেবে দেখুন এরকম স্বচ্ছ ভারত আপনারা চান কিনা। আর যারা প্রকৃত উদ্বাস্তু অথবা বেআইনি ঘুসপেটিয়া, একবার ধর্মের লাথি খেয়ে নিজের দেশ ছেড়েছেন, তারা অন্তত ওই একই জিনিস একইভাবে আপনার পাশের মানুষটির সাথে হতে দেবেন না। 

শুনলাম শাহবাবু বলেছেন বাংলায় এতো ভোট না পেলে কাশ্মীরের এই হাল নাকি করে উঠতে পারতেন না। বুঝে দেখুন একবার, আর 'নট ইন মাই নেম' বলতে পারবেন না কিন্তু। এই মেজরিটি নিয়েই কিন্তু সিএবি (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) আনতে চলেছে ওরা। দায় কিন্তু আছে। এই অ্যাক্ট না আনলে কিন্তু আইনত 'মুসলমান'দের 'তাড়ানো'-ই সম্ভব নয়। অর্থাৎ এই 'তাড়ানো'-র আকাঙ্খা মানুষ খুন করার মতই অসাংবিধানিক এবং আইনবিরুদ্ধ। সংবিধান কিন্তু ধর্মভিত্তিক সেগরিগেশনের অধিকার দেয় না। একমাত্র এই সংবিধানকে পাল্টে ফেললেই স্বচ্ছ হিন্দু রাষ্ট্র বানানো সম্ভব। কাশ্মীর থেকে এনআরসি, গণতান্ত্রিক দেশের সরকার কিন্তু বাংলার ভোটদাতাদেরই ধন্যবাদ জানাচ্ছে। আবার বাংলার কিন্তু ইতিহাসে নাম লেখাবার সময় হয়ে এসেছে। আজকে বুড়ো আঙুল দেখালে, কে জানে, কাল আপনাকে নিয়েই স্বাধীন ভারতের আরেক ইতিহাস রচিত হবে। একবার লাথি খেয়েছেন, এবারে আর লাথি দেবেন না। পেছন থেকে ছুরি না মারলে দেখবেন হাত শক্ত হবে, সবাই পাশে থাকবে। 
বাঙালি সংখ্যাগুরুর পুজো ভালো কাটুক।

চিরকুট ~ অবিন দত্তগুপ্ত

আমার পরিচিতেরা বারে বারেই বলেন আমি আজকাল হাত খুলে লিখি না । একথা অস্বীকার করে লাভ নাই , আমি মূলত পাঠক । পড়তে পড়তেই আমার লিখতে শেখা । আবার লিখতে লিখতেই নিজেকে নিজেই বেঁধে ফেলা । এটাও বলতে বাধা নেই যে মনের কথা লিখতে না পারার জন্য আমি স্বাগতার সাথে ঝগড়াও করেছি প্রচুর । কিন্তু ওটা স্রেফ্‌ দোষ চাপানো । আদতে ব্যাপারটা অন্য ।

আমার লেখা মূলত সমাজ এবং রাজনীতিধর্মী । এর বাইরে সতঃস্ফুতর্তা একমাত্র আমার ক্লাব । ব্যক্তিগত লেখা গুলি বেশ ভালোই হয় দেখেছি , সবই আমার নানা অভিজ্ঞতার এবং তারও একটা ক্ষয় আছে । অথবা হয়তো সব গল্পে নাক চিপে নিজেই ডুব দি নি । আমি সত্যি সীমাবদ্ধ । তথাপি এ অভিযোগ সত্য যে আমি হাতখুলে লিখি না । আজকে কেন লিখি না ,অথবা আদপে হাত খুলতে কেমন করে হয় ,সেই নিয়েই কয়েকটা কথা । 

আমার রাজনীতির মূল অনুপ্রেরণা আমার দাদুর চিরকুট , যেগুলো বাবাও দেখেনি । আমার দাদু সারাদিন গনশক্তি পড়ত আর সারা বছরের গণশক্তিগুলো একটা তাকের উপর তারিখ সমেত সাজিয়ে রাখতো । আমাদের বাড়িতে কাগজওয়ালা আসত । ঠামি তার কাছে আজকাল বিক্রি করলেও গণশক্তি বিক্রি করতেন না । একবার পূজার আগে গণশক্তি বিক্রী করতে গিয়েছিল ঠামি- সে নিয়ে সে কি বাওয়ালি । আমার বছর পাঁচ ,আমি দেখেছি । সে  যাই হোক তাকের উপরের গণশক্তি ছাড়াও আমার দাদুর একটা গোপন কাগজের আস্তানা ছিল । আমরা তো খুব ছোট পরিসরে বড় হয়েছি , তাই অ্যালোন টাইম কারুরি ছিল না - আমি দাদুর গোপন কাগজের বাক্সেরও উত্তরাধিকারী ছিলাম । সেখানেই প্রথম দেখা চিরকুট । দাদুর হাতের লেখা মুক্তর মতো ছিল ,ওইটা আমি পাইনি । চিরকুট পেয়েছিলাম । কোনটার তলায় লেখা লেনিন , কোনটায় মুজাফফার আহমেদ, কোনটায় মাও যে দং, কোনটায় স্তালিন । নাম গুলি প্রপার নাউন ছাড়া আর কিছুই ছিল না , কিন্তু অনুসন্ধিৎসা ছিল ঠিক । পরে বাবার কাছ থেকে কিছু ঠামির কাছ থেকে কিছু মায়ের কাছ থেকে কিছু ভাঙ্গা ভাঙ্গা অথচ কানেক্টেড্‌, এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়া কিন্তু একই দিকে দিক নির্দেশ করা গল্প শুনে আমার ইতিহাস সচেতনতা তৈরি হয় । দূরদর্শনের দৌলতে আবুল বাশারের মুখে রাজনীতি শব্দের মানে -"সর্বশ্রেষ্ঠ যে নীতি " শুনে শিহরিত হয়েছিলাম কৈশরে । তবে শ্রেণীসচেতনতা তৈরি করেছিল আমার রিফিউজি রিলিফ্‌ কমিটির সরকারি আবাসন - আজীবন তা ভোলার নয় । 

আমি যখন প্রথম সি পি আই এম-এর কাজ করি , তখন তা ছিল চেন ফ্ল্যাগ লাগানো - ২০০১ । আমি প্রথম মিছিলে হেঁটেছি লুকিয়ে , ১৫ বছর বয়সে । প্রথম নির্বাচনী রেজাল্ট শুনেছি বাবার কোলে চেপে , তখন আমার বয়স ৭ - আর এস পি , ফরোয়ার্ড ব্লক বললেও বাবাকে জিজ্ঞেস করতাম - "আমাদের দলে ?" 

আমার বাবা জোট সমর্থন করে । আমি জোট সমর্থন করি না । চলতে চলতে আমার আর বাবার অভিজ্ঞতা আলাদা হয়েছে - মতানৈক্য তৈরি হয়েছে । ঠামির সাথে ঝগড়া হলে আমি দাদুকে জিজ্ঞেস করতাম "ঠামি কি তোমার এনিমি ?" । দাদু বলতো আমরা বহুদিন একদল । আদতে ঠামি না থাকলে দাদুর বোধহয় ঠিক আমার দাদু হওয়া হয়ে উঠতো না । বামপন্থী রাজনীতিতে যারা দ্বন্দ দেখলে ভুরু কুঁচকান , তারা বামপন্থী রাজনীতি বোঝেন না । বামপন্থী রাজনীতি করতে এসে যারা আন্তদলীয় দ্বন্দের অর্থ শত্রু বোঝেন - তারা আগের শ্রেণীর চেয়েও ভয়ঙ্কর - পাতি ধান্দাবাজ ।

এটা আমার শারদীয়া লেখা । হাত খুলে লেখা ।  কেউ ছাপলে মেসেজ করবেন । :)