ইমারজেন্সি নাইট ডিউটি চলছিল সেদিন। রাত পৌনে বারোটা-র মতো বাজে। হুড়মুড় করে পেশেন্টের পর পেশেন্ট আসার আর বিরাম নেই। এসেই যাচ্ছে তো এ-সে-ই যাচ্ছে। নাগাড়ে। কাতরাতে কাতরাতে। ঝাঁপাতে লাফাতে। এবং...অতি অবশ্যই–খিস্তাতে খিস্তাতে! হুঁ হুঁ বাওয়া, যে সে দিন তো আর নয়! 'অমৃৎ মহোৎসব'-ওয়ালা স্বাধীনতা দিবস বলে কথা। বন্যার স্রোতের মতো রোগী যে আসবেই, এ কথা তো জানাই ছিল আগেভাগেই।
অন্তত পঞ্চাশ জনকে ভর্তি করে ফেলেছি এলরেডি। মদ খেয়ে হুড়ুম বাইক চালিয়ে স্বাধীনতা উদযাপন করতে গিয়েছিল বেটা-বিটিরা। ওই সেই তারাই এসে যাচ্ছে। নাগাড়ে। কারো খুলি ফেটে দুই ভাগ, কেউ লেংচে, কারোর ডান হাতখানি আবার ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়ে লটপট করছে পতাকার মতোই। নারী পুরুষের বিভেদ নেই।
হ্যাঁ, স্বাধীন আমরা হতে পেরেছি বটে– এ কথা বোঝা যাচ্ছিল বেশ রকম। আর... তারই মাঝে, ওই যে বললাম, রাত তখন পৌনে বারোটা মতো হবে, উর্ধস্বসে উর্ধ্বশ্বাসে রোগী দেখে চলেছি আমি।
এক্ষণে, আপাতত, আমার সামনে চারটে ট্রলি পরপর দাঁড়িয়ে। একটিকে পরীক্ষা করছি পেট টিপে টুপে। সম্ভবত গল ব্লাডারে পাথর হয়েছে তার। বিশেষ স্থানে একটু চাপ দিতেই হাউ মাউ করে চিল্লাছে বিকট। পিছনের অপেক্ষমান ট্রলিগুলির একটিতে হাঁফানি, বাকি দুইখানি বাইক দুর্ঘটনা ঘ্রিয়াওঁ। বাতাসে বাতাসে তখন আমার ম ম করছে মদের গন্ধ ফুরফুরিয়ে।
এমত সসেমিরা অবস্থায় হঠাৎ খেয়াল হলো, কাঁধে টুকটুক করে টোকা মারছে কেউ একজন। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই – টলটলায়মান এক ছোকরা। আঙুল উঁচিয়ে কি যেন একটা বলার চেষ্টা করছে চোখ মুখ কুঁচকে। বাম কানের স্টেথোর ইয়ার পিস সরিয়ে ঠাহর করলাম সেকেন্ড খানিক।টলটলায়মান যুবকটির বক্তব্য। শোনার পরেও, বুঝতে সময় লাগলো আরো সেকেন্ড খানিক। ছেলেটি যা বলছে স্খলিত ভাষ্যে, তার অর্থ হলো– "দশ সেকেন্ড"।
হ্যাঁ ওই একটি কথাই সে বলে যাচ্ছে নাগাড়ে–, দশ সেকেন্ড, দশ সেকেন্ড, দশ সেকেন্ড।
খানিকটা ভ্যাবলার মতোই জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম তাই –" কী হয়েছে ভাই? কী দশ সেকেন্ড?"
ফলাফল হলো ভয়াবহ। নিজের বাম হাতের তর্জনীটি দেখিয়ে বললো যুবক–" দেখতে পাচ্ছিস, পা-চ্ছি-স? হারামি?"
খিস্তি আমরা, স্বাস্থ্যকর্মীরা অনেক শুনেছি। সেসব কথা এখন বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে বেমালুম। তবুও, জীবনের প্রথম খিস্তি শোনার গল্পটা নাহয় বলেই যাই খানিক।
এ ঘটনা বছর বিশেক আগেকার। ইন্টার্নশিপ চলছে তখন আমার। বিদেশ ফেরত এক প্রফেসর পড়াতে এলেন আমাদের সার্জারি ওয়ার্ডে। সকালের রাউন্ড চলছে, আর স্যারের পিছু পিছু ঘুরছি আমরা। গন্ডগোলটা বাঁধলো এক্কেবারে শুরুয়াতি পেসেন্টেই। রোগীটি গতরাতেই ভর্তি হয়েছে। আঘাত পেয়ে, রক্ত জমেছে মস্তিষ্কে। ফ্রন্টাল লোব। আর তাই, হাত পা তার বেঁধে রাখা হয়েছে দড়ি দিয়ে।
যখন পৌঁছেছি সদলবলে আমরা রাউন্ড দিতে, রোগী তখন সেই বাঁধা হাতই টেনেটুনে চোখের উপর রেখে ঘুমাচ্ছে বিন্দাস। সিনিয়র পি.জি.টি ( পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেইনি), অভ্যাস মাফিক বলতে গেলো তড়বড়িয়ে–" স্যার, ইটস আ কেস অফ ফ্রন্টাল লোব হেমাটোমা। একটু সামলে হ্যান্ডেল করতে হবে। হ্যাঁ... এই...এই যে ভাই... তাকাও তো...।"
বিলেত ফেরত স্যার ক্ষেপে গেলেন দুম করে– " হোয়াট ননসেন্স ইজ গোয়িং অন! হাত বেঁধে রেখেছো? হোয়াট এবাউট হিউম্যান রাইটস! ছিঃ! আর তোমরা কি পেশেন্ট এক্সামিনেসন প্রশিজিওর টুকুও ভুলে গেছো ভাই? ইউ হ্যাভ টু গ্রিট দা পেশেন্ট ফার্স্ট। লেট মি ডেমনস্ট্রেট। দ্যাখো, কি ভাবে করতে হয় এসব।"
এই ব'লে ট'লে, ভদ্রলোক টাই গুছিয়ে পেসেন্টের কানের পাশে গেলেন ধীরে ধীরে। তারপর রোগীর চোখে ঢাকা কনুইটি ধরে, তুমুল ভালোবাসা ঝরিয়ে বললেন– " হেক্সকিউজ মি স্যার, ক্ষমা করবেন । মাই সেলফ...আমি... আপনার ডক্টর। একটু দেখব আপনাকে। আপনার হাতটা সরাতে হচ্ছে আমাকে, ক্ষমা করবেন। পিউপিল এক্সামিন করব। স্যার... শুনছেন... স্যার...এলাউ মি প্লিজ।"
উত্তরে, পেশেন্টটি এক ঝটকায় হাত সরিয়ে বলেছিল– "এই কোন খানকির বাচ্চা ঘুম ভাঙালি রে গাঁড়মারানি?"
স্যার, সভয়ে ছিটকে গিয়েছিলেন। আমরা ফ্যাকফ্যাক করে হেসেছিলাম। আর পি জি টি বলেছিল– "স্যার বললাম না? ফ্রন্টাল লোব? ফ্রন্টাল লোব ড্যামেজ হলে তো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না স্যার। "
তো ওই। ওই শুরু আমার খিস্তি শোনার। কখনো রোগের উপসর্গের কারণে। কখনো আবার দাদা কিংবা দিদির আশীর্বাদ ধন্য বলে। মোটমাট কথা এই যে, বাবা এবং মা ধর্মী খিস্তি, আমাদের রোজকার বরাদ্দ। অবাক হই না তাই আর। ফলত, সেদিন ইমারজেন্সিতে টলটলায়মানের মুখে
"হারামি" শুনেও তাই ঘাবড়ে যাইনি এতটুকুও। বরং একটু অবাক হয়েই দেখেছিলাম, ছেলেটির বাম তর্জনীতে এট্টুসখানিক খেটে গেছে। আর তাই নিয়েই সে তড়পে যাচ্ছে–" দশ সেকেন্ড। দশ সেকেন্ডের মধ্যে মাই টিটমেন্ট না হলে,মাডার করে দেব তোকে বাঁড়া।"
নিজের কষ্টটা সব্বার কাছেই সবচাইতে বেশি 'কষ্ট', একথা যদিও অনস্বীকার্য। ঠিক তেমনই এ কথাটিও মনে রাখা প্রয়োজন, চিকিৎসার ক্ষেত্রে 'ট্রায়াজ' নামক একটি বিষয় আমাদের পড়তে হয়েছে পাঠ্যক্রমে। যে ' ট্রায়াজ'-এর মোদ্দা কথা হলো– যদি জরুরি বিভাগে তোমার সামনে একসাথে একাধিক রোগী এসে উপস্থিত হয়, তবে সব্বার আগে তাকেই দেখবে, যার অবস্থা সবচাইতে সঙ্গীন।
ট্রায়াজ বোঝাবো, এমন স্বাধীনতা আমরা ছিল না। ছেলেটি ততক্ষণে কলারে হাত দিয়েছে,– " দশ সেকেন্ড, দশ সেকেন্ড বাঞ্চত...দশ সেকেন্ড দিলাম তোকে। "
হিসাব মাফিক এ সময়ে সিকিউরিটি অথবা পুলিশের কথাই মনে আসা উচিত প্রথমে। কিন্তু... আসে না। আমাদের। আমাদের মানে, আমরা যারা সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী, তাদের। পুলিশ বা হোমগার্ড যদিও একজন থাকেন বটে। তবে তাঁদের উপর অলক্ষ্যে নির্দেশ থাকে– ঝামেলা করতে যাবেন না। যা হচ্ছে হতে দিন।
বিডিওর রুমের বাইরে দণ্ডায়মান সান্ত্রী কিংবা ব্যাংকের ম্যানেজারের কেবিনের বাইরের নিরাপত্তা যতখানি, যে সবখানে স্রেফ প্রবেশ করতে হলেও রক্তচক্ষু দেখতে হবে তুমুল, তার দশ ভাগের এক ভাগও পাওয়া যাবে না সরকারি হাসপাতালে হুলিগ্যান তান্ডব চললেও। অথচ, পদাধিকার বলে, উপরিউক্ত আমরা সক্কলেই 'গ্রূপ A' অফিসার। অথচ, সবটাই সরকারি পরিকাঠামোর অফিস।
যাক গে যাক। যাক সে কথা। তর্ক করব না। সে রুচিও নেই। মোটমাট বিষয় এই যে, পুলিশের ভারী বয়ে গেছে আমাকে কলার ধরে কেউ 'বাঞ্চত' বললে। এ তো আমাদের, স্বাস্থ্যকর্মীদের জানা কথাই। আর তাই আমাদের ইন্ডিজেনাস পদ্ধতিতে ভরসা করতে হয় সর্বদা। অধুনা যার নাম- জুগাড়।
এবং সেই 'জুগাড়'ই করলাম। খুব শান্ত ভাবে বললাম–" ইউ টক ইংলিশ? ওকে! আই টক ইংলিশ টু। ওয়ান থেকে দশ কাউন্ট করুন তো স্যার। যদি তার মধ্যে আপনাকে না দেখি, দেন লাথ মারুন আমাকে। ফাক মি। কই! কী হলো? শুরু করুন, কাউন্ট। ওয়ান টু...। করুন। করুন।"
ব্যাস! তারপর আর কি! আমি ট্রলিতে শায়িত ওই চারজনকে তো দেখলামই। তারপরেও আরো জনা চার পাঁচ জনকে দেখে ফেললাম বিন্দাস। এবং শেষমেশ ফাঁকা হলাম যখন, তখন ছোকরার সামনে এসে বললাম এক গাল হেসে–
" দেখলেন তো? দাদা? দশ সেকেন্ডও লাগলো না?"
ছোকরা তখনও পাখি পড়ার মতো বলে যাচ্ছে–
" পাঁ-চ! পাঁচ। বাঁড়া পাঁচের পর কী? এই সঞ্জয়? বোকচোদ? পাঁচের পর কী বাঁড়া?...ফাইভ...
সি– হিক্স। হিক্স।"
যাওয়ার আগে রীতিমত আমার পা ছুঁয়ে গিয়েছিল ব্যাটা। বলেছিল–" দশ সেকেন্ডও লাগলো না বস তোমার। তুমি...শুওয়ের বাচ্চা গড বাঁড়া। ভগবান। হিক্স। "
এবং আরো একবার বেঁচে বর্তে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম আমি। খিক্স।