রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

লোভে লাভ ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য

তারপর একসাথে অনেকগুলো সোনার ডিম পাবে ভেবে লোকটা তো হাঁসের পেটটা ফেলল কেটে। কোথায় কী! মাঝ থেকে হাঁসটা গেল মরে।
'লোকটা' আবার কি! তার তো একটা নাম তো থাকা উচিৎ! আচ্ছা, ধরা যাক তার নাম ছিল ভুতো।

ভুল কাজ করবার পর যা হয়, মাথা চাপড়ানি, হায় হায়। কথামালার গল্পের সারমর্ম, উপদেশ। সে সব চুকে গেলে মাথায় চাপল শয়তানি।
পাড়ার হাবু অনেকবার তার কাছ থেকে হাঁসটা কিনতে চেয়েছিল। এই সুযোগ। ভুতো মুখচোখ মুছে ভালমানুষটি হয়ে হাবুর বাড়ি গিয়ে বলল, 'ভাই রে, হঠাত কিছু টাকার দরকার, ভাবছি ঐ সোনার ডিমপাড়া হাঁসটা বেচে দিই। তাই তোর কাছে এলুম। হাজার পাঁচেক টাকা হলেই আমার চলবে। তুই যদি রাজী না হোস, তাহলে ও পাড়ার বঙ্কুর কাছে যাই।'
হাবুর তো হাতে স্বর্গ! পাঁচ হাজার টাকায় এস ডি পি এইচ! (মানে সোনার ডিম পাড়া হাঁস। আজকাল আবার সব শর্টে শাঠ্যং তো!) তক্ষুণি সে এটিএম থেকে টাকা তুলে এনে ভুতোকে বলল, 'আমিই কিনব। কিন্তু হাঁসটা কই?'

-'সঙ্গে আনিনি, যদি তুই রাজী না হোস। আমার বাড়ীতেই আছে, গিয়ে নিয়ে নে! আমি একটু জরুরি কাজে চললুম। আসি ভাই?' 

আর আসে! হাতে টাকা পেয়ে ভুতো সঙ্গে সঙ্গে সামনের পগারটা পার হয়ে সেই যে গেল, আর পাক্কা একটা বছর গ্রাম মুখো হল না। 

লোভে পাপ হল, পাপে লাভ। গপ্পোটা কিন্তু এখানেও শেষ নয়।

বছর ঘুরলে ভুতোর মনটা খচখচ করতে লাগল। মরা হাঁস কিনে হাবু ঠিক কেমন মুরগি হলো? তার নামে মামলা ঠুকেছে কি? নিদেনপক্ষে ফেসবুকে আপডেট? শেষমেষ যা থাকে কপালে ভেবে সে চলল গ্রামে ফিরে।

হবি তো হ', রাস্তাতেই হাবুর সংগে দেখা। ভুতোকে দেখে সে তার বাইক থামিয়ে দৌড়ে এল। মারবে নাকি! না না, 'ওরে ভুতো রে, কতদিন দেখা হয় নি!' বলে জড়িয়ে ধরে, টেনে নিয়ে গেল পাশের রেস্টুরেন্টে। চা, মামলেট অর্ডার দিল। দিব্যি খোশমেজাজ! ভুতো তো হতভম্ব, পাঁচ হাজার টাকার শোকে হাবুর মাথাটাই বিগড়েছে নাকি!

-তারপর, কী খবর তোর! জরুরি কাজ বলে সেই যে চলে গেলি...
-হ্যাঁরে, তোর মনে আছে, সেই হাঁসটা...
-মনে থাকবেনা কেন! কিনলুম তো তোর কাছ থেকে! আর তার জন্যেই তো আমার এত উন্নতি!

-কী বলছিস! ওটা তো মরে গেছিল!
-হ্যাঁ তো। তোর বাড়ী পৌঁছেই বুঝলুম যে ঠকে গেছি। তখন আর কান্নাকাটি করে কী লাভ! ভেবেচিন্তে পেপারে একটা অ্যাড দিলুম, একশো টাকার লটারি, ফার্স্ট প্রাইজ এস ডি পি এইচ!
-তারপর? টিকিট বিক্রি হলো?
-হবে না আবার! দু-তিনটে গ্রাম মিলিয়ে পাঁচশো টিকিট বিক্রি! নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা এল হাতে!
-সেকিরে! লটারির দিন কী করলি?
-কী আবার করব! লটারি করলুম! নাম উঠল নবগ্রামের পঞ্চার!
-পঞ্চা কে কী বললি?
-বলার কী আছে! লটারি জিতেছে, বললুম হাঁসটা নিয়ে যা!
-মরা তো!
-হ্যাঁ, পঞ্চাও বলল, হাঁসটা মরা তো! বললুম, আমি তো বলিনি জ্যান্ত!
-পঞ্চা রাগ করে নি?
-কেন করবে! ও মরা হাঁস নিতে রাজী হলো না দেখে ওর একশো টাকা ওকে ফিরিয়ে দিলুম, আর সেদিন আমাদের বাড়ি ডাক রোস্ট হলো!! হ্যাঁ, তুই কিন্তু আজ দুপুরে আমার বাড়ি খাবি! তোরই জন্যে তো সব পেলুম!! 

(সারমর্মঃ  লোভ, পাপ, অন্যায়, এ কলিতে সবই মায়া...
সত্য কেবল মার্কেটিং, মার্কেটিং, আর মার্কেটিং, ভায়া!!)

শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

একুশে ফেব্রুয়ারি, দু হাজার তেরো ~ অমিতাভ প্রামাণিক

(আমি) বাংলায় হাঁটি পথ
(টানি) বাংলার জয়রথ
(ভুল) হলে ক্ষমা চাই বাংলায়, দিই বাংলায় নাকখৎ -
বাংলা আমার উদাসী বাউল
মনের ভাব প্রকাশ
(আমি) যেখানেই থাকি, সেখানেই করি শুধু বাংলায় বাস।

(আমি) বাংলায় করি চাষ
(দেখি) উদাত্ত নীলাকাশ
বাংলার নদীপাড় ঘেঁসে আমি ফুটে হই সাদা কাশ।

(আমি) বাংলার সিঁদুরে রাঙাই সিঁথি
বাংলায় বাঁধি চুল
(আমি) হাঁচি-কাশি সব বাংলায়, থাকি বাংলায় মশগুল।
বাংলা আমার সন্ধ্যা-আজান
প্রভাতী পুজোর ঢাক
শুভস্বপ্নের মত দুই বাংলাও এক হয়ে মিশে যাক।

মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

সি বি আই –এর চার্জশিট ও কিছু (বদ)বুদ্ধিজীবী - সদানন্দ কারিগর

কোথায়? তালপাটি-র খালের জলে মুণ্ডু কেটে ভাসিয়ে দেওয়ার দিবা স্বপ্ন দেখা দেড়েল কবি আজ কোথায়? বুদ্ধদেবের ছবির ঠোঁটে রক্তের রঙ লাগিয়ে নরেন্দ্র মোদীর সাথে তুলনা করা কাক আঁকিয়ে কে দেখছিনা যে! হাজার হাজার বাচ্চার পা চিড়ে খালের জলে ভাসিয়ে দেওয়ার গল্প বলিয়ে স্বঘোষিত দিদি আজ চুপ কেন? গণহত্যার গল্প ফাঁদা গণমাধ্যম আর দাসানুদাস পরিবর্তন প্রিয় (বদ)বুদ্ধিজীবীরাই বা কোথায়?  

চুপ আরও কেউ কেউ। ৩৪ বছরের আন্দোলন বিমুখতায় মেদ সর্বস্ব কোনও কোনও বাম নেতাও চুপ। ‘লজ্জায় মাথা কেটে যাওয়া’ গোঁসাই মশাই ও চুপ।   

ফলে গলার রগ ফুলিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে চ্যাঁচামেচিটা আমাদেরই করতে হবে। করতেই হবে কেননা, স্বজন হারানো ভিটে মাটি ছাড়া ক্যাম্পে থাকা এক মা-এর কোলে জন্ম নেওয়া ফুটফুটে একরত্তির ‘সন্ত্রাস’ (বাচ্চাটার নাম)-এর হাত ধরে কথা দিয়েছিলাম যে। বুড়ো মেনাজ দা-কে ওর ভাঙ্গা ক্ল্যারিওনেট এর দোহাই দিয়েছিলাম যে। কেননা, খুন হয়ে যাওয়া আমার কমরেড-দের চিতার আগুনে নিজেদেরও পোড়াতে পোড়াতে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে। ‘ক’ টাকে ‘ক’ বলার অপরাধে আমরাও সেদিন ‘হার্মাদ’ হয়েছিলাম যে।
অতএব লড়াই চলবে। লড়াই এর নিয়মেই সেদিন দু’পা পিছিয়ে এসেছিলাম। আজ আবার এগোনোর শুরু। আবার নতুন করে বলব সেদিনের কথা। বলব, ‘কোন জমি অধিগ্রহণ হবেনা’- তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেবের প্রতিশ্রুতি স্বত্বেও, নন্দীগ্রাম কে রাস্তা কেটে বিচ্ছিন্ন করে রাখাটা তৃণমূল তথা ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির ভুল নয়, ছিল গণ্ডগোল বাঁধানোর পরিকল্পিত প্রয়াস। সাউদাখালি-র বিশ্বজিৎ মাইতি, সোনাচুরার ভুদেব মণ্ডল, সুদেব মণ্ডল, রবিন ভুঁইয়া, তালডাংরার শঙ্কর সামন্ত কে খুন করাটা ওদের এলাকার মানুষদের সন্ত্রস্ত করে রাখার পরিকল্পিত ছক ছিল। তাই পরিবারের লোকের সামনে, ভুদেব মণ্ডলকে ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে অথবা শঙ্কর সামন্ত কে তলোয়ার দিয়ে চিরে জ্বলন্ত খড়ের গাদায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার বীভৎসতা। সাধুচড়ন চট্টোপাধ্যায় এর পচে ফুলে ওঠা চোখ বেড়িয়ে যাওয়া বিকৃত দেহটা যদিও  (বদ)বুদ্ধিজীবীদের ‘হাড় হিম’ করেনি, নন্দীগ্রাম-এর মানুষদের করেছিল।  সিঙ্গুরের তাপসী মালিক বা সোনাচুরার  সুনিতা মণ্ডল –কে ধর্ষণ করে খুন করাটা ছিল পলিটিকাল অ্যাজেন্ডা। কামদুনি থেকে লাভপুর- সেই ট্র্যাডিশন সমানে  চলেছে। বেশি ট্যাঁ ফুঁ করেছ কি বাড়ির মেয়েরা ধর্ষিতা হয়ে যাবে। ‘গুণ্ডা পোষা’ নেত্রীর গুণ্ডা কর্মীর সগর্ব হুঙ্কার- ‘কামদুনি করে দেব’। বাচ্চা- মহিলাদের সামনে এগিয়ে সশস্ত্র কাপুরুষের দল পেছনে থেকে ১৪ই মার্চ ২০০৭ এ যে ‘প্রতিরোধ’ গড়েছিল, তা ‘কি প্রতিরোধ করতে?’- জানা নেই। কিন্তু সি বি আই এর চার্জশিট-এ পরিষ্কার, নেপথ্যে কারা ছিলঅভিযুক্ত ১২৯ জনের বেশীর ভাগই তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী। আর গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া বি ডি ও, নীতিশ কুমার দাস এখন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব এর ব্যক্তিগত সচিব। কারা মন্ত্রীর  ব্যক্তিগত সচিব হয়? কেনই বা দময়ন্তী সেন-দের বদলি হতে হয় সুদূর দার্জিলিং-এ? উত্তরের অপেক্ষা রাখে না।   

সবে সি বি আই এর চার্জশিট বেরিয়েছে। সিঙ্গুর কৃষিজমি রক্ষা আন্দোলন-এর নামে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ৫৬ টা সংগঠন বা তার থেকে বাছাই করা পশ্চিমবঙ্গ কৃষিজমি রক্ষা কমিটি- র ১৯টা সংগঠন আর তাদের মাথা তৃনমূল কংগ্রেস তো আর চুপ করে বসে থাকবেনা। চুপ করে বসে থাকবেনা আমেরিকান কনসোল জেনারেল হেনরি জার্ডিন আর তার চেলা চামুণ্ডারাসামনে লোকসভা নির্বাচন। কারা সরকার গড়বে জানা নেই। ফলে, এই চার্জশিট এর পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটবে কিনা, সেটাও অজানা। শুধু কিছু প্রশ্ন, উত্তর খুঁজে বেড়াবে। আর উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত জারি থাকবে আমাদের লড়াই।   
   
তোষামুদে (বদ)বুদ্ধিজীবীরা নাটুকেপনায় পটু হবেই। হাওয়া মোরগের দল ততক্ষণ দুলবে, যতক্ষণ না তাদের কাঙ্ক্ষিত পুরস্কার পাচ্ছে। সবাই তো আর তা না। সাময়িক ভুল বোঝাবুঝিতে যারা তাৎক্ষণিক পরিবর্তন পিয়াসি হয়েছিলেন, শোনা যায়, আজ তাদের অনেকেই হাত কামড়াচ্ছেন। নিজেকে রক্তাক্ত না করে, আর একবার রাস্তায় নামবেন কি তারা? সেটাও সময় বলবে।  


আমাদের প্রতিজ্ঞা ছিল লড়াই-এ পাশে থাকার। লড়ে যাওয়ারলড়াই- সম্মিলিত আক্রমণের বিরুদ্ধে। মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে। মতাদর্শের জগতে হামলার বিরুদ্ধে। আজও ঘোষণা করতে দ্বিধা নেই, পাশেই আছি। আমরা যে সময়-এর সারথিলাল ঝাণ্ডার কসম, আজও বেঁচে আছি, আরও একটা সূর্যোদয়-এর প্রতীক্ষায়।।   

রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

মাইন হ্বাইডারস্টান্ড এবং অন্য তালিকা - লালমোহন গাঙ্গুলী

জার্মান শব্দের সঠিক উচ্চারন বাংলায় লেখা খুব কঠিন। আলি সাহেব হলে হয়ত পারতেন। আমার সে দুঃসাহস কোথায়? কাজেই “Mein Widerstand” এই শব্দরূপকে কোনক্রমে খাড়া করেছি। এটা একটা বইয়ের নাম, এবং বলাই বাহুল্য, লেখক জার্মান। এক সময় ওপার বাংলার ছিন্নমূল মানুষকে “জার্মান” বলে মজা করে ডাকা হতো। অবশ্য সে মজার মধ্যে নেহাত মজাই ছিলো, কোন ভাবে ছোট করার প্রয়াস ছিলোনা। বাঙাল আর জার্মান, দুজনেরই নাকি একই রকম গোঁয়ার। কিছু করবো ভাবলে করেই ছাড়ে। যাই হোক, এই বিদঘুটে নামওয়ালা বইয়ের লেখক ফ্রিডরিষ কেলনার ছিলেন জার্মান সরকারের মাঝারি গোছের কেরানি। লিনৎস্‌ আর লাউবাখ অঞ্চলে প্রধানত সরকারি আইন দফতরে কাজ করেছেন। তাঁর কর্মজীবনের একটা বড় অংশই কাটে হিটলারের শাষনাধীন জার্মানীতে। তাঁর লেখা বইয়ের নামের বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় – “আমার বিরোধীতা”। আসলে বই লিখবেন বলে লেখেননি। বলা চলে এ হলো একটা নোটবই। প্রথম পাতায় কেলনার লিখেছেন – “ওদের ক্ষমতা প্রচুর, ওরা আমার কন্ঠস্বর রোধ করে দেবে, বর্তমান সময়ে নাৎসিদের সঙ্গে আমি লড়তে পারবো না। তাই ঠিক করেছি, আমি ওদের সঙ্গে ভবিষ্যত সময়ে লড়বো। আমার চোখে দেখা ওদের বর্বরোচিত সবকিছুকে লিপীবদ্ধ করে রাখছি, আর ওদের থামাবার উপায় ও লিখে রাখছি”। কেলনার সাহেব জাত জার্মান, লড়াইয়ের গোঁ তিনি ছাড়েননি, কেলনার সাহেব জাত জার্মান, তাই বুদ্ধিদীপ্ত ভঙ্গিতে নিজের এবং প্রতিপক্ষের ক্ষমতা যাচাই করে লড়াইয়ের গতিপ্রকৃতি স্থির করেছেন। তাঁর নোটবইতে কেলনার সাহেব নিজের চোখে দেখা ও শোনা প্রতিটি অপরাধ লিপীবদ্ধ করেছেন, তার প্রামানিক খবরের কাগজের কাটিং সেঁটে রেখেছেন, আর কিছু ক্ষেত্রে, যে টুকু পেরেছেন, প্রামানিক অন্য নথিপত্রও নোটবই তে রেখে দিয়েছেন। নিখুঁত পেশাদার কাজ। ধাপে ধাপে সাজানো। আইনের দফতরের কর্মী বলে, আইনকানুন সম্পর্কে পরিস্কার ধারনা ছিলো তাঁর। কোন প্রমান গ্রাহ্য হবে, কোনটা হবেনা, নিশ্চিত ভাবেই জানতেন। ন্যুরেমবার্গের বিচার হয়েছিলো নাৎসি মাথাদের। কিন্তু এমনটা মনে করা উচিত নয়, এনারাই সব। প্রতিটি মহল্লায় , জনপদে অসংখ্য অপরাধ ঘটেছে। যুদ্ধ শেষের জার্মানিতে এই সব জল্লাদ শয়তানদের খোঁজ-তল্লাস ও সাখ্যপ্রমান মোটেই সোজা ছিলো না। কেলনার সাহেব তাঁর সমস্ত প্রমান সমেত নোটবইটি তুলে দেন আদালতের হাতে। বহু ঘাঘু নাৎসি শয়তানকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয়। এমনকি বহু বছর পরে ধরা পড়া কিছু নাৎসিকেও শাস্তি দেওয়া যায় এই সাখ্যপ্রমান থেকে। ১৯৬৮ সালে এই নোটবই ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়। অতি সম্প্রতি, ২০১১ সালে এই নোটবই, আস্ত একখানা বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।

অনেক দুরের দেশ জার্মানি। তবু কেন জানি আজকে ফ্রিডরিষ কেলনার আর তাঁর এই বিরোধিতার কথা বড্ড মনে পড়ছে। শাষক বহুগুনে শক্তিশালী, সামনাসামনি বিরোধিতা করতে যাওয়াতে বীরত্বের পরিচয় আছে, কিন্তু ফল কতটা হবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অযথা রক্তক্ষয় আর লাশের রাজনীতি কখনো কোন দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল করতে পারে না। আজ, ৯ই ফেব্রুয়ারী ২০১৪ সাল, দুপুর বেলা লাখ লাখ মানুষের সামনে বিমান বসু একটা খুব কাজের কথা বলেছেন। মমতা ব্যানার্জি কয়েক দিন আগে বলেছিলেন, এলাকায় এলাকায় তালিকা তৈরি করতে। যাঁরা এখনো তৃনমূল কংগ্রেসের সঙ্গে কাজ করছেন না, বা কাজের বিরোধীতা করছেন, তাঁদের নামের তালিকা। আজ দুপুরে, মধ্যাহ্নের সূর্য্যকে আর সামনে হাজির লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ আর শ-খানেক টিভি ক্যামেরাকে সাক্ষ্যী সামনে বিমান বসু বললেন – তালিকা এদিকেও তৈরি হচ্ছে, এবং কাজের হিসেব রাখা হচ্ছে। যারা জনগনের শত্রু, যারা মা বোনের ইজ্জত লুটছে, যারা দিনের পর দিন মনুষ্যত্বের অপমান করেও পার পেয়ে যাচ্ছে, তাদের তালিকা। ক্ষমা করা হবে না কাউকে। একজনকেও নয়। লেনিন বলেছিলেন – “A man in power is more powerful than a powerful man”। বামপন্থি মানুষ দুর্বল , তাঁদের মনের জোর নেই, তাঁরা লড়তে জানেন না, এরকম কেউ বলছেনা। বা বললেও আমরা শুনছি না। হঠকারী পদক্ষেপ নয়। চাই সংঘবদ্ধতার শক্তি। সাংগঠনিক শক্তি। বিমান বসু যখন বললেন – আগামী দিনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে, লড়াইয়ের শপথ নিতে, আজকের ব্রিগেডের লক্ষ লক্ষ গলা আকাশ কাঁপিয়ে সেই শপথ নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে গেলো। যারা অবরোধ এড়িয়ে, হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে, হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছুটে এসেছে, তাদের ঘৃনা, প্রতিস্পর্ধা আর ক্রোধের হুঙ্কারে কেঁপে গেছে কেউ কেউ। তাই পরে দেখেলাম টিভি তে কোন নেতা বলছেন দিশাহীন ব্রিগেড, কেউ বলছেন নীতিহীন বাম। কিন্তু সবার চেয়ে সরল ভাষায় টিভি ক্যামেরার সামনে বলে গেলেন এক গ্রাম্য তরুন। বললেন, তিনটে বিধায়ক গেছে, ওরা যাওয়াই ভালো। কিন্তু বামফ্রন্ট আমরা, এই সাধারন মানুষ। আমরা আছি, থাকবো।


বিরোধিতা, আর প্রতিরোধ, সেটা গাড়ির বনেটে নেচে, বা রাস্তায় বসে পড়ে হবে না। হবে মনের ভেতর , বুকের ভেতর, আর হাতে হাত রেখে। কোন রকম বড় প্রচার, ফেস্টুন ব্যানার আর দামি ফ্লেক্স ছাড়াই আজ সাধারন মানুষ যে বিরোধিতা দেখালেন, তাকে সেলাম জানাই। আর হ্যাঁ, তালিকা প্রস্তুত করবো। আজ থেকে। শক্তিশালী শাষকের সঙ্গে রাস্তায় নেমে লড়াই নয়। তার বন্দুকের গুলি খেয়ে অকালে ঝরে যাওয়া নয়। বরং সংঘবদ্ধ হওয়া, আর নিরবে মনের ভেতরে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। আজ বাদে কাল আমাদের দিন আসবেই। নেতারা নয়, সাধারন মানুষের বামফ্রন্ট। আজকের ব্রিগেড সেকথাই প্রমান করে গেলো। আগামী কাল, বামফ্রন্টের বিজয় সমাবেশে এই মানুষ গুলোই আসবেন। ততদিন, তালিকা তৈরি রাখুন। কেউ যেন বাদ না পড়ে।

শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

​সেদিন প্রভাতে ~ অমিতাভ প্রামাণিক

গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরছি। হাতে একটা মাঝারি সাইজের ট্রলিব্যাগ, চাকা লাগানো। তবে রাস্তার অবস্থা তো এমন নয় যে তার ওপর দিয়ে সেই ব্যাগ টেনে নিয়ে হাঁটা যাবে। চাকাগুলো একটা গর্তে ঢুকলে আর বেরোবে না। তবে ব্যাগে বিশেষ কিছু নেই। শীতকাল হলে মা বড়ি আর পাটালি ভরে দেয়, এখন গরম, সে সবের সময় নয়। যদিও বলছিল, কটা নারকোল ছাড়িয়ে নিয়ে যা। হুঁ, মাজদিয়া থেকে টেনে টেনে ব্যাঙ্গালোরে নারকেল আমি বয়ে নিয়ে যাব আর কী!

গ্রামের সমস্ত প্রভাতে অনিবার্যভাবে একটা পবিত্রতার গন্ধ লেগে থাকে। উঠোনে গোবরছড়া দেয় কাকিমারা, ফুল তুলে বেতের সাজিতে ভরে পাশের বাড়ির মেয়েটি, কাঁসার বালতিতে গরুর দুধ দোয়াতে আসে ও পাড়ার বৌটা, এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে অনিচ্ছুক শিশুকণ্ঠে ভেসে আসে ইমনের সুরে – ধনধন মূরত কৃষ্ণমুরারী। আমার অবশ্য এ সবের সৌন্দর্য উপভোগ করার উপায় নেই, মন ভারাক্রান্ত। মা কান্নাকাটি করে। বাবা নিস্পৃহ, প্রণাম করলে সবাইকে প্রতিনমস্কার করা তাঁর স্বভাব। ইদানিং তার সাথে যোগ হয়েছে – আবার যখন আসবি, আমার সাথে যে দেখা হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। আমার হঠাৎ তখন নিজেকে খুব অসহায় লাগে। মনে হয়, দূর, আত্মীয়-পরিজন ফেলে কী যে হাতিঘোড়া করছি, এখানে থাকলেই তো হয়। ধুপ করে বসে পড়ি তক্তাপোষে। বাবাই তাড়া লাগায়, ওঠ, যা, দেরি হলে ট্রেন চলে যাবে।

বাড়ি থেকে স্টেশন অলসভাবেও হেঁটে গেলে বড়জোর দশ মিনিট। আমি আমাদের গলিটা থেকে বড়রাস্তায় উঠেছি কি উঠিনি, পেছনে ভটভটি নিয়ে হাজির খোনে। ওর ভাল নাম প্রকাশ, ডাকনাম ক্ষৌণীশ থেকে খোনে। আমাদের লাগোয়া বাড়ির বাল্যবন্ধু, একসঙ্গে আমরা স্কুলে পড়েছি বারো ক্লাশ অবধি। এখনো সূর্য ওঠার কিছুটা বাকি, তবে ওর চোখে এখনই কালো রোদচশমা। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক মেরে আমাকে বলল, মিঠু! চলে যাচ্ছিস? কখন এলি?

আমি বললাম, আমার তো জানিসই। কাল রাত্রে।
- হুম, তোর তো এই রকমই ব্যাপার। তো আমাকে ডাকবি তো। আমি থাকতে একা একা হেঁটে হেঁটে তুই এতটা রাস্তা যাবি? তুই শহুরে মানুষ, তোর কি হাঁটাহাঁটি অব্যেস আছে?

খোনে জানে না আমি সওয়া দু ঘন্টায় হাফ ম্যারাথন দৌড়াতে পারি, ওটা দু ঘন্টায় নামানোর জন্যে লড়ছি। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে ওর মোটর সাইকেলের সওয়ারি হয়ে যাই। অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিয়ে খোনে বলে, তো এখনো সেই ব্যাঙ্গালোরেই আছিস তো, না কী? তোদের ব্যাঙ্গালোরে একবার যাব, বুঝলি? গিয়ে দেখে আসব কেমন সেই স্বপ্নের দেশ।

ও এখন কী করছে সেটা জিজ্ঞেস করতে জানলাম খোনে এবার পঞ্চায়েত ইলেকশনে কংগ্রেস প্রার্থী। এর আগে সিপিএম থেকেও ও লড়েছে, এবং হেরেছে। এবারেও খোনের ভোটে হারা একেবারে নিশ্চিত, জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়াও বিচিত্র না, তবে ও নিঃসন্দেহ যে ওই জিতবে। আমাকে বলল, এরা তো ভোটের স্ট্র্যাটেজি ব্যাপারটা জানে না, কংগ্রেস হল ন্যাশনালিস্ট পার্টি। আমাদের সব হাইকম্যান্ড থেকে নির্দেশ আসে। সনিয়া গান্ধী বলে দেবে কী কী করতে হবে। এদের মত উঁচাটে পাড়ার দাদাগিরি আমাদের পার্টির উদ্দেশ্য না। দেড়শো বছরের ঐতিহ্য এই পার্টির। গান্ধীজী শুরু করে গেছিল, সে কী আজকের কথা!

খোনের ভটভটি ঢুকে গেল একেবারে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। কাকে হঠাৎ নজরে পড়তে চেঁচিয়ে উঠল, এই মদনা, শালাচ্ছেলে একেনে কী কচ্চিস? মাঠে যাসনি আজ? শোন, এদিকে আয়।

মদন নামের যুবকটি কাছে আসতেই খোনে বলল, যা একটা টিকিট কেটে নিয়ায় তো। মিঠু কি শিয়ালদা অবদি যাবি, না দমদম? একই ভাড়া অবশ্য, যা যা একটা শিয়ালদার টিকিট কেটে নিয়ায়। এই নে টাকা।

খোনে নিজের পকেট থেকে টাকা বের করতে যাচ্ছে দেখে আমি ফট করে মানিব্যাগ বার করে মদনের হাতে একটা একশো টাকার নোট এগিয়ে দি। আমাদেরটা ডাউন প্ল্যাটফর্ম, টিকিটঘর আপের দিকে। মদন প্ল্যাটফর্ম থেকে লাইনে লাফিয়ে পড়ে ওদিকে চলে যায়।

- চ, চা খাবি চ।
- আমার চা খাওয়ার তেমন অব্যেস নেই রে খোনে।
- ও এখনো ধরিসনি? তুই সেই একই রকম থেকে গেলি। এখনও কি আঙুল দিয়ে হাওয়ায় এবিসিডি লিখিস? ঘুমানোর সময় মাথা নাড়াস? চ, সামনের দিকে চ। তুই না খাস, আমি একটু চা খাই।
- কিন্তু মদনা?
- আরে ও ঠিক খুঁজে নেবে। ব্যস্ত হচ্চিস কেন?

প্ল্যাটফর্মের চায়ের দোকানের পাশেই একজন বিরাট একটা মাটির জালায় জল ভরে তাতে একটা শিশি থেকে ঢেলে সবুজ রং মেশাচ্ছিল। তার পাশে পাঁচ ছটা চটের বস্তায় পটল ভর্তি। এ রকম নধর পটল আমাদের ওদিকে দেখাই যায় না প্রায়। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সে বলল, যাচ্চিস?
আমি বললাম, হুঁ।

কিন্তু কে এ? আমাকে চেনে, অথচ আমি চিনতে পারছি না! নাকি আমাকে অন্য কারও সাথে গুলিয়ে ফেলেছে?

চায়ের দোকানে খোনে লেবু চা অর্ডার করতেই আমি বললাম, আমার জন্যেও একটা বলে দে। ততক্ষণে মদনও টিকিট এনে সেখানে হাজির। খোনে ওর হাত থেকে টিকিটটা নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখল। ফেরত টাকাগুলো এক এক করে গুণলো। শিয়ালদার পঁচিশ টাকা ভাড়া। সাতটা দশটাকার নোট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে পাঁচটাকার কয়েনটা নিয়ে মদনের হাতে দিয়ে বলল, যা ভাগ। বিকেলে হাটখোলার মাঠে আসিস।

আমি খোনেকে বললাম, ওখানে পটলে রং মেশাচ্ছে লোকটা কে রে? আমাকে চেনে মনে হল!
- ওমা, তুই ওকে চিনতে পাল্লি নে? আমাদের বাদলা। তোদের বাড়ি এসে পড়ে গেছে স্যারের কাচে। সংস্কৃত ক্লাসে একবার নন্দবাবুর কাছে বেধড়ক ক্যালানি খেল, মনে নেই?
- ঘোষপাড়ার বাদলা?
- হ্যাঁ, বাদলা আবার কটা স্যারের কাচে পড়তে আসত? ওই।
- এখন কী করে?
- কী আবার করবে? কাঁচামালের ভ্যান্ডারি করে। ছটা চব্বিশের ট্রেনে ওর মাল যাবে, এটায় না।

ধোঁয়াওঠা কাঁচের গ্লাসে লেবু চার স্বাদ মন্দ না। আমি গ্লাস হাতে এগিয়ে গেলাম বাদলার দিকে। পেছন পেছন খোনেও। ওই শুরু করল, এই দ্যাখ বাদলা, শহরে গেলে বাবুদের হাল কী হয়। তোকে চিনতেই পারছে না।
বাদলা বলল, ধুস, মিঠু আমায় চিনবে না? হতেই পারে না। কাকিমার সাথে আমার ডেলি দেখা হয়। মিঠু, মাকে জিগ্যেস করে দেকিস, গতবার যে বড়ি দিল আড়াই কেজির, তার পাকা চালকুমড়ো জুগাড় করে দিল কে? এই তো কদিন আগে একটা কাঁঠাল দিয়ে এলাম কাকিমাকে। স্যার দেখলাম বসে বসে টিভি দেখছেন।

আমি হাসলাম। জিজ্ঞেস করলাম, পটলে কী মেশাচ্ছিস?
- রং। এসব তো বাবুদের পেটেই যাবে, কলকাতার বাবুদের। তারা একটু বেশি সবুজ পছন্দ করেন। তাই আর একটু সবুজ করে দিই।
- কিন্তু বাদলা, তোর পটল তো এমনিতেই দারুণ সবুজ রে। আমারই ইচ্ছে করছে ক কেজি বয়ে নিয়ে যেতে ব্যাঙ্গালোরে।
- তো নে না। যতখুশি নে।
- কিন্তু তুই যে কী কালার মেশাচ্ছিস।
- তাতে কী? সবাই মেশায়।
- এগুলো ভাল জিনিস না রে বাদলা। এই রংগুলো
- ভাল জিনিস না মানে?
- মানে এগুলো সব এক একটা পয়জন বলতে পারিস।
- পয়জন, মানে বিষ? বলিস কী! একেনে সবাই এই মাল পটলে দ্যায়।
- হুম, বিষই। এমন বিষ না যে খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মরে যাবে। তবে শরীরের পক্ষে খুব খারাপ। আগে সবুজ করার জন্যে তুঁতে দিত। তুঁতে জানিস তো, ঠাকুমা দিদিমারা মুখে রাখত দাঁত শুলোলে। তুঁতের জীবাণু মারার ক্ষমতা আছে, যদিও বেশি পেটে গেলে সেও বিষ। এখন এই যে শিশিতে দেখছি, এটা তুঁতে না। এ একধরণের অর্গ্যানিক ডাই, এটা সম্ভবত ম্যালাকাইট গ্রীন। বিষাক্ত জিনিস। আগে অন্যদেশে খাবারে সবুজ রং করতে ইউজ হত, কিন্তু এখন সব জায়গায় ব্যান্‌ড্‌।
- তাই?
- হ্যাঁ। ভেবে দেখ, একটা মা তার আদরের বাচ্চাটাকে তোর এই পটলের তরকারি খাওয়াচ্ছে। আর তার ছোট্ট শরীরে সবার অজান্তে জমা হচ্ছে বিন্দু বিন্দু বিষ। বাচ্চাটার মাঝে মাঝে পেটব্যথা হয়, ডাক্তারবদ্যি কেউ ধরতে পারে না কী রোগ। সেগুলো এই সব থেকে হতে পারে।

সবুজ শিশিটা ছুঁড়ে দূরে এক ঝোপের মধ্যে ফেলে দিল বাদলা। বলল, আমরা কী এসব জানি? লেখাপড়া শিখতে পারিনি। ভাগ্যিস তুই বললি। অকারণে পাপের ভাগী হতে চাইনে আর।

প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকছিল। ওদের হাত নাড়িয়ে আমার ট্রলিব্যাগ হাতে আমি ট্রেনে উঠে পড়লাম।

পয়লা ফেব্রুয়ারি ২০১৪