সোমবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১৯

হিন্দু কোড বিল ~ শুভদীপ দে

ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রথম অ্যাসিড টেস্টঃ হিন্দু কোড বিল।

স্বাধীনতার পর গণপরিষদের অন্যতম বড় টাস্ক ছিল হিন্দু বিবাহ ও সম্পত্তি আইনের কোডিফিকেশন, একীকরণ ও সংস্কার । বি এন রাউ এর করা খসড়া-র রিভিশনের ভার পড়ে সিলেক্ট কমিটির হাতে, যার মাথায় ছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী বাবাসাহেব আম্বেদকর । 

নতুন আইনের অন্যতম সূচীমুখ ছিল- স্বামী বা পিতার সম্পত্তিতে স্ত্রী ও কন্যার অধিকার, সেপারেটেড স্ত্রীর খোরপোষের অধিকার, বিবাহবিচ্ছেদ এর অধিকার,   সকল প্রকার ইন্টারকাস্ট বিবাহের অধিকার, সন্তান দত্তকের অধিকার, বহুবিবাহ নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি । 

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে হয়তো মনে হবে, এগুলো খুবই মিনিমাম দাবী, এটা তো সাধারণ অধিকার, এ নিয়ে এত মাতামাতির কী হল ? কিন্তু আজ থেকে সত্তর বছর আগে ব্যাপারটা মোটেই সহজ হয়নি । ব্রাহ্মন্যবাদী পুরুষতান্ত্রিক সমাজপতিরা মেয়েদের এইটুকু অধিকার দিতেও রাজী হচ্ছিল না । পেছনে যুক্তি কী ছিল ? সতীদাহ, বিধবাবিবাহ থেকে শুরু করে শবরীমালা অবধি এদের যে দাবী, হিন্দু কোড বিলের ক্ষেত্রেও তাই ছিল- "ট্র্যাডিশন" । যদিও বাবাসাহেব প্রথমেই এদের সঙ্গে অফেন্স এ যাননি, বরং প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র থেকে রেফারেন্স টেনে এনে দেখাতে চেয়েছিলেন যে শাস্ত্রে স্ত্রীকে পুরুষের দাসী বানানোর কথা বলা হয়নি । এইভাবে বাবাসাহেব আসলে রামমোহন বা বিদ্যাসাগরের পথই ফলো করছিলেন, তবে তাতে করে ব্রাহ্মন্যবাদীদের টলানো যায়না, যায়নি । 

বিলের প্রথম বিরোধিতা আসে গণপরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান তথা পরবর্তীতে ভারতের রাষ্ট্রপতি বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদের পক্ষ থেকে । যার যার ওনার সম্পর্কে খুব গ্রেট ফীলিং আছে, তাদের প্রণিধানের জন্য বলে রাখি- কংগ্রেসের যে লবি সুভাষ বসুকে দলছাড়া করিয়েছিলেন, বাবুজী ছিলেন সেই লবির সেনাপতি বিশেষ । হিন্দু কোড বিল নিয়ে তার বক্তব্য ছিলো, স্ত্রী অধিকার, সমানাধিকার এসব বিদেশী আইডিয়া, মুষ্টিমেয় কিছু লিবেরাল লোকজন এসব বিদেশী জিনিস ভারতের হিন্দুদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে । হায়, উনি সতীদাহ নিবারণের সময় থাকলেন না, থাকলে কী বলতেন শোনার ইচ্ছে ছিল । যাই হোক, শোনা যায় রাজেন্দ্রপ্রসাদ নেহরুকে এই নিয়ে একটি কড়া চিঠি লিখেছিলেন, সেটা পাঠানোর আগে কংগ্রেসে তার লবির অন্যতম সুহৃদ সর্দার প্যাটেলকে সেটা দেখিয়েছিলেন । প্যাটেলের মনে কী ছিল জানা নেই, তবে বাস্তববাদী পলিটিশিয়ান হিসেবে উনি প্রসাদকে বুদ্ধি দেন চেপে যেতে, কারণ গণপরিষদের মেয়াদ শেষ হচ্ছিল, ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে কংগ্রেসের মেজরিটি দক্ষিণপন্থী লবির পছন্দ ছিলেন প্রসাদ, ওদিকে নেহরুর পছন্দ ছিলেন রাজাগোপালাচারী । এই চিঠি নেহরুর কাছে পৌঁছলে তিনি প্রসাদের নামে ভেটো দিয়ে দিতেন, এবং কংগ্রেস ভাঙ্গনের দিকে চলে যেতো । বন্ধুর সুপরামর্শে বাবুজী সরাসরি বিরোধিতার পথ থেকে সরে আসেন । এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ।

ঘরের চাড্ডীদের সামলে উঠতে পারলেও পিকচার এখনো অনেক বাকি ছিল । ধর্মশাস্ত্রে হাত পড়ছে, হিন্দু সংসারের বেসিক স্ট্রাকচার ভেঙ্গে দিতে চাইছে এই বিলেত ফেরত নেহরু আর আম্বেদকার, এইসব বক্তব্য দিয়ে গঠিত হল হিন্দু কোড বিল বিরোধী কমিটি । একে একে জুটলো ধর্মীয় গুরু,  পেটোয়া সাধু সন্ন্যাসী যারা নামে সন্ন্যাসী হলেও পুরোপুরি গার্হস্থ্য জীবনযাপন করেন । আজকের দিনেও এদের দেখতে পাবেন, আরএসএস আয়োজিত মঞ্চে এসে কখনো এরা রামমন্দির চায়, কখনো শবরীমালা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আর পিনারাই বিজয়নের মুন্ডপাত করে ।  দ্বারকার শঙ্করাচার্য্য এই বিলের বিরুদ্ধে ফতোয়া গোছের দিলেন । ১৯৪৯ এর ১১ই ডিসেম্বর, দিল্লীর রামলীলা ময়দানে আরএসএস হিন্দু কোড বিলের বিরুদ্ধে সমাবেশ করলো, সেখানে বলা হল নারীর সম্পত্তি ও ডিভোর্সের অধিকার আসলে হিন্দুধর্মের ওপর পরমাণু বোমার আঘাত । নারী অধিকার পেলে হিন্দু সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে । একজন  নেহরুর ফাঁসিও চেয়েছিল । এক বক্তা বলেছিল "আম্বেদকর অস্পৃশ্য সমাজের লোক, হিন্দু ধর্ম নিয়ে বিধান দেওয়ার কোনো অধিকারই ওনার নেই" । এর পঞ্চাশ বছর পর আরেক শঙ্করাচার্য্য একই কথা বলবেন, তারও পনেরো বছর পর এই ভন্ড সাধুসন্ন্যাসীরা প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান আলো করে বসে থেকে সরকারের মনোভাবের আবরণ উন্মোচন করবেন, অবশ্য ততোদিনে আমরা সহ্য করতে শিখে গেছি, থাক সে কথা । 
কোড বিল বিরোধী বিক্ষোভের মাথা ছিলেন আরেক ভন্ড সাধু, স্বামী কর্পাত্রি মহারাজ । তিনি আরএসএস ও অন্যান্য সংগঠনের উদ্যোগে দেশজুড়ে উস্কানি দিয়ে বেড়ালেন । দাঙ্গা হাঙ্গামার হুমকি দিলেন । দেশ ভেঙ্গে টুকরো করার হুমকি দিলেন । রাষ্ট্রপতির চেয়ার নিশ্চিত হওয়ার পর মাঠে নেমে পড়লেন বাবুজীও, বললেন তিনি এই বিলে সই করবেন না । এই জায়গায় পিনারাই বিজয়ন থাকলে হয়তো আরএসএস-জনসঙ্ঘ নেতাদের স্ত্রীদের দিয়ে ডিভোর্স করিয়ে নিতেন, জ্যোতি বসু থাকলে দলের লোকজন দিয়ে এসব ভন্ড সাধুদের তুলিয়ে হিমালয়ে দিয়ে আসতেন, কিন্তু নেহরুর ততোটা জোর তখনও ছিল না । শশী থারুরের মতো ওনারও লিবেরাল জহরকোটের আড়ালে ভোটব্যাঙ্ক নির্ভর পলিটিশিয়ানের কম্পমান হৃদয় ছিল । উনিও আর ভোটের আগে এই নিয়ে এগোলেন না । অপমানিত, ভগ্নহৃদয় হয়ে বাবাসাহেব আম্বেদকর পদত্যাগ করলেন । 

তবে নেহরু আর যাই হোক, শশী থারুর নন । নির্বাচনী প্রচারে বারবার করে হিন্দু কোড বিলের কথা উনি তুলেছিলেন দেশজুড়ে । সমর্থন চেয়েছিলেন, যাতে প্রথম পার্লামেন্ট এ বিল পাশ করা যায় । তার বিরুদ্ধে এলাহাবাদ আসনে জনসঙ্ঘ-রামরাজ্য পরিষদ- হিন্দু মহাসভা যৌথ প্রার্থী করেছিল কোড বিল বিরোধী হাঙ্গামার অন্যতম নায়ক প্রভুদত্ত ব্রহ্মচারীকে । সেই আসনে নেহরু বিপুল ভোটে জয়ী হন । দ্বিতীয় হয়েছিলেন কৃষক মজদুর প্রজা পার্টির প্রার্থী বংশীলাল । ব্রহ্মচারী ফুটে যান । 

প্রথম লোকসভায় হিন্দু কোড বিল চার খন্ডে ভাগ হয়ে পাশ হয় ।

বুধবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৯

কাবাব রুটি ও পাহাড়ি চটির গপ্প ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

- যাব্বাবা, এ তো গলা ছিপি হয়ে যাবে গিলতে, রুটি গুলো হিমঠান্ডা, আর কাবাবও তথৈবচ
- কি করি বলুন তো? এই মাঝরাত্তিরে আমি কোত্থেকে পোলাও কালিয়া পাই?
- পোলাও কালিয়া কে চেয়েছে হে? এট্টু জল পেলেও ... শুকনো রুটি তো গিলতে পাচ্চিনা এই মাঝরাতে ...
- জল দিয়ে রুটি গিলবেন? এই ঠান্ডা পাহাড়ি দেশে যেখানে সেখানে জল খাওয়া কি ঠিক আপনার? আপনি শহুরে মানুষ...
- সে তোমাকে ভাবতে হবে না। কত ঘাটের জল খেয়ে হজম করে দিলুম
- সে করেছেন, বেশ করেছেন। এখন এখানে ওই নোংরা কুঁজোর জল খেয়ে যদি আপনার পেট খারাপ হয়, কলেরা হয় , তাহলে জবাবদিহি কে ...
- বড্ড বকবক করো হে ছোকরা ... থাক , আমার আর খেয়ে কাজ নেই, শুয়ে পড়ো দিকি।
- আপনি কিছু না খেলে যে উঠতে পারবেন না। কাল যে অনেক রাস্তা হাঁটা বাকি
- ও আমি ঠিক ...
- পারবেন না। আরে আমি আপনার গাইড। পাহাড়ে গাইডের কথা শোনার তো একটা নিয়ম আছে, না কি? 
- বেশ, হুকুম কিজিয়ে উস্তাদ
- আপনাকে খেতেই হবে
- কিছুতেই ওই লেড়ো বিস্কুট মার্কা খড়খড়ে রুটি আর জুতোর শুকতলা মার্কা কাবাব আমি খাবো না। ভুখ জিন্দা রহে।
- আপনি ... আপনি ... কি জেদি লোক রে বাবা... মহা মুশকিলে পড়লাম... একে গায়ে জ্বর, তার ওপরে বলছে খাবে না...
- খুব মুশকিলে পড়েছ, তাই না ভকৎরাম? আমি লোকটাই এরকম। জেদি, একগুঁয়ে। মুশকিলে ফেলি সবাইকে। ব্রিটিশ সরকারও আমাকে মুর্তিমান শীরঃপিড়া মনে করে।
- সে আর বলতে বোসবাবু? তারা এখন গোটা ভারত তোলপাড় করে আপনাকে খূঁজছে, কিন্তু ভাবতেও পারছেনা, সুভাষ বোস খাইবার পাস পেরিয়ে আফগানিস্থানের একটা অজ গাঁয়ে সরাইখানায় এক গাদা নোংরা পোশাক পরা গরীব পাঠানের মধ্যে গায়ে জ্বর নিয়ে শুয়ে আছে, আর তিন দিন অভুক্ত থেকেও বাচ্চা ছেলের মত জেদ করে খেতে চাইছেন না।
- রোটি তোড়ো, তুম ভি খাও, হাম ভি খায়েগা ভকৎরাম তলোয়ার। আমি জানি তুমি কিচ্ছু খাওনি, আমাকে ডাহা ঝুট বলেছ। 
- কি করে ধরলেন বোসবাবু? 
- ওসব ছাড়ো ছোকরা। একবার বেরিয়ে দেখো তো হে, যদি সরাইয়ের পাশে চায়ের দোকানটা খোলা থাকে...
- চা পেলে খাবেন তো? 
- তুম ভি খাওগে, হাম ভি
- আভি আয়া বোসবাবু

** ভকৎরাম তলওয়ারের স্মৃতিকথা থেকে সংগ্রহ করা একটা ছোট্ট ঘটনা। চা পাওয়া গিয়েছিল এবং দুজনে চায়ে ডুবিয়ে সে রাতে রুটি ভাগ করে খেয়েছিলেন।

সোমবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৯

ডাক্তার ~ ডা: বিষাণ বসু

দেখুন, গাঁড়লের মতো তর্ক করবেন না। বেসিক ব্যাপারটা বুঝুন।

প্রবল হাওয়ায় কি মোমবাতি জ্বলে? জ্বালিয়ে রাখা যায়? জ্বালানো সম্ভব?

তার জন্যে অনুকূল পরিবেশ লাগে।

প্রতিকূল অবস্থায় মোমবাতি জ্বালানোর কথা ভাবে, ওই আপনার মতো, গাণ্ডু। আর, আপনি যদি ভাবেন, মোমবাতি জ্বালাচ্ছেন না কেন বাকিরা, তাহলে তো আপনি একটা আস্ত…..নাঃ, থাক, লোকে আমাকেই খারাপ ভাববে।

অতএব, বাস্তবতাটা বুঝুন।

কুকুরশাবকের মৃত্যু হলে মোমবাতি জ্বালাতে সেলিব্রিটি জোটানো কঠিন নয়। কেননা, ওই যে বললাম, পরিবেশ অনুকূল।

কিন্তু, দার্জিলিং-এ ডাক্তারদিদির মাথায় আস্ত লোহার রড পড়লে…..ক্যালানের মতো কথা বলবেন না, প্লীজ…..ডাক্তার এবং সেই রিলেটেড যেকোনো ইস্যুতেই পরিবেশ যে প্রতিকূল,অ্যাদ্দিনে এটুকুও যদি না বোঝেন, তাহলে মেনটস ছাড়া আর কেউই আপনার দীমাগ কি বাত্তি জ্বালানোর দায়িত্ব নেবে না।

সুতরাং, ব্যাপারটা সিম্পল।

আরে বাবা, স্বয়ং পুলিশ লিখিত উত্তরে জানিয়ে দিয়েছেন, যে, ডাক্তারদের উপর আক্রমণের ঘটনার লিস্টি তাঁরা মেইনটেইন করেন না।

করবেনই বা কেন? আর কোনো কাজ নেই নাকি?!!

দার্জিলিং-এ ডাক্তারদিদির মাথায় রডের বাড়ি পড়লে মিডিয়ায়, প্রথম পাতায় সেই খবর নেই কেন, এমন প্রশ্নও অবান্তর। কেননা, সবাই জানে, কুকুর মানুষকে কামড়ালে খবর হয় না, মানুষ যদি কুকুরকে কামড়াতে যায়, খবর হয় সেইটাই।

কাজেই, ডাক্তার মার খেলে খবর হওয়ার প্রশ্নটাই বা আসছে কোত্থেকে!!

হ্যাঁ, খবর হবে তখনই, যদি সেই মার খেয়ে ডাক্তারেরা প্রতিবাদ করেন, পথে নামেন, কাজ বন্ধ করেন, মিছিল করেন। আরে বাবা, ডাক্তারদের এই হারামিপনার জন্যে মানুষের হয়রানির কথাটা তো তুলে ধরতে হবে!!

এর পরে, হাওয়া যে অনুকূল নয়, সেইটা বুঝতে কি হাওয়ামোরগ হতে হয় নাকি!! 

সেলিব্রিটিরা বিদ্বজ্জন কেন? আপনি তো আর বিদ্বজ্জন নন। তাঁরা বিদ্বজ্জন একারণেই, যে, তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তি, ইন্দ্রিয় আপনার-আমার থেকে এগিয়ে। 

কাজেই, এই এগিয়ে বাংলা-য়, তাঁরাও এগিয়ে। 

তাঁরা আলোর পথযাত্রি।

মোমবাতি জ্বেলে তাঁরা আলো দেখান।

যে অপদার্থ ডাক্তারদিদি ঝলমলে কাঞ্চনজঙ্ঘা ছেড়ে নারীর জঙ্ঘার মাঝখান থেকে সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানোর চেষ্টা করেন, এবং সেইটাও পেরে ওঠেন না, তাঁর তো আলোর অধিকারই নেই।

কাজেই, দুঃখিত ম্যাডাম, আপনার জন্যে মোমবাতি নেই। আপনার জন্যে কালো ব্যাজ, মুখে কালো কাপড়, শোকমিছিল - না, কিচ্ছুটি নেই।

ছেলেবেলায় সমাজবন্ধুদের লিস্টটি পড়েছিলেন তো? হ্যাঁ, সমাজের গু পরিষ্কারের দায়িত্ব থাকা আপনি, মানে ডাক্তাররা, সমাজবন্ধু, মানে সমাজের বন্ধু। কিন্তু, সমাজও আপনার বন্ধু হবে, এমন কোনো গ্যারান্টি তো আপনাকে কেউ দেয় নি। মানে, আপনি বিরাট কোহলির ফ্যান যদি হন, তাহলেই কি আপনি আশা করবেন যে বিরাট-ও আপনার ফ্যান!!

মনে রাখবেন, আপনি, আপনি স্রেফ একটা দাস। ক্রীতদাস।

এই ট্যাক্সপেয়ারদের পয়সায় আপনি ডাক্তারি পড়েছেন।

হ্যাঁ, এই কথাটা আপনাকে মনে করিয়ে দেবেন সেই সব শুয়োরের বাচ্চারা, যাঁরা জীবনে ট্যাক্স দেন নি, দেন না। কিন্তু, আপনাকে চুপ থাকতে হবে, থাকতেই হবে।

কেননা, মনে রাখুন, এইট পাশ যে মন্ত্রী আপনার মাথার উপরে, তিনি ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছেন নিজের পয়সায়। যে বন্ধু ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এখন স্টেটসে বসে দেশ এবং দশের হাল নিয়ে ভয়ানক চিন্তিত, তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন নিজের পয়সায়। এমনকি, যে দিগগজ বিদেশে পাড়ি জমানোর পাথেয় হিসেবে একটি পিএইচডি করছেন, তাঁর সেই রিসার্চ গ্র‍্যাণ্টের পয়সার একটুও ট্যাক্সপেয়ার্স মানি নয়।

নেতার ওয়ার্ল্ডট্যুর, কিম্বা মাটি উৎসবের ফান্ড। আকাশছোঁয়া রামের স্ট্যাচ্যু বা ইমাম ভাতা।

মনে রাখবেন, উপরের একটিতেও ট্যাক্সপেয়ার্স মানি খরচ হয় না, যেমন করে খরচ হয়, কিছু অপোগন্ডকে ডাক্তারি পড়াতে।

আর, যেহেতু আপনি এতো খরচ করেছেন এইসব চুথিয়াদের পেছনে, তারা পছন্দমতো সার্ভিস দিতে না পারলেই, মানে নব্বই বছরের বৃদ্ধকে টাট্টুঘোড়ার মতো চাঙা করতে না পারলেই বা আগেভাগে চেক-আপে না আসা প্রসূতি জটিল অবস্থায় হাসপাতালে এসে জাদুকাঠির ছোঁয়ায় সমস্যাহীন প্রসব না হলেই….আপনি ভাবেন…

শাল্লা….দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষেছি!!!

আর, সাপ দেখলে আপনি কী করেন!!

তবে কি, একটু রয়েসয়ে। সাপের ব্যাপারে একটু সাবধান।

সাপ কিন্তু ডাক্তার নয়।  

দুমদাম লোহার রড নিয়ে চড়াও হবেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। 

দেশে আইনকানুন আছে। মানেকাজি আছেন।

গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী মিডিয়া আছে।

সমাজসচেতন বিদ্বজ্জনেরা আছেন।

শনিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৯

সাবাস ~ অনামিকা

এখন থেকে কোথাও গেলে জানিয়ে যেও... কেমন!
ভিন পাড়াতে বন্ধুরা নেই... দাঁড়িয়ে আছে ডেমন।
এই বাংলার আলতো ছেলে, তুমি অরাজনীতি
এপাং-ওপাং ট্রামলাইনের সিনেমাটিক গীতি।
কড়ি কোমল প্রতিভাময়, জ্বলন্ত তরতাজা
ফুল রাইমএর মশাল তুমি, হাফ রাইমের রাজা।
কী অনায়াস অনভ্যস্ত ভাষার আঁকিবুঁকি 
সবাই লেখা নকল করি। ছন্দ থেকেও টুকি।

মধ্যবয়স পৌঁছে গেলে না খুঁজে ছলছুতো 
বঙ্গভাষী কলম আখের গুছিয়ে নেবেই দ্রুত।
এই রকমই নিয়ম যদি, কীসের তবে দেরি?
মঞ্চে ওঠো। কলমটাকে করতে থাকো ফেরি।
হাফ রাইমের ঈশ্বর হে, বেজায় মাথা চুলকে
সময় মতন করছ রিপু ঈশ্বরীয় ভুলকে।
সাবাস তোমায়, সার কথাটি ফেললে বুঝে আস্ত।
বাঁশ কিম্বা দূর্বা সবই দিনের শেষে ঘাস তো!

বৃহস্পতিবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৯

মকর সংক্রান্তি ~ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য

উত্তরায়ণ সংক্রান্তি  সমাগত, সে দিনে সকাল সকাল মকর স্নান করার জন্য মাতা যশোমতী বালক শ্রীকৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে সংক্রান্তির পূর্ব রাত্রে বলেছেন-
"আসিল যে পৌষ মাস শুনহ রাজন।
দ্বিদশ  নবম  দিন  দিল  দরশন ॥

সকালে স্নান শুনেই শ্রীকৃষ্ণের পেট গুড়গুড় শুরু হয়ে গেল, সেই ঠাণ্ডা জলে স্নান সে একমাত্র বহু কষ্টে সরস্বতী পুজোর দিন করে তাও যদি দেবী রুষ্ট হয়ে অঙ্কে ফেল করিয়ে দেন সেই ভয়ে, তাই কৃষ্ণ মাতা যশোমতীকে নানা অজুহাত দেওয়া শুরু করল। যশোমতী আবার এসব স্কুলে বহুদিন আগেই পড়াশুনো করেছেন, সুতরাং শ্রীকৃষ্ণের শরীর ভাল নেই, সর্দি লেগেছে। গা ম্যাজম্যাজ করছে বিশেষ পাত্তা পেল না। যশোমতী বললেন হ্যাঁ রে এই যে সারা দুপুর টোটো করে ঘুরে বেড়াস, বাঁশি বাজাস, ২০-২০ খেলিস তখন তো তবিয়ৎ আচ্ছা থাকে, যশোমতী বহুদিন মথুরায় ছিলেন তাই কথায় মাঝে মধ্যে হিন্দি শব্দ ঢুকে পড়ে।

শ্রীকৃষ্ণ শেষ চেষ্টা হিসেবে প্রস্তাব দিলেন গরম জলে স্নান করলে হবে না, শুনে যশোমতী যেন আকাশ থেকে পড়লেন, বললেন আরে এ স্নান গঙ্গাসাগরে করতে হবে, অনেক দূরের পথ, রাত থাকতে বেরতে হবে, শেলদা, ডায়মন্ড হারবার, নামখানা গঙ্গাসাগর। শ্রীকৃষ্ণ জিজ্ঞেস করলেন আচ্ছা এ পথে কি তিব্বত ডোকালামও যাওয়া যায়? যশোমতী তখন কয়লার উনুনে রুটি ভাজছিলেন, বললেন সে আমি অত জানি না, দরকার হয় তো গুগুল ম্যাপ দেখে নে।

মোবাইল তখন চার্জে বসানো, শ্রীকৃষ্ণ দেখেন একগাদা মেসেজ, হোয়াটসএপে হ্যাপি মকর সংক্রান্তির ছবি, শুভেচ্ছা ভর্তি, একজন সাধু একগলা জলে দাড়িয়ে পুণ্যস্নান করছেন আর সূর্যপ্রনাম করছেন। শ্রীকৃষ্ণ মনে মনে ভাবলেন কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ।তবে আগে স্নান না আগে সূর্যপ্রণাম এ নিয়ে তিনি ভয়ানক দ্বন্দে পড়ে গেলেন। উপায়, উপায় একটাই বেনিমাধব শীলের হাফ পঞ্জিকা, কিন্তু কাজের সময় কি সে হাতের কাছে পাওয়া যাবে?

 

যশোমতী পিঠে বানাবেন, নারকেল, খেজুর গুড়, চালের গুড়ো সব বাজার থেকে শ্রীকৃষ্ণকে দিয়ে আনিয়েছেন, বালক শ্রীকৃষ্ণর আজ ভারি মজা, রুটি তরকারি খেতে খেতে পেটে চড়া পড়ে গেছে, খাওয়াদাওয়াতে খানিক ভ্যারাইটি না হলে হয়, ইদানিং আবার অনলাইনের এক ফ্যাসান হয়েছে, সেদিন ধৃতরাষ্ট্র জ্যাঠার বাড়ি অনলাইনে আনা পাটিসাপটা দিয়েছিল জেঠি সে যে কি অখাদ্য যে না খেয়েছে কি বুঝবে। ওদিকে দুর্যোধন কানের কাছে ভাঙ্গা রেকর্ড বাজিয়ে যাচ্ছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে আমাদের হয়ে লড়াই করুন, সকাল বিকেল পাটিসাপটা পায়েস ফ্রি। শুনে কৃষ্ণ তো বলেই বসলেন তোরা খালি কখন অনলাইনে সেল লাগে সেই খোঁজ রাখ আর যত পুরনো এক্সপায়ার পিঠে , পায়েস খেয়ে দুহাত তুলে নাচ। আসিস সংক্রান্তির দিন, পেট ভরে পিঠে খেয়ে যাস।

শুনে গান্ধারী বললেন কি করি বল, এখন আর সেই নারকেল কোড়ানো, চাল গুড়ো করা, দুধ জাল দেওয়া, সরুচাকলি বানানো একহাতে পেরে উঠি না। তাই অগত্যা।

 

ওদিকে ভীষ্ম শরশয্যায়, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দশম দিনে অর্জুনের শরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে রথ থেকে মাটিতে পড়ে যান, তিনি জানতেন মহর্ষি বশিষ্ঠের অভিশাপগ্রস্ত হয়ে ইহলোকে মনুষ্য হিসাবে কৃতকর্ম ভোগের জন্য জন্ম নিয়েছিলেন। হিসেবমত তাঁকে দেবলোকে ফিরে যাবার কথা, কিন্তু প্রবলেম হল দক্ষিনায়নের সময় দেবলোকে রাত্রি, সবকিছু বন্ধ থাকে, অনেকটা সেই স্কয়ান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর মত, সুতরাং অপেক্ষাই যখন করতে হবে তিনি মনস্থ করেছিলেন পৃথিবীতে থাকবার। অন্তত কিচু চেনা মানুষজন দেখা যাবে, দু একটা সুখ দুঃখের কথা বলা যাবে আর দেবলোকের বাইরে সেই অন্ধকারে অপেক্ষা করবার কোন অর্থ হয় না, না সেখানে মোবাইল সিগন্যাল আছে না আছে ঘণ্টাখানেক সুমন।

ভোর হয় হয়, পৌষ সংক্রান্তি, উত্তরায়ণের প্রারম্ভ। সেই সাগরে হাজায় মানুষের সাথে শ্রীকৃষ্ণ ডুব দিলেন, তিনি ভুলেই গেছেন এ বিশ্ব সংসারের তিনিই স্রষ্টা, বিধাতা, নিয়ন্তা।

পিতামহ ভীষ্ম সদ্য শরীর ত্যাগ করেছেন চলেছেন দেবলোকের পথে।
 
যশোমতী আজ উঠোনে সকাল সকাল আলপনা দেবে, পিঠে বানাবে আর সেই আতপ চাল, নারকোল, গুড়ের গন্ধে ভেসে যাবে বিশ্ব চরাচর।

শুভ মকর সংক্রান্তি।

বুধবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৯

কুকুর ~ ড: রেজাউল করীম

এক চাষার ব্যাটা একবার জাঁক করে বলেছিলেন- হেলে ধরতে পারে না, কেউটে ধরতে গেছে। ঘটনাচক্রে, উপমাটা মনে হল এই জন্যে যে, মহাজোটের কাণ্ডারী তো রাজ্য সামলাতেই ল্যাজেগোবরে, দেশ সামলাবেন কি করে? "পঞ্চাশ টাকা বেশী দামের পশু খুনে" দুজন অল্পবয়সী মেয়েকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের অপরাধ খাটো করে দেখতে চাই না, কিন্তু এর জন্য ও কি তারাই দায়ী নয়, যারা শাসন ক্ষমতায় আসীন? এই অবুঝ মেয়েগুলো কিভাবে বুঝবে মানুষের চেয়ে গরু আর কুকুরের জীবনের দাম বেশী? অসংবেদনশীলতা তারা শিখেছে রাজনীতির কারবারিদের কাছে, যারা নিত্যদিন নতুন নতুন অবিমৃষ্যকারিতার ইতিহাস তৈরী করছে। যেদিন সুজেত জর্ডন ধর্ষিতা হন, সেদিন একজন বলেছিলেন সাজানো ঘটনা। অসংবেদনশীলতা নয়? যেদিন কাটোয়াই একজন মহিলা স্টেশনে ধর্ষিতা হয়ে ছিলেন সেদিন সেই একই ব্যক্তি বলেছিলেন- সিপিএম। অসংবেদনশীলতা নয়? এর পর নানা ঘটনায় দেখা গেছে প্রতিদিন কত অসংবেদনশীলতার ইতিহাস তৈরী হচ্ছে "দুষ্টু ছেলেদের" হাতে, হাতে হাতে লাল বাতাসা নিয়ে অপেক্ষমান উন্নয়নের হাতে! তারা প্রতিদিন এই অসংবেদনশীল পরিবেশে বেড়ে উঠছে, কি করে বুঝবে কুকুরছানা মরলে হাজতে যেতে হবে! এই তো কিছুদিন আগে একজন শিক্ষকের মৃতদেহ পাওয়া গেল, রেল লাইনের ধারে, নৃশংস ক্ষতচিহ্ন নিয়ে। কতজন গ্রেফতার হয়েছে? একজন পুলিশকে দিনদুপুরে খুন হতে হল। কতজন গ্রেফতার হয়েছে? উত্তরপ্রদেশে গরু খুনে গ্রেফতার হয় বলে যারা চিৎকারে আকাশ ভরিয়ে তোলেন তারা কুকুর খুনকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবেন, মানুষ খুনে কেন পায় না বিচার বলতে পারবেন? কাল একজন যুবক "নানা হাসপাতালে ঠোক্কর খেয়ে হাত হারিয়েছে"(আবাপ)। অসংবেদনশীলতা নয়? কে দায়ী? আপনি দায়ী। কারন ভোটে নির্বাচিত হয়ে ও বেড বাড়াননি, ডাক্তার বাড়াননি, পরিকাঠামো উন্নয়ন করেননি। তার কি কোন শাস্তি আছে? না নেই, ক্ষমতার চাবিকাঠি আপনার হাতে। বিচার করতে গেলে জজের ও হাত কাঁপে। আমাদের মত ছাপোষা মানুষদের জীবনের কোন দাম নেই। যে কোন সময় নেই হয়ে যেতে পারি। যেমন অম্বিকেশের হয়েছিল। যেমন প্রেসিডেন্সির সেই ছাত্রীটিকে দেগে দেওয়া হয়েছিল, যেমন সেদিন শালবনির ডাক্তারদের দেগে দেওয়া হয়েছে। কেউ সিপিএম কেউ মাওবাদী।
কাল একজন ডাক্তার মারা গেছে। একটি ছোট্ট শিশুর হার্ট সচল করতে গিয়ে নিজের হার্ট স্তব্ধ হয়ে গেছে। তার আরো ১৯২ জন সাথী আক্রান্ত হয়েছে। প্রানে মেরে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, একজনকে তো সপরিবারে। কেউ গ্রেফতার হয়েছে? কেন প্রতুল মাহাতো গ্রেফতার হয় নি? কেন পুলক দত্ত গ্রেফতার হয়নি? অসংবেদনশীলতা শুধু নয়, বিচারব্যবস্থা কে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দেওয়া। আইনকে ইচ্ছামত বাঁকানো। 
এই ইতিহাসের মহাভারত রচনা করা যায় কিন্তু  পাহাড় প্রমান নির্বুদ্ধিতা আর অসৌজন্য ও অসংবেদনশীলতার ইতিহাস লাগে না, বুঝ মন যে জানে সন্ধান। আসল কথা হল গনতন্ত্রের নব নব সংজ্ঞা উদ্ভাবন করে নিজের সব পাপ কার্পেটের তলায় ঢুকিয়ে ফেলা। তারপর সন্ন্যাসী সেজে বসা। দেশের শাসক হয়ে বসার আগে আগে "সর্বজন হিতায়, সর্বজন হিতায়" নীতি নিজের জন্য প্রয়োগ করুন। আগে প্রমান করুন, হেলে ধরতে পারেন, কেউটে দূর অস্ত।

মঙ্গলবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৯

কৃষক কেন দাম পায়না ~ অংশুমান মজুমদার

বিপ্লব সেনগুপ্ত বা দীপঙ্কর মুখার্জীর লেখায় বাজারের সমস্যা নিয়ে একটি গল্প পড়েছিলাম। গল্পটি ইংল্যান্ডের কয়লাখনি শ্রমিকের পরিবারে কথোপকথন। অনেকেই গল্পটা পড়েছেন, তবুও শীতের রাতে খনি শ্রমিকের পারিবারিক কথাবার্তায় আজকের চিত্রও ফুঁটে ওঠে।
শ্রমিকের ছেলে তার মা কে প্রশ্ন করে: বাড়িতে আজ ঘর গরম করার জন্য ফায়ার প্লেসে কয়লা দাওনি কেন?
মায়ের উত্তর: বাড়িতে কয়লা আর নেই।
ছেলের প্রশ্ন: তাহলে দোকান থেকে কয়লা কিনে আনো।

মায়ের উত্তর: কয়লা কিনতে তো টাকা লাগবে। কিন্তু আমাদের যে টাকা নেই।
ছেলের প্রশ্ন: টাকা নেই কেন?
মায়ের উত্তর: তোমার বাবাকে খনির মালিক বেতন দেননি এবং চাকরিটাই চলে গেছে। তাই আমাদের টাকা নেই।
ছেলের প্রশ্ন: বাবার চাকরি হারালো কেন?
মায়ের উত্তর : বাজারে কয়লার মজুদ বেশি হয়ে গেছে। সে জন্য খনির কাজ বন্ধ। ফলে তোমার বাবার চাকরি গেছে। চাকরি নেই, তাই হাতে টাকা নেই। টাকা নেই, তাই কয়লা কেনা যায়নি। বাজারে কয়লার পরিমাণ 'বেশি' হয়ে যাওয়ার কারণে আজ আমাদের ঘরে কয়লা 'নেই'।
গল্পটি পড়লে আজকে আনন্দবাজার পত্রিকার আট পাতায় প্রকাশিত '৫ পয়সা কেজি পেঁয়াজ, খাচ্ছে গরুতে' খবরের মিল খুঁজে পাওয়া যাবে।
খুচরো বাজারে পেঁয়াজের দাম আছে, অতি ফলনের খবর নেই, তবুও কৃষক ফসলের দাম পাচ্ছে না!
বাজারে অবশ্য গরু আছে খবরেই প্রকাশ, আর আছে ফঁড়ে, যেটা খবরে নেই। তবে কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের দাম সুনিশ্চিত করার প্রচেষ্টার মারাত্মক ঘাটতি যে আছে, সে কথা প্রকাশের প্রয়োজন হয় না।
দুর্দশার অন্য খবরও আছে। মহারাষ্ট্রের আখচাষীদের অল্প দামে তাঁদের কাছ থেকে আখ কিনে কারখানার মালিকরা চড়া দামে বিক্রি করে তার থেকে তৈরি হওয়া চিনি। মালিকপক্ষের কাছ থেকে বিক্রির সেই সামান্য টাকা তুলতেও কালঘাম ছুটে যায় কৃষকদের। বারবার অভিযোগ করেও কারখানার মালিকদের কাছথেকে বকেয়া না পেয়ে ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। শুক্রবার ক্ষুব্ধ চাষীরা ভাঙচুর চালায় সাতারার কৃষ্ণা চিনি কারখানায়।

মেল গ্যেজ বনাম পুরুষের মুগ্ধতা ~ উর্বা চৌধুরী

এই তো সেদিন গড়িয়াহাটের চারমাথা থেকে পার্কসার্কাসের সাতমাথায় যাব বলে অটোরিকশায় উঠেছি। পাশে যে মেয়েটি  বসেছিল, সে এক অপূর্ব সুন্দর মেয়ে। চোখ ফেরানো যায় না। তাও যদি বা আমার চোখ ফেরে, অটোচালকের চোখ তো মোটেই ফেরে না। ডানদিক-বামদিক যখন যে আয়না দিয়ে সম্ভব একজোড়া চোখ দেখে চলে। নিষ্পলক। মধ্যে মধ্যে মনে হচ্ছিল বলি, "ভাইয়া, সামনে দেখকে চালায়েঙ্গে!" কিন্তু বলতে আর পারি কই! অমন ব্যাকুল চাহনিকে কি আর ফিরত যেতে বলা যায়!

'মেল গ্যেজ' শব্দখানা ব্যবহার করতে হলে বড় নির্দয় লাগে নিজেকে। খুব বেশিদিন এ শব্দের অতিপ্রয়োগ চলছে তা নয়। ক'বছর হল। তাবলে পুরুষের চাহনি নিয়ে আমরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করিনি তা তো নয়! খারাপ ভাবে তাকানো, বিশ্রীভাবে তাকানো, লোলুপ চোখ, কামুক চোখ এসব তো বলতামই। 

আবার মুগ্ধ চোখের কদরও যে করিনি তেমনটা নয়! চাঁদ দেখতে গিয়ে তোমায় দেখে ফেলা চোখের জন্য আহ্লাদও নেহাত কম থাকে না। 

তেমনটাই ছিল অটোচালকের চোখে। হিমসিম খাওয়া মুগ্ধতা! নাচার মুগ্ধতা! পনেরো মিনিটের পথে যতক্ষণ পারা যায় ততক্ষণ তাকিয়ে থাকার মতো মুগ্ধতা!

মুগ্ধতাই তো! একই সমাজে বাঁচব। একই পৃথিবীতে বাঁচব। একই সঙ্গে বাঁচব! স্বস্তিতে বাঁচব! আনন্দে বাঁচব! তৃপ্তিতে বাঁচব! মুগ্ধ হব না! সে মুগ্ধতা প্রেমের হোক বা বাৎসল্যের, যৌনতার হোক বা স্নেহের, উচাটনের হোক বা আরামের, শেষতক, মুগ্ধতাই তো! 

তবে কোনোদিন সেই মুগ্ধতা যদি ঘুচবে, তবে এমনভাবে ঘুচবে যে, দেখার মানুষটি বেঁচে থেকেও মৃতের মতো বীভৎস ফ্যাকাসে হয়ে যাবে। ফ্যাটফ্যাটে হয়ে যাবে। সেদিন আর তার সে সৌভাগ্য থাকবে না, যে সৌভাগ্যে চাইলেই পলাশকে আগুন লাল রঙে দেখা যায়, শ্বেতকাঞ্চনের দিকে তাকালে আরাম পাওয়া যায়, স্থলপদ্মের হরেক রঙ খুঁজে পাওয়া যায়। 

সীলড্ বটল্। কীই বিস্ময়! আমার সহনাগরিক, আমাকে এমন একটি জড়বস্তুর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন, যার না আছে বুকের ধুকপুকানি, না আছে স্পর্শের রকমফের, না আছে চাহনির কোনো বার্তা, না আছে দেহের ভাষা, না আছে দাবি, না আছে ইচ্ছা, না আছে কোনো আগ্রহ। যৌন আবেদন! আছে! তাও তো নাই! 

আমার সহনাগরিক আমার মর্যাদা এমন মাটিতে মেশান যে, মাথা কুটে মরলেও তিনি আমার কাছ থেকে কণামাত্র মানবিক ছোঁয়াটুকুও আর পান না। আমাকে তিনি আস্ত একখানা জড়বস্তু বানিয়ে ছেড়ে দেন। 

শিক্ষক আকাশ থেকে পড়েন না। আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ও নির্দিষ্ট কোনো সামাজিক সংস্কৃতি থেকে কোনো সুইচ টিপে ভিন্ন হয়ে যায় না। 

টেলিভিশনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে তাদের অধ্যাপক কনক সরকার প্রসঙ্গে বলতে শুনলাম, "যাদবপুরের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে..."!

মন খারাপ লাগছিল ভেবে যে, বাচ্চা বাচ্চা কিছু ছেলেমেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নিয়ে গর্বের সঙ্গে প্রতিবাদ করতে গিয়ে থমকে যাচ্ছে। মন খারাপ লাগছিল ভেবে যে, তারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়েরও যে একটি গড়পড়তা বাস্তব ছবি রয়েছে, তা হুট্ করে দেখতে পেয়ে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে। 

কিন্তু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বাস্তবতার একটি বাস্তবতা এরকমই। 

সব প্রতিষ্ঠানেরই এমন এক একটি কান্না পেয়ে যাওয়ার মতো বাস্তবতা থাকে। সে বাস্তবতা সবটা নয়। তবে কিছুটা যেহেতু বটেই, তাই বারবার ফিরে যেতে হয় সেই অটোচালকটির কাছে, যাঁর মুগ্ধ চোখের ব্যাকুল চাহনিকে মোটেই ফিরত যেতে বলা যায় না। তিনি অন্তত জানেন, কামনার মানুষটির দিকে জড়ভ্রমে তাকাতে নাই। 

অধ্যাপক কনক সরকারের মতো বুরবকেরা নারীর মর্যাদাহানি করুন, ক্লেদে ডুবে থাকুন...তাই বলে ভাববেন না, নারীকে দেখার মতো মুগ্ধ পুরুষচোখের অভাব ঘটবে, ওটি আপনিই জুটে যাবে। নিত্যদিন!

বৃহস্পতিবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১৯

উচ্চবর্ণের সংরক্ষণ ~ শতাব্দী দাস

১) সংরক্ষণ-বিলে 'উচ্চবর্ণ সংরক্ষণ' কোথাও লেখা নেই।

২) অর্থনৈতিক অনগ্রসরদের সংরক্ষণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

৩) বলা হয়েছে, যারা এমনিতেই তপশিলী জাতি-উপজাতি-ওবিসি হওয়ায় সংরক্ষণ  পাচ্ছেন, তাঁরা এই সংরক্ষণ আর পাবেন না । এই ক্লজকেই 'উচ্চবর্ণের সংরক্ষণ' বলে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। এক মানুষকে দুরকম সংরক্ষণ দেওয়ার থেকে নতুন অভাবী মানুষকে সংরক্ষণের আওতায় আনা খুব মন্দ কিছু কি?  অর্থনৈতিক অনগ্রসরদের সংরক্ষণ খারাপ কিছু নয় মনে হয়৷ মণ্ডল কমিশনেও এমন সুপারিশ ছিল।

৪) কত আয় হলে অর্থনৈতিক অনগ্রসর বলা হবে, তা এখনও স্থির হয়নি৷ বিজেপি প্রচার করছে- বার্ষিক আট লাখ। কিন্তু তা বিলে এখনও নেই৷

^ এই জায়গাটি নিয়ে,  আবার বলছি, ঠিক এই জায়গাটি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলতে পারে৷ সর্বাধিক কত আয় হলে এই বিলের আওতায় আসা যাবে, তা ধার্য করার বিষয় নিয়ে সব পার্টি ভাবুক৷ বিরোধীরা আন্দোলন করুক এই জায়গাটি নিয়ে৷ আমাদের দেশের নিরিখে বার্ষিক আট লক্ষ টাকা আয়ের মানুষকে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া বলা যায় না৷ এই দশ পার্সেন্টের মধ্যে যেন অযাচিত সুবিধালোভীদের ভিড় না বাড়ে, তা লক্ষ্য রাখার জন্য আন্দোলন হোক।

৫) এই মুহূর্তে এটি একটি সম্ভাবনাময় বিল, যাকে ভাল বা খারাপ উভয় কাজেই লাগানো যেতে পারে। কেউ 'উচ্চবর্ণ সংরক্ষণ বিল' পাশ করায়নি। কিন্তু বিজেপি উক্ত বিলটিকে কার্যক্ষেত্রে 'উচ্চবর্ণ সংরক্ষণ বিল' করে তোলার আগে রুখে দিন।

৬) বিজেপি 'উচ্চবর্ণ সংরক্ষণ বিল' হিসেবে এটিকে প্রচার করছে। তারা মূর্খ বলে নয়, তারা উচ্চবর্ণের ভোট হারিয়েছে, সেই ভোট আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে ফিরে পেতে চায় বলে। খুবই ধূর্ততার পরিচয়৷ কিন্তু বিষয় নিয়ে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক ছাড়া এই ধূর্ততা আসেনা। এই হোমওয়ার্ক থাকলে, তথাকথিত বামপন্থীদের বিরোধিতাও সঠিক দিশায় ধাবিত হবে, আশা করা যায়। আপাতত যা চলছে, তা বালখিল্যতা।


রবিবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৯

ডাক্তার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার ~ ডা: রেজাউল করীম

আবার একজন ডাক্তারকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। যে পুলিশ রাজনৈতিক নেতার খুন, রাহাজানি, লুটতরাজ, ধর্ষনের এফ আই এর নেয় না, তদন্ত না করে এফ আই আর নেওয়া যাবে না এই যুক্তিতে, তাদের গ্রেফতার করা তো দূর অস্ত, সেই পুলিশ পলকে ডাক্তারদের হাজতে প্রেরণ দেয় কোন প্রমান ছাড়াই। এই রাজ্যের গনতন্ত্রের এই হাল। যারা শিক্ষিত ও মানী লোক তারারাজনৈতিক চাটুকার না হলে তাদের কপালে হাজতবাসের সম্ভাবনা প্রভূত। 
নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে চাটুকার বাজারী আনন্দ আর অন্যসব কৃপা-ভিক্ষুক মিডিয়া রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের ইমেজ বিল্ডিং শুরু করেছে। এদের দৃষ্টিতে কোন কোন নেতানেত্রী একাধারে কবি, গীতিকার, শিল্পী, দার্শনিক আরো কত কি? কিন্তু যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, যারা নিজের চোখে দেখতে পান না, নিজের কানে শুনতে পান না, তাদের সকল কথাই অনৃতভাষন তাঁরা কি করে মহাপুরুষ পদবাচ্য হয়ে ওঠে স্বয়ং ভগবান ই বলতে পারেন। 
আজকের আনন্দবাজার দেখুন। সরকারের হাতে আছে ১৪২০০০ শয্যা। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা কম করে ১০ কোটি। তাহলে মাথাপিছু কটি শয্যা হয়। আনন্দবাজার অঙ্ক কষে বার করেছে প্রতি ১১৯২ জন প্রতি ১টি শয্যা। কোন স্কুলে এরা লেখাপড়া করেছে ভগবান জানেন। কিন্তু, হাতে যখন কলম আছে তখন যত্রতত্র ছিটিয়ে নিজের বিদ্যাবুদ্ধি জাহির করবে তাতে আর আশ্চর্য কি? বিশেষতঃ বাংলার সবচেয়ে বড় বুদ্ধিজীবী যখন দোসর তখন মিথ্যার ফানুসের যে কোন পরিসীমা থাকবে না, তাতে আর সন্দেহ কি? 
সারা রাজ্যের মানুষের কাছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গুরুতর ত্রুটি তুলে ধরার দায়িত্ব তাই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিতে হবে। এ কোন রাজনৈতিক ভাষ্যের বিষয় নয়, আমাদের ভবিষ্যতের ভালমন্দ এর সাথে জড়িত। এই রাজ্যে সবচেয়ে বেশি নাবালিকা বিবাহ হয়। জনস্বাস্থ্যের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এই রাজ্য পিছিয়ে আছে। বেসরকারি ক্ষেত্রকে অন্যায় ব্যবসা করার অধিকার দেওয়া হয়েছে, জনগনের সম্পত্তি সরকারী হাসপাতাল বিনা পয়সায় বেসরকারি পুঁজিপতিকে উপহার দেওয়া হয়েছে, এর কোনটিই গ্রহণযোগ্য নয়।

চিকিৎসকদের মানসম্মান এই সরকারের আমলে ধুলোয় লুটিয়ে গেছে। মারধর, গ্রেফতার, হুমকি আর তোলাবাজি কোন কিছুই বাকি নেই। সরকার যে প্রতিশ্রুতি গতবছর দিয়েছিলেন তার কোনটি ই পালন করেন নি। এই অবস্থায় চিকিৎসকদের দাবী আদায়ের জন্য করণীয় কাজ করতে হবে। 
সব চিকিৎসক বন্ধু ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বুঝতে হবে যে আমাদের পেশাগত স্বাধীনতা ও নির্ভয়ে কাজ করার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার এই আন্দোলন সফল না হলে ভবিষ্যত প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।

শনিবার, ৫ জানুয়ারী, ২০১৯

বামপন্থীদের কথা বিশ্বাস করবেন না ~ সুশোভন পাত্র

বামপন্থীদের কথা বিশ্বাস করবেন না। বিশ্বাস করতে হলে আনন্দবাজার কে করবেন, চোস্ত ইংলিশে স্টুডিও কাঁপানো অর্ণব গোস্বামীদের করবেন, বিকাশের চৌকিদার কে করবেন, সততার পিসি কে করবেন, গেরুয়া কামিজে নিমেষে ঠ্যাং মাথায় তুলে দেওয়া 'বাবা' কে করবেন, তিন হাত লম্বা দাড়িওয়ালা ভাষণবাজ 'মৌলবি' কে করবেন। কিন্তু এক গলা গঙ্গা জলে ডুবে বললেও খবরদার, বামপন্থীদের কথা একদম বিশ্বাস করবেন না।

২৮ বছর আগে,আর্থিক সংস্কারে বায়নায় দেশের 'হটডগ' বাজার পৃথিবীর জন্য মুক্ত করে দিয়ে, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং পার্লামেন্টে বলেছিলেন "এই সংস্কার আর্থিক সমতা ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত করবে। পাঁচ বছর পর দেশে আর কেউ গরীব থাকবে না।" মুক্তবাজার অর্থনীতির ইনফ্যাচুয়েশেনের লুস-মোশেনে ভেসে গিয়েছিল মগধ থেকে পাটলিপুত্র, ছাতনা থেকে ছিন্নমস্তা। রাম-শ্যাম-যদু-মধু সমস্ত রাজনৈতিক দল কোরাস গেয়ে বলেছিল, "বাহ! ওস্তাদ বাহ!।" একমাত্র ঐ হাতে গোনা বামপন্থীরাই সেদিন বিরোধিতা করে বলেছিল, এই নীতি অচিরেই দেশজুড়ে আর্থিক বৈষম্য আরও প্রশস্ত করবে। ধনীরা আরও ধনী হবে। গরীবরা আরও গরীব। 

২৮ বছর পর, অক্সফামের রিপোর্ট বলছে, একদিকে দেশের ১% মানুষের হাতে দেশের মোট সম্পদের ৭৩% কুক্ষিগত। আর অন্যদিকে বিশ্বের ১/৪ ক্ষুধার্তের ঠিকানা আজ ভারতবর্ষ। একদিকে শেষ যে ২৮ বছরে ভারতবর্ষে বিলিয়নারির সংখ্যা ১ থেকে ১৩২ হয়েছে, সেই ২৮ বছরেই ১০০টাকা উৎপাদন মূল্যে শ্রমিক'দের প্রাপ্য মজুরি কমে ৯.৯ টাকায় ঠেকেছে। কি ভুলই না বলেছিলে সেদিন বামপন্থীরা! তথ্যই বলে দিচ্ছে, বামপন্থীদের মুখে ছাই দিয়ে, গত ২৮ বছরে দেশে কেমন 'আর্থিক সমতা ও সামাজিক ন্যায়' প্রতিষ্ঠা হয়েছে। গরীব খুঁজতে তো আজকাল গ্যালিলিওর দূরবীনও ভাড়া করে মিউজিয়ামে যেতে হচ্ছে। ঐ যে বললাম বামপন্থীদের কথা একদম বিশ্বাস করবেন না। 

রঙ্গরাজন এবং কিরীট পারিখ কমিটির সুপারিশে, সরকার তখন পেট্রোল-ডিজেলের দাম বিনিয়ন্ত্রণ করছে। কেতাদুরস্ত অর্থনীতিবিদরা বললেন, ভর্তুকির গলদঘর্ম ত্যাগ করলে, ৮০% তেল আমদানি করা ভারতে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্য কমলেই তার সরাসরি সুবিধা পাবেন আম জনতা। কংগ্রেস বলল 'বহুত আচ্ছা'। বিজেপি বলল 'মাশা আল্লাহ'। আর আম্বানিরা-আদানিরা বলল, 'জিও পাগলা'। একমাত্র ঐ হাতে গোনা বামপন্থীরাই সেদিন বিরোধিতা করে বলেছিল, বিনিয়ন্ত্রণ আসলে খুড়োর কল। অপরিশোধিত তেলের মূল্য বাড়লে তার দায় সাধারণ মানুষের ঘাড়েই চাপানো হবে। আর কমলে, তেল উত্তোলনকারী মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী মুনাফা ভোগ করবে। 

২০০৪-এ পেট্রোল-ডিজেলের দাম ছিল ৩৬.৪৯টাকা, ২৪.৩৫ টাকা। আর এখন? তাহলেই ভাবুন, কি ভুলই না বলেছিলে সেদিন বামপন্থীরা! বিনিয়ন্ত্রণের পর অপরিশোধিত তেলের মূল্য কমলে, সরাসরি সুবিধা আপনি পাচ্ছেন তো? গত চার বছরে ডিজেলে এবং পেট্রোলের বর্ধিত 'এক্সাইস ডিউটি' আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়ে আপনার বারান্দায় টপকে পড়েছে তো? বেশ সস্তায় আপনার রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার ঘরে ডেলিভারি হচ্ছে না? আর মুনাফার অভাবে, অনটনে নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারে মাত্র ১০০ মিলিয়ন ডলার খরচা করে কোন ক্রমে মেয়ের বিয়ে দিতে আম্বানিরা বাধ্য হচ্ছে না? ঐ যে বললাম বামপন্থীদের কথা একদম বিশ্বাস করবেন না। 

জঙ্গলমহল তখন ভিজে যাচ্ছে রক্তে। সালকু'র লাশটা যখন পাওয়া গেলো শরীরের চামড়া তখন পচে গলে যাচ্ছে। পোকাতে কুরে খাচ্ছে সারা দেহ, চারিদিকে দুর্গন্ধ। অথচ মাওবাদী'দের ফতোয়ায়, বৃদ্ধা বিধবা মা'র শত অনুরোধেও, মৃতদেহ সৎকারে সাহস করছে না ধরমপুর গ্রামের কেউ! শীতের রাতে, দুবরাজপুর গ্রামে, বাদল আহির কে মাওবাদীরা খুন করল গোটা শরীরে গুণে গুণে পেরেক পুঁতে। 

বুদ্ধিজীবীরা অবশ্য তখন সানগ্লাস। বুদ্ধিজীবীরা তখন লালগড়। বিসেলারির বোতলে তখন 'রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের' তুফানি চুমুক। এ যুগের পাবলো পিকাসোর ছবি তখন বিক্রি হচ্ছে ১.৮৬ কোটি টাকায়। হবু মুখ্যমন্ত্রীর 'সঙ্গে সুমন' হেলিকপ্টারে চেপে তখন কুচবিহার থেকে কাকদ্বীপ। বামপন্থীরা বলেছিল, দিনে যারা তৃণমূল, তাঁরাই রাতে মাওবাদী। বামপন্থীরা বলেছিল, এতো টাকার উৎস কি? ডেলোর বাংলো তে গভীর রাতের কেলোর মিটিং'র রহস্য কি?  চ্যানেলে টেনের সীমাহীন স্তাবকতার রেসিপি কি?  সো হোয়াট, জঙ্গলমহলের বেতাজ বাদশা অবশ্য তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যেই 'প্রকৃত কমিউনিস্ট' দেখতে পেলেন।

তারপর একদিন সেই 'প্রকৃত কমিউনিস্ট'ই মুখ্যমন্ত্রী হলেন। দফায় দফায় সেজেগুজে, পাউডার মেখে বিপ্লবী 'মাওবাদীরা' মহাকরণের অলিন্দে পৌঁছে গেলেন। কেউ আত্মসমর্পণের প্যাকেজ পেলেন। কেউ সরকারী চাকরী পেলেন। সুচিত্রা মাহাতো তৃণমূল নেতা প্রবীর গড়াই কে বিয়ে করলেন। পয়সা হল, গাড়ি হল, বাড়ি হল। পরের বৈশাখে, সুদীপ্ত সেনও গ্রেপ্তার হল। তৃণমূলের মন্ত্রী-সাংসদরা আর্থিক তছরুপের দায়ে জেলের ঘানি টানল। মুকুল রায়ও বিজেপি যোগ দিয়ে ধোয়া তুলসী পাতা হয়ে গেলো। সবই হল, শুধু 'প্রকৃত কমিউনিস্ট'র রাজত্বেই কিষানজি কে এনকাউন্টারে মরতে হল। আর আমানতদারীদের টাকাটা আজও বিশ বাঁও জলেই ডুবে রইলো।   

কি ভুলই না বলে বামপন্থীরা! তাই না? তাই অতীত থেকে শিক্ষা নিন। রাজনৈতিক সমীকরণের সংকীর্ণ স্বার্থেই সারদা-নারদা তদন্তে সিবিআই তৎপর হচ্ছে না কিম্বা সিবিআই'র জুজুতেই মুখ্যমন্ত্রী আজ রাফালে নিয়ে সাত চড়েও রা কাটছে না; রামনবমী আর হনুমান জয়ন্তীর নামে রাজ্যে ধর্মীয় মেরুকরণের তাস সাজাচ্ছে বিজেপি, কিম্বা ফেডারেল ফ্রন্টের নামে বিজেপি বিরোধী ঐক্য কে ভাঙতে চাইছে তৃণমূল, মানুষের জীবন জীবিকার সমস্যা থেকেই দৃষ্টি ঘোরাতে রামমন্দিরের হিড়িক তুলছে বিজেপি, কিম্বা  বিজেপি সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে মানুষের ধর্মঘট কে রুখতেই 'কর্মসংস্কৃতির' ন্যাকামি করছে তৃণমূল -এক গলা গঙ্গা জলে ডুবে বললেও খবরদার, বামপন্থীদের এসব কথা বিশ্বাস করবেন না একদম। 

আর গঙ্গা জলে ডুবে বললেই বিশ্বাস করবেনই বা কেন বলুন তো? গঙ্গার জল কি আদেও পবিত্র নাকি? 'নমামি গঙ্গার' ঢপ বাজিতে গঙ্গার জল আদেও পরিষ্কার নাকি? দূষণ মুক্ত হয়েছে নাকি? আবার শুনছি, ঐ গঙ্গার জলে তর্পণ করেই, চৌকিদাররা রাফালে চুক্তি তে চুরি করেছে নাকি?