শনিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১৭

যাদবপুরে তো আমরা ~ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য

দূরে দূরে শুধু ঘাস তৃণমূল মাঝে মাঝে কিছু পদ্ম
নেতা মন্ত্রীরা প্রাতরাশ করে বিশ্রাম নেন সদ্য;
যত বেয়াদব চুপ হয়ে গেছে,হেসে হেসে কন পার্থ
মাকুদের যত কায়দাকানুন নিমেষে করেছি ব্যর্থ;
আলিমুদ্দিনে ইয়েচুরি সাথে সূর্য বিমান বুদ্ধ
বলেন কিহবে ভারি ডামাডোল সব পথ অবরুদ্ধ ;
একরোখা কিছু একুশ বাইশ ক্ষমতা যৎসামান্য
যাদবপুরের পড়ুয়া তো তারা, চিন্তা ভাবনা অন্য;
তাদের পাশেই আর্টস ফ্যাকাল্টি, অনেক ছাত্রছাত্রী
মিটিং মিছিল পোস্টারে সব মুখরিত দিনরাত্রি ;
মন্ত্রী বলেন এস এফ আই যদি জিতে যায় কোন চান্সে
আমিও দেখিস পি এইচ ডি পাব,জার্মানি নয় ফ্রান্সে;
এরা গাঁজাখোর, গোলমাল করে তবু মনে জাগে ধন্ধ
রূপাদি বলেন ওদের গায়ে তো সাম্যবাদের গন্ধ;
নতমুখে ফেরে কেন্দ্র রাজ্য নেতারা হোমরা চোমরা
ক্ষমতায় তুমি যতদিন আছ, যাদবপুরে তো আমরা।।

যাদবপুর আর্টস ফ্যাকাল্টি নির্বাচনে জয়ী ছাত্রছাত্রীদের অভিনন্দন।।

বৈষম্য ~ সুশোভন পাত্র

​গত বছর, পিকনিকে গিয়েছিলাম দশজনে। সকালে বেগুনী মুড়ি। দুপুরে সরু চালের ভাত, মুগের ডাল, খাসি মাংস আর রসগোল্লা। সব মিলিয়ে, মাথাপিছু ৩০০ টাকা। নিজেরাই রাঁধলাম। নিজেরাই খেলাম। ফিরতি পথে 'বাজারে' সব দোকানের ধার মেটালাম। ছিল ৩,০০০। খরচা হল ৩,০০০। নো লস। নো গেন।
এবারও গিয়েছিলাম। একই জায়গা, একই মেনু, একই দশই। এবার 'বাজার' থেকে চাল-ডালের সাথে 'পণ্য' হিসেবে ১২০০ টাকায় কানাই রাঁধুনির 'শ্রমটাও কিনলাম'। শেষ বেলাতে জুটল আরও দুই হাফপ্যান্টের বন্ধু। মাথাপিছু ৪২০ করে ৫,০৪০ টাকা 'পুঁজি' হিসেবে আগেই জমা রাখলাম। আমি তখন 'পুঁজিপতি'। আমার তখন পকেট গরম। কানাই কে বললাম "১,২০০'তেই দশ নয় বারো জনের রান্না করতে হবে। না পারলে বল, গোপাল রাজি আছে।" নোয়াপাড়ার গোপাল আজকাল 'বেকার রাঁধুনি'। 'নাই মামা'র থেকে কানা মামা ভালো' ফর্মুলায় কানাই রাজি হল। এবার আমরা আড্ডা মারলাম, তাস খেললাম, আর কানাই কে দিয়ে রান্না 'করালাম'। প্রথম দশজনের রান্না কানাই'র 'আবশ্যিক শ্রম'। আর বাকি দুজনের রান্না কানাই'র 'উদ্বৃত্ত শ্রম'। জমিয়ে খেয়ে, কানাই কে ১,২০০ দিয়ে, 'বাজারে'র ৩,৬০০ মিটিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম; পকেটে তখনও ২৪০ টাকা পড়ে। এই ২৪০, 'উদ্বৃত্ত মূল্য'। এই ২৪০ আমার 'প্রফিট'। এই ২৪০ দিয়ে আমি গোল্ডফেল্ক কিংস'র আস্ত একটা প্যাকেট কিনলাম। আর রাতে কানাই'র 'প্রাপ্য মূল্যে' আমার 'ব্যক্তিগত সম্পত্তি' ঐ গোল্ডফেল্ক কিংস' ফুঁকে ওড়ালাম।
শ'খানেক বছর আগে ছুঁচলো দাড়ির টেকো লোকটা মস্কো তে বসে যখন লিখছিলেন "বিকাশের যে স্তরে শ্রমশক্তি নিজেই পণ্য তাকে বলে পুঁজিবাদ"¹ ; তখনও কানাই রান্নাই শেখেনি। তারও পঞ্চাশ বছর আগে গাল ভর্তি দাড়ি আর মাথা ভর্তি চুল নিয়ে আরেক ভদ্রলোক যখন ব্রাসেলস বসে লিখছিলেন "শ্রমই সকল সম্পত্তির উৎস। এই শ্রমের শোষণেই পুঁজিবাদে সম্পত্তির বিপুল কেন্দ্রীভবন এবং বৈষম্য অবশ্যম্ভাবী" ² ; তখনও গোল্ডফেল্ক কিংস বাজারেই আসেনি। তখনও গ্রেট ব্রিটেনের ১৭-ব্রডস্ট্রিটে অক্সফামের অফিস গজায়নি ³ । সেই অক্সফাম যারা প্রতিবছর নিয়ম করে 'পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্য' নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক করে। 'গরীব হটাও' যজ্ঞের রিপোর্ট লেখে। রাষ্ট্রপ্রধান'দের অসম্ভব বৈষম্যের ভয়ঙ্কর পরিণতি সম্পর্কে সাবধান করে। ২০১৬'তে অক্সফাম লিখেছিল "বিশ্বের প্রথম ৬২ জন ধনী ব্যক্তির মোট সম্পদ বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যার সম্মিলিত সম্পদের সমান" ⁴ । আর ২০১৭'তে 'ইকনমি ফর ১%' রিপোর্টে বলেছে "বিশ্বের প্রথম ৮ জন ধনী ব্যক্তির মোট সম্পদ বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যার সম্মিলিত সম্পদের সমান " ⁵।
এদেশে সংখ্যাটা ৫৭। মাত্র ঐ ৫৭ জন ধনকুবেরর মোট সম্পদ এদেশের গরীবতম ৭০% মানুষের সম্মিলিত সম্পদের সমান। আর মাত্র ১% ধনী অংশের পকেটে এদেশের ৫৮% সম্পদ। ৯১'র আর্থিক সংস্কারে যেদিন দেশের 'হটডগ' বাজার পৃথিবীর জন্য মুক্ত হল, করতালি তে মুখরিত হয়েছিলো লন্ডন থেকে লোনাভেলা, কেন্ট থেকে ক্যাওড়াতলা। আর আজ দেশ জোড়া উন্নয়নের চোটে গত ২৫ বছরের প্রতি বছরে, দেশের গরীবতম ১০%'র আয় যেখানে বেড়েছে গড়ে ২,০০০, সেখানে দেশের ধনীতম ১০%'র আয় বেড়েছে গড়ে ৪০,০০০ ⁶। গত ১৫ বছরে দেশে যে ১৪৪ ট্রিলিয়ন নতুন সম্পত্তি তৈরি হয়েছে তার ১১১.৩ ট্রিলিয়নই ঐ প্রথম ১০%'র উদরস্থ হয়েছে। আর বাকি ৩২.৭ ট্রিলিয়ন জুটেছে বাকি ৯০%'র কপালে। "ট্রিকল ডাউন পলিসি"র দয়ায় ৯১'এ বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশ ক্ষুধার্তের ঠিকানা ছিল যেখানে ভারত, এখন তা বেড়ে এক-চতুর্থাংশ। ৯১'এ বিশ্বের মোট নিরক্ষরতার ৩২.৬% ঠিকানা যেখানে ছিল ভারত, ২০১৪ তে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫.৬৫% ⁷ ⁸।
অক্সফাম বলেছে, ভারতের ব্যাপক আর্থিক বৈষম্যের মূলে সর্বস্তরের শ্রমিকের প্রাপ্য মজুরির বঞ্চনা। অক্সফাম জানে না, সারাবিশ্বে দৈনিক দুই ডলারের কম রোজগার করা শ্রমিকের সংখ্যা যেখানে গড়ে ২৮%, আমাদের দেশে ৫৯% ⁹। অক্সফাম বলেছে, সমাধানের পথ শিক্ষা ,স্বাস্থ্যে সরকারী বিনিয়োগ বৃদ্ধি। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি। অক্সফাম জানে না, গত বছর বাজেটে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাখাতে ১৩,৬৯৭ কোটি এবং উচ্চশিক্ষা খাতে ৩,৯০০ কোটি সরকারী বরাদ্দ হ্রাস করা হয়েছে ¹⁰। ১৫%'র ছাড়া বাকিদের জন্য ফেলোশিপ 'ডিসকন্টিনিউ'র সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ¹¹। অক্সফাম জানে না, ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের রিপোর্টে এদেশের ৭৮% স্বাস্থ্য ব্যবস্থারই আজ বেসরকারিকরণ হয়েছে ⁸। অক্সফাম জানে না, লেবার ব্যুরোর রিপোর্টে গত বছর এদেশে রেকর্ড হারে বেকারত্ব বেড়েছে ¹² । অক্সফাম বলেছে, রাজনৈতিক প্রভাব ও কর ফাঁকির সিঁড়ি বেয়েই এদেশের ধনকুবের'দের রমরমা। অক্সফাম জানে না ; এদেশ ললিত মোদীর। এদেশ বিজয় মালিয়ার। এদেশের সরকার মুকেশ আম্বানির। এদেশের আইন গৌতম আদানির। এদেশের হাইকোর্ট সলমন খানের। এদেশের 'কর্পোরেট পলিসি' হাজার-কোটির ট্যাক্স ছাড়ের।
স্তালিনের নাম শুনলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে আপনি উঠতেই পারেন, সোভিয়েতের প্রশংসায় 'অ্যানিম্যাল ফার্মের' অর্গাজমে স্বর্গসুখ আপনি পেতেই পারেন, বলিভিয়ার নিবিড় অরণ্যে ঐ দাড়িওয়ালা গ্ল্যামারাস ডাক্তার ছেলেটার মৃত্যুর প্রতি নিরাসক্ত আপনি থাকতেই পারেন, তীব্র শৈত্য প্রবাহে রেড আর্মির লং-মার্চ কিংবা পাভেল করচাগিনের ইস্পাত কঠিন লড়াই কে ব্যঙ্গ আপনি করতেই পারেন, এমনকি ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিনের দাড়ির থেকে রামদেবের দাড়িই আপনার বেশি পছন্দ হতেই পারে; কিন্তু গীতার 'শ্লোক' থেকে কোরানের 'সূরা' হয়ে বাইবেলের টেস্টামেন্ট -কোথাও এই ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের অর্থনীতির বিশল্যকরণী আপনি খুঁজে পাবেন না। পুঁজিবাদী বাজারে হিন্দু-মুসলমানের ক্যালোরির আলাদা হিসাব কষতে আপনি পারবেন না। মুক্তবাজারের মুনাফা তে ব্রাহ্মণ-দলিত'র 'উদ্বৃত্ত শ্রমের' পার্থক্য আপনি করতে পারবেন না। ধর্মের বুলি কপচে দু'বেলা দু'মুঠো ভাতও আপনি জুটিয়ে দিতে পারবেন না। কারণ বাস্তব এটাই যে আপনার-আমার শ্রম যে আজ 'বাজারের পণ্য'। বাস্তব এটাই যে শ্রমের শোষণেই পৃথিবী জোড়া সম্পদের এই যে প্রবল বৈষম্য। আর বাস্তব এটাই যে ধর্মশাস্ত্র বা অ্যাডাম স্মিথের 'দি ওয়েলথ অফ দি নেশন'র পুঁজিবাদী মুক্ত বাজারে নয়; দাড়ি বুড়োর 'দাস ক্যাপিটাল'ই বন্দী আছে অর্থনীতির সাম্য।

1. https://www.marxists.org/archive/lenin/works/1916/imp-hsc/

2. https://www.marxists.org/archive/marx/works/subject/quotes/


3. https://en.wikipedia.org/wiki/Oxfam

4. https://www.oxfam.org/.../bp210-economy-one-percent-tax...

5. https://www.oxfam.org/.../bp-economy-for-99-percent...

6. https://scroll.in/.../embargoed-jan-16-00-01gmt-57...

7. https://www.youtube.com/watch?v=Wtzs4lygpA0

8. http://timesofindia.indiatimes.com/.../artic.../54822103.cms

9. http://www.reuters.com/article/idUSDEL218894

10. https://cpim.org/.../do-saal-janta-behaal-modi-government...

11. https://www.youtube.com/watch?v=lpUrKAomkqU

12. http://indianexpress.com/.../unemployment-india-paints.../

শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৭

আগুন জ্বলবে ~ সঞ্জয় ঘোষ

অশীতিপর শীত বুঝি আজ
গা ঝাড়া দিয়ে উঠছে
ছোট পাপ আর বড় পাপগুলো
সহজ আড়াল খুঁজছে।

আড়ালে আড়ালে কানাকানি শুধু
পাপ মিশে যায় পুণ্যে
কিছু তার নাকি মনগড়া আর
বাকিটা খু্ঁজতে হন্যে।

ধৈর্য ঠেকেছে তলানিতে আজ
পাপের পাহাড় জমছে
কিছু ছোট কিছু হিমালয়সম
সবাই আড়াল খুঁজছে।

ঠগকে খুঁজতে গাঁ উজার হয়
কাকে ছেড়ে কাকে ধরবে?
এই পতন তো আমাদেরও দায়
তবে কী আগুন জ্বলবে?

দেশলাইটা খোয়া গেছে তাই
চকমকিটাকে খুঁজছি
কোন পাপ ঠিক কতটা দাহ্য?
নিজের সাথেই যুঝছি।

দেশপ্রেম ~ সুশোভন পাত্র

দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা, অভাব-অভিযোগ নির্বাচনী ভাষণে ভালো করে মিশিয়ে নিন। মিশ্রণে প্রতিশ্রুতি'র পাহাড় গুলে, 'আচ্ছে দিনের' বিজ্ঞাপনে ১০ মিনিট ম্যারিনেট করে রাখুন। এই ফাঁকে জনগণের ক্ষোভের আগুনে পিৎজা স্টোন সহ ওভেন ৪৫০ ডিগ্রিতে প্রি-হিট করুন। মিশ্রণ ফুলে ফেঁপে উঠলে; জে.এন.ইউ'র ভিডিও দিয়ে পুরু করে বেলে ফ্ল্যাটব্রেড বানিয়ে ফেলুন। ফ্ল্যাটব্রেডের উপর ৫৬ ইঞ্চি পুরু সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রলেপ লাগিয়ে, পাকিস্তানের সঙ্গে তু-তু-ম্যা-মা'র বার্বিকিউ আর মিডিয়ার টক শো'র হম্বিতম্বি কুচিকুচি করে সাজিয়ে, কাশ্মীরের পেলেট গান আর মোজোরেলা চিজ ছড়িয়ে, জাতীয় পতাকা'র টপিংস দিন। শেষে জাতীয় সঙ্গীত চালিয়ে, ওভেনের পাশে ঠাই দাঁড়িয়ে, ২০ মিনিট বেক করুন। সবদিকে সমান বেক হলে 'চিজ বেসড দেশপ্রেম পিৎজা'য় পরিবারের সব্বাই ভক্তিভরে পেটপূজা করুন। এবার ডিনার শেষে, বিছানায় রতি ক্রিয়া সেরে, নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যান। কারণ সীমান্তে জওয়ানরা আপনার নিরাপদ ঘুম নিশ্চিত করতেই তো দাঁড়িয়ে আছেন। এখন দুঃস্বপ্নে যদি দেখেন আপনার পিৎজা-পাৎসা'র জীবনে, আমার যুদ্ধ-যুদ্ধ ফ্যান্টাসিজমে আর আমাদের বর্ডার সিনেমা দেখে বগল বাজানোর অভ্যাসের আড়ালে জওয়ানরা আধপেটা খেয়েই দাঁড়িয়ে আছেন; খবরদার 'দেশদ্রোহীর' মত দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সরকারের দিকে আঙুল তুলে বসবেন না যেন। বরং হালকা পাশ ফিরে, নরম বালিশে মাথা রেখে, আবার ঘুমনোর চেষ্টা করুন। কারণ 'দেশপ্রেম' এই সরকারের পৈতৃক সম্পত্তি। জওয়ান'দের ভাবাবেগ লেপা জাতীয়তাবাদের ব্যবসা করা এই সরকারের পুরনো অভ্যাস।
তেজ বাহাদুর জওয়ান'দের ক্ষুধার্ত এবং আধপেটা রাত্রি কাটানোর অভিযোগ এনেছেন ¹। 'হুইসেলব্লোয়ার' কে শায়েস্তা করতে, তাঁর 'বেয়াড়া অতীতের' পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে বি.এস.এফ প্রধান, তেজ বাহাদুর কে তৎক্ষণাৎ বদলি করে দিয়েছেন ² । স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক নিয়মমাফিক তদন্তের ঘোষণা করেছে ³ । আর প্রধানমন্ত্রী'র দপ্তর ডাস্টবিনের শোভা বর্ধনের জন্য সেই তদন্তের রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে ⁴ । ঠিক যেমন ২০১৬'র জুলাইয়ে ডাস্টবিনের শোভা বর্ধন করেছিল ক্যাগের সেই রিপোর্ট, যে রিপোর্টে বলা হয়েছিল ইন্ডিয়ান আর্মি জওয়ানদের খাবারে পর্যাপ্ত সবজি ও ফল সরবরাহ করছে না, বলা হয়েছিল ৬৮% জওয়ানই খাবারে গুনগত মান সম্পর্কে 'অসন্তুষ্ট', বলা হয়েছিল বাৎসরিক ১,৪৪০ কোটির আর্মি রেশনের গুণমানে 'অত্যন্ত নিম্ন' এবং আনা হয়েছিল ২২ কোটির আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ  ⁵ ⁶ । অবশ্য আর্মি তে দুর্নীতির অভিযোগ এসেছিল ২০০৪'ও যখন লেফটেনেন্ট জেনারেল সাহনির'র বিরুদ্ধে সিয়াচেনের জওয়ান'দের মেয়াদ বহির্ভূত রেশন সরবরাহ'র তথ্যপ্রমাণ সামনে আসে ⁷, কিম্বা ২০০৭'ও যখন লেফটেনেন্ট জেনারেল দাহিয়া'র বিরুদ্ধে লাদাখের জওয়ান'দের ফ্রোজেন মিটের টেন্ডারে আর্থিক তছরুপরে অভিযোগ ওঠে ⁸ । আর এখনও কান পাতলেই শোনা যায় যে দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসার'রা আর্মি রেশন' সস্তায় পার্শ্ববর্তী দোকানদার'দের বিক্রি করেন ⁹ । 
ডিমনিটাইজেশেন দুর্নীতি মুক্ত হয়নি আর্মি। হওয়ার কথাও ছিল না। কারণ শুধু লিকুইড ক্যাশে এদেশের দুর্নীতির হিসেবে হয় না। শুধু ৫০০/১০০০'র নোটই এদেশে দুর্নীতি করতে শেখায় না। দুর্নীতি করতে শেখায় এদেশের রাজনীতি। দুর্নীতি করতে শেখায় এদেশের অর্থনীতি। দুর্নীতি করতে শেখায় এদেশের গোটা সমাজ ব্যবস্থা। আপনার অন্ধ দেশপ্রেমের বশংবদতায় এই দুর্নীতি বন্ধ হবে না। আপনার প্রশ্নহীন আনুগত্যে এই দুর্নীতি'র সমাধান হবে না। তাই যেদিন সীমান্তের জওয়ান'দের জরুরী ক্যালোরি'র জরুরী প্রশ্নের সমাধানের সঙ্গে আপোষ করে, এদেশের বিদেশ মন্ত্রী টুইটে ই-কমার্স সংস্থা আমাজন কে, পাপোষে জাতীয় পতাকা অবমাননার অপরাধে ভিসা বাতিলের হুমকি দিয়ে 'দেশপ্রেম' জাহির করেন, সেদিন তাঁকে প্রশ্ন করা জরুরী যে, কোথায় ছিল আপনার দেশপ্রেম যখন আপনার স্বামী স্বরাজ কৌশল ললিত মোদীর ওকালতি করতেন ¹⁰, কোথায় ছিল আপনার দেশপ্রেম যখন লন্ডনের পাঁচতারা হোটেলে আপনি ললিত মোদীর সাথে ডিনার সারতেন ¹¹, কোথায় ছিল আপনার দেশপ্রেম যখন 'সনাতনী শিক্ষা' ছেড়ে আপনার মেয়ে কে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি করতেন ¹² ? জাতীয় পতাকার অবমাননা সেদিনও হয়েছিল যখন সাংবিধানিক সভা তিরঙ্গা কে পতাকার রং হিসেবে বেছে নেওয়ার বিরোধিতা করে আর.এস.এসের মুখপাত্র 'অরগানাইসার', ১৯৪৭'র ৩১'শে জুলাই এবং ১৪'ই অগাস্ট 'হিন্দুস্তান' ও 'হুইদার' নামে দু-দুটো তাবড় সম্পাদকীয় ছেপেছিল ¹³ । জাতীয় পতাকার অবমাননা তখনও হয়েছিল যখন প্রথম এন.ডি.এ ক্ষমতায় আসার আগে কোনদিন সংঘের হেড কোয়ার্টারে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়নি ¹⁴ । জাতীয় পতাকার অবমাননা সেদিন হয়েছিল যখন দ্বিতীয় সংঘচালক এম.এস গোলওয়ালকার নাগপুরে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন " তিরঙ্গা নয়, আমরা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি একদিন গোটা দেশ গেরুয়া পতাকার কাছেই ঠিক নতজানু হবে" ¹⁵। জাতীয় পতাকার অবমাননা সেদিন হয়েছিল যেদিন মহম্মদ আখলাখের খুনি কে  তিরঙ্গায় ঢাকা হয়েছিল ¹⁶। জাতীয় পতাকার অবমাননা সেদিনও হয়েছিল যেদিন তিরঙ্গা মোড়া জওয়ান'দের কফিন নিয়ে কেলেঙ্কারি হয়েছিলো।  আর জাতীয় পতাকার অবমাননা প্রতিদিনই হয়, যখন ট্রাফিকে বিলাসবহুল গাড়ির জানলায় দু-টাকার বিনিময়ে জাতীয় পতাকায় মোড়া খেতে না পাওয়া শৈশব বিক্রি হয়।
তাই দেশপ্রেম যদি দেখাতেই হয় তাহলে প্রশ্ন করুন, ২৮.৭ কোটি নিরক্ষর দেশবাসী সাক্ষর হবে কবে?  প্রশ্ন করুন ৬২.৬ কোটির ঘরে শৌচাগার তৈরি হবে কবে ¹⁷? প্রশ্ন করুন সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিকের পেটের খিদের সুরাহা হবে কবে? প্রশ্ন করুন হনুমানথাপ্পার মত ঋণের দায়ে আত্মঘাতী কৃষকরাও ক্ষতিপূরণ পাবে কবে? জওয়ানদের পাশে যদি দাঁড়াতেই হয় তাহলে জিজ্ঞেস করুন, কাশ্মীরের দাবার বোর্ডে জওয়ানদের বোড়ে বানিয়ে সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি বন্ধ হবে কবে? জিজ্ঞেস করুন সার্জিক্যাল স্ট্রাইক কে নিজেদের সাফল্য বলে প্রচার করা সরকার জওয়ান'দের জরুরী পুষ্টি নিশ্চিত করবে কবে? জিজ্ঞেস করুন, উগ্র জাতীয়তাবাদ জিগিরে ক্ষুধার্ত দেশবাসীর রাজনৈতিক ফায়দা তোলা বন্ধ হবে কবে? সরকার বিরুদ্ধে কথা বললেই 'দেশদ্রোহী' দাগিয়ে দেওয়ার অভ্যাসে লাগাম পড়বে কবে? জওয়ান'দের পাশে যদি দাঁড়াতেই হয় তাহলে আগে আয়নার সামনে দাঁড়ান। জওয়ান'দের পাশে যদি দাঁড়াতেই হয় তাহলে আগে যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। কারণ রক্তে লেখা ইতিহাস সাক্ষী, যুদ্ধ যারা চায়, তাঁরা যুদ্ধে যায় না। আর যারা যুদ্ধে যায়, তারা যুদ্ধ চায় না।।



















শুক্রবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১৭

বিশ্বাস ~ সঞ্জয় ঘোষ

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু
তর্কে বহুদূর
গান বেজেছে কোরাসে, তাতে
মেলাতে হবে সুর।

মেলাতে হবে সুর আর
মানতে হবে কথা
দেশটা তো আর তোমার নয়
তাদের মাথাব্যথা।

তাদেরই মাথাব্যথা তাই
সারাটা দেশ জুড়ে
রাজা উজির বাদ্যি বাজান
তোমরা সবাই বোড়ে।

রাজা যেন অনন্ত লোভ
ভুবনগ্রাসী খিদে!
না-বলা না-পারা যন্ত্রণাটা
বোড়ের বুকে বিঁধে।

তবুও সবাই বোড়ে যে নয়
সেটাই আসল জোর
বিশ্বাসে মেলেনা বস্তু
তর্কে কাটে ঘোর।

*ঋণস্বীকার - আসাদ ইকবাল সুমন এর দুটি লাইন

শুক্রবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৭

লজ্জা ~ স্বর্ণালী ইসাক

আমার প্রোফাইলের সকল মহিলাদের উদ্দেশ্যে আমার এই পোষ্ট, আমি আপনাদের কিছু বলতে চাই,,,,,
 কিছু অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয়,,, কিছু স্বীকারোক্তিও বলতে পারেন। করতে হবে,তাছাড়া তো আর উপায় দেখছি না। ব্যাঙ্গালোরের "Mass molestation" এর ভিডিওগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর থেকে এটাই মনে হচ্ছে বারবার। 
তাহলে শুনুন, তখন আমি 15, বাবা সদ্য কিছুমাস হয়েছে মারা গেছেন।মা ট্রমাটাইজ্ড। কথা বলা বন্ধ,নড়াচড়া করেন না,ঘরে বসে থাকেন, আর চোখের জল বেরোতে থাকে শুধু। এমতাবস্থায়, কিছু জরুরী ব্যাঙ্কসংক্রান্ত কাজের জন্য আমি আমার এক আত্মীয়ের শরণাপন্ন হই। ইনি আমার বাবার থেকেও বয়সে বড় এবং শিশুকালে এনার কোলেপিঠে চড়েছি অনেক। বলাই বাহুল্য 15 বছরের আমি ব্যাঙ্কসংক্রান্ত কাজের কিছুই বুঝিনা। উনি ওনার বাড়িতে(পাশের পাড়াতেই) ডাকায় আমি সেখানে যাই। সেদিন তিনি একলা ছিলেন এবং আমায় চমকে দিয়ে তিনি আমায় আক্রমণ করেন। ঘটনার আকষ্মিকতায় বিহ্বল হয়ে আমি কিছু মিনিটের জন্য কেমন স্তব্ধ হয়ে যাই, আর সেই সুযোগে উনি আমার পোষাক এদিক ওদিক কিছুটা ছিঁড়ে ফেলতে সমর্থ হন। কয়েক মিনিটের বিহ্বলতা কাটাতেই আমি বাঁচার জন্য চিৎকার আর লাফালাফি শুরু করি। তাতে আমায় জলের জগ,দরজার খিল, এবং চড়-লাথিও মারা হয়। তারপর সেই দরজার খিলটা দিয়েই ওনার মাথা ফাটিয়ে আমি নিজেকে কোনোক্রমে বাঁচিয়ে বেড়িয়ে আসি ওনার বাড়ি থেকে। জামা ছেঁড়া,মানসিক ও শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত আহত আমি ও পাড়া থেকে নিজের বাড়ি অবধি কাঁদতে কাঁদতে দৌঁড়ে এসেছিলাম। কিন্তু বাড়ি ঢুকে দেখি অসুস্থ মা ছাড়া কেউ নেই।আমি বারান্দাতেই শুয়ে পড়ে থরথর করে কাঁপছিলাম। মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। খুব জলতৃষ্ণা পাচ্ছিল কিন্তু ওঠার শক্তি ছিল না।কী অপমান লাগছিল।শরীরের যেটুকু জায়গায় ওই আত্মীয় হাত দিতে সমর্থ হয়েছিলেন, সেসব জায়গা কেটে বাদ দিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল। স্তন,মুখ,কোমর,,,, ,মনে হচ্ছিল,খাবলে মাংস তুলে ফেলে দিলে বোধহয় ওই স্পর্শজনিত অপমান কিছুটা কমে। ইতিমধ্যে বাড়ির সবাই আধ ঘন্টা পর দল বেঁধে কোথাও থেকে এসে আমার উপর চড়াও হলেন। আমায় বলা হোল আমি নাকী সেই আত্মীয়ের কাছে টাকা চেয়েছি আর না পাওয়ায় ওনার মাথা ফাটিয়েছি। আমার ছেঁড়া জামা, মুখে অতটা আঘাত দেখেও কারো কিচ্ছু সন্দেহ হয়নি। আমি ওই ছেঁড়া জামা পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, আর বিজ্ঞচোদেরা সামনে দাঁড়িয়ে শালিসি করে যাচ্ছেন। কেউ একটা গামছা অবধি এগিয়ে দেননি নিজেকে ভালোভাবে ঢাকতে। তার উপর নোংরা কথা। একবারও আমার কথা কেউ বিশ্বাসও করেননি,কারণ করতে চাননি। প্রথম 20-25 মিনিট জানেনতো দিদিরা,,,  আমার খুব লজ্জা লাগছিল। ছিঁড়ে যাওয়া জামার জন্য। হাত দিয়ে বামস্তনের ছেঁড়া দিকটা ঢাকতে চাইছিলাম।আরেকহাত দিয়ে পেটের কাছের ছেঁড়া টা।কুঁকড়ে বেঁকে দাঁড়িয়েছিলাম। 26 নম্বর মিনিট থেকেই কিছু একটা হতে লাগল। আমি আস্তে আস্তে সোজা হতে লাগলাম। কারণ আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছিলাম যে, আমার কষ্টের দাম এই মূহুর্তে কারো কাছে নেই। আমার সত্যি অভিযোগটা এদের কাছে মিথ্যা। হাত দিয়ে শরীর আড়াল করার চেষ্টা ছেড়ে দিলাম।বুঝলাম এখন নিজের কথা এদের শোনাতে গেলে এদের বাধ্য করতে হবে শুনতে।এখন লড়াই করে সারভাইভ করার সময়,এখন শরীর নিয়ে ব্যস্ত হলে চলবে না। সব লজ্জা,ঘেন্না,কষ্ট সাইডে রাখলাম জোর করে, না, সেসব শরীর-মন ছেড়ে চলে যায়নি তখনো,জাষ্ট সাইডে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তারস্বরে চিৎকার করে সব বলতে লাগলাম। জিনিসপত্র ভাঙতে লাগলাম। আরো কিছু লোক জমা হয়ে গেল। ততক্ষণে ফাটা মাথা সেলাই সেরে সে আত্মীয় হম্বিতম্বি করবেন ভেবে এসে গেছিলেন।গেট পার হতে দেখেই আমি শাবল নিয়ে ওনাকে তাড়া করি।তখন কিচ্ছু করতে পারিনি যদিও।ওনাকে ধরার আগেই সবাই আমায় ধরে নিয়েছিল,বরং যারা ধরেছিল,তাদেরই আহত করেছিলাম।ভয়ঙ্কর সীন ক্রিয়েট হল। কিন্তু এতে একটা লাভ হয়েছিল,, আর কোনো আত্মীয় আমার দিকে আঙ্গুল তোলার সাহস দেখাননি। আর সেই সুওরের বাচ্চাও বাড়ি বেচে অন্যত্র চলে গিয়েছিল। 
 আমার বাপ শিখিয়েই গেছিলেন, "সব পরিস্থিতির একটা প্যাটার্ণ হয়, সেই প্যাটার্ণটা বোঝ, আর সেই অনুযায়ী নিজের শরীর মন তৈরী করে সারভাইভ কর,পরিস্থিতির প্যাটার্ণ টা ধরতে পারলে আর তার গোলামী করতে হয়না"। -- এটার মানে আমি তখন বুঝিনি যখন বাপ বলেছিলেন। এইদিন বুঝেছি যখন না বুঝেই আমি বাপের পরামর্শ পালন করে ফেলেছিলাম। 
.
        এতো হ্যাজ দেওয়ার একটাই কারণ, তা হল, আমি আপনাদের প্রত্যেকটা মহিলাকে এটা বলতে চাই যে , আপনাদের নিজেদের শরীরটা নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন? সারাক্ষণ নিজের শরীর আগলাতে গিয়ে যে ঠিক করে লড়তে পারেন না, তা কী দেখেছেন? আমি ব্যাঙ্গালোর কান্ডের ভিডিওগুলো দেখছিলাম। মেয়েগুলো বুক বাঁচাতে ব্যস্ত ছিল, নিজের যেটুকু শক্তি ছিল, সেটাও কাজে লাগাতে পারল না বুক,পাছা আর যোনী বাঁচাতে গিয়ে। অথচ মিনিটখানেকের মধ্যে ঘটনার আকষ্মিকতা সামলে যদি ঘুরিয়ে একটা মুখে ঘুষি বা নিদেনপক্ষে চোখে আঙ্গুলও ঢুকিয়ে দিতে পারত, তাহলেও বেঁচে যেত ওই মেয়েটি যাকে দুজন বাইকারোহী আক্রমণ করেছিল। তা না করে সে বুক গার্ড করে নীচু হয়ে গেল, তখন ওই জানোয়ারের বাচ্চাগুলো পিছন থেকে ওর জামায় হাত ঢুকিয়ে হেনস্থা করল।
যাদেরকে এক দল জানোয়ার ছেঁকে ধরেছিল, তাদের লড়াই করাটা কঠিন ছিল জানি, তবু শরীর বাঁচাবার চেষ্টায় কুঁকড়ে বসে না পড়ে ঘুরে হাত চালালে সেক্ষেত্রে অনেক আগেই সেফ হতে পারতেন তাঁরা।
"এরকম কেন হবে?" "এই অব্যবস্থার মানে কী?" এই প্রশ্ন সবাই করবেন, করছেন। একটা লোম্বাও ছেঁড়া যাচ্ছে না তাতে অপরাধীদের। লড়াই করুন।প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। আপনাদের নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছোঁয়া এত সোজা কেন জানেন? কারণ আপনারা ভাবেন স্তন, যোনী ,পেট এসবে আপনাদের "শ্লীলতা" থাকে। শরীরের আবার শ্লীল অশ্লীল কী বাঁড়া? আমাদের  শরীরের প্রতিটা স্কোয়ার ইঞ্চ আমাদের। হাত ধরে টানলেও ঘুরে মারুন, স্তনে খামচালেও তাই। একটা বালের সমাজ এতদিন আপনাদের স্তন, যোনী আর নিতম্বসর্বস্ব করে রেখেছে। আর আপনাদেরও লজ্জা করেনা যে আপনারা তাই হয়েই বেঁচে আছেন? রাস্তায় জামা কাপড় এদিক ওদিক হলে লজ্জা, পোষাকে মাসিকের দাগ লাগলে লজ্জা, কেউ হিসি করতে বসতে দেখে নিলে লজ্জা ..... এদিকে কনুই ছুলে গেলে সমস্যা নেই, কেউ ধাক্কা মেরে লাইন থেকে সরিয়ে নিজে ঢুকে গেলে সমস্যা নেই(যতক্ষণ না সেই ধাক্কাটা স্তন বা পাছায় লাগছে) ইত্যাদি। আপনারা নিজের শরীরের কয়েকটা অঙ্গে এত বন্দি কেন এটাই হেকা বুঝতে পারে না। ফাঁকা রাস্তায় কেউ টেনে জামা খুলে দিতে চাইলে নিজেই নিজের জামা খুলে নিয়ে তাতে রাস্তার ঢিল,আধলা ইঁট কুড়িয়ে ঢুকিয়ে জামাটাকে সৌরভ গাঙ্গুলীর ষ্টাইলে ঘুরিয়ে মুখ আর মাথা লক্ষ্য দে মার, দে মার। ছাড়েন কেন? আপনারা এত দিনেও বোঝেন নি যে আমাদের মেয়েদের এই শরীর সংক্রান্ত লজ্জাটা আসলে জানোয়ার চামড়াখেকোদের অস্ত্র? 
,
আমি ওসব বড় বড় নারীবাদী বালবিচি বুঝি না, বুঝতেও চাইনা। কোথাও একটা ধর্ষন, শ্লীলতাহানি হবে, আর ফেবু জুড়ে "প্যাট্রিয়ার্কাল","প্যাট্রিলিনিয়াল" ইত্যাদি শব্দের চোদনামী শুরু হবে। হা হুতাশ, কান্নাকাটি।মোমবাতি মিছিল, আরো কত বালবিচালি। এসব বালের জিনিস খালে দিন। লড়তে শিখুন। স্তন, যোনীকে শরীরের আরো 5 টা অঙ্গের মতো স্বাভাবিক নিতে শিখুন। হাত আর মন খুলে একবার মেরে দেখুন। ধর্ষকরা ভয় পাবে, পিছোবে। আমি আদারে বাদারে জঙ্গলে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াই। ইউপি বিহার বেল্টে অনেকবার অনেক অসভ্যতার মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু ওই লজ্জা কম থাকায় বেঁচে বেড়িয়ে এসেছি। গায়ের জোর,শারীরিক শিক্ষার থেকে বেশী কার্যকরী হল লজ্জাহীনতা। 
আক্রমনকারীর মুখ চোখ ফাটিয়ে বিচি ফিচি থেঁতলে তার ওই যন্ত্রনাবিদ্ধ শরীরের সামনে ব্রা খুলে দাঁড়ান। আপনাদের অনাবৃত উর্ধাঙ্গ সামনে পেয়েও যখন জানোয়ারগুলোর চোখে শুধু মাথা আর বিচিফাটা যন্ত্রনা আর মুখে কাতর গোঙ্গানি শুনবেন। অদ্ভুত closure পাবেন,মানসিকভাবে সুস্থ থাকবেন। ইয়ার্কী ভাববেন না, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।   নিজেকে ভালবাসুন, নিজের জন্য লড়ুন। ছিঁড়ে দিন নারীমাংসলোভীদের মুখ,চোখ আর লিঙ্গ। যা করবার করুন কিন্তু দয়া করে আর অসহায় হয়ে পড়ে থাকবেন না। এ লাটক আর নেওয়া যাচ্ছে না। পায়ে ধরছি।
I love u all <3  blessed be )o(

মমতা আপনিই ~ সুশোভন পাত্র

নিউটনের ঘরের কেয়ারটেকার সেদিন পরিচারিকা কে পই পই করে বলেছিলেন, "ডিমটা সেদ্ধ করে, বাবুকে খাইয়ে, তবেই আসবি।" কিন্তু গবেষণায় বিঘ্ন ঘটবে বলে, নিউটন নিজেই ডিম সেদ্ধ করে, সময়ে খেয়ে নেবার আশ্বাস দিয়ে তাঁর পরিচারিকা কে ফেরত পাঠিয়ে দেন। একঘণ্টা পর পরিচারিকা এসে দেখেন,  সসপ্যানে রিষ্ট ওয়াচটা সেদ্ধ হচ্ছে আর নিউটন উনুনের সামনে ঠাই দাঁড়িয়ে, হাতে ধরা ডিমের দিকে তাকিয়ে সময় দেখছেন।
টিকিট চেকার টিকিট চাইতেই আইনস্টাইন অনেক খুঁজেও টিকিটটা পেলেন না। টিকিট চেকার আইনস্টাইনকে চিনে বলেছিলেন, "আরে প্রফেসর, আর খুঁজতে হবে না। আমি নিশ্চিত আপনি টিকিট কেটেছেন।" কাতর স্বরে আইনস্টাইন বলেছিলেন, "না, না খুঁজতে তো হবেই। ওটা না পেলে আমি জানব কি করে কোথায় যাচ্ছি!"
ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সের পথিকৃৎ নিউটন ডিমের বদলে ভুল করে রিষ্ট ওয়াচ সেদ্ধ করেছিলেন। থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সের জাদুকর আইনস্টাইন টিকিট আনতে ভুলেছিলেন। আর দিল্লীর মসনদ দখলের দিবাস্বপ্নে মশগুল আমাদের মুখ্যমন্ত্রী স্বরচিত ইতিহাসটাই ভুলে গেছেন। আসুন দায়িত্বশীল কামাল হাসানের ভূমিকায় সদমা সিনেমার শ্রীদেবীর যত্ন নিন। কর্তব্যপরায়ণ নাগরিক হিসেবে তাঁর কৃতকর্ম স্মরণ করিয়ে দিন।  
জরুরী অবস্থায় সিদ্ধার্থশংকর রায়ের তাঁবেদারি করে, জয়প্রকাশ নারায়ণের গাড়ির বনেটে নেচে ¹, ইন্দিরা হত্যার সহানুভূতির ভোটে প্রথম সাংসদ হয়ে ², শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন আনন্দবাজারের হবু 'অগ্নিকন্যা'। ধর্মীয় মেরুকরণের চ্যাংড়ামি তে জাতীয় রাজনীতিতে দ্রুত উঠে আসছে বি.জে.পি ³ । 'লৌহ পুরুষ' রথে চেপে, বাড়ি বয়ে বলে আসছেন 'মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে'। অযোধ্যায় জুটছেন কর-সেবকরা। ৯২'র ৪ঠা ডিসেম্বর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শহীদ মিনারে জনসভা ডাকল বামফ্রন্ট। আর সেদিনই সিধো-কানহু ডহরে সভা করে 'ইন্ডিয়া ইয়ুথ কংগ্রেসের' সাধারণ সম্পাদিকা মমতা বললেন, ''সব সি.পি.এম'র ষড়যন্ত্র। বি.জে.পি অযোধ্যায় কিছুই করতে পারবে না। আসলে সি.পি.এম আমাদের আটকাতেই ক্যাডার জড়ো করছে" ⁴ ।  ৯৭'র ডিসেম্বরে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত মমতা'ই জোটসঙ্গী প্রসঙ্গে বলেছিলেন, "বি.জে.পি তো  অচ্ছুৎ নয়" ⁵।  বাস্তবেই ছুৎমার্গ শিকেয় তুলে ৯৮'র লোকসভা ভোটে‍‌ তৃণমূলের হাত ধরেই পশ্চিমবঙ্গে খাতা খুলল বি.জে.পি। আর ৯৯' এ এন.ডি.এ'র শরিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন রেলমন্ত্রী ⁶।
ম্যাডাম, আজ আপনার বি.জে.পি কে 'সাম্প্রদায়িক' মনে হচ্ছে? কিন্তু আপনিই তো বি.বি.সি'র সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন বি.জে.পি নাকি তৃণমূলের "ন্যাচারাল অ্যালি" ⁷? গুজরাট দাঙ্গার সময়ে আপনি বাজপেয়ী সরকারে মন্ত্রী ছিলেন না ⁶?  সংসদ যখন গুজরাটের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করছে তখন সরকারের পাশে দাঁড়াবার আশ্বাস দিয়ে বাজপেয়ী কে আপনি চিঠি লেখেননি ⁸? তবে যে আপনারই সাংসদ কৃষ্ণা বসু তাঁর 'অ্যান আউটসাইডার টু দি পলিটিক্স' বইয়ে লিখেছেন, লোকসভায় যেদিন গুজরাটে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়ে ভোটাভুটি হচ্ছে সেদিন আপনিই নাকি এন.ডি.এ সরকার কে ভোট দেবার হুইপ জারি করেছিলেন ⁹? আপনিই তো দাঙ্গা পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভের পর নরেন্দ্র মোদী কে অভিবাদন জানিয়ে পুষ্পস্তবক পাঠিয়েছিলেন ¹⁰। আপনিই তো ২০০৪'র লোকসভা এবং ২০০৬'র বিধানসভা নির্বাচনে বি.জে.পি'র সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন ⁴ । 
ম্যাডাম, আজ আপনি বলছেন আর.এস.এস 'ভয়ঙ্কর'? আর ২০০৩'র ১৫ই সেপ্টেম্বর দিল্লিতে 'পাঞ্চজন্য'র অনুষ্ঠানে আপনি সংঘ নেতৃত্বের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ''আপনারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। আপনারা দেশকে ভালোবাসেন। আপনাদের ১% সাহায্যে আমরা কমিউনিস্টদের সরাতে পারবো।'' মনে পড়ে গদগদ আর.এস.এস নেতারা আপনাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ''হামারি পেয়ারি মমতাদি সাক্ষাৎ দুর্গা'' ¹¹?  এই তো সেদিন 'দুর্গার' সাফল্যে খুশি হয়ে আর.এস.এস'র রাজ্য মুখপত্র 'স্বস্তিকা' সম্পাদকীয় তে লিখেছিল "দায়িত্বশীল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেতৃত্বে দুঃশাসনের অবসান" ¹² । এই তো সেদিন আর.এস.এস'র জাতীয় মুখপত্র 'ওর্গানাইজার' স্বর্ণাক্ষরে উত্তর-সম্পাদকীয় তে ছেপেছিল, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশের সেই বিরলতম প্রজাতির রাজনীতিবিদ যিনি আর্থিক ভাবে সৎ। দেশে তাঁর মতই রাজনীতিবিদ প্রয়োজন" ¹³ ।
সাইকো-অ্যানালিস্ট গিরিন্দ্রশেখর বসু কে একদিন তাঁরই এক রোগী বললেন "স্যার, গতরাতে স্বপ্নে দেখেছি আপনি নর্দমায় পড়ে গেছেন; আর আমি আপনাকে অনেক কষ্টে ওঠাতে চেষ্টা করছি।" গিরিন্দ্রশেখের মুচকি হেসে বলেন, "আমি অত্যন্ত আনন্দিত আপনার সাহায্য পেয়ে। কিন্তু নর্দমায় আমাকে ফেলেছিল কে?" ম্যাডাম, আপনার রাজত্বে যখন গত পাঁচ বছরে পাঁচ গুন বেড়েছে আর.এস.এস'র শাখার সংখ্যা ¹⁴, আজ যখন অনাহারে মরা চা শ্রমিকের রাজ্যে যাদবপুরে 'গরু পূজার' ছ্যাবলামি করছে মাথায় গোবর ভর্তি সন্তানরা, আজ যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে তিন তালাকের সমর্থন জানাচ্ছে আপনারই মন্ত্রীরা, আজ যখন হাজিনগর থেকে ধুলাগড়ে ধর্মের নামে ঘরে ঘরে দাঙ্গার আগুন ছড়াচ্ছে আপনার ভাইরা; তখন  রাজনীতির অঙ্ক কষতে সিদিকুল্লা-তোহা সিদ্দিকী'দের মাথায় তুলে রাখছেন আপনি? মোহন ভাগবত'দের কলকাতায় সভা করে বিষ ছড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছেন আপনি? বি.জে.পি-সংঘ বিরোধিতায় ভেকধারী খড়গহস্ত হওয়ার তামাশা করছেন আপনি? গোটা রাজ্য কে ধর্মীয় মেরুকরণের বারুদে সাজিয়ে, পায়ের উপর পা তুলে মুজরা দেখছেন আপনি? আগে বলুন তো মাননীয়া, নিজের আঁচল দিয়ে এদ্দিন এরাজ্যে আর.এস.এস আগলে রাখল কে?  বলুন সম্প্রীতির বাংলায় বি.জে.পি'র বীজ বপন করেছিল কে? নিজের গোয়ালে, নিজের আঁচলে, লুকিয়ে দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছিল কে? আমি আনন্দিত আজ আপনি বি.জে.পি-সংঘের বিরোধিতা করছেন। কিন্তু আগে বলুন তো ঐ নর্দমায় আমাদের ফেলেছিল কে?   
একদিন মার্ক টোয়েন সকালবেলা শার্ট পরতে গিয়ে দেখলেন শার্টে বোতাম নেই। একটার পর একটা, তিনটে শার্ট বার করে পরতে গিয়ে দেখেন সব সার্টেই একটা করে বোতাম নেই। রাগে অকথ্য গালিগালাজ করতে করতে মার্ক টোয়েনে যখন চতুর্থ শার্টটা বের করছেন, তখন তাঁর রুচিশীল স্ত্রী, সব শুনে, স্বামীকে অপ্রস্তুত করার জন্যেই প্রত্যেকটি গালিগালাজ স্পষ্ট করে আবার উচ্চারণ করলেন। মার্ক টোয়েন সেটা শুনে বলেছিলেন, "তোমার শব্দগুলো সব ঠিকই আছে, কিন্তু... ইমোশনটা মিসিং।"
ম্যাডাম,  আজ আপনি বি.জে.পি -সংঘের বিরোধিতা করছেন বটে।  কিন্তু ঐ যে... ইমোশনটা মিসিং।















রবিবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৭

নববর্ষের স্মৃতি ~ অমিতাভ প্রামাণিক

আমার ছোটবেলার নববর্ষের স্মৃতি এখনকার তুলনায় একেবারেই আলাদা।

মাজদিয়ায় বড়দিন বা নতুন বছর বলে কিছু ছিল না। শীতকাল, তাই সন্ধ্যেবেলা খেজুরের রস পাওয়া যেত। রবিবারে বুধবারে খেজুরের গুড়ের হাট বসত ইস্কুলের সামনের রাস্তায় আর তার পাশের মাঠে। দূর দূর থেকে লোক আসত সাইকেলের হ্যান্ডেল আর কেরিয়ারে বা গরুর গাড়িতে গুড়ের ভাঁড় সাজিয়ে। রাস্তা চলা সহজ হ'ত না, সাইকেল থাকলে তো আরো মুশকিল। ব্যাপারীরা লোহার লম্বা শিক ভাঁড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে চেক করত ভাঁড়ের তলায় বাজে গুড়ের পাইল দেওয়া কিনা। দরাদরি হ'ত। লাইন দিয়ে লরি দাঁড়িয়ে থাকত, বিকেলের পড়ন্ত রোদে সেগুলো ভাল কোয়ালিটির গুড়গুলো তুলে নিয়ে রওনা হ'ত। আমরা জানতাম - ওরা যাচ্ছে কলকাতায়, দিল্লীতে, আমেরিকায়। আমরা না পাঠালে ওখানকার মানুষ তো নলেন গুড় কী, তা জানতেই পারবে না। 

তবে এর সাথে পয়লা জানুয়ারির কোনো সম্পর্ক নেই। পঁচিশে ডিসেম্বরেরও। যদি কোন কারণে সে বছর মামার বাড়ি কৃষ্ণনগরে যেতাম ওই সময় - মাঝে মাঝে যেতাম - তবে তার মধ্যে কোনোবার চার্চে বেড়াতে যাওয়া হ'ত। কৃষ্ণনগরের গীর্জা বেশ পুরনো আর বেশ বড়, সে সময় মেলার মত ভিড় হ'ত। মনে আছে একবার, তখন আমি বেশ ছোট, সেখানে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। মাকে খুঁজে না পেয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে মাইকওলার কাছে গিয়ে বলেছিলাম, বলে দাও না, আমার মা হারিয়ে গেছে।

কেক নামক বিচ্ছিরি খাদ্যটি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে চোখেই দেখিনি। 

তখন ক্যালেন্ডার ইয়ারই ছিল আমাদের অ্যাকাডেমিক ইয়ার। পুজোর সময় ছুটি থাকত একমাস, ভাইফোঁটার পর স্কুল খুললেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা। তার রেজাল্ট বেরোতো ডিসেম্বরে। হেড মাস্টারমশাই সুসিতবাবু প্রত্যেক ক্লাসে গিয়ে পাশ করা ছাত্রদের নাম ঘোষণা করতেন। বাবা ঐ স্কুলেরই শিক্ষক ছিলেন, জীবনেও কোনদিন আগে থেকে বলতেন না আমার রেজাল্ট কেমন। ধুকপুকুনিটুকু জেগে থাকত হেডস্যারের মুখ থেকে নিজের নাম শোনা পর্যন্ত। 

অবশ্য পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেই মা এর ওর বাড়ি থেকে চেয়ে আনত পরের ক্লাসের অঙ্কবই। সকালে ঘুম থেকে তুলে সামনে বাড়িয়ে দিত তবলা বাঁয়া। আমি লেপের মধ্যে নিজেকে ঢেকে দু চারবার ধা তেরেকেটে মেরে আবার শুয়ে পড়ার ধান্দা করতেই মা চেঁচিয়ে উঠত তোলা উনুনে কয়লা সাজাতে সাজাতে। তাই আরো দু চারবার বাজাতে হ'ত ধা তেরেকেটে ক্রেধা তেরেকেটে ধিন্না কত্তা। উঠে তুষের চাদরে নিজেকে পেঁচিয়ে আভা না বিভা দাঁতের মাজন বাঁহাতের তালুতে ঢেলে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে দাঁত মালিশ করতে করতে চলে যেতাম বাসরাস্তার ধারে। হলুদ নরম রোদ উঠত তখন। রাস্তার ধারে কাঠ আর পুরনো খবরের কাগজ জ্বেলে হাত পা সেঁকত কেউ কেউ, আমি তার পাশে গিয়ে বসতাম। ইস্কুল ছুটি, তাই বাবার টিউশনির ছাত্ররাও তখন পড়তে আসত না। 

তখন আমাদের খেলা ছিল সিগারেটের বা দেশলাইয়ের খাপের ছবি দিয়ে তাস খেলা। মাটির ওপরে একটা বিন্দু, সেটা হচ্ছে এখনকার কম্পিউটারের ভাষায় 'হোম'। সেখানে দাঁড়িয়ে একটা লোহার কড়াইভাঙা চাকতি - যার মাপ বারো থেকে ষোলো বর্গ-ইঞ্চি, সেটা চালা হ'ত এমনভাবে, যাতে সেটা কুড়ি বাইশ মিটার দূরের কোনো এক জায়গায় এমনভাবে বসানো যায়, যাতে যে পরে চালবে, সে কিছুতেই তার চার-আঙুলের প্রস্থের দূরত্বে ফেলতে না পারে। চেলে নিজেকেই বুঝে নিতে হ'ত কতটা কঠিন জায়গায় চাকতিটা বসেছে। সেইমত তার ওপর একগোছা তাসের চ্যালেঞ্জ, মানে তুমি এর ঘাড়ে চাকতি বসালে আমি তোমাকে এতগুলো তাস দেব। চ্যালেঞ্জার কখনো সেই চ্যালেঞ্জ নিত, আর বসাতে পারলে জিতত, না বসাতে পারলে ততগুলো নিজের তাস গুনে দিত তাকে। সে চ্যালেঞ্জ না নিয়ে প্রথম চালা চাকতিধারীকে হোমে ফিরে আসার চ্যালেঞ্জও জানাতে পারত। এই খেলা চলত যতক্ষণ না একপক্ষ নিজের সব তাস হেরে যেত। সঙ্গে যত তাস আছে, তাকে বলা হ'ত হাত-প্যান্ট-পকেট। লোকজন চোট্টামো করে নিজের অঙ্গের বিচিত্র সব জায়গায় তাস লুকিয়ে রাখত। হাপ্প্যানপকেট ডেকে জিতলে বের হ'ত সেই সব তাস। সে নিয়ে মারামারিও হ'ত। 

কত বিচিত্র রঙের আর ডিজাইনের সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই বাক্স ছিল তখন। এখন আর দেখি না, সব উঠে গেছে। 

ডান্ডাগুলি বা লাট্টু খেলা হ'ত ইউনিয়ন বোর্ডের মাঠে। কাঁচের গুলি দিয়েও খেলা হ'ত খোলা জায়গায় বা দেওয়ালের ধারে। অনেক জন মিলে খেললে সেই গুলি চালা হ'ত কুলোয় ঢেলে। কুলো জিনিসটাই এখনকার বাচ্চারা হয়ত চোখে দেখেনি। 'ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো' বললে কী বলা হচ্ছে, তা বোঝাতেই সব্বোনাশ। ক্রিকেট খেলা হ'ত, অবশ্যই টেনিস বলে - আমরা বলতাম ক্যাম্বিস বল। রবার ডিউস নামে এক শক্তপোক্ত রবারের বল পাওয়া যেত, তার লাফানি দুরন্ত। প্যাড-গ্লাভ্‌স্‌ লাগিয়ে আসল বলে ক্রিকেট খেলার সঙ্গতি আমাদের ছিল না, তাই মাঝে মাঝে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে ঐ রবার ডিউস। তখনকার ফুটবল এখনকার এই নিটোল স্ফেরিক্যাল ছিল না। চামড়ার গোলকের মধ্যে ভরা থাকত রবারের গোলক, তার মুখে নল লাগানো। চামড়ার গোলকের এক জায়গায় কাটা থাকত, তার দুপাশে বোতাম লাগানোর মতন ঘর করা। নলে হাওয়া ভরা হ'ত, আর তারপর নলটা চেপ্টে ভাঁজ করে চামড়ার গোলকের মধ্যে ভরে জুতোর ফিতে বাঁধার মত সেই চামড়ার কাটা জায়গাটা বাঁধা হ'ত। বল পুরনো হয়ে গেলে সেই কাটা জায়গাটা বিচ্ছিরি রকম ফেটে যেত, তার তার মধ্যে থেকে রবারের ফুলানো বল আবের মত উঁচু হয়ে বেরিয়ে থাকত। আমরা অবশ্য বাতাবিলেবুর বল লাথানোর পরে সেই বল পেলেই উল্লসিত হয়ে তাই নিয়ে পেলে-র মত ড্রিবলিং করতাম। 

ইস্কুলের মাঠে স্যাররা ব্যাডমিন্টন খেলতেন। ছাত্র-শিক্ষক মিলে ভলিবল খেলত। একপাশে বাস্কেটবলও খেলা হ'ত কখনো কখনো।  

তবে বাড়ি ফিরে আমি সাধারণত অঙ্ক বইটা নিয়ে বসতাম। দোসরা জানুয়ারি নতুন ক্লাসে গিয়ে বসার একটা আনন্দ ছিল। ক্লাস শুরুর আগেই চার পাঁচটা চ্যাপ্টার আমি নিজে নিজেই করে ফেলতে পারতাম। তখন আর পুরনো বইটা ভাল লাগত না। নতুন ক্লাসে উঠলে নতুন বই এনে দিত বাবা, স্কুল থেকে বিক্রি হ'ত বঙ্গলিপি খাতা। 

আমরা একত্রিশে ডিসেম্বরের শীতের রাতে অন্য রাতের মতই রুটি-তরকারি-মাছের ঝোল খেতাম, শুয়ে পড়তাম রাত দশটার মধ্যেই। পয়লা জানুয়ারি ঘুম ভাঙত ভোরবেলা মা'র ডাকেই, যদিও তার অনেক আগে থেকেই বাবা বিছানায় বসে বসেই আবৃত্তি শুরু করে দিত - ওঁ পার্থায় প্রতিবোধিতাং ভগবতা নারায়ণেন স্বয়ম্ / ব্যাসেন গ্রথিতাং পুরাণমুনিনা মধ্যে মহাভারতম্‌ ...