বৃহস্পতিবার, ২১ মে, ২০০৯

জমে থাকা স্বপ্নেরা ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

জীবনের বেশ কয়েকটা বছর পেরিয়ে আসার পর, ইদানিং বড় অদ্ভুত একটা অনুভুতি মাঝে মাঝে মন কে আচ্ছন্ন করে রাখে। একজন সাধারন ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালি হিসেবে, জীবনে যা যা পাওয়ার থাকে, সেগুলো মোটের ওপর হয়ত পেয়েছি। নিজের ছোট্ট একটা বাড়ি, সংসার, সন্তান, চাকরি। সমাজে মোটামুটি একটা প্রতিষ্ঠা। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু চিন্তা এসে মন কে বিকল করে দেয় সাময়িক ভাবে। কলেজ জীবনের কিছু রোম্যান্টিক স্বপ্ন। দিন বদলানোর স্বপ্ন, সমাজ নতুন করে গড়ার স্বপ্ন। মাঝে মাঝে ভাবি, সেই স্বপ্ন গুলো কি শেষ হয়ে গেল নিজের মধ্যে? অফিসে, পাড়ায় বা আড্ডায় সিপিএম – কংগ্রেস নিয়ে ঝগড়া হলে তো কোমর বেঁধে নেমে যাই। ব্রিগেড কিম্বা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মহামিছিলে নিয়মিত যোগ দি। এমন কি মাঝে মধ্যে ঝোঁকে পড়ে কয়েক টা বিপ্লবী পদ্য টদ্য ও লিখে বন্ধুদের পিঠচাপড়ানি পেয়ে যাই। কিন্তু নিজের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, এই কি সব? এর বাইরে বেরনো যায় না? আদর্শটা কি তবে ভোটের বাক্সে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়ল? এমনটা তো কথা ছিলো না। ১৯৬৪ সালে যখন নতুন পার্টি তৈরি হল, সে সময়ে রাজনৈতিক ঘোষনাপত্রে বলা হয়েছিল, “মেহেনতি মানুষের নেতৃত্বে জনগনতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে পার্টি লড়াই করবে” এবং যতদিন পর্যন্ত না এই বিপ্লব সংগঠিত করা যাচ্ছে, ততদিন, মধ্যবর্তি ব্যবস্থা হিসেবে পার্টি, “যেখানে যেখানে সম্ভব, প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা হাতে নেবে, এবং বুর্জোয়া রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে থেকে মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। একই সময়ে, ভুস্বামী এবং বুর্জোয়া শাষিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাধারন মানুষ কে শিক্ষিত করা হবে”। কেরালা ও পশ্চিম বাংলায় ষাঠের দশকের শেষ থেকে এরকম একটা স্থিতিশীল সরকার গড়ার চেষ্টা চলেছে। এবং প্রথম বার ১৯৭৭ সালে পশ্চিম বাংলায় এই প্রচেষ্টা সফল হয়েছে।

যদি পশ্চিম বাংলাকে হিসেবের প্রথমে রাখি, তাহলে দেখবো ১৯৭৭ সালে, বামফ্রন্ট সরকার গঠনের অব্যবহিত পরেই অপারেশন বর্গার মাধ্যমে ভূমিসংস্কারের ব্যাপক কর্মসূচি নেওয়া হয়। এই প্রসঙ্গে দুটি শব্দের একটু ব্যাখ্যা দিয়ে রাখি। জোত শব্দটি আমাদের সাহিত্যে এসেছে কম, কিন্তু পত্র পত্রিকায় প্রায়শঃই আমরা এই শব্দটির মুখোমুখি হই। জোত অর্থ খুব সহজে বলতে গেলে বলতে হয় জমি। চাষ যোগ্য জমি। যদিও জোতদার এর সরাসরি অর্থ জমিদার করার একটু অসুবিধে রয়েছে। কারন বাংলায় জমিদার শব্দের অর্থ সাধারন ভাবে জমির মালিক বোঝানো হয় না। ব্রিটিশ সরকারের চিরস্থায়ী বন্দোবস্থের মাধ্যমে জমিদারি প্রথা এই দেশে জাঁকিয়ে বসে। জমিদার রা এক ধরনের সামন্ত প্রভু। কিন্তু গ্রাম্য সমাজে জোতদার কে জমিদারের শ্রেনী তে ফেলা যায় না সব সময়। জমি হয়ত অনেকেরই আছে, তবে কথাটা হলো, যাঁরই জমি আছে, তিনিই জমিদার নন। কিন্তু জোতদার হতেই পারেন। তেমনি ভাবে আসে বর্গাদার শব্দটা। যাঁদের জমি-জিরেত কিছু বেশি, তাঁরা নিজেরা চাষ করতে পারেন না। লোক লাগিয়ে চাষ করতে হয়। যাঁদের এই কাজে লাগানো হয়, মোটের ওপর তাঁরাই হলেন বর্গাদার। বামফ্রন্ট সরকার ভূমি সংস্কারের প্রথম ধাপ হিসেবে ভূমিহীন চাষীদের নথীভুক্ত করা হয়, এবং উর্ধসীমার ওপরে থাকা জমি বাজেয়াপ্ত করে ভুমিহীন চাষীদের মধ্যে বিলি করা হয়। লক্ষ্য করার মত বিষয় হলো, গ্রাম্য সমাজ কে একটা স্পষ্ট দাগ টেনে দু ভাগে ভাগ করা হলো। একদল যাঁদের আছে, একদল যাঁদের নেই। মার্ক্সবাদের একদম গোড়ার কথা। এই দাগ টানার মানেই শ্রেনী বিভাজন স্পষ্ট করা, এবং শ্রেনী সংগ্রাম শুরু করা। শ্রেনী সংগ্রামে লড়তে লড়তেই মানুষ অধিকার বোধ সম্পর্কে সচেতন হয়, এবং অধিকার ছিনিয়ে নিতে শেখে। ফলস্বরুপ লক্ষ্য করুন, আজ এই বাংলায় ৮৭% জমি রয়েছে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের হাতে এ হলো প্রত্যক্ষ্য ফলাফল। এই লড়াইয়ের আর এক পরোক্ষ ফলাফল, স্বাধীনতার পরবর্তী কালেও টিঁকে থাকা গ্রামীন সমাজের সামন্ততান্ত্রিক অংশগুলো নির্মূল হয়। অর্থাৎ মানুষ লড়তে লড়তেই নিজেদের শিক্ষিত করেছেন, পথ চিনেছেন। নিজেদের অগ্রগতির পক্ষে ক্ষতিকারক, প্রতিক্রিয়াশীল অংশকে চিহ্নিত করেছেন, এবং লড়াই করেছেন।

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে তার পরে। ভূমি সংস্কার মানে কি শুধু জমি ভাগ করা? আগে যে জমির মালিক ছিলো এক জন, এখন হয়ত ৫০ জন। যেখানে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ছিল শতকরা ৮০%, এখন হয়ত সেটা নেমে ৩০% হয়েছে। কিন্তু জমির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তো বদলায়নি। শুধু অনুপাতের কিছু হের ফের হয়েছে। সামন্ততান্ত্রিক পরগাছা হয়ত সাফ হয়েছে, কিন্তু তার জায়গায় জাঁকিয়ে বসেছে এক নতুন সৃষ্টি হওয়া “কুলাক” সম্প্রদায়। এঁরা জমি পেয়েছেন ৭৭ সালের পর। যতক্ষন সরাসরি স্বার্থে হাত পড়েনি, ততদিন কিন্তু এনারাই গ্রাম বাংলায় লাল ঝান্ডা উড়িয়ে রেখেছেন। কিন্তু যেদিন পরিবর্তনের আঁচ এসে গায়ে লাগলো, সেদিন শিবির বদলাতে এতটুকু সময় লাগেনি কারোর। কারন টা খুব সোজা। ৭৭ সালের কাটা দাগটা ফিকে হয়ে গেছে। যাঁরা সেদিনের বিপ্লবী অংশ, আজ তাঁদের অনেকেই কিন্তু পরিবর্তন কে স্বাগত জানাতে পারছেন না। কেননা, তাঁদের আশঙ্কা, যে টুকু তাঁরা পেয়েছেন, সে টুকু ও না যায়। তাহলে কি আজ যাঁরা বিপ্লবের অগ্রনী অংশ, কাল তাঁরাই প্রতিক্রিয়াশীল? তা কখনোই হতে পারে না। আসলে, শ্রেনী সংগ্রাম একটা অবিরাম চলতে থাকা লড়াই। বিপ্লবের অংশ। ভূমিসংস্কারের শুধুমাত্র একটা পর্য্যায় কিছুটা শেষ করেই থেমে যাওয়াটা হলো সবচেয়ে বড় ভুল। এক্ষেত্রে ভূমিসংস্কারের পরবর্তী পর্যায় গুলো পর পর চলে এলে হয়ত এই অবস্থা হতো না। অর্থাৎ শ্রেনী – সংগ্রাম তীব্রতর হবার বদলে প্রায় থেমে গেছে। আজকের গ্রাম বাংলার দিকে তাকান। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বসুন। দেখবেন, অপেক্ষাকৃত পশ্চাদপদ এলাকা গুলোতে লাল দুর্গ অটুট। কিন্তু হুঘলি, দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া বা পূর্ব মেদিনীপুরের মতো অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন জেলা গুলোতে পার্টির ভরাডুবি ঘটেছে। খোঁজ করে দেখুন, আজকে যাঁরা ঘাসফুলে ছাপ মারলেন, তাঁদের অনেকেই কিন্তু কয়েক মাস আগেও কাস্তে – হাতুড়ি ছাড়া অন্য কিছু তে ছাপ মারার কথা ভাবতেও পারতেন না। কেন এই পরিবর্তন এটা নিয়ে পার্টি কি কিছু ভেবেছে? বাহ্যিক প্রচার এবং আঙ্গিকে তো তার কোন প্রমান দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। জনগনতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে নির্বাচন কে গুরুত্ব দিতেই হবে, কিন্তু কেমন জানি মনে হচ্ছে নির্বাচনটাই প্রধান। বহু বছর যাবৎ বিপ্লবের কথা শুনিনা। কেন শুনিনা? তাহলে কি বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে গেছে? শ্রেনী সংগ্রাম সমাপ্ত? আমরা শ্রেনীহিন সমাজ গড়ে ফেলেছি? তা তো নয়। তাহলে আজ সরকারের ধুয়ো তুলে বিপ্লবের দাবী কে পেছনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কেন? রাজ্যসরকার যতই বামফ্রন্টের পরিচালিত হোক, এই সরকার আসলে ভারত সরকারের একটা অংশ। এবং তার চরিত্র বুর্জোয়া – প্রতিক্রিয়াশীল। সেটা ভুলে গেলে চলবে না।

কমরেড মাও এর একটা কথা আজ মনে পড়ে যাচ্ছে লিখতে বসে। সেটা হলো প্রতিটি কম্যুনিস্ট আদতে একজন বিপ্লবী। আজকে যদি “পরিবর্তিত পরিস্থিতি” তে পার্টি তে “বিপ্লব” কথাটা পেছনের সারিতে চলে গিয়ে থাকে, তাহলে প্রকৃত কম্যুনিস্টরাও আজ বোধহয় পেছনের সারি তে। উনিশ তম পার্টি কংগ্রেসএর দিকে তাকান। কংগ্রেস শেষ হবার পর কেন্দ্রীয় কমিটি এবং পলিটব্যুরো সদস্যদের শ্রেনীবিন্যাস লক্ষ্য করুন। বলতে পারেন কতজন এসেছেন সরাসরি শ্রমিক এবং কৃষক পশ্চাদপট নিয়ে? যতদুর মনে পড়ছে দলীয় মুখপত্র “পিপল্‌স ডেমোক্রাসি” তে সদস্যদের শ্রেনীবিন্যাস সর্ম্পকিত তথ্য দিয়ে একটা লেখা বেরিয়েছিলো। আমার তথ্যসূত্র সেটাই। মাটির সঙ্গে সম্পর্কহীন কৃষক নেতা কিম্বা কারখানার তেলকালি মাখা ছাড়া ধোপদুরস্থ ধুতি পাঞ্জাবি পরা শ্রমিক নেতা কি ভাবে শ্রেনী স্বার্থ রক্ষা করবেন সেটা আমার মাথায় ঢোকেনা। তবে আশার কথা যে একেবারে নেই তা নয়। রাজস্থানে পার্টি দুর্দান্ত ভাবে কৃষক আন্দোলন পরিচালনা করেছে। তার ফল ও পেয়েছে বিধানসভা নির্বাচনে। অন্ধ্রপ্রদেশেও তাই। সেখানে নকশালপন্থি বহু মানুষ এসে সামিল হয়েছেন পার্টির সঙ্গে। খাম্মামে পার্টি যে লড়াই টা দিয়েছে, সেটা ভোলার নয়। আর সবার ওপরে রাখছি পার্টির রাজনৈতিক দলিলকে। সেখানে কোনোপ্রকার দ্বিধা নেই। সমস্যা যে টুকু সামনে এসে দেখা দিয়েছে সে সমস্যা প্রতিটি কম্যুনিস্ট পার্টির সামনেই আসে। আজকের সুশীল সমাজ এবং একশ্রেনীর পার্টি নেতাদের সংশোধনবাদ সম্পর্কে সেই চল্লিসের দশকেই সাবধান করে দিয়ে গেছেন আন্তোনিও গ্রামশী। মাও বলেছিলেন বিপ্লবের পরেও বুর্জোয়ারা উৎখাত হতে চায় না। তারা আশ্রয় নেয় কম্যুনিস্ট পার্টির ভেতরে, আর জাঁকিয়ে বসে আমলাতন্ত্র। তার ফলাফল তো চোখের সামনেই রয়েছে। সোভিয়েত ইঊনিয়ন কে ভেঙে পড়তে দেখেছি আমরা। ক্ষমতার অলিন্দে থাকা একটা সুবিধেবাদী অংশ আশ্রয় নিয়েছে পার্টি তে। দরকার একটা জোরদার অভ্যন্তরিন লড়াইয়ের। ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া একটা অংশই কিন্তু সব নয়। মনে পড়ে যায় অসংখ্য মুখ, যেখানে প্রখর আদর্শবোধ ফুটে বেরোয় চোখের দৃষ্টি তে। এই অসংখ্য মুখগুলোই পিছু টেনে ধরে রাখে। এরাও পার্টি। টয়োটা চড়া নেতাদের থেকে এঁদের সংখ্যা যে অনেক বেশি। আর এনারাই আমার প্রকৃত কমরেড। কাজেই হতাশার কোনো জায়গা নেই। লড়াইটা কঠিন মানছি। কিন্তু ভেবে দেখুন, যে পার্টি একদিন স্লোগান দিয়েছে “এ লড়াই বাঁচার লড়াই, এ লড়াই জিততে হবে”, তার ঝাণ্ডার তলায় যে কোনো লড়াই ই লড়া যায়।

সব শেষে বলি, পার্টির কেউ যদি আপনার মতে ভুল করে থাকে, তবে ছেড়ে দেবেন? কেন কমরেড? পার্টি টা আপনার নয়? গা ঝাড়া দিন কমরেড। লাল ঝান্ডা ডাকছে আপনাকে।

সোমবার, ১১ মে, ২০০৯

সাচার সাহেব যাহা দেখেন নাই ~ পারিজাত ভট্টাচার্য্য

রাজিন্দার সাচারের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি দেশব্যাপী মুসলিম নাগরিকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিয়ে সমীক্ষা করেছেন। এই প্রতিবেদনে অনেক ক্ষেত্রেই মুসলিম জনগোষ্টীর পিছিয়ে থাকার স্পষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে। আবার, এই রিপোর্টের অনেক ঘাটতিও রয়েছে। কৃষিতে যুক্ত মানুষ বা মহিলাদের সম্পর্কে এই রিপোর্টে গুরুত্ব কম পড়েছে। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে ভুমি সংস্কার, গ্রামোন্নয়নের ফলে ঊপকৃত সংখ্যালঘুদেরকথা বাদই দেওয়া হয়েছে। অনেকে ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন সাচার রিপোর্ট গোটাদেশের, শুধু পশ্চিমবঙ্গের না। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে মুসলিম সঙ্খ্যালঘুদের অবস্থা কি? সাচার রিপোর্ট অনুযায়ী, রেলে ৪.৫%, সমস্ত ব্যাঙ্কে ২.২ %, কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীতে ৩.২ %, ডাক বিভাগে ৫ %, কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় ৩.৩ %। তাহলে কারা দায়ী এই পশ্চাৎপদতার জন্য। তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত ভালো। আমাদের রাজ্যে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের ১১ %, পুলিশে ৯ % বা স্বাস্থ্য দপ্তরে এ এন এম - এ কর্মরতদের ২২ % মুসলিম। সাচার কমিটির আগে আশির দশকে তৈরী হয়েছিলো গোপাল সিংএর কমিটি। ১৯৮৪ সালে তাদের রিপোর্ট জমা পড়লেও তা সংসদেই পেশ করেনি কংগ্রেস সরকার। বামপন্থীদের চাপে ১৯৯০ সালে ভি পি সিং সরকারের আমলে তা প্রকাশ করা হয়। কিন্ত তা রুপায়ন করার কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। সংখ্যালঘু মানুষের উন্নয়নের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব আছে কংগ্রেস, বি জ়েপি- র। তাই রিপোর্ট তৈরী হলেও বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে থাকে। আমাদের রাজ্যে সাচার কমিটি নিয়ে অনেকেই হই-চই করছেন। বাস্তব ঘটনা হলো ২০০৬ সালে কমিটির রিপোর্ট জমা পড়লেও ২০০৯ পর্যন্ত সংসদে তা নিয়ে কোনো আলোচনাইকরেনি ইঊ পি এ সরকার। চাপের মুখে কেন্দ্রে একটি মন্ত্রক খোলা হয়েছে। অথচ সংখ্যালঘু উন্নয়নে ২০০৮-০৯ - এ বাজেটে বরাদ্দ ১ হাজার কোটির ৩৪৯ কোটি টাকা খরচই হয়নি। বহুমুখী ঊন্নয়ন পরিকল্পনায় দেশের ৯০ টি সংখ্যালঘু নিবিড় জেলায় প্রকল্প নেবার কথা ছিলো। মাত্র ৪২ কোটি টাকা করে দেবার কথা। তাও হয়নি। এ পর্যন্ত ৩৭ টি জেলায় মাত্র৫ কোটি টাকা করে দেওয়া হয়েছে। ৫৩ জেলায় কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। সংখ্যালঘুদের ব্যাঙ্ক ঋণ পাবার অনুপাত ইউ পি এ-র আমলে কমে গেছে। কেন্দ্রীয় সরকারকেই এই উদাসীনতার জবাব দিতে হবে। বামপন্থীরা সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের স্বার্থে একটি দাবিসনদ ও প্রস্তাবগুচ্ছ প্রধানমন্ত্রীরকাছে পেশ করেছিলো। অন্যতম প্রধান প্রস্তাব ছিলো মোট বাজেটের ১৫ % বরাদ্দ করে উপ- যোজনা ( সাব-প্ল্যান) তৈরী করা হোক। কিন্ত সেই দাবি উপেক্ষা করা হয়, কেন্দ্রীয় তরফে। তবে কেন্দ্রের জন্যে বসে না থেকে পশ্চিমবঙ্গে মন্ত্রক- ভিত্তিকউপ- যোজনা চালু করে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গই এ - ব্যাপারে প্রথম রাজ্য। সাচার কমিটি প্রসঙ্গেই আসে রংগনাথ মিশ্র কমিটির কথা। ২০০৭ - এ এই কমিটির সুপারিশে বলেছে দলিত মুসলিম ও খ্রীষ্টানদের জন্য সংরক্ষণ করা হোক। বামপন্থীরা দাবী করেছে যে এই রিপোর্ট সংসদে পেশ করা হোক, সুপারিশ বিবেচনা করা হোক। ইউ পি এ - সরকার নিষ্ক্রিয় থেকেছে। কেন এই নিষ্ক্রিয়তা- জবাব দিতে হবে কংগ্রেস এবং তার জোটসঙ্গী তৃনমূল কংগ্রেসকে।


সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তর অথবা অন্যান্য বিষয়ে সংখ্যালঘুদের উন্নয়নপ্রকল্পে পশ্চিমবঙ্গসরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার পেছনেও কেউ কেউসাচার - এর ছায়া দেখছেন বা পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামফ্রন্টের পর্যুদস্ত হওয়ার অজুহাত দেখাচ্ছেন। এই দুই ধারনা যে সর্বৈব ভুল, তা বেশ স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল। পঞ্চায়ত নির্বাচনে প্রায় ৫২ শতাংশ ভোট পেয়েছে বামফ্রন্ট। পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম সমাজের অনগ্রসরতার কারণ অনুসন্ধান করতে হলে আমাদের ইতিহাস ঘাটতে হয়। সাচার প্রতিবেদনকে যথার্থভাবে বুঝতে গেলে সেই ইতিহাস চর্চা আবশ্যিক শর্তের মধ্যে পড়ে। ভারতবর্ষে প্রথম জনগননা হয় সম্রাট আকবরের সময়। টোডারমালের ‘বন্দোবস্ত’ নামক সেই গননা মৌজাওয়াড়ি করদাতাদের জনগননা। বাংলা যদিও আকবরের রাজত্বেরমধ্যেপড়তো না, তবুও টোডারমাল বাংলার একটি তাত্বিক সমীক্ষা (theoretical survey) করেছিলেন। এরপর ১৮০১ সালে বাংলার জেলাগুলিতে জনগননার একটি চেষ্টা করা হয়। ১৮৪০ ও ১৮৫০ - এও জনগননার কিচ্ছু অস্পুর্নকাজ হয়। এই সমস্ত নথি পড়ে এবং জনগননার একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরা হয় ১৮৭২ সালে। লর্ড মেয়োর নির্দেশে হান্টার এই কাজ শুরু করেন। অবিভক্ত বাংলায় সেই প্রথম জানা যায়, ‘গ্রেড থ্রি আসিসটান্ট ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে ২৪ জন হিন্দু, ১ জন মুসলিম; ৬৩ জন হিন্দু ওভারসিয়ার, ২ জন মুসলিম, অর্থ দপ্তরে ৫০ জন হিন্দুচাকরি করতেন, কোনও মুসলিম সেখানেনেই ইত্যাদি। ভারতের সংবিধানে ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ প্রথা নেই। নিম্নবর্ণের হিন্দু দলিতদের মধ্যে থেকে ধর্মান্তরিত হওয়া মুসলিমরাও এই সুযোগ পায়নি। এমনকি কোনো কোনো রাজ্যে পুলিসের চাকরিতেও মুসলিমদের নিয়গ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রচার শুরু হোলো- মুসলিমদের স্বার্থ এদেশে সুরক্ষিত নয়, ভয়ঙ্কর দাঙ্গার বিভীষিকা ও প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণ অনেক ক্ষেত্রে উপরের বক্তব্য কে প্রতিষ্টায় সিদ্ধান্তের সহায়ক হলো। সংখ্যালঘু হওয়ার অপরাধে প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধে থেকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে- এই ধারনাকে সংখ্যালঘুদের একাংশের মধেয় ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রয়াস শুরু হলো। বিশ্বে ইন্দোনেশিয়ার পরই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলিম বসবাস করেন ভারতে। এই অর্থে ভারতের স্থান দ্বিতীয়। এই প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রে জনতা সরকারের আমলে ১৯৭৮ সালে সংক্যালঘু কমিশন গঠন হয়। ১৯৮০ সালে তৈরি হয় একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি যার চেয়ারম্যান ছিলেন ড। ভি এ সৈয়দ মহম্মদ। পরবর্তিকালে ডঃ গোপাল সিং হন চেয়ারম্যান এবং ডঃ খুরশিদ আলম খান সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৮৩ সালে এই কমিটি একটি প্রতিবেদন পেশ করেন। যে প্রতিবেদনে মুসলিমদের অনগ্রসরতা ও তার বিহিত সম্পর্কে কিচ্ছু পরামর্শ ছিলো, আজ পর্যন্ত সেই প্রতিবেদন জনসমক্ষে আনা হয়নি। ১৯৯৬ সালে ১২ সদস্যের একটি সাব-কমিটি (যোজনা কমিশনের) মুসলিমদের প্রসঙ্গে বেশ কিছুকথা বলে। ৮০-র দশকে প্রধানমন্ত্রীর ১৫ দফা কর্মসুচী ঘোষিত হ ওয়ার দু’দশক পরে তার পুনরাবির্ভাব হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ‘নতুন’ ১৫ দফা কর্মসূচীরূপে। ২০০১ সালের জনগননা ও বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে স্পষ্ট, সংখ্যালঘুদের আর্থ-সামাজিক-শিক্ষার অবস্থার বিশষ কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। সাচার প্রতিবেদনে ভারতের মুসলিমদের রাখা হয়েছে এক অদ্ভূত অবস্থানে, যার একদিকে রয়েছে ‘মুসলিম তোষণের’ অভিযোগ, অন্য প্রান্তে রয়েছে মুসলিমরা ‘জাতিয়তাবিরোধী’ এমন কটাক্ষ। আর প্রতিনিয়ত সাধারণ মুসলিমদের পরিক্ষা দিতে হয়, তাঁরা জাতিয়তাবিরোধী নন, নন তোষণগ্রাহীও। সাচার রিপোর্টে মুসলিমদের অবস্থা দেখলে হিন্দুত্ববাদীদের তথাকথিত মুসলিম তোষনের তত্ব খারিজ হয়ে যায়। বিংশ শতাব্দীর শুরূ থেকেই, বিশষত স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কাল থাকে দেখা যায়, এই দেশের মুসলিম সম্প্রদায় জাতিয়তাবাদের প্রতিক। সে কথা আজও সমানভাবে সত্য।

সংখ্যালঘূ মানোন্নয়নে গঠিত কমিটি বা কমিশনের সুপারিশ ও কেন্দ্রীয় সরকার

১) ১৯৮০ সালে ডঃ গোপাল সিং এর নেতৃত্বে ১০ সদস্যবিশিষ্ট উচ্চক্ষমতাসম্পন্নকমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি ১৯৮৩ সালের ১৪ই জুন তার প্রতিবেদন পেশ করেন। কমিটির মতে সংখ্যালঘুদের মূলস্রোতে ফেরাতে গেলে সর্বপ্রথম তাদের মধ্যে বঞ্চনাবোধকে শিকড় ও শাখাপ্রসাখা সমেত উপড়ে ফেলতে হবে। দীর্ঘদিন পর ভি পি সিং সরকারের আমলে বামপন্থীদের চাপে এই রিপোর্ট সংসদে পেশ হ ওয়া সত্বেও সংসদের গ্রন্থাগার ছাড়া কোথাও এই রিপোর্টের স্থান হয়নি।

২) ১৯৮০ এর দশকে প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচী_ কর্মসুচী হয়েই থাকলো__, তার দু’দশক পরে, আবার প্রধানমন্ত্রীর নতুন কর্মসুচী ঘোষনা হলো।

৩) ১৯৯৫ সালে ন্যাশনাল মাইনরিটি কমিশন এর রিপোর্ট অথবা ১৯৯৬ সালে যোজনা কমিশনের সাব গ্রুপের রিপোর্ট।

৪) ২০০৭ সালের মে মাসে রংগনাথন মিশ্র কমিটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট সরকারের কাছে পেশ করেছে। রিপোর্টে মুসলিম এবং খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে যাঁরা দলিত, তাদের ব্যাপারে সংরক্ষণ সংক্রান্ত সুপারিশ করা হয়েছে । এই কমিটির সুপারিশ হলো- তফশিলী জাতি তালিকার মধ্যে দলিত মুসলিম ও খ্রীষ্টানদের অন্তর্ভূক্ত করার জন্যে সংবিধান সংশোধন করা উচিত। সরকার এখনো এই বিশয়ে নিশ্চুপ।

৫) সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী সরকার শুধুমাত্র, “Follow up action on the recommendation of the Sachar Committee” পেশ করেছেন।

দেশ ভাগের পর পশ্চিমবঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বহুমাত্রায়। এমনিতে বাংলার মুসলিমরা তখন খুব পিছিয়ে ছিলেন, শিক্ষা, কর্ম প্রভৃতি ক্ষেত্রে। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত উদ্বাস্তদের ঢল নামে পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৭১ - এ পূর্ব পাকিস্তান ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে স্বাধীন হয়। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে।

পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার ও সংখ্যালঘুদের উন্নয়ন

১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় আসার পর বামফ্রন্ট সরকার যে বিষয়গুলির উপর গুরুত্ব দেয় তার অন্যতম দুটি বিষয় হলো, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ভূমিসংস্কার। ধর্মীয় ভাবাবাবেগেরবিষয় মাথায় রেখে সরকার সংখ্যালঘুদের দিকে নজর দিয়েছে, তেমনি সংখ্যালঘুদের শিক্ষার দিকেও গুরুত্ব দিয়েছে অত্যন্ত বেশী। কবরস্থান ঘেরার জন্য শুধু গত আর্থিক বছরে চার কোটি টাকা মঞ্জুর করা হয়েছে। উর্দূ আকাদেমির উন্নতিকল্পে ২.৭০ কোটি টাকা যেমন বরাদ্দ হয়েছে, তেমনি হজযাত্রার জন্য অতিরিক্ত ২০ লক্ষ্য টাকা ধার্য্য করা হয়েছে।

হজযাত্রীর সুবিদার্থে কলকাতার বিমানবন্দরের কাছে ‘ হজ টাওয়ার কাম এমপাওয়ারমেন্ট সেন্টার’ নামে দ্বিতীয় হজ হাউসের নির্মাণ পর্ব চলছে। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এমনই জায়গায় দাঁডিয়ে যে তাকে গোটা ভারতের আদর্শ বললেও অতিরঞ্জিত করা হয় না। গর্বের সঙ্গে বলতে হয়, এর পেছনে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত, সচেতন ও সংগ্রামী মেহনতী মানুষের অবদানই সিং হভাগ। পাশাপাশি এটা সম্ভব হয়েছে বামফ্রন্টের নীতি ও আদর্শ রুপায়ণের মাধ্যমে।

ভূমি সংস্কার

ভূমি সংস্কারে পশ্চিমবঙ্গের স্থান সর্বপ্রথম। যার ফল ভূমিহীন কৃষকদের হাতে জমি। রাজ্যের ১৭ % সংখ্যালঘু মুসলিম মানুষ এর মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন। বর্গা আইনেও উপকৃত হয়েছেন লক্ষ্য লক্ষ্য দরিদ্র সংখ্যালঘুমানুষ। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে রাজ্যে যে ১১ লক্ষ্য একর খাস জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বন্টন করা হয়েছে, তার ফলে ২২ % মুসলিম উপকৃত হয়েছেন। ১৯৯২-৯৪ সালে ভূমিহীন মুসলিম কৃষক ছিলেন প্রায় ৪০%, পশ্চিমবঙ্গে সেই সংখ্যাটা আজ প্রায় ২০ %।


শিক্ষা

বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষার উন্নয়ন ও প্রসারে গুরুত্ব দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গই একমাত্র রাজ্য যেখানে শিক্ষার যাবতীয় দায়িত্ব রাজ্য সরকার বহন করে। ২০০৬-০৭ ও ২০০৮-০৯ আর্থিক বছরে উচ্চশিক্ষা দপ্তরে ২৬ টি সংখ্যালঘু অঞ্চলে কলেজের অনুমোদন দিয়েছে-- যেখানে এই দুই আর্থিক বছরে মোট ৩৬ টি কলেজ অনুমোদন পায়। রাজ্যে এ বছর ১৬০০ উচ্চ প্রাথমিক বিধ্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে, তার মধ্যে সংখ্যালঘু অঞ্চলে ৮০০ টি স্থাপিত করা হবে। ২৮২ টির অনুমোদন ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে। সংখ্যালঘু মেয়েদের জন্য ১৮ টি আবাসিক বিদ্যালয় তৈরি হচ্ছে। কস্তুরবা গান্ধী বালিকা বিদ্যালয় প্রকল্পে ইতিমধ্যে ১৫ টি বিদ্যালয় হয়ে গিয়েছে। ২০০৮-০৯ আর্থিক বছরে আরও ২৩ টি করা হবে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। রাজ্যে সামগ্রিকভাবে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত স্বাভাবিক রাখার জন্যে মোট ৪৮০০ টি শিক্ষক পদ সৃষ্টির করা হয়েছে, যার মধ্যে সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত এলাকায় ২৪০০ টি শিক্ষক পদ আছে। এ ছাড়াও এই মুহুর্তে রাজ্যে মুসলিম শিক্ষকের সংখ্যা ৩২, ৭১৩। এই রাজ্যে ৫০৬ টি অনুমোদিত মাদ্রাসার যে পাঠ্যক্রম চালু আছে, তা যথেষ্ট বৈজ্ঞ্যানিক ও আধুনিকমনস্ক। তা ছাড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাংবিধানিক অধিকার অনুযায়ী, মাদ্রাসার মতো প্রতিষ্টান গড়ে তোলা ন্যায়সঙ্গত। যাঁরা মাদ্রাসায় কেবলই ধর্মশিক্ষার পাঠ দেওয়ার পক্ষপাতী, তাঁরা ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক অবহিত নন। অবহিত হলে দেখা যাবে, গ্যানবিগ্যানের পাঠ্যদানে ইসলাম ধর্ম সমধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। পশ্চিমবঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যাবস্থা শুধু জাতীয়স্তরে নয়, আন্তর্জাতিক্সতরেও সুনাম অর্জন করেছে। সাতটি বৈশিষ্ঠের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষার ভিত। বৈশিষ্ট্য গুলি এক নজরে- ধর্মনিরপেক্ষতা, সহশিক্ষা, গুনগতমান, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে সমন্বয়, মুলস্রোতের শিক্ষাব্যাবস্থার সাথে সংযোগসাধন, মাদ্রাসার অনুমোদন দানের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলে বিশেষত উর্দু ভাষাভাষী অঞ্চলে ২০০ টি শিশু শিক্ষাকেন্দ্র ও ৩০০ টি মাদ্রাসা শিক্ষাকেন্দ্র অনুমোদন দেওয়া হবে। ৩২ টি আলিম মাদ্রাসা কে ফাজিল স্তরে উন্নীত করা হয়েছে। ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত কমানোর লক্ষ্যে ১০০০ টি নতুন শিক্ষক পদ অনুমোদন করা হয়েছে। ১২৫ টি উচ্চমাধ্যমিক মাদ্রাসায় গ্রন্থাগারিক পদ দেওয়া হয়েছে। মোট ১০০ টি মাদ্রাসায় বীক্ষনাগার তৈরি করা হয়েছে। গ্রন্থাগারের জন্য ৫০ লক্ষ্য টাকার পুরষ্কার দেওয়া হয়েছে। পরিকাঠামোর উন্নয়নার্থে ৩০ কোটি টাকা বিভিন্ন মাদ্রাসায় দেওয়া হয়েছে। ৩০০ টি নতুনসেট আপ, ৪০০ টি জুনিয়ার হাই মাদ্রাসাকে মাদ্রাসা শিক্ষাকেন্দ্রে রুপান্তর, মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন, মাদ্রাসাকে সংখ্যালঘু মর্যাদা দান প্রভৃতি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আলিয়া মাদ্রাসা রুপান্তর হয়েছে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, ভাঙ্গরে ৫০ একর জমির উপরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস গড়ে উঠবে, ইতোমধ্যে সল্টলেকে ৬ কোটি টাকা ব্যায়ে গড়ে উঠেছে মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদের- দ্বিত্বীয় প্রশাসনিক ভবন। সর্বোপরি, স্বশাসিত শিক্ষা পর্ষদের মাধ্যমে মাদ্রাসার পরিচালন, পঠন-পাঠন, পরীক্ষা গ্রহণ, শংসাপত্র দান এক নতুন নজির সৃষ্ঠি করেছে।


ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতা মহামেডান কলেজ প্রতিষ্টা করেন, যেখনানে ধর্মীয় পাঠের সঙ্গে জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, গনিতের পাঠও দেওয়া হতো। ১৮২৭ থেকে ১৮৩৬ সাল পর্যন্ত চিকিৎসাশাত্র পড়ানো হয় এখানে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় সঙ্কটে পড়ে এই প্রতিষ্ঠান, ১৯৪৯ সালে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের উদ্যোগে মাদ্রাসা কলেজ নতুন করে কাজ শুরূ করে। মাদ্রাসা কলেজের আদলে জোনাথান ডানকান, ১৮৭১ সালে বারানসীতে হিন্দু আইন, সাহিত্য ও ধর্ম পড়ানোর উদ্দেশ্যে একটি কলেজ খোলেন যেটি বেশ কিচ্ছু কাল আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তরিত হয়েছে। আলিয়া মাদ্রাসার যাবতীয় ঐতিহ্য অক্ষুন্ন রেখে এই প্রতিষ্ঠানটিকে ২০০৬ সালে কলেজের মর্যাদা দেওয়া হয়। এখন তা বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তরিত হয়েছে। ইসলামী ঐতিহ্যের পাশাপাশি এখানে ভাষাতত্ত্ব, শিক্ষাবিগ্যান, নার্সিং, ফার্মাসি, গনস্বাস্থ্য, বি বি এ, এম বি এ, তথ্যবিগ্যান প্রমুখ শাস্ত্রের ব্যাবস্থাকরা হয়েছে। ২০০৭-০৮ আর্থিক বছরে মাদ্রাসার পরিকাঠামো উন্নয়ন খাতে প্রায় ৩০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়েছে। বরাদ্দ হয়েছে আরও বেশী টাকা। অদূর ভবিষ্যতে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহু বিষয়ে বৃত্তিমূলক পাঠদানের পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে ছাত্রছাত্রীরা সেই শিক্ষাকে জীবিকার কাজে যথাযথভাবে লাগাতে পারে। মুখ্যমন্ত্রীর তহবিল থেকে ইতোমধ্যেই মেধা ও প্রয়োজনভিত্তিক মান্দন্ডে ৬১৯৭ জনকে ৪ কোটি ৪৯ লক্ষ টাকা প্রদান করা হয়েছে। ২০০৮-০৯ এ ৮৫০০ জন ছাত্রছাত্রীকে দেওয়া হবে ৬ কোটি টাকার মতন। ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য বিনা সুদে ৪২৯ জনকে ২ কোটি ১০ লক্ষ টাকা শিক্ষাঋণ দেওয়া হয়েছে। ২০০৮ এ তা বৃদ্ধি করে ৫০০ জনকে ৩ কোটি দেওয়া হবে। কারিগরী প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প নিগমকে ১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যে। এছাড়া কারইগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাসহ দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৫ কোটি টাকা। সংখ্যালঘু ছাত্রীদের সুবিদার্থে গোটা রাজ্জ্যে ১০ টি ছাত্রী আবাস নির্মিত হয়েছে। চারটি ছাত্রী আবাসের কাজ চলছে। এগুলির রক্ষণাবেক্ষনের জন্য ৪ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। কলকাতায় কর্মরত মুসলিম মহিলাদের আবাস নির্মানের কাজ শুরু হয়েছে, যার জন্যে খরচ ধরা হয়েছে আনুমানিক ২ কোটি টাকা।

ওয়াকফ সম্পত্তি

ওয়াকফ সম্পত্তির উদ্দেশ্যেই হলো জনসাধারণের সেবাকার্য্যে তা যাতে ব্যাহৃত হয়। সেই লক্ষ্যে অতিরিক্ত ২ কোটি টাকাসহ মোট ৭.৬ কোটি টাকা ওয়াকফ বোর্ডকে দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে এই টাকার পরিমাণ বাড়ানো হবে। এছাড়া, পশ্চিমবঙ্গে ওয়াকফ সম্পত্তির পূনরূদ্ধার, নথিভুক্তকরণ ও সমীক্ষার কাজে হাত দেওয়া হয়েছে। বোর্ডের সমস্ত দলিল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ কম্পিউটারের মাধ্যমে যাতে করা যায়, সেই ব্যাবস্থা নেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য, আবাসন প্রভৃতি বিষয়েউল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। মানব উন্নয়নের প্রতিটি সূচককে সামনে রেখে রাজ্যের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলের মানচিত্র অনুযায়ী উন্নয়ন ঘাটতি চিহ্নিতকরণের কাজ শুরু হয়েছে। আর এই উদ্দেশ্যে রাজ্যের ১২ টি জেলায় সংখ্যালঘু ও মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তরের জেলা অফিস খোলা হয়েছে। যাতে প্রতিটি সমস্যাকে সুচারুভাবে চিহ্নিত করে সমাধানের লক্ষ্যে এগোনো যায়।

দেশের একটি বৃহত্তম সংস্থা ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গানাইজেশন সাচার প্রতিবেদনকে ‘যথার্থ’ আখ্যা দিতে নারাজ। এমনকি এমন অভিমত শোনা যায় যে, নির্বাচনের দিকে লক্ষ্য রেখে এই প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে। সাচার রিপোর্টের একটি বড় দূর্বলতা হলো, এই প্রতিবেদনে কেবল উর্দূভাষী মুসলিমদের ওপর জোর দিয়েছে, ভুলে গেলে চলবে না অন্য ভাষালম্বী মুসলিম আছে এই রাজ্যে ও রাষ্ট্রে। তামিল মুসলিমদের কথা এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। তেমনি অনুল্লেখিত এই রাজ্যের বহু উন্নয়নমূলক তথ্য। ভূমি, ভূমিসংস্কারম, বর্গা প্রভৃতি ফলে একটি বড় অংশের মানুষ উপকৃত । গত তিন দশক ধরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অন্তত এই রাজ্যে সুস্থ্যভাবে, সম্প্রীতির উপর ভর করে শান্তিতে আছেন। তবু সাচার প্রতিবেদনকে এই রাজ্যে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে, তৈরি হয়েছে একশন প্ল্যান। যে সব মুসলিম প্রধান এলাকায় বিদ্যালয় নেই, সেখানে বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। ৪০ % মুসলিমপ্রধান গ্রামে স্বাথ্যসুবিধের অভাব আছে বলে এই প্রতিবেদনে জানিয়েছে। সেই মোতাবেক রাজ্যসরকার তড়িঘড়ি ব্যাবস্থা গ্রহণকরেছে এবং করছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারএই পদক্ষেপসমূহ কার্য্যকারী করার উদ্দেশ্যে একটি সাব-প্ল্যান তৈরি করে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কেন্দ্রীয় সরকার সেই প্ল্যান মঞ্জুর করে নি। ফলে স্বীমিত ক্ষমতার মধ্যে রাজ্য সরকার সাধ্যের অতিরিক্ত চেষ্ঠা করে যাচ্ছে যাতে এ রাজ্যের সংখ্যালঘুরা বাঁচার উপকরণসমুহ থেকেবঞ্চিত না হন।

সাচার কমিটির রিপোর্ট সম্পর্কে অপপ্রচার চালিয়ে বলা হচ্ছে এই রাজ্যে মুসলিমরা পিছিয়ে পড়েছে। ভাবখানা এইরকম যেন সাচার রিপোর্ট হয়েছে কেবল পশ্চিমবঙ্গের জন্যে। তা নয়, সাচার রিপোর্ট গোটা ভারতের মুসলিম জনগনের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত অবস্থান সম্পর্কে প্রতিবেদনে তৈরি করেছে। এটা নয় যে অন্য রাজ্যে মুসলিমরা এগিয়ে গেছে কেবল এই রাজ্যই পিছিয়ে পড়েছে। পাশাপাশি এটাও নয় যে এই রাজ্যে আগে মুসলিমরা এগিয়ে ছিলো, কেবল গত তিরিশ বছরে পিছিয়ে পড়েছে। তথ্য, পরিসংখ্যান তা বলে না। সাথে সাথে এটাও মনে রাখা দরকার এই রাজ্যে মুসলিম অনগ্রসরতার একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। যেমন ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে হিন্দুরা বেশির ভাগ জমিদার হলো, মুসলিমরা বেশীরভাগই চাষী। কয়েকটা মাদ্রাসা, মক্তব ছাড়া মুসলিম চাষীদের বড় অংশের ছেলেমেয়েরা আধুনিক পড়াশুনার পথে গেলো না। তারপর ১৯৪৭ সালের দেশভাগের ফলে রাজ্যের মুসলিমদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একটি ভালো অংশ তৎকালীন পূর্ববঙ্গে (বাংলাদেশে) চলে গেলো।

রাজ্যের মুসলিমরা দারূণ এগিয়ে গেছে, এই দাবি বামফ্রন্ট সরকার করে না। তাই তাদের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য রাজ্য সরকার নানা ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং করে চলেছে। সাচার রিপোর্ট প্রকাশিত হবার বহু পূর্ব হতেই সে কাজ করে চলেছে। যেমন মাদ্রাসা শিক্ষার বিস্তার এবং পাঠ্যপুস্তক আধুনিকিকরণ আজ গোটা দেশ জুড়ে সমাদৃত। ১৯৭৭ সালের আগে ছিলো ২৩৬ টি মাদ্রাসা। রাজ্য সরকার ব্যয় করতো মাত্র ৫ লক্ষ্য টাকা। বর্তমানে আছে এই রাজ্যে ৫০৬ টি মাদ্রাসা। এতে সরকার ব্যয় করে ২৩৩ কোটি টাকা। ১৭৫১২ টি আই সি ডি এস প্রকল্পের মধ্যে ৬৮৩১ টি মুসলিম প্রধান এলাকায় হয়েছে। মুসলিম বাড়ির মা , বোনেরাই সেখানে কাজ করছেন। সরকারী দপ্তরে ব্যয় অংশের কম করে ১৫ শতাংশ সংখ্যালঘু অংশের উন্নয়নের জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে। সেই সাথে মনে রাখা দরকার যে রাজ্য সরকার সাচার রিপোর্টকে অস্বীকার করেনি বরং তারা যথার্থ গ্রহণ করে প্রথম কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সাচার সুপারিশ রুপায়িত করার দাবি জানিয়ে সনদ পেশ করেছে। সেই সাথে সাথেপশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ঐ রিপোর্টের কিছু অসম্পূর্ণতা তুলে ধরেছে। যেমন ভূমি সংস্কারের সাফল্য ও পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ এই রাজ্যে মুসলিম জনগনকে কতখানি উপকৃত করেছে তার তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ থাকলে ভালো হতো। ভালো হতো যদি বিদ্যালয় ও মাদ্রাসাগুলিতে কর্মরত মুসলিম শিক্ষকদের হিসেবের মধ্যে আনা হতো।

কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা


সারা দেশে মুসলিম নাগরিকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান কি, শিক্ষার হাল কি সে সব জানার জন্যে প্রধানমন্ত্রীর তৈরি করা হয় এই কমিটি। বহু কমিটি ও কমিশন দেশে হয়। তার প্রতিবেদনগুলি প্রায় কেউ উল্টেও দেখেন না। কিন্তু বিচারপতি সাচার ও তাঁর প্রতিবেদন‘সেলিব্রেটির’ সন্মান পাচ্ছে। আগেও মুসলিমদের নিয়ে প্রতিবেদন হয়েছে, বামপন্থীরা ছাড়া এসব কেউ মনে রাখেননি। তবে এই আলোচনা যে আজ সারা দেশে হচ্ছে সেটা ভালো। পৃথিবীর কোনো প্রতিবেদনই ১০০ ভাগ ঠিক বা সফল নয় তাও নয়। অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন এটা কোনো রাজ্যের প্রতিবেদন নয়, সারা দেশের। এখানে বলা আছে সারা দেশের মুসলিমরা পিছিয়ে আছে, কেবল পশ্চিমবঙ্গ, বিহার বা আসাম নয়। কেন তারা এতো পিছিয়ে, কেন তাদের শিক্ষায় দূরবস্থা তার জবাব দিতে হবে জাতীয় সরকারকে, বিশষ করে যারা একটানা বহুকাল সরকারে ছিলো সেই কংগ্রেস কে।
মুসলিমদের উন্নয়ন ঘটাতে ‘এখনই কিছু করতে হবে’ বলে প্রধানমন্ত্রী কাছে প্রস্তাব রাখে কমিটি। ইউ পি এ সরকারের কোনো হেলদোল দেখা যায় নি। সামান্য কিছু অর্থ বরাদ্দ, একটি মন্ত্রক তৈরি আর সস্তায় বড় বড় বক্তৃতা ছাড়া কিছু করেনি দিল্লীর কর্তারা। বামপন্থীদের ধারাবাহিক দাবি সত্ত্বেও ইউ পি এ সরকার সংসদে এব্যাপারে আলোচনা মুখোমুখি হয়নি। কোন না কোন অজুহাতে আলোচনা এড়িয়ে গেছে। কেন? পরিকল্পনা কমিশন ১১ প্ল্যান-এ সংখ্যালঘু দপ্তরে ৭ হাজার কোটি টাকা ধার্য করেছে (২০০৭-২০১২), ২০০৮-০৯-এ ছিলো ১০১৩.৮৩ কোটি, দ্বিতীয় বর্ষে ১০১৬.৫০ কোটি। কিন্তু প্রথমবর্ষের ধার্য টাকার ৩৪৯ কোটি টাকা খরচ করতেই পারেনি। ইউ পি এ সরকারের সংখ্যালঘুদরদ তাহলে কেমন? উন্নয়নের জন্য ৯০ টি সংখ্যালঘু প্রধান জেলায় বহুমুখী উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়া ও অর্থ বরাদ্দের কথা প্রত্যেক জ়েলার জন্য ধার্য হয়েছে ৪২ কোটি টাকা মাত্র। ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০০৮ ৩৭ টি জেলার জন্য টাকা দেওয়া হয়েছে জেলা পিছু ৫.২৯ কোটি করে। কে করবে? নিশ্চয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার নয়। ইউ পি এ সরকারকে করতে হবে- কিন্ত হায়? সে তরী তো এখন ডুবছে। কি জবাব দেবেন মনমোহনজী?

শিক্ষার উন্নয়নের জন্যে কমিটি করেছিলো মন্ত্রী ফতমি সাহেব কে দিয়ে। একাদশ পরিকল্পনায় ৫৪৩৪.৪০ কোটি টাকার দাবি তৈরি হয়েছে। সব উপেক্ষা করে বরাদ্দ সামান্য। সংখ্যালঘু নিবিড় এলাকায় পলিটেকনিক, আই টি আই, প্রশিক্ষণকেন্দ্র ইত্যাদি প্রতিষ্রুতিই কেবল পাওয়া গেছে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে। মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণের জন্য ৬২৫ কোটি টাকার প্রস্তাবে পাওয়া গেছে ২০০৭-০৮ - এ ৪.৫ কোটি আর এবছর ৪৫ কোটি। সংখ্যালঘুদের ব্যাঙ্ক ঋণের দরকার বেশী। ছোট শিল্পকর্মের সঙ্গে তারা অনেকেই যুক্ত। ব্যাঙ্কগুলিকে অগ্রাধিকারর ভিত্তিতে ঋণ দিতে বলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। বলা হয়েছে সংখ্যালঘুদের ঋনদান ‘প্রায়রিটি সেক্টার’। কিন্তু বিগত ৩ বছরের হিসাবে দেখা যাচ্ছে সংখ্যালঘুদের ঋণ দেবার পরিমাণ কমেছে। ২০০৩ সালের ৩১ শে মার্চ ছিল ৯.৪৭ %, ২০০৬ সালের ঐ সময়ে ৯.৩৫ %। কী জবাব আছে ইউ পি এ-র কাছে? মাদ্রাসা শিক্ষার শংসাপত্রের সন্মান মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাব সাচার কমিটির প্রতিবেদনের। কিছু করেনি কেন্দ্রীয় সরকার। উর্দূ ভাষার প্রসার ও মর্যাদা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। কোনো উদ্যোগ নেই। এবার আসন পুণর্বিন্যাস করে লোকসভা নির্বাচন হচ্ছে। সাচার কমিটির পরামর্শের মধ্যে ছিলো, ভালো সংখ্যাক সংখ্যালঘু আসনগুলি যেন তফশিলী জাতি উপজাতি সংরক্ষিত হয়ে না যায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ৫০ % এর ও বেশী সংখ্যালঘুর বাস, কিন্তু সংরক্ষিত হয়ে গেছে। কী উদ্যোগ নিয়েছিলো কেন্দ্রীয় সরকার এটা আমরা জানতে চাই। একমাত্র বামপন্থীরা ২০০৭ , ৫ ই এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর কাছে সংখ্যালঘু উন্নয়নে কী করা উচিত তা দিয়েছে- ‘ Charter for advancement of Muslim community’। তাতে মোট বাজেটের ১৫ % বরাদ্দ, সাব-প্ল্যান তৈরি , ব্যাঙ্ক ঋণ বৃদ্ধি সঙ্ক্রান্ত দাবি জানানো হয়। সবক’টি থেকেই ফলাফল শুন্য। শুধু রাজ্যসরকারকে দোষ দিয়ে আর সাচার কমিটির প্রতিবেদনের কথা বলে লাভ কি?। এ রাজ্যের এক চতুর্থাংশ মানুষ সংখ্যালঘু। ৩২ বছরে বামফ্রন্টের বহু সাফল্যের কারিগর সংখ্যালঘুরা। বামপন্থীরা যে দর্শন চিন্তায় নিজেদের নিয়োজিত করেন তাতে সংখ্যালঘু, পিছিয়ে পড়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা স্বাবাভিক। সেই কারণে বামপন্থীদের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস, চাহিদাও বেশী। এতে কোন অন্যায় নেই। এরাজ্যের সংখ্যালঘুরা অন্যান্য রাজ্যগুলির মতন নয়, যাদের সঙ্গে তুলনা আসছে। বেশীরভাগই কৃষিজীবী। ভূমিসংস্কার, মজুরি বৃদ্ধির লড়াইতে সংখ্যালঘুরা উপকৃত হয়েছেন। এর কেউ বিরোধিতাকরলে অসত্য বলবেন। কিন্ত কর্মসংস্থান-এ বেশ খানিকটা পিছিয়ে আছে, রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা ছিল না- কংগ্রেসের শাসনকালে দাঙ্গা নিত্যসঙ্গী ছিলো। দ্বিত্বীয়ত, সামাজিক অস্থিরতা ছিল- মুসলিমরা ভাবতো যে কোনো সময় পূর্ব পাকিস্তানে চলে যেতে হবে। সুতরাং শিক্ষায় নজর দেয়নি। এখন বিগত ৩ দশক রাজনৈতিক সামাজিক স্থিতাবস্থার সময়। এখন দেখা যায়, লক্ষ্য লক্ষ্য মুসলমান বাড়ির ছেলেমেয়েরা স্কুল/কলেজে পড়ছে, কারিগরি শিক্ষা নিচ্ছে, মাধ্যমিক পরিক্ষায় রাজ্যে প্রথম হচ্ছে, জয়েন্ট এন্ট্রান্স এর মতন কড়া পরিক্ষায় রাজ্যে প্রথম হচ্ছে, সিভিম সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৩০/৪০ জনের মধ্যে সংখ্যালঘু ছেলেমেয়েদের নাম থাকছে। এই উন্নয়ন কে কেঅস্বীকার করতে পারে?এই মধ্যবিত্ত্বউদ্ভব কে আমাদের আহবান করতে হবে। এদের দরকার উচ্চশিক্ষা, শহরে বাসস্থান, ভালো স্কুল, মর্যাদা ও কর্মসংস্থান যার সবরকম প্রয়াসই বামফ্রন্ট সরকার করছে। সাচার কমিটির রিপোর্ট বেরোনোর অপেক্ষায় বামফ্রন্ট বসে থাকেনি। এবং যে তৎপরতার সাথে রাজ্য সরকার কাজ করেছে তার কিছুটা বিবরণ আমার আগেই দেওয়া আছে।

এবার এক নজরে দেখা যাক যে আমাদের দেশে সংখ্যালঘু ভাইবোনেদের উন্নয়নপ্রকল্পে যে বিপুল কর্মকান্ড উপস্থিত তাতে আমাদের ‘আম আদমির’ কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা কি:

১) সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমিক উত্তীর্ণ বৃত্তিঃ একাদশ পরিকল্পনায় লক্ষ্যমাত্রা ১৫ লক্ষ্য। ২০০৮-০৯ সালের লক্ষ্যমাত্রা মাত্র ২ লক্ষ্য ৩০ হাজার। এর মধ্যে ২০০৯ সালের ১৫ জানুয়ারী পর্যন্ত বৃত্তি দেওয়া হয়েছে ৫৮,৯৫৫ জনকে বা লক্ষ্যমাত্রার ২৩.৫৮ % ছাত্রছাত্রীকে।

২) মাধ্যমিক পূর্ব বৃত্তি প্রদান ঃ একাদশ পরিকল্পনায় লক্ষ্যমাত্রা ২৫ লক্ষ্য বৃত্তি প্রদান। ২০০৮-০৯ সালে মাত্র ৬ লক্ষ্য বৃত্তি। এর মধ্যে ২০০৮ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ১,৯৫,৬৩৭ জন ছাত্রছাত্রিকে বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ৩২.৬১ %।

৩) মেধা ও আয়ের ভিত্তিতে বৃত্তি ঃ ২০০৮-০৯ সালে লক্ষ্যমাত্রা ৪০,০০০ জন থাকলেও বাস্তবে মাত্র ১২,০৫২ জনকে বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ৩০.১৩ %।

৪) মাদ্রাসায় উন্নত শিক্ষা প্রবর্তনের কর্মসূচী ঃ ফতেমি কমিটি এই খাতে ৬২৫ কোটি টাকা বরাদ্দের সুপারিশ করে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার একাদশ পরিকল্পনায় মাত্র ৩২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। এর মধ্যে ২০০৭-০৮ সালে মাত্র সাড়ে ৪ কোটি টাকা ও ২০০৮-০৯ সালে ৪৫ কোটি ৪৫ লক্ষ্য টাকা বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছে। সর্বমোট দু’বছরে মাত্র ১৫.৩৭ % অর্থ বরাদ্দ। এ খাতে প্রকৃত ব্যায়ের কোন তথ্য সরকারী সুত্রে পাওয়া যায়নি।

৫) প্রধানমন্ত্রীর ঘোষনামাফিকফ্রি- কোচিং ও আনুষঙ্গিক প্রকল্পগুলির অধীনে ২০০৭ সালের জুলাই মাস থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ৪১৪৭ জন ছাত্রছাত্রী প্রশিক্ষণ লাভে সমর্থ হয়েছে।

৬) মৌলানা আজাদ এডুকেশন ফাউন্ডেশনের জন্যে ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হলেও প্রকৃত ব্যয় অনেক কম।

৭) প্রধানমন্ত্রীর ১৫ দফা কর্মসূচীতে অগ্রাধিকারের মাধ্যমে ২০১০ সালের মধ্যে মোট ঋণের ১৫ শতাংশ সংখ্যালঘু জনগনকে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে ঋণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রাপকদের হার ২০০৩ সালের মার্চে ছিলো ৯.৮৭ %, তা হ্রাস পেয়ে ২০০৬ সালের মার্চে হয়েছে ৯.৩৫ % । ২০০৭-০৮ অর্থ বর্ষে এই হার সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৯.৬৭ %, যা এখনো ২০০৩ সালের বররাদ্দকৃত ঋণের তুলনায় কম। ২০০৮-০৯ সালে লক্ষ্যমাত্রা ১০ % এ নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হলেও প্রকৃত বাস্তবায়নের কোন পরিসংখ্যান নেই। স্পষ্ঠই সরকার লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছে পৌঁছতে পারছে না।


বামফ্রন্ট সরকার ও সংখ্যালঘু উন্নয়ন

এই প্রবন্ধের শেষে একবার দেখা যাক আমাদের রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নয়নের সার্বিক অবস্থা:

১) কিছুদিন আগে লোকসভায় একটি প্রশ্নের উত্তরে মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, মুসলিম চাত্রছাত্রিদের শিক্ষার অঙ্গনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষে।

২) সারা দেশে প্রাথমিকস্তরে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের গড় হার ৯.৩৯ % এবং আপার প্রাইমারিতে ৭.৬২ %। পশ্চিমবঙ্গে এই হার যথাক্রমে ২৭.৯ % এবং ১৯.৩৩ %।

৩) পশ্চিমবঙ্গে ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে মুসলিমদের জমির অধিকার দেওয়ার বিষয়টি সাচার কমিটি বিবেচনায় আনেনি। রাজ্যে মোট গ্রামীন পরিবারের মধ্যে ৩০.৯ % মুসলিম। তাঁদের হাতেই রয়েছে মোট কৃষিজমির ২৫.৬ %। এব্যাপারে জম্মু ও কাশ্মীরের পরেই পশ্চিমবঙ্গের স্থান।

৪) পশ্চিমবঙ্গের প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের সুযোগ পাওয়া স্বনির্ভর গোষ্টীগুলির ২১.৮ শতাংশ মুসলিম সদস্যের দ্বারা পরিচালিত। সাড়ে ১৭ হাজার আই সি ডি এস প্রকল্পের মধ্যে সাড়ে ৬ হাজার পরিচালিত হয় সংখ্যালঘু এলাকায়।

৫) সংখ্যালঘুদের জন্যে পৃথক সাব প্ল্যান কার্যকরী করেছে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্য বাজেটের ১৫ শতাংশ অর্থ এই খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার এখনো পৃথক সাব প্ল্যানের দাবিতে কর্ণপাত করেনি।

৬) সারা দেশে ২৯ টি রাজ্যের জন্যে কেন্দ্রিয় সরকার মাদ্রাসা শিক্ষায় উন্নয়নের জন্যে বরাদ্দ করেছে মাত্র ৫৫ কোটি টাকা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারই বরাদ্দ করেছে ২২৩ কোটি টাকা।

৭) রাজ্য সরকার নতুন যে ৩৬ টি কলেজ করছে তার মধ্যে ২৬ টি সংখ্যালঘু এলাকায়। ১৬০০ নতুন আপার পাইমারি স্কুলের মধ্যে আর্ধেক হবে সংখ্যালঘু এলাকায়। সংখ্যালঘু ছাত্রীদের জন্যে ১৮ টি আবাসিক স্কুল হচ্ছে। মুসলিমদের উন্নত শিক্ষার সুযোগ সুবিধে দিতে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করা হয়েছে।

৮) সংখ্যালঘু বসবাসকারী রাজ্যের ১২ টি জেলায় সংখ্যালঘু উন্নয়নের জন্যে বিশেষ অফিস খুলেছে রাজ্য সরকার। দেশের মধ্যে এমন উদ্যোগ প্রথম।

৯) সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রশিক্ষন দিতে রাজ্য সরকার ৫ কোটি টাকা খরচ করছে। সংখালঘু মহিলাদের ব্যবসা শুরু করার জন্যে ঋণ দিতে ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

১০) সাম্প্রতিককালে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের ৬১৯৭ জনকে মাধ্যমিক পূর্ববর্তী এবং ২২২৩ জন ছাত্রছাত্রীকে মাধ্যমিক পরবর্তী শিক্ষার জন্য স্কলারশিপ দেওয়া হয়েছে। উর্দূভাষীদের শিক্ষার উন্নতির জন্যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। উর্দূভাষা চর্চার জন্যে উর্দূ একাদেমিকে ২.৭ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।

বৃহস্পতিবার, ৭ মে, ২০০৯

আর কত দিন ... ~ পারিজাত ভট্টাচার্য্য

আরো কত দিন এরকম সন্ত্রাস চলবে এই রাজ্জ্যে। দার্জিলিং জেলাতে ভোট দিতে গিয়ে শুনলাম যে সেখানকার ভোটার দের বাধ্য করা হচ্ছে, মোর্চাকে ভোট দেবার জন্যে। মুসলিম এবং তিব্বতী সম্প্রদায়ের মানুষকে সন্ত্রস্ত করা হচ্ছে। সাধারণ ভোটারদের জোর করে তুলে নিয়ে, হাতে ভোটের কালি মাখিয়ে, ই ভি এম অবধি যেতে দেওয়া হয়নি। ই ভি এম এর কাছে বসে, মোর্চার এক জঙ্গী নেতা, তিনিই নিজেই ভোটার দের কষ্ট লাঘব করে, নিজের হাতেই ভোট দিচ্ছেন, সব ভোটার দের হয়ে। সবই ঘটলো, নির্বাচন কমিশন কে বূড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে। সাথে আছেন আমাদের নির্বাক দর্শক রাজ্য প্রসাশন। প্রশংগত, বিমল গুরং নির্বাচনের বেশ কয়েক দিন আগেই হুমকি দিয়েছিলেন, যে দার্জিলিং এ ওনারদের ইচ্ছা মতো ভোট হবে, কংগ্রেসীদেরও ছাড়া হবে না। কংগ্রেস অবশ্য এই বিশয়ে চুপ। ঠিক যেমন ভাবে হুমকি দিয়েছিলেন আমাদের লালগডের নব্য নায়ক ছত্রপতি ছত্রধর। ঊত্তরের নির্বাচনে এই সন্ত্রাসের পরেও রাজ্য প্রসাসনের পক্ষ্য থেকে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন যে বিরোধী দের সাথে আলোচনা করতে হবে। মজার ব্যাপার, একদিকে আলোচনা চলবে, আর একদিকে আমাদের পার্টীকর্মী খুন হবে, মোর্চার, তৃনমুলি আর মাওবাদীদের হাথে। দার্জিলিং এ কয়েক ব্যাটেলিয়ন কেন্দ্রীয় পূলিশবাহিনী আসার কথা ছিলো, কোথায় তারা? তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে পাঠানো হয়নি। ভালোই সক্রীয় সাম্রাজ্যবাদ, কমিঊনিষ্ট নিধন যজ্ঞ্যে। গাড়ীর নম্বর প্লেটে জি এল লেখা, সরকারী অফিসের বোর্ডে গোর্খাল্যান্ড সরকার লেখা, রাস্তা কাটা, গাছ ফেলা আবার অরন্যে সেই দূর্মুল্য গাছ, চোরাচালানকারীদের হাথে বিক্রী করা, সি পি এম এর কর্মি/ সমর্থক মারা, সবই চলছে নির্দ্বিধায়ে। আমরা মার খেয়ে যাবো, নন্দীগ্রাম, লালগড় দার্জিলিঙ্গে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া চলছে, তার মধ্যে চলছে বুথ দখল, নির্বাচনী কর্মী খুন, মাইনবিষেশগ্য রা তৎপর। সাথে দৈনিক সি পি এম পার্টি কর্মী খুন। কোনো সি বি আই তদন্তের দাবী নেই, সুশীল সমাজ চুপ এবং উলটে ওনারা আনন্দিত, নির্লজ্জভাবে বৈদুতিন সংবাদ্মাধ্যমের কাছে ওনাদের স্বীকার, তারা আনন্দিত এই নিধনযজ্ঞে। গোয়েবেলসের বংশধরেরাও তৎপর। আনন্দবাবুরা আনন্দিত। আজ অর্থাৎ ৭/০৫/২০০৯ এ এই বাংলার দ্বিতিয় দফা নির্বাচন। সকাল থেকেই অশান্ত, নন্দিগ্রাম, আসানশোল, কৃষ্ণনগর ডোমকল। চলছে তৃনমুলী, মাওবাদী আর কংগ্রেসী দের সন্ত্রাসের খেলা। বুথ দখলের এক প্রতিযগিতা। বিমল গুরং এর রেকর্ড ভাংগতে হবে আর সি পি এম নিধন যজ্ঞে হিটলারকেও হারাতে হবে। এই শপথ নিয়েই বোধহয় মা-মাটি-মানূষ এর উদ্দেশে নিজেকে “উৎসর্গ” করে, দিদি আর তার বাহিণী ময়দানে নেমে পড়েছেন। মারা যাচ্ছে সাধারণ পার্টিকর্মি- সমর্থক। তাদের নিরাপত্তা নেই। আতঙ্কের দিন গুনছেন ওনারা। কবে প্রান যায়। সাথে আছে পার্টীর প্রতি দায়বদ্ধতা, ভালোবাসা। শহীদ হচ্ছে। কিন্ত এরকম আর কতদিন? বাংলার মাটি আর কতদিন শহীদের রক্তে ভিজবে। প্রশাসন চুপ। পার্টি রাজ্য কমিটি বলছেন, ধৈর্য্য ধরতে। এদিকে মরছে পার্টিকর্মিরা। কোথায় তাহলে গনতন্ত্র। ২৩৫ তা আসন তো জানতাম, গনতন্ত্র (সাংবিধানিক পরিভাষায়)। ১১৫১ টি পরিবার, সিঙ্গুরে জমিদাতা, (মোট জমিদাতাদের ৮৫%) , সেটাও তো জানতাম গনতন্ত্র। কিন্ত সেই গনতন্ত্র এবং মানুষের প্রত্যয় এবং বিশ্বাসের একি পরিনিতি। গনতন্ত্র হত্যাকারীদের দলেদের সঙ্খায়ও ত খুব তাৎপর্যপূর্ণ নয়। তাহলে তো বোঝা যায় যে গনতন্ত্র হত্যাকারীদের যুগ, ১৯৭০-৭২ এর আধা-ফ্যাসিস্তদের যুগ আবার ফিরে আসলো। প্রশাসন নির্বিকার, সাধারন মানুষ তাই দিন গুনছে আবার আতঙ্কের দিনের অপেক্ষায়। অনেকপার্টীকর্মী রা ্তাই নিরুপায়ভাবে দিন গুনছে, ন্রৃশংসভাবে খুন হবার অপেক্ষায়।

-----------------------------------------------------------------------------------

May 7, 2009


Press Release



Shri Jogendra Sharma, Member, Central Secretariat of the Communist Party
of India (Marxist) met the Dy. Election Commissioner Shri Balakrishnan
this afternoon to appraise him of the incidents of rigging in the
Nandigram area of 210 Nandigram AC under 30 Tamluk Parliamentary
Constituency in West Bengal.


He handed over a memorandum listing out 42 polling booths that were
forcibly captured by hoodlums belonging to the Trinamul Congress. CPI(M)
polling agents were not allowed to enter these booths. Several CPI(M)
workers have suffered injuries in the attacks. It was also pointed out
that the Biman Basu, Secretary of the West Bengal State Committee of the
Party and the Secretary of the Purba Medinipur District Committee had
written to the West Bengal CEO on several occasions detailing the
situation and seeking his intervention to ensure free and fair polls in
the constituency.


The Party has demanded repoll in 50 polling booths in the Tamluk
Parliamentary constituency.

মঙ্গলবার, ৫ মে, ২০০৯

ডাক দিয়ে যাই ~ তরুন মজুমদার

তরুন মজুমদারের নতুন সিনেমা, ডাক দিয়ে যাইঃ









সুমনা মান্ডি কে মনে রেখে ~ জয় ব্যানার্জী


একটু থামি, চলতে চলতে,
একটু থামার জন্য।
ঊষর মাটি, ধুসর আকাশ,
ছিলো তো আমার ই জন্য,
একটু থামি, পিছন ফিরি,
তোমায় দেখতে চেয়ে,
পিছনে জ্বলছ উতাল আগুনে,
পুড়ছি, তোমার মেয়ে।
চার বছরের অঙ্গার আমি,
তোমার ছোট্ট 'সুমি',
চিৎকার করি,
মা-মাগো-মা,
কেন এত উজ্জ্বল তুমি?
আমি থেমে থাকি, মা থেমে থাকে,
জ্বলছে জন্মভুমি।
হাহাকার বুকে, বাবা আমার
বুক চাপড়িয়ে কাঁদে,
তোমার পোড়া, কংকাল হাত,
রাখলে আমার কাঁধে।
হাত ধরেছো মা? চলো এইবারে
পিছে থাক যারা বন্য
শেষবার থামি, আঙ্গার গায়ে,
বৃষ্টি মাখার জন্য

কারা যেন উল্লাসে মেতেছিল - এই ঘটনা নিয়ে একটি তথ্যচিত্র :





সোমবার, ৪ মে, ২০০৯

মুখোমুখি নিরুপম সেন

একটি বেসরকারি বাংলা news channel এ পশ্চিম বাংলার শিল্প মন্ত্রি নিরুপম সেনের সাক্ষাৎকার:

১ -

২ -

৩ -

৪ -

৫ -


৬ -


৭ -

৮ -

৯ -

১০ -

১১ -

বিদেশে কর্মরত ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

বিদেশ ব্যপারটা আমাদের অনেকের কাছেই বেশ স্বপ্নময় একটা অনুভূতি। বিশেষকরে যাঁরা কখনোই দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরে পা রাখেননি তাঁদের ক্ষেত্রে তো কথাটা অনেকটাই ফলে যায়। শহুরে বাঙালির পক্ষে বিদেশের ছোঁয়াচ এড়ানো কঠিন। আজ এবাড়ির ছেলে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের জলপানি পাকড়ায় তো কাল, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ওবাড়ির মেয়ে কালাপানি পার হয়। আপনার বাড়ির দুপাশের দুই প্রতিবেশির কথাই কইচি মশায়, আপনার ভাগ্যে যে সেই শিকে ছেঁড়েনি সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। আসমানী ডানায় ভর করে যদি সত্যি ঘুরে আসতেন স্যার, তাহলে এই লেখা কি আর হাতে তুলে দেখতেন? সংস্কৃতির জন্য তো “বাঙ্গালি মননের সঙ্গী” আছেই। আমারও দাদা আপনার মতোই অবস্থা। দুপাশে না হোক, ডান পাশের বাড়ির ছেলেটি বিদেশ ভ্রমন করে বছরে অন্তত একবার তো বটেই (আর বাড়ির বাঁ দিকে পানা পুকুর)। সে কর্মসূত্রে বিদেশ থেকে ফিরলে দু-চারটে চকোলেট, সিগারেট (বদলোকে বলে বাড়তি) আমার ও পাওনা হয়।

কিছুদিন আগে একদিন সন্ধেবেলা দেখি বাড়ির সামনে ট্যাক্সি। আর তাতে পেল্লায় দুখানা স্যুটকেস ঢোকাবার চেষ্টায় ছেলেটি গলদঘর্ম হচ্ছে। জিজ্ঞেস করেই ফেললাম – “ ভায়া আবার চল্লে নাকি?”। হেসে উত্তর দিল – “ হ্যাঁ, আবার বাক্স-প্যাঁটরা বেঁধে বেরিয়ে পড়তে হলো”। এটা একবিংশ শতাব্দী। বিদেশ যাত্রা কপালে না থাক, একটা ই-মেইল ঠিকানা অন্তত আমার আছে। ঝট করে একটা চিরকূটে সেইটা লিখে দিয়ে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে বেশ গর্বের সঙ্গে বললাম – “সময় পেলে মেইল কোরো”।

তা সে চলে যাবার কিছুদিন পর তার কথা প্রায় ভুলেই গেছি। সে বিদেশে গিয়ে কেমন তোফা আরামসে দিন কাটাচ্ছে সেই বাবদে খবর নিয়ে তাকে এক কলম লিখেও ছিলাম ই-মেইল এ। সে ট্যাক্সি তে ওঠার আগে নিজের ঠিকানাটা মনে করে দিয়ে গিয়েছিল। ইতিমধ্যে মাসখানেক পার হয়েছে। একদিন ছুটির দিন দেখে পাড়ার সাইবার ক্যাফে তে ( যেখানে খাবার এবং পানীয় পাওয়া যায় সেটা কি তবে খাইবার ক্যাফে?) ই-মেইল খুলে দেখি সেই ছেলেটি কিছু লিখেছে। প্রথমে ভেবে ছিলাম “কেমন চলছে? আমি ভালো” গোছের কিছু একটা হবে। কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখি তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু লেখা। শুরু করেছিলাম বেশ কৌতুহল নিয়ে। কিন্তু পড়তে পড়তে দেখলাম মনটা কিঞ্চিৎ ভারি হয়ে গেল। শুনবেন সে কি লিখেছিলো? তার জবানীতেই লিখছি, কোথাও কোন পরিবর্তন না করে।

- সক্কাল বেলা উঠতে হয় এখানে। সেই ভোর ৪টে। উঠেই প্রথম কাজ, একরাশ ঘুম চোখে নিয়ে গ্যাস জ্বেলে ভাত বসানো। নইলে খাবো কি? চোখের ভেতর কর কর করে আর একটু ঘুমের জন্য। ভাত হতে হতে বাথরুমের সব কাজ সারতে হয়। চান টান করে তোয়ালে জড়িয়ে বেরিয়ে ভাতের ফ্যান গালা, আর ফ্রীজ থেকে গতকাল রাতের তরকারি বের করে প্যাক করা। অন্যদিকে হিম-ঠান্ডা দু টুকরো পাউরুটিতে হয় জ্যাম মাখিয়ে নয়ত ততোধিক বিস্বাদ একটা সালামি, ওই দুটো পাউরুটির মধ্যে ভরে কোনরকমে জল দিয়ে গিলে খেয়ে নেওয়া। তারপর বাসন মেজে, বিছানা তুলে, হুড়োহুড়ি করে জামাকাপড় গলিয়ে (সব কিছু ধোপদুরস্থ এবং ফিটফাট হওয়া একান্ত প্রয়োজনিয়), ১০ মিনিটের হাঁটা পথ ৬ মিনিটে পেরিয়ে ভোর ৫ টা ১০ এর বাস ধরা। বাইরে তখন তাপমাত্রা হিমাঙ্কের বেশ কিছুটা নিচে, তার ওপরে শনশনে হাওয়া।

বাসে ১৫ মিনিটে রেল স্টেশন। এটা প্রান্তিক স্টেশন, তাই বসতে পাওয়ার ঝামেলা নেই। ৫ টা ৩৪ এর ট্রেন এ, জানলার ধারে বসে ল্যাপটপটা ( নিজের নয়, কোম্পানির দেওয়া) বের করে দিনের কাজ শুরু করি। পৌঁছেই একটা মিটিং এ ঢুকতে হয়, এটা রোজকার রুটিন। ট্রেন পেরোয় একের পর এক স্টেশন। সময় পেরোয় তার চেয়েও দ্রূতগতিতে। গন্তব্যে পৌঁছনোর আগেই মিটিং এর প্রয়োজনিয় কাজকর্ম সেরে ফেলতে হবে। যেখানে ট্রেন এ উঠেছিলাম সেই স্টেশনটা ছিলো দোতলায়, আর আমার গন্তব্য স্টেশন মাটির নিচে। কারন যেখানে আমার অফিস, সেইটা একটা বিশাল শহর, সেখানে থাকার মতো রেস্ত বা হিম্মত ( যত বড় শহর, তার ততো বদনাম) কোনোটাই আমার নেই। কাজেই দুই – দুই মোট চার ঘন্টার দৈনিক রেল-যাত্রা আমার বরাদ্দ। ট্রেন থামলে হুড়মুড় করে নামি, আবার হুড়মুড় করেই সিঁড়ি বেয়ে মাটির ওপরে উঠে আসি। শনশনে হাওয়া সারা শরীরে একটা থাপ্পড় মেরে যায়। পকেটে হাত ঢুকিয়ে মাথা নিচু করে দ্রুত পা চালাই। আরো ২০ মিনিট পায়ে হাঁটতে হবে এই হাড় কাঁপানো ঠান্ডায়, আর কপাল খারাপ হলে তুষারপাতের মাঝে। একবার একটা ওভারকোটের কথা ভেবেছিলাম। দাম দেখে সাহসে কুলোয়নি। ট্যাক্সি নিলে চলবে না, পকেটে অতো পয়সা নেই। তুষারপাতের মধ্যেই মাঝে মাঝে আবার বৃষ্টিও হয়। দু-দিন ভিজেছি তাইতে। রাস্তার একদিকে সমুদ্র, আর অন্যদিকে সারি সারি আকাশ ছোঁওয়া বাড়ি। ঠান্ডায় হাত পা জমে যায়। ক্লান্তিতে এবং ঘুমে কোমর-পিঠ ভেঙে পড়তে চায়। কিন্তু উপায় নেই, সস্তার মজুর যে। ওই যে অফিসটা দেখা যাচ্ছে। আর এই টুকু যেতে পারলেই একটু উষ্ণতা পাওয়া যাবে। কাঁপুনিটা কমবে আর আঙ্গুল গুলোয় সাড় ফিরে আসবে।

অফিসে ঢুকে এক কাপ গরম......... সময় নেই, সময় নেই, মিটিং এর দেরি হয়ে যাচ্ছে, এখুনি ঢুকতে হবে কনফারেন্স রুমে। সেখানে ঢুকে সাজাই, কাগজপত্র, প্রোজেক্টর, টেলিফোন। এখূনি ক্লায়েন্টের লোকজন এসে পড়বে, তার আগে সব ব্যবস্থা নিখুঁত হওয়া চাই। ক্লায়েন্টের দিকের লোকজন আসতে থাকে। হাতে গরম কফির কাপ, কারোর হাতে সদ্য সেঁকা মুচমুচে স্যান্ডুইচ। মনেপড়ে যায় সকালের খাওয়া সেই দু-পিস পাউরুটি কখন হজম হয়ে গেছে এই ঠান্ডায় হেঁটে আসতে আসতে। তবু হাসিমুখে গলায় ঝূলতে থাকা টাই টা টানটান করে নিজেকে “প্রেজেন্টেবল” করার চেষ্টা করে যেতে হয়। যদি ক্লায়েন্টের কাছ থেকে পাওয়া যায় একটা প্রশংসা। সবকিছু চেপে রেখে, হাসিটি ঝুলিয়ে রাখি ঠোঁটের ডগায়। মিটিং শেষ হয় আমার ঘাড়ে আজকের রাজ্যের কাজের বোঝা চাপিয়ে। মুখ গুঁজে পড়ে থাকি কম্পিউটারের পর্দার সামনে। ঘড়ির কাঁটা বেলা ১২ টার ঘর পেরয়। পেটের ভেতর আগুন জ্বলতে থাকে। সাত ঘন্টা আগে খাওয়া ২ টুকরো পাউরুটি সেই আগুনটাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনা। টিফিন কৌটোটা খুলি। জমে পাথর হয়ে যাওয়া ভাত আর আলু চামচ দিয়ে কেটে কেটে মুখে তূলি। কৌটোর আকার পেটের খিদের চেয়ে একটু ছোট মনে হয়, তাই পেট ভরে জল খেয়ে নি। পেট ভর্তিকরে খেতেও ভয় লাগে, যদি ঘুম আসে তাতে? খেয়ে উঠে এক কাপ কালো কফি নিয়ে বসি। ঘুম তাড়াবার এ হলো মোক্ষম অস্ত্র (এবং এটা ফ্রী তে পাওয়া যায়)। আবার কম্পিউটারের পর্দায়। কি-বোর্ডের ওপরে ঝড়ের মত আঙুল চলে। একে একে বাড়ি যায় সবাই। পাঁচটার পর কেঊ কাজ করেনা এদেশে। ডেডলাইন নিয়ে হিমসিম খাই আমি। কাজ শেষ করতেই হবে। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে সাতটার ঘর পেরোয়। দৌড়ে বেরোই ভুতুড়ে অফিস থেকে। যারা কাজ করে এখানে, তারা অনেক আগেই চলে গেছে। আমি সস্তার বিদেশী মজুর, এসব নিয়ম আমার ওপর বর্তায়না। বিশাল চেহারার সিকিওরিটি গার্ড, আমার দিকে করুনার চোখে তাকায় দেঊড়িতে। আবার সেই হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় ২০ মিনিট হেঁটে পৌঁছই স্টেশনে। ট্রেন আসে, গন্তব্যে পৌঁছই আরো ২ ঘন্টা পরে। উর্ধশ্বাসে ছুটি প্লাটফর্ম দিয়ে, নয়ত বাসটা ফস্কাবো। দূরে বাস এর পেছনের ক্রমশঃ ছোট হয়ে আসা লাল আলোটা দেখতে পাই। জনমানবহীন কোনো এক বিদেশী গ্রামের বাসস্ট্যান্ডে হিম-ঠান্ডায় জমে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে থাকি পরের বাসের অপেক্ষায়। আরো আধঘন্টা পরে আসার কথা সেটার।

ঘরে ঢুকি, রান্না চাপাই। নইলে খেতে দেবে কে? কোনোমতে অল্প কিছু রান্না করে খেতে বসি। সঙ্গে সঙ্গে ফোন বেজে ওঠে। কলকাতার অফিস থেকে রোজকার নিয়ম মাফিক ফোন আসে এই সময়। ফোনে কথা চলতে থাকে। রুটি শুকোয় থালায়। শুকোতে থাকে। রাত ১২ টার কিছু পরে ফোন রাখে ওরা। গোগ্রাসে গিলতে থাকি জুতোর শুকতলার মতো ঠান্ডা রুটি আর তরকারি। শুতে যাই। আগামীকালের জন্য ঘড়িতে ৪ টের সময় আলার্ম দিতে যাবার সময় মনে পড়ে যায় আজ ছিলো পয়লা বৈশাখ।

এইখানেই ওর চিঠি শেষ। হয়ত সবাই এই ভাবে থাকেনা। এটা হয়ত নেহাতই একটা খন্ডচিত্র। বিশ্বায়নের যুগে, এই রকম সস্তা মজুর হতে কার ই বা ভালো লাগে বলুন? মনকে তাই প্রবোধ দি, এ হলো নিতান্তই একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কোন রকমে একটা দায়সারা উত্তর দিই চিঠিটার। সাইবার ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে মনে হলো, এই ভাবে প্রায় ভূমিদাসের মতো জীবনযাপনের অর্থ কি? শুধুই কি দুটো পয়সা? নাকি আজও আমাদের মন থেকে ঔপনিবেশিক দাসত্ব পুরোপুরি যায়নি? স্পষ্টতঃ ওর নিজের কাছেই এটা পরিস্কার, যে পেশাগত চাহিদার বাইরেও ওকে আরো অনেক কিছু দিতে হচ্ছে। এবং নিজের কাছে, নিজেরই সম্মানহানী ঘটছে। ওর পড়াশোনা রয়েছে, বুদ্ধিমান, একে কি দেশে একটা জীবিকার ......।

চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়। সামনে গোলমাল শুরু হয়েছে। কারা যেন একটা বাসে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। কৃষিজমি অধিগ্রহন করে শিল্পস্থাপনের বিরুদ্ধে এ হলো রাজনৈতিক আন্দোলন। আগামীকাল বাংলা বন্ধ।

আলোর নিশানা ~ একটি সিনেমা

১ -

২ -

৩ -

৪ -

৫ -

৬ -

৭ -

৮ -

৯ -

১০ -

১১ -

১২ -

১৩ -

১৪ -