মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

সেটিংয়ের 'পিপিপি' মডেল ~ সুদীপ্ত বসু

অষ্টম শ্রেণির ছাত্রও নেটে সার্চ দিয়ে যে তথ্য খুঁজে পেতে পারে তাই এখন ইডির কাছে রকেট সায়েন্সের মত দুর্বোধ্য!!
চিত্রনাট্য এতটাই দূর্বল যে ইডি এক বিশেষ দুই ব্যক্তিকে তদন্তে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে, এটা না বুঝতে পারাটা ই এখন ' অপরাধ '!

' সেটিং ' এখন আর রাজনৈতিক দলের অভিযোগের পর্যায়ে নেই।
সেটিং ' চেহারা কেমন তা এখন আদালতের এজলাসে খোদ ইডি প্রমাণ করছে।

কেমন করে? আচ্ছা উদাহরণ দেওয়া যাক.

আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের নিউ আলিপুর শাখা, এইচডিএফসি ব্যাঙ্কের হরিশ মুখার্জি রোডের শাখা, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাঙ্কের চৌরঙ্গী শাখা, স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার পার্লামেন্ট শাখা এবং এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের হরিশ মুখার্জি রোড শাখা।

এই পাঁচটি অ্যাকাউন্ট অভিষেক ব্যানার্জির। এর মধ্যে শেষ অ্যাকাউন্টটি অভিষেক ব্যানার্জি নির্বাচনী অ্যাকাউন্ট হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন ২০১৯ সালের ভোটে।

প্রকাশ্যেই সেই তালিকা রয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে অভিষেক ব্যানার্জি ডায়মন্ড হারবারে তৃণমূলের প্রার্থী হিসাবে যে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন তাতেই রয়েছে সেই তথ্য। 
অথচ ইডি নাকি খুঁজে পায়নি!!!

শুধু তাই নয়, অভিষেক ব্যানার্জির সম্পত্তি বলতে ইডি'র জমা দেওয়া রিপোর্টে উল্লেখ আছে কেবল মাত্র তিনটে জীবন বিমার পলিসি! 
সেই তথ্যও অসম্পূর্ণ। অন্তত অভিষেক ব্যানার্জির নির্বাচনী হলফনামা জানাচ্ছে, তাঁর নামে রয়েছে লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির অব ইন্ডিয়ার চারটি পলিসি!

তদন্তকারী সংস্থার বিরুদ্ধে 'সেটিংয়ের' যে অভিযোগ উঠছে রাজনৈতিক মহলে, তাকেই যেন বৈধতা দিচ্ছে ইডি'র এমন দায়সারা রিপোর্ট। 

১৮৮ এ, হরিশ মূখার্জি রোডের বিলাসবহুল 'শান্তিনিকেতন' ভবন। সারা বছর এখানে রাস্তার একাংশ বন্ধ থাকে, ফুটপাতেও চলাচল নিষিদ্ধ। স্থায়ীভাবে রয়েছে পুলিশের কিয়ক্সও। চব্বিশ ঘন্টা সেখানে প্রহরা। 
 লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের দুই প্রাক্তন ডিরেক্টর ( অভিষেক ও রুজিরা নারুলা ব্যানার্জি) ও বর্তমান সিইও অভিষেক ব্যানার্জি থাকেন এই বাড়িতে। অথচ ডিরেক্টরদের সম্পত্তির তালিকাতেই উল্লেখ নেই এই প্রাসাদোপম বাড়িটির!

আরো আছে, তালিকা লম্বা। লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস কিসের সংস্থা, ব্যবসা টা কিসের, আয় করে কিভাবে সেটুকুও নাকি তদন্ত করে জানতে পারেনি ইডি!!

কিন্তু ইডি নিজেদের অপদার্থতা এভাবে নিজেই আদালতে প্রকাশ করছে কেন?? 
হিস মাস্টারস ভয়েস! তদন্ত রিপোর্টে তারই প্রতিফলন!

সারদা কাণ্ডের তদন্ত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ২০১৪ সালে শুরু হয়। সাড়ে নয় বছর পেরিয়ে গেছে।
তদন্তের এই  দীর্ঘসূত্রিতায় লাভ কার?? চোরদের ই লাভ। তদন্তকারী সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে ঠেকলে তখন অভিযুক্তদের অভিযোগই বৈধতা পায়!!!!
চুরি, দুর্নীতি ছাপিয়ে তখন স্বাভাবিকভাবে তদন্তকারী সংস্থার ভূমিকাই মানুষের চোখের সামনে ধরা দেয়!!

ইডি সিবিআই এবং বিজেপি আসলে এরাজ্যে শাসক তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে প্রশমিত করতে, দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল নেতাদের প্রতিহিংসার তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে, অভিযুক্তের ইমেজকেই রিবিল্ডিং করতে সাহায্য করছে!!!!

পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূলকে এমনভাবে বৈধতা আর কেউ দিতে পারেনি!!!

শুধু এটুকুর জন্যই ২০-২২ টা আসন অনায়াসে উপহার দেওয়া যায়!!

৫ অক্টোবর সিজিও কমপ্লেক্স অভিযান নিছক তাই একটা কর্মসূচি নয়, দুই শাসকের সেটিংয়ের পিপিপি মডেলের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট কনফ্রন্টেশন!!

ইডি সিবিআইয়ের অফিস ঘেরাও করে সারদা থেকে নারদা, কয়লা গোরু থেকে নিয়োগ দুর্নীতির কিংপিনদের গ্রেপ্তারির দাবি তোলা আসলে এরাজ্যের বুকে তৃণমূল বিজেপির বাইনারি ভাঙারই স্লোগান।

সিবিআই - ইডি ' এখন সিআইডি' র 
থেকেও বেশি স্বস্তি দিচ্ছে শাসক দলকে!

তাই আপনি সিজিও কমপ্লেক্স অবরুদ্ধ করুন, অটোমেটিক ঘাম ঝরবে নবান্নের! 

রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

Syzygy (ফেলুদা ফ্যান ফিকশন) ~ মালবিকা রায়

Syzygy ফেলুদা ফ্যান ফিকশন
পর্ব ১ঃ প্রথম দেখা
—————————————————
কেদারে সিংঘনিয়ার সঙ্গে দেখা করে ধর্মশালায় ফেরার পথে ফেলুদাকে কোন অজ্ঞাত আততায়ী কাঁধে বাড়ি মেরে পালাল।ওকে আমি আর লালমেহনবাবু মিলে ধরে তুলতেই দেখলাম কাঁধে বেশ জখম। একজন ডাক্তার লাগবে শীগ্গীর। ধর্মশালায় ফিরতে মাখনবাবু বললেন পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথে ডঃ ব্যানার্জির বাড়ি। শুনেই আমরা ফেলুদাকে নিয়ে রওনা দিলাম। ও অবশ্য গাঁইগুঁই করছিল কিন্তু জটায়ু যখন বললেন "যাবেন, নাকি কাঁধের ব্যথায় ভুগে কালকের ক্লাইম্যাক্সটা মিস করবেন ফেলুবাবু?" তখন রাজী হল।
ছোট্ট পাহাড়ী জায়গায় রাত নটা মানে অনেক। দুটো গলি পেরিয়ে নির্দেশমত একটা দোতলা বাড়ির একতলার দরজায় নক করতেই কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলেন বছর ছাব্বিশের এক ভদ্রমহিলা, মনে হল ঘুমোতে যাচ্ছিলেন, পাজামার ওপর চাদর জড়ানো।
"কিছু মনে করবেন না, বাধ্য হয়ে এত রাতে বিরক্ত করতে এলাম। আপনার বাবাকে একটু ডেকে দেবেন?"
"আমার বাবা! তিনি তো কলকাতায়!"
ভদ্রমহিলা অবাক।
"তবে কি আপনার স্বামী? মানে ডাঃ ব্যানার্জিকে খুঁজছি…আসলে এই ভদ্রলোকের একটু চোট লেগেছে… দেখাতে হবে।" লালমোহনবাবু বলেন।
" আসুন ভেতরে।" ভদ্রমহিলা দরজা ছেড়ে দাঁড়ান।
ভেতরে গিয়ে দেখি বেশ বড় একটা ঘর। বেশ গোছানো। জানলার পাশে একটা ডেস্ক আর চেয়ার। তারপাশে একটা বড় বুকশেল্ফ। দূরের দেওয়ালে একটা খাট।আর কোন লোক দেখা গেল না। ভেতরের দিকের একটা দরজা দিয়ে ডাইনিং টেবলের অংশ বিশেষ আর চেয়ার দেখা যাচ্ছে।
"বসুন আপনি এই চেয়ারে..কোটটা খুলে রাখুন ঐ হ্যাঙ্গারে।"ফেলুদাকে বলেন উনি।
"আর আপনারা ঐ মোড়াদুটো টেনে নিন" আমি আসছি। বলে ভেতরের দরজা দিয়ে চলে গেলেন। বোধহয় ওঁর স্বামী ডাঃ ব্যানার্জিকে ডাকতে।
মিনিট খানেক পরে ফিরে এলেন একাই।চাদরটা খুলে এসেছেন। হাতদুটো সদ্য ধোওয়া।জামার হাতাদুটো কনুই অব্দি গোটানো।
"আপনি শার্টটা খুলুন। ইনজুরিটা দেখতে হবে.." ভদ্রমহিলা গম্ভীরভাবে নির্দেশ দেন ফেলুদাকে।
আমি ততক্ষণে আন্দাজ করেছি ব্যাপারটা..
"কিন্তু আপনার স্বামী মানে ডাঃ ব্যানার্জি…" জটায়ু এখনো বোঝেননি মনে হচ্ছে।
"স্বামী টামী নেই। আমিই ডাঃ মণিকঙ্কণা ব্যানার্জি। চলবে তো তাতে?"
জটায়ু বেকুবের মত ঘাড় নাড়েন।
ভদ্রমহিলা এত গম্ভীর কেন!
আমি ফেলুদাকে সাহায্য করতে গেলাম…ও ডান হাত প্রায় ব্যবহার করতে পারছে না। মুখের চেহারাও দেখার মত। উঠে আসতেও পারছে না কিন্তু থাকার যে বিশেষ ইচ্ছে আছে তাও মনে হচ্ছে না।
শার্ট খোলা হয়ে গেছে। ডাঃ ব্যানার্জি দেখে নিলেন একবার আঘাতটা। মুখটা আর গম্ভীর করা সম্ভব নয় ওঁর। তাও একটা চেষ্টা হল মনে হল। কানে স্টেথোটা গুঁজে বললেন
"গেঞ্জিটা খুলুন এবার।"
কাঁধের যে জায়গায় চোট তার মধ্যিখান দিয়ে স্যান্ডো গেঞ্জির হাতাটা গেছে। না খুললে যে চিকিৎসা সম্ভব নয় সেটা বুঝতে ডাক্তার হতে হয় না।
ফেলুদার ভ্রূকুটিও ম্যাক্সিমাম হয়ে গেছে। কিন্তু ওর ক্ষুরধার বুদ্ধিতে ওখান থেকে উঠে আসার কোন উপায় বের করার আগেই আমি আর লালমোহনবাবু মিলে ওর গেঞ্জিটা মাথার ওপর দিয়ে সাবধানে তুলে নিলাম।
ভদ্রমহিলা মনে হল ডাক্তার হিসেবে ভালই। চোটের জায়গাটা আর পিঠে, কাঁধে তার আশপাশটা ভাল করে মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। ফেলুদা পুরো সময়টা দেওয়ালে একটা গ্ল্যাক্সোর ক্যালেন্ডার আর তার ওপর বসা টিকটিকির দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল।
"দেখুন, ফ্র্যাকচার কিনা বুঝতে তো এক্স রে করতে হবে। সে তো এখন হবে না। ইন দ্যাট কেস, দ্য বেস্ট আই ক্যান ডু ইজ…আপনি আসুন মিঃ..
"মিত্র। প্রদোষ মিত্র। কোথায় যাব"?
"ঐ খাটে গিয়ে শুয়ে পডুন। অন ইওর টামি। আমি দেখব শোল্ডার ব্লেডে কোনো অবভিয়াস ফ্র্যাকচার আছে কিনা…"
"কিন্তু ওটা তো পেশেন্ট বেড নয়…" ফেলুদার গলায় ভীষণ অনিচ্ছা।
"না নয়। দ্যাটস মাই ওন বেড। আ্যন্ড এই যে চেয়ারটায় আপনি বসে আছেন সেটাও পেশেন্টদের নয়। আমার পড়ার চেয়ার। এই ঘরটাও ডিসপেন্সারী নয়, আমি এখানে থাকি। এমার্জেন্সী সিচুয়েশনে বোধহয় আগে কখনো পড়েননি না? খুব সিকিওরড, প্ল্যানড জীবনে অভ্যস্ত নাকি? কি করেন আপনি, সরকারী চাকরী?"
বাপরে। ডাঃ ব্যানার্জি তো ভালই বকুনি দিতে পারেন!
ফেলুদা আর কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়াল। জিনসের ওপর ব্যায়ামপুষ্ট খোলা গা আর উস্কোখুস্কো চুলে বেশ একটা র্যাম্বো সুলভ ভাব এসেছে। কাঁধের কাটাটা একটা এক্সট্রা রাফনেস যোগ করেছে।
গটগট করে গিয়ে উপুর হয়ে শুয়ে পড়ল খাটটায়। ডাঃ ব্যানার্জি কাঁধ, পিঠ টিপেটুপে, স্টেথো লাগিয়ে, হাত কতটা উঠছে এসব দেখে মনে হল সন্তুষ্ট হয়েছেন।
"আমি শিওর ভাঙেনি। তবে চাইলে পরে এক্স রে করে নিতে পারেন। আমি প্রেসক্রিপশন লিখে দিচ্ছি আ্যন্টি ইনফ্লামেশন আর পেইনকিলারের । আজকের রাতের মত আমার থেকে নিয়ে নিন। কাল কিনে নেবেন।"
চেয়ারে বসে লিখতে লিখতে বলেন ডাঃ ব্যানার্জি।
ফেলুদা খাটেই বসে। কারণ ঘরে আর কোনো বসার জায়গা নেই।
"আপনি এখানে এসে বসুন মিঃ মিত্র। উঠে দাঁড়িয়ে বলেন উনি। একটা ব্যান্ডেজ করে দিই আর একটা মেকশিফট স্লিং.."
"না, ব্যান্ডেজ করুন। তবে নো স্লিং"।
"কেন বলুন তো?"
"কারণ স্লিং সমেত রিভলভার চালানো সম্ভব নয়, যেটা আমার কয়েকঘন্টা পরেই হয়তো লাগবে।"
এবার ডাঃ ব্যানার্জি সত্যি গম্ভীর।
"বিকজ অফ দ্যাট হিপোক্র্যাটিক ওথ আমি সব ধরণের লোকের চিকিৎসা করতে বাধ্য। কিন্তু ইউ আর পুশিং ইট ট্যু ফার। স্মাগলিং বা গ্যাং ওয়ার যাই আপনার প্রফেশন হোক না কেন, আ্যজ এ ডক্টর আই উড রেকমেন্ড…"
"এই যে বললেন আমি সিকিওর সরকারী চাকরী করি.." র্যাম্বো এবার চান্স পেয়েছে।
"আমি কি করে জানব বলুন! রিভলবার টিভলবার.."
"আপনার শেলফে তো ভর্তি ক্রাইম থ্রিলার। গুন্ডা বদমাইশ ছাড়া সেগুলোতে কারো রিভলভার থাকে না?"
"পুলিশ নাকি আপনি? তাহলে কিন্তু রিভলভার আর সরকারী চাকরী দুটোই হল",
ব্যান্ডেজের জোগাড় করতে করতে এতক্ষণে ফিক করে হাসলেন উনি। বেশ দেখায় কিন্তু হাসলে। কেন যে গম্ভীর থাকেন এত জানিনা।
"আপনি কেমন পুলিশ? লেস্ট্রেডের মত না বচ্চনের ইনস্পেক্টর বিজয়ের মত?" ব্যান্ডেজটা বাঁধতে বাঁধতে বলেন ডাঃ ব্যানার্জি।
"আরে ম্যাডাম, লেস্ট্রেড অব্দি গেলেন আর আসল লোককে ভুলে গেলেন?" জটায়ু এখন কথা খুঁজে পেয়েছেন।

"দোহাই আপনার, ম্যাডাম বলবেন না। নাম ধরে ডাকুন, ডাক্তারবাবু বলুন, বহেনজী বলুন…যা খুশী। কেবল ঐ ট্যাঁশ ফিরিঙ্গি সম্বোধনটা করবেন না।"
ফেলুদার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল।ও ও পারতপক্ষে স্যর শুনতে চায় না।
"তা আসল লোক মানে…শার্লক হোমস? ডিটেক্টিভ?" ব্যান্ডেজ শেষ করতে করতে বলেন ডঃ ব্যানার্জি।
"আমার ধারণা ছিল ওটা শুধু গল্পে হয়…আপনি শার্টটা পরে ফেলতে পারেন মিঃ মিত্র।"
"গল্পেই বেশী হয়। যেমন এঁর গল্প। তবে আমি বাস্তবের.." চেয়ার ছেড়ে উঠে বলে ফেলুদা।
"উনি কি গোয়েন্দা গল্প লেখেন?"
"হ্যাঁ। ওঁর বই দেখলাম তো আপনার শেলফে। সাহারায় শিহরণ!" শার্টটা পরতে পরতে বলে ফেলুদা।
"মাই গড! আপনি লালমোহন গাঙ্গুলী? দারুণ টানটান লেখেন আপনি, ধরলে ছাড়া যায় না…"
লালমোহনবাবুর মুখে একগাল হাসি।
"তবে…কয়েকটা ফ্যাকচুয়াল এরর আছে। যেমন ধরুন উটের পাকস্থলীতে জল জমিয়ে রাখার ব্যাপারটা। ওটা ঠিক নয়। হয় কি জানেন, ওদের ঐ কুঁজের ফ্যাটটা অক্সিডাইজ হয়ে.."
লালমোহনবাবু চুপসে গেছেন, কিন্তু ওঁর হাসি ফেলুদার ঠোঁটের একপাশে সংক্রামিত হয়েছে।
—————————————————-
পর্ব ২ঃ শব্দ-জব্দ
—————————————————
পরদিন ভোরের মধ্যেই কেদারের ক্লাইম্যাক্স ভালয় ভালয় মিটে গেছে। দেবীশংকর পুরী ওরফে মিঃ ভার্গব ধরা পড়েছেন। লালমোহনবাবু ছোটকাকাকে খুঁজে পেয়েছেন। সেই সঙ্গে বহুমূল্য বালগোপাল লাভ হয়েছে। কিন্তু এত ভাল ভাল ঘটনার মধ্যে একটা বাজে ব্যাপার হল যে ফেলুদার কাঁধের চোট থেকে আবার রক্ত পড়ছে। ওরই দোষ। কয়েকঘন্টার মধ্যে একটুও বিশ্রাম না নিয়ে এইরকম ছোটাছুটি করলে আর কি হবে!
"তাহলে চল আবার ডাঃ ব্যানার্জির ওখানে, এটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে তো।" আমি বললাম।
"আর কোনো ডাক্তার পাওয়া যায় না?"
ফেলুদা বলে ওঠে।
"এই ছোট পাহাড়ী জায়গায় আবার কটা ডাক্তার পাব ফেলুবাবু? উনি দেখছিলেন এটা। ডাক্তার তো উনি খারাপ বলে মনে হল না…"
"খারাপ ডাক্তার তা আমি বলি নি। তবে…"
ও কি নিজেও জানে প্রবলেমটা কি!
"তবে ওটা ওঁর থাকার বাড়ি, ডাক্তারখানা নয়। সেখানে এরকম বারবার গিয়ে হানা দিলে…"
এতক্ষণে একটা অজুহাত পেয়েছে।
"আরে কতক্ষণ আর লাগবে, সেরকম হলে আমরা বাইরে দাঁড়াই, আপনি দেখিয়ে আসুন.."জটায়ু বলেন।
"না না, তার দরকার নেই। আপনারা আসুন সঙ্গে".. চটপট বলে দেয় ফেলুদা।
"কি হল, কিছু প্রবলেম?" আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করলেন ডাঃ ব্যানার্জি।
"হ্যাঁ, মানে ব্যান্ডেজটা থেকে ব্লীডিং হচ্ছে.."
"সেকি? কথা নয় তো। আসুন ভেতরে।"
আজ এই সকালবেলা বিছানা টিছানা সব পরিপাটি করে তোলা। টেবলে একটা স্ক্র্যাবলের বোর্ড পাতা…অর্ধেক খেলা হয়েছে।
ফেলুদা বসল চেয়ারে।
"আসলে আপনার দোষ না, আমিই একটু বেশী স্ট্রেন করে ফেলেছি" শার্ট খুলতে খুলতে বলে ও।
"সে তো দেখতেই পাচ্ছি…সাতসকালে মারামারি করতে গেছিলেন? ডাক্তারের কথা টথা শোনার দরকার নেই…ওঃ স্যরি, মাই হ্যান্ডস আর কোল্ড।"
শেষ কথাটার কারণ হল ওঁর হাত ফেলুদার গায়ে পড়তেই ও শিউড়ে উঠেছে।
"আসলে এইমাত্র চান করে এলাম তো!"
"দ্যাটস ওকে!" গম্ভীর গলায় বলল ফেলুদা।
আবার সেই ক্ষতস্থান পরীক্ষা, ড্রেসিং, ব্যান্ডেজ..! তবে আজ আর টিকটিকি না দেখে ফেলুদা স্ক্র্যাবলের বোর্ডের দিকে তাকিয়ে রইল।
একবার নিজের মুখটা যখন ফেলুদার প্রায় কানের কাছে এনে উনি ক্ষতটা পরীক্ষা করছিলেন, মনে হল ওর মুখের রংটা একটু বদলে গেল…তবে সেটা আমার চোখের ভুলও হতে পারে।
"ওকে। ইটস ডান নাও। জল না লাগানোর চেষ্টা করবেন দুদিন।আপনার স্ত্রীকে বলবেন যেন স্পঞ্জ বাথ দিয়ে দেন"।
"স্ত্রী-টী নেই ।তবে আমি জল লাগাব না। থ্যাঙ্ক ইউ।" শার্ট পরতে পরতে বলে ফেলুদা।
"বেশ পোক্ত করেই ড্রেসিং করে দিয়েছি। তবে ফরওয়ার্ড শর্ট লেগে ক্যাচ ধরতে যাবেন না ক'দিন, তাহলেই হল।" বলে দেন ডাঃ ব্যানার্জি ।
"আর সিলি মিড অফে?" ফেলুদার ঠোঁটে মৃদু হাসি। ও কলেজে ক্রিকেট খেলত, তাই মেটাফোরগুলো বেশ উপভোগ করছে বুঝতে পারলাম।
"ডোন্ট বী সিলি! আই ক্যান ওনলি আ্যলাউ ফিল্ডিং আ্যট দ্য মিড উইকেট!"
ভদ্রমহিলা বেশ উইটি।
"কিছু যদি মনে না করেন , আপনি কি একা একা স্ক্র্যাবল খেলছিলেন?" ফেলুদার গলাটা এখন রিল্যাক্সড।
"হ্যাঁ । এখানে আর দোকা কোথায় পাব বলুন! তাই একাই খেলি।"
"আরে আমাদের ফেলুবাবুও তো তাই, কেউ না থাকলে একা একা স্ক্র্যাবল বা দাবা…" লালমোহনবাবু বলে ওঠেন।
"ফেলুবাবু!"
"আরে ওঁর ডাক নাম তো ঐ। ভাল নাম.."
"মিত্র! ফেলু মিত্তির! ইয়েস আই হ্যাভ হার্ড আ্যবাউট ইউ। সেই বোম্বাই এর ঘটনাটা কাগজে বেরিয়েছিল তো!
গুড ওয়ার্ক। তারপর আপনার গার্লফ্রেন্ড ফিল্ম আ্যকট্রেস রূপার ইন্টারভিউ।"
"আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই। ওটা নেহাতই ফিল্মি গসিপ। দুদিন বেরিয়েছিল এখন খবরের অভাবে চাপা পড়েছে বহুদিন। আপনি এই পান্ডববর্জিত জায়গায় না থাকলে জানতে পারতেন। আমাদের জীবন ভীষণরকম নারীবিবর্জিত।"
"ইউ সীম ট্যু বী প্রাউড অফ দ্যাট! হোয়াটস রং উইথ আস?"
"আমি বলিনি আমি প্রাউড। আই মেয়ারলি স্টেটেড দ্য ফ্যাক্ট।দেয়ার ইজ নাথিং রং উইথ এনি জেন্ডার। আপনি যেভাবে আমাকে চিকিৎসা করেছেন তারপরে তো ওকথা মুখে আনাও পাপ।"
"খালি একটা প্রশ্ন, এই যে এই ওয়ার্ডটা…syzyg-ওটা কি…?" ফেলুদা স্ক্র্যাবল বোর্ড দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে।
"ঐ ব্ল্যাঙ্কটা y. শব্দটা Syzygy"
"আ্যকচুয়েল ডিকশনারীতে আছে নাকি..?"
"তার মানে? নিজেই নিজেকে চীট করে খেলছি নাকি? সর্বভূতে ক্রিমিনাল দেখেন কি আপনি?"
"আহা, ভুল হতে পারে তো!"
"স্ক্র্যাবলে ভুল হয় না আমার মিঃ মিত্তির। মেডিক্যালে আমি অবিসংবাদী চ্যাম্পিয়ান ছিলাম।"
"ডাক্তারদের কলেজ তো! তারা আর শব্দের মাস্টার কবে থেকে? ওষুধের নাম হলে নয় হত…"
"আর আপনার আ্যলমা ম্যাটারটা.."?
"ঐ আপনার পাশেই!"
"ঠিক জানি! প্রেসি ছাড়া এরকম বিশ্ব স্নব আর কে হবে! এক হাত খেলে দেখুন না ডাক্তাররা ওয়ার্ড গেম পারে কিনা।"
"আমার ক্রিমিনাল ধরা পড়ে গেছে। এখানে ছুটি কাটাতেই এসেছিলাম। এক হাত খেলতেই পারি। কিন্তু আপনার কি কাজ নেই? আজ তো সোমবার।"
"আমি শনি রবি কাজ করি কেদারে।এনজিওর হয়ে।সোম মঙ্গল আমার ছুটি। আজ বিকেলে চলে যাব রুদ্রপ্রয়াগ। সপ্তাহের বাকী ক'দিন ওখানে থেকে কাজ করি।
"ঠিক আছে। আমরাও বিকেলে নেমে যাব রুদ্রপ্রয়াগে।ওখানে আর দুটো দিন কাটিয়ে কলকাতায়। সুতরাং আমরা একসঙ্গেও যেতে পারি।তবে আপনাকে বলা আমার কর্তব্য যে আমি কিন্তু কখনো স্ক্র্যাবলে হারিনি। কলেজে না, বাড়িতে না, বন্ধুদের সঙ্গে না। কাজেই.. "
"চ্যালেঞ্জ আ্যকসেপ্টেড মিঃ মিত্র। ওদিকে চলুন, এখানে তো জায়গা নেই। ডাইনিং টেবলে বসতে হবে।
কিন্তু লালমোহনবাবু আর…তোমার নাম কি ভাই?"
"তপেশ। তপেশ রঞ্জন মিত্র।"
"তা ওরা কি করবেন?"
"যদি কিছু মনে না করেন তো আমি একটু ঐ চৌমাথার দিকে যাব। দারুণ আলুর পরটা করছিল কাল দেখেছি।" জটায়ু বললেন।
"আর আমি আশপাশটা ঘুরে দেখে ছবি তুলব আমার নতুন ক্যামেরায়। চলুন লালমোহনবাবু।"
আলু পরটা খেয়ে, ছবি তুলে, বাজারে ঘুরে, আমি একটা হিমাচলী টুপি কিনলাম আর লালমোহনবাবু একটা পাথরের শিব কিনলেন।
"এটাও তো আপনার আর একটা ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট হয়ে গেল লালমোহনবাবু।" পাথরের তৈরী ওজনদার জিনিসটা দেখে আমি না বলে পারলাম না।
"এটা একটা ওয়ার্ক অফ আর্ট তপেশ, আর রিলিজিয়াস ইমপর্টেন্সটাতো জানই।"
আমার অবিশ্যি ওটা দারুণ কিছু ওয়ার্ক অফ আর্ট মনে হচ্ছিল না, তবে আর ঘাঁটালাম না। বললাম,
"এগারটা বেজে গেছে , চলুন লালমোহনবাবু, ফেলুদাকে নিয়ে আসি।"
"চল। কে জিতবে বলে মনে হয় তোমার তপেশ ভাই?"
"কি করে জানব বলুন। ফেলুদা ভাল, তবে…"
"তবে টবে কিছু নেই। ভারী জাঁহাবাজ মেয়ে ঐ ডাঃ ব্যানার্জি। না জিতলেই ভাল।"
"তা বলছেন কেন? চিকিৎসা করলেন ফেলুদার। আপনার বই পড়েন.."
"হ্যাঁ আর রাজ্যের ভুল ধরেন! ফেলুবাবুকে শুদ্ধ বকুনি! জিতবে না, দেখ তুমি!"
গিয়ে দেখলাম ফেলুদার সামনে একটা শেষ হওয়া প্লেট।
"ক্যারামেল পুডিং খাওয়ালেন ডাঃ ব্যানার্জি।" ফেলুদা সাফাই দেয়।
"তা কে জিতল?" জটায়ুর প্রশ্ন।
"আমি। একবার না দু দুবার।" ডাঃ ব্যানার্জির মুখে এখন ঝকঝকে হাসি। বলেছিলাম তো পাঙ্গা না নিতে।"
"কি না নিতে?"জটায়ুর জিজ্ঞাসা।
"পাঙ্গা, পাঙ্গা! হিন্দি কি কিছুই বোঝেন না নাকি আপনি?"
"এই নিন। ক্যারামেল পুডিং। আপনাদের জন্য।আপনারা তো হেরোর দলে। তাই অন্ততঃ এটুকু করা আমার কর্তব্য।"
জটায়ু গম্ভীর মুখে প্লেটটা টেনে নিলেন।কিন্তু মুখে প্রথম চামচটা দিয়েই ওঁর মুখের চেহারা বদলে গেল। অসম্ভব ভাল খেতে।
"বাই দ্য ওয়ে, এটাতে কিন্তু আপনার সই চাই।"সাহারায় শিহরণ বাড়িয়ে দিলেন ভদ্রমহিলা।জটায়ুর মুখে এবার অনাবিল হাসি।


———-—————————————-
পর্ব ৩ঃ ভানু গোয়েন্দা জহর আ্যসিসট্যান্ট
—————————————————

রুদ্রপ্রয়াগে আমরা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে বাদামভাজা খাচ্ছিলাম। ডাঃ ব্যানার্জিও আমাদের সঙ্গে আছেন। আমার সঙ্গে এখন দারুণ ভাব হয়ে গেছে…মণিদি আর তুমিতে নেমে এসেছি। কারণ ওঁর কাছে ‘ডার্কসাইড অফ দ্য মুন’ ক্যাসেটটা দেখেই আমি ধার চাইলাম আমার ওয়াকম্যানের জন্য। দেখা গেল উনিও পিঙ্ক ফ্লয়েডের ভক্ত। লেখাপড়া নিয়েও অনেক কথা হল।

“কোন সাব্জেক্ট ফেভারিট তোমার, তপেশ?”
“ফিজিক্স। ম্যাথও ভাল”।
“তাহলে কেমিস্ট্রি আর বায়োলজি খারাপ লাগে, তাই  তো?” হেসে জিজ্ঞেস করে মণিদি।
“হ্যাঁ। ঐ মানে…তুমি জানলে কি করে ?”
“এরকমই হয়।ইলেভেনে পড়ে আমার মামাতো বোন পুকাই, তারও তাই… হাসলে যে?”
“না, আসলে ঐ…পুকাই নামটা…”
“আর তোমার দাদা যে তোমাকে তোপসে বলেন সে বেলা? পুকাই-এরও ভাল নাম আছে, রূপমঞ্জরী ।”

“বাবা! আপনাদের বাড়ির মেয়েদের নামের তো খুব ঘটা! আপনারা কি জুতোর নাম দেন অবিমৃষ্যকারিতা, ছাতার নাম প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আর বাড়ির নাম কিংকর্তব্যবিমূঢ”? জটায়ু বলে উঠলেন।
“আর আপনার কি মেসোর নাম তকাই, শ্বশুরের নাম বিস্কুট”? মণিদিরও সুকুমার রায় ঠোঁটস্থ।
“শ্বশুর তো নেই, ডাঃ ব্যানার্জি। আমি, ফেলুবাবু সবাই ব্যাচেলর। তপেশের বয়স কম, এখনো সময় আছে তাই ওকে ওদলে ফেললুম না।”
“তা আপনাদের দুজনের কি সময় গেছে নাকি?”
“আমার সময় কোনদিনই ছিল না। ফেলুবাবুর কথা উনিই জানেন। কি মশাই?”

ফেলুদা অবশ্য জটায়ুর প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না। তার বদলে একটা চারমিনার ধরিয়ে বলল,

“আমার শরীরটা ঠিক জ্যুৎ নেই বলে হারলাম।” 
বেচারা! উপুর্যপরি দুবার স্ক্র্যাবলে হারের কথাটা ভুলতে পারছে না।

“জীবনে শুনিনি লোকে কাঁধে ব্যথা বলে স্ক্র্যাবলে হারে। তাও দু বার।” মণিদি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল।
“ওষুধগুলোর এফেক্ট আছে তো!”
“কি নেপ্রক্সেন আর প্যারাসিটামল? এতে আপনার ব্রেন ফাংশন গুলিয়ে গেল! মেডিসিনে নবদিগন্ত খুলে যাবে এই আবিষ্কারে।”
“ভোরে উঠে ছুটতেও হয়েছিল ক্রিমিনালের পেছনে। যদি কাল একবার চান্স পেতাম তো…”

ঠিক শুনছি কি! ফেলুদা আবার একবার ওঁর ওখানে যেতে চায়। তাও কোনো ডাক্তারী কারণে না, স্ক্র্যাবল খেলতে! আঁতে লেগেছে মনে হয়।

“বেশ বারবার তিনবার হয়ে যাক। আপনার বুদ্ধির তো খুব প্রশংসা চারিদিকে। তৃতীয়বার হারলে মুচলেকা লিখে দেবেন। আমি বাঁধিয়ে রাখব।”
“আগে তো হারি!”
“ওহো! কিন্তু কাল যে…মণিদির কিছু মনে পড়েছে।
“কি ভয় পেয়ে গেলেন? পরাজয় স্বীকার করে নিতে
পারেন। ওয়াক ওভার দিয়ে ।”
“হ্যাঁঃ। মণিকঙ্কণা ব্যানার্জি ভয় পায় এমন শর্মা এখনো জম্মায়নি, বুঝলেন মিত্তির মশাই! কাল দুপুরে আমি একবার পাহাড়ে চড়তে যাব ভাবছিলাম তাই…”
“ও, তাই ঘরের কোনে ঐ মাউন্টেনিয়ারিং বুটগুলো দেখছিলাম। আমারি তো লোভ হচ্ছে মশাই আপনার সঙ্গে ঝুলে পড়ার।”
“একেবারেই না। কাঁধের এই অবস্থায় পাহাড়ে চড়তে আমি আপনাকে আ্যলাউ করতে পারি না ডাক্তার হিসেবে। শেষে যদি আমার ওপর পড়েন তো আমিই ছবি হয়ে যাব।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ একদম ঠিক। পাহাড়ে আর চড়তে হবে না। যথেষ্ট চড়েছি গত ক’দিনে।” জটায়ু বলে দেন।
“ক’টায় বেরোবেন কাল?” ফেলুদার প্রশ্ন
“এই দশটা নাগাদ। “
“যদি আমি আটটায় যাই তাহলে একদান খেলা যাবে তো?”
 
ওরে বাবা। এতো উৎসাহ! হেরে গিয়ে খুব মানে লেগেছে বোধহয়।

পরদিন দশটা নাগাদ ডাঃ ব্যানার্জির বাড়ি গিয়ে দেখলাম উনি হাসিমুখে বেরোচ্ছেন পাহাড়ে চড়ার জন্য রেডি হয়ে। মুখ দেখলেই বোঝা যায় উনি জিতেছেন।
যেটুকু সন্দেহ ছিল সেটুকুও উনি মাথার ওপর দুহাত তুলে নাচের ভঙ্গিমা করায় ঘুচে গেল।

“সে কি আবার হেরে গেলেন ফেলুবাবু?” 
জটায়ুও বুঝেছেন।
“হি হি! আমি তো আগেই বলেছিলাম! আজ তো আর ক্যারামেল পুডিং নেই, তবে দুঃখ করবেন না, এই নিন ম্যাঙ্গো ড্রপস লজেন্স।”
একগাল হেসে লজেন্স সমেত হাতটা বাড়িয়ে দেন ডাঃ ব্যানার্জি।

যাকে দেওয়া হল সে যে হেরে বিশেষ দুঃখিত তা মনে হল না অবিশ্যি। কিন্তু একটা লজেন্স মুখে দিয়েই ফেলুদার মুখটা অদ্ভুত হয়ে গেল।

“কি, পছন্দ নয় ফ্লেভারটা?” মণিদি জিজ্ঞেস করল।
“কি রকম একটা…ঠিক আপনার শ্যাম্পুর মত গন্ধ।”

ডাঃ ব্যানার্জি সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালেন। 
আমি আর লালমোহনবাবু চুপ।

“না মানে আপনার বিছা-আ-নায়…আই মীন বা-বালিশে ..মা-মানে সেদিন কেদারে চেকআপের সময়…আমার ঘ্রাণশক্তি আসলে বেশ …”
কোনোদিন ফেলুদাকে এত তোতলাতে দেখিনি তো!
“হ্যাঁ, আমি ক্লোরানে ম্যাঙ্গো শ্যাম্পু ব্যবহার করি। আপনার নাক তো দারুণ…আমার বাচ্চাটার মত প্রায়।” মণিদি আবার সহজ।

“আপনি যে বললেন আপনি ব্যাচেলর। তাহলে বাচ্চা?” লালমোহনবাবু বলে উঠলেন।

“কে বলেছে মশাই বিয়ে করতেই হবে বাচ্চা পেতে গেলে? একটা মেয়ে যদি চায় তাহলে সে মা হতেই পারে। দ্যাটস হার প্রেরোগেটিভ। থিংকিং আদারওয়াইজ ইজ রিগ্রেসিভ। আপনি নীনা গুপ্তা আর ভিভ রিচার্ডসের কথা শোনেননি?” এক নিঃশ্বাসে বলে যান উনি।

“আপনার তো মশাই ভিভ রিচার্ডসও নেই, বাচ্চাও নেই…শুধু শুধু কেন তর্কগুলো করছেন”?
ফেলুদা বলে উঠল।
“কি করে জানলেন নেই”?
“দেখলেই বোঝা যায় কার কতদূর দৌড়। ভিভ রিচার্ডস! বাচ্চা বলতে কি পালিত কুকুর নাকি বেড়াল? কুকুরই হবে। নাক ভাল যখন।”
“হ্যাঁ কুকুর। হল তো! কি মহান ডিটেক্টিভ! সরুন এখন আমার ট্রেকিং এর দেরী হয়ে যাবে।”
“ফিরছেন কখন?”
“এই চারটে নাগাদ..”
“তো আজ রাতে ডিনারটা আমাদের সাথে করলে অসুবিধে আছে?”
“না, অসুবিধা আবার কিসের! সন্ধেবেলা এসে হোটেল থেকে ডেকে নেব আপনাদের।” বলে রওনা দিল মণিদি।

ফেলুদা তো দেখছি ওঁর সঙ্গে সময় কাটানোর কোন সুযোগই ছাড়তে রাজী নয়!
               
“তা ফেলুবাবু, ডাঃ ব্যানার্জির সঙ্গে আপনার বেশ ভাব হয়ে গেছে দেখতে পাচ্ছি।”
 জটায়ু বলে উঠলেন মণিদি বিদায় নেবার পর। ওঁরও নিশ্চয় একই কথা মনে হয়েছে।
“ভাব বলতে যদি মীন করেন বন্ধুত্ব তবে নিশ্চয়ই হয়েছে। কিন্তু যদি অন্যকিছু দ্ব্যর্থবোধক ইঙ্গিত করেন তো ডেফিনিটলি না। শী ইজ গুড কম্পানি, দ্যাটস অল।”
                   ——————
সারাদিন আশপাশের জায়গাগুলো বেড়িয়ে এসে বিকেলে আমরা হোটেলের লবিতে বসে গল্প করছিলাম। মণিদির একক্ষণ এসে পড়ার কথা। 
“ভুলে যাননি তো আবার উনি”, সবে বলেছেন জটায়ু এমন সময় ঝড়ের মত এসে হাজির হল মণিদি…

“মিঃ মিত্র আমার বাচ্চাটাকে না কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না!”
“তা ওরা স্বাধীন জীব তো, গেছে কোথাও…”
“কি করে যাবে বেশীদূর? ওর একটা ঠ্যাং ভাঙা তো! কাছাকাছিই থাকে। আমি খেতে না দিলে মরেই যেত ! রোজ বিকেলে ব্রীজের কাছেই বসে থাকে, আমি পাঁউরুটি দিই তো! যখন কেদারে থাকি পাশের চায়ের দোকানদার ওকে খেতে দেয়। পয়সা দিয়ে বলা আছে ওকে।কাল রাত অব্দি ছিল। এখন গায়েব।”

“তা আপনি কি আমাকে আ্যপয়েন্ট করতে চাইছেন? কুকুর খুঁজতে?” 
ফেলুদার মুখ গম্ভীর কিন্তু চোখ হাসছে!
“না না সে কি! আপনি এত বিখ্যাত গোয়েন্দা…আপনি কেন করবেন এসব…কিন্তু কি যে করি …খুঁজলাম চতুর্দিক!” ডাঃ ব্যানার্জির মুখটা করুণ।
“সে তো বুঝলাম, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন আপনি চান যে আমি তদন্তটা করি কিন্তু সোজাসুজি বলতে লজ্জা পাচ্ছেন!”
“ওসব লজ্জা টজ্জা আমার আসে না মিঃ মিত্তির। কিন্তু ভয় হয় আপনার ভক্তবৃন্দ তেড়ে আসবেন ফেলু মিত্তিরকে দিয়ে কুকুর খোঁজালে।”
“হুম! তবে লজ্জা নয়, ভয়! কিন্তু শোনেননি, ঘৃণা, লজ্জা, ভয়…তিন থাকতে নয়?”
“হ্যাঁ কিন্তু আপনার ভক্তরা…”
“তা ভক্তরা আমায় ভালবাসে কিনা, ওরা তো ওরকম ভাবতেই পারে। না বললেই তো হল ওদের। হোয়াট হ্যাপেনস ইন রুদ্রপ্রয়াগ, স্টেস ইন রুদ্রপ্রয়াগ!
চলুন তবে, একটু তদন্ত করে আসি।”

“না না, সত্যি, আপনি কেন এ রকম তুচ্ছ ব্যাপারে…”
“আপনার কাছে তুচ্ছ কি ব্যাপারটা?”
“তা নয় তবে..”
“তবে টবে আর কিছু নেই। তাছাড়া সেদিন চিকিৎসার পরে ফিজটাও নেননি। তারওপর ক্যারামেল পুডিং। ফলে কৃতজ্ঞতার ভারটাও একটু নামানো দরকার। আপনি একটু বসুন এখানে,আমরা ঘরে গিয়ে গরম জামা পরে আসি তারপর চলুন দেখাবেন কোথায় বাসস্থান ছিল আপনার সারমেয়টির।”
—————————————————
পর্ব ৪ঃ হর্ষবর্ধন বন্দ্যোপাধ্যায়
—————————————————

“কি মশাই? শেষে কুকুর হারানোর কেস? তা আবার তিন ঠেঙে রাস্তার কুকুর! আপনার একটা ইজ্জৎ নেই? ভানু গোয়েন্দা জহর আ্যসিসট্যান্টেও তো ওরা গরু চুরির কেস নিল না। আর আপনি এই দুদিন আগে এখানেই এতবড় একটা কেস সমাধা করে কিনা…”

ঘরে যেতেই বললেন জটায়ু। ভীষণ অফেন্ডেড হয়েছেন।
আমারও মনে হচ্ছিল একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে। কি যে হয়েছে ফেলুদার কে জানে!

“কেন লালমোহনবাবু? পাখি চুরির কেস নিই নি আমি? সাধু সাবধান!” ফেলুদার যুক্তি অকাট্য।
“আহা সে তো পরে অন্য রকম দাঁড়াল…”
“এখানে তেমন হবে না আপনি জানেন?”
“না তা নয়, তবে ভাবলুম…মানে আপনি ঐ ডাঃ ব্যানার্জির জন্য একেবারে…মানে স্ক্র্যাবলে হারলেন ইচ্ছে করে, তারপর এই কুকুরের কেস…”
“কে বলল আমি ইচ্ছে করে হেরেছি? খেলেছেন কখনো স্ক্র্যাবল বা দাবার মত মাইন্ড গেম? খেললে বুঝতেন ওতে হারার চেয়ে হাজারগুণ বেশী খারাপ হল অযোগ্য প্রতিদ্বন্দীর সঙ্গে খেলা! শিশু তো নন উনি যে জিতিয়ে দিতে হবে! 
        তাছাড়া এটা কি লুডো যে দুটো খাবার ঘুঁটি না খেলেই জিতে যাবেন উনি! ক্যাট ম্যাট ধরণের বালখিল্য শব্দ গড়লে বুঝবেন না উনি? ওঁর মাথায় যে নেহাৎ গোবর পোরা তেমন ভাবার কোন কারণ আছে কি? আ্যদ্দিনে আপনার সঙ্গে খেলেছি কি একবারও? উপযুক্ত প্রতিপক্ষ ছাড়া ফেলু মিত্তিরের মস্তিষ্ক পুষ্টি হয় না, বুঝলেন?”
“বুঝলুম ফেলুবাবু। এখন চলুন দেখি এই তিন ঠেঙে কুকুরের কেস কোন রোমহর্ষক দিকে মোড় নেয়!”

“কি ব্রীড ছিল আপনার কুকুরের?” 
মেইন রোডের দিকে যেতে যেতে প্রশ্ন করল ফেলুদা।
“কুকুর কুকুর করবেন না মিঃ মিত্র। ও আমার…”
“তা নাম দিয়েছিলেন কিছু ওর?”
“হ্যাঁ । ভাল নাম হর্ষবর্ধন বন্দ্যোপাধ্যায়—ওকি, আপনি হাসলেন নাকি মিঃ গাংগুলী?”? 
পেছনে “খিঁক” শুনে বললেন ডাঃ ব্যানার্জি ।
“না না। হাসব কেন? হাসার কথা  নাকি! আমার হেঁচকি উঠল বলেই তো..”
“আর ডাকনাম!”? 
ফেলুদা যে কি করে না হেসে আছে কে জানে। আমার তো পেট ফেটে যাচ্ছে।
“ডাকনাম হালুম।”
“তা এই হালুমের বংশ পরিচয় কিছু জানেন? না মানে এখন উনি ব্যানার্জি পরিবারভুক্ত ঠিকই, তবে জন্মসূত্রে ঠিক কি?”
“জার্মান শেপার্ড। ইফ দ্যাটস হোয়াট ইউ আর আস্কিং!”

বলতে বলতে আমরা ব্রীজের পাশে এসে গেছি। ব্রীজের নীচের একটা খোঁদল মত দেখিয়ে মণিকঙ্কণা বললেন “ওখানেই থাকত হালুম! আমি ভেবেছিলাম বাড়িতে নিয়ে আসব। কিন্তু বাড়িওয়ালা রাজী না। তার ওপর আমি সারাদিন থাকি না, কে দেখবে ওকে। তারপর আবার দুদিন পরে দার্জিলিং চলে যাব..”
“আপনি দার্জিলিং চলে যাবেন? চাকরী নিয়ে?” জটায়ু শুধোন।
“হ্যাঁ । ওখানে আ্যপ্লাই করেছিলাম,হয়ে যাবে মনে হয়। আসলে আমার পাহাড় ভাল লাগে বলে খালি এসব জায়গাতেই খুঁজি।”

ব্রীজের পাশে একটা ছোট্ট গুমটি চায়ের দোকান। সেটার দোকানদার দেখলাম মণিদিকে চেনে। 
“আরে বহেনজী, ও কুত্তা আভি মিলা নেহি ক্যায়া আপকো?”
“নেহি ভাইসাব। আজ শুভেসে উসকো নেহি দেখা আপনে, হ্যায় না?”
“নেহি বহেনজী। পাতা নেহি কাঁহা গয়া, আ্যয়সে তো রোজ আ যাতা হ্যায় খানে কে লিয়ে। শান্তি সে বৈঠা রহতা হ্যায়। মগর কাল রাতকো, জব ম্যয় দুকানকে অন্দর শো রাহা থা তো বহৎ ভোঁক রাহা থা। ম্যয় শোচ ভি রাহা থা কি যাকে দেখুঁ ক্যায়া হ্যায়…লেকিন সর্দি ইতনি থী…অউর থোড়ি দের বাদ তো চুপ ভি হো গয়া।”

ফেলুদা ইতিমধ্যে ঢালু দিয়ে নেমে ঐ খোঁদলের পাশে চলে গেছে। আমরাও ওর কাছে গেলাম।
“ম্যাগনিফায়িং গ্লাস নেই আপনার?” মণিদির প্রশ্ন।
“ কেন তাছাড়া ঠিক গোয়েন্দা গোয়েন্দা লাগছে না?” ফেলুদা চারপাশটা দেখতে দেখতে বলে।
“ভাববেন না, দরকার লাগলে সব পাওয়া যাবে, ম্যাগনিফায়িং গ্লাস, রিভলভার…তবে আপাততঃ…”বলে আশপাশের মাটিতে মন দিয়ে কি যেন দেখতে দেখতে হঠাৎ উবু হয়ে বসে একটা মাঝারি গোছের পাথরের ওপর তর্জনী বুলিয়ে কি যেন তুলে আনল।

মণিদি এতক্ষণ চোখ গোল গোল করে সব কিছু দেখছিল। ওর দিকে আঙুলটা বাড়িয়ে দিয়ে ফেলুদা বলে
 “কি, কিছু বুঝতে পারছেন?”
খপাৎ করে ওর আঙুলটা ধরে মণিদি নিজের চোখের কাছে এনে ভুরু টুরু কুঁচকে দেখল খানিক্ষণ।

“টেস্ট না করলে তো বুঝতে পারব না, তবে টেক্সচার আর কালার যা দেখছি তাতে মনে হয়…”
“হুম। যা ভাবছেন তাই।টেস্ট না করলেও বুঝতে পারছি আমি”। 
আঙুলটা মণিদির কবল থেকে ছাড়িয়ে নিজের নাকের কাছে নিয়ে বলল ফেলুদা।
“খুব হাল্কা কোকোর গন্ধ।ভেরী ফেইন্ট।বললাম না, আমার ঘ্রাণশক্তি খুব প্রখর!”
“ওহ্, তার মানে কি…”
“ইয়েস ডাঃ ব্যানার্জি। আপনার হালুম মনে হচ্ছে স্নিফার ডগ ছিল। জার্মান শেপার্ড বললেন তো, তাই না! এল কি করে এখানে! কতদিন ধরে এখানে ছিল জানেন?”
“মাস তিনেক হবে। একটা পা খুব ইনজিওরড ছিল। এখানে তো সেরকম ভেট টেট নেই। আমিই একটু দেখাশোনা করে অনেকটা সারিয়েছিলাম।”
“ইন্টারেস্টিং! স্নিফার ডগ, জার্মান শেপার্ড এভাবে রাস্তার ধারে…”

“ঐ সাদা গুঁড়োটা কি ফেলুবাবু?” জটায়ু বলে ওঠেন।
“কোকেন। মনে হয় কাল রাতে এখানে কিছু ডেলিভারি হচ্ছিল যেটি হালুমবাবু টের পেয়ে চেঁচিয়ে উঠে ধরতে যায়।”
“ধরতে যায় বুঝলেন কি করে?”
“কারণ এই পড়ে থাকা গুঁড়ো। আরো কয়েক জায়গায় আছে আশপাশে।হয়ত প্যাকেট কামড়েছিল হালুম। আর ঐ দেখুন ঐ ঘাসে…দু ড্রপ রক্ত.”
“সেকি? হালুমের রক্ত নাকি!”
“ঐ রক্তের ফোঁটা সম্ভবতঃ ড্রাগ পেডলারদের। হালুমচন্দ্র বিনা যুদ্ধে জমি ছাড়েননি। হাজার হোক সম্রাট হর্ষবর্ধনের নামে নাম তো!”

“কিন্তু ও গেল কোথায় বলতে পারেন?”
“সে তো বলা মুশকিল ডাঃ ব্যানার্জি । হয়তো ওকে কাবু করে ধরে নিয়ে গেছে। শুনলেন না, চায়ের দোকানী বলল চিৎকারটা হঠাৎ থেমে গেল!”
“ঈশ! মেরেই ফেলেছে বোধহয় হালুমটাকে”।
কেঁদে ফেলবেন নাকি ভদ্রমহিলা ! 

“আমি বাড়ি যাই মিঃ মিত্তির। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।” হঠাৎ উল্টো দিকে হাঁটা লাগালেন উনি।
“আরে, আরে! দাঁড়ান, দাঁড়ান! কোথায় চললেন? ডিনার খাবেন না?”
“আপনারা যান। আমার খিদে নেই।”
“এভাবে আহার নিদ্রা ত্যাগ করলে তো কোনো লাভ হবে না। তারচেয়ে চলুন কিছু খেয়ে নিই সবাই মিলে। পেটটা ভরা থাকলে দেখবেন আইডিয়া আসবে মাথায়।”
“হ্যাঁ মণিদি চল। তোমার থেকে আমার বেঞ্জিন রিং এর স্ট্রাকচারটা বোঝার আছে।”
“চলুন ডাঃ ব্যানার্জি, আমার পরের গল্পের প্লটটা একটু বলি আপনাকে। এটা ভাবছি একদম মাসাইমারায় ফেলব…সেরেঙ্গেটি ন্যাশনাল পার্ক, ভিক্টোরিয়া ফলস…”জটায়ু উৎসাহ দেন।
“ওটা মাটেরুনি ফলস হবে লালমোহন বাবু “, মণিদি ফোঁৎ করে নাকটা টেনে ধরা গলায় শুধরে দেয়। 
ফেলুদার মুখটা দেখতে পেলাম না, কারণ তক্ষুণি ও হাত মুঠো করে একটা ছোট্ট কাশি আড়াল করল।

রেসট্যুরেন্টে গিয়ে মণিদি শুধু একটু স্যুপ খেল। কথাবার্তাও হুঁ হাঁ দিয়ে চালিয়ে দিল।
“আপনি তো এনজিওর হয়ে ডাক্তারী করেন। পেশেন্টদের মধ্যে ড্রাগ প্রবলেম দেখেন?” ফেলুদা অবশেষে একটা চারমিনার ধরিয়ে জিজ্ঞেস করল।
“বিনি পয়সায় চিকিৎসা করাতে আসে যারা তারা সব গরীব লোক। কোকেনের পয়সা কোথায় পাবে? নেশার সমস্যা আছে, কিন্তু সেগুলো ঐ বাংলা চোলাই জাতীয়। 
তবে একবার আমার ডাক পড়েছিল সরকারী হাসপাতালে, একটা সার্জারীর জন্য…এখানে তো সার্জন অত আ্যভেলেবল নয়, তাই ওরা অনেক সময় আমাদের হেল্প নেয়। তো সেটা ছিল একটা ড্রাগ মিউলের কেস।”

“ড্রাগ মিউল আবার কি ফেলুবাবু? খচ্চড় ড্রাগ বয়ে আনে নাকি?”
“না লালমোহনবাবু, পশুতে নয়। মানুষে বয়। গরীব মানুষকে সামান্য পয়সার লোভ বা ভয় দেখিয়ে এই কাজ করানো হয়। তাদের ছোট ছোট ড্রাগ ভর্তি প্লাস্টিকের পোঁটলা গিলিয়ে দেওয়া হয়। ফলে পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়া যায়। ঐ লোকগুলোই তখন চলমান ড্রাগবাহক বা মিউল। এভাবে এক এক জন মিউল কোটি টাকার কোকেন ক্যারি করতে পারে।”

“কি সাংঘাতিক! কিন্তু পেটে তো আ্যসিড থাকে মশাই।ঐ প্লাস্টিকের পোঁটলাগুলো ফেটে টেটে যায় না?”
“এমন জিনিস ব্যবহার হয় যাতে তা না হয়। কারণ ফেটে গেলে মিউল মরবে তো বটেই, কিন্তু কোটি টাকার কোকেনও বরবাদ হবে। তাই ঠিকঠাক মেটিরিয়ালের পাউচ বানানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। গুড কোয়ালিটি ল্যাটেক্স, প্রেফারেবলি মাল্টি লেয়ার্ড, লো পারমিয়াবিলিটি…” 

“এত স্বত্ত্বেও সে রকম দুর্ঘটনা মাঝে মাঝে ঘটে বই কি! ঐ মিউলের তখন প্রাণ সংশয়…হেভি ড্রাগ ওভারডোজে। সেকরমই হয়েছিল এখানে ক’দিন আগে। সরকারী হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল একজনকে। তারই এমার্জেন্সী গ্যাস্ট্রিক সার্জারীতে সাহায্য করতে আমার ডাক পরে।” মণিদি বুঝিয়ে বলে।
“যে লোকটির অপারেশন হয়েছিল তার নামধাম পাওয়া যাবে?” ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
“তা আমি গিয়ে হাসপাতালে চাইলে ওরা দেবে মনে হয় আমাকে।”
“তাহলে চলুন হাসপাতাল” ফেলুদা উঠে বলল।
“কিন্তু এত রাতে?”
“তাতে কি? হাসপাতাল তো! ২৪ ঘন্টা খোলা।”

হাসপাতালে গিয়ে কিন্তু কোন লাভ হল না। লোকটিকে কেউ হাসপাতালের সামনে ফেলে গেছিল। সেরে যাবার পর পুলিশ এসেছিল। কথা ছিল পরদিন এসে জেরা করবে। কিন্তু তার আগেই লোকটি পালায়। এই সরকারী হাসপাতালে সিকিউরিটি এমন কিছু কড়া না, কোন ওয়ার্ডবয়কে কিছু টাকা দিয়ে পালানো কিছুই নয়। লোকটি নিজের নাম বলেছিল মোহন, এর চেয়ে বেশি কিছু জানা গেল না।

“আপনি বাড়ি যান ডাঃ ব্যানার্জি। আমি ভেবে দেখছি কি করা যায়।” ফেলুদা অবশেষে বলল।
“হ্যাঁ সে তো যেতেই হবে। আপনিও হোটেলে ফিরে যান। অনেক করেছেন আপনি, আর ঝামেলায় জড়াবেন না। আপনার সোল্ডার ইনজুরি এখনো পুরো সারে নি।”
বলে মণিদি বিদায় নিল।

—————————————————
পর্ব ৫ঃ শিবতীর্থ
—————————————————

ফেলুদা কিন্তু হোটেলে না ফিরে ঘুরল বাজারের দিকে।
“আপনি কি মশাই আবার তদন্ত করার তালে আছেন? এবার ক্ষ্যামা দিন তো। এখনো পুরো সারেননি আগের জখম থেকে, একটা কুকুরের জন্য…ডাঃ ব্যানার্জিও তো বললেন ছেড়ে দিতে।”
“এটা কিন্তু আর কুকুরের নেই লালমোহনবাবু, কোকেনের মামলা হয়ে গেছে। যাকগে, আপনারা হোটেলে যান, আমি ঐ ওষুধের দোকান থেকে  আরো ক’টা পেইনকিলার কিনে নিয়ে আসছি। মিনিট পনেরর বেশী লাগবে না।”

হোটেলে ফিরে আমাদের ঘরে বসে গপ্প করতে করতে আমি আর জটায়ু যখন এক ঘন্টা কাটিয়ে ফেলার পরেও ফেলুদা ফিরল না, তখন চিন্তা হতে লাগল।
“তোমার দাদার এই ব্যাপারটা না ফ্র্যাঙ্কলি ভেরি ইরিটেটিং তপেশ।” জটায়ু ভুরু টুরু কুঁচকে বললেন।
“দেখি আর আধঘন্টা মত, নাহলে…”
“না হলে কি করবে বলতো তপেশভাই?”
“জানিনা। মাথায় আসছে না কিছু। একবার মণিদিকে..”
“না না, এই রাত বিরেতে, এটা তো কোন ডাক্তারী কেসও নয়। তারচেয়ে বরং পুলিশের কাছে..”

“পুলিশের কাছে কি হবে লালমোহনবাবু?”
 ফেলুদা ফিরেছে।
“এই তোমার পনের মিনিট? ওষুধ কিনতে ক ঘন্টা লাগে ফেলুদা?”
“আরে ওষুধ কিনতে গিয়েই তো অযাচিত ভাবে একটা ক্ল্যু পেয়ে গেলাম। ফলে সেটার একটু তদন্ত না করে তো আর আসা যাচ্ছিল না।”
“কিসের ক্ল্যু মশাই”?
“দেখলাম আমার আগের লোকটা ষোল বাক্স কন্ডোম কিনল।”
“ক্কি, কি বলছেন মশাই…তপেশের সামনে…ছি ছি ছি…”
“আপনি ধিক্কারটা থামান মশাই। এগুলো ইউরোপে ১০/১২ বছরের বাচ্চাদের স্কুলে শেখায়।তোপসে আর তিন মাস পরে আ্যডাল্ট হবে। ওর বায়োলজি টেক্সট বইতে আছে, ও যদি কিছু না জানে তো আমি ওর আসন্ন হায়ার সেকেন্ডারী নিয়ে সবিশেষ চিন্তায় পড়ব।”

“কিন্তু ফেলুদা তার থেকে তুমি ক্ল্যুটা কি পেলে? একটা লোক ফার্মেসীতে কিনতে এসেছে তো এর মধ্যে অস্বাভাবিক ব্যাপারটা কোথায়?”
“অস্বাভাবিকত্বটা পরিমাণে। ঐ পরিমাণ একসঙ্গে কেনা…হাউ শ্যুড আই সে ইট…মোস্ট লাইকলি ইজ নট ফর দ্য ইনটেন্ডেড পারপাস!”
“তার মানে?” লালমোহনবাবুর প্রশ্ন।
“জানেন আর কিসে কিসে এর ব্যবহার হতে পারে?”
“হ্যাঁ …মা-মানে, সে তো আর না জানার কি আছে…” লালমোহনবাবু বেগুনী হয়ে গিয়ে তোতলাচ্ছেন।
“না, আমি এর প্রাইমারী ফাংশন আ্যজ এ বার্থ কন্ট্রোল টুলের কথা বলছি না…” ফেলুদাকে অসহিষ্ণু শোনায়।
“দেয়ার আর মেনি আদার লেসার নোন ইউজেজ, যেমন আন্ডার ওয়াটার সাউন্ড রেকর্ডিঙে লাগে আ্যজ এ ওয়াটার টাইট স্যাক ট্যু পুট দ্য মাইক্রোরেকর্ডার ইন। তেমনি…”

“আ্যজ ড্রাগ পাউচ…ফর দ্য মিউলস!” আমি বলে উঠি কারণ আমার মাথায় চট করে খেলে গেছে টাইমস ম্যাগাজিনের একটা আর্টিকেল।

“সাবাশ তোপসে। হ্যাঁ , আমি শিওর এগুলো কেনা হচ্ছে ওগুলোকে ড্রাগ পাউচ হিসেবে ব্যবহার করতে। আর তারপর সেগুলো মিউলের মাধ্যমে পাচার করতে।এটা অত্যন্ত ওয়েল নোন টেকনিক।পৃথিবীর সর্বত্র…মেক্সিকো, কলম্বিয়া থেকে ফার ইস্টের বিভিন্ন দেশেই বহুল প্রচলিত।”
“বলেন কি মশাই? ঐ জিনিস ড্রাগ পাচারের কাজে লাগে? জানতুম না তো!” বলে ওঠেন জটায়ু।
“ গুড কোয়ালিটি ল্যাটেক্স, ভেরি লো পারমিয়াবিলিটি, —মিউলদের পেটে ইনট্যাক্ট অবস্থায় থাকার সব গুণ আছে।তা ছাড়াও সস্তা, সহজলভ্য এবং সন্দেহউদ্রেককরী নয়। সুতরাং ড্রাগের কারবারীদের কাছে বেশ পছন্দের অপশন।”

“আমি একবার টাইমসে একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম।দু তিন পিস একসঙ্গে ইউজ করে মাল্টিলেয়ার্ড পাউচ বানায়, মিউলদের পেটের আ্যসিডে অক্ষত রাখার জন্য। তাই বোধহয় এই বাল্ক পারচেস, না ফেলুদা?”
“এক্সাক্টলি! তাই আমি দোকানদারের সঙ্গে ভাব জমিয়ে জানার চেষ্টা করলাম ক্রেতাটি কে! “
“জানতে পারলেন কে?”
“হ্যাঁ । সাম তিওয়ারী। মাঝে মাঝেই এভাবে এসে লার্জ কোয়ান্টিটিতে কিনে নিয়ে যায়। অদ্ভুতভাবে কেউ সন্দেহও করে না…দে ওয়্যার জাস্ট মেকিং সাম টেস্টলেস পুয়োর জোকস আ্যবাউট হিজ প্রাওয়েস। এনিওয়ে ওরা বলতে পারল না তিওয়ারী কোথায় থাকে, তবে বলল যে ও একটা বাইকে চেপে আসে যেটা সারাই করায় মাঝে মাঝে বাজারের নাথ্থু গ্যারেজে।”

“তা তখন আপনি নাথ্থু গ্যারেজ গেলেন নাকি?”
“ন্যাচেরালি!  ওখানে ওদের মেকানিক ইসমাইলের থেকে পাওয়া গেল আসল খবর। ওদের ওখানে কাজ করত মোহন নামে এক হেল্পার যে গত একমাস ধরে আসছে না পেটে আ্যপেন্ডিক্স অপারেশন হয়েছে বলে। তিওয়ারীর কাজ মূলতঃ মোহনই দেখত। ওদের কাজের চাপ খুব বেড়ে গেছে মোহন না থাকায়। আর শেষ খবরটা হল…তিওয়ারী ওয়ার্কস আ্যট দ্য মেঘরাজ হাউস!”

এরপর খট করে যে আওয়াজটা হল সেটা জটায়ুর দাঁতে দাঁতে লাগার।
              ———-
“আমাদের আগেই বোঝা উচিৎ ছিল মশাই। পাহাড়ী জায়গা, ড্রাগ…এ আমাদের মগনলাল ছাড়া কেউ না।”
পরদিন সকালে গাড়ির দিকে যেতে যেতে বলেন জটায়ু।
“শুধু তাই না। সবই শিবের তীর্থ। কাশী, পশুপতিনাথ কিম্বা এই কেদার-বদ্রী।” ফেলুদা মনে করিয়ে দেয়।
“হ্যাঁ মশাই, সেই জন্য তো কেদারে কেনা ঐ পাথরের শিবও কাছেই রেখেছি।”
কাঁধের ঝোলা থাবড়ে বুঝিয়ে দেন জটায়ু।
“বেশ একটা কনফিডেন্স পাওয়া যায়, বুঝলেন তো!”

“ভেবে দেখুন আপনি যাবেন কিনা। আপনাকে যেতেই হবে এমন কিন্তু কোন মানে নেই। মগনলাল পার্টিকুলারলি আপনাকে যেমন নাজেহাল করে তাতে করে আপনি না গেলে আমি কিচ্ছু মনে করব না…”
“ফেলুবাবু, আপনি কিন্তু আমায় দারুণ আন্ডার এস্টিমেট করছেন। আমরা যে থ্রি মাস্কেটিয়ার্স তাও কি ভুলে গেলেন?” জটায়ু গম্ভীর হয়ে বললেন।
“এবারে তাহলে থ্রি নয়, ফোর মাস্কেটিয়ার্স।” দূরে মণিদিকে দেখিয়ে বলল ফেলুদা।
“কি মশাই! ওঁর মত একজন মহিলাকে নিয়ে মগনলালের বাড়িতে… না না। মানা করুন ওঁকে।”
“পারলে করুন আপনি। সকালে উনি ফোন করেছিলেন। বললাম এই ব্যাপার তো উনি জেদ ধরলেন যাবেনই। বারণ করতে গেলাম তো দুকথা শুনিয়ে দিলেন কিসব নারীবিদ্বেষী টেসী বলে। আপনার সাহসে কুলোয় তো মানা করুনগে যান।”

মেঘরাজ হাউস শহর থেকে একটু দূরে একটা সুন্দর ছবির মত সাদা বাড়ি, বিরাট কম্পাউন্ডের মাঝখানে। চারপাশে পাইন ফারের জঙ্গল। গেট থেকে নুড়ি বিছানো পথ তার মধ্যে দিয়ে অনেকটা গিয়ে শেষ হয়েছে গাড়িবারান্দার নীচে। গোল গাড়িবারন্দার নীচে বড় ফোয়ারা, চারপাশে ফুলের কেয়ারি।আমরা গেটের সামনে গিয়ে আমাদের ভাড়ার গাড়ি ছেড়ে দিয়ে দারোয়ানকে বললাম মেঘরাজ মশাইকে জানাতে যে কলকাতা থেকে তাঁর চেনা মিঃ মিত্র এসেছেন দেখা করতে। সে ইন্টারকমে কথা বলে নিয়ে আমাদের প্রবেশের অনুমতি দিল।

ভেতরের সুসজ্জিত বসার ঘরে কিছুক্ষণ বসার পরেই শুনলাম পরিচিত কণ্ঠস্বরঃ
“আরে মিঃ মিত্তর নাকি! কি সৌভাগ্য হামার…সাথমে কাজিন ঔর আঙ্কল কো তো ম্যয় পহচানতা হুঁ, লেকিন ইয়ে মোহতরমা কৌন হ্যায়? ভাবীজী?”
“ না মিঃ মেঘরাজ। ওঁর একটা জিনিস হয়তো আপনার কাছে আছে। সেই জন্যেই আসা আর কি!”
“আচ্ছা। উনকি কোঈ চীজকে লিয়ে আপ সিধা মেরে ঘর আ পঁহচে। বিনা কোঈ ডর! তব তো ইয়ে সায়দ হোনেবালি ভাবীজী হ্যায়। শরমাইয়ে মত। বোল দিজিয়ে, হাম তো ঠেহরে পুরানে জান পহচান বালে..”

ফেলুদা মগনলালের খোঁচা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল,
“মগনলালজি, পরশু রাতে আপনার লোকেরা যখন কোকেন ডেলিভারী নিচ্ছিল ব্রীজের পাশে, তখন কোনো কুকুর আপনাদের বড্ড বিরক্ত করে। যার ফলে আপনারা তাকে চুপ করান জোরপূর্বক।সেই কুকুরটি কোথায় এখন বলতে পারেন?”
“কুকুর ? আরে উয়ো স্নিফার ডগ! ক্যায়া ভাবীজী, উয়ো স্নিফার ডগ লেকে আপ ক্যায়া করেঙ্গে? মিঃ মিত্রা সে কহিয়ে উয়ো আপকো এক ছোটাসা, প্যারা সা পুডল দিলা দেঙ্গে। খুব যাচেগা আপকো!”
মণিদিও দেখলাম বেশ বুদ্ধিমতী। কোনো রিআ্যক্ট করল না।

“তাহলে আপনার ড্রাগ মিউলের কারবারটা…মানে পাউচ বানানো , মিউলদের দিয়ে সেটা ক্যারি করানো সব কি আপনার এই বাড়ি থেকেই হয় নাকি?” 
ফেলুদা নিজের লাইন অফ কোয়েশ্চনসে অটল।
“আপ ইয়ে ক্যায়া অনাব শনাব বকে যা রহে হ্যায় মিঃ মিত্তর? হাঁ কোকেন কা কাম হাম থোড়া বহুৎ করতে হ্যায়  আ্যজ এ রিক্রিয়েশনাল ড্রাগ। লেকিন ইয়ে ড্রাগ মিউল ব্যাগেড়া…”
“তাহলে আপনার কর্মচারী তিওয়ারী কাল ওরকম বাল্ক পারচেজ অব কন্ডোমস করল কেন? দোকানে যা ছিল সব?”

“ আররে মিঃ মিত্র … আব সমঝা!” হেসে উঠল মগনলাল ।
“আপকো জরুরত থী  উয়ো চীজ, পর মিলি নেহি…ইসি লিয়ে ইতনা নারাজ হ্যায়….মুঝ পর, তিওয়ারী পর, সারি দুনিয়া পর! বহুৎ গলত কিয়া উস তিওয়ারী নে…”
মগনলালের উস্কানি অব্যাহত।

“ঔর আঙ্কলজি, আপ ক্যায়সে হ্যায়? ঠিক ঠাক”?
“আ্যঁ হ্যাঁ …সব ঠিক ঠাক, ঠিক ঠাক”। জটায়ু চমকে উঠে বলেন।
“মিঃ মিত্তর নে তো ঢুঁঢ লিয়া আপনি মাশুকা, ঔর আপকো কোঈ মিলি নেহি ক্যায়া আভি, আঙ্কলজি?”
“না না…মেরা তো মানে কুছ নেহি…মানে ম্যায় করতা নেহি এই সমস্ত।”
“কিঁউ? নামর্দ হ্যায় আপ…?”
মগনলালের সাহস বেড়ে চলেছে। ফেলুদা কি ভাবছে জানিনা। এই বাক্যবাণ আর কতক্ষণ সহ্য করবে ও…!

“ইউ কান্ট টক ট্যু হিম লাইক দ্যাট”, ফেলুদা কিছু বলার আগেই মণিদি বলে উঠেছে।
“ক্যায়া”? মগনলাল হকচকিয়ে গেছে।
“উনি একজন নামকরা সাহিত্যিক এবং ভদ্রলোক । এভাবে আপনি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে পারেন না”। মণিদি গনগনে গলায় বলে ওঠে।

“আরে মিঃ মিত্তর, আপকো তো শেরনি মিলি হ্যায়। বাধাই হো। ঔর মেরে নসিব দেখিয়ে… কালি ভৈঁস!
খ্যার ছোড়িয়ে, আপ আয়ে হ্যায় ইধার শিউজিকা দর্শন কিজিয়ে আঙ্কলকে সাথ, কাজিন কে সাথ পাহাড় মে চঢিয়ে, ভাবীজীকে সাথ রোমান্স কিজিয়ে…কেঁও ঝুটমুট আপনা অউর মেরা টাইম এক কুত্তে কে পিছে বরবাদ কর রহে হ্যায়? 
তিওয়ারীকে বারেঁ মে পুছ রহে থে না? বুলাতা হুঁ ম্যয় …তিওয়ারী,আরে ও তিওয়ারী ইধার আ জারা…” 

ভেতর থেকে বেরিয়ে এল খোলা পিস্তল হাতে ন্যাড়া মাথা তিওয়ারী। হাতের কব্জির কাছে একটা ব্যান্ডেজ। বোধহয় হালুম বাবুর দাঁতের কাজ।

“যা তিওয়ারী ইন লোগোকো বাহার ছোড় আ। অউর গনেশ , তু ভী ইধার আ…”

আর একজন দশাসই লোক এসে হাজির হল। এর হাতে পিস্তল নেই বটে তবে রীতিমত পালোয়ান।
“গনেশ, তু মিঃ মিত্তরকে বিলকুল বগল মে রহনা, কোঈ উল্টি সিধি হরকত করনে না পায়ে ইয়ে।”

আমরা পর পর লাইন করে বেরিয়ে এলাম। আগে আমি, তারপর জটায়ু , তারপর ফেলুদা সবার শেষে মণিদি। নুড়িবিছানো পথ দিয়ে একটু এগোতেই শুনলাম “আঃ”, মণিদি বেচারা হোঁচট খেয়ে পড়ছে। তুলবার জন্য এগোনো যাবে কিনা ভাবার আগেই দেখলাম তিওয়ারী একটু নীচু হয়ে বাঁ হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মণিদির দিকে । ডান হাতে রিভলভার ধরা।
বেচারী ভূপতিত মহিলার প্রতি গুন্ডাদেরও দয়া হয়!

কিন্তু মণিদি বাড়ানো হাত ধরে ওঠার বদলে এক হ্যাঁচকা টান এমন ভাবে দিল যে তিওয়ারী কুমড়ো গড়াগড়ি আর একই সঙ্গে ও নিজে উঠে দাঁড়াল। তিওয়ারীর হাতের রিভলভার ছিটকে গেল যেটা সঙ্গে সঙ্গে আমি তুলে নিয়ে তাক করলাম।ফেলুদা ওর পাশের গনেশ লোকটাকে ততক্ষণে কাবু করে মাটিতে ফেলেছে, ধ্বস্তাধস্তি চলছে…এমন সময় ঠকাং। গনেশের মাথায় জটায়ুর ঝোলায় থাকা পাথরের শিবের বাড়ি। এবার লোকটা চোখ এলিয়ে চিৎপাত।

ফেলুদা রিভলভারটা আমার থেকে নিয়ে তিওয়ারীর দিকে চোখ রেখেই মণিদিকে জিজ্ঞেস করল “জুজুৎসু শিখতেন বুঝি?’ উচি মাতা ‘প্যাঁচে কাত করলেন না তিওয়ারীকে?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ । ব্লু বেল্টের বেশী এগোইনি, তবে কাজে লেগে গেল আজ! তা এবার কি? কতক্ষণ এভাবে পিস্তল তাক করে থাকবেন।”? মণিদির প্রশ্ন।
“আমার হিসেব মত বেশীক্ষণ না। ইনপেক্টর সিং এলেন বলে। সব সিনেমার মত শেষ দৃশ্যে।”
“বাতাইয়ে তিওয়ারী জী সারা সামান অউর উয়ো কুত্তা কিধার হ্যায়।”?

ফেলুদা পরে বলেছিল যে এটা নাকি সাইকোলজ্যিকাল। মানুষের পিউপিল মুভমেন্ট থেকে খুব সহজেই তার আসল মনের ভাব বোঝা যায়।
                তিওয়ারীও মুখে কিছু না বললেও একবার নিজের কব্জির আঘাতের দিকে আর পরক্ষণেই গাড়িবারান্দার নীচে ফোয়ারাটার দিকে তাকাল। আমরা সবাই ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি ফোয়ারার সামনে বাঁধানো জায়াগাটায় একটা ম্যানহোলের ঢাকনার মত। ওপরে আংটা লাগানো। 

“ছুটবেন না ডাঃ ব্যানার্জি “,
বলাটা দরকার ছিল কারণ মণিদি ছুটতে যাচ্ছিল।
“আমি বাইরের রাস্তায় গাড়ির শব্দ পেলাম। পুলিশ ঢুকছে মনে হয়। এদুটোকে তাদের হাতে দিয়ে তারপর আপনার হালুম উদ্ধার।”

পাঁচমিনিটের মধ্যে পুলিশ এসে তিওয়ারী আর গনেশকে হাতকড়া পড়িয়ে জীপে তুলল। দুজন বাড়ির ভেতরে গেল বোধহয় মগনলালের সঙ্গে কথা বলতে।তারপর ম্যানহোলের ঢাকনা তুলতেই দেখা গেল ভেতর দিয়ে লোহার সিঁড়ি নেমে গেছে। পুলিশের পেছন পেছন আমরা চারজনও নেমে এলাম সেটা দিয়ে। নীচে একটা হলের মত। সামনের দরজাটার তালা খুলতেই দেখা গেল ভেতরে বিশাল কারখানার মত ঘর। সেখানে কোকেনের প্যাকেট, পাউচ সবই পাওয়া গেল। আসলে পুরো মেঘরাজ হাউসের বেসমেন্ট জুড়েই এই কারবার। আমরা যেখান দিয়ে এলাম সেটা ছাড়াও বাড়ির মধ্যে থেকে এখানে আসারও নিশ্চয় রাস্তা আছে। তবে সেসব এখন পুলিশ দেখবে। আমরা উঠে এলাম ওপরে।

“ও মিঃ মিত্তির, সবই তো হল, কিন্তু আমার বাচ্চাটা…” মণিদি এখনো দুঃখী।
“চলুন ঐ আউট হাউসে দেখি, নয়তো মগনলালকে আবার দাবড়ানি দিয়ে খোঁজ বের করতে হবে।”
“ওকে দাবড়ানি এমনিই দিতে হবে! ভাবীজি বলা আমি বের করছি ওর”।
“দেখুন মগনলালের হাজার দোষ, কিন্তু ভাবীজি বলা ইজ হার্ডলি এ ক্রাইম। বহেনজীতে তো চটেন না। ভাবীজি বললে চটেন কেন?”
“ইজি ফর ইউ ট্যু সে! আপনাকে তো আর বলেনি!”
“বলতে তো কিছু বাকীও রাখেনি। ছিলেন তো ওখানেই বসে, শোনেননি?”

এর মধ্যে এসে গেছি আউটহাউসের সামনে।
ভেতরের ঘর থেকে চাপা ভৌ ভৌ আওয়াজ আসছিল। একজন কনস্টেবল দরজা টা খুলতেই তীরের মত ছিটকে বেরিয়ে এলেন হর্ষবর্ধন বন্দ্যোপাধ্যায়।

তারপর কুড়ি সেকেন্ডে যে ঠিক কি কি জিনিস কি অর্ডারে ঘটল তা বোঝানোই শক্ত, তবু চেষ্টা করছি।
বাইরে দাঁড়িয়েছিল ফেলুদা। তার একটু পেছনে মণিদি। হালুম মারল ঝাঁপ মণিদির দিকে। ফেলুদা গেল লাফিয়ে পিছনে সরতে, মণিদি গেল এগিয়ে হালুমকে ধরতে…এই ত্রিবিধ ঝটাপটিতে দেখলাম ফেলুদা, মণিদি আর হালুম তিনজনেই ঢালু মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

-————————————————
পর্ব ৬ঃ Syzygy 
—————————————————

“সেই পড়লেন আমার ঘাড়ে?” উঠে দাঁড়িয়ে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল মণিদি!
“আমার পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন কেন? “ ফেলুদাও উঠে দাঁড়িয়েছে।
“আমি মোটেই আপনার পেছনে দাঁড়াইনি। হালুমটা ছুটে আসছিল আমার দিকে, আপনি কোথায় সরে যাবেন, তা না…”
“সরতে গিয়েই তো এই কান্ড। যাকগে, লেগেছে নাকি আপনার?”
“তা আর না লাগে! ওজন আছে বাপু আপনার! দেখে তো মোটা লাগে না, তবু…”
“ওজন ফ্যাটের হয় না। হয় মাসল আর হাড়ের । ডাক্তার হয়ে জানেন না সেকথা?”
“জানি কিন্তু…ও কি? আবার আপনার কাঁধে চোট পেলেন নাকি?”
“না না ঠিক আছে বোধহয়”। কাঁধে হাত বুলিয়ে বিকৃত মুখে বলে ফেলুদা।
“ঠিক আছে কিনা সে তো আমি বুঝব। প্রেসির লোকেরা ভাবে বটে তারা সর্বজ্ঞ, তবে সেটা তো ঠিক নয়! দেখি কি অবস্থা। বসুন একটু, নয়তো আমি নাগাল পাব কি করে? যা ঢ্যাঙা আপনি!”

আমি যতক্ষণ হালুমের সঙ্গে খেলছিলাম তারমধ্যে আবার চোট পরীক্ষা হল। এবার যে ফেলুদার মুখের রং বদলে গেল সেটা আমি আড়চোখে হলেও পষ্ট দেখেছি…চোখের ভুল টুল নয় মোটেই। আবার ফেলুদার চোখে চোখ পড়তেই মণিদিও কেমন জানি দুম করে ডাক্তারীটা শেষ করে হুটপাট সরে দাঁড়াল।
“ঠি-ঠিক আছে। সে-এ-রে এসেছে মনে হয়”। এবার দেখছি মণিদির তোতলানোর পালা।

তা, সব  যখন ঠিকঠাক আছে, তখন ফেরা যেতে পারে।

                   ——————
বিকেলে একটা ক্যাফেতে বসেছিলাম চার জনে। আমি জ্যুস নিয়েছি। ফেলুদা আর মণিদি কফি আর লালমোহনবাবু চা।

“মগনলালের কি হবে ফেলুবাবু”? জটায়ু জিজ্ঞেস করলেন।
“এখনকার মত তো বামাল সমেত গ্রেপ্তার । কিন্তু এই নিয়ে তো তিনবার হল। লোকটার পয়সাও আছে, কানেকশনও।দুবছর পর আবার কোন তীর্থে দেখা হয়ে গেলে আশ্চর্য হব না।সেই জন্যই আরো কাল গেলাম ওর বাড়ি। শুধু পুলিশকে খবর দিলে ওরা একটা রুটিন এনকোয়ারি করে কোন লীড না পেয়ে ফিরে আসত। মেঘরাজ হাউসের বেসমেন্টে ড্রাগের ব্যবসা চলতেই থাকত ।”
“ও কি আপনার পুরোনো শত্রু নাকি মিঃ মিত্র”? মণিদির প্রশ্ন।
“তা একরকম বলতে পারেন। শার্লক হোমসের যেমন প্রফেসর মরিয়ার্টি…ইনিও তেমন ঘুরে ফিরে এসে পড়েন আমার জীবনে। তবে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি সেদিন অতগুলো ভুলভাল কথা আপনাকে শুনতে হল…”
“তাতে আপনার ক্ষমা চাওয়ার কি হল? আপনাকেও তো বহুকিছু বলল। বললেই কি হয়ে গেল নাকি? যত্তসব। আপনি ছিলেন বলে হালুমটা ফেরত এল…”
“হ্যাঁ , হালুম তো বেশ অভিজ্ঞ স্নিফার ডগ, পুলিশের কুকুরই ছিল তো। ইনস্পেক্টর সিং বললেন যে মাস তিনেক আগে একটা অপারেশনের সময় ও ইনজিওরড হয়ে নদীতে পড়ে যায়। সবাই ভেবেছিল মরেই গেছে, কিন্তু দেখাই যাচ্ছে ও কোনরকমে তীরে উঠে ঐ ব্রীজের তলায় আশ্রয় নেয়।। নামটা অবশ্য হর্ষবর্ধন নয়, জ্যাক! তো সে যাই হোক, নামে কি যায় আসে, এখন আবার ও সঠিক জায়গায় ফিরবে, চিকিৎসাও পাবে।”

“হালুমটার জন্য মন খারাপ লাগছে জানেন। জানি ও ভাল থাকবে, তাও”।
“অত ভাববেন না। বরং আপনি এবার একটা বিয়ে থা করে নিন, নিজের ছেলেপুলে হোক তাহলে দেখবেন আর…” লালমোহন বাবু বলে ওঠেন।
“আপনি কি আমায় প্রস্তাব দিচ্ছেন নাকি?” 
চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করল মণিদি। 
আমি জ্যুসের গ্লাসে বিষম খেলাম।
ফেলুদা অব্দি একটা খোলা হাসি হেসে উঠল।

“এই দ্যাখ! কি কথার কি মানে করে বসল, আপনি কিন্তু খুব গোলমেলে লোক মশাই ।”
“ ভাববেন না, আমি আপনার লেগ পুলিং করছিলাম। আমি জানি আপনি ভাল লোক।”
ফিক করে হেসে বলে মণিদি।
“তাহলে আপনাকে কেউ প্রস্তাব দিলে সে খারাপ লোক হবে বলছেন?” ফেলুদা হাসি থামিয়ে বলল।
“ধুর ধুর, আমাদের দেশে আবার কেউ দিতে পারে নাকি প্রস্তাব… যত সব মায়ের আঁচল ধরা বুড়ো খোকার দল,
মায়ের জন্য দাসী আনতেই শিখেছে কেবল।
                   এক হাঁটু গেড়ে বসে, আংটি দিয়ে বলবে…’উইল ইউ ম্যারি মী’…ব্যাকগ্রাউন্ডে মুন রিভার বাজবে, তবে না…”!
“হুম একদম বিলিতি মতে। তাহলে অবিশ্যি একটু শক্ত ! কখনো যদি পান কাউকে তো জানাবেন, শুভদিনে হাজির থাকব কথা দিলাম।”
           ————————
পরদিন সকালে গাড়িতে মালপত্র তুলছি হোটেলের বাইরে। 
“কই ফেলুবাবু, উঠে আসুন।” হাঁক দেন লালমোহনবাবু।
ফেলুদার চোখ চারিদিকে কি যেন খুঁজছে।
“চলুন”, বলে সবে উঠতে যাবে ড্রাইভারের পাশে এমন সময় দেখা গেল প্রায় দৌড়তে দৌড়তে আসছে মণিদি।

“স্যরি, ভীষণ দেরী হয়ে গেল। আর একটু হলেই মিস করে যেতাম আপনাদের।”
“খুব ভাল হল দেখা হয়ে মণিদি।”
“হ্যাঁ ভাই। বেস্ট উইশেস ফর ইওর হায়ার সেকেন্ডারী। ভালোই হবে তোমার পরীক্ষা। লালমোহনবাবু, আপনার প্লট শুনেও কিন্তু মনে হচ্ছে পরের বইও সুপার হিট। আপনাদের সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে কিনা জানি না, তবে…”

“এ আবার কি কথা ডাঃ ব্যানার্জি , দেখা হবে না কেন? ফোন নাম্বার দিলুম যে! ফোন করবেন। কলকাতা গেলে অবশ্যই দেখা করবেন গড়পারে। ক্যারামেল পুডিং খাওয়াতে পারব না, তবে আমার রান্নার ঠাকুর রাঁধে কিন্তু খাসা।” জটায়ু বলে ওঠেন।
“তা না হলে আর আপনার বাড়িতে ওর চাকরী থাকত নাকি!” ফেলুদা বলে।
“আর ডাঃ ব্যানার্জি, আর একদান খেলা বাকী রইল কিন্তু! সে কলকাতায় হোক দার্জিলিঙে।”
“হারবেন তো সেই আবার! যেখানেই হোক।”
“দেখবেন দার্জিলিং গিয়ে আপনাকে এবার ঠিক হারিয়ে আসব”।
                   ———————
“ কখন যে মানুষের অন্য কারো সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে যায় কিছুই বলা যায় না, বুঝলে তপেশ ভাই”। গাড়ি চলতে শুরু করার কিছুক্ষণ পরে বললেন জটায়ু।
“সে তো বটেই।আপনার সঙ্গেও তো আমাদের আলাপ এরকম পথেই।” আমি মনে করিয়ে দিলাম।
“যা বলেছ ভাই, ভবিতব্য ! আ্যলাইনমেন্ট অফ স্টারস। তাকেই তো বলে ঐ যে ঐ খটমটে শব্দটা…syzygy…তাই না ফেলুবাবু?”

ফেলুদা কিছু না বলে দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়ার রিং ছাড়তে লাগল।