জল তো দাদা এমনিতে শান্তই। ঢিল মেরে কেউ ঢেউ তুলে দিলে কী হয়, বলা যায় না!
ইদের প্রস্তুতির রং তখন লেগে আছে জেলাটা জুড়ে। নানা বিপণিতে বিভিন্ন ছাড়ের ব্যবস্থা, কেনাকাটার ভিড়ে শামিল সব সম্প্রদায়ের, সব ধরনের মানুষ। সেই সময়েই দেখা সানোয়ার ইসলামের সঙ্গে।
পদ্মা দেখার জন্য রঘুনাথগঞ্জের প্রান্তিক গ্রামে ঢুকে সানোয়ারের সঙ্গে মোলাকাত। সেকলিপুরে সরু রাস্তা বেয়ে এগিয়ে বিএসএফ ছাউনিতে কাগজ-পত্র এবং সঙ্গের ব্যাগ বা থলে দেখিয়ে নৌকোর সওয়ারি নিচ্ছেন কত লোক। নদী পার হলে আরও কয়েক কিলোমিটার পেরিয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত। চড়া পড়ে পদ্মা সেখানে শীর্ণকায়। তবে পরিষ্কার, টলটলে জল! চোখের অদ্ভুত আরাম, পারে গিয়ে দাঁড়ালেও মন শান্ত হয়। সেই তল্লাটেই মনিহারি দোকান চালানো সানোয়ার বলেছিলেন শান্ত জলে ঢিল মেরে কল্লোল তুলতে চাওয়ার কথা।
এই আলাপচারিতার পরে মেরেকেটে দিন পনেরো পেরোতে না পেরোতেই হিংসার আগুনে পুড়েছে মুর্শিদাবাদে ওই জঙ্গিপুরের বেশ কিছু এলাকা। ধুলিয়ান, সুতি, শমসেরগঞ্জ। দেদার লুঠপাট হয়েছে, পুলিশের গাড়িতে হামলা হয়েছে, আগুন জ্বলেছে। চলে গিয়েছে তিনটি প্রাণ। আহতের সংখ্যা বেশ কিছু। উপলক্ষ, কেন্দ্রীয় সরকারের আনা ওয়াকফ সংশোধনী আইনের প্রতিবাদ। সে প্রতিবাদের চেহারা কয়েক বছর আগে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) বিরোধিতায় বিক্ষোভকে মনে করিয়ে দিচ্ছে অনেকটাই। ঘটনার পরে অবধারিত ভাবে রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস এবং প্রধান বিরোধী বিজেপির উচ্চ গ্রামের তরজা শুরু হয়ে গিয়েছে।
মুখ খুলেছেন মুখ্যমন্ত্রীও। মুর্শিদাবাদের ঘটনার জন্য তিনি বিজেপি তো বটেই, শান্তি রক্ষায় উদ্যোগী না-হওয়ার জন্য আঙুল তুলেছেন কংগ্রেসের দিকেও। বিএসএফ-কে দোষী করেছেন। আর সার্বিক পরিকল্পনার নেপথ্যের কারিগর চিহ্নিত করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশে আবেদন করেছেন শাহকে সামলে (কন্ট্রোল) রাখার!
বসিরহাট, সন্দেশখালি বা শমসেরগঞ্জ হোক, রাজ্যের কোনও জায়গায় অশান্তির কিছু ঘটলেই চক্রান্তের অভিযোগ রাজ্যের শাসক পক্ষের গলায় অহরহ শোনা যায়। মুর্শিদাবাদের সাম্প্রতিক ঘটনায় 'চক্রান্তে'র কথা মাথায় রেখেও কেউ যদি প্রশ্ন তোলে— বিরোধী দল বিজেপি বাইরে থেকে গুন্ডা বা দুষ্কৃতী আনল, বিএসএফ কিছু টাকা দিয়ে বাচ্চা ছেলেদের দিয়ে পাথর ছোঁড়াল, কেউ এসে গুলি চালিয়ে দিল, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের অভিযোগ মতো এই সবক'টা ঘটনাই এ ভাবে বিনা বাধায় ঘটে গেলে প্রশাসন করছিল কী? পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ কোথায় ছিল? অশান্তির আগুন ছড়িয়ে পড়ছে দেখেও পুলিশ প্রথম দিকে কেন তৎপর হল না? মুখ্যমন্ত্রী এই পর্বে একাধিক বার শান্তি বজায় রাখার আবেদন করেছেন ঠিকই। কিন্তু আবেদনই কি একমাত্র এবং শেষ কথা? দুষ্কৃতী-রাজ যদি জাঁকিয়ে বসতে চায়, আইন হাতে তুলে নিয়ে কোনও অপশক্তি যদি জীবন, জীবিকা, সম্পত্তি ধ্বংসের খেলায় নামে, প্রশাসনের তখন দায়িত্ব কী?
ধুলিয়ানের জাফরাবাদে উন্মত্ত তাণ্ডবকারীদের হাতে খুন হয়ে গিয়েছেন বাবা ও ছেলে। পারিবারিক ব্যবসা আছে তাঁদের। বাবা ছিলেন সিপিএমের সক্রিয় কর্মী, বয়সের কারণে পরে আর সদস্যপদ নবীকরণ করেননি। ওই রানিপাড়ায় হামলাকারীদের লুটপাট ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা আরও উন্মত্ত হয়ে, দল ভারী করে পাড়ায় ঢুকে আসে। ধারালো, ভোঁতা নানা সরঞ্জাম নিয়ে হামলা চালায়, যার পরিণতি, বাড়ির সামনেই বাবা-ছেলের মৃত্যু। একের পর এক বাড়িতে হামলার দাগ বাসিন্দারাই দেখিয়েছেন। পরে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এবং কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য অধীর চৌধুরী যখন এলাকায় গিয়েছেন, বাসিন্দারা সমস্বরে অভিযোগ করেছেন, তাণ্ডব চলাকালীন খবর দেওয়া হলেও পুলিশ সেখানে আসতে চায়নি। গাড়িতে থানা মিনিটদশেকের দূরত্বে হলেও সে দিন হিংস্র বাহিনীর মুখে অসহায় হয়ে লড়ে যেতে হয়েছে বাসিন্দাদের। রাজনৈতিক দলের সফরের সময়ে ওঠা ভিডিয়োয় ধরা পড়ছে বাসিন্দাদের ক্ষোভ। কেন সে দিন পুলিশ ও'ভাবে মুখ ঘুরিয়ে থাকল, তার উত্তর কি বিরোধী দল বা বিএসএফ দেবে!
সুতির কাসেমনগরে মারা গিয়েছেন ২১ বছরের আর এক যুবক। তাঁর শরীরে গুলির ক্ষত ছিল। পরিবারের বক্তব্য, পুলিশই তাঁকে নিয়ে গিয়ে জঙ্গিপুরের হাসপাতালে ভর্তি করায়। বুলেট বার করে নেওয়া হয়। তার পরে বলা হয় বহরমপুরের বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে। জঙ্গিপুর থেকে হাসপাতালের কোনও অ্যাম্বুল্যান্স ওই পরিবার পায়নি। ওই গোলমালের মধ্যে টাকা দিয়ে গাড়ি জোগাড় করে বহরমপুরে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হলেও রক্তক্ষরণ চলতে থাকা যুবককে বাঁচানো যায়নি। হাসপাতালে ভর্তি আরও কয়েকজনের গুলির আঘাত আছে, স্থানীয় মানুষ এবং পরিবারের লোকেরাই বলছেন। পুলিশি তৎপরতায় তাঁদেরও বুলেট বার করে নেওয়া হয়েছে।
শাসক শিবিরের অন্দরেও আলোচনা আছে শমসেরগঞ্জ এবং সুতি থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের নিয়ে। গোলমাল সেখানে পরতে পরতে বেড়েছে, ওই এলাকার পুলিশই আর্ত বাসিন্দাদের ডাক পেয়েও যায়নি বলে অভিযোগ। সংশ্লিষ্ট পুলিশ আধিকারিকদের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের অভ্যন্তরেও চর্চা আছে। এবং ঘটনার কয়েক দিন পরে সরকারি আদেশ জারি করে দুই থানায় নতুন আইসি (আগে ইনস্পেক্টর স্তরের কেউ দায়িত্বে ছিলেন না ওখানে) নিয়োগ করা হয়েছে, পুরনো আধিকারিকদের আপাতত পাঠানো হয়েছে পুলিশ লাইনে। পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (এসআইটি) গঠন করে তদন্ত চলাকালীন এই বদলির পদক্ষেপে কিছু ইঙ্গিত মিলছে কি?
গোটা ঘটনার গতিপ্রকৃতি দেখে কেউ যদি প্রশ্ন তোলেন, নিয়োগ-দুর্নীতি এবং ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি হারানোর সঙ্কট ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই এমন এক হিংসালীলা চলতে দেওয়া হল কি না, খুব অসঙ্গত প্রশ্ন হবে কি? বেশ কিছু দিন ধরেই বাংলা জুড়ে হিন্দুত্ববাদী জিগির তোলার চেষ্টা চলছে চড়া সুরে। রামনবমী পালনকে ঘিরে হুঙ্কারের বহর কারওরই নজর এড়ানোর কথা নয়। কিন্তু হাতে জ্বলন্ত কাঠি নিয়ে যারা ঘুরছে, তাদের জন্য বারুদের স্তূপ মজুত রাখা কি একই কৌশলের অঙ্গ নয়? নাকি সেটা কিছু কম অপরাধ?
এই আঁধারে ওই সানোয়ারের কথাটাই ফিরে ফিরে ভাবায়। ''জল তো দাদা এমনিতে শান্তই। ঢিল মেরে কেউ ঢেউ তুলে দিলে কী হয়, বলা যায় না!''
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন