আমার ছোট্ট শহর দূর্গাপুর। বেড়ে ওঠার সময় লক্ষ্য করেছিলাম নবী'র সদ্যজাত বোন রিঙ্কিদের বাড়িতে খুব আদর-যত্ন পেতো। রিঙ্কিদের বাড়িতে আমার-ও খুব যাওয়া-আসা ছিল ছুটির দিনে। দূর্গাপূজোর ছুটির আগে আমাদের এক বিশেষ আলোচনার বিষয় ছিল কার ক'টা নতুন জামা হয়েছে। এমনি এক বছর জানতে পারলাম নবীদের নাকি পূজোতে নতুন জামা হয় না। তাই রিঙ্কির বাড়ি থেকে জামা দেয়া হয়। ব্যাপারটা কেন এমনি জানার কৌতূহল প্রকাশের বিশেষ জায়গা ছিল না। বাবা-মা খুব কড়া করে বুঝিয়েছিলেন কার কতগুলো জামা হয়েছে সেই নিয়ে আলোচনা করা মোটেই ভালো জিনিস নয়। পরে বড়ো হয়ে বুঝেছিলাম নবীরা ইসলাম ধর্মালম্বী তাই ওদের বছরকার জামা ঈদ এর সময় হয়। এই বেলা বলে রাখি আমাদের বাবাদের বেতনে তখন নতুন জামা বছরে একবারই কেনা সম্ভব ছিল। অনেকের তা-ও হতোনা নানা রকম পারিবারিক দায়বদ্ধতা সামাল দিতে গিয়ে।
তখন আমি ক্লাস ৭ কি ৮। ওই সময় জানতে পারলাম আমার অনেক বন্ধুরা পূজোতে অষ্টমী র পূজো দেয়।ছায়া-কে তখন নতুন নতুন চিনছি। সে বললো ওর নাকি আগের বছরের মতো সেই বছরও অষ্টমীর অঞ্জলির সব প্ল্যান সারা। খুব সমস্যায় পড়লো মন। বললাম, হোক তাহলে এবার। আমিও দেব পূজো। ছায়ার কাছেই জেনেছিলাম কি কি করতে হবে। কারণ পূজোর ব্যাপারে পটুয়া বন্ধুরা আমাকে নিয়ে মজা করতো কিন্তু ছায়া খুব ভালো করে আমাকে দু'-চারটে জিনিস বুঝিয়ে দিয়েছিলো। ছায়ার ভালো নাম ছিল রেহানা বেগম।
ইরফান মামা, ছোটবেলা থেকেই জানলাম উনি মামা। বাবা-কাকা রা মানে ওনার বন্ধুরা ওনাকে 'ভটচাজ' বলে ডাকতেন। কেন, সে সব জানতাম না। বড়ো হয়ে জেনেছিলাম বাবা রা যখন SAIL এর হোস্টেলে তখন ইমার্জেন্সির সময়। তখনই সবার ছদ্মনাম দেওয়া হয়েছিল। আর ইরফান মামা কে ওই নাম-ই অনেকবার বাঁচিয়েছিল। কাকা-র জীবনের শেষ দিকে যখন বাবা মানসিক আর শারীরিক ভাবে ভেঙে পড়ছিলেন তখন ইরফান মামাই কিন্তু এক ডাকে দূর্গাপুর থেকে দিল্লি এসে গেছিলেন অনির্দিষ্টকালের জন্য।
এ-তো হলো আমার আসে-পাশের ধর্ম নিয়ে কষাকষি! অঙ্কটাতে যদি-ও আমি খুব কাঁচা ছিলাম। কিন্তু বেশতো ছিল। সবাই তো দিব্যি ছিলাম। শুনেছি বন্ধে শ্রমিকরা কারখানায় আটকে গেলে রাজনীতিটির দলের উর্ধে গিয়ে তাদের বাড়ির লোকের কাছে বাজার পৌঁছে যেত। যাতে পরিবারের মানুষের বা বাচ্চাদের কোনো ক্ষতি না হয়। ধর্ম, জাত, রাজনৈতিক দল মানুষ চেনার বা বিচার করার বস্তু ছিল না। তোমার পাশের বাড়ি, পাড়ার লোক, ক্লাসের বন্ধু, ঠেকের দাদা, এই ছিল আইডেন্টিটি।
তরপর হলাম বড়ো। বেরোলাম ছোট্ট শহরের গন্ডি ছেড়ে। বুঝলাম মানুষ বন্ধু হওয়ার আগে জাত জানতে চায়। বললাম, সে তো আমি জানি না। তারা আমার থেকেও বেশি অবাক হলো, আমার অজ্ঞতা দেখে। তারপর দেশ ছাড়লাম মানুষ এখন ধর্ম-ও জানতে চায় - বলি মানুষ! ছোটবেলা থেকে তাই-তো জেনে এসেছি। তারা আরো বেশি চিন্তায় পরে যায়। মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে আমার আসে-পাশের পরিধিটা বাড়লো নাকি কমলো।
আজ যখন বিদেশে বসে দেখলাম দূর্গাপুরে এক অনুমানিক COVID-১৯ রোগাক্রান্ত প্রৌঢ়কে ঘিরে তার বাড়ির লোক কে সবাই জেরা করছে তখন মনে হলো তাহলে কি আর আমার সেই বেড়ে ওঠার শহরের অস্তিত্ব আর নেই। হারিয়ে গেছে অন্যের বিপদকে নিজের ভেবে দাঁড়িয়ে যাওয়ার সেই ইচ্ছে? সেই পরিবারের কি দোষ? তাঁদের নাম? আর যা দেয় মানুষকে মানুষ না ভেবে তাদের এক গন্ডির মধ্যে বেঁধে নিজেদের মনের অন্ধকারকে চর্চা করার সম্পূর্ণ সুযোগ! যাঁরা এতদিন ওই পরিবারের নামের ভিত্তিতে কারণ খুঁজে তাঁদের হয়রান করলেন, জানতে চাইলেন ওই পরিবারের কেও কোন ধর্ম সভায় গেছিলেন কি না, বিচার করলেন, নিজের অনুমানকে প্রকৃত ঘটনা বলে অন্যদের কাছে বললেন, তাঁরা কি কেও COVID-১৯ টেস্ট নেগেটিভ আসার পর ক্ষমা চেয়েছেন? ওই দিনগুলো যখন ওনাদের পরিবারের সবচেয়ে দুর্বিসহ দিন ছিল তখন কি কেও ওঁদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন ওঁদের বাড়িতে কারোর কিছু লাগবে কি না যাতে ওঁদের বাড়ি থেকে বের হয়ে ওই সব প্রশ্নের সম্মুখীন না হতে হয়? কেও কি ভেবেছেন এই রোগ কাল আমার-আপনার বা আমাদের প্রিয়জনের হতে পারে আর তখন আমরা আমাদের প্রিয় শহরবাসীর কাছে কি রকম সাহায্যের আশা রাখবো?
হ্যাঁ, আজ দূর্গাপুর ছোট আর নেই। আমাদের ছেলেবেলা থেকে বেড়ে ওঠার মতো সে-ও নিজের গন্ডী ছাড়িয়ে বেড়েই চলেছে। রোজই শুনি একটা নতুন কিছু গড়ে উঠেছে সেখানে- কখনো আধুনিকতার দরুন কখনো বা সংস্কৃতির ছোঁয়ায়। কিন্তু আমাদের কি তাহলে প্রকৃত অর্থে বড়ো হওয়া হলো? গন্ডী কি সত্যিই বড় হলো? নাকি ছোট হতে হতে মনুষ্যধর্মের নিঃকৃষ্টতম জায়গায় পৌঁছে গেছি আমরা সবাই? খুব মিস করছি আজ ওই নবী, রিঙ্কি, ছায়া ও ইরফান মামাদের। এখনো কি আমাদের উপায় আছে আবার একবার মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবার?
*নাম ও পরিচয় পরিবর্তিত