মঙ্গলবার, ১৯ মে, ২০২০

দুর্গাপুর কি পাল্টে যাচ্ছে ~ নীলাঞ্জনা চৌধুরী

আমার ছোট্ট শহর দূর্গাপুর। বেড়ে ওঠার সময় লক্ষ্য করেছিলাম নবী'র সদ্যজাত বোন রিঙ্কিদের বাড়িতে খুব আদর-যত্ন পেতো। রিঙ্কিদের বাড়িতে আমার-ও খুব যাওয়া-আসা ছিল ছুটির দিনে। দূর্গাপূজোর ছুটির আগে আমাদের এক বিশেষ আলোচনার বিষয় ছিল কার ক'টা নতুন জামা হয়েছে। এমনি এক বছর জানতে পারলাম নবীদের নাকি পূজোতে নতুন জামা হয় না। তাই রিঙ্কির বাড়ি থেকে জামা দেয়া হয়। ব্যাপারটা কেন এমনি জানার কৌতূহল প্রকাশের বিশেষ জায়গা ছিল না। বাবা-মা খুব কড়া করে বুঝিয়েছিলেন কার কতগুলো জামা হয়েছে সেই নিয়ে আলোচনা করা মোটেই ভালো জিনিস নয়। পরে বড়ো হয়ে বুঝেছিলাম নবীরা ইসলাম ধর্মালম্বী তাই ওদের বছরকার জামা ঈদ এর সময় হয়। এই বেলা বলে রাখি আমাদের বাবাদের বেতনে তখন নতুন জামা বছরে একবারই কেনা সম্ভব ছিল। অনেকের তা-ও হতোনা নানা রকম পারিবারিক দায়বদ্ধতা সামাল দিতে গিয়ে।

তখন আমি ক্লাস ৭ কি ৮। ওই সময় জানতে পারলাম আমার অনেক বন্ধুরা পূজোতে অষ্টমী র পূজো দেয়।ছায়া-কে তখন নতুন নতুন চিনছি। সে বললো ওর নাকি আগের বছরের মতো সেই বছরও অষ্টমীর অঞ্জলির সব প্ল্যান সারা। খুব সমস্যায় পড়লো মন। বললাম, হোক তাহলে এবার। আমিও দেব পূজো। ছায়ার কাছেই জেনেছিলাম কি কি করতে হবে। কারণ পূজোর ব্যাপারে পটুয়া বন্ধুরা আমাকে নিয়ে মজা করতো কিন্তু ছায়া খুব ভালো করে আমাকে দু'-চারটে জিনিস বুঝিয়ে দিয়েছিলো। ছায়ার ভালো নাম ছিল রেহানা বেগম।

ইরফান মামা, ছোটবেলা থেকেই জানলাম উনি মামা। বাবা-কাকা রা মানে ওনার বন্ধুরা ওনাকে 'ভটচাজ' বলে ডাকতেন। কেন, সে সব জানতাম না। বড়ো হয়ে জেনেছিলাম বাবা রা যখন SAIL এর হোস্টেলে তখন ইমার্জেন্সির সময়। তখনই সবার ছদ্মনাম দেওয়া হয়েছিল। আর ইরফান মামা কে ওই নাম-ই অনেকবার বাঁচিয়েছিল। কাকা-র জীবনের শেষ দিকে যখন বাবা মানসিক আর শারীরিক ভাবে ভেঙে পড়ছিলেন তখন ইরফান মামাই কিন্তু এক ডাকে দূর্গাপুর থেকে দিল্লি এসে গেছিলেন অনির্দিষ্টকালের জন্য।

এ-তো হলো আমার আসে-পাশের ধর্ম নিয়ে কষাকষি! অঙ্কটাতে যদি-ও আমি খুব কাঁচা ছিলাম। কিন্তু বেশতো ছিল। সবাই তো দিব্যি ছিলাম। শুনেছি বন্ধে শ্রমিকরা কারখানায় আটকে গেলে রাজনীতিটির দলের উর্ধে গিয়ে তাদের বাড়ির লোকের কাছে বাজার পৌঁছে যেত। যাতে পরিবারের মানুষের বা বাচ্চাদের কোনো ক্ষতি না হয়। ধর্ম, জাত, রাজনৈতিক দল মানুষ চেনার বা বিচার করার বস্তু ছিল না। তোমার পাশের বাড়ি, পাড়ার লোক, ক্লাসের বন্ধু, ঠেকের দাদা, এই ছিল আইডেন্টিটি।

তরপর হলাম বড়ো। বেরোলাম ছোট্ট শহরের গন্ডি ছেড়ে। বুঝলাম মানুষ বন্ধু হওয়ার আগে জাত জানতে চায়। বললাম, সে তো আমি জানি না। তারা আমার থেকেও বেশি অবাক হলো, আমার অজ্ঞতা দেখে। তারপর দেশ ছাড়লাম মানুষ এখন ধর্ম-ও জানতে চায় - বলি মানুষ! ছোটবেলা থেকে তাই-তো জেনে এসেছি। তারা আরো বেশি চিন্তায় পরে যায়। মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে আমার আসে-পাশের পরিধিটা বাড়লো নাকি কমলো।

আজ যখন বিদেশে বসে দেখলাম দূর্গাপুরে এক অনুমানিক COVID-১৯ রোগাক্রান্ত প্রৌঢ়কে ঘিরে তার বাড়ির লোক কে সবাই জেরা করছে তখন মনে হলো তাহলে কি আর আমার সেই বেড়ে ওঠার শহরের অস্তিত্ব আর নেই। হারিয়ে গেছে অন্যের বিপদকে নিজের ভেবে দাঁড়িয়ে যাওয়ার সেই ইচ্ছে? সেই পরিবারের কি দোষ? তাঁদের নাম? আর যা দেয় মানুষকে মানুষ না ভেবে তাদের এক গন্ডির মধ্যে বেঁধে নিজেদের মনের অন্ধকারকে চর্চা করার সম্পূর্ণ সুযোগ! যাঁরা এতদিন ওই পরিবারের নামের ভিত্তিতে কারণ খুঁজে তাঁদের হয়রান করলেন, জানতে চাইলেন ওই পরিবারের কেও কোন ধর্ম সভায় গেছিলেন কি না, বিচার করলেন, নিজের অনুমানকে প্রকৃত ঘটনা বলে অন্যদের কাছে বললেন, তাঁরা কি কেও COVID-১৯ টেস্ট নেগেটিভ আসার পর ক্ষমা চেয়েছেন? ওই দিনগুলো যখন ওনাদের পরিবারের সবচেয়ে দুর্বিসহ দিন ছিল তখন কি কেও ওঁদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন ওঁদের বাড়িতে কারোর কিছু লাগবে কি না যাতে ওঁদের বাড়ি থেকে বের হয়ে ওই সব প্রশ্নের সম্মুখীন না হতে হয়? কেও কি ভেবেছেন এই রোগ কাল আমার-আপনার বা আমাদের প্রিয়জনের হতে পারে আর তখন আমরা আমাদের প্রিয় শহরবাসীর কাছে কি রকম সাহায্যের আশা রাখবো?

হ্যাঁ, আজ দূর্গাপুর ছোট আর নেই। আমাদের ছেলেবেলা থেকে বেড়ে ওঠার মতো সে-ও নিজের গন্ডী ছাড়িয়ে বেড়েই চলেছে। রোজই শুনি একটা নতুন কিছু গড়ে উঠেছে সেখানে- কখনো আধুনিকতার দরুন কখনো বা সংস্কৃতির ছোঁয়ায়। কিন্তু আমাদের কি তাহলে প্রকৃত অর্থে বড়ো হওয়া হলো? গন্ডী কি সত্যিই বড় হলো? নাকি ছোট হতে হতে মনুষ্যধর্মের নিঃকৃষ্টতম জায়গায় পৌঁছে গেছি আমরা সবাই? খুব মিস করছি আজ ওই নবী, রিঙ্কি, ছায়া ও ইরফান মামাদের। এখনো কি আমাদের উপায় আছে আবার একবার মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবার?

*নাম ও পরিচয় পরিবর্তিত

শুক্রবার, ১৫ মে, ২০২০

গ্লানি ~ অংশুমান ভট্টাচার্য্য

ভারত বর্ষ এই কোভিডের লড়াই শেষ পর্যন্ত জিতেই যাবে। অন্য দেশের তুলনায় সংক্রামিত হবেন অনেক কম, জনসংখ্যার নিরিখে। মৃত্যুহারও হয়তো কমই হবে। কয়েক মাস বাদে আমরা ফিরে যাবো পুরনো জীবনে। নতুন ছন্দে ফিরে আসবে গোটা সমাজ।

তবুও এইসব আশা-ভরসার মাঝেই আমাদের তাড়া করে যাবে কিছু ছবি। ছবিগুলো অনেক কাল আমাদের খোঁচাবে, ভাবাবে, ভয় পাওয়াবে। মাঝে মাঝে হয়তো শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে যাবে ঠান্ডা একটা স্রোত। কখনো কারো চোখের কোনে দু ফোঁটা জল।

জামলো মাকদম। বছর বারোর সেই কিশোরী যে তেলেঙ্গানার লঙ্কার ক্ষেতের কাজ হারিয়ে দুশ মাইল হেঁটে ফিরে আসছিল ছত্তিশগড়ে। বন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। কিংবা নাম না জানা বছর তিনেকের সেই ছেলেটি। চাকা লাগানো সুটকেসের উপরে যে ঘুমিয়ে পড়েছে মে মাসের দুপুরের রাস্তায়। মা তার টেনে চলেছেন দড়ি বাঁধা সুটকেস। অথবা রেললাইনে ছড়িয়ে থাকা রুটিগুলো। মাল গাড়ির চাকা ষোল জন মানুষকে পিষে দিয়ে গেলেও রুটিগুলো রয়ে গেছে। আবার মুজাফফরনগরের থেঁতলানো ট্রাক্টর, যাতে করে ছজন বাড়ি ফিরছিলেন। অথবা মধ্যপ্রদেশের গুনা রাস্তায় পড়ে থাকা ট্রাকের নিচে পিষ্ট কটা লাশ।

চলচ্ছবির মত আমরা দেখে যাই অগুনতি মানুষ হেঁটে চলেছেন ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে। গুরগাঁও রাজস্থান গুজরাট মহারাষ্ট্র কেরল থেকে পুবের রাজ্যে। ঘাড়ে মাথায় বস্তা, ব্যাগ‌, সস্তার সুটকেস। আর বাচ্চা। ভবিষ্যতের ভারতবর্ষ। এই স্মৃতি নিয়েই তারা নাগরিক হতে চলেছে। 

নতুন একটা শব্দ শিখলো ভারতবাসী - পরিযায়ী শ্রমিক। অর্থনীতির ছাত্র রা আরেকবার ঝালিয়ে নিল মাইগ্রেশনের থিওরি, গ্রাম থেকে শহরে শ্রমিকের গতায়াত। সাধারণ মানুষ আবার শিখলো ভূগোল। তেলেঙ্গানা থেকে ঔরঙ্গাবাদ হয়ে মোজাফফরপুর অব্দি ছড়ানো ভূগোল সেই দেশের।

লকডাউন শুরু হওয়ার পর প্রায় পঞ্চাশ দিন বাদে কেন্দ্রীয় সরকারের মুখে শোনা গেল এদের কথা। কি আশ্চর্য যে এত বড় পরিকল্পনার ফাঁকে হারিয়ে গেছিলেন প্রায় দশ কোটি মানুষ। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যিনি যেখানে আছেন তিনি সেখানেই রয়ে যাবেন। এই প্রান্তিক মানুষদের ব্যবস্থা রাজ্য কেন্দ্র কেউই করে উঠতে পারলো না প্রায় দু'মাসে, স্রেফ ভোটার নয় বলে। ইতিহাস কেন আমাদের ক্ষমা করবে!

অর্থমন্ত্রীর বয়ানে আগামী প্রকল্প পরিকল্পনা জানা গেল। কিন্তু এই পরিকল্পনা কি পঞ্চাশ দিনের গবেষণার ফসল! এক দেশ এক রেশন কার্ড তো খাদ্যমন্ত্রী পাসোয়ান গত বাজেটেই ঘোষণা করেছিলেন। এই বছরের মার্চে তা সম্পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। সে যদি নাও হয়ে থাকে, এক দেশ এক আধার কার্ড তো ছিলই। তা দিয়ে ভিন রাজ্যের শ্রমিকদের রেশন কেন দেওয়া গেল না তার সদুত্তর পাওয়া যায় না। 

পঞ্চাশ দিন বাদে যে ব্যবস্থা নিয়ে আপনি আসলেন মাননীয়া অর্থমন্ত্রী তা খুবই সাধারন, খুবই অপ্রতুল। আশা ও প্রয়োজন দুটোই অনেক অনেক বেশি ছিল। ক্ষমা করবেন ম্যাডাম কিছুতেই বলতে পারছিনা যে দের আয়ে দুরস্ত আয়ে। 

দিনের শেষে রাজ্য কেন্দ্র সব সরকারই আমাদের বিশ্বাস করিয়ে ছাড়বেন যে এই করোনা যুদ্ধে আমাদেরই জয় হয়েছে। সংখ্যাতত্ত্বও সে কথাই সপ্রমাণ করবে। রাষ্ট্র তার বিধি নিষেধ পালনে, নিয়মের নিগড়ে, নাগরিকের বাধ্যতায় প্রমাণ রেখে যাবে কি কঠোরতায় আমরা এ জয় সম্ভব করেছি। 

তবুও জামলো মাকদমের মাতৃভূমি হিসেবে, সুটকেসের ওপরের নাম-না-জানা ঘুমন্ত বাচ্চাটির জন্মভূমি হিসেবে, এই দেশ শেষমেষ পরাজিত। রেল লাইনের উপরে ছড়িয়ে থাকা রুটিগুলো আজন্ম এই পরাজয়ের দলিল হয়ে থাকবে। সরকার বা রাষ্ট্র জয় ঘোষণা করলেও এই দেশ শেষ পর্যন্ত হেরেই গেছে। পরাজয়ের এই গ্লানি থেকে আমাদের কোনো মুক্তি নেই।

ছবি গুলো বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে নেওয়া। এত পরিচিত হয়ে গেছে আজ যে আলাদা করে নাম দেবার দরকার নেই। কোলাজ ও  স্কেচ এফেক্ট আমার করা কম্পিউটারে।

সোমবার, ১১ মে, ২০২০

করোনা ও শ্রমিক ~ পুরন্দর ভাট

প্রতিদিন আমরা দেখতে পারছি লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক শ'য়ে শ'য়ে কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে নিজের দেশে পৌঁছনোর চেষ্টা করছে শহরগুলো থেকে। অনেকে শেষ অবধি পৌঁছতে পারছে না, রাস্তাতেই হার স্বীকার করে নিচ্ছে। মৃত শ্রমিকের সংখ্যা করোনায় মৃতের সংখ্যার মত গোনা হচ্ছে না, কোনো ওয়েবসাইট মৃত শ্রমিকের সংখ্যার "ইউনিফর্ম" বা "লগারিদমিক" - কোনো স্কেলেই "কার্ভ" তৈরি করে দেখাচ্ছে না। হাতে গোনা কিছু খবর আসছে যেমন ট্রাকের ধাক্কায় গুজরাটে ৫ জনের মৃত্যু বা অরঙ্গাবাদে ট্রেনের তলায় ১৫ জন অথবা আম বোঝাই ট্রাক উল্টে ৫ জন। এর বাইরেও যে অনেক বড় সংখ্যক শ্রমিক মাঝরাস্তায় হারিয়ে যাচ্ছে সেই নিয়ে সন্দেহ নেই।

তবে করোনায় মৃত্যুর সঙ্গে শ্রমিকের মৃত্যুর একটা তফাৎ রয়েছে। করোনায় মৃত্যু ভাইরাসে, আর শ্রমিকের মৃত্যু রাষ্ট্রের জন্য। করোনায় মৃত্যুগুলো রোখা সম্ভব ছিল না, শ্রমিকদের মৃত্যুগুলো রোখা যেত। রাষ্ট্র যদি এদের থাকার-খাওয়ার ব্যবস্থা করতো, অথবা প্রত্যেকের হাতে এক মাসের রোজগার পৌঁছে দিত তাহলে এই পরিণতি হতো না। কিছু কিছু বিজ্ঞ দেখছি বলছে যে সরকারের কী দোষ, সরকার কী করবে ইত্যাদি। তাদেরকে শুধু একটাই কথা বলব যে অপেক্ষা করুন, যে অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে চলেছে দেশ এবং বিশ্ব তাতে সরকারি চাকুরেদেরও মাইনে এবং চাকরিতে কাট ছাঁট হতে চলেছে, বেসরকারি চাকরি... হেঁ হেঁ। আপনি আইটিতে কাজ করেন? ভাবছেন আইটিতে ওয়ার্ক ফ্রম হোম হয়, চাকরিতে টান পড়বে না? কে নেবে আপনার সার্ভিস? কে হবে আপনার ক্লায়েন্ট? আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান - যে দেশগুলোয় ভারতের সবচেয়ে বেশি আইটি রফতানি সেখানকার সব থেকে বড় বড় কোম্পানিগুলোও চরম অর্থনৈতিক সংকটে। ২০০৮-এর মত এখনো লেম্যান ব্রাদার্স বা এআইজি দেখতে পাননি তার কারণ এদের ব্যালেন্স শিট এবং ব্যাংকগুলোর কাছে প্রকৃত বকেয়া ঋণের হিসেব এখনো করে ওঠা হয়নি। লকডাউন ওঠার পরেই আসল চিত্র দেখতে পাবেন। আমেরিকায় বেকারত্ব ১৫%-এ পৌঁছেছে যা ঐতিহাসিক। সেখানকার সরকারও আউটসোর্সিংয়ের ওপর বিধিনিষেধ চাপাবে। মার্কিনী বিশেষজ্ঞরা সকলেই এক মত যে এই ক্রাইসিস ২০০৮-এর গ্রেট রিসেশনের থেকেও অনেক গ্রেটার। তাই আইটি ভাই বোনেরা একটু ধৈর্য ধরুন, আমি নিশ্চিত যারা এখনো পরিযায়ী শ্রমিকদের সাথে সমব্যথী হতে পারছেন না তারা কয়েক মাস পরেই হতে পারবেন।

তবে শুধু কয়েক কোটি পরিযায়ী শ্রমিকই এতে বিপর্যস্ত এটা খুব ভুল ধারণা। তাদের কষ্টটা হয়ত সর্বাধিক এবং তারা শ'য়ে শ'য়ে কিলোমিটার হাঁটছে বলে সেটা সামনে আসছে, কিন্তু অর্থনৈতিক বিপর্যয় চিত্রটা যে অনেক বিপুল বুঝতে পারবেন যখন আপনি নিজের পাড়ায় খোঁজ নেবেন। ছোট কারখানা, রেস্তোরাঁ, দোকান, ট্যাক্সি বা অটোচালক, রিকশাচালক, হকার - এই বিপুল সংখ্যক মানুষ, যারা ছোট ব্যবসা বা অস্থায়ী চাকরি করে পেট চালান তাদের রেশনের চাল আর আটা ছাড়া বাকি কোনো কিছু কেনার আর পয়সা নেই। শুধু এরাই নন, টিউশন করে পেট চালানো, অথবা স্কুল বা কলেজের অস্থায়ী শিক্ষক/শিক্ষিকা, যারা আপাত মধ্যবিত্ব তাদেরও অনেকের অবস্থা এরকম, আত্মীয় স্বজনের থেকে ধার চাইতে হচ্ছে বিদ্যুতের বা টেলিফোনের বিল দিতে। যাঁরা ত্রাণ দিচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়, অথবা কমিউনিটি কিচেন চালাচ্ছেন তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন, কত মধ্যবিত্ব বাড়ির লোকজনকেও খাবার দিতে হচ্ছে কারণ তাদের বাড়িতে গ্যাস কেনার টাকা নেই।

অথচ এই অর্থনৈতিক সংকট আটকানো না গেলেও কিছুটা সুরাহা মানুষকে হয়ত দেওয়া যেত। আমেরিকা ও ইউরোপের অধিকাংশ দেশের সরকার নিঃশর্তে প্রত্যেকটা মানুষের একাউন্টে বেশ কিছু টাকা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উচ্চবিত্ত বাদ দিয়ে বাকি প্রতিটা মানুষের একাউন্টে ১,২০০ ডলার দিয়েছে, ৯০,০০০ টাকা। জার্মান সরকার প্রত্যেকের একাউন্টে দিয়েছে ৮০০ ইউরো, তা ছাড়া ছোট ব্যবসায়ীদের দিয়েছে ৫০০০ ইউরো করে যাতে তারা কর্মচারীদের মাইনে দিতে পারে। উন্নত দেশ বাদ দিন, অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশও ভারত সরকারের চেয়ে বেশি ত্রাণ দিয়েছে। নীচে একটি গ্রাফ রয়েছে (চিত্র-১)। ইউরোপের সেন্টার ফর ইকোনোমিক পলিসি রিসার্চ বিশ্বের অর্থনৈতিক গবেষণার একটি অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। তারা প্রতি সপ্তাহে কোভিড-১৯-এর অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে কিছু গবেষণাপত্র প্রকাশ করছে। এই গ্রাফটি সেখানকারই একটি গবেষণাপত্র থেকে নেওয়া যার লিংক শেষে পাবেন (লিংক-১)। এই গ্রাফে এক একটা নীল বিন্দু হলো এক একটি দেশ। এই গ্রাফে এক একটি দেশের অর্থাৎ বিন্দুর অবস্থান নির্ভর করছে দুটো সংখ্যার ওপর - এক, সে দেশের সরকার কতটা কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে এবং দুই, সে দেশের সরকার কতটা ইকোনোমিক রিলিফ দিয়েছে জাতীয় আয়ের শতাংশের হিসেবে। যে দেশের সরকার যত বেশি কঠোর লকডাউন ঘোষণা করবে তত বেশি সেই দেশের মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এবং তাই মানবতার খাতিরে ধরে নেওয়া যায় যে সেই দেশের সরকার তত বেশি অর্থনৈতিক ত্রাণ দেবে। ওই চিত্রটিতে দেখা যাচ্ছে যে অধিকাংশ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই সেটা সত্যি - যত কঠিন লকডাউন তত বেশি ত্রাণ, একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কখনো দেশের নাগরিকদের আধ পেটা খেয়ে থাকতে বাধ্য করতে পারে না। কিন্তু দেখুন, একমাত্র ব্যতিক্রম কে? ভারতবর্ষ! এই দেশ লকডাউনের দিক দিয়ে প্রায় কঠোরতম অথচ অর্থনৈতিক ত্রাণের দিক দিয়ে প্রায় কৃপণতম। ভুল বুঝবেন না, এখানে কিন্তু ত্রাণের হিসেবটা জাতীয় আয়ের শতাংশে করা হচ্ছে তাই আমাদের দেশ গরিব সেই যুক্তি খাটবে না। ও হ্যাঁ, এই গ্রাফ তৈরির জন্য সমস্ত তথ্যই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কোভিড ডেটাবেস থেকে জোগাড় করা। এই ডেটাবেসের হিসেবেই ভারতের লকডাউনকে বিশ্বের মধ্যে কঠিনতম বলা হয়েছিল, যা দেখিয়ে ভারতের সরকারপন্থী মিডিয়া মোদির গুনগান গেয়েছিল। তখন বোধয় তারা জানতো না যে সেই ডেটাবেসে অর্থনৈতিক ত্রাণেরও হিসেবও দেওয়া থাকে।

অর্থাৎ ভারতের রাষ্ট্র বিশ্বের সমস্ত দেশের তুলনায় সব থেকে শ্রমিক বিরোধী অবস্থান নিয়েছে করোনাযুদ্ধে। কিন্তু প্রশ্ন হলো - কেন? এই কোটি কোটি মানুষের তো ভোটাধিকার আছে, ভারত এখনো গণতন্ত্র, এখনো ভোট হয়, তাহলে কী এমন দায় পড়লো সরকারের যে তারা এই কোটি কোটি মানুষের চরম বিপর্যয়ে একটু সাহায্যের হাতও বাড়াতে চাইছে না? কার স্বার্থ কোটি কোটি শ্রমিক ও খেটে খাওয়া মানুষের চেয়েও বেশি? এর উত্তর আছে দ্বিতীয় চিত্রে। দ্বিতীয় চিত্রে ফের এক একটি বিন্দু হলো এক একটি দেশ এবং এই গ্রাফে এক একটি দেশের অবস্থার নির্ধারিত হয়েছে ফের দুটি সংখ্যামানের দ্বারা যার একটি আগের মতোই অর্থনৈতিক ত্রাণ কিন্তু অপরটি হলো "সভরেন ক্রেডিট রেটিং"। সভরেন ক্রেডিট রেটিং কী? এটি হলো একটা মাপকাঠি যা নির্ধারণ করে কোন দেশের বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে কতটা আকর্ষণীয় হওয়া উচিত। সভরেন ক্রেডিট রেটিং যদি খারাপ হয়ে যায় কোনো দেশের তাহলে সে দেশের শেয়ার বাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পয়সা তুলে নেবে, সে দেশের কোম্পানিগুলোর বিদেশ থেকে ঋণ পাওয়া মুশকিল হবে বা সুদের হার বেশি দিতে হবে, সে দেশের সরকারকেও বিদেশ থেকে ধার করলে সুদের হার বেশি দিতে হবে। এই গ্রাফটিতে দেখতে পাচ্ছেন যে যেসব দেশগুলির ক্রেডিট রেটিং খারাপ সেই দেশগুলো করোনার জন্য অর্থনৈতিক ত্রাণও কম দিয়েছে এবং ভারতও সেই দেশগুলির মধ্যে একটা। এর কারণ হলো সরকারি খরচ বাড়ালে ক্রেডিট রেটিং কমার সম্ভাবনা থাকে, তাই যাদের ক্রেডিট রেটিং আগের থেকেই খারাপ তারা ত্রাণও কম দেবে এই ভয়ে যে রেটিং তাতে আরো খারাপ হয়ে যেতে পারে।

তাহলে এটা বোঝা গেল যে ভারত সরকার শ্রমিক বিরোধী অবস্থান নিচ্ছে, ত্রাণ দিচ্ছে না তার কারণ ক্রেডিট রেটিংয়ের ভয়। কিন্তু ক্রেডিট রেটিং খারাপ হলেই বা কী? অসুবিধে কোথায়? আগেই বলেছি যে তাতে শেয়ার বাজার ধাক্কা খাবে কারণ বিদেশি বিনিয়োগ বেরিয়ে যাবে। শেয়ার বাজারে এই বিদেশি বিনিয়োগটা মূলত ফাটকা পুঁজি। কিন্তু তা বেরিয়ে গেলেই বা কী? অনেকেরই ভুল ধারণা থাকে যে শেয়ার বাজারের ওপর অর্থনীতির স্বাস্থ্য নির্ভর করে, কিন্তু আসলে বিষয়টা উল্টো - অর্থনীতির স্বাস্থ্যর ওপর শেয়ার বাজার নির্ভর করে (যদিও সেটাও সবসময় হয় না)। তাই শেয়ার বাজার পড়লে অর্থনীতির আলাদা করে বড় ক্ষতি হবে না, বিশেষ করে যেখানে আমাদের দেশে খুব কম সংখ্যক মানুষ শেয়ার বাজারে অনেক টাকা বিনিয়োগ করে। তাহলে? শেয়ার বাজারে বড় বিনিয়োগকারীদের অনেকের সাথে বিজেপি আরএসএস-এর দহরম মহরম কোনো গোপন তথ্য নয়, তাদের স্বার্থ রক্ষা করাটা হয়ত একটা উদ্দেশ্য হতে পারে। অপর একটা যুক্তি হতে পারে যে বিদেশি ফাটকা পুঁজি বেরিয়ে চলে গেলে টাকার দাম পড়বে। সেটার একটা সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এ কথাও সত্যি যে ভারতের বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার বিশ্বের মধ্যে অন্য বৃহত্তম, তা ছাড়া তেলের ও সোনার দাম তলানিতে। এই দুটো দ্রব্য ভারতের সবচেয়ে বড় আমদানি, তাই এদের দাম কমলে/বাড়লে টাকার দামও বাড়ে/কমে। সেই দিক দিয়ে তাই এক্ষুনি টাকার ওপর চাপ আসার তেমন কারণ নেই। সম্প্রতি, আইএমএফ উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুদ্রার দাম করোনা সংকটের জন্য যাতে হঠাৎ করে পড়ে না যায়, আর তাদের বিদেশি মুদ্রার কোষাগার যাতে ফাঁকা না হয়ে যায়, তার জন্য সব উন্নয়নশীল দেশকে ব্যাপক বিদেশি মুদ্রা ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দেয় (স্পেশ্যাল ড্রয়িং রাইটসের লিমিট বাড়িয়ে), কিন্তু ভারত একমাত্র উন্নয়নশীল দেশ যে এটার বিরোধিতা করেছে। তাই ধরে নেওয়া যায় যে ভারত সরকার টাকার মূল্য পড়া নিয়ে ভাবিত নয়।

তাহলে ক্রেডিট রেটিং খারাপ হলে আর কী কী ক্ষতি হতে পারে যার জন্য সরকার এত ভাবিত? ভারত সরকার বিদেশ থেকে ঋণ নিতে চাইলে সুদ বেশি দিতে হতে পারে। কিন্তু ভারত সরকারের বিদেশ থেকে ঋণ খুবই সামান্য, আর যেটুকু সেগুলোও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মত সংস্থা থেকে স্পেশ্যাল ডেভেলপমেন্টাল লোন যাতে সুদ নামমাত্র। তাহলে? দেখুন আরো একটা কারণ ওপরে লেখা রয়েছে। দেখছেন? - ভারতীয় "কোম্পানিগুলোর বিদেশ থেকে ঋণ পাওয়া মুশকিল হবে বা সুদের হার বেশি দিতে হবে"। এই, এইটেই হলো সেই গোপন কথাটি যেটা সরকার কোনোদিন উচ্চারণ করবে না। ব্যাংক অফ ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট জানাচ্ছে যে ভারতের কর্পোরেট সেক্টরের মোট বিদেশী ব্যাংকগুলো থেকে বিদেশী মুদ্রার ঋণ হলো ৫৯০০ কোটি ডলার, ৩ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা (লিংক-২)। এটা শুধুই কিন্তু বিদেশী ব্যাংক থেকে। অন্য জায়গা থেকে বিদেশী মুদ্রার ঋণ ধরলে সংখ্যাটা আরো বেশি। শুধু ২০-টা বৃহত্তম কর্পোরেট সংস্থার বিদেশী ঋণই ১৮০০ কোটি ডলার, ১ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে রিলায়েন্স, টাটা, বিড়লা - সবই আছে (কোম্পানিগুলির ব্যালেন্স শিট থেকে এই তথ্য পেয়ে যাবেন।) সভরেন রেটিং খারাপ হলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে এদের ওপরেই। এই ঋণের ওপর সুদ বেড়ে যাবে, নতুন ঋণ পেতে অসুবিধে হবে, লাভ কমবে।

তাহলে বোঝা গেল যে ভারতের কোটি কোটি শ্রমিক, ছোট ব্যবসায়ী, দিন আনি দিন খাই মানুষের প্রতি সরকারের অমানবিক আচরণ এবং পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক ত্রাণ দেওয়ায় অনীহার পেছনে কারণ হলো যে এই সরকার বৃহৎ পুঁজিপতি ও শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করতে বেশি ব্যস্ত। শ্রমিকদের ট্রেনের টিকিটের টাকা না দেওয়ার অমানবিক সিদ্ধান্তের পেছনেও রয়েছে টাটা আম্বানি - যারা বিজেপির ইলেক্টরাল বন্ডে হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়েছে - সেই তাদের স্বার্থ রক্ষার তাগিদ। ভারতের শ্রেণী সংঘাত বোধয় এতটা সরাসরি এবং এতটা ক্ষিপ্র আকার ইদানিংকালে নেয়নি। কিন্তু অধিকংশ মানুষ জানবে না যে লক্ষ লক্ষ মানুষ হাজার হাজার কিলোমিটার হাঁটছে আসলে শ্রেণী সংঘাতের কারণে, তারা জানবে না যে তাদের ওপর শ্রেনিযুদ্ধর ঘোষণা হয়েছে। ভাববার সময় হয়েছে যে এই বৃহৎ পুঁজিপতিরা কতটুকু সম্পদ ও চাকরি তৈরি করে দেশের জন্য যার জন্য এরকম কোটি কোটি মানুষ আধপেটা খাবে? যারা এখনও পুঁজিপতিদের পক্ষ নেবে তাদের সাথে এখনই কোনো তর্ক করবো না, তিন মাস পর করবো কারণ আমি নিশ্চিত যে তিন মাসের মধ্যে এর আঁচ কর্পোরেট চাকরি করা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গায়ও লাগবে। তখন না হয় তাদের মতামত শুনতে চাইবো।
*******************

লিংক ১: https://cepr.org/si…/default/files/news/CovidEconomics11.pdf

লিংক ২: https://stats.bis.org/statx/srs/table/A6.1?c=IN&p

রবিবার, ১০ মে, ২০২০

রাষ্ট্র তুমি কার ~ শমীক লাহিড়ী

১৯৩৫ সাল। জানুয়ারী মাসের শীতের রাত। নিউইয়র্ক শহরে ঠান্ডার রাতে নৈশবিচারসভায়  শতচ্ছিন্ন পোশাকের একজন বয়স্ক মহিলাকে এনে উপস্থিত করলো নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ। বিবর্ণ চেহারা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অভুক্ত।

বিচারক তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন - আপনি কি সত্যি রুটি চুরি করেছেন? 
মাথা নীচু করে মহিলা বললেন - হ্যাঁ,  আমি রুটি চুরি করেছি। 
বিচারক - কেন আপনি রুটি চুরি করেছেন - ক্ষিদের জ্বালায়? 
মহিলা এবার সরাসরি বিচারকের দিকে তাকালেন। মৃদু কিন্তু দৃঢ় গলায় বললেন - আমার মেয়েকে তার স্বামী পরিত্যাগ করেছে। আমার মেয়ে অসুস্থ। সে তার দুই ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে আমার কাছে থাকে। গত কয়েকদিন ধরে তারা অভুক্ত। আমি তাদের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। 
বিচার কক্ষে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। যে দোকানদার চুরির অভিযোগ এনেছিলেন, দাঁড়িয়ে বললেন, একে উদাহরণযোগ্য শাস্তি দিন, যাতে আর কেউ এই কাজ করার সাহস না পায়।

বিচারক তাঁর চেয়ারে গা এলিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে মহিলার উদ্দেশ্যে বললেন - দেখুন আমাকে আইন অনুযায়ী চলতে হবে। আইন অনুযায়ী আপনাকে ১০ ডলার ফাইন দিতে হবে, না পারলে ১০ দিনের জেল।

এই কথা বলেই নিজের পকেট থেকে ১০ ডলার বের করে নিজের টুপি খুলে তার মধ্যে রেখে বললেন - আমি ওনার জরিমানার অর্থ দিয়ে দিলাম। আর যতজন এই বিচার কক্ষে উপস্থিত আছেন, প্রত্যেকে ৫০ সেন্ট করে জরিমানা জমা করুন। আপনাদের এই জরিমানা দিতে হবে কারণ, আপনারা ওনার দুর্দশা সম্পর্কে জানতেন অথচ উদাসীন ছিলেন। অথচ ইনি আমাদের সমাজেরই অংশ। বেইলিফকে নির্দেশ দিলেন উপস্থিত সকলের কাছ থেকে, জরিমানা নিয়ে আসতে। এমনকি সেই দোকানদার, পুলিশকেও জরিমানা দিতে হ'লো।

পরেরদিন নিউইয়র্ক সিটি টাইমস সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল এই খবর বিচারকের মন্তব্যসহ  - '৫০ সেন্ট জরিমানা করা হয়েছিল মানুষের সমস্যার প্রতি উদাসীনতাকে'।

আমাদের দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা কি শুনছে? 

৫ই মে সুপ্রিম কোর্টে দায়ের হওয়া এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বলেছে - কেন্দ্র শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন চালাচ্ছে, এটা জানিয়েছে। কেন্দ্র ৮৫% এবং রাজ্য ১৫% দেবে কি না এটা তাদের বিচার্য বিষয়। তাই কোর্ট এই বিষয়ে কোনও নির্দেশ দেবে না।

৪৫/৫০ দিন ধরে মজুরি না পাওয়া শ্রমিকদের ফেরৎ আনার দায়িত্ব রাষ্ট্র নেবেনা। রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা দায়িত্ব নেবে না। কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমের বড় অংশই মুখ কুলুপ এঁটেছে। 

৪ঠা মে সরকারি বিজেপি দলের মুখপাত্র শ্রী সম্বিত পাত্র তড়িঘড়ি ঘোষণা করছিলেন - কেন্দ্রীয় সরকার শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনের ৮৫% ভাড়া বহন করবে, বাকিটা রাজ্য সরকারগুলো দিক। আর সরকারি উকিল তুষার মেহেতা ৫ই মে সুপ্রিম কোর্টে বলছেন, সরকার বা রেল এইরকম কোন তথ্য আমাকে দেয়নি এবং কেন্দ্রীয় সরকার রেলের খরচ বহন সম্পর্কে কিছু জানাতে রাজি নয়।

কোনও কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যমকে, এই অসত্যবাদী দল এবং সরকারের উদাসীনতা সম্পর্কে কিছু বলতে শুনেছেন?  বিচারব্যবস্থা কত বিষয় নিয়ে নিজে থেকে মামলা রুজু করে, আর কয়েক কোটি এই দেশের নাগরিক ৫০ দিন ধরে মজুরি না পেয়ে অভুক্ত/আধাপেটা হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেই প্রশ্নে নীরবতাকেই বেছে নিল!! প্রধানমন্ত্রী উদাসীন - এটা দেখেও নিজে থেকে মামলা রুজু করে সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ার কড়া নির্দেশ দেওয়ার পরিবর্তে, দায়িত্ব ছাড়লো সেই উদাসীন-অসত্যবাদী সরকারের উপর!!!! বিনা ভাড়ায় এদের নিয়ে যেতে নির্দেশ দিতে পারলো না দেশের বিচার ব্যবস্থা!!!

১৬ টা লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকার বিভৎস দৃশ্য দেখে গোটা দেশ শোকে মুহ্যমান,  আর রাষ্ট্র নিশ্চিন্তে জলখাবার খেতে খেতে খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে প্রশ্ন তুলছে - রেললাইন কি ঘুমাবার জায়গা!!!
এবার পাল্টা প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে - দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকা কি প্রধানমন্ত্রীর বা রাষ্ট্রের কেষ্টুবিষ্টুদের  পিতৃপুরুষের?

ধনীদের ফেরৎ আনার জন্য উড়োজাহাজ বিনি পয়সায় ওড়ে, আর ৫০ দিন মজুরি না পাওয়া আধপেটা সর্বহারা মানুষগুলো গুনে গুনে হাজার টাকা দিলে তবে ট্রেনে উঠতে পারবে। না পারলে রেললাইন ধরে ট্রেনের পিছু পিছু হাঁটো। কেউ লাইনে কাটা পড়বে, কেউ মাথা ঘুরে পড়ে মরবে, আর সরকার বাহাদুর, মাইবাপ বিচারক, মান্যবর আইনসভার সদস্যবৃন্দ, সমাজের প্রতিচ্ছবি সংবাদমাধ্যম গা এলিয়ে লকডাউনের ছুটি উপভোগ করবে??

সংবিধানের ৪৪৮টা ধারা যা ২৫টি অনুচ্ছেদে বর্ণনা করা আছে ১২টি  তপশীল সহ - এর কোথাও কি লেখা নেই, লকডাউনের বিশেষ পরিস্থিতিতে দেশের কোটি কোটি ভুখা মানুষের বাড়ি ফেরার জন্য সরকারকে ট্রেন/বাস ভাড়া দিতে হবে! যদি নাই থাকে তাহলে বিনি পয়সায় ধনীদের উড়োজাহাজে উড়িয়ে আনার আইন কোন ধারায়  লেখা আছে? 

কি বলে রাষ্ট্র? কি বলছে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান অঙ্গ বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, সংসদ আর ৪র্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যম?  সবার বিবেক কি অর্থময় হয়ে গেল? ১৫৮ জন বিলিওনিয়ার কি কিনে নিল রাষ্ট্রের বিবেক? দেশটা কি শুধু ওদের বলেই মনে করছে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও তার প্রধান অঙ্গগুলো??
এবার লড়াই বাঁধবে, গরীব নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষের সাথে রাষ্ট্রের। দেশটা শুধু লুঠে খাওয়াদের জন্য নয়, দেশটা সবার। এদেরও সমান অধিকার আছে দেশের কোষাগারের উপর।

১৯৩৫ সালে নিউইয়র্ক আদালতের সেই বিচারক ফাওরেলো  ল্যা গোয়ার্দুয়া আজকের ভারত দেখে বিস্মিত না স্তম্ভিত হতেন জানি না - তবে বিচারকের আসনে বসলে বিচারপতি, আমলা, প্রধানমন্ত্রী, রেলমন্ত্রী, রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের থেকে নিঃসন্দেহে জরিমানা আদায় করে এদের ট্রেন ভাড়া মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিতেন।


রেল লাইন কি ঘুমনোর জায়গা? ~ সুশোভন পাত্র

আমার বন্ধু বলেছে, রেল লাইন কি ঘুমনোর জায়গা?  
ঠিকই তো বলেছে বলুন আমার বন্ধু। রেল লাইন ঘুমোতে গিয়েছিলো কেন পরিযায়ী শ্রমিক গুলো? নিশ্চিন্তে ঘুমনোর জন্য মুকেশ আম্বানির মত ৪৯হাজার স্কয়ার ফুটের বাড়ি বানিয়ে নিলেই পারতো। ভালোবেসে বাড়িটার 'অ্যান্টিলিয়া' নাম রাখত। ২৭ তালা বাড়িতে ১৬৮টি গাড়ি রাখার গ্যারেজ, ৩টে হেলিপ্যাড থাকতো। ইনডোরের ঝুলন্ত উদ্যানের পাশে ৯টা লিফট সারাদিন ওঠা নামা করত। বডি-স্পা সেন্টার লাগোয়া ইন হাউস সিনেমা হলে বসে বেশ একটা ম্যাটিনি শো চলত। অতিথি সেবার জন্য ৬০০ 'চাকর' পুষত। আর সকালবেলায় নীতা আম্বানির মত জাপানের নরিটেক কোম্পানির ৩লক্ষ টাকার কাপে আমেজ করে চা খেয়ে প্রাতরাশ সারতো। তা না করে, রেল লাইন ঘুমোতে গিয়েছিলো কেন পরিযায়ী শ্রমিক গুলো? রেল লাইন গুলো কি ওঁদের বাপের?
আমার বন্ধু বলেছে, হেঁটে ঘরে ফিরতে গিয়েছিলো কেন পরিযায়ী শ্রমিক গুলো?  
ঠিকই তো বলেছে বলুন আমার বন্ধু। মহারাষ্ট্র থেকে ১৫৭ কিলোমিটার হেঁটে মধ্যপ্রদেশের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার কি দরকার ছিল পরিযায়ী শ্রমিক গুলোর? বাড়ি যদি ফিরতেই হত একটা চ্যাটার্ড বিমান কিনে নিলেই পারতো। আগামী জুলাই মাসে ফ্লোরিডা থেকে প্রধানমন্ত্রীর জন্য যে ৮.৫হাজার কোটির বোয়িং-৭৭৭ বিশেষ বিমান আসছে সেটা ভাড়া করলেই পারতো। ক্লান্তি এলে এলিয়ে নেওয়ার জন্য বিলাস বহুল লাউঞ্জ থাকবে। অন বোর্ড ওয়াইফাই থাকবে। মিড এয়ার বিনোদন থাকবে। মিডিয়াম সাইজ কনফারেন্স রুম থাকবে। দেশ-বিদেশের রকমারি কুসিন রান্নার কিচেন থাকবে। তা না করে, পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরতে গিয়েছিলো কেন পরিযায়ী শ্রমিক গুলো? কমপক্ষে একটা বুলেট ট্রেনে চাপলেই তো পারতো। 
মৃত এক পরিযায়ী শ্রমিকের বাড়ি মধ্যপ্রদেশের মাঝগাঁও ব্লকের কেওত্রা গ্রামে। পরিবারে ৭ মাসের গর্ভবতী স্ত্রী। ডাক্তার বলেছেন, ২৭বছরের হবু মায়ের এই সময়ে একটু মানসিক ভাবে চাপহীন থাকা চাই। সুষম একটু আহার চাই। প্রতিদিন অল্প কিছু ফল চাই, পারলে একটু দুধ চাই। আমার বন্ধু বলেছে, দুধই যখন চাই, তখন একটু ডালগোনা কফি খেলেই তো পারতো। টেস্টি হবে, ক্রিমী হবে, মুখে দিলেই মেল্ট হয়ে যাবে। সুষম আহারই যদি একটু চাই, একটা চিজ বার্স্ট পিৎজা অর্ডার দিলেই তো পারতো। পুষ্টি পাবে, বার্বে-কিউর টপিংস পাবে। মানসিক চাপ থেকে যদি মুক্তিই চাই, অ্যামাজন প্রাইমে ফরেস্ট গাম্প দেখলেই তো পারতো। রিল্যাক্স করতে সপ্তাহে একবার গোল করে কাটা শসা, চোখে চেপে ত্বকের যত্ন নিলেই তো পারতো।
আসলে আমার বন্ধু সরকারী কর্মচারী। 'প্রিভিলেজড'। প্রিভিলেজড কারণ, আমার বন্ধু অর্থনীতির পোশাকি ভাষায় 'অরগানাইজড সেক্টর'। মাস গেলে বেতনের নিশ্চয়তা আছে, চাকরি'র নিরাপত্তা আছে, সরকার ধার্য ছুটি আছে, শ্রম আইনে বোনাস আছে, ইনক্রিমেন্ট আছে, প্রভিডেন্ট ফান্ড আছে, প্রোমোশন আছে। লকডাউনের সময় তাই একটু চিল-পিল করতে, আমার বন্ধুর বৌ-র কোলে মাথা রেখে, হাতে অ্যান্ড্রয়েড ফোন গুঁজে, দেশের অর্থনীতি নিয়ে বাতেলা দেওয়ার সুযোগ আছে। হোয়াটস-অ্যাপ ইউনিভার্সিটি তে কলার তুলে ফেক নিউজ বিলি করার সময় আছে। রেল লাইন ঘুমনোর জায়গা কিনা প্রশ্ন তোলার বিলাসিতা আছে। 30ml স্কচের পেগে, 'হেঁটে ঘরে ফিরতে গিয়েছিলো কেন?' ভেবে নাবালক সুলভ অবাক হবার ফ্যান্টাসি আছে। দুঃখ একটাই, এতো কিছু 'আছে'র মধ্যে শুধু গায়ে মানুষের চামড়া রাখার অভ্যাসটাই বাদ পড়ে গেছে।
না হলে জানতো, ১৩০ কোটির দেশে এরকম প্রিভিলেজড মানুষের সংখ্যাটা মেরে কেটে ৩কোটি। জনসংখ্যার ২.৩%। আর স্রেফ পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যাটা ১২কোটি। জনসংখ্যার ৯.২৩%। না হলে জানতো, ১৯৫৭'তে অর্থনীতিবিদ গুলজারি লাল নন্দা'র নেতৃত্ব ১৫তম ইন্ডিয়ান লেবার কংগ্রেস বলেছিল –"শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি, চারজনের পরিবারের প্রতিজন কে প্রতিদিন ২৭০০ ক্যালরির ব্যালেন্স ডায়েট, পরিবার প্রতি বছরে ৬৫ মিটার কাপড়, সরকারি আবাসন প্রকল্পে প্রদত্ত এলাকার সংশ্লিষ্ট ঘর ভাড়া এবং জ্বালানি, বিদ্যুৎ সহ বিবিধ খরচা পুরোপুরি ভাবে বহন করার উপযুক্ত হওয়া প্রয়োজন।" ১৯৯২'এ সুপ্রিম কোর্ট এই ন্যূনতম মজুরির উপর আরও ২৫% ছেলেমেয়ের পড়াশুনা, চিকিৎসা, বিনোদন এবং উৎসবের জন্য সংযোজনার নির্দেশ দেয়। সব মিলিয়ে বর্তমান বাজার মূল্যে ন্যূনতম মজুরিটা প্রায় মাসিক ২৬,০০০ টাকা। একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন তো, আপনার পাড়-মহল্লায় মাসিক ২৬,০০০ রোজগারের নিশ্চয়তা আছে শতকরা কতজনের?
হোয়াটস-অ্যাপ ইউনিভার্সিটির সিলেবাসে আপনি পাবেন না যে, ১৯৮৭-২০১৫, যে ২৮ বছরে সেনসেক্স-নিফটি-জিডিপি'র ঊর্ধ্বগামী অর্থনীতিতে শ্রমিক'রা ২১০% নিট মূল্য সংযোজন করেছে, সেই ২৮ বছরেই শ্রমিক'দের নিট পারিশ্রমিক নাম মাত্র ১৪% বেড়েছে। যে ২৮ বছরে ভারতবর্ষে বিলিয়নারির সংখ্যা ১ থেকে ১৩২ হয়েছে, সেই ২৮ বছরেই ১০০ টাকা উৎপাদন মূল্যে শ্রমিক'দের প্রাপ্য মজুরি কমতে কমতে ৯.৯ টাকায় ঠেকেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ১২ই এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছে, পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য গোটা দেশে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার মিলে যে মোট ২২,৫৬৭টি শিবিরের ব্যবস্থা করেছে তার ১৫,৫৪১টি, অর্থাৎ ৬৯%-ই কেরালায়। একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন তো, মিডিয়ার সাধের গুজরাট মডেলে এই শতকরাটা কত?
ফুটেজ খোর প্রধানমন্ত্রী তৃতীয় লকডাউন ঘোষণার সময় ক্যামেরার সামনে আসার রিস্ক নেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৯মিনিট মোমবাতি জ্বালিয়ে সেই যে গর্তে ঢুকেছেন আর বেরিয়ে আসেননি। অর্থমন্ত্রী সেই যে হালুয়া পূজা করে ইতিহাসের দীর্ঘতম বাজেট ঘোষণা করে ঠাণ্ডা ঘরে বসেছেন আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি। ঘটা করে PM Care হয়েছে। ১৯৪৮ থেকে PMNRF থাকা সত্ত্বেও PM Care কেন? উত্তর নেই সরকারের কাছে। PM Care-র পরিচালক মণ্ডলী তে অন্য কোন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব নেই কেন? উত্তর নেই সরকারের কাছে। PM Care–এ CAG-র অডিটে সরকারের আপত্তি কেন? উত্তর নেই সরকারের কাছে। PM Care থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের ট্রেনের টিকিটের ভাড়া, তাঁদের শিবিরের, রেশনের, universal income support-র ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না কেন? উত্তর নেই সরকারের কাছে। 
এই প্যান্ডেমিকের অভিজ্ঞতা দিয়ে কর্পোরেটদের দালাল এই সরকারটাকে চিনুন। আদ্যোপান্ত দুর্নীতি তে ডুবে থাকা এই রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে চিনুন। আর চিনুন, আপনার আশে পাশের ঐ মানুষ গুলো কে। যারা কদিন আগে পালাগড়ে দুজন 'হিন্দু' সন্ন্যাসীর গণ পিটুনি তে মৃত্যুর পর, 'হিন্দু খতরে মে হ্যা' বলে পাড়া মাথায় তুলেছিল; আর আজ ১৬জন 'হিন্দু' পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুর পর 'রেল লাইন কি ঘুমনোর জায়গা?' বলে দায় সারছে, তাঁদের চিনুন। যারা 'শ্রমিক স্পেশাল' ট্রেনে সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে নির্লজ্জের মত ভাড়া চাইলে মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিল, আর আজ 'হেঁটে ঘরে ফিরতে গিয়েছিলো কেন?' বলে ফেসবুক কাঁপাচ্ছে, তাঁদের চিনুন। যারা পাড়ার মস্তান তৃণমূল নেতা ক্যালাবে বলে রাজ্যে সীমাহীন রেশন দুর্নীতি দেখেও চোখ বুজে বসে আছে, তাঁদের চিনুন। চিনুন এই কারণেই যে বিজ্ঞান কে ভিত্তি করে প্যান্ডেমিকের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ মানুষ আজ না হয় কাল জিতবেই। পৃথিবীর রোগ ঠিক সেরে যাবে। তখন অবিকল মানুষের মত দেখতে এই জন্তুদের সোশ্যাল ডিসটেন্সিং লাগবে। কোয়রেন্টাইন লাগবে। দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসা লাগবে।

শুক্রবার, ৮ মে, ২০২০

রবীন্দ্রনাথ কি বুর্জোয়া কবি? ~ সৌরভ গোস্বামী

রবীন্দ্রনাথের জন্ম-মৃত্যু দিন এলেই শুনতে হয় কমিউনিস্ট পার্টি তাকে 'বুর্জোয়া কবি' বলেছিল ।  কমিউনিস্টদের আক্রমণের এই মোক্ষম সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে!! কিন্তু,  কমিউনিস্ট পার্টির কোন বৈঠকে এই রকম সমবেত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল? কোন দলিলে, মুখপত্রে তা প্রকাশিত হয়েছিল, সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে কোন নেতা কী মত দিয়েছিলেন  তার উত্তর মেলেনা। 
যে আলোচনা হয়েইনি তার প্রমাণই বা দেবে কী করে!
কমিউনি্সট পার্টিতে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মানে, একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনের ভিত্তিতে। 
রবীন্দ্রনাথকে 'রবীন্দ্র গুপ্ত' ছদ্মনামে বুর্জোয়া কবি বলেছিলেন কমিউনিস্ট নেতা ভবানী সেন। যা ছিল ভবানী সেনের একান্তই নিজস্ব মতামত। যা নিয়ে পার্টির মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিলে তিনি তা প্রত্যাহার করে নেন।
১৯৬১ সালে কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে একটি মেলার আয়োজন করে কমিউনিস্টরা। উদ্বোধন করেন রবীন্দ্র কন্যা মীরা দেবী। আমন্ত্রিতদেস মধ্যে ছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস, জে বি এস হল্ডেন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ,সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, সোভিয়েত ইউনিয়নের সুরকার বালাসানিয়ান, কিউবার নর্তকী এ.এলিশিয়া। ছিলেন কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক থেকে শতাধিক কবি। এছাড়াও বাংলার আদিবাসী লোকশিল্পীরা এবং বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের মজুর শিল্পীরাও মর্যাদার সাথে তাদের শিল্প নৈপুণ্য প্রকাশ করেন। ছিলেন দুই বাংলার কবিরা। সাথে ছিল উর্দু কবিদের মুশায়েরা। উত্তরপ্রদেশের নিরক্ষর কবি রামখেরের কবিতা এবং ভারতের বিভিন্ন ভাষার কবির কবিতা পাঠ ও আবৃত্তির আয়োজন করা হয়। কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশনা সংস্থা ' ন্যাশনাল বুক এজেন্সি ' থেকে গোপাল হালদারের সম্পাদনায় প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয় যার লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে,   নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। হীরেন্দ্রনাথ মুখপাধ্যায় লেখেন 'Himself a true poem'.  এই মেলা বয়কট কারা করেছিল? যাদের 'পড়তে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়'

ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির উষালগ্নে 'লাঙল' পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হলে রবীন্দ্রনাথের আশির্বাদ চান কমরেড মুজফফর আহমেদ, কবি নজরুল ইসলাম (কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীও বটে) এবং তাঁদের অন্যান্য সহযোগীরা। 

সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন—" রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে 'লাঙলের' জন্য আশীর্বচন যোগাড় এর ভার পড়ল আমার উপর।একদিন সকালবেলা রবীন্দ্রনাথের কাছে পেশ করলুম আমাদের আর্জি। তিনি তৎক্ষণাৎ লিখে দিলেন----  জাগো, জাগো বলরাম, ধরো তব মরুভাঙ্গা হল /প্রাণ দাও , শক্তি দাও, স্তব্ধ করো ব্যর্থ কোলাহল।
'লাঙলে'র  প্রচ্ছদপটে তাঁর ঐ আশীর্বচন থাকত।" 
ঐ লাঙল পত্রিকা প্রকাশের সূত্রে কমিউনিস্টরা জোড়াসাঁকোর বাড়ি ও কিছুটা রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে আসেন। পশ্চিমবঙ্গ সিপিআই(এম) সম্পাদক সরোজ মুখোপাধ্যায় ১৯৮৩, ২১ জানুয়ারী 'দেশহিতৈষী' পত্রিকায় লেখেন, ' জোড়াসাঁকোর বাড়িতে নিচের তলায় নেপু ঠাকুরের ঘর ছিল তদানীন্তন কমিউনিস্ট পার্টির গোপন কেন্দ্র। সে ঘরে কমরেড হালিমের সাথে আমি বহুবার গেছি। সোমনাথ লাহিড়ীও যেতেন, রণেন সেনও যেতেন। আব্দুল হালিমের সঙ্গে আমি ছ'সাতবার ওখানে রবীন্দ্রনাথের সাথে আলাপ আলোচনার সুযোগ পেয়েছিলাম। আব্দুল হালিম বীরভূমের মানুষ—তাঁকে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ স্নেহ করতেন। তাই আমাদের আলাপ ভালোই জমত। একবার আমরা তাঁর তীব্র সমালোচনা করে বললাম – আপনার 'রাশিয়ার চিঠি'র কয়েক জায়গা আমাদের ভালো লাগে নি। আমরা "সর্বহারার দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের 'রাশিয়ার চিঠি'" শীর্ষক একটা পুস্তিকা প্রকাশ করছি। তিনি বললেন, তা তোমরা কর , কিন্তু মোটামুটি ভালো চিঠি লিখি নি? আমি তো আর তোমাদের মত কমিউনিস্ট নই। আমরা বলি ঠিকই তো, আপনি যা লিখেছেন তাতে তো দারুণ কাজ হয়েছে, সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যা অপপ্রচার চলছে তাঁর মোক্ষম জবাব আপনি দিয়েছেন।"
আবার ওই একই বইতে তিনি লিখেছেন, ''গুরুতর গলদ আছে। সেজন্যে একদিন এদের বিপদ ঘটবে। ...ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেঁকে না ... একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিম্বা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।'' রবীন্দ্রনাথের মুশকিল হল তাঁকে কেটে-ছেঁটে সাইজ় করা যায় না। ব্যক্তিস্বাধীনতাকে মানেন তিনি, কিন্তু সামাজিক দায়িত্ব ভুলে যান না- যা গান্ধীজীর সাথেও তাঁর বিতর্কের একটা অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।

সোমবার, ৪ মে, ২০২০

কোরেন্ট আইন ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য

লকডাউনের আপন দেশে
আইন কানুন সর্বনেশে।
কেউ যদি যায় রোজ বাজারে, 
প্যায়দা এসে পাকড়ে ধরে। 
অনলাইনে হয় বিচার, 
কোরেন্টাইন দণ্ড তার! 
সেথায় সন্ধ্যে ছ'টার আগে
হাঁচতে সার্টিফিকিট লাগে। 
হাঁচলে পরে বিন কাগজে, 
'কোভিড পেশেন্ট' লোকে বোঝে। 
কোটাল তোলে পাকড়ে ভ্যানে, 
দেয় পাঠিয়ে কোরেন্ট্যানে! 
কারুর যদি দাঁতটি নড়ে, 
'মুখোশ পরো!' আদেশ করে। 
কারুর যদি গোঁফ গজায়,
সাবান দিয়ে হাত ধোয়ায়। 
খুঁচিয়ে পিঠে গুঁজিয়ে ঘাড়, 
কোরেন্টাইন যায় আবার!! 
চলতে গিয়ে কেউ যদি চায়
এদিক ওদিক ডাইনে বাঁয়, 
রাজার কাছে খবর ছোটে, 
পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে।
দুপুর রোদে ঘামিয়ে তায় 
কোরেন্টিনে ফের পাঠায়। 
যে সব লোকে খবর লেখে 
তাদের ধরে খাঁচায় রেখে 
কানের কাছে নানান সুরে 
শেখায়, "বালির স্তুপ সে গুড়ে!" 
সামনে রেখে মুদীর রেশন, 
বানান শেখায় "আইসোলেসন"!
হঠাৎ সেথায় রাত দুপুরে 
নাক ডাকালে ঘুমের ঘোরে 
অমনি তেড়ে মাথায় ঘষে 
রসুন গুলে লেবুর রসে।
পিপিই নেই, রাত পোশাকে 
 কোরেন্টিনে ভর্তি রাখে।।

ইমিউনিটি ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

করোনা রোগের মোকাবিলায় ভ্যাকসিন নিয়ে আলোচনা বহু চর্চিত। ওটা বেসিক্যালি ইমিউনিটির দু নম্বর ধারা, এডপটিভ ইমিউনিটি। আমি আপনি করোনায় একবার আক্রান্ত হলে আমাদের T সেল, B সেল একই ভাবে তৈরি হয়ে যাবে রোগটার মোকাবিলায়। এই সূত্র কাজে লাগিয়েই ওই কোনভালেসেন্ট সেরা থেরাপি অর্থাৎ সেই এন্টিজেন আর এন্টিবডি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। ভ্যাকসিন কবে পাওয়া যাবে চিত্রটা আশাপ্রদ নয়।

কোনো কোনো জনস্বাস্থ্যবিদ আবার হার্ড ইমিউনিটির কথা বলছেন। R নট ১.৫ ধরলে মোটামুটি ভাবে জনসংখ্যার ৬০% সংক্রমিত হয়ে পড়লে বাকি ৪০% ওই হার্ড বা পাল এর ইমিউনিটির দৌলতে বেঁচে যেতে পারে। মুস্কিল একটাই। সবাই চাইবে সে যেন ওই ৪০% এর দলে থাকে। না থাকলে তার দশা ওই বরিস জনসনের মতো হতে পারে।

আমাদের সবাই কেমন অদ্ভুত ভাবে ইমিউনিটির প্রথম ধারা টা ভুলে যেতে বসেছি। ইনেট বা সহজাত ইমিউনিটি। সেই মনোসাইট ম্যাক্রফ্যাজ, সেই ডেন্দ্রাইটিক সেল, সেই এলভিওলার এপিথেলিয়াম। যারা যে কোনো ব্যাকটেরিয়া ভাইরাস এর বিরুদ্ধে আমাদের শরীরে প্রথম লড়াইটা দেয়। সেই বিশ্বস্ত, পুরোনো, প্রাচীন পাহারাদারদের কথা আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। 

ওদের কথা একটু বোধ হয় ভাবা দরকার। ওদের একটু যত্নআত্মি প্রয়োজন। অতি সম্প্রতি একটি প্রবন্ধে বেশ কিছু মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা অনুপুষ্টি খাদ্য কে চিহ্নিত করা হয়েছে যারা সাইনারজিস্টিক উপায়ে বা একযোগে দেহের ইমিউন সিস্টেম বা প্রতিরোধ ক্ষমতা কে শক্তিশালী করে। তার মধ্যে রয়েছে ভিটামিন A, D, C, E, B6, B12, ফলেট, কপার, আয়রন, জিঙ্ক এবং সেলেনিয়াম [সূত্রঃ Gombart AF, Pierre A, Baghini S.A.; Nutrients 2020; 12: 236]।  এদের মধ্যে আবার ভিটামিন C, D এবং জিঙ্ক নিয়ে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ এভিডেন্স বা তথ্য-প্রমাণ জোগাড় হয়েছে। খুব সংক্ষেপে রেসপিরেটরি হেলথ বা শ্বাসযন্ত্র এর সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে এদের ভূমিকা উল্লেখ করা হল কারণ আমরা জানি যে কোভিভ-১৯ মূলতঃ শ্বাসযন্ত্রের অসুখ।

ভিটামিন সি এর ভূমিকা সেই ১৯৩০ এর দশক থেকে আলোচিত হয়ে আসছে। ২০১৭ সালের একটি গবেষনায় তিনখানি কন্ট্রোলড ট্রায়ালে দেখা গেছে যে ভিটামিন সি নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সাহায্য করে [সূত্রঃ Hemlia H, Nutrient 2017; 9:339]

শক্তিশালী ইমিউনো রেগুলেটর হিসেবে কমিউনিটি একোয়ার্ড নিউমোনিয়া তে ভিটামিন ডি এর ভূমিকাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন গবেষণায় [ সূত্রঃ Zdrenghea MT, Markrinioti H, Bayaran C, Rev Med Virol 2017, 27:e 1909]

জিঙ্ক কে বিবেচনা করা হয় ইমিউন ফাংশন এর "গেট কিপার হিসেবে [ সূত্রঃ Weasels I, Maywald M, Rink L, et al. Nutrients, 2017, 9:1286]। জিঙ্ক এর অভাবে বয়স্ক মানুষদের মধ্যে নিউমোনিয়া এর প্রকোপ ও তীব্রতা, দুটোই বেড়ে যায় [ সূত্রঃ Barnett JB, Hamer DH, Meydani SN; Nutr Rev 2010; 68:30-7]

এই ভিটামিন সি, ডি আর জিঙ্ক এমনি এমনি শরীরে পাওয়া যাবে না। খাবারের মধ্যে দিয়ে ওদের শরীরে ঢোকাতে হবে। একটু সুষম খাবার। এই লক ডাউন এর বাজারে অনেকের কাছেই এই শব্দটা উপহাস মনে হতে পারে। তাই পাল্টে বলা যায়, একটু পেট ভরে খাবার। বেশি কিছু নয়। একটু ডাল ভাত সবজি, আর পাতের কোনে এক টুকরো পাতি লেবু। সঙ্গে যদি একটা ডিম জুটে যায়। আহা।

বিশ্বাস করুন, গুরুর দিব্যি। এটুকু পেলেই আমার শরীরের এলভিওলার এপিথেলিয়াম চাঙ্গা হয়ে উঠবে। আমি জানতেও পারবো না যে সে কিভাবে ও সার্স কোভ ২ সেই নোভেল করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ে যাবে।

আমি আমার ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে ভাইরাসের বিরূদ্ধে লড়তে চাই। আমি চাই ভারতের সব অপুষ্ট শিশু আর বৃদ্ধ লড়ে যাক তাদের মতো করে। আপনার কাজ কেবল নজর রাখা যে তাদের পাতে যেন ভাত পরে দুবেলা। তাদের মুখের গ্রাস কেউ যেন কেড়ে না নেয়। করোনা আটকাতে গেলে চালচোরদের, রোজগার চোরদের আটকাতে হবে। নইলে বৃথা এ লড়াই। আপনার ইনেট ইমিউনিটির দোহাই।

শনিবার, ২ মে, ২০২০

মমতার রাজ্যে করোনা ~ পুরন্দর ভাট

"ওরে আয়রে ছুটে আয়রে ত্বরা, হেথা নাইকো মৃত্যু নাইকো জ্বরা"

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের করোনা মোকাবিলায় ব্যর্থতা ক্রমশ নতুন নতুন শিখর স্পর্শ করে চলেছে। সাধারণ মানুষের কাছে নিত্য তথ্য লুকোনোর, তথ্য পরিবর্তন করার এমন এক ইতিবৃত্ত রচনা করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে রীতিমত এক রোমহর্ষক গোয়েন্দা গল্প হয়ে যায়। 

 শুরুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মবিশ্বাস এবং করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে তৈরি রাখার তোড়জোড় দেখে মানুষ আশ্বস্তই হয়েছিল। অনেকে তো বলা শুরু করেছিলেন যে ভারতের সব রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে একমাত্র মমতাই গুরুত্বটা বুঝছে। করোনা আর নিশ্চিন্তে নিদ্রিত বাংলার মানুষের মাঝে তিনি প্রাচীরের মত দাঁড়িয়ে, অথবা বাংলার চারপাশে লক্ষণরেখা আঁকছেন - এমন সব কল্পচিত্রতে ফেসবুক ভরে গেছিল, রাজনৈতিক সত্তা নির্বিশেষে সকলে মমতার ওপর ভরসা করেছিলেন, এমন কি আমার  পরিবারের লোকেরাও। আমি পারিনি করতে, কিন্তু সে কথা থাক। প্রথম কনফার্মড কেস সেই লন্ডন ফেরত আমলাপুত্র। সেই ঘটনাতেই সন্দেহ হয়েছিল আদৌ কতটা তৈরি প্রশাসন। একজন উচ্চপদস্থ আমলার যদি এইটুকু সেন্স না থাকে যে ছেলেকে আইডিতে কোয়ারানটাইন করার পরামর্শ দেওয়ার পরও তাকে বাড়িতে নিয়ে আসবে, সেখানে তার সাথে স্বাভাবিক মেলামেশা করবে, এবং এত কিছুর পর নবান্নে গিয়ে মিটিংও করবে, তাহলে বোঝাই যায় যে প্রশাসনের উপরমহলেই কোনো সচেতনতা নেই। রাজ্যের প্রথম দিকের করোনা আক্রান্তের মৃত্যু নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয়। প্রথমে প্রশাসন বলে যে তিনি বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে রোগ এনেছেন কিন্তু পরিবার থেকে সম্পূর্ণভাবে তা নাকচ করা হয়।  এর পর সেই নিয়ে কী তদন্ত হলো আর তার কী ফল হলো কেউ জানতে পারে না। ফেসবুকে তার ইতালীয় পুত্রবধূর ছবি ছড়িয়ে যায় যে ছেলে আর বউকে বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিল তাই করোনা হয়েছে। কিন্তু সেই সবই গুজব। একই ভাবে বেলঘড়িয়ায় করোনা আক্রান্ত রোলের দোকানের মালিকের মৃত্যু নিয়েও রহস্য তৈরি হয়। আজও জানা যায়নি কী ভাবে তাঁর করোনা হয়েছিল। সরকার শুরুর দিকে করোনা আক্রান্তদের নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট দিচ্ছিল, কী ভাবে তারা আক্রান্ত হলো, কত জন কনট্যাক্টকে ট্রেস করা হয়েছে, ইত্যাদি। কিন্তু ক্রমশ একের পর এক কেসে বিদেশযোগ খুঁজে না পেয়ে সরকার সেই বিস্তারিত রিপোর্ট করাই বন্ধ করে দিলো। যদি কারুর ক্ষেত্রে বোঝা না যায় যে সে কী ভাবে আক্রান্ত হয়েছে তাহলে সে ক্ষেত্রে ওই এলাকায় কমিউনিটি স্প্রেড হচ্ছে সেটা স্বীকার করা প্রয়োজন এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সরকার সে সবের ধার ধারেনি, উল্টে তথ্যই চেপে দেওয়ার রাস্তা নেয়। বোধয় এই সময় তাবলীগি জামাত সূত্রে হওয়া সংক্রমণগুলো সামনে আসতে থাকে, সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার্থে হয়ত সেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে চায়নি। এই সময় অপর একটি বিষয়ও সামনে আসে। তা হলো পশ্চিমবঙ্গ বাকি রাজ্যের তুলনায় অনেক কম পরীক্ষা করছে, এমন কি বিহার বা ঝাড়খণ্ডের মত রাজ্য যেগুলোয় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কম - তাদের চেয়েও। এবং এই অভিযোগ ওঠা শুরু হতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথ্য লুকোনোর আর মিথ্যা বলার এমন এক কানাগলির মধ্যে প্রবেশ করে যে তার থেকে বেরোনোর পথ সে এক মাস পরেও খুঁজে পাচ্ছে না।

অথচ এই রেগুলার হেলথ বুলেটিন, অথবা সাংবাদিক সম্মেলনে করোনা পরিস্থতি মানুষকে জানানোর  প্রথা শুরু করায় পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু প্রথম সারিতে থাকবে। ফেব্রুয়ারি থেকে পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য দফতর দু তিন দিনে একবার করে রাজ্যের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে বুলেটিন প্রকাশ করা শুরু করে। মার্চের শুরু থেকে এটা প্রায় প্রতি দিন নিয়মিত হয়ে যায়। সেই সময় খুব কম রাজ্যই এতটা স্বচ্ছভাবে তথ্য দিচ্ছিল মানুষকে, বহু রাজ্যের তো কোনো নিয়মিত বুলেটিনই ছিল না। কিন্তু টেস্ট নিয়ে প্রশ্ন শুরু হতে পশ্চিমবঙ্গ পথ বদলায় এবং বাকি দেশের সব রাজ্য যে পথে চলছে তার উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করে। কী রকম? এপ্রিলের শুরু থেকে সমস্ত রাজ্যগুলো প্রতিদিন নিয়মিত বুলেটিনে কত জন নতুন আক্রান্ত হলো, শুরু থেকে সেই দিন অবধি কত জন মোট আক্রান্ত, কত জন মারা গেছেন, কত জনের পরীক্ষা হয়েছে এসমস্ত কিছুর জেলাওয়ারী হিসেব দেওয়া শুরু করে। তখন পশ্চিমবঙ্গ জেলাওয়ারী হিসেব  বা  পরীক্ষার হিসেব দেওয়া তো ছেড়েই দিন, এমন কি কত জন মোট করোনা আক্রান্ত এবং কতজন মোট মৃত সেটা নিয়েও পরিষ্কার ভাবে জানানো বন্ধ করে দেয় বুলেটিনে। মার্চ অবধি পশ্চিমবঙ্গও বাকিদের মত মোট আক্রান্তের হিসেব দিত তাদের বুলেটিনে কিন্তু এপ্রিলের ১ থেকে ৫ হঠাৎ বুলেটিন প্রকাশ স্থগিত হয়ে যায়। ফের তা চালু হলে দেখা যায় দুটি বিষয় - এক, বুলেটিনের ফরম্যাট বদলে গেছে, মোট আক্রান্তের সংখ্যা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে আর তার বদলে সেই দিন কতগুলো একটিভ কেস,  কতজনের মৃত্যু হয়েছে, এবং সেই দিন কত জন রুগী সুস্থ্য হয়েছে - এই তথ্য দেওয়া শুরু করে। এই তথ্য থেকে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বের করা সম্ভব নয় যতক্ষন না শুরু থেকে কত জনের মৃত্যু হয়েছে এবং শুরুর থেকে কতজন সুস্থ হয়েছে তা জানা যাচ্ছে। এবং দুই,  এই সময়তেই এক্সপার্ট কমিটি গঠন হয় যারা করোনা আক্রান্ত কারুর মৃত্যুকে করোনায় মৃত্যু নাকি অন্য কারণে - তা ঠিক করে দিতে থাকে। দেখা যায় যে মৃতের সংখ্যা হঠাৎ করে কমে যায়। যে সব করোনা আক্রান্তের মৃত্যুকে করোনা মৃত্যু বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না তাদের সরকারের তালিকাতেও জায়গা হয় না। এই রিপোর্টিংয়ের বদল দেখেই বুঝে যাই যে সরকার তথ্য লুকোনো শুরু করেছে। বামপন্থীরা এই নিয়ে প্রতিবাদে সরব হন। গণশক্তি পত্রিকা এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ৩০ জন মৃতের তালিকা প্রকাশ করে যখন সরকারি হিসেবে মৃত ছিল বোধয় ১১ জন। গণশক্তির বিরুদ্ধে পুলিশে ডাইরি হয়। বামপন্থী নেতারা আটক হন। চারপাশে খবর রটতে থাকে যে পুলিশ রাতের অন্ধকারে দেহ দাহ করছে। সরকার গুজব বলে সেগুলোকে উড়িয়ে দেয়, যাঁরা ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন তাদের পোস্ট উড়ে যেতে থাকে, পুলিশ ধমকি দিতে থাকে। অথচ ব্যক্তিগত আলাপে পুলিশকর্মীদের কাছেই জানতে পারি যে স্পেশ্যাল শ্মশানে দাহ করা মৃতের সংখ্যা সরকারিভাবে স্বীকৃত মৃতের অন্তত ১০ গুন। বেশিদিন লাশের গন্ধ চাপা থাকে না। শেষে ২৪  এপ্রিল সরকার স্বীকার করে যে করোনা আক্রান্তে মৃতের সংখ্যা আসলে ৫৭ কিন্তু তার মধ্যে ৩৯ জন "অন্য কারণে" মারা গেছে। সরকারি ভাবে স্বীকৃত মৃতের সংখ্যা সেদিন অবধি ১৮। অর্থাৎ গণশক্তির দেওয়া হিসেবই মেনে নেয় সরকার। চারপাশে সরকারি তথ্য চাপবার প্রয়াসকে নিয়ে হই চই পড়ে যায়, সবাই নিন্দে করতে থাকে, সরকারের দেওয়া সমস্ত তথ্যই সন্দেহ করতে থাকে মানুষ। এর মধ্যে কিছু তৃণমূলী সাফাই গাইতে থাকে যে অন্য অসুস্থতার কারণে মৃত্যু হলে তার শরীরে করোনা পাওয়া গেলেও তাকে করোনায় মৃত বলা উচিত না, অন্য কেউই তাদেরকে কাউন্ট করছে না, ইত্যাদি। একদম সর্বৈব মিথ্যে কথা। সব রাজ্যই করোনা পজিটিভ কারুর মৃত্যুকে করোনা মৃত্যু বলেই ধরছে। মহারাষ্ট্রে মৃতর তালিকায় ৭০%-এরই শরীরে অন্য রোগও ছিল, তাদের রাজ্যের রোজের হেলথ রিপোর্টেই সেটা থাকছে।  উন্নত দেশগুলোতে তো করোনা পরীক্ষা না হলেও যদি কারুর মধ্যে কিছু সিম্পটম দেখা যায় আর সে মারা যায় তাহলে তাকেও করোনায় মৃত বলে ধরে নিচ্ছে। হু-এর গাইডলাইন রয়েছে এক্সপার্ট কমিটি গঠন করার বিষয়ে কিন্তু সেটা করোনায় মৃতের সংখ্যা কমানোর জন্য নয়, উল্টে টেস্ট করা সম্ভব না হলে সিম্পটম দেখে করোনায় মৃত কি না তা যাচাই করার জন্যে অর্থাৎ মৃতের সংখ্যা বাড়ানোর জন্যে সেই কমিটি করার কথা বলেছে। মৃতের সংখ্যা আন্ডারএস্টিমেট করাটা সমস্যার, ওভারএস্টিমেটটা সমস্যার নয় কারণ মৃতের সংখ্যা বেশি হলে বেশি টেস্ট করার তাগিদ হবে, উল্টে সংখ্যা কম দেখালে মানুষও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বা মুখ ঢাকার গা করবে না। এই ৫৭ সংখ্যাটিকেও লোকে অবিশ্বাস করতে থাকে। সেটাই স্বাভাবিক, একবার মিথ্যে বলতে ধরা পড়ে গেলে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। আরো বাড়তে থাকে জল্পনা, আরো লুকিয়ে দাহ করার ঘটনা সামনে আসতে থাকে। এর পর বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে দাহ করা নিয়ে প্রতিরোধ শুরু হয়। করোনা আক্রান্তকে রাতের অন্ধকারে, ফাঁকা শ্মশানে দাহ করাটা খুবই যুক্তিযুক্ত কিন্তু আক্রান্তের বাড়ির লোককে কেন অন্তত শ্মশান অবধি আসতে দেওয়া হবে না? তারা লাশের সংস্পর্শে না এলেই তো কোনো অসুবিধে নেই। বাড়ির লোকেরা যদি দেহর সাথে আসে তাহলে পাড়ার লোকও ঝামেলা করবে না। নাকি বাড়ির লোকজনকে না জানিয়েই দাহ করা হচ্ছে যাতে লুকিয়ে ফেলা যায়? ডেথ সার্টিফিকেটে করোনা পজিটিভ লিখতেও যেখানে কমিটির পারমিশন চাই সেখানে করোনা লুকোনোটাই উদ্দেশ্য মনে হচ্ছে। এত হই চইয়ের পরেও কিন্তু কমিটি বাতিল হয়নি। এরপরও তারা করোনা আক্রান্তের মৃত্যুকে করোনা মৃত্যুর তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। এই করতে করতে এপ্রিলের ২৯ তারিখ মোট করোনা আক্রান্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০৫-এ যেখানে সরকারি তালিকায় করোনায় মৃত বলে স্বীকার করা হয়েছে মাত্র ৩৩ জন। 

এই মৃত্যু লুকোনোর কারণ কী? কেন মৃতের সংখ্যা কমানোর চেষ্টা? কারণ হলো যে মৃতের প্রকৃত সংখ্যা স্বীকার করে নিলে পশ্চিমবঙ্গে করোনায় মৃতের হার সারা ভারতে সর্বোচ্চ হয়ে যাবে। সারা দেশে যেখানে মৃতের হার মাত্র ৩-৪% সেখানে এই রাজ্যে তা দাঁড়াবে ১২%। কেন বেশি মৃত্যু? কারণ যথেষ্ট সংখ্যক করোনা রুগী ধরা পড়েনি। মৃত্যুর হার  গণিত হয় মোট আক্রান্তের সংখ্যার ওপর, আর মোট আক্রান্তের সংখ্যা নির্ধারিত হয় মোট পরীক্ষার ওপর। এবার যদি মোট পরীক্ষাই কম হয় তাহলে মোট আক্রান্তও কম হবে এবং মৃতের হার বেশি মনে হবে। টেস্টিংয়ের ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে তাই মৃতের সংখ্যায় জল মেশানোর রাস্তা নেয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু ছোটর থেকে আমরা জানি যে একবার মিথ্যে বললে ক্রমশ সেই মিথ্যেকে ঢাকতে আরো মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন ঠিক সেই ফাঁদেই ক্রমশ জড়িয়ে পড়েছে। এই যে অতিরিক্ত ৭২ জন মৃত এরা কিন্তু সরকার প্রকাশিত করোনা তালিকায় কোথাও কাউন্টেড নন। কারণ আগেই বলেছি যে সরকার মোট আক্রান্তের সংখ্যা দিচ্ছে না, তার বদলে গত দু সপ্তাহ ধরে তারা জানাচ্ছে শুধু মোট বর্তমানে আক্রান্ত, কত জন সুস্থ হয়েছে, এবং কত জন মৃত। মৃতের মধ্যে এদের নাম নেই, এরা বর্তমানে আক্রান্ত, অথবা সুস্থও হয়ে ওঠেননি। তাই মোট করোনা আক্রান্তের মধ্যে এরা নেই। রাজ্যে মোট করোনা আক্রান্ত কত জন? এই সংখ্যাটাই আর পরিষ্কার নয়। রাজ্য ৩০-এ এপ্রিল সকালের পর আর বুলেটিন বের করেনি। শেষ বুলেটিনের হিসেবে ধরলে মোট আক্রান্ত ৭৫০ জন। অথচ কালকে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রককে দেওয়া চিঠিতে রাজ্য সরকার জানিয়েছে যে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৯৩১ জন। এই ১৮০ জন কি এক দিনে আক্রান্ত হলো নাকি আগের হিসেবে গরমিল ছিল?  কেউ জানে না। সেই চিঠিতে জেলাওয়ারী হিসেবও দিয়েছে রাজ্য অথচ বুলেটিনে জেলা বাবদ আক্রান্তের সংখ্যা জানানো হচ্ছে না।

 যদি বুঝতাম যে মানুষকে তথ্য না দিলেও সরকার যা ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন তা নিচ্ছে তাহলেও হতো। কিন্তু সেটাও নেয়নি। আসলে আমাদের দেশ তো আর চীন নয়, এখানে কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে আগে মানুষকে বলতে হয় কেন সেই পদক্ষেপ প্রয়োজন। তাই তথ্য লুকিয়ে মানুষের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিলে মানুষ মানে না। মানুষ বাজার হাট, দোকান পাটে ভিড় করছে গুরুত্ব না বুঝে, এতে বিপদ বাড়ছে। আমি অনন্তকাল লকডাউন রাখার পক্ষে নই, কিন্তু লকডাউন তুলে নিতে গেলে একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনে তা করতে হবে যাতে টেস্টিংয়ের এবং সংক্রমণকে চিহ্নিত করে রুগীদের তাড়াতাড়ি আলাদা করার ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটাই যদি না হয় তাহলে লকডাউন তুললে দুদিন পর পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে।

করোনা মোকাবিলায় বিশ্বের সব উন্নত দেশও পর্যদুস্ত। পশ্চিমবঙ্গে করোনা আক্রান্ত এবং মৃতের প্রকৃত সংখ্যা মানুষকে জানালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেউ খারাপ প্রশাসক বলতো না, আমেরিকাই পারছে না তো মমতা পারবেন এই আশা কেউ করে না। কেরালার প্রসঙ্গ আলাদা। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে দক্ষ প্রশাসক প্রমাণ করতে সংখ্যা নিয়ে এই লুকোচুরি করলো। এতে উল্টে রাজ্যের মানুষের বিশ্বাস খোয়ালো সরকার। এখন গোটাটার দায়ে মমতা চাপিয়ে দিয়েছে চিফ সেক্রেটারি আর হেলথ সেক্রেটারির ওপর এবং ওই মৃত্যু বিচারের এক্সপার্ট কমিটিকে প্রায় বিদায় দিয়েছে। তবুও এর দায় নিজে নেয়নি। নিজের ইমেজের কথা না ভেবে যদি একটু রাজ্যের মানুষের কথা ভাবতেন মমতা তাহলে আজকে রাজ্য এই বিপদের সামনে পড়ত না। এখন পরিস্থিতি এমনই যে রাজ্যে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করলেও অধিকাংশ মানুষ সেটাকেও মেনে নেবে। যদি শেষ অবধি সেটাই হয় তাহলে তার জন্য দায়ী হবেন একা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

(নিচে সমস্ত তথ্যর লিংক দেওয়া রইলো)

শুক্রবার, ১ মে, ২০২০

"ভুল করে তুই চিনলি না রে..." ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

এর আগে রাষ্ট্র ও সরকারের নানান নীতির সমালোচনা করে অনেক কিছু লিখেছি। জ্ঞানত কোনো মিথ্যে কথা লিখিনি, কোনো বিকৃত তথ্যও পরিবেশন করিনি। তাতে প্রচুর সাধুবাদও পেয়েছি। কিন্তু বারবার একটি কথাই মনে হয়েছে। সমস্ত সমালোচনা কি কেবল ওদেরই প্রাপ্য? আমাদের অর্থাৎ আম-আদমিদের নিয়ে গঠিত জনসমাজ এর কোনই দায়িত্ব নেই, বা ছিল না?

আজকে সারা পৃথিবী জুড়ে, দেশ জুড়ে, রাজ্য জুড়ে যখন জনস্বাস্থ্যের করুন চেহারাটা একটু একটু করে বে-আব্রু হচ্ছে, তখন আমরা ক্ষোভে ফেটে পড়ছি। কিন্তু একদিনে তো এটা হয় নি। বছরের পর বছর ধরে স্বাস্থ্যের জন্য ১% ২% বাজেট বরাদ্দ হয়েছে। আমরা চুপ করে ছিলাম। আমরা মেতে ছিলাম বিদেশে বেআইনি অভিবাসী নিয়ে অথবা দেশে মন্দির-মসজিদ, এনআরসি নিয়ে। 

আমাদের দেশে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট কত বরাদ্দ হল, কোনো নির্বাচনে এটা ইস্যু হয়েছে কোনোদিন? স্বাস্থ্যের মধ্যে আবার চিকিৎসাখাতে আর জনস্বাস্থ্যের খাতে কত বরাদ্দ হল আমরা ভেবেছি কোনোদিন?

আজ স্টার আনন্দের সাংবাদিকের মা ভর্তি হতে হয়রানি হওয়ার পরে সংবাদের চর্চায় এসেছে কোন বেসরকারি হাসপাতালে কত আইসলেশন বেড। এর আগে তো আসেনি। ওই আনন্দতেই তো সার্জিক্যাল স্ক্রাব সুট পরা মুখপাত্ররা প্রচার করতে ব্যস্ত ছিলেন যে বাইপাসের ধারের পাঁচতারা হাসপাতালগুলি কোনো অংশে দক্ষিণ ভারতের চেয়ে কম নয়। আমরা দর্শক-শ্রোতারা তখন কেবল হাততালি দিতেই ব্যস্ত ছিলাম।

আজকে তৃণমূলস্তরের স্বাস্থ্যকর্মী এএনএম আর আশাকর্মীরা বাড়ি গিয়ে জ্বরের সার্ভেলেন্সে কি উজ্জ্বল ভূমিকা নিতে পারেন তার কথা বলা হচ্ছে। অথচ এরা যখন চাকরিগত কিছু সামান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য আন্দোলন ধর্মঘট করেছিল তখন আমরা জনসাধারণ পাত্তাই দিই নি। আমাদের মনোভাব ছিল - এরা কারা, চিনিনা তো। এক পদ এক বেতনের দাবিতে সেকেন্ড এএনএমরা জমায়েত করলে পুলিশ দিয়ে গলা ধাক্কা দিয়ে বিগ বসরা নিজের নীল বাতি জ্বালানো গাড়ি নিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেছেন। এবিপি আনন্দ কভার করেনি কিন্তু সেই ফুটেজ। আজ সুমন কাঁপা কাঁপা গলায় কাঁদুনি গাইছে।

আজকে টেস্ট বাড়াও, টেস্ট বাড়াও বলে আমরা যারা চিল্লিয়ে বাজার মাত করে দিলাম তারা ক'জন খোঁজ নিয়েছিলাম যে নবগঠিত মেডিক্যাল কলেজগুলোর মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের কটাতে বায়ো-সেফটি ক্যাবিনেট আছে। ক'জন আমরা মাথা ঘামিয়েছি যখন একের পর এক ল্যাব টেকনোলজিস্ট, বা অক্সিলিয়ারী নার্স কাম মিডওয়াইফ N95 এর অভাবে এমডিআর যক্ষায় আক্রান্ত হয়েছেন। আজ টোটেম পোলের সর্বোচ্চ কোনো ডাক্তার পিপিই পাচ্ছেন না বলে আমরা আহা-উহু করছি। কেন, ওই ল্যাব টেক, ওই এএনএম কি মানুষ ছিল না? ডাক্তার সংগঠন থেকে দাবি জানানো হচ্ছে, মৃত ডাক্তার কে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে। একশো বার দিতে হবে। কেবল তুচ্ছ প্রশ্ন, যে এএনএম টিবিতে মারা গেল তার শহীদের মর্যাদার জন্য কোন ডাক্তার সংগঠন কবে মুখর হল কেউ জানাবেন? পাবলিক হেলথের অন্যতম স্তম্ভ হেলথ এসিস্টেন্ট মেল নামে একটা গোটা ক্যাডার অবলুপ্ত করে দেওয়া হল, ডান-বাম কারুর কোনো হেলদোল দেখিনি। গ্রামের ছোট্ট পিএইচসির ডাক্তারকে "অর্ডিনারী এমবিবিএস" বলে উপহাস করেছি পাবলিক হেলথে তার লিডারশিপের ভূমিকা অক্লেশে ভুলে।

আমরা প্রাণভরে মন্দির-মসজিদ, ইউনিফর্ম সিভিল কোড ৩৭০ এসব বড় বড় বিষয় নিয়েই মেতে ছিলাম। আজ করোনা আসাতে স্বাস্থ্য নিয়ে একটু আধটু মাথা ঘামাচ্ছি। লিখে রাখুন, আগামী নির্বাচনে স্বাস্থ্য কোনো এজেন্ডাই হবে না। আমরা আলোকিত ফ্লাইওভার, বিশাল প্যাটেল মূর্তি, নেতা নেত্রীর ছবি ঝোলানো ফিল্ম উৎসব, আম/ইলিশ উৎসব এসব নিয়েই আবার মেতে উঠবো।

কেবল, কেবল আমরা গুটিকয় মানুষ সীমিত সাধ্য নিয়ে, মানুষের হাজার সমালোচনা মেনে নিয়ে তখনও লড়ে যাবো। আমাদের গ্ল্যামারহীন জগতে কোনো তারকা খচিত লিভার বিশেষজ্ঞ নেই। আমরা মাঠে ঘাটে কাজ করা মানুষ, প্রতিদিন মানুষের প্রত্যাশার চাপ নেওয়া মানুষ, যাদের পয়সা দিয়ে স্বাস্থ্য কেনার ক্ষমতা নেই তাদের সেবা করা মানুষ, যাদের কেউ টিভি টক শোতে ডাকে না, তেমন গ্ল্যামারহীন মানুষ। 

আমরা সীমিত সাধ্য নিয়ে ময়দানে আছি। এই কারণেই আছি যে নিউইয়র্ক এর কুইন্স বোরোর ছোট্ট রাব্বি পরিবারে জন্মানো আমার, আমাদের না দেখা শিক্ষক, জন হপকিন্সের প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক লিওন গর্ডইস শিখিয়ে ছিলেন যে এপিডেমিওলজিটা কেবল ক্লাস রুমে শেখা যায় না, মানুষের মাঝে গিয়ে শিখতে হয়।

কেবল একটাই অনুরোধ, পরের বার কেউ ভোট চাইতে এলে একটি বার জিজ্ঞেস করবেন, স্বাস্থ্য বাজেট এ ক'পয়সা খরচ করবে বাবারা? সিয়াচেনে সৈনিকদের আত্মত্যাগের পাশাপাশি নিজের পাড়ায় কাজ করা আশা কর্মী, HHW, এএনএমদের কথাও বোধহয় একটু ভাবা দরকার। সৈনিক কি কেবল জলপাই বা খাকি রঙের ইউনিফর্মই পরে?

"রাধে, ভুল করে তুই চিনলি না তোর প্রেমের শ্যাম রাই;
ঝাঁপ দিলি তুই মরণ যমুনায়..."