সেই কলমটা থেমে গেলো আজ,
এই সময়ে সব থেকে যা দামী।
খিস্তি করে দেখানো যার কাজ
রাষ্ট্র আর সমাজের ঢ্যামনামি....
চেতনায় ছুঁয়ে যাক নবারুণ আলো............
সেই কলমটা থেমে গেলো আজ,
এই সময়ে সব থেকে যা দামী।
খিস্তি করে দেখানো যার কাজ
রাষ্ট্র আর সমাজের ঢ্যামনামি....
চেতনায় ছুঁয়ে যাক নবারুণ আলো............
আমাদের ক্লাবের মাঠের বড় পর্দায় দেখলাম জায়ান্টস অফ ব্রাজিল। একেবারে সিনেমা। মারপিট আছে, চোট্টামি আছে আমাদের মতো, তারচেয়েও বড় কথা ড্রিবল আছে, শিল্প আছে, স্বপ্ন আছে। সে দেশের সমর্থকেরা গোলা ফাটানোর জন্যে ঘরবাড়ি বিক্রি করে মহাদেশ পার করে জাহাজে করে অন্য দেশে পাড়ি দেন। হেরে যাবার পর তাঁদের হাতে থাকে স্রেফ ভিক্ষার ঝুলি, কান্নাতো নিত্যদিনের সঙ্গী। কারন ব্রাজিল দেশটা আমাদের চেয়েও তখন নাকি গরিব।
সেইদেশও আমাদের মতো ইউরোপীয়দের দেশ ছাড়া করে স্বাধীন হয়েছে অথচ তারা গোটা বিশ্বকে অস্ত্র দিয়ে নয়, যুদ্ধ দিয়ে নয়, রাজনৈতিক কুটকচালি দিয়ে নয়, স্রেফ খেলা দিয়ে শাসন করেন। সবাই তাঁদের পেছনে দৌড়ায়, তাঁরা এগিয়ে যান খেলে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে। সেই ছাপ থাকতো তাঁদের খেলাতেও, তাঁরা ফেয়ার প্লে অর্থাৎ মারপিট না করে স্রেফ খেলার আনন্দেই খেলেন এবং জেতেন সেই সুস্থ প্রতিযোগিতায়।
ইংল্যান্ডে যেবার বিশ্বকাপ হয় সেবার তাঁরা পারেন নি। সেবার নাকি স্রেফ ইংরেজদের চোট্টামির জন্যেই অনেক ভালো দল প্রতিযোগিতা থেকে হারিয়ে যান। কিন্তু, চ্যালেঞ্জ ছিল জুলেরিমে কাপ জেতার। যে তিনবার জিতবে সেই কাপ চিরজীবনের জন্যে তাঁদের। সেই লড়াই ব্রাজিল জিতে নেয়। এবং গোটা বিশ্বে নিজের দেশের নাম স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করে নেয়। তখনো মারাদোনা তথা আর্জেন্টিনা বিশ্বফুটবলের মানচিত্রে আসেন নি।
সেই স্বপ্নে ভারতবর্ষের একটা ছোট্ট শিশু মশগুল হয়ে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ছিল এবং অবশ্যম্ভাবী ছিল। কারন এই খেলা ছিল দেশকাল, বর্ণ, রাজনীত, যুদ্ধ সবকিছুর উর্ধে। স্রেফ ভালবাসার অন্তিম বহিঃপ্রকাশ।
জায়ান্টস অফ ব্রাজিল দিয়ে শুরু, তারপর জিকো অর্থাৎ সাদা পেলে, এডিনহো, সক্রেটীস, কারেকা, অ্যালেমাও, ফালকাও, জুনিয়রকে দিয়ে সরাসরি দেখা ব্রাজিলের ম্যাজিক। না সেবার ব্রাজিল পারে নি জিততে। কিন্তু মন ভরিয়ে দিয়েছিল তাঁদের খেলোয়াড়ি শিল্পে। ঢেউয়ের মোট আছড়ে পড়া বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে। এবং একেরপর এক গোলের সম্ভাবনা তৈরি করা। কোনদিনই তাঁরা ডিফেন্সে বিশ্বাসী ছিলেন না। বরং একটা গোল খেলে ৪টে গোল করার মানসিকতায় মাঠে নামতেন। আবার একই কথা বলি, খেলার আনন্দে খেলতেন ফলে তাঁদের খেলা ছিল স্বপ্নময় সুন্দর।
জেতার জন্যে কিছু দল বিধ্বংসী খেলা খেলে, যার বেশিরভাগই ইউরোপীয়। সেই দলের নাম বলে আর বিড়ম্বনা বাড়াতে চাই না। তবে তাঁরাও জেতে। কিন্ত,শুধু খেলাটুকুই জেতে। মন জিততে পারে না। কালোচামড়ার প্রতি সাদা চামড়ার শোষণের লড়াইতে চিরকাল জিতে এসেছে, সেখানে এই খেলাটুকুই হচ্ছে সান্ত্বনার জায়গা। এবং বৃহত্তর মানবিকতার লড়াই। যা গোটাবিশ্বের আপামর জনতার হয়ে লড়েছে, ব্রাজিল। এবং স্বপ্নপুরন করেছে ব্রাজিল। আমাদের কিছু না করতে পারা জীবনের এটাই ছিল একটা সান্ত্বনার জায়গা। যেখানে ব্রাজিল বলে দেয় "যে সব ক্ষেত্রেই ওরা সেরা নয়, ওঁরা যেখানে সেরা সেটাই একমাত্র মোক্ষ নয় আমাদের জীবনে"।
তাই ব্রাজিলকেই সমর্থন করে ফেলেছি অজান্তেই। ভালবেসে ফেলেছিও অজান্তেই। যথার্থই ভালবাসা বলতে বাধা নেই, কারন এখানে চাওয়াপাওয়ার হিসেবটা নেই। তবে কি কিছুই চাই নি?
চেয়েছি, বারবার চেয়েছি, প্রতিবার প্রমান করতে যে ব্রাজিলই শ্রেষ্ঠ, কিন্তু খেলার অমোঘ নিয়ম এমনই যে এই খেলায় যে কোন দুটো দলের সবসময়েই একদম ৫০-৫০ সম্ভাবনা থাকে। সামান্যতম সুবিধা কেউ আগেপরে পায় না। সেখানেই ফুটবল আলাদা। শ্রেষ্ঠ খেলা ফুটবল।
তিলতিল করে গড়ে তোলা ভালবাসার প্রাসাদ আজ চূর্ণ জার্মানির অতর্কিত আক্রমণে। আজ ব্রাজিল ৭-১ গোলে হেরে যাওয়াতে কি প্রমান হয়? আমার জ্ঞ্বান সীমিত, তবু বলতে পারি যে ৮৪বছরের বিশ্বফুটবলের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে লজ্জাজনক হার। আমার মনে প্রশ্ন উঠে আসে, যে তাহলে কি সৃষ্টিশীল ফুটবলের ধারক ও বাহকের দিন শেষ? এবার শুরু নতুন অধ্যায় যেখানে কেবলই ট্যাকটিকস ও পরিকল্পনা মাফিক খেলার জয় হবে? তাহলে সেটা কি খেলা হবে নাকি রোবটের লড়াই হবে। হয়তো কেউ কেউ বলবেন, কেন আর্জেন্টিনা, হল্যান্ড, উরুগুয়ে, চিলি, স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স, পেরু, ক্যামেরুন, জাপান এদের খেলায় কি শিল্প নেই? আমি বলবো আলবাত আছে। মানুষ এতবড় মূর্খ হতে পারেনা যেখানে মারাদোনা স্বয়ং আছেন। তিনিও ফুটবলে শিল্পের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় [আমার মতে]। মারাদোনা মানেই স্বপ্ন। কিন্তু সেতো শুধু মারাদোনা। তাঁর দেশ আর্জেন্টিনা আমার মনে সেইভাবে দাগ কাটেনি। মারাদোনার আবির্ভাবের আগেই আমার মনের গাঁটছড়া বাধা হয়ে গেছে ব্রাজিলের সঙ্গে, গোটাদেশটার সঙ্গে। সেখানে মারাদোনাকে আমি কুর্ণিশ করতে পারি। তাকে প্রণাম করে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতে পারি। কিন্তু ভালবাসতে পারি শুধু ব্রাজিলকেই। আমার অক্ষমতা ক্ষমা করবেন আশাকরি।
আলোচনার খাতিরে ধরে নিচ্ছি, যদি ব্রাজিলের স্বপ্নের দিন শেষ। কিন্তু তাতেও অন্যান্য দলের কোন ফায়দা হচ্ছে না। একটা মহীরুহ যদি উপড়ে যায়, সেইসঙ্গে একটা গোটা ইকোসিস্টেম ধ্বংস হয়ে যায়। সেই জেতা কখনই আনন্দের হতে পারে না। বরং, লড়াই করে জেতার স্বাদই আলাদা।
আরমাডিলো-ফুলেকা আর ব্রাজিলের ফুটবল এক সাথে কাব্যিক পরিণতি দিচ্ছে এই বিশ্বকাপের খেলায়। এই অসহায়তা কাউকেই আনন্দ দিতে পারে না বোধহয়। হয়তো আর্জেন্টিনা জিতবে, কিম্বা জার্মানি, অথবা নেদারল্যান্ড। যেই জিতুক সেই দেশকে অনেক দায়িত্ব নিতে হবে। যদি হয় হোক আরেক নতুন অধ্যায়ের সূচনা, ক্ষতি নেই। তাকেও সসম্মানে স্বাগত জানাই।
---------------------------------------------------------------
আর যারা গতবার স্পেনকে সাপোর্ট করেছিলেন, এবার জার্মানিকে করছেন, কিম্বা ২০০৬এ ফ্রান্সকে করেছিলেন এবার অন্য কাউকে করছেন, কিম্বা ২০০২তে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করেছেন এবার হয়তো নেদারল্যান্ডকে করছেন তাঁরা হয়তো ফুটবলের অনেক কিছুই জানেন যা আমার মতো সাধারণ মানুষ জানেই না। কিন্তু তাঁদেরকেও আমি ক্ষমা করে দিলাম, ব্রাজিলের লজ্জাজনক পরাজয়ে নখ বাজাচ্ছেন আর গোটা ফেসবুক দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন "তোর ব্রাজিল কি করলো রে" বলে... বেচারারা এতো কিছু জানলো, কিন্তু ভালবাসতে জানলো নে এখনো...